৫৩
‘পৃথিবীর যেকোনো নগরে কারও ভালো করার
চেয়ে খারাপ করা অনেক সহজ।’
—প্লেটো
***
এথেন্সের ধর্মীয় আদালত।
আজ খুব সকালেই এই আদালত প্রাঙ্গণ একেবারে লোকারণ্য। বিপুল উৎসাহে মানুষ আসছে। থিয়েটার দেখতে যেভাবে দলে দলে মানুষ আসে, সেভাবেই লাইন ধরে লোক আসছে। মানুষের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে তারা থিয়েটার দেখতে যাচ্ছে নাকি আদালতে বিচার দেখতে যাচ্ছে। এই আদালতের সাথে থিয়েটারের পার্থক্য হলো থিয়েটারের ট্র্যাজেডি শেষ হলে মৃত অভিনেতা মুখোশ খুলে হাসতে হাসতে বাড়ি যায়, আর এই আদালতের ট্র্যাজেডির হিরো কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যুর দেশে যায়। দর্শকদের জন্য আদালতের ট্র্যাজেডি আরও বেশি উত্তেজনার, আরও বেশি থ্রিলিং। একজনের জীবন-মরণের থিয়েটার দেখতে আদালত এখন লোকারণ্য।
এই আদালতে আজ সক্রেটিসের বিচার হবে।
বিচারকের সংখ্যা পাঁচশত। এরা কেউ পেশাদার বিচারক নন। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শ্রমিক, কেউ সৈনিক, কেউ দার্শনিক, কেউ কবি, কেউ কামার, কুমার, মুচি বা অন্যকিছু। এখানে বিচারক বাছাই করা হয় লটারিতে। যার ভাগ্যে আছে, সেই বিচারক হবে। আইন জানুক আর না জানুক, কোনো সমস্যা নেই।
লটারি হলো। এথেন্সে দশটি গোত্র। প্রতি গোত্র আলাদা লটারিতে পাঁচজন করে পঞ্চাশ জন বিচারক বাছাই করা হলো। এরা সবাই এক দিনের বিচারক। পরদিন আবার নতুন লটারি হবে। নতুন লোক বিচারকগিরি করবে। একদিন বিচার করার জন্য প্রত্যেক বিচারক সম্মানী হিসেবে তিন ওবল করে অর্থ পাবেন। এই নিয়ম পেরিক্লিস করে গিয়েছিলেন যাতে সবাই আদালতে এসে বিচারে অংশ নেন।
আদালত ভবনটি খুবই সুন্দর। পেরিক্লিস যেসব সুন্দর সুন্দর ভবন বানিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে একটি এই আদালত ভবন। শ্বেত পাথরের ভবনটির নাম রাজ-ভবন বা রয়্যাল স্টোয়া। এখানে ধর্মীয় আদালত বসে। সক্রেটিসের মামলার সাথে দেবদেবীর ব্যাপার আছে। তাই তার বিচার হবে ধর্মীয় আদালতে। এটি আগোরার উত্তর-পূর্ব কোনায়। বিশাল ভবন। সামনে অনেক বড় বারান্দা।
ভবনটির সামনে অনেক উঁচু বেদির উপর বিচারের দেবী থেমিসের মূর্তি। বিচারের দেবীর চোখ বাঁধা। মানে বিচার অন্ধ ও নিরপেক্ষ। আদালতে ঢোকার দরজার সামনে ঝকঝকে সাদা পাথরের উপর খোদাই করা সলোনের আইন। চমৎকার এই আদালত ভবনে এখন হাজার হাজার মানুষ। তিল ধারণের জায়গাও নেই। এক্ষুনি বিচার শুরু হবে।
বিচারকগণ যেখানে ইচ্ছা বসতে পারবে না। লটারিতে নাম উঠলে প্রত্যেক বিচারক একটি মাটির পাত্র হতে একটি পাথর নেবে। পাথরে একটি বর্ণ লেখা আছে— আলফা, বিটা, গামা ইত্যাদি। এগুলো আসন নম্বর। যার যার আসন নম্বরে বসতে হবে। যাতে নিজের পছন্দের লোকের পাশে বসে জোট বেঁধে পক্ষপাত করতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা।
লটারিতে বাছাই হওয়া বিচারকেরা সারি করে গ্যালারির মতো আসনে বসেছেন। এখন তারা মহাক্ষমতাবান। তাদের হাতে সক্রেটিসের জীবন।
মামলার বাদী তিনজন। তারা বাম দিকে বসেছেন।
একমাত্র আসামি সত্তর বছরের সক্রেটিস। তিনি ডান দিকে বসেছেন। তার মুখে হাসি। ঠিক হাসি নয়। কৌতুক বলা যায়। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এটি আদালত নয়, মজার অনুষ্ঠান। তিনি এখানে মজা করে জ্ঞানের কথা বলতে পারবেন। তিনি দেরি না করে সকাল সকালই এসে পড়েছেন। তার পরনে চিরাচরিত পোশাক। খালি পা, শরীরের উপর থেকে ঝুলছে একটি উত্তরীয়। তিনি এর আগে কোনোদিন আদালতে আসেননি, তাই সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। তার জন্য মঞ্চ প্রস্তুত হচ্ছে। একটু পরেই ঝাঁপিয়ে অভিনয় করতে হবে। তিনি ভাবছেন এখানে ইউরিপিডিস থাকলে ভালো অভিনয় করতে পারতেন। ইউরিপিডিসের কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি মারা গেছেন সাত বছর হয়ে গেল। বেলা বয়ে যাচ্ছে। যাদের নিয়ে দিন কাটিয়েছেন, তাদের অনেকেই চলে গেছেন চিরতরে। চেরোফোন, সিমন, ইউরিপিডিস সবাই মারা গেছেন। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে শুধু ক্রিতো বেঁচে আছেন। এই শেষ বয়সে আদালতে এসে তিনি চোখ দুটো পিটপিট করে চারিদিকে দেখছেন। তার খুব বেশি টেনশান হচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে জেনথিপির কান্নাভেজা মুখটা মনে পড়ছে। সেই মুখ তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তিনি জেনথিপিকে ভুলে থাকতে চাইছেন।
জেনথিপি আদালতে আসতে পারেননি। নারীদের জন্য আদালতে আসাও নিষেধ। দুটি শিশুপুত্রকে নিয়ে ঘরে বসে তিনি স্বামীর জন্য প্রার্থনা করছেন। কাল সারা রাতও প্রার্থনা করেছেন। এক ফোঁটাও ঘুম আসেনি। তার চোখের পাতা ফুলে গেছে। তিনি আজও সারাদিন দেবীকে ডাকবেন। আজ সকাল থেকে জেনথিপির ঘরের পেছনে দুটি পাখি ডাকছে। অন্য দিনও মনে হয় ডাকে, কিন্তু আজকের ডাকটা যেন অন্যরকম। যেন পাখিগুলো বুঝতে পেরেছে আজ কিছু হতে চলেছে। জেনথিপি পাখিগুলোর ডাক শুনছেন আর আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন, মাঝে মাঝেই কেমন একটি বোবা কান্না উথলে উথলে আসছে। আজ তিনি শব্দ করে কাঁদছেন না। তিনি ঘরে আছেন, কিন্তু তার মন রয়েছে আদালতে।
আদালতে এখন কয়েক হাজার দর্শক। তারা কেউ গ্যালারিতে, কেউ মেঝেতে, যে যেভাবে পারে বসে গেছে। অনেকেই ভেতরে জায়গা না পেয়ে বাইরে বিশাল বারান্দায় বসে গেছে। ক্রিতো, প্লেটো, ফিদো একসাথে বসেছে। তাদের সাথে আছে সক্রেটিসের বড় ছেলে লেমপ্রোক্লিস এবং ক্রিতোর ছেলে ক্রিতোবুলাস।
প্রধান বিচারক আসন গ্রহণ করলেন। বিচার একটি ধর্মীয় কাজ। এর গুরুত্ব অনেক। সেজন্য শপথ নিতে হবে। শপথ শুধু মুখে নিলে হবে না। বিচারের দেবী থেমিসের উদ্দেশ্যে একটি পশু বলি দেওয়া হলো। পশুর রক্ত একটি পাত্রে রাখা হলো। সেই রক্তে আঙুল ডুবালেন প্রধান বিচারক। এর মানে হলো— আমি দেবতার কাছে রক্তমাখা শপথ করছি— আমি নিরপেক্ষ বিচার করব। যদি অন্যায় করি আমার পরিবারের ওপর অভিশাপ নেমে আসবে।
প্রধান বিচারক রক্তমাখা দুহাত তুলে সকলকে দেখালেন। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। সব ঠিক আছে। অন্য সব বিচারক মুখে শপথ নিল- ‘গণতন্ত্রের জন্য আমরা একত্রে ন্যায় করব।’ এখন বিচার শুরু করা যায়।
এটি এক বেলার আদালত। যা করার আজকে দিনের মধ্যেই করতে হবে। সময় কম। সেজন্য বাদী আর বিবাদী দুপক্ষের জন্যই সময় নির্ধারণ করা আছে। সময় মাপার জন্য আছে জলঘড়ি। একটি কলসি পানি দিয়ে পূর্ণ করে দেওয়া হয়। কলসিটির নিচে একটি ফুটো। ফুটো দিয়ে পানি পড়তে থাকে। যতক্ষণ পানি পড়বে, ততক্ষণই সময়। কলসি খালি হয়ে গেলে সময় শেষ। বাদী অল্প কথা বলবে। তার জন্য ছোট জলঘড়ি। আর আসামি বেশি কথা বলবে। তার জন্য বড় জলঘড়ি[১৩২]।
বিচারক অভিযোগ পড়ে শুনালেন। অভিযোগ তিনটি—
এক. সক্রেটিস এথেন্সের যুবকদের কুপথে নিয়ে যাচ্ছেন।
দুই. সক্রেটিস দেবতাদের মানেন না।
তিন. সক্রেটিস নতুন নতুন দেবতা সৃষ্টি করেন।
প্রস্তাবিত শাস্তি : মৃত্যুদণ্ড
প্রধান বিচারক বললেন, বাদীরা তাদের আর্জি জানাতে পারেন।
ছোট জলঘড়ি চালু হলো। বাদীদের পক্ষে সামনে এলো এনিতাস। তার কণ্ঠ ভালো। জোর আছে। সে সংসদে বক্তৃতা করে। সংসদের ঢঙেই শুরু করল :
মাননীয় আদালত, ঐ যে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ। নাম সক্রেটিস। বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু নষ্টামি কমেনি। তিনি এথেন্সের জন্য এক দুষ্ট ফোঁড়া। ভয়াবহ ফোঁড়া। এই ফোঁড়া কেটে দূর করতে হবে। ইনি থাকলে আজ আমার ছেলে খারাপ হয়েছে, কাল আপনার ছেলে খারাপ হবে, পরশু সবার ছেলে খারাপ হবে। আপনারা এথেন্সকে বাঁচাতে চান? এই দুষ্ট ফোঁড়া দূর করেন। তার জন্য একটিই উপায়— মৃত্যুদণ্ড।
এনিতাস অনেক লোক নিয়ে এসেছে। তার পক্ষের লোকেরা হইচই করছে। তারা হৈ হৈ করে উঠল, মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড।
সক্রেটিসের ঠোঁটে তার চিরকালের ট্রেডমার্ক হাসিটুকু লেগে আছে। এনিতাসের ভয়ংকর মিথ্যায়ও সেই হাসি নিভেনি।
এনিতাস বলছে :
সক্রেটিস মানুষকে কুশিক্ষা দেয়। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে। সে ভালো ছেলেদের নষ্ট করে। এলসিবিয়াডিসের কথা মনে আছে? ক্রিটিয়াসের কথা মনে আছে? তারা এথেন্সকে ধ্বংস করেছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। তারা আসলে কে? তারা ছিল সক্রেটিসের ছাত্র। সক্রেটিসই তাদের দুষ্ট বুদ্ধি দিয়েছে, তাদের নষ্ট করেছে। তাই সে ছেলেদের জন্য ক্ষতিকর। সেদিন এক কবি বলছিল, ‘আমাকে একজন সক্রেটিস দাও— আমি এথেন্সের ঘরে ঘরে দুষ্ট এলসিবিয়াডিস এনে দেব।’ সক্রেটিস খারাপের চেয়ে খারাপ, মহাখারাপ, সে খারাপ বানানোর কারখানা। সে সব সময় যুবকদের কুশিক্ষা দেয়। গোপনে গোপনে খারাপ মন্ত্রণা দেয়। তার সাথে কিছুদিন মিশলেই ছেলেরা আর বাবা-মাকে মানে না, মুরুব্বিদের মানে না, কাউকে মানে না। তার কাছে প্রতিদিন আমাদের সোনার ছেলেরা নষ্ট হচ্ছে। এথেন্সে যুবক কমে গেছে। যুদ্ধে, প্লেগে আমাদের ছেলেরা মরে গেছে। আমরা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলে পাচ্ছি না। সেজন্য একটি যুবককে নষ্ট করা মানে, এথেন্সের এক টুকরা কলিজা কেটে ফেলা। আমরা চাই এথেন্সে যেন এমন কেউ না থাকে, যে আমাদের সোনার ছেলেদের নষ্ট করতে পারে। সে এথেন্সের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, সে দেশদ্রোহী। তাকে সরিয়ে দিন। এক্ষুনি এথেন্স থেকে সরিয়ে দিন।
দর্শকরা চিৎকার করে উঠল, সরিয়ে দিন। সরিয়ে দিন।
প্লেটো চিৎকার করে উঠল, মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা। ফিদো কান্না শুরু করে দিয়েছে। সে চোখ মুছতে মুছতে বলছে— মিথ্যা, মিথ্যা। তাকে কাঁদতে দেখে সক্রেটিসের ছেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল। সক্রেটিস দাঁড়িয়ে দেখলেন, তার ছেলে কাঁদছে। বাবার অপমানে কাঁদছে। ঘর ভর্তি লোকের সামনে বাবাকে এভাবে অপমান করছে, ছেলেটি সইতে পারছে না। ছেলের কান্নায় তিনি নরম হয়ে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে তার চোখেও পানি চলে আসবে। তিনি মনে করলেন হোমারের সেই লাইনগুলো। ঘোর বিপদে অডিসিয়াস বলেছিল— ‘হৃদয় আমার, ধৈর্য ধরো, তুমি অতীতে এর চেয়ে অনেক কঠিন সময় পার হয়ে এসেছো।’
এনিতাস আবার বলছে—
মাননীয় আদালত, এবার সক্রেটিসের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের কথা বলছি। সে ধর্ম মানে না। সে আসলে একটি শয়তান। আমাদের দেবতা মানে না। দেবতাদের নিয়ে উল্টা-পাল্টা কথা বলে। আমাদের এখানে অনেক মানুষ আছে, যাদের সামনে সে পবিত্র ধর্ম নিয়ে মশকরা করেছে। দেবতাদের নিয়ে যা না, তা বলেছে। সে আমাদের দেবতা মানে না। নতুন দেবতা আমদানি করতে চায়। কত বড় আস্পর্ধা— ধর্মের নামে খারাপ কথা বলে?
মাননীয় আদালত, এথেন্সের আইনে এটি অন্যায়। মহাঅন্যায়। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে শাস্তি পেতে হয়। ভয়াবহ শাস্তি। একে এমন শাস্তি দিন, যাতে আর কেউ ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা করতে সাহস না পায়। দেবতাদের অপমান করতে না পারে। এমন শাস্তি চাই যেন সে আর কোনোদিন আমাদের সন্তানদের কুপথে নিতে না পারে। যে মুখ দিয়ে সে দেবতাদের অপমান করে, যে মুখে আমাদের সন্তানদের খারাপ বুদ্ধি দেয়, সেই মুখে কুলুপ দিতে হবে। চিরকালের মতো কুলুপ। আর তার জন্য একটিই উপায়। সেটি হলো— মৃত্যুদণ্ড।
দর্শকরা হৈ হৈ করে উঠল, মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড।
এনিতাস জলঘড়ির দিকে তাকাল। সময় প্রায় শেষ। কথা শেষ করতে হবে। তার গলায় যতটুকু আবেগ আছে, সবটুকু ঢেলে দিল। প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল—
বিজ্ঞ বিচারকগণ, আপনারা আমাদের রক্ষাকারী। আপনারা এমন ব্যবস্থা করবেন যেন এথেন্সে ধর্মবিরোধী কেউ না থাকে, আমাদের শিশুদের জন্য ক্ষতিকর কেউ না থাকে। আজ আপনারা চাইলে আমাদের যুবককে বাঁচাতে পারেন, না চাইলে এই দুষ্ট সক্রেটিসকে বাঁচাতে পারেন। আজ আপনাদের হাতেই এথেন্সের ভবিষ্যৎ। এথেন্সকে বাঁচাতে চাইলে একে মৃত্যুদণ্ড দিন। আপনারা আমাদের মাতৃভূমিকে বাঁচান, আমাদের প্রিয় এথেন্সকে বাঁচান।
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কথা শেষ করল এনিতাস। খুব বেদনার পরিবেশ। সবাই ভাবছে, এথেন্স তো একেবারে শেষ হয়ে গেছে। সক্রেটিস বিদায় হলেই এথেন্স বাঁচবে।
এনিতাস জোরে জোরে কাঁদছে। তার সাথে কাঁদছে অনেক মানুষ। সবাই একসাথে বলছে, ‘এথেন্সকে বাঁচান। সক্রেটিসের হাত থেকে আমাদের সন্তানদের এথেন্সকে বাঁচান।’ একটু পরেই কান্না থেমে গেল। সারা ঘরে শুরু হলো চিৎকার, ‘মৃত্যুদণ্ড দিন, মৃত্যুদণ্ড।’
ক্রিতো বুঝতে পারছেন, ঘটনা খারাপ। এনিতাসের অভিনয় মানুষকে ছুঁয়ে গেছে। আদালতের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে আর ন্যায়বিচার নয়, অভিনয়ের জয় হবে।
ক্রিতোর ভীষণ হতাশ লাগছে। প্লেটো ভাবছে, সক্রেটিস কী করবেন? তিনি কি এই পরিবেশ ঘোরাতে পারবেন? সক্রেটিস কোনোদিন আবেগ মিশিয়ে কথা বলেন না। তিনি যুক্তির কথা বলেন। এই ঘরে যা হচ্ছে, যুক্তি দিয়ে সেটি মোকাবিলা সম্ভব নয়। সক্রেটিস কথা বলেন ছোট ছোট খোঁচা দিয়ে। এখানে সেই খোঁচা খাটবে না। প্লেটো ভয় পাচ্ছে। মানুষ এমন করে মিথ্যা বলতে পারে? একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধকে হত্যা করতে এরা এমন মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে! এমন কেঁদে কেটে অভিনয় করছে! প্লেটো কাঁদছে। ক্রিতোও নিঃশব্দে কাঁদছেন। ফিদো কাঁদছে চিৎকার করে।
হাসছেন শুধু সক্রেটিস। যেন তিনি জানতেন, এমন করেই বলা হবে তার নামে। বিচারক ঘোষণা করলেন, আসামি সক্রেটিস, আপনি আপনার জবানবন্দি দিতে পারেন।
সক্রেটিস ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বিচারকদের দিকে তাকালেন। দর্শকদের দিকে তাকালেন। তার মনে হচ্ছে অনেক দিন আগে ‘মেঘ’ নাটকের থিয়েটারে মানুষ যেমন চিৎকার করছিল, আজ আদালতে সেই একইভাবে চিৎকার করছে। এটি আদালত নয়। এটি থিয়েটার। এখানেও নাটক হচ্ছে। সেদিন থিয়েটারে নাটক করছিল এরিস্টোফানিস। আজ নাটক করছে এনিতাস। তার মনে পড়ল— সেদিন থিয়েটারে যারা ‘মেঘ’ নাটকের দর্শক ছিল, আজ তারাই বিচারক। এই বিচারকদের সবাই সেই নাটক দেখেছে। এই মুহূর্তে সবার মাথায় সেই নাটকে দেখানো সক্রেটিস চলে এসেছে।
আসামির জলঘড়ি চালু হলো। সক্রেটিস জলঘড়ির দিকে তাকালেন। পানির ফোঁটা পড়ছে টিপ টিপ করে। এই ফোঁটা শেষ হওয়ার আগেই এমন কিছু বলতে হবে যাতে মানুষ বুঝতে পারে, সক্রেটিস ধর্ম-বিদ্বেষী নন।
.
সক্রেটিস শুরু করলেন তার জবানবন্দি[১৩৩]:
প্রিয় এথেন্সের ভাইয়েরা, এতক্ষণ যা শুনলাম, তাতে আমি যে কে, সেটিই ভুলে গেছি। আমি যে এত কিছু করতে পারি, সেটি এখানে না এলে আমি জানতামই না।
আমার নামে তিনটি অভিযোগ। আসলে এগুলো কোনো অভিযোগ না। আসল অভিযোগ অনেক দিনের। এখানে তিনজন মামলা করেছে। আসলে তিনজন নয়, আমার নামে মনে মনে মামলা করে এমন মানুষ অনেক। তারা কীভাবে আমার কথা জেনেছে? তারা একটি নাটক দেখেছে। হাসির নাটক। আমার বয়োকনিষ্ঠ বন্ধু এরিস্টোফানিস লিখেছিল সেই নাটক। নাটকের নাম ‘ক্লাউডস’ বা মেঘ। সেই নাটকের প্রধান চরিত্রের নাম সক্রেটিস। সেই সক্রেটিস মেঘের উপর ঘুরে বেড়ায়, তার একটি চিন্তার দোকান আছে। সে চিন্তা করে দুষ্ট বুদ্ধি বানায়, আর যুবক ছেলেরা তার কাছে এলে সে তাদের কুবুদ্ধি দেয়। সে ছেলেদেরকে বাবা-মায়ের অবাধ্য বানায়। সে সত্যকে মিথ্যা করে, আর মিথ্যাকে সত্য।
সেই নাটক দেখে এরা সক্রেটিসকে জেনেছে। আসল সক্রেটিসকে তারা কোনোদিন দেখেনি। তারা ঐ নাটকের সক্রেটিসকেই সত্যিকার সক্রেটিস বলে জানে। আমাকে তারা চেনে না। তারাই আমার নামে মামলা করেছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, ঐ নাটক লেখার সময় এরিস্টোফানিস আমাকে চিনতই না। না জেনে অন্যের মুখে শুনে ভুল লিখেছে, মানুষ তাই বিশ্বাস করেছে।
এই পর্যন্ত সক্রেটিস যা বলেছেন, তাতে প্লেটো খুশি। তিনি ঠিক পথেই আগাচ্ছেন। শুধু বলার ভঙ্গিটা ঠিক হচ্ছে না। সক্রেটিস একটি শব্দও আসামির মতো করে বলছেন না। তিনি বলছেন শিক্ষকের মতো করে। যেন একজন জ্ঞানী বৃদ্ধ শিক্ষক উপদেশ দিচ্ছেন একদল ছাত্রকে।
প্লেটো বারবার বিচারকদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বিচারকদের মনোভাব বোঝা যাচ্ছে না। প্লেটো পেপিরাসে নোট নিচ্ছে। সক্রেটিস যা বলছেন— প্লেটো লিখে রাখছে।
সক্রেটিস বলছেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ— আমি বাচ্চাদের ক্ষতি করি। তো এনিতাস, তুমি তো ভালো জানো। তুমি বলো, বাচ্চাদের উপকার করে কারা?
এনিতাস একটু ভ্যাবাচেকা খেলেও সামলে নিয়ে বলল, আইন।
‘আইন তো একটি ধারণা। মানুষের কথা বলো। বলো কোন কোন মানুষ এথেন্সের বাচ্চাদের উপকার করে।’
‘এই বিচারকগণ।’
‘একজন বিচারক, নাকি সব বিচারক?’
‘সব বিচারক।’
‘শুধু বিচারকগণ, নাকি অন্যরাও উপকারী?’
‘সব সংসদ সদস্য, সব সরকারি লোক, সব ধর্মীয় নেতা, সব পুরোহিত- এরা সবাই বাচ্চাদের জন্য উপকারী।’
‘তাহলে এথেন্সের সবাই বাচ্চাদের জন্য উপকারী, শুধু আমিই ক্ষতিকর।’
‘হ্যাঁ, শুধু আপনিই ক্ষতিকর। আর সবাই উপকারী।’
‘তাহলে তো এথেন্সের বাচ্চারা খুব ভাগ্যবান। তাদের লক্ষ লক্ষ উপকারী মানুষ আছে, ক্ষতিকর লোক শুধু একজন। বিচারক বন্ধুরা, আপনাদের বাচ্চাদের কপাল খুবই ভালো।’
আদালতের সবাই হেসে উঠল।
এনিতাস বলল, এতে কিন্তু প্রমাণিত হয়নি যে সক্রেটিস বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর নন। তিনি অবশ্যই ক্ষতিকর। আর সেই ক্ষতিকর সক্রেটিসকে অবশ্যই দূর করতে হবে। বিদায় করতে হবে চিরতরে।
সক্রেটিস বললেন, উনি বললেন, আমি বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু সত্য হচ্ছে আমি বাচ্চাদের জন্য উপকারী। আমি তাদের প্রশ্ন করতে শিখাই। আমি তাদের জাগিয়ে রাখি। আপনারা সবাই এক রকম পোকা দেখেছেন, যে পোকা[১৩৪] ঘোড়াকে জাগিয়ে রাখে। ঘুমাতে দেয় না। আমিও ওরকম একটি পোকা, যে এথেন্সকে জাগিয়ে রাখে। আমি প্রশ্ন করি। আমি তরুণদের প্রশ্ন করতে শিখাই। এই প্রশ্নই এথেন্সকে ঠিক পথে রেখেছে।
এনিতাসের লোকেরা চিৎকার করছে, ভুয়া, চুপ করো, চুপ করো। তারা সক্রেটিসকে বলতে দিতে চাচ্ছে না। জলঘড়ির সময় শেষ হলেই রায়। তাই সময় নষ্ট করতে পারলেই লাভ। চিৎকার চেঁচামেচির পর পরিবেশ একটু শান্ত হলে সক্রেটিস আবার বলতে শুরু করলেন—
‘আমি মানুষকে বলি, প্রশ্ন কর। তোমরা সবাই প্রশ্ন কর। পরীক্ষা কর। জীবনকে পরীক্ষা কর। বিনা প্রশ্নে কিচ্ছু মেনে নিও না। যে জীবন পরীক্ষিত, শুধু সে জীবনই বেঁচে থাকার উপযুক্ত। অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার উপযুক্ত নয়। আমি মানুষের উপকার করছি। এথেন্সের উপকার করছি। সেজন্য আমার পুরস্কার পাওয়া উচিত। কোনো শাস্তি নয়।’
এবার প্লেটো অবাক। সক্রেটিস হঠাৎ এমনভাবে কথা বলছেন যেন এটি আদালত নয়। এটি সিমনের দোকান। এটি একটি দর্শনের ক্লাস। আর সক্রেটিস একগাদা ছাত্রের সামনে জ্ঞানমাখা কথা বলছেন।
ক্রিতো প্লেটোকে বললেন, সক্রেটিস কী করছে? ইচ্ছা করেই মৃত্যু বেছে নিচ্ছে? ও কি জ্ঞানের জন্য শহিদ হতে চাচ্ছে?
প্লেটো হতবাক। কিছু বলতে পারছে না।
সক্রেটিস বলছেন, ‘বিচারক বন্ধুরা, আমার নামে আরেকটি অভিযোগ, আমি নাকি ধর্ম মানি না। আমি নাকি নতুন দেবতা আমদানি করি। এটিও মিথ্যা, আমি আসলে ধর্মের জন্যই মানুষকে প্রশ্ন করি। আমার বন্ধু চেরোফোনকে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। সে দুবছর আগে মারা গেছে। তার ভাই আজ এই আদালতে উপস্থিত আছেন। সেই চেরোফোন একবার একটি কাণ্ড করেছিল। সে ডেলফিতে গিয়ে ওরাকলকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী কেউ আছে কিনা।’ ওরাকল উত্তর দিয়েছিল, ‘না, সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী কেউ নেই।’ আমি কথাটা বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ আমি জানি যে, আমি তেমন কিছুই জানি না। আমি সবচেয়ে জ্ঞানী কী করে হবো?
তখন ভাবলাম, দেবতারা তো মিথ্যা বলেন না। নিশ্চয়ই কিছু ভুল হচ্ছে। আমি সবচেয়ে জ্ঞানী নয়। আমি পরীক্ষা করতে নামলাম। দেবতার কথা আমাকে পরখ করে দেখতে হবে। প্রথমে গেলাম দার্শনিকদের কাছে। তাদের সাথে কথা বলে আমি অবাক হলাম। তারা নিজেদের বিরাট জ্ঞানী দাবি করে, পর্বতের মতো বড় বড় কথা বলে, কিন্তু তারা তেমন কিছুই জানে না। এরপর গেলাম কবিদের কাছে। কবিরা তাদের নিজের কবিতা নিজেরাই সবচেয়ে কম বোঝে। তারপর গেলাম রাজনীতিকদের কাছে। তারা তো আরেক কাঠি সরেস। তারা সাধারণ মানুষদের চেয়েও রাজনীতি কম জানে। আমি বুঝলাম, আমি জ্ঞানী, কারণ আমি জানি যে আমি আসলে কিছুই জানি না। অন্যরা অজ্ঞান, কারণ তারা যে কিছুই জানে না— সেটিও তারা জানে না। তাই আমি তাদের চেয়ে জ্ঞানী।
বিচারকেরা অবাক। এই বুড়ো কী করছেন। এটি আদালত। তিনি একজন আসামি। আদালতে আসামীরা কাকুতি-মিনতি করে যুক্তি দেয়। মাফ চায়। প্রাণ ভিক্ষা চায়। বলে যে, ‘আমি এথেন্সের জন্য এত এত ভালো কাজ করেছি, এখন মাফ করে দাও। আর হবে না। ভুল করলে না বুঝে করেছি।’ আর বুড়ো সক্রেটিস সেসব কিছুই করছেন না, উল্টা আমাদের জ্ঞান দিচ্ছেন। ইনি তো আসলেই বেকুব। ইনি কি জানেন না যে, তার জীবন আমাদের উপর নির্ভর করছে?
আরেক দল বিচারক ভাবছেন, বুড়োটা আসলে অত খারাপ নয়। তিনি ঠিকই বলছেন। এনাকে শুধু শুধু হেনস্থা করা হচ্ছে।
জবানবন্দি শেষ। এখন ভোট দিচ্ছেন বিচারকরা। দুই রকম পাথর দিয়ে ভোট। এক রকম পাথরে ছিদ্র আছে, আরেক রকমে ছিদ্র নেই। ছিদ্রওয়ালা পাথর হলো হ্যাঁ ভোট, মানে মৃত্যুদণ্ড। আর ছিদ্রহীন পাথর হলো না ভোট, মানে নির্দোষ।
বিচারকরা আনন্দের সাথে ভোট দিচ্ছে। যেন এক উৎসব। ভোট উৎসব শেষের দিকে। ভোট গণনায় বেশি সময় লাগল না। মোট পাঁচশত ভোট। ফলাফল—
মৃত্যুদণ্ড-২৮০ ভোট
খালাস-২২০ ভোট
ষাট ভোটের ব্যবধানে সক্রেটিসের জন্য রায় হলো— মৃত্যুদণ্ড।
এনিতাস হই হই করে উঠল। তারা খেলায় জিতেছে। প্লেটো কাঁদছে, ফিদো হাউমাউ করছে, ক্রিতো বাকরুদ্ধ।
এটিই চূড়ান্ত রায় নয়। আর একটি চান্স আছে। এখন আসামিকে সুযোগ দেওয়া হবে। মৃত্যুদণ্ড না নিয়ে তিনি অন্য একটি বিকল্প শাস্তি চাইতে পারেন।
সক্রেটিস আবার উঠে দাঁড়ালেন।
বিচারকগণ ভাবছেন, এবার সক্রেটিস নরম হবেন, এবার মরণের ভয় একেবারে সামনে এসে গেছে, এবার তিনি ক্ষমা চাইবেন। প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন।
কিন্তু না, সক্রেটিস ধীরে ধীরে বললেন, আপনারা আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। এখন এর বদলে অন্য কিছু চাইতে হবে। বিকল্প কী চাইব? আমি আবারও বলছি, আমি কোনো দোষ করিনি। আমি এথেন্সের জন্য যা করেছি, তার জন্য শাস্তি নয়, আমার পুরস্কার পাওয়া উচিত। তাই বিকল্প শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নয়, আমাকে অলিম্পিকের বীরদের মতো প্রিটারিয়ামে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক
সারা ঘরের মানুষ বলে উঠল, কত বড় আস্পর্ধা! প্রিটারিয়ামে থাকতে চায়!
প্রিটারিয়াম হলো এথেন্সের বীরদের থাকার জায়গা। যারা অলিম্পিকে জয়ী হয়, তাদের সারা জীবনের দায়িত্ব সরকার নেয়। তারা প্রিটারিয়ামে থাকে। খুবই সম্মানের জায়গা।
বিচারকরা এবার চরম বিরক্ত। এত বড় আস্পর্ধা। বিচার নিয়ে ফাজলামি? একজন দাগি আসামি যার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়ে গেছে, সে কিনা বলছে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হোক। বীরের মতো প্রিটারিয়ামে জায়গা দেওয়া হোক। এত বড় সাহস! সক্রেটিস এথেন্সের সম্মান নিয়ে মশকরা করছেন। আর কোনো কথা শোনা হবে না। অনেক হয়েছে। এবার দ্বিতীয় ভোট
দ্বিতীয় ভোটের ফলাফল :
মৃত্যুদণ্ড-৩৪০ ভোট
খালাস-১৬০ ভোট
সক্রেটিসের বিকল্প শাস্তির প্রস্তাব শুনে আরও ৬০ জন বিচারক মন বদলে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
দর্শক সারি থেকে ক্রিতো বললেন, এই শাস্তির বদলে অর্থদণ্ড করা হোক। আইনে আছে, জরিমানা দিয়ে শাস্তি মওকুফ করা যায়।
বিচারক সক্রেটিসকে বললেন, ঠিক আছে, জরিমানা কত দিবেন?
সক্রেটিস বললেন, আমার তো টাকা-পয়সা নেই। জরিমানা কোত্থেকে দেব?
বিচারক বললেন, সময় নষ্ট না করে জরিমানার অংক বলুন।
সক্রেটিস বললেন, এক মিনা।
এক মিনা খুবই সামান্য পরিমাণ অর্থ। বিচারকগণ হতভম্ব। এই লোক আবার তাদের অপমান করছেন। বিচার নিয়ে মশকরা করছেন। এক মিনা কোনো জরিমানা হয় না। ক্রিতো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সক্রেটিস সব মাটি করে দিলেন। তাকে বাঁচানোর আর কোনো আশা নেই।
প্লেটো শেষ চেষ্টা করতে চায়। সে চিৎকার করে বলল, জরিমানা ত্রিশ মিনা দেওয়া হবে। আমরা দেব।
প্লেটোর দিকে তাকিয়ে সক্রেটিস বললেন, ঠিক আছে, ত্রিশ মিনা। বিচারকরা সেই কথা আমলেই নিল না। বিচার শেষ।
প্রধান বিচারক চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করলেন, সক্রেটিসের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
সক্রেটিস স্মিত হাসি দিয়ে শান্ত মুখে বললেন, আমি যাচ্ছি মরণের দিকে, তোমরা যাচ্ছ জীবনের দিকে; কোনটি ভালো, সেটি শুধু ঈশ্বর জানেন।
এনিতাস চিৎকার করছে। সে জিতে গেছে। সক্রেটিসের লোকেরা সব কাঁদছে। সক্রেটিসের ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। মাকে খবর দিতে হবে।
আদালত থেকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হবে সক্রেটিসকে। পায়ে শিকল পরানো হলো। তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। জেলখানা বেশি দূরে নয়। আগোরার ভেতরেই। দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায়। পাঁচ-ছয় মিনিটের হাঁটাপথ। সবাই মিলে হইহই করতে করতে সক্রেটিসকে নিয়ে যাচ্ছে জেলখানায়। চুপচাপ হাসিমুখে জেলের দিকে হাঁটছেন সক্রেটিস। পথেই দেখা গেল, জেনথিপি দৌড়ে আসছেন। ক্রিতো তার ছেলে ক্রিতোবুলাসকে পাঠালেন, জেনথিপি যেন এখানে না আসেন। তুমি তাকে নিয়ে সরাসরি জেলখানার গেইটে চলে যাও। সেখানে দেখা করার ব্যবস্থা হবে।
কীভাবে সক্রেটিসের মৃত্যু হবে, সেটি ঠিক হবে জেলখানায়।
***
১৩২. জলঘড়ি (Water Clock) : সেই সময় গ্রিসে সময় মাপা হতো জলঘড়ি দিয়ে, গ্রিক ভাষায় এর নাম Klepsydra.
১৩৩. প্লেটো তার ‘এপোলজি’ (Apology) গ্রন্থে আদালতে সক্রেটিসের জবানবন্দি বিস্তারিত লিখেছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, প্লেটো নিজে সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং সক্রেটিসের কথার নোট নিয়েছেন। সক্রেটিসের আরেকটি জবানবন্দি লিখেছেন তার আরেক শিষ্য জেনোফোন। কিন্তু তিনি নিজে আদালতে ছিলেন না, তিনি তখন এথেন্স থেকে নির্বাসিত, স্পার্টায় ছিলেন। জেনোফোন জবানবন্দি লিখেছেন প্লেটো ও অন্যদের থেকে শুনে। আমি এই জবানবন্দির মূল উৎস হিসেবে প্লেটোর ‘এপোলজি’কেই নিয়েছি।
১৩৪. প্লেটোর ‘এপোলজি (Apology) গ্রন্থে সক্রেটিস যে পোকাটির কথা বলেছেন, ইংরেজিতে সেটিকে বলে Gadfly, গ্রিক ভাষায় নাম Myops (মিওপস)। এই পোকাটি ঘোড়া, গরু এসব প্রাণীদের ক্রমাগত হুল ফুটায়, বিরক্ত করে, ঘুমাতে দেয় না। সক্রেটিসও এই পোকার মতো এথেন্সের মানুষদের হুল ফুটিয়েছেন, যাতে তারা সত্য পথে থাকে, ঘুমিয়ে না পড়ে।