হেল কমাণ্ডো – ১৩

১৩.

জুলাই মাস। একটা অনুশীলন চলছে। আনোয়ারসই ষোলোজন অফিসার আটক দুর্গের বাইরে। ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে শত্রুর হাতে তাড়া খাচ্ছে ওরা। কৌশলে ওরা শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে। বেশ কয়েকদিন হলো পেটে কিছু পড়েনি। ওদের দুর্বল শরীর, তার ওপর অমানুষিক পরিশ্রম। একদিন হাঁটল সারা রাত। শেষ রাতে ওরা নিরাপদে পৌঁছল আটক দুর্গের অভ্যন্তরে। বাকি রাতটুকু সকলে অফিসার্স মেসের চত্বরে কাটিয়ে দিল।

সকাল। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় সবাই প্রবেশ করল ডাইনিংয়ে। বিশাল ডাইনিং টেবিলে থরে থরে ব্রেকফাস্ট সাজানো। বেশ কয়েকদিন পর রাজকীয় আয়োজন দেখে ওদের জিভ গড়িয়ে পানি ঝরার উপক্রম। গোগ্রাসে খেতে শুরু করল ষোলোজন ক্ষুধার্ত ট্রেইনী কমাণ্ডো।

হঠাৎ ডাইনিংয়ের দরজায় সাব-মেশিনগান লোড করার আওয়াজে ওরা চমকে ফিরে তাকাল। সবেমাত্র কয়েক গ্রাস পেটে গিয়েছে। ফলে খিদেটা ভয়ানকভাবে চাগিয়ে উঠেছে। প্রত্যেক দরজায় শত্রু-হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান। লোডেড। শত্রুদের ভাবলেশহীন চেহারা, যেন পাষাণমূর্তি। ওদের স্থির দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা ঝিকমিক করছে।

কঠিন কণ্ঠে নির্দেশ এল, হ্যাণ্ডস আপ। কলজে হিম করা কণ্ঠস্বর। ট্রেইনীরা বুঝতে পারল, সিরিয়াস কোন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও ওদের মনে একটা খুঁতখুঁতে ভাব। এটা সিরিয়াস কোন কৌতুক নয়তো? শত্রুপক্ষ আবার নির্দেশ দিল, সবাই মেঝেতে বুক ডনের পজিশন নাও। পজিশন নিতে দুজন অফিসারের একটু বিলম্ব হওয়াতে পিঠে সাব-মেশিনগানের প্রচণ্ড গুতো খেয়ে ওরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

আনোয়ার মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেল। এটা কোন কৌতুক নয়। মারাত্মক কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে। কিন্তু কি সেটা, বোঝ যাচ্ছে না। চিন্তা করার তেমন কোন অবকাশও দিচ্ছে না শত্রুপক্ষ। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আদেশ মানতে কোনরকম ত্রুটি করাটা আপাতত উচিত হবে না। কৌশলে এদেরকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে হবে। নইলে নির্ঘাত প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন। তারপরও কি অবস্থায় নিস্তার মিলবে জানা নেই। সাব-মেশিনগানধারীরা ট্রেইনীদের পরনের সমস্ত পোশাক খুলে নিল। শুধু আণ্ডারওয়্যার রইল ওদের পরনে। তারপর প্রত্যেকের হাত-পা, চোখ এঁটে বাঁধল ওরা।

আনোয়ার এই অবস্থায় একজনকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কি? সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল, সুসরাল যায়েগা। অর্থাৎ শ্বশুর বাড়ি যাবে। ওদের পা দড়ি দিয়ে বাঁধলেও একটু ফাঁক রাখা হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে হাঁটা যায়। প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। হুকুম হলো উঠে দাঁড়াবার। এ অবস্থায় শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে উঠে দাঁড়ানো সহজ নয়। ট্রেইনী কমাণ্ডোরা উঠে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একটু বিলম্ব হওয়াতে শুরু হলো বৃষ্টির মত কিল, ঘুসি, লাথি। লাথির চোটে অনেকেই ককিয়ে উঠল। লাথি, ঘুসি খেতে খেতে কোনমতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল আনোয়ার। তারপর ওদের ডাইনিং থেকে ঠেলে বের করে নিয়ে আসা হলো বাইরে। এদিকে প্রচণ্ড এলোপাতাড়ি মার অবিরাম চলছে। আনোয়ার ঠোঁটের কোণে নোনা স্বাদ পেল। জিভ দিয়ে চেটে বুঝতে পারল, রক্ত গড়াচ্ছে। ঘুসি ও থাবড়ার চোটে চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে।

শুরু হলো নগ্নপায়ে পথ চলা। ওদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ওদের চলার পথে তীক্ষ্ণ কাঁটাঝোঁপ শুরু হলো। তীক্ষ্ণ কাটা পায়ের নরম তালুতে ফুটে ভিতরে ভেঙে যাচ্ছে। চারদিক ভরে গেল আর্তচিৎকারে। আনোয়ারের চোয়ালের মাংসপেশী কঠিন হয়ে উঠল। ওর মুখ দিয়ে কোন রকম বেদনার্ত ধ্বনি বেরুচ্ছে না। নীরবে সইছে সমস্ত ব্যথা। আর্তচিৎকারকারী অফিসারদের ঘুসি, লাথি ও বেতের বাড়ি উপরি পাওনা হিসেবে জুটছে। এক সময় শেষ হলো কাঁটাওয়ালা পথ। প্রত্যেকের পা ক্ষতবিক্ষত। আনোয়ারের মনে হলো, ওর পায়ের তলায় শত শত কাঁটা ফুটে ভেঙে রয়েছে।

মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ ওদের কানে ভেসে আসছে। জি.টি. রোডের পাশ ঘেঁষে চলেছে ওরা। আনোয়ার দৌড়ে পালানোর চিন্তা ছেড়ে দিল। এখন সমস্ত বাঁধন খুলে দিলেও দৌড়ে পালানোর উপায় নেই, পায়ের তালুতে ফুটে থাকা কাঁটাগুলো বের না করা পর্যন্ত। অতি কষ্টে হেঁটে চলেছে ওরা।

বহু বেসামরিক গাড়ি ওদের পাশে ব্রেক করে থেমে যাচ্ছে। ব্যাপার কি? আরোহীদের কৌতূহলী. প্রশ্ন। শত্রুপক্ষের কেউ কেউ জবাব দিচ্ছে, ফরেন স্পাইস। গাড়ির আরোহীরা চিৎকার করে বলছে, শালাদের পিটিয়ে মেরে ফেলো। দুই একজন অতি উৎসাহী আরোহী পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় কষে চপেটাঘাত আর লাথিও এনাম দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আনোয়ারের মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই। কারণ কমাণ্ডো জীবন ওকে সবরকম ঘটনা সহ্য করার জন্য তৈরি করে ফেলেছে।

ঢালু রাস্তা বেয়ে নামছে ওরা। আচমকা লাথির চোটে কেউ কেউ গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। আবার কেউ হোঁচট খেয়েও গড়াচ্ছে। আনোয়ার সাবধানের সঙ্গে নামছে ঢালু পথ বেয়ে। হঠাৎ পিঠে প্রচণ্ড বুটের লাথি। ছিটকে গড়িয়ে পড়ল সে। পাথুরে রাস্তা। অমসৃণ। ছোট বড় পাথরের ডগা বেরিয়ে আছে। তীক্ষ্ণ ডগার আঘাতে ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গার চামড়া চিরে গেল। গড়াতে গড়াতে একটা শক্ত পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেলো ওর ভারী শরীর।

অতিকষ্টে উঠে দাঁড়াল আনোয়ার। আবার শুরু হলো পথ চলা। কিছুক্ষণ চলার পর ওরা পৌঁছাল একটা হলরূমে। বিশাল আকৃতির হলরূম। একেকজন প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ল কঠিন মেঝের ওপর। আনোয়ার বুঝল এটা বেগম-কি-সরাই। সরাইয়ের চারদিকে শুরু হয়েছে বাবাগো, মাগো বিভিন্ন ধরনের কাতরানি। কারও কারও মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে চাপা গোঙানি। এ যেন এক নারকীয় পরিবেশ।

আনোয়ার পিছমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় ডান কাতে শুয়ে আছে। হঠাৎ একটা বুট পরিহিত ভারী পা পড়ল ওর গালের ওপর। ভারী বুটের চাপ ক্রমশই বাড়ছে। নিচে অমসৃণ পাথুরে মেঝে। গালের নরম মাংস থেঁতলে যাচ্ছে বুটের চাপে। তীব্র ঘষায় গালের চামড়া ছিঁড়ে গেল। বাম পাশে ফিরতেই চটচট করে উঠল গাল। ওর সারা গালে রক্ত। পাশ ফিরতেই শুরু হলো তীব্র জ্বলুনি।

বুট দিয়ে দলাই মলাই করাতে ওর প্রায় সারা মুখের চামড়া উঠে গেছে। দগদগে ক্ষতস্থানগুলো থেকে রক্ত ও কস বের হচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে। এবারে অচেনা বুটওয়ালা ওকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা মেরে উপুড় করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে নাকটা ঠুকে গেল মেঝেতে। থেঁতলে গেল নাকের নরম হাড়। প্রচণ্ড ব্যথা ও জ্বলুনি নীরবে সহ্য করতে না পেরে এই প্রথমবারের মত আনোয়ারের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল ইস্। তারপর নিশ্চুপ । কোনরকম নড়াচড়া নেই।

কিছুক্ষণ অমানুষিক অত্যাচারের পর ওকে শোয়ানো হলো। ওর মুখমণ্ডলের অংশটা প্রায় অবশ। হঠাৎ ও টের পেল, ওর মুখে তুলো দিয়ে কি যেন চেপে ধরা হচ্ছে। মুখের নরম ক্ষতস্থানগুলো জ্বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। টিংচার আয়োডিন! সারা শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। টিংচার আয়োডিনের সংস্পর্শে ক্ষতস্থানগুলোর জ্বালা লক্ষগুণ বেড়ে গেল নিমেষেই। অসহ্য। ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল আর্তচিৎকার, স্প ইট। পিঠের ওপর দ্রুত পড়ল, ভারী ওজনের লাথি। কেউ একজন বলে উঠল, ওহো এটার এখনও তেজ কমেনি।

শুরু হলো সজোরে লাথি দিয়ে গড়ানো। আনোয়ারের ভারী শরীরটা গড়িয়ে চলেছে। কখনও শরীরের নিচে তীক্ষ্ণ পাথর পড়ছে, কখনও কাঠির খোঁচা লাগছে, আবার কখনও কাঁটাঝোঁপের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শরীর। ওর শরীরের প্রতিটি বোন জয়েন্ট বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হলো। তবুও নিস্তার নেই। অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

বাইরের তাপমাত্রা একশো বাইশ ডিগ্রী ফারেনহাইট। আনোয়ারের শরীর দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে দরদর করে। পিপাসায় ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত। মুখের ভিতরটা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কাঁটাবিদ্ধ পায়ের তলায় তীব্র ব্যথা। গড়িয়ে চলা হঠাৎ করে বন্ধু হলো এক সময়।

তারপর ওর পা ধরে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলল বুটধারীদের একজন। পিঠের নিচে উত্তপ্ত বালি। বালি তো নয়, যেন গনগনে আগুন। পুড়ে গেল পিঠের চামড়া–আর ঘষা খেয়ে সেগুলো আরও দগদগে ঘায়ে পরিণত হতে লাগল। কিছুদূর টেনে হেঁচড়ে চলার পর ওকে ফেলে রাখা হলো বালির ওপর।

আনোয়ারের এখনও ক্ষীণ চৈতন্য আছে। আর সবার অবস্থা কেমন কে জানে। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবী থেকে বহুদূরের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আবার পৃথিবীটা সচল হয়ে উঠছে। পুনরায় হারিয়ে যাচ্ছে সে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো। সারা শরীর ঘিরে ক্লান্তি, অবসাদ। এখন শুধু চাই বিশ্রাম, অফুরন্ত বিশ্রাম। একসময় উত্তপ্ত বালির ওপর ক্লান্ত আনোয়ার ঘুমিয়ে পড়ল অসহায়ের মত।

হঠাৎ তন্দ্রার ভাবটা ছিন্ন হয়ে গেল ওর। ওরে বাবারে, ওরে মারে তীব্র আর্তচিৎকার। চিৎকারগুলো ওর কানে অস্পষ্ট। শ্রবণশক্তিও প্রায় অকেজো। ও শুধু ভাবছে, যন্ত্রণাকাতর দেহটা কখন চেতনাশূন্য হবে। দুই বগলের নিচে এবং আণ্ডারওয়্যারের তলে দপ করে জ্বলে উঠল। কে যেন গনগনে পাথরের কুচি ঢুকিয়ে দিয়েছে। এরপর অবিশ্বাস্য ভাবে বিশাল আকারের একটা পাথর চাপিয়ে দেয়া হলো মৃতবৎ শায়িত, আনোয়ারের বুকের ওপর। বাঁচার ক্ষীণ আশাটুকুও দূর হয়ে গেল। গরম পাথরের কুচি আণ্ডারওয়্যারের নিচে আটকে রয়েছে। ভিতরটা ধীরে ধীরে পুড়ছে। বগলের নিচের চামড়াও পুড়িয়ে দিচ্ছে উত্তপ্ত পাথর। বুকের ওপর বিশাল ভারী পাথরের জন্য শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাহায্যের বিন্দুমাত্র আশা নেই। মৃত্যু আসন্ন। অথচ ইচ্ছে করলেই এধরনের মৃত্যুকে এড়ানো যায়। আনোয়ারের মনটা হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠল। কিন্তু বড় দেরিতে। এখন সে অসহায়। পায়ের তালু কাঁটাবিদ্ধ। সারা শরীর পাথরের আঘাতে ও লাথির চোটে ক্ষতবিক্ষত। পাথরের কুচি শরীরের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে–নিচে উত্তপ্ত বালি। তার ওপর অসহ্য তাপমাত্রা–তৃষ্ণায় কণ্ঠতালু শুষ্ক।

শত্রুরা ঠাণ্ডা পানীয় পান করছে অদূরে। গ্লাসে ঠোকাঠুকি ও বরফ ভাঙার শব্দ শুনতে পেল আনোয়ার। কয়েকটা বরফের ছোট ছোট টুকরো ছিটকে পড়ল শরীরে। এগুলো ইচ্ছাকৃত তা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। তবুও মুখ হাঁ করে রইল আনোয়ার। যদি ছিটকে দুই একটা বরফের টুকরো মুখের ভিতর পড়ে। হাঁ করা মুখটা সত্যিই ভরে গেল; কিন্তু বরফে নয়। গনগনে বালিতে। প্রায় গলার নিচ পর্যন্ত পৌঁছে গেল বালি। বুকের ওপর ভারী পাথরের জন্য অতিকষ্টে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে ওর। মুখের ভিতর বালি দেয়ার জন্য নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল । দমবন্ধ করে অতিকষ্টে বালিগুলো মুখ থেকে ফেলে দিল সে। অবশিষ্টটুকু গিলে ফেলল। আবার শুরু হলো শ্বাসপ্রশ্বাস। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গেল।

বুটধারীদের একজন বলে উঠল, কে কে পানি খাবে? কেউ কোন উত্তর দিল না। আরেকজন বলল; সত্যি বলছি। আমরা ঠাট্টা করছি না। শুধু একটু হাঁ করো। ঠাণ্ডা পানি দিচ্ছি। সবাই নিশ্চুপ। মুখ বন্ধ করে আছে ওরা। কারণ হাঁ করলেই মুখে বালি

অথবা ওই জাতীয় কিছু দেয়া হবে।

আনোয়ারের কাছে একজন এসে ফিসফিস করে উঠল, পানি খাবে?

হ্যাঁ, দুর্বল কণ্ঠ আনোয়ারের।

তাহলে একটু হাঁ করো। কিন্তু সে মুখ খুলল না কিছুতেই। বরফগলা ঠাণ্ডা পানির গ্লাসের ছোঁয়া পেল গালে।

তোমাকে পুরো এক গ্লাস পানি দেব। শুধু একটু হাঁ করো।

তবুও মুখ খুলল না। গালে ঠাণ্ডা পানির পরশে ভিতরটা ছটফট করছে ওর। কিন্তু মুখ খুললেই পড়বে ঠাণ্ডা পানির পরিবর্তে গরম বালি। অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করল আনোয়ার।

মুখ যখন খুলবেই না, তবুও তোমাকে পানিটা দিয়ে যেতেই হবে। বলেই লোকটা ওর মুখের ওপর পানির গ্লাসটা উল্টে দিয়ে চলে গেল। ক্ষণিকের জন্য শীতল পানির পরশ দারুণ আরাম দিল। তারপর ক্ষতস্থানগুলো জ্বলে উঠল তীব্রভাবে। জিভ দিয়ে চেটে যতদূর পারা যায় পানির স্বাদ নিল আনোয়ার। এইভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা অতিবাহিত হলো।

ওর বুক থেকে পাথরটা সরে গেল হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো দুর্গের ভিতর । দুর্গের এক প্রান্তে সবাই ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছে। প্রত্যেকের শরীরে অমানুষিক অত্যাচারের চিহ্ন পরিস্ফুট। শত্রুরা লাঞ্চ করছে অদূরে বসে। গন্ধে বোঝা যাচ্ছে সুস্বাদু খাবার। গন্ধ দিয়ে ক্ষুধা বাড়িয়ে তুলতে চাইছে শত্রুরা। মাঝে মাঝে কৌতুক করে দুই একটা হাড্ডিও ছুঁড়ে মারছে ওরা ওদের দিকে।

শেষ হলো লাঞ্চ। হঠাৎ দুলে উঠল আনোয়ারের শরীর। শত শত বৃশ্চিক যেন কামড়ে দিল। কিন্তু মুহূর্তে ভুল ভাঙল ওর। অসংখ্য সুচবিদ্ধ একটা ব্রাশ দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে ওর শরীরে। চারদিকে ইস্, উহ্, আহ্ যন্ত্রণাকাতর ধ্বনি। ঘাড় থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত এবং দুই হাতের প্রতিটি ইঞ্চি সুচবিদ্ধ হলো। কাতরাতে কাতরাতে এক সময়ে আর সে শক্তিও রইল না। ইতোমধ্যে ওর সমস্ত অনুভূতিশক্তি প্রায় ফুরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় দফা সুচ ফোঁটানোর পর বন্ধ হলো সুচওয়ালা ব্রাশের আঘাত।

এবারে শুরু হলো জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে পোড়ানো। আনোয়ারের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরা হচ্ছে। তাজা মাংসের পোড়া গন্ধে চারদিকের বাতাস ভরপুর। ওর শরীর দুএকবার কেঁপে কেঁপে থেমে গিয়েছে। হঠাৎ শক খাওয়ার মত চমকে উঠল আনোয়ার। একটি জ্বলন্ত সিগারেট ধীরে ধীরে নাকের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ভিতরে। তীব্র কণ্ঠে অকথ্য গালি দিয়ে উঠল সে, ইউ মীন বাস্টার্ড। স্প- ইট। নাকের ভিতর জ্বলন্ত সিগারেট গলিয়ে দিতে দিতে অচেনা লোকটি বলে উঠল, সত্যি আমি একটা মীন বাস্টার্ড। তবে এই দাওয়াই তোমাকে নিতে নাকের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছল সিগারেট। জ্বলন্ত সিগারেটের ঘর্ষণে নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তক্ষরণে একসময় সিগারেটটি নিভে গেল। আনোয়ারের মনে অনিশ্চিত আতঙ্ক, না জানি এরপর আবার কি বিপদ আসে। সামনে কি ধরনের যন্ত্রণা-আল্লাহই জানেন।

নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। শুরু হলো আবার হাঁচড়েপাঁচড়ে চলা। ওদের ক্রমশই ওপরের দিকে উঠতে হচ্ছে। আনোয়ার আন্দাজ করল মেইন অফিসের দিকে চলেছে ওরা। মেইন অফিস প্রায় দুশো ফুট উঁচুতে। চড়াই অতিক্রম করে এই পথটুকু পৌঁছতে ওদের প্রায় একঘণ্টা সময় লেগে গেল।

ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেল, একটি লোহার গরাদ। কামরাটি আয়তনে বেশ বড়। একটাই মাত্র দরজা । কোন জানালা নেই। উঁচু দেয়াল-এর ওপরে ছোট ছোট কয়েকটি ভেন্টিলেটর। এই দেয়ালঘেরা কামরায় বন্দী করা হলো ট্রেইনী কমাণ্ডোদের। সেই সঙ্গে প্রত্যেকের চোখের বাঁধন খুলে দিল শত্রুপক্ষ। বাধন খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তীব্র আলো জ্বলছে বন্দীশালায়। আলোর দিকে চাইলে চোখ অন্ধ হওয়ার উপক্রম। কেউ ওপরের দিকে তাকাতে পারছে না। একমাত্র লোহার গরাদটিও বন্ধ হয়ে গেল ঘটাং করে। সবাই নির্বিকার। কারও দিকে তাকানোর উপায় নেই। ঠোঁট, নাক, মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, সমস্ত শরীর আঘাতে জর্জরিত। প্রত্যেকের মাথার চুলে বালি ও মাটি-রক্তের সঙ্গে চাপ ধরে আছে।

এভাবে নির্যাতন আর সহ্য করা যায় না। কিছু একটা করা উচিত। কিন্তু কি করা উচিত, এ সিদ্ধান্ত কেউ দিতে পারল না। বন্দীশালায় চাপাস্বরে আলোচনা চলছে। আনোয়ার ধীরে ধীরে বলল, আগে আমাদের দেখতে হবে ঘরটা মজবুত কেমন। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুরু হলো ঘর পরীক্ষার পালা। বড় বড় পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি দেয়ালগুলো উঁচু। দ্বিতীয় কোন দরজা নেই। নিরস্ত্র অবস্থায় দেয়াল ভেঙে পালানো কোনমতেই সম্ভব নয়। বাতিল হয়ে গেল দেয়াল ভেঙে পালানোর প্ল্যান।

সামনে লোহার গেটে সশস্ত্র সেন্ট্রি সর্বক্ষণ পাহারারত। এখন পালানোর একটাই মাত্র পথ। পরাস্ত করতে হবে সশস্ত্র শত্রুদের তারপর পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ওদের শরীরের যে অবস্থা, তাতে সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ঝুঁকির ব্যাপার। তবুও ট্রেইনীরা সিদ্ধান্ত নিল, সুযোগ এলেই ওদের কাবু করে পালাতে হবে। শেষে ওরা চোখ বন্ধ করে নেতিয়ে পড়ল বিশ্রামের কোলে। যাতে দুর্বল শরীর কিছুটা লড়াইয়ের উপযোগী হয়।

হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই–কর্কশ বাজনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল বন্দীশালা। ধাতব পাতের সংঘর্ষ, পাথরের ঘর্ষণ, রক্তহিম করা আর্তচিৎকার, হিসহিস, খলখল, হাঃ হাঃ হাঃ, হাসির আওয়াজ, পাগলের প্রলাপ, বিস্ফোরকের আওয়াজ প্রভৃতিতে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো ঘর। বন্দীশালার উঁচু ছাদে বিশাল আকৃতির চারটে লাউড স্পীকার। শক্ররা, কোথাও স্টেরিওগ্রাম অন্ করেছে। সেই শব্দ লাউড স্পীকারে ভেসে আসছে। ভীষণ অস্বস্তি শুরু হলো বন্দীদের মাঝে।

কানে আঙুল দিয়েও কেউ রেহাই পাচ্ছে না। একনাগাড়ে বেজে চলেছে বিশ্রী বাজনা। মুহূর্তের মধ্যেই সৃষ্টি হলো এক ভৌতিক পরিবেশ। বন্দীদের মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছে বৃহৎ আকারের চারটে লাউড স্পীকারের পচা বমি। ওদের মাথায় শুরু হলো অসহ্য যন্ত্রণা। কানের পাতলা পর্দা যে-কোন মুহূর্তে ফেটে যেতে পারে।

আনোয়ারসহ কয়েকজন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে বীভৎস অত্যাচার। কিন্তু সবাই সহ্য করতে পারল না। কয়েকজনের শরীরে শুরু হলো ভীতিকর খিচুনি। আনোয়ার দ্রুত গড়িয়ে অসুস্থদের কাছে গেল। ওদের কানের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কেমন বোধ করছ? কিন্তু কোন উত্তর দিল না অসুস্থরা। ভয়ানকভাবে পাথুরে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সারা শরীরে প্রচণ্ড খিচুনি। মুখ দিয়ে গোঙানির সঙ্গে লালা গড়াচ্ছে। যে-কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে। নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় আক্রান্ত বন্দীরা।

রাগে অন্ধ হয়ে গেল আনোয়ার। দৌড়ে গেল লোহার গরাদের কাছে। চিৎকার করে উঠল শক্রদের উদ্দেশে, আমরা যে-কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারি। তোমরা বন্ধ করো এই বিশ্রী বাজনা। প্রতিপক্ষের তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। একেবারে নিশ্চুপ। এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টা পার হলো। হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল লোহার গরাদ। ঘরের মাঝে প্রবেশ করল কয়েকজন যমদূত। ওদের হাতে লিকলিকে বেতের চাবুক। ওরা এদের পেটাতে শুরু করল বেধড়ক। চাবুক মারা শেষে ইবলিসগুলো দ্রুত বের হয়ে গেল বন্দীশালা ছেড়ে। গরাদও বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর লাউড স্পীকারের অত্যাচারও মিলিয়ে গেল। হলঘরে, নেমে এল প্রশান্তি। ওরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রাত কত হয়েছে বোঝা মুশকিল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ওদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পেটের নাড়িভুড়ি জ্বলে যাচ্ছে। ওদের ঢুলু ঢুলু চোখ। নিদ্রার ভাব থাকা সত্ত্বেও কেউ ঘুমাতে পারছে না। সবাই নির্জীবের মত পড়ে আছে মেঝের ওপর। কারও কোন সাড়া নেই।

আবার ঘটাং করে উঠল লোহার গরাদ। খুলে গেল দরজা। প্রবেশ করল একজন জালেম! দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন সশস্ত্র সেন্ট্রি। বন্দীরা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ইবলিসের হাতে পানির পাত্র, গ্লাস ও একঝুড়ি রুটি। ক্ষণিকের জন্য ওরা ভুলে গেল সমস্ত যন্ত্রণা। দুশমনটা, ওদের সবাইকে একটা লুচি আকারের শুকনো রুটি ও আধ গ্লাস করে পানি দিল খেতে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল রুটি ও পানির ওপর। নির্জীব শরীরে সামান্য কিছুটা শক্তি ফিরে এল ট্রেইনীদের।

ইবলিসটা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার বন্ধ হলো লোহার দরজা। এবং আবার শুরু হলো পৈশাচিক বাজনা। ওরা আবার হারিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রণার সাগরে। অসহ্য যন্ত্রণায় কয়েকজন পাগলের মত লম্পঝম্প শুরু করে দিল। মিনিট দশেক পর পুনরায় থেমে গেল শব্দত্রাস। বন্দীদের মাঝে আবারও নেমে এল প্রশান্তি। কিন্তু সবাই আতঙ্কিত হয়ে রইল, যে-কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে পৃথিবীর জঘন্যতম কর্কশ সুরলয়হীন বাজনার খিচুড়ি।

সময় যেন স্থির হয়ে গেছে ওদের জন্য। শম্বুকগতিতে গড়িয়ে চলেছে প্রহর। আনোয়ার ধীরে ধীরে মাথা তুলল মেঝে থেকে। সবার দিকে চাইল সে। ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আহমেদ জিয়া, ক্যাপ্টেন চিমা, ক্যাপ্টেন মালেক নূর ওর দিকে তাকিয়ে আছে করুণ দৃষ্টি মেলে। অন্যরা পড়ে রয়েছে স্থির হয়ে। আনোয়ার হেঁচড়ে এগিয়ে যেতে লাগল ওদের দিকে। সেই মুহূর্তে খুলে গেল লোহার গরাদ। প্রবেশ করল একদল অস্ত্রধারী। শুরু হলো এলোপাতাড়ি মার। মুহূর্তে বদলে গেল হলঘরের চেহারা। ওদের দেহ থেকে পাথুরে মেঝেতে রক্ত পড়ছে টপ টপ করে। ক্যাপ্টেন চিমা উহ্ মাগো বলে চিৎকার করে উঠল। চিমার বাম হাত বেকায়দা ভঙ্গিতে মুচড়ে ধরেছে এক ভয়ঙ্কর দুশমন। সারা বন্দীশালা জুড়ে আর্তচিৎকার। আনোয়ারের কপালটা বেপভাবে ফুলে আছে। ঠোঁটের কোণ চিরে রক্ত ঝরছে। ঘুসির চোটে বাম চোখ দিয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছে না ও। ফোলা মাংসের আড়ালে চোখটা ঢাকা পড়ে আছে। সারারাত ধরে চলল এই নারকীয় নির্যাতন।

পরদিন সকাল । ওদেরকে বের করে আনা হলো হলরুম থেকে। এবার শুরু হলো নতুন কায়দায় নির্যাতন। ক্যাপ্টেন আহমেদ জিয়াকে উল্টো করে ঝোলানো হলো। প্রচণ্ড ঝটকায় চিপের একগোছা চুল উঠে গেল জিয়ার। ওর কণ্ঠচিরে মরণ আর্তনাদ বেরুচ্ছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে একই ধরনের চিৎকার। ক্যাপ্টেন জানজুয়াকেও টাঙানো হলো উল্টো করে। এক বালতি পায়খানা ও প্রস্রাবের মধ্যে চুবানো হলো ওর মাথা। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল বেচারা।

আনোয়ার চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বিচিত্র কায়দায় নির্যাতন চলছে ওর ওপর। ভয়ানকভাবে হাঁপাচ্ছে সে। একজন শত্রু এগিয়ে গেল ওর দিকে। হাতে চকচকে ধারাল ব্লেড। ফস করে ব্লেড দিয়ে কয়েকটা পোচ দিল আনোয়ারের নিতম্বের ওপর। দুফাঁক হয়ে গেল নিতম্বের মাংস। প্রথমে সাদা, তারপর লাল হয়ে উঠল পোঁচ দেয়া অংশগুলো। সামান্য দুলে উঠল ওর শরীরটা। মুখটা হাঁ হয়ে আছে ওর। পানি-আনোয়ারের কণ্ঠস্বর। একজন শত্ৰু এগিয়ে এসে ওর মুখে প্রস্রাব করে দিল। ও প্রথমে বুঝতে পারল না–কি খাচ্ছে। পানি নাপ্রস্রাব? ভীষণ নোনতা ও বিস্বাদ বলে মনে হলো তরল পদার্থটাকে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল পদার্থটা কি, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। প্রায় সবটুকু তরল পদার্থ গলাধঃকরণ করেছে আনোয়ার। বাকিটুকু মুখ কাত করে ফেলে দিল।

উহ্-আবার চিৎকার। আনোয়ারের ক্ষতস্থানগুলোতে লবণ চেপে ধরা হচ্ছে। শরীরের প্রতিটি শিরা দপ দপ করছে অসহ্য যন্ত্রণায়। ও জড়ানো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, মেরে ফেলল আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিয়ো না। প্রতিটি ক্ষতস্থান লবণে পরিপূর্ণ। সদ্য জবাই করা মুরগির মত ছটফট করছে ওর দেহটা। ধীরে ধীরে শরীরটা নিথর হয়ে গেল আনোয়ারের; যেন প্রাণহীন, নিস্পন্দ।

ছোট একটি খাদ। থিকথিকে। বহুদিনের পুরানো পায়খানা, প্রস্রাব জমে রয়েছে। খাদটি দুর্গের একপ্রান্তে। শুধু পায়খানা, প্রস্রাবই নয়–দুর্গের যাবতীয় ময়লা ফেলা হয় এখানে। নোংরা ও দুর্গন্ধে ভরা। সবাইকে এলোপাতাড়িভাবে মারতে মারতে শত্রুরা নিয়ে চলল সেদিকে। তারপর বন্দীদের চোবানো হলো সেই নোংরা কাদার মধ্যে।

পুরো দিনটা ওদের কেটে গেল পায়খানা প্রস্রাব ভরা খাদের মধ্যে। বিকেলের দিকে ওরা এক অপ্রস্তুত অবস্থার সম্মুখীন হলো। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল তরুণী এসেছে, ঐতিহাসিক আটক দুর্গ পরিদর্শনে। যুবতীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দুর্গের চওড়া দেয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দুর্গ দেখছে। ভ্রমণরত একদল যুবতী খাদের পাশ ঘেঁষে দেয়ালের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। নিচে তাকিয়ে ওরা অস্ফুটস্বরে চিৎকার করে উঠল, হায় আল্লা, ইয়ে লোগো কো ইয়ে হালাত কিঁউ হ্যায়? ইয়ে লোগ কেয়া কালপ্রিট হ্যায়? চোর, ইয়া ডাকু? যুবতীদের সঙ্গে শত্রুপক্ষের একজন গাইড হিসেবে ছিল। সে ইংরেজিতে বলল, নো, দে আর ফরেন স্পাইস। বিদেশী গুপ্তচর। তৎক্ষণাৎ একজন যুবতী বলে উঠল, দেন, কিল দেম। হোয়াই ডোন্ট ইউ ডু সো?

গাইড আশ্বাস দিল; ওদেরকে মেরে ফেলা হবে। গাইডের কথায় যুবতীরা সন্তুষ্ট হলো। ওরা দেয়ালের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে আর আড়চোখে নিচে তাকাচ্ছে। নিচে ওদের পরনে আণ্ডারওয়্যার ছাড়া কিছুই নেই। যুবতীদের কৌতূহলী দৃষ্টির সম্মুখে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল ওরা। এক সময় যুবতীরা ওদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল। ক্রমেই সন্ধ্যার অন্ধকার ঘিরে ফেলল চারপাশ। ওদেরকে আবার নিয়ে যাওয়া হলো গতরাতের সেই বন্দীশালায়।

অবিরাম বেজে চলেছে সেই পৈশাচিক অর্কেস্ট্রা। বন্ধ হল ঘরের কঠিন পাথুরে দেয়ালে লাউড স্পীকারে কর্কশ চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বন্দীদের কয়েকজনের শরীরে আবার শুরু হলো ভীতিকর খিচুনি। সারারাতের মধ্যে ছিটেফোঁটা খাবারও ওদের কপালে জুটল না। এবং মাঝে মাঝেই শত্রুরা দমকা হাওয়ার মত হলে ঢুকছে, আর পিটাচ্ছে বেধড়ক। ওদের কাউকে আর মানুষ হিসেবে চেনার উপায় নেই। রক্তাক্ত শরীর-ছোটবড় ক্ষতে ভর্তি। পরনে শতচ্ছিন্ন আণ্ডারওয়্যার, নেই বললেই চলে। ওদের চেহারার দিকে চাইলে শরীর শিউরে ওঠে। দফায় দফায় বেতের লিকলিকে ছড়ি, ঘুসি, লাথি ও বেসুরো অর্কেস্ট্রার মধ্য দিয়ে রাত কেটে গেল বন্দীদের।

ভোর । পুব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। তার তীক্ষ্ণ রেখা দুর্গের মাথার ওপর। ওদেরকে বের করা হলো বন্দীশালা থেকে। তারপর ওদের একে অপরের থেকে আলাদা করা হলো। আনোয়ারকে ঢোকানো হলো ছোট্ট একটা সেলে। ওকে পিছমোড়া করে চিকন নাইলনের রশি দিয়ে দুহাতের কব্জির ঠিক সংযোগের স্থানে বাঁধল শত্রুরা। চিকন রশির অপর প্রান্ত দরজার চৌকাঠের একটা ফুটো দিয়ে বাইরে ঝুলছে।

বাঁধনটা পানি দিয়ে ভেজানো হলো। হাতের মাংস ভেদ করে রুশি ক্রমেই চেপে বসছে। সেইসাথে রশিতে শুরু হলো টান। আনোয়ারের দুহাত ওপরের দিকে উঠছে টানের সঙ্গে সঙ্গে। তীব্র ব্যথায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হাতের রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ। আঙুলগুলো নীলবর্ণ ধারণ করেছে। ওর শরীর ক্রমেই বাঁকা হচ্ছে সামনের দিকে। এক সময় দুপায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল সে। রশির টান বেড়েই চলেছে। হাত ও কাঁধের প্রতিটি শিরা-উপশিরা সহ্য সীমার শেষপ্রান্তে। যে-কোন মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে ওগুলো। তবু ও নির্বিকার। ওর সহ্যশক্তি এখনও পরাজয় বরণ করেনি।

আবার ভেজানো হলো বাঁধন। চেপে বসল নাইলনের রশি। যে-কোন মুহূর্তে এখন হাত দুটো কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। আনোয়ারের চেতনাশক্তি শূন্য হতে চলেছে। শুরু হলো চাপা গোঙানি। এক সময় গোঙানি বীভৎস আর্তনাদে রূপ নিল। রশির বাধন একটু ঢিল হলো। ওর গোঙানিও কমে এল একটু। আবার শক্ত হলো বাঁধন। আবার বাড়ল আর্তনাদ। এইভাবে চলল সারাদিন। সন্ধ্যার দিকে এই অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেল সে। বাঁধন খুলতেই কাটা কলাগাছের মত দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল, আনোয়ারের ভারী দেহটা। চেতনাশূন্য অবস্থায় ও পড়ে রইল মাটির ওপর। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর একজন বুটধারী ওকে টেনে নিয়ে চলল সামনের দিকে। একটা ঘরে পৌঁছে ওর চোখের বাঁধন খুলে দিল লোকটি। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে ঘরটা।

সারাদিন চোখবাঁধা অবস্থায় থাকার ফলে আলোর দিকে ভালভাবে তাকাতে পারছে না ও। ওকে একটা চেয়ার দেয়া হলো বসার জন্য। সামনের চেয়ারে সামরিক বাহিনীর পোশাক পরা একজন অফিসার বসে আছেন। তিনি আনোয়ারকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। নাম কি? র‍্যাংক কি? কোন ইউনিটের অফিসার? বাড়ি কোথায়? ইত্যকার প্রশ্ন। প্রশ্ন শেষে ওকে আবার নিয়ে যাওয়া হলো বন্দীশালায়।

ও শুয়ে আছে নিঃসাড়, নিস্পন্দ, যেন মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষারত। চারদিকে অখণ্ড নীরবতা। বাতাসে ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু শব্দ। গভীর রাতে হঠাৎ লোহার গরাদ খোলার আওয়াজ কানে ভেসে এল আনোয়ারের। একজন বুটধারী এগিয়ে এসে ওকে ফিসফিস করে বলল, পালাতে চাও?

হ্যাঁ। নির্জীব কণ্ঠে উত্তর দিল আনোয়ার।

তবে এসো আমার সঙ্গে। ও দ্রুত অনুসরণ করুল বুটধারীকে। সামনে একটা ভোলা মাঠ। বুটধারী বলল, দৌড় দাও, কুইক। ও প্রাণপণে দৌড়ানো শুরু করল সম্মুখের দিকে। মুক্তির আনন্দ ওর শরীরে সতেজ অনুভূতি এনে দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর সামনে পড়ল সিন্ধু। সিন্ধুর তীরে নরম বালির ওপর আছড়ে পড়ল ওর দেহ। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল সে।

সূর্য তার প্রখর তেজ ওর চোখেমুখে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এল আনোয়ারের। চোখ মেলে চাইতেই নজরে পড়ল সিন্ধু। পাশে একটা বিশাল পাথর। কোনমতে উঠে বসল সে বালির ওপর। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সিন্ধুর দিকে। আঁজলা ভরে পানি পান করল। হাত মুখ ভাল করে ধুয়ে ফিরে এল পাথরের কিনারায় । ভাল করে আশপাশটা দেখতেই জায়গাটা চিনতে পারল আনোয়ার। তারপর টলতে টলতে এগিয়ে চলল । আটক দুর্গে পৌঁছতেই ওকে জানানো হলো, ইন্টারোগেশন ট্রেনিং শেষ।

তোর ট্রেনিং-এর নিকুচি করি–বিড়বিড় করল আনোয়ার।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *