৪৬
‘আমার জীবনের জন্য আমি মা-বাবার কাছে ঋণী,
আর সুন্দর জীবনের জন্য ঋণী শিক্ষকের কাছে।’
— আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট
***
আজ প্লেটোর জীবনের বিশেষ দিন।
তরুণ প্লেটো আজ সক্রেটিসের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। সে ছোটবেলা থেকেই সক্রেটিসের নাম শুনেছে। সক্রেটিস ভীষণ জ্ঞানী। মানুষ হিসেবেও খুবই অসাধারণ। প্লেটোর মামা ক্রিটিয়াস উঠতে বসতে সক্রেটিসের নাম করে। তিনি নাকি জীবন বদলে দেন। এক নিমিষে চক্ষু খুলে দেন। মজায় মজায় এমন কথা বলেন যে মধুর মতো লাগে। সেই কথায় যুক্তি আর জ্ঞান একেবারে ঝরে ঝরে পড়ে।
কিন্তু সক্রেটিসের ব্যাপারে প্লেটোর একটি খটকা আছে। সেটি হলো সক্রেটিস নাকি নাটক পছন্দ করেন না। তিনি শুধু ইউরিপিডিসের নাটক ছাড়া থিয়েটারে যান না। প্লেটো একজন লেখক। সে কবিতা, নাটক লেখে। সক্রেটিস নাটক পছন্দ করেন না শুনে প্লেটোর খারাপ লাগে। শুধু এই কারণেই সে সক্রেটিসের সামনে যায়নি। শুধু দূর থেকে আগোরায় দেখেছে।
মামা ক্রিটিয়াস প্লেটোকে সিমনের দোকানে নিয়ে যাচ্ছে। মামা বলেছে, সক্রেটিস তার শিক্ষক হবেন। সেজন্য প্লেটোর ভয় ভয় লাগছে। অজানা একটি আশঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
তাকে দেখেই সক্রেটিস বললেন, এই ছেলের কপাল এত চওড়া কেন? এ তো মাথা দিয়েই জগৎ কিনে ফেলবে।
প্লেটো চমকে উঠল। মনে হলো এমন মধুর স্বর সে জীবনে আর শোনেনি এথেন্সে সবাই তার প্রশংসা করে, ভালো ভালো কথা শুনে সে অভ্যস্ত। কিন্তু সক্রেটিস ছোট্ট করে যা বলল, তাতে সে যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল, মনে হলো কোথা থেকে একটি শক্তি আসছে তার মধ্যে। তার ভয় কেটে গেল।
সক্রেটিস অনেকের সাথে কথা বলে যাচ্ছেন। তার কাছে এক দল মানুষ যায়, আরেক দল আসে। কথার বিষয় বদলে যাচ্ছে। কিন্তু সক্রেটিসের রসালো যুক্তি বদলাচ্ছে না। তিনি প্রশ্ন করছেন, আর অন্যরা উত্তর করছে। একের পর এক প্রশ্ন চলছে, যে পারছে উত্তর দিচ্ছে। এক সময় সবাই মেনে নিচ্ছে যে, তারা যেটি বুঝতে চায়, সেটি বুঝতে পেরেছে। এটিই তাহলে সেই সক্রেটিস মেথড! প্রশ্ন করে করে কোনো জিনিসের একেবারে গভীরে চলে যাওয়া। সকলে সম্মিলিতভাবে নতুন কিছু বের করা। প্লেটো মুগ্ধ হয়ে শুনছে। ক্ষণে ক্ষণে টপিক বদলে যাচ্ছে।
সক্রেটিস বলছেন, মানুষ শব্দটার মানে একজন মানুষ নয়। মানুষ মানে অনেক মানুষের একত্র শক্তি। একা একা জ্ঞানী হয়ে লাভ নেই। একা কোনোদিন সুন্দর জীবন পাওয়া যাবে না। অনেকে একসাথে সুন্দর জীবন যাপন করলেই জীবন সুন্দর হবে। আর এই কারণেই আমি মানুষ খুঁজি। মানুষ না দেখলে আমি হাঁসফাঁস করি। শুধু মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে পারি।
একেবারে নতুন কথা। কেমন অদ্ভুত! প্লেটোর কেমন যেন লাগছে। সে একজন মহাপড়ুয়া মানুষ। গ্রিক ভাষায় কিছু লেখা হয়েছে আর প্লেটো পড়েনি, এমন কিছুই নেই। কিন্তু সক্রেটিস যা বলছেন, এমন কথা কোথাও লেখা নেই।
প্লেটো এথেন্সের সব নেতার বক্তৃতা শুনেছে। কিন্তু কারও মুখে এমন কথা শোনেনি। কেমন মিষ্টি করে বলছেন, ‘শুধু মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে পারি।’
সক্রেটিস বলে যাচ্ছেন, সুন্দর জীবনের জন্য সাধনা দরকার, চেষ্টা দরকার। জীবন এমনি এমনি সুন্দর হয় না।
যত শুনছে, তত অবাক হচ্ছে প্লেটো। আরও বেশি শুনতে ইচ্ছে করছে। প্লেটো তন্ময় হয়ে শুনছে।
একটু পরে সেখান এক ফেরিওয়ালা এলো। সক্রেটিস তার সাথে কথা বললেন। একটু আগে ছাত্রদের সাথে যেভাবে বলেছেন, ফেরিওয়ালার সাথেও একইভাবে বলছেন। যেন ফেরিওয়ালাও তার বন্ধু। ফেরিওয়ালা তার কথায় অনেক খুশি। এরপরে সেখানে এলো এক দাস। সক্রেটিস দাসের সাথেও একই স্বরে কথা বললেন। দাস তার কথায় হাসতে হাসতে চলে গেল। তিনি ছাত্র, ব্যবসায়ী, নেতা, দাস সবার সাথেই একইভাবে কথা বলছেন। কোনো পার্থক্য নেই।
প্লেটো ভাবছে, এ কেমন মানুষ! এর কাছে উঁচু-নিচু কোনো ভেদাভেদ নেই। ছোট-বড় সবাই সমান। মুচি আর সেনাপতি দুজনের সাথেই একইভাবে কথা বলেন। নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই। দাস আর মনিবকে একই রকম চোখে দেখেন। এরকম সাম্যবাদী মানুষ সে জীবনে দেখেনি। সে ভাবছে, সক্রেটিস যদি ভালো মানুষ হন, তাহলে সাম্যবাদ ব্যাপারটিও ভালো। জীবনে সাম্যবাদের চর্চা করা ভালো।
হঠাৎ সক্রেটিস বললেন, চলো আমরা বের হই। সিমনকে এক দিনে যতটুকু জ্বালানো দরকার, সেটি শেষ।
বলেই তিনি হাঁটা শুরু করলেন। তার পিছে পিছে ছুটল ছাত্ররা। প্লেটোও যোগ দিল সেই দলে। আগোরার রাস্তার পাশে তার ছাত্রদের নিয়ে বসে গেলেন। দর্শন আলাপ করছেন। কঠিন সব জ্ঞানের আলাপ হচ্ছে। হঠাৎ রাস্তায় ভুস করে বের হলো ঝাকানাকা সুন্দর একটি মেয়ে। এথেন্সের রাস্তায় কোনো মেয়ে আসতে পারে না। মেয়েদের ঘরের বাইরে আসা নিষেধ। এই মেয়েটি নিষিদ্ধ পল্লির। সেজন্য বাইরে আসতে পেরেছে। মেয়েটিকে দেখে সক্রেটিসের ছাত্ররা সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বাঁকিয়ে হাঁ করে রইল। একেবারে ‘পড়ে না চোখের পলক’ অবস্থা। এই ছেলেরা সারা মাসে একটিও মেয়ে দেখতে পায় না। হঠাৎ অপ্সরা ধরনের কাউকে দেখে পলক ফেলতে পারছে না।
ছেলেদের কাণ্ড দেখে মেয়েটি আহ্লাদে বাক-বাকুম। মেয়েটি সক্রেটিসকে চেনে। সক্রেটিসকে ছোট্ট একটু পিন দিয়ে মেয়েটি বলল, দেখুন, সক্রেটিস, আপনি তো বিরাট জ্ঞানী। কিন্তু আপনার চেয়ে আমার শক্তি অনেক বেশি। আমি চাইলে এক্ষুনি আপনার সব ছাত্রকে আঙুলের ইশারায় যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আপনি চাইলেও আমার কোনো অনুরাগীকে নিয়ে আসতে পারবেন না।
সক্রেটিস বললেন, কথা সত্য। এটির কারণ হচ্ছে তুমি ওদেরকে নিয়ে যাবে নিচের দিকে, আর আমি নিয়ে যাচ্ছি উপরের দিকে। নিচে নামা খুবই সহজ, কিন্তু উপরে ওঠার পথ সব সময়ই কঠিন। ভীষণ কঠিন
প্লেটোর খুবই মজা লাগল। সবার সাথে কথায়ই তিনি খোঁচা দিচ্ছেন। প্রতিটি বাক্যে খোঁচা আছে। কারও সাথে রাগ করছেন না। কিন্তু বুদ্ধি করে পিন দিচ্ছেন। এমন রসালো, বুদ্ধিদীপ্ত পিন প্লেটো আগে কখনো শোনেননি।
এই এক বিকেলে প্লেটোর জীবন পাল্টে যাচ্ছে। সে সব সময় নতুন কিছু খোঁজে। নতুন কিছু শেখার আশায় দেশ-বিদেশের জ্ঞানীদের কাছে গিয়ে তার ফালতু মনে হয়েছে। তারা যা বলে, প্লেটো নিজেই তার চেয়ে অনেক বেশি জানে। তার ধী-শক্তি অনেক তীক্ষ্ণ। কিন্তু এই প্রথম মনে হচ্ছে, কোনো মানুষ তাকে শেখাতে পারেন। নতুন যদি কিছু জানার থাকে, তো সেটি বলতে পারেন এই সক্রেটিস। এত দিন কেন আসেনি সক্রেটিসের কাছে? অনেক সময় বৃথা নষ্ট হয়েছে।
এথেন্সে গণতন্ত্রে সবাই কথার রাজা। কিন্তু গণতন্ত্রের নেতাদের কথা বোমার মতো। শব্দ দিকে দিকে ছড়িয়ে যায়। ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে যায়। সেখানে একজন বলে, সবাই শোনে। কিন্তু সক্রেটিসের কথা বোমা নয়, তার কথা মিষ্টি সংলাপ। তার প্রতিটি বাক্যে খোঁচা আছে। তিনি কথা একা বলেন না, অন্যদের দিয়ে বলান।
প্লেটো ভাবছে, সক্রেটিস একজন জ্ঞান ভিখারি। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে জ্ঞান ভিক্ষা করে বেড়ান। নাকি জ্ঞানের ফেরিওয়ালা, জনে জনে জ্ঞান বিলি করেন? এ কার সাথে তার দেখা হলো! তার মনে হলো, এই লোক তাকে টানছে, কেমন একটি আবেশের মতো টানছে। কাল আবার আসতে হবে সিমনের দোকানে। প্লেটো সক্রেটিফাইড হয়ে গেল।
হঠাৎ সক্রেটিস প্লেটোকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি শুধু শোননেওয়ালা? কিছুই বলবে না?
প্রশ্নের জন্য প্লেটো প্রস্তুত ছিল না। কী বলবে সে? অমন হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলে কিছু উত্তর করা যায়? তার জিভের ডগায় যা এলো দুম করে সেটিই জিজ্ঞেস করল, আপনি কিছু লিখেন না কেন?
সক্রেটিস হেসে বললেন, এথেন্সে পেপিরাস কাগজের অনেক দাম। এত টাকা আমার নেই। পেপিরাস কিনতে পারি না বলে আমি কিছু লিখি না।
প্লেটো এমন তন্ময় হয়ে ছিল, সক্রেটিস যে মজা করছেন, সেটি বুঝতেই পারল না। সে ঝোলার ভেতর থেকে এক গোছা পেপিরাস বের করে সক্রেটিসের হাতে দিয়ে বলল, এই নিন। এখন থেকে আপনি লিখবেন। যত পেপিরাস লাগে, আমি দেব।
হো হো করে উঠলেন সক্রেটিস। ক্রিতোও হাসছেন।
সক্রেটিস বললেন, দেখো ক্রিতো, দেখো। এতদিন তো আমার বিপদে শুধু তুমিই এগিয়ে আসতে। এখন থেকে আর একজন পেলাম। আমার কাছ থেকে লেখা বের করার জন্য ও নিজের সব পেপিরাস দিয়ে দিচ্ছে।
ক্রিতো বললেন, প্লেটো তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। ওর চোখের দিকে তাকাও। ঐ চোখে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা উপচে পড়ছে।
যারা সক্রেটিসকে ভালোবাসে, তারা পাগলের মতো ভালোবাসে। আর যারা ঘৃণা করে, তারা তীব্র শত্রুর মতো ঘৃণা করে।
গুরুগম্ভীর পরিবেশ বেশিক্ষণ ভালো লাগে না সক্রেটিসের। তিনি প্লেটোকে বললেন, ওরে ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেন না। তিনি আমাকে একখান মুখের মতো মুখ দিয়েছেন। সেই মুখে আমি কথা বলি। ঈশ্বর আমাকে লেখার জন্য সেরকম হাত দেননি। সেই হাত তোমাকে দিয়েছে। তুমি লিখতে পার। তুমি লেখা শুরু কর।
***
প্লেটো সেই যে সক্রেটিসের পিছু ধরেছে, আর ছাড়তে পারেনি। এখন প্রতিদিন সকালে উঠে তার একটিই রুটিন। সেটি হলো সক্রেটিসকে খুঁজে বের করা। কেন যে সক্রেটিসের সাথে সময় কাটাতে তার এত ভালো লাগে, সে জানে না। প্লেটো এথেন্সের সবচেয়ে যুক্তিবাদী ছেলে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছুর কারণ বের করে। অথচ এই কারণটি বের করতে পারছে না! একটি অতি সহজ কারণ হলো : সক্রেটিস সবার মতো নন, তিনি অন্যরকম; তিনি হাবেভাবে খুবই সহজ; কিন্তু আসলে রহস্যময়, তাকে বোঝা যায় না। সেজন্য ছেলেরা তার পিছে পিছে ঘোরে।
কিন্তু এই কারণ প্লেটো বিশ্বাস করে না। হাবভাব অন্যরকম বলেই তার মতো ছেলে একজনের পিছে পিছে ঘুরবে, এটি হতে পারে না। অন্য কিছু একটা আছে। সেই কিছুটা যে কী, প্লেটো এখনও বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু সত্যি হলো, প্লেটো সক্রেটিসের পেছনে ঘুরছে। এথেন্সের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ণ ধীশক্তির অধিকারী ছেলেটিও সক্রেটিসের চ্যালা হয়ে গেছে।
প্লেটো এখন সক্রেটিসের সাথে উদ্ভট উদ্ভট জায়গায় যায়। এমন এমন জায়গা যেখানে আগে সে কখনো যায়নি। যেমন এই মুহূর্তে তারা একটি অন্যরকম জিমনেশিয়ামে এসেছে। এসেই প্লেটোর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
এটি ভদ্রলোকের জিম নয়। যেসব ছেলের বাবার পরিচয় নেই অথবা বাবা তার মাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাদের জন্য এথেন্সের সরকার এই জিম’[১১৪] বানিয়ে দিয়েছে। এখানে শুধু সমাজের একেবারে নিচুতলার ছেলেরা আসে। আর প্লেটো এথেন্সের সবচেয়ে উঁচু তলার মানুষ। সে ভদ্রলোকের জিমে যায়, এথেন্সের সবচেয়ে ধনীদের জন্য যেসব জিম, সেগুলোতেই প্লেটো ব্যায়াম করে। সেখানে জ্ঞানের আলাপ হয়। হোমার, সফোক্লিসদের বই নিয়ে কথা হয়, সেখানে সবাই প্লেটোকে হোমারের সাথে তুলনা করে। ব্যায়াম শিক্ষক তাকে নিয়ে গর্ব করেন। সেখানে সে হিরো। আর এখানে তেমন কেউ তাকে চেনে না। এখানে কি জ্ঞানের কোনো আলাপ হবে? কতগুলো অজ্ঞাতকূলশীল, অশিক্ষিত ছেলে খেলাধুলা করছে। সক্রেটিস কেন যে এখানে এসেছেন, প্লেটো বুঝতে পারছে না। দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটি এই অশিক্ষিত, ন্যাংটা জন্মপরিচয়হীনদের মাঝে এসে বসে আছেন, ভাবতেই তার মাথা ধরে যাচ্ছে।
গ্রিসে শরীরচর্চা খুবই জরুরি বিষয়। এখানে প্রতিটি ছেলেকে যুদ্ধ করতে হয়। অনেকেই অলিম্পিকে অংশ নেয়। তাই শরীর ভীষণ দরকারি জিনিস। ছেলেরা দিনের অনেকটা সময় জিমনেশিয়ামে কাটায়। গ্রিক শব্দ জিমনোস থেকে এসেছে জিমনেশিয়াম। জিমনোস মানে ন্যাংটা। তাই যেখানে ন্যাংটা হয়ে খেলাধুলা করা হয়, সেই জায়গার নাম জিমনেশিয়াম। এখানে ছেলেরা ন্যাংটা হয়েই শরীরচর্চা করে। জিমনেশিয়াম মানে খোলা আকাশের নিচে ঘাস বিছানো অনেক বড় প্রান্তর।
সেই ঘাসে বসে সক্রেটিস নিচুতলার ছেলেদের সাথে খোশগল্প করছেন। গল্পে গল্পে চলছে সক্রেটিস মেথডে প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা। দুষ্টু-মিষ্টি আলাপ। প্লেটো কিছুই বলছে না, মাথা নিচু করে শুনছে। সে বিন্দু বিন্দু ঘামছে। তার ঘামকে বলা যায় ‘মন খারাপের ঘাম’। আগামীকাল থেকে সে আর সক্রেটিসের কাছে আসবে না। দুপুর রোদে এমন অ-জায়গায় কু-জায়গায় যাওয়ার জন্য তার জন্ম হয়নি।
এর ফাঁকে আধান্যাংটা ছেলেরা আলাপ শুরু করেছে। আলাপের বিষয়, তরুণরা কেন সক্রেটিসকে ভালোবাসে? একেকজন একেক উত্তর দিচ্ছে। ভালো ভালো উত্তরই আসছে। প্লেটোর মাথায়ও উত্তর এসেছে, কিন্তু এই ন্যাংটা মূর্খদের মাঝে কিছুই বলবে না। হঠাৎ পেছন ভেসে এলো একটি স্বর,
‘সক্রেটিসকে ভালোবাসার কারণ : সক্রেটিস দেখতে কদাকার কিন্তু মনটা বিশাল, তিনি জুতা পরেন না, তাই তার পা কাদায় ভরা; তিনি যেখানে যান কাদামাখা পায়ের চিহ্ন পড়ে থাকে, সেই চিহ্নটি অনুসরণ করতে পারলে পাওয়া যায় সুন্দর জীবন।’
সবাই চমকে পেছনে তাকাল। সবচেয়ে বেশি চমকে গেছে প্লেটো। এমন জায়গায় এমন মিষ্টি আর সুন্দর কথা কেউ বলতে পারে, সেটি সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে উঠে দেখতে গেল কথাটি কে বলল। দেখে আরও অবাক! যে বলেছে সে শুধু জন্মপরিচয়হীন নয়, সে আরও নিচুতলার মানুষ। সে একজন দাস। তার মাথা ন্যাড়া। দাসটির বয়স অল্প, প্লেটোর চেয়েও ছোট হবে। ছেলেটি মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দাসদের কোনো ভদ্রসমাজে কথা বলার নিয়ম নেই। তাই সে ভয়ে কাঁপছে।
সক্রেটিস হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি বালক?
ছেলেটি উত্তর দিল, আমি একজন দাস। আমার নাম ফিদো’[১১৫]। বাড়ি এলিস নগরে, যেখানে অলিম্পিক প্রতিযোগিতা হয় সেখানে।
‘তুমি দাস হলে কীভাবে?’
‘খুবই সহজ উপায়ে। আমাদের নগর যুদ্ধে হেরে গেলে বিজয়ীরা আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলে আর আমাকে দাস বাজারে বিক্রি করে দেয়। আমাকে যে কিনেছে, সে নিয়ে এসেছে এথেন্সের কেরামেকাসে।’
‘কেরামেকাসে!’ চমকে উঠলেন সক্রেটিস। কেরামেকাস মানে এথেন্সের ভয়ংকর নিষিদ্ধ পল্লি। সেখানে তরুণ ছেলেদেরও রাখা হচ্ছে! ছেলেটি কী সাংঘাতিক জীবন যাপন করছে! কেরামেকাসের নাম শুনেই সক্রেটিসের মনে পড়ল আসপাশিয়ার কথা। সেই মেয়েটিও কেরামেকাসে ছিল। আসপাশিয়াকে বাঁচিয়েছিলেন পেরিক্লিস। এখন এই ফিদোকে বাঁচাবে কে? কিছুক্ষণ আলাপ করেই সক্রেটিস বুঝলেন, ছেলেটি জ্ঞানী। মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর কথা বলে। সাহসও আছে। সক্রেটিস ছেলেটিকে পছন্দ করেছেন। তিনি তাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করবেন। কিন্তু তার টাকা নেই। টাকা দেবেন অন্য কেউ।’
.
দুদিন পরে খুব সকালে ফিদোর মালিক তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। ফিদো বের হয়ে দেখে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন সক্রেটিস ও প্লেটো। আর ক্রিতো গুণে গুণে অনেকগুলো টাকা দিচ্ছেন ফিদোর মালিককে I
ঘটনাটি ফিদোর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। সে চিমটি কেটে দেখছে ঘটনা সত্য কিনা। বিশ মিনা পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাকে মালিকের কাছ থেকে কিনেছেন ক্রিতো। সক্রেটিস যে সত্যি সত্যি তাকে মুক্ত করে ফেলবেন, সে বিশ্বাস করেনি। সে ভেবেছে, মানুষ তো কত কথাই বলে। সকালে বলে, বিকেলে ভুলে যায়। তার উপর সক্রেটিস হলেন বাচাল শ্রেণির লোক। এরা সারাদিন কথা বলেন। কাজ- কর্ম করেন না। তারা যে সত্যিই তাকে গোলামি থেকে বাঁচাবেন, এত বড় আশা সে করেনি।
ক্রিতো তাকে কিনেছেন। হিসাব মতো এখন থেকে ফিদো ক্রিতোর দাস। সে ক্রিতোকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে যাচ্ছে।
ক্রিতো তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তুমি এই মুক্ত আকাশের নিচে মুক্ত মানুষ। আমি শুধু টাকা দিয়েছি, আসল লোক তো সক্রেটিস। যাও, ঐ বুড়োকে ধরে আনন্দ করো।
কিন্তু আনন্দ করতে গিয়ে ফিদো কেঁদে ফেলল। গত কয়েক বছর সে দেখেছে মানুষ কত খারাপ হতে পারে। কত নিষ্ঠুর হতে পারে। তার নগর যুদ্ধে হেরে গেলে তাকে বন্দি করে ফেলে শত্রুরা। মাথা ন্যাড়া করে এথেন্সে দাস বাজারে বেচে দেয়। শুরু হয় তার গোলামি জীবন। তখন তার বয়স তেরো। গত চার বছর ধরে এমন কোনো কষ্ট নেই যেটি সে করেনি। সে যে একজন মানুষ, সেটিই ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছিল। গোলামি যে কোনোদিন শেষ হবে, ভাবতেও পারেনি। তার মনে হতো মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো জীব পৃথিবীতে নেই।
আজ সক্রেটিস আর ক্রিতোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের মতো ভালো প্রাণী আর নেই। ছোটবেলায় ভালো মানুষের কথা সে বইতে পড়েছে। সেরকম ভালো মানুষ দু’একজন এখনও পৃথিবীতে আছেন।
ফিদো কাঁদছে। দুই প্রবীণকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সক্রেটিস তার মুক্তিদাতা আর ক্রিতো হলেন মুক্তির জন্য অর্থদাতা। দুজনকে ধরে সে অঝোরে কাঁদছে। ক্রিতো তার কান্না থামাতে চাচ্ছেন। সক্রেটিস নিষেধ করলেন। ফিদো কাঁদুক। মুক্তির আনন্দে কাঁদুক। নতুন জীবনের জন্য কাঁদুক। কিছু আনন্দের উদযাপন কান্না ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না।
ফিদো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, আমি জীবনে কোনোদিন এই ঋণ শোধ করতে পারব না।
সক্রেটিস হাসতে হাসতে বললেন, ঋণ-টিন কিচ্ছু নয়। তোমাকে ছাড়িয়ে নিলাম কারণ তুমি একজন জ্ঞান-প্রেমী। অন্য কোনো কারণে নয়। এথেন্সে হাজার হাজার দাস আছে। আমি কি অন্যদের মুক্ত করতে গিয়েছি? সেই সাধ্য আমার নেই। তোমার বুদ্ধি-বিবেচনা দেখে তোমাকে ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে এই ছেলেটি দাস হয়ে থাকার জন্য জন্মায়নি। সুন্দর জীবনের অধিকার ওর আছে।
ফিদো ভাবছে, এথেন্সে তো কত মানুষ। কত ধনী, কত নেতা। অন্য কেউ তো এগিয়ে আসেনি। এই দুই পাগলা বুড়োই তাকে গোলামি থেকে বাঁচালেন। এই বুড়োরা অন্য রকম। এথেন্সের মানুষ এদের সত্যিকার পরিচয় জানে না।
ক্রিতো বললেন, তোমার তো থাকার একটি জায়গা লাগবে। তুমি চাইলে আমার বাড়ি থাকতে পার।
সক্রেটিস বললেন, তাতে একটি সমস্যা আছে, ক্রিতো। তুমি ওকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছ। এখন তোমার বাড়িতে থাকলে ও নিজেকে তোমার দাসই ভাববে। মুক্তির স্বাদ পেতে ওকে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। ক্রিতো বললেন, ঠিক আছে। তাহলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
প্লেটো বলল, আপনাদের আপত্তি না থাকলে ফিদো আমার বাড়িতে থাকতে পারে। সে আমাকে পছন্দ করে।
সক্রেটিস ফিদোর দিকে তাকালেন। তার চোখে সম্মতি।
সক্রেটিস ফিদোকে বললেন, তলে তলে প্লেটোকেও বন্ধু করে ফেলেছো? তুমি তো মহাচালবাজ। তোমাকে দিয়ে হবে। যাও, প্লেটোর বাড়িতেই ওঠো। সে কিন্তু বিশাল চিন্তাবিদ। তার সাথে যা করবে, বুঝে শুনে করবে।
ফিদো বলল, জি, আচ্ছা।
সক্রেটিস বললেন, এসব জি হুজুর, জি আচ্ছা এগুলো বাদ দাও। তুমি এখন মুক্ত মানুষ। চালচলনে একটি মুক্তি মুক্তি ভাব আনো। আর একবারও ‘জি আচ্ছা’ বলবে না।
ফিদো ঘাড় বাঁকা করে আবার বলল, জি আচ্ছা।
চারজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
সক্রেটিস বললেন, শোনো, পুরনো বোল-চাল বাদ দাও। নতুন সাজসজ্জা করো। নতুন জীবন, নতুন সাজ। এতদিন ছিলে দাস, ওরা তোমার মাথা ন্যাড়া করে দিত। এখন থেকে লম্বা চুল রাখবে। মাঝে মাঝে চুলে হাত দিয়ে বলবে এটি আমার নতুন জীবন, আমার সুন্দর জীবন।
ফিদো ঠিক করল, আজ থেকে তার জীবনের আদর্শ হলো সক্রেটিস। সক্রেটিসের সুন্দর জীবনের তত্ত্বকে সে তার জীবনে প্রয়োগ করবে। তিনি যেভাবে বলেন, সেভাবেই জীবন যাপন করবে। এই মুহূর্ত থেকে ফিদো সক্রেটিসের ছায়াসঙ্গী। ছায়ার মতো অনুসরণ করবে সারা জীবন।
***
১১৪. এথেন্স দেয়ালের বাইরে এলসাস নদীর তীরে অবৈধ সন্তানদের জন্য এই সরকারি জিমের নাম Kznosarges.
১১৫. ফিদো (Phaedo): সক্রেটিসের শিষ্য এবং পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত দার্শনিক। তিনি প্লেটোর সমবয়সী বলে ধারণা করা হয়। সক্রেটিস তাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন। তার মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত ফিদো তার সাথে ছিলেন। সক্রেটিসের মৃতদৃশ্যের বর্ণনা করে প্লেটো যে ডায়ালগ লেখেন, সেটির নাম Phaedo সক্রেটিসের মৃত্যুর পরে তিনি Elis নগরে Elean School of Philosophy প্রতিষ্ঠা করেন।