হেলেন কেলার (১৮৮০-১৯৬৮) – যাঁর খ্যাতিকে নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করা হতো
কেবল মনের বল এবং কর্মোদ্যমের মাধ্যমে যাঁরা নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মহিমান্বিত করেছেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন মহীয়সী নারী হেলেন কেলার (Helen Keller)।
জন্মগ্রহণের সময় হেলেন অবশ্য আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর মতোই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মগ্রহণের বছর দেড়েক তিনি আর দশটা শিশুর মতোই দেখতে পেতেন, কানে শুনতেন এবং কথাও বলতে পারতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর জীবনে নেমে এল এক মহাদুর্যোগ। তিনি পড়লেন ভয়ানক অসুখে। ফলে মাত্র উনিশ মাস বয়সে তিনি হয়ে গেলন বধির, বোবা এবং অন্ধ। তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ নয়টি বছর তিনি ছিলেন বাকশক্তিহীন।
অথচ এই মহীয়সী নারীই পরবর্তী জীবনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে বক্তৃতা দিয়ে ফিরেছেন এবং ভ্রমণ করেছেন ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশ।
হেলেন কেলারের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলবানা অঙ্গরাজ্যের তাসকামবিয়া শহরে ১৮৮০ সালের ২৭ জুন। পিতা ক্যাপটেন আর্থার কেলার এবং মা ক্যাথেরিন। আর্থার কেলার ছিলেন সুইডেনের অধিবাসী। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় (১৮৬১-৬২ সালে) তিনি ভাগ্যের অন্বেষণে সুইডেন ছেড়ে চলে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর স্থায়ীভাবে এখানেই বসবাস করতে থাকেন। এখানে আসার পরই হেলেন কেলারের জন্ম হয়।
তাঁর বাল্যজীবন ছিল খুবই দুঃখের। বোবা, কালা আর অন্ধত্বের অভিশাপ নিয়ে তিনি বড় হয়েছেন অবোধ বন্যপ্রাণীর মতো। যা কিছু তাঁর খারাপ লাগত, রাগে-ক্ষোভে ভেঙে চুরমার করতেন। ছোটবেলায় তিনি দুহাতে মুখে খাবার গুঁজে দিতেন বিশ্রীভাবে। অবশেষে অসহ্য হয়ে হেলেনের মা-বাবা তাঁদের মেয়েকে বোস্টনে অন্ধদের এক প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেন। বলতে গেলে এই প্রতিষ্ঠানেই হয় হেলেন কেলারের নবজন্ম মিস অ্যান সুলিভান ( Annie Mansficld Sullivan) নামের একজন শিক্ষিকার কল্যাণে।
অশেষ দরদ আর স্নেহ ভালবাসা দিয়ে সেবাশুশ্রূষা করে সুলিভান হেলেনের জীবনে ঘটান আশ্চর্য পরিবর্তন। তাঁরই চেষ্টায় হেলেন কেলার যেদিন প্রথম কথা বলতে শিখেছিলেন, সেদিন তাঁর যে আনন্দানুভূতি হয়েছিল, সে কথা হেলেন পরবর্তী সময়ে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন।
হেলেন কেলারের যখন সাত বছর বয়স, তখন এক মজার ঘটনা ঘটে। হেলেনের মা ক্যাথেরিন কেলার সেদিন বিখ্যাত লেখক চার্লস ডিকেন্সের ‘আমেরিকান নোট্স্’ (American Notes) পড়ছিলেন। তার থেকেই তিনি জানতে পারেন, বোস্টন শহরে পারকিন্স্ ইনস্টিটিউট নামে একটি হাসপাতালে মূক বধির এবং অন্ধ ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা এবং সেবাশুশ্রূষা করা হয়।
তখন পারকিন্স্ ইনস্টিটিউটের প্রধান ছিলেন মাইকেল অ্যানাগনোস। এই ইনস্টিটিউটেই হেলেন কেলারকে ভর্তি করা হয় এবং তাঁর দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে অ্যান সুলিভানের ওপর। তাঁকে এখানে ভর্তি করা হয় ১৮৮৭ সালের ৩ মার্চ।
প্রথম যখন হেলেনকে এখানে এনে সুলিভানের হাতে তুলে দেওয়া হয় তখন তিনি ছিলেন একেবারেই উন্মাদ এবং মানবাকৃতির একটি জন্তুবিশেষ। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে সুলিভান তাঁকে মানুষ করে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে লাভ করেন অভাবনীয় সাফল্য।
মাত্র বছরখানেকের চেষ্টার ফলেই হেলেন কথা বলতে শেখেন এবং ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রথমে ইংরেজি, তারপর ল্যাটিন, গ্রিক, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মানভাষা শিখে ফেলেন। ১৮৯০ সালের ২৬শে মার্চ ছিল হেলেন কেলারের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। এদিনই তিনি কারো সাহায্য ছাড়াই ‘ইট ইজ ভেরি হট’—চার শব্দের এই বাক্যটি উচ্চারণ করেন।
শুধু ভাষা শেখা নয়, তিনি আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে করেই বাক্য বিনিময় করতেও শেখেন। তিনি শুধু অনুভূতি দ্বারাই তাঁর চারপাশে কে আছে, তার নাম-পরিচয় পর্যন্ত বলে দিতে পারতেন।
তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। এই সময়েই নরওয়ের একটি মূক ও বধির মেয়েকে হাসপাতালের ডাক্তাররা কথা বলাতে সক্ষম হন। এটা দেখে হেলেন নিজেও দাবি পেশ করে বসেন, তাঁকেও যেন কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়।
তারপর তা-ই করা হয় এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সুলিভান মাত্র ১১টি লেসনের মাধ্যমেই হেলেনকে কথা বলাতে সক্ষম হন। হেলেন অসম্ভব দক্ষতায় প্রতিটি লেসন আয়ত্ত করেন এবং কথা বলে ওঠেন।
তিনি সহসাই ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলে ওঠেন, আমি এখন আর বোবা নই (I am not dumb now)।
এর মাত্র মিনিট কয়েক পরই আনন্দিতা হেলেন সুলিভানের হাত স্পর্শ করে দ্বিতীয় বার উচ্চারণ করেন, টিচার (Teacher), অর্থাৎ সুলিভান হলেন হেলেনের শিক্ষিকা।
ইনস্টিটিউটের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৯০০ সালে এবার হেলেনকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় র্যাডক্লিফ কলেজে। চার বছর পড়ার পর এই কলেজ থেকেই তিনি সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে বি. এ. পাস করেন। কলেজের দৃষ্টি ও শ্রবণেন্দ্রিয়সম্পন্ন ছেলেমেয়েদের চেয়েও হেলেন বেশি নম্বর পেয়েছিলেন।
অবশ্য তিনি কলেজে পড়তেন তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে। তাঁর জন্যই বিশেষ ব্যবস্থায় কলেজ কর্তৃপক্ষ পাঠ্যবইসমূহকে ব্রেইল পদ্ধতিতে ছাপার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর লেখা ও পরীক্ষার খাতা দেখার জন্যও অন্ধদের জন্য তৈরি বিশেষ ধরনের টাইপ-মেশিনের ব্যবস্থা করা হয়।
কলেজ শিক্ষকদের পাশাপাশি সুলিভান নিজেও সর্বক্ষণই তাঁর পাশে থাকতেন। তিনিই কলেজের শিক্ষকদের ক্লাসের বক্তৃতা প্রথমে নিজে মুখস্থ করে রাখতেন, তারপর সেগুলো বলে যেতেন আর হেলেন সুলিভানের গণ্ডদেশ স্পর্শ করে সব কথা বুঝে নিতেন। তিনি মানুষের গলার স্বরতন্ত্রের যে কম্পন, সেই কম্পন অনুভব করেই বুঝতে পারতেন গলা দিয়ে কোন্ শব্দ নির্গত হচ্ছে।
তিনি র্যাডক্লিফ কলেজে পড়ার সময়েই আত্মজীবনীমূলক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নাম ‘অপটিমিজম’ (Optimism)। তারপর কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে রচনা করেন ‘দি স্টোরি অব মাই লাইফ’ (The Story of My Life)। কলেজ ছেড়ে আসার অল্প কিছুদিন পরেই প্রকাশ করেন তাঁর তৃতীয় গ্রন্থ ‘দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন’ (The world I Live in)। এর প্রায় একই সাথে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি কবিতার বই “দি সঙ অব দি স্টোন ওয়াল’ (The Song of the Stone Wall)। তিনি তাঁর বইগুলো প্রথমে লিখতেন ব্রেইল পদ্ধতিতে, পরে এগুলোকে স্বাভাবিক হরফে ছাপিয়ে প্রকাশ করা হতো।
তাঁর বইগুলো প্রকাশিত হবার পরপরই কিন্তু দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি এমন এক জগতের কথা লিখতেন, যে জগতের রহস্য কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। এক অজানা অন্ধকারময় জগতের অভিযাত্রীর গল্প সেগুলো। পড়তে পড়তে মানুষের মন এক অজানা অনুভূতি এবং রহস্যময়তায় ভরে উঠত।
আর তা ছাড়া যখনই কেউ জানতে পারতেন যে, এই লেখিকা নিজেই একজন অন্ধ ও বধির, তিনি নিজেই তাঁর অন্ধকার জগতের বাস্তব কথা বলেছেন, তখন পাঠকদের মন আরও কৌতূহলে ভরে উঠত।
হেলেন কেলারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে কিংবদন্তির মতো। এরপর বহু স্থান থেকে তাঁর কাছে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ আসত। তিনি সব অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বক্তৃতা দিতেন। তবে সর্বক্ষণই তাঁর পাশে থাকতেন সুলিভান।
কিন্তু এর মধ্যে একটি অসুবিধা দেখা দিল। সুলিভান ম্যাকি নামের এক লোককে বিয়ে করে সংসার পেতে বসলেন। বিয়ের পরেও সুলিভান তাঁর ছাত্রী হেলেনের সাথে থাকতে চেষ্টা করতেন। তবু তাঁর নিজের একটি সংসার আছে, তাই সর্বক্ষণই থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সুলিভান নিজেই হেলেনের সহযোগিনী হিসেবে দুটি মেয়েকে নিয়োগ করলেন।
তখন হেলেন বই লেখা এবং বক্তৃতা দেওয়াকেই নিজের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বিয়ে হলেও সুলিভান প্রত্যেক অনুষ্ঠানেই হেলেনের সাথে থাকতেন এবং তাঁর বক্তৃতা ব্যাখ্যা করে শ্রোতাদের শোনাতেন।
তারপর দেখা দিল আরেক বিপদ। সুলিভান এবার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিশক্তি আগে থেকেই দুর্বল ছিল, এবার আরও খারাপ হয়ে গেল। প্রায় অন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো তাঁর।
তখন বাধ্য হয়ে সুলিভানের মতো একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলার দরকার পড়ল হেলেনের জন্য, তাঁর একান্ত সহকারিণী হিসেবে যিনি কাজ করবেন।
অবশেষে পাওয়া গেল সেই কাঙ্ক্ষিত মহিলাকে। স্কটল্যান্ডের পলি থমসন (Polly Thomson) নামের এক মহিলাকে নিয়োগ করা হলো হেলেন কেলারের প্রাইভেট সেক্রেটারি কাম কেয়ারটেকার হিসেবে।
১৯১৮ সালে হলিউড থেকে হেলেন কেলারের কাছে তার ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব এলো। এই চলচ্চিত্র নির্মিত হবে তাঁর নিজেরই অন্ধকার জগতের কাহিনী নিয়ে।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, হেলেন কেলার সত্যি সত্যি একটি চলচ্চিত্র তৈরি করে ফেললেন। ‘ডেলিভারেন্স’ (Deliverance) নামের এই চলচ্চিত্র অন্ধ ও বধির নায়িকার ভূমিকায় হেলেন কেলার নিজেই অভিনয় করলেন।
হেলেন কেলারের অন্যতম গুণগ্রাহী এবং বন্ধু ছিলেন টেলিফোন আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। কারণ গ্রাহাম নিজেও ছিলেন মূক ও বধির স্কুলের শিক্ষক।
তিনি হেলেন কেলার এবং সুলিভানকে নানাভাবে সহযোগিতা করতে লাগলেন। গ্রাহাম বেল নিজেই দিতে লাগলেন প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য। তারপর হেলেনকে যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রদেশে ঘুরিয়ে আনা হলো। সেসব স্থানেও হেলেন বক্তৃতা দিলেন।
দেশভ্রমণ করতে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে বহু বিশ্বখ্যাত ব্যক্তির। তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, অ্যান্ড্রু কার্নেগি, স্যার হেনরি আরভিং, মার্ক টোয়েন (Mark Tawin)-এর মতো ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। হেলেন তাঁদের গণ্ডদেশ স্পর্শ করেই তাঁদের বক্তব্য বুঝে নিয়েছেন এবং তাঁদের কথার উত্তর দিয়েছেন।
হেলেনের এই অনুভূতি জাত ক্ষমতা ছিল সত্যি এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি কারও গণ্ডদেশে হাত বুলিয়ে বলতে পারতেন তাঁর সামনের লোকটি কী বলছেন। তাঁর হাত স্পর্শ করে বলতেন তিনি কে, কী নাম বা তাঁর বংশপরিচয় কী? তিনি শুধু ফুলের গন্ধ শুঁকেই বলতে পারতেন ওটা কী ফুল।
কিন্তু এই যে নিষ্পাপ, পবিত্র ও বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারিণী হেলেন কেলার, তাঁরও শত্রু ছিল। অনেকে তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভা এবং জনপ্রিয়তাকে হিংসার চোখে দেখতেন। অনেকে তাঁর প্রতিভাকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করতেন।
কেউ কেউ বলতেন, তিনি আসলে অন্ধ বা বধির ছিলেন না, তিনি ছিলেন একান্তই স্বাভাবিক মানুষ। তিনি অন্ধ বা বধিরের ভান করতেন মাত্র।
আবার কেউ কেউ বলতেন, হেলেন কেলার ছিলেন আসলে এক বোকা মহিলা। সব কারসাজি অ্যান সুলিভানের। হেলেন ছিলেন আসলে সুলিভানের হাতের নাচের পুতুল। তিনি যা শিখিয়ে দিতেন, হেলেন তাই হুবহু অনুকরণ করতেন মাত্র। এখানে হেলেনের নিজস্ব কোনো কৃতিত্ব নেই। একটি নাচের পুতুল যেমন করে অন্তরালে বসে থাকা আসল খেলোয়াড়ের হাতের আঙুলের সুতোর টানে নাচে, এখানেও তেমনি নাচতেন হেলেন। নাচের পুতুলের মতোই। এখানেও হেলেনের নিজস্ব ক্ষমতা বলে কিছু নেই।
কিন্তু হেলেন কেলারের বেলায় নিন্দুকদের এই অভিযোগ সত্যি নয়। তারা হেলেনকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারতেন না বলেই তাঁর সম্পর্কে তাঁর ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতেন।
গ্রাহাম বেলের মৃত্যুর এক বছর পরে ১৯২৩ সালে হেলেন কেলার আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর দি ব্লাইন্ড-এ যোগদান করেন। যুদ্ধে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন এমন অনেক সৈনিক সেখানে আসতেন। হেলেন তাঁদের জন্য ছিলেন প্রধান অবলম্বন। তিনি তাঁদেরকে অন্ধকারে কীভাবে চলতে হয়, তা শেখাতেন। তিনি অন্ধ ব্যক্তিদের চলাফেরার এমন একটি পদ্ধতি বের করলেন যা একজন অন্ধকে দান করতে পারে নতুন জীবন। ১৯৩৬ সালে হেলেনের শিক্ষিকা সুলিভান নিজেই সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। তখন হেলেন নিজেই তাঁর দেখাশোনা করতে শুরু করেন। সুলিভান অন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মারাও যান। সুলিভানের মৃত্যুর পর অনেকে ধারণা করেছিলেন, এবার হয়তো হেলেন সত্যি সত্যি অসহায় হয়ে পড়বেন।
কিন্তু তা হয়নি। তিনি দিব্যি একাই চলতে-ফিরতে পারতেন। তিনি তখন স্বাবলস্বী হয়ে উঠেছেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুদ্ধে আহত এবং অন্ধ হয়ে যাওয়া সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য হেলেন তাদের কাছে ছুটে গেলেন, এবং নিজের অন্ধকার জীবনের গল্প বলে তাদের সান্ত্বনা দিতে থাকেন। তাদের নির্বিঘ্নে চলাফেরার প্রশিক্ষণও দিতেন তিনি। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অন্ধ মানুষদের সমাবেশে তাঁর বক্তৃতা দেয়ার কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। তিনি বক্তৃতা-সফরে ঘুরে বেড়ান বিশ্বের বহু দেশ।
হেলেন কেলার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক ও মনীষী মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটো চরিত্র হলো সম্রাট নেপোলিয়ন এবং হেলেন কেলার।” মার্ক টোয়েন এও বলেছিলেন, “জোয়ান অব আর্কের পর ধরিত্রীর বুকে এমন গুণবতী নারী বিরল।” শুধু ঊনবিংশ শতাব্দী নয়, এই বিংশ শতাব্দীতেও হেলেন কেলার পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তিদের একজন। অথচ তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ। তারপরও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন বহু জ্ঞানীলোকের চেয়ে তিনি অধিক বই পড়েছেন।
অনেকে বলেন, অন্ধদের জীবন সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু হেলেন কেলারই তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, অন্ধদের জীবন অভিশপ্ত নয়। দৃষ্টিহীনতা, বধিরতা জীবনের উন্নতির জন্য কোনো বাধা নয়।
পরিপূর্ণ অন্ধকার এবং নিস্তদ্ধতা তাঁর জীবনকে জগতের আলোময় ও কলকোলাহলমুখরিত জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বটে, কিন্তু স্তদ্ধ করে দিতে পারেনি।
এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয় ১৯৬৮ সালের ১ জুন।