1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৪৫

৪৫

‘তোমার সাথে যেটি করলে তুমি কষ্ট পাও,
সেটি কোনোদিন অন্যের সাথে কোরো না।’

—সক্রেটিস

***

সাগর তীরে বসে ইউরিপিডিস কষ্ট উদযাপন করছেন।

তার কষ্ট উদযাপনের তরিকা আলাদা। কষ্ট পেলে তিনি সাগরের কাছে আসেন, চোখ বুজে সাগর দেখেন। নীল সাগরের নীল জলে কষ্ট ভিজিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। তিনি লেখক। লেখকদের সমস্যা হলো, কষ্ট পেলে সেটি কলমে আনতে চান। কলমে আনতে হলে কষ্টটা একেবারে নিজের করে অনুভব করতে হয়, অন্যের কষ্টে নিজেকে বসিয়ে নীরবে কাঁদতে হয়। ইউরিপিডিস সেটি করেন সাগরের কাছে এসে। চোখ বন্ধ করে সাগরের কান্নার সাথে নিজে কাঁদেন।

তার আজকের কষ্ট ব্যক্তিগত নয়, এথেন্সের নির্মমতায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন। আলোর নগরী এথেন্স এমন মায়াহীন হতে পারল! এমন কাজ করতে পারল? পনেরো বছর ধরে এথেন্স আর স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এথেন্সের পক্ষের দ্বীপগুলোকে আক্রমণ করে স্পার্টা, আবার স্পার্টার মিত্র দ্বীপকে দখল করে এথেন্স। এভাবেই চলছে। যুদ্ধ সব সময়ই ভয়ংকর। তবে মাঝে মাঝে তা হয়ে ওঠে একেবারেই অমানবিক। কয়েকদিন আগে এথেন্সের নৌবাহিনী স্পার্টার মিত্র দ্বীপ মিলোস[১১১] দখল করেছে। কিন্তু মিলোস দ্বীপের নেতারা ভীষণ ত্যাড়া, তারা আত্মসমর্পণ করবে না। তখন এথেন্স দ্বীপটির সব পুরুষকে হত্যা করল, নারী ও শিশুদের বিক্রি করে দিল দাস বাজারে।

এই ভয়াবহ ঘটনা মানবতাবাদী নাট্যকার ইউরিপিডিসকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তিনি মর্মাহত হলেন, কিছুতেই মানতে পারছেন না। কিন্তু কী করবেন তিনি! তিনি নেতা নন, তার অস্ত্র নেই। তিনি লেখক মাত্র, তার দৌড় কলম পর্যন্ত। লেখা ছাড়া কিছু করার ক্ষমতা নেই। তিনি ঠিক করলেন, তিনি লিখবেন। যুদ্ধ বিরোধী নাটক লিখবেন।

তিনি গত বছরই একটি নাটক শুরু করেছেন। নাটকটির প্লট ট্রয়ের যুদ্ধ। গ্রিকরা ট্রয়কে হারানোর পরে সেখানের হতভাগ্য মেয়েদের ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে একটি যুদ্ধবিরোধী নাটক লেখার ইচ্ছা তার অনেক দিনের। এখন সঠিক সময়। এখন সবাই মিলোস দ্বীপের ঘটনায় মর্মাহত। এখন নাটকটি শেষ করবেন। এই নাটকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন, যুদ্ধ কত জঘন্য বিষয়। তিনি নাটকের নাম দিলেন ‘ট্রয়ের নারীরা’[১১২]।

সালামিনা দ্বীপে গুহায় বসে তিনি কাহিনি বানাচ্ছেন। জেতার পরে গ্রিকরা ট্রয় পুড়িয়ে দিয়েছে, সকল পুরুষকে মেরে ফেলেছে। এখন নারীদের ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে গ্রিসের যোদ্ধাদের মাঝে। এক-একজন গ্রিক পুরুষ বেছে নিচ্ছে ট্রয়ের নারীদের। সেই করুণ হতভাগ্য নারীদের নিয়ে প্লট সাজালেন। নাটকের চরিত্র : হেলেন, ট্রয়ের রানি হেকুবা, রাজকন্যা কাসান্দ্রা, হেক্টরের স্ত্রী।

যুদ্ধ বিরোধী এমন কাজ গ্রিসে আগে কেউ করেনি। ইউরিপিডিস সব সময়ই নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লেখেন। প্রতিবার লেখার পর লাফ দিয়ে ওঠেন, মনে হয় এমন চমৎকার জিনিস আগে কেউ করেননি। এবারও তিনি ভীষণ খুশি। চমৎকার হয়েছে। এই বছর তিনি অবশ্যই প্রথম হবেন। কারণ এবার সফোক্লিস কোনো নাটক লেখেননি। সফোক্লিস থাকলে, বিচারকরা ইউরিপিডিসকে হিসাবেই ধরেন না। তাই সফোক্লিস না থাকায় এবার তার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

কিন্তু ইউরিপিডিস জানেন না যে, তিনি যে কাহিনিটি নিয়েছেন সেটি মানবতার বিবেচনায় মর্মস্পর্শী, কিন্তু গ্রিকরা কি সেই বেদনায় সাড়া দেবে? পরাজিত নগর ট্রয়ের নারীদের গ্রিকরা ভাগ করে নিচ্ছে লুটের মাল হিসেবে। সেই নারীদের বেদনা কি গ্রিকদের ছুঁতে পারবে? এথেন্সের থিয়েটারে যখন গ্রিক দর্শক দেখবে, তাদের বীরেরা ট্রয়ের মেয়েদের ওপর অত্যাচার করছে, সেটি কি তাদের ভালো লাগবে? ইউরিপিডিসের মানবতার মধুর কথায় গ্রিকরা কি নিজেদের পূর্বপুরুষদের অন্যায়কে স্বীকার করতে শিখবে? এতটা উন্নত মনের কি এখনও হতে পেরেছে মানুষ? তারা কি সক্রেটিসের মতো বলতে পারবে, খারাপ সবার জন্যই খারাপ? অন্যায় গ্রিকরা করলেও, সেটি অন্যায়ই।

সালামিনা দ্বীপের গুহায় নাটকটি লেখা শেষ করে এথেন্সে ফিরলেন ইউরিপিডিস। বসন্ত উৎসবে মঞ্চস্থ হবে।

থিয়েটারে নাটক চলছে :

ট্রয় নগর পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রিকরা। ট্রয়ের সব সমাধি, সব মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। গ্রিকদের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত সাগরের দেবতা পোসাইডন। প্রথমেই পোসাইডন মঞ্চে এসে বলছেন, ‘যে মানুষ নগর পোড়ায়, মন্দির আর সমাধি ধ্বংস করে, তার মতো হটকারী আর কেউ নেই। সে নিজের ধ্বংস ডেকে আনছে। আমি শাস্তি দেব, কঠিন শাস্তি।’

ট্রয়ের রানি হেকুবা বিলাপ করছে। সে ছিল রানি, হয়ে যাচ্ছে দাসী। তাকে নিচ্ছে গ্রিক বীর অডিসিয়াস। তার মেয়ে ট্রয়ের রাজকন্যা কাসান্দ্রা যাবে রাজা আগামেমননের ঘরে। মা-মেয়ে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে মা বলছে অতি পরিচিত সংলাপ, ‘একজন মানুষ যতই ধনী হোক না কেন, মৃত্যুর আগে তাকে সুখী বলা যাবে না।’ সংলাপটি আইনপ্রণেতা সলোনের। প্রায় একশ বছর আগে সলোন এটি বলেছিলেন। এই সংলাপ এথেন্সের সবাই জানে। হেরোডোটাস তার বক্তৃতায়ও এটি বলেছিলেন। এটি গ্রিক ট্র্যাজেডির একটি বৈশিষ্ট্যবাহী সংলাপ।

এরপর মঞ্চে এলো ছলনাময়ী সুন্দরী হেলেন, যার জন্য ট্রয়ের যুদ্ধ হয়েছে। হেলেনও কাঁদছে। কিন্তু তার কান্নায় কেউ কষ্ট পাচ্ছে না। ট্রয়ের রানি হেলেনের স্বামীকে বলছে, ‘হত্যা কর, হেলেনকে হত্যা কর, আর সব নারীর জন্য এই নিয়ম লিখে দাও, যে নারী তার স্বামীর সাথে প্রতারণা করবে, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর যদি হত্যা না করো, যদি তুমি হেলেনকে গ্রিসে নিয়ে যাও, তবে তার সাথে এক জাহাজে যেও না। ও ছলনাময়ী। ও একবার ধরলে আর ছুটতে পারবে না।’

ইউরিপিডিসের নাটক মানেই থিয়েটারে সক্রেটিস আছেন। তিনি ভাবছেন, ট্র্যাজেডিতে মৃত্যু দরকার, চরম অধঃপতন দরকার হয়। এই নাটকে সেটি কোথায়? সারা ট্রয়ের ট্র্যাজেডি নিয়েই তো নাটক। তাহলে নতুন করে আর মৃত্যু বা চরম পরিণতির কী দরকার? ট্রয়ের মেয়েরা কাঁদছে, তাদের সাথে দর্শকরা কাঁদছে। নাটক জুড়ে শুধু কান্না। এটি ভালো। মানুষ থিয়েটারে বসে কাঁদলেই নাটক সাৰ্থক হয়।

আজ সক্রেটিস জেনথিপিকে নিয়ে এসেছেন। জেনথিপি নাটক দেখছেন আর কাঁদছেন। ট্রয়ের রানি হেকুবার দুঃখে তার গাল ভেসে যাচ্ছে। এরপর যখন হেক্টরের স্ত্রীর কাছ থেকে তার কোলের ছেলেকে কেড়ে নিচ্ছে গ্রিসের সেনারা, সেই দৃশ্য দেখে জেনথিপি চিৎকার করে কাঁদছেন।

নাটকে হেক্টরের স্ত্রী তার শিশু পুত্রকে বলছে—

‘আয় রে সোনা, চাঁদের কণা, তোরে শেষ-চুমো দেই,
আঁচল টানিস না, অসহায় মা, কিছুই করার নেই
ওরা তোকে নেবে কেড়ে, জোর করে, ঐ হত্যাপুরীতে
আসবে না পিতা তোর বীর হেক্টর কবর হতে বর্শা হাতে
হে গ্রিক, বলো, কে বানাল নিয়ম এমন বর্বর নিষ্ঠুর
জিতেছ, তাই নিতে হবে প্রাণ নিষ্পাপ দুধের শিশুর?’[১১৩]

পাঁচদিন নাটক হওয়ার পরে পুরস্কার ঘোষণা হলো ইউরিপিডিস দ্বিতীয় হয়েছেন। প্রথম হয়েছেন জেনোক্লিস নামের নতুন এক নাট্যকার।

ইউরিপিডিস স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এথেন্সের বিচারকদের খুশি করতে আর কী দরকার সেটি তার জানা নেই। সকলেই অবাক। সবাই ধরে নিয়েছিল, এবার ইউরিপিডিস নিঃসন্দেহে প্রথম হবে। কিন্তু হলো না।

ইউরিপিডিসের কাঁধে হাত রেখে সক্রেটিস বললেন, ব্যাপার নয়। তোমার নাটক দেখে বিচারকরা কাঁদতে কাঁদতে নম্বর দিতে ভুলে গেছে। বাদ দাও, তুমি সুন্দর নাটক করেছ, সেটিই আসল কথা। পুরস্কার যারা দেয়, তারা তাদের যোগ্যতা দিয়ে বিচার করে।

চেরোফোন পাশে ছিলেন। তিনি বললেন, এথেন্সে নাটক হলে ইউরিপিডিসকে হারতে হবে, এটিই নিয়ম। বিচারকরা এই নিয়ম মানেন। কে প্রথম হলো, সেটি কোনো ব্যাপার নয়। ইউরিপিডিস প্রথম হয়নি, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

তারা কেউ জানেন না, কেন ইউরিপিডিস প্রথম হতে পারেন না। যে কারণে মানুষ সক্রেটিসকে পছন্দ করে না, সেই একই কারণে ইউরিপিডিস কোনোদিন প্রথম হন না। তারা যুগের চেয়ে এগোনো মানুষ। তাদের চিন্তাকে ধারণ করার ক্ষমতা এখনও এথেন্সের মানুষের হয়নি। সক্রেটিস নতুন নতুন কথা বলেন, পুরনো মতবাদকে প্রশ্ন করতে বলে, তাই তার অনেক শত্রু। একইভাবে ইউরিপিডিসও মঞ্চে নতুন নতুন কথা বলেন। তার নাটকের কাহিনি গতানুগতিক নয়, তিনি নাটকে পুরনো ধারণা বাদ দিয়ে নতুন ধারণার জন্ম দেন। তিনি সফোক্লিসের মতো মানুষ যা পছন্দ করে, শুধু সেই কাহিনি নিয়ে নাটক বানান না; তিনি বিপ্লবী, তিনি সমাজ বদলের নাটক লেখেন। গ্রিকরা খারাপ কিছু করলে, তিনি নাটকে সেটিকে অন্যায় বলেই দেখান। মানুষের মন- রাখা কথা তার নাটকে নেই। তার নাটককে গ্রহণ করার মন এথেন্সের মানুষের এখনও হয়নি। তাই তার অনেক শত্রু। এই শত্রুরা অনেক ক্ষমতাবান, এরাই নাটকের বিচারক। তাই তিনি কোনোদিন প্রথম হন না, হতে পারবেনও না।

***

১১১. এজিয়ান সাগরে সান্তোরিনি দ্বীপের পাশে মিলোস (Milos) দ্বীপ। এই সাগরে ভূমিকম্পে সাইকেল বা চক্রাকারে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো দ্বীপ, যেগুলোকে বলে সাইক্লাডিস (Cyclades) দ্বীপ। এগুলোর একটির নাম মিলোস। এটি এথেন্সের কাছে, দূরত্ব মাত্র ১১০ কিলোমিটার; কিন্তু পেলোপোনেসিস যুদ্ধে তারা স্পার্টার পক্ষে যোগ দিয়েছিল। সেজন্য এথেন্স খ্রিস্টপূর্ব ৪১৬ অব্দে দ্বীপটিকে আক্রমণ করে এবং ভয়াবহ গণহত্যা চালায়।

১১২. ‘ট্রয়ের নারীরা’ (The Trojan Women) ইউরিপিডিসের বিখ্যাত যুদ্ধ-বিরোধী ট্র্যাজেডি। নাটকটির গ্রিক নাম Troades, এটি খ্রিস্টপূর্ব ৪১৫ অব্দে প্রথম রচিত হয়।

১১৩. ইউরিপিডিসের The Trojan Women ট্র্যাজেডিটির D.A. Svarlien কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমি সংলাপের বাংলা করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *