হেলেঞ্চাপোতার ফুটবলার

হেলেঞ্চাপোতার ফুটবলার

আমাদের হেলেঞ্চাপোতা গ্রামকে এককথায় একটা ভিরকুট্টি গ্রাম বলা যায়। কী নেই আমাদের গ্রামে? দু-দশটা গ্রামে ভূত তাড়ানোয় যেমন খুব নাম হয়েছে কবন্ধ দাসের। তিনি ভূত সংক্রান্ত যে কাজেই যান, সবসময় তাঁর কাঁধের কালো লম্বা ঝোলায় ভূত তাড়ানোর মন্ত্রের খাতা থেকে শুরু করে বোতলবন্দি ভূত, সবই থাকে।

তেমনি গোটা হরিণভাসা ব্লক জুড়ে সাপ ধরে বেড়ান আমাদের গ্রামের অহিভূষণ কামিলা। তাঁর সাপ ধরার দক্ষতা দেখে নিখিল বঙ্গ সাপুড়ে সমাজ তাঁকে ‘ভুজঙ্গশ্রী’ উপাধি দিয়ে নিজেরাই ধন্য হয়েছে। তিনি যেখানেই যান, সবসময় তাঁর গলায় পেঁচিয়ে থাকে দু-তিনটে বিষাক্ত সাপ। তিনি বলেন, এগুলো নাকি তাঁর পোষা সাপ!

আবার পাঁচ-সাতটা গ্রামে শুধু আঠাকাঠি পেতে সারাদিন পাখি ধরে বেড়ান পক্ষীন্দ্র মহাকাল। যদিও পাখি ধরা এখন পুরোপুরি বেআইনি। তবুও পক্ষীন্দ্রের পাখি ধরার কৌশল নাকি নন্দনতত্ত্বের সীমা স্পর্শ করেছে। তাঁর দুটো কাঁধকে দাঁড়ের মতো মনে করে বসে থাকে একটা শালিক আর একটা চড়াই পাখি। তিনি বলেন, এই পাখিগুলোই নাকি তাঁকে পুষেছে।

মহকুমা স্তর ছাপিয়ে জেলা স্তর পর্যন্ত নানা ফাংশানে গায়নদারির বরাত পায় মধুমাধবী অধিকারী। তিনি যেকোনো ফাংশনে গেলে নিজে-নিজেই তাঁর নামের আগে ‘সংগীতচূড়ামণি’ কথাটা ব্যবহার করছেন আজকাল। তিনি যেখানেই যান, সঙ্গে নিয়ে যান একটা ডিভিডি প্লেয়ার আর খানকয়েক তাঁরই গানের সিডি। সুযোগ পেলেই সেগুলো বাজিয়ে লোককে শোনান।

একজন খুব নামি লেখক আছেন আমাদের গ্রামে। তিনি হলেন লেখনকান্তি সান্ধ্যকী। তাঁর খ্যাতি গ্রাম, মহকুমা ছাড়িয়ে জেলাতেও পৌঁছে গেছে। প্রথম দিকে নিজের পয়সায় বই ছাপলেও, এখন তাঁর বই বিক্রি হয় হু হু করে। তিনি যেকোনো সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে অন্তত এরকম দাবি করেন। কাঁধের ব্যাগে নিজের লেখা বই দু-চারখানা নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়ান। সুযোগ হলে ধরে ধরে লোককে শোনাতেও ছাড়েন না।

এখন বাজনদার হিসেবে ঝনাৎচন্দ্র সরখেলকে না হলে যেকোনো রাজনৈতিক দলের বিজয় মিছিলের গ্ল্যামার থাকে না। তাই ছোটো-বড়ো ফাংশন থেকে বিজয় মিছিল, সবেতেই তাঁর ডাক বাঁধা। দূর থেকে শুনে ওটা কার বাজনা এ নিয়ে যদি কারও সংশয় তৈরি হয় মনে, তখন পাশের লোকটিই বলে দেয়, ‘ঝনাৎচন্দ্র দাস ছাড়া এ বাজনা কে বাজাবে মশাই?’

কবিরাজ ভেষজেন্দু কান্ডারের মোবাইলে আজ ফোন আসে রাজ্যপালের সেক্রেটারির চিকিৎসার জন্যে, তো কাল খোদ প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী ফোন করে ডেকে পাঠান। তিনি যখনই যেখানে যান না কেন, তাঁর হাতব্যাগে সবসময় থাকে খলনুড়ি আর নানা রকমের শিকড়বাকড়।

খোদ রাজ্য সরকার এবারই ‘ব্যায়ামভূষণ’ শিরোপা দিয়েছে অঙ্গচালন ধরকে। তিনি খুব ছোটোহাতা জামা পরেন। এর আর কোনো কারণ নেই, যাতে তাঁর বাইসেপটা লোকে একনজর তাকালেই দূর থেকে দেখতে পায়।

আমাদের গ্রামে এত গুণী মানুষজন আছেন বলে আমরা গর্ব করতেই পারি। কিন্তু দুটো জিনিসের অভাব আমাদের সে-গর্বের পথে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের গ্রামে একজন ভালো শিক্ষক আর একজন ভালো ফুটবলারের অভাব ছিল।

বিনোদবিহারী প্রাইমারি স্কুল আর হেলেঞ্চাপোতা জুনিয়ার হাই স্কুল, দুটো স্কুল আছে আমাদের গ্রামে। শুধু একজন যোগ্য শিক্ষক নেই বলে জুনিয়ার হাই স্কুলকে হাই স্কুলে উন্নীত করা যাচ্ছিল না। রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের ফাইলে বেশ কিছুদিন ধরে সেই সুপারিশের কঠিন বন্দিদশা চলছিল। সে নিয়ে হেলেঞ্চাপোতা গ্রামের অধিবাসীদের খেদেরও অন্ত ছিল না।

প্রাইমারি স্কুল থেকে জুনিয়ার হাই স্কুলে যেতে হলে এখন পাস-ফেলটা কোনো ম্যাটার করে না। কিন্তু যেটা ম্যাটার করে তা হল, আমাদের সামনে বিস্কুটদৌড়ের বিস্কুটের মতো অধরা হয়ে ঝুলতে থাকা ‘ভালো শিক্ষক’ কথাটা। আমাদের ছোটোদেরই ভালো শিক্ষক হয়ে গ্রামের দৈন্যদশা ঘোচাতে হবে, এমন আদর্শের আর অনুপ্রেরণার কথা আমাদের ক্লাস ফাইভ থেকে শোনা শুরু হয়। কিন্তু ভালো শিক্ষকের অভাব মেটানোর চেষ্টা সফল করে তোলা যে খুবই কঠিন কাজ, তা আমরা ইতিমধ্যেই টের পেয়েছি। চেষ্টা করলে হয়তো একজন ভালো ফুটবলার হওয়া যায়। তবু ভালো শিক্ষক কথাটা এমন তীক্ষ্ণ খাঁড়ার মতো আমাদের মাথার উপর ঝুলছিল যে, এতদিন অন্য কোনো দিকে তাকানোর ফুরসত হয়নি আমাদের।

ভালো শিক্ষকের অভাবের কথাটা কে যে কবে রটিয়ে দিয়েছিল এখন আর তাকে খুঁজে বের করা মানে খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার শামিল। তবে গর্বের কথা, এখন ভালো শিক্ষকের সেই অভাবও মিটেছে। আমাদের হেলেঞ্চাপোতা জুনিয়ার হাই স্কুলের হেডমাস্টারমশাই অনন্তচরণ সামন্ত আজ তিন বছর হল রাষ্ট্রপতির হাত থেকে জাতীয় শিক্ষকের শিরোপা নিয়ে এসেছেন।

এখন হেডস্যারকে নিয়ে আমরা পাঁচ-সাতটা গ্রামে গর্ব করে বেড়াই। তাঁরই জাতীয় শিক্ষক হওয়ার সুবাদে আমাদের জুনিয়ার স্কুল এখন হেলেঞ্চাপোতা হাই স্কুল।

আর শুধু একটি মাত্র অভাব এখন পূরণ হতে বাকি। সেটি হল, একজন ভালো ফুটবলারের অভাব। আমাদের হেলেঞ্চাপোতা ফুটবল টিম যেখানেই খেলতে যায়, ভালো ফুটবলারের অভাবে প্রতি খেলাতেই হেরে আসে। কোথাও এক-দু-গোলে হারে, কোথাও পাঁচ গোলে। একবার ব্লক পর্যায়ের ফাইনাল খেলায় ঝঞ্ঝাটপুর একাদশের সঙ্গে হেলেঞ্চাপোতা ফুটবল টিম দশ গোলে হেরেছিল দু-বছর আগে। সেটাই হেলেঞ্চাপোতা ফুটবল টিমের হারার সেরা রেকর্ড।

আমাদের স্কুলের ক্লাস এইট থেকে টেনের ছেলেদের ডেকে এর আগে একটা মিটিং হয়ে গেছে স্কুলের মাঠে। প্রধান উদ্যোক্তা অনন্তস্যার। সেবার অতিথিরা ব্যস্ততার জন্যে সকলে মিটিংয়ে এসে পৌঁছোতে পারেননি। আর পনেরো দিন পরেই তো ব্লক স্তরের ফুটবল ম্যাচের ফাইনাল। এবারও ফাইনালে উঠেছে সেই ঝঞ্ঝাটপুর আর হেলেঞ্চাপোতা। যেটুকু প্রস্তুতি নেওয়ার তা এখনই নিতে হবে। তাই আজ আবার মিটিং ডাকা হয়েছে স্কুলের মাঠেই। ক্লাস এইটের আমি, ভোলা, বিল্টু, অনিমেষ, মনোজ, নবারুণ সকাল থেকে বেঞ্চ সাজানো থেকে ডায়াস বাঁধায় কোনো খামতি রাখিনি। আমাদের মধ্যে অকুলেন্দু দারুণ গাছে উঠতে পারে। সে মাঠের পাশের কদম গাছের উঁচু ডালে মাইক বেঁধে এইমাত্র নেমে এসেছে।

তিনটেয় মিটিং। অনন্তস্যার অনেক আগেই এসে গেছেন। একটু পরে এলেন স্কুলের গেমস টিচার সুবলস্যার। ছেলেরাও অনেকে এসে গেছে। অন্য মাস্টারমশাইরাও চলে এসেছেন। দেখতে দেখতে ভিড় জমে যাচ্ছে। অতিথিদের মধ্যে প্রথমেই চলে এলেন অঙ্গচালন ধর। তাঁর একটু মোটাসোটা চেহারা বলে তাঁকে একটা বৃহৎ চেয়ারে বসানো হয়েছে। তারপর এলেন ঝনাৎচন্দ্র সরখেল। তাঁর একটু পরেই অহিভূষণ কামিলা আর কবন্ধ দাস একসঙ্গে হাজির হলেন।

মিটিংয়ে গণ্যমান্যদের উপস্থিতির স্রোত দেখে অনন্তস্যারের চোখে-মুখে একটা আশ্চর্য আলো ছড়িয়ে পড়েছে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব তদারক করছেন। দেখতে দেখতে চলে এলেন পক্ষীন্দ্র মহাকাল। ক্লাস নাইন-টেনের দাদারাও প্রায় সকলে এসেছে। গ্রামবাসীদের ভিড়ে উপচে পড়ছে সভাস্থল।

দেখলাম, ক্লাস নাইনের প্রণতিদি স্কুলের অফিসঘরের দিক থেকে আসছে। তার পিছন পিছন ভোলা। সে হারমোনিয়াম বয়ে নিয়ে আসছে। অনন্তস্যার বলে দিয়েছেন, প্রণতিদি উদবোধনী সংগীত গাইবে।

অনন্তস্যার ঝনাৎচন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যেকোনো শুভ ব্যাপারে গান দিয়ে শুরু করাটাই সমীচীন! বলুন, ঠিক কি না?’

এমন সময় এসে ঢুকলেন মধুমাধবী অধিকারী। গানের আয়োজন দেখে তিনি যার পর নাই পুলকিত হয়ে বললেন, ‘এভাবেই তো নতুন প্রতিভাকে স্বাগত জানাতে হবে।’

অনন্তস্যার তাঁকে শুধরে দিয়ে বললেন, ‘না, মানে এটা তো আর গানের প্রতিযোগিতা নয় মধুমাধবীবাবু। তাই নতুন প্রতিভা-টতিভা নিয়ে কিছু নয়। একটা গান দিয়ে আমাদের আজকের যাত্রা শুরু করতে চাইছি।’

তিনি একটু সংকুচিত হয়ে বললেন, ‘আহা, ওই আর কী!’ গান হল উৎকৃষ্ট জিনিস। ওই যে ‘নাদব্রহ্ম’ বলে সংগীতে একটা কথা আছে না…?’

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অনন্তস্যার ছুটলেন ডায়াসের দিকে। তাঁর পিছন পিছন ছুটলেন গেমস টিচার সুবলস্যার। তিনটে বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। সবসময় অনন্তস্যার টাইম মেন্টেন করেন। অগত্যা মধুমাধবী অধিকারীর সংগীততত্ত্বের ব্যাখ্যা মাঝপথে থেমে গেল।

টেবিলের উপর হারমোনিয়াম রেখে দিয়েছিল ভোলা। প্রণতিদি উদবোধনী গান গাইল, ‘তোরা শুনিসনি কি শুনিসনি তার পায়ের ধ্বনি, ওই যে আসে, আসে, আসে।’ প্রণতিদির গান শুনে আমরা যারা চমকে-দেওয়া ফুটবল টিমে ঢুকে পড়তে পারি বলে অনেক আশা নিয়ে বসে আছি, আমরা খুবই উদ্দীপিত হয়ে উঠলাম।

অনন্তস্যার মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন, ‘আমাদের গ্রামে সমস্ত ক্ষেত্রে কত গুণীজন আছেন। ইতিমধ্যেই তাঁদের দক্ষতা এবং কৃতিত্বের পরিচয় আমরা পেয়েছি। তাঁরা তাঁদের অমূল্য সময় খরচ করে আজ আমাদের এই জনসভায় উপস্থিত হয়েছেন। আপনারা জানেন, শুধু একটি মাত্র বিষয়ে আমাদের গ্রাম পিছিয়ে আছে। সেটি হল ফুটবল। অন্তত একজন ভালো ফুটবলার আমাদের গ্রাম থেকে তৈরি করতেই হবে। এই একটি বিষয়ে যদি আমরা কৃতিত্ব দেখাতে পারি, তা হলে আমাদের হেলেঞ্চাপোতা গ্রাম গোটা জেলায় একটা আদর্শ গ্রাম হয়ে উঠতে পারে। বলা যেতে পারে, সেঞ্চুরির চেয়ে আর মাত্র এক রান দূরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এবার অনেক লড়াই করে আমরা ব্লক স্তরে ফাইনাল পর্যন্ত এসেছি। ক্লাস এইট থেকে টেনের ছেলেদের নিয়ে আমরা একটা দুর্দান্ত ফুটবল টিম গড়ে এবার ফাইনাল খেলতে যাব। আমরা এবার জয় ছিনিয়ে আনবই। আজই মিটিংয়ের পর আমাদের গেমস টিচার সুবলবাবু ফাইনাল খেলার জন্যে ফুটবল টিম ঘোষণা করবেন। তার আগে আমি আজকের অতিথিদের প্রত্যেককেই উৎসাহদান ভাষণ রাখতে অনুরোধ করছি।’

এবার ভাষণ দিতে এলেন ভূতবিশারদ কবন্ধবাবু। তিনি কাঁধে ভূত-ভরতি চিরাচরিত ঝোলা নিয়ে ডায়াসে এলেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার মনে হয়, ভূতেদের স্পিরিটটাকে তোমরা ফুটবলেও কাজে লাগাতে পারো। ভূত যেভাবে শাঁ শাঁ করে এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় নিমেষে পৌঁছে যায়, বল পায়ে তোমাদেরও বিপক্ষ দলের সীমায় ঢুকে পড়তে হবে সেইভাবে…।’

ডায়াসের ওধার থেকে অনন্তস্যার কী যেন ইঙ্গিত করলেন। বক্তব্যের মাঝপথে নেমে এলেন কবন্ধবাবু। তাতেই প্রচুর হাততালি পড়ল। ফুটবল আর ভূতকে একাকার করে ফেলেছেন বলে কিনা কে জানে!

এর পর তিনটে সাপ গলায় জড়ানো অবস্থায় বক্তব্য রাখতে ডায়াসে উঠলেন অহিভূষণবাবু। ছোটোরা ভয়ে ডায়াসের সামনে থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে সরে গেল। তিনি বললেন, ‘সাপের পেঁচিয়ে ধরা কী জিনিস, হুটোপাটির জঙ্গলে আমি নিজের চোখে দেখেছি। বিপক্ষ দলের গোল পোস্টটাকে সেইভাবে সব প্লেয়ার দিয়ে পেঁচিয়ে ধরতে হবে। তা হলে দেখবে গোলের বন্যা বইবে।’

সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ করে বসতেই না বসতেই মাইক্রোফোনের সামনে এলেন দু-কাঁধে দু-টো শালিক পাখি নিয়ে পক্ষীন্দ্রবাবু। তাদের কিচিরমিচির শব্দ মাইক্রোফোন ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে। সেই সঙ্গে ছোটোদেরও কিচিমিচি শোনা গেল। তিনি শুরু করলেন, ‘পাখিরা বুঝতে পারে বিপদ তাদের দিকে ধেয়ে আসছে কি না। তেমনি তোমাদেরও মাঠের মধ্যে থেকে বুঝতে হবে বিপক্ষ দল অ্যাটাকে উঠছে কি না। অমনি সেই মতো প্রতিরক্ষা সাজিয়ে ফেলবে। দেখবে বিপক্ষ একটাও গোল দিতে পারবে না। তারপর সুযোগ বুঝে পালটা অ্যাটাক করলেই, গোল দেওয়া আটকায় কে?’

তাঁর পরপরই ডায়াসে এসে দাঁড়ালেন সংগীতের দিকপাল মধুমাধবীবাবু। টেবিলের হারমোনিয়ামটা ঠেলে সরিয়ে তাঁর ডিভিডি প্লেয়ার আর সিডিগুলো রাখলেন। তারপর বললেন, ‘তোমাদের বলি, সংগীতের সঙ্গে ফুটবলের বিশেষ কোনো তফাত নেই। গানের শুরুতে যেমন স্থায়ী, তারপর অস্থায়ী, পরে অন্তরায় যেতে হয়। ফুটবলেও তেমনি, সেন্টার লাইন থেকে ধীরে-ধীরে গতি বাড়িয়ে বিপক্ষের গোলপোস্টের দিকে এগোতে হয়। তা হলে আর গোল দেওয়া থেকে তোমাদের আটকায় কে?’

ঝনাৎচন্দ্রবাবু আঙুলে তবলা বাজানোর ভঙ্গি করতে করতে মাইক্রোফোনের সামনে এলেন। তারপর তিনি মুখে তবলার বোল তুলতে লাগলেন। সামনে বসে থাকা ছোটোরা মজা পেয়ে গেল। ডায়াসের ওধার থেকে অনন্তস্যারের ইঙ্গিতে সে-মজা নিমেষে হুস হয়ে উবে গেল। ঝনাৎচন্দ্রবাবু শুরু করলেন, ‘এখানে তো তবলা নেই। তাই আমি মুখে তবলা লহরার একটু শোনালাম। এর কারণ আর কিছুই নয়, বাজনার সঙ্গে ফুটবল একই গতে বাঁধা কিনা। বাজনাও যেমন ধীরে ধীরে চড়ার দিকে ধাবিত হয়, ফুটবলও তেমনি। আক্রমণের গতি ধীরে ধীরে শাণিত করে তুলতে হয় বিপক্ষ দলের গোলপোস্টের দিকে।’

ওদিকে দেখলাম, ডায়াসের বাঁদিকে সুবলস্যার কাগজ-কলম নিয়ে কিছু লিখছেন। মনে হল, উনি ফাইনালের জন্যে ফুটবল টিম তৈরি শুরু করে দিয়েছেন। এমন সময় মাইক্রোফোনের সামনে এলেন ভেষজেন্দুবাবু। শিকড়বাকড় আর খলনুড়ি ভরতি হাতব্যাগটা এক পাশে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর শুরু করলেন, ‘ভেষজ ওষুধ আর ফুটবলকে কোনোভাবেই পৃথক করা যায় না। দুটোই একই অনুপানে বাঁধা। খলনুড়িতে ভেষজ ওষুধ রেখে যেমন মাড়াই করতে হয়, যত বেশি মাড়াই করা যাবে, ফল তত ভালো হবে। ফুটবলও তাই। সেন্টার লাইন পেরিয়ে বিপক্ষের পেনাল্টি এরিয়ার সামনে বল নিয়ে যত বেশি ঘোরাফেরা করবে, ততই গোলের সুযোগ তৈরি হবে। হুট করে কি আর গোলে বল মারলে গোল হয়?’

এর পর বলতে এলেন লেখনকান্তি সান্ধ্যকী। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের লেখা একখানা প্রায় পাঁচশো পাতার বই তুলে ধরে বললেন, ‘এই যে বইটা দেখছ, হ্যাঁ, এটা আমারই লেখা বই। গল্পের কাহিনির সঙ্গে ফুটবলের একটা নিকট সম্পর্ক আছে। গল্পের কাহিনি যত এগোয়, ততই তার চরিত্ররা ব্যস্ত হয়ে পড়ে উপসংহারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে। ফুটবলও তাই। খেলা যত সমাপ্তির দিকে এগোয়, ফুটবলারদের মধ্যে গোলক্ষুধা ততই বাড়তে থাকে। তোমাদের এই গোলের খিদেটাকে কাজে লাগাতে হবে। তা হলেই জয় চলে আসবে হাতের মুঠোয়।’

এবার আজকের শেষ অতিথির ভাষণ। বাইসেপ ফুলিয়ে ডায়াসে এলেন অঙ্গচালনবাবু। ছোটোহাতার জামায় দু-বাহুর বাইসেপ দুটো দুশো গ্রাম ওজনের আলুর মতো উঁচু হয়ে আছে বলে মাঠের শেষ প্রান্তের লোকেরও দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘ফুটবল আর এই বাইসেপ একই গোত্রের জিনিস। কোনোটাই ঝটাস করে হয়ে যায় না। এই বাইসেপ তো আর একদিনে তৈরি হয় না। এর জন্যে তিলতিল করে প্রস্তুতি নিতে হয়। তেমনই ফুটবলও। বিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণ গড়ে তুলতে হয় একটু একটু করে। তারপর দেখবে বিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে আছ শুধুই তোমরা। ওরা সব হাওয়া হয়ে গেছে।’

সব বক্তার বক্তব্যের পর যেমন করে প্রচুর হাততালি পড়েছিল, এবারও তার অন্যথা হল না। হাততালির গুণে সব বক্তারই মন খুশিতে ডগমগ।

এবার অনন্তস্যার তাঁর সমাপ্তি ভাষণ দিতে এলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা এতক্ষণ আমাদের হেলেঞ্চাপোতা গ্রামের বিশিষ্ট মানুষদের মনোজ্ঞ ভাষণ শুনলাম। তাঁরা ফুটবল নিয়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন, এই কথাগুলো আমাদের ফাইনাল ফুটবল টিমের খুবই কাজে লাগবে। সুবলবাবু এক্ষুনি ফাইনাল টিম ঘোষণা করবেন। তার আগে আমি শুধু দু-একটা কথা বলতে চাই আমার ছাত্রদের উদ্দেশে। তোমাদের আদর্শ ফুটবলার হয়ে উঠতে হবে। সততা থাকবে, জেদ থাকবে, আর থাকবে গোল করার অপরিসীম চেষ্টা। ব্লক পর্যায়ে দশ গোলে পরাজয়ের গ্লানি আমাকে এখনও কুরে কুরে খায়। আজকের এই মিটিং, বিশিষ্ট মানুষদের দারুণ দারুণ কথা তোমাদের প্রেরণা জোগাবে। এবার আমরা জিতবই।’

সুবলস্যার এবার এসে হেলেঞ্চাপোতা ফুটবল টিমের নাম ঘোষণা করলেন। দেখলাম, সেই টিমে ক্লাস এইটের তিনজনের জায়গা হয়েছে, তার মধ্যে আমি একজন। ক্লাস নাইনের চারজন আর টেনের চারজন দাদা আছে আমাদের টিমে।

এর পর টানা চোদ্দো দিন ধরে চলল প্রাণান্তকর ফুটবল প্র্যাকটিস। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলাম আমরা। একদিন মা বললেন, ‘তুই তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গোল গোল বলে চেঁচিয়ে উঠছিলি কাল রাতে।’ আমি নিশ্চিন্ত হলাম, তার মানে ঘুমিয়ে পড়লেও ফুটবল আমাকে ছাড়েনি।

খেলার দিন সকাল থেকে অনন্তস্যারের মতো আমরাও টগবগ করে ফুটছিলাম। খেলা শেষে সেই টগবগে ব্যাপারটা বেড়ে গেল এক-শো গুণ। কারণ, আমরা হেলেঞ্চাপোতা ফুটবল টিম ঝঞ্ঝাটপুর একাদশকে দুই-শূন্য গোলে হারিয়ে শিল্ড জিতেছি। গোল দুটো দিয়েছি আমিই। তাই সেরা গোলদাতার পুরস্কারটাও পেলাম আমি।

খেলার পর যখন ঝঞ্ঝাটপুর একাদশের সকলেই গোলকিপারকে বলল, ‘বল মাত্র দু-বারই তো গোলে এসেছে রে, তুই একবারও ধরতে পারলি না?’

গোলকিপার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি যখনই গোলে আসা বলটা ধরতে গেছি, দেখেছি, একসঙ্গে দুটো বল গোলে ঢুকছে। একটাকে ধরতে গিয়ে দু-বারই দেখলাম, আর একটা বল গোলে ঢুকে গেল।’

ঝঞ্ঝাটপুর একাদশের টিম-ম্যানেজার বলল, ‘ওসব ছাড়! হুঁ, দুটো বল! তুই হেরে গিয়ে এখন কত কথাই না বানিয়ে বানিয়ে বলবি!’

আমরা ‘হেলেঞ্চাপোতা ফুটবল টিম, হিপ হিপ হুররে’ বলে লাফাতে লাফাতে আমাদের গ্রামে ফিরে এলাম। অনন্তস্যার আর সুবলস্যারের সঙ্গে আমাদের অভিনন্দন জানাতে এলেন অহিভূষণ কামিলা, পক্ষীন্দ্র মহাকাল, মধুমাধবী অধিকারী, ঝনাৎচন্দ্র সরখেল, লেখনকান্তি সান্ধ্যকী, ভেষজেন্দু কান্ডার, অঙ্গচালন ধর। হঠাৎ এর মধ্যে থেকে অনন্তস্যার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আচ্ছা, কবন্ধ দাসকে তো দেখতে পাচ্ছি না?’

কোথা থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের গ্রামের হরিৎশেখরকাকু এসে খবর দিলেন, ‘কবন্ধ দাসকে এইমাত্র মাঠের পাশের ঝোপজঙ্গলের অন্ধকারের মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবন্ধবাবু, কী খুঁজছেন অত আঁতিপাতি করে? এমন অন্ধকারে? সাপখোপ থাকতে পারে তো!’ উনি বললেন, ‘আজ সেকেণ্ড হাফে যে ভূতটাকে ফুটবল বানিয়ে ম্যাচে নামিয়ে ছিলাম, তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সে-ই তো দুটো গোল দিয়েছে আজ। এখন সেই ভূতব্যাটাকে কোথায় খুঁজে পাই?’ আপনারা ঝোপের কাছে গেলে এখনও কবন্ধ দাসকে ওখানে দেখতে পাবেন!’

একথা শোনার পর আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। একটু আগে ঝঞ্ঝাটপুর একাদশের গোলকিপার যে বলল, সে দেখেছে, দু-বারই দুটো বল একসঙ্গে গোলে ঢুকছিল? তা হলে কথাটা ঠিক? আমার পায়ের বল একবারও বিপক্ষের গোলে ঢোকেনি? বারের উপর দিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেছে? আর কবন্ধ দাসের ভূত-ফুটবলটাই দু-বার গোলে ঢুকেছে? ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

ওদিকে কারা চিৎকার করে উঠল, ‘কবন্ধ দাস, হিপ হিপ হুররে!’ অন্ধকারে তাদের স্পষ্ট দেখা গেল না।

অনন্তস্যার আফশোসের গলায় বললেন, ‘এবারও তা হলে হেলেঞ্চাপোতার ভালো ফুটবলারের অভাব ঘুচল না!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *