৮
‘সিংহ বেঁচে থাকে তার থাবার জোরে,
ষাঁড় বেঁচে থাকে তার শিংয়ের জোরে,
তেমনই মানুষ বেঁচে থাকে মানুষের মস্তিষ্কের শক্তিতে।’
—এনাক্সাগোরাস
***
নিশির ডাকে সক্রেটিস ছুটছে।
গন্তব্য পেরিক্লিসের বাড়ি। সেখানে তার গুরু থাকেন।
সক্রেটিস দেব-দেবী নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। আজ সন্ধ্যার আড্ডায় চেরোফোন মনের গভীর বিশ্বাস নিয়ে বলল— দেবী এথিনা নিজে এথেন্সকে জ্ঞানের নগর বানিয়ে দিয়েছে। এসব গল্প মিথোলজির মতো। শুনতে মজার। এখানের সবাই এই মজার গল্পগুলো বিশ্বাস করে।
কিন্তু সক্রেটিসের এসব গল্প বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। তবে এমন নয় যে, সে দেবতাদের মানে না। সে দেবতাদের ভক্তি করে। পায়ে ব্যথা পেলে, আপনা-আপনিই বলে ওঠে, দেবী এথিনা, ভালো করে দাও। কিন্তু দেব-দেবী নিয়ে এথেন্সের মানুষ যেসব আজগুবি কথা বলে, সেগুলো নিয়ে তার খটকা লাগে, মনে প্রশ্ন জাগে।
মনে প্রশ্ন জাগলেই সে গুরু এনাক্সাগোরাসের কাছে যায়। এনাক্সাগোরাস তার একার গুরু নন। পেরিক্লিসেরও গুরু। পেরিক্লিস গুরু বলেন বলেই এথেন্সের অনেকেই তাকে গুরু বলে। সক্রেটিসও বলে। গুরুকে এথেন্সে আশ্রয় দিয়েছেন পেরিক্লিস।
গুরু এনাক্সাগোরাসের সাথে পেরিক্লিসের সাক্ষাতের ঘটনা খুবই নাটকীয়। ঘটনাটি এরকম—
পেরিক্লিস তখন মাত্র নেতা হচ্ছেন। তরুণ নেতা। একদিন দেখেন, আগোরার রাস্তায় এক মধ্যবয়সী মানুষ চিৎকার করছেন। তার চারপাশে ভিড়। লোকটি আকাশে আঙুল দেখিয়ে বলছেন, ‘ঐ যে দেখো সূর্য; তোমরা তো বলো সূর্য নাকি দেবতা, এপোলো তাকে ঘোড়া দিয়ে টানছে। এসব ভুয়া কথা। আসলে সূর্য হলো বাদামি রঙের এক খণ্ড ধাতু।’ ভিড়ের মানুষ চিৎকার করে উঠল, ‘আরে, পাগলে বলে কী! দেবতা মানে না! উল্টা-পাল্টা কথা বলে। উন্মাদ! বদ্ধ উন্মাদ!’ লোকটি আবার বললেন, ‘বিশ্বাস করলে না? দেখো, একদিন না একদিন ঐ সূর্য থেকে একটি বাদামি খণ্ড পৃথিবীতে এসে পড়বেই।’ লোকজন হই হই করে উঠল, ‘এত বড় সাহস, দেবতাদের নিয়ে মশকরা? ব্যাটা শয়তান! ওকে আটক কর। সিপাহিদের কাছে দাও।’ সে সময় তাকে রক্ষা করল তরুণ পেরিক্লিস। বলল, ‘পাগল মানুষ, কী না কি বলছে। ছেড়ে দিন ভাই।’ পেরিক্লিস লোকটির পরিচয় জিজ্ঞেস করল। লোকটি এজিয়ান সাগরের ওপাড় থেকে এসেছে। এথেন্সে আশ্রয় চায়। ভিড়ের মানুষ টিপ্পনি কেটে বলল, ‘পেরিক্লিস, তুমি তো পাগলটার পক্ষ নিলা। এইবার ঠ্যালা সামলাও, ওরে আশ্রয় দাও। ঐ পাগলা, যা, ওর সাথে যা। ওর টাকা আছে, তোর খাওন-পরনের চিন্তা হবে না।’ পাগল বললেন, ‘টাকা? টাকা দিয়ে কী হবে? আমার কপাল খুবই ভালো, কারণ আমার সব টাকা-পয়সা ফুঁস করে শেষ হয়ে গেছে, তা না হলে ওরা আমাকেই শেষ করে দিত।’ পেরিক্লিস পাগলকে বাড়িতে আশ্রয় দিল। কিন্তু পাগল ভালো হলেন না। তিনি সুযোগ পেলেই বলেন, সূর্য থেকে একটা কিছু পৃথিবীতে পড়বেই, তার রং হবে বাদামি। এর কিছুদিন পরেই এথেন্সের প্রায় দেড়শ মাইল পশ্চিমে আকাশ থেকে জ্বলজ্বলে কী যেন একটি মাটিতে পড়ল। যারা পড়তে দেখেছে, তারা বলল, এটি সূর্য থেকে পড়েছে[৩২]। দেখা গেল, সেটি একটি বড় বাদামি রঙের পাথর। সবাই বলল, এটির কথাই পাগল এনাক্সাগোরাস এতদিন বলছেন। পাগল রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। কিছুদিনেই বোঝা গেল, এই পাগল আসলে জ্ঞানের পাগল। সব বিষয়ে এমন জ্ঞান, এমন বুদ্ধি অন্য কারও নেই। তিনি পেরিক্লিসের খুবই আপনজন হয়ে গেলেন। পেরিক্লিস তাকে ডাকেন মুশকিল আসান গুরু। সে মুশকিলে পড়লে গুরুই আসান করেন।
তারপর অনেক বছর গুরুর তেমন কোনো আওয়াজ নেই। সবাই ভাবল পাগল চুপ করে গেছেন। কিন্তু কয়েক মাস পরে বোঝা গেল পাগল চুপ করেননি। বরং আরও বড় পাগল হয়েছেন। এতদিন তিনি বই লিখেছেন। তার নতুন বই বের হলো। সেই বইতেও তিনি লিখলেন— সূর্য আর চাঁদ আসলে দুটি গোল গোল ধাতু ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এগুলোকে যারা দেবতা বলে তারা আহাম্মক। অনেক হিসাব-নিকাশ করে প্রমাণপত্র দিয়ে তিনি বইতে এসব লিখেছেন।
সেই সময় এই বই নিয়ে শুরু হলো বিশাল ঝগড়া। মানুষ ক্ষেপে তাকে গালাগালি দিতে শুরু করল। কিন্তু পেরিক্লিস তার পক্ষে। পেরিক্লিস জ্ঞানের জন্য সবকিছু করতে রাজি। পেরিক্লিস পক্ষে থাকায় এখন পর্যন্ত গুরুকে কেউ কিছুই বলতে পারেনি।
তরুণ সক্রেটিস গুরুর নতুন বইটা পড়ল। পড়েই তার মনে হলো— এই বইয়ের লেখক সময়ের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ, সবচেয়ে স্মার্ট। সক্রেটিস দৌড়ে গেল তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু গুরু সক্রেটিসকে পাত্তা দিলেন না। তিনি ভাবলেন, ‘পিচ্চি একটি ছেলে, দেখতেও বদখৎ। এর সাথে সময় নষ্ট করে লাভ কী?’ তখন সক্রেটিস বলল, ‘গুরু, আপনার আর আমার মধ্যে একটি মিল আছে। লোকে যেমন সকাল-বিকাল আপনাকে গালাগালি দেয়, তেমনই ছুতানাতায় আমাকেও গালি দেয়। আমি নাকি বাচ্চাকাচ্চাদের নষ্ট করে ফেলছি।’
গুরু ভাবলেন, একথা যদি সত্য হয়, তাহলে ছেলেটার মধ্যে কিছু না কিছু আছে, যেটি অন্যদের থেকে আলাদা। গুরু আলাদা ধরনের মানুষ পছন্দ করেন। তিনি সক্রেটিসের সাথে কথা শুরু করলেন। একটু আলাপেই বুঝলেই সক্রেটিস আসলে একজন উঁচু স্তরের প্রশ্ন-রোগী। সে বিনা প্রশ্নে কিছুই মেনে নেয় না। এরকম মানুষই গুরুর দরকার। তিনি সক্রেটিসকে খুবই পছন্দ করলেন।
গুরু আর একটি জিনিস লক্ষ করলেন। এই ছেলেটির অসাধারণ স্মরণশক্তি। যা একবার শোনে, সাথে সাথে মনে গেঁথে ফেলে। কিচ্ছু ভোলে না। হুবহু বলতে পারে। সে এক অক্ষরও লেখে না। কোনো নোট নেয় না। সব তার মাথার মধ্যে থাকে, দরকার হলেই মুখ দিয়ে পটপট করে বের হয়। এই মেধা দেখে গুরু সক্রেটিসকে তার লাইব্রেরির চাবি দিয়ে দিলেন। সক্রেটিস যখন ইচ্ছা এসে লাইব্রেরিতে বসে পড়ে।
এমন সুযোগ পেয়ে আহ্লাদে সক্রেটিসের বাকবাকুম অবস্থা। সে দিনরাত পড়াশুনা করে লাইব্রেরির সব বই শেষ করে ফেলল। এখানে বই মানে বিশাল পেপিরাস কাগজের টুকরা, এক একটি লম্বায় দুই হাতের বেশি। লম্বা টুকরাগুলো রোল করে রাখতে হয় অথবা দেয়ালে টানিয়ে দিতে হয়। গুরুর লাইব্রেরিতে সব বই দেয়ালে টানানো। তার লাইব্রেরিটি একটি দেখার মতো জিনিস। একটি বিশাল ঘরে বড় বড় বোর্ড লাইন ধরে দাঁড় করানো। বোর্ডগুলোর দুপাশে ঝুলছে লম্বা লম্বা পেপিরাসের টুকরা। এগুলোই হলো বই। এরকম কয়েকশ বই ঝুলছে গুরুর লাইব্রেরিতে।
সক্রেটিস যখন সময় পায়, তখনই এই লাইব্রেরিতে বই পড়তে আসে। সে যখন পড়ে, একেবারে পাগলের মতো পড়ে। এই লাইব্রেরির সব বই তার আগাগোড়া মুখস্ত। কোনোকিছু নিয়ে সন্দেহ হলেই সে এই লাইব্রেরিতে আসে। বইয়ের ভেতর খুঁজতে থাকে। খুঁজে না পেলে গুরুর সাথে দ্বিপাক্ষিক সভায় বসে। সভা সব সময় রাতে হয়। সে সারাদিন আড্ডা দেয়। আর রাতে বই পড়ে। গভীর রাতে সক্রেটিসকে আসতে দেখে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে— নিশিতে ডাক দিয়েছে গো। তাই যাচ্ছি।
তো আজ রাতে সক্রেটিস নিশির ডাকে গুরুর কাছে এসে বললেন, গুরু, এক কথায় বলুন, দেব-দেবী সত্য না মিথ্যা?
গুরু হাসলেন। তার মনে পড়ল, কয়েক বছর আগে সক্রেটিস যখন আরও ছোট ছিল, তখন প্রতিদিন এই একই প্রশ্ন তুলে ঘ্যান ঘ্যান করত।
গুরু বললেন, আবার মাথায় সেই পোকা ঢুকছে। তো যা, ঐ যে তিন নম্বর সারিতে মিলেটাস দ্বীপের তিন জ্ঞানীর বই আছে। ওগুলো আগে পড়েছিস। তবু আর একবার পড়। তারপর তোর মাথার পোকা বের করার ব্যবস্থা হবে।
সক্রেটিস গেলেন মিলেটাস শহরের তিন জ্ঞানীর বইয়ের কাছে। এই তিন জ্ঞানী হলেন থেলিস, এনাক্সিম্যানডার এবং এনাক্সিমিনেস[৩৩]। তারা এজিয়ান সাগরের ওপাড়ে মিলেটাস শহরে জন্মেছিলেন। তারাই প্রথম বলেন যে পৃথিবীর সব ঘটনা দেবতাদের খেয়ালে হয়, একথা ঠিক না। প্রকৃতি চলে একটি ধরাবাঁধা নিয়মে। তারা বললেন, প্রকৃতির সবকিছুরই একটা কারণ থাকে।
সক্রেটিস প্রথম যে পেপিরাস টুকরায় চোখ বুলাচ্ছেন, সেটি লিখেছেন থেলিস। মিলেটাসের তিন জ্ঞানীর মধ্যে পুরনো হলেন থেলিস। তিনিই প্রথম আকাশ, বাতাস, জোয়ার-ভাটা এসব দেখে লিখতে শুরু করেন। আকাশের একটি ঘটনার সাথে আরেকটি মিলিয়ে যুক্তি দাঁড় করালেন। বললেন, সূর্যগ্রহণ হয় এই কারণে; জোয়ার-ভাটা হয় এভাবে। থেলিস-এর এই লেখা থেকেই জ্ঞানের নতুন একটি শাখার জন্ম হলো, যেটির নাম বিজ্ঞান।
গ্রিকরা অবশ্য বিজ্ঞান শব্দটা বলত না, তাদের কাছে যেকোনো জ্ঞান মানে দর্শন বা ফিলোসফি। আর যেকোনো কিছু নিয়ে যারা গবেষণা করে তারাই জ্ঞান-প্রেমিক বা ফিলোসফার। তো প্রকৃতির নিয়ম বের করতে চাওয়া এই জ্ঞানীদের নাম তারা দিলেন প্রাকৃতিক দার্শনিক বা ন্যাচারাল ফিলোসফার। থেলিস হলেন প্রথম প্রাকৃতিক দার্শনিক।
সক্রেটিস থেলিসের ন্যাচারাল ফিলোসফি নিয়ে লেখা পেপিরাসে চোখ বুলাচ্ছে। থেলিস জমিজমার মাপজোক নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন।
মাপ-জোক থেলিস শিখেছিলেন মিশরে গিয়ে। তিনি মিশরে গিয়েছিলেন জ্ঞান লাভ করতে। কিন্তু গিয়ে দেখেন, নীল নদে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বন্যায় থেলিসের যতটুকু সমস্যা হলো, তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা হলো মিশরের রাজা ফারাও সাহেবের। রাজা মিশরের প্রজাদের মধ্যে জমি ভাগাভাগি করে যে দাগ দিয়েছিলেন, বন্যায় সেগুলো সব ধুয়ে গেছে। নতুন করে জমি ভাগ- বাটোয়ারা করে দাগাদাগি করতে হলো। থেলিস নিজের চক্ষে সেই মাপজোক দেখলেন। তিনি শিখে গেলেন কীভাবে জমি মাপতে হয়। বিষয়টি তার ভালো লাগল। তিনি মাপ-জোকের আঁকাআঁকি দিয়ে পেপিরাস কাগজ ভরিয়ে তুললেন।
পাশের পেপিরাসে থেলিস অনেকগুলো ত্রিভুজ এঁকেছেন। তার নিচে কিছু কথা, ত্রিভুজ নিয়ে নানান সূত্র লেখা। থেলিসের ত্রিভুজ জ্ঞানও মিশরেই পাওয়া। মিশরে যে যায়, সেই পিরামিড দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। থেলিস শুধু হা করে তাকিয়েই থাকেননি, তিনি ঠিক করলেন পিরামিড কত উঁচু তা মাপতে হবে। অনেক চিন্তা করে ঠিকই একটি উপায় বের করে ফেললেন। দিনের যে সময়ে মানুষের ছায়া তার উচ্চতার সমান হয়, সেই সময়ে পিরামিডের ছায়া মেপে তিনি পিরামিডের উচ্চতা বের করে ফেললেন। পিরামিডের উচ্চতা মেপে তার আনন্দ হলো, কিন্তু মন ভরলো না। তিনি পিরামিডের ত্রিভুজের গুমর বের করতে চাইলেন। পেপিরাসে ত্রিভুজ আঁকলেন। দিনের পর দিন তিন কোনা নিয়ে মাপজোখ করলেন। বের করলেন ত্রিভুজের নানান সূত্র। গ্রিকরা থেলিসকে পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী মনে করে।
এর পরের পেপিরাসে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সক্রেটিস। এটিতেই থেলিস তার সবচেয়ে সাহসী কাজটি করেছেন। তিনি লিখেছেন, পৃথিবীতে সকল প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে পানি থেকে। মারাত্মক কথা। তার মানে দেবতারা প্রাণী সৃষ্টি করেননি। সারা পৃথিবীর মানুষ জানে দেবতারা পুরুষ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তারপর পেন্ডোরার কারণে নারীদের সৃষ্টি। থেলিস সে কথা বাতিল করে দিয়েছেন। বলেছেন সবকিছু এসেছে পানি থেকে।
সক্রেটিস মুগ্ধ হয়ে দেখছেন পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানীর লেখা। তার ভালো লাগছে এই ভেবে যে ‘দেবতারাই সব করে’ এই কথাকে যিনি প্রথম ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে সাহস করেছেন, সেই থেলিসের লেখায় হাত বুলাতে পারছেন। একটানা লেখা। কোনো দাঁড়ি-কমা নেই, দুটি শব্দের মাঝে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। টানা লিখে গেছেন থেলিস। এখানকার সবাই এভাবেই লিখে।
এরপর সক্রেটিস এনাক্সিমিনডারের লেখা দেখলেন। তিনি থেলিসের ছাত্র ছিলেন। তিনিও থেলিসের মতো লিখেছেন দেবতারা প্রাণীদের সৃষ্টি করেননি। কিন্তু পরের লাইনে লিখেছেন, ‘থেলিসের ধারণা সবকিছু পানি থেকে এসেছে, এটি ভুল, আসলে প্রাণীরা এসেছে একটি ‘অসীম’ ধরনের কিছু একটি থেকে যেটি দেখা যায় না’। পরের পেপিরাসে তিনি একটি মানচিত্র এঁকেছেন। এটি নাকি পৃথিবীর মানচিত্র। মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে চারদিকে মহাসাগরের পানি। তার মাঝে তিন টুকরা স্থল : ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকা। আর দুটি সাগর— ভূ-মধ্যসাগর আর কৃষ্ণ সাগর। এটিই ইউরোপের কোনো মানুষের আঁকা পৃথিবীর প্রথম মানচিত্ৰ।[৩৪]
সক্রেটিস পাশের পেপিরাসে গেল। সেটিতে মিলেটাস নগরীর তৃতীয় জ্ঞানী এনাক্সিমিনেসের লেখা। তিনি বৃষ্টি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন, বৃষ্টির সময় পানি আর বাতাস কীভাবে যেন একটি থেকে আরেকটি হয়ে যায়। তিনি বাতাসকে খুব গুরুত্ব দিলেন। লিখলেন— ‘থেলিস ঠিকই বলেছিলেন, দেবতারা প্রাণীর জন্ম দেয়নি। কিন্তু তিনি ভুল বলেছিলেন, পানি থেকে প্রাণ আসেনি, পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে বাতাস থেকে। ‘
মিলেটাস দ্বীপের তিন জ্ঞানীর লেখা শেষ করলেন সক্রেটিস। তারা দেবতাদের বাতিল করে দিয়েছেন, এই যুক্তিগুলো তার ভালো লাগছে। আরও পড়তে ইচ্ছে করছে। আরেকটি পেপিরাসে তাকালেন সক্রেটিস। এটি লিখেছেন হেরাক্লিটাস নামক এক জ্ঞানপ্রেমী।
হেরাক্লিটাস খুব সুন্দর একটি কথা লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে সবকিছু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, এক মুহূর্ত পরেই কোনোকিছু আর আগের মতো থাকে না, তুমি একই নদী জীবনে কখনই দুইবার পার হতে পারবে না।’
বাহ, কী চমৎকার কথা! জীবনে কখনই একই নদীকে দুইবার পার হতে পারবে না। নদী প্রতি মুহূর্তে বয়ে চলে, নদী প্রতি মুহূর্তে বদলে যায়। তাই এক নদীকে দুইবার পার হওয়া সম্ভব নয়। জীবনে যে মুহূর্তটি চলে যাচ্ছে, তা আর কোনোদিন ফিরে পাওয়া যাবে না। হেরাক্লিটাস আবার লিখেছেন, বিশ্বের সবকিছুর একটি সাধারণ নিয়ম আছে। এই নিয়মের নাম হলো লোগোস (logos)। লোগোস থেকে লজিক (logic), মানে যুক্তি বা কারণ। দুনিয়ায় সবকিছুর একটি কারণ থাকে, পেছনে একটি যুক্তি থাকে। যুক্তি দিয়েই পৃথিবী চলে, দেবতাদের খেয়ালে চলে না।
উল্টো দিকের পেপিরাসটি পিথাগোরাসের। তিনি লিখেছেন, প্রকৃতির সবকিছু খুব সুন্দর নিয়মে বাঁধা। সংগীতে যেমন সুর আছে, গণিতে যেমন সংখ্যার একটি ধারা আছে; তেমনই এই মহাবিশ্বও একটি সুন্দর নিয়মে চলে, একটি ধারায় চলে। তিনি মহাবিশ্বের নাম দিয়েছেন ‘কসমস’। এর মানে হলো সুশৃঙ্খল।
এঁদের লেখা পড়ে সক্রেটিসের মনের দোনোমনো ভাব দূর হয়ে গেল। সে ভাবলো এঁদের লেখাই সঠিক। দেবতারা অলিম্পাস পাহাড়ে বসে নিজেদের কাজ করে। কিন্তু পৃথিবী চলে পৃথিবীর নিয়মে। সে ঠিক করল, লোকে যা বলে বলুক। সে নিজে বুঝে গেছে, সত্যিটা কী।
বইগুলো পড়া শেষ করে গুরুর ঘরে ঢুকল সক্রেটিস। গুরু জেগেই আছেন।
সক্রেটিস বলল, গুরু, আমার মনের সন্দেহ মিটে গেছে। আর কোনো দোনোমনো ভাব নেই। দেবতাদের নিয়ে আর ঝামেলা নেই।
গুরু বললেন, তুমি অনেক দিন ধরেই এদের লেখা পড়ছো। আজ তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি এদের কথা বুঝতে পেরেছ। আগে পুরোপুরি বোঝনি। আজ বুঝেছ। তারা বলেছেন, পৃথিবী চলে যুক্তি দিয়ে। দেবতাদের ইশারা না, যুক্তিই হলো পৃথিবীর নিয়ম। দেবতারা অলিম্পাস পাহাড়ে বসে কিছুই ঘটায় না, প্রতিটি বিষয় ঘটার পেছনে একটি কারণ আছে। এই নতুন ধারণাটা তারা বের করেছেন। তাদের আগে হয়তো অনেকে বলেছে। কিন্তু সাহস করে বই লিখে মানুষকে জানিয়ে পৃথিবীতে এরাই প্রথম যুক্তির ধারণাটা সামনে এনেছেন। এই যুক্তির ধারণা বের করেছেন গ্রিসের দার্শনিকরা, সেজন্য এটিকে আমরা বলি ‘গ্রিক থট’ বা গ্রিসের ধারণা।
সক্রেটিস মুগ্ধ হয়ে শুনছে। এমন কথা শোনার জন্যই তো তাকে গভীর রাতে নিশিতে ডাকে। নিশির ডাক জিনিসটা তাহলে মন্দ নয়।
গুরু আবার বললেন, মজার কথা হলো এই গ্রিক থট আবিষ্কার করা হয়েছে এজিয়ান সাগরের ওপাড়ে মিলেটাস শহরে। আশেপাশের কয়েকটা দ্বীপের মানুষও এটি নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু ‘গ্রিক থট’ এর আসল চর্চা হচ্ছে এথেন্সে। এথেন্সের গণতন্ত্র মানুষকে কথা বলার অধিকার দিয়েছে। অন্য কোথাও দেবতার বিরুদ্ধে কথা বললে, সাথে সাথে মেরে ফেলবে। কিন্তু এথেন্সে আছে আইনের শাসন, আছে গণতন্ত্র। এখানে ইচ্ছে করলেই কাউকে মেরে ফেলা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো এথেন্সে আছেন পেরিক্লিস। তার মতো নেতা আছেন বলেই— এখানে বিনা বাধায় কথা বলা যায়। তোমরা তো কথায় কথায় বলো— এথেন্স হচ্ছে জ্ঞানের নগরী। এই জ্ঞান কী জিনিস? এই জ্ঞান হলো যুক্তি, পণ্ডিতেরা বলেন গ্রিক থট। আর জ্ঞানী কারা? যারা অন্ধ বিশ্বাস বাদ দিয়ে সবকিছুতে যুক্তি খোঁজে, গ্রিক থটের চর্চা করে। এথেন্সে ‘গ্রিক থট’-এর চর্চা করা যায় বলেই সারা পৃথিবীর জ্ঞানী মানুষ এখানে ছুটে আসে। আর এই কারণেই এথেন্স হলো জ্ঞানের নগরী।
সক্রেটিস বলল, এই কারণেই আপনিও সেই এজিয়ান সাগরের মধ্যখানের এক দ্বীপ থেকে এথেন্সে ছুটে এসেছেন।
গুরু মাথা নাড়লেন। যার মানে— পাগলা তুই ঠিক ধরেছিস।
সক্রেটিসের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আজ সন্ধ্যায় চেরোফোন যখন বলছিল, দেবী এথিনা এসে এথেন্সে জ্ঞান দিয়ে গেছে তখন থেকেই সমস্যাটা সক্রেটিসের মাথায় ঢুকেছিল। গুরুর কাছে এসে আসল কারণ জানতে পারল। গুরু সত্যিই মুশকিল আসান গুরু।
সক্রেটিসের মন পরিষ্কার হয়ে গেছে। সে গুরুর বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।
রাত প্রায় শেষ। ভোর হয় হয়। এই সময়কে ঊষালগ্ন বলা হয়। ঊষালগ্নেও তিনি বাড়ি ফিরে গেল না। নিশির ডাক শেষ হয়েছে। এখন নতুন ডাক এসেছে। এটিকে বলা যায় ঊষার ডাক।
ঊষার ডাকে সে হাঁটতে লাগল পাহাড়ের ঢালে। পাহাড়ের একটি দিক নিচু হয়ে মিশে গেছে সাগরে। অন্য পাশে কুল কুল করে বইছে একটি ঝরনা। মনে. হয় এখন পাহাড় আর সাগর একান্তে মনের কথা বলবে। এমন জায়গা সবারই ভাবুক হতে ইচ্ছা করে। সক্রেটিস ভাবুক হয়ে গেল। ঊষার ডাকে আবার ভাবতে শুরু করল।
গুরুর বাড়িতে মনে হয়েছিল তার সব হিসাব মিলে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, একটুখানি মিলেনি। সে নিজে কী যেন ভাবছে, সেটি গ্রিক থট-এর ভেতরে নেই। প্রকৃতির দার্শনিকরা বলছেন, প্রকৃতির সবকিছু নিয়মে চলে, প্রকৃতির সবকিছু যুক্তি দিয়ে হয়। কিন্তু তারা শুধু প্রকৃতির কথা বলেছেন। অন্য একটি বিষয়ের কথা তাদের মাথায়ই নেই। সেটি হলো মানুষ
প্রকৃতির দার্শনিকদের মতে সবকিছু হলো বস্তু, তাহলে মানুষও একটি বস্তু। সব বস্তু যদি যুক্তি দিয়ে চলে, তাহলে মানুষও যুক্তি দিয়েই চলবে। একটি বস্তু তাপে গরম হয়, বর্ষায় পানিতে ভেজে, শীতকালে ঠাণ্ডায় জমে যায়। সক্রেটিস ভাবছেন, মানুষ তো ঠিক এই নিয়মে চলে না। মানুষের ভেতরে অন্য কিছু আছে, যা এসব নিয়ম মানে না। তাই মানুষের জীবনকে কাঠখোট্টা নিয়মে ফেলা যায় না। মানুষ আলাদা জিনিস।
ততক্ষণে সূর্য উঠি উঠি করছে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে সক্রেটিস ভাবছে তাহলে মানুষকে কে চালায়?
সক্রেটিস আবার দৌড়ে গুরুর কাছে এলো।
গুরু মাত্র শুয়েছেন। সারা রাত সক্রেটিস তাকে জ্বালিয়েছে। সে যাওয়ার পর মাত্র দুচোখ এক করেছেন। তখনই আবার ডাকাডাকি শুরু করেছে। সক্রেটিসের মাথায় প্রশ্নের পোকা ঢুকলে সে কিছুই মানে না। চোখ ডলতে ডলতে ঘরের বাইরে এসে গুরু ঝিমুতে শুরু করলেন। ঝিমুনি-টিমুনি সক্রেটিস বোঝে না। সে বলল, গুরু, আমার মুশকিল তো আসান হয়নি। প্রকৃতির দার্শনিকরা বলেন, সবকিছু যুক্তি দিয়ে চলে। কিন্তু মানুষের জীবন যুক্তি দিয়ে চলে না। তাহলে মানুষকে কে চালায়?
গুরু ঝিমুতে ঝিমুতে বললেন, প্রতিটি জিনিসের ভেতরে একটা কিছু আছে, যা তাকে নিয়ম মেনে চলতে শেখায়
‘মানুষের ভেতর সে রকম কী আছে?’
‘মানুষের আছে ‘মন’। আত্মাও বলতে পারিস।’
সক্রেটিস লাফ দিয়ে বলল, ‘ইউরেকা’। এটি তার ইউরেকা মুহূর্ত। সে গুরুকে একটি চুমো দিয়ে তার বাড়ি থেকে এক দৌড়ে আবার সেই পাহাড়ের উপর গিয়ে বসল।
এই সকালে সক্রেটিস পুরোপুরি নতুন একটি জিনিস নিয়ে ভাবলো। সেটি হলো ‘মানুষ’। সক্রেটিসের আগে মানুষকে নিয়ে এমন করে আর কেউ ভাবেন নি।
এতদিন দর্শন ছিল আকাশের জিনিস, উপরের জিনিস। এতদিন দুই রকম জ্ঞানী মানুষ ছিল। একদল বলত, ঐ উপরে অলিম্পাস পাহাড়ে রসে দেবতারা সবকিছু করছে। দেবতাদের কীভাবে খুশি রাখতে হবে, সেটি নিয়েই তারা সারা দিন কথা বলত। তাদের কাছে মাথার উপরের দেবতারাই সবকিছু, মানুষ কিছুই নয়। আর একদল জ্ঞানী সব সময় প্রকৃতি নিয়ে কথা বলছে। তারা বলেন, আকাশে চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-তারা, জোয়ার-ভাটা এসব কীভাবে চলে, সেই নিয়ম বের করাই একমাত্র জরুরি বিষয়। তাদের কাছেও প্রকৃতিই সবকিছু। মানুষ কিছুই নয়।
সক্রেটিস ভাবল, না, এসবের বাইরেও আরও একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে, সেটি হলো মানুষ। মানুষের জীবনকে সুন্দর করাই মানুষের এক নম্বর কাজ। মানুষ যদি সঠিক পথে না আসে, তাহলে সব জ্ঞান বৃথা। আকাশ, বাতাস, সাগর নিয়ে গবেষণা করে কোনো লাভ নেই, যদি সেটি মানুষ না বোঝে। আজ থেকে আমার বিষয় হলো ‘মানুষ’। আমি মানুষ নিয়ে কাজ করব। কিন্তু এথেন্সে এখন মানুষের সংখ্যা কত? প্রায় তিন লাখ। তো আমার গবেষণার বিষয় এই তিন লাখ মানুষ। কিন্তু তিন লাখ মানুষ নিয়ে আমি একা কাজ করব? মানুষ তিন লাখ কিন্তু তাদের বিবেক একটি। আমি মানুষের বিবেক নিয়ে কাজ করব। আমি মানুষের বিবেক ছুঁয়ে চলব।
সবার আগে মানুষের জন্য নিয়ম বানাতে হবে। সেজন্য জরুরি হলো মানুষের মন। একটি সুন্দর মন তৈরি করতে হবে। মন সুন্দর হলেই জীবন সুন্দর হবে। তাহলে আজ থেকে আমি সুন্দর মন তৈরির উপায় খুঁজব।
সক্রেটিসের এই এক ভাবনায় দর্শন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এলো। জ্ঞান বাইরের জিনিস থেকে মানুষের মনের ভেতরের জিনিস হয়ে গেল। পৃথিবীর জ্ঞানের ভাণ্ডারে নতুন একটি সাম্রাজ্য তৈরি হলো—
সেটি হলো মনের সাম্রাজ্য।
***
৩২. এরিস্টটল বলেন, খ্রি. পূ. ৪৬৭ অব্দে প্রাচীন Aegospotami নামক নদীর তীরে একটি উল্কাপাত হয়েছিল। সেই ঘটনার সাথে এনাক্সাগোরাসের কথার মিল ছিল বলে লোকে এটিকে তার ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
৩৩. এরিস্টটলের মতে. থেলিস (Thales) হলেন বিজ্ঞানের জনক। তার জীবনকাল ছিল খি. পূ. ৬২০-৪৪৬ অব্দ। তার ছাত্র ছিলেন। এনাক্সিম্যানডার (Anaximander) ও এনা।স নেস (Anaximenes)। তারা Pre – Socratic Philosophers যারা দেবদেবীর তত্ত্বকে বাতিল করে প্রকৃতির দর্শন শুরু করেছিলেন। তারা জন্ম নিয়েছিলেন মিলেটাস শহরে, যেটি বর্তমানে তুরস্কের মধ্যে, সেই সময়ে ছিল গ্রিক নগর।
৩৪. তখন ইউরোপের পণ্ডিতগণ জানতেন শুধু ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকা নিয়েই পৃথিবী; এর বাইরে আর কিছুই নেই।