১৮
‘একটি দয়াশীল হৃদয় যেকোনো দার্শনিকের চেয়ে
অনেক বেশি কিছু আবিষ্কার করতে পারে।’
—সফোক্লিস
***
এথেন্সের পিরাউস বন্দর।
জাহাজ থেকে নামলো এক যুবক। যুবকের মন খারাপ। খুবই খারাপ। তার পিছনে এজিয়ান সাগরে টলটলে নীল পানি। বিকেলের আলোয় নীল রং উছলে উছলে পড়ছে। কিন্তু নীল পানি দেখে তার মনে কোনো রোমাঞ্চ এলো না। উল্টো মনে হলো নীল হলো কষ্টের রং। তার কষ্টের জন্যই সাগরের পানি নীল হয়েছে।
যুবকটির নাম হেরোডোটাস[[৫৫]। জীবনের খুব কঠিন সময়ে সে এথেন্সে এসেছে। হাতে টাকা-পয়সা নেই। এ শহরে কাউকে চেনে না। কিন্তু এথেন্সের কথা সে জানে। অনেক শুনেছে। এখানে জ্ঞান থাকলে কিছু না কিছু করে খাওয়া যায়। সে শুনেছে এথেন্সের ধনীরা তাদের ছেলেদের পড়ানোর জন্য বিদ্বান মানুষ বাড়িতে রাখে। টাকা-পয়সাও ভালোই দেয়। কিছু একটা জুটে যাবে, এই আশায় সে এথেন্সে এসেছে।
হেরোডোটাস জাহাজ থেকে নামলো। সামনে কতগুলো গাধায় টানা গাড়ি। তাতে লেখা— বন্দর থেকে আগোরা। হেরোডোটাস একটি গাড়িতে উঠে বসল। আগোরার কথা সে জানে। সেটিই এথেন্সের কেন্দ্ৰ।
হেরোডোটাস অনেক সাহসী। অচেনাকে ভয় পায় না। বয়স ত্রিশ না হতেই পৃথিবীর বহু জায়গা ঘুরে ফেলেছে। তাকে মস্ত পরিব্রাজক বলা যায়। আগে ব্যবসা করতো। জাহাজ নিয়ে বের হতো বেচা-কেনা করতে। অনেক দেশে গিয়েছে। মিশর, পারস্য, ব্যাবিলন আশেপাশে সব দেশ ভাজাভাজা করে ফেলেছে। কিন্তু মুস্কিল হলো ছেলেটির মন ঘুরাঘুরিতে। বেচাকেনায় মন নেই। যেখানে যায় নানা রকমের মানুষের সাথে কথা শুরু করে। নতুন কিছু শুনলেই লাফ দিয়ে ওঠে। আরও শুনতে চায়। একটি কথা যাচাই করতে দশজনকে জিজ্ঞেস করে। তার ব্যাগে সব সময় পেপিরাস কাগজের টুকরা রাখে। কিছু ভালো লাগলেই, লিখে ফেলে। বন্ধুরা বলত, ‘বাণিজ্যে নেমে অত ঘন প্যাঁচাল করলে চলে না। ব্যবসার নিয়ম হলো— কথা কম, কাজ বেশি।’ কিন্তু হেরোডোটাসের কাছে কথার দামই বেশি। সে ঘন প্যাঁচালের লোক। তাই পয়সা করতে পারেনি। কিন্তু সে মনে করে—সে অনেক কিছু জানে। নিজের কাছে সে মহাজ্ঞানী। তাই জ্ঞানের শহর এথেন্সে এসেছে।
সে এথেন্সের কাহিনি জানে। কিন্তু সেটি কাজে লাগবে কিনা সে বুঝতে পারছে না। একটু পরীক্ষা করা দরকার। সে গাধার গাড়ির সহিসকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের এখানে যে ম্যারাথনের যুদ্ধ হয়েছিল, সেই ম্যারাথন জায়গাটি কোন্ দিকে?
সহিস বলল, ঐ উত্তর দিকে। এখান থেকে পঁচিশ মাইলের কম হবে না।
হেরোডোটাস বলল, ‘ম্যারাথন যুদ্ধের কথা তুমি জানো?’
সহিসের মনে অপমান লাগল। এই লোকটা তো উজবুক। সহবৎ শিখেনি। এথেন্সের মানুষকে জিজ্ঞেস করছে ম্যারাথন যুদ্ধের কথা জানে কিনা! সে জবাব দিল, জনাব, এথেন্সের একটি জলপাই গাছকে বলেন, সেই গাছও ম্যারাথন যুদ্ধের কাহিনি বলে দেবে। আর আপনে আমাকে বলতেছেন সেই যুদ্ধের কথা জানি কিনা? বড়ই শরম দিলেন জনাব। বুকে ব্যথা পেলাম।
হেরোডোটাস বলল, দুঃখিত। ব্যথা নিও না, ভাই। আমি ব্যথা দেওয়ার মানুষ না। শুধু সেই যুদ্ধের কথা তোমার কাছে জানতে চাই।
সহিস বলল, বলেন। কী জানতে চান? এই যুদ্ধ আমার আগাগোড়া মুখস্থ।
‘তো আমাকে একটু বলো তো ফিডিপিডিসের বাড়িটা কোনদিকে?’
‘ফিডিপিডিস? কোন ফিডিপিডিস?’
হেরোডোটাস অবাক। সে বলল, এবার কিন্তু আমার মনে ব্যথা দিলে ভাই। ম্যারাথন যুদ্ধের আগাগোড়া তোমার মুখস্থ, আর ফিডিপিডিসের নাম জানো না? ফিডিপিডিস হলো খবর বাহক। খবর আনে বলে তাকে বলে খবরি। পারস্যের সাথে এথেন্সের জয়ের খবর এক দৌড়ে ম্যারাথন থেকে এথেন্সে নিয়ে এসেছিল যে লোক, সে হলো ফিডিপিডিস 1
সহিস লজ্জা পেল। এবার সে সম্মানের চোখে হেরোডোটাসের দিকে তাকাল। হাল্কা স্বরে বলল, আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আপনি সেখানে ছিলেন।
হেরোডোটাস হেসে বললেন, আমি ছিলাম না। কিন্তু যারা সেখানে ছিল, তাদের কাছ থেকেই শুনেছি। পৃথিবীতে সত্য জানার দুটি উপায়। একটি হলো, নিজে সেখানে উপস্থিত থাকা। দ্বিতীয় হলো, যে উপস্থিত ছিল, তার কথা বিশ্বাস করা। শোন, তোমাকে ম্যারাথনের কাহিনি শুনাই।
হেরোডোটাস অনেকক্ষণ ধরে ম্যারাথন যুদ্ধের কথা বলল। মুগ্ধ হয়ে শুনল সহিস। সে বলল, আপনি যেমন করে কাহিনি বলেন, এমন করে আর কাউকে বলতে শুনিনি। জনাব, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি একজনকে চিনি। উনিও খুব মিঠা করে গল্প বলেন। তিনি আপনাকে পছন্দ করবেন। দেখা করতে চান তার সাথে?
‘কে তিনি? কী নাম তার?’
‘আসল নাম সফোক্লিস। কিন্তু মানুষে বলে ‘মধুকর’।’
‘মধুকর?’
‘হ, মধুকর। মানে মৌমাছি। মৌমাছির যেমন মধু নিয়ে কারবার, তেমনই ওনারও মধু নিয়ে কারবার।’
‘মধু নিয়ে কারবার? মানে মধুর ব্যবসা করেন?’
‘কী যে বলেন? উনি মধুর ব্যবসা করবেন কে? তাঁর কি টাকার অভাব আছে? তিনি এথেন্সের একজন সেনাপতি। বিরাট যোদ্ধা। নিজের বাবার অস্ত্র কারখানা আছে। ঢাল, বর্শা এসবের কারখানা। সেটি বড় কথা নয়। কথা হলো— তার গলার স্বর মধুর মতো মিষ্টি। গান ধরলে মনে হয় মধু চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। তাই সবাই তার নাম দিয়েছে ‘মধুকর’।’
হেরোডোটাস বলল, কী নাম বললে ওনার?
‘সফোক্লিস। তিনি এক বিরাট প্রতিভা। বিরাট নাট্যকার। নিজের লেখা নাটক এমন করে অভিনয় করেন যেন, পুরো থিয়েটারে একটি মাছিও ভ্যান করে শব্দ করে না। হোমারের কবিতা এমন সুন্দর করে বলেন, সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।’
হেরোডোটাস জিজ্ঞেস করল, কী নাটক লিখেছেন সফোক্লিস?
সহিস বলল, আমি কি আর অত কিছু নাম-টাম মনে রাখতে পারি? আপনি আগোরাতে যেকোনো বইয়ের দোকানে গেলেই দেখবেন, প্রথমেই সারি সারি সফোক্লিসের বই। দোকানে যদি দশজন লোক দেখেন, তাদের পাঁচজন কিনবে হোমারের বই, আর তিনজন সফোক্লিসের বই, আর বাকি দুই জন অন্য লোকের বই। তাহলেই বোঝেন, সফোক্লিস কেমন লেখক। হোমারের থেকে উনিশ-বিশ।
হেরোডোটাস সফোক্লিসকে চেনে। প্রকৃতপক্ষে সে এথেন্সে তার কাছেই এসেছে। সফোক্লিস সামোস দ্বীপে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তখন হেরোডোটাস সেখানে ছিল। সফোক্লিস তাকে এথেন্সে আসতে বলেছেন। এখন হেরোডোটাসের দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। কাজ-কর্ম নেই। তাই এসেছে এথেন্সে। ভেবেছিল আগোরাতে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করবে, সফোক্লিসের বাড়ি কোথায়। কিন্তু এত সহজে যে পেয়ে যাবে, সে ভাবেনি। সফোক্লিস যে এত বিখ্যাত মানুষ, সেটি আগে বোঝেনি হেরোডোটাস।
সে গাড়ির চালককে বলল, চলো, তাহলে সফোক্লিসের কাছেই যাই।
হেরোডোটাসের মনে সন্দেহ আছে সফোক্লিস তাকে চিনবেন কিনা। সামোস দ্বীপে অল্প দিনের আলাপ। মনে নাও থাকতে পারে। মনে না থাকলে, সে চলে আসবে। কথা বাড়াবে না। এই সুযোগে সে একটি বুদ্ধি করল। সে ছদ্মবেশ ধরে সফোক্লিসের বাড়ি যাবে। একবার নিজেকে পরীক্ষা করে দেখা যাক, পরিচয় না দিলে সফোক্লিস চাকরি দেন কিনা। হেরোডোটাস মাথায় পাগড়ির মতো জড়িয়ে একটি ছদ্মবেশ নিল। তাকে সহজে চেনা যায় না।
.
বারান্দায় একটি মাচার উপরে বসে আছে হেরোডোটাস। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, কেউ খবর নেয়নি। খুব অপমান লাগছে। অচেনা লোকের বাড়িতে ভিক্ষুকের মতো বসে আছে। চলে যাবে কিনা ভাবছে। এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পেল একটি মিষ্টি স্বর, তুমি কি আমার কাছে এসেছো?
হেরোডোটাস পেছন ফিরে তাকাল। ঢুলুঢুলু চোখে দাঁড়িয়ে আছেন সফোক্লিস। একটি হালকা চাদর তার গায়ে। ডান হাতে কালি লেগে আছে। বোঝা যায় তিনি লিখছিলেন। তার মুখে বিরক্তি, চোখে প্রশ্ন।
হেরোডোটাস উত্তর করল, জি, আপনার কাছেই এসেছি। আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনি জ্ঞানী মানুষ। প্রতিভাবান মানুষ।
প্রশংসায় বিগলিত না হলেও, একেবারে অখুশি হলেন না সফোক্লিস। মৃদু স্বরে বললেন, তোমার পরিচয়?
‘এশিয়া মাইনর থেকে এসেছি। আমার বাড়ি হালিকারনাসস। নানান দেশে ঘুরেছি। কিন্তু ব্যবসায় সুবিধা হলো না। আপনাদের শহরে জ্ঞানী লোকের সম্মান আছে। সেজন্য এসেছি।’
জ্ঞানী লোক কথাটা কানে লাগল সফোক্লিসের। জ্ঞানীরা নিজেকে জ্ঞানী বলেন না। তিনি বললেন, যার যা আছে, এথেন্সে সবকিছুই বেচতে পারে। তুমি কি জ্ঞানী? জ্ঞান বিক্রি করবে? কিন্তু আমি তো জ্ঞানের বেপারী নই। জ্ঞান কিনতে পারে কম বয়সী সন্তানের বাবারা। তুমি তাদের কাছে যেতে পার। কারও ঘরে মাস্টারি জুটে যাবে।
হেরোডোটাস হতাশ। এই লোক অন্য ধাঁচের। দয়া-মায়া আছে বলে মনে হয় না। তাকে চুপ থাকতে দেখে সফোক্লিস বললেন, ঠিক আছে জ্ঞানী মিয়া, তোমাকে আর একটি সুযোগ দিচ্ছি। বলো কোন মহাজ্ঞান আছে তোমার ঝোলায়? তাড়াতাড়ি বলো, সময় অল্প।
‘আমি এথেন্সের গত একশো বছরের কাহিনি আপনাকে শোনাতে পারি।’
হো হো করে উঠলেন সফোক্লিস, ‘এটি তো আমার দাদুও বলতে পারেন। এটিকে তুমি বলছো জ্ঞান? জ্ঞান কী জিনিস— তুমি তো সেটিই জানো না।
আবার হতাশ হলো হেরোডোটাস। লোকটা তাকে অপমান করছেন। তবু বিনয়ের সাথে বলল, আমি শুনেছিলাম আপনি গল্প বোঝেন। সমঝদার মানুষ। তাই এসেছিলাম।
‘গল্প? এই মাত্র বললে তুমি এথেন্সের ঘটনা বলবে। আবার বলছো গল্প! মানে কী? সত্য ঘটনা, নাকি বানানো কাহিনি?’
‘জনাব, আমি সারা পৃথিবী ঘুরেছি। মিশর, পারস্য, ব্যাবিলন, এথেন্স সব। ঘুরে ঘুরে দেখে দেখে আমি পৃথিবীর একটি মানচিত্র এঁকেছি।’
‘সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্র?’ পিটপিট চোখে তাকালেন সফোক্লিস। বিশ্বাস হচ্ছে না। গাঁজাখুরি গল্প বলছে। অবিশ্বাসের চোখে বললেন, বের করো, দেখি তোমার মানচিত্র।
হেরোডোটাস একটি পেপিরাস টুকরো বের করল। টুকরোটি বেশ বড়। লম্বায় প্রায় চার হাত। তাতে কালো আর নীল কালিতে পৃথিবীর নকশা। মেঝেতে বিছিয়ে দিল হেরোডোটাস।
সফোক্লিস সামনে এগিয়ে চোখ বুলালেন নকশাটির দিকে। তিনি সৈনিক মানুষ। নকশা ভালোই বোঝেন। যুদ্ধের মাঠে নকশা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। কয়েক মুহূর্ত নকশাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। নকশায় মিশরের নীল নদ থেকে ব্যাবিলন, পারস্য, ভারত, এথেন্স সব চিহ্ন দেওয়া। এই জিনিস যদি সত্যি এই ছেলেটি করে থাকে, তাহলে ছেলেটির গুণ আছে। সাধারণ ছেলে নয়। এতক্ষণে সফোক্লিস ভালো করে তাকালেন ছেলেটির দিকে 1 দাসকে ইশারা করলেন ছেলেটিকে কিছু খেতে দিতে। গভীর মনোযোগে মানচিত্র দেখছেন সফোক্লিস। বললেন, তুমি কি সত্যিই এসব জায়গায় গিয়েছ?
হেরোডোটাস বলল, জি, গিয়েছি। যেখানেই গিয়েছি, মানুষের সাথে কথা বলেছি। সৈনিকদের পটিয়ে পটিয়ে বের করেছি যুদ্ধের বিবরণ। যার কাছে যা পেয়েছি, কিছুই বাদ দিইনি। শুধু খুঁজে গেছি।
সফোক্লিস বললেন, ‘এই যে দেখো, তুমি দেখিয়েছ নীল নদ এই জায়গাটা থেকে শুরু হয়েছে। এটি তুমি কার কাছে জেনেছ?’
হেরোডোটাস বলল, আমি গিয়েছি সেখানে। সে এক কঠিন ভ্রমণ। রাত- দিন নীল নদের তীর ধরে চলেছি। কখনো ঘোড়ায়, কখনো নৌকায়। মাঝে মাঝে এমন কঠিন জায়গা যে ঘোড়াও চলে না। তখন পায়ে হেঁটেছি। একেবারে পাহাড়ের সেই ছোট্ট ঝরনা যেখানে নীল নদ শুরু, আমি নিজে সেখানে গিয়েছি।
সফোক্লিসের মুগ্ধতা শুরু হয়েছে। এই বয়সেই এত কিছু ঘুরে এসেছে! ছেলেটা যে জ্ঞানের কথা বলেছিল, সেটি যে ওর কিছুটা আছে, তা স্বীকার করতেই হয়।
‘তোমার মানচিত্রে এখানে দেখছি ভারত। ভারতের পরে আর কিছুই নেই। তুমি কি ভারতে গিয়েছ?’
‘না জনাব, ভারতে যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা। কিন্তু এখনও ভাগ্যে হয়নি। মানুষের কাছে শুনেছি। আরবের বণিকরা ভারতের কথা জানে। ভারতই পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষিণে। এরপর আর কিছুই নেই। আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া আর ভারত— সারা পৃথিবীটাকেই আমি নকশায় এনেছি[৫৬]।’
সফোক্লিস নকশা নিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন করে বুঝলেন নকশাটি এই ছেলেটিরই আঁকা। তিনি বললেন, হুঁম, তোমার উপরে আমি মুগ্ধ হয়েছি। নাও, নাস্তা খাও।
মাটির পাত্রে তাদের জন্য অলিভ অয়েল মাখা রুটি আর আঙুর রসের সুরা নিয়ে এলো ভৃত্য। সফোক্লিস বললেন, তুমি তো বললে আজই এথেন্সে এসেছ? তা কোথায় উঠবে?
নিচু স্বরে হেরোডোটাস বললেন, আসলে এখানে আমি কাউকে চিনি না। কোথায় উঠব তা এখনও জানি না।
সফোক্লিস বললেন, খোলাখুলি বলো। তুমি কি আমার কাছে আশ্রয় চাও? হেরোডোটাস বলল, বাড়ির ছেলেমেয়ে পড়ানোর ভার আমি নিতে পারি। হেসে উঠলেন সফোক্লিস। তুমি কি জানো, বাড়িতে থেকে যারা বাচ্চাকাচ্চা পড়ায়, এথেন্সে তাদেরও বলে দাস।
‘অ্যাঁ!’
‘হুঁম, ঐ চিন্তা বাদ দাও। তুমি প্রতিভাবান। এখন পয়সা নেই। পয়সা একদিন হবে। তুমি আমার এখানেই থাকো। তোমার যা জ্ঞান, তা দিয়ে এথেন্সে কিছু একটা করতে পারবেই। তা, এথেন্স নিয়ে কি তুমি কিছু এঁকেছ?’
‘না আঁকিনি। তবে আমি এথেন্সের কাহিনি বলতে পারি।’
‘আবার কাহিনি? বললাম তো এ আমার দাদুও বলতে পারেন।’
‘আমার বিশ্বাস, আমি যা বলতে পারব, সেটি আমাদের দাদুরা বলতে পারবেন না।’
‘ঠিক আছে। আলতু ফালতু কথা বাদ দিয়া সংক্ষেপে বলো।’
হেরোডোটাস বলতে আরম্ভ করলেন এথেন্সের কাহিনি। সফোক্লিস অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন। এ তো কাহিনি নয়। এ তো সত্য ঘটনা। আর ছেলেটি শুধু ঘটনা বলে না, ঘটনা কেন ঘটছে, আগু-পিছু মিলিয়ে সেটিও বলে। ঘটনার পরে কী হতে পারে তাও বলছে। সফোক্লিসের মুগ্ধতা আরও বাড়ছে।
গল্প বলার এক ফাঁকে সফোক্লিস হেরোডোটাসকে চিনে ফেললেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, এই ছেলে, আমার সাথে এত বড় চালাকি করতে লজ্জা করল না? মাথার পাগড়ি খোল, হেরোডোটাস। আমি তোমাকে চিনে গেছি।
হেরোডোটাস হেসে ফেলল। সফোক্লিস তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
সফোক্লিস বললেন, তোমার চাচা তো একজন কবি। তার কথা আমি শুনেছি। যে অত্যাচারী রাজা তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল, সে কি এখনও ক্ষমতায় আছে?
হেরোডোটাস বলল, হুঁম আছে। সে যতদিন আছে, আমি দেশে ফিরতে পারব না। আমার অবস্থা আসলেই খারাপ। টাকা-পয়সা নেই। একটি কাজ হলে মন্দ হয় না। সামোস দ্বীপে বসে আপনার কথা মনে হলো, তাই এথেন্সে চলে এলাম।
সফোক্লিস বললেন, এথেন্সে যখন এসেছো—ভালো কিছু হবেই। চিন্তা করো না। আজ বিশ্রাম নাও। কাল সকালে তোমাকে পেরিক্লিসের কাছে পাঠাব।
সকালবেলা ভৃত্য এসে পেরিক্লিসের হাতে একটি পত্র দিল। একটি লম্বা পেপিরাস টুকরো। ঠিক মাঝখানে অল্প একটু লেখা। তিনি চিঠি পড়লেন-
বন্ধুবরেষু পেরিক্লিস,
পরম করুণাময়ী দেবী এথিনার নামে শুরু করিলাম।
আমি একটি অনন্য অসাধারণ যুবককে তোমার কাছে পাঠাইলাম। যুবকটির নাম হেরোডোটাস। অসামান্য প্রতিভাধর যুবক। তুমি কিঞ্চিৎ আলাপ করিলেই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবে যে আমি কোন উদ্দেশ্যে যুবকটিকে তোমার সমীপে প্রেরণ করিয়াছি। তুমি যেইরূপ মহান এথেন্সের স্বপ্ন দেখিয়া থাকো, সেইরূপ এথেন্সের কথা উহার চাইতে উৎকৃষ্টরূপে বলিতে আমি অদ্যাবধি আর কাহাকেও শুনি নাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যুবকটি তোমার বিশেষ কাজে আসিবে।
পুনশ্চ : তোমার বুঝিবার সুবিধার জন্য উল্লেখ করিতেছি যে, এই যুবক শুধু এথেন্সের কাহিনি জানে তাহাই নহে, সে ইতোমধ্যে সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ সম্পন্ন করিয়া ফেলিয়াছে। নিজের হস্তে সসাগরা পৃথিবীর একখানা নকশাও অঙ্কন করিয়া ফেলিয়াছে।
কল্যাণময়ী দেবী এথিনা তোমাদিগের মঙ্গল সাধন করুন।
ইতি,
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী,
সফোক্লিস
পত্র পড়েই পেরিক্লিস বারান্দায় এলেন। সফোক্লিস যখন অত জোর দিয়ে লিখেছেন, তখন ছেলেটির মধ্যে কিছু চমক আছে। সফোক্লিস ফালতু কথার লোক নন।
পেরিক্লিসকে দেখে হেরোডোটাস উঠে দাঁড়াল। সে এখানে চাকরির উমেদার। ভাব-হাব সেরকম হতে হবে। মুখে থাকবে একটি ভিক্ষুক ভিক্ষুক ভাব। কিন্তু খুব করে চেষ্টার পরও সে নিজেকে ভিক্ষুক বানাতে পারল না। তাকে একটুও চাকরির উমেদারের মতো লাগছে না। তার ভয় করছে। সে এথেন্সের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটির সামনে চাকরির আশায় দাঁড়িয়েছে। একটি চাকরির জন্য কত তুচ্ছ মানুষ তাকে কতভাবে অপমান করেছে, গলা ধাক্কাও দিয়েছে। আজ কপালে কী আছে, কে জানে!
কিন্তু আজ তার কপাল ভালো। একটু বেশি রকমই ভালো। পেরিক্লিস কোনো ভণিতা না করে সরাসরি বললেন, যুবক, তোমার চোখে ভয় দেখতে পাচ্ছি। কিসের ভয়? তুমি এখন এথেন্সে। এথেন্স মানে গণতন্ত্র। এথেন্স মানে মানুষের শাসন। গণতন্ত্রে কেউ কাউকে ভয় করে না। তোমার কোনো ভয় নেই। নির্ভয়ে ওখানে বসো।
বেশি বড় মানুষ সাহস দিলে উল্টা ভয় লাগে। হেরোডোটাসেরও ভয় লাগল। এবার না চাইতেই একটি ভিক্ষুক-ভিক্ষুক ভাব মুখে এসে গেল। সে কাঁচুমাচু করে বসল।
পেরিক্লিস বললেন, তুমি এথেন্সের কাহিনি বলতে পার? শুরু কর।
হেরোডোটাস উঠে দাঁড়াল।
পেরিক্লিস বললেন, একটু বসো। আর একজন আছে। সে আসুক। তারপর শুরু কোরো।
তিনি আসপাশিয়াকে ডাকতে দাসীকে ইশারা করলেন। আসপাশিয়া ঘরে ঢুকতেই হেরোডোটাস প্রায় ভিরমি খেলো। এমন সুন্দর মেয়ে সে আগে কোনোদিন দেখেননি। এর সামনে গল্প বলতে হবে ভেবে তার তালু আর ও শুকিয়ে গেল। আসপাশিয়া টের পেয়ে তাকে একটু পানি এগিয়ে দিল।
হেরোডোটাস কাহিনি শুরু করল। সফোক্লিস তাকে বলে দিয়েছেন, পেরিক্লিসের কাছে শুধু এথেন্সের কাহিনি বলতে হবে। অন্য দেশের কাহিনি পেরিক্লিস পছন্দ করবেন না। পেরিক্লিসের মনে ঢুকতে শুধু এথেন্সে কথা আর গণতন্ত্রের কথা বলতে হবে।
হেরোডোটাস বলছে আর পেরিক্লিস ও আসপাশিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। সবই তাদের জানা কথা। কিন্তু হেরোডটাসের মুখে এথেন্সের মহিমা কেমন অন্য রকম ভালো লাগছে। কাহিনিতে নেশা ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে ছেলেটির। সে অনেক চতুর। একটু একটু দেবতার কথা ঢুকিয়ে গল্প বলছে। মানুষের কথা পনেরো আনা, সেই সাথে এক আনা অলৌকিক ঘটনা। দারুণ মিশ খাচ্ছে। শুনতে চমৎকার লাগছে।
এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। হেরোডোটাস বলেই চলেছে। দাস এসে খবর দিল, পেরিক্লিসের সাথে দেখা করতে অনেকে এসেছে।
পেরিক্লিস বললেন, সবাইকে বিকেলে আসতে বলো। আমি ব্যস্ত।
আরও অনেকক্ষণ শুনিয়ে গল্প শেষ করল হেরোডোটাস। আসপাশিয়া হাততালি দিয়ে উঠল। পেরিক্লিস উঠে দাঁড়িয়ে হেরোডোটাসকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বললেন, তুমি তো কাঁচা সোনা। হেরোডোটাস, তুমি কাল বিকেলে একবার এসো। তোমার জন্য কোনো ছোট-মোট কাজ নয়। তোমাকে অনেক বড় কিছু করতে হবে, বিশাল কিছু।
আসপাশিয়া হেরোডোটাসকে বলল, যা বললেন— সেগুলো কি আপনি কোথাও লিখেছেন?
হেরোডোটাস বলল, টুকরো-টুকরো লেখা আছে। নোটের মতো আর কি! ভালো করে লিখিনি।
আসপাশিয়া বলল, আপনি সব গল্প লিখে ফেলুন। একটি বই করুন। পৃথিবীতে এমন কাজ আগে হয়নি। মানুষের ঘটনা আগে কখনো লেখা হয়নি। আপনি লিখুন।
হেরোডোটাস বিদায় নিলে পেরিক্লিস আসপাশিয়াকে বললেন, বলো তো। ছেলেটি তো নতুন কিছু বলেনি। তাহলে আমার এত ভালো লাগল কেন?
আসপাশিয়া বলল, হেরোডোটাস একজন বিদেশি। একজন বিদেশি যখন এথেন্সের কথা বলছে, আমাদের ভালো লাগছে। তার মুখে এথেন্সের প্রশংসা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। এথেন্সের কেউ বললে সেটি নিজের ঢাক নিজে পিটানোর মতো ব্যাপার হয়। আর হেরোডোটাস বললে মনে হয় এক পণ্ডিত একেবারে সাচ্চা বয়ান দিচ্ছে।
‘ঠিক বলেছ। তবে ছেলেটির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ।’
‘হ্যাঁ, এখন বলেন, এই অসাধারণ জিনিসটাকে কি কাজে লাগাবেন?’
‘তুমিই বলো কী করব।’
‘ওকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেন। জমকালো অনুষ্ঠান। সারা এথেন্সের মানুষকে দাওয়াত দেন। সবার সামনে সে ম্যারাথন যুদ্ধের কথা বলবে।’
‘তাতে আমার লাভ?’
‘আপনার নিজের খরচে আয়োজন করবেন। সবাই বলবে— পেরিক্লিস এথেন্সের গৌরবের কথা প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। আপনার সুনাম আরও বাড়বে।’
‘আর হেরোডোটাস?’
‘সেও বিখ্যাত হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত— অনেকেই তাকে পুরস্কার দেবে।’ পেরিক্লিস হাসি দিলেন। সম্মতির হাসি।
***
৫৫. হেরোডোটাস (Herodotus): ইতিহাসের জনক, পৃথিবীর প্রথম ইতিহাস বইয়ের লেখক।
৫৬. তখনও পর্যন্ত ইউরোপের মানুষ জানত যে এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকা নিয়েই পৃথিবী। অন্য কোনো ভূখণ্ড তখনও অজানা ছিল।