1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৩১

৩১

‘তোমাকে সারা জীবন নোঙরের মতো
ধরে রাখে একজন নারী, সে তোমার মা।’

— সফোক্লিস

***

আসপাশিয়া মা হবে।

একটি মেয়ের জন্য এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর হতে পারে না। কিন্তু আসপাশিয়া আনন্দে নেই। তার মা হওয়ার খবরে সারা এথেন্সে বিশ্রী রকম রব উঠেছে। নিন্দার রব। মানুষ পথে ঘাটে নোংরা কথা বলছে। আসপাশিয়া সারাদিন কাঁদছে। এসব নিন্দা আগে গায়ে লাগত না। কিন্তু সন্তান তুলে গালি দিলে পৃথিবীর কোনো মা সহ্য করতে পারে না। আসপাশিয়াও পারছে না।

এই প্রথম তার মনে হচ্ছে সে জীবনে ভুল করেছে। পেরিক্লিসের ঘরনি হওয়াটা ভুল ছিল। একটি ভুল জীবনের জালে সে জড়িয়ে আছে। বড় কঠিন সে জাল। ভুল জালটিকে ছিঁড়ে শুদ্ধ করার ক্ষমতা তার নেই। আসপাশিয়া কাঁদছে। দিন-রাত কাঁদছে। সে বুঝতে পারছে তার অনাগত সন্তান এথেন্সে কোনো মর্যাদা পাবে না। সেই শিশুটিকে রাস্তা ঘাটে গালি শুনতে হবে। কুৎসিত সেই গালি। জন্মের অপরাধে গালি। নিষ্পাপ শিশুটি অনেকদিন সেই গালির অর্থ বুঝবে না। যেদিন বুঝবে, সেদিনই তার ছোট্ট পৃথিবীটি ছারখার হয়ে যাবে। আর সেই মুহূর্ত থেকেই তাকে পৃথিবীতে আনার অপরাধে মাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে।

আমার সন্তান আমাকে ঘৃণা করবে? সারা এথেন্স আমার সন্তানকে ঘৃণা করবে? তার জীবনে থাকবে শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা। কিন্তু কেন? তার আর পেরিক্লিসের ভালোবাসার ফল কখনো ঘৃণা হতে পারে না। কিন্তু তার জীবনে সেটিই হচ্ছে। একটি অনাগত শিশুর ঘৃণাভরা জীবনের কথা মনে করে আসপাশিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

পেরিক্লিসও ভেতরে ভেতরে কাঁদছেন। তিনি ভাবছেন তার সন্তান এথেন্সের নাগরিক হতে পারবে না। তার উত্তরাধিকারীও নয়। তারও মন খুব খারাপ। তিনি বাইরে কাঁদছেন না, কিন্তু ভেতরের একূল ওকূল দুকূলই হু হু করছে। তার ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কান্না করতে। কিন্তু তিনি কাঁদলে আসপাশিয়াকে সামলাবে কে?

কিছু দিনের মধ্যেই আসপাশিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ল। ভীষণ রকম অসুস্থ। তার’ চিকিৎসা দরকার। এখানে রোগ মানে দেবতার অভিশাপ। কেউ অসুস্থ মানে হলো তার উপর দেবতা রুষ্ট হয়েছে। সবাই বলল, কোনো কারণে আসপাশিয়ার উপরে দেবতারা অসন্তুষ্ট হয়েছে। দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে পেরিক্লিস আর আসপাশিয়া দুজন মিলে অনেক চেষ্টা করলেন। পশু বলি দিলেন, ধুমধাম করে প্রার্থনা করলেন। কিন্তু দেবতার রাগ কমছে না, সুস্থ হচ্ছে না আসপাশিয়া।

পেরিক্লিস তাকে নিয়ে গেলেন এসক্লিপিয়ন হাসপাতালে।

গ্রিকদের চিকিৎসার দেবতার নাম এসক্লিপিয়াস। ডাক্তারি শাস্ত্রের সব জারিজুরি তার হাতেই। এ দেবতার বংশধররা সারা গ্রিসে কয়েকটা সুন্দর বাড়ি করে রেখেছে। যেকোনো রোগ হলে, এসব বাড়িতে একবার ঢুকতে পারলেই নাকি সব রোগ সেরে যায়। দেবতা এসক্লিপিয়াসের নাম থেকে এ বাড়িগুলোকে তারা বলে এসক্লিপিয়ন হাসপাতাল।

এসক্লিপিয়াস কীভাবে চিকিৎসাবিদ্যা শিখল সেটি নিয়ে নানা কাহিনি আছে। হোমার তার ইলিয়াডে বলেছেন, এসক্লিপিয়াস ছিল ট্রয় যুদ্ধের সময়ে গ্রিক সেনাদের চিকিৎসক। কিন্তু গ্রিকরা বিশ্বাস করে যে, সে একজন দেবতা। সে দেবতা এপোলোর ছেলে। এপোলো নিজে তাকে রোগ সারানোর সব উপায় শিখিয়েছেন। আবার অনেকে বলে যে এসক্লিপিয়াস একটি সাপকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, সাপটি তার কানে কানে চিকিৎসা করার সব গোমর বলে গেছে। সেজন্য এসক্লিপিয়াস তার হাতে সব সময় রাখেন একটি সাপ। খালি হাতে সাপ রাখা সমস্যা। সেজন্য তিনি সাপটিকে একটি লাঠিতে পেঁচিয়ে রাখেন। লাঠিতে জড়ানো এই সাপটিই চিকিৎসাবিদ্যার প্রতীক। গ্রিকদের চিকিৎসার ব্যাপারে তাই সাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রিকরা মনে করে, সাপের যেমন বিষ আছে, তেমনই বিষ টানার ক্ষমতাও আছে। রোগ তো দেবতার অভিশাপ, সেই অভিশাপ টেনে নিতে পারে সাপ। তাই সাপের চিকিৎসা ক্ষমতা আছে। সাপ একটি ডাক্তার প্রাণী। চিকিৎসা করতে সাপ লাগবেই।

এসক্লিপিয়ন হাসপাতালেও রোগ ভালো করা হয় সাপের মাধ্যমে। এখানে চিকিৎসা মানেই সর্প-চিকিৎসা। প্রতিটি এসক্লিপিয়ন হাসপাতালে সাপ পোষা হয়। সারা গ্রিসের সবচেয়ে বড় আর বিখ্যাত এসক্লিপিয়ন হাসপাতাল হলো এথেন্স থেকে দেড়শ মাইল পশ্চিমে এপিদাভরোস নামে একটি জায়গায়। পেরিক্লিস আসপাশিয়াকে সেখানে নিয়ে গেলেন।

এখানে এসেই আসপাশিয়ার মন ভালো হয়ে গেল। এমন জায়গায় আসপাশিয়া আগে কখনো আসেনি।

জায়গাটি ভীষণ মনোরম। তিন দিকে পাহাড়, এক দিকে সাগর। পাহাড়গুলো সবুজের মতো সবুজ, আর সাগরটা নীলের মতো নীল। তিনটি পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে সাগর থেকে বাতাস আসছে। নির্মল বাতাস। সেই বাতাসে মিষ্টি একটি গন্ধ আছে। সাথে আছে শন শন একটি সুর। সেই সুর মানুষকে উদাস করে দেয়। সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। এখানে এসে আসপাশিয়ার মনে হচ্ছে এই পৃথিবী খুব সুন্দর। কোনো চিন্তা নেই, মানুষের কোলাহল নেই, ঝগড়াঝাঁটি নেই, প্রতিযোগিতা নেই। মনে হচ্ছে— জীবন একটিই, আর সে জীবন বড় স্নিগ্ধ, বড় শান্তির।

এখানে আসার কয়েকদিন পরেই আসপাশিয়ার মনে হচ্ছে সে সুস্থ হয়ে গেছে। তার সর্প-চিকিৎসা এখনও হয়নি। চিকিৎসার জন্য কিছুদিন এখানে থাকতে হয়। দুনিয়ার ঝামেলা বাদ দিয়ে কয়েকদিন ফুরফুরে মেজাজে ঘুরতে হবে। শান্তিতে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। তারপর পূর্ণিমার রাতে হবে চিকিৎসা। সর্প-চিকিৎসা। সেই রাতে একটি ছোট্ট ঘরে একলা ঘুমাতে হবে। আর মনে মনে ভাবতে হবে রাতে একটি সাপ আসবে আমার ঘরে, ডাক্তার সাপ। আমার শরীর থেকে দেবতার অভিশাপ শুষে নেবে। সেই ভেবে ঘুমিয়ে যেতে হবে। ঘুমের ঘোরেও সাপ স্বপ্ন দেখবে। আর সকালে উঠে দেখবে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

আসপাশিয়া ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছে। একটি ঘরে কয়েকটি সাপ। বড় বড় সাপ। সেগুলো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চলছে। জিহ্বা বের করছে। লকলকে জিহ্বা। ফণা তুলছে। হিশ্ হিশ্ শব্দ করছে। ভয়ংকর ব্যাপার।

আসপাশিয়া ভাবছে, এই রকম একটি সাপ আমার ডাক্তার। রাতে একলা ঘরে আমার চিকিৎসা করবে। আমার পেটে সন্তান। আমার শরীর পেঁচিয়ে ধরবে ঐ বড় সাপটি। ভেবেই ভীষণ ভয় লাগল তার। সে এই চিকিৎসা করাতে পারবে না। সর্প-চিকিৎসায় ভরসা করতে পারছে না। সে বিজ্ঞানের দেশের মেয়ে, তার শহরে জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানের জনক থেলিস। সে ছোটবেলা থেকেই যুক্তি শিখেছে, দেবতার নামে সবকিছু সে বিশ্বাস করে না।

সে পেরিক্লিসকে গিয়ে বলল, তার সর্প-চিকিৎসার দরকার নেই। সে তো ভালো হয়েই গেছে।

পেরিক্লিস বুঝতে পারল। তাদের মনে হচ্ছে এই হাসপাতালের স্নিগ্ধ জলবাতাস, ভালো পরিবেশ সব মিলিয়ে আসপাশিয়ার রোগ ভালো হয়ে গেছে। দেবতা তার অভিশাপ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর সর্প-চিকিৎসার দরকার নেই।

পূর্ণিমার আগেই তারা এথেন্সে ফিরে এল।

.

এথেন্সে ফিরে আসপাশিয়া জন্ম দিল ফুটফুটে একটি শিশু। ছেলে শিশু। ছেলের নাম রাখল বাবার নামে। ছেলের নামও হলো পেরিক্লিস। লোকে বলে পেরিক্লিস নম্বর দুই

পেরিক্লিস নম্বর দুইকে দেখতে এল সক্রেটিস। ছেলে খুবই ভালো আছে। চোখ পিটপিট করছে, চ্যা চ্যা করে জানাচ্ছে আমি এসেছি পৃথিবীতে। কিন্তু মা ভীষণ দুর্বল। কথা বলতেই কষ্ট হয়। তবে সক্রেটিসকে দেখে আসপাশিয়া যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তার ওস্তাদ সত্ত্বা জেগে উঠেছে। সে কথা বলতে শুরু করল।

আসপাশিয়া সক্রেটিসকে এসক্লিপিয়ন হাসপাতালের কথা বলল। ভীষণ ভয় পেয়েছিল। সাপের কথা মনে পড়লেই এখনও তার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। এটিকে কি চিকিৎসা বলে? এর চেয়ে দেবতার কাছে বসে বসে প্রার্থনা করাও ভালো।

সক্রেটিস বলল, সর্প-চিকিৎসা এক কথায় অতি ভয়ংকর ব্যাপার। চেরোফোনের কাছে সারা দুনিয়ার খবর থাকে। সে চিকিৎসা বিষয়ে নতুন এক খবর দিল

আসপাশিয়া বলল, কী রকম খবর?

সক্রেটিস বলল, চেরোফোন শুনেছে কস দ্বীপে নাকি একজন নতুন চিকিৎসক আছেন। আমার বয়সী হবে। তিনি নাকি বলেন, মানুষের রোগের জন্য দেবতার অভিশাপ, আশীর্বাদ এসব কিছুই নয়। রোগ নাকি হয় চারপাশের আলো-বাতাস আর খাবার-দাবার থেকে।

আসপাশিয়া বলল, তাই নাকি! এ তো একেবারে নতুন কথা। দেবতাদের বিরুদ্ধে কথা।

‘হুঁম, এমন কথা বলতে সাহস লাগে।’

‘কী নাম ঐ চিকিৎসকের?’

‘হিপোক্রাটিস। তার বাড়ি এজিয়ান সাগরের মধ্যে কস দ্বীপে। তিনি বললেন, তিনি এক নতুন চিকিৎসা শাস্ত্র বের করছেন। এতদিন চিকিৎসার নামে যেটি ছিল, সেটি নাকি কেবল দেবতার কাছে করুণা চাওয়া। সেটি চিকিৎসা নয়। হিপোক্রাটিস যেটি শুরু করছেন, সেটিই হলো সত্যিকার চিকিৎসা শাস্ত্র। সেই হিসেবে চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক হলেন হিপোক্রাটিস।’

**

কস দ্বীপের শান্ত সাগর পাড়ে বসে আছেন হিপোক্রাটিস।

তার মন খুব খারাপ। তিনি একজন চিকিৎসক। কিন্তু তার চিকিৎসায় কাজ হচ্ছে না। রোগ সারছে না। কস দ্বীপে একটি প্লেগ চলছে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। কিন্তু লোক ভালো হচ্ছে না। দিনে দিনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলছে। চিকিৎসক হিসেবে তিনি নিজের ওপর খুবই বিরক্ত।

আজ সকালেও তার চোখের সামনে তিনজন মানুষ মারা গেছে। খুবই কম বয়সে মারা গেছে। লোকগুলো তার হাত ধরে বলছিল, ডাক্তারবাবু বাঁচান। দেবতাকে বলুন আমাকে মাফ করে দিতে। ডাক্তার দেবতাকে বলেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি। লোকগুলো মারা গেছে।

তার বয়স ত্রিশ পার হয়েছে মাত্র। এই বয়সেই তিনি মানুষের খুব পছন্দের ডাক্তার। মানুষ তাকে খুব মান্য করে, ভরসা করে। মানুষ ভাবে যত বড় রোগই হোক, হিপোক্রাটিসের কাছে একবার যেতে পারলেই ভালো হয়ে যাবে। এই বয়সেই তিনি স্বনামে খ্যাত।

কিন্তু এই খ্যাতি তার ভালো লাগছে না। তিনি মনে করছেন আমি এই খ্যাতির যোগ্য নই। গ্রিসের কোনো ডাক্তারই কোনো খ্যাতির যোগ্য নয়। কারণ এখানে ডাক্তাররা কিছুই করে না। এখানে চিকিৎসা বলতে কিছুই নেই। এরা ডাক্তার নয়, এরা মন্দিরের পুরোহিত। অসুখ হলে মানুষ দৌড়ে আসে চিকিৎসার দেবতা এসক্লিপিয়াসের কাছে। মানুষ মনে করে এই দেবতার কিছু বংশধর আছেন, যাদের সাথে দেবতার সরাসরি যোগাযোগ আছে। দেবতা তাদের কথা শোনেন। রোগাক্রান্ত মানুষ এই দেবতাদের বংশধরদের কাছে এসে তাদের কষ্টের কথা বলে, আর দেবতার বংশের লোকেরা দেবতার কাছে রোগের বিধান চায়। দেবতার বিধান অনুযায়ী তারা পশু বলি দেয়, আচার অনুষ্ঠান করে। এর বাইরে এসক্লিপিয়ন হাসপাতালে সর্প-চিকিৎসা করা হয়। এটুকুই হলো চিকিৎসা। এই কাজ যারা করেন, তাদেরকেই বলা হয় চিকিৎসক

হিপোক্রাটিসও এরকমই একজন চিকিৎসক। এই চিকিৎসকেরা সবাই নাকি দেবতা এসক্লিপিয়াসের বংশধর। দেবতার এক মেয়ের নাম হাইজিয়া (Hygieia–গ্রিক উচ্চারণ ইগিয়া), তার নাম থেকেই হাইজিন শব্দটি এসেছে। আরেক মেয়ের নাম পেনাসিয়া (Panacea), মানে সর্ব রোগের নিরাময়। তাদের ছেলেপেলে, নাতি-নাতনিদের বংশধররাই সারা গ্রিসের ডাক্তার। হিপোক্রাটিস চিকিৎসার দেবতার পনেরতম বংশধর। এই বংশের লোক ছাড়া অন্য কারও ডাক্তারি করার অধিকার নেই।

হিপোক্রাটিস ভাবছেন, কস দ্বীপের প্লেগ কেন দূর হচ্ছে না? ডাক্তাররা তো সব রকম চেষ্টা করছেন, তবু দেবতারা কথা শুনছেন না। তাহলে সমস্যা কোথায়? দেবতারা কি সত্যিই শাস্তি হিসেবে রোগ দেন? দেবতারা কি রোগ ভালো করেও দেন? কিছুদিন ধরে খুব ভাবছেন তিনি। দিন-রাত ভাবেন।

তার ভাবনার কথা বললে সবাই রাগ করে। সবাই বলে, দেবতাদের নিয়ে সন্দেহ কোরো না, বিপদ হবে। ডাক্তারি বিদ্যা চলে যাবে। সাবধান হও। তাদের বংশের সবাই ডাক্তার। বাবা, দাদা, চাচা, খালা, ছেলে, মেয়ে সবাই ডাক্তার। তারা সবাই দেবতাভক্ত লোক। দেবতারাই অসুখ দিয়েছেন, দেবতারাই সারাবেন

হিপোক্রাটিস কিছুদিন ধরে একটি অদ্ভুত কাজ করছেন। যে রোগী দেখেন, তার বিষয়ে নানা কথা লিখে রাখেন। নাম, বয়স, কী রোগ, কত দিন ধরে ভুগছে— এসব কথা তিনি পেপিরাস কাগজে লিখে রাখেন। তার ঘরের কয়েকটা তাক রোগীদের তথ্যে ভরে গেছে। লোকে বলে এগুলো তার পাগলামি। দেবতাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে মানুষ নিয়ে লেখালেখি শুরু করছেন। এই ছেলের ডাক্তারি বিদ্যা আর থাকবে না।

সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হচ্ছেন তার বাবা। তিনি রাগ করে বলছেন, এসব রোগীর কথাবার্তা লিখে কী কাজটা হবে? রোগের বিষয়ে রোগী কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু? প্রকৃত বিষয় হলো দেবতা। তাই দেবতা নিয়ে লেখো। কী করলে দেবতা খুশি হয়ে রোগ সারান, সেটি লেখো। রোগী কোনো বিষয় নয়।

বাবা তাকে ডাক্তারি শিখিয়েছেন। তার যত বিদ্যা সব বাবা আর দাদার কাছে পাওয়া। তিনি বাবার সাথে বেআদবি করেন না। নীরবে মেনে নেন। কিন্তু তার মনে হয় দেবতা নয়, রোগের জন্য রোগীর শরীরই জরুরি। তিনি রোগীর কথাবার্তা লিখতে শুরু করেছেন

সন্ধ্যা হয় হয়। লাফ দিয়ে উঠলেন হিপোক্রাটিস। এক দৌড়ে ঘরে গেলেন। তিনজন দাসকে ডেকে বললেন, এতদিন যত কিছু লিখেছি, সব কাগজ বের কর।

হিপোক্রাটিসের পরিবার খুবই ধনী। তার বংশের লোকেরাই দূর-দূরান্তে রাজাদের রাজবৈদ্য। তারা বিশাল বড়লোক। তাদের অনেক দাস। ডাক্তারদের দাস মানে লেখাপড়া জানা দাস। তিনজন পড়ালেখা জানা দাসকে নিয়ে ডাক্তার সন্ধ্যার আলোয় কাগজপত্র নিয়ে বসেছেন। দাসেরা কাগজ বাছাই করছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি রোগীর পেটের পীড়া।

ডাক্তার একটি নতুন কাগজের উপরে বড় করে লিখলেন পেটে পীড়া। বললেন, পেটে ব্যথার রোগীদের কাগজগুলো জোরে জোরে পড়। তারা ত্রিশ জন রোগীর তথ্য পড়ল। একই রকম কথা পেলেই ডাক্তার লিখে ফেলছেন। ঐ ত্রিশ জন রোগীর বাড়ি কোন্ কোন্ জায়গায়, সেটির তালিকা করলেন।

পরদিন তিনি ত্রিশ জনের বাড়িতে গেলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ঘুরছেন। সাথে তিনজন দাস। সব রোগীর সাথে কথা বলছেন। রোগী মারা গিয়ে থাকলে তার পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলছেন। তারা কী খায়, রোগ হওয়ার আগে কী খেয়েছে, কখন ঘুমায়, কতবার পায়খানায় যায় সবকিছু লিখে ফেললেন। আগের ত্রিশ জন রোগীর মধ্যে নয় জন ভালো হয়ে গেছে, দশ জন এখনও ভুগছে, আর এগারো জন মরে গেছে। যারা মারা গেছে তারা সবাই শিশু বা বুড়ো, যুবকেরা এখনও ভুগছে, আর যারা ভালো হয়ে গেছে, তারা সবাই খাওয়ার পাল্টে অন্য খাওয়ার খেয়েছে। কে কী খাওয়ার খেয়েছে সব লিখে রাখলেন। সবার বাড়ির আশপাশে ঘুরে দেখলেন তিনি

তারপর বাড়ি গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। টানা তিন দিন ঘরের দরজা খুললেন না। এক মনে কী যেন ভাবেন, পেপিরাসের লেখাগুলো মিলান 1 আবার ভাবেন আবার কাটাকুটি করেন। নাওয়া-খাওয়া নেই, কারও সাথে কোনো কথা নেই। সবাই ভাবছে ছেলেটা পাগলই হয়ে গেল।

তিন দিন পরে ঘর থেকে বের হলেন হিপোক্রাটিস। জীবিত দশজন রোগীকে খবর দিলেন।

এরপর ডাক্তারদের ডেকে বললেন, ভাইয়েরা, এখন আমি নিশ্চিত দেবতা-টেবতা কিচ্ছু নয়। রোগ হলো শরীরের একটি নিজস্ব সমস্যা। শরীর যখন স্বাভাবিক নিয়মে চলতে পারে না, তখন যে প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটিই হলো রোগ। রোগের চিকিৎসার জন্য এক নম্বর বিষয় হলো রোগী।

হিপোক্রাটিস সবকিছু ব্যাখ্যা করলেন। লিখে লিখে দেখালেন— তিনি কেন একথা বলছেন। তিনি বললেন, শিশু আর বুড়োরা মারা গেছে, কারণ তাদের শরীরে শক্তি কম, আর জোয়ানরা মরেনি, কারণ তাদের শরীরে শক্তি বেশি। তাই রোগীর শরীরই চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে জরুরি। চারপাশের আলো-বাতাস আর খাবার-দাবার জরুরি। দেবতা জরুরি নয়।

অন্য ডাক্তাররা কিছুই বলছেন না।

তিনি আবার বললেন, এই যে আমার সামনে বসে আছে দশ জন রোগী। আমার বিশ্বাস আমি সবাইকে বাঁচাতে পারব। তারা বাঁচলে তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? তিনি কিছু লতা-পাতা বের করলেন, অনেকটা থানকুনি পাতার মতো পাতা। বললেন, আমার মনে হয়— এই পাতার রস খেলে ওরা ভালো হয়ে যাবে।

রোগীরা সেই পাতার রস খেতে শুরু করল। তিন দিনের মধ্যে সবাই সুস্থ হয়ে গেল। আর রাতারাতি বীর হয়ে গেলেন হিপোক্রাটিস। নতুন গ্রিক বীর। তিনি মানুষের জীবন বাঁচান। তিনিই নতুন দেবতা।

এভাবে চিকিৎসাশাস্ত্র বের হলো দেবতার খপ্পর থেকে। বিজ্ঞানের সাথে মিশে গেল চিকিৎসা। বিজ্ঞানের জন্য যে রকম নতুন জিনিস করেছেন থেলিস, দর্শনের জন্য সক্রেটিস, স্থাপত্যে ফিডিয়াস, সাহিত্যে এস্কিলাস ও সফোক্লিস, সেরকম চিকিৎসার জন্য একেবারে নতুন কিছু করলেন কস দ্বীপের হিপোক্রাটিস।

পৃথিবীতে যারা নতুন কথা বলেছে, সবাই বিপদে পড়েছে। দেবতার ভক্তরা তাদের বিরুদ্ধে নেমেছে। কিন্তু হিপোক্রাটিস সেরকম বিপদে পড়লেন না। তার কারণ তিনি সবার চোখের সামনে মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছেন। তার কথা মতো কস দ্বীপের প্লেগ দূর হয়েছে মাত্র কয়েক সপ্তাহে, মানুষ সুস্থ জীবন পেয়েছে। তিনি যেটুকু বাধা পাচ্ছেন, সেটি তার নিজের পরিবার থেকেই। সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।

তাছাড়া রাস্তাঘাটে তিনি দেবতার অপমান করেননি। যা বলার পরিবারের ডাক্তারদের কাছে বলেছেন। তিনি নিজেকে চিকিৎসার দেবতা এসক্লিপিয়াসের বংশের লোক হিসেবেই পরিচয় দেন। তার হাতে সাপের ছবিওয়ালা লাঠি আছে। তিনি মানুষকে বলেননি যে, দেবতাকে মানবে না। তিনি বলেন, দেবতাদের ভক্তি করা ভালো, তাতে দেবতা খুশি হয়ে তোমাকে সুস্থ রাখবে। তবে দেবতারা এখন ভীষণ ব্যস্ত, তাদের অনেক কাজ, তাই সবার শরীরের খবর রাখা তাদের জন্য কঠিন। সেজন্য যার যার নিজের শরীরকে সুস্থ রাখতে নিজেকেই কাজ করতে হবে। ভালো খাওয়ার খেতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে আর চারপাশের পরিবেশ ভালো রাখতে হবে।

সক্রেটিস যেটি মানুষের মনের জন্য করতে চায়, সেটিই মানুষের শরীরের জন্য করলেন হিপোক্রাটিস।

.

হিপোক্রাটিসের এখন অনেক কাজ। তিনি নতুন কিছুর সন্ধান পেয়েছেন। বিশাল কিছু। শরীরের এত রকম ঝামেলা, মানুষের এত রকম রোগ, সেই রোগের এত রকম ওষুধ এগুলো নিয়ে একা কাজ করা যায় না। তার পরিবারের ডাক্তারদের দু-একজন তার সাথে আছে, কিন্তু বেশিরভাগই তাকে এখনও পাগল মনে করে। তারা তাকে কোনো সাহায্য করবে না। কিন্তু লোক দরকার। ভালো লোক। যে খেটে খেটে মানুষের শরীর ভালো করার উপায় বের করবে।

তিনি ঠিক করলেন, তার পরিবারের বাইরের ছেলেদের ডাক্তারি শেখাবেন। এটি খুবই দুঃসাহসী কাজ। সারা গ্রিসে এসিক্লিপিয়াসের বংশধর ছাড়া কেউ ডাক্তারি করতে পারে না। চিকিৎসাশাস্ত্র বড় পবিত্র জিনিস। এতে সবার অধিকার নেই। এখন হিপোক্রাটিস যদি বলেন, রাস্তাঘাটের ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি করবে, সারা গ্রিসে আগুন জ্বলে উঠতে পারে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তার লোক দরকার। যে বিশাল কাজ তার সামনে, সেটি করতে লোক লাগবেই।

প্রস্তাব শুনে তার বাবা মহা ক্ষেপে গেলেন।

বাবা বললেন, তোর লোক লাগবে, তো বিয়ে কর। একটা না, তিনটা বিয়ে কর। ভাইদের চারটা-পাঁচটা করে বিয়ে দে। কচি-কাঁচায় ভরিয়ে ফেল পুরো কস দ্বীপ। তাহলেই তোর সংসারেই পেয়ে যাবি একদল ডাক্তার। অন্য বাড়ির পোলাপান দরকার হবে না। ঐ কথা ভুলেও মাথায় আনবি না

হিপোক্রাটিস বললেন, বিয়ে করে ছেলেপেলে বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলে, আমার মাথায় যা আছে সব উড়ে যাবে। সেটি সম্ভব নয়, বাবা। আমাকে অনুমতি দিন, না হলে আমি নিজে নিজেই ছেলেদের শেখাতে শুরু করে দেব।

বাবা জানেন, তার ছেলে ভীষণ ত্যাড়া। কিন্তু ত্যাড়ামি করে সমস্যাটা বুঝতে পারছে না।

বাবা বললেন, তুই চিকিৎসা বিদ্যালয় করবি, কিন্তু ছাত্র পাবি কোথায়? কেউ ছেলেকে পাঠাবে না ডাক্তার হতে। তুই কাকে শিখাবি? তারপর যদি কেউ তোর স্কুলে আসেও, সমাজ তাদের বিরুদ্ধে থাকবে। তারা শিখতে পারবে না। তারপর ধর তোর বিশাল কেরামতিতে ছাত্ররা ডাক্তারি শিখেই গেল। তারপরও কেউ তাদের ডাক্তার বলবে না, কেউ ওদের দিয়ে চিকিৎসা করাবে না, ওদেরকে কেউ পয়সা দেবে না। মানুষ একটি কথা জানে এবং মানে, সেটি হলো ডাক্তার হতে দেবতার পুত্র হওয়া লাগে।

হিপক্রাটিস ভাবছেন, এটি বাবা ঠিক বলছে। তিনি এটি ভাবেননি।

বাবা বললেন, ডাক্তারি করতে গিয়ে তুই একটি ভুল করলে, দেবতার ছেলে বলে তোকে কেউ কিচ্ছু বলে না। কিন্তু ওরা কেউ ভুল করলে, মানুষে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।

হিপোক্রাটিস বললেন, এগুলো আমার মাথায় আসেনি। আরেকবার বুঝলাম— আপনি আমার ওস্তাদ। কিন্তু আমার কিছু ছেলে লাগবেই। আমার সব কাজ থেমে আছে। এখন আপনিই বুদ্ধি দেন, কী করলে চিকিৎসা স্কুল হবে?

বাবা অবাক। কিছুদিন ধরে ছেলেটা উল্টাপাল্টা করছে। কিন্তু মনে মনে তিনি ছেলেকে শ্রদ্ধা করেন। এমন প্রতিভাবান ছেলে সারা গ্রিসে আর নেই।

বাবা তার হাতের সাপ আঁকা লাঠি মাটিতে ঠুক ঠুক করছেন। তিনি ভাবছেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, তাহলে একটি কাজ কর। মানুষকে বলতে হবে যে ডাক্তার হচ্ছিস একা তুই। যারা শিখছে— তারা শুধু তোর শিষ্য, তারা ডাক্তার নয়। সব কাজ হবে তোর নামে। এমন হতে হবে রোগী ভালো হলে সুনাম তোর, মন্দ করলে দোষও তোর। এরকম বোঝাতে পারলে লোকে ছেলেদের পাঠাতে পারে।

তিনি বাবাকে পায়ে ছুঁয়ে সালাম করলেন। বাবার আশীর্বাদ নিয়েই হিপোক্রাটিস চালু করলেন পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসা বিদ্যালয়। যেকোনো ছাত্ৰ- ছাত্রী আসতে পারবে তার স্কুলে। যে কেউ হতে পারবে ডাক্তার। তার খুব প্রিয় একটি গাছ আছে কস দ্বীপে। অশ্বত্থ গাছের মতো বিশাল এক বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের তলায় গিয়ে বসলেন হিপোক্রাটিস। এটিই তার চিকিৎসা বিদ্যালয়। সুবিশাল বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় তিনি প্রথম মেডিকেল ক্লাস নিবেন। ছাত্র মাত্র তিনজন। তিনজনই হিপক্রাটিসের আশ্রিত। তাদের বাবা-মা নেই। তিনি তাদের ভরণ-পোষণ করেন। শুধু তারাই এসেছে। তাও নিজেরা ইচ্ছে করে আসেনি। ডাক্তার জোর করে নিয়ে এসেছেন।

তারাই প্রথম চিকিৎসক, যারা দেবতার সন্তান নন। তারা ছাড়া আর কেউ তাদের সন্তানকে পাঠাতে রাজি হয়নি। তার বাবা ঠিক বলেছিলেন। দেবতার রক্তের সন্তান না হলে, কারও ডাক্তার হওয়া খুব দুষ্কর।

কিন্তু হারবেন না হিপোক্রাটিস। তিনজন ছাত্র নিয়েই তিনি শুরু করবেন। বৃক্ষের নিচে বসে হিপক্রাটিস শান্ত স্বরে বললেন, শোনো, তোমরা চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে এসেছ। চিকিৎসা হলো একটি শিল্প, একটি আর্ট। এই শিল্প শিখতে হলে সবার আগে বিশ্বাস করতে হবে যে—

জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শিল্প দীর্ঘস্থায়ী। জীবন ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু শিল্প বেঁচে রবে।

ছাত্ররা কোনো উত্তর করছে না। চিকিৎসা যে একটি শিল্প, একথা বিশ্বাস করতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। হিপোক্রাটিস বৃক্ষের দিকে তাকালেন। ওই বৃক্ষ তার সঙ্গী। কস দ্বীপে কেউ তাকে খুঁজতে এলে যে কেউ চোখ বন্ধ করে বলে, ওই গাছটির নিচে গিয়ে বসে থাকো, হিপক্রাটিসকে পেয়ে যাবে। লোকে বলে, তিনি নাকি এই বৃক্ষটির প্রেমে পড়েছেন, বৃক্ষটিও নাকি তার প্রেমে ব্যাকুল। মানুষের মুখে এখন এই বৃক্ষের নাম হিপোক্রাটিস বৃক্ষ।[৮৮]

তার বৃক্ষ প্রেম নিয়ে সবাই মজা করে। তিনি হেসে বলেন, ভুল বলোনি, গাছ তো ডাক্তারের বন্ধুই। গাছ না থাকলে ওষুধ পেতাম কীভাবে? তাই গাছই আমার প্রেমিকা। তবে তোমরা বলো, একটি মাত্র গাছ নাকি আমার প্রেমিকা, সত্য হলো— সব গাছই আমার প্রেমিকা। আমি প্রতিদিন নতুন নতুন ওষুধি গাছ পাই, আর আমার প্রেমিকার সংখ্যা বাড়ে।

বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে তিনজন ছাত্রকে মহা আবেগ নিয়ে হিপোক্রাটিস আবার বললেন,

‘যদি তুমি চিকিৎসা শিল্পকে ভালোবাসো, তুমি আসলে মানুষকে ভালোবাসো। চিকিৎসা হলো মানবপ্রেম, অন্য কিছু নয়।’

ছাত্ররা শুনছে। তাদের আগ্রহ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে শিক্ষকের যে ব্যাপক আগ্রহ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষক মধুর স্বরে বলছেন—

‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।’

ছাত্ররা এবার মাথা উপরে-নিচে নাড়ল। এটি সোজা কথা। তারা বুঝতে পেরেছে। একথা তারা ছোটবেলা থেকেই শুনছে। তারা মনে করছে ডাক্তারি তো খুবই সোজা জিনিস। আমি তো জানিই যে, স্বাস্থ্যই হলো সম্পদ। ছাত্রদের মুখ দেখে হিপোক্রাটিস খুশি হলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মানুষের জন্য সবচেয়ে ভালো ওষুধ কী জানো?

ছাত্ররা ডানে-বামে না-সূচক মাথা নাড়ল। তাদের জানার কথাও নয়।

হিপোক্রাটিস বলল, ‘মানুষের জন্য সর্বোত্তম ওষুধ হলো হাঁটা’।

ছাত্ররা হেসে দিল। এটিও সোজা কথা। এটিও তারা কিছুটা জানে। হাঁটা খুবই ভালো জিনিস। ডাক্তার ছাত্রদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। এবাড়ি থেকে ওবাড়ি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছেন ডাক্তার। হাতে সাপের নকশা করা লাঠি, মুখে মিষ্টি হাসি। মানুষ তাকে দেখলে খুশি হয়। তারা শ্রদ্ধাভরে তাকে বসায়, আদর করে এটি-সেটি দেয়। এত বড় ডাক্তার নিজে থেকে এসে তাদের শরীরের খবর নিচ্ছেন, এটি কি কম কথা! ডাক্তার সবার খাবার-দাবারের কথা জিজ্ঞেস করেন। কে কী খায়, কার কী খাওয়া উচিত, সেই তালিকা বলে দেয়। ডাক্তার বলছেন, খাবারের মধ্যেই সবকিছু। ভালো থাকতে হলে ভালো খাওয়ার খেতে হবে।

এরপর ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনো, আজ থেকে খাদ্য বিষয়ে আমাদের মন্ত্র হবে—

‘খাদ্যই হোক ওষুধ, আর ওষুধই হোক খাদ্য।’

একজন ছাত্র বলল, কথাটায় প্যাঁচ আছে গুরু। একবার মনে হয় বুঝেছি, আবার মনে হয় বুঝিনি। একটু খোলাসা করে বলবেন?

ডাক্তার বলল, ‘খাদ্যই হোক ওষুধ’– এর মানে হলো— খাদ্য এমন করে খেতে হবে, যেন সেটি ওষুধের কাজ করে। খাদ্য পরিমাণ মতো খেলে সেটি হবে ওষুধ, আর বেশি খেলে সেটিই হবে বিষ। আমরা গ্রিকরা যেমন সব কিছুতে বলি—

‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে কোনো কিছুই আর উত্তম থাকে না।’

ছাত্র বলল, বাহ, কবিতার মতো কথা। মজা পাচ্ছি।

ডাক্তার বললেন, এত বেশি মজা পেয়েছ যে আমাকে বলতেই দিলে না। অর্ধেক পথেই থামিয়ে দিলে। বাকি অর্ধেক শোনো। ‘ওষুধই হোক খাদ্য- এর মানে হলো যেসব জিনিসে শরীর ভালো থাকে, সেগুলোই হোক খাদ্য। আমরা বেছে বেছে উপকারী জিনিসই শুধু খাব, ক্ষতিকর জিনিস বাদ দেব।

ছাত্র বলল, চমৎকার। আমার তো আরও জানতে ইচ্ছে করছে।

ডাক্তার বললেন, সময়ে সবই জানবে। এখন আরেক বাড়ি চলো। আর শোনো, আমি মানুষের সাথে যত কথা বলছি, যে যা বলছে, সবকিছু লিখে রাখতে হবে। একটি কথাও যেন বাদ না যায়।

এভাবে হেঁটে হেঁটে একবাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাচ্ছেন ডাক্তার। চলছে চিকিৎসা, চলছে শিক্ষা, চলছে গবেষণা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে আর একটি কাজও করছেন তিনি। কোন্ বাড়িতে ডাক্তারি পড়ার মতো ছেলে আছে, সেটিও খোঁজ নিচ্ছেন। তার ছাত্র দরকার। অনেক চেষ্টা করছেন ছাত্রের জন্য। কিন্তু লাভ হচ্ছে না।

অবশেষে আবার এগিয়ে এলেন বাবা। কস দ্বীপের গণ্যমান্যদের ডেকে সভা করে বললেন, হিপোক্রাটিস যেভাবে চিকিৎসা করছে, সেটি দেবতার বিরুদ্ধে নয়। দেবতারা তো বলেছেন, রোগ হলে লতা-পাতা ছেঁচে ওষুধ খেতে হবে। হিপোক্রাটিস তো সেটিই করছে। তাই ওর কাজে দেবতাদের সাথে কোনো বিরোধ নেই।

এর কয়েক দিনের মধ্যে হিপোক্রাটিসের স্কুল কচিকাঁচায় ভরে গেল। মানুষ আর ভয় পেল না। দলে দলে ছেলে আসতে শুরু করল তার মেডিকেল স্কুলে। বাবা-মায়েরা বুঝল— চিকিৎসা করা হতে পারে মানুষের পেশা, একটি মহান পেশা।

নতুন ছাত্র পেয়ে হিপোক্রাটিস আনন্দে বাক-বাকুম। তাকে অনেক কাজ করতে হবে। তিনি ছাত্রদের নিয়ে পথে নেমে পড়লেন। তিনি চিকিৎসা বিষয়ে বই লেখা শুরু করেছেন। তার শিষ্যরাও মেতে উঠেছে। তারা ডাক্তার হবে, আগে কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। জীবনে যে সুযোগ আসার কথা ছিল না, সেই সুযোগ পেয়ে ছাত্ররা গুরুর সাথে দিন-রাত খাটছে। তারাও লিখছে। কারও বিরাম নেই, সবাই অবিরাম লিখছে।

তাদের লেখা নিয়ে বই বের হলো। বইয়ের নাম হিপোক্রাটিক কর্পাস[৮৯]। শুধু রোগ, শরীর আর চিকিৎসা বিষয়ে লেখা। দেবতাদের প্রশংসা নেই, গালাগালিও নেই। সবার জন্য উপকারী বই। সারা গ্রিসে ছড়িয়ে গেল সেই বই। মানুষ জেনে গেল নতুন এক চিকিৎসাশাস্ত্র শুরু হয়েছে। সেটি করেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তার হিপোক্রাটিস।

হিপোক্রাটিস দিন-রাত গবেষণা করছেন। প্রতিদিন নতুন নতুন কিছু জানতে পারছেন। নতুন রোগের কথা জানছেন, নতুন ওষুধ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি একটি ল্যাবরেটরি বানিয়েছেন। শিষ্যরা দূরে দূরে গিয়ে রোগী দেখে। সন্ধ্যায় একসাথে বসে সবকিছু আলাপ করে। হিপোক্রাটিস সিদ্ধান্ত দেয় কোন কোন নতুন জিনিস আজ শেখা হলো। সেগুলো লিখে রাখা হয়। বই লেখা এখনও চলছে। চিকিৎসাশাস্ত্র সাগরের মতো বিশাল। এই জ্ঞানের শেষ নেই। তাই আরও বই আসবে। চলতে থাকবে হিপোক্রাটিক কর্পাস।

একদিন হিপোক্রাটিস বৃক্ষের নিচে বসে শিষ্যদের পড়াচ্ছেন।

হঠাৎ সাপের লাঠি হাঁকিয়ে বৃক্ষতলে এসে দাঁড়ালেন তার বাবা। তিনি বললেন, তোমরা তো শুনছি অনেক ভালো কাজ করছ। ভালো ভালো বই লিখছ। মানুষের উপকার হচ্ছে। মানুষের উপকার করলে দেবতারাও খুশি হয়।

হিপোক্রাটিস বললেন, বাবা, আমার উপর কি দেবতারা খুশি হয়েছে?

বাবা বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে। তুমি তোমার স্কুল নিয়ে আমাদের এসক্লিপিয়ন হাসপাতালে চলে আসো। সেখানেই ক্লাস নেবে। আমাদের গবেষণাগারেই কাজ করবে।

হিপোক্রাটিসের বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই কি বাবা তাকে এত বড় সুযোগ দিচ্ছেন? তিনি বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

বাবা বললেন, আর ভেবো না, চলে এসো। তবে একটি কথা।

‘কী কথা?’

‘তুমি কাজ করবে তোমাদের ছেলেদের নিয়ে আলাদা। অন্য ডাক্তাররা, যারা দেবতার নির্দেশে কাজ করে, তারা থাকবে আলাদা। তাদের নামে কোনো খারাপ কথা বলতে পারবে না। মনে থাকে যেন।’

‘ছিঃ বাবা, আমি কি এত খারাপ? আমি কারও নিন্দা করব না।’

কয়েক দিনের মধ্যে ডাক্তার তার শিষ্যদের নিয়ে চলে এলেন এসক্লিপিয়ন হাসপাতালে। এজিয়ান সাগরের পাড়ে পাহাড়ের উপর সুন্দর ভবন। সামনে নীল সাগর। সাগরের পেছনে ছোট্ট পাহাড়। একেবারে মনোরম। এটি তার নতুন মেডিকেল স্কুল। ছাত্ররা আনন্দে সিম্পোজিয়াম আয়োজন করল। নাচে- গানে উদযাপন করল নতুন ভবন। নতুন ভবনে এসে হিপোক্রাটিসের গবেষণা আরও বেড়ে গেল। এখন তার দু হাতে টাকা আসছে। দূর-দূরান্তের ধনীরা জাহাজ পাঠিয়ে দিচ্ছে তাকে নিতে। তিনি নিজে যেতে না পারলে, তার শিষ্যদের পাঠিয়ে দেন। তাতেই কাজ হয়।

ডাক্তার জাহাজ বানিয়েছেন। জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে। ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখেন। রোগ চেনেন আর বই লেখেন। কিছুদিনের মধ্যেই অনেক নতুন নতুন জিনিস লিখে ফেললেন তিনি। ভাঙা হাঁটু জোড়া লাগানোর উপায় বের করলেন। হাড় জোড়া লাগানোর জন্য একটি টুলের মতো জিনিস বের করেছেন। তার শিষ্যরা এই টুলকে বলে ‘হিপোক্রাটিক বেঞ্চ’।

তিনি মনে করেন চারটি রস আমাদের শরীরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এসব রস ঠিকঠাক মতো থাকলে মানুষ সুস্থ থাকে। এই চারটি রস হলো রক্ত, কফ, হলুদ পিত্তরস আর কালো পিত্তরস। তিনি আর তার শিষ্যরা এখন সব রোগীর এই চারটা রস পরীক্ষা করে রোগ বের করেন।

হিপোক্রাটিস ঠিক করেছেন, তিনি গ্রিসের লারিসা নামে একটি জায়গায় আরেকটি চিকিৎসা স্কুল বানাবেন। জায়গাটি পড়াশুনার জন্য উপযোগী। তিনি স্বপ্ন দেখেন, একদিন প্রতিটি নগরে চিকিৎসা বিদ্যালয় হবে। অনেক যোগ্য চিকিৎসক থাকবে চারদিকে। বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না। অকারণে দেবতার জন্য বসে না থেকে মানুষ শরীরের যত্ন নেবে। সবাই স্বাস্থ্য সচেতন হবে। সবাই বুঝতে পারবে—

রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা উত্তম।

***

৮৮. কস দ্বীপে ঐরকম একটি বৃক্ষ এখনও আছে, মানুষ যাকে হিপোক্রাটিস বৃক্ষ (Tree of Hippocrates) বলে। এটি ঐ দ্বীপের দর্শনীয় স্থান। বৃক্ষটিকে ইংরেজিতে বলে Oriental plane tree, বৈজ্ঞানিক নাম Platanus orientalis

৮৯. হিপোক্রাটিস ও তার ছাত্ররা চিকিৎসা বিদ্যার যে বইগুলো লিখেছিলেন, সেগুলোকে Hippocratic Corpus’ বলা হয়। এগুলোই চিকিৎসা বিদ্যার প্রথম গ্রন্থ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *