1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৩৭

৩৭

‘আমি কাউকে কিচ্ছু শেখাতে পারি না,
আমি শুধু তাদের দিয়ে চিন্তা করাতে পারি।’

—সক্রেটিস

***

যতই কান্না পাক, দুঃখ বিলাস করার সময় নেই আসপাশিয়ার। সে মহাব্যস্ত। দম ফেলার সময় নেই। সক্রেটিস ব্যস্ত নয়। সে অপেক্ষা করছে। কখন আসপাশিয়ার লেখা শেষ হবে।

আসপাশিয়া পেপিরাস কাগজে লিখছে। খুব দ্রুত লিখছে। মেয়েটি এমন চমৎকার করে লিখতে পারে! সক্রেটিসের ঈর্ষা হলো। সক্রেটিস কিছু লেখে না। কলম তার দুচোখের বিষ। লিখতে গেলে তার আঙুলে ব্যথা লাগে। আর এই মেয়েটি ঘচাঘচ লিখে যাচ্ছে। কেমন করে আঁকাবাঁকা অক্ষরগুলো বসিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ঐ চিকন আঙুলে জাদু আছে।

লেখা শেষ করে সক্রেটিসকে পেপিরাসগুলো দিল আসপাশিয়া পেপিরাসের উপর লেখা :

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বক্তৃতা[৯৬] অথবা আখেরি বিদায় বক্তৃতা

বক্তা : পেরিক্লিস

সক্রেটিস বুঝল পেরিক্লিস বক্তৃতা দেবেন। স্পার্টার সাথে যুদ্ধে যারা মারা যাচ্ছে, তাদের কবর দেওয়া হবে। ধুমধাম করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে। এতক্ষণ ধরে আসপাশিয়া সেই বক্তৃতা লিখছে

আসপাশিয়া বলল, যুদ্ধে আমাদের ছেলেরা মারা যাচ্ছে। প্রতিদিন লাশ আসছে। লাশ দেখে মানুষ ভয় পাচ্ছে। মানুষের সাহস ধরে রাখতে হবে। সেজন্য পেরিক্লিস ঠিক করেছেন, তিনি ভাষণ দেবেন। এথেন্সের মহিমা বলবেন, যাতে মানুষ সাহস পায়। এথেন্স যে একটি মহান নগর, সেটি মানুষ বুঝতে পারে।

সক্রেটিস বলল, কবে এই অনুষ্ঠান?

আসপাশিয়া বলল, পরশু বিকেলে। কেরামেকাসের গোরস্তানে। এখন বক্তৃতাটা পড়ো। পড়া হলে বিশেষজ্ঞ মন্তব্য কর।

সক্রেটিস বক্তৃতাটি পড়তে শুরু করল। আসপাশিয়া খুব মিষ্টি করে লেখে। শুনলে মনে হয় যেন খুব আপনজনকে বলছে। সক্রেটিস পড়ছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। এত চমৎকার ভাষণ সে কোনোদিন শোনেনি।

সক্রেটিস আসপাশিয়ার দিকে তাকাল। এই লেখা এই মেয়েটি লিখেছে? বলে না দিলে, কেউ বিশ্বাসই করবে না। তার চোখে এক সাগর মুগ্ধতা।

সে বলল, কী চমৎকার লিখেছ। বারবার পড়তে ইচ্ছে করছে। এ বক্তৃতাটি মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে। তোমার এই শব্দগুলো যখন পেরিক্লিস গদগদ গলায় বলবে, এটি একটি কালজয়ী বক্তৃতা হয়ে যাবে। মানুষ এই বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দেবে। হোমারের লেখার মতো আলাদা কিছু সৃষ্টি করে ফেলেছ তুমি। তোমার শব্দগুলো কেমন মিঠা, বারবার শুনতে মন চায়।

আসপাশিয়া বলল, প্রশংসা করার জন্য তোমাকে ডাকিনি। প্রশংসা করার জন্য আমার পিছে সারাদিন ছয় হালি লোক ঘোরে। আমার ভুল ধরার লোক নেই। আমি তোমাকে ডেকেছি ভুল ধরার জন্য। ভুল ধরো। সমালোচনা করো। চাঁছাছোলা সমালোচনা। কঠিন শিক্ষকের মতো বলো, ভাষণের মধ্যে কী দিতে ভুলে গেছি।

সক্রেটিস বলল, দেবতাদের কথা দিতে ভুলে গেছ। এথেন্সে বক্তৃতা হবে, আর দেবী এথিনার নাম নেই। লোকে মানবে?

আসপাশিয়া বলল, দেবীকে আমি ভক্তি করি, সেটি আমার মনের ব্যাপার। সরকারি কাজে দেবীর দরকার নেই।

সক্রেটিস বলল, ঝুঁকি নিচ্ছ?

আসপাশিয়া বলল, দেবতাদের নাম নেবে কিনা, সেটি পেরিক্লিসই ঠিক করুক। সে আমার চেয়ে অনেক ঝানু নেতা। সিদ্ধান্ত তার। আমি গণতন্ত্রের কথা, এথেন্সের কথা লিখে দিলাম। আর কোনো সমালোচনা?

‘নারীদের কথাও নেই। তুমি নারী হয়ে তোমার লেখায় মেয়েদের নিয়ে একটি শব্দও নেই। অদ্ভুত লাগছে।’

আসপাশিয়া বলল, নারীদের কথা শুনতে তোমাদের এথেন্স কি তৈরি?

সক্রেটিস কিছুই বলছে না। এর উত্তর তার জানা নেই।

আসপাশিয়া বলল, যেদিন এথেন্স মেয়েদের মনের কথা শুনতে চাইবে, সেদিনের বক্তৃতায় নারীদের কথা আসবে। তার আগে মেয়েদের কথা লিখতে গেলে তোমার বন্ধু ইউরিপিডিসের মতো অবস্থা হবে। সে বেচারা মেয়েদের মনের সত্য কথা লেখে, আর সবাই তাকে বলে নারীবিদ্বেষী। আর কিছু বলবে?

সক্রেটিস বলল, এই লেখায় বিকেলের নরম রোদের মতো সুন্দর করে এথেন্সের কথা আছে। ছোট্ট পাখির পালকের মতো গণতন্ত্রের কথা আছে। গণতন্ত্র নিয়ে এত সুন্দর সুন্দর কথা অন্য কেউ বলতে পারেনি। সহজভাবে আমাদের কথা লিখেছ তুমি। এক কথায় চমৎকার। এথেন্সের যে শুনবে, সেই ভাববে, এটি তার মনের কথা।

আসপাশিয়া ক্ষেপে গেল। সে প্রশংসা চায় না, সমালোচনা চায়।

সক্রেটিস বলল, অসাধারণ হয়েছে। তোমার যদি বিশ্বাস না হয়, তুমি পেরিক্লিসকে জিজ্ঞেস করতে পার।

সক্রেটিস কিছু শব্দ পাল্টে দিল।

আসপাশিয়া বলল, ঠিক আছে। সমালোচক হিসেবে তুমি বেশি নম্বর পেলে না। আরেকজনকে দেখাতে হবে।

‘কাকে দেখাবে?’

‘তার নাম থুকিডিডিস’[৯৭]।

‘সৈনিকদের জেনারেল থুকিডিডিস?’

‘তোমাদের কাছে সে শুধু একজন সৈনিক। কিন্তু তার অন্য একটি গুণ আছে। সে চমৎকার লেখে।’

‘তাই নাকি? তার লেখা তো দেখিনি। শুনিও নি।’

‘হুঁম, এখনও বেশি কিছু লিখেনি। কিন্তু লেখার হাত চমৎকার। সে ইতিহাস লেখে। এখন পেলোপোনেসিস যুদ্ধের কথা লিখে রাখছে।’

‘হেরোডোটাসের মতো?’

‘হুঁম, তবে হেরোডোটাস হিজিবিজি করে লিখে। থুকিডিডিস পরিষ্কার করে লেখে। সে একজন সত্যিকার ইতিহাসবিদ।’

.

পরদিন বিকেলে কেরামেকাসের সমাধিক্ষেত্র লোকারণ্য। এথেন্সের প্রায় সব মানুষ এসেছে। পেরিক্লিস মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। সামনে সারি সারি কফিন। ফুল দিয়ে ঢাকা। স্পার্টার সাথে যুদ্ধে যারা মারা গেছে, তাদেরকে কবর দেওয়া হবে। পেরিক্লিস বক্তৃতা করবেন। অনেক বড় বক্তৃতা।

প্রথমেই তিনি পূর্ব-পুরুষদের শ্রদ্ধা জানালেন। এথেন্সের জন্য যারা প্রাণ দিচ্ছে, তাদের প্রতি সম্মান জানালেন। তারপর গদগদ গলায় বলতে শুরু করলেন :

আমরা সারা পৃথিবীর জন্য অনুকরণীয় ব্যবস্থা চালু করেছি। সেই ব্যবস্থার নাম গণতন্ত্র। আমাদের শাসন শুধু কয়েকজনের হাতে নয়, আমাদের নগর সবার হাতে। এখানে সবার সমান অধিকার। আমরা আইন দিয়ে দেশ চালাই। আমরা আইন মানি। তাই অন্যায় করি না। আদালত ও বিচারকাজে আমরা সবার চেয়ে অনেকগুণ এগিয়ে।

সক্রেটিস শুনছে। সে বুঝতে পারছে পেরিক্লিস গণতন্ত্র দিয়ে শুরু করেছেন। আসপাশিয়ার লেখার পিছনের জিনিস তিনি আগে নিয়ে এসেছেন।

পেরিক্লিস বলছেন— এথেন্সে সব কাজে একটিই মাপকাঠি, সেটি হলো যোগ্যতা। সব নাগরিকের যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়। যোগ্যতা থাকলে যেকোনো নাগরিক সরকার পরিচালনায় অংশ নিতে পারে। দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়।

ইউরিপিডিস সক্রেটিসের পাশে ছিল। সে প্রায় হাততালি দিয়ে ফেলল। ভুলে গেছে যে এটি শোকের অনুষ্ঠান।

পেরিক্লিস বলছেন, আমাদের নগর মুক্ত। সারা পৃথিবীর জন্য মুক্ত। আমরা কোনোদিন কোনো বিদেশিকে নগর থেকে বের করে দেইনি। কোনো বিদেশিকে এই নগরের কোনো কিছু দেখা থেকে বিরত রাখিনি 1

সক্রেটিস ইউরিপিডিসকে বলল, আসপাশিয়া নিজে বিদেশি। তাই বিদেশিদের অধিকারের কথা লিখেছে।

বক্তৃতা চলছে—

অন্যরা যেখানে শিশুদের কঠিন পরিশ্রমে একরোখা সৈনিক বানায়, আমরা সেখানে শিশুদের সহজভাবে শিক্ষা দিই। শিশুদের বানাই জ্ঞানী ও সাহসী।

সক্রেটিস ইউরিপিডিসকে বলল, স্পার্টা শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে যুদ্ধ শেখায়, সেটি নিয়ে খোঁচা দিল।

পেরিক্লিস মিষ্টি ভাষায় বলছেন :

এথেন্স হচ্ছে সমগ্র গ্রিসের জন্য একটি পাঠশালা। এটি শুধু কথার কথা নয়, এটি ধ্রুব সত্য। আমরা সুন্দর নগরের সুন্দর মানুষ। অন্যরা আমাদের দেখে শিখতে পারে।

ইউরিপিডিস বলল, বাহ, কী সুন্দর কথা! প্রতিটি দেশে কীভাবে সরকার চলা উচিত, সেটি এই বক্তৃতায় বলে দিলেন।

পেরিক্লিস শেষ করছেন—

এই যুদ্ধে যারা সন্তান হারালেন, আমরা তাদের গর্বে গর্বিত। তারা এথেন্সের সবচেয়ে মহান সন্তান। সবচেয়ে মহৎ নাগরিক। আমরা তাদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করব।

বক্তৃতা শেষ হলো।

পেপিরাস কাগজে থুকিডিডিস বক্তৃতাটি লিখে ফেলেছে। সে এখন ঘষা- মাজা করছে। সে খুবই আনন্দিত। এমন সুন্দর কথা সে জীবনে শোনেনি। গণতন্ত্র যে কী জিনিস, এথেন্স যে কীভাবে চলছে সেটি সাধারণ মানুষ বোঝে না। পেরিক্লিস সহজ ভাষায় সেই বিষয়গুলো বলে দিলেন।

থুকিডিডিস বললেন, এটি হলো গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতা। ভবিষ্যতে যে-ই বুঝতে চাইবে গণতন্ত্র কী, সে এই বক্তৃতা একবার হলেও দেখবে। এই বক্তৃতা নিয়ে আমি লিখব। আগামী দিনে মানুষ যাতে পেরিক্লিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বক্তৃতাটি জানতে পারে, সে জন্য আমি বিস্তারিত লিখব।

.

সবাই পেরিক্লিসকে বাহবা দিচ্ছে। অনেকেই বলছে, বাহ, এমন চমৎকার বক্তৃতা পেরিক্লিস ছাড়া আর কে দিতে পারেন? সবাই বলছে, কী মধুর কথা বললেন! এথেন্স হচ্ছে সমগ্র গ্রিসের জন্য একটি পাঠশালা। স্পার্টা এক কথায় বুঝে যাবে, আসলে কে সেরা।

সক্রেটিস প্রশংসা শুনছে আর আসপাশিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। আসপাশিয়া নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।

সক্রেটিস ভাবছে, সবাই পেরিক্লিসের প্রশংসা করছে। কিন্তু বক্তৃতাটা যে আসপাশিয়া লিখেছে, সেকথা কেউ জানে না। একদিন হয়তো থুকিডিডিসের লেখা থেকে এই বক্তৃতা মানুষের মুখে মুখে ঘুরবে, সেদিন সবাই বলবে পেরিক্লিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বক্তৃতা। সেদিনও আসপাশিয়ার কথা কেউ জানবে না। এথেন্সের মাটিতে একজন দার্শনিক নারী নীরবে পুরুষদের চেয়ে অনেক মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন, ইতিহাসে তার কথা লেখা থাকবে না। কিন্তু এই কেরামেকাসের ঘাস মনে রাখবে যে, এই বক্তৃতা লিখতে আসপাশিয়ার কয়টা নির্ঘুম রাত পার হয়েছে।

.

বক্তৃতা শেষে বাড়ি ফিরছেন পেরিক্লিস।

তিনি খুব খুশি। সুন্দর বক্তৃতা করেছেন। অনেক দিন ধরে তার মন খারাপ ছিল। স্পার্টার সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মনে শান্তি ছিল না। আজ বেশ শান্তি শান্তি লাগছে। বিকেলের আকাশ ঝকঝকে নীল। মনে হচ্ছে আকাশের নীল বুঝি তাকে ছুঁতে চাইছে। আকাশ থেকে এক মুঠো নীল রং বুঝি বাতাসেও ছড়িয়ে গেছে। বাতাসও আজ নির্মল। একটি মিষ্টি গন্ধ চারদিকে। যুদ্ধ শুরুর পরে এমন শান্তি আর লাগেনি।

মনের আনন্দে হেঁটে হেঁটেই বাড়ির ফিরছিলেন তারা।

দূর থেকে একজন দাস দৌড়ে আসছে। সে চিৎকার করে ডাকছে পেরিক্লিস দাঁড়ালেন। দাস কাছে এসে বলল, বিপদ, মহাবিপদ। এথেন্সে আচানক এক রোগ শুরু হয়েছে। ভয়ংকর অজানা রোগ। মানুষ মারাও যাচ্ছে। কয়েক দিনেই বোঝা গেল, এথেন্সে প্লেগ এসেছে। মহামারী শুরু হয়েছে। ঘরে ঘরে লোক মারা যাচ্ছে। এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। ডাক্তাররা কিছুই করতে পারছেন না। একেবারে নতুন রোগ।

প্রথমে মাথায় ভীষণ জ্বর হয়। মাথা ঘুরায়। কদিন পরে আরম্ভ হয় চোখ জ্বালা। তীব্র জ্বালায় চোখ ছটফট করে। তারপর শুরু হয় পেট ব্যথা। পেটের ব্যথা থেকে ডায়রিয়া। শরীর শুকিয়ে যায়। আরম্ভ হয় পানির তীব্র পিপাসা। গলা ফেটে যায়। পানি পানি বলে চিৎকার করতে করতে এক সময় মারা যায়।

ভয়াবহ দিন এসেছে এথেন্সে। পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত নগরে অন্ধকার এসেছে। মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এথেন্সের ছোট্ট দেয়ালের মধ্যে প্লেগের জীবাণু কিলবিল করছে। যারা ভেতরে আছে, একে একে মারা যাচ্ছে। পালানোর পথও নেই। দেয়ালের বাইরে রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে স্পার্টার সেনা

পেরিক্লিস যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব পাঠালেন স্পার্টার কাছে। কিন্তু স্পার্টা মানল না।

স্পার্টার সেনাপতি লাইসেন্ডার বলল, প্লেগের দেবতা এপোলো আমাদের আশীর্বাদ করেছেন, আর এথেন্সকে শাস্তি দিচ্ছেন। ওরা পাপী। একে একে সবাই মরবে। আমাদের কিছুই হবে না। আমরা চারিদিকে ঘিরে থাকব। কাউকে বের হতে দিব না। যুদ্ধ বন্ধ হবে না। একজন স্পার্টান বেঁচে থাকতেও যুদ্ধ বন্ধ হবে না।

ছোট্ট দেয়ালের মধ্যে আড়াই লাখ মানুষে গিজগিজ করছে। তার মধ্যে প্লেগ। দেদারছে মানুষ মরছে।

এথেন্সের সবখানে লাশ। চারদিকে লাশের গন্ধ। তীব্র গন্ধে রাস্তায় নামা যায় না। অনেক দাস মরে গেছে। অনেক দাস পালিয়ে যাচ্ছে। লাশ দাফন করার লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।

সারি সারি লাশ যাচ্ছে গোরস্তানের দিকে। নানা পথ থেকে লাশ আসছে। মানুষ লাশের দিকে তাকিয়ে হায় হায় করছে। যে যার মতো বিলাপ করছে। কান্না আর কান্না। ঘরে ঘরে কান্না। চিৎকার করে কান্না। এথেন্সে অন্য কিছুই শোনা যায় না, শুধু কান্নার শব্দ।

দেবতাদের কাছে অনেক প্রার্থনা চলছে। মন্দিরের সামনে চলছে পশু বলি। তবু কোনো উন্নতি নেই। দিনে দিনে অবস্থা খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।

এই সময় স্পার্টার সেনাপতি লাইসেন্ডার একটি ভয়ংকর কূটচাল দিল। সে খবর পাঠাল, স্পার্টা যুদ্ধ বন্ধ করবে। তবে শর্ত হচ্ছে, এথেন্সের নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে হবে পেরিক্লিসকে। পেরিক্লিস না থাকলে, স্পার্টা আর যুদ্ধ করবে না।

আসলে এই সুযোগে স্পার্টা পেরিক্লিসের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। পেরিক্লিস এথেন্সকে সাজিয়েছেন। তিনিই এথেন্সকে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নগর করেছেন। তার কারণেই লোকে স্পার্টার কথা ভুলে গেছে। তিনিই দেশ-বিদেশের গুণী মানুষকে এথেন্সে জায়গা দিয়েছেন। আজকের এই আলোকিত এথেন্স আসলে পেরিক্লিসের এথেন্স। পেরিক্লিস না থাকলে, এথেন্স এমন থাকবে না। তখন স্পার্টার সুদিন আসবে। তাই পেরিক্লিসকে সরতে হবে। পেরিক্লিস সরে গেলেই স্পার্টা যুদ্ধ থামাবে।

স্পার্টা গুজব ছড়িয়ে দিল যে পেরিক্লিস খারাপ মানুষ। তিনি দেবতা মানেন না। তিনি অনাচার করেছেন। তাই দেবতা প্লেগ পাঠিয়েছেন। শাস্তি দিচ্ছেন এথেন্সকে। এখন এথেন্সের মানুষের হাতে দুটো পথ— পেরিক্লিস থাকলে এথেন্স ধ্বংস হবে, আর এথেন্সকে বাঁচাতে চাইলে পেরিক্লিসকে সরাতে হবে।

দিন যায়। এসব কথা লোকের মুখে মুখে ছড়ায়। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, পেরিক্লিসই সবকিছুর জন্য দায়ী। আগোরার পথে পথে এটি নিয়ে আলাপ হচ্ছে।

একজন বলছে, ভাই, এমন প্লেগ কেন হলো এথেন্সে?

আরেকজন উত্তর দিচ্ছে, কারণ, দেবতা রাগ করেছে।

কেন রাগ করেছে?’

‘তোমরা অনাচার করেছ। এথেন্সের ঘরে ঘরে মারাত্মক অনাচার চলছে।’

‘আমরা অনাচার করলাম কোথায়? আমরা তো সকাল-বিকাল দেবীর কাছে প্রার্থনা করি। মাঝেমধ্যে দেবতার কাছে ছাগল বলি দিই। টাকা হাতে থাকলে মহিষ বলি দিই। আমরা তো ভক্ত মানুষ। অনাচার কোথায় দেখলে?’

‘অনাচার কি সবাইকে করতে হয়? অনাচার করে দেশের রাজা। একা রাজার পাপেই মরে সকল প্রজা।’

‘এথেন্সে তো রাজা নেই।’

‘কেন, পেরিক্লিস কী? তিনিই তো রাজা। গণতন্ত্র বলো, আর যা-ই বলো, গত ত্রিশ বছর এথেন্স চালাল কে?’

‘পেরিক্লিস।’

‘হুঁম, তিনিই হলেন নষ্টের মূল। পেরিক্লিসই পাপী। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ঘেন্না। তার কথা মনে পড়লেই ঘেন্না লাগে। তার অনাচারেই এই প্লেগ।’

‘কী অনাচার করছেন?’

‘কী করেন নাই? কেরামেকাস পাড়ার একটি মেয়েকে নিজের ঘরে এনেছেন। তার নাম আসপাশিয়া। তারা বিয়ে করেননি। বিয়ে না করেই লীলা করছেন। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তাদের আবার সন্তান আছে। ভেবে দ্যাখো কত বড় অনাচার! এমন অনাচার দেবতা কত দিন সহ্য করবে? দেবতার সহ্যেরও একটি সীমা আছে।’

‘হুঁম, এটি কিঞ্চিৎ সত্য।’

‘কিঞ্চিৎ নয়, পুরোই সত্য। ওদের নষ্টামির জন্যই দেবতা এপোলো ক্ষেপে গেছেন। শাস্তি হিসেবে প্লেগ পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

‘এরকম নষ্টামি তো কত মানুষই করছে। এথেন্সের অনেক মানুষই তো গোপনে কেরামেকাসে যায়। কত কিছু করে।’

‘অন্য মানুষের করা আর রাজার করা কি এক হলো? রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট— প্রজা কষ্ট পায়।’

‘এটি কিছুটা সত্য।’

‘এর চেয়েও বড় সত্য আছে। পেরিক্লিস দেবতা মানেন না। তিনি আসলে নাস্তিক।’

‘এটি সত্য নয়। তিনি দেবী এথিনার ভক্ত। দ্যাখো কেমন সুন্দর করে দেবীর মন্দির বানিয়েছেন। পার্থেননে দেবীর মূর্তি দেখলে কেউ বলতে পারবে না যে, পেরিক্লিস দেবীকে মানেন না।’

‘ওইসব হলো মানুষকে দেখানোর জন্য। মানুষকে দেখাতে মন্দির বানিয়েছেন। মন্দির বানিয়ে কি ভক্তি হয়? ভক্তি হলো মনের জিনিস। মনে মনে তিনি দেবতাদের মানেন না।’

‘একথা লোকে বিশ্বাস করবে না। মানুষ প্ৰমাণ চায়।’

‘প্রমাণ চাও? একজন মানুষকে চিনতে চাও? তার বন্ধুদের দিকে তাকাও। গত ত্রিশ বছরে পেরিক্লিস কাদের সাথে ওঠা-বসা করেছেন? কে কে ছিল তার সব সময়ের সঙ্গী? তার সাথে যারা ছিল তারা একজনও দেবতা মানে না।’

‘কাদের কথা বলছো?’

‘মনে করে দ্যাখো— তার বাড়িতে থাকত এই দুনিয়ার এক নম্বর নাস্তিক এনাক্সাগোরাস। সে বইতে লিখেছিল— সূর্য, চাঁদ এসব নাকি দেবতা নয়, এরা নাকি বড় ধাতুর গোল্লা। এরকম একজন ধর্মবিদ্বেষী লোক ত্রিশ বছর পেরিক্লিসের বাড়িতে ছিল। পেরিক্লিস তাকে বাড়িতে রেখেছিলেন, তার বুদ্ধিতে কাজ করতেন। তারপর আরেক দার্শনিক প্রোটাগোরাস। সে তো সরাসরি বলল, দেবতা-টেবতা কিচ্ছু না, পৃথিবীর সবকিছুর মূলে মানুষ। এই শয়তান দার্শনিক ছিল পেরিক্লিসের প্রাণের দোস্ত। তারপর তার বন্ধু ভাস্কর ফিডিয়াস। সে তো দেবীর হাতের ঢালের উপর পেরিক্লিসের মূর্তি এঁকেছে। তারপর ডেমন— সংগীত শিল্পী। সে মানুষের মাথা নষ্ট করতে গান বানাত, দেবতাদের নিয়ম উল্টে দিতে চেয়েছিল। তারপর সক্রেটিস। সে তো এথেন্সের এক নম্বর খারাপ লোক। দেবতা মানে না। সে প্রতিদিন পেরিক্লিসের বাড়িতে গিয়ে আসপাশিয়ার সাথে গুজুর গুজুর ফুসুর-ফাসুর করে। তো তাহলেই দ্যাখো! কাদের নিয়ে পেরিক্লিস চলেছে এত বছর। তার সব বন্ধুরা নাস্তিক। তো সে কী করে ধোঁয়া তুলসী পাতা হয়? সেই হলো এসব নাস্তিকদের এক নম্বর পাণ্ডা। এদের সবাইকে সাহস দিয়েছে সে। তাই দেবতারা রাগ করেছেন। এই প্লেগের জন্য একমাত্র দায়ী পেরিক্লিস। পেরিক্লিস ক্ষমতা ছাড়লেই প্লেগ থামবে, তার আগে প্লেগ থামবে না।’

এমন কথা এখন অনেকেই কানাঘুষা করে। পেরিক্লিসের বিরোধীরা সব খানে এই কথা শোনাচ্ছে। স্পার্টার নেতারাও বলছে পেরিক্লিস চলে গেলেই প্লেগ থামবে, যুদ্ধও থামবে।

সফোক্লিস আগোরার পথে এসব কথা শোনেন। তার মাথায় নতুন নাটকের কথা ঘোরে। তিনি নাটক লিখবেন। এবার তিনি প্লেগ আর পেরিক্লিসকে মিলিয়ে নাটক লিখবেন।

***

৯৬. খ্রি. পূ. ৪৩১ অব্দে পেরিক্লিস গণতন্ত্রের ইতিহাসের সুবিখ্যাত ভাষণ ‘Pericles’ Funeral Oration’ প্রদান করেন। ভাষণটি আসপাশিয়া লিখেছিলেন বলে প্লেটো তার Menexenus ডায়ালগে উল্লেখ করেন।

৯৭. গ্রিক ইতিহাসবিদ থুকিডিডিস (Thucydides), পেলোপোনেসিস যুদ্ধ নিয়ে তিনি লেখেন বিখ্যাত বই ‘History of the Peloponnesian War’, এতে তিনি ‘Pericles’ Funeral Oration’ লিপিবদ্ধ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *