হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৬

‘যে কথা বলছ আজ অন্য জনেরে,
নিশ্চিত থাক— সেকথা আসবে ফিরে তোমার দুয়ারে।’

—হোমার

***

নতুন একটি জুতার দোকান হয়েছে। আগোরার ঠিক বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার পাশে দোকান। শুধু দোকান নয়, ছোটখাটো কারখানা। ফরমায়েশ করলে জুতা বানিয়ে দেওয়া হয়। পেছনে কাঠ, চামড়া, আঠা, লোহার পেরেক দেখা যাচ্ছে। দোকানের মালিক তরুণ। বয়স মাত্র বিশ পার হয়েছে। নাম সিমন[২২]। তার পয়সা-কড়ি বেশি নেই, কিন্তু ব্যবসা করার ভীষণ ইচ্ছা। অল্প টাকায় আগোরার ভেতরে দোকান পাওয়া যায় না। তাই বাইরে পথের ধারে এই দোকান নিয়েছে।

জুতার দোকান দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সক্রেটিসের। সে জুতা পরে না। জুতা একেবারেই অদরকারি জিনিস। এমন অদরকারি জিনিসের দোকান বসেছে তার চলাচলের পথে! প্রতি বেলা এই দোকানের সামনে দিয়ে যেতে হবে। তার মেজাজ ভাদ্র মাসের তালগাছ হয়ে গেল।

খুব ভালো আর খুব খারাপ- দুটো জিনিসের দিকেই মানুষ আকৃষ্ট হয়। সক্রেটিস খারাপ দোকানটির দিকে এগোতে লাগল।

দোকানি সিমন দেখল— খালি পায়ে একজন লোক আসছে। পেশার কারণে মানুষের কিছু অভ্যাস তৈরি হয়। নাপিতের নজর যেমন থাকে মানুষের চুলের দিকে, তেমনই মুচির নজর থাকে পায়ের দিকে। পায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে এক সময় সে মুখ দেখা ভুলে যায়। মুখ দেখে আর মানুষ চিনতে পারে না। পা দেখলে ঠিকই চিনে ফেলে।

সক্রেটিসের খালি পা দেখে সিমন খুব খুশি। লোকটি নিশ্চয়ই জুতা কিনতে আসছে। তার মনে হচ্ছে আজকে দিনটা শুভ। একটু বাদে বাদেই খদ্দের আসছে। সে আহ্লাদে বাইরে এগিয়ে এলো।

সিমন বলল, আসেন, আসেন। আপনার তো পা খালি। জুতা ছিঁড়ে গেছে? ‘না, ছিঁড়েনি।’

‘হারিয়ে গেছে?’

‘না, হারায়নি।’

‘ওহ, তাহলে চুরি গেছে। কী যে দিনকাল পড়ছে! চোর-ছেঁচড়ে এথেন্স শহরটা ভরে গেল। জুতা চুরি গেল ক্যামনে? ঘটনাটা কোথায় ঘটল?’

‘কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

‘মানে?’

‘মানে, আমার জুতা ছিঁড়ে যায়নি, হারায়ওনি। চুরিও হয়নি।’

‘তাহলে?’

‘আমি জুতা পরি না।’

সিমন ভীষণ বিরক্ত হলো। আজেবাজে লোক দোকানে ঢুকে সময় নষ্ট করছে। কারও পায়ে নতুন জুতা দেখলেই সিমনের ভালো লাগে না। কতদিনে জুতাটা পুরনো হবে, কেবল সেটিই মাথার মধ্যে ঘোরে। আর যদি শোনে কেউ একেবারেই জুতা পরে না, তাহলে তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে ইচ্ছে করে।

সক্রেটিসকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া যায় কিনা ভাবছে। তাকে দেখে পথের ফকিরই মনে হচ্ছে। কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি ফকিরের মতো নয়। কেমন একটি জ্ঞানী জ্ঞানী টান আছে গলার স্বরে। একজন জ্ঞানী ফকিরের সাথে কতটুকু খারাপ ব্যবহার করা যায় ভাবছে সিমন

হঠাৎ মনে হলো, আরে, আমি তো ভুল ভাবছি। লোকটা মনে হয় গরিব জুতা কেনার টাকা নেই। এই যুগে জুতা পরে না, ‘এমন মানুষ আছে নাকি? বড় মায়া হলো তার। আহা রে, যুবক ছেলে। জুতা কেনার টাকাও নেই। এথেন্স শহরটা বুঝি গরিব হয়ে যাচ্ছে!

সিমন বলল, আমি নতুন দোকান দিয়েছি। আপনাকে এক জোড়া জুতা উপহার দিতে চাই। পয়সা দিতে হবে না। ঐ কোনায় কম মূল্যের জুতা আছে। যেটি পছন্দ হয়, একজোড়া নিয়ে নেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।

পিটপিট করে তাকাল সক্রেটিস। তাকে কি সত্যিই ভিখারির মতো লাগছে? এথেন্সে সবাই তাকে এক নামে চেনে। তার জুতা না পরার কেচ্ছা সবাই জানে। আর এই উজবুক জুতাওয়ালা তাকে চেনে না। শুধু চেনে না, তাই নয়। পা খালি দেখে জুতা দান করতে চাইছে। আস্পর্ধা দেখে অবাক হলো সে।

সক্রেটিস জুতা বাছতে শুরু করল। দোকানের সবচেয়ে দামি এক জোড়া জুতা বাছাই করল।

সিমনের মাথায় হাত! এত দামি জুতা সে দান করতে পারবে না। লোকটাকে লাই দেওয়ায় একেবারে মাথায় উঠে গেছে। আশকারা পেয়ে গলাটা সোয়া হাত লম্বা হয়ে গেছে।

সক্রেটিস বলল, এই জোড়া আপনার পায়ে হবে কিনা দেখুন। আমি আপনাকে এই জুতা জোড়া উপহার দিচ্ছি। দাম কত বলুন।

সিমন ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। সে তার ভুল বুঝতে পারল।

লজ্জিত স্বরে সিমন বলল, মাফ করবেন। অন্যায় হয়েছে। আপনি সত্যি জুতা পরেন না?

‘না।’

‘কেন?’

‘আমার দরকার হয় না। যা দরকার নেই, আমি তা পরি না। যতটুকু না পরলে, রাস্তায় বের হওয়া যাবে না, আমি শুধু ততটুকু কাপড়ই পরি। প্রয়োজনের অধিক নৈব নৈবচ।’

সিমন তাকিয়ে দেখল, কথা সত্য। কোমরে আর উপরের অঙ্গে শুধু দুই টুকরা কাপড় ঝুলছে। মনে হচ্ছে তার আর কোনো সম্বল নেই। কিন্তু মুখে বলছে আর কিছুই দরকার নেই। মুখটাও সুখী সুখী। এত কম জিনিস নিয়েও যে জীবনে সুখী হওয়া যায়, সিমন জীবনে প্রথম দেখল। সে ভালো করে তাকাল লোকটির দিকে। এখন লোকটাকে অত খারাপ মনে হচ্ছে না।

সিমন জিজ্ঞেস করল, আপনার পরিচয়টা জানতে পারি কি?

সক্রেটিস উত্তর দেওয়ার আগেই দোকানের বাইরে চিৎকার শোনা গেল। কে যেন খুবই কদর্য ভাষায় গালাগালি করছে। চৌদ্দ গুষ্ঠি তুলে গালি দিচ্ছে। সিমন দৌড়ে বাইরে গেল।

যে লোক চিৎকার করছে, সে একজন ইজারাদার। ইচ্ছা করে মাতব্বরি করা তার স্বভাব। সে গতকাল একজোড়া জুতা বানিয়েছিল, আজ আবার এসেছে। এসেই হম্বিতম্বি শুরু করেছে।

সিমনের কানের একেবারে সামনে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলল, কি সিমন মুচি, কেমন আছো?

সিমন শান্তভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, ভালো।’

‘তুমি তো ভালো থাকবাই। মানুষকে আজেবাজে জুতা দাও। লাভ করো সেরের উপর সোয়া সের। এরকম করলে মুচি তো ভালো থাকবেই। কিন্তু মুচি সাহেব, তুমি ভালো থাকলেও তোমার জুতা ভালো নেই। কালকে দিলে, আজকেই শেষ। জুতার সুখতলা খুলে দুঃখতলা হয়ে গেছে। তুমি তো মুচি নামের কলঙ্ক।’

আমি আপনাকে বলেছিলাম জুতা জোড়া দুই দিন পরে নিতে। কাঁচা চামড়ায় আঠা ধরে না। আপনার সময় নেই। জোর করে নিয়ে নিলেন।’

আরে মিয়া, মুচির কথায় জুতা বানামু নাকি? বেশি ফাল্ দিও না। দাও, বদলাইয়া নতুন আরেক জোড়া দাও। এবার মইষের চামড়া দিয়ে বানাবা। পাকা মইষের চামড়া আছে তো? নাকি এখনও খালি কাঁচা চামড়া? কোনটা কাঁচা চামড়া আর কোনটা পাকা চামড়া সেটিই চেনে না, সে আবার মুচি!’

ইজারাদার মুখ বাঁকিয়ে খুবই তাচ্ছিল্য ভরে মুচি শব্দটা বলছে। ইচ্ছে করে সকলের সামনে অপমান করছে। গা জ্বলে যাচ্ছে সিমনের। কিন্তু সে কম বয়সে ব্যবসা দিয়েছে। নতুন দোকান। মানুষের সাথে ঝগড়া করা যাবে না। সে নীরবে চামড়া বাছাই করতে লাগল। মহিষের পাকা চামড়া।

সক্রেটিস ইজারাদারকে চেনে। তার মতো পাজি লোক এথেন্সে আর নেই। প্রতিদিনই কারও না কারও সাথে ঝগড়া করে।

সিমন আবার জুতার মাপ নিচ্ছে।

ইজারাদার বলছে, তুমি তো দেখি আসলেই মুচি নামের কলঙ্ক। কালকে একবার মাপলে। আজ আবার কেন?

‘ভুল যেন না হয়, সেজন্য আরেকবার নিয়ে নিচ্ছি।’

‘মুচির তো একটিই কাজ— জুতার মাপ নেওয়া। সারাদিন মানুষের জুতার দিকে তাকিয়ে থাকো। তাও জুতার মাপ মনে থাকে না। কেমন মুচি তুমি?’

সক্রেটিস অনেকক্ষণ ধরে শুনছিল। লোকটা মুচি মুচি বলে ছেলেটাকে ভীষণ অপমান করে যাচ্ছে। আর সহ্য হলো না সক্রেটিসের।

সে ইজারাদারকে বলল, জনাব, মুচি কথাটার মানে কী?

ইজারাদার উত্তর দিল, কেন, জানো না? ঐ যে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ও একজন মুচি। তার কাজ একটিই— জুতা সেলাই করা।

‘উনি তো শুধু সেলাই করেন না। পুরো জুতাটা তৈরি করেন। উনি একজন কারিগর। একজন শিল্পী।’

‘শিল্পী? জুতাশিল্পী?’

‘জুতার একটি সুন্দর নাম আছে— পাদুকা। উনি হলেন একজন পাদুকা শিল্পী।’

‘জুতা বানানোও একটি শিল্প? পাদুকাশিল্প?’

‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?’

‘না।’

‘তাহলে বলুন শিল্প মানে কী?’

ইজারাদার সক্রেটিসকে চেনে। তার স্বভাব জানে। সক্রেটিস একবার যদি কী-কেন ধরনের প্রশ্ন শুরু করে, তাহলে কী ঘটে সেটি তার জানা আছে। এই ছেলে একবার প্রশ্ন শুরু করলে, সবার সামনে ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দেয়। ইজ্জত ফালুদা হওয়ার আগেই সরে পড়তে হবে। সরে পড়লেও মানে মানে সরতে হবে।

ইজারাদার বলল, শোনো মিয়া সক্রেটিস, আমার সাথে জলি-ফলি করবে না। আমি কিন্তু লোক সুবিধার নই। তুমি আসছো জুতা নিয়ে কথা বলতে? তুমি তো মিয়া জুতাই পরো না। তুমি জুতার কী বোঝ? আজ আমার হাতে সময় নাই। আমি এখন যাই। তুমি থাকো তোমার শিল্পীর লগে। তোমার প্রিয় জুতা শিল্পী। না, ভুল বললাম, পাদুকাশিল্পী।

ইজারাদার ক্ষুব্ধ হয়ে চলে গেল। সে বেশ কায়দা করে নতুন মুচিটারে ধরেছিল। চিপড়ানোও শুরু করেছিল। কিন্তু ঝামেলা করল সক্রেটিস। এই ইঁচড়ে পাকা সক্রেটিস দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। ওরে একটি শিক্ষা দিতে হবে।

ইজারাদারের মুখে সক্রেটিসের নাম শুনল সিমন। এই তাহলে সক্রেটিস! অনেকের কাছেই শুনেছে এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হলো সক্রেটিস। কিন্তু কোনোদিন দেখেনি। আজ প্রথমে দেখে মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এখন লোকটাকে এত বেশি ভালো লাগছে যে সিমনের আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে।

সিমন এক মুহূর্তে সক্রেটিসের চ্যালা হয়ে গেল। তার কারণেই সে মুচি থেকে পাদুকাশিল্পী হয়েছে। সে তাকে আদর করে বসাল।

কিছুক্ষণ কথা বলে সক্রেটিসও বুঝল, সিমনও একজন জ্ঞানপ্রেমিক মানুষ। ছেলেটিকে তার পছন্দ হলো। যাকে পছন্দ হয় সক্রেটিস তার কাছে বারবার আসে। সে এই দোকানে আসবে। শীতকালে আড্ডার একটি জায়গা পাওয়া গেল। তার আড্ডার নতুন ঠিকানা হবে সিমনের পাদুকালয়। এখন তারা আড্ডা দেয় আগোরার পেছনে খোলা আকাশের নিচে। ঠাণ্ডার দিনে সন্ধ্যার পর সেখানে বেশিক্ষণ থাকা যায় না।

.

আড্ডার কথা ভাবতেই সক্রেটিসের মন হু হু করে উঠল। আজ সকাল থেকে কোনো আড্ডা হয়নি। সারাদিন বাবার সাথে মূর্তি বানিয়েছে। তিন অপ্সরার মূর্তি। এক ফোঁটাও আড্ডা দিতে পারেনি। এক বেলা আড্ডা না হলে তার বুক ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কেমন একটি চিন-চিন ব্যথা হয়। তাকে এক্ষুনি বের হতে হবে। বন্ধুরা বসে আছে আড্ডাখানায়।

কিন্তু সিমন বের হতে দিচ্ছে না।

সিমন বলল, সক্রেটিস, আমি শুনেছি তুমি অনেক জ্ঞানী মানুষ। আমি তোমার কাছে এথেন্সের কথা শুনতে চাই।

সক্রেটিস বলল, এথেন্সের তো অনেক কথা। কী কথা শুনতে চাও?

সিমন বলল, যখন পিচ্চি ছিলাম, তখন থেকেই শুনেছি এথেন্স হলো পৃথিবীর মধ্যে এক নম্বর জ্ঞানের নগর। সারা দুনিয়ার সকল জ্ঞানী মানুষ সাগর পার হয়ে এই শহরে চলে আসে। এখানে নাকি টাকা ওড়ে। এই মাটিতে পা দিলেই কপাল খুলে যায়। তো আমাকে বলো, তোমরা এথেন্সের লোকেরা কী এমন করেছ যে সবাই তোমাদের কাছে ছুটে আসে? আমি এথেন্সের একেবারে শুরুর কথা জানতে চাই।

সক্রেটিস বলল, এই কাহিনি আমি বলব না। বলবে চেরোফোন[২৩]। এথেন্সে কীভাবে জ্ঞানের জন্ম হলো সেটি বলার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হলো চেরোফোন।

সিমন বলল, কে তিনি?

‘চেরোফোন আমার বন্ধু। খুবই কাছের মানুষ। সে এথেন্সের জন্য একেবারে নিবেদিতপ্রাণ। এথেন্সে যা আছে, চেরোফোনের কাছে সব ভালো। তুমি এথেন্সের নামে ভালো কিছু বললে তুমিও ভালো; আর এথেন্স নিয়ে মন্দ বলেছ তো তোমার মতো খারাপ লোক পৃথিবীতে নেই। এথেন্সের কথা শুনতে এই চেরোফোনকেই তোমার দরকার।’

‘তাকে কোথায় পাব?’

‘যাবে তার কাছে? তোমার দোকান থেকে বেশি দূরে নয়। আগোরার পিছনে, ঐ পশ্চিম কোণে। ওখানে সন্ধ্যাবেলা আমরা কিছু বোকাসোকা ছেলে গল্পগুজব করি। ওখানে যারা আসে সবাই প্রশ্ন-রোগী। তারা প্রশ্ন-প্ৰশ্ন খেলে। খেলাটা একবার শুরু করলে নেশা ধরে যায়। এই নেশা করতে চাও? তাহলে চলো আমার সাথে আমাদের আড্ডাখানায়।’

সিমন প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলাটা বোঝেনি। কিন্তু সে যাবে। সক্রেটিস ডাকলে সে আর না গিয়ে পারবে না। সে সক্রেটিফাইড হয়ে গেছে। সে এখন থেকে সক্রেটিসের সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকবে। তার জীবনের পথ পাল্টে যাচ্ছে। সে নতুন পথের দেখা পেয়েছে।

সক্রেটিস পেল আরেকজন বন্ধু। খাঁটি, অকৃত্রিম বন্ধু সিমন। তারা পা বাড়াল সক্রেটিসের আড্ডাখানার দিকে।

আড্ডার ছেলেরা চলে এসেছে।

সন্ধ্যা হতে না হতেই সবাই হাজির। একটি ঝিরঝির বাতাস বইছে। আকাশে এখনও চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। উঁকি দিতে শুরু করেছে একটি দুটি তারা। নিভু নিভু জ্বলছে জলপাই তেলের মশাল। জলপাই তেলের হালকা একটি মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। শুরু হচ্ছে সক্রেটিসের সান্ধ্য আসর।

এই আসরের ছেলেদের মধ্যে শুধু সক্রেটিসই গরিব। বাকি সবাই ধনী। এথেন্সের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরাই সক্রেটিসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর সেই ছেলেদের পিতারাই তার সবচেয়ে বড় শত্রু।

সক্রেটিসের আসর জমানোর প্রধান মানুষ চেরোফোন। সে সক্রেটিসের চেয়ে কয়েক বছরের বড়। বয়সে বড় হলেও চেরোফোন সক্রেটিসের গুণমুগ্ধ। সক্রেটিসকে ভীষণ ভালোবাসে। সে যে কোনো ছুতা পেলেই চেঁচিয়ে বলে, পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হলো সক্রেটিস।

কিন্তু আজ চেরোফোনের মাথা ভীষণ গরম। রাগের মাত্রা বিপদ সীমার অনেক উপরে। রাগের কারণ গত কদিনে সক্রেটিস চেরোফোনকে বাদ দিয়েই অনেক কিছু করেছে। তাকে বাদ দিয়েই সক্রেটিস আর ক্রিতো দাস বাজারে ঘুরে এসেছে। সক্রেটিস ও কবির জ্ঞানযুদ্ধে তাকে ডাকেনি। সক্রেটিস থিয়েটারে গিয়েছিল, তাও সে জানত না। এই কারণে চেরোফোনের অভিমান হওয়ার কথা। কিন্তু অভিমান বলতে কোনো জিনিস তার নেই। তার সবটাই রাগ। সে রাগে গজগজ করছে। তার ভালোবাসার প্রকাশ যেমন বেশি, রাগের প্রকাশও অনেক বেশি।

সে সক্রেটিসকে বলছে, তুমি দোস্ত নামের কলঙ্ক। এক নম্বরের বেইমান। দুর্জন যেমন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য, তেমনই বেইমান মানুষ বন্ধু হলেও পরিত্যাজ্য।

সক্রেটিস হাসি মুখে গালি খাচ্ছে। তবুও চেরোফোনের ঝাল মিটছে না। কারণ কেউ পাল্টা গালি দিচ্ছে না। সান্ত্বনাও দিচ্ছে না। সক্রেটিস ভাবছে, এখনই চেরোফোনকে থামাবে, নাকি রাগ কমতে আর একটু সময় দেবে।

এমন সময় হঠাৎ ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ পাওয়া গেল। এই সময় তো এখানে ঘোড়া আসার কথা না। বন্ধুরা কেউ ঘোড়া নিয়ে আড্ডায় আসে নয়। সবাই পেছন ফিরে তাকাল। ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামলেন মোটাসোটা দশাসই এক লোক। তার সাথে কয়েক জন দাস। নেমেই তিনি উচ্চ স্বরে হাসতে শুরু করলেন। অবজ্ঞার হাসি। তাচ্ছিল্যের হাসি। সক্রেটিস লোকটিকে চেনে না। কিন্তু ভাবে মনে হচ্ছে লোকটি তাকে চেনেন। বোঝা যাচ্ছে, লোকটি ঝামেলা করতে এসেছেন।

হঠাৎ বড় এক ধমক দিয়ে লোকটি বললেন, কী যুবক সমাজ, তোমরা নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছ? সারাদিন শুধু জ্ঞান জ্ঞান করো?

চেরোফোন তার দিকে উঠে যাচ্ছিল। কিন্তু সক্রেটিস তাকে থামিয়ে শান্তভাবে জবাব দিল, হ্যাঁ, আমরা সারাদিন জ্ঞান জ্ঞান করি।

লোকটি বললেন, ‘কী সমস্যা তোমাদের? কেন এমন করো?’

‘কারণ এটি আমার মায়ের আদেশ। আমি মাতৃআজ্ঞা পালন করি।’

‘তোমার মা বলেছেন জ্ঞান-জ্ঞান করতে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার মা তো একজন অতি সাধারণ ধাত্রী।’

‘হ্যাঁ, আমার মা একজন সাধারণ ধরণী। সাধু ভাষায় ধাত্রী। চলতি কথায় দাইমা। আমার মা একজন দাইমা আর তার ছেলে আমিও দাইমা। আমিও ধাত্রী। খুবই সাধারণ একজন ধাত্রী।’

‘তুমি ধাত্রী?’

‘অবশ্যই। আমি আর আমার মা একই কাজ করি।’

‘ছিঃ ছিঃ, সক্রেটিস, ছিঃ। এথেন্সে নারীরা বেগানা পুরুষদের সামনে যেতে পারে না। আমি জীবনে পরিবারের বাইরের কোনো নারীর মুখ দেখিনি। সেখানে তুমি পুরুষ হয়ে একজন ধাত্রী? ছিঃ ছিঃ ছিঃ…’

সক্রেটিস বলল, জনাব, আমার মা একজন ধাত্রী, কারণ তিনি অন্য মায়েদের সন্তান জন্ম দিতে সাহায্য করেন; আমিও একজন ধাত্রী, কারণ আমি অন্যদের মাঝে জ্ঞানের জন্ম দিতে কাজ করি। দুটোই জন্ম দেওয়া, শুধু তরিকা আলাদা। আমি হলাম জ্ঞানের ধাত্রী।[২৪]

‘জ্ঞানের ধাত্রী!’ লোকটি বোঝার চেষ্টা করছেন, সেটি কী জিনিস? মানুষ জ্ঞানের জন্ম দেয়? তাতে আবার ধাত্রীও লাগে? সক্রেটিস সেই ধাত্রী? তিনি সক্রেটিসের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

ক্রিতো মিষ্টি করে লোকটিকে বলল, জনাব, আর কিছু শুনবেন?

লোকটি লাফ দিয়ে ঘোড়ায় উঠে পড়লেন। যেমন চট করে এসেছিলেন, তেমন ঝট করেই পালিয়ে গেলেন।

চেরোফোন লাফ দিয়ে বলল, জ্ঞানের ধাত্রী! উফ, এক্কেবারে থিয়েটারের সংলাপ। সক্রেটিস জ্ঞানের দাইমা। সে জ্ঞানের জন্ম দিতে কাজ করে। এমন একটি সংলাপ শোনার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করা যায়।

সংলাপে দুটো কাজ হয়েছে। লোকটি পালিয়ে গেছেন আর চেরোফনের রাগ পড়ে গেছে। তার রাগ এমনই। দপ করে জ্বলে ওঠে, থপ করে নিভে যায়।

সিমন এই আড্ডায় প্রথম এসেছে। সে সক্রেটিসের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে এক সাগর মুগ্ধতা।

সিমন ভাবছে, সক্রেটিস সত্যিই জ্ঞানের ধাত্রী। গত দুই ঘণ্টায় সিমন সক্রেটিসের কাছে যা শিখেছে, তাতেই তার মধ্যে অনেক নতুন ধারণার জন্ম হয়েছে। সক্রেটিস না হলে সে নিজে এসব ভাবতেই পারত না। সক্রেটিস আইডিয়া জন্ম দেয়। ধন্য সক্রেটিসের মা। সক্রেটিস তার মায়ের ধাত্রী পেশাটিকেও কত সম্মান দেয়! এথেন্সে মেয়েদের কাজ করার কোনো অধিকারই নেই, এথেন্সের মানুষ মেয়েদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে চায়, কোনো মেয়ে ধাত্রীর কাজ করলে, সেটিকে নিচু চোখে দেখা হয়। সেখানে সক্রেটিস তার মায়ের ধাত্রী পেশা নিয়ে গর্ব করে। সবার সামনে অহংকার করে বলে, মায়ের মতো আমিও একজন ধাত্রী।

হঠাৎ সিমনের দিকে নজর পড়ল সক্রেটিসের। সিমনকে তো বন্ধুদের সাথে আলাপ করানো হয়নি।

সক্রেটিস সিমনকে দেখিয়ে বলল, দেখো। আজ তোমাদের সাথে যোগ দিল নতুন এক প্রশ্ন-রোগী।

সবাই সিমনের দিকে তাকাল।

সক্রেটিস বলল, এ হলো এথেন্সের এক নম্বর পাদুকাশিল্পী।

সকলে চেঁচিয়ে উঠল, পাদুকাশিল্পী?

এমন শব্দ আগে কেউ শোনেনি।

সিমন লজ্জা পেল। সে বলল, না না, সক্রেটিস মজা করছে। আমি জুতা বানাই। আমার একটি জুতার দোকান আছে। আমি জুতার কারিগর।

চেরোফোন চিৎকার করে বলল, জুতার কারিগরের নাম পাদুকাশিল্পী! আরও কত কী শিখব এই সন্ধ্যায়! দুটি নতুন জিনিস দিয়ে শুরু হলো আজকের সন্ধ্যা, পাদুকাশিল্পী সিমন আর জ্ঞানের ধাত্রী সক্রেটিস।

.

আড্ডায় প্রাণ এসে গেছে। ঝড়ের মতো কথা চলছে। সিমনের দোকানে আজ ইজারাদার যে বজ্জাতি করল, সিমন সেই ঘটনা বলল। সেদিন সক্রেটিসের কাছে কবি কী রকম নাকাল হলো ক্রিতো সেই ঘটনা বলল।

সিমন সক্রেটিসকে ইশারা করল। সে এথেন্সের কাহিনি শুনতে চায়। এথেন্স নগর কীভাবে তৈরি হলো, কীভাবে আলোর নগরী নাম পেল, সেসব জানতে চায়। সক্রেটিস ফিসফিস করে বলল, ‘চেরোফোনকে শুধু এক লাইনের একটি খোঁচা দাও।’

‘কী বলে খোঁচা দেব?’

‘বলো যে এথেন্স নষ্ট হয়ে গেছে, এখানে কোনো আলো নেই, চারিদিকে খালি অন্ধকার। তাহলেই চেরোফোন ঝাড়ি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে, এথেন্স কী রকম আলোর নগরী। ঐ আলো কোথা থেকে এসেছে আর এখন কোথায় আছে; আলো কি শুয়ে আছে, নাকি বসে আছে— সবকিছু একেবারে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করে দিবে।

সিমন চেরোফোনের দিকে পিটপিট করে তাকাল। তারপর সাহস করে বলেই ফেলল, এথেন্সে কোনো আলো নেই, চারিদিকে খালি অন্ধকার?

লাফ দিয়ে উঠল চেরোফোন। বলল, অন্ধকার? এই পাদুকাশিল্পী বলে কী? এথেন্সে অন্ধকার কোথায় দেখলে? এথেন্সে কোনো অন্ধকার নেই। এথেন্স হচ্ছে আলোর নগরী। অন্ধকার দেখতে চাইলে ওই সাগরের ওপারে তাকাও। ওখানে সবই অন্ধকার। ওখানে ইট্টুস ফোঁটাও আলো নেই। আর এথেন্সের চারধারে আলো। জ্ঞানের আলো। বিদ্যার আলো।

সিমন আরও একটু পিন দিয়ে বলল, মুখে বললেই হলো? বুঝিয়ে বলো, কীভাবে এথেন্স জ্ঞানের নগরী হলো? কী এমন কাজ তোমরা করলে যে জ্ঞান হেঁটে হেঁটে এথেন্সে চলে এলো?

সিমন একেবারে জায়গা মতো আঘাত করেছে। এটি চেরোফোনের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। সে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। এথেন্সের কাহিনি বলতে তার আবেগ ধরে না, উথলে উথলে পড়ে। গদগদ গলায় সে বলল, এথেন্স একটি জ্ঞানের নগরী। একটি বাচ্চা ছেলেও এই কারণ জানে।

ক্রিতো বলল, কারণটা কী?

‘কারণটা হলো আমরা এথেন্সে জ্ঞানকে বন্দি করে ফেলেছি।’

সিমন বলল, বন্দি করে ফেলেছি? জ্ঞানকে? তার মানে এথেন্স হলো একটি কারাগার, আর সেখানে বন্দি আছে জ্ঞান?

চেরোফোন বলতে লাগল, হ্যাঁ, আমরা এথেন্সে জ্ঞানকে আটক করেছি। শোন সেই কাহিনি :

অনেক বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা যাযাবরের মতো ঘুরছিল এক টুকরো মাটির জন্য। কোথায় বসতি গড়া যায়? ঘুরতে ঘুরতে এজিয়ান সাগরের পাড়ে এই জায়গাটি তাদের পছন্দ হলো। তখন তারা দেবতাদের ডাকলো, ‘হে মহান দেবতারা, এখানে আমাদের একটি শহর বানিয়ে দাও। আমরা এখানে বাস করব।’ কিন্তু দেবতারা তখন নিজেরা ঝগড়া-ঝাঁটি করছিল। তারা কোনো সাড়া দিল না। হতাশ হয়ে মানুষ নিজেরাই কষ্ট করে একটি শহর বানিয়ে তুলল। এক্রোপলিস পাহাড়টিকে ঘিরে তৈরি হলো নগর। যখন বানানো শেষ, তখন দেবতাদের হুঁশ হলো। আরে, আমাদের বাদ দিয়েই মানুষ এত ভালো একটি শহর গড়ে তুলেছে! তখন কাড়াকাড়ি পড়ে গেল কে কার আগে এই নগরের দেবতা হবে?

একটু থেমে চেরোফোন বলল, বন্ধুরা, কিছু ভুল বললে ধরিয়ে দিও।

ক্রিতো বলল, মজা পাচ্ছি। চালিয়ে যাও।

চেরোফোন আবার শুরু করল, নতুন নগর দখল করতে এক্রোপোলিসের উপরে এলো দুই দেবতা। সমুদ্রের দেবতা পোসাইডন[২৫] আর জ্ঞানের দেবী এথিনা। এথিনা আবার যুদ্ধেরও দেবী। তারা দুজন শুরু করল যুদ্ধ। এক্রোপলিসের উপরে ভীষণ যুদ্ধ। কেউ কারে নাহি জিনে— এমন যুদ্ধ। এই দুই দেবতা আবার আত্মীয়। এথিনা হলো দেবতাদের রাজা জিউসের মেয়ে। আর পোসাইডন হলো জিউসের ভাই। সম্পর্কে তারা চাচা-ভাতিজি। নিজের ভাই আর মেয়ের এমন মারামারি দেখে মনে ব্যথা পেলেন জিউস। তিনি বললেন, চাচা-ভাতিজিতে যুদ্ধ করছো! ছিঃ ছিঃ, তোমরা তো দেবতা নামের কলঙ্ক। ঝগড়া বাদ দাও। শান্তির পথে আসো। কূটনীতির রাস্তায় হাঁটো। নতুন শহরের মানুষের কাছে যাও। তাদের উপহার দাও, তাদের খুশি কোরো। মানুষ খুশি হয়ে যাকে মেনে নেবে, সেই হবে নতুন নগরের দেবতা।

সিমন বলল, মানুষকে বাছাই করতে দিলে তারা কি বুড়ো চাচা পোসাইডনকে নেবে? সবাই সুন্দরী তরুণী এথিনাকেই চাইবে। বেচারা পোসাইডনের কোনো সুযোগ নেই।

চেরোফোন হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ, ঘটনা সেটিই হয়েছে। এথিনা জিতেছেন। তবে সুন্দরী তরুণী বলে নয়, জিতেছেন বুদ্ধির জোরে। সেই ঘটনাও মজার। বলছি শোন—

জিউসের অনুরোধে যুদ্ধ বন্ধ হলো। দুই দেবতা ঘুষ নিয়ে মানুষের কাছে এলো। মানুষকে ভোলাতে হবে। পোসাইডন সমুদ্রের দেবতা। পানির কেরামতি তার হাতে। তিনি ইশারা করলেন আর পাহাড় ফেটে বের হলো পানি। তৈরি হলো ঝরনা। তিনি এথেন্সবাসীকে বললেন, ‘এই নাও, এই ঝরনা তোমাদের। আজ থেকে এই নগরের মানুষের আর পানির অভাব হবে না।’ মানুষ আনন্দে ঝরনার কাছে গেল। পানি মুখে দিল। কিন্তু হায় হায়! পানি তো সমুদ্রের পানির মতো নোনতা। সাগরের দেবতা সাগরের পানি দিয়েছেন। এই পানি কোনো কাজে আসবে না।

এরপর এলেন দেবী এথিনা। তিনি বুদ্ধির দেবী। তার অনেক বুদ্ধি। সেই বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে দেবী তার মাথার মুকুট থেকে বের করলেন একটি জলপাই গাছ। বললেন, নাও, এই গাছ তোমাদের। তিনি একটি তুড়ি বাজালেন আর এথেন্সের পাহাড়ি মাটিতে জন্ম হলো হাজার হাজার জলপাই গাছ। এথিনা বললেন, ‘আজ থেকে তোমাদের আর কোনো অভাব থাকবে না। জলপাই[২৬] থেকে তেল হবে। সেই তেল বিদেশে বিক্রি করে তোমাদের সকল অভাব দূর হবে।’ নগরের মানুষ মহাখুশি। এথিনা কাজের মতো কাজ করেছেন। তারা বাদ্য-বাজনা নিয়ে দেবীকে এক্রোপোলিসের চূড়ায় নিয়ে গেল। ঘোষণা করল, আজ থেকে এই শহরের নাম এথিনা[২৭]।

দেবী অনেক খুশি। খুশিতে তার পোষা পেঁচা বের করে দেবী বললেন, জ্ঞানের আলোতে অন্ধকারেও দেখতে পাওয়া যায়। পেঁচাও অন্ধকারে দেখতে পায়। সেজন্য পেঁচা হলো জ্ঞানের প্রতীক। এই নাও, আজ থেকে এই জ্ঞান এথেন্সের। এখন থেকে এথেন্স হবে জ্ঞানের শহর। এই মুহূর্ত থেকেই তোমাদের অনেক বুদ্ধি হয়ে যাবে।

দেবীর কথায় তক্ষুনি এথেন্সবাসীর অনেক বুদ্ধি হয়ে গেল। বুদ্ধি পেয়ে তারা সেই বুদ্ধি দেবীর উপরেই খাটাল। ফন্দি করল কীভাবে দেবীকে এথেন্সে আটকে রাখা যায়। তারা দেবীর পাখা কেটে দিল। দেবী আর উড়ে যেতে পারলেন না। আটকা পড়লেন এথেন্সে। তিনি জ্ঞানের দেবী, সেজন্য তার সাথে আটকা পড়ল জ্ঞান। সেই থেকে এথেন্সে জ্ঞানের বসতি। এজন্যেই এথেন্স জ্ঞানের শহর, আলোর শহর।

.

সিমন বলল, এটি কি সত্য কাহিনি? মনে হচ্ছে আমার দাদির কাছে রূপকথার গল্প শুনছি।

ক্রিতো বলল, রূপকথা মনে হলেও, এই গল্পই সবাই বিশ্বাস করে। এথেন্স নগরী প্রতিষ্ঠার কাহিনি এটিই। কাহিনিতে কোনো ফাঁক নেই। আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে সোজা উপরে তাকাও। ঐ যে এক্রোপলিসের উপরে এথিনার মন্দির দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের পাশের জায়গাটাতেই নাকি এথিনা আর পোসাইডনের সেই যুদ্ধ হয়েছিল। তার একটু পেছনে দেখো— ওই যে এথিনার মূর্তি। মূর্তিটির পাখা সত্যি কাটা।

চেরোফোন বলল, আরও প্রমাণ আছে। আমরা সাগরের দেবতা পোসাইডনকে একেবারে তাড়িয়ে দেইনি। তার জন্য একটি মন্দির করেছি। সেই মন্দিরটিও আমরা সবাই দেখেছি। এথেন্স থেকে একটু দূরে সোনিওতে[২৮]। সমুদ্রের দেবতা খুশি হয়ে আমাদেরকে সমুদ্রে ব্যবসা করার বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছেন। আমাদের জাহাজ দেশ-বিদেশে যায়। আমাদের বন্দরে সারা দুনিয়ার জাহাজ আসে। জাহাজে করে এথেন্সের জলপাই তেল দেশ- বিদেশে যায়। সমুদ্রপথে ব্যবসায় এথেন্সই সারা দুনিয়ার মধ্যে এক নম্বর। সমুদ্র যুদ্ধেও আমরা সবার উপরে।

সিমনের চোখে এখনও অবিশ্বাস।

চেরোফোন একটু রেগে বলল, শোন পাদুকাশিল্পী, আমার এথেন্সের কাহিনিতে কোনো ফাঁক নেই। এথেন্সের সব মানুষ এই কাহিনিই বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করার জন্য তোমার সামনে সব প্রমাণ হাজির আছে। এখন বিশ্বাস করা না করা একান্তই তোমার ব্যাপার।

সিমন কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে জ্ঞান-পাগল মানুষ। যুক্তি দিয়ে সবকিছু দেখে। দেবতারা এসে এখানে জ্ঞান দিয়ে গেছে, এমন কথা বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছে করছে না। সে সক্রেটিসের দিকে তাকাল।

সক্রেটিসের চোখেও অবিশ্বাস। সে বলল, দেবতাদের গল্প মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন। এটি সত্য কিনা কেউ জানে না।

পেছন থেকে ইউরিপিডিস বলল, তবে যেটি সত্য, সেটি হলো আজ থেকে চারশত বছর আগে এখানে এক বিশাল যুদ্ধ হয়েছিল। সেটি হলো ট্রয়ের যুদ্ধ। স্পার্টা নগরের সুন্দরী হেলেনকে চুরি করে নিয়ে গেলে গ্রিসের সাথে ট্রয় নগরীর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধটি সত্য। সেই যুদ্ধ নিয়ে মহাকবি হোমার লিখেছেন তার বই ইলিয়াদ। তার বই আমরা সবাই পড়ি। আগোরার বইয়ের দোকানে এখনও সব থেকে বেশি বিক্রি হয় হোমারের বই।

কোন ফাঁকে যেন ইউরিপিডিস এসে গেছে। সে এতক্ষণ কিছুই বলেনি। সে যখন শুরু করেছে, এবার আর তাকে থামানো যাবে না।

***

২২. সিমন : দার্শনিক, তিনি Simon the Shoemaker নামে পরিচিতি। আগোরার প্রবেশপথেই ছিল তার দোকান। সক্রেটিস তার দোকানে বসে ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন।

২৩. চেরোফোন : সক্রেটিসের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং বন্ধু। তার বয়স সক্রেটিসের চেয়ে একটু বেশি।

২৪. প্লেটোর থিটিটাস (Theaetetus) ডায়ালগে সক্রেটিস নিজেকে Midwife to knowledge বলেন।

২৫. পোসাইডন (Poseidon) : গ্রিক মিথোলজির সমুদ্রের দেবতা। তিনি জিউসের ভাই।

২৬. প্রাচীন এথেন্সের প্রধান কৃষি পণ্য ছিল জলপাই তেল।

২৭. এথেন্স শহরের নাম দেবী এথিনার নামে, গ্রিক ভাষায় Athina (গ্রিক উচ্চারণ আথিনা)

২৮. সোনিও (Sounion): এথেন্স থেকে ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এজিয়ান সাগরের তীরে পাহাড়ি এলাকা, এখানে এখনও পোসাইডনের মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *