৫০
‘একই ভুল দ্বিতীয় বার করা জ্ঞানের পরিচয় নয়।’ -মিনানডার
***
সক্রেটিস ভেবেছিলেন তিনি কোনো দিন নেতা হবেন না। তবু তাকে নেতা হতে হলো। ছোটখাটো নেতা নয়, তিনি একেবারে সংসদের প্রধান ২৩ হয়ে গেলেন। তিনি নেতা হলেন এথেন্সের গণতন্ত্রের অদ্ভুত নিয়মের কারণে। এখানে প্রতিদিন লটারি করে একজন সংসদের নেতা হন। লটারির গুণে এক দিনের জন্য নেতা হয়ে গেলেন সক্রেটিস।
তিনি ভেবেছিলেন কোনো রকমে চামেচিকনে দিনটা পার করে দেবেন। কিন্তু সেটি হলো না। অনিচ্ছাকৃতভাবে নেতা হয়ে তিনি পড়লেন বিরাট ঝামেলায়। সংসদে মামলা এসেছে। মামলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। তার মানে তিনি একাধারে নেতা এবং বিচারক। দুটোই তার অপছন্দের কাজ। তিনি বিষণ্ণ বদনে মামলার বিবরণ শুনছেন। অদ্ভুত এক মামলা :
এথেন্সের নৌবাহিনী এক ভয়াবহ যুদ্ধে স্পার্টার সাথে জিতে ফেরার পথে ঝড়ের কারণে তাদের অনেকগুলো জাহাজ ডুবে গেছে। সাগরে ডুবে মারা গেছে কিছু সেনা। তীব্র ঝড়ের কারণে মৃত সৈনিকদের লাশ আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু লাশ ফেলে আসা এখানে ভয়াবহ অপরাধ। সেই অপরাধে এথেন্সে ফেরা মাত্র গ্রেফতার করা হয়েছে ঐ যুদ্ধের তরুণ সেনাপতিদের। আটজন সেনাপতি ছিল। তাদের দুইজন পালিয়েছে, তারা বুঝতে পেরেছে যে ঘটনা খারাপ। বাকি ছয়জন এথেন্সে ফিরেই আটক হয়েছে। এদের একজন হলো আসপাশিয়ার পুত্র পেরিক্লিস নাম্বার টু। তাদেরকে বিচারের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে সংসদে। আজকে সংসদের নেতা সক্রেটিস। তিনি বিচার করবেন যে সেনাপতিদের শাস্তি দেবেন নাকি ক্ষমা করে দেবেন। তুমুল আলোচনা চলছে। বিশাল বিতর্ক। লোকজন চিৎকার করে বলছে, ‘মৃত্যুদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড’। আঁৎকে উঠলেন সক্রেটিস। ঝড়ের কারণে লাশ আনতে পারেনি বলে এথেন্সের সেরা সেনাপতিদের মৃত্যুদণ্ড চাইছে মানুষ? চারিদিকে বিপুল গোলমাল, সবাই মৃত্যুদণ্ড চাইছে। তিনি ভাবছেন এথেন্সের মানুষ এত অবিবেচক হলো কী করে? এমনিতেই যুদ্ধে, প্লেগে এথেন্সে যুবক ছেলে কমে গেছে, এখন সেরা যোদ্ধাদের বিনাদোষে মেরে ফেলবে? মানুষ এত অসহিষ্ণু! এই তরুণদের সক্রেটিস ভালোবাসেন, তিনি তাদের সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখান। তিনি বললেন, ‘না, কিছুতেই নয়, আমি নেতা থাকতে এই তরুণ ছেলেদের বিনা দোষে মরতে দেব না।’ সক্রেটিসের বাধার কারণে সেদিন আর বিচার শেষ হলো না। পরদিন সক্রেটিস সংসদের নেতা নেই, বাধা দেওয়ারও কেউ নেই। পরদিন বিচার করে সেনাপতিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। মেরে ফেলা হলো এথেন্সের শ্রেষ্ঠ তরুণ যোদ্ধাদের। চোখের পানি মুছতে মুছতে সক্রেটিস বললেন, ‘এভাবে তরুণদের মেরে ফেললে যুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজিত হতে বেশি দিন লাগবে না।’
তার দু বছরের মধ্যেই এক সন্ধ্যার আবছা আলোয় খবর এলো এথেন্স হেরে গেছে। পঁচিশ বছর ধরে যুদ্ধের পর জিতে গেল স্পার্টা। পেলোপোনেসিস যুদ্ধ শেষ হলো। এথেন্সের দেয়াল ভেঙে নগরে ঢুকল স্পার্টানদের নেতা লাইসেন্ডার[১২৪]। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর এখন তাদের হাতে। তারা চাইলে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে এথেন্স। কিন্তু এত চমৎকার নগর তারা ধ্বংস করল না। তারা মানুষ মারবে না। বাড়িঘর পোড়াবে না। সব আগের মতোই থাকবে। শুধু গণতন্ত্র থাকবে না। যত নষ্টের মূল হলো গণতন্ত্র। তাই আজ থেকেই গণতন্ত্র বাতিল। স্পার্টান নেতারা তাদের পছন্দের ত্রিশ জনের একটি কমিটি করে বলল, আজ থেকে এরাই এথেন্সের শাসক। আর কোনো ভোটাভুটি নেই, গণতন্ত্রের খেলনাপাতি সব বন্ধ। এথেন্স শহরের চারদিকের সুরক্ষা দেয়াল ভেঙে ফেলা হলো। বাতিল করা হলো এথেন্সের সেনাবাহিনী। অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সৈনিকদের কৃষিকাজে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এথেন্সের সব যুদ্ধ জাহাজ দূরের দ্বীপে জিনিসপত্র পরিবহনের কাজে লাগিয়ে দিল।
ত্রিশজন একনায়ক একসাথে এথেন্সের রাজা হয়ে গেল। কী তাদের দাপট! তারা এতদিন গণতন্ত্রীদের অনেক জ্বালা সহ্য করেছে, এবার তারা দেখিয়ে দেবে শাসন কাকে বলে! তারা শুরু করল ব্যাপক কর্মকাণ্ড। আজকে এই আদেশ, কালকে অন্যটা। তাদের নেতা হলো প্লেটোর মামা, নাম ক্রিটিয়াস। গণতন্ত্রের সর্বনাশ আর ক্রিটিয়াসের পৌষ মাস। সে গণতন্ত্রের সব নেতাদের নামে হুলিয়া জারি করল। বন্দি করল অনেককে, অনেকে পালিয়ে গেল। তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল। শুরু করল নিষ্ঠুর হত্যালীলা। যখন যাকে খুশি মেরে ফেলে, যাকে ইচ্ছা নির্বাসন দেয়। শুরু হলো এথেন্সের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম সময়। চামড়া ব্যবসায়ী গণতন্ত্রী নেতা এনিতাসের ঘর বাড়ি, কারখানা সবকিছু বাজেয়াপ্ত করে নিল। ত্রিশজন একনায়কের মধ্যে প্লেটোর আরেক মামাও আছেন। তার নাম কারমিড। ক্রিটিয়াস ও কারমিড সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন। যখন তারা ক্ষমতায় আসেনি, তারা সক্রেটিসের আড্ডাখানায় যেত। আর সবার কছে বলত আমরা সক্রেটিসের শিষ্য।
ত্রিশ একনায়করা একটি বুদ্ধি করল। এথেন্সের সব নামি দামি মানুষকে কাজে লাগাবেন। মানী লোকেরা তাদের আদেশ মানতে শুরু করলে, সবাই বুঝবে তাদের অনেক ক্ষমতা। তাই সব নামি দামি লোকের তালিকা করো, কাজ দাও। সেই তালিকায় সক্রেটিসও আছেন।
ক্রিটিয়াস ডেকে পাঠাল সক্রেটিসকে। পত্রপাঠ যেন সক্রেটিস চলে আসেন। সক্রেটিসের প্রতি তার ভীষণ রাগ ছিল। কিছুদিন আগে সক্রেটিস তার চরিত্র নিয়ে ভীষণ বাজে কথা বলেছিলেন। সকলের সামনে তাকে শূকরের সাথে তুলনা করেছিলেন। এক সন্ধ্যায় একটি সিম্পোজিয়াম চলাকালে ক্রিটিয়াস নেশার ঘোরে ইউথিডিমাস নামের একটি সুদর্শন তরুণকে বারবার জড়িয়ে ধরছিলেন। সক্রেটিসের মোটেই ভালো লাগেনি এই ব্যবহার। তিনি সবার সামনে পিন দিয়ে বললেন, ‘তুমি এমন করছো যেন একটি বাচ্চা শূকর পাথরের সাথে শরীর ঘষা দিচ্ছে।[১২৫] ক্রিটিয়াস হাসি দিয়ে থেমে গিয়েছিল। হাসি-ঠাট্টায় শেষ হয়েছিল ঘটনা। কিন্তু ক্রিটিয়াস এই অপমান ভোলেনি। সে প্রতিশোধের আশায় ছিল। এখন প্রতিশোধ নেবে। তাই সক্রেটিসকে ডাকল।
সে সক্রেটিসকে আদেশ করল, এক্ষুনি সালামিস দ্বীপে চলে যাও, সেখানে লিওন নামে এক ধনী লোককে আটক করে নিয়ে আসো। তার টাকা-সম্পত্তি সব বাজেয়াপ্ত করে আনো। সক্রেটিস ও আরও চারজন, মোট পাঁচজনে মিলে গ্রেফতার করতে হবে। এখুনি সেনা নিয়ে বেরিয়ে যাও।
সক্রেটিস ভালো করে ক্রিটিয়াসের দিকে তাকালেন। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, এ কি তার ছাত্র ক্রিটিয়াস? একজন নিরপরাধ মানুষকে গ্রেফতার করতে বলছে! সক্রেটিসের মতো বৃদ্ধকে এই কাজ করতে হবে? এই কাজ সক্রেটিস করতে পারেন না। তিনি বাড়ি চলে গেলেন। অন্য চারজন আদেশ পালন করল। শুধু সক্রেটিস অন্যায় আদেশ মানলেন না।
বাড়ি ফিরেই সক্রেটিস খবর পেলেন, জেনথিপি তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এটিও ছেলে। এথেন্সে এখন ছেলে শিশু দরকার। সরকার বুড়ো- বুড়িদের বাবা-মা হতে উৎসাহ দিচ্ছে। জেনথিপি তৃতীয় বারের মতো মা হলেন। ছেলের নাম রাখা হলো মেনেক্সানোস।
.
প্লেটো ভীষণ ক্ষুব্ধ। তার মামা এটি কী করছে? এটি কি কোনো শাসন! প্লেটোর রাজনীতি করার ইচ্ছাটাই চলে গেল। সে গণতন্ত্রকে তেমন পাত্তা দিত না। গণতন্ত্র হলো বাচালদের শাসন। বাচালরা বেশিরভাগ সময় মূৰ্খ হয়। প্লেটো ভাবত, গণতন্ত্রের বদলে একনায়করা ভালো শাসন করবে। তার মতে যোগ্য একনায়কই সেরা শাসক। কিন্তু নিজের মামা ক্রিটিয়াস যখন একনায়ক হলো, তখন প্লেটোর ভুল ভাঙল। একনায়ক যে কত খারাপ হতে পারে, সেটি নিজের চক্ষে দেখল। নিজের এত ভালো মামাটা এমন হয়ে গেল কেন? তার মানে স্বৈরাচারী একনায়ক ব্যবস্থাটা ভালো নয়। এটি ভালো মানুষকে খারাপ শাসক করে তোলে।
প্লেটো ভাবছে গণতন্ত্রও ভালো নয়, আবার একনায়করাও খারাপ। তাহলে দেশ চলবে কী করে? সে একটি সুন্দর নগরের স্বপ্ন দেখে। যে নগরে সবাই সুখে থাকবে। কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা সব থাকবে। সে যখনই সময় পায়, সক্রেটিসের সাথে আলাপ করে, একটি সুন্দর নগর কীভাবে বানানো যায়! প্লেটো সেই নগরের নাম দিল কালিপলি বা সুন্দর নগর[১২৬]। আসলে এই সুন্দর নগর হলো একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চিন্তা। তো কে হতে পারে আদর্শ রাষ্ট্রের আদর্শ শাসক? গণতন্ত্র? একনায়ক?
প্লেটো এই ব্যাপারে সক্রেটিসের সাথে পরামর্শ করে। সক্রেটিস বলেন, ‘দার্শনিক বা জ্ঞান-প্রেমিকরাই হলো সবচেয়ে ভালো মানুষ। দার্শনিক মানে যারা সত্যকে দর্শন করেছেন, সত্যকে নেড়েচেড়ে দেখেছেন। তাদের চেয়ে ভালো মানুষ আর নেই। তারা সাধারণত বিয়ে করেন না। বিয়ে করলেও তাদের মনে থাকে বৈরাগী স্বভাব। তারা নিঃস্বার্থ হয়। নিঃস্বার্থ দার্শনিকের শাসনই সবচেয়ে ভালো শাসন।’
কথাটা প্লেটোর পছন্দ হলো। দার্শনিকের শাসন দরকার। যার হাতে অস্ত্র থাকবে, সে শাসন করবে না। সে অন্যের আদেশ মানবে। তাহলেই অস্ত্রের ব্যবহার সুন্দর হবে। সেনাপতি শাসন করবে না। সেনাপতি দার্শনিক রাজার অধীনে থেকে কাজ করবে। তাহলেই আদর্শ রাষ্ট্র হবে।
প্লেটো ভাবছে দার্শনিকের শাসনে আদর্শ রাষ্ট্রে সবকিছুতে ন্যায় থাকবে। মানুষের ব্যক্তিজীবনে যেমন সবকিছুতে ন্যায় প্রয়োজন, তেমনই রাষ্ট্রের জন্যও দরকার ন্যায়। রাষ্ট্রকেও হতে হবে ন্যায়পরায়ণ। সেটি তখনই সম্ভব যদি ছোটবেলা থেকে তরুণদের দার্শনিক বানানো যায়। সেজন্য স্কুল দরকার। বড়দের জন্য স্কুল। সক্রেটিস যদি একটি স্কুল দিতেন, অনেক মানুষের উপকার হতো। তরুণরা শিখতে পারত। সক্রেটিস যে সুন্দর জীবনের কথা বলেন, যুবকেরা সেই সুন্দর জীবন পেত।
একদিন ভয়ে ভয়ে সক্রেটিসকে বলেই ফেলল, আপনি একটি স্কুলের মতো কিছু দিলে ছাত্রদের অনেক উপকার হতো।
হো হো করে হেসে উঠলেন সক্রেটিস। বললেন, আমার তো স্কুল আছে। সারা এথেন্সই তো আমার স্কুল। এথেন্সের প্রতিটি অলি-গলি আমার স্কুল। প্রতিটি জিমনেশিয়াম আমার স্কুল। সিমনের দোকান আমার স্কুল। এত বিশাল স্কুলের এত ছাত্র ফেলে আমি এক ভবনের একটি স্কুল বানালে তাতে ছাত্রদের ক্ষতি হবে।
প্লেটো বুঝল, সক্রেটিস সেই ধরনের মানুষ নন। তিনি মুক্ত। ধরাবাঁধা জীবন তার জন্য নয়।
.
ত্রিশ একনায়কের যন্ত্রণায় মানুষ ভীষণ ভীতিকর সময় কাটাচ্ছিল। ভাগ্য ভালো এই ভয়ের শাসন বেশিদিন রইল না। প্লেটোর মামা ক্রিটিয়াস বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারল না। মাত্র আট মাস পরেই গণতন্ত্রের পক্ষের লোকজন দখল করল এথেন্স। এই দখলে নেতৃত্ব দিল এনিতাস। ত্রিশ একনায়ক সবাই মারা গেল। আরেক দফা রক্তপাত হলো, আবার অনেক মৃত্যু হলো। এথেন্সে আবার গণতন্ত্র ফিরে এলো।
এখন নেতারা খুঁজছে— এথেন্সের এই খারাপ সময়ের জন্য দায়ী কে? ছেলেদের নষ্ট করছে কে? কে গণতন্ত্রকে বারবার হারিয়ে দিচ্ছে? কে দায়ী? কেন স্পার্টার সাথে হারল এথেন্স? এথেন্স হেরেছে, তার কারণ এলসিবিয়াডিস। তার জন্যই বড় হার হয়েছিল সিসিলিতে, পরিণামে স্পার্টার সাথে চূড়ান্তভাবে হেরে গেছে। এই দুষ্ট এলসিবিয়াডিস কে? সে সক্রেটিসের শিষ্য। এথেন্সের আরেক দুষ্ট লোক ক্রিটিয়াস। সে কয়েক মাস ক্ষমতায় থেকে গণতন্ত্রের নেতাদের কচুকাটা করেছে। তার মতো খারাপ লোক এথেন্সে গত কয়েকশ বছরে জন্মায়নি। সে কে? সেও সক্রেটিসের শিষ্য তার মানে সক্রেটিসের শিষ্যরাই এথেন্সের ধ্বংসের জন্য দায়ী। সকল নষ্টের গোঁড়া হলো সক্রেটিস। সেই আমাদের সোনার ছেলেদের নষ্ট করছে। সক্রেটিসকে শিক্ষা দিতে হবে। সক্রেটিসকে শিক্ষা দিতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী হলো এনিতাস। এনিতাস এখন বড় নেতা। নতুন গণতন্ত্রের সে একজন নীতি-নির্ধারক। এনিতাস অনেকদিন ধরে সক্রেটিসকে শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। সে নিজের টাকায় ‘মেঘ’ নাটক অভিনয় করিয়েছে অনেক জায়গায়। সক্রেটিসকে মানুষের কাছে খারাপ করে তুলে ধরতে যা যা করা সম্ভব, সব করেছে সে। আবার ‘মেঘ’ নাটকটি দেখাতে হবে মানুষকে। সবাইকে বোঝাতে হবে যে আমাদের খারাপ সময়ের জন্য সক্রেটিসই দায়ী।
.
আজ সন্ধ্যায় এথেন্সে আবার ‘মেঘ’ নাটকটি অভিনীত হবে। আবার সারা শহরে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আর নাট্যকার এরিস্টোফানিস অভিনয় করবে না। সে বুঝতে পেরেছে যে সে ভুল লিখেছিল। কিন্তু তার কিচ্ছু করার নেই। নাটকের প্রযোজক হলো এনিতাস। এনিতাস নিজের টাকায় নাটকটি অভিনয় করায়। এথেন্সের বিভিন্ন পাড়ার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করায়।
প্লেটো নাটকটি দেখল। নাটকে দেখানো হচ্ছে, সক্রেটিস তার চিন্তার দোকানে বসে একটি ছেলেকে খারাপ করছে। ছেলেটি সক্রেটিসের শিক্ষায় নষ্ট হয়ে গেল। বাবাকে পিটাল। দেবতা জিউসকে ভুলে মেঘকে দেবতা মেনে নিল। অবশেষে ছেলেটির বাবা সক্রেটিসকে ঘরে আটকে আগুন দিয়ে দিল। কোনমতে পালিয়ে বাঁচল সক্রেটিস।
এই নাটক দেখতে দেখতে থিয়েটারে বসেই কাঁদল প্লেটো। মঞ্চে এরকমভাবে কেউ সক্রেটিসকে দেখাতে পারে, সেটি তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। এমন মিথ্যা কথা মানুষ লিখতে পারে? এটি কি কোনো মানুষের কাজ? এই নাটক লিখেছে এরিস্টোফানিস। খুবই প্রতিভাধর নাট্যকার। তার মতো লেখক যদি এমন মিথ্যা নাটক লেখে, তাহলে অন্যদের কী অবস্থা! তো নাটক মানেই মিথ্যা। কবিতা মানেই বানানো। নাটক, কবিতা সমাজের জন্য ক্ষতিকর সক্রেটিসের মতো দেবতাতুল্য মানুষকে নিয়ে যদি এমন নাটক লেখে, তাহলে সাহিত্যিকরা পারে না এমন কোনো জিনিস নেই।
থিয়েটার থেকে বের হয়ে প্লেটো বাড়ি ফিরে গেল না। সরাসরি সক্রেটিসের বাড়ি গেল। তার চোখ এখনও ছলছল করছে। সক্রেটিস আর জেনথিপি দুজনেই তাকে দেখে চমকে উঠলেন। এই সন্ধ্যায় প্লেটো তাদের বাড়িতে এসেছে? নিশ্চয়ই ঘটনা সাংঘাতিক। সে অনেক প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটি ছেলে। তার চোখে বিষাদ থাকে না। সেই ছেলে সন্ধ্যাবেলা কাঁদতে কাঁদতে সক্রেটিসের বাড়িতে এসেছে, মোটেই ভালো কথা নয়।
জেনথিপি এই ছেলেটিকে খুব পছন্দ করেন। তিনি জানেন, এই ছেলেটি সক্রেটিসকে সীমাহীন ভালোবাসে।
জেনথিপি প্লেটোকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চোখে পানি কেন?
প্লেটো বলল, থিয়েটার থেকে এলাম।
জেনথিপি কিছু বুঝতে পারছেন না। থিয়েটার থেকে এলে কান্না করার কী আছে? তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
সক্রেটিস বললেন, তার মানে হলো, আজ প্লেটো ‘মেঘ’ নাটকটি দেখেছে। এনিতাস আবার নাটকটি দেখাতে শুরু করেছে।
সক্রেটিসের মনে আছে, প্রথমবার নাটকটি দেখে তিনিও কেঁদেছিলেন। চেরোফোন হাউমাউ করে কেঁদেছিল। এখন প্লেটোর মতো একটি শান্ত ছেলেও কাঁদছে। প্লেটোর অবস্থা দেখে জেনথিপির চোখও ছলছল করে উঠল। তিনি কান্না গোপন করতে চাচ্ছেন। সক্রেটিস দেখলেন, এখানে থাকলে সম্মিলিত কান্না শুরু হয়ে যাবে। তার চেয়ে নাটক নিয়ে প্লেটোর মনের দুশ্চিন্তা দূর করতে কিছু করা যাক।
সক্রেটিস বললেন, প্লেটো, চলো একজন নাট্যকারের কাছে যাই।
দুজনে বের হলো।
নাট্যকারের নাম ইওন[১২৭]। ইদানীং খুব ভালো অভিনয় করছে। সে মঞ্চে উঠেই কান্নাকাটি শুরু করে, এমন হৃদয় বিদারক কান্না করে যে থিয়েটারের সকল দর্শক হাউমাউ করে কাঁদে। তাকে সবাই এখন বলে কান্না বাহার। কেঁদে কেঁদে সে ইদানীং পুরস্কারও জিতছে। গতকাল এথেন্সের বাইরে এপিডাভরো শহর থেকে সেরা নাট্যকারের পুরস্কার নিয়ে এসেছে। সক্রেটিস তাকে বললেন, নাট্যকার, তুমি কি জানো, তোমার কান্না কেমন করে দর্শকদের কাঁদায়?
ইওন বলল, হ্যাঁ, জানি তো। আমি মঞ্চ থেকে দেখি, আমি কাঁদি, আমাকে দেখে দর্শকরাও কাঁদে। এতে মনে মনে আমার খুব আনন্দ হয়। আমি খুব কায়দা করে ওদের কাঁদাই। এই কাঁদানোর জন্যেই লোকে আমায় ডাকে। এই কাঁদিয়েই আমি পয়সা পাই। কান্না শেষে পয়সা হাতে নিয়ে আমি হাসি।
প্লেটো বলল, বাহ, নাট্যকার তুমি খুব সহজে সত্যিটা বলেছ। ধন্যবাদ। তোমার এই কান্নাবিলাস প্লেটোকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল।
তারা নাট্যকারকে ছেড়ে দিল। নিজেরা আলাপ শুরু করল। আলাপের বিষয় কবিতা, নাটক এসব দরকার আছে কিনা?
প্লেটো বলল, নাট্যকার ইওন খুব সৎ লেখক। সে সত্য কথাটা বলেছে। কবিতা, নাটক এমনই। এগুলো মানে শুধুই মিথ্যার অভিনয়।
সক্রেটিস বললেন, কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে আসলেই ঝামেলা। তারা মানুষকে উস্কে দিতে খোঁচা দেয়। দেখো, হোমারের মতো মহান কবি তার অডিসি কাব্যে কীরকম একটি বিশ্রী কাহিনি দিয়ে খোঁচা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন : ‘সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি তার স্বামী কর্মকার দেবতা হেফাস্টাসকে ভালোবাসে না, সে ভালোবাসে যুদ্ধের দেবতা আরিসকে। তার স্বামী তাদেরকে ধরার জন্য অনেক দিন তক্কে তক্কে ছিল, শেষে একদিন প্রেমিক-প্রেমিকাকে লজ্জাকর অবস্থায় একসাথে ধরে অদ্ভুত এক লোহার শিকলে দুজনকে আটকে সব দেব-দেবীকে খবর দেয়। লজ্জাকর উলঙ্গ অবস্থায় দুজনকে আটকে থাকতে দেখে সব দেব-দেবী ঠাট্টামশকরা শুরু করল।[১২৮] এখন প্লেটো, তুমিই বলো এখানে হোমার কী বোঝাতে এই কাহিনি অডিসি বইতে দিলেন? এতে কি কোনো শিক্ষা আছে? স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক ধরার জন্য স্বামীকে ফাঁদ পাতা শেখানোর জন্যই কি এরকম কাহিনি লিখলেন হোমার? হোমারের মতো মহান কবির যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে অন্যরা কী লিখতে পারে সেটি ভেবে দেখো। এই ধরনের লেখার কোনো দরকার আছে?
অনেক রাত পর্যন্ত এসব নিয়ে আলাপ করল সক্রেটিস আর প্লেটো। প্লেটো মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আমার আদর্শ রাষ্ট্রে আমি কোনো নাট্যকার রাখব না, কোনো কবি রাখব না। শুধু এমন কবিরা থাকবে যারা শিক্ষামূলক লেখা লিখবে। যারা মিথ্যা কথা লেখে, যারা যুবকদের জন্য ক্ষতিকর কথা লেখে, আদর্শ রাষ্ট্রে তাদের দরকার নেই। তাদের সব নির্বাসন দিয়ে দেওয়া হবে। মিথ্যাবাদী কবি, মিথ্যাবাদী নাট্যকার সবাইকে আদর্শ রাষ্ট্র থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা হবে। যারা সত্য কথা লিখবে, ভালো কথা লিখবে তারাই শুধু আদর্শ রাষ্ট্রে থাকবে।
প্লেটো ভাবছে একথা সক্রেটিসকে বলা যাবে না। সক্রেটিস রাজি হবে না। সক্রেটিস সবকিছুতে মধ্যপন্থি। তিনি কোনোকিছুতেই চরম সিদ্ধান্ত নেন না। কিছু করতে বাধ্য করেন না। কবি-সাহিত্যিকদের তাড়িয়ে দেওয়ার মতো এরকম কঠিন কথা সক্রেটিস মানবেন না। বাড়ি ফিরে একটি অদ্ভুত কাণ্ড করল প্লেটো। প্লেটোর বয়স ছাব্বিশ। সে যত কবিতা আর নাটক লিখেছিল সব এনে উঠানে জড়ো করল। এই বয়স পর্যন্ত সে যা কিছু লিখেছিল সব কিছু একত্র করল। উঠানে পেপিরাসের বিশাল স্তূপ হয়ে গেল।
বাড়ির লোকেরা কিছুই বুঝতে পারছেন না। ছেলে কী করছে! কিছু মনে হয় হারিয়ে গেছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখা মনে হয় খুঁজছে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই পেপিরাসের স্তূপে আগুন জ্বালিয়ে দিল প্লেটো। সবাই হায় হায় করে উঠল। সন্ধ্যার আঁধার আলো করে জ্বলে উঠল প্লেটোর এত বছরের লেখা। তার মা কাঁদছেন। ছেলে পাগল হয়ে গেল। বাবা বলেছিল, এই ছেলে একদিন হোমারকে ছাড়িয়ে যাবে, একদিন সফোক্লিসের চেয়ে বড় নাট্যকার হবে। আর সেই ছেলে তার সব লেখা পুড়িয়ে দিল!
সবাই আফসোস করছে। শুধু প্লেটো হাসছে। একটি শান্তির হাসি। সক্রেটিসের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই তার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। সে আর কোনোদিন কবিতা লিখবে না। নাটক লিখবে না। কবিতায়, নাটকে মিথ্যা কথা লেখা হয়। সে আর এসব কিছুই লিখবে না। যদি কিছু লিখে, সেটি হলো সক্রেটিসের মুখের কথা, সক্রেটিসের দর্শন। সেগুলো সব সত্য, কোনো মিথ্যা কিছু আর সে লিখবে না।
রাতের আকাশ আলো করে জ্বলছে প্লেটোর লেখা সব কবিতা। পুড়ছে তার লেখা সব নাটক। এথেন্সের বাতাসে ভাসছে কবিতা পোড়ার গন্ধ।
আগুনের শিখা ছুঁয়ে প্লেটো মনে মনে দৃঢ়ভাবে বলছে, পৃথিবীতে আর কোনো কবি থাকবে না, কোনো কবিতা থাকবে না। কোনো নাটক থাকবে না, কোনো নাট্যকারও থাকবে না। আমি যদি কোনোদিন একটি আদর্শ নগর তৈরি করতে পারি, সেই নগরে কোনো কবি থাকবে না, কোনো নাট্যকার থাকবে না। যারা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা লেখে, আমার নগরে তাদের কোনো স্থান হবে না। আমি সেই নগর থেকে সকল মিথ্যাবাদী কবি-সাহিত্যিককে নির্বাসন দেব।
এই সন্ধ্যায় এথেন্সের নিকষ আঁধার ভাসিয়ে জ্বলছে অদ্ভুত এক আগুন। সেই আগুনে খড়কুটোর মতো পুড়ে যাচ্ছে একজন কবি, মোমের মতো গলে যাচ্ছে একজন নাট্যকার, ছাই হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা একজন সাহিত্যিক। আর সেই ছাইয়ের ভগ্নস্তূপ থেকে জন্ম নিচ্ছে একজন সুকঠিন দার্শনিক, তার নাম প্লেটো।
***
১২৩. সক্রেটিস খ্রি. পূ. ৪০৬ অব্দে এক দিনের জন্য এথেন্সের সংসদ (Boule) এর নেতা হন, সেদিনই ছয়জন তরুণ সেনাপতিকে বিচারের জন্য সংসদে আনা হয়।
১২৪. খ্রি. পূ. ৪০৪ অব্দে স্পার্টান সেনাপতি লাইসেন্ডার এথেন্সকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে।
১২৫. জেনোফোন তার Memoribilia গ্রন্থে ক্রিটিয়াসের সাথে সক্রেটিসের এই হাল্কা ঝগড়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
১২৬. প্লেটোর সুবৃহৎ Republic গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্র বা নগরের কল্পনা করেছেন, যেটিকে গ্রিক ভাষায় kallipolis বলে। প্লেটোর মতে সব ভালোর এই নগরকে চালাতে একজন সর্বগুণান্বিত দার্শনিক শাসকের প্রয়োজন হবে।
১২৭. প্লেটোর Ion নামে ডায়ালগে এটি বিস্তারিত লিখেছেন।
১২৮. প্লেটো তার Republic বইতে হোমারের লেখা নিয়ে সক্রেটিসের মুখে এই সমালোচনা উল্লেখ করেছেন।