1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৪৩

৪৩

‘আমাদের শোনার জন্য দুটি কান,
বলার জন্য একটি মুখ দেওয়া হয়েছে,
তাই আমরা বলব কম, শুনব বেশি।’

—জেনো

***

একটি ছেলে কথায় কথায় চুটকি বলে।

ছেলেটির নাম এরিস্টোফানিস[১০৩]। এক্রোপোলিসের খুব কাছেই তার বাড়ি।

গণতন্ত্রে মানুষ কথা বলতে পারে। মত প্রকাশ করতে পারে। যা ইচ্ছা বলা যায়। কেউ বাধা দেয় না। যে কারও নামে যে কোনো মজা করা যায়। কেউ রাগ করতে পারে না। হাসি-ঠাট্টা গণতন্ত্রের নাগরিক অধিকার।

সেজন্য এথেন্সের তরুণরা সব সময় হাসি-ঠাট্টা করে। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। ধনীর দুলালরা মাস্টার রেখে বক্তৃতা দেওয়া শেখে, কিন্তু স্কুলের বয়স শেষ হয়ে গেলে দেখে, তাদের বক্তৃতা দেওয়ার জায়গা নেই, অন্য কোনো কাজও নেই। সবার বাড়িতে দাস-দাসী আছে। নিজের কিছুই করতে হয় না। শুধু যুদ্ধ লাগলে সরকার থেকে ডাক পড়ে। বাকি সময় বসে বসে গলির মুখে আড্ডা মারা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। এই অফুরন্ত সময়ে তাদের কিছু একটা তো করতে হবে।

তাই সমবয়সীরা একত্র হলে তারা অশ্লীল কৌতুকের ঝাঁপি খুলে বসে। কিন্তু ঐসব কৌতুক তো আর সবার সামনে করা যায় না। সবার সামনে মজা করার জন্য তারা এথেন্সের নেতাদের নিয়ে চুটকি বানায়। বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে ছড়া বানায়। এটি এখন এথেন্সের সংস্কৃতির অংশ।

কৌতুক, ছড়া, চুটকি সবকিছুতেই এরিস্টোফানিস সবচেয়ে পাকা। ছেলেটির বয়স মাত্র বিশ বছর। কিন্তু একেবারে ঝুনা নারকেল। সারাদিন যা তা নিয়ে পিন মারতে থাকে। পিনমারা কথার বেশিরভাগই অশ্লীল। কিন্তু মুখে মিঠা ভরা। অশ্লীল হলেও রাগ করা যায় না, হাসি পায়। পাহাড়ের নিচে রকের উপর বসে থাকে, কিন্তু রকবাজি করে না, যেটি করে সেটিকে ফস্কেমি বলা যায়। ছোটবেলা থেকেই সে পড়াশুনায় একেবারে এক নম্বর, প্রখর স্মরণশক্তি কিন্তু দোষ ঐ একটিই— বেহুদা চুটকি বলে।

এই রকম অশ্লীল রসিকতা করে দেখে বুড়োরা তার কাছে বেশি আসে না। জ্ঞানীরা তাকে এড়িয়ে যায়। একদিন এক সদয় জ্ঞানী লোক তাকে বলল, তুমি তো ভীষণ মজার মজার কথা বলো। এক কাজ করো। এভাবে ঘাটে-পথে ফস্কেমি না করে, এগুলো লিখে ফেলো। তোমার ভেতরে জিনিস আছে, কলম হাতে নাও, নোংরা কথা কমাও, বুদ্ধির খোঁচা বাড়াও। তোমাকে দিয়ে হবে।

কথাটি ভালো লাগল এরিস্টোফানিসের। সে সাহস করে লিখতে শুরু করল। লেখায় বাজিমাৎ। যা লিখে একেবারে রসে ভরে যায়। মানুষ না হেসে পারে না। ছোট ছোট চুটকি লিখে সে একে ওকে দেয়। সবাই হেসে কুটিকুটি। বন্ধুরা তার নাম দিয়েছে চুটকির ডিব্বা।

এই চুটকির ডিব্বা গত বছর বড় একটি চুটকি লিখে নিজেই পাড়ার থিয়েটারে অভিনয় করেছে। দেখে সবাই বলেছে এমন হাসির কাণ্ড নাকি তাদের জীবনেও হয়নি। এতে সাহস হয়েছে। এখন সে বড় করে হাসির কাহিনি লিখবে। পাড়ার থিয়েটারে নয়, এথেন্সের সবচেয়ে বড় ডিওনিসাস থিয়েটারে নিয়ে যাবে। সফোক্লিস, ইউরিপিডিসরা যেখানে ট্র্যাজেডি করে, সেখানে সে হাসির নাটক করবে।

সে ভাবছে, ট্র্যাজেডি ভালো জিনিস, কিন্তু এই ট্র্যাজেডির সাথে একটু হাসি যোগ হলে একেবারে সোনায় সোহাগা হবে। ঠিকভাবে হাসিটুকু যোগ করতে এই নাট্যকারগণ পারেন না। আমি সেটিই করব। আমি মানুষকে নতুন জিনিস দেব। মানুষ হাসতে হাসতে কাঁদবে, কাঁদতে কাঁদতে হাসবে।

ও যা করে, তাতেই মানুষ হাসে। কাতুকুতু দিয়ে হাসাতে হয় না। এমন সব সংলাপ বলে যে, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। তার একটি ভালো দিক হলো, সে যুদ্ধ দুই চক্ষে দেখতে পারে না। তার কথা হলো মানুষ পৃথিবীতে আসে আনন্দ করতে। আনন্দ না করে যারা যুদ্ধ করে সময় নষ্ট করে তারা মূর্খ, মহামূর্খ। সে বলে, এথেন্স এখন মহামূর্খের মতো একটি যুদ্ধ করছে। একেবারে খামাখা, বেহুদা যুদ্ধ। এখুনি এই যুদ্ধ বন্ধ হোক। সে কলম হাতে নিল। লিখে ফেলল যুদ্ধ বিরোধী একটি চমৎকার হাসির নাটক। নাম দিল আখারনিয়ান[১৪০]। কাহিনি এমন :

এক সৈনিক যুদ্ধে আহত হয়েছে। তার শরীর মন আর যুদ্ধ চাইছে না, সে শান্তি চায়। সে পিনিক্স পাহাড়ে যায়, এথেন্সের নেতাদের সাথে কথা বলে। কিন্তু নেতারা কেউ শান্তি চায় না, যুদ্ধ বন্ধের কোনো আলাপ নেই। তখন ওই সৈনিক নিজে উদ্যোগী হয়ে দেবতাদের সাহায্যে স্পার্টার সাথে একটি শান্তিচুক্তি করে যুদ্ধ বন্ধ করে ফেলল।

নাটক তো লিখে ফেলেছে, কিন্তু তার বয়স মাত্র উনিশ বছর। রাজনীতি নিয়ে নাটক লেখার বয়স হয়নি। লোকে কী বলবে! এই নাটক মঞ্চে অভিনয় করতে তার বুক কাঁপে। সে একজন ভালো অভিনেতার কাছে গেল। তার নাম ক্যালিস্ট্রাটাস। অভিনেতা নাটক পড়ে অবাক। এই বাচ্চা ছেলে এরকম জিনিস লিখেছে! সে বলল, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমি আমার নামে এই নাটক করব। তোমার কোনো ভাবনা নেই, যদি কেউ গালি দেয়, আমাকে দেবে, তোমাকে কেউ ফুলের টোক্কাও দিতে পারবে না।

লিনিয়া উৎসবে নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। হয়ে গেল সেরা নাটক। পেল প্রথম পুরস্কার। পুরস্কার নিল অভিনেতা। নাট্যকারকে কেউ চেনে না। তবু নাট্যকার খুশি। তার নাটক লোকে পছন্দ করছে, এটিই যথেষ্ট, নাম তার একদিন হবে।

তার সাহস বেড়ে গেল। এবার সে সরাসরি আক্রমণ করবে নেতাদের। গণতন্ত্রের নামে ভণ্ডামিকে আক্রমণ করবে। এথেন্সের নেতা ক্লিয়ন মিতিলিনের সব মানুষকে মেরে ফেলতে চেয়েছে, সেটি নিয়ে নাটক লিখল। নাম দিল ‘ব্যাবিলোনিয়ান’[১০৫]। এটিও অভিনয় করবে অভিনেতা ক্যালিস্টাটাস, নাট্যকারকে কেউ চিনবে না।

এই নাটকে বিশ্রীভাবে দেখানো হলো অন্য নগরগুলো হলো এথেন্সের দাস, এথেন্স তাদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। নাটক দেখে ক্লিয়ন একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। নাটকে এথেন্সকে অপমান করা হয়েছে। সে মামলা করল। যেই মামলা হলো অমনি অভিনেতা বলল, নাটক লিখেছে এরিস্টোফানিস, আমি কিছুই জানি না। অভিনেতা তাকে বলেছিল, তোমার গায়ে কেউ ফুলের টোক্কাও দিতে পারবে না। কিন্তু ফুলের টোক্কা আসার আগেই অভিনেতা পালিয়ে গেল। সকলের সামনে এলো পিচ্চি এক নতুন নাট্যকার।

আদালতে সকলে অবাক! এই বাচ্চা ছেলে এরকম নাটক লিখেছে! এ তো প্রতিভার হাঁড়ি। তার মামলা নিয়ে সংসদে ভোট হলো। সবাই বলল, আহা রে, বাচ্চা ছেলে, একেবারে আগুনের ফুলকি। এই ছেলেকে আদালতে ডেকে এনেছে? ও নাটকে তো মিথ্যা বলেনি। আমরা মিতিলিন শহরের সাথে যা করেছি, তা মানুষ দাসদের সাথেও করে না। নাট্যকারের বিরুদ্ধে মামলা বাতিল কর। হলো।

আদালত থেকে বের হয়েই কলার ঝাঁকুনি দিল এরিস্টোফানিস। দেখি, এবার আমাকে কে আটকায়! সে এখন আহত সিংহ। হুংকার দিয়ে সব শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এবার সে দেখে নেবে। কলম কী করতে পারে, এবার দেখিয়ে দেবে। ক্লিয়ন তার নামে মামলা করেছে, ক্লিয়নকে সে চরম শিক্ষা দেবে। সেই রাতেই লিখতে বসল নতুন নাটক। এবার কোনো রাখঢাক নেই। সে মুখোশ খুলে দেবে। ক্লিয়নকে নিয়ে লিখে ফেলল নাটক। নাম : ‘নাইটস’১০৬ বা নেতা

নাইটস নাটকের কাহিনি এমন :

নাটকের একটি চরিত্রের নাম ডিমোস, মানে জনগণ। তাদের মিথ্যে আশ্বাস আর মিষ্টি কথা দিয়ে ক্লিয়নের মতো দুষ্ট নেতারা সব লুটে নিচ্ছে। জনগণ বুঝতে পারছে না। শেষে এক চতুর লোক তাদের মুখোশ খুলে দেয়, ক্লিয়নের মতো দুষ্ট নেতা পালিয়ে যায়। এরিস্টোফানিস লিখল—

‘হে এথেন্সের জনগণ, দেশের ধন তো তোমার ধন
ওরা সব নিল কেড়ে, মিষ্টি কথায় ছুরি মেরে
কিছুই তুমি বুঝলে না রে।
ক্ষমতা তোমার হাতে, তবু নুন জোটে না তোমার পাতে?
তোমার মুখে কাঁচকলা শুধু, খাচ্ছে ঘি যদু আর মধু
তবু রয়েছো চুপ করে- হে বেকুব জনগণ?
বুঝেছি, তুমি গিয়েছিলে বাঁশবন
বাঁশ খেয়ে হারিয়ে ফেলেছো মন।’[১০৭]

নাটক দেখে মানুষ হেসে একেবারে লুটোপুটি। মানুষ দেখছে, এই ছেলে তো আমাদের কথা বলেছে। দর্শক সারিতে প্রথমেই নেতা ক্লিয়ন বসা। ক্লিয়নের সামনেই তাকে গালাগালি দিচ্ছে। একটি করে গালি দেয়, আর দর্শকরা হাততালি দেয়। ক্লিয়ন টের পাচ্ছে সে কেমন চিপায় পড়েছে। এর নাম গণতন্ত্রের মাইনকা চিপা। কিচ্ছু করার নেই। সে রাজা নয়। সে গণতন্ত্রের নেতা। গণতন্ত্রে কথা বলার অধিকার আছে। তাই সহ্য করতে হবে।

ক্লিয়নের আর কিছুই করার নেই। সে ভাবল আর এইসব পুঁচকে নাট্যকারের পিছে লাগবে না। সে ভোটের রাজনীতি করবে। নাটকে আর আসবে না।

এথেন্সে শুরু হলো নতুন এক নাট্যধারা। এর নাম কমেডি বা প্রহসন। এটি জন্ম দিলেন তরুণ নাট্যকার এরিস্টোফানিস।

***

সকাল সকাল এরিস্টোফানিসের বাড়িতে কড়া নাড়ছে।

বাইরে থেকে জোরে জোরে ডাকছে, রসিকরাজ বাড়ি আছো? ওহে রস সম্রাট, রসিক চূড়ামণি, আছো নাকি?

নাট্যকারকে ডাকছে এনিতাস। দাস খবর দিল। নাট্যকার অবাক। এনিতাসের মতো বড় একজন গণতন্ত্রী নেতা তার মতো বাচ্চার কাছে এসেছে? নিশ্চয়ই ঘটনা সাংঘাতিক। তার নামে নতুন মামলা করবে নাকি? ভয়ে ভয়ে সামনে এলো নাট্যকার।

এনিতাস হাসি মুখে বলল, তোমার গুণে মুগ্ধ হয়ে দেখা করতে এলাম। তুমি তো সারা এথেন্স নাড়িয়ে দিয়েছ।

নাট্যকার একটু হাসি দিল। মুখচোরা হাসি। সে এনিতাসের মতলব বোঝার চেষ্টা করছে। তার চিন্তা লাগছে। অল্প সময়ের মধ্যেই চিন্তা দূর হলো। এনিতাস এমন প্রশংসা করছে, বাচ্চা নাট্যকার আহ্লাদে একেবারে গদগদ হয়ে যাচ্ছে।

এনিতাস বলছে, শোনো, রসিকরাজ, তোমাকে আমি রসিকরাজ ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকব না কিন্তু! তুমি এমন কাজ করেছ যে, নাটক কী জিনিস মানুষ সেটিই নতুন করে বুঝতে শিখল। জানো, কালকে ওরা কী বলাবলি করছিল?

‘কী বলছিল?’

‘বলছিল, তোমার হাসির নাটকের কাছে নাকি সফোক্লিসের নাটকও কিছুই নয়।’

‘ধুর, কী সব বলছেন! মশকরা করছেন।’

‘তোমার সাথে কি আমার মশকরার সম্পর্ক? শোন, সফোক্লিস সত্যিই ভয় পেয়েছেন। আর ইউরিপিডিসের তো পাত্তাই নেই।’

এরিস্টোফানিস আরও ফুলতে শুরু করল। তার মনে হচ্ছে, এই লোকটি তার পরম বন্ধু। বন্ধু ছাড়া এমন করে কেউ প্রশংসা করে? কেমন মধুর করে বলছে! ওনার প্রতিটি কথা একেবারে ধ্রুবতারার মতো সত্য। এতদিনে নাটকের একজন সত্যিকার সমঝদার তার কদর করছে। এনিতাসের মতো সিনিয়র নেতা কি তাকে মিথ্যে বলতে পারে? তাহলে সত্যিই সে সফোক্লিস আর ইউরিপিডিসের সমান হয়ে উঠেছে! তারা তাকে ভয় পাচ্ছেন?

এনিতাস বুঝল, তার কাজ হচ্ছে। সে পিচ্চি নাট্যকারকে দিয়ে একটি কাজ করাতে এসেছে। তার কথায় নাট্যকারের ভেতর আগুনটা জ্বলে উঠেছে। এখন আর একটু হাওয়া দিতে হবে। সে বলল, আবার শুনলাম ইউরিপিডিস তো নাটক লেখাই ছেড়ে দেবেন। তিনি বুঝে গেছেন, তোমার মতো নতুন প্রতিভার কাছে পারবেন না।

এতক্ষণে নাট্যকার পুরোপুরি গলে গেছে। এনিতাস জানত, বাইশ বছরের ছেলেকে বশে আনতে তার বেশি সময় লাগবে না।

নাট্যকার বলল, না না, সে কী! আপনি ইউরিপিডিসকে বলেন, তিনি যেন নাটক লেখা বন্ধ না করেন। খালি মাঠে গোল দিয়ে বাহাদুর হতে চাই না।

এনিতাস বলল, ইউরিপিডিসের যা খুশি করুক। ও তো এমনিতেই একটি মাকাল ফল। তাকে নিয়ে আমার ভাবনা নেই। আমার ভাবনা তোমাকে নিয়ে।

‘আমাকে নিয়ে?’

‘হ্যাঁ, তোমার জন্য একটি প্লট এনেছি।’

‘প্লট? নাটকের কাহিনি?’

‘তো আবার কী? তুমি হলে হাসির সম্রাট, আমাদের রসরাজ। তুমি এমন কাজ করবে যেটি সারা পৃথিবীর লোক জানবে। তোমার সংলাপ মানুষের মুখে মুখে ঘুরবে। যুগের পর যুগ তোমার নাটক মানুষ করবে। তুমি তো হোমারের সমান হয়ে যাবে!’

‘হোমার?’

‘তো আবার কী! তোমার কলমে যে কী রকম জাদু আছে, তা তুমি নিজেও জানো না। খালি সাহস করে কয়েকটা কালজয়ী নাটক লিখতে হবে। তার জন্য ভাবনা নেই। আমি তোমার জন্য একটি প্লট নিয়ে আসছি। খুবই বাহারি প্লট।’

‘কাহিনি কী নিয়ে?’

‘কাহিনি হলো সক্রেটিস।’

এরিস্টোফানিস কিছুই বুঝতে পারছে না। অস্ফুট স্বরে বলল, সক্রেটিস? সক্রেটিস একটি কাহিনি?

এনিতাস বলল, হুঁম, সক্রেটিস হলো বিরাট এক কাহিনি। সে অদ্ভুত এক জিনিস। তোমার নাটকের জন্য এর চেয়ে ভালো জিনিস আর হতে পারে না।

নাট্যকারের চোখ পিটপিট করছে। সে এখনও বিষয়টি বুঝতে পারছে না। এনিতাস কি সক্রেটিসকে নিয়ে নাটক লিখতে বলছে?

এনিতাস বলল, মানুষের চরিত্র নিয়ে নাটক লেখার ক্ষমতা তোমার মতো আর কারও নেই। তুমি ক্লিয়নকে নিয়ে যেরকম নাটক লিখেছ ‘নাইটস’, ঐ রকম একটি নাটক লিখবে সক্রেটিসকে নিয়ে।

‘কিন্তু কেন? সক্রেটিস কী করেছে?’

‘সক্রেটিস কী করেনি? সে এথেন্সের সব ছেলেপেলেকে গোল্লায় নিয়ে যাচ্ছে। সে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে। তুমি এসব জানো না? ছিঃ ছিঃ, তোমার মতো জ্ঞানী ছেলে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় খেয়ালই করোনি?’

এনিতাস এমন করে বলল, যেন সক্রেটিসের কুকীর্তি খেয়াল না করা বিরাট অন্যায়।

নাট্যকার লজ্জা পেয়ে বলল, না, না, খেয়াল করেছি তো। সক্রেটিস তো দিন-রাত আগোরার আশেপাশে তরুণদের নিয়ে আড্ডা দেয়।

‘আড্ডা না ছাতা! ও যুবকদের কানপড়া দেয়।’

‘কী দেয়?’

‘কানপড়া। মানে কুবুদ্ধি। বাড়িতে গিয়ে ছেলেরা আর বাবা-মাকে মানে না।’

‘তাই নাকি?’

‘হুঁম, যুব সমাজ হলো দেশের ভবিষ্যৎ। দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলছে সক্রেটিস। এর প্রতিবাদ করতে হবে। তোমার মতো বুঝদার যুবককেই করতে হবে। বলো, ঠিক কিনা?

‘ঠিক। আমার কাজই তো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। আমার নাটকের আসল উদ্দেশ্য হলো সমাজের দুষ্ট লোকদের মুখোশ খুলে দেওয়া।’

‘ষোল আনা খাঁটি কথা। সক্রেটিসের মতো দুষ্ট লোক এথেন্সে আর কেউ আছে? দাও, ওর মুখোশ খুলে দাও। ওঠো, কলম ধরো, রসরাজ। এমন কিছু লিখো যাতে এথেন্সের মানুষ শয়তান সক্রেটিসের আসল রূপ জানতে পারে।’

নাট্যকার এখনও নিশ্চিত নয়, কী করা উচিত? সক্রেটিস কী আসলেই নাটক লেখার মতো খারাপ একটি চরিত্র? সে কিছুই বলছে না।

এনিতাস বলল, শোনো, নাটকের খরচাপাতি যা লাগে, আমিই দেব। তোমার কোনো চিন্তা নেই। তুমি তো এখন উদীয়মান তারকা। তোমাকেও আমি খুশি করে দেব। সম্মানী ভালোই পাবে। লেখা শুরু করো। দেবী এথিনার নামে শুরু করে দাও।

লেখক এখনও ভাবছে একজন দার্শনিককে নিয়ে উল্টাপাল্টা লেখা কী উচিত? এনিতাস কি তাকে ব্যবহার করছে? সক্রেটিসের সাথে এনিতাসের কি কোনো শত্রুতা আছে? আর একটু জানা দরকার। আমি কি ভাড়ায় খাটা লেখক হয়ে যাব?

সে বলল, ঠিক আছে, আমি একটু ভেবে দেখি। আপনাকে জানাব।

এনিতাস দেখল, পিচ্চি লেখক পয়সার টোপ গিলছে না। পিছলে যাচ্ছে।

সে বলল, আমি সফোক্লিসকে বললে এক কথায় লিখতে বসে যাবে। এমন গরম কাহিনি সে ছাড়বে না। কিন্তু আমি চাচ্ছি তোমার মতো একজন যুবককে কাজটি দিতে। তুমি না পারলে, বলো। আমি সফোক্লিসের বাড়ি যাই।

এনিতাসকে নাট্যকার যতটা সহজ ভেবেছিল, সে তত সহজ নয়। সে বিরাট প্যাচের লোক। এক কথায় রাজি না হওয়ায় সে সফোক্লিসকে দিয়ে লেখানোর হুমকি দিচ্ছে। লেখক ভাবছে বড় একটি কাজ ফস্কে যেতে পারে।

সে বলল, তাহলে সক্রেটিসকে একদিন ভালো করে দেখে আসি। নাটক নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে, বহুদিন সক্রেটিসের চালচলন নিজের চোখে দেখিনি। এনিতাস ভাবল, এই ছেলেকে সক্রেটিসের সামনে পাঠানো যাবে না। বাচ্চা ছেলে, সক্রেটিসের সাথে মিশলেই তার ভক্ত হয়ে যাবে। তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আর নাটক লিখবে না।

সে বলল, আরে ধুর, ওর কাছে যাওয়ার কী দরকার? ও তুকতাক জানে, ধুলাপড়া জানে। তুমি কাজটা শুরু করো। সময় নষ্ট কোরো না। ওর ব্যাপারে কী জানতে চাও বলো। আমি ওর হাঁড়ির খবর জানি, হাড়ে হাড়ে চিনি। তুমি লেখা শুরু করো। কিছু জানার থাকলে আমার কাছে জিজ্ঞেস কোরো

নাট্যকার আমতা আমতা করছে। এনিতাস বলল, শোনো, আরেকটা কথা। তুমি যে এটি লিখছ, সেটি যেন কাক-পক্ষীতেও টের না পায়। খুব গোপনে করতে হবে। জানব শুধু তুমি আর আমি।

নাট্যকার এখনও চুপ। এনিতাস বলল, শোনো, তুমি তো হোমার হবে? হোমার হতে হলে একটি বড় ঝাঁকুনি দিতে হবে। সবচেয়ে বড় গাছকে ঝাঁকুনি দিতে হবে। সক্রেটিস হলো সেই বড় গাছ। গাছটা যদি তোমার ঝাঁকুনিতে উল্টে পড়ে, তাহলেই তুমি হোমার হয়ে যাবে। রাজনীতি বলো আর সাহিত্য বলো, সবখানেই এই নিয়ম

এরিস্টোফানিস বলল, সক্রেটিসের দুই-একজন বন্ধুর নাম বললে ভালো হতো। হাসির নাটকে ভাঁড়ামি করতে বন্ধু লাগে। বন্ধু সব কথায় হয় হয় করবে। মজার কাণ্ড-কারখানা করবে।

এনিতাস খুশি হলো। নাট্যকার টোপ গিলে ফেলেছে। তার কাজ হাসিল।

সে বলল, সক্রেটিসের তো হাজার হাজার বন্ধু। সবগুলোই এক-একটি জিনিস। তাদের মধ্যে কৌতুক করার চরিত্র হিসেবে তুমি যাকে নিতে পার, তার নাম ‘চেরোফোন।’ সে ভালোই লাফালাফি করে।

***

জানুয়ারি মাস। আকাশ ঝকঝকে।

আকাশ আর সাগর মিলে চারধারে নীল আর নীল। কোথাও ছিটেফোঁটাও মেঘ নেই। কিন্তু সারা এথেন্সের মানুষ বলছে, চল, ‘মেঘ’ দেখতে যাই। ‘মেঘ’ দেখতে যাই। বিকেল হতেই তারা লাইন দিয়ে হেঁটে চলছে। ‘মেঘ’ দেখবে।

‘মেঘ’[১০৮] একটি নাটকের নাম। এথেন্সের রসিকরাজ এরিস্টোফানিস লিখেছে নাটক। সে নিজেই আজ বিকেলে অভিনয় করবে নাটকটি।

সক্রেটিস সেজেগুঁজে তৈরি। তিনিও নাটক দেখতে যাবেন। তিনি নিজে থেকেই যাবেন। কারণ আজ যে নাটক অভিনয় হবে, সেটির প্রধান চরিত্র সক্রেটিস নিজে। জীবন্ত সক্রেটিস দেখবেন মঞ্চের সক্রেটিসকে।

সক্রেটিস জানেন না কী দেখানো হবে সেই নাটকে। তবে খুব ভালো কিছু যে হবে না, সেটি নিশ্চিত। যে নাট্যকার লিখেছে, সে বিদ্রূপ করে হাসি-ঠাট্টার নাটক লেখে। সে যাকে ধরে, তার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে দেয়। তাই আজ থিয়েটারে সক্রেটিসের ইজ্জতের বারোটা বাজার সম্ভাবনা আছে।

চেরোফোন বললেন, আমাদের নাটক দেখার জন্য লাইন ধরে মানুষ যাচ্ছে। থিয়েটার নাকি হাউজফুল হবে।

সক্রেটিস বললেন, আমাদের নাটক মানে কী? আমি তো জানি আমাকে নিয়ে নাটক।

চেরোফোন বললেন, তোমাকে নিয়েই নাটক। তোমার সাথে আমিও নাটকের একটি চরিত্র।

সক্রেটিস বললেন, বাহ, আমরা তো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের বিখ্যাত করে লাভটা কার হবে, সেই খবর বের করতে পেরেছ?

চেরোফোন বললেন, লাভ হবে এনিতাসের। থিয়েটার যাতে ভরে যায়, সেজন্য এনিতাস তুমুল আয়োজন করেছে। লোকের বাড়ি বাড়ি লোক পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করেছে। তোমার নিজের মহল্লাতেই বেশি করে প্রচার করেছে। এমন প্রচার আগে কোনো নাটকের জন্য হয়নি।

ক্রিতো আর সিমন যাবেন না। তারা সক্রেটিস আর চেরোফোনকে যেতে মানা করেছেন। কিন্তু তারা যাবেনই। সক্রেটিসের যুক্তি, আমাকে নিয়ে মানুষ কী লিখে সেটি নিজের চোখে দেখা আমার কর্তব্য। আর চেরোফোন বলেছেন, লেখা হলো গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতন্ত্রে আমরা কাউকে কোনোকিছু লিখতে বাধা দিই না। তার লেখার কাজ সে লিখছে, যারা অভিনেতা তারা অভিনয় করবে, আর তোমার আমার কাজ হলো নাটকটা দেখা। আমরা দেখব।

জেনথিপি যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সক্রেটিস না করেছেন। নাটকে তো ভালো কিছু দেখাবে না। স্বামীর নামে উল্টা-পাল্টা দেখে শেষে থিয়েটারেই কেঁদে-কেটে অস্থির করে ফেলবেন। সেজন্য জেনথিপি যাচ্ছেন না।

সক্রেটিস আর চেরোফোন যাচ্ছেন থিয়েটারে। শত শত মানুষ যাচ্ছে সেই পথে। এনিতাসের প্রচারে কাজ হয়েছে। মহল্লার সবাই হাঁটা শুরু করেছে।

রাস্তায় নানান জায়গায় পোস্টার চোখে পড়ছে। পেপিরাস কাগজের পোস্টারে ছেয়ে গেছে আগোরা। পোস্টারে বড় বড় করে লেখা,

সুখবর, সুখবর, সুখবর
এই প্রজন্মের সবচেয়ে হাসির, সবচেয়ে মজার নাটক
মঞ্চে আসছে হাসির সম্রাট, উদীয়মান তরুণ নাট্যকার, রসরাজ এরিস্টোফানিস
নাটকের নাম : মেঘ।
স্থান : ডিওনিসাস থিয়েটার, এক্রোপোলিস।
সময় : আগামী শুক্রবার, বিকেল চার প্রহর গতে।

পোস্টারের ডান দিকে ডিজাইন করে লেখা :

সক্রেটিসকে চিনেন? না, আপনি চিনেন না। তাকে চিনতে হলে এই নাটক আপনাকে দেখতেই হবে।

পোস্টারে চোখ বুলিয়ে সক্রেটিস বললেন, হ্যাঁ, ওরা যখন লিখেছে, সক্রেটিসকে চিনতে এই নাটক দেখতেই হবে; চলো, দেখে আসি সক্রেটিস কেমন

চেরোফোন গম্ভীর। তার চিন্তা হচ্ছে। তিনি কিছু কথা শুনেছেন। এনিতাস নাকি সক্রেটিসকে অপমান করতে নিজের পকেটের পয়সায় এই নাটক করিয়েছে। তবু তারা থিয়েটারে পৌঁছে গেলেন।

থিয়েটার কানায় কানায় ভরা। বসার জায়গা নেই। অনেক মানুষ দাঁড়িয়েও আছে। সক্রেটিস আর তার বন্ধুদের জন্য সামনের সারিতে জায়গা রেখে দিয়েছে এনিতাস। সক্রেটিস সেখানেই বসলেন। নিজেকে মঞ্চে দেখবেন। ভালো করেই বসলেন।

.

নাটক শুরু হলো। মঞ্চে এরিস্টোফানিস অভিনয় করছে। নাটকের কাহিনি এমন : নাটকের সক্রেটিসের একটি দোকান আছে। দোকানের নাম ‘চিন্তার দোকান’। সে চিন্তা বিক্রি করে। অনেক দাম চিন্তার। এক বাবা সক্রেটিসের কাছে এসেছে তার ছেলেকে নিয়ে। সেই চিন্তার দোকানে ছেলেকে ভর্তি করাবে। ছেলে যাতে ভালো বক্তৃতা শিখে নেতা হতে পারে সেজন্য। তো ছেলের বাবা এসে ডাকছে, ‘সক্রেটিস, সক্রেটিস।’ সক্রেটিস বলছে, ‘আমি এখানে।’ কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না। অনেক খুঁজে দেখা গেল— সক্রেটিস অনেক উপরে ঝুলছে। তাকে একবার দেখা যায়, আবার হারিয়ে যায়, সে মেঘের মধ্যে ভাসছে। বাবা অবাক! সক্রেটিস বলল, ‘শোনো, দেবতা বলতে কিছুই নেই, জিউস বলতে কেউ নেই।’ বাবা বলল, ‘তাহলে বৃষ্টি দেয় কোন দেবতা?’ সক্রেটিস বলল, ‘বৃষ্টি দেয় মেঘ। তাই মেঘ হলো দেবতা। জিউস বলতে কেউ নেই।’ বাবা মনে করল, বাহ, কী সুন্দর যুক্তি! সক্রেটিস তো বিরাট কাবিল মানুষ। সে তার ছেলেকে সক্রেটিসের ‘চিন্তার দোকান’-এ শিক্ষা লাভের জন্য পাঠিয়ে দিল।

মঞ্চে তুমুল অভিনয় হচ্ছে। সারা থিয়েটার হাসিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দর্শকরা দুয়ো ধ্বনি দিচ্ছে, ‘সক্রেটিস ভুয়া, ভুয়া। সবাই নাটক দেখছে আর সামনের সারিতে সক্রেটিসের দিকে তাকাচ্ছে।

সক্রেটিস প্রতি মুহূর্তে অপমানিত হচ্ছেন। তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত ক্রিতোও এসেছেন থিয়েটারে।

ক্রিতো বললেন, চলো, বের হয়ে যাই।

সক্রেটিস বললেন, না, সেটি ঠিক হবে না। তাতে কাল সকালে লোকজন আরও বেশি ঠাট্টা করবে।

সক্রেটিসের ঠিক উল্টো পাশে বসেছে এনিতাস। নাটক চলছে আর সে বলছে, বাহ, চমৎকার।

মঞ্চে অভিনয় চলছে। তুমুল অভিনয় করছে এরিস্টোফানিস। অভিনয় চলছে : একজন বলছে সক্রেটিসের চিন্তার দোকান কই? সক্রেটিস কাপড় খুলে ন্যাংটা হয়ে পশ্চাৎদেশ দেখিয়ে বলল, এই যে এখানে।

সারা থিয়েটার হাসিতে ফেটে যাচ্ছে। সক্রেটিসও হাসছেন। এখানে কান্না করা যাবে না।

মঞ্চে অভিনয় চলছে : নাটকের সক্রেটিস বলছে, জিউস বলতে কোনো দেবতা নেই। দেবতা হলো মেঘ, আজ থেকে কেউ আর জিউসকে ডাকবে না, সবাই ডাকবে ‘মেঘ’ দেবতাকে।

দর্শকরা চিৎকার করে বলছে,

সক্রেটিস ভুয়া, দেবতাকে মানে না।
সক্রেটিস ভুয়া, জিউসকে মানে না।

.

মঞ্চে কাহিনি এগোচ্ছে, ছেলেটি সক্রেটিসের কাছে শিক্ষা লাভ করে বাড়িতে ফিরে গেল। বাড়িতে গিয়ে সে বাবাকে পিটাচ্ছে। বাবা বলছে, আমাকে মারছিস কেন? ছেলে বলছে, সক্রেটিস শিখিয়েছে, বাবা ভুল করলে বাবাকেও পিটাতে হবে। ছেলে ইচ্ছা মতো মারছে বাবাকে, রক্ত বের হচ্ছে।

দর্শকরা আবার দুয়ো দিচ্ছে—

সক্রেটিস ভুয়া, শিক্ষক নামের কলঙ্ক
সক্রেটিস ভুয়া, বাবা-মায়ের আতঙ্ক।

সক্রেটিসের মনে হচ্ছে স্লোগান সব ঠিক করা। তিন-চারজন একসাথে স্লোগান ধরছে, তাদের সাথে গলা মিলাচ্ছে সারা থিয়েটারের মানুষ। স্লোগানও কি এনিতাস আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে?

এনিতাসের মুখে হাসি। সক্রেটিসের মনে হচ্ছে, এই হাসিটা খাটাসের মতো। এনিতাস তার বন্ধুকে বলছে, এমন ব্যবস্থা করছি, কাল সকাল থেকে সক্রেটিস মানুষকে মুখ দেখাতে পারবে না। ওকে হাতে মারব না, ওকে ভাতে মারব না— অন্যরকম মাইর দেব। গণতান্ত্রিক মাইর। সে সুর করে বলছে,

জমিয়ে দিলাম খেলা,
কাঁদতে হবে একেলা।

মঞ্চে কাহিনি এগোচ্ছে— ছেলের হাতে মার খেয়ে বাবা কোনোমতে বাঁচল। সে এবার হুংকার দিল। তার ছেলেকে নষ্ট করেছে সক্রেটিস। সে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করতে শিখিয়েছে। সক্রেটিসের কোনো ক্ষমা নেই। বাবা দৌড়ে গেল সক্রেটিসকে ধরতে। তাকে আর চেরোফোনকে আটক করল একটি ঘরের মধ্যে, বাইরে থেকে শিকল দিয়ে আগুন জ্বেলে দিল। প্রায় মরে যাচ্ছিল তারা, কোনোমতে দুয়ার খুলে এথেন্স থেকে পালিয়ে গেল সক্রেটিস। চিরতরে বিদায় হলো দুষ্টটা। এভাবে শেষ হলো নাটক।

দর্শকরা আবার দুয়ো দিচ্ছে—

সক্রেটিস ভুয়া, উচিত শিক্ষা পেয়েছে
সক্রেটিস ভুয়া, জান নিয়ে পালাইছে।

নাটক শেষ হলে দর্শকরা বের হচ্ছে আর সক্রেটিসকে দেখে দুয়ো দিচ্ছে। অনেকক্ষণ চলল এই অপমান। ক্রিতো আর সিমন চেষ্টা করছেন তাকে আড়ালে রাখতে। চেরোফোন হাউমাউ করে কাঁদছেন।

এনিতাস বলছে, কাঁদো, বুক ভাসিয়ে কাঁদো। কান্না তো মাত্র শুরু। এমন দিন আসবে যে, সেই পিথাগোরাসের শিষ্যদের যেমন পুড়িয়ে মেরেছিল, তেমনই সক্রেটিসকে এথেন্সের মানুষ পুড়িয়ে মারবে।

চেরোফোন থিয়েটার ফেরত মানুষদের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। তাদের যে ভাবভঙ্গি, তাতে সক্রেটিসকে পুড়িয়ে মারা কোনো বড় ঘটনা নয়। দর্শকদের মুখ বলছে, তার আগুন শাস্তিই প্ৰাপ্য।

সক্রেটিস ভাবছেন— নাটকের বার্তা কত মারাত্মক! এই থিয়েটারের প্রতিটি মানুষ ভাবছে— সক্রেটিস দেবতা মানে না, ধর্ম মানে না, সে যুবকদের নষ্ট করে। তারা চায় সক্রেটিসকে পুড়িয়ে মারা হোক।

পিথাগোরাসের নামেও মিথ্যা রটনা ছিল যে, তিনি দেবতা মানেন না, ধৰ্ম মানেন না। তার শিষ্যরা শুধু গণিত, জ্যামিতি আর সংগীত জানেন, ধৰ্ম-কৰ্ম জানেন না। সেজন্য একবার পিথাগোরাসের কিছু শিষ্য যখন সভা করছিলেন, তখন বাইরে থেকে তালা মেরে ঘরে আগুন দিয়ে দেয়, পুড়িয়ে মারে অনেক দার্শনিককে[১০৯]। দেবতাদের অস্বীকার করে জ্যামিতি আর গণিত চর্চা করার অপরাধে তাদের নিশ্চিহ্ন করেছিল গ্রিসের মানুষেরা।

এই নাটক দিয়ে মানুষকে বলা হচ্ছে সক্রেটিসও ঐ রকম। তাকেও পিথাগোরাসের শিষ্যদের মতো পুড়িয়ে মারা হোক

বাড়ি ফিরে সেই রাতে আর খেতে পারলেন না সক্রেটিস। জেনথিপি অনেক জিজ্ঞেস করলেন নাটকের কথা। সক্রেটিসের মুখ থেকে কিছুই বের হলো না। জেনথিপি শুনলে কাঁদবেন। এই মেয়েটির বকা তিনি নীরবে সহ্য করেন, কিন্তু কান্না তাকে কষ্ট দেয়। আজ সক্রেটিস একাই কাঁদবেন, যুগল কান্নার কোনো মানে হয় না।

‘মেঘ’ নাটক অভিনয় হওয়ার পরে সারা এথেন্সে ঢি ঢি পড়ে গেছে।

সক্রেটিসের মনে হচ্ছে, কে যে আসল সক্রেটিস, সেটিই মানুষ ভুলে গেছে। নাটকে যে সক্রেটিসকে দেখানো হয়েছে, সেটিকেই সবাই মনে করছে আসল সক্রেটিস। মানুষ তাকে দেখে হাসে। পেছন থেকে টিপ্পনি দেয়।

ছিচল্লিশ বছরে এসে সক্রেটিস আবিষ্কার করলেন নাটকের শক্তি কত বিশাল হতে পারে। একটি মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারে একটি নাটক।

এথেন্সে কোনো খবরের কাগজ নেই। এখানে সকাল বিকাল সংবাদ শোনানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে প্রধান মিডিয়া হলো নাটক। সব শিক্ষিত মানুষ নাটক দেখে। নাটকের সংলাপ মুখে মুখে ঘোরে। কোনো সংলাপ ভালো লাগলে সেটি প্রবাদের মতো হয়ে যায়।

‘মেঘ’ নাটকের সংলাপ যাতে মানুষের মুখে মুখে ঘোরে, সেই ব্যবস্থা করতে এনিতাস কোনো ত্রুটি রাখেনি। সে এথেন্সের সব পাড়ার থিয়েটারে ‘মেঘ’ নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করল। সেখানে আর এরিস্টোফানিস নয়, বিভিন্ন লোকে অভিনয় করে। প্রতিটি পাড়ার মানুষ কয়েক দিনেই জেনে গেল সক্রেটিস কেমন। শুরু হয়ে গেছে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল।

তবে প্রচারের একটি গুণ থাকে। দেশ-বিদেশের মানুষ সক্রেটিসের কথা আরও বেশি করে জেনে গেল। নানা নগরের মানুষ এসে খোঁজ করে সক্রেটিস কোথায়। আর একবার যদি কেউ সক্রেটিসের সাথে কিছু সময় কাটায়, সেই ব্যক্তিই সক্রেটিসের সুন্দর মন আর পরিষ্কার জীবনের একটি ছবি পেয়ে যায়। তারা সক্রেটিসের গুণের কথা নগরে নগরে নিয়ে গেল।

এভাবে বিভিন্ন নগরের সফিস্টরা সক্রেটিসের জ্ঞান নিয়ে প্রচার শুরু করল। সারা গ্রিসে সক্রেটিস হয়ে গেলেন একজন অতি পরিচিত মানুষ। একইসাথে নন্দিত আর নিন্দিত মানুষ সক্রেটিসের মতো আর কেউ নেই।

***

১০৩. এরিস্টোফানিস (Aristophanes, ৪৫০-৩৮৮ খ্রি. পূ.) কমেডি সাহিত্য বা ‘প্রহসন’ এর জনক।

১০৪. এরিস্টোফানিসের কমেডি আখারনিয়ান (The Acharnians ), খ্রিস্টপূর্ব ৪২৫ অব্দে এটি লিনিয়া উৎসবে প্রথম পুরস্কার পায়।

১০৫. এরিস্টোফানিসের কমেডি (The Babylonians)।

১০৬. এরিস্টোফানিসের কমেডি The Knights, খ্রিস্টপূর্ব ৪২৪ অব্দে এটি লিনিয়া উৎসবে প্রথম পুরস্কার পায়।

১০৭. এরিস্টোফানিসের কমেডি The Knights এর Paul Roche কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ থেকে এই অংশটুকু বাংলা করেছি।

১০৮. সক্রেটিসকে অত্যন্ত জঘন্যভাবে তুলে ধরে এরিস্টোফানিস ৪২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখেন কমেডি ‘The Clouds’, আমি কমেডিটির Paul Roche কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ থেকে কাহিনি নিয়েছি।

১০৯. খ্রি. পূ. ৪২৪ অব্দে বর্তমান ইতালির Croton শহরে পিথাগোরাসের শিষ্যদের পুড়িয়ে মারা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *