৪২
‘বিস্ময়ই হলো জ্ঞানের সূতিকাগার।’
—সক্রেটিস
***
চেরোফোন কপাল চাপড়াচ্ছেন। নিজের কপালে ছোট ছোট আঘাত করছেন আর বলছেন, এ কী করল এথেন্স? এর নাম কি গণতন্ত্র? পেরিক্লিস বেঁচে থাকলে কোনোদিন এটি দেখতে হতো না। আমরা কি মানুষ? এথেন্স কি সব নীতি ভুলে গেল? এটি গণতন্ত্রের নিয়ম নয়।
চেরোফোন একা নয়, এথেন্সের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ আজ হতভম্ব। সক্রেটিস বাকরুদ্ধ। এথেন্স জঘন্যতম অন্যায় করতে যাচ্ছে একটি দ্বীপের মানুষদের সাথে। দ্বীপটির নাম লেসবস। এই দ্বীপের বিরুদ্ধে এথেন্সের সংসদে পাস হয়েছে এক ভয়ংকর প্রস্তাব। এথেন্সের সেনারা দ্বীপের সব পুরুষকে মেরে ফেলবে; আর সব নারী ও শিশুকে বেঁচে দেবে দাস বাজারে।
এই ভয়াবহ প্রস্তাব যে করেছে, তার নাম ক্লিয়ন। পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর এথেন্সের গণতন্ত্রের নতুন নেতা সে। পেরিক্লিসের মারা যাওয়ার পর এথেন্সে নতুন নতুন নেতা হচ্ছে। যে যার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। উদ্ভট সব সিদ্ধান্ত। ক্লিয়ন ছিল পেরিক্লিসের ঘোর বিরোধী। সে বলত, স্পার্টার সাথে যুদ্ধের জন্য দায়ী পেরিক্লিস। কিন্তু পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর সে যুদ্ধ বন্ধ করল না, উল্টা আরও বেশি করে যুদ্ধ শুরু করল। রক্ত গরম করা যুদ্ধের কথা বললে ভোট বাড়ে। ভোটের চক্করে পড়ে শান্তিকামী ক্লিয়ন হয়ে গেল যুদ্ধবাজ। সে এখন যুদ্ধের জন্য উসখুস করে। অল্প দিনেই বড় একটি যুদ্ধের সুযোগ পেয়ে গেল।
খবর এসেছে, এজিয়ান সাগরের লেসবস দ্বীপের মানুষ এথেন্সের পক্ষ ত্যাগ করে স্পার্টার জোটে যোগ দিয়েছে। এই খবরে ক্লিয়ন বিশাল বাহিনী নিয়ে ঐ দ্বীপের রাজধানী মিতিলিন শহর দখল করল। এখন মিতিলিনের মানুষের বিচার হবে। তারা এথেন্সের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ক্লিয়ন সংসদে পাস করাল, ‘ওরা বেইমানি করেছে। বেইমানির শাস্তি হিসেবে এথেন্সের সেনারা দ্বীপের সব পুরুষকে মেরে ফেলবে, সব নারী ও শিশুকে দাস বাজারে বিক্রি করে দেবে।’ এই ভয়াবহ আদেশ নিয়ে জাহাজ রওনা হলো লেসবসের দিকে। আদেশ হাতে পেলেই সেনারা শুরু করবে তাণ্ডব।
এই ভয়াবহ খবরে সারা এথেন্সের শুভবুদ্ধির সব মানুষ হতভম্ব। এটি কী হলো? এথেন্স কি এরকম? গণতন্ত্রের এ কী মারাত্মক পরিণতি! পেরিক্লিস মারা যেতেই আমরা এমন আমানবিক হয়ে গেলাম?
সক্রেটিস দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, মানুষ যখন ‘আরও চাই’, ‘আরও চাই করতে থাকে, তখন গণতন্ত্র শুধু একটি সাইনবোর্ড হয়ে, যায় যেটাকে সামনে রেখে শুধু যুদ্ধ করা যায়।
চেরোফোন বললেন, ক্লিয়ন গণতন্ত্রের নামে অন্যায় করছে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ঠকাচ্ছে।
পরদিন সকালেই ভালো খবর এলো। এথেন্সের নেতারা ভুল বুঝতে পেরেছে। সংসদে নতুন বিল পাস হয়েছে। লেসবস দ্বীপের মানুষদের মারা হবে না। শুধু বেইমানদের বিচার হবে। আদেশ বাতিলের খবর নিয়ে আরেকটি জাহাজ রওনা হলো লেসবসের দিকে। সব শুনে সক্রেটিস বললেন, এথেন্সের গণতন্ত্রে সার্কাস চলছে। পেরিক্লিস শেষ, তো গণতন্ত্রের দিনও শেষ।
.
সিমনের দোকানে তুমুল আড্ডা চলছে। কথার তুবড়ি ছুটছে। চারপাশে অনেক মানুষ।
চেরোফোন বলছেন, একটি দ্বীপের সব মানুষ মেরে ফেলবে এমন কাজ এথেন্স করতে পারে? ক্লিয়ন একটি বর্বর। সে চামড়া ব্যবসায়ী। তার ট্যানারি আছে। সে সারা জীবন পশু জবাই করেছে, চামড়া ছাড়িয়েছে। ও কী করে মানুষের মর্ম বুঝবে?
সক্রেটিস বললেন, চামড়ার ব্যবসা করা দোষের কিছু নয়। কোনো কাজই ছোট নয়। তবে ঘটনা অন্যখানে। এই গণতন্ত্রের মারাত্মক সমস্যা অন্যখানে।
সিমন বললেন, গণতন্ত্রের সমস্যা কোনখানে?
সক্রেটিস বললেন, এথেন্সের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা[১০১] শুনতে চাও? তাহলে শোন, আসল সমস্যা হলো— এখানে কোনো কাজে কোনো বিশেষজ্ঞ নেই। ধরো, তোমার জুতা দরকার, তো জুতা বানাতে কার কাছে যাবে?
‘মুচির কাছে।’
‘কেন তার কাছে যাবে?’
‘কারণ সে কাজটা জানে, সে জুতা বানানোর বিশারদ।’
‘একটি যুদ্ধ জাহাজ চালাতে কার কাছে যাও?’
‘নাবিকের কাছে, বা জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে।’
‘কেন?’
‘কারণ সে জাহাজ বিশারদ, সে কাজটা জানে।’
‘বাড়ি করতে হলে কাকে ডাকবে?’
‘রাজমিস্ত্রি।’
সক্রেটিস বললেন, তাহলে কী দাঁড়াল? আমরা প্রত্যেক কাজের জন্য, সেই কাজের একজন বিশেষজ্ঞের কাছে যাই। জুতা বানাতে মুচি, ঘর বানাতে রাজমিস্ত্রি, জাহাজ চালাতে ক্যাপ্টেনকে ডাকি। তো সব কাজেই বিশেষজ্ঞ দরকার। আর শুধু দেশ চালাতে বিশেষজ্ঞের দরকার নেই? এখানে গণতন্ত্রে নেতা হতে কোনো যোগ্যতা লাগে না। কিছু মানুষ নিয়ে গলাবাজি করতে পারলেই কাজ হয়ে যায়। এরা নেতা নয়, এরা গলাবাজ। এরা ভোটের জন্য মানুষকে লোভ দেখায়। এখানে সরকারি কাজে লোক নিয়োগ হয় লটারিতে। আসল কাজে কোনো বিশেষজ্ঞ নেই। দেশ চালায় গলাবাজরা আর তেলবাজরা। এটি দেশ শাসন নয়। এটি ছেলেখেলা।
.
এর মধ্যে সিমনের দোকানে এসেছে এনিতাস। তার চামড়ার ব্যবসা। সে সিমনের কাছে চামড়া বিক্রি করে। সক্রেটিসের মনে পড়ল, এই সেই লোক যে তার নামে উল্টা-পাল্টা বলে। পেরিক্লিসের বাড়িতে হেরোডোটাসের সিম্পোজিয়ামে সে সক্রেটিসকে সবার সামনে ধাক্কা মেরেছিল। ধমকও দিয়েছিল। এনিতাস পেছনে বসে ছিল। সে রাগে গজগজ করছে। সক্রেটিসের এত বড় সাহস! সে এথেন্সে বসে প্রকাশ্যে গণতন্ত্রের নিন্দা করে? ওকে একটি শিক্ষা দিতে হবে।
এমন সময় সিমন বললেন, সক্রেটিস। তোমার সাথে দেখা করার জন্য সেই থেসালি থেকে একটি ছেলে এসেছে। ওর নাম মেনো[১২০]। ওর অনেক প্রশ্ন। জানার অনেক আগ্রহ। ও তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে চায়।
সক্রেটিস বললেন, একা কথা বলতে চায়? এখানে এত মানুষ। এদের মধ্যে একা একা কথা বলব?
সিমন বললেন, উনি জ্ঞানের আশায় সেই পাঁচশ মাইল দূর থেকে আসছেন। জ্ঞানের জন্য চাতক পাখি না হলে এমন হয় না। চাতক পাখিকে সময় দাও।
সক্রেটিস দোকানের এক কোনায় বসলেন। তার সামনে চাতক পাখি মেনো জড়োসড়োভাবে হাঁটুগেড়ে বসেছে।
সক্রেটিস বললেন, উঠে বসো। জ্ঞানের কথা হয় সমান আসনে। এই মুহূর্ত থেকে আমি আর তুমি সমান। আমি যা বলব, ভালো লাগলে হ্যাঁ করবে, আর মন্দ লাগলে চিৎকার করে বলবে, মানি না। তাহলেই জ্ঞানের কথা জমবে।
মেনো উপরে উঠে বসল।
সক্রেটিস বললেন, সরাসরি আসল কথায় চলে যাও।
মেনো বলল, আমি শুনেছি আপনি সুন্দর জীবনের কথা বলেন। জীবন সুন্দর করার জন্য আমাদের সদগুণ (Virtue) দরকার। অন্তরের ভেতরের গুণ দরকার। তো এই সদগুণ কার কাছে শিখতে পারি?
সক্রেটিস বললেন, তার আগে বলো ‘সদগুণ কী?
শুরু হলো প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা। সক্রেটিস আর মেনোর অনেকক্ষণ ধরে প্রশ্ন আর পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে আলাপ চলতে লাগল।
শেষে সক্রেটিস বললেন, সদগুণ হলো জ্ঞান। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সেই জ্ঞান। এই জ্ঞান পেলে মানুষ ভালোটা করবে আর মন্দটা বাদ দেবে। সুন্দর জীবন পাবে। যতদিন ভালো আর মন্দের পার্থক্য করতে না পারবে, ততদিন এই গুণ অর্জিত হবে না। ততদিন সুন্দর জীবনও পাবে না।
মেনো বলল, এত সহজ! সদগুণ মানে ভালো-মন্দের জ্ঞান? আর কিছু নয়? এত আলাপ করে এই সহজ কথা বুঝলাম!
সক্রেটিস হাসছেন। পৃথিবীতে ভালো জিনিস যা আছে তা সবই সহজ। শুধু বুঝতে পারলেই হলো। প্যাঁচ দিয়ে কঠিন করে বলে মানুষ পণ্ডিতি দেখায় মাত্র। কিন্তু সত্যি হলো— সহজ করে বলতে পারাই পাণ্ডিত্য।
মেনো মনে মনে ভাবছে সে ঠিক বুঝল কিনা। সদগুণ মানে ভালো-মন্দের জ্ঞান। জ্ঞানই হলো শক্তি। সঠিক জ্ঞান থাকলে, মানে সঠিক পথটি জানতে পারলে, সেভাবে জীবন যাপন করা যায়। সেটিই হলো সুন্দর জীবন I
এমন সময় এগিয়ে এলো এনিতাস। সে বলল, বসতে পারি? সক্রেটিস তাকে হাসিমুখে বসালেন। বললেন, এসো, এনিতাস। এই হলো মেনো। ও জানতে চায় যে কার কাছে গেলে সে সদগুণ পাবে?
এনিতাস বলল, ওরে বাপ রে! গুণ, সদগুণ, অন্তরের গুণ। বহুত কঠিন কথাবার্তা। তো আমিও শুনি কে আমাদের গুণ শেখাতে পারেন।
সক্রেটিস বললেন, ডাক্তারি শিখতে হলে যেমন ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, জুতা বানানো শিখতে হলে যেতে হয় পাদুকাশিল্পীর কাছে, তেমনই গুণ পেতে হলে এমন কারও কাছে যেতে হবে, যার সেই গুণ আছে।
‘সে কে? কার সেই গুণ আছে?’
‘তারা হলেন জ্ঞানপ্রেমিক বা দার্শনিক।’
দার্শনিক শব্দটা শুনেই এনিতাস ক্ষেপে গেল। চিৎকার করে বলল, দার্শনিক আবার কী জিনিস? আবার বলে জ্ঞানপ্রেমিক! যতসব বুগিজুগি কথা আসলে তুমি নিজে একজন সফিস্ট। সেজন্য সফিস্টদের পক্ষে কথা বলছো। আমার কাছে শোনো, সফিস্টরা হলো পয়সাখোর। তারা বাচ্চা পড়িয়ে রক্তচোষার মতো টাকা নেয়। তাদের কাছে শেখা যাবে গুণ?
সক্রেটিস তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
এনিতাস আবার বলল, তুমি আসলে কিছুই জানো না। তুমি একটু আগে গণতন্ত্রের নামে অনেক আজেবাজে কথা বলেছ। আমি সব শুনেছি। তুমি চাও গণতন্ত্র চলে যাক, স্বৈরাচার আসুক?
এনিতাসের গলায় তীব্র ঝাঁজ। রাগে চোখ বেরিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে সে সক্রেটিসকে ভস্ম করে ফেলবে। সক্রেটিস কোনো অবস্থায়ই কারও সাথে ঝগড়া করেন না। তিনি শান্তভাবে তাকিয়ে আছেন।
এনিতাস বলল, এথেন্সে বসে গণতন্ত্রের নিন্দা করো?
সক্রেটিস বললেন, আমি দেশ চালাতে যোগ্যতার কথা বলছি। গণতন্ত্রেও যোগ্য লোক দরকার, সেই কথা বলছি।
এনিতাস বলল, তুমি কী বলেছ সেটি আমি শুনেছি। আমার লোক আছে চারদিকে। শোনো সক্রেটিস, সাবধান হও। তুমি গণতন্ত্রের এক নম্বর শত্রু। এখনও সাবধান হও। খুব বিপদে পড়বা।
চেরোফোন অনেকক্ষণ সহ্য করেছেন। তিনি এনিতাসের দিকে এগিয়ে এলেন। তার চোখে চোখ রেখে বললেন, হুমকি দিও না। তুমি একা গণতন্ত্রের নেতা নয়। আমরাও গণতন্ত্র ভালোবাসি।
এনিতাস চেরোফোনকে পাত্তাই দিল না। সে জানে যে চেরোফোন গণতন্ত্রের পক্ষের লোক। সে এটিও জানে যে এখানে চেরোফোন কোনো বিষয় নয়। সক্রেটিসই আসল পাণ্ডা। সে সক্রেটিসের দিকে তাকিয়ে বলল, শোনো, সক্রেটিস। আমি হুঁশিয়ার করে বলে দিচ্ছি, খুব খেয়াল করে শোনো :
‘পৃথিবীর যেকোনো নগরে কারও ভালো করার চেয়ে খারাপ করা অনেক সহজ। এথেন্সে সেটি আরও বেশি সহজ। এখানে মন চাইলেও কারও উপকার করা যায় না, কিন্তু ইচ্ছা হলেই তাকে বিপদে ফেলা যায়।’
বলেই সে গটগট করে বের হয়ে গেল। এনিতাস হাঁটছে আর বিড়বিড় করছে, ওকে একটি শিক্ষা দিতেই হবে। আমি ওর নামে মামলা করব। এমন মামলা যেন কিছুতেই রেহাই না পায়।
সাথে ছিল এনিতাসের একজন দাস। সে বলল, কী মামলা দেবেন? ওনার বিরুদ্ধে কোনো প্ৰমাণ আছে?
এনিতাস বলল, না, প্রমাণ নেই। ও খুব ধড়িবাজ। কাউকে গালি দেয় না, একা দেয় না, মারামারিও করে না।
‘তাহলে সমস্যা কী? সে কী করে?’
‘খালি লম্বা লম্বা কথা বলে। গণতন্ত্র বিরোধী কথা। কিন্তু কোনো প্ৰমাণ রাখে না। এর নামে মামলা দিয়ে লাভ হবে না।’
‘তাহলে কী করবেন?’
‘মামলায় কাজ হবে না। অন্য একটি প্যাঁচ দিতে হবে।’
‘চলেন, আচ্ছা রকম একটি পিটুনি দিয়ে দিই?’
‘ধুর, আমি গণতন্ত্রের নেতা। গণতন্ত্র হলো সভ্য মানুষের কারবার। এখানে মার-ধরের মতো অসভ্য কাজ হয় না।’
‘তাহলে কী করবেন?’
‘ওকে পিটুনিই দিতে হবে। কিন্তু সভ্য পিটুনি। গণতান্ত্রিক পিটুনি। আঘাত শরীরে লাগবে না, লাগবে অন্তরের গহিন ভিতরে।’
‘সেই আঘাত কী রকম?’
‘আছে, গণতন্ত্রে সেই রকম আঘাতের ব্যবস্থা আছে। সময় হলেই দেখতে পাবে।’
.
মেনো মাথা নিচু করে আছে। এথেন্সের মানুষ যে সক্রেটিসের সাথে এমন ব্যবহার করে, সেটি সে জানত না।
সক্রেটিস বললেন, দেখলে মেনো। এই হলো এথেন্সের অবস্থা। সে নাকি আবার নেতা! এথেন্সে কী সব মানুষ নেতা হচ্ছে। সে গালাগালি করে গেল।
মেনো বলল, ওর কথায় কী আসে যায়?
‘কিছুই আসে যায় না। ও যদি জানত যে, গালাগালির ফলে কী হতে পারে, তাহলে আর এসব করত না। ‘
‘তার মানে ঐ লোক ভালো-মন্দ জানে না। ও জ্ঞানহীন। জ্ঞানের অভাবেই আপনাকে গালাগালি করল।’
‘হ্যাঁ, জ্ঞানহীন। এরকম মানুষদেরই ভালো-মন্দের জ্ঞান শেখাতে হবে।’
‘কে শেখাবে?’
‘শেখাবেন জ্ঞানপ্রেমিকগণ, দার্শনিকগণ। তাদের কাছ থেকেই মানুষ সুন্দর জীবনের উপায় জানবে। যখন অনেক মানুষ সুন্দর জীবনের উপায় জেনে যাবে, সবাই মিলে সেই জীবনের অভ্যাস করবে, তখন জীবন সত্যিকার সুন্দর হবে।’
সক্রেটিস আবার বললেন, তবে জ্ঞান বিষয়ে আর একটি ব্যাপার আছে। মানুষ যখন জ্ঞানকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারে, তখন তাকে বলে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা কাউকে শেখানো যায় না। প্রজ্ঞা হলো স্বর্গীয় জিনিস। যে এটি পায়, সে আপনা-আপনি পায়। একটি অবস্থায় যাওয়ার পর আর কোনো শিক্ষক থাকে না।
এখানে সক্রেটিস একটু ধোঁয়াটে। মনে হয় এনিতাস সক্রেটিসের মাথা আউলা করে দিয়ে গেছে। মেনো মুখে বলছে যে, সে বুঝেছে। কিন্তু প্ৰজ্ঞা কী জিনিস সেটি সে বোঝেনি। সে ভাবছে আমার সব বুঝে কাজ নেই। প্রজ্ঞা ব্যাপারটা সক্রেটিস বুঝলেই হবে।
মেনো যা বুঝেছে, তাতেই সে সক্রেটিসের অনেক বড় ভক্ত হয়ে গেল। যে আশা নিয়ে সে এসেছিল, তা পূরণ হয়েছে। এখন থেসালিতে ফিরে গিয়ে সক্রেটিসের মতো করে কথা বলবে। তার মতো সবাইকে বলবে, জ্ঞানই হচ্ছে সদ্গুণ (Knowledge is Virtue), জ্ঞানই হচ্ছে শক্তি।
সক্রেটিসের সবকিছুই তার খুব ভালো লেগেছে।
মেনোর মতো অনেকেই এখন সক্রেটিসের কাছে আসে। দূর-দূরান্ত থেকে আসে। কয়েক দিন থাকে। সক্রেটিসের সাথে আলাপ করে। তার থেকে শিখে নিজের শহরে ফিরে গিয়ে সক্রেটিসের মতো কথা বলতে শুরু করে। এভাবে সক্রেটিসের কথা, তার ভাবনা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রিসের বিভিন্ন শহরে। গ্রিসের সকল নগরের মানুষ সক্রেটিসকে এক নামে চিনছে।
সক্রেটিস বিমূর্ত কোনো ধারণা নিয়ে কথা বলেন না, তার সবকিছু প্র্যাকটিক্যাল, কোনো কিছুই অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়। তিনি মানুষের জীবনের প্রতিদিনের সমস্যা, মনের উন্নতি এসব নিয়েই কথা বলেন। তিনি এমন জ্ঞানের কথা বলেন, যে জ্ঞানকে জীবনে ব্যবহার করা যায়। তাই তার কথা সহজ। অর্থ গভীর কিন্তু শুনতে খুবই সহজ। মানুষের কাছে মনে হয়, সে তার নিজের কথা শুনছে। তাই তরুণরা সক্রেটিসকে ভালোবাসে, দূর থেকে ছুটে আসে তার কাছে, দূরে নিয়ে যায় তার ভাবনা
***
১০০. খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮/৪২৭ অব্দে এথেন্স মিতিলিন শহর অবরোধ করে, যেটি ‘Siege of Mytilene ‘ নামে পরিচিত। তবে পরদিনই গণহত্যার আদেশ বাতিল করে, সেখানে গণহত্যা হয় নি।
১০১. এথেন্সের গণতন্ত্রের বিষয়ে সক্রেটিসের এই মনোভাব প্লেটো তার Protagoras নামক সংলাপে বলেছেন।
১০২. প্লেটো Meno নামে একটি ডায়ালগ লিখেছেন, যেখানে সক্রেটিস Virtue (সদগুণ) ব্যাখ্যা করেছেন। এই সংলাপে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মামলাকারী ‘এনিতাস’-এর সাথে তার কথা কাটাকাটির কথাও বিস্তারিত আছে।