হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৫৫

৫৫

‘মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত, কাউকে সুখী বলা যায় না,
ততদিন শুধু সৌভাগ্যবান বলা যায়।’

—সলোন

***

লেখালেখি সক্রেটিসের বড়ই অপছন্দ।

তিনি সারা জীবনে কিছুই লিখেননি। কবিদের তিনি ভীষণ অপছন্দ করেন। কবিরা সব মিথ্যার রাজা। তারা অকারণে মিথ্যা বলে। মজার মজার মিথ্যা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এরিস্টোফানিসের মতো প্রতিভাবান ছেলে না জেনেই সক্রেটিসের নামে ভুলভাল নাটক লিখে তার জীবনে ভয়াবহ বিপদ নিয়ে এসেছে। মানুষ ওই নাটকের সক্রেটিসকেই মনে রেখেছে। কবিদের মজা মাখানো মিথ্যা কথাই মানুষ বিশ্বাস করে। গুজব সৃষ্টিতে কবিরা ওস্তাদ।

সক্রেটিস সত্যের পূজারি। মিথ্যা তার সহ্য হয় না। সেজন্য সক্রেটিস কবিদের দু’চক্ষে দেখতে পারেন না।

কিন্তু জীবনের একেবারে শেষ সময়ে সক্রেটিসের নিজেরই কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছে। অদ্ভুত রকমের ইচ্ছা। তার মাথায় কবিতা ঘুরছে। তিনি ভাবছেন, এ তো মহা ঝামেলা হলো। সবাই জানে আমি কবিতা বিদ্বেষী মানুষ। সেই আমি কিনা কবিতা লিখব।

কারাগারে সারাদিন তার সামনে লোক থাকে। জ্ঞানের আলাপে অন্য চিন্তা মাথায় আসতে পারে না। কিন্তু সন্ধ্যার পরে আর কাউকে কারাগারে থাকতে দেয় না। সন্ধ্যাটা একাই কাটে সক্রেটিসের। তখন তার মাথায় কবিতা আসে। শব্দগুলো পোকার মতো গুনগুন করে। কথাগুলো সব ইসপের গল্পের মতো।

ইসপ[১৩৭] খুব সুন্দর সুন্দর গল্প লিখেছেন। তার গল্প বাচ্চাদের জন্য খুবই শিক্ষণীয়। শুধু বাচ্চা নয়, চাইলে বাচ্চার বাবা-মায়েরাও শিখতে পারে। পশুপাখি নিয়ে কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প লিখেছে ইসপ। বড় ভালো লাগে। ইসপ এথেন্সের লোক না। কিন্তু গ্রিক। তার গল্প সারা গ্রিসের মানুষই জানে।

ইসপের গল্পগুলো ছন্দে ছন্দে সক্রেটিসের মাথায় পোকার মতো ঘুরছে। লিখতে না পারলে এই পোকা যাবে না। লিখতে পেপিরাস দরকার। জেলের দারোয়ান কি পেপিরাস দিবে? সক্রেটিস একটি সুযোগ নিলেন।

দারোয়ান তাকে পছন্দ করে। একবার বলতেই কাজ হলো। হাসিমুখে পেপিরাস আর কলম এনে দিল।

সক্রেটিস শুরু করলেন। ইসপের গল্পকে ছন্দে বসিয়ে লিখবেন কবিতা। সক্রেটিসের নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না যে তিনি কবিতা লিখছেন। ছোটবেলায় সক্রেটিস মাঝে মাঝেই কেমন যেন একটি শব্দ শুনতেন। কে যেন তাকে ডেকে একটি নাকি সুরে কী যেন বলতেন। বলতেন, তুই সংগীত কর, কবিতা লিখ, কাব্য কর। এই জীবনে সংগীত, কবিতা কোনোটাই সক্রেটিস করেননি। এখন এই শেষ সময়ে সত্যিই কবিতা লিখলেন। তিনি কবিতার দিকে তাকালেন। ইসপের সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প— খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় নিয়ে লিখেছেন—

আলস্য দোষে খরগোশ দিবা নিদ্রা দেয়
সেই ফাঁকে কচ্ছপ দেখ দৌড় জিতে নেয়
সময় থাকতে হও সাবধান, না হইলে শেষে
খরগোশ হয়েও হারতে হবে কচ্ছপের কাছে।

সক্রেটিস ভাবছেন— এই কবিতা নিয়ে কী করা যায়! প্লেটোকে দেখানো যায়। লেখালেখির জন্য সবচেয়ে বড় বিচারক হলেন প্লেটো। তার মতো মেধা পৃথিবীতে বিরল। তাকে দেখালে সে যুতসই একখান মন্তব্য দেবে। এক-আধটু ঠিক-ঠাকও করে দিতে পারবে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্লেটো এখন কবিদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না। সে মনে করে সক্রেটিসের বিপদের দায় পুরাটাই এরিস্টোফানিসের। সে ঐ নাটকটা না লিখলে মানুষ সক্রেটিসকে এতটা ভুল বুঝত না। বিনাদোষে সক্রেটিসের মৃত্যুও হতো না। কবিদের প্রতি এখন প্লেটোর রাগ এমন পর্যায়ে গেছে যে, সে উঠতে বসতে বলে, আমার ক্ষমতা থাকলে আমি সব কবিকে নির্বাসন দিতাম। একটি আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের কোনো দরকার নেই।

এই অবস্থায় প্লেটোকে কবিতা দেখানো যাবে না। সক্রেটিস ভাবছেন, আমি কবিতা লিখেছি শুনলেই ছেলেটা দুঃখ পাবে। ওকে দুঃখ দেওয়া ঠিক হবে না। প্লেটোর মতো এমন শিষ্য আমার আছে ভাবলেই আনন্দ হয়।

তাহলে কাকে শুনানো যায়? জেনথিপি? পৃথিবীর সব কবির কবিতার প্রথম পাঠক অবশ্যই তাদের বউ অথবা প্রেমিকা।

পরদিন দুপুরে জেনথিপি এলেন খাবার নিয়ে। দুপুরের খাবারটা তিনি স্বামীকে নিজ হাত খাওয়ান। সক্রেটিসের জেলখানায় সারাদিন মানুষ আর মানুষ। বেচারি জেনথিপি দুদণ্ড স্বামীকে একলা পান না। তাই ক্রিতো ঠিক করে দিয়েছেন— ঠিক দ্বিপ্রহরের সময় সক্রেটিসের জ্ঞানের ক্লাস এক ঘণ্টা বিরতি। সেই সময়টা শুধু জেনথিপি আর সক্রেটিসের। তাদের সন্তানেরা থাকতে পারে। অন্য কেউ থাকতে পারবে না।

জেনথিপিকে কবিতা শুনালেন সক্রেটিস। বললেন, এই জিনিস আর কেউ জানে না। শুধু তুমিই জানো যে আমি কবিতা লিখি।

জেনথিপি হো হো করে হাসছেন।

সক্রেটিস রাগ করলেন। কবিতা এমন খারাপ হয়েছে যে, হাহা হিহি করে হাসতে হবে?

জেনথিপি বললেন, সারা জীবন শুনে এসেছি আমার স্বামী বিরাট জ্ঞানী, তার জ্ঞানের কথা দুনিয়ার বেবাক মানুষ জানে, শুধু আমিই জানি না। আর এখন বের হলো, আমার স্বামী একজন বিরাট কবি, একথা দুনিয়ার কেউ জানে না, শুধু আমি একলা জানি।

এবার সক্রেটিসও হাসলেন। সারা জীবনে আসলেই জেনথিপিকে সুখ দিতে কোনো চেষ্টা করেননি। মেয়েরা যে এত সহজে খুশি হয়, এই হিসাব তার জানা ছিল না। তার জীবনে মেয়েদের অধ্যায়টা কেমন খালিই রয়ে গেল। যে কটা দিন আছে, আরও কিছু কবিতা লিখে জেনথিপিকে দিয়ে যেতে হবে। এগুলো হবে এই মেয়েটির সম্পদ।

এমন খুশির দিন জেনথিপির জীবনে আর আসেনি। তার স্বামী তার জন্য কবিতা লিখেছেন। এথেন্সে এমন ভাগ্যবতী নারী আর কে আছে? তিনি খুশি। মহাখুশি। কিন্তু জেনথিপি হাসলেন না। শুরু করলেন কান্না। ভয়াবহ কান্না।

সক্রেটিস জিজ্ঞেস করলেন, কেন কাঁদো?

জেনথিপি বললেন, সব কান্নার কারণ হয় না। আর এত কারণ দিয়ে কী করবেন? আপনি তো কোনোকালেই আমাকে বোঝেননি। এখন মরণকালে আর বুঝে কী হবে?

সক্রেটিস বললেন, কথা সত্য। এখন আর বুঝে কোনো লাভ নাই।

জেনথিপি আবার বললেন, এখন আমার কথার উত্তর দেন। এত কিছু থাকতে আপনি ইসপের গল্প নিয়ে কবিতা লিখলেন কেন? আপনি জ্ঞানী মানুষ। সারা জীবন দর্শন চর্চা করেছেন। এখন হঠাৎ ইসপের কচ্ছপ- খরগোশ, ইঁদুর-সিংহ, কাক-শিয়াল এসব নিয়ে শুরু করলেন কেন? কী পেলেন ইসপের মধ্যে?

সক্রেটিস বললেন, ঘটনা হলো, ইসপ এখন আমার কাছে আলাদা ব্যক্তি। তুমি তো ইসপের কাহিনি জানো।

‘জানি তো। তিনি রাজ্যের সব পশু-পক্ষী নিয়ে গল্প লিখেছেন। বাচ্চাদের জন্য উপদেশের গল্প। ছোটবেলায় মা বলতেন।’

‘আরে এটি তো সবাই জানে। আমি বলছি ইসপের নিজের জীবনের কাহিনির কথা। কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে সেটি জানো?’

‘না। কীভাবে মারা গেছেন ইসপ?’

‘তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। বিনা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড।’

‘তাই নাকি?’

‘ডেলফি শহরের মানুষ তাকে মিথ্যা চোর সাজিয়েছিল। লুকিয়ে তার ঝোলায় একটি সোনার বাটি ভরে দিয়েছিল। তারপর ধরে বলে সে নাকি এপোলোর মন্দিরের সোনার বাটি চুরি করেছে। সেই অপরাধে বিচার হয়। বিচারে পাহাড়ের উপর থেকে ছুড়ে ফেলে মৃত্যুদণ্ডের হুকুম হয়। ‘

‘ঘটনা তো একেবারে আপনার বিচারের মতো।’

ধীরে ধীরে সক্রেটিস বললেন, রাত হলেই ইসপের কথা মনে পড়ে। মাঝে মধ্যে স্বপ্নেও তাকে দেখি। মনে হয় আমি বুঝি সেই ইসপ ছিলাম। তার আত্মাই সক্রেটিস হয়ে জন্ম নিয়েছে।

জেনথিপি বললেন, এবার দুয়ে দুয়ে চার মিলছে। আপনি সেজন্যই ইসপের গল্প নিয়ে কবিতা লিখছেন?

‘আমার সাথে ইসপের আরও মিল আছে। আমার চেহারা তো কদাকার। ইসপের চেহারা ছিল ভয়াবহ রকম বদখত। তাকে দেখলে নাকি লোকের ভয় লাগত।

‘আপনার মুখে এতদিন তো ইসপের কথা শুনিনি।’

‘ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি। সেদিন প্লেটো ইসপের বিস্তারিত কাহিনি বলল। আমি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিলাম। তবে ঘটনা আরও আছে। ইসপের মৃত্যুর পর ডেলফিতে বিশাল দুর্ভিক্ষ হয়। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। যারা ইসপের মিথ্যা বিচার করেছিল, সবাই কঠিন সাজা পায়। লোকে বলে, ইসপের শাপ লেগেছে।’

জেনথিপি বললেন, হবেই তো। বিনা দোষে ভালো মানুষদের মেরে ফেলবে। দেবতা কি বসে থাকবেন? আপনার সাথে এথেন্সের লোকেরা যা করল, এথেন্সেরও শাপ লাগবে। ঐ এনিতাস, মেলিতাস ওদের বিনাশ হবে। এই ভর দুপুরে আমি শাপ দিচ্ছি।

‘ছিঃ ছিঃ। জেনথিপির মুখ চেপে ধরলেন সক্রেটিস। আমি সারা জীবনে কোনো মানুষের খারাপ চাইনি। ওদের জ্ঞান নেই বলেই এই কাজ করছে। তুমি আর কোনোদিন কোনো শাপ মুখেও আনবে না।’

‘কেন, আমার সংসার যারা ছারখার করল তাদের সংসারও ছারখার হবে।’

সক্রেটিস দেখলেন, জেনথিপি তার আগের সেই মুখরা অবস্থায় ফিরে গেছেন। কোমর বেঁধে তৈরি হয়েছেন। এখন দেখা যাবে শাপ কাকে বলে! সক্রেটিস তাড়াতাড়ি উঠে বললেন, তুমি এক্ষুনি বাড়ি যাও। জেলখানার বড় সাহেব আসার সময় হয়েছে।

জেনথিপি বুঝলেন, তার চিৎকার, শাপ-শাপান্ত বন্ধ করতে সক্রেটিস তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

তিনি বললেন, ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। একটি অনুরোধ— দেবতা এপোলোকে নিয়ে দু’একটি কবিতা লিখেন। এপোলোর ইশারাতেই জাহাজটা আটকে আছে। সেজন্য আপনি এখনও বেঁচে আছেন। তাকে নিয়ে লেখেন।

সক্রেটিস বললেন, অবশ্যই লিখব। কাল তোমাকে সেই কবিতা দেখাব।

.

সন্ধ্যায় সক্রেটিস আবার বসলেন কবিতা লিখতে। ইসপের গল্পর নিয়ে দুটি কবিতা আর দেবতা এপোলোকে নিয়ে একটি গীতি কবিতা লিখলেন। এবার ঘুমাতে হবে। একটি গাঢ় নিদ্রা দরকার।

কিন্তু নিদ্রা গাঢ় হলো না। একটি সমস্যা হয়েছে। কয়েকদিন ধরে তিনি কেবল স্বপ্ন দেখেন। দুচোখ এক হলেই হুরহুর করে চলে আসে স্বপ্ন। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন। কোনো মাথামুণ্ডু নেই। আগাগোড়া নেই। ইসপকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখেন। দেখেন ইসপ পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছে। পড়তে পড়তে ডেলফির মানুষদের কী যেন বলছে।

আজ অন্য একটি স্বপ্ন দেখলেন। সেটি আরও উদ্ভট। স্বপ্নে দেখলেন— সক্রেটিস একটি ছোট্ট শিশু হয়ে গেছেন। শিশুটি মাত্র জন্ম নিয়েছে। জন্ম নিয়েই সে প্লেটোর হাত ধরে হাঁটছে।

সক্রেটিস ভাবেন, কেন এসব স্বপ্ন দেখছেন? তিনি কি মরতে চান না? নাকি আবার ফিরে আসতে চান? তাই কি এসব উদ্ভট স্বপ্ন দেখছেন?

স্বপ্ন নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়লেন তিনি। তেমন কাউকে বলেন না। নিজে নিজে চিন্তা করেন। মৃত্যুর পর আসলে কী হয়? আত্মা কোথায় যায়? আত্মা কি আবার ফিরে আসতে পারে?

***

১৩৭. ইসপ (Aesop): শিক্ষামূলক শিশুতোষ গল্পের বিশ্ববিখ্যাত লেখক। তিনি উত্তর গ্রিসের থ্রেস অঞ্চলে জন্মেছিলেন। তার জীবনকাল আনুমানিক ৬২০-৫৬৪ খ্রি.পূ.। সক্রেটিসের সময়ে তার গল্প গ্রিসে জনপ্রিয় ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *