হেরোডোটাস (আনু. ৪৮৫–৪২৫ খ্রি. পূ.) – ইতিহাসশাস্ত্রের জনক
ইতিহাসশাস্ত্রের জনক বলে যিনি পরিচিত, তাঁর নাম হেরোডোটাস (Herodotus)। আজ যে ইতিহাসশাস্ত্র বিশ্ব জুড়ে এত বিস্তৃতি লাভ করেছে, তার আদি সূত্রপাত হয়েছিল মহাজ্ঞানী হেরোডোটাসের হাতেই।
তিনিই সর্বপ্রথম পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক-পার্শিয়ান যুদ্ধের ঘটনাবলিকে লিপিবদ্ধ করেন এবং তখন থেকেই শুরু হয় ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণী সংরক্ষণের প্রথা। শুরু হয় ইতিহাস রচনার কাজ।
মহাজ্ঞানী হেরোডোটাসের জন্ম ৪৮৫ খ্রিস্টপূর্বে। এশিয়া মাইনরের হেলিকারনাসাসের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। শিক্ষাজীবনও এখানেই শুরু হয়। কিন্তু সারাজীবন জন্মভূমিতে কাটানো সম্ভব হয়নি হেরোডোটাসের।
যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি বহিশত্রু টাইউরানানি লিগদামিসদের দ্বারা বিতাড়িত হন। কিন্তু কয়েক বছর পর আবার নিজের শক্তিতেই ফিরে আসেন স্বদেশভূমিতে। প্রতিষ্ঠা করেন প্রশাসনিক সরকার।
কথিত আছে, সেকালের প্রখ্যাত মহাকবি পানিয়াসিস-এর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁর সঙ্গে একত্রে তিনি দীর্ঘকাল সামোস দ্বীপেও অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু দূরে অবস্থান করলেও দেশের প্রতি, হেলিকারনাসাসের প্রতি ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক আকর্ষণ। তিনি দূরে বসেই স্বদেশের জন্য কাজ করে যেতেন।
কিন্তু তবু দুর্ভাগ্য হেরোডোটাসের, দেশের জন্য এত কাজ করেও তিনি দেশবাসীর মন জয় করতে পারেননি। হেলিকারনাসাসের অধিবাসীদের কাছে তিনি দিনদিনই যেন অপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে দ্রুত। তখন বাধ্য হয়েই তিনি স্বদেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চিরদিনের জন্য হেলিকারনাসাস ছেড়ে চলে যান অ্যাথেন্সে। অবশ্য তিনি অ্যাথেন্সেও সবসময় ছিলেন না। এখানকার নতুন উপনিবেশ দক্ষিণ ইতালির থুরি নগরীতে তিনি বাস করতেন।
কথিত আছে, হেরোডোটাস তাঁর বাকি জীবন এখানেই অতিবাহিত করেন। তিনি মারা যান ৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। মৃত্যুর পর এখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
হেরোডোটাস ছিলেন প্রকৃতপক্ষে জন্মগতসূত্রে এশিয়ান গ্রিক। বাল্য ও যৌবনের কিছু সময় গ্রিসে কাটালেও তাঁর জীবনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে এথেন্সে। হেরোডোটাসের সাথে সে-জন্যই এথেন্সের নাম জড়িয়ে আছে। অনেকে তাঁকে এথেন্সের অধিবাসী বলেই জানেন।
হেরোডোটাস ইতিহাসকেও বিজ্ঞান বলে মনে করতেন। বিজ্ঞানের মতোই ঐতিহাসিক তথ্যাবলি ও হাজারো প্রশ্নের সমাধানের ভিত্তিতে এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়। তারপর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আসতে হয় সঠিক সিদ্ধান্তে। ঠিক বিজ্ঞানের মতো করে। যেমন, গ্রিক-পার্শিয়ান যুদ্ধ। এই যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিল? এই যুদ্ধে কোন্ পক্ষ কী আদর্শ ও পটভূমিকায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, কী কৌশলে এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল—এসব প্রশ্নের সমাধান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই করতে হয়। আর তাই ইতিহাসকেও বিজ্ঞান থেকে আলাদা করে দেখা যায় না।
গ্রিক-পার্শিয়ান যুদ্ধের এই ইতিহাস লেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না হেরোডোটাসের। তিনি শুধু এই যুদ্ধের স্থান ও পটভূমির একটি ভৌগোলিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর আগে মাইলেটাসের হেকাটাকাস নামের এক পণ্ডিত ‘পেরিয়েগেসিস’ নামের একটি বই লিখেছিলেন। এতে তিনি ভূমধ্যসাগরের অনেক দ্বীপ, দেশ, সাগর ও উপসাগরের বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন। হেরোডোটাসের ইচ্ছে ছিল, তিনিও হেকাটাকাসের অনুকরণেই, তবে এর চেয়ে উন্নত একটি গ্রন্থ রচনা করবেন, যার ভিত্তি হবে গ্রিক- পার্শিয়ান যুদ্ধ।
তাঁর ইতিহাসগ্রন্থ ‘হিস্টোরিস’ (Histories)-এর শুরুতেই তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন সেইকালে এশিয়া মাইনরের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ গ্রিক সাম্রাজ্য লিডিয়ার রাজা ক্রোসাসের কথা। রাজা ক্রোসাস কেমন করে গুরুত্বপূর্ণ হেলিস নদী কৌশলে অতিক্রম করেছিলেন, তার কথা। তিনি বলেন, রাজা ক্রোসাস এই বিশাল নদীতে একটি শক্ত সেতু তৈরি করে তবেই তা পার হতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এই শক্ত সেতুটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছিলেন আদি বিজ্ঞানী মাইলেটাসের থ্যালেস। মাইলেটাস এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সেকালে শিক্ষা ও শিল্পসাহিত্যে ছিল শীর্ষস্থানে। এই মাইলেটাস থেকেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারা গ্রিক সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে। সেকালে থ্যালেস কেবল একজন বিজ্ঞানীই নন, মাইলেটাসের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও ছিলেন।
সেকালে এ অঞ্চলের আরেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন হেকাটাকাস। তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ পরিব্রাজক এবং গদ্যলেখকও।
হেকাটাকাসের কথা হেরোডোটাস তাঁর গ্রন্থে বহুবার উল্লেখও করেছেন। তাঁর মতোই তিনিও দেশের ঐতিহাসিক বিবরণ দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের ও কালের জনগণের মুখের কথার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। তারা যা বলেছে, তাকেই সত্য বলে ধরে নিয়ে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন গ্রন্থে।
একবার তিনি কৃষ্ণসাগরেও ভ্রমণে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সফরের পেছনে তাঁর কোনো ঐতিহাসিক তথ্যসংগ্রহের ব্যাপার ছিল না। তিনি গিয়েছিলেন একান্তই দ্বীপ- দীপান্তরের ভৌগোলিক অবস্থান জানার উদ্দেশ্যে। শুধু কৃষ্ণসাগর নয়, একবার সুদূর মিশরেও গিয়েছিলেন। মিশরে যাওয়ার সময় তিনি হেকাটাকাসের লেখা বইখানাও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বইতে আলেকজান্দ্রিয়ার যে ভৌগোলিক বর্ণনা আছে, তা পরীক্ষা করে দেখা। সম্ভব হলে তাকে আরও নিখুঁত এবং উন্নত করা।
হেরোডোটাসের এই মিশর ভ্রমণ সম্পর্কে ফরাসি বিশেষজ্ঞ মি. কামিল সৌরডিল ১৯১০ সালে বলেছেন, হিরোডোটাস সম্ভবত মিশরে প্রবেশ করেছিলেন পশ্চিম বদ্বীপের ক্যানোপাস দিয়ে, ডিসেম্বর মাসে। এই সফরের সময় তিনি মিশরের মেমফিস এবং পিরামিড সন্নিহিত অঞ্চলসমূহও পরিদর্শন করেছিলেন। গিয়েছিলেন নীলনদের তীরে প্রাচীন নগরী থিবস পর্যন্ত।
মিশরের নীলনদে প্রতিবছরই বন্যা হতো আর দুর্ভোগ ডেকে আনত মিশরবাসীর। হেরোডোটাস তাই নীলনদের এই বন্যার বিষয় নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। বন্যার কারণসমূহ উল্লেখ করার চেষ্টা করে তিনি বলেছিলেন, নীলনদ যদি কোনো সময় লোহিত সাগরের দিকে সামান্য সরে আসে, তা হলে হয়তো আগামী পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে এর মোহনায় জেগে উঠবে একটি নতুন ভূখণ্ড, যার আয়তন হবে বর্তমান মিশরের সমান। হেরোডোটাসের এই অনুমান অবশ্য সত্যি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। এমন একটি নতুন ভূখণ্ড জেগে উঠবার কিংবা নীলনদের সরে আসবারও কোনো লক্ষণ আজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তা হলেও সেই প্রাচীনকালেই ভূপৃষ্ঠের গঠন সম্পর্কে এমন চিন্তাভাবনা করা কম কথা নয়।
হেরোডোটাস মিশরের প্রাচীন পিরামিড সম্পর্কেও দিয়েছিলেন এরকম আরেকটা মজার ভুল তথ্য। তিনি পিরামিড অঞ্চল পরিদর্শন করে বলেছিলেন, এই পিরামিডগুলো যতটা প্রাচীন বলে মনে হয়, নিশ্চয়ই ততটা প্রাচীন নয়। কারণ, এই অঞ্চলটা প্রাচীনকালে নীলনদের প্লাবনে ডুবে থাকত। এখানে তাই অত আগে পিরামিড তৈরি করা সম্ভব ছিল না। এগুলো তৈরি হয়েছিল অনেক পরে। হেরোডোটাসের এই অনুমানও যে সত্যি নয়, তা আজ সবাই জানে। কারণ, মিশরের পিরামিডগুলো সত্যি সত্যি সুপ্রাচীনকালেই তৈরি হয়েছিল।
মিশরের প্রচীন প্যাপ্রিমিস নামক স্থানে মিশর-পার্শিয়ানদের যে যুদ্ধ হয়েছিল, হেরোডোটাসের ভ্রমণবৃত্তান্তে তারও বর্ণনা আছে। কিন্তু এই যুদ্ধ কখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার অবশ্য কোনো উল্লেখ তিনি করেননি। তবে পরবর্তীকালের গবেষকরা মনে করেন, এই যুদ্ধ সম্ভবত ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছু পরে সংঘটিত হয়েছিল।
তিনি মিশর সম্পর্কে আরও বলেছেন, মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম সৌরবর্ষ আবিষ্কার করেন। তারাই সর্বপ্রথম সারা বছরকে ১২টি ভাগ করে মাসের সৃষ্টি করেন। তিনি স্বীকার করেছেন, মিশরীয়দের জ্যোতির্বিজ্ঞান গণনা গ্রিকদের চাইতেও উন্নত ছিল।
হেরোডোটাস শুধু দেশ ও অঞ্চলের ঐতিহাসিক বিবরণই লিপিবদ্ধ করেননি, সেসব দেশের জীবজন্তু ও পাখি সম্পর্কেও আগ্রহী ছিলেন। তিনি এমন বহু পশুপাখির নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে গেছেন, যাদের অস্তিত্ব আজ লোপ পেয়েছে। এখনকার জীববিজ্ঞানীরাও ওইসব বিলুপ্ত পাখির বিবরণ সংগ্রহের কাজ অব্যাহত হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুসারে।
অবশ্য তার কোনো-কোনো বর্ণনা আবার জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের সাথে খাপ খায় না। যেমন—তিনি এমন এক জাতের পিঁপড়ের বর্ণনা দিয়েছেন, যেগুলোর আকৃতি ছিল একটি শেয়ালের সমান। বাস্তবে হয়তো এমন দানব-পিঁপড়ার অস্তিত্ব কোথাও ছিল না। তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনার মতোই এসব কথাও লোকের মুখে শুনেই বইতে লিখেছিল। নিজে দেখে পরীক্ষা করে লেখেননি, আর তাতেই এমন তিলের গল্প তাল হয়ে দেখা দিয়েছে।
কিন্তু তাঁর সম্পর্কে মজার ব্যাপার হলো, তিনি ভূগোলবিষয়ে আগ্রহী হলেও শেষ পর্যন্ত যে বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তা ছিল ইতিহাস। তিনি ভূতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা না করে রচনা করেন গ্রিক-পার্শিয়ান যুদ্ধের কাহিনী। আর তার ফলেই তিনি পরবর্তীকালে পারিচিতি লাভ করেন একজন ঐতিহাসিক হিসেবে।
তিনি গ্রিক-পার্শিয়ান যুদ্ধের শুধু ঐতিহাসিক বর্ণনাই দেননি, এই যুদ্ধের ভিত্তিতে এর ধর্মীয় পরিবেশেরও বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি এই পটভূমিকাতেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুদীর্ঘকালের সম্পর্কের ধারাবাহিক বর্ণনাও দিয়েছেন। তিনি ইতিহাসের ধারাকে দুটো ভাগে বিভক্ত করে দেখিয়েছেন—একটি ঐতিহাসিক পর্ব, অপরটি প্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক পর্ব। এ ধরনের বিভাগ তিনিই প্রথম করে গেছেন।
মূলত হেরোডোটাস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং প্রথম ঐতিহাসিক। এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয়।