হেমলকের নিমন্ত্রণ – ২

‘সত্য আর সুন্দর সবার জন্য একই; শুধু সন্তুষ্টি একেক জনের কাছে একেক রকম।’—ডিমোক্রিটাস

***

খুব সকালে সক্রেটিস আর ইউরিপিডিস নাটক দেখতে যাচ্ছে।

এথেন্সে বসন্ত উৎসব[১৩] চলছে। এই উৎসবে নাটক প্রতিযোগিতা হয়। নাটক দেখতে চলেছে হাজার হাজার মানুষ। শহরের সব অলি, গলি, তস্যগলি দিয়ে মানুষ চলছে; যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু, দাস সবাই লাইন ধরে যাচ্ছে। অন্য অনুষ্ঠানে মেয়েরা যেতে পারে না, কিন্তু থিয়েটারে যেতে পারে। তাই আজ রাস্তায় অনেক মেয়ে। মেয়েদের আপাদমস্তক ঢাকা, শুধু মুখটা কোনোরকমে অনাবৃত রেখে তারাও হাঁটছে। বড় রাস্তায় লাইন ধরে গাধায় টানা গাড়িতে করেও চলছে অগুনতি মানুষ। সবার গন্তব্য একটিই, ডিওনিসাস থিয়েটার।

এটি পৃথিবীর প্রথম থিয়েটার। এখানেই জন্ম হয়েছে গ্রিক ট্র্যাজেডি আর কমেডি। এথেন্সের প্রাণকেন্দ্র আগোরার গা ঘেঁষে ঠিক দক্ষিণে একটি পাহাড়, নাম এক্রোপোলিস। এই পাহাড়টির ঢালে খোলা আকাশের নিচে এই থিয়েটার।

দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে। বিশ-পঁচিশ মাইল দূর থেকে কাক-ডাকা ভোরে মানুষ রওনা করে। সক্রেটিসের অত ভোরে বের হওয়ার দরকার নেই। তার বাড়ি থিয়েটারের কাছেই। সে ভেবেছিল খেয়েদেয়ে ধীরে-সুস্থে বের হবে। কিন্তু সূর্য ওঠার আগেই ইউরিপিডিস এসে এমন হাঁক-ডাক শুরু করেছে যে পাড়ার সবাই জেগে গেছে। মঞ্চের সামনের আসন দখল নিতে আগে যেতে হবে। নাটক ভালো করে বুঝতে সামনে বসা জরুরি।

এথেন্সের মানুষের এক নম্বর বিনোদন হলো নাটক। এখানের ধনী মানেই নাটক-পাগল। ধনীদের ফাঁকে দুই-একজন গরিব লোকও নাটক পাগল। সেরকম একজনের নাম ইউরিপিডিস। সে কোনোরকমে মধ্যবিত্ত। তার বাবার ফলের দোকান ছিল। এখন বাবা নেই। দোকান চালান তার মা। কোনোমতে দিন আনে দিন খায়। এরকম গরিব ঘরের ছেলে হয়েও ইউরিপিডিস নাটক- পাগল। যেমন তেমন পাগল নয়, একেবারে নাটকখোর। কাজ-কর্ম করে না। সারাদিন নাটক দেখে আর সুযোগ পেলে নাটক লেখার চেষ্টা করে। নাটক না হলে তার ঘুম আসে না। গরিবের যেমন ঘোড়া রোগ হয়, তেমনই তার হয়েছে নাটক রোগ।

এই নাটকখোর ইউরিপিডিস সক্রেটিসের বন্ধু। তাদের বন্ধু হওয়ার কথা নয়। দুজনের স্বভাব পুরোপুরি উল্টা। দুজন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। সক্রেটিস মহাআড্ডাবাজ। নিজে বকবক করে, মানুষকে দ্বিগুণ বকবক করায়। ইউরিপিডিস মিতভাষী, সে আড্ডা পছন্দ করে না। প্রতিদিন নাটক দেখে, আর ফাঁক পেলেই লিখতে বসে। সক্রেটিস লেখালেখির ধারে-কাছেও নেই। পেপিরাস কাগজের উপর কলম ছোঁয়াতে তার কষ্ট লাগে। দুজনের সবচেয়ে বড় অমিল হলো বয়সের। সক্রেটিসের সব বন্ধু তার থেকে বয়সে ছোট। ইউরিপিডিস তার একমাত্র বেশি বয়সের বন্ধু। সে সক্রেটিসের চেয়ে পনেরো বছরের বড়। ইউরিপিডিস আসলে সক্রেটিসের ভক্ত। সক্রেটিস নতুন নতুন কথা বলে। এমন কথা অন্য কেউ বলে না। কবি-সাহিত্যিকরা সব সময় নতুন কথা খোঁজেন। সে অনেক নতুন কথা পায় সক্রেটিসের কাছে।

সক্রেটিস নাটক পছন্দ করে না। নাট্যকাররা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে। এসব তার ভালো লাগে না। সে সত্যের পূজারি। মিথ্যা শুনলে তার কান গরম হয়ে ওঠে। সে থিয়েটারে যায় শুধু ইউরিপিডিসের পাল্লায় পড়ে।

নাটক শুরুর অনেক আগেই তারা থিয়েটারে পৌঁছে গেল। তারা তৃতীয় সারিতেই আসন পেয়েছে। গ্যালারির প্রথম সারি এথেন্সের জন্য যুদ্ধে শহিদদের সন্তানদের জন্য, দ্বিতীয় সারি নেতাদের জন্য, তৃতীয় সারি থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত। তৃতীয় সারিতে বসতে পেরে তারা খুশি। থিয়েটারটি বিশাল। সতের হাজার মানুষ বসতে পারে। পাহাড়ের অনেক উঁচু পর্যন্ত চলে গেছে গ্যালারি।

নাটক শুরু হতে এখনও অনেক দেরি। কিছু সময় পাওয়া গেল খেজুরে আলাপ করার জন্য। সক্রেটিস খুশি। নাটক দেখার চেয়ে গপসপ করতেই তার ভালো লাগে। গপসপ শুরু করার আগেই তাকে ইশারায় ডাকছে একটি মেয়ে। দূর থেকে হাত নাড়ছে। মেয়েটি অপরূপ সুন্দরী। চাঁপা-কলির মতো আঙুল নেড়ে ডাকছে। এমন মেয়ে ডাক দিলে পাথরও বসে থাকতে পারে না।

সক্রেটিসও পারল না। সে উঠে দাঁড়াল। একদিকে বন্ধু ইউরিপিডিস, অন্যদিকে অপ্সরার মতো মেয়ে। কার কাছে যাবে? সে চিন্তা করছে ইউরিপিডিসের সাথে বেইমানি করা সম্ভব, নাকি সম্ভব নয়? বেশি চিন্তা করতে হলো না। মেয়েটি নিজেই চলে এলো তার কাছে। মেয়েটির অনেক সাহস। সক্রেটিসের বাম পাশের আসনে বসে পড়ল। আপাতত মুশকিল আসান। সক্রেটিস মাঝখানে। ডানে ইউরিপিডিস আর বামে মেয়েটি।

সক্রেটিস ইউরিপিডিসকে বলল, বন্ধু, ইনি হলেন আসপাশিয়া। আমার শিক্ষিকা।

শিক্ষিকা! রাগে ইউরিপিডিসের ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। এই মেয়ে তার শিক্ষিকা? সে তাকে পড়ায়! সক্রেটিস তলে তলে এত খারাপ?

ইউরিপিডিস ছোট্ট করে পিন দিয়ে বলল, আমি ওনাকে চিনি! তোমার শিক্ষিকা তো বাড়াবাড়ি রকম বিখ্যাত মেয়ে। তাকে চেনে না, এমন মানুষ এথেন্সে নেই।

কথা শুনে আসপাশিয়া এমনভাবে ইউরিপিডিসের দিকে তাকাল যেন তাকে এই মুহূর্তে ভস্ম করে দেবে। সক্রেটিস ভয়ে ভয়ে দুজনকে দেখছে। ইউরিপিডিস আসপাশিয়াকে চেনে মানে ঘটনা খারাপ। এথেন্সে আসপাশিয়ার পরিচিতি হলো, সে ভীষণ বাজে মেয়ে। ঘর-সংসার করে না। স্বভাব-চরিত্র একেবারেই সুবিধার নয়। ইউরিপিডিস চিনলে তাকে এভাবেই চেনে। কিন্তু সক্রেটিস চেনে অন্যভাবে। এই মেয়েটি ভীষণ বুদ্ধিমতী, অনেক কিছু জানে। এরকম জ্ঞানী মেয়ে এথেন্সে আর নেই। সে মাঝে মাঝে আসপাশিয়ার কাছে যায়। তার কাছে অনেক কিছু শেখে। সক্রেটিস মানুষকে বিচার করে জ্ঞানের মাপাকাঠি দিয়ে, অন্য কিছু বিবেচনার বিষয় নয়। সে উঁচু গলায় আসপাশিয়াকে তার শিক্ষিকা বলে পরিচয় দেয়।

সক্রেটিস ভয়ে ভয়ে আসপাশিয়াকে বলল, এই হলো আমার বন্ধু ইউরিপিডিস। বয়সে বড়, কিন্তু প্রাণের বন্ধু। উনি একজন নাট্যকার।

আসপাশিয়া ছোট্ট করে পিন দিয়ে বলল, ওনাকে চিনি! তোমার প্রাণের বন্ধু তো মারাত্মক রকমের বিখ্যাত নাট্যকার। তিনি নাটকে মেয়েদেরকে গালাগালি করেন।

এবার ইউরিপিডিস এমন করে তাকাল যেন আসপাশিয়াকে ভস্ম না করে থামবে না। সক্রেটিসের মহাবিপদ। দুই দিক থেকেই ভস্ম করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মাঝখানে বসে সে কি বাঁচতে পারবে? মঞ্চে নাটক শুরু হওয়ার আগেই তার দুই পাশে নাটক শুরু হয়ে গেছে।

ইউরিপিডিস সক্রেটিসের ওপর মহাবিরক্ত। ছেলেটা যে এত বেহায়া, তা সে ভাবেনি। আসপাশিয়ার মতো একটি মেয়েকে পাশে বসিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। কোনো হেলদোল নেই। মানুষ কী ভাবছে তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। সে জানত যে তার লজ্জা-শরম কম। কিন্তু এতটা কম, সেটি ভাবেনি।

সবাই চুপচাপ। কেউ কোনো কথা বলছে না। সক্রেটিস একটু সময় নিচ্ছে। দেখা যাক, কে আগে কথা বলে! কিন্তু দুইজনই সমান ত্যাড়া। সক্রেটিসকেই কথা বলতে হবে। সে ভাবছে এমন কিছু বলতে হবে যাতে দুজনই ক্ষেপে যায়।

সে বলল, ইউরিপিডিস নাটকে মেয়েদের গালাগালি করে, এটি কিঞ্চিৎ সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য হলো সে নাটকে মেয়েদের মনের আসল কথা বলে।

দুজনেই রে রে করে উঠল। ইউরিপিডিস তার জামা টেনে ধরে বলল, বলো, আমি কোন নাটকে মেয়েদের গালি দিয়েছি? আসপাশিয়া বলল, উনি কোন নাটকে মেয়েদের মনের কথা বলেছেন?

সক্রেটিস কিছুই বলছে না। একেবারে চুপ। তাকে চুপ দেখে দুজন সরাসরি কথা বলতে শুরু করল। ঝগড়া শুরু হয়ে গেছে। তুমুল ঝগড়া। সক্রেটিস শুধু একবার ডানে তাকাচ্ছে, একবার বামে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে, একটি ঝগড়ার অনুষ্ঠান চলছে। সক্রেটিস সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। উপস্থাপকের কোনো কাজ নেই। সে মিষ্টি হাসি দিয়ে ডানে-বামে তাকাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কাটল। নাটক শুরু হতে এখনও অনেক বাকি। গ্যালারিতে লোক ঢুকছে মাত্র। ঝগড়াকারী দুজন এখন চুপ। ক্লান্ত হয়ে গেছে। সক্রেটিস ভাবল, যতটুকু ঝগড়া দরকার ছিল, সেটি হয়ে গেছে। এবার বিষয় পরিবর্তন করা দরকার। সে বলল, সারাদিন এখানে থাকতে হবে। আমার তো এখনই ক্ষুধা লেগে গেল। তোমাদের কাছে খাবার-দাবার কিছু আছে?

আসপাশিয়া ভুট্টা দানা বের করল। ভুট্টা ভেজে মধু মেখে শুকানো হয়েছে। থিয়েটারে বসে চিবানোর জন্য এর চেয়ে ভালো জিনিস আর হয় না। মধুমাখা ভুট্টার গুণে তাদের মন মধুর মতো হয়ে গেল। ঝগড়াঝাঁটি শেষ।

আসপাশিয়া বলল, সক্রেটিস, আমি যদি না আসতাম, তোমরা দুই বন্ধু এখন কী করতে?

সক্রেটিস বলল, আমি চুপচাপ বসে থাকতাম। আর ইউরিপিডিস আমাকে জ্ঞান দিত। নাটক নিয়ে তার অশেষ জ্ঞান। এই বিষয়ে সে দিনরাত জ্ঞান দিতে পারে। নাটক বিষয়ে তার কোনো ক্লান্তি নেই। সে একটি বিরাট প্রতিভা।

আসপাশিয়া বলল, তোমার বিরাট প্রতিভা জ্ঞান দিতে পারে। মনে করো আমি এখানে নেই, আমার কানে তুলা দেওয়া। ইউরিপিডিস হেসে ফেলল। ভুট্টা খেতে খেতে তারা নাটক নিয়ে আলাপ শুরু করল। লম্বা আলাপ।

.

গ্রিক ট্র্যাজেডি নাটক শুরু হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। শুরুর ঘটনাটি মোটামুটি এরকম : এথেন্সে নাটকের জন্ম হয়েছে বসন্ত উৎসবে। প্রতি বছর বসন্তের শুরুতে এথেন্সে বিশাল আনন্দ-ফূর্তি হয়। গ্রিকদের সবকিছুর দেবতা আছে। আনন্দ- ফূর্তির দেবতাও আছে। তার নাম ডিওনিসাস। বসন্তের শুরুতে ডিওনিসাসের নামে বসন্ত উৎসব হয়। সেই উৎসবেই জন্ম হয়েছে নাটক।

আনন্দের দেবতাকে খুশি রাখতে আনন্দ-ফূর্তি করতে হয়। ফূর্তি করার জন্য অনেকের দরকার হয় সুরা। তারা সুরা খায়, মাতাল হয় আর ফূর্তি করে। এর ফলে ডিওনিসাস যে আনন্দের দেবতা সেটি লোকে ভুলে গেছে, লোকে বলে তিনি সুরার দেবতা। বসন্ত উৎসবকে অনেকে ডিওনিসাস উৎসব বলে। এই উৎসবে তারা হৈ-হুল্লোড়, নাচ-গান যা ইচ্ছা তাই করে।

এই ফূর্তিবাজিকে কাজে লাগাল এথেন্সের এক ধূর্ত শাসক। তার নাম পেসিসট্রাটাস[১৪]। সে ভাবলো ফূর্তি-ফার্তি দিয়ে যদি মানুষকে মাতিয়ে রাখা যায়, তাহলে তারা রাজনীতি নিয়ে ভাবার সময় পাবে না। আমার গদি পোক্ত হবে। বেশি করে ফূর্তি করার জন্য সে বসন্ত উৎসবকে এথেন্সের জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা করে দিল। বলল, যাও বাবা, মনের সাধ মিটিয়ে আনন্দ করো। সব খরচ সরকারের। তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি শুধু আনন্দ করো। যতদিন খুশি আনন্দ করতে থাকো। চূড়ান্ত উৎসব হবে পাঁচ দিন। এই পাঁচদিন যাতে ঝামেলা ছাড়া মাস্তি করা যায়, সেজন্য এক সপ্তাহ সরকারি ছুটি। তারপর বলল, আনন্দ করার জন্য একটি ভালো জায়গা দরকার। সরকারি ফূর্তি মানে উন্নত রকমের ফূর্তি। সেটি হতে হবে সবচেয়ে ভালো জায়গায়। সে এক্রোপোলিস পাহাড়ের উপরে তৈরি করে দিল থিয়েটার। পাহাড়ের ঢাল কেটে কেটে অর্ধচাদের মতো করে কাঠ বিছিয়ে বানানো হলো গ্যালারি। বলল, নাও, এখানে যত পার ফূর্তি করো। নাচ, গান যা খুশি করো। সবাই বলল, আমরা আনন্দ করব, আর আপনি কী করবেন? সে বলল, আমি তোমাদের পুরস্কার দেব। যে যত বেশি আনন্দ দিতে পারবে, তাকে তত বেশি পুরস্কার দেব। এই থিয়েটারে হবে নাচ-গানের প্রতিযোগিতা। অলিম্পিকে যেমন দৌড়-ঝাঁপের খেলা হয়, তেমনই বসন্ত উৎসবে হবে আনন্দের খেলা। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা

এই কৌশল দারুণ সাড়া ফেলল। এথেন্সবাসী আনন্দে ধেই ধেই করে উঠল। হোমারের সময় থেকে পথে পথে ঘুরে যেসব চারণকবি গান লিখতেন, তারা প্রতিযোগিতার জন্য গান লিখতে বসলেন। অল্প দিনেই বসন্ত উৎসব হয়ে উঠল এথেন্সের এক নম্বর অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের জন্য মানুষ সারা বছর ধরে কাজ করে। কবিরা পালাগান বানায়। কয়েকজন একসাথে কোরাস করে সেই পালাগান গায়। এভাবে দলে দলে প্রতিযোগিতা চলে। সেরা কোরাস দল পায় পুরস্কার।

তো এক বছর বসন্ত উৎসবে থেসপিস[১৫] নামক এক অখ্যাত কোরাস গায়ক অদ্ভুত একটি কাণ্ড করে বসল। সে মঞ্চে উঠল মুখোশ পরে। তার গায়ের পোশাকটাও উদ্ভট। দলের কোরাসের সময় সে মাঝে মাঝে গান থামিয়ে নিজে হাত-পা ছড়িয়ে অঙ্গ-ভঙ্গি করে কাহিনি বলতে শুরু করল। মানুষ তো হেসে লুটোপুটি। এ কোন ভাড়ামি! কী সব শুরু হলো কোরাস গানের মাঝে! কিছুক্ষণ পর থেসপিস অন্য একটি মুখোশ পরে অন্য রকম সংলাপ বলতে শুরু করল।

প্রথমে ভাঁড়ামি মনে হলেও মানুষ বুঝতে পারল— গানের মাঝে কথা আর অঙ্গভঙ্গির কারণে তারা পালাগানের কাহিনি আরও ভালো করে বুঝতে পারছে। বিচারকরাও একই মত দিল। সেই বছর থেসপিস হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন।

থেসপিসের এই অভিনয় এথেন্সে নতুন একটা কিছু জন্ম দিল। পরের বছর আর কোনো দলই শুধু কোরাস গাইল না। সব দলেই এক এক জন লোক এলো অভিনেতা হিসেবে। এভাবে এথেন্সে সৃষ্টি হলো ইউরোপের প্রথম নাট্যকলা। এথেন্সের পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হলো থিয়েটার। কবি হোমার ও হেসিওডের যেসব কাহিনি এতদিন লোকে শুধু সুর করে বলত, এখন শুরু হলো সেগুলোর অভিনয়। তবে অভিনেতা শুধু একজন। সে মুখোশ বদল করে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে। তার সাথে অনেকে কোরাস গায়। থেসপিস চালু করেছে বলে এই নাটককে অনেকে বলতেন থেসপিয়ান নাটক। আবার থেসপিস যখন প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হলো, তাকে পুরস্কার দেওয়া হলো একটি ছাগল, যেটি দেবতা ডিওনিসাসের কাছে উৎসর্গ করা হলো। ছাগলকে গ্রিকরা বলে ট্রাগোস, আর গানকে বলে অডি। ট্রাগোস আর অডি মিলে হয় ট্র্যাজেডি। tragos & ode : tragedy. থেসপিসকে ছাগল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল বলে এই সংগীতমাখা নাটককে অনেকে বলল ট্র্যাজেডি।

এরপর এথেন্সে গণতন্ত্র এলো। গণতন্ত্র মানে বাকস্বাধীনতা। গণতন্ত্রে সব কিছু বলা যায়। যে কারও সমালোচনা করা যায়। আগে যেসব কথা বলা যেত না, লেখা যেত না, গণতন্ত্র আসায় মানুষ সেসব লেখার সাহস পেল। সৃষ্টিশীল মানুষরা পেলেন স্বাধীনতা। লেখকরা মনের সুখে লিখতে শুরু করল। পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হলো থিয়েটার। গ্রিকরা যে কাজই শুরু করে, তাতেই চালু করে প্রতিযোগিতা। এখানে সবাই সবকিছুতে এক নম্বর হতে চায়। হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যে বীর একিলিসকে তার বাবা বলেছিলেন,

‘সময়ের সেরা হও
প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাও
বিপদের ভয়ভরা রাতে সাহস বিছিয়ে দাও
পথ কঠিন? নিজের পথ তৈরি করে লও।’

এটি এথেন্সের মানুষের মূলমন্ত্র। নাটক চালু হতেই শুরু হলো লেখকদের এক নম্বর হওয়ার প্রতিযোগিতা। যখনই সুস্থ প্রতিযোগিতা হয়, তখনই প্রতিভাবান মানুষদের সুযোগ আসে। এরকম একজন মহাপ্রতিভাবান মানুষ হলেন এস্কিলাস। তিনি এসে বললেন, আমি নাটক নিয়ে নতুন কিছু করব। আর শুধু গানের অভিনয় নয়, টুকরো টুকরো গল্প নয়, আমি পূর্ণ কাহিনি বানাবো। পূর্ণ কাহিনিকে বলা হলো প্লট। তিনি প্লট বানানো শুরু করলেন। কাহিনি নিলেন হোমারের ট্রয় যুদ্ধ থেকে। ট্রয় যুদ্ধ শেষে গ্রিক রাজা আগামেমননের পরিবার আর অডিসিয়াসের পরিবারের ঘটনা নিয়ে তিনি কয়েকটি প্লট বানালেন। প্রতিটি কাহিনির সমাপ্তি খুব করুণ। ভাগ্যের হাতে নায়ক বা নায়িকার ভীষণ করুণ পরিণতি। দিনে দিনে নায়কের করুণ পরিণতিকেই বলা হলো ট্র্যাজেডি।

এস্কিলাস আর একটি নতুন কাজ করলেন। থেসপিস চালু করেছিলেন একজন অভিনেতা। এস্কিলাস নিলেন দুজন। গান কমে গেল, অভিনয় বেড়ে গেল। কোরাস কমে অভিনয়ই হয়ে উঠল প্ৰধান।

মানুষ অভিনয় দেখে আর মনে করে, এটি তো আমি। সবাই ভাবে এই নাটকের কাহিনিতে আমি নিজেই আছি। নায়কের করুণ পরিণতি আমারই পরিণতি। এই পরিণতির নামই ট্র্যাজেডি। এথেন্সে ট্র্যাজেডি নাটক তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল। থেসপিস যেটি চালু করেছিলেন পালাগানের মতো করে, এস্কিলাস সেটিকে শিল্পে নিয়ে গেলেন। জীবনের অংশ করে তুললেন। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, গরিব সব মানুষের কাছে এক নম্বর বিনোদন হয়ে উঠল ট্র্যাজেডি নাটক। সব লেখকই ট্র্যাজেডি লিখতে শুরু করলেন।

কয়েক বছর পর এস্কিলাসের মনে হলো বড় বড় কাহিনি একটি নাটকে শেষ করা যায় না। একটি ঘটনার উপর মোটামুটি তিনটি নাটক হলে কাহিনি পূর্ণ হতে পারে। তিনি শুরু করলেন একই ঘটনার ওপর তিনটি নাটকের ‘ট্রিলজি’ বা ত্রয়ী। এখন বসন্ত উৎসবে একজন নাট্যকার ট্রিলজি অভিনয় করেন।

অভিনেতারা নিজেদের চেহারায় মঞ্চে ওঠে না। তারা মুখোশ পড়ে। চরিত্রের প্রয়োজনে মুখোশ বদলে নেয়। তাই থিয়েটার মানেই হরেক রকম মুখোশ। একই মানুষ মুখোশ বদলে হয়ে যায় দেব-দেবী, দৈত্য-দানব, রাজা- রানি, ডাইনি, যোদ্ধা, নারী-শিশু সবকিছু।

অভিনেতা মানেই পুরুষ। এথেন্সে নারীদের এখনও রাস্তায়ই নামতে দেওয়া হয় না, মঞ্চে ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। নারী-পুরুষ সব চরিত্রে ছেলেরাই অভিনয় করে। এথেন্সের বয়স্ক বিখ্যাত নাট্যকাররাই মঞ্চে উঠে তরুণী মেয়ের মতো কোমর দোলায়, নাকি সুরে কান্না করে।

আজ থিয়েটারে ট্র্যাজেডির জনক এস্কিলাস অভিনয় করবেন প্রমিথিউসকে নিয়ে তার লেখা তিনটি নাটকের ট্রিলজি।

***

১৩. বসন্ত উৎসব : মার্চের শুরুতে এথেন্সে দেবতা ডিওনিসাস এর উদ্দেশ্যে একটি উৎসব হতো, একে ডিওনিসাস উৎসবও (Festival of Dionysus) বলে। এই উৎসবেই ট্র্যাজেডির প্রতিযোগিতা হতো।

১৪. পেসিট্রাটাস: Peisistratos, এথেন্সে গণতন্ত্র চালুর পূর্বের একনায়ক। তিনি এক্রোপলিসের পাদদেশে পৃথিবীর প্রথম থিয়েটার ডিওনিসাস থিয়েটার তৈরি করেন।

১৫. থেসপিস: Thespis, এরিস্টটলের মতে তিনিই প্রথম মঞ্চে অভিনয় চালু করেন। তার নাম থেকেই থিয়েটারের অভিনেতাদের বলা হয় থেসপিয়ান (Thespian)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *