1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৩৬

৩৬

‘মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোত্তম প্রকাশ তখনই পায়,
যখন সে নিজেকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে।’

—সক্রেটিস

ভর সন্ধ্যায় পেরিক্লিস একা বারান্দায় হাঁটছেন। তার মন ভীষণ খারাপ। বাইরে শীতের ঠাণ্ডা বাতাস শুরু হয়েছে। কেমন একটি হু হু শব্দ চারদিকে। শব্দটি পেরিক্লিসের বুকের ঠিক মাঝখানে আঘাত করছে। সব দিক থেকে ভাঙনের শব্দ আসছে। পেরিক্লিসের বুক ভেঙে যাচ্ছে।

এনাক্সাগোরাস চলে গেছেন। এথেন্স থেকে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন। পেরিক্লিসই তাকে চলে যেতে বলেছেন। এথেন্সের মানুষ গুরুকে থাকতে দিল না। তাকে মামলা দিয়ে নগরছাড়া করল।

গুরু পাগলা কিসিমের মানুষ। নিজের মনে থাকতেন। কারও কোনো ক্ষতি করেছেন বলে কেউ শোনেনি। তার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু শত্রু আছে পেরিক্লিসের। তারা পেরিক্লিসকে তাড়াতে চায়। কিন্তু পেরিক্লিসকে তাড়ানো সহজ নয়। মানুষ তাকে ভালোবাসে, তাকে ভোট দেয়। তাকে তাড়ানোর চেয়ে তার কাছের মানুষদের তাড়ানো অনেক সহজ। পেরিক্লিসের প্রিয় মানুষ এনাক্সাগোরাস। সবচেয়ে কাছের দার্শনিক। তার নামে মামলা দিল। অভিযোগ : তিনি নাকি ধর্ম মানেন না। তিনি দেবতাদের অপমান করেন।

পেরিক্লিস চেষ্টা করেছেন, মামলা বন্ধ করতে। কিন্তু না, মামলাবাজ শত্রুরা প্রমাণ নিয়ে হাজির। এনাক্সাগোরাস নিজের মুখে বলেছেন, সূর্য হলো একটি লাল ধাতুর গোল্লা, সূর্যের চলাচলে দেবতাদের কোনো হাত নেই। এই কথা হাজার হাজার মানুষ শুনেছে। আরও অনেক বড় প্রমাণ আছে। গুরু তার বইতে দেবতাদের নিয়ে হাসাহাসি করে অনেক কথা লিখেছেন।

এত দিন তার নামে নানা কথা হলেও পাগল বলে সবাই হাসি-ঠাট্টা করেছে। কিন্তু এখন সময় আলাদা। কিছুদিন হলো পেরিক্লিসের শত্রুরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা পেরিক্লিসকে শিক্ষা দিতে চায়। সেজন্য সহজ শিকার তার গুরু এনাক্সাগোরাস। তার নামে মামলা করল। মারাত্মক মামলা। ধর্ম বিরোধিতার মামলা। এই মামলার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

বিপদ বুঝে পেরিক্লিস নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, গুরু পালিয়ে যাক। এই মামলায় তার মাফ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বুড়ো মানুষ। প্রাণে বাঁচুক। এথেন্স ছেড়ে চলে গেলেই তার আর কোনো সমস্যা নেই। গুরু যেতে চাননি। সে পাগল হলেও তার বিবেক টনটনে। সম্মান জ্ঞান মারাত্মক। তিনি জানেন, তিনি কোনো দোষ করেননি। তিনি জ্ঞানপ্রেমিক মানুষ। জ্ঞানের টানে যা সত্য বলে মানেন, তাই বলেছেন। কোনো অন্যায় করেননি। তিনি এথেন্স ছাড়বেন কেন?

কিন্তু পেরিক্লিস জানেন এই জেদের পরিণাম কী হবে। তিনি জোর করেই গুরুকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। গুরুর জীবন বাঁচাতে আর কোনো উপায় ছিল না।

পেরিক্লিস পুবের ঘরটার দিকে তাকাতে পারছেন না। খোলা জানালাটার দিকে চোখ গেলেই বুকটা চিনচিন করে। এই ঘরে টানা ত্রিশ বছর ছিলেন গুরু। আজ সেই ঘরটা শূন্য। ঘরের বাসিন্দা বৃদ্ধ বয়সে ঘুরছেন পথে পথে। খুঁজছেন নতুন ঠিকানা। পেরিক্লিস তরুণ বয়সে তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন বিপদে-আপদে সব সময় সুবুদ্ধি দিয়ে পাশে থেকেছিলেন গুরু। পেরিক্লিসের চোখে কেউ কোনোদিন পানি দেখেনি। তিনি দেবতা জিউসের মতো গম্ভীর কিন্তু গুরুর দুঃখে তার চোখ বেয়ে পানি এলো। পেরিক্লিস কাঁদছেন। বুক চেপে কাঁদছেন।

আসপাশিয়াও কাঁদছে। গুরু যাওয়ার সময় সে সবকিছু গুছিয়ে দিয়েছে। আসপাশিয়ার দর্শন আলোচনার এক নম্বর সঙ্গী ছিলেন এই বৃদ্ধ। সে শব্দ করে কাঁদছে। এমন দুঃখের পরিবেশ পেরিক্লিসের ঘরে আগে আর আসেনি। পেরিক্লিসের ভীষণ অসহায় লাগছে। জীবনে এই প্রথম নিজেকে খুব দুর্বল লাগছে।

একদিকে চলছে স্পার্টার সাথে যুদ্ধ। অন্যদিকে এসব ঝামেলা। পেরিক্লিসের সময় ভালো যাচ্ছে না।

খাওয়ার ঘরে রাতের খাওয়ার পড়ে আছে। আজ এই ঘরে কেউ খেতে পারবে না। এমন সময় দাস খবর দিল ফিডিয়াস আর ডেমন এসেছে।

পেরিক্লিস বললেন, ওদেরকে এখানে নিয়ে আয়।

দুই শিল্পী ঘরে ঢুকে বসল। চারজনই চুপ।

ফিডিয়াস একটি পেপিরাস কাগজ দিল পেরিক্লিসের হাতে। আর একটি মামলার নোটিশ। পেরিক্লিস নোটিশে চোখ বুলিয়ে শুকনো মুখে আসপাশিয়াকে দিলেন কাগজটি।

শিল্পী ফিডিয়াসের নামে মামলা হয়েছে। অভিযোগ : পার্থেনন আর এথিনার মূর্তি বানাতে টাকা চুরি করেছে ফিডিয়াস। এথিনার মূর্তিতে অনেক স্বর্ণ দেওয়া হয়েছিল। সব স্বর্ণ নাকি মূর্তিতে দেওয়া হয়নি। ফিডিয়াস নিজে নিয়ে গেছে সেই সোনা।

পেরিক্লিসের মুখে কোনো কথা নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন ফিডিয়াসের দিকে। গুরুকে সরিয়ে দিয়েই ওরা ক্ষান্ত হয়নি। এবার টার্গেট ফিডিয়াস।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল ফিডিয়াস। পেরিক্লিসের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি গুরুর মতো আমাকেও এথেন্স থেকে চলে যেতে বলবে?

পেরিক্লিস কিছুই বলছেন না।

চিৎকার করে উঠল ফিডিয়াস— পেরিক্লিস, আমি বলে দিচ্ছি আমি কিন্তু পালিয়ে যাব না। আমি শিল্পী। জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছি এথেন্সকে। নিজের হাতে সাজিয়েছি এই স্বপ্নের এথেন্স। এই স্বর্ণপুরী আমার নিজের ডিজাইন করা। আমি এখান থেকে কোথাও যাব না। আমি মামলা লড়ব। আমি আমার কাছে পরিষ্কার। এক রত্তি সোনাও সরেনি। ওরা পরীক্ষা করুক।

আসপাশিয়াও হুংকার দিয়ে বলল, হ্যাঁ, এবার আমাদের লড়তে হবে। গুরুর মতো পালাতে বলবে না ওকে।

সবাই এমন করে কথা বলছে যেন এর জন্য পেরিক্লিসই দায়ী। সবাই ধরেই নিয়েছে, ফিডিয়াসকেও পালিয়ে যেতে বলবে পেরিক্লিস।

পেরিক্লিস দাঁড়িয়ে বললেন, না, তুমি পালাবে না ফিডিয়াস। গুরুর পালানোর কারণ ছিল। তাকে যে মামলা দিয়েছিল, তাতে গুরুর মৃত্যুদণ্ড হতো। আমি গুরুকে বাঁচাতে পারতাম না। ওরা গুরুকে ফাঁসি দিয়ে দিত। কিন্তু তোমার মামলা চুরির মামলা। এই মামলা আমরা লড়ব। তুমি প্রমাণ জোগাড় করো ফিডিয়াস। আসপাশিয়া তোমার জন্য আদালতের জবাব লিখে দেবে।

রাত-দিন খেটে হিসাব বানাল ফিডিয়াস। হিসাব এক্কেবারে পাকা। এক সুতাও ফাঁক নেই। সে খুশি। এবার চলো আদালতে।

.

আদালতে ফিডিয়াস নির্দোষ প্রমাণিত হলো। সে মাথা উঁচু করে আদালত থেকে বেরিয়ে এথিনার মন্দিরে গেল। দেবী তাকে এই ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচিয়েছেন। দেবীকে ভক্তি করতে হবে। কিন্তু মন্দির থেকে বের হতেই তার দাস আর একটি নোটিশ তার হাতে দিল। তার নামে নতুন মামলা হয়েছে। এবার অভিযোগ মারাত্মক।

এবারের অভিযোগ : ধর্মদ্রোহিতা। ফিডিয়াস এথিনার সোনার মূর্তিতে দেবীর হাতে যুদ্ধের ঢালের উপর যে দুইজন যোদ্ধার মুখ এঁকেছেন, সেই দুজন নাকি পেরিক্লিস আর ফিডিয়াস। সে দেবীর ঢালে নিজেদের মুখ বসিয়েছে। আর এটি করে ফিডিয়াস নিজেকে আর পেরিক্লিসকে দেবতা বলে ঘোষণা করেছে।

এটি ভয়াবহ অপরাধ। এই মামলা মারাত্মক। ফিডিয়াস পার্থেননের দরজায়ই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকাল মূর্তির দিকে। দেবীর হাতে ঢালটা দেখা যাচ্ছে। সোনার মূর্তির উপর দুজন সোনালি যোদ্ধা। চকচক করছে। এক নজরেই বোঝা যায় ঐ দুইজন যোদ্ধা আসলে পেরিক্লিস আর ফিডিয়াস।

ফিডিয়াস জানে এটি সত্য। সে এটি করে ফেলেছে। সৃষ্টির আনন্দে তখন সে দিশাহারা। ঐ সময় সে পেরিক্লিসের উপর ভীষণ মুগ্ধ। ভীষণ কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতায় তার মুখ বানিয়ে ফেলেছিল। পেরিক্লিস দেখে লজ্জা পেয়ে বলেছিলেন, এটি কী করেছ তুমি? ফিডিয়াস বলেছিল, যা করেছি ভালো করেছি। পেরিক্লিস বলেছিলেন, তাহলে আর একজন যোদ্ধা তুমি হয়ে যাও। দুজনেই তখন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মগ্ন। বিপদের কথা মাথায়ই আসেনি

এই মামলা ভয়াবহ। নতুন মামলার কথা শুনে পেরিক্লিস বললেন, ফিডিয়াস, এইবার তুমি পালিয়ে চলে যাও। ওরা তোমাকে এথেন্সে থাকতে দেবে না।

‘আমার অপরাধটা কী বলো তো?’

‘তোমার অপরাধ তুমি আমার বন্ধু।’

না, ফিডিয়াস যাবে না। তিনি শিল্পীদের ওস্তাদ মহাশিল্পী। শিল্পীরা ভীষণ একরোখা হয়। শেষ দেখে ছাড়বে। পেরিক্লিস অনেক বলেও তাকে পালাতে রাজি করাতে পারল না। ফিডিয়াস শিল্পীমানুষ। সে রাজনীতি বোঝে না। সে জানে না যে স্বার্থের জন্য মানুষ কত খারাপ হতে পারে।

মামলা আদালতে উঠল। ফিডিয়াস দোষী। সে দেবতাদের আসনে মানুষকে বসিয়ে ধর্মের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। শাস্তি ঘোষণা হলো যাবৎ জীবন জেল। ফিডিয়াস জেলে গেল।

অন্ধকার কারাগারে বন্দি শিল্পী ফিডিয়াস। যে মানুষটি এথেন্সে আলো আনতে দিন-রাত খেটেছে, সে এখন অন্ধকারে। যে নিজের হাতে কয়েকশ অট্টালিকা ডিজাইন করেছে, সে এখন ছোট্ট এক ঘুপচি কুঠুরিতে বন্দি। এটি মানতে পারলেন না ফিডিয়াস। কয়েক দিনেই শিল্পীর মনের শক্তি চলে গেল। সে উল্টা-পাল্টা কী যেন করে। দিন-রাত কী সব আঁকিবুকি করে। জিজ্ঞেস করলে বলে, আর একটি পার্থেনন বানাচ্ছি।

জেলের খাদ্য তার ভালো লাগে না, তবু খেতে হয়। খেলেই তার বুক জ্বালা করে, মনে হয় পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে আসছে। তাকে যে খাবার দেওয়া হতো, তাতে বিষ ছিল। স্লো পয়জনিং করা হয়েছে। একদিন খবর এলো, প্রতিদিন একটু একটু করে বিষের যন্ত্রণা সয়ে সয়ে ধীরে ধীরে জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে মারা গেছে ফিডিয়াস। মিশর থেকে আনা নীল রং দিয়ে সে এথেন্সকে সাজিয়েছিল, আজ বিষে নীল হয়ে পড়ে আছে তার নিথর দেহ। যে হাত একদিন পাথরকে কথা বলাত, সেই হাত আজ নিশ্চল। যার অপরূপ মূর্তি দেখতে ছুটে আসে সারা পৃথিবীর মানুষ, সে একাকী মরে পড়ে আছে কারাগারের স্যাঁতসেঁতে ঘরে। এথেন্সে হাজার হাজার মূর্তি কথা বলছে, কিন্তু সেই মূর্তির কারিগরের মুখ অন্যায়ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে চিরতরে।

পেরিক্লিসের আরেকজন কাছের মানুষ চলে গেল। তার কথা মনে হলেই পেরিক্লিস কোঁদে ওঠেন। তার বুক ফেটে দুঃখ বেরিয়ে আসে। পেরিক্লিস পার্থেননের দিকে তাকাতে পারেন না। এথেন্সের রাস্তায় বের হতে পারেন না। যেদিকে তাকান, সেদিকেই ফিডিয়াসের বানানো নানান জিনিস। এক একটি জিনিস চোখে পড়লেই তার কান্না আসে।

আসপাশিয়াও দিন রাত কাঁদছে।

পেরিক্লিস আসপাশিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, পেরিক্লিসের সভার দুটি পাখি উড়াল দিল। এর পরে কে?

আসপাশিয়া অস্ফুট স্বরে বলল, দার্শনিক প্রোটাগোরাস।

প্রোটাগোরাস এথেন্সের সবচেয়ে শক্তিশালী দার্শনিক। সবাই জানে তিনি দেবতা মানেন না। তার কথা হলো ‘মানুষই সবকিছুর পরিমাপক’। দেবতারা কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে না। মানুষের নিজের চিন্তা থেকে দেবতা তৈরি হয়েছে। পেরিক্লিসের কাছের মানুষদের যখন একে একে মামলা দিয়ে ফাঁসাচ্ছে, তখন প্রোটাগোরাস বাদ যেতেই পারেন না।

পরের সপ্তাহেই মামলা হলো। প্রোটাগোরাস আগে থেকেই তৈরি ছিল। প্রাণ বাঁচাতে তিনি এথেন্স ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

তার কয়দিন পরেই শিল্পী ডেমনের নামে মামলা হলো। অভিযোগ : সে নাকি পেরিক্লিসকে ভোটে জেতাতে গান লেখে। তার গানে মানুষের মাথা বিগড়ে যায়। সে দেবতার গান গায় না। মানুষকে পাগল বানাতে গান বানায়। খুবই হাস্যকর মামলা। কিন্তু ডেমন ভয় পেল। ফিডিয়াসের মারা যাওয়ার কথা মনে পড়ল। ডেমন এথেন্স ছেড়ে পালিয়ে গেল।

পেরিক্লিস আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। এথেন্সের মেঘমুক্ত রাতের নির্মল আকাশে অনেক তারা জ্বলজ্বল করছে। পেরিক্লিসের মনে হচ্ছে আকাশ থেকে একটি একটি করে তারা খসে পড়ছে। তিনি অনেক চেষ্টা করছেন, কিন্তু থামাতে পারছেন না। সব তারা ঝরে যাচ্ছে। পেরিক্লিসের মনের ভেতরটা হু হু করছে।

.

পেরিক্লিস ভেবেছিলেন, তার খারাপ সময় চলে গেছে।

কিন্তু দেখা গেল দুঃসময় কাটেনি। আরও বড় দুঃসময় আসছে। এবার মামলা হলো আসপাশিয়ার নামে। মামলা করেছে হার্মিপাস নামক একজন কবি ও নাট্যকার।

আসপাশিয়ার নামে অভিযোগ : সে নাকি এথেন্সের মেয়েদের কুপথে নিচ্ছে। সে পেরিক্লিসের মনোরঞ্জনের জন্য দূর থেকে মেয়েদের নিয়ে আসে।

অভিযোগ শুনে আসপাশিয়া সারাদিন কাঁদল। এথেন্সের মানুষ যে এত নিচু মনের হতে পারে, সে ভাবতেও পারেনি। পেরিক্লিস তাকে সাহস দিল। এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। এই মামলায় কিচ্ছু হবে না।

পেরিক্লিসের কথাই ঠিক হলো। সে মামলা থেকে খালাস পেল।

কিন্তু এত সহজে তাদের ছাড়বে না শত্রুরা। আসপাশিয়ার নামে আবার মামলা করেছে সেই একই কবি। এবার অভিযোগ আসপাশিয়া দেবতাদের অপমান করেছে। সে দেবতা মানে না। দেবতাদের নামে সে যা খুশি বলে।

এবার ভয় পেল পেরিক্লিস। দেবতাদের অপমানের মামলা ভয়াবহ। এই মামলায় কোনো প্রমাণ লাগে না। অভিযোগ করা মানেই বিপদ। এরকম মামলায়ই সাজা পেয়েছে ফিডিয়াস।

পেরিক্লিস দিনে দিনে দুর্বল হয়ে গেছেন। একের পর এক আঘাত আর সইতে পারছেন না। একদিকে স্পার্টার সাথে যুদ্ধ চলছে। তিনি রাত-দিন বৈঠক করে যুদ্ধের কৌশল করেন। তার উপর একের পর এক মামলা দিয়ে বিরোধীরা তাকে দম ফেলতে দিচ্ছে না।

আসপাশিয়ার মামলা তাকে একেবারে কাবু করে ফেলল। আসপাশিয়াকে ছাড়া তিনি বাঁচতে পারবেন না। গুরু চলে গেছে, প্রোটাগোরাস মরে গেছে। যারা তার মনের জোর ছিল তারা একে একে বিদায় নিয়েছে। যাকে নিয়ে এথেন্সকে সাজিয়েছিলেন, সেই ফিডিয়াস জেলে পচে মরেছে। ডেমন পালিয়েছে। এসব আঘাত পেরিক্লিসের বুকে ঘা করে ফেলেছে। কিন্তু এবার যেটি এসেছে, সেটি একেবারে মরণ বাণের মতো। আসপাশিয়ার কিছু হলে তিনি বাঁচতে পারবেন না।

মামলা চলতে দেওয়া যাবে না। তার যা ক্ষমতা আছে, সব দিয়ে আসপাশিয়াকে বাঁচাতে হবে।

আসপাশিয়া কাঁদছে না। ফিডিয়াসের জন্য সে কেঁদেছে, গুরুর জন্য চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছে। কিন্তু নিজের বিপদে সে কাঁদবে না। তার জন্য পেরিক্লিস কাঁদছেন। পেরিক্লিস ভেঙে পড়েছেন। তাই সে নিজে ভেঙে পড়বে না। পেরিক্লিসকে সোজা করে দাঁড় করাতে হবে। শুধু ছেলের দিকে তাকালে কান্না আসে। ছেলের বয়স পাঁচ বছর। মা চলে গেলে তাকে দেখার কেউ নেই।

আসপাশিয়া ভাবছে কী করা যায়। পরামর্শ নেওয়ার কেউ নেই। বন্ধুদের আগেই দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভালো বন্ধু বলতে আছে সক্রেটিস। কিন্তু সক্রেটিস রাজনীতি করে না। মামলা-মোকদ্দমা বোঝে না। আসপাশিয়া ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছে না।

.

গুরু এনাক্সাগোরাসের জন্য সক্রেটিস কেঁদেছে। এমন ভোলাভালা ভালো মানুষকে তাড়িয়ে দিয়ে এথেন্সের কী লাভ হলো? তার মানে এই গণতন্ত্রে ভালো মানুষদের সাজা দেওয়া যায়। এটি মারাত্মক ব্যবস্থা।

সক্রেটিস আসপাশিয়ার মামলার কথা শুনল। তার মন ভীষণ খারাপ। এথেন্সে কী শুরু হয়েছে! একের পর এক মামলা। পেরিক্লিসকে শেষ না করে ওরা ছাড়বে না। সক্রেটিস আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল।

সক্রেটিস জেনথিপিকে আসপাশিয়ার মামলার কথা বলল। জেনথিপি সরল মেয়ে। সে মামলা-টামলা বোঝে না। কোনো মেয়ের নামে মামলা হয়েছে, এটি সে কোনোদিন শোনেনি।

জেনথিপি বলল, আজব ঘটনা। মেয়েমানুষের নামে আবার মামলা হয় নাকি?

সক্রেটিস বলল, এটি ঠিক বলেছ, এথেন্সে মেয়েদের নামে মামলার কথা শোনা যায়নি। আজব ঘটনাই।

জেনথিপি বলল, এথেন্সে কী শুরু হয়েছে? দেবতার শাপ লাগছে। ঘোর দুর্দিন আসছে। দেবতারা সইবে না। মেয়েরা হলো ঘরের শান্তি। তাদের নিয়ে আদালতে টানাটানি!

সক্রেটিস বলল, আসপাশিয়া ঘরের শান্তি ধরনের মেয়ে নয়। অত ভোলাভালা নয়। সে পুরুষের চেয়ে কয়েক কাঠি সরেস।

জেনথিপির বিশ্বাস হচ্ছে না। মেয়েমানুষ আবার পুরুষের চেয়ে সরেস হয় নাকি? সে বলল, কিন্তু মামলা কেন করেছে? দোষ কী? কিছু চুরি করছে? নাকি প্রেম-ট্রেম, পরকীয়া?

সক্রেটিস হাসল। এথেন্সে প্রেমের কোনো কারবার নাই। একমাত্র প্রেমের ঘটনা হলো পেরিক্লিস-আসপাশিয়া জুটি।

‘তাহলে কী নিয়ে মামলা?’

‘মামলায় ওরা যাই লিখুক, আসল অপরাধ সে পেরিক্লিসের ঘরনি। পেরিক্লিসের শত্রুরা তার সকল আপন মানুষদের পিছনে লেগেছে। ছুতানাতায় তাদের নামে মামলা দিচ্ছে।’

‘কী মতলবে এমন করছে?’

‘মতলব হলো পেরিক্লিসকে একা করে ফেলা। সামনে থেকে পেরিক্লিসকে কিছুই করতে পারছে না, তাই পেছন থেকে ছুরি মারছে। সে জন্য তার নিজের লোকদের সরিয়ে দিচ্ছে। একে একে সবার নামে মামলা হচ্ছে।’

‘তো পেরিক্লিস কি বসে বসে আঙুল চুষছেন? তিনি কিছু করতে পারেন না? তিনি তো রাজা। রাজার বউয়ের নামে মামলা করে, আর রাজা বসে থাকেন?’

সক্রেটিস বলল, পেরিক্লিস রাজা নন। তিনি গণতন্ত্রের নেতা। রাজা হলে, তার বউয়ের নামে কেউ মামলা করতে পারত না। সেটি সম্ভব নয়। কিন্তু গণতন্ত্রে সম্ভব।

‘এত কিছু বুঝি না। আমরা তো জানি পেরিক্লিস ত্রিশ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। এত লোক এলো-গেল কিন্তু পেরিক্লিস ঠিকই রয়ে গেছেন। তিনি রাজা নয় তো কী? এথেন্সে এমন কে আছে যে পেরিক্লিসের কথা ফেলে দেবে? তিনি চাইলে এসব মামলা-টামলা সব পানি-ভাত হয়ে যাবে।

সক্রেটিস কিছুই বলল না। জেনথিপি একেবারে মিথ্যা বলেনি। পেরিক্লিস যদি গোপনে চেষ্টা করে, সংসদে এই মামলা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে পারে।

কয়েক দিনেই দেখা গেল, এই বুদ্ধি শুধু জেনথিপির নয়। সবাই এই পরামর্শ দিচ্ছে। পেরিক্লিস যদি সংসদে অনুরোধ করে বলেন যে, আসপাশিয়া নির্দোষ, এই মামলা বন্ধ করেন, তাহলে মামলা বন্ধ হবে। এখনও লোকে পেরিক্লিসের কথা বিশ্বাস করে, তিনি এথেন্সকে কতটা ভালোবাসেন, তা মানুষ জানে।

কিন্তু পেরিক্লিস মন ঠিক করতে পারছেন না। মানুষ যাই বলুক গণতন্ত্র, আইন, বিচার এগুলো তিনি মন থেকেই মানেন। তার কাছে এথেন্সের গণতন্ত্র সারা পৃথিবীর জন্য উদাহরণ। এথেন্সে আইন নিজের মতো চলে, তাতে কেউ নাক গলায় না। বিচার বিচারের মতোই হয়, শাসকরা কেউ বিচারে হাত দেয় না। এখানে সবার অধিকার সমান। পেরিক্লিসই এই ব্যবস্থা তৈরি করেছেন। তিনি নিজে এই আইন ভাঙবেন না। যেদিন তিনি আসপাশিয়াকে ঘরে এনেছেন, সেদিনও আইন ভাঙেননি। নিয়ম মেনে নিজের বউকে তালাক দিয়ে আসপাশিয়াকে ঘরে এনেছেন। এত বছর আইনের বিয়েও করতে পারেননি। তবু আইন ভাঙেননি পেরিক্লিস।

কিন্তু এখন শত্রুরা চূড়ান্ত আঘাত করছে। মামলা চললে আসপাশিয়ার মৃত্যুদণ্ড বা যাবৎ জীবন জেলও হতে পারে। বিনা দোষে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের এই পরিণতি মানা যাবে না।

পেরিক্লিস সংসদে গেলেন। পিনিক্স পাহাড়ের উপর হাতজোড় করে দাঁড়ালেন। সবাই অবাক। তাকে এইরূপে কেউ দেখেনি। তিনি সবার কাছে জিউসের মতো। সবাই জানে যে তার কোনো আবেগ নেই, কোনো হতাশা নেই। তিনি দাঁড়ালেই মানুষ ভরসা পায়। তিনি সব বিপদ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। সেই পেরিক্লিস হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছেন।

পেরিক্লিস ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন— গত পঁচিশ বছরে তিনি কীভাবে এথেন্সকে আজকের জায়গায় এনেছেন। আজ এথেন্সের সামনে কোনো নগর দাঁড়াতে পারে না। অর্থ, বিত্ত, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দৰ্শন, সাহিত্য, শিল্প, সৌন্দর্য সব ক্ষেত্রে এথেন্স সবার সেরা। সেটি হয়েছে এই পেরিক্লিসের সময়েই। সবাই তার কথায় সায় দিল। এর চেয়ে সত্য কথা আর হয় না।

এরপর তিনি বললেন আসপাশিয়া এথেন্সের জন্য কী করেছে। আসপাশিয়ার বুদ্ধিতে এথেন্স যে সুনাম পেয়েছে সেটি দুনিয়ার সেরা।

তারপর পেরিক্লিস, সকলের কাছে আসপাশিয়ার মামলা বাতিল করার অনুরোধ করলেন। বলতে বলতে তার চোখে পানি চলে এলো।

অশ্রু ভরা চোখে পেরিক্লিস বললেন, যদি কোনো দোষ হয়ে থাকে, সেটি আমার। আসপাশিয়া কোনো দোষ করেনি। তাকে রেহাই দাও।

এথেন্সের সংসদে ভীষণ এক বেদনার পরিবেশ। এথেন্সের মানুষ এভাবে পেরিক্লিসকে দেখতে চায় না। পেরিক্লিস তাদের বিপদের কাণ্ডারি। সুখের দিনে আরও সুখ আনার মানুষ। তিনি দুঃখে আছেন, সেটি ভেবে মানুষের কষ্ট হলো। এই মামলা চলবে কিনা সেই বিষয়ে তখুনি ভোট হলো। ভোটে মামলা বাতিল হয়ে গেল।

হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন পেরিক্লিস। কিন্তু তাকে দেখেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল আসপাশিয়া। সে জানে এই মামলা শেষ করতে পেরিক্লিসকে কতখানি ছোট হতে হয়েছে। পেরিক্লিস মানুষের কাছে তার জন্য দয়া চাইছেন, এটি ভাবলেই আসপাশিয়ার কান্না পাচ্ছে। এর চেয়ে তার মরে যাওয়াই ভালো ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *