হেল কমাণ্ডো – ১৪

১৪.

ফ্রগম্যান ট্রেনিং। বাংলায় এটাকে বলা হয় ডুবুরী প্রশিক্ষণ । এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ট্রেনিংগুলোর অন্যতম। একজন কমাণ্ডো ফ্রগম্যানকে অত্যন্ত দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে সাগরের তলায় নানারকম বিপজ্জনক কাজ করতে হয়। যেমন, কোন জাহাজের তলায় লিমপেট মাইন লাগানো, কোন ড্যাম বা ব্রিজের পিলারের গোড়ায় এক্সপ্লোসিভ সেট করা, শত্রু এলাকায় প্লেন থেকে প্যারাশুটে করে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দেয়া, পানির তলায় যে কোন রকম অনুসন্ধানের কাজ করা, যে-কোন রকম বিস্ফোরণ ঘটানো ইত্যাদি।

নভেম্বর। হেডকোয়ার্টার থেকে এস,এস,জি, অফিসার্স অ্যাডভান্সড ফ্রগম্যান কোর্সের জন্য তিনজন অফিসারের নামের তালিকা প্রকাশ করা হলো। ক্যাপ্টেন জানজুয়া, ক্যাপ্টেন জিয়া ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার। ওদের নির্দেশ দেয়া হলো মঙলা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে মুসা কোম্পানীতে যোগদানের জন্য। MUSA কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়–মেরিন আণ্ডার ওয়াটার সারফেস এয়ারবোর্ন। অর্থাৎ মুসা কোম্পানীর একজন সৈনিককে পানির ওপরে, নিচে, মাটিতে ও শূন্যে যে-কোন ধরনের কাজ করার জন্যে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুদক্ষ হতে হবে।

মঙলা ক্যান্টনমেন্ট মঙলা ড্যাম তৈরির সময় আমেরিকানরা বানিয়েছিল। তখন এটি আমেরিকানদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। অত্যাধুনিক কায়দায় নির্মিত ক্যান্টনমেন্টটি। আমেরিকানরা ড্যাম ও পাওয়ার হাউজ তৈরি করে ফেরত যাবার পর পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। এই ক্যান্টনমেন্টে ব্যাচেলরস কোয়ার্টার ও ম্যারিডদের জন্য চার-পাঁচ বেডের অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। প্রতিটি বাড়ি অত্যন্ত দামী আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। রান্নাঘরগুলোয় রয়েছে ওভেন, ফ্রীজ, ডিস-ওয়াশার, ওয়াটার বেসিন, গ্যাস ইত্যাদি। বাথরুমগুলোতে আছে গরম পানির গীশার ও কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন। প্রতিটি ঘরে ফ্লোরেসেন্ট আলোর ব্যবস্থা ও দামী দামী বিদেশী অয়েল পেন্টিং। পুরো বাড়ি এয়ারকণ্ডিশনড। পুরু ও কোমল কার্পেটে মোড়া ঘরগুলোর মেঝে । প্রথমদিন, জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার মঙলা ক্যান্টনমেন্টের অত্যাধুনিক ক্লাব, সিনেমা হল, মার্কেট, বোলিং অ্যালে প্রভৃতি ঘুরে ঘুরে দেখল। বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিল সুইমিংপুলের উষ্ণ পানিতে।

দুদিন আরামে অতিবাহিত হয়েছে। তৃতীয় দিন। তখনও ভোরের অন্ধকার কাটেনি। ওরা তিনজন নির্দেশমত সুইমিং কস্টিউম পরে খালি গায়ে, খালি পায়ে রূম থেকে বেরিয়ে এল। মঙলা লেকের পাড় পাথরময়। উঁচু নিচু। শুরু হলো দৌড়। চারদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। কনকনে শীত। নগ্ন পায়ে পাথুরে পথে ওরা প্রায় আট মাইল দৌড়াল। চোখা চোখা পাথরের আঘাতে ওদের প্রত্যেকের পায়ের তালুতে রক্ত জমে নীল হয়ে গেল। দৌড়ের পর শুরু হলো ক্যালিসথেনিক পিটি। এটা অত্যন্ত কঠিন পিটি বলে পৃথিবী খ্যাত। পৌনে এক ঘণ্টা ধরে চলল ক্যালিসথেনিকস।

পৌনে আটটায় শুরু হলো থিওরিটিক্যাল ক্লাস। একজন জেসিও ক্লাস নিচ্ছে। পানির তলার জগতের ওপর লেকচার দিচ্ছে জেসিও। সর্দি লাগা অবস্থায় কোন ফ্রগম্যানের পানির নিচে যাওয়া। উচিত নয়। কারণ এ অবস্থায় কপালে সাইনাস বন্ধ থাকে। পানির তলদেশে একজন ফ্রগম্যানের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এই প্রচণ্ড পানির চাপে ফ্রগম্যানের সাইনাস ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সাইনাস ফেটে রক্ত বেরুলে হাঙ্গরের মারাত্মক আক্রমণের সম্মুখীন হতে পারে ফ্রগম্যান। একই কারণে শরীরে কোন ক্ষত নিয়েও পানির নিচে যাওয়া নিষেধ।

পানির নিচে কোন কাজ তাড়াহুড়ো করে করা উচিত নয়। বিশেষ করে দ্রুত ওপরে উঠে আসাটা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। নিচে পানির অধিক চাপকে মোকাবেলা করার জন্য অক্সিজেন ট্যাঙ্ক থেকে সমান অনুপাতের প্রেশারাইজড বাতাস শরীরে প্রবেশ করে। তাড়াহুড়ো করে ওপরে উঠলে হঠাৎ করে পানির চাপ কমে যায়। ফলে শরীরের ভিতর প্রেশারাইজড় (ঘনীভূত) বাতাস পাতলা হয়ে দ্রুত আয়তনে বাড়তে থাকে। এই বাতাসের চাপ বেড়ে যাওয়াটা সাংঘাতিক তীব্র হয়। ঘন ঘন শ্বাস ফেলেও ফুসফুস খালি করা যায় না। পরিণামে বাতাসের চাপে লাং ফেটে যায়। এই বিপদের নাম এয়ারএমবোলিজম বা লাং বাস্ট।

দ্রুত ওপরে ওঠার আরও একটা বিপদ আছে। পানির নিচে অক্সিজেন ট্যাংক থেকে যে প্রেশারাইজড বাতাস ফ্রগম্যান নেয়, তার তিন চতুর্থাংশ নাইট্রোজেন। এই নাইট্রোজেন ফুসফুস থেকে সরাসরি রক্তে মেশে। রক্তের সঙ্গে একাকার হতে নাইট্রোজেনের কিছুটা সময় লাগে। দ্রুত ওপরে উঠলে নাইট্রোজেনের যে অংশটা রক্তের সঙ্গে মিশতে পারে না, বাইরে পানির চাপ কমে আসায় সেটা রক্তের ভিতর বুদুদের সৃষ্টি করে। ফ্রগম্যান যতই দ্রুত ওপরে উঠতে থাকে বুদ্বুদের আয়তন রক্তের ভিতর ততই বাড়তে থাকে। ফলে বুদ্বুদগুলো শরীরের প্রতিটি সংযোগস্থলে আটকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রগম্যানের শরীরের প্রতিটি সংযোগস্থল বিকৃত হয়ে যায়। এতে একজন ফ্রগম্যান তৎক্ষণাৎ মারা যায় না। তবে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে। এর কোন ডাক্তারী চিকিৎসা নেই। এই বিপদের নাম বে।

বেণ্ডে আক্রান্ত ফ্রগম্যানকে পানির নিচে পূর্বের গভীরতায় নিয়ে যেতে হয়। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে পরিমিত পানির চাপে রক্তের ভিতর নাইট্রোজেনের বুদ্বুদগুলো পূর্বের স্বাভাবিক, অবস্থায় ফিরে আসে। তারপর ফ্রগম্যানকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠিয়ে আনতে হয়। এয়ার এমবোলিজম বা বেণ্ড থেকে বাঁচতে হলে একজন ফ্রগম্যানকে একটা নির্দিষ্ট গতিতে ওপরে উঠতে হবে। তা হলো, নিশ্বাস ছাড়ার সময় পানিতে যে বুদ্বুদ সৃষ্টি হয় সেই বুদ্বুদের ওপরে উঠে আসার গতির সঙ্গে ফ্রগম্যানকে ওপরে উঠে আসতে হবে। প্রতি তিরিশ ফুট অন্তর অন্তর ফ্রগম্যান কয়েক মিনিটের জন্য স্থির হয়ে বিশ্রাম নেবে। পানির নিচের জগতে মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা। সেজন্য পানির নিচে ফ্রগম্যান একা নয়- জোড়ায় জোড়ায় যাবে।

গ্যাস পয়জনিং। এটা পানির নিচে ফ্রগম্যানের জন্য মারাত্মক বিপদ বয়ে আনতে পারে। গ্যাস পয়জনিংয়ে আক্রান্ত ফ্রগম্যানের মৃত্যুর সম্ভাবনা শতকরা একশো ভাগ। কার্বন মনো অক্সাইড পয়জনিং, কার্বন ডাই অক্সাইড পয়জনিং, অক্সিজেন পয়জনিং এবং নাইট্রোজেন নারকোসিস-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেজন্য গ্যাস পয়জনিংয়ের ব্যাপারে ফ্রগম্যানকে সাংঘাতিক সতর্ক থাকতে হয়। গ্যাস পয়জনিং থেকে বাঁচতে হলে ফ্রগম্যানকে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত তাল মিলিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে। একে বলে পেণ্ডুলাম ব্রিদিং।

এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর জলজ প্রাণীর আক্রমণ। সাগরের নিচে মোরে-ঈল ভয়ঙ্করতম প্রাণী। এই প্রাণী বারো থেকে তেরো ফুট পর্যন্ত লম্বা। বিশাল আকৃতির। এই হিংস্র মাংসাশী জলজ প্রাণীর ধারাল দাঁতের আঘাতে নিমেষেই একজন ফ্রগম্যান টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। এছাড়া আছে শার্ক বা হাঙর। এগুলো বিভিন্ন জাতের হয়। কোন কোনটার আকৃতি বিশাল। এদের চোয়ালের দুপাশে তীক্ষ্ণ ধারাল দাঁত রয়েছে। রক্তের গন্ধ এদেরকে উন্মাদ করে তোলে। শার্ক অতীব হিংস্র এবং মাংসাশী। ব্যারাকুডার প্রকৃতিও প্রায় শার্কের মত। ব্লু বটল এবং পোর্টগীজ ম্যান অভ ওয়ার একজাতীয় বিষাক্ত মাছ। এগুলো দৈর্ঘ্যে প্রায় ইঞ্চি ছয়েক হয়। অত্যন্ত ভয়ানক এদের বিষ। এই বিষ আক্রান্ত ফ্রগম্যানকে নিমেষেই মৃত্যু-যন্ত্রণা এনে দেয়। জেলী ফিশ এক ধরনের পর্দার মত। পানির ওপর ভেসে বেড়ায়। দেখে এদের জীবন্ত বলে মনে হয় না। এগুলো শরীরের উন্মুক্ত জায়গায় আঠার মত লেগে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে সৃষ্টি হয় তীব্র যন্ত্রণা।

সাগরের তলদেশে রঙিন গাছপালা, ফুল প্রভৃতি দেখতে পাওয়া যায়। সাবধান! এগুলো যেন কোন ফ্রগম্যান স্পর্শ না করে। কারণ এগুলোর অধিকাংশই জীবন্ত প্রবাল কীটের তৈরি। কোটা আসল গাছপালা আর কোটা প্রবাল কীটের তৈরি কৃত্রিম গাছপালা-তা চেনা মুশকিল। প্রবাল কীটের তৈরি কোন রঙিন ফুল বা গাছ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ লক্ষ কীট নিমেষেই হাতে জড়িয়ে যায়। মাংসাশী এই কীটগুলো মুহূর্তের মধ্যেই আক্রান্ত স্থানের হাড় বের করে ফেলে।

শত্রুপক্ষ থেকেও পানির নিচে বিপদ আসতে পারে। পানির তলায় বিস্ফোরণের সময় ফ্রগম্যানকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এক্সপ্লোশনের ফলে পানির নিচে একটা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে চাপের সৃষ্টি হয়। এই চাপের আওতায় পড়লে ফ্রগম্যানের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। প্রতি এক পাউণ্ড টি.এন.টি. এক্সপ্লোশনে ফ্রগম্যানকে এক হাজার গজ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে। সেদিনের ক্লাস শেষ হলো।

পরদিন। ট্যাকটিক্যাল সুইমিং ট্রেনিং শুরু হলো। সাঁতারের পূর্বে জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ারকে সতর্ক করে দেয়া হলো। পানিতে নামা ও ওঠার সময় যেন কোন প্রকার শব্দ না হয়। শব্দ হওয়া শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। ওদের পরনে সুইমিং কস্টিউম। গায়ে লাইফ জ্যাকেট। কোনরকম ইমারজেন্সী হলে জ্যাকেটের সঙ্গে লাগানো কর্ড টান দিলে মুহূর্তে জ্যাকেটটি বাতাসে ফুলে ওঠে। তাছাড়া জ্যাকেট থেকে বেরিয়ে থাকা একটা টিউব দিয়েও বাতাস ভরা যায়। ওদের সঙ্গে রয়েছে হাবিলদার ইট্রাক্টর রমজান। নিষ্ঠুর প্রকৃতির রমজানের বিশাল পেশীবহুল শরীর। ভয় কাকে বলে জানে না। প্রথম দিন ওরা মঙলা লেকের চকচকে পানিতে বেলা দশটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত সাঁতার কাটল।

বিকেল চারটায় শুরু হলো প্যাডেলিং ক্লাস। ওদের তিনজনকে একটা রাবারের ডিঙি নৌকা দিয়ে নির্দেশ দেয়া হলো, কম্পাসের সাহায্যে দিক নির্ণয় করে মাইল পাঁচেক দূরে একটা জায়গায় গিয়ে, ফিরে আসতে হবে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর ওদের প্যাডেলিং ক্লাস শেষ হলো। এরপর সেদিনের মত ছুটি।

আবার শুরু হলো থিওরিটিক্যাল ক্লাস। আজকের আলোচ্য বিষয় ডাইভিং। SCUBA (স্কুবা) সেট সম্পর্কে প্রথমে বলা হচ্ছে ওদের। স্কুবা অর্থ সেলফ কনটেইন আণ্ডার ওয়াটার ব্রিদিং অ্যাপারেটাস। একটি আমেরিকান কোম্পানী স্কুবা সেটটির প্রস্তুতকারক। মলিবডেনাম নামক শক্ত ধাতুতে প্রস্তুত প্রতি সিলিণ্ডারের সঙ্গে লাগানো রয়েছে একটি ডিমাণ্ড ভালভ, ও একটি গোলাকৃতি হোস পাইপ। প্রেশারাইজড বাতাস সিলিণ্ডারে ভরা হয়। প্রয়োজনীয় বাতাস ভরা হলো কিনা সেটা মিটার দিয়ে চেক আপ করতে হয়। একটা সরু তারের মত রড সিলিণ্ডারের মাথা থেকে সংযুক্ত হয়ে সিলিণ্ডারের বাইরের দিকে, তলায় গিয়েছে। ডাইভার (ফ্রগম্যান) বেখেয়ালী হওয়ায় হঠাৎ যদি টের পায় ট্যাংক বাতাসশূন্য হয়েছে, তখন সরু রডটা নিচের দিকে টান দিলে ট্যাংকের রিজার্ভড বাতাস ব্যবহার করা যায়। রিজার্ভড বাতাস ব্যবহারের সময়সীমা মাত্র পাঁচ মিনিট। সিলিণ্ডারের মাথায় একটা ডিমাণ্ড ভাল্ভ লাগানো থাকে। এই ডিমাণ্ড ভালভের কাজ ডাইভার পানির যত গভীরে যাবে, পানির চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাল্ভ ট্যাংক থেকে আনুপাতিক হারে প্রেশারাইজড বাতাস সাপ্লাই করবে। ডাইভার পানির যত নিচে যায়, চারদিক থেকে পানির চাপও ততই বাড়তে থাকে। সেই চাপকে মোকাবেলার জন্য ট্যাংক থেকে এই বাতাস সাপ্লাই করা হয়।

ডিমাণ্ড ভালভ থেকে একটি গোলাকৃতি হোস পাইপ বেরিয়ে কানের দুই পাশ দিয়ে মুখের সামনে মাউথ পীসে সংযুক্ত হয়েছে। এই পাইপের একটি টিউব দিয়ে ডাইভারকে ট্যাংক থেকে বাতাস নিতে হয়। অপর টিউব দিয়ে ব্যবহৃত বাতাস বুদ্বুদ আকারে বেরিয়ে যায়। এই ধরনের স্কুবা সেট ট্যাকটিক্যাল কাজে ব্যবহার করা যায় না। কারণ টিউব থেকে বেরিয়ে যাওয়া বুদ্বুদ ডাইভারের অবস্থানকে শক্রর কাছে ফাঁস করে দেয়। সেজন্য অপারেশনের সময় ক্লোজ সার্কিটসেট ব্যবহার করতে হয় ডাইভারকে। এই ধরনের স্কুবা সেটে হোস পাইপে শ্বাস ছাড়ার পর ব্যবহৃত বাতাস একটা কনটেইনারের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই কনটেইনারে বাতাস পরিশোধনকারী কেমিক্যাল থাকে। পরিশোধিত বাতাস পুনরায় এয়ার ট্যাংকে ফিরে যায়। ফলে কোন বুদ্বুদের সৃষ্টি হয়

এই স্কুবা সেটের ব্যবহার ঠিকমত জানা না থাকলে ডাইভার মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হবে। ক্লান্ত বা উত্তেজিত অবস্থায় ডাইভার যদি ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, তাহলে ব্যবহৃত বাতাস কেমিক্যাল কনটেইনারে সম্পূর্ণরূপে পরিশোধিত না হয়েই পুনরায় এয়ার ট্যাংকে ফিরে যায়। কিছুক্ষণ এই অবস্থায় চললে ট্যাংক অপরিশোধিত বাতাসে পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে পরিশোধিত বাতাসের অভাবে ডাইভার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

এছাড়াও, অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য গ্যাস পয়জনিং ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সমস্ত দুর্ঘটনা এড়াতে হলে ডাইভারকে পানির নিচে উত্তেজিত বা ক্লান্ত হওয়া চলবে না। তাকে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বা পেণ্ডুলাম ব্রিদিং চালাতে হবে।

এরপর শুরু হলো রাবার সুটের ওপর আলোচনা। পাতলা মজবুত রাবারের তৈরি এই সুটের বুকের সামনে একটা বড় রাবারের চোঙ আছে। এই চোঙের ভেতর দিয়ে শরীর গলিয়ে ডাইভার বা ফ্রগম্যানকে রাবার সুটে প্রবেশ করতে হয়। রাবার সুট পরিহিত অবস্থায় ফ্রগম্যানের সমস্ত শরীরের মধ্যে মুখমল ও হাতের কব্জি থেকে অগ্রভাগ শুধু অনাবৃত থাকে। বুকের সামনে রাবারের চোঙ ভালভাবে শক্ত করে রাবারের ব্যাণ্ড দিয়ে বাঁধতে হয়। রাবার সুটের ভেতর সামান্য বাতাস থাকলেও ফ্রগম্যান সহজে পানির নিচে যেতে পারে না। একটা বিশেষ কৌশলে সুটের ভেতর থেকে সামান্যতম বাতাসও বের করে দিতে হয়। কৌশলটা হলো, রাবার সুটের থুতনির কাছের অংশটা টেনে নিয়ে শুধুমাত্র মুখটা ভেতরে ঢুকিয়ে শ্বাস নিতে হবে। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে বাইরে। এই প্রক্রিয়ায় রাবার সুট সম্পূর্ণরূপে বাতাসশূন্য হয়ে গায়ের সঙ্গে চেপে বসে।

পানির নিচে যে-কোন গভীরতায় সহজেই যে-কোন পজিশনে অথবা যে-কোন অবস্থায় থাকার জন্য একজন ফ্রগম্যানের বয়ানসি (BOUYANCY) বা, ভেসে থাকার ক্ষমতাশূন্য হতে হবে। একে বলা হয়, জিরো বয়ানসি। সেজন্য ডাইভিংয়ের সময় প্রত্যেক ফ্রগম্যানের বয়ানসি পরীক্ষা করা হয়। যাদের বয়ানসি পজেটিভ অর্থাৎ বুক ভরা শ্বাস নেয়া অবস্থায় পানিতে ভাসে, তাদের রাবার সুটের ওপরে কোমরে একটা ওয়েট বেল্ট পরে নিতে হয়। বয়ানসি জিরো না হওয়া পর্যন্ত একটার পর একটা ওয়েট আটকে নিতে হয় বেল্টে। আর নেগেটিভ বয়ানসির বেলায় ওয়েট বেল্ট তো নয়ই, বরং তাকে খানিকটা বাতাস পুরে নিতে হবে, রাবার সুটের ভিতর, যতক্ষণ না বয়ানসি জিরো হয়।

এরপর এল ফিন, ডেপথ গেজ, আণ্ডার-ওয়াটার ক্যামেরা ও কম্পাস। পানির নিচে দ্রুত চলাচলের জন্য ফ্রগম্যান পায়ে ফিন ব্যবহার করে। ফিন পরা অবস্থায় ফ্রগম্যান হাত ব্যবহার ছাড়াই দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে। ডেপথ গেজ অনেকটা ঘড়ির মত দেখতে। এটা একটা বেল্টের সাহায্যে ফ্রগম্যানের হাতের কব্জিতে আটকে থাকে। ডেপথ গেজের সাহায্যে ফ্রগম্যান পানির নিচে নিজের অবস্থানের গভীরতা সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য পায়। আণ্ডার ওয়াটার কম্পাসের সাহায্যে পানির নিচে সঠিক দিক নির্ণয় করে চলা যায়। আণ্ডারওয়াটার ক্যামেরার সাহায্যে পানির নিচে যে

কোন বস্তুর পরিষ্কার ছবি তোলা যায়। … এরপর এল ফেস মাস্ক ও এয়ার কমপ্রেশার বা জেনারেটর। ফেসমাস্ক রাবার জাতীয় জিনিসের তৈরি। এটার সামনের দিকটা স্বচ্ছ কাঁচের মত। ইলাস্টিক জাতীয় ব্যাণ্ড দ্বারা এটা ভোলা মুখের সঙ্গে আটকে থাকে। যদি ফেস মাস্কের ভেতর পানি ঢুকে দৃষ্টিশক্তির কোন বাধা সৃষ্টি করে, তখন নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ব্লো করতে হয়। নিঃশ্বাস ব্লো করার সঙ্গে সঙ্গে ফেস মাস্কের স্বচ্ছ কাঁচ পরিষ্কার হয়ে যায়। জেনারেটর বা এয়ার কমপ্রেশারের সাহায্যে ধাতব সিলিণ্ডারগুলোতে কমপ্রেশড এয়ার ভরা হয়। কমপ্রেশারের সাহায্যে প্রেশারাইজড এয়ার প্রায় তিন হাজার পি.এস.আই. (PS) পর্যন্ত সিলিণ্ডারে ভরা যায়। বাতাস ভর্তি অবস্থায় এক একটা সিলিণ্ডারের ওজন হয় প্রায় ঊনচল্লিশ পাউণ্ড।

পানির নিচে চাপ বা ওয়াটার প্রেশার প্রতি তেত্রিশ ফুট গভীরতায় ওয়ান অ্যাটমোসফিয়ারিক প্রেশার বা সংক্ষেপে ওয়ান অ্যাটমোস (সী লেভেলে যা প্রতি বর্গইঞ্চিতে ১৪.৭ পাউণ্ড)। তেত্রিশ ফুট গভীরতায় একজন ফ্রগম্যানের শরীরের ওপর পানির চাপের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ২৯.৪ পাউণ্ড। এভাবে প্রতি তেত্রিশ ফুট গভীরতায় শরীরের প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১৪.৭ পাউণ্ড করে চাপ বৃদ্ধি পায়। অ্যাডভান্সড ফ্রগম্যান ট্রেনিংয়ে প্রতি ফ্রগম্যানকে ১৮০ (একশত আশি) ফুট গভীরতায় যেতে হবে। এই গভীরতায় একজন ফ্রগম্যানের শরীরের ওপর শত শত টন পানির চাপ পড়বে।

মজার ব্যাপার হলো, এই প্রচণ্ড চাপ আসে চারদিক থেকে এবং এই প্রেশারকে মোকাবেলা করে একমাত্র শরীরের মধ্যকার প্রেশারাইজড বাতাস, যা এয়ার সিলিণ্ডার থেকে ডিমাণ্ড ভাভের সাহায্যে গভীরতা অনুযায়ী ঘনীভূত হয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে যায়। পানির গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটার প্রেশার যেমন, বাড়ে, ঠিক তেমনি আনুপাতিক হারে প্রেশারাইজড বাতাসও নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভিতরের চাপ বৃদ্ধি করে। ফলে দুদিকে চাপ সমান হওয়ার জন্য ফ্রগম্যানের পানির তলায় চলাফেরা করতে কোন অসুবিধা হয় না। এই উভয় দিকের চাপের যদি কোন তারতম্য ঘটে তাহলে ফ্রগম্যানের বিপদাশঙ্কা করা হয়।

.

মঙলা লেক। চকচকে রূপালি পানি। পানির নিচে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। লেকের তলদেশে অসংখ্য নুড়ি পাথর ও তুষারশুভ্র বালি। থিওরিটিক্যাল ক্লাস শেষে ওরা তিনজন ডাইভিং শুরু করল মঙলা লেকের তলদেশে। দশ থেকে বারো ফুট গভীরতা পর্যন্ত ওরা পৌঁছাল। লেকের তলদেশে যে-কোন বস্তুকে প্রকৃত আয়তনের তুলনায় অনেক বেশি বড় দেখায়। এই ব্যাপারটা যারা জানে না, তাদের নিক্ষিপ্ত সুচ ওরা অনায়াসেই লেকের তলদেশ থেকে তুলে এনে দিত। ব্যাপারটা ওদের কাছে সহজ হলেও যারা জানে না, তাদের কাছে সাংঘাতিক আশ্চর্যের ছিল। এইভাবে ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে চলল ডাইভিং, সাঁতার ও রাবার র‍্যাফট চালানোর অনুশীলন।

এই সময় ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলো। কারণ একজন ফ্রগম্যানকে হতে হবে যে কোন জলজ প্রাণীর মত। পানিতে তার চলাফেরা হবে স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ ও নিঃশব্দ। ছোটখাট যে ত্রুটিগুলো কাটানো মুশকিল–সে ধরনের ত্রুটির জন্য ওদেরকে পেতে হলে কঠিন শাস্তি। দুই হাতের কব্জিতে দুটো বড় বড় তোয়ালে বেঁধে ওদের বহুদূর পর্যন্ত ফ্রি-স্টাইলে সাঁতার কাটতে হলো। পিঠের ওপর ৭৮ পাউণ্ড ওজনের এয়ার সিলিণ্ডার নিয়েও সুইমিং করতে হলো এবং শাস্তি স্বরূপ ৩৬ মাইল রাবারের র‍্যাফটও চালাতে হলো। শাস্তির চোটে ওরা ধীরে ধীরে জলজ প্রাণীর মত আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *