হেল কমাণ্ডো – ১১

১১.

আটক দুর্গ। শেরশাহের তৈরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ঠিক ওপরে মোঘল সম্রাট আকবর এই দুর্গ তৈরি করেন। দুৰ্গটার নির্মাণ কৌশল অপূর্ব। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের জন্য দুর্গটার অবস্থান বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। আটক দুর্গের চারপাশ ঘিরে কয়েক মাইল ফাঁকা জায়গা। দুর্গে অবস্থানকারী সৈন্যেরা সহজেই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে পারে। গভীর পাথুরে খাদ ঘিরে রেখেছে দুর্গের চারপাশ। পাথুরে খাদের কিনারা ঘেঁষে দুর্গের আকাশচুম্বি দুর্ভেদ্য দেয়াল। কোন কোন জায়গায় দেয়ালের উচ্চতা ১৩০ ফুট। দুর্গের সম্মুখের দেয়ালের ওপর দিয়ে দুটো ট্রাক অনায়াসে চলতে পারে। ফটকের নির্মাণশৈলীও অপূর্ব! প্রধান সড়ক সোজা দুর্গে প্রবেশ করেনি।

ইংরেজি এস অক্ষরের মত বাঁক ঘুরে প্রবেশ করেছে। যাতে শক্তিশালী পালোয়ানরা বড় বড় গাছের গুঁড়ি কাঁধে নিয়ে দৌড়ে দরজা ধাক্কা মেরে ভাঙতে না পারে। প্রধান ফটক বিশাল। পেটানো লোহা দিয়ে তৈরি ভীষণ মজবুত। কোন হাতি দিয়েও ফটক ভাঙার উপায় নেই। এছাড়া বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রয়েছে। বিশাল পাল্লার বাইরের দিকে অসংখ্য সঁচালো লোহার স্পাইক লাগানো। এছাড়াও রয়েছে, সম্মুখবর্তী দেয়ালের ওপরের অংশে নানা আকারের ছিদ্র। ছিদ্রগুলো দিয়ে সৈনিকরা ফটক আক্রমণকারী শত্রুদের ওপর গরম পানি, বোল্ডার প্রভৃতি নিক্ষেপ করতে পারে।

দুর্গের বাইরে একটা উঁচু কংক্রিটের প্ল্যাটফরম, যেখান থেকে দৃষ্টি যায় দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের দিকে। এক সময় প্ল্যাটফরমের ওপর একটা বিশাল আকৃতির কামান বসানো ছিল। কংক্রিটের দেয়ালের ওপর চেইন দিয়ে কামান আটকে রাখার জন্য লাগানো বিশাল লোহার বালাগুলো এখনও অটুট। এসত্ত্বেও দুর্গ ছেড়ে পালানোর জন্য একটা নিরাপদ গুপ্তপথ আছে। এই সুড়ঙ্গটির  দৈর্ঘ্য প্রায় এক মাইল। সিন্ধু ও কাবুল নদের সঙ্গমস্থলের তল দিয়ে চলে গেছে সুড়ঙ্গ পথটি। নদীর অপর পাড়ে সুড়ঙ্গ থেকে বেরুনোর মুখ। দুর্গের ভিতর রয়েছে বহু গোপন ও ভূগর্ভস্থ কক্ষ। মজবুত এই কক্ষগুলো এখনও অটুট। এইগুলো এখন টু কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের গোলা-বারুদ রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

দুর্গ থেকে প্রায় কোয়ার্টার মাইল দূরে বেগম-কি-সরাই। সরাই-এর সম্মুখ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সিন্ধু নদ। পাশ ঘেঁষে চলে গেছে জি.টি. রোড। জি.টি. রোডের খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে সামনে সিন্ধু-অববাহিকা। এই অববাহিকা অঞ্চলের এক মনোরম স্থানে বেগম-কি-সরাই বা রাণীর পান্থশালা। বেগম-কি-সরাই থেকে পিণ্ডিগামী জি.টি, রোড ধরে কয়েকশো গজ গেলে সামনে পড়ে একটা উঁচু টিলা। এই টিলার পাদদেশে রাণী ও তার সহচরীদের জলকেলি করার এক অভিনব স্থান।

সরাই থেকে খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে নিচে জি.টি. রোড। রোডের ধার ঘেঁষে আর একটি চড়াই প্রায় ৭০-৮০ ফুট ওপরে উঠে গেছে। এই ঢালের ওপরেই টু কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের অফিসার্স মেস। বেগম-কি-সরাই-এর দেয়াল ঘেরা মনোরম মাঠ টু কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের শরীরচর্চার জন্য ব্যবহৃত হয়।

অফিসার্স মেস থেকে শুরু হয়েছে মসৃণ পীচঢালা পথ। পথের একধারে ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার। এখান থেকে পীচঢালা পথ বাঁক ঘুরে গিয়েছে ম্যারিড অফিসার্স কোয়ার্টারের দিকে। এই এলাকাটা জুড়ে পাথুরে পাহাড়। চারদিকে খটখটে নিণ। বহু পরিশ্রম করে সযত্নে বেশ কিছু ফুলগাছ লাগানো হয়েছে মেস বিল্ডিং-এর আশপাশে এবং ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার-এর সামনে। অফিসার্স মেসের উঁচু পিলারের ওপরে রেলিং ঘেরা বিরাট পার্লার। এখানে বসে নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া কাবুল ও সিন্ধুর সঙ্গমস্থলের সুন্দর দৃশ্যাবলী উপভোগ করা যায়।

কামরায় পৌঁছেই আনোয়ার দেখল, ওর কামরা সাজানো গোছানো। এরমধ্যেই আর্দালিরা সবকিছু ঠিক করে ফেলেছে। কামরার এককোণে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে ফায়ারপ্লেসে। তিরিশ ফুট বাই পঁচিশ ফুট বিশাল আকৃতির কামরা। ড্রেসিং কাম স্টোর রূমও বিশাল-বিশ ফুট বাই পনেরো ফুট। সেই সঙ্গে প্রমাণ সাইজের বাথরূম-পনেরো ফুট বাই দশ ফুট। কামরার সামনে দশ ফুট চওড়া বারান্দা। বারান্দার নিচে ফুট তিনেক চওড়া ফুল গাছের কেয়ারি করা লন।

আনোয়ার ইউনিটে যোগদানের পর ওদের ইউনিটে কমাণ্ডিং অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন লে. কর্নেল সোলেমান খান এবং মেজর আবু তাহের (বাংলাদেশে কর্নেল ঈহের নামে পরিচিত) । লে. কর্নেল সোলেমান সদালাপী, হাসিখুশি। খুবই অভিজ্ঞ ও বহু উচচতর ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তিনি কয়েকদিনের মধ্যে ইউনিটের সবার মন জয় করে নিলেন। আনোয়ারকে জাংজু কোম্পানীতে পোস্টিং করা হলো। একটা কোম্পানীতে কোম্পানী কমাণ্ডার একজন মেজর ও প্ল্যাটুন কমাণ্ডার তিনজন ক্যাপ্টেনসহ মোট চারজন অফিসার থাকার কথা। কিন্তু জাংজু কোম্পানীতে আনোয়ার ছাড়া আর কোন অফিসার নেই।

জাংজু কোম্পানী, হেলি এয়ারবোর্ন। হেলিকপ্টার ও প্যারাশুট দ্বারা মিশন পরিচালনা করার দায়িত্ব এই কোম্পানীর। অবশ্য অন্যান্য কোম্পানীকেও একই দায়িত্ব পালন করার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়। এই কোম্পানীর মিশন সাধারণত সমতল ভূমিতে পরিচালিত হয়। মেজর তাহের যোগ দিলেন কায়েদ কোম্পানীতে। এই কোম্পানীর দায়িত্ব মরুভূমি এলাকায় মিশন পরিচালনা করা। পাশে গজনভী কোম্পানী । এই কোম্পানীর দায়িত্ব পার্বত্য অঞ্চল ও তুষার এলাকায় কাজ করা।

কিছুদিন পর মেজর তাহের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকা পাড়ি দিলেন। আমেরিকায় যাওয়ার আগে তিনি বিয়ে করেন এবং লণ্ডনে চাকুরিরত স্ত্রীর বড় ভাই ড. রফিকের কাছে স্ত্রীকে রেখে যান।

ইউনিটের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর আকরাম খটক। বিশালদেহী মেজর খটক জাতে পাঠান, বেশ কৌতুকপ্রিয়। প্রচুর অর্থশালী হলেও তিনি টাকা পয়সার ব্যাপারে কৃপণ। তবুও তিনি সকলের প্রিয়পাত্র। তাঁর চার হাজার টাকায় কেনা শেয়ারের দাম বেড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়েছে। এই গল্পটা তিনি প্রায়ই শুনিয়ে তৃপ্তি পান। একদিন আনোয়ার বলল, স্যার, আপনার এই সৌভাগ্যটাকে আজ আমরা সেলিব্রেট করব। চলুন, মেসে যাই।

আনোয়ার, এ তুমি কি বলছ? তারচেয়ে চলল খোলা মাঠে যাই।

খোলা মাঠে? সকলের অবাক কণ্ঠ।

আরে ইয়ার, খোলা মাঠের মুক্ত বাতাস স্বাস্থ্যের পক্ষে ভীষণ উপকারী।  

সবাই হো-হো করে হেসে উঠল মেজর খটকের কথা শুনে। তারপর খটককে টানতে টানতে মেসে হাজির হলো সবাই। কয়েক বোতল সেভেন আপ, কোক, স্যাণ্ডউইচের সামান্য বিল দিতে হলো মেজর খটককে। বার কাউন্টারে বিলে সিগনেচার করার সময় তিনি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমলোক মেরা কাবাড়া কার দিয়া। আওর মেসমে নেহী আয়েগা।

তবুও ওরা মাঝে মাঝেই খটকের ওপর হামলা চালাত।

ইউনিটে বিবাহিত অফিসাররা হলেন, লে. কর্নেল সাৈলেমান, মেজর আকরাম খটক, মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশারফ এবং ক্যাপ্টেন (ড.) মহম্মদ হোসেন। অবিবাহিত অফিসাররা হলেন, ক্যাপ্টেন সরদার হুমায়ুন খান (অ্যাডজুটেন্ট), ক্যাপ্টেন সাইদ আহমদ (কোয়ার্টার মাস্টার), ক্যাপ্টেন খালেদ, ক্যাপ্টেন জায়েদী এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার। কিছুদিন পর ওদের সঙ্গে যোগ দিলেন মেজর আজম, ক্যাপ্টেন সিকান্দার, ক্যাপ্টেন রিফাজ, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন গোলাম কাদের।

প্রতিদিন সকালে ওরা দৌড়ে বেগম-কি-সরাই পর্যন্ত যায়। দূরত্ব প্রায় এক মাইল। শরীর গরম হওয়ার পর শুরু হয় প্যারা পিটি। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে চলে এই কঠিনতম শরীর চর্চা। এটা ওদের প্রাত্যহিক কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত। এরই মাঝে সপ্তাহে একদিন ভোরে চার মাইল দৌড়ের পরীক্ষা হয়। সকালে দৌড় ও পিটি শেষে ওরা রওনা হয় দুর্গের উদ্দেশে। প্রত্যেকের নিজ নিজ অফিসে ফায়ারপ্লেসের আরামদায়ক উষ্ণতায় অফিস-আওয়ার কেটে যায়।

বেলা এগারোটায় টি-ব্রেক। গরম মুরগীর রোস্ট, স্যাণ্ডউইচ ও কফি সহযোগে টি-ব্রেক সারে ওরা। তারপর বেলা দুটোয় লাঞ্চ। লাঞ্চের পর অনেকেই রূমে ফিরে যায়। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশারফ, ক্যাপ্টেন সাইদ ও আনোয়ার তাস নিয়ে বসে এয়ার কণ্ডিশশু বারে। বিকেলে গেমস পিরিয়ডের আগে ওরা ওখানেই পোশাক বদলে নেয়। গেমসে যাওয়ার আগে বেয়ারা ঘড়ি দেখে ওদের চা পরিবেশন করে। চা ও সিগারেট শেষ করে ওরা বেরিয়ে পড়ে গেমসের জন্য দুর্গের উদ্দেশে।

দুর্গে ঢুকে সোজা বাস্কেটবল বাউণ্ডে চলে যায় আনোয়ার। বাস্কেটবল সে নিয়মিত খেলে। ঘণ্টাখানেক বাস্কেটবল খেলার পর ও আবার স্কোয়াশ গ্রাউণ্ডে হাজির হয়। কিছুক্ষণ কর্নেলের সঙ্গে স্কোয়াশ, খেলার পর রূমে ফেরে সে। রূমের পেছনের দিকে একটা খোলা জায়গা। সেখানে বারবেল দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে আনোয়ার। মাঝে মাঝে সঙ্গী পেলে জুডো কারাতের প্র্যাকটিসও করে। সবকিছুর পর আর্দালি ভাল মত শরীর মেসেজ করে দেয়। অরপর শুরু হয় গরম পানির শাওয়ার বাথ। ঝরঝরে শরীর নিয়ে ফায়ারপ্লেসের ধারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও কফি পান। রাত নয়টার সময় ডিনারের জন্য আবার মেস। ডিনার শেষে ঘণ্টাখানেক টেলিভিশন দেখে ঘরে ফেরে ও। আর্দালিকে চিঠির জবাব লেখার নির্দেশ দিয়ে বিছানায় যায় আনোয়ার। এই হলো। আটক দুর্গে ওর দৈনন্দিন কর্মসূচী।

শীতকালে আটকের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। ধীরে ধীরে শীত ফুরিয়ে গেল। শুরু হলো গরম। প্রথম প্রথম গরমের তীব্রতা আনোয়ার বুঝতে পারেনি। গরমকালের মাঝামাঝি সময় আটকের আবহাওয়া অসহনীয় হয়ে উঠল। একশো উনিশ থেকে একশো বাইশ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা ওঠানামা শুরু করল। অসহ্য হয়ে উঠল আনোয়ারের কাছে আটক দুর্গের ভিতর সমস্ত বিল্ডিংগুলোর দেয়াল ভীষণ পুরু। সেজন্য কিছুটা রক্ষা তবে আউটডোের ট্রেনিং-এর সময় সকাল থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত এই প্রচণ্ড তাপমাত্রায় কাজ করতে হয় ওদের। এসময় ওদের পোশাক হাফহাতা সুতির গেঞ্জি। গেঞ্জির বুকের ওপর নাম ও পদবী ছাপা। পরনে খাকি ট্রাউজার্স ও বুট। মাথায় ব্যেরেট ক্যাপের পরিবর্তে কটন জকি ক্যাপ।

তীব্র রোদে শরীরের চামড়া ঝলসে যাওয়া শুরু হলো আনোয়ারের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় খুললে রোদে পোড়া অংশ এবং কাপড়ে আবৃত অংশের পার্থক্য প্রকট হয়ে চোখে পড়ে। দুর্গের ভিতরে রয়েছে, একটা সুন্দর সুইমিংপুল। কর্নেলের অনুমতি পাওয়ার পর থেকে অফিস শেষে ওরা সবাই সুইমিংপুলে ছুটে যায়। কাবুল নদীর বরফ গলা জলে পুল ভর্তি। একবার পুলে নামলে আর উঠতে ইচ্ছে করত না আনোয়ারের। সুইমিংপুলে কোক, স্যাণ্ডউইচ, কফি খেত সে। মাঝেমধ্যে পুলে গোসলরত অবস্থায় অফিসের কাগজপত্রও দেখত।

জুলাই-এর এক সন্ধ্যা। আনোয়ারসহ কয়েকজন অফিসার মাটক দুর্গের খোলা মাঠে বসে গল্প করছে। হঠাৎ সস্ত্রীক মেজর তাহের উপস্থিত হলেন। আনোয়ারকে দেখে তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, হাই আনোয়ার, কেমন আছ?

তারপর আনোয়ারকে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। মিসেস তাহের খুব খুশি হলেন আনোয়ারকে বাংলায় কথা বলতে দেখে। স্বাভাবিকভাবে মেহমানদারী করার দায়িত্ব ওর ওপরেই পড়ল। কোল্ড ড্রিঙ্কস, স্ন্যাক্স শেষে মেস-হাবিলদারকে নিয়ে ওরা গেল গেস্টরূমে। আপাতত সেখানেই মেজর তাহের ও মিসেস তাহেরের থাকার ব্যবস্থা হলো। গেস্টরুমে বসে আনোয়ারের সঙ্গে নেকক্ষণ আলাপ করলেন দুজন। শেষে মেজর তাহের বললেন, এখন থেকে দুপুর আর রাতে তুমি আমাদের এখানে খাবে। এই বাংলাভাষী বিবর্জিত এলাকায় তোমার সঙ্গে কথা বলে তোমার ভাবী নিশ্চয়ই স্বস্তি পাবেন।

কিছুদিন পর দুর্গের সবচেয়ে কাছে একজন বিবাহিত অফিসারের বাসস্থান খালি হলো। মেজর তাহের সেখানে চলে গেলেন। নতুন করে সংসার গোছানো তাহেরের পক্ষে কষ্টকর। এসব ব্যাপারে তিনি একেবারে আনাড়ী। সংসারের ছোটখাট জিনিসপত্র কেনায় তাঁর ভীষণ বিরক্তি। তার ওপর ধারে কাছে কোন বাজার নেই। আটক দুর্গ থেকে বাজার প্রায় বাইশ মাইল দূরে। মেস-হাবিলদার প্রায়ই গাড়ি নিয়ে বাজার করতে যায়।

একদিন তাহেরের নতুন বাসায় গেল আনোয়ার। গিয়ে দেখে মিসেস তাহের পাঞ্জাবী মেস-হাবিলদারকে কি যেন বোঝানোর চেষ্টা করছেন। মেস-হাবিলদার বাংলার কিছুই বোঝে না এবং কিছু না বুঝেই সে ঘাড় নাড়াচ্ছে। আনোয়ারকে দেখে মিসেস তাহেরের মুখটা করুণ হয়ে উঠল, দেখুন তো ভাই, আমি হাবিলদারের একটা কথাও বুঝতে পারছি না। আর হাবিলদারও আমাকে বুঝতে পারছে না। অথচ জিনিসগুলো দরকার। আপনার স্যার তো এসবের কথা শুনতেই পারেন না।

আপনি চিন্তা করবেন না। বলুন আপনার কি কি দরকার?

আনোয়ারকে নিয়ে মিসেস তাহের ঘরের ভেতরে গেলেন। তিনি বাংলায় একটা ফর্দ লিখে ওর হাতে দিলেন। ও পাঞ্জাবী মেসূ-হাবিলদারকে সবকিছু বুঝিয়ে বলল । হাবিলদার গাড়ি নিয়ে চলে গেল বাজারে।

যাক আপনি বাঁচালেন। কি বিপদেই না পড়েছিলাম। মিসেস তাহের বললেন।

এখন থেকে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার কোন কিছুর প্রয়োজন হলে দয়া করে আমাকে বলবেন। আমি মেস হাবিলদারকৈ সবকিছু বুঝিয়ে বলে দেব।

সত্যি বলছেন?

অবশ্যই। এতে মিথ্যে বলার কি আছে?

না, আপনারা নানা ঝামেলায় ব্যস্ত থাকেন তো।

এখানে আরামেই তো আছি। তেমন কোন ঝামেলা নেই। বরং আপনার এই কাজটুকু করতে পারলে আমি খুশিই হব।

যাক, তাহলে আমার দুশ্চিন্তা অনেকখানি কেটে গেল। মিসেস তাহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। কয়েকদিন পর মিসেস তাহেরের সুবিধার্থে পাঞ্জাবী মেস-হাবিলদারের পরিবর্তে একজন বাঙালী মেস-হাবিলদার নিয়োগ করা হলো। মিসেস তাহেরের সমস্ত সমস্যার সমাধান হলেও খাওয়ার সময় প্রায়ই আনোয়ারকে হাজিরা দিতে হত মেজর তাহেরের বাসায়।

মেজর তাহের একটা অদ্ভুত মানুষ। খাটো শক্ত কাঠামোর অধিকারী এ মানুষটির চোখে মুখে কঠিন আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। এক কঠিন ব্যক্তিত্বের দুর্ভেদ্য দেয়ালে ঘেরা মেজর তাহের। তিনি যেমন স্পষ্টভাষী, নির্ভীক, তেমনি একগুঁয়ে। ঈশ্বরবাদে তাঁর বিন্দুমাত্র বিশ্বাসও নেই। তাহের অতিমাত্রায় নাস্তিক। এই কঠিন স্বভাবের অদ্ভুত মানুষটি কিন্তু আনোয়ারকে ভীষণভাবে স্নেহ। করেন।

প্রথম পরিচয়ের কথা আজও মনে পড়ে আনোয়ারের। তুমি কি বাঙালী কমাণ্ডো? তাহেরের স্মার্ট কণ্ঠস্বর শুনেই আনোয়ার বুঝেছিল, ইনি সাংঘাতিক মানুষ। ও তাড়াতাড়ি জবাব দিয়েছিল, ইয়েস, স্যার।

কয়েকটা কথার পরেই মেজর তাহের দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, কমাতে যোগ দিয়েছ দেখে আমি বেশ খুশি হয়েছি। কিন্তু মনে রেখো, দেশ স্বাধীন করতে হবে। বাংলায় কথা হচ্ছিল। আনোয়ার তো অবাক! মানুষটা বলে কি?

স্যার, পাকিস্তান তো একটা স্বাধীন দেশ। তবে কোন্ দেশ আমাদের স্বাধীন করতে হবে? সঙ্গে সঙ্গে মেজর তাহেরের প্রচণ্ড ধমক, গোল্লায় যাক পাকিস্তান। মনে রেখো, তুমি একজন বাঙালী। এখন বুঝতে পেরেছ, কোন দেশ স্বাধীন করতে হবে?

ব্যাপারটা ১৯৬৭ সালের। তখন বাঙালী রাজনৈতিক নেতাদের মুখেও দেশ স্বাধীন করার কথা শোনা যেত না। অথচ একজন সৈনিক হয়ে তাহের এই কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন। প্রথমে আনোয়ারের কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে কথাগুলো বাস্তবে রূপ নিতে দেখে ওর শ্রদ্ধা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছিল তাহেরের ওপর। একটা ব্যাপারে ওর সঙ্গে মেজর তাহেরের বিরাট পার্থক্য ছিল। তাহেরের ঈশ্বরবাদে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। অথচ আনোয়ার ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তাহের মাত্রাতিরিক্ত মদ পান করেন। আনোয়ার মদ নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি করেনি কোনদিন।

একদিন মিসেস তাহের আনোয়ারকে বললেন, মদের মাত্রা কিছুটা কমানোর জন্য তাহেরকে অনুরোধ করতে। বারে বসে, মেজর তাহেরকে ও ঢোক গিলতে গিলতে বলল, স্যার, ড্রিঙ্কটা একটু কম করলে মনে হয় ভাল হত। বলেই ঘামতে শুরু করল আনোয়ার। এই বুঝি শুরু হলো বজ্রপাত। কিন্তু না, তাহের শান্ত ভাবে ওর দিকে তাকালেন।

তুমি দিনে দশ কাপ চা খাও কেন? তাহেরের প্রশ্ন।

সতেজ অনুভূতির জন্য। আনোয়ারের ভীত কণ্ঠ।

তৎক্ষণাৎ তাহেরের উত্তর, আমি সতেজ হবার জন্য মদ খাই। আমি তো মদ খেয়ে মাতলামি করি না, কিংবা বউকে মারপিটও করি না। তাছাড়া মদ আমাকে খায় না, আমিই মদকে খাই। বুঝলে, ইডিয়ট?

রাইট, স্যার। ও তাড়াতাড়ি তাহেরের কথায় সম্মতি জানাল। কিছুক্ষণ পর তিনি পুনরায় বললেন, নিশ্চয়ই আমাকে এ-কথা বলার জন্য তোমার ভাবী তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। নাহ্, আমার বউটা ভেতো বাঙালীই রয়ে গেল। ঠিক আছে, সে যখন অতিরিক্ত ড্রিঙ্কস পছন্দ করে না, আমি কিছুটা কমানোর। চেষ্টা করব। তবে একেবারে ছাড়তে পারব না। কথাগুলো বলেই তাহের আনোয়ারকে নিয়ে বার থেকে বেরিয়ে এলেন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি প্রামাণ্য চিত্র টিভিতে দেখছেন তাহের। চিত্রটা দেখার পর থেকেই তাঁর মাথায় চাপল অদ্ভুত খেয়াল। ছবিতে আমেরিকান সৈনিকেরা একটা উঁচু দেয়াল বাঁশের সাহায্যে বিশেষ কায়দায় পার হলো। তাহের ফিসফিস করে পাশে বসা আনোয়ারকে বললেন, দৃশ্যটা বেশ সুন্দর। তাই না?

সুন্দর। তবে রিস্কি।

মাই ব্লাডি ফুট। রিস্কি, এই শব্দটা কমাণ্ডোদের অভিধানে আছে? তাহেরের কণ্ঠস্বরে রীতিমত তাচ্ছিল্য । আনোয়ার, মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। তিনি আবার বললেন, আগামী রোববার আটক দুর্গের দেয়ালে রেপেলিং করার জায়গায় এই প্রচেষ্টা চালানো হবে।  কথাটা শুনে চমকে উঠল আনোয়ার। এবার বুঝি মানুষটার মাথা সত্যিই খারাপ হলো। কোথায় আমেরিকান সৈনি বিশ ফুট উঁচু দেয়াল পার হলো, আর সেখানে কিনা মেজর তাহের একশো বিশ ফুট উঁচু দেয়াল পার হবেন। এটা একটা পাগলামি ছাড়া আর কি হতে পারে। আনোয়ার একটু চিন্তা করে বলল, স্যার, আপনি কি ঠাট্টা করছেন?

শাট আপ, এটা ঠাট্টা নয়। ধমক খেয়ে ও নীরব হয়ে রইল।

পরদিন। ইউনিটে টি-ব্রেকের সময় এই আলোচনা উঠল। এটা নিছক পাগলামি-সমস্ত অফিসারদের মন্তব্য। কিন্তু তাহের তাঁর সিদ্ধান্তে আটক দুর্গের কঠিন শিলার মত স্থির, অনড়, অবিচল। তাঁর অনমনীয় মনোভাব দেখে কর্নেল সোলেমান বাধ্য হলেন নির্দেশ দিতে। সমস্ত অফিসারদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন। কর্নেল সবাইকে আটক দুর্গের রেপলিং করার জায়গায় উপস্থিত থাকতে বললেন। অর্থাৎ ছুটির পুরো দিনটাই মাটি।

অফিসে ফিরে আনোয়ার তাহেরকে জিজ্ঞেস করল, স্যার, অত উঁচু বাঁশ কোথায় পাবেন?

কেন? ছোট ছোট বাঁশের টুকরো জোড়া দিয়ে?

কিন্তু স্যার, জোড়া দেয়া জিনিস কি গোটা বাঁশের মত শক্ত হবে? ওর কণ্ঠস্বরে সন্দেহ।

সে আমি ম্যানেজ করে নেব।

আনোয়ার আর কিছু না বলে তাহেরের অফিস থেকে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে এল।

রোববার সকাল দশটা। সমস্ত অফিসাররা হাজির আটক দুর্গের রেপেলিং করার স্থানে। দুর্গের দেয়ালের এই অংশটা একটু বাঁক খেয়ে খাড়া কোনাকুনি গোলাকার হয়ে ওপরে উঠে গেছে । একশো বিশ ফুট লম্বা জোড়া লাগানো একটা বাঁশের দণ্ড! মেজর তাহের দুই হাতে দণ্ডটার অগ্রভাগ ধরলেন। দশজন শক্ত সমর্থ জোয়ান দণ্ডটাকে খাড়া কোনাকুনি অংশ বরাবর ঠেলে ওপরের দিকে ওঠাতে শুরু করল। তাহের দুই পা দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে অনেকটা হাঁটার ভঙ্গিতে দেয়াল বেয়ে উঠছেন। পঞ্চাশ ষাট ফুট ওঠার পর সমস্ত অফিসারদের হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করতে থাকল। দণ্ডটা দুপাশে ভীষণভাবে দুলছে। যে-কোন মুহূর্তে মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে। এই ভীতিকর অবস্থা দেখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল অফিসারদের মাঝে। কিন্তু তাহের ওপর থেকে অনবরত বলে যাচ্ছেন, দ্যাটস্ রাইট, ক্যারি অন। লগিটাকে এইভাবে ওপরের দিকে ঠেলতে থাকো।

নিচে আতঙ্কিত নীরবতা। সকলের বিস্ফারিত দৃষ্টির সম্মুখে তাহের আটক দুর্গের একশো বিশ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর কর্নেল সোলেমানের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, স্যার, এটা কঠিন কিছু না। আর একজন অফিসারকে এবার পাঠান। কর্নেল চারদিকে তাকালেন। প্রত্যেকের দৃষ্টিতে নীরব অসম্মতি।

তাহের যদি এটা করতে পারে, তাহলে তোমাদেরও পারা উচিত। কর্নেলের কথা শুনেও সবাই নিরুত্তর। এবার কর্নেল বলে উঠলেন, একজন বাঙালী অফিসার যখন এটা করতে পেরেছে, অতএব আর একজন বাঙালী অফিসারও পারবে। আমি আশা করি, এবারে আনোয়ার একটু চেষ্টা করে দেখবে।

আনোয়ার কোন বাক্যব্যয় না করে সোজা গিয়ে দণ্ডটার অগ্রভাগ ধরল। জোড়া লাগানো দণ্ডটা একবার ব্যবহারের পর পূর্বের তুলনায় আরও বেশি লচপচে হয়ে গেছে। তার ওপর ওর ওজন তাহেরের চেয়ে প্রায় তিরিশ পাউণ্ড বেশি। কিছুদূর ওঠার পর শুরু হলো দুলুনি। কাঁচ কাঁচ শব্দ উঠছে দণ্ডটার প্রতিটা জোড়া থেকে। যে-কোন মুহূর্তে দণ্ডটার যে-কোন অংশ ভেঙে যেতে পারে। সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে ও প্রায় আশি ফুট পর্যন্ত উঠল। তারপর হঠাৎ করে দুলুনিটা বেড়ে গেল প্রচণ্ডভাবে। ওদিকে তাহের ওপর থেকে চিৎকার করছেন, ব্র্যাভো, ব্র্যাভো। আর একটু বাকি। উঠে এসো, কুইক।

কিন্তু কর্নেল বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি আনোয়ারকে নিচে নামিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন। তাহের নিচে নেমে এসে ওকে বললেন, ব্লাডি হেল কমান্ডো, তোমার মত একটা ভীতু অপদার্থের কমাণ্ডোতে যোগ দেয়া উচিত হয়নি। নাউ পুশ অফ। প্রচণ্ড ধমক খেয়ে আনোয়ার মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল। তাহের পেছন থেকে ওকে ডাক দিলেন, তুমি কিছু মনে করোনি তো, আনোয়ার? তার কণ্ঠে স্নেহ।

না স্যার, একটুও না। আনোয়ার তাড়াতাড়ি বলে উঠল।

তোমার বিপদের গুরুত্ব আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ওকে, ইটস অল রাইট। চলো বারে যাই।

আর একটা ঘটনা।

গ্রীষ্মকাল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণকালীন মেজর তাহের সমুদ্রে সারফিং করতেন। সার্ফ বোট একটু লম্বাকৃতি কাঠের তৈরি। বোটের কোণগুলো সামান্য বাঁকা হয়ে ওপরের দিকে ওঠানো। উত্তাল ঢেউয়ের মাথায় ভেসে চলাটা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। তাহেরের মাথায় আবারও ভূত চাপল। আগামী রোববার তিনি সারফিং করবেন। তাহের কাবুল নদীর একটা বরফ গলা জলভর্তি চ্যানেল পাড়ি দেবেন। চ্যানেলটা মেসের অদূর দিয়ে প্রবাহিত। গ্রীষ্মকাল হলেও এই চ্যানেলে পড়ে গেলে কারও রক্ষা নেই। শরীরের সমস্ত রক্ত নিমেষেই জমে যাবে। চ্যানেলটা পাহাড়ী এলাকা ভেদ করে গিয়েছে। সারফিং-এর জন্য চাই উত্তাল ঢেউ। নেই। পরিবর্তে আছে বরফ গলা হিম স্রোত। চাই সারফিং বোট। তাও নেই। তার পরিবর্তে আছে একটা লম্বা কাঠের তক্তা। তাহেরের একগুঁয়েমির কাছে আবার কর্নেল হার মানলেন। সারফিং-এর নির্দেশ পেয়ে গেলেন তাহের।

পরদিন রোববার বেলা দশটা। ওরা সকলেই কাবুল নদীর পারে উপস্থিত। এখান থেকে চ্যানেলটা এঁকে বেঁকে বেরিয়ে গেছে। প্রত্যেকের পরনে সাঁতারের পোশাক। একটা দশফুট বাই দেড় ফুট কাঠের তক্তা । এটা দিয়ে তাঁহের সারফিং করে চ্যানেল পার হবেন। পানিতে নামার আগে কর্নেলসহ ওরা সবাই তাহেরকে অনুরোধ করল নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার জন্য কোমরে একটা রশি বাঁধতে। তাহের রাজি হলেন। কোমরে বাঁধা দড়ির অপর প্রান্ত কিনারায় অপেক্ষমাণ ওদের কাছে রইল।

তাহের তক্তাসহ পানিতে নামলেন। তক্তার ওপর শরীরের। চাপ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তক্তা পানিতে প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। তক্তার যেদিকে ডুবতে শুরু করে, তাহের তার উল্টোদিকে পা রাখেন। এইভাবে এক অভিনব কায়দায় তাহের সারফিং শুরু করলেন। চ্যানেলটি তিরিশ ফুট চওড়া। আশ্চর্যজনকভাবে তাহের তার সাহায্যে চ্যানেল পার হলেন। তারপর স্বাভাবিকভাবেই আনোয়ারের পালা। কোমরে দড়ি বেঁধে আনোয়ার তক্তার দিকে এগুলো । এ-ব্যাপারে ও একেবারে নতুন। সারফিং কাকে বলে সে। জানে না। তবুও তাহেরের জন্য চেষ্টা করতে হলো। দুই-তিন ফুট যাওয়ার পরই ঝপাং করে পানিতে পড়ল আনোয়ার। তলিয়ে গেল বরফগলা জলে। কোমরে বাধা দড়ির সাহায্যে ওকে দ্রুত টেনে তোলা হলো ওপরে। মুহূর্তের মধ্যেই আনোয়ারের হাত-পা ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে গেছে। সমস্ত শরীর যেন অনুভূতিহীন। এরপর কর্নেল সোলেমান সারফিং বন্ধের নির্দেশ দিলেন।

আজও আনোয়ারের কাছে মেজর তাহের একটি জীবন্ত স্মৃতি। তাহের দুর্লভ। তাহের দুর্ধর্ষ। তাহের দেশপ্রেমিক! অদ্ভুত গুণাবলীর সংমিশ্রণে তৈরি মানুষটি। আনোয়ারকে কত বকুনি দিয়েছেন তিনি। তারপর আবার প্রশান্ত হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার মুখ । হাই আনোয়ার, হাই কমাণ্ডো, কিছু মনে করোনি তো? সস্নেহে বলতেন তাহের। নো স্যার, নট অ্যাট অল। এই ছিল আনোয়ারের জবাব। তাহেরের কথা মনে হলে ও যেন কেমন আনমনা হয়ে যায়। তখনি মনে পড়ে, ফিট টু সার্ভ উইথ এনি আর্মি আণ্ডার এনি কণ্ডিশন ইন দ্য ওয়ার্লড়। আমেরিকায় আন্তর্জাতিক ট্রেনিং শেষে তাহেরের সার্টিফিকেটে এই মন্তব্যই লেখা ছিল, পৃথিবীর যে-কোন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে কোন অবস্থায় কাজ করতে সক্ষম।

ব্যাটল ইনোকুলেশন, কাকুল। এটা একটা মারাত্মক প্রশিক্ষণ। সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্র। একটা নির্দিষ্ট টার্গেট রয়েছে। শত্রুপক্ষের ব্যুহ ভেদ করে টার্গেটের দিকে ছুটে যেতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে আনোয়রিসহ সকল প্রস্তুত। ওদের পরনে ব্যাটল ড্রেস।

অস্ত্র বাগিয়ে ওরা এগুলো টার্গেটের দিকে। শুরু হলো, শত্রুপক্ষের অবিরাম গুলিবর্ষণ। দুই পাশ থেকে বৃষ্টির মত গুলি ছুটে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন বুলেটগুলো বাতাসে হিসহিস শব্দ তুলছে। ওরা সবাই মাথা নিচু করে ক্রলিং করে এগুচ্ছে। মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট-একটু এদিক ওদিক হলেই ঠুস করে ঢুকে পড়বে মগজের মধ্যে।

ট্যাট…ট্যাট…ঠাঠাঠা…অটোমেটিক অস্ত্রগুলো গজরাচ্ছে। মাঝে মাঝে রকেট-ফায়ারের কান ফাটানো আওয়াজ। প্রচণ্ড ধোঁয়া

ও বারুদের গন্ধে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। ওরা ক্রল করে কাঁটাতারের নিচ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাথার কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে হেভী মেশিনগানের প্রচণ্ড গতির অসংখ্য বুলেট। টার্গেট এলাকায় চলছে মর্টার ও কামানের অবিরাম গোলাবর্ষণ। ঘন কালো ধোঁয়া টার্গেট এলাকা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বারুদ পোড়া গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওদের। প্রতিটি মুহূর্ত ওরা সজাগ। শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি সতর্ক। অতি সাবধানে ওরা টার্গেট এলাকার দুশো গজের মধ্যে প্রবেশ করল। হঠাৎ থেমে গেল মর্টার ও কামানের গোলাবর্ষণ। ওরা রক্ত হিম করা রণহুঙ্কার দিয়ে ছুটল টার্গেটের দিকে। এইভাবে শেষ হলো ব্যাটল ইনোকুলেশন, কাকুল।

.

কেবল ট্রেনিং। একটা উঁচু চূড়া থেকে স্টীলের কেবল জলাশয়ের ওপর দিয়ে গিয়েছে। উঁচু চূড়া থেকে কেবটা ক্রমশই ঢালু হয়ে জলাশয়ের অপর প্রান্ত পর্যন্ত পৌচেছে। চূড়ার কাছে স্টার্টিং পয়েন্ট। ওখানে একটা পুলি। পুলির সাহায্যে সহজে কেবলের ওপর দিয়ে রোল করে যাওয়া যায়। জলাশয়ের মাঝামাঝি কেবলের সঙ্গে একটা স্পর রয়েছে। পুলির হ্যাঁণ্ডেল ধরে ট্রেইনীরা লাফ দেয় চূড়া থেকে। তারপর প্রচণ্ড বেগে ঝুলন্ত অবস্থায় গিয়ে বাড়ি খায় স্পরের সঙ্গে। সেই সঙ্গে শরীরের সামনের দিকটা ওপরের দিকে উঠে যায়। ট্রেইনীকে দুপা দিয়ে স্টীলের কেবল জড়িয়ে ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। শরীরের ভারসাম্য রক্ষার পর ঝুপ করে পানিতে লাফিয়ে পড়লেই কেব ট্রেনিংয়ের সমাপ্তি।

কাকুলে ব্যাটল ইনোকুলেশনের পর শুরু হলো এই কেবল ট্রেনিং। এই ট্রেনিংয়েও-যে-কোন মুহূর্তে বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে হাত ফসকে গেলে, কিংবা কেবল ছিড়ে গেলে হাড়গোড় চূর্ণ হয়ে যেতে পারে। চূড়ার উচ্চতা মাটি থেকে অনেক ওপরে। তারপর প্রচণ্ড গতি। স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে জলাশয়ে পৌঁছানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ট্রেইনী অফিসারের মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা থাকে। এই দূরত্বের মধ্যে পতন ঘটলে নিচে কঠিন মাটির সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটবে শরীরের। স্টার্টিং পয়েন্ট। চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ার। সে চারপাশ দেখে নিল। সম্মুখে কেবলটা ক্রমশই ঢালু হয়ে গিয়েছে। ওর শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি। বেশ দূরে, নিচে স্পর দেখা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে হ্যাঁণ্ডেলটা বাড়ি খাবে, শরীরের সামনের দিকটা উঠে যাবে শূন্যে, জড়িয়ে ধরতে হবে দুপা দিয়ে স্টীলের কেবল্। লাফ দেয়ার পূর্ব মুহূর্তে স্টীলের কেবলটা ওর কাছে বেশ সরু মনে হলো। ওর বিশাল শরীরের ওজন বইতে পারবে তো কেবলটা? দ্রুত মন থেকে সমস্ত খুঁতখুঁতে অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে দিল আনোয়ার।

তারপর এগিয়ে গেল পুলির দিকে। পুলির হাতল শক্ত করে ধরল। তারপর লাফ দিল। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে ও। সারা শরীর রোমাঞ্চিত। সমস্ত মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে আছে। বিশাল শরীর বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে। ঝুলন্ত অবস্থায় পেছনে চাইল ও। নিচে মাটি সরে যাচ্ছে অতি দ্রুত। মনে হচ্ছে ওকে ঢিল মেরে কেউ সামনে ছুঁড়ে ফেলেছে। নিমেষের মধ্যেই স্পরের কাছে পৌঁছে গেল আনোয়ার । পুলিটা প্রচণ্ড গতিতে বাড়ি খেলো স্পরের সঙ্গে। শরীরের সামনের অংশ শূন্যে ওঠার আগেই হঠাৎ ওর হাত ফসকে গেল পুলির হাতল থেকে। ঝপাং করে পানিতে পড়ল বেকায়দা ভঙ্গিতে। বেশ ব্যথা পেল সে।

সাঁতার কেটে জলাশয়ের কিনারায় পৌঁছে আবার এগিয়ে গেল স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে। এবারে হাত থেকে পুলির হাতল ফসকাল না। সুন্দর ভঙ্গিতে শরীরের সামনের অংশ উঠে গেল ওপরে। সেই সঙ্গে দুপা দিয়ে স্টীলের কেবল জড়িয়ে ধরল আনোয়ার। তারপর ঝুপ করে পানিতে লাফিয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে কেবল ট্রেনিংটা ওর কাছে ছেলেখেলার মত হয়ে গেল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *