হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৩

‘যা ঘটছে সেটি ঘটনা নয়;
বরং সেটিকে তুমি কীভাবে নিচ্ছ সেটিই ঘটনা।’

—ইপিকটেটাস

***

মধুমাখা ভুট্টা ভাজা শেষ।

অনেকক্ষণ ধরে নাটকের আলাপ শুনতে শুনতে সক্রেটিসের কান ঝালাপালা। ইউরিপিডিস জ্ঞান দিয়েই যাচ্ছে। এতক্ষণে থিয়েটারের গ্যালারি কানায় কানায় ভরে গেছে। তিল ধারণের জায়গাও নেই। দুই কোনায় অনেক লোক দাঁড়িয়েও আছে। সতের হাজার আসনেও জায়গা হয় না। এখনই শুরু হবে অনুষ্ঠান।

বসন্ত উৎসব শুরু হয়েছে গতকাল। গতকাল সকালে সারা এথেন্সে শোভাযাত্রা, নাচ-গান হয়েছে। দুপুরে মন্দিরে পশু বলি, আর সন্ধ্যায় হয়েছে বিশাল খানাদানা। প্রথম দিনে কোনো নাটক নেই, নাটক শুরু দ্বিতীয় দিন থেকে। কয়েক মাস আগে নাট্যকারগণ নগরপালের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছেন। নগরপাল সেরা তিনজনকে বাছাই করেছেন। সেই তিনজন তিন দিন তিনটি ট্র্যাজেডি অভিনয় করবেন। আজ সারাদিন তিনটি নাটক অভিনয় করবেন নাট্যকার এস্কিলাস।

অনুষ্ঠান শুরু হলো। নাটকের আগে কয়েকটি ছোট ছোট পর্ব আছে। এই বছর এথেন্সের যারা অলিম্পিকে পদক জিতেছেন, সেই সব বীর নাগরিক মঞ্চে এলেন। তারা সবাইকে তাদের পদক দেখালেন। এরপর এই বছর যেসব নাগরিক যুদ্ধে মারা গেছেন, তাদের সন্তানরা মঞ্চে এলো। গানের তালে তালে তাদের জন্য দোয়া প্রার্থনা করা হলো। ঘোষণা করা হলো, আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তাদের সব ভার সরকারের। এরপর শুরু হবে নাটক। ঘোষণা হলো, মঞ্চে আসছেন নাট্যকার এস্কিলাস এবং প্রযোজক পেরিক্লিস[১৬]।

নাটকের খরচপাতি দেন প্রযোজক। প্রযোজক হন একজন ধনী নেতা। সম্মান ও পুরস্কারের জন্য তিনি খরচ করেন। এস্কিলাসের নাটক প্রযোজনা করছেন এথেন্সের গণতন্ত্রের এক নম্বর নেতা পেরিক্লিস।

এস্কিলাস দর্শকদের সালাম জানিয়ে মঞ্চের পেছনে চলে গেলেন। তিনি দলবল নিয়ে অভিনয় শুরু করবেন। আর পেরিক্লিস বসলেন গ্যালারিতে। তিনি বাম দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল এক পরমা সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটি আসপাশিয়া। পেরিক্লিস চোখ ফেরাতে পারছেন না। নজর আটকে গেছে। সেই নজর লক্ষ করল আসপাশিয়া। তার বুক কেঁপে উঠল। এত বড় নেতা তাকে এমন করে দেখছে! আসপাশিয়া ভয় পেল। আবার ভালোও লাগল। সে বারবার পেরিক্লিসকে দেখছে। সক্রেটিস বোকাসোকা মানুষ। পাশে বসেও এসবের কিছুই লক্ষ করল না।

নাটক শুরু হলো। প্রমিথিউসের কাহিনি নিয়ে এস্কিলাসের তিনটি নাটক— প্রমিথিউস বন্দি, প্রমিথিউস মুক্ত আর অগ্নিদাতা প্রমিথিউস। প্রথমে হবে ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’[১৭]। মানে প্রমিথিউস বন্দি। নাটকের কাহিনি এমন—

দেবতা জিউস সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। পৃথিবীতে কোনো মানুষ থাকবে না। জিউসের হুকুম মেনে নিল সব দেবতা। কিন্তু একজন মানল না। তার নাম প্রমিথিউস। সে মানুষকে নিশ্চিহ্ন হতে দেবে না। এত বড় অন্যায় সহ্য করবে না। সে রাতের আঁধারে আগুন চুরি করল, নিয়ে গেল মানুষের কাছে। মানুষকে শেখাল আগুনের ব্যবহার। শুধু আগুন নয়, সে মানুষকে আরও অনেক কিছু শেখাল। কৃষিকাজ, লেখা, গণনা সবকিছু মানুষকে শিখিয়ে দিল। মানুষ হয়ে গেল ক্ষমতাবান। দেবতাদের মাতব্বরি শেষ। এই খবর শুনে জিউস বন্দি করল প্রমিথিউসকে। তার শাস্তি— তাকে ককেশাস পাহাড়ে শিকল দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হবে।

এই কাহিনি নিয়ে মঞ্চে এলেন বুড়ো এস্কিলাস। তিনি নিজেই প্রমিথিউস 1 এস্কিলাস মঞ্চে আসতেই সারা থিয়েটার করতালিতে ফেটে পড়ল। সতের হাজার মানুষ একসাথে হাততালি দিচ্ছে। চিৎকার করে স্বাগত জানাচ্ছে। মঞ্চে তিনি বৃদ্ধ প্রমিথিউস। হাত-পা শিকলে বাঁধা। তাকে পাহাড়ের দেয়ালে বাঁধা হচ্ছে। তবু দৃঢ় তার বিশ্বাস। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের উপকারী 1

জিউসের হুকুমে তাকে বন্দি করছে তিনজন। একজনের নাম ‘ক্ষমতা’, একজন হলো ‘শক্তি’ আর তৃতীয়জন কর্মকার দেবতা ‘হেফাস্টাস’। হেফাস্টাস আগুন দিয়ে লোহা পুড়িয়ে নানা জিনিস বানায়, শিকলও বানায়। সেজন্য জিউস তাকেই পাঠিয়েছে প্রমিথিউসকে বন্দি করতে। এই তিনজনের মধ্যে ‘ক্ষমতা’ আর ‘শক্তি’ খুবই নিষ্ঠুর। জিউসের আদেশ পালন করতে যত খারাপ হওয়া দরকার, তারা হবে। কিন্তু শিল্পী হেফাস্টাস নিষ্ঠুর না। প্রমিথিউসকে বন্দি করে সে নিজে কষ্ট পাচ্ছে।

প্রমিথিউসকে বন্দি করতে এসে হেফাস্টাস বললেন, জিউস নিষ্ঠুর। ভীষণ নিষ্ঠুর। সে নতুন ক্ষমতা পেয়েছে। ক্ষমতার ধর্ম হলো— নতুন নতুন ক্ষমতা পেলে সবাই নিষ্ঠুর হয়ে যায়। এখন জিউসের মতো নিষ্ঠুর অন্য কেউ নেই।

দর্শকরা চমকে উঠল। মঞ্চে দেবতাদের গালি দিচ্ছে। জিউসকে অপমান করছে। ভয়াবহ ব্যাপার। কেউ কেউ বলছে, এটি তো নাটকের সংলাপ। এই কথা নাট্যকার বলছেন না, বলছেন আরেক দেবতা হেফাস্টাস। কাহিনির খাতিরে বলাই যায়।

সক্রেটিস ভাবছে, এথেন্সে এমন সাহসী উচ্চারণ সে জীবনে শোনেনি। এস্কিলাস যে এত সাহসী মানুষ, সেটি আগে জানা যায়নি। ইউরিপিডিস চারদিকে তাকাচ্ছে। মানুষ চিৎকার করছে, কেউ নাট্যকারের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। বিপক্ষেই বেশি। বিশাল বিতর্ক। সারা থিয়েটারে চিৎকার হচ্ছে, কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। নাটক প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

তখন মঞ্চে উঠলেন পেরিক্লিস। হাত তুলে বললেন, ভাইয়েরা আমার

তার এক কথাতেই সারা থিয়েটার চুপ। একেবারে পিনপতন নীরবতা। তার কণ্ঠস্বরে একটি শক্তি আছে। মানুষ সম্মোহিত হয়। তিনি এই নাটকের প্রযোজক। তার চেয়েও বড় কথা সে এথেন্সের গণতন্ত্রের প্রধান নেতা। মানুষ তাকে বিশ্বাস করে, তাকে ভোট দেয়। সবাই আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

পেরিক্লিস বললেন, আমরা সবাই প্রমিথিউসের কাহিনি জানি। আমাকে বলুন, এই কাহিনিতে দেবতা জিউস কিসের মতো? দর্শকরা বলল, অত্যাচারী একনায়কের মতো। পেরিক্লিস বললেন, আর প্রমিথিউস কিসের মতো? দর্শকরা বলল, সে প্রতিবাদী। পেরিক্লিস বললেন, ঠিক তাই, প্রমিথিউস মানুষের পক্ষে, সে একনায়কের বিরুদ্ধে, সে গণতন্ত্রের পক্ষে, সে আমাদের পক্ষে। আমরাই এক- একজন প্রমিথিউস। দর্শকরা চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ, আমরাই প্রমিথিউস। পেরিক্লিস বললেন, আসুন, আমরা নাটকটি দেখি। আমাদের প্রিয় নাট্যকার এস্কিলাসকে তো আমরা চিনি। তিনি খারাপ কিছু করবেন না।

জাদুর মতো কাজ করল তার কথা। সকল দর্শক হাসিমুখে শান্ত হয়ে বসে পড়ল। পেরিক্লিস যতক্ষণ কথা বলছিল, আসপাশিয়া মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। মানুষের ব্যক্তিত্ব এমন পর্বতের মতো হতে পারে! সে নিশ্চিত, একই কথা অন্য কেউ বললে দর্শকরা মানত না।

আবার নাটক শুরু হলো। এস্কিলাস মঞ্চে এলেন। তিনি ভয় পাননি। আগের চেয়ে বেশি সাহস নিয়ে ফিরে এসেছেন। প্রমিথিউস পাহাড়ের দেয়ালে বন্দি। তার কাছে এলো সাগর কন্যারা। এই কন্যারা শুধু কোরাস গায়। তারা সুরে সুরে তাকে জিজ্ঞেস করল, কে তাকে বন্দি করেছে?

প্রমিথিউস বলল, বন্দি করেছে এক একনায়ক। তার নাম জিউস। একনায়করা সব সময় অবিশ্বাসের রোগে ভোগে, তারা না পারে বন্ধুকে বিশ্বাস করতে, না পারে পরিবারকে বিশ্বাস করতে।

এটি আগের চেয়ে খারাপ কথা। কিন্তু এবার আর দর্শকরা চিৎকার করল না, বরং হাততালি দিল। পেরিক্লিসের এক কথায় সব বদলে গেছে।

সাগর কন্যারা জিজ্ঞেস করল— কেন বন্দি করেছে?

প্রমিথিউস ধীরে ধীরে বলল, জিউস যেদিন দেবলোকের রাজা হলো, সেদিন সে সকল দেবতাকে একটি করে উপহার দিল, সবাইকে খুশি করে নিজের গদি পোক্ত করল। কিন্তু সে মানুষকে মনে করল অতি তুচ্ছ। জিউস ভাবল, মহাবিশ্বে মানুষের কোনো দরকার নেই। এদের ধ্বংস করে দিতে হবে। দেবতারা কেউ প্রতিবাদ করল না। তারা জিউসের ঘুষ পেয়ে তার কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করছে। কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। শুধু প্রতিবাদ করলাম— আমি। এই প্রমিথিউস। আমিই সাহস করলাম, মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমি তাদের দিলাম আগুন। এই আগুন থেকেই তারা সবকিছু করতে পারবে।

আমি তাদের অন্তরে একটি নতুন জিনিস ঢুকিয়ে দিলাম— জিনিসটার নাম আশা। এখন তারা শত বিপদেও আশা রাখবে। তারা বাঁচতে চাইবে।

আগে মানুষের চোখ ছিল, তারা তাকাত, কিন্তু যেটি দেখার দরকার সেটি দেখতে পেত না। তাদের কান ছিল, কিন্তু যেটি শোনার দরকার সেটি শুনতে পেত না। তাদের দিন কাটত উদ্দেশ্যহীন। তারা পিঁপড়ার মতো অন্ধকার গুহায় থাকত। বাড়ি-ঘর বানানো জানত না। আমি তাদের হাতে তুলে দিলাম আগুন। শিখিয়ে দিলাম কৃষিকাজ, ঋতুর জ্ঞান। সংখ্যার জ্ঞান দিলাম তাদেরকে, তারা হিসাব করতে শিখে গেল। পড়া আর লেখার কৌশল দিয়ে দিলাম, তারা জ্ঞানী হয়ে গেল।

এজন্য আমার ওপর ক্ষেপে গেল জিউস।

দর্শকরা চিৎকার করে বলল, প্রমিথিউস, তুমিই আমাদের সবকিছু শিখিয়েছ। তোমাকে সালাম। এবার দর্শকরা খুব খুশি। সবার জীবনের সাথে মিলে গেছে। সবাই ভাবছে— হ্যাঁ, প্রমিথিউসই এসব আমাকে দিয়েছে, তাই আমি এখন এত কিছু পারি।

নাটক চলছে : সাগর কন্যারা প্রমিথিউসকে উপদেশ দিল। মুক্তির উপায় ভাবতে বলল। প্রমিথিউস হেসে বলল, যতক্ষণ সমস্যা নিজের ওপর না আসে, ততক্ষণ সমস্যাগ্রস্ত লোককে উপদেশ দেওয়া খুবই সহজ।

দর্শকরা বলল, ‘ঠিক ঠিক’। এখন অভিনেতা যা বলছে, তাই দর্শকদের ভালো লাগছে। প্রমিথিউস দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী। সে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব জানে। এটি জিউসও জানে না। অনেক জিনিস জানার জন্য জিউসের তাকে দরকার।

এরপর মঞ্চে প্রমিথিউসের কাছে এলো তার বন্ধু মহাসাগরের দেবতা, নাম ওশান (Ocean). ওশান জিউসের কাছে যাবে প্রমিথিউসের জন্য ওকালতি করতে। প্রমিথিউস বলল, ‘গিয়ে লাভ হবে না, যেও না। সময় হলে জিউস নিজেই আমাকে মুক্ত করতে বাধ্য হবে।’

নাটকের ভিলেন হলেন জিউস। জিউসের শয়তানি ভালো করে বোঝাতে এবার কাহিনিতে নিয়ে এলেন আরেকটি মেয়েকে। এই মেয়েটিও জিউসের দুষ্টকাজের শিকার, নাম আইও। সুন্দর মেয়ে দেখলেই জিউসের দুষ্ট বুদ্ধি আসত। আইওকে দেখেই সে ধরতে গেল। কিন্তু জিউস যদি দুষ্ট হয়, তার বউ হেরা মহাদুষ্ট। স্বামীকে হাতে-নাতে ধরে ফেলতে সেখানে হাজির হলো হেরা। তখন বউয়ের কাছে ইজ্জত বাঁচাতে জিউস ফুঁ দিয়ে মেয়েটিকে একটি ষাঁড় বানিয়ে ফেলল। তার বউ হেরা সেই ষাঁড়ের পিছনে লেলিয়ে দিল একটি লম্বা হুলযুক্ত মাছি। মাছিটি ষাঁড়রূপী মেয়েটিকে সারাক্ষণ তাড়াচ্ছে। আর মেয়েটি জীবন বাঁচাতে ছুটছে, প্রাণপণ ছুটছে।

সেই মেয়ে আইও ছুটতে ছুটতে চলে এলো প্রমিথিউসের কাছে। দুজনই জিউসের অন্যায়ের শিকার। দুইজনই নিরপরাধ। তারা অনেক কথা বলল। নিজেদের কাহিনি বলল। প্রমিথিউস বিরাট জ্ঞানী। সে অতীত, ভবিষ্যৎ সব দেখতে পায়। সে বলল, আইও, তুমি ছুটতে ছুটতে যে সাগর পার হয়ে এসেছ, একদিন সেই সাগরের নাম হবে আইওনিয়ান সাগর।

থিয়েটারের দর্শকরা বলল, ঠিক ঠিক। আমরা সবাই জানি— এখন সেই সাগরের নাম আইওনিয়ান সাগর। ঐ যে এথেন্সের পূর্ব দিকে সেই সাগর।

প্রমিথিউস বলল, আইও, তুমি ষাঁড়ের রূপেই সাগর প্রণালি পার হয়ে ইউরোপ থেকে মিশরে চলে যাবে। ষাঁড়ের রূপে তুমি প্রণালিটি পার হবে বলে এর নাম হবে বসফোরাস।

গ্রিক শব্দ ‘বস্’ মানে ষাঁড়, ‘পোরাস’ মানে পথ। বপোরাস বা বসফোরাস মানে ষাঁড়ের চলার পথ।

দর্শকরা বলল, ঠিক ঠিক, এশিয়া আর ইউরোপের মাঝের সাগর প্রণালির নাম এখন বসফোরাস

আইও জানতে চাইল, কে প্রমিথিউসকে মুক্ত করবে?

প্রমিথিউস বলল, তোমার বংশের ত্রয়োদশ প্রজন্মের এক ছেলে আমাকে মুক্ত করবে।

দর্শকরা চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ জানি, সেই ছেলের নাম হারকিউলিস। এরপর মঞ্চে এলো জিউসের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছেলে হার্মিস। সে বাবার কথায় সবকিছু করে। সে আবার দেবতাদের দূত।

জিউস সমস্যায় পড়েছে। সে জানে যে তার নিজের এক ছেলে ভবিষ্যতে তাকে হারিয়ে দেবে। কিন্তু জানে না কে হবে সেই ছেলে, কে হবে তার মা। এটি শুধু জানে প্রমিথিউস। সেজন্য জিউস হার্মিসকে পাঠিয়েছে প্রমিথিউসের কাছে

হার্মিস মঞ্চে এসেই হম্বিতম্বি শুরু করল। সে তার বাপের মতোই গোঁয়ার। সে বলল, কী হে প্রমিথিউস, জনাব আগুন চোর। বলো, কাকে বিয়ে করলে জিউস তার রাজ্য হারাবে? কে সেই নারী? কে তার ছেলে? এক্ষুনি বলে দাও। তুমি যদি বলো, তাহলে জিউস তোমার কথা বিবেচনা করবে। সে তোমাকে মাফ করলেও করতে পারে।

প্রমিথিউস হাসতে হাসতে হার্মিসকে বলল, ভালো করে শুনে নাও—

যতই কষ্ট আমি পাই, কোনো আফসোস নাই
তবু কষ্টের বদলে কোনোদিন দাসত্ব না চাই

প্রমিথিউস কিছুতেই বলবে না। যদি জিউস তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়, শুধু তাহলেই সে বলবে। তার আগে কিছুতেই নয়।

হার্মিস অনেক ভয় দেখাল। কিছুতেই প্রমিথিউস টললো না। হার্মিস বলল, তোমার এই জেদের অর্থ কী?

প্রমিথিউস বলল, সময় হলেই বুঝবে—

চলতে চলতে বুড়ো হয়— নিষ্ঠুর সময়
জীবনকে ভুল-শুদ্ধের হিসাব বলে দেয়

হার্মিস বলল, তুমি যদি না বলো, তুমি ভাবতেও পারবে না, জিউস তোমাকে কী শাস্তি দিবে। তোমার দিকে ছুটে আসবে জিউসের ঈগল। তারা সারাদিন তোমার কলিজা খাবে। বছরের পর বছর খাবে।

প্রমিথিউস বলল, পৃথিবীর যত সাজা আছে, সব দিলেও আমি নত হবো না। তুমি জিউসকে জানিয়ে দিও।

হার্মিস চলে গেল। সাথে সাথে শুরু হলো শাস্তি। আকাশ পাতাল কেঁপে উঠল, একের পর এক বজ্র আসছে প্রমিথিউসের দিকে। তার মাথা ঘুরছে, চারদিক অন্ধকার। সেই অন্ধকারে প্রমিথিউস অপেক্ষা করছে কখন ঈগল আসবে তার বুক ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য।

.

এস্কিলাসের প্রথম নাটক শেষ হলো। নাটক শেষ হতেই ইউরিপিডিস নাটকের সংলাপ বলতে লাগল। সে ঝড়ের মতো একের পর সংলাপ বলছে। এই মাত্ৰ শুনেই সে সব মনে রেখে দিয়েছে। তার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। সক্রেটিসের স্মৃতিশক্তি তার চেয়েও ভালো। কিন্তু সেটি নাটকের জন্য নয়। নাটকের ছন্দবাঁধা সংলাপ সক্রেটিসের আসে না। মনেও থাকে না।

থিয়েটারে এখন দুপুরের খাবারের বিরতি। সক্রেটিস, ইউরিপিডিস আর আসপাশিয়া বাইরে বের হলো। খাবারের দোকানে যাবে। এখনই ভরপেট খেয়ে বসতে হবে। দ্বিতীয় আর তৃতীয় নাটকের মধ্যে বিরতি নেই।

আসপাশিয়া দেখল— পেরিক্লিস গম্ভীর মুখে কী সব বলছেন। তার চারপাশে অনেক মানুষ। আসপাশিয়ার সারা শরীর কাঁপছে। পেরিক্লিসের চোখগুলো ভালো করে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু ইচ্ছে করলেও সবকিছু দেখা ঠিক নয়। সে সক্রেটিসের সাথে খাবারের দোকানে ঢুকে গেল।

এস্কিলাস দ্বিতীয় নাটক শুরু করলেন। নাটকের নাম ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ মানে প্রমিথিউস মুক্ত। ভয়াবহ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে প্রমিথিউস। সারা দিন দুটি ক্ষুধার্ত ঈগল প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে কলিজা শেষ করে ফেলে। রাতে আবার কলিজা জন্মায়। পরদিন সকালে ঈগলগুলো এসে আবার ঠুকরে ঠুকরে খায়। এভাবে দিনের পর দিন অসহ্য কষ্ট সহ্য করছে প্রমিথিউস। মাঝে মাঝে জিউস খবর পাঠায়। যদি সে বলে যে কোন্ ছেলে তাকে ভবিষ্যতে হারাবে, তাহলে তাকে মাফ করে দেবে। কিন্তু প্রমিথিউস অনড়। সে জিউসের মতো শয়তানকে কিছুই বলবে না। তাতে যত যন্ত্রণাই আসুক। অবশেষে এক সময় জন্ম নিলো হারকিউলিস। মহান বীর। সে জিউসেরই পুত্র। সে হারিয়ে দিল জিউসকে। ঈগলগুলোকে মেরে মুক্ত করল প্রমিথিউসকে।

তৃতীয় নাটক ‘প্রমিথিউস আগুনদাতা’। মানুষকে আগুন দান করে প্রমিথিউস কী কী উপকার করেছে, সেটি নিয়ে মজা করে লিখেছেন এস্কিলাস। এই নাটকে প্রমিথিউস খুবই ভোলাভালা প্রেমিক ধরনের, কিন্তু বিচক্ষণ। সে মানুষকে নানান বিদ্যা শেখায়। সে সবার কথা শোনে, মানুষের মতামত নিয়ে কাজ করে। সে গণতান্ত্রিক দেবতা। সে ভালো ভালো কাজ করে আর মজা করতে করতে অত্যাচারী একনায়ক জিউসকে গালি দেয়।

নাটক শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

সক্রেটিস খুব খুশি। নাটক যে এমন হতে পারে, তার ধারণাই ছিল না। সে ছোটবেলা থেকে নাটক দেখছে। নাটক মানে লেখকরা ভূরি ভূরি ডাহা মিথ্যা কথা লেখে। বানিয়ে বানিয়ে অভিনয় করে। খালি মিথ্যার কারবার। সক্রেটিস সত্যের পূজারি। সে নাটক পছন্দ করে না। কিন্তু এই তিনটি নাটক দেখে সে বিস্মিত হয়ে গেল। এখানে দেবতাদের জন্য কোনো তেলবাজি নেই। এখানে মানুষের কথা। প্রমিথিউস মানুষকে বাঁচিয়েছে সেই কথা। সক্রেটিস খুবই পছন্দ করল এই নাটক।

সক্রেটিস আর ইউরিপিডিস আসপাশিয়াকে এগিয়ে দিল। একটি গাধার গাড়ি করে বিদায় নিল আসপাশিয়া। সে চারদিকে তাকাচ্ছে যদি পেরিক্লিসকে একবার হলেও দেখা যায়।

ইউরিপিডিস ছুটছে বাড়ির দিকে। কাল সকালে আবার আসতে হবে। কাল তিনটি নাটক। তাতে অভিনয় করবেন সফোক্লিস।

সক্রেটিস আগোরার দিকে হাঁটতে শুরু করল।

পেছন থেকে ডাক দিল ক্রিতো। সক্রেটিস পেছন ফিরে দেখে ক্রিতো আর তার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।

ক্রিতোর বাবা বললেন, এই যে জ্ঞানের বটবৃক্ষ, তোমার বাবা তোমাকে খুঁজছেন। এখুনি বাড়ি যেতে বলেছেন। তোমার নতুন খালা তোমাদের বাড়ি গেছেন।

‘কে, ডিওটিমা[১৮] খালা?’

‘হ্যাঁ, তিনিই।’

সক্রেটিস আনন্দে নেচে উঠল। তাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে। ডিওটিমা খালাকে সে ভীষণ পছন্দ করে। এই নতুন খালা একজন জ্ঞানপ্রেমী মানুষ।

ডিওটিমা সক্রেটিসের সত্যিকার খালা নন। তিনি একজন পুরোহিত। নারী পুরোহিত। এথেন্স থেকে একশ মাইল পশ্চিমে স্পার্টার কাছে মানটিনিয়া নামক এক শহরে দেবতা জিউসের একটি মন্দির আছে। ডিওটিমা সেই মন্দিরের পুরোহিত।

এথেন্সে নারীদের বাইরে বের হওয়া নিষেধ। কিন্তু পুরোহিত নারীদের জন্য নিষেধ নেই। পুরোহিত নারীরা দেবতার পূজা করে, ধর্ম-কর্ম করে। তারা পুরুষদের বিপথে নেয় না, বরং ধর্মের পথে রাখে। তাই মন্দিরের নারীরা বাইরে আসতে পারে, সবার সামনে বেপর্দা হয়ে কথা বলতেও পারে। তাদের মধ্যে যারা স্টার পুরোহিত, তারা নগরে নগরে ঘোরে। আখড়া বানিয়ে থাকে, আসর বসিয়ে ধর্মকথা বলে। ডিওটিমা সেরকম একজন নামকরা পুরোহিত। কিছুদিন হলো তিনি এথেন্সে এসেছেন। এথেন্সে তার আখড়ায় দেবতাদের গুণগান হয়। সেসব শুনতে অনেক মানুষ ভিড় করে।

এথেন্সে এসে ডিওটিমা কোনো এক আজানা কারণে খুব পছন্দ করেছেন সক্রেটিসের মাকে। সক্রেটিসের মায়ের সাথে ডিওটিমার দোস্তি’ হয়ে গেছে। তারা বোন পাতিয়েছেন।

সক্রেটিস এক্ষুনি বাড়ি যাবে। ডিওটিমার কথা শোনার জন্য সে অনেকবার তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত আখড়ায় বসে ছিল। এই নারীর কথায় কেমন একটি সম্মোহন আছে। প্রতিটি বিষয়ে তিনি একটি না একটি গল্প তৈরি করে ফেলেন। রহস্য গল্প। গল্পে এমন টান থাকে, সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। সক্রেটিস তার বিরাট ভক্ত। বিশেষ করে প্রেম বিষয়ে এই নারীর বিশ্লেষণ একেবারে আলাদা। সক্রেটিস সময় পেলে তার সাথে ভালোবাসা নিয়ে কথা বলে।

ক্রিতো বিষয়টা জানে। সে সক্রেটিসকে একটু খোঁচা দিয়ে বলল, সক্রেটিস, তাড়াতাড়ি যাও। খালা বসে আছেন প্রেমের ক্লাস শুরু করতে।

সক্রেটিস বলল, উল্টা-পাল্টা কিচ্ছু বলবা না। তিনি খুব জ্ঞানী মানুষ। আমার গুরু।

‘শুধু গুরু? নাকি প্রেমের গুরু?’

সক্রেটিস চোখ পাকিয়ে বললেন, উনি যদি আমাকে প্রেম শিখান, তোমার কোনো অসুবিধা আছে?

ক্রিতো বলল, অসুবিধা নয়, সুবিধা। তুমি তার কাছে প্রেম শিখে আমাদের শেখাবে। আমরা পাব একটি নতুন জিনিস, সক্রেটিসের প্রেমতত্ত্ব।

সক্রেটিস বলল, যতই পিন মারো, সত্য হলো— প্রেমের বিষয়ে ডিওটিমা খালা একজন বিশারদ। আমি কোনো পুরুষকে এমন করে প্রেমের কথা বলতে শুনিনি। তুমি এথেন্সের পুরুষদের জিজ্ঞেস করো, প্রেম কী। তারা বলবে, প্ৰেম হলো নারী-পুরুষ, বিয়ে-শাদি, শরীর-টরির মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি এক ব্যাপার।

‘আর ডিওটিমা কী বলেন?’

‘তিনি বলেন, প্রেম হলো একটি অনুভূতি। অনুভূতিটি ঈশ্বরের দেওয়া। প্রেমের অনেক শক্তি। প্রেম ভাঙতেও পারে, আবার গড়তেও পারে। তুমি কেমন করে সেই প্রেমকে কাজে লাগাবে সেটি তোমার ব্যাপার।’

ক্রিতোর মনে হচ্ছে ডিওটিমার খপ্পরে পড়ে তার বন্ধুটা জ্ঞানী সক্রেটিস থেকে প্রেমিক সক্রেটিস হয়ে যাচ্ছে। সক্রেটিস আগে কোনোদিন প্রেম নিয়ে কথা বলেনি। এথেন্সে প্রেম-ট্রেমের কোনো কারবার নেই। বাড়ির বাইরের মেয়েদের মুখ দেখাই নিষেধ। প্রেম আসবে কোত্থেকে? তবে সক্রেটিসের মুখে প্রেমের কথা শুনতে ক্রিতোর ভালো লাগছিল। প্রেমের কথা শুনতে ভালো লাগে না, এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই।

ক্রিতো বলল, থামলে কেন? আর একটু চলুক তোমার প্রেমের ক্লাস

সক্রেটিস বলল, ক্লাস নেওয়ার জন্য খাতাপত্র নিয়ে বসে আছেন প্রেম বিশারদ ডিওটিমা খালা। আগে সেই ক্লাস করে আসি।

সক্রেটিস বাড়ির দিকে দৌড় দিল

***

১৬. পেরিক্লিস : Pericles, (খ্রি.পূ. ৪৯৫-৪২৯), এথেন্সের গণতন্ত্রের প্রধান নেতা। ক্লাসিক্যাল এথেন্সের সব রকম জ্ঞানচর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি যে সময় এথেন্সের নেতা ছিলেন, সেটিই ছিল এথেন্সের স্বর্ণযুগ, এটিকে Age of Pericles বলা হয়।

১৭. Prometheus Bound এর কাহিনি অংশ D. H. Robert কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ থেকে নিয়েছি।

১৮. ডিওটিমা : নারী দার্শনিক এবং মন্দিরের পুরোহিত। খ্রি.পূ. ৪৪০ অব্দের দিকে তিনি এথেন্সে এসেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *