৭
‘আমরা বাহ্যিক সৌন্দর্যকে ভালোবাসি,
কিন্তু সেই ভালোবাসা আমাদের বিলাসী করেনি;
আমরা অন্তরের সৌন্দর্যকে ভালোবাসি,
কিন্তু সেই ভালোবাসা আমাদের শক্তিহীন করেনি
— পেরিক্লিস
***
ইউরিপিডিস আড্ডার জন্য জুতসই লোক নয়।
সে আড্ডা নষ্ট করে। সে সব সময় বড় বড় জিনিস নিয়ে আলাপ করে। উচ্চস্তরের কথাবার্তা বলে। আড্ডার জন্য উচ্চস্তরের কথা ক্ষতিকর। আড্ডায় দরকার তুচ্ছ কথা, টুকরা আলাপ। ইউরিপিডিস কোনো ধরনের টুকরা আলাপে নেই। তার সবকিছু উচ্চপর্যায়ের
ইউরিপিডিস নিজে জানে যে সে আড্ডার জন্য উপযোগী নয়। তাই সে আড্ডায় বেশি কথা বলে না, চুপচাপ শোনে। কিন্তু যেদিন সে কথা শুরু করে, সেদিন সবাই বুঝে যায় যে আজ আর কারও কোনো সুযোগ নেই, আজ সব কথা সে একাই বলবে। সেসব কথা উচ্চস্তরের সাহিত্যের কথা। তখন আর উপায় নেই, সবাই মুখে কুলুপ দিয়ে তার কথা শোনে।
আজ ইউরিপিডিস কথা শুরু করেছে। তাই অন্য সবার মুখে কুলুপ।
সক্রেটিসের মুখেও কুলুপ। সে মনে মনে বলছে ইউরিপিডিস যেন আজ হোমারের বই নিয়ে আলাপ শুরু করে। হোমারের লেখা সে খুব সুন্দর করে বলতে পারে।
ভাগ্য ভালো। ইউরিপিডিস হোমারের লেখা নিয়েই কথা বলছে। সে নাটকের মতো ঘটা করেই শুরু করেছে ট্রয় যুদ্ধের কথা। তার প্রিয় বই হোমারের ‘ইলিয়াদ’। সে এখন ইলিয়াদ আবৃত্তি করবে। সেটি বুঝতে পেরে সক্রেটিস বলল, আজকের আড্ডার একটি নাম দিই। নাম হোক ‘হোমারের আকাশে এক ঝাঁক যুবক।
সিমন বলল, হোমারের আকাশে ঢোকার শুরুতে বলো, ট্রয় যুদ্ধের জায়গাগুলো ঠিক কোনখানে?
ইউরিপিডিস বলল, কোনখানে? মানে আমাকে এখন ভূগোল বলতে হবে? ঠিক আছে, ইতিহাস থাক, আগে ভূগোল। তো শোন, ট্রয় যুদ্ধের ভূগোল হলো তিনটি প্রধান শহর নিয়ে। সেগুলো হলো ট্রয়, স্পার্টা আর মাইসিন। ট্রয় শহরটি আমাদের ঠিক নাক বরাবর। ওদিকে তাকাও, এথেন্স থেকে এজিয়ান সাগরের ঠিক উল্টা পাড়েই ট্রয়। স্পার্টা হলো এথেন্স থেকে আড়াইশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি শহর। স্পার্টার রানি হেলেন ছিলেন বিশ্ব সুন্দরী। সুন্দরী হেলেন ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের প্রেমে পড়ে ট্রয় নগরে পালিয়ে যায়। প্রতিশোধ নিতে হেলেনের স্বামী স্পার্টার রাজা মেলেনাউস ছুটে এলো তার বড় ভাইয়ের কাছে। বড় ভাই মাইসিন[২৯] নগরের রাজা আগামেমনন। আগামেমনন গ্রিসের সব নগরের মানুষকে নিয়ে একটি বিশাল সেনাবাহিনী একত্র করল মাইসিন শহরে। মাইসিন শহরটি এথেন্স থেকে নব্বই মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এই মাইসিন থেকেই গ্রিক বাহিনী জাহাজে করে ট্রয় আক্রমণ করে। যুদ্ধটা হয়েছিল ট্রয় নগরেই
সিমন বলল, বাহ্, তুমি তো ভূগোলে একেবারে দশে দশ। কোন জায়গা কোন দিকে, কত দূরে সব মুখস্ত।
ইউরিপিডিস বলল, কারণ হলো এই জায়গাগুলো আমার একেবারে তীর্থস্থানের মতো। আমার কয়েকটা তীর্থ আছে, সেই জায়গাগুলোতে আমি বারবার যাই। প্রথম তীর্থ হলো সেই জায়গা, যেখানে হোমার জন্ম নিয়েছিলেন। সেটি হলো কিয়স দ্বীপ। সেখানে আমি দশবার গিয়েছি। এর পরের তীর্থ হলো ট্রয় যুদ্ধের জায়গাগুলো। আমি সময় পেলেই এই জায়গাগুলো ঘুরে আসি। কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম ট্রয় নগরে। এবার সেখানে গিয়ে ঠিক করলাম একদিন ট্রয়ের মেয়েদের নিয়ে একটি নাটক লিখব।
সক্রেটিসের মনে হলো, আড্ডা যত খারাপ হবে ভেবেছিল, তত খারাপ লাগছে না। ইউরিপিডিস নাটকের মানুষ। সে নাটকীয়ভাবে ঘটনা বলতে পারে। হোমারের বই তার টানা মুখস্ত। সে তোতাপাখির মতো ঘটনা বলছে। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তার মনে হলো হোমারের আকাশে সত্যিই জ্বলে উঠেছে এক ঝাঁক যুবক।
কবি হোমারের বই এখানে ধর্মগ্রন্থের মতো। এখানে অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। গ্রিসের ধর্ম-কর্ম এরকম-
মানুষ বিশ্বাস করে যে এথেন্সের উত্তরে চারশ কিলোমিটার দূরে অলিম্পাস পাহাড়ে বারোজন দেবতা থাকে। সেই দেবতাদের রাজা হলেন জিউস। জিউস তার সাঙ্গাপাঙ্গ নিয়ে পৃথিবী চালান। এই দেবতারাই মানুষের সব কাজ নিয়ন্ত্ৰণ করে। দেবতারা খুশি হলে মানুষ সুখে থাকে আর বেজার হলে ঘটে সাড়ে সর্বনাশ। এক একজন দেবতা আবার এক একটি শহর কবজা করে রাখেন। যেমন এথেন্সের দেবী হলেন এথিনা। এখানে সব কাজ দেবী এথিনার নামে হয়। দেবতাদের সব কাজকর্ম মানুষের মতোই, তবে তাদের সবকিছু একটু বেশি বেশি। তাদের রাগ বেশি, আবেগ বেশি, ভালোবাসা বেশি, হিংসাও বেশি। খুশি হলে তারা হা হা, হো হো করে হাসে; দুঃখ পেলে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে; আবার হিংসায় জ্বলে পুড়ে তীব্রভাবে ঝগড়া করে। তাদের ঝগড়া আর হিংসায় মানুষের জীবনে নেমে আসে ট্র্যাজেডি।
এখানে দেবতাদের কথা মানুষের মুখে মুখে, লিখিত কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। ধর্মগ্রন্থের জায়গাটি শূন্য। সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে হোমারের দুটি বই— ইলিয়াদ আর অডিসি। এই দুটি বই বাচ্চারা তোতাপাখির মতো মুখস্ত করে। একটু বড় হলে কথায় কথায় এই বইগুলো থেকে শোলক বলে। বই দুটো প্রত্যেকের জীবনের অংশ। বড় পবিত্র জিনিস। এই দুটোর কাহিনি জানে না এমন মানুষ এথেন্সে নেই। ইলিয়াদ হলো ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনি।
ইউরিপিডিস মায়াভরা গলায় বলছে, ট্রয় নগরীকে আমরা গ্রিকরা বলি ইলিয়ন। ইলিয়নের কাহিনি নিয়ে হোমারের কবিতা, সেজন্য বইয়ের নাম ইলিয়াদ। ইলিয়াদ হলো কবিতা, একটি মহাকাব্য। কবি হোমার এই মহাকাব্যে সুর, ছন্দ, অলংকার মিশিয়ে ট্রয় যুদ্ধের কথা বলেছেন। এই বইতেই হোমার একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করে গেছেন। একটি দীর্ঘ কবিতা কীভাবে লেখা যায়; মহাকাব্য কেমন হয়; একটি কাহিনি কীভাবে শুরু করে কীভাবে শেষ করতে হয়, সেটি তিনি তৈরি করে গেছেন।
সক্রেটিস ভাবছে ইউরিপিডিস নতুন কথা বলছে। এখানে সবাই ইলিয়াদের কাহিনি জানে। কিন্তু ইউরিপিডিস যেভাবে ব্যাখ্যা করছে, সেটি কেউ জানে না। ছেলেটা আসলেই সাহিত্যের পণ্ডিত। কিন্তু বেশি পণ্ডিতি করতে দিলে ওর কথা কেউ কিছুই বুঝবে না। ওকে এমনভাবে বলতে দিতে হবে যেন বেশি গভীরে চলে না যায়। হালকার উপর ঝাপসা করে বলতে দিতে হবে।
সক্রেটিস বলল, কবিতার ছন্দ, সুর ওসব তোমাদের কবিদের কাজ। ছন্দ, সুর নিয়ে আমাদের কাজ নেই। আমাদের বলো যে ইলিয়াদ বইটা হোমার এমন কীভাবে শুরু আর শেষ করলেন যে, যেটি একেবারে নতুন একটি ধারা হয়ে গেল?
ইউরিপিডিস বলল, ভেবে দেখো, ইলিয়াদের কাহিনি তো হোমার নিজে তৈরি করেননি। ট্রয় যুদ্ধের কাহিনি মানুষ কয়েক শত বছর ধরে জানে। সেই কাহিনি থেকে একটি মহাকাব্য লিখতে কোনখান থেকে শুরু করবেন, সেটি একান্তই কবির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। হোমার ইলিয়াদ[৩০] শুরু করেছেন এভাবে—
‘রাগ, মহারাগ, রাগে ফুঁসছে মহাবীর একিলিস’। এটি ইলিয়াদের প্রথম লাইন।
দেখো— এখানে একটি আকর্ষণ আছে। সবাই জানে একিলিস হলো রক্ত মাংসের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় বীর। সেই বীর রাগে ফুঁসছে। লাইনটি পড়েই মানুষের মনে হয় একিলিস কেন রাগ করেছে? একিলিসের মতো বীর রাগ করেছে মানে ঘটনা সাংঘাতিক। মানুষ জানতে চায় এই রাগের কারণ কী, পরিণতি কী? এই যে শুরুতেই মানুষের মনে একটি প্রশ্ন জাগিয়ে দেওয়া, জানতে চাওয়ার একটি ইচ্ছা জাগিয়ে দেওয়া, এটি হোমার আমাদের শিখিয়েছেন। আজ যদি তুমি তোমার দাদুকে ট্রয় যুদ্ধের কথা জিজ্ঞেস করো, তিনি শুরু করবেন এভাবে— তিনজন দেবী একটি আপেল নিয়ে ঝগড়া করছিল, তারা হেলেনকে প্যারিসের প্রেমে মশগুল করে দিল, তারা পালিয়ে গেল। কিন্তু হোমার সেভাবে শুরু করেননি। হোমার একজন বীরকে বাছাই করেছেন যার নাম একিলিস, যার রাগ-ক্রোধ-বীরত্বকে কেন্দ্র করে কাহিনি টেনে নিয়ে গেছেন। এখন আমরা সব লেখক এভাবেই কাহিনি বানাই, এভাবেই নাটক শুরু করি।
সিমন বলল, বোঝা গেল যে ইলিয়াদের শুরুটা নাটকীয়। এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যে নাটকীয়ভাবে শুরু করার ব্যাপারটা চালু হয়েছে। আর এই বইয়ের সমাপ্তি কীভাবে আলাদা?
ইউরিপিডিস বলল, সেখানেও হোমার নতুনত্ব এনেছেন। ট্রয় যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ইলিয়াদের কাহিনি যায়নি। হোমার ইলিয়াদ শেষ করেছেন ট্রয়ের বীর হেক্টরের মৃত্যুতে। তুমি যদি ইলিয়াদ লেখার আগে কাউকে ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনি জিজ্ঞেস করতে, সে বলত, ট্রয় যুদ্ধের মূল চরিত্র হেলেন বা প্যারিস। হয়তো অন্য কেউ বলত, এই যুদ্ধ জিতেছে গ্রিসের রাজা আগামেমনন, তাই মূল চরিত্র সে। কিন্তু হোমারের কাহিনি এখানে একেবারে অনন্য। তার কাহিনির মূল হলো একিলিস আর হেক্টরের যুদ্ধ। হোমার এই বইতে দুজন বীর মানুষের চরিত্র এঁকেছেন। একিলিস হলেন বিরাট যোদ্ধা, একই সাথে ভীষণ রাগী। আর হেক্টর হলেন মহান বীর, তিনি মানবিক। তার মৃত্যুকেই কবি মনে করেছেন কাহিনি শেষ করার জন্য উপযুক্ত। হেক্টরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইলিয়াদ শেষ করার মাধ্যমে কবি হোমার শুরু করলেন নতুন ধারা। তিনিই দেখালেন কাহিনি শেষ হবে বীরের মৃত্যুতে। তার মৃত্যুই হবে ট্র্যাজেডি। আমরা এখন যত নাটক লিখি— সেগুলোর পরিণতি হয় ট্রাজিক, এই ব্যাপারটা শুরু করেছেন হোমার। তার থেকেই আমরা শিখেছি। তিনিই আমাদের গুরু।
একথা বলতে বলতে ইউরিপিডিস মাথা নুইয়ে হোমারকে সম্মান জানাল। আড্ডার সবাই একেবারে মুগ্ধ। এত চমৎকার করে হোমারের কথা তারা আগে কোনোদিন শোনেনি। এরা সবাই ছোটবেলা থেকেই হোমারের ভক্ত। কিন্তু হোমারের পাণ্ডিত্য যে কতখানি, সেটি তারা জানত না। ইউরিপিডিস আজ সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দিচ্ছে।
সিমন বলল, এবার তুমি অতি সংক্ষেপে ইলিয়াদের কাহিনি শোনাও। দেখি, এতক্ষণ যা ব্যাখ্যা করলে, সেটির সাথে মিলে কিনা।
ইউরিপিডিস মুচকি হাসি দিয়ে শুরু করলেন ইলিয়াদের কাহিনি। এই কাহিনি তার ঠোঁটের আগায়। সে তরতর করে বলতে শুরু করল :
ইলিয়াদের আগে ট্রয় যুদ্ধের একটি প্রেক্ষাপট বলা দরকার। ট্রয় যুদ্ধ শুরু হয় এভাবে। বীর একিলিসের বাবা-মায়ের বিয়ের উৎসবে সব দেব-দেবী দাওয়াত পেয়েছেন। শুধু দাওয়াত পাননি ঝগড়ার দেবী। সেজন্য তিনি রাগ করে বিয়ের উৎসব ভণ্ডুল করার জন্য সেখানে পাঠালেন একটি সোনার আপেল, আপেলের ওপর লেখা— ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারীর জন্য।’ সাথে সাথে আপেল নেওয়ার জন্য ঝগড়া লেগে গেল। তিনজন দেবী এথিনা, হেরা আর আফ্রোদিতি নিজেকে সেরা সুন্দরী বলে দাবি করলেন। দেবতাদের রাজা জিউস ঠিক করলেন, প্রতিযোগিতা হবে। পৃথিবীর প্রথম সুন্দরী প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার বিচারক হবেন ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস। প্যারিস সোনার আপেলটা হাতে নিয়ে বসল। তিন সুন্দরীই তাকে ঘুষ দিতে চাইলেন। দেবী হেরা বললেন, আমি হলাম দেবতাদের মহারানি, আমি তোমাকে সারা পৃথিবীর রাজা করে দেব। দেবী এথিনা বললেন, আমি যুদ্ধের দেবী, তোমাকে সব যুদ্ধ জিতিয়ে দেব। দেবী আফ্রোদিতি বললেন, আমি সৌন্দর্যের দেবী, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে তোমার প্রেমে পাগল করে দেব। তরুণ প্যারিস প্রেমিক মনের মানুষ। সে ভাবলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের প্রেমের চেয়ে বড় পুরস্কার আর হতে পারে না। সে আফ্রোদিতিকে সোনার আপেল দিয়ে দিল। আফ্রোদিতি কথা রাখলেন। পৃথিবীর সেরা সুন্দরী স্পার্টার রানি হেলেন প্রেমে পড়ল প্যারিসের, তার সাথে ট্রয় নগরে পালিয়ে গেল। হেলেনের স্বামী স্পার্টার রাজা মেনেলাউস তার ভাই আগামেমননের কাছে গেল। আগামেমনন সব গ্রিক বীরদের একত্র করে জাহাজে করে আক্রমণ করল ট্রয়। উদ্দেশ্য হেলেনকে উদ্ধার করা। গ্রিকদের ছিল সবচেয়ে বড় বীর একিলিস, সবচেয়ে বুদ্ধিমান অডিসিয়াস আর তাদের সবার নেতা রাজা আগামেমনন। গ্রিকরা ভেবেছিল, তারা খুব সহজে ট্রয়কে ধ্বংস করে মহানন্দে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু সেটি হয়নি। ট্রয়ের আছে বীর যোদ্ধা হেক্টর আর আছে শহরের চারধার ঘিরে অনেক উঁচু দেয়াল। তারা দেয়ালের ভেতরে থাকে। সেই দেয়াল ভেদ করে ট্রয়ের ভেতর কেউ ঢুকতে পারে না। গ্রিকরা ট্রয়ের দেয়ালের চারপাশ ঘিরে রইল।
এই অবস্থা থেকে হোমার তার ইলিয়াদ মহাকাব্যের কাহিনি সাজিয়েছেন। হোমার যেভাবে ইলিয়াদের কাহিনি নির্মাণ করেছেন, সেটি মোটামুটি এরকম—
গ্রিকরা নয় বছর ধরে ট্রয়কে চারদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। দশম বছরের যুদ্ধ চলছে।
একিলিস খুব রাগ করেছে। রাজা আগামেমননের সাথে তার ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়ার কারণ খুবই লজ্জাজনক। ঝগড়া হচ্ছে যুদ্ধে পাওয়া একটি নারীকে দখল করা নিয়ে। ট্রয় আক্রমণ করে লুটের সম্পদ ভাগাভাগি করে নিয়েছিল গ্রিকরা। যুদ্ধে পাওয়া মেয়েদেরও নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল গ্রিক বীরেরা। এক সময় হঠাৎ শুরু হলো প্লেগ। প্লেগে গ্রিক সেনারা মারা যাচ্ছে। প্লেগের কারণ রাজা আগামেমনন ট্রয়ের যে মেয়েটিকে যুদ্ধবন্দি করে রেখেছিল, সে ছিল দেবতা এপোলোর মন্দিরের সেবিকা। মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে তার বাবা অনেক কান্নাকাটি করেছে, অনেক ঘুষ দিতে চেয়েছে, কিন্তু একরোখা আগামেমনন কিছুতেই মেয়েটিকে ছাড়বে না। সেজন্য দেবতা এপোলো রাগ করে গ্রিকদের মাঝে প্লেগ ছেড়ে দিয়েছে। প্লেগ থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে আগামেমনন মেয়েটিকে ফেরত দিচ্ছে, কিন্তু বিনিময়ে একিলিসের কাছে যে যুদ্ধনারী ছিল, তাকে নিয়ে নিচ্ছে। সেই রাগে বীর একিলিস ফুঁসছে। সে আগামেমননকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, সে আর তাকে রাজা বলে মানবে না, সে আর এই যুদ্ধ করবে না। একিলিস যুদ্ধ ত্যাগ করে তার মা থেটিসের কাছে কেঁদে কেঁদে নালিশ করল। তার মায়াশীলা মা দেবরাজ জিউসের কাছে ছেলের জন্য তদবির করল, ‘দেবরাজ, এমন কিছু করুন যেন গ্রিকরা বিপদে পড়ে, একিলিসকে ছাড়া কিছুতেই যুদ্ধ জিততে না পারে। জিউস আগামেমননকে স্বপ্নে বলল, আর অবরোধ করে থেকো না, ট্রয় আক্রমণ কর।
দেবতার স্বপ্নাদেশ পেয়ে গ্রিকরা সেনা সাজালো। ট্রয়ও তাদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এলো। যুদ্ধের শুরুতে প্রেমিক পুরুষ প্যারিস একটু বীরত্ব দেখাতে চাইল। সে বলল, ‘হেলেনকে নিয়ে এই যুদ্ধ। আমি আর মেনেলাউস দুজনেই হেলেনকে চাই। তো আসো, আমি আর মেনেলাউস দুজনে যুদ্ধ করি। যে জিতবে হেলেন তার। ট্রয় যুদ্ধ এখানেই শেষ হবে।’ গ্রিকরা রাজি। কিন্তু প্যারিস আসলে প্রেমের মাঠের পাকা খেলোয়াড়, যুদ্ধে খুবই কাঁচা। সে একেবারে গো হারা হেরে গেল মেনেলাউসের কাছে। হারার পর আর তার বীরত্ব থাকল না, জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গেল ট্রয়ের দেয়ালের ভেতরে। দুই পক্ষে শুরু হলো বিশাল যুদ্ধ।
হেক্টর তার স্ত্রী ও সন্তানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলো। অনেক বিক্রমে যুদ্ধ করল। কয়েক দিন যুদ্ধ চলল, হেক্টর গ্রিকদের হারিয়ে এগিয়ে চলল। আর একটু আগালেই গ্রিকদের জাহাজ পুড়িয়ে দেওয়া শুরু করবে। অবস্থা খারাপ বুঝে আগামেমনন দেখল আর উপায় নেই, এখন সবচেয়ে বড় বীর একিলিসকে লাগবেই। গ্রিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী অডিসিয়াস ও এজাক্স গেল একিলিসকে বোঝাতে। একিলিসের কাছ থেকে আগামেনন যে নারীটিকে নিয়ে গিয়েছিল, তাকেও ফেরত দিল। কিন্তু না, একিলিস আগামেমননকে ঘৃণা করে, সে যুদ্ধ করতে এলো না। এখানে হোমার একিলিসের মুখে খুব সুন্দর একটি সংলাপ দিলেন। যুদ্ধে যাবে কিনা সেই দ্বিধায় একিলিস বলল,
‘আমার মা থেটিস বলেছেন, আমার সামনে এখন দুটি ভাগ্যরেখা। যদি যুদ্ধ করি, আমার আর বাড়ি ফেরা হবে না, কিন্তু আমার গৌরব রয়ে যাবে চিরকাল। আর যদি যুদ্ধ না করে ফিরে যাই, তাহলে বেঁচে থাকব অনেক দিন, কিন্তু গৌরবের হবে মরণ।’
একিলিস যুদ্ধ করতে গেল না। এদিকে ট্রয়ের হেক্টর এগিয়ে আসছে, সব গ্রিক জাহাজ পুড়িয়ে দেবে। তখন একিলিসের সবচেয়ে কাছের বন্ধু পেট্রোক্লাস একিলিসের যুদ্ধ-পোশাক পরে যুদ্ধে এগিয়ে গেল। হেক্টর তাকে একিলিস মনে করে হত্যা করল। একিলিসের কাছে যখন প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ এলো, সে আকাশ কাঁপিয়ে হাহাকার করে উঠল,
‘কষ্ট, আমার বুকভরা কষ্ট, পিতা বা পুত্রের মৃত্যুও আমার কাছে এত কষ্টের নয়।’
বীর একিলিস হাউমাউ করে কাঁদল। কিন্তু একটু পরেই কান্না থামিয়ে রাগে গর্জন করে উঠল। বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। প্রতিশোধের নেশায় সে উন্মাদ হয়ে গেল। সে যুদ্ধে গেল। উদ্দেশ্য হেক্টরকে হত্যা করা। হেক্টর তার সাথে যুদ্ধের শর্ত নিয়ে কথা বলতে চাইল। কিন্তু একিলিস হুংকার দিয়ে বলল,
‘সিংহ কোনোদিন মানুষের শর্ত মানে না, নেকড়ে কোনোদিন মেষের সাথে চুক্তি করে না, এই যুদ্ধে কোনো শর্ত হবে না; শর্ত শুধু একটিই— মরতে হবে একজনকে, একজনের রক্তে ভিজতে হবে এই রণাঙ্গনের মাটি।’
ভয়াবহ যুদ্ধে একিলিস হত্যা করল হেক্টরকে। প্রতিশোধের নেশায় একিলিস হেক্টরের দেহ রথের চাকায় বেঁধে ট্রয়ের দেয়ালের চারপাশে উন্মাদের মতো ঘুরতে থাকল। প্রতিশোধ শেষ হলে, একিলিস বন্ধুর দেহ সৎকার করল। বন্ধুর স্মৃতিতে বিশেষ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করল। কিন্তু এরপরও হেক্টরের উপর তার রাগ কমল না। সে হেক্টরের মৃতদেহ ফেরত দেবে না, হেক্টরের দেহের সৎকার হবে না, তার মৃতদেহ শিয়াল-কুকুরে খাবে। তখন হেক্টরের বৃদ্ধ বাবা ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম অনেক উপহার নিয়ে এসে অনুনয় করলে হেক্টরের দেহ ফেরত দিল। হেক্টরের দেহ চিতায় পোড়ানো হলো। পোড়ানো শেষে হাড়গুলো একটি সোনার ঘটে করে কবর দেওয়া হলো। মহান বীর হেক্টরের দেহ সৎকার পেল।
হোমার এই পর্যন্ত ইলিয়াদ শেষ করেছেন।
.
ইলিয়াদ এখানে শেষ হলেও ট্রয় যুদ্ধ শেষ হয়নি। একিলিস যুদ্ধ করছিল। একিলিসের একটি মজার বর ছিল। শুধু গোড়ালিতে ছাড়া অন্য কোথাও কোনো আঘাতে তার কিচ্ছু হবে না। দেবতা এপোলো এই গোপন খবর বলে দিল প্যারিসকে। প্যারিস তীর মারলো একিলিসের গোড়ালি লক্ষ্য করে। মারা গেল গ্রিসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর একিলিস। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়নি। হেক্টরের মৃত্যুর পর ট্রয় বাহিনী প্রায় শেষ হয়ে গেছে। গ্রিকদের জয় এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ট্রয় নগরের দেয়াল বড় কঠিন। গ্রিকরা সেটি ভেঙে ঢুকতে পারছে না, তাই যুদ্ধও শেষ হচ্ছে না। শেষে গ্রিসের কৌশলী নেতা অডিসিয়াস একটি ফন্দি করল। কাঠের একটি বিশাল ঘোড়া বানিয়ে ট্রয়কে উপহার দিয়ে বলল, ‘যুদ্ধ শেষ, আমরা গ্রিসে ফিরে যাচ্ছি। এই ঘোড়া আমাদের কাছ থেকে তোমাদের জন্য উপহার। নাও, ঘোড়া নিয়ে আনন্দ করো।’ ট্রয়ের মানুষ সেই ঘোড়া নগরের দেয়ালের ভেতরে নিয়ে আনন্দ শুরু করল। তারা যুদ্ধ জিতে গেছে। কিন্তু সেই কাঠের ঘোড়ার ভেতরে লুকিয়ে ছিল গ্রিসের কয়েকজন শক্তিশালী যোদ্ধা। তারা রাতে ঘোড়া থেকে বের হয়ে ভেতর থেকে ট্রয়ের দেয়াল খুলে দিল আর গ্রিক বাহিনী ঢুকে পড়ল ট্রয় নগরে। তারা ট্রয় শহর জ্বালিয়ে দিল। সব পুরুষ নাগরিককে হত্যা করল। নারী আর শিশুদের যুদ্ধবন্দি করে জাহাজে তুলল। রাজা আগামেমনন জিতল ট্রয়ের যুদ্ধ। হেলেনকে ফিরে পেল মেলেনাউস। তারা বাড়ি ফেরার জন্য জাহাজে উঠল।
অনেকক্ষণ ধরে ট্রয়ের কাহিনি বলতে বলতে ইউরিপিডিস ক্লান্ত। সে একজন দাসকে ইশারা করল। গলা শুকিয়ে কাঠ। পানীয় দরকার।
সক্রেটিস ইউরিপিডিসের পিঠ চাপড়ে বলল, আমি নাটক, গল্প, কবিতা এগুলো তেমন ভালোবাসি না। এগুলো মিথ্যার বেসাতি। কিন্তু ইউরিপিডিস যেভাবে বলে, সেটি ভালো না লেগে উপায় নেই। আজ তুমি সত্যিই আসর জমিয়ে দিয়েছো। একেবারে কিস্তিমাৎ।
ক্রিতো বলল, আমরা চাই ইউরিপিডিস প্রতিদিন আমাদের আড্ডায় আসুক। আমরা তার কাছে প্রতিদিন বিনা টিকিটে নাটক দেখব।
সিমন বলল, আমার কিন্তু আরও কিছু কঠিন আলাপ বাকি আছে।
ক্রিতো বলল, কঠিন-তরল যা বাকি আছে সবই বলে ফেল।
সিমন বলল, কবি হোমার কি নিজে ট্রয় যুদ্ধ দেখেছেন?
ইউরিপিডিস হাসতে হাসতে বলল, হোমার কেন, তার দাদার দাদাও দেখেননি। ট্রয় যুদ্ধের চারশো বছর পরে হোমার ইলিয়াদ লিখেছিলেন। সেই সময় সবাই মুখে মুখে ট্রয়ের কাহিনি মনে রাখত। এই কাহিনি নিয়ে কবিরা পালাগান লিখতেন। একদিন হোমার এই কাহিনি নিয়ে চমৎকার কবিতার ছন্দে লিখে ফেললেন বিশাল এক কবিতার বই। একটি মহাকাব্য। নাম দিলেন ইলিয়াদ।
সিমন বলল, চমৎকার।
চেরোফোন অনেকক্ষণ কথা বলেনি। সে বলল, ইলিয়াদ তো বিশাল কাব্য। কয়টি লাইন আছে এই কবিতায়?
ইউরিপিডিস বলল, ১৫৬৯৩ লাইন। এতগুলো লাইনে তিনি চমৎকার সব অলংকার আর তুলনা ব্যবহার করেছেন। একিলিসকে তিনি খুব সুন্দর সুন্দর উপাধি দিয়েছেন। হোমারের ভাষায় একিলিস দ্রুতর চেয়ে দ্রুততর, তুলনাহীন তার ছুটে চলা। হোমার অলংকারের রাজা। আজও যেসব সুন্দর সুন্দর অলংকার ব্যবহার করি, তা শুরু করেছেন হোমার।
সক্রেটিস বলল, সেজন্যেই তো আজকের আড্ডার নামও অলংকারময় ‘হোমারের আকাশে এক ঝাঁক যুবক’।
সবাই সায় দিল।
ইউরিপিডিস বলল, তোমরা রাগ না করলে আমি একটি কথা বলি। আমার মনে হয় হোমার যেভাবে ইলিয়াদ লিখেছেন, তাতে এই মহাকাব্যের নায়ক একিলিস নয়। নায়ক হলো ট্রয়ের বীর হেক্টর।
সবাই রে রে করে বলল, আমরা গ্রিক, আমাদের কাছে নায়ক হলো একিলিস। একিলিসই সবার সেরা।
ইউরিপিডিস ত্যাড়া মানুষ। সে বলল, হোমার কিন্তু তার কোনো লেখায় গ্রিকবাহিনী বলেননি। এথেন্সের সেনাবাহিনীও বলেননি। গ্রিক বাহিনীকে তিনি নাম দিয়েছেন আখাইয়ান।
সবাই ইউরিপিডিসকে জেঁকে ধরল। পারলে তাকে পিটুনি দেবে।
চেরোফোন বলল, আরে আখাইয়া তো গ্রিসেরই একটি এলাকা। স্পার্টা থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে। হোমার যদি গ্রিকদের আখাইয়ান বলেন, তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু হোমারের বইয়ের নায়ক একিলিস। এটি তোমাকে মানতেই হবে। শোন, তুমি একাই ইলিয়াদ পড়নি, আমরাও এক-আধটু জানি। একিলিস যুদ্ধে যাত্রা করার সময় তার বাবা বলেছিলেন, ‘যাও, সব সময় সবার সেরা হও, প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাও, সবচেয়ে সাহসী হও, মস্তক উন্নত রেখে সবার উপরে থাকো।’ একিলিসের জীবনের মন্ত্র ছিল এটি। সে সব সময় সবার সেরা হতে চেয়েছে। আজকে যত গ্রিক তরুণ আছে, সবার মন্ত্রও এটি। আমরা সবাই একিলিস হতে চাই। আমরাও তার মতো সবার সেরা হতে চাই এজন্য একিলিসই আমাদের নায়ক।
মোটামুটি যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। ইউরিপিডিসকে নিয়ে এই আরেক বিপদ। সে প্রচলিত কথা মানে না। সবাই বলে নায়ক হলো একিলিস। আর ইউরিপিডিস বলে, না, হোমার সেভাবে লিখেননি। তিনি হেক্টরের মৃত্যুতে ইলিয়াড শেষ করেছেন। এখানে নায়ক হেক্টর।
ইউরিপিডিস লেখক। সে অনুমান করতে পারে, লেখার সময় হোমারের মনে কি কাজ করেছিল। সে ভাবছে, হোমারের কাছে হেক্টর খুবই উন্নত চরিত্রের। সে দেশ রক্ষায় যুদ্ধ করছে। সে তার স্ত্রীকেই ভালোবাসে। সে সন্তানের জন্য কাঁদে। তার মানবিক দিক খুব মহৎ। আর উল্টো দিকে একিলিস বিরাট বীর, সে বিশাল বড় যোদ্ধা। কিন্তু মানুষ হিসেবে সে হেক্টরের কাছে কিছুই না। একিলিস যুদ্ধে পাওয়া নারীকে দখল করা নিয়ে রাজা আগামেমননের সাথে ঝগড়া করে যুদ্ধ থেকে চলে যায়। শুধু বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে হেক্টরকে হত্যা করে। হেক্টরের লাশ ফেরত দিতে অস্বীকার করে। পরে হেক্টরের বাবার কাছ থেকে অনেক ঘুষ পেয়ে লাশ ফেরত দেয়। তাই একিলিস মানুষ হিসেবে খুব মহৎ না। হোমার যেভাবে লিখেছেন তাতে নায়ক হেক্টরই, একিলিস নয়।
মনের কথা এই আড্ডায় বলা যাবে না। একিলিসকে ছোট করে হেক্টরকে বড় করার কথা বললে পিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ইউরিপিডিস থেমে গেল।
সবাই ভেবেছে আড্ডা শেষ। ছেলেরা উঠি উঠি করছে।
কিন্তু সিমনের সাধ মিটেনি। তার জ্ঞান তৃষ্ণা পাহাড় সমান। সে বলল, ট্ৰয় যুদ্ধ শেষে বিশ্বসুন্দরী হেলেনের কী হলো? তার স্বামী কি তাকে মাফ করেছিল?
ইউরিপিডিস বলল, হেলেন হলো ছলনাময়ী সুন্দরী। এক ঝলক আগুনের মতো। আগুনের সামনে গেলে ঘি গলবেই। হেলেনের সামনে তার স্বামীও গলে গিয়েছিল। তারা স্পার্টায় ফিরে সুখে-শান্তিতে বাস করেছে। ভয়ংকর কোনো শাস্তি হেলেন পায়নি।
চেরোফোন চেঁচিয়ে উঠল, ঘটনা দেখেছো! হেলেনের রূপের আগুনে ট্রয় পুড়ে গেছে, হেক্টর মারা গেছে, একিলিস মারা গেছে। আর হেলেন স্বামীর সাথে বাকি জীবন মহাসুখে কাটিয়েছে।
ইউরিপিডিস বলল, আরও আছে। এই যুদ্ধ জয়ী আগামেমননের পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেছে। যুদ্ধ জিতে আগামেমনন ট্রয়ের রাজকন্যা কাসান্দ্রাকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই তার স্ত্রী ক্লিটেমনেস্ট্রা ও স্ত্রীর প্রেমিক মিলে তাদের হত্যা করে। তার স্ত্রী বিয়ে করে নতুন প্রেমিককে। এর কিছুদিন পরে আগামেমননের ছেলে অরিস্টিস ও মেয়ে ইলেকট্রা বাবাকে হত্যার প্রতিশোধের ছক কষে। ছেলে অরিস্টিস হত্যা করে তার মা ও মায়ের প্রেমিককে। কিন্তু মাকে হত্যার পরে সে নিজে অনুশোচনায় পাগল হয়ে যায়।
সিমন বলল, বড়ই দুর্ভাগা আগামেমননের পরিবার।
ইউরিপিডিস বলল, হুঁম, যুদ্ধ শেষে আরেক বীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান অডিসিয়াসও অনেক ভুগেছে। দীর্ঘ দশ বছর সে এখান থেকে ওখানে ঘুরে তারপর বাড়ি ফিরতে পেরেছে। অডিসিয়াসের এই দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাড়ি ফেরার ঘটনা নিয়ে হোমার লিখেছেন তার মহাকাব্য ‘অডিসি’।
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইউরিপিডিস অডিসির কাহিনি শুরু করে দিল—
অডিসিয়াসের বাড়ি ছিল ইথাকা দ্বীপে। ট্রয় যুদ্ধ জিতে গ্রিকদের সবচেয়ে বড় কৌশলী ও কূটনীতিক অডিসিয়াস বাড়ি ফিরতে পারেনি। ভূমধ্যসাগরের ঝড়ে তার জাহাজ ডুবে যায়। সে ভাসতে থাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। দশ বছর কেটেছে পথে পথে। ট্রয়ের যুদ্ধের দশ বছর আর তারপরে আরও দশ বছর— মোট বিশ বছর তীব্র কষ্ট আর অনেক সংগ্রামের পর অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে অডিসিয়াস ফিরে আসে ইথাকায়। ফিরে আসে তার স্ত্রী পেনেলোপির কাছে। এই বিশ বছর তার স্ত্রী পেনেলোপিও সহ্য করেছে ভয়াবহ কষ্ট। টানা বিশ বছর সে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছে। তাকে বিয়ে করার জন্য অনেক পুরুষ নানা ফন্দি করেছে, চাপ দিয়েছে। কিন্তু পেনেলোপি রাজি হয়নি। স্বামীর প্রতি অবিচল বিশ্বাস নিয়ে সে অপেক্ষা করেছে। বুদ্ধি করে বড় করেছে নিজের ছেলেকে। ছেলে টেলেমেকাসকে নিয়ে কৌশল করে তার প্রানিপ্রার্থীদের দূরে রেখেছে। পেনেলোপি একজন সত্যিকার স্বামী অন্তঃপ্রাণ নারী। আর অডিসিয়াস একই সাথে অসীম সাহসী আর পরম বুদ্ধিমান মানুষ। অনেক প্রলোভন, অনেক বিপদেও মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিল অডিসিয়াস। তার মনে একটি ভাবনাই ছিল— আমাকে ইথাকায় ফিরতেই হবে। ফিরতেই হবে স্ত্রী পেনেলোপির কাছে। অডিসিয়াস হলো অসীম সাহসের প্রতীক। মানুষের হার না মানা মানসিকতার প্রতীক। অডিসিয়াসের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে হোমার শেষ করেন তার মহাকাব্য অডিসি।
ইউরিপিডিস বলল, হোমারের অডিসি বইটি ইলিয়াদের চেয়ে অনেক সহজ। কাহিনিতে তেমন প্যাঁচ নেই। সরাসরি একের পর এক ঘটনা ঘটে গেছে। তবে কবি হোমার এই বইতে কৌশলে একটি প্রেমের গল্প বলেছেন। অডিসিয়াস আর পেনেলোপি দুজনই খুব চমৎকার প্রেমিক-প্ৰেমিকা 1 পেনেলোপির প্রেমের তো কোনো তুলনাই হয় না। হোমার চমৎকার অলংকরণে অডিসিয়াসের সাহসের গল্পের আড়ালে একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প বলেছেন কবিতার ছন্দে। হোমার অডিসিয়াসের মুখে সুন্দর একটি প্রেমের সংলাপ দিয়েছেন—
‘যখন দুটি নর-নারী একে অন্যের চোখে চোখ রেখে ঘর করে, দুজন একজন হয়ে শত্রুকে দূরে আর বন্ধুকে কাছে রাখে— তার চেয়ে ভালো কিছু পৃথিবীতে আর হয় না।’
.
এটুকু বলেই ইউরিপিডিস থামল। ক্রিতো তাকে থামাল। আজ আর বলা যাবে না। আড্ডা শেষ করতেই হবে। রাত এত গভীর হয়ে গেছে যে এখন বাড়ি ফিরতে না পারলে সবার বাড়ি থেকে লোক চলে আসবে তাদেরকে খুঁজতে। সবাই উঠে পড়ল।
উঠতে উঠতে সিমন বলল, আজকের আড্ডায় আমার অনেক লাভ হলো। হোমারের বই দুটো আর তার আগে-পরের কাহিনি থেকে আমার অনেক সুবিধা হলো। আমি অনেক দিন বিদেশে থেকে এথেন্সে ফিরেছি। এথেন্সে এখন যেসব নাটক হচ্ছে সেগুলোর কাহিনি সবই ট্রয় যুদ্ধ বা আগামেমননের পরিবার এরকম আর দু একটি কাহিনি নিয়েই হয়। আমি ভালো করে বুঝতাম না। এখন এথেন্সের নাটক বুঝতে পারব।
হোমারের ইলিয়াদ আর অডিসি বই দুটো সবাই ভালোবাসে। সক্রেটিসও ভীষণ ভালোবাসে। তবে একটি জায়গায় তার খটকা আছে। সেটি হলো— এই দুটো বইয়ে দেবতাদের বিশাল ভূমিকা। দেবতারাই সব করেছে। তারা চেয়েছে বলেই হেলেন আর প্যারিস প্রেমে পড়েছে, পালিয়ে গেছে, আবার দেবতারা এই যুদ্ধে কেউ গ্রিসের, কেউ ট্রয়ের পক্ষে ছিল। এই যে দেবতাদের ভূমিকা, সেটি নিয়ে সক্রেটিসের মনে খটকা আছে।
ইউরিপিডিসের মনেও খটকা আছে। সেও দেব-দেবী মানে না।
.
আড্ডার ছেলেপেলে সবাই চলে যাচ্ছে। সক্রেটিস, ক্রিতো আর সিমন একসাথে বাড়ির দিকে চলেছে।
সিমন বলল, আচ্ছা, এই যে দেব-দেবীরা সবকিছু করেছে, মানুষ কিছু করছে না। এটি তোমাদের বিশ্বাস হয়?
সক্রেটিস বলল, এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। দেব-দেবী নেই, আমি অত সহজে এটি বলতে পারব না। সেটি বলতে পারবেন আমার গুরু।
‘তোমার গুরু? কে সে মহামানব?’
‘তার নাম এনাক্সাগোরাস[৩১]। তিনি থাকেন পেরিক্লিসের বাড়িতে। আমি এখন গুরুর বাড়ি যাব।’
‘মানে?’
‘মানে হলো তোমরা আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছ। উত্তর খুঁজতে আমি এক্ষুনি গুরুর কাছে যাব।’
‘এই গভীর রাতে? এখন রাতের ষষ্ঠ প্রহর। ‘
‘হুঁম, মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমাকে নিশিতে ডাকে। তখন কিছুই ভালো লাগে না। তখন তার বাড়ি যাই। এখন যেমন নিশিতে ডাকছে। আমি চললাম গুরুর বাড়ি।’
সক্রেটিস সত্যি সত্যি গুরুর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। খালি পা। প্রায় উলঙ্গ। বাঁকা বাঁকা পায়ে অন্ধকার পথে ছুটছে।
সিমন তার চলার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে এটি কোন্ নিশির ডাক, যার জন্য এই যুবক গভীর রাতে পাগলের মতো তার গুরুর বাড়ির দিকে ছুটছে?
***
২৯. মাইসিন (Mycenae): ব্রোঞ্জ যুগে এই শহরকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত মাইসেনিয়ান সভ্যতা (Mycenaean civilization) গড়ে উঠেছিল। ট্রয়ের যুদ্ধ মাইসেনিয়ান সভ্যতার সময়ে ঘটেছিল। এখানে রাজা আগামেমননের সময়ের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
৩০. ট্রয় যুদ্ধ নিয়ে হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াদ (The Iliad)। এই বইয়ে যেখানেই ইলিয়াদ মহাকাব্যের অনুবাদ দরকার হয়েছে, আমি Stanley Lombardo এর ইংরেজি (The Essential Iliad) থেকে বাংলা করেছি।
৩১. এনাক্সাগোরাস (Anaxagoras) : সক্রেটিস পূর্ব গ্রিক দার্শনিক। সক্রেটিসের শিক্ষক। তিনিই বৈজ্ঞানিক ধারণা আয়োনিয়া অঞ্চল (বর্তমানে তুরস্কের মধ্যে, সেই সময় গ্রিক) থেকে এথেন্সে নিয়ে আসেন।