হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৪

‘আমি শুধু একটি জিনিসই জানি,
সেটি হলো–আমি কিছুই জানি না।’

—সক্রেটিস

***

ডিওটিমার কাছে প্রেমের ক্লাস করার জন্য সক্রেটিস তাড়াহুড়া করে বাড়ি এসেছে। কিন্তু তার কপালে প্রেমের ক্লাস নেই। এখন যা চলছে সেটিকে বলা যায় মায়ের ঘ্যান ঘ্যান ক্লাস।

পৃথিবীর সব মা সন্তানকে একই ভাষায় বকা দেন। একই স্বরে ঘ্যান ঘ্যান করেন। বিধাতা মায়েদের ঘ্যান ঘ্যান করার এক অসীম ক্ষমতা দিয়েছেন।

এই মুহূর্তে সক্রেটিস তার মায়ের ঘ্যান ঘ্যান সহ্য করছে। ভর সন্ধ্যায় তার বাড়ি থাকার কথা নয়। সন্ধ্যাবেলা সক্রেটিস বাড়ির বারান্দায় বসে আছে— এমন ঘটনা কত বছর আগে হয়েছিল, মা মনে করতে পারছেন না। আজ শুধু ডিওটিমা খালার টানে ভর সন্ধ্যায় সক্রেটিস বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু খালার সাথে কথা শুরু করতে পারেনি।

বাড়ি আসতেই মা বকা শুরু করেছেন। ধর্মের বোন ডিওটিমাকে সামনে রেখে ছেলেকে শাসন করছেন। মায়ের বিস্তর অভিযোগ। একের পর এক বলে যাচ্ছেন। সক্রেটিসের মনে হচ্ছে, মা বুঝি একটি অনুষ্ঠান করছেন, অনুষ্ঠানের নাম ‘বিরতিহীন অভিযোগমালা’ কিংবা ‘আপনার নালিশ আপনার মুখে।

সক্রেটিস সব অভিযোগ নীরবে হজম করছে। হজম যাতে ভালো হয় সেজন্য সে মায়ের একেবারে পায়ের কাছে বসেছে। অবশ্য হজম না করে কোনো উপায় নেই। একটি অভিযোগও মিথ্যা নয়। একের পর এক অভিযোগ চলছে।

প্রথম অভিযোগ— সক্রেটিস সময়মতো বাড়ি ফেরে না। দিন নেই রাত নেই শুধু টো টো। পোশাক-আশাকের ঠিক-ঠিকানা নেই। খালি পায়ে সারা এথেন্স ঘোরে। বাড়ি ফেরে শেষ রাত্রে। কোনো কোনো রাতে বাড়ি ফিরেও না।

দ্বিতীয় অভিযোগ— সক্রেটিস বাবার সাথে মূর্তি বানাতে যায় না। বাবা বুড়ো হচ্ছেন। জোয়ান ছেলে পিতার কোনো কাজে আসছে না। সংসারে কোনো নজর নেই।

তৃতীয় অভিযোগ— সক্রেটিসের নামে তার বাবার কাছে প্রতিদিন নালিশ আসে। সক্রেটিস নাকি এথেন্সের বাচ্চাদের কুবুদ্ধি দেয়। উল্টাপাল্টা কথা শেখায়। তর্ক করতে শেখায়। এই নালিশ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। প্ৰথম প্ৰথম মাসে দুই একটি নালিশ আসত। তারপর সেটি সাপ্তাহিক হয়ে গেল। এখন দৈনিক। দিনে চার-পাঁচ জন ব্যক্তি তার বাবার কাছে নালিশ করে। সক্রেটিসের বাবা ছেলের নাম দিয়েছেন নালিশ কুমার।

নালিশ কুমারের নামে এই মুহূর্তে তার মা একের পর এক নালিশ করে যাচ্ছেন। থামাথামির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সক্রেটিস নীরব। মা বলছেন বলুক। মায়েরও তো দায়িত্ব আছে। মাতৃদায়িত্ব পালন করুক। সে মাঝে মাঝে আহ্লাদি মুখে মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। ভাবটা এমন যেন মাকে বলার সুযোগ দিয়ে ধন্য করছে। মা ভালোই ধন্য হচ্ছেন। মনের ঝাল মিটিয়ে বকা দিচ্ছেন।

কিন্তু সক্রেটিসকে বকা দিয়ে কোনো মজা নেই। কথার পিঠে কথা না হলে বকা দিয়ে সাধ মেটে? একলা একলা কতক্ষণ ঝগড়া করা যায়!

তবে মায়ের শান্তি এটুকু যে, ছেলে মা-বাবাকে অসম্মান করে না। এই বয়সেও চুপ করে মায়ের বকা শোনে। মুখে মুখে তর্ক করে না।

সক্রেটিসের মা একজন ধাত্রী। সন্তান জন্ম দিতে নারীদের সাহায্য করেন। তাঁর নাম ফেনারিটি। সক্রেটিসের বাবা একজন রাজমিস্ত্রি। মাঝে মাঝে মূর্তি ও বানান। বাবার নাম সফ্রোনিকাস। তাদের সুন্দর পাড়াটির নাম এলোপেকি। এথেন্সে নামের সাথে এলাকার নাম যোগ করে পুরো নাম হয়। সেই হিসেবে সক্রেটিসের পুরো নাম সক্রেটিস এলোপেকিথেন (Socrates Alopekethen)।

এই পাড়ায় একটু কম আয়ের মানুষ বাস করে। তাদের বেশিরভাগই রাজমিস্ত্রি। সক্রেটিসের বাবাও রাজমিস্ত্রি। তার অল্প কিছু জমি-জমা আছে। তাতে জলপাই হয়। এছাড়া ঘর বানানো, মূর্তি বানানো— যখন যেটি পান, সেটিই করেন। সংসার মোটামুটি চলে যায়। এই মধ্যবিত্ত পাড়ায় একমাত্র ধনী ক্রিতোর পরিবার। যেমন তেমন ধনী নয়, একেবারে মহাধনী। এথেন্সের সেরা পাঁচজন ধনীর মধ্যে ক্রিতোর বাবা একজন।

সক্রেটিসের বাবাও আজ বাড়ি আছেন। তিনি ঘরে বসে স্ত্রীর গালি শুনছেন। বাবার মজাই লাগছে। শুধু ডিওটিমার সামনে ছেলেটাকে উল্টা-পাল্টা বলছে, সেটি একটু খারাপ লাগছে। কী আর করা! স্ত্রী-বুদ্ধি সব সময়ই প্রলয়ংকরী।

বাবার সাথে সক্রেটিসের কথাবার্তা তেমন হয় না। তার কারণ এই বয়সে পিতা-পুত্র আলাপ করলে অবশ্যই টাকা-পয়সার কথা উঠবে, সংসারের কথা উঠবে। কিন্তু সক্রেটিসের জীবনে টাকা-পয়সার কোনো প্রয়োজন নেই। সংসার তার কাছে ঝামেলা। তাই পিতা এখন আর সক্রেটিসকে ঘাঁটান না। পিতা জানেন সক্রেটিস বৈরাগী স্বভাবের। তার বৈরাগী মন বাবার জন্য বড় কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো ইদানীং লোকজন প্রতিদিন ছেলের নামে নালিশ করছে। সক্রেটিস নাকি এথেন্সের ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথা নষ্ট করছে। এই নালিশ নিয়ে পিতা মাঝে মাঝে সক্রেটিসকে তলব করেন।

বাবা বললেন, কী রে, তুই নাকি ক্রিতোকে নষ্ট করে ফেলছিস?

‘কী করে ফেলছি?’

‘কান কি ঠসা হইছে? নষ্ট করে ফেলছিস।’

‘নষ্ট করা মানে কী?’

‘নষ্ট করা মানে কুপথে নিয়ে যাচ্ছিস।’

‘কুপথ কী?’

আর সহ্য হলো না। বাপের সাথেও প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা! ঠাস করে একটি চড় দিলেন সক্রেটিসকে। তার বাম গাল লাল হয়ে গেল।

গালে হাত বুলিয়ে হাসি মুখে সক্রেটিস বলল, বাবা, এই গালে আরেকটা চড় দেন। আপনি আমার বাবা। শাসন তো করবেনই। তবু বলেন, কুপথ মানে কী? আমি ক্রিতোকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছি?

এই প্রশ্নের উত্তর পিতার কাছে নেই। তিনি জানেন তার ছেলে জ্ঞানপ্রেমী। ছেলের বন্ধুরাও তাই। এরা কেউ কুপথে যায়নি। এরা সারাদিন জ্ঞান নিয়ে থাকে। পারলে জ্ঞান খায়, জ্ঞানকে বালিশ বানিয়ে ঘুমায়, আবার ঘুমের মধ্যে জ্ঞান নিয়েই স্বপ্ন দেখে। এদের কোনো কুঅভ্যাস নেই। এদের চেয়ে ভালো ছেলে এথেন্সে আর একটিও নেই।

ছেলেকে থাপ্পড় দিয়ে বাবার খারাপ লাগছে। তিনি ডিওটিমার সামনে ছেলেকে চড় দিলেন! ছিঃ ছিঃ, একটু আগে ভাবছিলেন স্ত্রী-বুদ্ধি প্রলয়ংকরী। আর এখন তিনি নিজেই অবুদ্ধিমানের কাজ করলেন! তার মানে শুধু স্ত্রী-বুদ্ধিই না, স্বামী-বুদ্ধিও প্রলয়ংকরী হতে পারে।

মনে মনে তিনি ছেলেকে সমীহ করেন। সক্রেটিস তার ছেলে— এটি ভেবে তার গর্বও হয়। কোত্থেকে যে ছেলে এত কিছু জানে! ঐ ছোট্ট মাথায় এত চিন্তা কী করে আসে! শহরের সবাই তার ছেলেকে নিয়ে আলাপ করে। দূর থেকে তাকে দেখলে বলে, ‘ঐ যে, উনি সক্রেটিসের বাবা।’ ছেলের বয়স বিশ বছর না হতেই, মানুষ তাকে ছেলের পরিচয়ে চিনছে। তার নিজের নাম লোকে ভুলে যাচ্ছে। সফ্রোনিকাস নামে এখন আর তেমন কেউ তাকে ডাকে না। সবাই বলে, সক্রেটিসের বাবা।

বাবা সক্রেটিসকে বললেন, শোনো, আমি আর তোমার নামে নালিশ শুনতে চাই না। ত্যক্ত হয়ে গেছি। সারাদিন নালিশ আর নালিশ। তুমি তো আর সক্রেটিস নেই, তুমি হয়ে গেছো নালিশ কুমার। আমি এখন আর সক্রেটিসের বাপ না, নালিশ কুমারের বাপ

সক্রেটিস বলল, বাবা, নালিশ মানে কী?

এবার পিতার মনে হলো— এই শয়তানকে দুই গালেই থাপ্পড় দেওয়া দরকার। একে সারাদিন থাপ্পড়ের ওপর রাখলে ঠিক হবে।

পিতা অন্য কাজে মন দিলেন। এর সাথে আলাপ করে কোনো লাভ নেই। মানুষ অধিক শোকে পাথর হয়ে যায়। সক্রেটিসের পিতা অল্প শোকেই পাথর হয়ে গেছেন। শুধু মাঝে মাঝে পাথর স্বভাব ত্যাগ করে সক্রেটিসকে বলেন, জনাব নালিশ কুমার, আজ আপনার নামে পাঁচখানা নালিশ এসেছে, গতকাল ছিল সাতখানা।

তবে পিতা জানেন তার ছেলে আলাদা রকমের। এই ছেলে সময়ের চেয়ে আগানো এক মানুষ। এ রকম মানুষের পিতা হওয়া খুব সৌভাগ্যের, আবার একই সাথে খুবই দুর্ভাগ্যের। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই হোক পিতা মেনে নিয়েছেন। তিনি আর সক্রেটিসকে বকাঝকা করেন না। বকাঝকা যা করার, মা-ই করেন।

ছেলের জন্মের পর মা নাম রেখেছিলেন সক্রেটিস (Socrates)। গ্রিক শব্দ Sos আর Kratos মিলিয়ে হয় Socrates, Sos মানে নিরাপদ আর Kratos মানে শক্তিশালী। মা-বাবা চেয়েছিলেন ছেলে সুস্থ, সবল আর নিরাপদ হোক।

ছেলে অবশ্যই সুস্থ-সবল হয়েছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি হয়েছে আলাভোলা। তার বৈরাগী স্বভাব। কোনোকিছুতেই মন নেই। নিজের খেয়ালে থাকে। পড়াশুনায় ভালো। বই পড়তে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সংসারে মন নেই। প্রথম প্রথম বাবা মারতেন। অনেক দিন পিটিয়েছেন। কোনো লাভ হয়নি। বাবা বুঝে গেছেন যে তার ছেলের ধরনই ঐরকম, মার-ধর করে লাভ হবে না।

ছেলের ভবিষ্যৎ জানতে বাবা একবার ডেলফিতে গিয়েছিলেন। ডেলফির মন্দিরে জানতে চেয়েছিলেন— সক্রেটিসকে নিয়ে কী করা উচিত!

ডেলফির ওরাকল বলেছেন, এই ছেলে যা করতে চায়, করতে দাও। বাধা দিও না। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। এই ছেলের নাম পৃথিবীতে রয়ে যাবে। ওকে বদলানোর চেষ্টা বৃথা।

এখানে সবাই জানে ডেলফির ওরাকল যা বলেন, তা কখনো মিথ্যা হয় না। তাই বাবা-মা মেনে নিয়েছেন। সক্রেটিস এমনই। সে বৈরাগী স্বভাবের। তার মন সব সময় উচাটন। সে ঘরে থাকে। কিন্তু আসলে সে একজন বাউল এথেন্সের নগর-বাউল।

.

মা এখনও বকে যাচ্ছেন। ডিওটিমাকে সাক্ষী রেখে বকছেন। পাতানো বোনকে পেয়ে মায়ের জোর বেড়ে গেছে। এই কয়দিনেই ডিওটিমা তাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছেন।

মা ডিওটিমাকে বললেন, তুমি ওরে কিছু বলো। নালিশ কুমার তোমারে খুব মানে।

ডিওটিমা ভাবছেন। কোন্ পক্ষ নিলে সুবিধা হবে সেটি বুঝতে পারছেন না। সক্রেটিসকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। সক্রেটিসের কোনো দোষ তার চোখে ধরা পড়ে না। এত ভালো ছেলে কদাচিৎ জন্মে। কিন্তু ছেলেটা কাজ-কর্ম করছে না। এটি ঠিক হচ্ছে না।

ডিওটিমা বললেন, নালিশ কুমার নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। নামটার মধ্যে একটি মায়া আছে।

সক্রেটিস বলল, এই নামে আমারও কোনো আপত্তি নেই।

ডিওটিমা বলল, নামে আপত্তি নেই, আপত্তি শুধু কাজে? জনাব, তোমার জন্য কাজ ঠিক করা হয়েছে। নালিশ কুমারকে এখন থেকে কাজ করতে হবে।

সক্রেটিস বলল, কাজ?

‘হুম, তুমি যেটি পার— সেই কাজ। মূর্তি বানানো। তোমার বাবা একটি সরকারি কাজ পেয়েছেন। এক্রোপলিসের সামনে মূর্তি বানাতে হবে। কারিগর হিসেবে তোমার নাম দিয়েছেন।’

‘আমার নাম দিয়েছেন? তাহলে নিশ্চিত থাক, বাবা কাজটা পাবেন না। আমাকে কাজ দেবে এমন লোক এথেন্সে নেই। এখানে সক্রেটিসের নামে সবাই ভয়ে অস্থির।’

‘জি না, ভয় পায়নি। তোমরা কাজটা পেয়ে গেছো। কারিগর হিসেবে তুমি পাস করেছো। কাজের আদেশ আছে তোমার বাবার কাছে। আগামী সোমবার থেকে শুরু।’

সক্রেটিসের বিশ্বাস হচ্ছে না। এথেন্সে তাকে কাজ দেওয়ার লোক এখনও আছে? সে বাবার হাত থেকে পেপিরাস কাগজ নিল। সরকারি সিল দেওয়া পেপিরাস, তাতে লেখা—

কাজ : তিন অপ্সরার মূর্তি।
স্থান : এক্রোপলিসের সদর দরজার ডানে।
ঠিকাদার : সফ্রোনিকাস[১৯], ঠিকানা : এলোপেকি
কারিগর : সক্রেটিস সফ্রোনিকাস, ঠিকানা : এলোপেকি
শেষ করার সম্ভাব্য সময় : তিন চন্দ্রমাস

—স্বাক্ষর
ফিডিয়াস[২০]
এথেন্স নগর সরকারের প্রধান ভাস্কর।

তার মানে এথেন্সের এক নম্বর ভাস্কর ফিডিয়াসের থেকে কাজ পেয়েছেন তার বাবা। বাবার সাথে ফিডিয়াসের পরিচয় আছে। ফিডিয়াস সাহেবই কাজটা দিয়েছেন। অন্য কেউ সক্রেটিসকে কাজ দিত না।

এতক্ষণে সক্রেটিস ঘটনা বুঝতে পারল। তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কাজের ফাঁদ। বাবা তার জন্য কাজ ঠিক করেছেন। সে যদি রাজি না হয়, সেজন্য ডিওটিমা খালাকে বাড়িতে ডেকেছেন। ডিওটিমা খালার কথা সক্রেটিস ফেলতে পারবে না। সেজন্যই এত আয়োজন। এখন আর রাজি না হয়ে উপায় নেই।

সক্রেটিস রাজি হলো। একবার যখন রাজি হয়েছে, সে কাজটা করবে। যে কাজ সে ভালোবাসে, সেটি নিয়ে সে দিন-রাত পড়ে থাকে।

সক্রেটিসের মা-বাবা খুব খুশি। ছেলের কাজে মতি হয়েছে। নতুন কাজও পেয়েছে। আগামীকাল তারা দেবী এথিনার মন্দিরে যাবেন। দেবীকে ভক্তি করতে হবে। দেবীর ইচ্ছাতেই ছেলের সুমতি হয়েছে।

মা বললেন, সক্রেটিস, তুইও মন্দিরে চল্।

সক্রেটিস বলল, মা, মন্দির-ফন্দিরে আমি যাব না। ‘কেন?’

‘ঐ যে আমাদের বাড়ির পাশে আফ্রোদিতির মন্দির। সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি। আমাদের পাড়ার দেবী। আমি জন্মানোর আগে তুমি নিশ্চয়ই ঐ মন্দিরে গিয়েছ!’

‘হ্যাঁ, অনেকবার গিয়েছি।’

‘সৌন্দর্যের দেবীর কাছে নিশ্চয়ই একটি সুশ্রী শিশু চেয়েছো।’

‘হ্যাঁ, চেয়েছি।’

এথিনার মন্দির ‘পার্থেনন’ নকশা করেছিলেন।

‘কিন্তু সৌন্দর্যের দেবী তোমাকে একটি সুশ্রী শিশু দেননি। আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো— দেবী তোমাকে কী রকম একটি বখত ছেলে দিয়েছেন।’

‘মানে? কী বলতে চাচ্ছিস?’

‘বলতে চাই— সেদিন দেবী তোমার কথা রাখেননি। দেবীরা কারও আবদার রাখেন না। দেবী-টেবীকে ভক্তি করে কোনো লাভ নেই।’

সক্রেটিসের মা কানে হাত দিয়ে বললেন, চুপ কর! এমন কথা বলতে নেই। তোকে মন্দিরে যেতে হবে না। কিন্তু এসব কথা কোনোদিন বলবি না। দেবী রাগ করবেন।

দেবী যাতে রাগ না করেন সেজন্য মা বারবার হাতজোড় করে দেবীর কাছে মাফ চাইতে লাগলেন।

বাবা বললেন, দেবী রাগ করুক আর না করুক, এসব কথা শুনলে এথেন্সের মানুষ রাগ করবে। সাবধান, আর কোনোদিন দেব-দেবীর নিন্দা করবে না। কেউ শুনলে কিন্তু মামলা করে দেবে। ভয়ংকর বিপদ হবে।

সক্রেটিস কিছুই বলছে না। মুচকি মুচকি হাসছে।

বাবা আবার বললেন, তুমি সারাদিন জ্ঞান জ্ঞান করো। নানান বিলকি – ছিলকি বলো। আমি কিছুই বলি না। কিন্তু কোনোকিছুতে যেন দেবতাদের নিন্দা না হয়। এথেন্স খুব ভয়ংকর জায়গা। বুঝেছো?

‘বুঝেছি।’

‘কী বুঝেছ?’

‘বুঝেছি, এথেন্স খুব ভয়ংকর জায়গা। দেবতার নিন্দা সহ্য করবে না। মামলা করে দিবে।’

বাবার আর কিছুই বলার নেই। তিনি কাজে বেরিয়ে গেলেন। মা ঘরের কাজ করতে অন্য দিকে গেলেন।

সক্রেটিস এতক্ষণে ডিওটিমা খালাকে একটু একা পেল। সে অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল। খালাকে একা পেলেই প্রেমের ক্লাস শুরু করবে। সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেলবে, ‘খালা, ভালোবাসা কারে কয়?’

কিন্তু সেটি আর হলো না। ডিওটিমার সাঙ্গাপাঙ্গরা এসে হাজির। আজ সন্ধ্যায় উত্তর পাড়ায় ডিওটিমার ধর্মসভা আছে। অনেক ভক্ত অপেক্ষা করছে তার মুখের কথা শোনার জন্য।

ডিওটিমা বলল, সক্রেটিস তুমি একদিন বিকেলে আমার আখড়ায় এসো। নিরিবিলি কথা বলব।

ডিওটিমা চলে গেলেন।

একটু পরই ক্রিতো এসে হাজির।

ক্রিতো বলল, কই, ডিওটিমা খালা কই? প্রেমের ক্লাস শেষ?

ক্রিতোর জন্য মায়া হলো সক্রেটিসের। বেচারা বড় আশা করে এই রাতেই চলে এসেছে প্রেমের কথা শুনতে। সক্রেটিস তাকে নিয়ে বের হলো। বাড়ির পাশের পাহাড়ের তলায় বসল।

তার মন কিঞ্চিৎ খারাপ। মা-বাবার বকা তার গায়ে লাগে না। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে বোঝে না, কেউ বোঝে না। মন হু হু করে ওঠে।

আকাশে অনেক তারা। পাহাড় থেকে সাগর দেখা যায়। মনে হচ্ছে আকাশ ভরা তারা নিয়ে রাতের পৃথিবী সাগরকে ছুঁতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। অনেক দিনের বিরহী সাগর কাঁদছে। নিরালা বাতাসে ভেসে আসছে সাগরের কান্নার শব্দ। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে।

সক্রেটিস একটি বাঁশি বের করল। সে বাঁশি বাজাতে জানে না। বাঁশি বাজায় ক্রিতো। ক্রিতো বাঁশিতে সুর তুলল। একাকী নিশুতির বিরহের সুর। কেন বিরহের সুর তুলল কেউ জানে না। যে কেউ বলবে, এটি সক্রেটিস ও ক্রিতোর দুঃখ-বিলাস। এদের কোনো দুঃখ নেই। তবু মানুষ দুঃখজীবী প্রাণী মানুষের অন্তরে একটি দুঃখ-কোঠা আছে। সেই কোঠায় সব সময়ই কিছু না কিছু দুঃখ থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষেরও একটি দুঃখ-কোঠা আছে। সেখানে কারণে অকারণে বাঁশি বাজে। বিরহের বাঁশি।

ক্রিতো অনেকক্ষণ বাঁশি বাজালো। বাঁশি বন্ধ হলে সক্রেটিস বলল, সুর আত্মাকে শুদ্ধ করে, একটি আবছা অলস উদাসীনতা নিয়ে আসে।

ক্রিতো বলল, এই কথাটা নাকি পিথাগোরাস[২১] বলতেন। ছোটবেলায় প্রথম যখন বাঁশি শিখি, তখন ওস্তাদজি আমাকে পিথাগোরাসের একটি বই দিয়েছিলেন। ছোট্ট বই। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। পিথাগোরাস বীণা বাজাতেন। সেই বীণা তিনি নিজ হাতে তৈরি করতেন। গণিতের হিসাব দিয়ে তিনি বীণা বানাতেন। তিনি বলতেন, সংগীত হলো পুরোপুরি গণিতের মতো। তিনিই প্রথম বের করেছিলেন, যন্ত্রের তারগুলো মাপ মতো বসাতে পারলে ভিন্ন ভিন্ন সুর হয়, হারমোনি তৈরি হয়। এই তত্ত্ব দিয়ে তিনি নিজেই বীণা বানিয়েছিলেন। আজ আমরা যেসব বীণা দেখি, সেগুলো আসলে পিথাগোরাসের সেই তত্ত্ব অনুযায়ী বানানো। সংগীতের যন্ত্র বানানোর আধুনিক উপায় তিনিই শিখিয়েছেন।

সক্রেটিস বলল, হ্যাঁ, তার বই পড়ে আমার খুব গান শিখতে ইচ্ছে হয়েছিল। ভীষণ ইচ্ছা। কিন্তু হলো না। আমি না পারি গাইতে, না পারি কিছু বাজাতে। সুর আমার আসে না। সুরের দেবী সবার প্রেমে পড়ে না।

ক্রিতো বলল, তোমার অন্তরে যে সুর আছে, সেটি পৃথিবীর যেকোনো সংগীতের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। সেই সুর তরুণদের নতুন স্বপ্ন দেখায়। নতুন পথের দিশা দেখায়।

রাত গভীর হচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক থেমে গেছে।

ঘরে ফেরার সময় ক্রিতো বলল, কাল সকালে দাস বাজারে যাব। কয়েকজন দাস কিনতে হবে। যাবে নাকি আমার সাথে?

দাস বাজারে সক্রেটিসের কোনো কাজ নেই। সে ধনী নয়। দাস কেনার টাকা নেই। অন্য সময় হলে সে একবাক্যে নিষেধ করে দিত। কিন্তু এখন তার মন তরল। সে যাবে ক্রিতোর সাথে দাস বাজারে।

***

১৯. সফ্রোনিকাস : সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিকাস। মায়ের নাম ফেনারিটি।

২০. ফিডিয়াস : এথেন্সের প্রধান ভাস্কর ও স্থপতি। তিনি এথেন্সের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপনা দেবী।

২১. পিথাগোরাস : Pythagoras, সক্রেটিস-পূর্ব যুগের দার্শনিক। জ্যামিতি, সংগীত ইত্যাদি নিয়ে তিনি মৌলিক কাজ করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *