হেলেন কিলার : যাকে নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল
জন্মগ্রহণের সময় হেলেন কিলার ছিলেন একটি স্বাভাবিক শিশু। তাঁর জীবনের প্রথম দেড়টি বছর অন্যান্য শিশুদের মতোই দেখতে ও শুনতে পেতেন এমনকি কথাও বলতে পারতেন। হঠাৎ করে এক মহাদুর্যোগ দেখা দিল তার জীবনে। তিনি ভয়ানক অসুখে পড়লেন। মাত্র উনিশ মাস বয়সেই হয়ে গেলেন বধির, বোবা এবং অন্ধ। তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ নয়টি বছর তিনি বাকশক্তিহীন ছিলেন। অথচ এই মহিলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে বক্তৃতা করেছেন এবং ইউরোপের সব দেশ ভ্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ছোটবেলায় অবোধ বন্যপ্রাণীদের মতো তিনি বড় হতে থাকলেন বোবা, কালা ও অন্ধত্বের অভিশাপ নিয়ে। যা কিছু তার খারাপ লাগত তাই ভেঙে তছনছ করে ফেলতেন। তিনি দু-হাত দিয়ে মুখে খাবার খুঁজতেন; এ অভ্যাস শুধরাবার চেষ্টা করলে তিনি রাগে হাত পা ছুঁড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিতেন আর চিৎকার করে কাঁদার চেষ্টা করতেন।
অবশেষে হেলেন কিলারের অসুখী বাবা-মা বোস্টনের একটি অন্ধ প্রতিষ্ঠানে হেলেন কিলারকে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে এ্যান মেনসফিল্ড সুলিভান নামক এক মহিলা হেলেন কিলারকে সারিয়ে তোলার ও শিক্ষাদানের অসম্ভব কাজটির দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। মিস্ সুলিভানের বয়স ছিল তখন মাত্র কুড়ি। নিজের জীবনটা ছিল অত্যন্ত দুঃখময় ও দারিদ্র্যপূর্ণ।
এ্যান সুলিভান ও তার এক ছোট ভাইকে ম্যাসাচুসেট্স-এ এক দরিদ্র ভবনে পাঠানো হয়েছিল। দরিদ্র ভবনে এত বেশি গরিব ছেলেমেয়ে থাকত যে, ওদের দুজনকে মৃতের ঘরে ঘুমুতে হত, এ ঘরে যেসব মৃতব্যক্তিকে কবর দেয়া হবে তাদেরকে রাখা হত। ছ’মাস পরে সুলিভানের ছোটভাইটি মারা যায় দরিদ্র ভবনে। আর সুলিভান ও চৌদ্দ বছর বয়সে প্রায় অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। যার জন্য তাকে পরে অন্ধ প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। এ্যান সুলিভান সেখানে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান এবং পরবর্তীতে হেলেন কিলারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
এ্যান সুলভান কীভাবে হেলেন কিলারের মধ্যে অলৌকিক পরিবর্তন ঘটালেন এবং তার মনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন তা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। হেলেন কিলারের লেখা আমার জীবন কাহিনী’তে উদ্ধৃত আছে, যেদিন হেলেন কিলার প্রথম কথা বলতে শিখলো সেদিনের তার আনন্দটি অপরিমেয়।
হেলেন কিলারের বয়স যখন বিশ বছর, লেখাপড়ায় তিনি যথেষ্ট অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি রেডক্লিক কলেজে ভর্তি হন। তিনি কেবল শিখতে ও পড়তে পেরেছিলেন তা নয়, তার বাকশক্তিও ফিরে পেয়েছিলেন। তিনি যে বাক্যটি প্রথম শিখলেন তা হল—’আমি এখন আর বোবা নই।‘ কথাগুলো বলতে পারার আনন্দে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন।
মার্ক টোয়েন বলেছেন, উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি চরিত্র হল সম্রাট নেপোলিয়ান এবং হেলেন কিলার। আজ এ বিংশ শতাব্দীতেও হেলেন কিলার পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে বিরাজ করছেন। হেলেন কিলার ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ; কিন্তু দৃষ্টি শক্তিসম্পন্ন বহু লোকের চেয়েও তিনি অধিক সংখ্যক বই পড়তে সক্ষম হয়েছেন। একজন সাধারণ মানুষের চেয়েও একশ গুণ বেশি বই পড়েছেন এবং নিজেও লিখেছেন এগারোটি। নিজের জীবনকাহিনী অবলম্বনে তিনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং তাতে অভিনয়ও করেছেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় তিনি বধির হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ সুস্থ লোকের চেয়েও তিনি সঙ্গীত উপভোগ করতেন বেশি। তিনি এখন সামান্য বিদেশী উচ্চারণে কথা বলতে পারেন। হেলেন কিলার যখন হাঁটেন তখন প্রায়ই আপন মনে কথা বলেন কিন্তু আপনার আমার মতো ঠোঁট নাড়েন না, বরং আঙুল নেড়ে সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজের সাথে কথা বলেন। অনেকে মনে করেন যে, যেহেতু তিনি অন্ধ, তার হয়তো রহস্যজনক ষষ্ঠেন্দ্রিয় আছে। তার আরেকটি অন্ধুত দক্ষতা ছিল, তা হল তার বন্ধুরা যখন তার সাথে কথা বলত, তারা কী বলত তা তিনি তাদের ঠোঁটের উপর আলতোভাবে আঙুল রেখে বুঝতে পারতেন।
তিনি পিয়ানো বা বেহালার কাঠের উপর হাত রেখে সঙ্গীত উপভোগ করতেন। গায়কের গলার উপর আলতোভাবে নিজের আঙুল রেখে গান উপভোগ করতেন এমনকি কেবিনেটের অনুকম্পন অনুভবের মাধ্যমে রেডিও শুনতেন! যদি হেলেন কিলার আজ আপনার সাথে পরিচিত হতে গিয়ে করমর্দন করেন এবং পাঁচ বছর পর আপনার দেখা হয় এবং করমর্দন করেন; ওই করমর্দন দ্বারাই তিনি আপনাকে মনে করতে ও চিনতে পারবেন এবং আরো বলতে পারবেন আপনি ক্রুদ্ধ নাকি সন্তুষ্ট ছিলেন, নাখোশ ছিলেন না খুশি ছিলেন।
হেলেন কিলার সাঁতার কাটতেন এবং নৌকা বাইতে পারতেন। তিনি জঙ্গলের মধ্যদিয়ে অত্যন্ত দ্রুত বেগে ঘোড়া চালাতে পছন্দ করতেন। তিনি চেকারস ও দাবা খেলতেন এমনকি তাস দিয়ে সলিটেয়ার খেলতেন। বৃষ্টির দিনে তিনি সেলাই করতেন অথবা কুরুশ কাঁটা দিয়ে কাপড় বুনে সময় কাটাতেন। আমাদের সবার ধারণা, অন্ধ হওয়াটা মানুষের জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু হেলেন কিলার এটাকে কখনো দুর্ভাগ্যজনক মনে করেন নি। শুধু এক পরিপূর্ণ অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা তাকে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কারণে বন্ধুসুলভ মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে না পাওয়ার ব্যথা হেলেন কিলারকে সবসময় পীড়া দেয়।