২৭
‘Many are the wonders of the world,
but none is more wonderful than man.’
— Sophocles
***
অনেক দিন ইউরিপিডিসের খোঁজ নেই
তাকে খুঁজতে বের হয়েছে সক্রেটিস। কোনো খবর না দিয়েই গোপনে চলে এসেছে সালামিনা দ্বীপে। সে জানে ইউরিপিডিস এই দ্বীপে বসে নতুন নাটক লিখছে। অনেক দিন ধরেই সক্রেটিস ভাবছিল, একবার সালামিনা দ্বীপে ইউরিপিডিসকে দেখতে আসবে। আজ চলে এসেছে।
এই দ্বীপে ইউরিপিডিসের কোনো বাড়ি-ঘর নেই। সে পাহাড়ের ভেতরে একটি গুহায় থাকে। তাকে গর্তবাসী নাট্যকার বলা যায়। এই গর্তবাসী নাট্যকারকে এই দ্বীপের সবাই এক নামে চেনে। সে এই দ্বীপের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ। তার গর্তের নাম ‘পাতালের নাটকপুরী।
নাটকপুরী খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হলো না সক্রেটিসের। সে নৌকা থেকে নেমেই একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, ইউরিপিডিসের গুহাটা কোথায় বলতে পার? ছেলেটি একেবারে তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ের ভেতরে একটি গর্তের সামনে এনে বলেছে, এই সেই বিখ্যাত নাটকপুরী গুহা। এখানে মানুষ ইউরিপিডিসকে খুবই মান্য করে।
সক্রেটিস কোনো আওয়াজ না করেই গুহায় ঢুকে পড়ল। ঢুকে দেখে, আওয়াজ করলেও কোনো সমস্যা নেই। ইউরিপিডিস গুহায় নেই। সক্রেটিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গুহা দেখতে শুরু করল। সে অবাক। গুহা যে এমন চমৎকার হতে পারে তার ধারণাই ছিল না। তারা ভাবত, ইউরিপিডিস বুঝি অনেক কষ্টে থাকে। কিন্তু এ তো রীতিমতো বিলাসখানা। সক্রেটিসের বাড়ির চেয়ে অনেক উন্নত। এ গুহায় সব আছে। রান্নাঘর, গোসলখানা, স্টাডি, পাঠাগার। পাঠাগারে অনেক বই-পত্র সারি সারি করে রাখা। সামনে লেখার টেবিল। টেবিলে একটি নাটকের পাণ্ডুলিপি।
এখানে আসার আগে ইউরিপিডিস বলেছিল, সবাই বলে আমি নাকি শুধু মেয়েদের গালাগালি দিই। মেয়েদের নিয়ে আজেবাজে কথা লিখি। তাই এবার একটি মহৎ মেয়ের কাহিনি লিখব। দেখিয়ে দেব যে, মেয়েরাও ত্যাগ করতে পারে, মেয়েরাই খাঁটি প্রেম করে।
একথা বলে সে এথেন্সে ছেড়েছে, আর কোনো পাত্তা নেই। কারও কাছে কোনো খোঁজ নেই। সে এই তিন মাস একাকী সাহিত্য সাধনা করেছে। লিখে ফেলেছে নতুন নাটক।
সক্রেটিস নাটকের পাণ্ডুলিপি পড়তে শুরু করল।
নাটকের নাম ‘এলসেসটিস’।
কাহিনি এরকম : রাজার নাম এডমিটাস। তার ভাগ্যে অল্প বয়সে মৃত্যু লেখা। তবে একটি শর্তে সেই মৃত্যু ঠেকানো যাবে। শর্ত হলো রাজার বদলে যদি কেউ নিজের ইচ্ছায় মরতে রাজি হয়। রাজা ভাবলেন এটি তো সোজা। রাজ্যজুড়ে এত লোক আমার জন্য জান কোরবান। তাদের একজন রাজি হলেই ঘটনা শেষ। কিন্তু দেখা গেল, কাজের সময় কেউ রাজি নয়। কেউ নিজের ইচ্ছায় জীবন দেবে না। শেষে রাজি হলেন— তার স্ত্রী রানি এলসেসটিস। তিনি প্রাণ দিলেন স্বামীর জন্য। মৃত্যুর সময় স্বামীকে বললেন, কথা দাও, আমার মৃত্যুর পর তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করবে না। রাজা কথা দিলেন রানি নিশ্চিন্ত মনে মারা গেলেন। সেই বিকেলেই রাজবাড়িতে এলেন বীর হারকিউলিস। তিনি রাজার বন্ধু। রাজা ভাবলেন, বীর বন্ধু অনেক আশা নিয়ে এসেছেন, রাজার বাড়িতে একটু আদর-যত্ন পাবেন। তিনি দাসদের আদেশ দিলেন, হারকিউলিসকে কেউ রানির মৃত্যু সংবাদ দিও না, তাকে ঠিকমতো আদর যত্ন করো। সবাই আদর যত্ন শুরু করল। কিন্তু অতি আদরে বাঁদর হয়ে গেলেন হারকিউলিস, আদর পেয়ে তিনি সীমাহীন মাতলামি শুরু করলেন। তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এক দাস রানির মৃত্যু সংবাদ দিল। হারকিউলিস স্তম্ভিত হয়ে ভাবলেন, রাজা আমার কত বিশাল মাপের বন্ধু, আমার আরামের জন্য নিজের স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদও গোপন করলেন। এমন ভালোও মানুষ হয়! আর রাজা তো যেমন তেমন, রানি তো দেখি সত্যিকারের মহীয়সী নারী। নিজের স্বামীর জন্য সত্যি সত্যি জীবন দিয়ে দিলেন? হারকিউলিস ঠিক করলেন, তিনি রানিকে মৃত্যুপুরী থেকে ফিরিয়ে আনবেন। রাজাকে কিছু না বলে হারকিউলিস চলে গেলেন পাতালে মৃত্যুপুরীতে। যুদ্ধ করে রানিকে নিয়ে ফিরে আসলেন। এসেই রাজাকে বললেন, বন্ধু, আমি একটি প্রতিযোগিতায় একটি পরমা সুন্দরী মেয়ে পেয়েছি। তুমি, মেয়েটিকে বিয়ে করো। রাজা কিছুতেই দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না। তিনি রানিকে কথা দিয়েছেন। হারকিউলিসের ভীষণ পীড়াপীড়িতে তিনি এক সময় রাজি হলেন, কিন্তু পর্দা উঠিয়ে দেখলেন— আরে, এ তো রানি এলসেসটিস। তারা সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন।
সক্রেটিস নাটক পড়ে পুরোপুরি মুগ্ধ। ইউরিপিডিস একটি খাঁটি প্রেমের নাটক লিখে ফেলেছে। প্রেমের আত্মত্যাগের কাহিনি। রানি এলসেসটিস একজন প্রেমময়ী, মমতাময়ী, স্বামী অন্তঃপ্রাণা নারী। তিনি স্বামীর জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিচ্ছেন। মেয়েরা যে তীব্রভাবে ভালোবাসতে পারে, ভালোবেসে জীবন দিতে পারে, এমন কথা এর আগে এথেন্সে কেউ বলেনি। ইউরিপিডিস সাহস করে সেটিই বলেছেন। খুব সুন্দর করে একজন প্রেমময়ী নারীর আত্মত্যাগ ফুটিয়ে তুলেছেন।
এই নাটকের মধ্য দিয়ে আরেকটি নতুন বিষয় এনেছেন ইউরিপিডিস। সেটি হলো ভালোবাসার দৃশ্য। নাটকের প্লট আর সংলাপ দুটোই ভীষণ রোমান্টিক। একেবারে প্রেমে গদগদ। প্রেমের সংলাপগুলো সক্রেটিসের মজা লাগছে, সে কিছু সংলাপ আবার পড়ছে।
মৃত্যুশয্যায় রানি চোখ বুজে বলছেন, ‘ঐ যে আসছে, মৃত্যু। আমি দেখতে পাচ্ছি— একটি নৌকা আসছে, আমাকে নিতে আসছে। আসো, তাড়াতাড়ি আসো, আমি প্রস্তুত, আমাকে নাও, দেরি করছো কেন?।’ রাজা বলছেন, ‘না না না, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, ঈশ্বরের দোহাই— যেও না। তুমি চলে গেলে আমি বাঁচব না। তোমার মাঝেই আমাদের বেঁচে থাকা, তোমার মাঝেই মরণ। তোমার ভালোবাসাই আমাদের দুই জীবনের সেতু।’ স্বামীর হাত ধরে রানি বললেন, ‘কথা দাও, আমার মৃত্যুর পর তুমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করবে না। আমার সন্তানরা কোনোদিন সত্মার হাতে পড়বে না।’ রাজা কথা দিলেন, তিনি আর কোনোদিন বিয়ে করবেন না। রানি হাসিমুখে মৃত্যুর দিকে চললেন। রানি বলছেন, ‘হে পৃথিবী, তোমাকে বলে যাচ্ছি— আমার স্বামী যেন গর্ব ভরে এই কথা বলতে পারে যে, আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নারীটিকে বিয়ে করেছিলাম।’ রাজা কেঁদে কেঁদে বলছেন, ‘তোমার সাথে সব আনন্দ চলে গেল। তুমি চলে গেলে এই বাড়িতে আর কোনো অনুষ্ঠান হবে না, ফুল ফুটবে না, বাঁশি বাজবে না।’
এমন সুন্দর প্রেমের দৃশ্য এর আগে কোনো নাটকে হয়নি। এলসেসটিস তার সন্তানদের স্বামীর হাতে তুলে দিলেন। স্বামী চিৎকার করে বলছেন, তুমি যেও না, তোমার সাথে আমাকে নিয়ে যাও, আমি একা থাকতে পারব না।
রানি মারা গেলেন। রানিকে কবর দিতে যাওয়ার সময় রাজা একটি খারাপ কাজ করলেন। নিজের বাবা-মাকে অনেক গালমন্দ করলেন। বাবা-মা কেন তার জন্য জীবন দিলেন না, সেই অপরাধে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।
নাটকের সমাপ্তিও মিলনের। ট্র্যাজেডি যেমন করুণভাবে শেষ হয়, তেমন নয়। মিলন দিয়ে নাটক শেষ হয়েছে। হারকিউলিস রাজাকে না জানিয়ে পাতালে থেকে রানিকে ফিরিয়ে নিয়ে এনে বললেন, রাজা, এই নারীকে বিয়ে করো। কিন্তু রাজা কিছুতেই বিয়ে করবেন না। হারকিউলিস বললেন, ‘একবার দেখো তো মেয়েটিকে!’ রাজা ঘোমটা তুলে দেখেন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্ত্রী স্বয়ং।
সক্রেটিস ভাবছে, ইউরিপিডিস সব সময়ই নতুন কিছু করতে চায়। অন্যেরা যা করছে, সে সেটি না করে নতুন কিছু আনতে চায়। এই মুহূর্তে এথেন্সের নাটকে ট্র্যাজেডির জয়-জয়াকার। সবাই নায়কের করুণ পরিণতি দেখে কাঁদতে কাঁদতে থিয়েটার থেকে বের হলে সেটিই ভালো ট্র্যাজেডি। নাট্যকার এস্কিলাস যেমন করে শুরু করেছিলেন, সফোক্লিস সেভাবেই লিখছেন সুন্দর সুন্দর ট্র্যাজেডি। সেখানে ইউরিপিডিস বিয়োগাত্মক নয়, মিলনাত্মক নাটক লিখল। এজন্যেই সক্রেটিস ইউরিপিডিসকে পছন্দ করে। সে আলাদা। সে চেনা পথে হাঁটে না, সে নিরন্তর নতুন পথ সৃষ্টির চেষ্টা করে।
সক্রেটিস ভাবছে, আসপাশিয়া এই নাটক দেখে খুব খুশি হবে। এথেন্সে এমন রোমান্টিক নাটকে আর হয়নি। এখানে এমন করে প্রকাশ্যে প্রেমের কথা বলে না। এখানে প্রেম মানে খুব গোপন জিনিস। রাতের আঁধারের জিনিস। ইউরিপিডিস প্রেমকে মঞ্চে নিয়ে এসেছে। অন্ধকারে নয়, ঝলমলে আলোর মধ্যে প্রেমের কথা বলছে স্বামী-স্ত্রী। তাদের জীবনে প্রেম, মরণেও প্রেম।
সক্রেটিস ভাবছে, ইউরিপিডিসের স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ইউরিপিডিস যে এত রোমান্টিক, তার স্ত্রী নিশ্চয়ই সে কথা জানে না। এত রোমান্টিক মানুষের বউ চলে যাবে কেন? তার সংসার হবে ভালোবাসায় ভরা। এত রোমান্টিক কথাবার্তা লিখেছে, এর ছিটেফোঁটা হলেও তার মধ্যে আছে। নিজে অনুভব না করে এমন সুন্দর প্রেমের কথা লেখা যায় না। তাহলে ওর নিজের সংসার টিকল না কেন?
ইউরিপিডিসের সংসারের বিষয়ে সক্রেটিস যেটি বুঝতে পারেনি, সেটি হলো :
ইউরিপিডিসের সবকিছু বিশাল। তার চিন্তা বড়, সে মানুষ হিসেবেও অনেক বড়। তার প্রেমও অনেক বড়। তার প্রেম সাধারণ নয়। সেজন্যই তার সংসার টিকেনি।
ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে। বড় প্রেম বিরহের জন্য উপযোগী, সংসারের জন্য নয়। সংসার হলো দুটি মানুষের প্রতিদিনের তুচ্ছ ঝগড়া-ঝাঁটি, রাগ-ক্রোধ, অভিমান মিশানো একঘেয়ে অম্ল-মধুর জিনিস। তার জন্য দরকার সাধারণ, একঘেয়ে ছোট্ট প্রেম। বড় প্রেমে এগুলো খাপ খায় না। বড় প্রেম হলো হঠাৎ উচ্ছ্বাস, যা দুজনকে ভাসিয়ে নেয়, আশেপাশের মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এই প্রেম দিয়ে ভালো সাহিত্য হয়, কিন্তু ভালো সংসার হয় না। এই প্রেম দুটি জীবনকে পুড়িয়ে দেয়, প্রত্যাশার আগুনে ছারখার করে দেয় সংসার। হেলেন আর প্যারিসের প্রেমে পুড়ে যায় ট্রয় নগর। বড় প্রেম কোনো কিছুকে ধরে রাখে না, ধরে রাখে ছোট প্রেম। তাই অনেক আশা নিয়ে শুরু হওয়া বড় বড় প্রেমের সংসার সুখী হয় না। সুখী হয় ছোট প্রেমের সংসার।
ছোট প্রেম নিজে ছোট বলে অন্যায় রাগ-ক্রোধকে জায়গা দিতে পারে, আর জায়গা দিতে দিতে ছোট প্রেমের ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে ওঠে, সে সেক্রিফাইস করতে শিখে যায়। আর বড় প্রেম নিজে বড় বলে একটি ছোট্ট অভিমানকেও জায়গা দিতে পারে না, ছাড় না দিতে দিতে বড় প্রেমের ব্যক্তিত্ব ছোট হয়ে যায়, সেক্রিফাইস কী জিনিস সেটিই ভুলে যায়। তাই ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে।
সক্রেটিস এখনও বিয়ে করেনি। প্রেমও করেনি। বড় প্রেম, ছোট প্রেমের পার্থক্য সে এখনও বুঝে না। তাই ইউরিপিডিসের সংসার ভাঙ্গার রহস্যও বোঝেনি।
.
এক মাস পরে বসন্ত উৎসবে নাটক মঞ্চে এলো। কিন্তু এমন রোমান্টিক নাটক করেও ইউরিপিডিস প্রথম হতে পারল না। সে দ্বিতীয় হয়েছে। আবারও প্রথম হয়েছেন সফোক্লিস।
ইউরিপিডিস জ্বানে, সে যত ভালো কিছু লিখুক, তাকে প্রথম বলতে এথেন্সের মানুষের খুব কষ্ট হয়। সে কখনো প্রথম হতে পারেনি। এবার ভেবেছিল হবে। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত হলো না।
সে প্রতি বছর নাটক লেখে। জমা দেয় নগরপালের অফিসে। নগরপাল সেরা তিনজনের নাটক বাছাই করেন বসন্ত উৎসবে অভিনয়ের জন্য। আশ্চর্য হলো কোনো বছরই ইউরিপিডিসের নাটক বাছাইতে বাদ পড়ে না। সেরা তিনজন নাট্যকারের একজন হয়ে সে প্রতি বছর অভিনয় করে। পুরস্কারের সময় প্রতি বছর একই ঘটনা ঘটে। তিনজন নাট্যকার লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নগরপাল মঞ্চে এসে বলেন, এবারের বসন্ত উৎসবে তিনজন নাট্যকারই এত চমৎকার নাটক করেছেন যে, বিচার করতে বিচারকদের ঘাম ছুটে গেছে। তবু বিচার করতে হয়। তো এবারের প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছেন আমাদের প্রিয় নাট্যকার তরুণ সমাজের গর্ব ইউরিপিডিস।
সে তিনজনের মধ্যে তৃতীয় হয়। প্রতি বছর তৃতীয় হয়। তার মনে হয় এরা আগেই ঠিক করে রাখে ইউরিপিডিস যাই লিখুক, সে তৃতীয় হবে। প্রথম আর দ্বিতীয় নিয়ে বিচার হয়। অনেকে বলে, আসলে প্রথম কে হবে, সেটিও বিচারকরা আগেই ঠিক করে রাখে। প্রতি বছর প্রথম হন সফোক্লিস।
ইউরিপিডিস মনে করে, নগরপাল প্রতি বছর তার নাটক বাছাইতে রাখেন যাতে তৃতীয় বাছাই করতে কোনো সমস্যা না হয়
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার নাটকের প্রযোজকের কখনো অভাব হয় না। কোনো না কোনো ধনী মানুষ ঠিকই টাকা-পয়সা নিয়ে চলে আসে। ইদানীং তার নাটক প্রযোজনা করছেন তরুণরা।
মন খুব খারাপ করে বাড়ির পেছনের জলপাই গাছের নিচে বসে আছে ইউরিপিডিস। সেখানে হাজির হলো আসপাশিয়া। ইউরিপিডিস বিশ্বাস করতে পারছে না। আসপাশিয়া একা একা তার বাড়িতে এসেছে!
আসপাশিয়া জলপাই বাগানেই বসে পড়ল।
মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে বলল, জলপাই শাখা হলো শান্তির প্রতীক। এর তলায় বসলে একটি শান্তি শান্তি ভাব আসে।
কিন্তু ইউরিপিডিসের মনে শান্তি নেই। সে এখনও বুঝতে পারছে না এই মেয়ে কেন এসেছে?
আসপাশিয়া বলল, আজ তোমার সাথে যেটি হলো, সেটি খুবই অন্যায়। বিচারকরা যাই বলুক তোমার নাটকই প্রথম হয়েছে।
ইউরিপিডিস একটু হাসল।
আসপাশিয়া বলল, এমন রোমান্টিক নাটক সারা পৃথিবীতে আর হয়নি। এই নাটকে তুমি যেভাবে প্রেমকে এনেছ, সেভাবে আর কেউ পারেনি। এই নাটকে যেভাবে প্রেম এসেছে, হোমারের হেলেন আর প্যারিসের প্রেম তার কাছে খুবই তুচ্ছ। ওডিসিয়াস আর পেলনোপির প্রেম অনেক বড়, কিন্তু হোমার তাদের প্রেমের বর্ণনা তেমন করে দেননি। তুমি যেভাবে প্রেমকে মঞ্চে এনেছ— সেটি একেবারে নতুন। জানো, নাটক দেখে আমি পেরিক্লিসকে কী বলছিলাম?
‘কী?’
‘বলছিলাম— এই নাটকে ইউরিপিডিস যেসব সংলাপ বলল, আমি মনে মনে সারা জীবন তোমার কাছে ওরকম কথা শুনতে চেয়েছি’। শুনে পেরিক্লিস বললেন, প্রতিটি নারী তার স্বামীর কাছে ঐ রকম কথা শুনতে চায়, আর প্রতিটি স্বামীও চায় তার স্ত্রী হোক ইউরিপিডিসের লেখা এলসিসটিসের মতো।
‘একথা পেরিক্লিস নিজে বলেছেন?’
‘হুঁম। তোমার নাটক দেখে পেরিক্লিস আরও বললেন, তুমি নাটকে যেটি দেখিয়েছ, সেটি বাস্তব। স্বামী যতই শপথ করুক না কেন, বউ মারা গেলে সে দ্বিতীয় বিয়ে করবেই করবে।’
ইউরিপিডিস হাসল।
আসপাশিয়া বলল, তোমার নাটকটা দেখে আমার মনে হচ্ছে আজ রাতে এথেন্সের প্রতিটি নারী-পুরুষ তোমার সংলাপ বলবে। প্রতিটি মেয়ে মনে মনে বলবে— ‘আমার স্বামী যেন গর্ব ভরে বলতে পারে যে আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নারীকে বিয়ে করেছি।’ আর প্রতিটি ছেলে বলবে— ‘তোমার মাঝেই আমাদের বেঁচে থাকা, তোমার মাঝেই মরণ। তোমার ভালোবাসাই আমাদের দুই জীবনের সেতুবন্ধন। ‘
ইউরিপিডিস বলল, তাহলে প্রথম হলাম না কেন?
আসপাশিয়া বলল, তুমি নতুন জিনিস মঞ্চে নিয়ে এসেছ। সেটি বিচারকরা বুঝতে পারছে না। বিচারকরা সব বয়সে বড়, তারা সফোক্লিসের প্রচলিত কাহিনি ভালোবাসে। নতুন কাহিনি তারা নিতে পারে না। তবে একটি ঘটনা আমার চোখে পড়েছে। সেটি হয়তো তোমার নম্বর কমিয়ে দিয়েছে।
‘কোন ঘটনা?’
‘তুমি খেয়াল করেছ কিনা জানি না। তোমার নাটকে ভিলেন হয়ে গেছে রাজার বাবা। নাটকে তুমি স্বামী-স্ত্রীর প্রেম এনেছ। সেই প্রেমের ভিলেন রাজার বাবা। রাজা তার বউয়ের জন্য গদগদ, আর বাবাকে গালি দিচ্ছে। বৃদ্ধ বাবা ছেলের জন্য জীবন দিলেন না, সেজন্য রাজা তার বাবাকে বকাঝকা করছে। নাটকের বুড়ো বিচারকরা একথা মানবে না। তারা এই জিনিস মঞ্চে দেখতে চায় না। সেজন্য তারা তোমাকে কম নম্বর দিয়েছে। আরও বিষয় আছে।’
‘আর কী বিষয়?’
‘নারীকে মহৎ করে ভাবতে এথেন্সের মানুষ এখনও প্রস্তুত নয়। তুমি যেভাবে মেয়েদের দেখছো, এথেন্সের কেউ সেভাবে দেখছে না। তাই নারীদের বড় করে নাটক লিখে তুমি প্রথম হতে পারবে না।’
‘তাহলে কি আর মেয়েদের নিয়ে লিখব না?’
‘তুমি না লিখলে কে লিখবে? আর কে আছে যে মেয়েদের মনের আসল কথা লিখতে পারে।’
ইউরিপিডিসের মনে পড়ল অনেক দিন আগে থিয়েটারে যেদিন প্রথম আসপাশিয়াকে দেখেছিল, সেদিন সক্রেটিস এই কথাটা বলেছিল। সেদিন সে আসপাশিয়ার সাথে ঝগড়া করছিল। সেদিন ঝগড়া শেষ হয়নি। আজ আসপাশিয়া নিজে এসে ঝগড়াটা শেষ করে গেল। বলে গেল— ইউরিপিডিসই একমাত্র নারীদের মনের কথা লিখতে পারে।
ইউরিপিডিসের মন ভালো হয়ে গেছে। সে ভাবছে, ইশ, এথেন্সের মানুষ যদি আসপাশিয়ার মতো করে বুঝত।
মন ভালো হলেও এথেন্সে থাকবে না সে। আবার সালামিনা দ্বীপে চলে যাবে। এথেন্সের মানুষ তাকে খুব কষ্ট দেয়। এর চেয়ে সালামিনার গুহা অনেক ভালো। সেখানের নিশ্চুপ সাগর তাকে কাঁদায় না। এথেন্সের মাটিতে ফিরলেই সে কাঁদে। আজই চলে যাবে। কাউকে কিছু না জানিয়ে আবার চলে যাবে সালামিনা দ্বীপে।
সে হাঁটতে শুরু করল সাগর পাড়ের দিকে। নৌকায় করে যেতে হয় দ্বীপে। তার নিজের নৌকা আছে, নিজেই মাঝি। নৌকা ছেড়ে দিচ্ছে। অনেক দিনের জন্য এথেন্স ছাড়বে। হঠাৎ মনে হলো দূরে তার নাম ধরে কেউ ডাকছে।
একটি ঘোড়া ছুটে আসছে অনেক জোরে। ঘোড়ার চড়ে দুইজন মানুষ তার নৌকার দিকেই আসছে। ঘোড়ার উপর ক্রিতো। সাথের লোকটিকে সে চেনে না। ঘোড়া থামতেই তারা চট করে উঠে পড়ল নৌকায়। ইউরিপিডিস কিছুই বুঝতে পারছে না। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে প্রশ্ন।
ক্রিতো বলল, তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন সক্রেটিস বলল, ‘যাও, সালামিনার পথে দেখো।’ তারপর ঘোড়া নিয়ে দৌড়ে ছুটে এলাম সাগর পাড়ে।
ইউরিপিডিস বলল, ঘোড়া ছুটিয়ে আসার মতো জরুরি কিছু হয়েছে? তিনজনের মধ্যে তৃতীয় হওয়া নাট্যকারের কাছে কারও জরুরি কিছু থাকার কথা নয়।
ক্রিতো ইউরিপিডিসের কাঁধে হাত রেখে বলল, নাটকের জন্যই এসেছি। ভালো খবর আছে। তৃতীয় নাট্যকারকেই মানুষ পছন্দ করেছে। সেই খবর নিয়েই এলাম।
ইউরিপিডিস ক্রিতোর সাথের লোকটির দিকে তাকাল।
লোকটি হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম সক্রেটিস।
‘সক্রেটিস?’ ইউরিপিডিস অবাক।
ক্রিতো বলল, হুঁম, ওনার নামও সক্রেটিস। বাড়ি এনাগিরোস মহল্লায়। পেশায় সৈনিক। কিন্তু নাটকের খুব সমঝদার
নতুন সক্রেটিস বলল, আমাদের পাড়ায় একটি বড় থিয়েটার হয়েছে। আমরা চাই সেখানে আপনার ‘এলসেসটিস’ মঞ্চস্থ করব। আপনি যদি পরিচালক হন।
ইউরিপিডিস বলল, আপনাদের থিয়েটার আমি দেখেছি। সারা গ্রিসের এমন কোনো থিয়েটার নেই, যেখানে আমি যাইনি। যাই হোক, আপনারা আমার নাটক কেন মঞ্চে আনবেন? সফোক্লিসেরটা কেন নয়?
সফোক্লিস আমাদের পাড়ায় নাটক করবেন না। আর করলেও যে টাকা চাইবেন, সেটি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা আপনার নাটকটা পছন্দ করেছি। এমন রোমান্টিক নাটক এর আগে এথেন্সে কোনোদিন হয়নি। এমন সংলাপ কোথাও নেই। আমরা নাটকটা আবার দেখতে চাই। আপনি পরিচালনা করতে রাজি হলে আমি নিজেই প্রযোজনা করতে চাই। অভিনয় আমার পাড়ার ছেলেরাই করবে।
‘কোনো নির্দিষ্ট তারিখ আছে আপনাদের?’
আমরা কালই কাজ শুরু করতে পারি। বাকিটা আপনার হাতে। যেদিন বলবেন অভিনেতারা প্রস্তুত, সেদিনই মঞ্চস্থ হবে।
ইউরিপিডিস ভাবছে, প্রস্তাব ভালো না মন্দ?
ক্রিতো বলল, প্রস্তাব ভালো। ভালো জিনিসই মানুষ বারবার দেখতে চায়। বই বলো, আর নাটক বলো, মানুষ পছন্দ করলেই সেটি টিকে থাকে। আসো, ঘোড়ায় ওঠো।
ইউরিপিডিস নৌকা থেকে নামল।