1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৩০

৩০

‘মানুষ হলো সেই জীব,
যে সারা জীবন শুধু জীবনের অর্থ খুঁজে যায়।’

—প্লেটো

***

সিমন বই লিখেছে।

সে অনেক দিন ধরে নোট রাখছে। সক্রেটিস তার দোকানে বসে যার সাথে যা বলত সেটি সে সাথে সাথে টুকে ফেলত। সেই টোকাটুকি একত্র করে নাকি সিমন বই লিখে ফেলেছে। নানান বিষয়ে সক্রেটিস কী বলছে সেগুলো গুছিয়ে নাটকের মতো লিখে ফেলেছে।

তার বইয়ের মূল চরিত্র সক্রেটিস।

সেই সাথে আরও একটি বা দুটি চরিত্র আছে। তারাও সক্রেটিসের বন্ধু। কোনো বইয়ের চরিত্র ক্রিতো, কোনোটির চেরোফোন, আবার কোনোটিতে সিমন নিজেই চরিত্র। বন্ধুরা হেসে কুটিকুটি। তারা নিজেরা সবাই বইয়ের চরিত্র হয়ে গেছে+বইতে সক্রেটিস কথা বলছে তাদের সাথে। নানা বিষয়ে কথা।

কথাবার্তার বই। সেজন্য এই বইকে তারা বলে ডায়ালগ বা সংলাপ। নাটকের ডায়ালগ নয়। দর্শনের ডায়ালগ। খুব কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলাপ। মূল চরিত্র যেহেতু সক্রেটিস, সেজন্য সবাই এই বইকে বলছে সক্রেটিক ডায়ালগ বা সক্রেটিসের সংলাপ।

সিমন সক্রেটিসের ত্রিশটা সংলাপ লিখেছে। খুব ছোট ছোট সংলাপ। এক একটি কয়েক লাইন মাত্র। মনে হয় দোকানে বসে ব্যবসার পাশাপাশি এর চেয়ে বড় কিছু লিখতে পারেনি। শুধু সার অংশটুকু লিখেছে। ত্রিশটি সংলাপ মাত্র দুইটি বড় প্যাপিরাস কাগজে এঁটে গেছে। এই ছোট ছোট সংলাপের আবার নামও আছে। নামগুলোও চটকদার। যেমন সৌন্দর্য কী, জ্ঞান কী, দেবতা প্রসঙ্গে, ভালোবাসা বিষয়ে ইত্যাদি। সিমন একটি ছুপা রুস্তম। সে বইয়ের কথা কাউকে বলেনি। নিজে নিজে লিখে ফেলেছে। কেউ জানতই না যে তার হাতে লেখা আছে।

সিমনের বই দেখে সক্রেটিস খুবই খুশি। এই প্রথম তাকে নিয়ে বই লিখেছে কেউ। সক্রেটিস ভাবছে, আমি কী? ফিলোসফার নাকি সফিস্ট? নাকি অন্য কিছু? দার্শনিকরা অনেকেই নিজে বই লেখে। আর আমার কথা নিয়ে বই লিখছে অন্যজন। পৃথিবীতে কতই না আজব ঘটনা ঘটে। সিমনের জুতার দোকান। মানুষ তাকে বলে মুচি। অথচ সেই মুচির কলমের মাধ্যমেই প্রথমে মানুষের কাছে গেল সক্রেটিসের কথা।

সক্রেটিস বলল, তুমি লিখেছ, আমি খুবই খুশি, তোমাকে বুকভরা অভিনন্দন। কিন্তু আমার মুখ দিয়ে যেসব কথা বসিয়েছ, সব তো সঠিক নয়।

সিমন বলল, তুমি নিজে না লিখলে, তোমার কথা হুবহু কীভাবে হবে? আমি যা বুঝেছি লিখেছি। সৎভাবেই লিখেছি। ভুল হলে সেই দায় আমার।

সক্রেটিসের সংলাপ খুব ভালো চলছে বাজারে। দোকানদার রোজ খবর দিয়ে বলে যে আরও কিছু নতুন বই কপি করেছে। সক্রেটিসের নামের মূল্য আছে। মানুষ কিনছে। যারা সক্রেটিসকে গালি দেয়, তারাই বেশি কিনছে। গোপনে গোপনে কিনছে।

এই বই যাতে সবার কাছে পৌঁছে যায়, চেরোফোন তার ব্যবস্থা করেছে। এথেন্সের বাইরেও পৌঁছে দিচ্ছে সক্রেটিসের সংলাপ। সে ভাবছে, লিখে ফেলায় ভালো হয়েছে। মানুষ সক্রেটিসকে জানতে পারছে। এতে তার শত্রু কমবে।

সিমনের বই উপলক্ষে সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছে ক্রিতো। তার বাড়িতে উৎসব। সেখানে আর একটি বড় কাণ্ড হলো। জানা গেল ক্রিতোও নাকি বই লিখেছে। সেও সক্রেটিসের সংলাপ লিখেছে। তাছাড়া নিজের বইও লিখেছে।

সক্রেটিস বলল, বাহ, আমার কত সৌভাগ্য! আমি ছাড়া আমার সব বন্ধু লেখক। সবাই কলমবাজ।

ক্রিতো বলল, একমাত্র তুমি হলে কথাবাজ।

সক্রেটিস বলল, চাপাবাজও বলতে পার। আমি রাগ করব না।

একটি নতুন ফ্যাশান চালু হয়ে গেল। সক্রেটিসের সব বন্ধু তার নামে বই লিখছে। যেই সক্রেটিসের সাথে মিশেছে, সেই একটি সক্রেটিক ডায়ালগ লিখে ফেলছে। অমর হওয়ার কোনো তাড়না সক্রেটিসের ছিল না। কিন্তু মনে হচ্ছে বন্ধুরা তাকে জোর করেই অমর করে ছাড়বে।

.

সিমন আর ক্রিতোর বই সক্রেটিস দিল আসপাশিয়াকে। পেরিক্লিস খুব পছন্দ করলেন সিমনের লেখা। তিনি সিমনকে ডেকে পাঠালেন।

পেরিক্লিস সিমনকে বলছেন, তুমি অসাধারণ প্রতিভাবান একজন মানুষ। জুতা তৈরির জন্য তোমার জন্ম হয়নি। তোমার আরও কাজ আছে। তুমি আমার সাথে এসে থাকো। এই বাড়িতে থাকবে।

সিমন বলল, অনেক ধন্যবাদ। আমি স্বাধীন মানুষ। নিজেই ভালো আছি। আমি আপনার কাছে এসে থাকতে পারব না। সোনার খাঁচা আমার জন্য নয়। আমি বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো পাখি। খাঁচায় বন্দি হলে পোষাবে না।

.

আসপাশিয়া ভাবছে এথেন্সে এক নতুন ধরনের দার্শনিক দল তৈরি হয়েছে। এরা ত্যাগী, ভোগী নয়।

সিমন একেবারে খাঁটি সক্রেটিস ভক্ত মানুষ। সে তার জীবনে সক্রেটিসের দর্শন প্রয়োগ করেছে। সে দুটো জিনিস চায়—

প্রথমত, সে নিজে মুক্ত বা স্বাধীন থাকবে। সে কারও অধীনে থাকবে না, এমনকি এথেন্সের সবচেয়ে বড় নেতা পেরিক্লিসের বাড়িতেও নয়। সে গরিব, তবু তার জীবিকা স্বাধীন। সে কারও কাছে বিক্রি হয় না। কারও দয়া নেয় না। দ্বিতীয়ত, সে কথা বলার স্বাধীনতা চায়। সে তার ছোট্ট জুতার দোকানে বসে যা ইচ্ছা তাই বলে। কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না।

এই দুটোই সিমন শিখেছে সক্রেটিসের কাছ থেকে। সে তার জীবনে সক্রেটিসকে চর্চা করে। সুন্দর জীবনের চর্চা করে। ন্যায়ের চর্চা করে। আসপাশিয়া বুঝল, সিমনরা বিক্রি হয় না। কারও কাছে মাথা নোয়ায় না।

আসপাশিয়া এই প্রথম এক নতুন ধরনের জ্ঞান দেখতে পেল। সক্রেটিস নতুন এক সাম্রাজ্য তৈরি করে ফেলেছে। মানুষ তাকে অনুসরণ করছে। তার সুন্দর জীবন অনেককে আকর্ষণ করছে। অনেক মানুষই সেটির চর্চা করছে। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়, কোনো পদের জন্য নয়— সক্রেটিসের জীবনের ধরনটা মানুষকে টানছে। এথেন্সের এই নতুন দার্শনিকদের কথা মানুষ বেশি জানে না। নেতারাও জানেন না। হেরোডোটাস এথেন্স নিয়ে বই লিখছে। তার বইতে নেতাদের কথা থাকবে। রাজাদের কথা থাকবে, দেবতাদের কথা থাকবে। কিন্তু এই যে এথেন্সের রাস্তার একদল তরুণ সুন্দর জীবনের খোঁজ করছে— এই কথা হেরোডোটাস জানবে না। তাই কোনো ইতিহাস বইতে এদের কথা লেখা হবে না।

পর পর কয়েকটি ঘটনায় সক্রেটিসের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। সে যে খুব বেশি জ্ঞানী, এটি সে নিজে আগে মনে করত না। ডেলফির ওরাকলের কথাও সে প্রথমে বিশ্বাস করেনি। পরে নানান প্রশ্ন করে দেখেছে যে, যাদের জ্ঞানী বলা হয়, তারা শুধু শুধু জ্ঞানের বড়াই করে। তাদের চেয়ে সক্রেটিস আসলেই বেশি জানে। তারপর সক্রেটিসের মুখের কথা নিয়ে সিমনের বই লিখেছে। সেই বই মানুষ পছন্দ করেছে। গরম ভাঁপা পিঠার মতো বিক্রি হয়েছে সেই বই। সক্রেটিস বুঝেছে মানুষ তার কথা পছন্দ করে।

আগে বুড়োরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করত, তার কথা হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু সেই কথা যখন কলমের মধ্য দিয়ে এসেছে, তখন মানুষ বুঝেছে সেই সহজ কথাগুলোর অর্থ কতো বিশাল! তার কথা জীবনকে ব্যাখ্যা করে। তার কথা জীবনকে সুন্দর করার উপায় বলে। অল্প কিছু দিনে সক্রেটিসের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। সে এখন আর ভয় পায় না। সে এখন প্রতিটি বিষয়ে নতুন নতুন মতামত দিচ্ছে। তার কথায় সৃষ্টি হচ্ছে জ্ঞান। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সে কাঁপছে।

আগে সে ছিল আলোকিত নগর এথেন্সের একজন আলোকিত মানুষ। এখন সে নিজেকে মনে করে আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। তার হাতে তৈরি হবে শত শত আলোকিত মানুষ। সে শিশু, বুড়ো, ছাত্র, বন্ধু, ছেলে, ছেলের বাবা, ছেলের দাদা সবাইকে সুন্দর জীবন যাপন করতে বলছে। ন্যায় আর সুন্দরের একটি মিষ্টি আন্দোলন চলছে। সক্রেটিস মিষ্টি কথায় তরুণদের ডাকছে। সে এথেন্সের বাঁশিওয়ালা। তার সুরে যে তরুণরা ছুটে আসছে, তারা ভাগ্যবান। যারা আসতে পারছে না, তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই।

***

ক্রিতোর মন খুব খারাপ। তার এক ব্যবসার অংশীদার তার সাথে প্রতারণা করেছে। সেই লোকের নাম আরিস। সে তার অনেক ক্ষতি করেছে। ক্রিতো রাগে জ্বলছে।

ক্রিতো বলল, আমি কালই ওকে পথে বসাব। ও আমাকে চেনে না। ও আমার কী ক্ষতি করছে, আমি তার চেয়ে চারগুণ ফেরত দেব।

সক্রেটিস বলল, কেউ তোমার সাথে খারাপ করলেও, তার সাথে খারাপ কিছু করা উচিত নয়।

ক্রিতোর মেজাজ গরম হয়ে গেল। সে বলল, কেন? ও ইচ্ছে করে আমার লোকসান করেছে। ওকে শিক্ষা দেবই। ও, এখনও জানে না ক্রিতো কী জিনিস!

সক্রেটিস বলল, এবার ঠিক বলেছ। ও জানে না। ও সত্যি জানে না যে— কারও ক্ষতি করা খারাপ। ওর সেই জ্ঞান নেই। জ্ঞান থাকলে সে করত না। জ্ঞান থাকলে কেউ খারাপ হয় না।

ক্রিতো রেগে বলল, ‘আমি বলছি, ও ইচ্ছে করে আমার ক্ষতি করছে। আর তুমি বলছ, তার জ্ঞান নেই? সে জানে না?

‘হ্যাঁ, যেটি জানা দরকার, সে সেটি জানে না। ঐ লোক জানে, কী করলে তোমার ক্ষতি হবে, সেটি জেনেই তোমার ক্ষতি করেছে। কিন্তু জানে না যে, মানুষের ক্ষতি করা অন্যায়। ও হয়তো কথাটা শুনেছে কিন্তু সত্যিকারভাবে বোঝেনি, মন থেকে মানেনি। তার মানে সে অজ্ঞান। ভালো-মন্দের সত্যিকার জ্ঞান থাকলে সে খারাপ কাজ করতে পারত না। মানুষ স্বভাবত ভালো চরিত্রের। কেউ নিজে থেকে খারাপ হয় না। মানুষ খারাপ কাজ করে কারণ সে সত্যিকার বিষয়টা জানে না।’

ক্রিতো বলল, আমি তোমার সব কথা মানি। কিন্তু এটি মানব না। এটি বাস্তব নয়। এসব কথা মুখে বলা যায়, কিন্তু কাজে করা যায় না। একজন ইচ্ছা করে আমার এত বড় ক্ষতি করল, তারে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব?

‘হুঁম, ছেড়ে দেবে। কারণ তুমি সুন্দর জীবনের সাধক। তোমার জ্ঞান আছে। তুমি বোঝ। ও বোঝে না। তুমি ওর সমান নও। তুমি ওর থেকে উপরের স্তরের মানুষ। তুমি ওর কোনো ক্ষতি করবে না, উল্টা ওকে ভালো পথে আনবে। সুন্দর জীবন কী জিনিস সেটি ওকে শেখাবে।’

‘আমার কোন ঠেকা পড়ছে— আমি ওকে ভালো পথে আনাব?’

‘কারণ, কেউ একা ভালো থাকতে পারে না। তুমি একা ভালো হলে, আর চারপাশের সব খারাপ রয়ে গেল— তাতে কেউ তোমার মতো ভালো আচরণ করবে না। তাতে তোমার কোনো লাভ হবে না। পৃথিবীরও কোনো লাভ হবে না। ভালো থাকতে হলে— সকলকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে। অন্তত বেশির ভাগ মানুষকে ভালো করতে হবে। সেজন্য ওই লোককে তুমি ভালো পথে আনবে।’

‘তোমার কথা শুনতে মধুর। কিন্তু করাটা অত সোজা নয়। তোমার সময় আছে। তুমি একজন একজন করে মানুষকে ভালো পথে আনো। আমার সেই সময় নাই। আমি ওরে শিক্ষা দেব। আমি প্রতিশোধ নেব, বিরাট প্রতিশোধ।’

‘প্রতিশোধ কোনোদিন কারও ভালো করে না। তাতে দুজনেরই ক্ষতি হয়।’

‘তুমি উল্টা-পাল্টা বলছো। আমাদের সমাজে যারা ভয়াবহ প্ৰতিশোধ নিতে পারে, তারাই শ্রেষ্ঠ। আমাদের দেবতারা সবাই প্রতিশোধ নেয়, তারা কাউকে মাফ করে না। জিউস কী সাংঘাতিক প্রতিশোধ নিয়েছে প্রমিথিউসের উপর, সেটি ভুলে গেছ? ঠিক আছে বাদ দাও দেবতাদের কথা, মানুষের কথায় আসো। মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? আমাদের বীর কারা? যারা প্রতিশোধ নিতে পারে তারা। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর একিলিসের কথা মনে করো। হোমার কীভাবে একিলিসের কথা বলেছেন? একিলিস তার বন্ধুকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে হেক্টরকে কী নির্মমভাবে হত্যা করেছে? তার প্রতিশোধ এত জঘন্য যে, সে হেক্টরের লাশকে তার ঘোড়ার সাথে বেঁধে ট্রয়ের চারপাশে ঘুরেছে, হেক্টরের বাবা অনেক টাকা না দেওয়া পর্যন্ত তার ছেলের লাশটাও দেয়নি। এত নির্মম প্রতিশোধ নিতে পারে বলেই সে বীর। আমাদের সকল বীরদের কাহিনি এরকমই। আর তুমি বলছ প্রতিশোধ ভালো জিনিস নয়?’

সক্রেটিস বলল, আমি দেবতাদের নিয়ে কিছু বলব না। বললে, সবাই রাগ করবে। আর হোমারের বীরদের কথা বলছ? হুঁম, হোমারের সময় পৃথিবী ঐরকম ছিল। একজনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়ে বীর হওয়াই ছিল জীবনের সবচেয়ে মহৎ কাজ। কিন্তু সেই সময়টা আমরা পার হয়ে এসেছি। এখন আমরা সুন্দর জীবন চাই। হোমার যে প্রতিশোধের জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন, সেই জীবন বীরের জীবন, সুন্দর জীবন নয়। আমরা একটি সুন্দর জীবন চাই।

ক্রিতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কিছুই বলছে না।

সক্রেটিস বলল, তুমি একটু চিন্তা করো ক্রিতো। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। তুমি বুঝবে। তুমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তুমি একজন লেখক। তুমি একজন দার্শনিক। তুমি চেষ্টা করলে বুঝবে।

ক্রিতো অবাক। সে নতুন এক সক্রেটিসকে দেখছে। এই সক্রেটিসকে আগে দেখেনি। এখন সে সীমাহীন বিশ্বাস নিয়ে বলছে— প্রতিশোধ নেওয়া জীবনের লক্ষ্য নয়। কেউ খারাপ কিছু করলেও, তার সাথে খারাপ করা যায় না। ক্রিতো আবার ভাবছে, ছোটবেলা থেকে আমি সক্রেটিসের সাথে ছায়ার মতো লেগে আছি। কোনোদিন ওর কথা মিথ্যা হয়নি। সে চুপচাপ কিছুক্ষণ ভালো করে ভাবল। বুঝল—

সবাই যদি প্রতিশোধ নিতে চায়, তাহলে তো এর শেষ হবে না। আমি একজনের ক্ষতি করব, সে আমার ক্ষতি করবে। এভাবে প্রতিশোধ চলতে থাকবে। এক সময় আমার ছেলে ওর ক্ষতি করবে, ওর ছেলে আমার ক্ষতি করবে। তো এর শেষ হবে কী করে? কাউকে না কাউকে তো থামতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রথমজনই যদি থেমে যায়। প্রথমজনই যদি প্রতিশোধ না নিয়ে, অন্যায়কারীর ভালো করার চেষ্টা করে, তাহলেই পৃথিবীতে খারাপ কাজ কমে যাবে। হানাহাসি কমে যাবে। মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে পারবে।

ক্রিতো ভাবছে, এটিই কি সক্রেটিসের সুন্দর জীবন?

ক্ৰিতো এত সহজে মানবে না। সে বলল, ঠিক আছে, তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু তোমার সাথে কেউ একদিন খুব খারাপ কিছু করুক, সেদিন বোঝা যাবে। আজকের ভালো ভালো কথার পরিণতি দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

সক্রেটিস হাসি মুখে বলল, তোমাকে পরীক্ষা দিতে আমি প্রস্তুত।

ক্রিতো অবাক হয়ে ভাবছে— সক্রেটিস একেবারে নতুন কিছু বলল। এখন সে যেভাবে কথা বলছে সেটিকে নৈতিকতা বা এথিকস বলা যায়। এটি একটি নতুন জিনিস। গ্রিসে নীতিজ্ঞান আছে। কিন্তু সেটি বাচ্চাদের জন্য। একজন শিশুসাহিত্যিক বাচ্চাদের জন্য অনেক ছোট ছোট গল্প লিখেছেন। তার নাম ঈশপ। তার গল্পের বই বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না যে-ঈশপের গল্প বড়দের জন্য কোনো কাজ দেবে। বড়রা নিজেরাই তো ওস্তাদ। তাদের আর নীতিজ্ঞান দরকার নেই। এখানে শিক্ষা জীবন হলো সাত থেকে চৌদ্দ বছর। তারপর কয়েক বছর সৈনিকের প্রশিক্ষণ। আর কোনো শিক্ষার দরকার নেই।

বড় বয়সে শুধু দেবতাদের মেনে চললেই হবে। আর একমাত্র লক্ষ বীর হওয়া, একিলিসের মতো হওয়া। কিন্তু সক্রেটিস যেটি বলছে সেটি অন্য রকম নৈতিকতা। সেখানে প্রতিশোধ নেই। আছে ক্ষমা, আছে মানুষকে ভালো পথে আনার আহ্বান।

ক্রিতো পিটপিট করে সক্রেটিসের দিকে তাকাল। হোমার সবাইকে শিখিয়েছে— বীরত্ব মানে প্রতিশোধ, বীরত্ব মানে চোখের বদলে চোখ। হোমারের সে কথা সবাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। সবাই বীর হতে চায়। সেই হোমারীয় প্রতিশোধকে এক কথায় বাতিল করে দিল সক্রেটিস? এত মনের জোর সক্রেটিসের? সে শত শত বছরের বীরত্বের ধারণা বাতিল করে নতুন জীবনের সন্ধান দিচ্ছে। ক্ষমা আর ন্যায়ের মধ্য দিয়ে সুন্দর জীবন যাপন করার উপায় বলছে।

মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য বদলে যাচ্ছে— সক্রেটিসের এথিকস বা নৈতিকতার মাধ্যমে। সক্রেটিসের এই সুন্দর জীবনের ধারণা হোমারের ছিল না। তার আগে কারওই ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *