হেল কমাণ্ডো – ১০

১০.

রাওয়ালপিণ্ডির অভিজাত চাইনিজ রেস্তোরাঁ ডিম-সাম। সন্ধ্যার পর এখানে শহরের অন্যতম ধনীরা আসর জমায়। জোড়ায় জোড়ায় যুবক-যুবতীরাও আসে। সবাই দুহাতে প্রচুর পয়সা উড়িয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে যায়। রেস্তোরাঁটার ওপর যুবকদের দুর্বলতাই বেশি। মালিক এক বোম্বাইয়া মহিলা। তার সুন্দরী দুই কন্যা এটার দেখাশোনা করে। সন্ধ্যার পর অনেক সুবেশি তরুণদের আগমন ঘটে এখানে। সুন্দরী দুজন সবাইকে মিষ্টি হেসে স্বাগত জানায়।

ফাইনাল এক্সারসাইজ শেষ হওয়ার পর দুদিন ছুটি পেল আনোয়ার। ছুটি কাটানোর জন্য সে বেরিয়ে পড়ল পিণ্ডির উদ্দেশে। পরনে ঢোলা ট্রাউজার, পায়ে স্পোর্টস ভেস্ট ও তার ওপর ফিল্ড জ্যাকেট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ওর চেহারা এখনও রীতিমত এলোমেলো, রুক্ষ, অনেকটা আমেরিকান কাউবয়দের মত। পিণ্ডি পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিল আগে ডিম-সামে উদরপূর্তি করতে হবে। ওর শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু এখনও ক্ষুধাপীড়িত।

রেস্তোরাঁর ভারী কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল আনোয়ার। কাউন্টারে বোম্বাইয়া মহিলা ও তার সুন্দরী কন্যাদ্বয়। তিনজনই ওর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। তারপর মুখ নামিয়ে ফিসফিস শুরু করল। আনোয়ার বুঝতে পারল, অভিজাত রেস্তোরাঁয় ওর চেহারা এখন বেমানান। কিন্তু কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ও সোজা ভিতরে গিয়ে একটা কেবিনে ঢুকে পড়ল। উর্দিপরা ওয়েটার এসে মেন্যু এগিয়ে দিলে খাবারের অর্ডার দিয়ে বলল, অ্যাণ্ড নাউ টু কোক্স প্লীজ। পুরো রেস্তোরাঁ এয়ারকণ্ডিশণ্ড। আনোয়ার গায়ের, জ্যাকেট খুলে রাখল চেয়ারের পিঠে। দ্রুত দুবোতল কোক শেষ হলো, তবুও তৃষ্ণা যেন মেটে না।

ইতোমধ্যে অন্যান্য টেবিলগুলো লোকজনে ভর্তি হয়ে গেছে। হঠাৎ ওয়েটার এসে ওকে ফ্যামিলি রূমের মাঝে বড় একটা টেবিল দেখিয়ে বসতে অনুরোধ জানাল। এর কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। বাক্যব্যয় না করে আনোয়ার সোজা ওয়েটারের দেখিয়ে দেয়া টেবিলে গিয়ে বসল। এখন শুধু চাই খাবার। ফ্যামিলি রূমের প্রতি কেবিন তরুণ-তরুণীদের দখলে। বিরাট সাইজের একটা ওভালশেপড টেবিল দখল করে আনোয়ার বসে আছে–একা। সবাই ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। খাবার দিতে দেরি দেখে কারণ জিজ্ঞেস করতেই ওয়েটার সবিনয়ে জানাল, স্যার, আপনার অন্যান্য সাথীদের আগমনের অপেক্ষা করছি। অবাক হয়ে আনোয়ার বলল, আমি একসঙ্গে কোন সাথী নেই। জদি খাবার সার্ভ করো।

শুরু হলো খাবার পরিবেশন। ওয়েটার প্রথমে নিয়ে এল দুবাউল চিকেন কর্ন সুপ ও দুই প্লেট এগ ফ্রায়েড রাইস । তারপর পরিবেশিত হলো ডবল বীফ উইথ চিলিস, দুপ্লেট সুইট অ্যাণ্ড সাওয়ার প্রন, দুটো বীফ উইথ ভেজিটেবল, এক প্লেট নুড়ল, এক প্লেট চপ সুয়ে, সিঙ্গল ফ্রায়েড চিকেন। সেইসঙ্গে চারটে কোকাকোলা। আনোয়ার গিলছে গোগ্রাসে। ।

খাওয়ার মাঝে এক সুবেশি বাঙালী ভদ্রলোক উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মাফ করবেন। আপনি কি বাঙালী? ও হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়ে বলল, কেন, কোন সন্দেহ আছে কি?

না মানে, আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভদ্রলোক ওকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ফিরে গেল। খেতে খেতে হঠাৎ আনোয়ার বুঝতে পারল, কাঁচের জানালার ওপাশে কে যেন তাকিয়ে রয়েছে। দৃষ্টি ফেলতেই দেখল রেস্তোরাঁর মালিক স্বয়ং চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছে। আশপাশেও চেয়ে দেখল, অনেকেরই ত্যারছা দৃষ্টি ওর দিকে। এতক্ষণে ব্যাপারটা বোধগম্য হলো। এই বিশাল খাবারের বহরই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ।

এবার কাঁচের জানালার ওপাশে মালিকের পরিবর্তে তার সুন্দরী কন্যাদ্বয়কে দেখা গেল। ওরা আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আনোয়ারও জবাবে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিল এক টুকরো মুচকি হাসি। অনেকদিন এধরনের উপাদেয় খাদ্য পেটে পড়েনি। খাওয়া শেষে তৃপ্তির সঙ্গে একটা সিগারেট ধরিয়ে কাউন্টারে এল সে। বিল পে করে ডিম-সাম হোটেল থেকে বেরিয়ে এল দৃঢ় পদক্ষেপে।

চেরাট ক্যান্টনমেন্ট। পিণ্ডিতে দুদিন ছুটি কাটিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসেছে আনোয়ার। ওর মনটা প্রফুল্লতায় ভরে আছে। শরীরটা বেশ ঝরঝরে। ওকে জানানো হলো, পরদিন শুরু হবে ছত্রিশ মাইল দৌড়ের পরীক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায়, পিঠে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক, হাতে রাইফেল ও ব্যাটল ড্রেস। মেজর রউফ ওকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, দৌড়ে তোমাকে, প্রথম স্থান অধিকার করতেই হবে আনোয়ার। নইলে মেজর ভর্দগের থোতা মুখ ভোতা হবে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আনোয়ার, ওকে।

সবাই প্রস্তুত। শুরু হলো দৌড়। উঁচু-নিচু পাহাড়ী পথ। কমাণ্ডোদের ভারী বুটের চাপে ছোট ছোট পাথর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। : ওদের পদক্ষেপ একপ্রকার বেসুরো আওয়াজ তুলল। সকলের দৃষ্টি পথের ওপর। এখনও সম্মুখে অনেক পথ । ওরা দৌড়ে চলেছে। দশ মাইল পার হলো–আরও ছাব্বিশ মাইল। প্রত্যেকের জুলফি বেয়ে কুলকুল করে ঘাম গড়াচ্ছে। পুরো ইউনিফরম ঘামে ভেজা। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ওদের বুকের ছাতি দ্রুত ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ পর মুখে আর পোশাকের এখানে ওখানে লবণ জমতে শুরু করল। কিন্তু কোনদিকে কারও খেয়াল নেই। সর্বাগ্রে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। এখনও অনেকটা পথ।

বিশ মাইল পার হয়ে গেল–আরও ষোলো মাইল। প্রত্যেকের পায়ের পেশীগুলো প্রচণ্ড পরিশ্রমে স্ফীত। পিঠের চল্লিশ পাউণ্ড পঞ্চাশ পাউণ্ড হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। একে একে রাইফেল, হাত বদল করা শুরু করল সবাই। প্রত্যেকের মুখমণ্ডল লবণে প্রায় সাদা। শরীর যেন আর চলে না। ক্লান্তি ও অবসাদ সবাইকে ঘিরে ধরেছে। পাহাড়ী উঁচু-নিচু পথ আরও দুর্গম হয়ে এল ওদের কাছে। তবুও সবাই ছুটে চলেছে। ছত্রিশ মাইলকে জয় করতেই হবে। অতিক্রান্ত হলো, ত্রিশ মাইল–আর মাত্র ছমাইল। মন্ত্রমুগ্ধের মত দৌড়চ্ছে আনোয়ার। আ-র-ও এক মাইল। তাহলেই শেষ হবে দৌড়। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল গন্তব্যস্থল। সবাই শরীরের শেষ শক্তিটুকু ব্যয় করছে জয়ের মালা ছিনিয়ে নেবার জন্য। আনোয়ার দেখতে পেল দূরে মেজর রউফ দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে হাত নেড়ে উৎসাহ দিচ্ছেন।

আনোয়ার সবার আগে। গন্তব্যস্থল প্রায় সন্নিকটে। বিপুল সংখ্যক দর্শক অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। ওদের মাঝে দারুণ উত্তেজনাকে প্রথম হয়? সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখল, আনোয়ার সকলের আগে এগিয়ে আসছে। দর্শকদের কণ্ঠে ফুটে উঠল আনন্দ-সূচক ধ্বনি, আনোয়ার, আনোয়ার, আনোয়ার। মেজর রউফ আনন্দে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

পেশওয়ার। প্যারা ট্রেনিং স্কুল। চেরাট থেকে পুরো ফোর্সকে ট্রান্সফার করা হলো এখানে। ক্যান্টনমেন্ট-এর মল রোডের ওপর দ্বিতল অফিসার্স মেস, রোডের উল্টো দিকে পেশওয়ারের ডিভিশনাল কমিশনারের বাসভবন। অফিসার্স মেসের ওপরতলায় ট্রেইনী কমান্ডোদের থাকার ব্যবস্থা। নিচতলায় এন্ট্রিরূম, ডাইনিং হল, গেস্ট রূম এবং প্যারা স্কুলের অফিসার-ইন-চার্জ তারেক মাহমুদ (সেতারা-ই-জুরাত) এর কামরা। ইংরেজিতে তাঁর নামের আদ্যক্ষর টি.এম. হলেও স্পেশাল সার্ভিসে টি.এম. অর্থ টক্কর মার। তারেক মাহমুদ-এর টক্কর মার নামে খ্যাত হওয়ার পেছনে একটা ঘটনা আছে। দুর্ধর্ষ, অকুতোভয় ও প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী তিনি অথচ দারুণ হাসিখুশি।

চেরাটে একবার দলবল নিয়ে তিনি খাড়া পাহাড়ের আঁকা বাঁকা গা বেয়ে নিচে নামছিলেন। সবার আগে তারেক মাহমুদ। দলবল তাঁকে অনুসরণ করছে। পাহাড়ের ঢালে বালু জুমে শক্ত: পাথরের মত হয়ে আছে। কঠিন শিলার মত চাঁইগুলোর কোন কোনটার ওজন ৪/৫ মণেরও বেশি। মাহমুদ পাহাড়ের প্রায় পাদদেশে পৌঁছেছেন। ঠিক এই সময় পেছনে একজনের পায়ের চাপে মণ দুয়েক ওজনের একটা চাই পাহাড়ের গা থেকে খসে যায়, আর সেটা সোজা গিয়ে পড়ে সেতারা-ই-জুরাত-এর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে টক্কর মারের মুখ থেকেও বেরিয়ে আসে বাপ।

মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে ভেবে সবাই নিচে নেমে এল। তারেক মাহমুদ দুপা সামনের দিকে ছড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরছে। তিনি ডানে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়তে পারছেন না। অথচ সামনের দিকে, তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছেন। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো সি.এম.এইচ.-এ। দেখা গেল তিনি ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছেন এবং মাথার চামড়া খানিকটা কেটে গেছে। তাছাড়া অন্য কোন ক্ষতি হয়নি। এরপর থেকে তিনি এস.এস.জি-তে টি.এম, অর্থাৎ টক্কর মার নামে খ্যাত হয়েছিলেন।

তারেক মাহমুদের অধীনে প্যারা স্কুলে শুরু হলো ট্রেনিং। স্কুলের প্রবেশ মুখে একটি ফলকগেট টেন, আদারওয়াইজ অর্থাৎ দশটা বুকডন দাও, নইলে…। এখানে প্রত্যেককে দশটা করে বুকডন দিয়ে স্কুলে ঢুকতে হয়। এছাড়াও স্কুলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নির্দেশ সম্বলিত ফলক। কোনটার গায়ে লেখা আছে বিশবার ওঠাবসা করো, নইলে… আবার কোনটার গায়ে লেখা আছে দৌড়াও, নইলে… সবাই প্রথমে মাইলখানেক দৌড়ে শরীর গরম করে নেয়। তারপর শুরু হয় প্যারা পিটি। পিটি শেষে ওদের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও থাকে না। অথচ তারেক মাহমুদ পিঠের ওপর ২০/২৫ সের ওজন নিয়ে অনায়াসে একশো বুকডন দিতেন।

এবার শুরু হলো অ্যাপারেটাস-এর সঙ্গে পরিচয়পর্ব ও অনুশীলন। পি.এল.এফ. বা প্যারা ল্যাণ্ডিং ফল-জায়গাটা দুফিট বাই চার ফিট বেদীর মত। প্যারাট্রুপার দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য আকাশ থেকে পড়ে কিছুটা গড়িয়ে যাওয়ার ট্রেনিং নেয় এখানে। শূন্য থেকে প্যারাট্রুপার সেকেণ্ডে আঠারো থেকে বাইশ ফিট গতিতে নিচের দিকে নামতে থাকে। প্যারাল্যাণ্ডিং-এর কৌশল জানা না থাকলে প্যারাট্রুপার যে-কোন সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে।

এস.এল.এফ.টি-সুইং ল্যাণ্ডিং ফল ট্রেনিং। বাতাসের বেগ যদি বেশি থাকে, তখন প্যারাট্রুপার দোল খেতে খেতে কিভাবে ল্যাণ্ড করবে তার জন্য এ-ট্রেনিং।

টাওয়ার-উচ্চতা ৩৭ ফিট। টাওয়ারের ওপর থেকে হার্নেস বেঁধে লাফ দিয়ে স্টীলের কেবল-এর ওপর দিয়ে গড়িয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে হয়। এয়ারক্রাফট-এর দরজা থেকে জাম্প দেয়ার পর শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখা, সময় গণনা করা, শূন্যে প্যারাশুট খুলে যাওয়ার পর ওপরে তাকিয়ে সেটা পরীক্ষা করা এবং ডানে-বাঁয়ে অন্যান্য প্যারাট্রুপারের অবস্থান লক্ষ্য করার জন্য এই ট্রেনিং।

ড্রাগ–এটা একটা ভীতিকর: প্রশিক্ষণ। বাতাসের গতি তীব্র থাকাকালীন অবস্থায় যদি প্যারাট্রুপার ল্যাণ্ড করে তখন বাতাসের বেগ প্যারাশুটসহ প্যারাট্রুপারকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। সেই অবস্থায় প্যারাট্রুপার কিভাবে হার্নেস মুক্ত হয়ে নিজেকে রক্ষা করবে তার জন্য এই ট্রেনিং। হার্নেস মুক্ত করতে না পারলে তার মৃত্যু অনিবার্য। কয়েক বছর পূর্বে জনৈক বাঙালী হাবিলদার নুরুল ইসলাম এয়ারক্রাফট থেকে জাম্প করে। তখন নিচে তীব্র বাতাস বইছিল। নুরুল ইসলামের ড্রাগ অনুশীলন আয়ত্তে ছিল না। প্যারাশুটসহ বাতাসের বেগ তাকে প্রায় মাইল তিনেক টেনে নিয়ে যায়। পরিণতি করুণ মৃত্যু।

রিগিং-প্যারাশুট ভাঁজ করার কৌশল। রিগিং শেডে সর্বদাই লেখা থাকে: রিমেম্বার, দ্য লাইফ অভ এ ম্যান ডিপেণ্ডস অন ইচ প্যারাশুট ইউ প্যাক। অর্থাৎ মনে রেখো তোমার ভাঁজ করা প্যারাশুটের ওপর একটা মানুষের জীবন নির্ভরশীল।

সাসপেনডেড হার্নেস। এখানে শেখানো হলো, প্যারাশুট খুলে যাওয়ার পর শূন্যে কি কি করতে হবে, প্যারাশুট ডানে বামে বা সামনে পেছনে নিতে হলে হার্নেসের চারটা মেইন স্ট্রাপ কিভাবে ব্যবহার করতে হবে; কোন গাছ ইলেকট্রিক পোল বা কোন মারাত্মক অবস্থানে যদি প্যারাশুট ল্যাণ্ড করতে যায়; তখন কিভাবে ইমারজেন্সি ল্যাণ্ডিং করতে হবে; নদী অথবা সাগরে ল্যাণ্ড করার আগে শূন্যে কিভাবে সমস্ত স্ট্র্যাপ, স্টীল হেলমেট প্যাক অস্ত্র ইত্যাদি ফেলে দিয়ে বগলের নিচে চেপে রাখা স্ট্রাপ ছেড়ে দিয়ে পানিতে ঝুপ করে পড়তে হবে ইত্যাদি।

সাসপেনডেড হার্নেসের এতগুলো বিষয় একসঙ্গে শেখার জন্য ওদেরকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হার্নেসের ভিতর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতে হয়। হার্নেসের দুটো স্ট্র্যাপ পেছন দিক থেকে এসে সামনে দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে তলপেটটাকে এত জোরে চেপে রাখে যে জায়গাটা প্রায় অবশ হয়ে যায়। তাই ওরা এটার নাম দিয়েছিল ফ্যামিলি প্ল্যানার।  

টাওয়ার জাম্প শুরু হলো। এয়ারক্রাফট থেকে প্যারাশুটসহ জাম্প করার পূর্ব-যোগ্যতা হিসেবে প্রত্যেককে ছয়টা করে সন্তোষজনক টাওয়ার জাম্প দিতে হয়। ছয়টা স্যাটিসফ্যাক্টরি জাম্প দিতে প্রত্যেককে অন্তত ৩০/৪০ বার চেষ্টা করতে হয়। যদি কেউ ৫০/৬০ বার জাম্প দিয়ে একটা জাম্পও স্যাটিসফ্যাক্টরি দেখাতে না পারে তখন তাকে এয়ারবোর্ন কোর্স থেকে বাদ দেয়া হয়। জাম্প শুরু হওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আনোয়ারকে যেতে হলো খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টে। ওকে ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশনের জন্য পরীক্ষা দিতে হবে।

পরীক্ষা শেষে প্যারা স্কুলে ফিরে এলে টি.এম. তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কটমট করে বললেন, দুদিন খুব ফাঁকি দিয়েছ। আজ তোমাকে টাওয়ার থেকে এমন লাফ দেয়া যে, হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবে না। টি.এম.-এর নির্দেশ মত আনোয়ার সোজা গিয়ে টাওয়ারে চড়ল। হার্নেস পরে রেডি হলো জাম্পের জন্য। নিচ থেকে স্পীকারে নির্দেশ এল গো।

লাফ দিল আনোয়ার। ও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। টাওয়ারের সামনে টাঙানো কেব্‌ল বেয়ে। হঠাৎ নিচ থেকে টি, এম-এর গলা ভেসে এল ওয়াণ্ডারফুল! ওয়েলডান! ফাস্ট জাম্প, স্যাটিসফ্যাক্টরি। কথাটা শুনে শিউরে উঠল ও। তবে কি টাওয়ার জাম্পে কোন রেকর্ড সৃষ্টি হলো? কারণ আমেরিকানরা এই প্যারা স্কুল তৈরি করার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রথম জাম্প সন্তোষজনক হওয়ার মত কোন ঘটনার রেকর্ড নেই। জাম্প শেষে হার্নেস থেকে বেরিয়ে টি.এম. এর কাছে ফিরে এল আনোয়ার। হঠাৎ তিনি হুকুম দিলেন গেট ফিফটি। আনোয়ার অবাক! বলে কি? কোথায় ও রেকর্ড সৃষ্টি করার চিন্তা করছে আর সেখানে কিনা পঞ্চাশটা বুকডন? দ্রুত মন থেকে দূর হয়ে গেল স্বপ্নিল চিন্তাটা। ৫০টা বুকডন দেয়া শেষ হতেই টি. এম. ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

স্পীকারে ঘোষণা করলেন, আনোয়ার প্রথম জাম্প। স্যাটিসফ্যাক্টরি করে টাওয়ার জাম্পে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পরের জাম্পও স্যাটিসফ্যাক্টরি হলো। টি.এম. পুনরায় স্পীকারে ঘোষণা করলেন, আনোয়ারকে আর জাম্প দিতে হবে না। টাওয়ার জাম্পে ক্যাপ্টেন আহমেদ জিয়াও প্রথম জাম্প স্যাটিসফ্যাক্টরি করে আনোয়ারের সঙ্গী হলো। অনেকে টাওয়ার জাম্পে ভাল ফল দেখাতে না পেরে কোর্স থেকে বাদ পড়ল।

শুরু হলো ভীতিকর ড্রাগ ট্রেনিং। জীপের পেছনে দশ-বারো ফুট লম্বা দুটো স্ট্র্যাপ লাগানো। স্ট্র্যাপের মাথায় সংযুক্ত দুটো হার্নেস। আনোয়ারের পিঠে রবারের প্যাড। হার্নেস পরে দুপা ভঁজ করে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ও। মাথায় স্টীল হেলমেট। জীপ ঘণ্টায় বিশ-পঁচিশ মাইল বেগে এগিয়ে চলেছে মসৃণ পাথরের রাস্তা ধরে। আনোয়ার ব্যাক সমার সল্ট করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জীপের পেছনে কয়েক ধাপ দৌড়াতে পারলেই ড্রাগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। ও ব্যাক সমার সল্ট করে। ঠিকই উঠে দাঁড়াল, কিন্তু পরক্ষণে জীপের প্রচণ্ড ঝটকায় পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ল। ডান হাতের কনুই প্রচণ্ড বেগে বাড়ি খেলো উঁচু হয়ে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরের সঙ্গে-ব্যথায় হাতটা অবশ হয়ে গেল।

মাথাটা বোঁ করে উঠল–স্টীল হেলমেট থাকায় এযাত্রায় কিছুটা রক্ষা। উঁচু নিচু পাথুরে রাস্তা। জীপের গতির সঙ্গে মাথাটা ঝাঁকি খাচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে চেপে রেখেছে সে। মনে হচ্ছে দেহ থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে। শরীরের কোন অংশই অক্ষত রইল না। রাস্তার ঘষায় হাত ও পায়ের মাংস চিরে গেল, গড়িয়ে পড়া শুরু হলো রক্ত। আনোয়ার অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল, স্প, স্প। কিন্তু কে শোনে কার কথা? টি.এম. নিজে জীপের স্টিয়ারিং ধরে আছেন। সুতরাং নির্ধারিত কোয়ার্টার মাইল জীপের পেছনে হেঁচড়ে যেতেই হলো।

নির্ধারিত দূরত্বে পৌঁছানোর পর আনোয়ারকে হার্নেস মুক্ত করে দেয়া হলো। কোনমতে টলতে টলতে একটা গাছের নিচে বসে পড়ল ধপাস করে। শরীরের দিকে তাকানো যায় না। প্রতিটি জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে, এখানে-ওখানে থেঁতলে গেছে। ঘাড় স্বাভাবিক ভাবে নড়ানো যাচ্ছে না। প্রচণ্ড ব্যথা। তবুও মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। কারণ প্যারাশুট জাম্পের চারদিন বাকি। আছে। এর মধ্যে শরীরকে জাম্পের উপযোগী করে নিতে হবে।

.

পেশওয়ার বিমান বন্দর। বিরাট আকারের একটা সি-১৩০ কার্গো দাঁড়িয়ে আছে। কার্গোর পেছনের দিকে প্ল্যাটফরম উন্মুক্ত অবস্থায় মাটির সঙ্গে ঠেকানো। অনতিদূরে প্যাক করা প্যারাশুটের বিরাট একটা স্থূপ। নির্দিষ্ট দিনে আনোয়ারসহ ১৪৮ জন অফিসার হাজির হলো পেশওয়ার বিমান বন্দরে। ওদেরকে প্যারাশুট জাম্প করতে হবে। ওদের সঙ্গে জাম্পে অংশ নিল অ্যাডভেঞ্চার কোর্স এবং অ্যানুয়্যাল জাম্প রিয়ালের জন্য এস.এস.জি-র একটা ট্রেইণ্ড কমাণ্ডো দল।

।সবাই প্যারাশুটের হার্নেস আটকে দাঁড়িয়ে আছে। হার্নেস শক্ত করে বাঁধার জন্য ওদের শরীরের ঊর্ধ্বাংশ বাঁকা হয়ে আসতে চাইছে। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। কার্গো চারটা ট্রিপ দেবে। প্রতি ট্রিপে ৭২ জন। ড্রপজোন পনেরো মিনিটের পথ। প্রতি ট্রিপে সময় লাগবে প্রায় আধ ঘণ্টা। আনোয়ার দ্বিতীয় ব্যাচে। ব্রিফিংয়ের পর প্লেন উড়ল আকাশে। ট্রেইও কমান্ডোরা প্রথমে জাম্প করবে। প্রথম ট্রিপের পর ফাঁকা কার্গো ফিরে এল। ইঞ্জিন চালু অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল প্লেন-বৃহৎ আকারের চারটি প্রপেলার প্রচণ্ড গতিতে ঘুরছে। আনোয়ার এগিয়ে চলল কার্গোর দিকে। সবাই চিৎকার করছে, এয়ারবোর্ন, এয়ারবোর্ন বলে। ওর মনে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

সি-১৩০ কার্গো একটানা বে-ও-ও আওয়াজ করে ছুটে চলেছে ড্রপজোনের দিকে তেরোশো ফুট ওপর দিয়ে ঘণ্টায় দুশো মাইল বেগে। প্লেনের ফিউজিলাজের দিকে দাঁড়ানো জাম্প মাস্টার টিম.এম.-এর সশব্দ হাততালি শোনা গেল। সেই সঙ্গে টি.এম. গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেন, টেন মিনিটস। অর্থাৎ আর দশ মিনিট পরে শুরু হবে জাম্প। আবার শোনা গেল, সিক্স মিনিটস। প্লেনের দরজা খুলে টি. এম. বাইরে ভাল করে দেখে নিলেন। আবার চিৎকার করলেন, স্ট্যাণ্ড আপ। সবাই পেছনের দরজায় লাইন বন্দী হয়ে দাঁড়াল। আবার নির্দেশ এল, হুক আপ। প্যারাশুটের স্ট্যাটিক লাইনের হুকগুলো প্লেনের অ্যাংকর লাইনের সঙ্গে আটকে অধিকতর নিরাপত্তার জন্য সবাই পিন লাগিয়ে নিল। এরপর নির্দেশ এল–চেক আপ। স্ট্যাটিক লাইন চেক করে সকলে ওয়ান ওকে টু ওকে এবং অল ওকে বলে ওকে রিপোর্ট করল। স্ট্যাণ্ড ইন দি ডোর। নির্দেশ আসার সঙ্গে সঙ্গে লাইনের প্রথমজন দুপা শাফলিং করে প্লেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। আনোয়ার লাইনের দ্বিতীয়জন। কার্গোর দরজায় লাল লাইট জ্বলছে। প্রথমজন বা স্টিক লীডার নির্দেশ অনুযায়ী দরজার দুপাশের হ্যাঁণ্ডেল ধরে প্লেনের বাইরে চারপাশ দেখে নিয়ে দরজার কিনারে দাঁড়াল জাম্পের ভঙ্গিতে। লাল আলো নিভে গিয়ে দপ করে জ্বলে উঠল সবুজ আলো। স্টিক লীডারের পশ্চাদদেশে টি.এম. প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিলেন, গো। মুহূর্তে হারিয়ে গেল স্টিক লীডার কার্গোর বাইরে।

দরজায় আবার লাল আলো জ্বলে উঠল। আনোয়ার নির্দেশ অনুযায়ী এগোল দরজার দিকে। প্রপেলারের ঠেলে দেয়া বাতাস প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে পেছনে। এই বাতাসের ভিতর লাফ দিতে হবে ভেবে ওর মনে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। ঠিক ভয় বলতে যা বোঝায় তা নয়। একটা অচেনা অনুভূতি মনকে দোলা দিচ্ছে। নিচে মাটিতে বিছানো ইংরেজি টি অক্ষরটা দেখা গেল। টি-র মাথায় প্লেন পৌঁছলে লাফ দিতে হবে। টি.এম. ওকে নিয়ে নিষ্ঠুর কৌতুক শুরু করলেন। তিনি কখনও বলছেন, তোমার প্যারাশুট তো খুলবে না। আবার কখনও বলছেন, তোমাকে যে প্যারাশুটটা দেয়া হয়েছে, সেটা ঠিকমত প্যাক করা হয়নি! অতএব বুঝতেই পারছ। আনোয়ারও উল্টো বলছে, আমার প্যারাশুট যদি না-ই খোলে তাহলে আমি কিন্তু এয়ারক্রাফটে ফিরে আসব। কার্গোটি টি অক্ষরের মাথায়। দপ করে জ্বলে উঠল সবুজ আলো। টি.এম, ওর পশ্চাদদেশে চপেটাঘাত করে নির্দেশ দিলেন গো।

পিঠের ওপর প্যাক করা মেইন প্যারাশুট এবং পেটের কাছে রিজার্ভড প্যারাষ্ট ওর একমাত্র সঙ্গী। ও ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনে। হু হু করে ছুটে যাচ্ছে প্রপেলারের ঠেলে দেয়া বাতাস। বাতাসের গতিবেগ ওকে বেশ কিছুটা পেছনের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। তারপর শুরু হলো নিচের দিকে পতন। আনোয়ারের দুহাত, রিজার্ভড প্যারাশুটের প্যাকের দুপাশে ডান হাত রিপ কর্ডের ওপর। মেইন প্যারাশুট কাজ না করলে রিপ কর্ডের হ্যাঁণ্ডেল টেনে যাতে রিজার্ভড প্যারাশুট ওপেন করা যায়। ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ওয়ান থাউজে, টু থাউজেণ্ড–চার সেকেণ্ড গণনার হিসাব। এই সময়ের মধ্যে খুলে যাবে মেইন প্যারাশুট। স্ট্যাটিক লাইন থেকে প্যারাশুট খুলে গেছে। সামান্য একটু ঝুঁকি খেয়ে নিচে পতনের গতি কিছুটা হ্রাস পেতেই ও ওপরের দিকে চাইল।

বিশাল ব্যাঙের ছাতার মত বাতাসে ফুলে রয়েছে প্যারাশুটটা। নিচের দিকে চাইতেই একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল । একি! পৃথিবীটা দুলছে কেন? ভাল করে খেয়াল করতেই ব্যাপারটা বোঝা গেল–পৃথিবী নয়, ও নিজেই প্যারাশুটের নিচে দুলছে। বহুদূর দৃষ্টি যাচ্ছে শূন্যে ভাসমান অবস্থায়। ওপরে বিশাল আকাশ-মেঘমুক্ত। নিচে শ্যামল প্রান্তর। যারা কোনদিন প্যারাশুট জাম্প করেনি অথবা করবে না তাদের জন্য আনোয়ারের মনে করুণার উদ্রেক হলো। প্যারাট্রুপার আনোয়ার সেকেণ্ডে আঠারো থেকে বাইশ ফুট গতিতে নিচে নামছে। ও সুন্দর ভঙ্গিতে পি.এল.এফ. করে মাটিতে পড়ল। তারপর প্যারাস্যুট গুটিয়ে নিয়ে ড্রপজোনের অদরে অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে এগুলো ।

পরদিন সকাল। সবাই ব্রেকফাস্ট খেয়ে রওনা হলো পুনরায় বিমান বন্দরের দিকে। আজ ওদেরকে লাইনবন্দী হয়ে পর পর জাম্প করতে হবে। ওরা কার্গোর অভ্যন্তরে ৩৬ জন করে পাশের দরজায় দণ্ডায়মান। জাম্প মাস্টারের গো নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল শূন্যে। প্লেন থেকে বেরুতে ওদের সময় লাগল পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড। টি.এম. বললেন, হোপলেস্। সময় আরও কমাতে হবে। দ্বিতীয়বার জাম্পে ওরা পাঁচ সেকেণ্ড সময় কমিয়ে চল্লিশ সেকেণ্ডে আনল।

সেদিনের মত জাম্প শেষ হলো। পরদিন আবার শুরু হলো জাম্প । দুটো করে অ্যাডমিনিসট্রেটিভ জাম্প শেষে অ্যাডভেঞ্চার কোর্সের অফিসারদের বুকে পরিয়ে দেয়া হবে বহু প্রতীক্ষিত প্যারাউইং, আর এস.এস.জি ট্রেইনীদের রাতে আরও একটা ট্যাকটিক্যাল জাম্প শেষে ডান বুকে পরিয়ে দেয়া হবে দুর্লভ কমাণ্ডো উইং।

রাত আটটার দিকে আনোয়ারসহ এস.এস.জি-র ট্রেইনী অফিসাররা বের হলো পেশওয়ার বিমান বন্দরের উদ্দেশে।

রাত সাড়ে আটটা। পেশওয়ার বিমান বন্দর। বিশাল রানওয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। স্থির, শান্ত। চারদিকে খোলামেলা পরিবেশ।

ব্রিফিং শেষ হলো। আনোয়ারসহ সমস্ত এস.এস.জি-র ট্রেইনী অফিসাররা এগিয়ে গেল, সি-১৩০ কার্গোর দিকে।

সি-১৩০ উড়ছে মাত্র আটশো ফুট উপর দিয়ে। প্লেন থেকে প্যারাশুট জাম্প করার জন্য স্বল্প উচ্চতা বিপজ্জনক। প্যারা ল্যাণ্ডিং ফলের প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। প্যারাট্রুপার সেকেণ্ডে বিশ থেকে বাইশ ফুট গতিতে নিচের দিকে, ধাবিত হয়। প্যারাট্রুপার যদি পি.এল, এফ-এর প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়, তবে-মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। সেজন্য উচ্চতা বেশি হলে প্যারাট্রুপার পি.এল.এফ-এর জন্য বেশ কয়েক সেকেণ্ড সময় পায়।

ড্রপ জোন আর বেশি দূরে নয়। আনোয়ারের মনটা রোমাঞ্চিত। এটাই হবে জীবনের প্রথম রাত্রিকালীন জাম্প। ও ভারছে ছেলেবেলার কথা। আক্লাশে প্লেন উড়ত। দ্রুত সেগুলো হারিয়ে যেত দৃষ্টিসীমার আড়ালে। মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে খেলা দেখাত প্লেনগুলো । ও তখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত। কি অদ্ভুত সৃষ্টি এই প্লেন! আকাশের বুকে উড়ে বেড়ায়! আশ্চর্য! বড়দের কাছ থেকে গল্প শুনত। ছত্রীসেনারা প্যারাশুটে করে প্লেন থেকে ঝাঁপ দেয়। ওর বিশ্বাসই হত না। দূর, অত উঁচু থেকে কেউ কখনও লাফ দিতে পারে? একদিন সিনেমায় দেখল-প্লেন থেকে ছত্রীসেনা লাফ দিচ্ছে। ওর ছোট্ট হৃদয়টা অবাক বিস্ময়ে ভরে উঠেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল ছত্রীসেনারা কি অপূর্ব! কি অদ্ভুত ওদের জীবন! না জানি ওরা কত বড়! নিজেকে ছত্রী হিসেবে কল্পনা করতে খু-উ-ব ভাল লাগত আনোয়ারের।

প্লেনের দরজায় দপ করে সবুজ আলো জ্বলে উঠল। ছোটবেলার চিন্তাটা উবে গেল নিমেষেই। জাম্প মাস্টারের চিৎকার ধ্বনি ভেসে এল, গো। একজন ট্রেইনী প্যারাট্রুপার লাফিয়ে পড়ল বাইরে। এবার আনোয়ার এগুলো প্লেনের দরজার দিকে। দরজায় লাল আলো জ্বলছে। কানে ভেসে আসছে প্লেনের একটানা গর্জন। অদূরে ড্রপজোন। ও প্লেনের দরজা গলিয়ে শরীরটা বাইরে এনে চারপাশটা ভাল করে দেখে নিচ্ছে।

মিষ্টি রাত। আকাশে প্রস্ফুটিত চাঁদের আলো। কোমল। জ্যোত্সামাখা প্রকৃতি। স্বপ্নিল। ছুটে যাওয়া ঠাণ্ডা বাতাস। তন্দ্রালু। ও দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে জাম্পের ভঙ্গিতে দাঁড়াল। দরজায় সবুজ আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ এল গো। এক ঝলক কোমল বাতাস আনোয়ারের চোখে-মুখে ঝাঁপটা দিল। মেইন প্যারাশুট খুলে গিয়েছে। দ্রুত ক্যানোপি, সাসপেনডেড লাইন, হার্নের্স পরীক্ষা করে নিল সে। তারপর রূকস্যাক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সামনের বেল্টের দুটো ফিতা টান মারতেই। কোমরের বেল্টের সঙ্গে বাঁধা একটা দড়ির সঙ্গে ঝুলছে রূকস্যাকটা।

প্যাক খুলে যাওয়ার কয়েক সেকেণ্ড পর নিচের দিকে তাকাল আনোয়ার। সারা শরীর আড়ষ্ট হলো ভয়ে। প্যারাশুট একেবারে মাটির সন্নিকটে। পি.এল.এফ-এর জন্য সময় নেই। মুহূর্তের মধ্যেই প্যারাট্রুপার আনোয়ারের সারা শরীর বাড়ি খেলো মাটিতে। স্টীল হেলমেট সমেত মাথাটাও ঠুকে গেল। মারাত্মক আঘাত না পেলেও বোঁ করে উঠল মাথাটা। কোনরকমে নিজেকে হার্নেসমুক্ত করে, প্যারাশুট রোল করে মাটিতে বসে বিশ্রাম নিল সে। ভাবল, ভবিষ্যতে সব রকম মহড়ায় ওদের মাত্র আটশো ফুট উচ্চতা থেকে এই বিপজ্জনক ট্যাকটিক্যাল জাম্প দিতে হবে। এবারে তো কোনরকমে প্রাণ রক্ষা হলো। ভবিষ্যতে এর চেয়েও মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে?

বিশ্রামের পর প্যাক ও প্যারাশুট ঘাড়ে নিয়ে অপেক্ষারত গাড়ির দিকে এগুলো আনোয়ার। সেদিন মেসে দারুণ হৈ-চৈ হলো। পরদিন সকালে ওদের পরিয়ে দেয়া হবে কমাণ্ডো উইং। সৈনিকদের সেরা গ্রুপ-কমাণ্ডো। দুর্লভ প্রতীক–কমাণ্ডো উইং একজন কমাণ্ডো, মানুষরূপী, ভয়ঙ্কর যান্ত্রিক রোবট বিশেষ। বিভিন্নরকম বিপজ্জনক ট্রেনিংয়ে দক্ষ ওরা। প্যারাশুট জাম্প মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পার হলো। বিছানায় শুয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাল আনোয়ার।

পরদিন সকাল। ঘুম থেকে উঠে বাথরূমে ঢুকল আনোয়ার। টয়লেট, শেভ সেরে শাওয়ারের ট্যাপ খুলে দিল। কোমরে শুধু তোয়ালে জড়ানো। আয়নাতে চেয়ে দেখল, এই বুকের ডান ধারেই শোভা পাবে দুর্লভ কুমাণ্ডে উইং। ঝরঝরে মন নিয়ে বেরিয়ে এল বাথরূম থেকে আনোয়ার। একটা প্রফুল্লতা ওকে ঘিরে রেখেছে। চকচকে ইউনিফরম পরে স্মার্ট অথচ বেপরোয়া একটা ভাব নিয়ে প্যারা স্কুলে পৌঁছল সে।

সেখানে বিরাট আয়োজন। সকাল নয়টার দিকে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের গ্রুপ কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার শেরউল্লাহ বেগ এলেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিটি অফিসারের বুকে পরিয়ে দিলেন কমাণ্ডো উইং। আনোয়ারের বুকটা ভরে উঠল এক অনাবিল আনন্দে। এটা অগ্নি পরীক্ষার দুপ্রাপ্য পুরস্কার। ওর মনে পড়ল মেজর ভর্দগের সেই কথা, মাই ডিয়ার মাম্মি, আমি এখন একজন কমাণ্ডো হয়ে গেছি। ওর ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে উঠল, আমি কিন্তু তা নই, এখন আমি একজন হেল কমাণ্ডো। বিকেলে ওরা রওনা হলো চেরাট ক্যান্টনমেন্টের পথে।

শুরু হলো এস.এস.জি-র পাসিং আউট প্যারেড। এই প্যারেড সেনাবাহিনী-পাসিং আউট প্যারেডের মত নয়। ওদের প্রত্যেকের পরনে কমপ্লিট ব্যাটল ড্রেস-মাথায় স্টীল হেলমেট, ফুলপ্যান্টের নিচের প্রান্ত প্যারা-জাম্পের লং-বুটের ভিতর গোঁজা, পিঠে রূকস্যাক, রাইফেল বুকের সামনে আড়াআড়িভাবে ধরা। ব্যাণ্ড দ্রুত তালে বাজছে। হাঁটু ভাঁজ করে পা বুক সমান উঠিয়ে ওরা মার্চ-পাস্ট করল। শেষে ওদের নিয়ে যাওয়া হলো একটা পাহাড়ের ধারে। পাহাড়ের গা কেটে বানানো হয়েছে বিশাল আকৃতির কমান্ড্রো উইংয়ের প্রতিকৃতি।

শুরু হলো কমাণ্ডোদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সাব মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ে ওদের শপথ করানো হলো। সেদিন রাতে এস.এস.জি-র ঐতিহ্য অনুয়ায়ী ওদেরকে অফিসার্স মেসের ডাইনিং মেম্বার বানানো হবে। সে এক অদ্ভুত কায়দা। অ্যান্টি রূমের ফলস্ সিলিং খুলে ফেলা হলো। মাটি থেকে তেরো-চোদ্দ ফুট উঁচু একটা লোহার বিম দেখা যাচ্ছে। চার-পাঁচজন পুরানো অফিসার মিলে এক একজন নবীন অফিসারকে হাতের ওপর শোয়াল। তারপর ওয়ান, টু, থ্রী বলে নবীন অফিসারকে ছুঁড়ে দিল ওপরে। নবীন অফিসার ওপরে লোহার বিম ধরে ফেলল। দশবার চিন আপ (শরীরকে দুই হাতের জোরে কনুই ভেঙে ওপরে তুলে, বিমের সঙ্গে থুতনি ঠেকানো ও আবার হাত সোজা করে ঝোলা) . ও নিখুঁত ভঙ্গিতে পি.এল.এফ. করে নিচে নেমে এল নবীন অফিসার। তারপর বিশটা বুকডন। এস.এস.জি-র ঐতিহ্য অনুযায়ী নবীন অফিসার অফিসার্স মেসের ডাইনিং মেম্বার হয়ে গেল তখন থেকে। তিনদিন ছুটি পেল ওরা। যাদের বাড়ি কাছে তারা চলে গেল ছুটি কাটাতে। ছুটির তিনটা দিন আনোয়ার সানরূমে তাস খেলে, টিভি দেখে কাটিয়ে দিল। ছুটি শেষে ওকে বদলি করা হলো চেরাট থেকে ৬৩ মাইল দূরে রাওয়ালপিণ্ডি ও পেশওয়ারের মাঝামাঝি টু কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান, আটক ফোর্টে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *