হেল কমাণ্ডো – ১

০১.

গভীর রাত। আকাশে চাঁদের লুকোচুরি। চারদিকে মৃদু বাতাস। ঠিক এমনি এক মায়াময় পরিবেশে দূর কোন্ অরণ্যের মাঝে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি স্নিগ্ধ নদী। একটা স্পীডবোট–সেই নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে কোন দূর অজানায়। আর সেই স্পীডবোটের ওপর তন্ময় হয়ে বসে আছে একজন যুবক।

আনোয়ারের ঠিক এমনি একটি স্বপ্ন ছিল। এমনি এক মধুর জীবনের রঙিন কল্পনায় কার না সাধ জাগে। সাধ ছিল ছোট্ট একটি জীবনের। যেখানে সুখ আছে, দুঃখ আছে, প্রাচুর্য আছে, দৈন্যও আছে। আর আছে এগুলোকে সমানভাবে ভাগ করে নেয়ার মত একজন প্রিয় সঙ্গী, যাকে নিয়ে সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে অস্তাচলগামী সূর্যকে বিদায় সম্ভাষণ জানানো যায়, যাকে নিয়ে সেই স্নিগ্ধ নদীর বুক বেয়ে দূর অজানায় হারিয়ে যাওয়া যায়, যাকে নিয়ে জীবনের সবটুকু পথ অতি সহজেই অতিক্রম করা যায়।

এই রকম একটি জীবন আনোয়ারের জন্য অতিরিক্ত কিছু ছিল না। ছোটবেলা থেকেই কালো রঙের লম্বা গড়নের এই ছেলেটি ছিল খুব মেধাবী। দুচোখের দৃষ্টি ছিল প্রখর। তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির জন্য যে-কোন জটিল জিনিসকে সহজেই আয়ত্তে রাখাটা আনোয়ারের কাছে তেমন কোন কঠিন কাজ ছিল না। সেজন্য পড়াশোনায় ওর বেশ সুনাম ছিল। শিক্ষকরা ওর প্রতি খুবই আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু কি অদ্ভুত পরিহাস! যে আনোয়ার রাতকে ভয় করত–সেই ওকেই কিনা প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে রাতের আঁধারে। কারণ কমান্ডোদের প্রতি নির্দেশই হলো: রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের মত চমক লাগিয়ে তোমার কমাণ্ডো-নাইফ দিয়ে শত্রুর ওপর হামলা করো।

ছুরি নামক বস্তুটাকে সে কতই না ভয় করত। অথচ ছুরিই হলো ওর সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী। একে সঙ্গে নিয়ে ও জীবনে বহু বিপজ্জনক পথ অতিক্রম করেছে। বহু বিপজ্জনক যাত্রার সঙ্গী হয়েছে এই কমাণ্ডো-নাইফ। আনোয়ারের স্বপ্ন ছিল রাতের গভীরে শান্ত সমুদ্রে প্রিয় সঙ্গীকে পাশে বসিয়ে স্পীডবোট নিয়ে কোন অনাবিষ্কৃত দ্বীপের উদ্দেশে ছুটে চলা। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। ও শুধু সাগরের বুক চিরে প্রচণ্ড গতিতে ছুটেই চলেনি, সাগরের অতল গভীরে ডুবও দিয়েছে। তখন ওর সঙ্গী রয়েছে ডুবুরি পোশাক, অ্যাকুয়ালাং স্পিয়ার-গান ও প্রিয় নাইফ। আর ও যে সাগরে ছুটে বেড়িয়েছে, সে সাগরে উত্তাল ঢেউয়ের পরিবর্তে ছিল বিভিন্ন সাইজের ভয়ঙ্কর-দর্শন বোল্ডার, আর সঙ্গী হয়েছে কাঁধের ওপর স্ট্র্যাপ দিয়ে লাগানো ভারী ওজনের প্যাক, সাব মেশিনগান ও কমাণ্ডো-নাইফ।

অদ্ভুত পরিহাস এজন্যই বলছি, যে আনোয়ার পড়াশোনায় ভাল বলে সবাই ধরেই নিয়েছিল, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বেশ কয়েকটা লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ তো হবেই সেই সঙ্গে স্ট্যাণ্ডও করবে। হতও তাই। কিন্তু সবার সে ধারণা আনোয়ারের জীবনে সফল হয়নি। পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর অথবা এই বিভাগের বেশি জোটেনি। ফলে ছাত্র জীবন থেকেই শুরু হয়েছিল সব নাটকীয় পরিবর্তন।

তদানীন্তন পাক-বাহিনীতে আনোয়ার ছিল একটি পরিচিত নাম । আনোয়ার মানেই প্রাণোচ্ছল, কোমলে-কঠোরে মেশানো একটি মন; যে মন অন্যকে সহজেই আপন করে নিত। ও তখন ক্যাপ্টেন। পাক সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমাণ্ডো-ব্যাটালিয়নের একজন অফিসার। তার ছয় ফুট লম্বা, ১৮২ পাউণ্ড ওজনের পেশীবহুল শরীর পাক সেনাবাহিনীর অফিসারদের মুগ্ধতার কারণ ছিল। আদর করে অনেকেই ওকে হেল কমাণ্ডো বলে ডাকত। কেউ কেউ ডাকত লুমুম্বা বলে। তবে সবচেয়ে পরিচিত নাম ছিল কিলু বিলু। যে নামে ও বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহু অফিসারের কাছে পরিচিত। কমাণ্ডো বাহিনীকে যে-কোন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে অভিজাত গ্রুপ বলে গণ্য করা হয়। কারণ, যুদ্ধের সময় কমাপ্তোদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভীষণ বিপজ্জনক ও ঝুঁকিতে ভরা।

ছোটবেলায় এই ধরনের বিপজ্জনক ও গুরুত্বপূর্ণ চাকরি ছিল আনোয়ারের স্বপ্নেরও অগোচরে। কারণ কমাণ্ডো হতে হলে চাই বলিষ্ঠ দেহ, যথেষ্ট শক্তি ও প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতা। কিন্তু এগুলোর কোনটাই ছোটবেলায় ওর ছিল না। ১৯৫৯ সালে আনোয়ার দশম শ্রেণীর ছাত্র। ক্যারম খেলা নিয়ে একজনের সঙ্গে তার সামান্য বিরোধ হয়। সেজন্য প্রতিপক্ষ দুষ্ট ছেলেটা ওকে ভীষণ মারপিট করে। ওর ঠোঁট কেটে, নাক ফেটে রক্ত গড়াচ্ছিল। ওর এই দুরবস্থা দেখে বরকতউল্লাহ নামে ওর এক সহপাঠী বলল, তুই ফি সারা জীবন মারই খাবি? প্রয়োজনে মারকে ঠেকাতেও পারবি না? চল, আজ থেকে তোকে আমার সঙ্গে ব্যায়াম করতে হবে। সহপাঠীর পীড়াপীড়িতে রাজি হতে হলো। আনোয়ার দুর্বল শরীর নিয়ে নতুন ওস্তাদের সঙ্গে এগিয়ে চলল ব্যায়াম-আখড়ার দিকে।

শুরু হলো রীতিমত শরীর চর্চা। ৩৫ দিন অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর জীবনের প্রথম একটি সফল বুক ডন দিল ও। তারপর শুরু হলো অগ্রযাত্রা। দুবছর কঠোর অনুশীলনের পর তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল ক্যারম খেলার সেই সহপাঠীর সঙ্গে যার হাতে সে একদিন প্রচণ্ড মার খেয়েছিল। ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের মনে পড়ে গেল বিগত দিনের সেই স্মৃতি। ধীরে ধীরে সেই সহপাঠীর দিকে এগিয়ে গেল সে। ওকে দেখেই সেই ছেলেটা চমকে উঠল। কারণ এখন আনোয়ারকে দেখেই বোঝা যায়, সে বেশ দৈহিক শক্তির অধিকারী। মৃদু হেসে সেই সহপাঠীকে সে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, ভাল তো? সহপাঠী চমকে উঠে জড়ানো গলায় বলল, হ্য, জ্বি, ভাল আছি। মানে…আপনি কেমন আছেন?

তোমার একটা পাওনা আছে আমার কাছে। সেটা সুদসহ তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার পর আশা করি ভাল থাকব।

সেই সহপাঠী অবাক হয়ে পাওনাটা কিসের জিজ্ঞেস করতেই প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাতে ছিটকে পড়ল। তারপর শুরু হলো আনোয়ারের দেনা পরিশোধের পালা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ছেলেটির নাক মুখ বেয়ে রক্ত পড়া শুরু হলো। তখন আনোয়ার ওকে দাঁড় করিয়ে কলার ধরে বলল, বাড়ি গিয়ে হিসেবটা মিলিয়ে দেখো, ঠিক আছে কিনা। নাউ ইউ গেট লস্ট।

এই সহপাঠী আনোয়ারের জীবনে দুটো জিনিসের পরিসমাপ্তি ঘটাল। তা হলো মার খাওয়া এবং মার দেয়া। এরপর ও আর জীবনে কোনদিন মারামারি করেনি এবং তার দরকারও পড়েনি। পরবর্তী জীবনে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সেই প্রহারকারী এবং শুভানুধ্যায়ী বরকতউল্লাহ, দুজনের কাছেই ও হয় সমানভাবে কৃতজ্ঞ। এরপর আনোয়ার চিটাগাং গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা ভার্সিটিতে পরিসংখ্যানে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হলো। মনে মনে ইচ্ছা ছিল লণ্ডন স্কুল অভ ইকোনোমিক্স থেকে পি. এইচ. ডি. করা অথবা লণ্ডন থেকে অ্যাকচুয়ারী ডিগ্রী নেয়ার। কিন্তু তখনও কি সে জানত, জীবনের মোড়টা এভাবে ঘুরে যাবে? : একদিন আকাশে একটা ফাইটার-প্লেন নানারকম ওলট-পালট করে কসরত দেখাচ্ছিল। তা দেখে আনোয়ারেরও শখ চাপল, সেও পাইলট হবে। সুযোগ বুঝে একবার ইন্টারভিউও দিল। কুইস্ট টেস্ট থেকে শুরু করে সবকিছুতেই সে আশাতিরিক্ত ভাল করল। কিন্তু নিয়তির সেই অদ্ভুত পরিহাস। অল্পের জন্য চোখের ডাক্তারী পরীক্ষায় ও আটকে গেল। ৬/৬ দৃষ্টিশক্তি প্রয়োজন; কিন্তু ওর হলো ৬/৯, অর্থাৎ ঠিক এক ধাপ নিচে। ডাক্তার ওর অন্যান্য পরীক্ষায় এত খুশি হয়েছিলেন যে, পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত তিনিও ওর জন্যে চেষ্টা করেন। তবুও আনোয়ার, পাইলট আনোয়ার হতে পারেনি। হবে কি করে? বিধিই বাম!. ..

১৯৬৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম ব্যাচে যোগদানের চেষ্টা করল আনোয়ার। তখন প্রথম ব্যাচে ভর্তি হতে লাগত অভিভাবকের ছাড়পত্র। এ ছাড়া ভর্তি করা হত না। ছাড়পত্রের জন্যে আনোয়ার চিঠি লিখল তার বাবাকে। বাবা পত্রের উত্তরে জানালেন, তোমার অনার্স ডিগ্রী নেয়ার আর মাত্র এক বছর বাকি আছে। তারপর তুমি যেখানে যাও না কেন আমি নিষেধ করব না। কিন্তু এখন অনার্স ডিগ্রী নিতেই হবে। এই কথায় হয়তো সেদিন বিধাতাও সবার অলক্ষে হেসেছিলেন। কারণ পরবর্তীতে ওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী নেয়া আর সম্ভব হয়নি। আবার বাবার কাছ থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যোগদান করাও সম্ভব হলো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ৩০৬ নং কক্ষে আনোয়ার থাকত। রূমে ওকে পাওয়া যেত রাত এগারোটার পর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে পড়াশোনায় ওর তেমন কোন মনোযোগ ছিল না। কারণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে ওকে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়েই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখাপড়ার প্রতি ওর চরম অনীহা প্রকাশ পেতে থাকল। ক্লাসের সময় ওকে প্রায়ই দেখা যেত কমনরূম, আর্টস বিল্ডিং, ক্যাফেটেরিয়া অথবা কোন সিনেমা হলে।

অনার্স পরীক্ষার আগে আনোয়ার পরীক্ষার ফিস জমা দিতে গিয়ে চমকে উঠল। ক্লাসের হাজিরা রেজিস্টারে ও ডিসকলেজিয়েট। নিয়ম ছিল, শতকরা ষাট ভাগের নিচে হাজিরা থাকলে জরিমানা দিয়ে পরীক্ষা দেয়া যেত। কিন্তু শতকরা চল্লিশ ভাগের নিচে হাজিরা থাকলে জরিমানা দিয়েও পরীক্ষা দেয়া যেত না। কোন উপায় না দেখে এক বন্ধুর পরামর্শে আনোয়ার গিয়ে হাজির হলো বিভাগীয় প্রধানের বাসায়। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন একজন অবাঙালী-নাম ডক্টর আতিকুল্লাহ ডি. এস. সি. । আচার আচরণ ও কথাবার্তায় এমন একটা ভাব ছিল যে তার আশপাশে কোন ছাত্র ভিড়ত না। সেক্ষেত্রে ড. আতিকুল্লাহর বাসায় যাওয়াটা ছিল যে-কোন ছাত্রের জন্য কোন বাঘের গুহায় ঢোকার সামিল। যদিও আনোয়ার তার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। সেও এক স্মরণীয় ঘটনা।

মাঝে মাঝেই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে গলা ছেড়ে গান গাইত আনোয়ার। ড. আতিকুল্লাহ একেক দিন ওর পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতেন। গান শেষ হলে মাথায় টোকা মেরে ইংরেজিতে বলতেন, হোয়াই ডিড ইউ স্টপ? কাম অন, ক্যারি অন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ড. আতিকুল্লাহ যে বিষয় পড়াতেন সে বিষয়ে আনোয়ার ছিল রীতিমত মাস্টার। কারণ পরিসংখ্যানে তাঁর সাবজেক্ট নিউমেরিক্যাল ম্যাথমেটিকসে সে কখনও ৯০% এর নিচে নম্বর পেত না। তবুও ড. আতিকুল্লাহ পুরোপুরি খুশি হতে পারতেন না। তিনি মনে করতেন, আনোয়ারের ১০০% নম্বর না পেলেও ৯৯% নম্বর পাওয়া অবশ্যই উচিত। এ ধরনের পূর্ব পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তার ড্রয়িংরূমে বসে, আনোয়ারের শরীর দিয়ে ঘাম বেরুনোর উপক্রম হলো। কিছুক্ষণ পর তিনি ড্রইংরূমে প্রবেশ করলে ও ঢোক গিলতে গিলতে তাঁকে ওর ডিসকলেজিয়েট হবার কথা বলল। সব শুনে তিনি হেসে বললেন, সি মি ইন দ্য ডিপার্টমেন্ট।

এরপর ওকে সঙ্গে করে তিনি নাশতা করলেন এবং নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে ডিপার্টমেন্টে নামিয়ে দিলেন। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে সহপাঠীরা মন্তব্য করল, আনোয়রের ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট ঠেকায় কে? ফার্স্ট ও ঠিকই হয়েছিল, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় নয় হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে নীরস পার্বত্য-অঞ্চলে কমাণ্ডো ট্রেনিংয়ে ৩৬ মাইল দৌড় প্রতিযোগিতায়, হয়েছিল পঞ্চাশজন অফিসারের মধ্যে আমেরিকায় পাথফাইণ্ডার, রেঞ্জার ও কমাণ্ডো কোর্সে সিলেক্ট হবার পরীক্ষায়।

অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। সবেমাত্র আনোয়ার তিন পেপার পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা খুব একটা ভাল হয়নি। হিসেব করে সে দেখল, গড়ে ৩০% নম্বর আশা করা যেতে পারে। চতুর্থ দিন পরীক্ষা দিয়ে দেখল, একই অবস্থা। সে তখন সামনে সীটে বসা ঘনিষ্ঠ বন্ধু আহসানকে বলল, দোস্ত, আমি আর পরীক্ষা দেব না।

পরীক্ষা তোকে দিতেই হবে। হেড অভ দ্য ডিপার্টমেন্ট থাকতে তোর চিন্তা কি? তাছাড়া তোর ছক্কা মার্কা সাবজেক্টের পরীক্ষা তো এখনও হয়নি, আহসান বলল।

কিন্তু আনোয়ার প্রথম ঘণ্টা যাবার পর খাতায় পরীক্ষা দেব। না এই জাতীয় একটা মন্তব্য লিখে বাথরূমে যাওয়ার নাম করে হল থেকে বের হয়ে এল। ও জানত পরীক্ষা না দিয়ে হলে থাকলে হেড ওকে ঘাড়ে ধরে পরীক্ষার হলে নিয়ে যাবে। তাই মোহাম্মদপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিল।

এদিকে ডিপার্টমেন্টের হেড ড. আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে পরীক্ষার হলে না পেয়ে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। আনোয়ারের সমস্ত সহপাঠী এমন কি ডিপার্টমেন্টের বেয়ারা সুরেশ ও নিয়ামতউল্লাহকেও তিনি আদেশ দিলেন, যেভাবেই হোক আনোয়ারকে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু অত বড় ঢাকা শহরে আনোয়ারকে খুঁজে বের করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বেশ কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর সে পরাজিত সৈনিকের মত বাড়ি ফিরে এল। বাবা সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে ভীষণ দুঃখ পেলেন। তবে পরবর্তীতে অনার্স পরীক্ষায় ভালমত পাস করতে পারলে তার আর কোন দুঃখ থাকবে না–একথাও আনোয়ারকে জানিয়ে দিলেন।

১৯৬৫ সাল। আনোয়ার তখন বাড়িতে বসে আছে। এই সময় পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলো। হঠাৎ করে সেনাবাহিনীতে অফিসার পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হলো। ও কাউকে না জানিয়ে দরখাস্ত করল। বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে যথারীতি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলে জেন্টেলম্যান ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হলো।

কিছুদিন পরের ঘটনা। আনোয়ার তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে সবার সঙ্গে দেখা করতে। সবার সঙ্গে দেখা করে ও গেল ডিপার্টমেন্টের হেড ড. আতিকুল্লাহর সাথে দেখা করতে। ড. আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে দেখে খুশি হলেন। আরও খুশি হলেন, যখন জানতে পারলেন, ও এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। তিনি খুশিতে বলেই ফেললেন, ওয়েল ডান, আনোয়ার, ওয়েল ডান।

এরপর তিনি ওকে কফি অফার করলেন। ঢোক গিলতে গিলতে ও কোনমতে কফি পান করল। এরপর আরেক চমক! তিনি বললেন, আনোয়ার, আই থিংক ইউ স্মোক, এই বলে তিনি ওকে সিগারেট অফার করলেন। ওর তো তখন ভিরমি খাবার জোগাড়। অবস্থা বুঝতে পেরে তিনি আবার বললেন, ডোন্ট বি শাই, আনোয়ার। নাউ, ইউ আর অ্যান অফিসার। কাম অন।

আনোয়ার হেডের বাড়িয়ে দেয়া প্যাকেট থেকে আস্তে করে একটি ফিল্টার টিপড় উঠিয়ে নীরবে ধূমপান করতে লাগল। ধূমপানের ফাঁকে ফাঁকে ড. আতিকুল্লাহ মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ওকে দেখছিলেন। মৃদু হেসে বললেন, তুম্ জবর দোস্ত স্মার্ট হোগিয়া। এই ধরনের কথোপকথন ও অবিশ্বাস্য দৃশ্য ওর সহপাঠীরা (তারা তখন এম. এ., এম. এস.সি. ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র হেডের পেছনের জানালা দিয়ে চোখ ছানাবড়া করে দেখছিল।

আনোয়ার অসমাপ্ত তিন পেপার পরীক্ষার নম্বর দেখতে চাইলে হেড-মার্কশীট আনালেন। মার্কশীট দেখে ও তৃতীয় বারের মত চমকে উঠল। নীরবে মার্কশীটের দিকে চেয়ে থাকল সে। একি অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ওর হিসেবে এত গরমিল? পরীক্ষার সময় ওর সব বন্ধুরা হল থেকে বের হয়ে হিসেব করেছিল, কেউ ৬০% নম্বর পাবে, কেউ ৭০% নম্বর পাবে। আনোয়ার হিসেব করেছিল সে পাবে ৩৫% নম্বর। সেজন্যেই পুরো পরীক্ষা দেয়নি সে। কিন্তু তখন কি আনোয়ার জানত যে হিসাবে কত বিরাট ভুল হচ্ছে? ওর আবাল্য অভ্যাস ছিল প্রাপ্ত নম্বর থেকে অনেক কম আশা করা। তার প্রমাণ বেশ ভাল করেই পেল এই মার্কশীট দেখে। তিন পেপারে ও পেয়েছে গড়ে ৫৮%। ড, আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ডোন্ট থিংক। আই অ্যাম উইথ ইউ। টুমি আবার পরীক্ষা ডিবে।

বিদায় নেয়ার সময় ড. আতিকুল্লাহ হ্যাণ্ডশেক করে বলেছিলেন, আই উইশ ইওর ব্রাইট লাইফ ফুল অভ জাসটিস মাই বয়।

এরপর ড, আতিকুল্লাহর চেম্বার থেকে বের হয়ে এলে বন্ধুরা ওকে বলেছিল, দোস্ত, তুই-ই দেখালি।

ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখ, ১৯৬৫। ঢাকা বিমান বন্দর। সন্ধ্যা। চারদিক আলোয় উদ্ভাসিত। আনোয়ার চলেছে অফিসার হবার জন্য পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলের উদ্দেশে। সেদিন ঢাকা বিমান বন্দরে ওর প্রিয় বন্ধু আহসান, সাজেদ, আহসান উল্লাহ, নাজমুল, আহসান আহমেদ সহ অনেকেই উপস্থিত ছিল। তখনও কি আনোয়ার ভেবেছিল, ওকে উত্তাল সাগরের অতল গভীরে নামতে হবে? ছুটতে হবে রাতের আঁধার পেরিয়ে প্লেন নিয়ে অজানার দিকে? লাফ দিতে হবে অসীম অনন্ত মহাশূন্যে? পেরিয়ে যেতে হবে মালাকান হিলস-এর দুর্লজ্জ প্রাচীর? ওকে হারিয়ে যেতে হবে অসীম বিস্তার মরু প্রান্তরে? দুর্যোগের রাত্রে তুষার-ঝড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে হবে বরফের দেশে? দুবছরের ব্যবধানে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হবে দুহাজার মাইল দুর্গম পথ? প্রতিটি পদে অজানা রহস্য। অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। কুত্তার মাংস ভক্ষণ। চারদিকে শুধু হিম শীতল মৃত্যুর হাতছানি!

একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল আনোয়ার। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল প্লেনের গ্যাংওয়ের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে শেষবারের মত সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। প্রিয় বন্ধুরা বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল অপসৃয়মান প্লেনের দিকে। প্লেন তখন চল্লিশ হাজার ফুট উপরে। ৬৫-এর যুদ্ধের কারণে শ্রীলংকার ওপর দিয়ে ওভার-ফ্লাই করে ঘণ্টায় ছশো মাইল বেগে সে এগিয়ে চলেছে করাচী বিমান বন্দরের দিকে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *