৩৯
‘মানুষমাত্রই ভুল করে, কিন্তু যে ভুল বুঝতে
পারামাত্র সংশোধন করে, সেই হলো ভালো মানুষ।
মানুষের একমাত্র অপরাধ অহংকার।’
—সফোক্লিস
***
দিনে দিনে প্লেগ ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
মিনিটে মিনিটে মানুষ মরছে। প্রতি ঘরে ঘরে মরছে। যত দিন যাচ্ছে মৃত্যু বাড়ছে। যেন ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল। এথেন্স খালি হয়ে যাচ্ছে। গরিব ধনী কেউ বাদ যাচ্ছে না। তাজা ছেলে মায়ের সামনে ছটফট করছে। সুন্দর মুখের কচি মেয়ে রক্ত-বমি করছে। মা কিছু করতে পারছেন না, বাবা বুক চাপড়াচ্ছে। কোনো উপায় নেই। এই প্লেগ যাকে ধরছে, সেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো আগেই মরে শেষ। সারা এথেন্সে আর মনে হয় একটি বাচ্চাও বেঁচে নেই। কোনো ঘর থেকে এখন আর কোনো শিশুর কান্না শোনা যায় না।
পেরিক্লিস দিন-রাত ঘুরছেন। সারা এথেন্স চষে বেড়াচ্ছেন। ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। আগে তিনি কোনোদিন কারও বাড়ি যেতেন না। কত লোক তাকে সিম্পোজিয়ামে দাওয়াত দিত, তিনি কারও বাড়ি যাননি। এখন তিনি সবার ঘরে ছুটছেন। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে আক্রান্ত মানুষদের দেখছেন। তার দুই ছেলে তার সাথে সবখানে যায়। পেরিক্লিস মানুষের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। হাত ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ভরসা দিচ্ছেন। আশার কথা বলছেন।
পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে তিনি বলছেন, ভাই আর একটু ধৈর্য ধরো। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। বরং পেরিক্লিসের নিজের ঘরেই চলে এলো প্লেগ। তার প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলেকে একসাথে প্লেগে ধরল।
তাগড়া যুবক ছেলে দুটি। বড়টি হুবহু পেরিক্লিসের মতো দেখতে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বাবা বাবা বলে চিৎকার করে বলছে, ‘কষ্ট, অনেক কষ্ট। বুক জ্বলে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট, বাবা।’
পেরিক্লিসের বুক ফেটে যাচ্ছে। তিনি এদিক ওদিক ছুটছেন। যে যা বলছে সব করছেন। যত রকম তুকতাক আছে সব চলছে।
আসপাশিয়া রাত-দিন খাটছে। ছোটাছুটি করছে। ছোট ছেলে বলছে, ‘মা, বাঁচাও, আমি বাঁচতে চাই।’ আসপাশিয়া ছেলেদের জন্য সবকিছু করছে। দুই ছেলের জন্য বারো জন দাস-দাসী সব সময় তৈরি আছে। তারা পাগলের মতন খাটছে।
পেরিক্লিসও অনেক খাটছেন। তিনি নিজেই ছেলেদের মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন। সারা গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। বাবার ছোঁয়ায় যদি একটু কষ্ট কমে।
কিন্তু কষ্ট কমছে না। বরং দিনে দিনে বাড়ছে। এমন ভয়াবহ দিন পেরিক্লিসের বাড়িতে আগে আসেনি। সারা দিন চিৎকার করছে দুটি জোয়ান ছেলে। বলছে, আর পারছি না বাবা। মেরে ফেলো। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও। আমার সারা গা জ্বলছে। গলা জ্বলছে। চোখ দুটি বের হয়ে আসছে। মাথা তুলতে পারছি না। আমাকে মেরে ফেলো।
এক সন্ধ্যায় পেরিক্লিস বুঝলেন যে ছেলেদের সময় শেষ। তিনি তাদের মাকে আনতে লোক পাঠালেন। তাদের মা এসে সারা রাত দুই ছেলেকে জড়িয়ে রইলেন। কিছুতেই যেতে দেবেন না। কিন্তু ভোরবেলা আর ধরে রাখতে পারলেন না। সকালেই মারা গেল দুই ছেলে। একজন ঊষালগ্নে, আর একজন কয়েক ঘণ্টা পরে। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল পেরিক্লিসের বংশধর। জিউসের মতো যার শক্তি, সেই পেরিক্লিস কিছুই করতে পারলেন না। চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দাফন করে এলেন।
বাড়ি ফিরে ছটফট করছেন পেরিক্লিস। আসপাশিয়া বিলাপ করে কাঁদছে। ছেলে দুটি তাকে বড় গলায় মা বলে ডাকত। অল্প বয়সেই দুটি বড় বড় ছেলের মা হয়েছিল আসপাশিয়া, কিন্তু কপালে সইল না।
.
বিকেলে আসপাশিয়া ধীরে ধীরে পেরিক্লিসকে বলল, তোমার কোনো উত্তরাধিকারী রইল না।
পেরিক্লিস তার দিকে তাকিয়ে রইল।
আসপাশিয়া আবার বলল, এই যে এত সম্পদ তোমার, কে খাবে? খাওয়ার লোক কই?
কথা সত্য। পেরিক্লিসের দুই ছেলে মারা গেছে। এক ছেলে আছে। সেই ছেলে আসপাশিয়ার। তার নামও পেরিক্লিস। লোকে বলে পেরিক্লিস নম্বর দুই। কিন্তু এই পেরিক্লিস নম্বর দুই এথেন্সের নাগরিক নয়। এথেন্সের নিয়মে বাবা-মা দুজনই এথেন্সের নাগরিক হলেই শুধু সন্তান এথেন্সের নাগরিক হবে। সেই হিসেবে আসপাশিয়ার সন্তান এথেন্সের নাগরিক নয়। তাই পেরিক্লিসের সম্পদের উত্তরাধিকারীও সে হতে পারবে না।
আসপাশিয়া অনেকক্ষণ হাউমাউ করে কাঁদল। পেরিক্লিস কোনো রকমে তাকে শান্ত করলেন। কিছুক্ষণ কেটে গেল। কারও মুখে কথা নেই।
আসপাশিয়া খুব নিচু স্বরে বলল, একটি উপায় আছে তোমার উত্তরাধিকারী হওয়ার।
পেরিক্লিস মুখ তুলে তাকালেন।
আসপাশিয়া আবার বলল, আমাদের ছেলে তোমার ওয়ারিশ হতে পারে। ‘কীভাবে?’
‘যদি সংসদে পাস করানো যায়।’
‘সেটি কীভাবে?’
‘তোমার জীবনে কী ঘটছে সবাই জানে। এখন তুমি যা চাইবে, মানুষ তাতেই ভোট দেবে। তুমি যদি সংসদে একবার গিয়ে অনুরোধ করো যে তোমার ওয়ারিশ নেই, এথেন্সে তোমার চিহ্ন মুছে যাচ্ছে। তারা যেন আমাদের ছেলেকে নাগরিকত্ব দেয়।’
পেরিক্লিস তাকালেন আসপাশিয়ার দিকে। সে কী বলছে? আসপাশিয়া কি সৎ ছেলেদের মৃত্যুতে খুশি হয়েছে? এই সুযোগে তার পেটের ছেলের জন্য জায়গা বানাতে চাইছে? নাকি সে রাজনীতির মাঠের পাক্কা খেলোয়াড়? বিপদেও রাজনীতি বুঝে চলতে চাইছে। নাকি সে সত্যিই পেরিক্লিসকে ভালোবেসে এমন বলছে?
পেরিক্লিস বুঝতে পারছেন না। তারা মাথা কাজ করছে না। তবে আসপাশিয়া যে বুদ্ধি দিয়েছে, তার চেয়ে অন্য কিছু তার মাথায় আসছে না।
তিনি বললেন, ঠিক আছে, যদি পার, একটি বক্তৃতা তৈরি কর। আমি আমার ছেলের জন্য নাগরিকত্ব চাইব। যারা চলে গেছে, তাদের তো আর পাব না। যে বেঁচে আছে, সেটিকে যদি রেখে যেতে পারি।
সেই রাতে আসপাশিয়া ঘুমাল না। তার দুটি কাজ। দুটিই মহা গুরুত্বপূর্ণ। এক. পেরিক্লিসের জন্য বক্তৃতা লিখে দেওয়া। তার ছেলেকে নাগরিক বানানোর জন্য বক্তৃতা। সেটি সারা রাত বসে লিখবে আসপাশিয়া। তার আগে আরেকটি কাজ করতে হবে। তার পরিচিত সব মানুষকে খবর দিতে হবে যাতে তারা কাল অবশ্যই সংসদে গিয়ে পেরিক্লিসের পক্ষে ভোট দেয়। আসপাশিয়া একজন দাসকে ডেকে লিখতে বসল। যাদের কাছে আজ সন্ধ্যায়ই খবর দিতে হবে। সে বলছে আর দাস লিখছে— সক্রেটিস, ক্রিতো, চেরোফোন, সফোক্লিস, এনিতাস… অনেক লম্বা লিস্ট।
আসপাশিয়া ছোট্ট একটি চিঠি লিখে দিল। অনেকগুলো দাস সেটি কপি করবে। চিঠিগুলো সবার কাছে দিয়ে আসবে আগামী দুই ঘণ্টার মধ্যে।
আর একটি চিঠি লিখল সংসদের স্পিকারের জন্য। এটি স্বাক্ষর করবে পেরিক্লিস। সংসদের স্পিকারকে বলা হচ্ছে কাল সকালে আলোচনার তালিকায় নতুন একটি বিষয় থাকবে। নতুন একটি বিল আসবে সংসদে। পেরিক্লিস নম্বর দুইয়ের নাগরিকত্ব বিষয়ে বিল।
পরদিন খুব সকালে পিনিক্স পাহাড়ে চলে গেলেন পেরিক্লিস। সকলের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন, ভাইয়েরা, এথেন্স মরে যাচ্ছে। আমরা সবাই মরে যাচ্ছি। তোমরা জানো আমার ছেলেরা নেই। আমার কোনো উত্তরসূরি নেই। তোমরা আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দাও।
সংসদে লোক কম এসেছে। এই বিপদের দিনে যার কাজ নেই, সে আসেনি। যারা এসেছে, তাদের মধ্যে পেরিক্লিসের পক্ষের লোকই বেশি। আসপাশিয়ার চিঠি পেয়ে তাদের কাছের লোকেরা দলে দলে এসেছে। তারা ফিসফাস করছে।
পেরিক্লিস বললেন, আমার আরেক ছেলে আছে। ওর নামও পেরিক্লিস। তোমরা চাইলে সে আমার ওয়ারিশ হতে পারে। ওকে তোমরা এথেন্সের নাগরিক করে নাও। এথেন্সে পেরিক্লিসের একটি চিহ্ন থাকুক। আমি তোমাদের অনুরোধ করছি। এই বিপদে পাশে দাঁড়াও।
বলতে বলতে তার চোখে আবার পানি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার সংসদে কাঁদলেন তিনি। তার কান্নার দাম আছে এথেন্সে। দাম ফেরত পেলেন পেরিক্লিস।
তাকে সমর্থন করে অনেকেই বক্তৃতা দিল। এনিতাস বলল, ভাইয়েরা, পেরিক্লিস আর আসপাশিয়ার ছেলে মানে তো আসলে এথেন্সের রক্ত। তাকিয়ে দ্যাখো ঘরে ঘরে আমাদের যুবকরা মারা যাচ্ছে। এথেন্স যুবকশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আসো, ভাইয়েরা, আমরা এথেন্সের মুখের দিকে চেয়ে পেরিক্লিস নম্বর দুইকে এথেন্সের নাগরিক করে নিই।
আজ অনেক দিন পরে আবার সংসদে এসেছে সক্রেটিস। তার কাছে এটি হলো ব্যাঙের মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ গণতন্ত্র। এখানে সে আসে না। আজ শুধু আসপাশিয়ার কথায় তার ছেলের জন্য ভোট দিতে এসেছে। সব সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে দুই হাত তুলে ভোট দেবে। তারা চিৎকার করে বারবার বলেছে— হ্যাঁ ভোট, হ্যাঁ ভোট।
ভোটে বিরোধীরা পাত্তা পেল না। পেরিক্লিস নম্বর দুই এথেন্সের নাগরিকত্ব পেল। তাকে ডেকে পরিচয়পত্র দেওয়া হলো। পেপিরাস কাগজে সিল দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো নতুন পরিচয়পত্র :
নাম : পেরিক্লিস
মহল্লা : হোলারগোস
পিতা : পেরিক্লিস
মাতা : …
(মাতার ঘর খালি, তার মা এথেন্সের নাগরিক নন)
নতুন পরিচয়পত্র নিয়ে সে বাড়ি ফিরছে। সাথে ফুফাত ভাই এলসিবিয়াডিস। সেও কাল রাত থেকে অনেক চেষ্টা করে ছোটাছুটি করে লোক নিয়ে এসেছে ভোট দিতে। ভোটে জিতে সে খুশি। কিন্তু মুখ বেজার অন্য কারণে।
তিতা মুখে এলসিবিয়াডিস বলল, এটি কিছু হলো? তোর বাপ হলো এথেন্সের মা-বাপ। তার কথায়ই মানুষ ওঠে-বসে। সে হলো দেবতা জিউস। রাজার থেকে বড় রাজা। তুই হলি রাজার ছেলে। রাজকুমার। রাজকুমারকে নাগরিকত্ব দিতে রাজাকে মানুষের সামনে কাঁদতে হয়? তোর বাপ একটি বোকা। সে সারা জীবন এসব গণতন্ত্র-টনতন্ত্র বলে বলে নষ্ট করল। এসব করে না পারল নিজে কিছু করতে, না দিল আমাদের কিছু করতে।
পেরিক্লিস নম্বর দুই কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বলল, আমার বাবা কোন দোষ করেছে?
এলসিবিয়াডিস বলল, না, তোর বাপ কোনো দোষ করেনি, সব দোষ আমার। আমার দোষ আমি চাই তোর বাপ রাজা হয়ে যাক। এসব গণতন্ত্ৰ বাদ দিক। তিনি না পারলে আমাদের বলুক। আমরা লোক জড়ো করব। আমিই সব করব।
পেরিক্লিস নম্বর দুইয়ের বয়স কম হলেও বুদ্ধিতে অন্তত এলসিবিয়াডিসের চেয়ে ভালো। সে বলল, এখন চুপ করো। মানুষে শুনলে বাবার বিপদ হবে। তার চেয়ে চলো বাড়ি যাই। মাকে পরিচয়পত্রটা দেখিয়ে আসি।
এলসিবিয়াডিস বলল, হুঁম, ঠিক বলেছিস, তুই যে বুদ্ধিমতী আসপাশিয়ার ছেলে সেটি বোঝা যায়। তোর মাথায় ঘিলু আছে। যা, তুই বাড়ি যা। দাসদের সাথে চলে যা। বাড়ি গিয়ে মাকে সালাম কর। এই পরিচয়পত্র আসলে পেয়েছে তোর মা। জিতেছে বুদ্ধিমতী আসপাশিয়া। তুই তো দুধ-ভাত।
‘তুমি যাবে না?’
‘না, আমি একটু সক্রেটিসের কাছে যাই। সে আজ দলবল নিয়ে এসেছে। আমাদেরকে ভোট দিয়েছে। তার সাথে একটু সাক্ষাৎ করে আসি।’
.
প্লেগের ভয়ে দলে দলে মানুষ এথেন্স ছেড়ে যাচ্ছে।
আসলে ছেড়ে যাচ্ছে না, পালাচ্ছে। যে যেভাবে পারে পালাচ্ছে। এথেন্সের বাতাস দূষিত প্লেগে ভরা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মরছে। এটি এখন মৃত্যুপুরী। জীবন বাঁচাতে এথেন্স ছাড়ছে মানুষ।
এতদিন স্পার্টার সেনারা রাস্তা আটকে ছিল। কেউ পালাতে পারেনি। এখন প্লেগ বেড়ে গেছে। স্পার্টার সেনারা ভয়ে পালিয়েছে। এখন যে কেউ পালাতে পারে। তাই অনেকেই এথেন্স ছেড়ে পালাচ্ছে।
ক্রিতোও এথেন্স ছেড়ে যাবে। অনেক দিন ধরেই সে যাব যাব করছে। সাহস করে অনেক দিন রয়ে গেছে। বেশি সাহস করলে শেষে জানে-প্রাণে মরতে হবে। গ্রিসের উত্তরে থেসালি নগরে ক্রিতোর অনেক বন্ধু আছে। সে সময়ে-অসময়ে বিস্তর মানুষকে সাহায্য করেছে। আশ্রয়ে দিয়েছে। এখন নিজের বিপদে পরিবারসহ থেসালিতেই যাবে। ক্রিতোর টাকা-পয়সার অভাব নেই। সে থেসালিতে বাড়ি বানাতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছে।
চেরোফোনও যাচ্ছে ক্রিতোর সাথে। প্লেগ শুরুর প্রথমে তার খুব চোটপাট ছিল। বলত, সবাই গেলেও আমি কোনোদিন এথেন্স ছাড়ব না। দেশের মাটি বড় পবিত্র। কিন্তু আর ভরসা পাচ্ছে না। এখন চারধারে লাশ আর লাশ। যে কোনোদিন লাশ হয়ে যেতে হবে। জান বাঁচাতে পালাতে হবে।
পাদুকা শিল্পী সিমনও সাথে যাবে। তার পাদুকা ব্যবসা একেবারে বন্ধ। কারিগর সব মারা গেছে।
শুধু সক্রেটিস যাবে না। সে কোনোদিন এথেন্স ছেড়ে যায়নি। এই নগরী তার কাছে প্রেমিকার মতো। ভালো-মন্দ যাই হোক, সে যাবে না। মরতে হলে এই মাটিতেই মরবে।
ক্রিতো বলল, সক্রেটিস, অল্প কিছু দিনের জন্য হলেও চলো। এথেন্সের বাতাসে অসুখ ঢুকে গেছে। যখন তখন রোগে ধরে ফেলবে। বাতাস ঠিক হলেই আমরা ফিরে আসব। টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো চিন্তা কোরো না। আমি সবার ভার নিলাম। দশখান গাধার গাড়ি বানিয়েছি। সাথে কয়েকজন দাসও নিলাম। একেবারে পাকাপাকি ব্যবস্থা। এক চিলতেও ভুল ধরতে পারবে না। শুধু শরীরটা নিয়ে গাধার গাড়িতে বসে একটা ঘুম দাও। চোখ খুলে দেখবে আমরা উত্তর গ্রিসের থেসালি নগরে চলে গেছি।
কিন্তু না, সক্রেটিস যাবে না। ক্রিতো যতই বলুক, সে এথেন্স ছাড়বে না।
ক্রিতোর মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। গোয়ার্তুমির একটা সীমা আছে। এমন একগুঁয়ে মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করে ভুল করেছে।
চেরোফোন সক্রেটিসকে ভালো জানে। সে সক্রেটিসকে কিছুই বলল না। সে গেল জেনথিপির কাছে। স্ত্রী রাজি হলে অমত করবে এমন স্বামী পৃথিবীতে নেই। সতীর ইচ্ছাই পতির ইচ্ছা।
চেরোফোন জেনথিপিকে বলল, ভাবী, দেখছেন তো যে অবস্থা চলছে, তাতে এথেন্সে কেউ বাঁচবে না। আপনি সক্রেটিসকে বুঝান। আমরা চলে গেলে ও কার সাথে থাকবে? কিছু একটা হলে, সাহায্য করারও কেউ থাকবে না।
জেনথিপি সব সময় সক্রেটিসের বিরোধী দল। সক্রেটিস ডানে গেলে তিনি যান বামে। কিন্তু কেন যেন সে আজ সক্রেটিসের পক্ষে চলে গেল। আজ সক্রেটিসের কথায় সায় দিয়ে দিল।
জেনথিপি চেরোফোনকে বলল, ভাই, আপনারাই তো বলেন সক্রেটিস নাকি ভুল কিছু করে না। সে নাকি সবার চেয়ে ভালো বোঝে। তাহলে সে যা বলেছে, বুঝেই বলেছে। আমরা এথেন্সেই থাকব।
চেরোফোন বিশ্বাস করতে পারছে না। এই মহিলা কথায় কথায় সক্রেটিসের গুষ্ঠি উদ্ধার করেন, এখন তার স্বামীপ্রেম জেগে উঠেছে। হঠাৎ ভালোবাসা একেবারে উথলে উথলে পড়ছে। চেরোফোন নীরব। তার কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
সক্রেটিস গেল না। ক্রিতো, চেরোফোন আর সিমোনের পরিবার এথেন্স ছেড়ে গেল। যাওয়ার সময় সবাই কাঁদছে। শুধু সক্রেটিস তাদের হাসিমুখে বিদায় দিল।
গাধার গাড়ি ছাড়ার সময় ক্রিতো বলল, আমার বাড়িতে কিছু দাস আছে। এখনও সবাই মরেনি। একটি গাধার গাড়ি রেখে গেলাম। যখনই মত পাল্টাবে, গাড়ি নিয়ে চলে এসো। আমরা অপেক্ষায় থাকব।
সক্রেটিস বললেন, উল্টা হবে। প্লেগ কমে যাবে, আর আমি নিজে গিয়ে তোমাদের নিয়ে আসব। তোমার গাধার গাড়িটা তখন কাজে লাগবে।
সবাই চলে গেলে সক্রেটিস একেবারে একা হয়ে গেল। কাছের কেউ নেই। একেবারে বন্ধুহীন। তারচেয়েও বড় বিপদ হলো ঘর থেকে বের হতে পারছে না। রাস্তার দুধারে পড়ে আছে মানুষ আর মানুষ। কেউ মরা, কেউ আধমরা। এর মধ্য দিয়ে হাঁটলে ভয় লাগে। মনে হয় দুদিন পরে আমিও এরকম রাস্তার ধারে পরে থাকব। সরকারি মেথর এসে লাথি দিয়ে দেখবে মারা গেছি কিনা। না মরলে তার মন বেজার হবে। মরলে পায়ে রশি বেঁধে যাবে মাটি দিতে।
সক্রেটিস ঘর থেকে বের হতে পারছে না। মনে হচ্ছে জেলখানায় আছে। এমন ঘরের মধ্যে আটকা থাকলে প্লেগে নয়, দম বন্ধ হয়েই মরতে হবে।
শুধু খুশি হয়েছে জেনথিপি। স্বামী টো টো করে সারা এথেন্স বেড়াতে পারছে না। ঘরে আটকা পড়েছে। এতদিনে দিনে একটু কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। সক্রেটিসও কাউকে না পেয়ে বউয়ের কাছেই জ্ঞানের কথা বলছে—
‘বউ শোনো, আমি কিসের জন্য বেঁচে আছি জান?’
‘কিসের জন্য?’
‘জীবন কীভাবে উন্নত করা যায় সেটি বের করার জন্য। কীভাবে ভালোভাবে বাঁচা যায় সেটি জানার জন্য।’
‘জানতে পেরেছেন?’
‘হুঁম, অনেকখানি পেরেছি।’
‘তাহলে তো আপনে ভালো জীবনের উপায় জানেন। আপনার জীবন নিশ্চয়ই অনেক ভালো। সকালে বাড়ি থেকে খালি পায়ে বের হয়ে যান, সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন। গভীর রাতে ফিরেন। খুব ভালো জীবন। অতি উত্তম জীবন, তাই না?’
সক্রেটিস কোনো উত্তর দিল না। কথা এক ফোঁটাও মিথ্যা নয়। তার ট্র্যাজেডি হলো, তার সাধনা সে নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারছে না। সেই চেষ্টাই করছে না।
সক্রেটিস উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
জেনথিপির মন খারাপ হলো। সে ভেবেছিল সক্রেটিস যতদিন একা আছে, যতদিন প্লেগ না কমে, ততদিন বকাঝকা করবে না। কিন্তু অভ্যাস খুব খারাপ জিনিস। অনেক দিনের অভ্যাস হঠাৎ করে বদলানো যায় না।
জেনথিপি বলল, আচ্ছা, সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কী করেন?
‘মানুষ দেখি। মানুষের সাথে কথা বলি।’
‘তো আমার সাথে কথা বলেন না কেন? আমি বুঝি মানুষ নই?’
‘শোনো, আমি শুধু মানুষের সাথে কথা বলি সেটি নয়। আমি মানুষকে দিয়ে কথা বলাইও। আমি তোমার সাথে কম কথা বলি এটি সত্য। কিন্তু তোমাকে দিয়ে আমি অনেক কথা বলাই। আমাকে দেখলেই তুমি চেঁচামেচি শুরু করো। কথার তুবরি ছোটাও। বলো, সত্য কিনা?’
‘সত্য। ষোল আনা সত্য। তো, আপনি আমার সাথে এটি ইচ্ছে করে করেন?’
‘ঠিক তা নয়। বলতে পার এটিও আমার মানুষ দেখার অংশ। আমি তোমাকে দেখি। স্বামীর প্রতি অতি বিরক্ত একটি ভালো মেয়ে কেমন ব্যবহার করে, সেটি বুঝতে চাই।’
‘বুঝতে পেরেছেন?’
‘না, এখনও পুরোপুরি বুঝিনি।
‘কোনোদিন কি বুঝতে পারবেন?’
‘মনে হয় না।’
‘তাহলে এত গবেষণা করে লাভ কী?’
‘মানুষকে শিখাই। কীভাবে ভালোভাবে বাঁচা যায়, সেটি মানুষকে শিখাই। তুমিই বলো কিছু মানুষ কি শিখছে না?’
জেনথিপি ভেবে দেখল কথা সত্য। কিছু মানুষ শিখছে। ক্রিতো, চেরোফোন, সিমনদের মতো লোকেরা তো সক্রেটিসের জন্য একেবারে ফিদা। এরা অনেক কিছু শিখছে। কিন্তু এটি স্বীকার করা যাবে না। তাহলে কথার পিঠে কথা জমবে না। উল্টা কিছু বলতে হবে।
জেনথিপি বললেন, কিছু লোক শিখছে, তবে বেশিরভাগ মানুষই কিছু শিখছে না। তারা আপনার শত্রু। আপনাকে মানে না।
‘তারাও শিখছে। শত্রুতা করতে হলেও বিষয়টি বুঝতে হয়। আমার কথাকে মূল্য দেয় বলেই তারা আমাকে শত্রু ভাবে।’
‘কিন্তু ভয় লাগে, আপনার মিত্র অল্প, শত্রু অনেক বেশি।’
‘শোনো, শত্রু-মিত্র বুঝি না। আমি শুধু বুঝি আমার গবেষণার বিষয় মানুষ। আর আমার গবেষণাগার হলো এথেন্স। আমি এথেন্সের মানুষ নিয়ে ভাবি। তাদের ভালো জীবনের উপায় বলি। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন প্রতিটি মানুষ সুন্দর জীবন যাপন করবে। সত্য ও ন্যায়ের কথা সবাই বুঝতে পারবে। সবাই পাবে একটি অন্যরকম সুন্দর জীবন।’
জেনথিপি মুগ্ধ হয়ে শুনছে। সে সক্রেটিসকে এভাবে বলতে কোনোদিন শোনেনি। তার স্বামী যে কত বড় মানুষ, সেটি দেখার সুযোগই তার হয়নি।
জেনথিপি বলল, আপনার কথাগুলো এত মধুর লাগছে। এই কথা আমার সারাদিন শুনতে ইচ্ছা করত, শুধু আমি যদি আপনার স্ত্রী না হতাম।
এর চেয়ে সত্য কথা আর নেই। সক্রেটিস বুঝল দার্শনিকের বউ হওয়ার চেয়ে দুর্ভাগ্য একটি মেয়ের জন্য আর কিছু হতে পারে না। সক্রেটিস করুণা নিয়ে জেনথিপির দিকে তাকিয়ে রইল। দার্শনিকরা বউয়ের জন্য করুণা নিয়ে তাকিয়ে থাকতেই পারে, আর কিছুই পারে না।
চারিদিকে প্লেগ আর ঘরে ঘরে মৃত্যু যন্ত্রণার মাঝে সক্রেটিস আর জেনথিপির একটু ভালো সময় কাটল।