1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ২১

২১

‘দয়াশীল হও— তোমার চারপাশে যাদের দেখছো,
সবাই একটি কঠিন যুদ্ধের মধ্যে আছে।’

—প্লেটো

***

অলিম্পিয়ার বিশাল মঞ্চ।

অলিম্পিকের শেষ দিনে সন্ধ্যায় পেরিক্লিস এই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছেন। .অলিম্পিকে যেখান থেকে যারা এসেছে, সবাই এই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত। তারা জানে না এই অনুষ্ঠানে কী হবে। কিন্তু আয়োজন ব্যাপক। একটা বড় কিছুই হবেই। এথেন্সের পতাকা দিয়ে চারদিক সাজানো হয়েছে। তার মাঝখানে আলোয় ঝলমল করছে মঞ্চ।

মঞ্চে উঠেছে হেরোডোটাস। সামনে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার দর্শক। হেরোডোটাস শুরু করল এথেন্সের গল্প :

এথেন্স একটি মহান নগর। জ্ঞানের শহর। এখানে জ্ঞান উৎপত্তি হয়। এই শহরে গণতন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে।

হেরোডোটাস মজা করে কাহিনি বলছে। সে ম্যারাথন যুদ্ধের কাহিনি শুরু করল— এথেন্স আমাদের সব নগরকে বাঁচিয়েছে। পারস্যের হাত থেকে আমাদের সবাইকে বাঁচিয়েছে।

সে অনেকক্ষণ ধরে খুব মিষ্টি করে ম্যারাথনের কাহিনি বলল। দর্শকরা তুমুল হাততালি দিল। সবাই খুশি। শুধু খুশি হলো না স্পার্টার লোকেরা। ম্যারাথনের যুদ্ধে স্পার্টা ঠিক সময়ে সাহায্য করেনি। তাই ম্যারাথনের গল্পে এথেন্স উপরে আর স্পার্টা নিচে। স্পার্টানরা একটু বিরক্ত হচ্ছে। হেরোডোটাস খেয়াল করল স্পার্টানদের উসখুস। তাদের শান্ত করতে হবে।

সে বলল, ভায়েরা। পারস্যের সাথে যুদ্ধ শুধু এথেন্স একা করেনি। এথেন্স আর স্পার্টা মিলেমিশে একটি চমৎকার যুদ্ধ করেছে। এখন আমি সেই কথা বলব।

স্পার্টার লোকেরা নড়েচড়ে বসল।

হেরোডোটাস বলে চললো—

ম্যারাথন যুদ্ধে জয়ের পর এথেন্সে উৎসব হচ্ছে। সবার মনে আনন্দ আর আনন্দ। কেউ ভাবতেই পারেনি যে, পিচ্চি গণতন্ত্র এথেন্স সত্যি সত্যি একদিন পারস্যের বিশাল বাহিনীকে হারিয়ে দেবে। সবাই আনন্দে গলাগলি, কোলাকুলি করছে। কয়েকটি মেয়ে কিথারা বাজিয়ে গান গাইছে। তাদের সাথে নাচছে ম্যারাথন যুদ্ধের সেনাপতিরা। সবার মনে থৈ থৈ আনন্দ।

শুধু একজন যোগ দেননি এই আনন্দে। তার নাম থেমিস্টক্লিস[৬৫]। তিনি এথেন্সের একজন সেনাপতি। বয়স পঞ্চাশের মতো। সেই সন্ধ্যায় তিনি গম্ভীর। কিছুটা চিন্তিত। তিনি ভাবছেন— এথেন্সের এই বিজয় কত দিনের। কুট্টি নগর এথেন্সের কাছে হেরে গেছে বিশাল পারস্য। সম্রাট দারিউস কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? খুব শীঘ্রই আবার আসবে। তখন কী করবে এথেন্স? উপায় ভাবছেন থেমিস্টক্লিস।

উপায় একটি আছে। সেটি হলো নৌযুদ্ধ। মাটিতে যুদ্ধ করলে কিছুতেই পারবে না এথেন্স। সাগরে যুদ্ধ হলে পারস্যকে হারানো যেতে পারে। সেই সন্ধ্যায় থেমিস্টক্লিস সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি এথেন্সে একটি বড় নৌবাহিনী বানাবেন। কয়েকশ জাহাজ করবেন। সেজন্য দরকার অনেক টাকা।

টাকার বিষয়ে কদিনের মধ্যেই একটি বিরাট সুখবর পাওয়া গেল। এথেন্সে রুপার খনি পাওয়া গেছে। এক্রোপলিস থেকে মাত্র চার মাইল দক্ষিণে লরিয়াম নামক এক জায়গায় আবিষ্কার হয়েছে রুপা। এখন এই রুপার টাকা দিয়ে কী করা হবে, সেটি নিয়ে সংসদে ভোট হবে। পিনিক্স পাহাড়ে সেদিন অনেক লোক। টাকার গন্ধে দলে দলে মানুষ আসছে। সংসদ জমজমাট।

অনেকেই বক্তৃতা দিচ্ছে। টাকার বখরা চাই। তারা বলছে, এই সম্পদ আমাদের সবার, আসুন, সবাই ভাগ করে নিই।

থেমিস্টক্লিস বললেন, আপনারা ঠিক বলেছেন। এই অর্থ আমাদের সবার। আমরা ভাগ করেই নেব। তবে একটি বিষয়। এজিয়ান সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ঐ যে আমাদের শত্রু দ্বীপ এজিনা। আর একটু দূরে আর এক শত্রু দেশ মেগারা। চারিদিকে এথেন্সের শত্রু। তার চেয়েও বড় শত্রু পারস্য। ম্যারাথনে আমরা জিতেছি। কিন্তু পারস্য যদি আবার আসে?

সবার মনে ভয় ঢুকে গেল। তাই তো?

থেমিস্টক্লিস আবার বললেন, সেজন্য আমাদের তৈরি হতে হবে। আমরা এই টাকা দিয়ে জাহাজ বানাব। নৌবাহিনী বানাব। আমাদের নৌসেনা হবে পৃথিবীর সেরা। নৌবাহিনী দিয়েই আমরা শত্রুর মোকাবেলা করব।

সবাই দেখল— লোকটি গ্রিক বীরের মতো কথা বলছে। গ্রিক পুরাণের বীরদের আওয়াজ সবাই পছন্দ করে। এই লোককে সমর্থন করা যায়। ভোটে থেমিস্টক্লিসের প্রস্তাব পাস হলো।

তিনি শুরু করলেন জাহাজ বানানো। পাশের শহর করিন্থের লোকজন নতুন এক আশ্চর্য রকমের জাহাজ বানিয়েছে। এর নাম ট্রাইরিম, মানে তিন বহরের জাহাজ। এই জাহাজের সামনের দিক অনেক লম্বা আর চোখা। যুদ্ধের সময় এই চোখা অংশটি হয়ে যায় একটি মারাত্মক অস্ত্র। শত্রুর জাহাজের মাঝ বরাবর দ্রুতগতিতে চালিয়ে দিলে শত্রুর জাহাজ মুহূর্তেই ভেঙে যায়। থেমিস্টক্লিস এই ট্রাইরিম পছন্দ করলেন। তিনি দুইশ ট্রাইরিম জাহাজ বানালেন। অনেক মানুষ নিয়ে তৈরি করলেন এথেন্সের নৌবাহিনী।

কিছু দিন পরে শোনা গেল, পারস্য বাহিনী সত্যিই আবার আসছে। এবার আর বড় রাজা নন, বড় রাজা মারা গেছেন। তার ছেলে ছোট রাজা ড্রেক্সি[৬৬]। অপমানের শোধ নিতে দশ বছর পর বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছে। এবার পারস্যের সেনা কয়েক লাখ।

গ্রিসের নগরগুলোর জন্য মোটামুটি দশ নম্বর বিপদ সংকেত। মহাবিপদ টের পেয়ে গ্রিসের ছোট ছোট নগরগুলো একত্রিত হলো। বিপদের দিনে বন্ধু হলো গ্রিসের সবচেয়ে বড় দুই শক্তি এথেন্স আর স্পার্টা। এই যুদ্ধে এথেন্স যুদ্ধ করবে সাগরে, তারা নৌযুদ্ধে ভালো। আর স্পার্টা যুদ্ধ করবে মাটিতে। গ্রিসের সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি স্পার্টার রাজা লিওনিদাস।

লিওনিদাস গেলেন ডেলফিতে। ডেলফির এপোলোর মন্দিরে ওরাকলের কাছে জিজ্ঞেস করলেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। ওরাকলের কথা মিথ্যা হয় না। ওরাকল যা বলে, গ্রিসের সবাই সেটিই করে। ওরাকল তিনটি কথা বললেন, এক. এই যুদ্ধে গ্রিসের জন্য ভয়াবহ বিপদ আসছে। দুই. সামনের পূর্ণিমায় বিশেষ পূজা আছে, সেই পূর্ণিমার আগে স্পার্টার বাহিনী কিছুতেই যুদ্ধে যেতে পারবে না। তিন. হারকিউলিসের বংশধর কোনো রাজা যদি এই যুদ্ধে আত্মাহুতি দেয়, তাহলেই গ্রিস রক্ষা পাবে।

ওরাকলের প্রথম কথা সবাই জানে পারস্যের আক্রমণ একটি মহাবিপদ। দ্বিতীয় কথাটা সমস্যার। পূর্ণিমার এখনও অনেক বাকি। পারস্য সেনা উত্তর দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। পূর্ণিমার আগেই তারা দখল করে ফেলবে এথেন্স। লিওনিদাস ভাবছেন। ওরাকলের তিন নম্বর কথাটি তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। তিনি শুনতে পাচ্ছেন, এই যুদ্ধে গ্রিসকে বাঁচাতে হারকিউলিসের বংশধর কোনো রাজাকে মরতে হবে। হঠাৎ বলে উঠলেন, আমিই তো হারকিউলিসের বংশধর। আমি মরলে যদি স্পার্টা বাঁচে, তবে তাই হোক। কিন্তু পূর্ণিমার আগে স্পার্টা বাহিনী যুদ্ধে যাবে না। এটি মহা চিন্তার কারণ। এটির জন্য কী করা যায়! অন্য কী উপায়ে পারস্যকে আটকানো যায়!

চোখ বন্ধ করে দেখছেন লিওনিদাস। কোন পথ দিয়ে শত্রু আসছে। কোথায় তাদের আটকানো যায়। হঠাৎ চোখ বুজে খুঁজে পেলেন তার ‘ইউরেকা মুহূর্ত’। চিৎকার করে বললেন, ‘আছে আছে, উপায় আছে। একটি ভীষণ সরু জায়গা আছে। সেখানে আটকে দিলে বিশাল সেনা নিয়ে আর আগাতে পারবে না। অল্প কিছু ভালো যোদ্ধা নিয়েই দিনের পর দিন আটকে রাখা যাবে পারস্য বাহিনীকে। মাত্র তিনশ জন স্পার্টান আমার সাথে আসো। স্পার্টা বাহিনী এখন যুদ্ধে যাবে না। তারা পূর্ণিমার পরেই যাত্রা করবে। আমি মাত্র তিনশ জনকে নিয়েই শত্রুকে আটকে রাখব।’

তিনশ জন সেনা নিয়ে লিওনিদাস পৌঁছলেন পাহাড় আর সাগরের মাঝে একটি সরু জায়গায়। জায়গাটি নাম থার্মোপিলাই[৬৭]। থার্মো মানে গরম আর পিলাই মানে গেইট বা দরজা। এই গরম দরজা ভীষণ অদ্ভুত। পৃথিবীতে এমন অদ্ভুত জায়গা খুব কম আছে। এখানে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে একটি তীব্র গরম পানির ঝরনা। ফুটন্ত গরম পানিতে সালফার মিশে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস। লিওনিদাস সেই বিষাক্ত গরম পানি আটকে লেক তৈরি করে পাহাড়ের সরু পথটা আরও সরু করে ফেললেন। আর নিজে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনশ জন স্পার্টান নিয়ে। ততদিনে আরও কিছু অন্য নগরের গ্রিক সেনা তার সাথে যোগ দিয়েছে।

সম্রাট ড্রেক্সির নেতৃত্বে পারস্য বাহিনী এলো থার্মোপিলাইতে। এত অল্প সেনা দেখে তারা কিছুক্ষণ কৌতুক করল। কিন্তু সরু পথ দিয়ে এগিয়ে আসতেই বুঝতে পারল লিওনিদাসের যুদ্ধ কৌশল। চিকন পথ— একসাথে মাত্র কয়েকজন সেনা যেতে পারে। পাশেই বিষাক্ত তীব্র গরম পানি আর সামনে ভয়-ডরহীন তিনশ জন স্পার্টান। কয়েকজন এগিয়ে এলেই স্পার্টান অস্ত্রের সামনে পড়ে। এমন অদ্ভুত যুদ্ধে টানা সাত দিন সেখানেই লিওনিদাস আটকে রাখলেন বিশাল পারস্য বাহিনীকে। রাগে চুল ছিঁড়তে থাকল পারস্যের রাজা। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। স্পার্টান যুদ্ধ কায়দার কাছে তারা কিছুই করতে পারলেন না।

অবশেষে সাত দিন পর এক বিশ্বাসঘাতক গ্রিক সৈনিক পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে অন্য একটি পথ দেখিয়ে দিল পারস্যদের। সেখান দিয়ে গিয়ে পারস্যরা লিওনিদাস আর তিনশ স্পার্টানকে ঘিরে ফেলল। তীরের ফলায় মৃত্যু হলো লিওনিদাসের। পারস্যের রাজা ড্রেক্সি লিওনিদাসের মাথা কেটে ক্রুশবিদ্ধ করে থার্মোপিলাইতে ঝুলিয়ে দিল।

ওরাকলের কথা রাখলেন লিওনিদাস। দেশের জন্য প্রাণ দিলেন হারকিউলিসের বংশধর রাজা। আজও যদি আমরা সেখানে যাই, শুনতে পাব লিওনিদাস বলছেন—

‘হে পথিক-
স্পার্টায় গিয়ে বলো, আজও এখানেই বসে রয়েছি
ছাড়িনি পথ-
মৃত্যুকে ভালোবেসে আমি জীবনের কথা রেখেছি।’[৬৮]

এই বলে হেরোডোটাস থামল। তার চোখে পানি। সকল স্পার্টানদের চোখে পানি। এতক্ষণে স্পার্টানরা হেরোডোটাসের উপর খুশি।

হেরোডোটাস আবার শুরু করল— ততদিনে পূর্ণিমা শেষ হয়েছে, স্পার্টার সেনারা যুদ্ধযাত্রা করেছে। এথেন্সের বাহিনীও জাহাজ নিয়ে তৈরি।

এথেন্সের সেনাপতি থেমিস্টক্লিস। এতদিন তিনি যে ছক করেছিলেন, এবার সেটি পূরণ করার সময় এসেছে। তিনি ঠিক করলেন, আমরা সবাই এথেন্স ছেড়ে চলে যাব। এথেন্স একেবারে খালি থাকবে। আমাদের সব সেনা জাহাজ নিয়ে সালামিনা দ্বীপে থাকবে। আর নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা দূরের আর একটি দ্বীপে চলে যাবে।

তো পারস্য বাহিনী এথেন্সে এসে দেখে, শহর খালি। তারা ভাবল এথেন্সবাসী পালিয়ে গেছে। তারা বিজয়ের আনন্দ শুরু করল। এক্রোপোলিসের উপর গিয়ে দেবী এথিনার মন্দির পার্থেনন পুড়িয়ে দিল। এথেন্সের মানুষ সালামিনা দ্বীপ থেকে দেখল পার্থেনন পুড়ে যাচ্ছে। তাদের শহর পুড়ে যাচ্ছে। দেবী এথিনা পুড়ে যাচ্ছে। থেমিস্টক্লিস পারস্যদের খবর পাঠাল, তারা আত্মসমর্পণ করতে রাজি। জাহাজ নিয়ে পারস্য বাহিনী যেন সালামিনা[৬৯] দ্বীপে আসে। সেখানে আত্মসমর্পণ করবে এথেন্স।

আসলে এটি ছিল একটি ফাঁদ। ড্রেক্সি আনন্দে তার সব জাহাজ নিয়ে সালামিনার দিকে যাত্রা করল। এথেন্সে থেকে সালামিনা দ্বীপে ঢোকার সাগর পথ খুবই সরু। পারস্য তাদের সব জাহাজ নিয়ে সেই সরু পথে ঢুকে পড়ল। এই সুযোগের আশায়ই ছিলেন থেমিস্টক্লিস। যখন পারস্যের সব জাহাজ সরু চ্যানেলে ঢুকে পড়েছে, তখনই এথেন্সের নৌবাহিনী আক্রমণ করল তাদের ট্রাইরিম জাহাজগুলো দিয়ে। লম্বা চোখা মাথার ট্রাইরিম জাহাজগুলো খুব দ্রুত আঘাত করল পারস্য জাহাজের মাঝ বরাবর। মুহূর্তের মধ্যে পারস্যের জাহাজগুলো ভেঙে ভেঙে ডুবে যেতে লাগল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পারস্যের একশ জাহাজ ডুবে গেল। জেক্সি এতক্ষণে বুঝল তারা আসলে ফাঁদে পড়েছে। সে জাহাজগুলোকে পিছে আসতে আদেশ দিল। কিন্তু পথ খুবই সরু। দ্রুত পিছানো যাবে না। এথেন্সের নৌসেনারা একের পর এক পারস্য জাহাজ ডুবিয়ে দিচ্ছে।

সেই পারস্য বাহিনীতে ছিল এক গ্রিক নারী। তার নাম আর্টিমিসিয়া। সে তার কয়েকটি জাহাজ নিয়ে ভীষণ যুদ্ধ করল এথেন্সের বিপক্ষে। তার যুদ্ধ দেখে পারস্যের রাজা বলল, ‘দেখো, আমার পুরুষ সেনাপতিরা সব নারী হয়ে গেছে, তারা যুদ্ধ ভুলে গেছে। আর আমার নারী সেনানেত্রী পুরুষ হয়ে গেছে, সেই সবচেয়ে ভালো যুদ্ধ করছে।’ বীরের মতো লড়াই করে আর্টিমিসিয়া এক সময় মারা গেল।

কয়েক ঘণ্টায় পারস্যের প্রায় সব জাহাজ ডুবে গেল। অর্ধেকের বেশি সেনা মারা গেল। জেক্সি অল্প সেনা নিয়ে পালিয়ে গেল। এথেন্স জিতে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৌযুদ্ধ। গ্রিসের সব নগরকে আবারও রক্ষা করল এথেন্স। সেদিন যদি এথেন্স হেরে যেত, তাহলে সকল গ্রিক নগর পারস্যের অধীন থাকত।

[হেরোডোটাসের মতে, এই যুদ্ধে পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রিসের বিজয় এশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় কোনো শক্তির চূড়ান্ত বিজয়।]

হেরোডোটাস গলা উঁচু করে বলল, সবার পক্ষ থেকে এথেন্সকে অভিনন্দন। সকল দর্শক, শ্রোতা তুমুল হাততালি দিল। সবাই বলল, হ্যাঁ, এথেন্সকে অভিনন্দন। স্পার্টার মানুষরাও হাততালি দিল। তারাও বলল, এথেন্সকে অভিনন্দন।

সব দেশের মানুষ এথেন্সের নামে জয় জয় করছে। সবাই স্বীকার করে নিয়েছে এথেন্সই সব নগরের নেতা। অলিম্পিকে বেশি সোনা জিতেছে স্পার্টা। কিন্তু হেরোডোটাসের মুখের কথায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল এথেন্স।

আসপাশিয়া চুপি চুপি পেরিক্লিসের হাতে টোকা দিল। পেরিক্লিস দ্রুত মঞ্চে উঠলেন। হাত তুলে বললেন, প্রিয় ভাইয়েরা, বিগত দিনে সব ধরনের বিপদে আপদে এথেন্স আপনাদের পাশে ছিল, সামনের দিনেও কেউ বিপদে পড়লে যে নগর সবার আগে এগিয়ে আসবে, সে হলো এথেন্স।

তুমুল হাততালিতে চারদিক কেঁপে উঠল। পেরিক্লিস জড়িয়ে ধরলেন হেরোডোটাসকে। দুজনে হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদনের উত্তর দিচ্ছেন।

আসপাশিয়া চোখ বুজে আছে। তার দু’চোখে পানি। আনন্দের অশ্রু বন্যার মতো বের হচ্ছে তার দু’চোখ বেয়ে। তার বুদ্ধি এমন চমৎকার কাজ করেছে, মনে হচ্ছে সে সত্যি উড়ছে। দেবী আফ্রোদিতির মতো উড়ছে।

***

চেরোফোনের কথা আর ফুরায় না।

অলিম্পিয়া থেকে ফিরে সে বলছে তো বলছেই। অন্য কাউকে সুযোগই দিচ্ছে না। সে তো এমনিতেই বাচাল। এখন মহাবাচাল হয়ে গেছে। কথার গাড়ি চালু করে বন্ধ করতে ভুলে গেছে। চলছে তো চলছেই। হেরোডোটাস কীভাবে সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে এথেন্সকে সেরা বানিয়ে তুলল— সেকথা বলতে বলতে তার মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে।

চেরোফোনের যন্ত্রণায় সক্রেটিস আর সিমনের কান ঝালাপালা। সক্রেটিসের ধৈর্যের কোনো শেষ নেই। সে কিছু বলছে না। কিন্তু সিমন আর সহ্য করতে পারছে না।

চেরোফোন বলছে, এবারের অলিম্পিকে পদক পেয়েছে একজনই। তার নাম হেরোডোটাস।

সিমন বলল, সেটি বুঝলাম। একটি ব্যাপার বলো— অলিম্পিকে সব খেলোয়াড় মাঠে নামে ন্যাংটা হয়ে। হেরোডোটাসের কি কাপড় ছিল?

চেরোফোন রাগে এমনভাবে তাকাল, যেন সিমনকে এক্ষুনি ভস্ম করে দেবে। এ কী কথা? মহান হেরোডোটাস ন্যাংটা হয়ে মঞ্চে উঠবে? এ কেমন রসিকতা! সক্রেটিসের সামনে এমন রসিকতা করছে, তবু সক্রেটিস কিছুই বলছে না?

সিমন চেরোফোনের রাগকে পাত্তাই দিল না। সে সিরিয়াস মুখ করে বলল, ঠিক আছে, কাপড় পরার কথা বাদ দাও। অন্য কথা বলি 1 হেরোডোটাস তো অলিম্পিক জিতে এসেছে। সেই হিসেবে এথেন্সে ঢোকার সময় তার তো গেইট দিয়ে নয়, দেয়াল ভেঙে ঢোকার কথা। তা কোন দিকে দেয়াল ভেঙে এথেন্সে ঢুকেছে সে?

গ্রিসের সব নগরের চারদিক ঘিরে বাইরের আক্রমণ ঠেকাতে একটি সুরক্ষা দেয়াল থাকে। এথেন্সের চারদিকেও আছে। সে দেয়ালে দরজাও আছে। নিয়ম হলো কেউ অলিম্পিক পদক জিতে এলে, সে এথেন্সের দেয়ালের সদর দরজা দিয়ে ঢুকবে না, ঢুকবে এক জায়গার দেয়াল ভেঙে। অলিম্পিক জিতলে সে তো আর সাধারণ মানুষ নয়। সে দেবতার কাছাকাছি। সে বীর। বীরেরা দরজা দিয়ে নয়, দেয়াল ভেঙে ঢোকে।

চেরোফোন বুঝল, সে হেরোডোটাসকে নিয়ে এত বেশি বলছে যে, সবাই তাকে পিন দিচ্ছে। কিন্তু সে ছেড়ে দেওয়ার লোক নয়। তার নীতি হলো— বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী।

চেরোফোন বলল, তাহলে শোন— হেরোডোটাস এথেন্সের মানুষের হৃদয়ের দেয়াল ভেঙে ঢুকেছে। উঁকি দিয়ে দেখো— তোমার হৃদয়েও হেরোডোটাস আছে।

সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। এবারে চমৎকার বলেছে চেরোফোন

সক্রেটিস বলল, হেরোডোটাস আমাদের কাছে অনেক সম্মানের। তাকে নিয়ে আর কচায়ন কোরো না। বেশি কচলালে তিতা হয়ে যায়। এখন বলো আমাদের আসপাশিয়া কেমন ছিল? তার তো ঝামেলা হওয়ার কথা।

চেরোফোন বলল, ঝামেলা মানে? একেবারে মহা ঝামেলা। সবচেয়ে বিপদে ছিল আসপাশিয়া। তাকে চোরের মতো লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। মাঠে তো যেতেই পারবে না। সে হলো তাঁবুবাসী। তাঁবুর মধ্যে বন্দি। তাঁবুতে যেন কাক-পক্ষীও ঢুকতে না পারে, সে ব্যবস্থা করেছিলেন পেরিক্লিস। তাঁবুতে ঢুকতে পারতাম শুধু দুজন—আমি আর ক্রিতো।

সিমন বলল, কিন্তু অলিম্পিকে নারী ঢুকতে পারবে না কেন? ঢুকলে নাকি মৃত্যুদণ্ড। এটি কোনো কথা হলো?

চেরোফোন হাসতে হাসতে বলল, একটু আগেই তো বললে অলিম্পিকের খেলোয়াড়রা সব ন্যাংটা। তো অতগুলো ন্যাংটা পুরুষের সামনে নারী আসতে পারে? সর্বনাশ হয়ে যাবে না?

সবাই হেসে উঠল। সক্রেটিস বলল, সারা গ্রিসেই নারীদের জন্য বাইরে আসা নিষেধ। অলিম্পিকেও সেই একই নিয়ম।

চেরোফোন বলল, অলিম্পিক মাঠে কিন্তু একবার এক নারী গিয়েছিল। এক নারী পুরুষ বেশে ঢুকেছিল। তার স্বামী ছিল তাদের ছেলের বক্সিং প্রশিক্ষক। স্বামীও অলিম্পিক জয়ী। কিন্তু ছেলের অলিম্পিক শুরুর আগে হঠাৎ স্বামী মারা গেল। কিন্তু ছেলেকে পদক জিততেই হবে। তাই মহিলা নিজেই ছেলেকে শিখাতে শুরু করেন। তারপর পুরুষ বেশে অলিম্পিক মাঠে চলে আসেন। তার ছেলে বক্সিংয়ে প্রথম হয়ে যায়। কিন্তু ছেলে প্রথম হতেই সে চিৎকার করে ওঠে। তার গলার স্বরে ধরা পড়ে যায়, সে নারী।

সিমন বলল, তো তাকে কি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়?

‘না, সে বেঁচে যায়। তার ছেলে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, মাকে দণ্ড দিলে ছেলেও সেখানেই প্রাণ দেবে। পরে অলিম্পিক কমিটি মাকে মাফ করে দেয়। বলে— তার স্বামী আর পুত্র দুজনেই অলিম্পিক জয়ী বীর। তাই তাকে এবারের মতো মাফ করা হলো।’

সিমন বলল, যাক, মা হিসেবে প্রাণে বেঁচে গেছে।

চেরোফোন বলল, তবে মাঠে না এসেই নারীরা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছে। সিমন বলল, মানে?

‘মানে হলো রথ প্রতিযোগিতায় প্রতিযোগীর মাঠে আসার দরকার নেই। তার হয়ে রথচালক ঘোড়া নিয়ে মাঠে গেলেই হলো। এই নিয়মে স্পার্টার রাজার বোন রথ পাঠিয়ে কয়েকবার অলিম্পিক জিতেছে।’

সিমন বলল, ভালো খবর। মেয়েদের তো সুযোগ নেই, একটু সুযোগ পেলেই দেখা যায়, মেয়েরা বসে থাকে না।

সক্রেটিস বলল, মূল ঘটনায় আসো। আসপাশিয়ার কী হলো সেই কথা বলো।

চেরোফোন বলল, আসপাশিয়া কোনোমতে পাঁচটা দিন তাঁবুতে কাটিয়েছে। তারপর সে যেতে পেরেছিল হেরোডোটাসের অনুষ্ঠানে। পেরিক্লিস বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করেছিল। ওটা তো অলিম্পিক খেলা নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাই অনুমতি মিলেছিল। তবে ঘটনা একটি হয়েছিল।

সক্রেটিস বলল, কী ঘটনা?

‘ঘটনা কবি পিনডারকে নিয়ে। আমরা এসে আসপাশিয়াকে পিনডারের কথা বললাম। শুনে সে একটি বুদ্ধি দিল। পেরিক্লিসকে বলল, কবি পিনডারকে দিয়ে এথেন্সের জন্য কবিতা লেখাতে। আসপাশিয়া কিছু বললে পেরিক্লিস সেকথা না রেখে পারেন না। তিনি তক্ষুনি কবিকে আনতে লোক পাঠালেন 1 কিন্তু তাড়াহুড়ায় একটু ভুল করে বসলেন। তিনি কবি পিনডারকে এথেন্সের তাঁবুতে নিয়ে আসেন। আসপাশিয়াকে দেখে তো কবির মাথা ঘুরে পুরোপুরি আউলা হয়ে গেল। অলিম্পিকের ময়দানে নারী আসতে পারে একথা তিনি ভাবতেই পারেননি। তার উপর আসপাশিয়ার রূপে কবি একেবারে দিশাহীন হয়ে গেলেন। সেটি সামলাতে পেরিক্লিস আর আসপাশিয়াকে অনেক ঝামেলা করতে হয়েছিল।’

সক্রেটিস বলল, পিনডার কোন কবিতা লিখলেন?

চেরোফোন বলল, কবিতা ভালোই লিখলেন। তিনি লিখলেন—

‘দিবসের সূর্য আর রজনীর তারা
আজ সব ম্লান, সব জ্যোতিহারা
একটিমাত্র জ্যোতিস্ক জ্বলে, সারা আকাশের নীড়
তোমাকে অভিবাদন- হে অলিম্পিক বিজয়ী বীর।’[৭০]

সক্রেটিস বলল, বাহ, চমৎকার। অলিম্পিকের জন্য এর চেয়ে ভালো কবিতা আর হতে পারে না। আসপাশিয়ার কথা কবি বাইরে গিয়ে বলে দেয়নি?

‘না। পেরিক্লিস ব্যবস্থা করেছিলেন। কবিতা লিখে কবি পিনডার তাঁবু থেকে বের হলে পেরিক্লিসের দাস তাকে বলল, শোনেন কবি, একটি কথা। আপনি কিন্তু তাঁবুতে কোনো মহিলা দেখেননি। ঠিক আছে?’

কবি তো হতভম্ব। কী বলবেন তিনি? কোনো মহিলা দেখেননি?

দাস বলল, এ কথা জানাজানি হলে, জীবনে আর কোনো মহিলা দেখতে পাবেন না। এই শেষ দেখা। অলিম্পিয়া থেকে ফিরতেই পারবেন না।

কবি সারা জীবনে আরও অনেক মহিলা দেখতে চান সেজন্য আসপাশিয়ার কথা চেপে গেছেন।

***

৬৫. এথেন্সের নৌসেনাপতি থেমিস্টক্লিস (Themistocles) পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা নৌকৌশলী। তার কৌশলেই Battle of Salamis এর যুদ্ধে পারস্যকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে গ্রিস।

৬৬. পারস্যের সম্রাট জেক্সি (Xerxes I), তিনি ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স আক্রমণ করেন। হেরোডোটাস তাকে অত্যন্ত ক্রূর চরিত্রের হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

৬৭. এথেন্স থেকে ২০০ কি:মি: উত্তরে সরু যুদ্ধক্ষেত্র থার্মোপিলাই (Thermopylae), এখানে স্পার্টার রাজা লিওনিডাস মাত্র ৩০০ জন সেনা নিয়ে পারস্যকে আটকে রাখেন। লিওনিডাস এখানেই মারা যান। এখন এখানে রাজা লিওনিডাসের একটি মূর্তি আছে।

৬৮. গ্রিক কবি Simonides এর লেখা এই বিখ্যাত কবিতাটি থার্মোপিলাইতে পাথরে খোদাই করা ছিল। হেরোডোটাসের লেখা থেকে এটি অনেকেই অনুবাদ করেছেন। আমি ইতিহাসবিদ Jesse Rufus Fears এর ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছি।

৬৯. ম্যারাথন যুদ্ধের দশ বছর পরে খ্রি. পূ. ৪৮০ অব্দে সালামিনা দ্বীপে (Salamis Island) পারস্য ও গ্রিসের মধ্যে বিশাল নৌযুদ্ধ হয়, যুদ্ধকে Battle of Sis বলা হয়।

৭০. কবি পিনডার (Pindar) এর Olympian 1 কবিতার অংশ, D. A. Svarlien কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *