১৬
‘অট্টহাসি হেসো না অন্যের বেদনায়,
দুষ্ট নিয়তি আছে ওঁৎ পেতে, তোমার অপেক্ষায়।’
—ইসোক্রেটিস
***
সক্রেটিস এক মনে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে।
মনে হচ্ছে নদীর পানিতে গভীর সমস্যা আছে, আর সেটি সমাধানের জন্য সে এক মনে চিন্তা করছে। বিরাট গবেষণা। তার চোখে মৎস্য-দৃষ্টি। একেবারে ‘পড়ে না চোখের পলক’ অবস্থা।
পাশে বসে আছে সিমন। দুজনে নদীর তীরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সিমন সক্রেটিসের নতুন ভক্ত। সক্রেটিসের সবকিছু তার ভালো লাগে।
সক্রেটিসের চরিত্রে একটি মাধুর্য আছে। মানুষ তাকে পছন্দ করে। তার কাছে বসে থাকতে ভালো লাগে। সে এত কিছু জানে, অথচ কোনো অহংকার নেই। আড়ম্বর বলতে কোনো বিষয়ই নেই। সারাক্ষণ হাসছে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। কাউকে কোনো কটু কথা বলছে না। কেউ ঝাড়ি দিলে উল্টো হাসে। হেসে এমন একটি জ্ঞানমাখা কথা বলে, যে তাকে ঝাড়ি দিয়েছে সে লজ্জা পেয়ে যায়। তার সাথে রাগ করা যায় না। যে তার সাথে ভালো মনে একবার মিশে, সে সারাজীবনের জন্য বন্ধু হয়ে যায়।
সে সারাদিন ধরে কথা বলে। কথাও যে কারও সম্পদ হতে পারে, তার উদাহরণ সক্রেটিস। সত্যি বলতে, সক্রেটিসের একমাত্র সম্পদ তার কথা। মন বা মস্তিষ্ক তো ভেতরের ব্যাপার, সেটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। সক্রেটিসের যেটি দেখা যায়, সেটি হলো কথা। তার কথার ওজন নেই, একেবারে হালকা। কিন্তু মারাত্মক ধারালো। ছোট ছোট বাক্যে সব সময় রসিকতা করছে। রসিকতার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ এমন সুন্দর কিছু বলে, যা আগে কেউ কোনোদিন শোনেনি।
সিমন হঠাৎ খেয়াল করল— অনেকক্ষণ হলো সক্রেটিস কোনো কথা বলছে না। একদৃষ্টে পানির দিকে তাকিয়ে আছে।
এমন করে কী দেখছে সক্রেটিস! এই নদীতে দেখার মতো কী আছে? এটিকে তো নদী বললে নদী লজ্জা পাবে। পাহাড় থেকে চিকন দুটি ঝরনা কোনোমতে একসাথে মিশে একটি সরু নালার মতো চলে গেছে। ঐ নালার পানির দিকে সক্রেটিস অমন করে তাকিয়ে আছে যেন মহাসাগরের রহস্য খুঁজছে!
তবে সক্রেটিস যখন তাকিয়ে আছে, তখন কিছু একটি ঘটনা অবশ্যই আছে। সিমনও সক্রেটিসের মতো পানির দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখেও মৎস্যদৃষ্টি। সিমন অনেক চেষ্টা করেও আলাদা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তবুও তাকিয়ে আছে। ভাবছে কিছু একটি অবশ্যই হবে।
কিন্তু অনেকক্ষণ কেটে গেল। কিছুই হলো না। সক্রেটিস আগের মতোই তাকিয়ে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই।
ঘটনা বুঝতে পারছে না সিমন। বোঝার জন্য কিছু বলা দরকার। সে হালকা করে বলল, এই নদীটি বড়ই অদ্ভুত। এর পানিও অদ্ভুত। সারাদিন দেখতে ইচ্ছে করে।
সে মিথ্যে বলল। তাকিয়ে থাকতে তার খুবই বিরক্তি লাগছে। শুধু সক্রেটিসের হাবভাব বোঝার জন্য কিছু একটি বলা দরকার। তাই বলছে।
সক্রেটিস কিছুই বলছে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে।
সিমন ভাবছে, সক্রেটিসের মতো মানুষকে এত তুচ্ছ একটি কথা বলা ঠিক হয়নি। তাই পাত্তা দিচ্ছে না। পাত্তা পেতে হলে একটু উচ্চ স্তরের কথা বলতে হবে। সে মনে মনে উচ্চ স্তরের কথা খুঁজতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর সিমন বলল, এই যে নদী বয়ে চলছে, এটি একেবারে জীবনের মতো। নদী কেমন করে সাগরে যায়? নেচে নেচে যায়, কেঁদে কেঁদে যায়। আবার হেসে হেসেও যায়। জীবনও এমনই— এই কান্না, এই হাসি; তবু বয়ে বয়ে চলে।
কথাটি বলে নিজেই অবাক হলো সিমন। খুবই জ্ঞানের কথা। দার্শনিকের মতো কথা। এবার সক্রেটিস তাকে জ্ঞানী ভাববে।
কিন্তু আশ্চর্য, সক্রেটিস কিছুই বলছে না। সে একভাবেই তাকিয়ে আছে। চোখে সেই মৎস্যদৃষ্টি।
এমন তো হওয়ার কথা নয়। কেউ ভালো কিছু বললে, সক্রেটিস প্রাণখুলে প্রশংসা করে। প্রশংসা করতে তার কোনো কৃপণতা নেই। অথচ এখন কিচ্ছু বলছে না। সিমন এবার ভালো করে সক্রেটিসের চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে ভাবলেশ নেই। মরা মানুষের মতো। মনে হয় কিচ্ছু শুনছে না। হঠাৎ সিমন লক্ষ করল সক্রেটিস ঘামছে। দরদর করে ঘামছে। সিমন ভীষণ ভয় পেয়ে গেল।
সে ডাক দিল, সক্রেটিস, শুনতে পাচ্ছ? কোনো উত্তর নেই।
সিমন আরও জোরে ডাক দিল, সক্রেটিস!
সাড়া নেই। সক্রেটিস শুনতে পাচ্ছে না।
সিমন ছুটে গিয়ে সক্রেটিসকে ধরতেই, সে মাটিতে লুটিতে পড়ল।
সিমন চিৎকার করে উঠল, কে কোথায় আছ, বাঁচাও! সক্রেটিস মরে যাচ্ছে। বাঁচাও!
.
সক্রেটিস যখন চোখ খুলল তাকে ঘিরে অনেক মানুষ। সিমন তার চোখে পানি ছিটাচ্ছে। সিমন কাঁদছে। সক্রেটিস উঠে বসল। বসে আস্তে আস্তে বলল, পাদুকাশিল্পী, ভয় নেই। আমি ঠিক আছি।
সিমন আরও জোরে কেঁদে উঠল
সক্রেটিস ভিড়ের লোকদের বলল, আপনারা তো অনেকেই জানেন, আমার মাঝে মাঝে এমন হয়। আগেও হয়েছে।
ভিড়ের মধ্য থেকে এক বৃদ্ধ বললেন, জানি তো, তুমি পাক্কা খেলোয়াড়। মাঝে মাঝেই খেলা দেখাও। তা আজকে তোমার সাগরেদ অকারণে অমন চেঁচামেচি করল কেন?
সক্রেটিস বলল, আমার এই ব্যাপারটা সিমন জানে না। তাই ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়েছে। মাফ করবেন। আপনাদের কষ্ট দিলাম। শরমিন্দা।
বুড়ো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন, শরমিন্দা? তামাশা করো, আর মুখে বলো শরমিন্দা! লজ্জা-শরম কিছু আছে?
সিমন দেখল, সক্রেটিস এখনও ঘামছে। আর এই লোকটা যা-তা বলছে। সে বলল, আপনার কি মনে হচ্ছে সক্রেটিস তামাশা করছে?
বুড়ো বললেন, তা নয়তো কী? ও মাঝে মাঝেই এমন করে। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, ভ্যাং ধরে পড়ে যায়। যায় যায় অবস্থা। মানুষজন আসে। হাত মালিশ করে, পায়ে ডলা দেয়। কিছুক্ষণ পরে সব ঠিক। মৃগী রোগীর মতো কাণ্ড। এগুলো তামশা না হলে কী?
সিমন বলল, আপনি একবার ওরকম তামাশা করে দেখান তো।
মুরুব্বি বললেন, তুমি সক্রেটিসের নতুন চ্যালা। তুমি কিছুই জানো না। এখন কী হবে আমার কাছে শোন। এখন তোমার জ্ঞানী সক্রেটিস বলবে, ‘আমি এখানে ধ্যান করছিলাম। ধ্যানের মধ্যে একটি আজব সংকেত পেলাম। শব্দ শুনলাম। শোঁ শোঁ শব্দ। শব্দে আমার উপর নতুন এক জ্ঞান এলো। সেই জ্ঞানের কথাবার্তা আমি ঘাটে পথে বিলাই।’ কী সক্রেটিস, ঠিক কিনা?
সক্রেটিস মাথা নাড়ল। বৃদ্ধ ঠিক বলেছেন।
মুরুব্বি আবার বললেন, ধ্যান কি এত সহজ বস্তু? ভং করে একদিকে তাকিয়ে থাকো। চোখ দুটি করো মরা মাছের মতো। একে কি ধ্যান বলে? মানুষ ধ্যান করে পাহাড়ের গুহায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে। আর তুমি শহরের মধ্যখানে শত শত লোকের সামনে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকো। এটি কিছু হলো? এটিকে কি পাগলেও ধ্যান বলবে? আর লোক হাসাইও না। তামাশা বাদ দাও।
সিমন উত্তর করতে যাচ্ছিল। সক্রেটিস সিমনের হাত চেপে বলল, ছেড়ে দাও। তারপর বুড়োকে বলল, চাচা, ক্ষমা দেন। আমি তামাশাই করি। আপনারা যারা আমার এই তামাশা আগে দেখেছেন, তারা দয়া করে যেতে পারেন।
তামাশা অনেকেই আগে দেখেনি। তারা গেল না। অনেকে বসে পড়ল। মুরুব্বি চলে গেলেন। সক্রেটিস তখনও দরদর করে ঘামছে। সিমন হাতপাখা দিয়ে বাতাস শুরু করল। সক্রেটিস তাকে নিষেধ করল, বাতাস লাগবে না।
একজন বলল, সক্রেটিস, বুড়া মিয়া চলে গেছে। এবার বলো তো, তোমার কাহিনিটা কী? আমরা তো ভয় পেয়েছিলাম।
সক্রেটিস বলল, কাহিনি যে কী, সেটি আমি নিজেও বুঝি না। আমার মাঝেমধ্যে এমন হয়। ছোটবেলা থেকেই হয়।
‘কী হয়?’
‘ধরুন, আমি একটা কিছু নিয়ে চিন্তা করছি। গভীর চিন্তা। হঠাৎ মনে হয় আমি আর পৃথিবীতে নেই। চারপাশের কিছুই আর শুনতে পাই না। কিছু দেখতে পাই না। মনে হয় অন্য কারও সাথে যেন কথা বলছি। শুধু একটি শব্দ শুনি। একটানা কিছু শব্দ। মনে হয় কেউ যেন কিছু বলছে। মাঝে মাঝে ছবিও দেখি। ঝাপসা একটি ছবি। স্বপ্নের মতো। ‘
একজন বলল, অদ্ভুত কথা।
‘হুঁম, প্রথম প্রথম আমারও খুব অদ্ভুত লাগত। প্রথম দিন তো খুব ভয় পেলাম। মাকে বললাম। মা কান্না শুরু করল— আমার ছেলে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তারপর যখন মাঝেমধ্যেই এমন হতে থাকল, তখন থেকে আর মা- বাবাকে জানাই না।’
‘কতক্ষণ চলে এমন?’
‘তখন আমার সময় হিসাব থাকে না। তবে বন্ধুরা বলছে, একবার নাকি সারা বিকাল এমন করেছিলাম।’
‘বিষয়টা শেষ হয় কীভাবে?’
‘আপনা-আপনিই ঠিক হয়ে যায়।’
সিমন বলল, আমি তো ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তো, এখন বলো তো— আজ কী শুনলে? নতুন কোনো সংকেত এলো?
সক্রেটিস ধীরে ধীরে বলল, আজ একটি পরিষ্কার সংকেত পেলাম। এতদিন ভাবনা ছিল; আজ যেন দেখতে পেলাম, একেবারে স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
সিমন বলল, কী দেখতে পেলে?
সক্রেটিস বলল, এতদিন সুন্দর জীবনের কথা বলতাম। আজ আমি সুন্দরকে দেখতে পেলাম।
কয়েকদিন ধরে সক্রেটিস কথায় কথায় শুধু ‘সুন্দর জীবন’
‘সুন্দর জীবন’ করছে। মনে হতো বিলকি-ছিলকি আলাপ, নতুন মুদ্রাদোষ। কথার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, শুধু কথার কথা নয়। সে সত্যিই ‘সুন্দর জীবন’ নিজের চক্ষে দেখতে পেয়েছে।
সিমন বলল, অদ্ভুত কথা! তুমি ‘সুন্দর জীবন’ দেখতে পেলে? ‘সুন্দর জীবন’ আসলে কি? সেটি দেখতে কেমন?
সক্রেটিস বলল, সত্য ও ন্যায়ের জীবনই সুন্দর জীবন। মুখে আর অন্তরে একই সত্য মেনে চলাই সুন্দর জীবন। তুমি মুখে ভালো ভালো কথা বলবে, আর কাজের সময় নিজের স্বার্থ দেখে চলবে, সেটি নয়; ভেতরে আর বাইরে এক থাকলেই জীবন সুন্দর হবে। আর একটি বড় ব্যাপার হলো— একা একা ভালো থাকা যায় না। সবাই মিলে একসাথে ভালো থাকতে হয়। আমি যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য চাই, আরেক জনেরও সেটি দরকার। এটিকে বুঝে সবাই মিলে সত্য আর ন্যায়ের পথে থাকাই সুন্দর জীবন। সবাই যদি সত্য ও ন্যায়কে বুঝে সেই মতো চলে, সেই জীবনই সুন্দর জীবন।
সিমন বোঝার চেষ্টা করছে। সে বলল, যেটি বললে, এরকম জীবন তুমি আজ দেখতে পেলে?
সক্রেটিস বলল, ‘হ্যাঁ, দেখতে পেলাম। আজ নদীর তীরে তুমি আর আমি কথা বলছিলাম। কিন্তু কাল রাত থেকেই আমার মাথায় একটি পোকা ঘুরছিল— জীবন কীভাবে সুন্দর হতে পারে— সেই পোকা। সুন্দর জীবনের পোকাটা মাথার ভেতরে কিলবিল করছিল। স্বস্তি দিচ্ছিল না। এর মধ্যেই তুমি কথা বলছিলে। কোন ফাঁকে যেন আমি আর তোমার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার সামনে হঠাৎ একটি ছবি ভেসে উঠল। স্পষ্ট ছবি। আমি দেখতে পেলাম—
একটি সুন্দর শহর। সেই শহরে কেমন মিঠা একটি আলো। সেই আলোতে কেমন করে যেন শহরের সব মানুষ সত্যকে বুঝে গেল। সত্যকে বুঝতে পারামাত্রই সবাই মুখে আর অন্তরে এক হয়ে গেল। কারও ভেতরে আর কোনো অভিনয় নেই। সবার ভেতর আর বাহির এক। সবাই নিজের স্বার্থ আর অন্যের স্বার্থ দুটোই এক রকম করে বুঝতে পারছে। বুঝতে পেরে সবাই সেভাবে চলছে। সবাই সত্য বলছে, সবাই ন্যায় করছে। তাদের কাছে সুখ জিনিসটা আর জিরো-সাম গেম নেই। দুজনের সুখের যোগফল শূন্য নয়। তোমার জন্য যা প্লাস, আমার জন্য তা মাইনাস নয়। তুমি সুখী হলে আমি অসুখী— এরকম নয়। তারা উপায় বের করে ফেলেছে যে, সবাই মিলে একসাথে সুখে থাকা যায়। আর তাতেই সবার জীবন সুন্দর হয়ে গেছে। আমি দেখছিলাম— অপূর্ব সেই শহরের ছবি। একঝাঁক রঙিন মুখ, সবাই হাসছে, অনাবিল সেই হাসি, জ্যোৎস্না রঙের হাসি। প্রেমের ঘ্রাণ লাগা হাসি। ভালোবাসা ছোঁয়া লাগা সেই হাসিতে সত্য ও ন্যায় ঝরে ঝরে পড়ছে।
আর ঠিক সেই সময়েই তুমি আমাকে ধাক্কা দিলে। আমি চোখ মেলে দেখি, আমি মাটিতে পড়ে আছি, আমাকে ঘিরে অনেক মানুষ, তুমি হাউমাউ করে কাঁদছো।’
সিমন তন্ময় হয়ে শুনছিল। গল্পের মতো লাগছে। অবিশ্বাস্য গল্প। কিন্তু সে নিজে দেখেছে, সক্রেটিসের সারা শরীর কেমন কাঁপছিল। তার চোখ এখনও কেমন উদভ্রান্ত, এই চোখ মিথ্যে বলছে না।
সিমন বলল, আমি এখনও তোমার ‘সুন্দর জীবন’ বোঝার চেষ্টা করছি। যেটুকু বুঝলাম, তা হলো— সবাই মিলে সত্য আর ন্যায়ের পথে থাকাই সুন্দর জীবন। একা একা নয়, সবাই যদি সত্য ও ন্যায়কে বুঝতে পারে, সেই মতো চলে, সেটিই সুন্দর জীবন। তবে একটি খটকা আছে।
সক্রেটিস বলল, কী খটকা?
সিমন বলল, ‘সুন্দর জীবন’ পেতে সবাইকে সত্য ও ন্যায় বুঝতে হবে? সেটি কীভাবে হবে? সব মানুষকে সত্য পথে কে আনবে? এটি সম্ভব নয়।
সক্রেটিস দৃঢ়ভাবে বলল, ‘সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব। আমি করে দেখাব। আমি আজ সত্যকে দেখতে পেয়েছি। ন্যায়কে বুঝতে পেয়েছি। সেজন্যই বলছি, সম্ভব। মানুষকে সত্য ও সুন্দর পথে আনার একমাত্র বাধা হচ্ছে অজ্ঞানতা। মানুষ সুন্দর জীবন যাপন করে না, কারণ সে জানেই না— ‘সুন্দর জীবন’ কী। জানেই না— কীভাবে সেই জীবন পাওয়া যায়। যদি সঠিক কথা জানানো যায়, তাহলেই সে সুন্দর জীবনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবে। সেজন্য আমি মানুষকে জানাব। আমি মানুষকে ডেকে ডেকে বলব,
‘পৃথিবীতে একমাত্র সুন্দর জিনিস হচ্ছে জ্ঞান, আর একমাত্র মন্দ জিনিস হচ্ছে অজ্ঞতা’।
অজ্ঞতা দূর করতে আমি এথেন্সের পথে পথে যুবকদের শিক্ষা দেব। কীভাবে সুন্দর জীবন পাওয়া যায়, সেই কথা বলব। সত্য ও ন্যায়ের বাণী শোনাব। সাহস ও সংযমের কথা শোনাব। সবাইকে সুন্দর জীবনের তরিকা বলাই আজ থেকে আমার জীবনের লক্ষ্য। মানুষের জীবনে কখন কী করা উচিত— আমি সেটি নিয়ে কাজ করব। সেজন্য এথেন্সের পথে পথে ঘুরে আমি জ্ঞান ভিক্ষা করব। জ্ঞানের মাধুকরী হয়ে আমি মানুষের কাছে যাব। মানুষের ভেতরের জ্ঞানকে বের করে আনব। আমি মানুষের জীবনকে বদলে দেব। সবার জন্য এনে দেব একটি ‘সুন্দর জীবন’।
সিমন ভাবছে, সক্রেটিস কত অবলীলায় এমন চমৎকার সব কথা বলে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সে যা বলছে, তা একেবারেই নতুন জিনিস। পৃথিবীতে তার আগে এমন কথা কেউ বলেনি। এই মুহূর্তে সে নতুন কিছু সৃষ্টি করছে।
সে মানুষকে জানানোর জন্য পথ পথে হাঁটবে। সে জ্ঞানের মাধুকরী। সে মানুষের ভেতরের জ্ঞানকে বের করে আনবে। সে জ্ঞানের ধাত্রী। সে মানুষের মনকে বদলে দেবে। গড়ে তুলবে মনের সাম্রাজ্য।
সবচেয়ে বড় কথা— সে বলছে, জ্ঞানই শক্তি। জানতে পারলেই উপায় বের হয়। বদলে দেওয়া যায়। মানুষের ভেতরে জ্ঞানকে বের করে এনে সে তাদের জীবনকে বদলে দেবে। শুধু থিওরি নয়, একেবারে প্র্যাকটিক্যালি সুন্দর জীবনের পথ দেখিয়ে দেবে। এখন থেকে জ্ঞান আর আকাশের জিনিস নয়, কোনো অশরীরী বিষয় নয়; জ্ঞান মানে নিজেকে জানা, সুন্দর জীবনের উপায় জানা। শুধু জানার মাধ্যমেই সত্যকে ধরা যাবে। সত্যকে বুঝে জীবনকে সুন্দর করে তোলা যাবে। হাজার বছর ধরে অনেক মানুষ জ্ঞানের কথা বলছে। সেসব জ্ঞানের আলাপ শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু সক্রেটিস বলছে তার জ্ঞানের থিওরি সে প্র্যাকটিক্যালি ব্যবহার করবে।
এথেন্সে এখন জ্ঞান সাধনার সময় চলছে। এখানে ধনী লোকদের কোনো কাজ করতে হয় না। সব কাজ করে দাসেরা। তাই তাদের হাতে অফুরন্ত সময়। এই অফুরন্ত সময় তারা ব্যয় করে জ্ঞানের কাজে। সারা দুনিয়ায়ই ধনীরা সময় কাটায় সুরা আর সাকি নিয়ে। তাদের বিনোদন মানে হেরেম ভর্তি বাইজি। আর এথেন্সের ধনীরা সময় কাটায় জ্ঞান নিয়ে তর্ক করে। তাদের বিনোদন মানে হোমারের বই থেকে পালা গান আর থিয়েটারের নাটক। এখানেই এথেন্স সবার থেকে আলাদা। সেজন্য এই আলোকিত সময়ে ঝাঁকে ঝাঁকে জ্ঞানী লোকে এথেন্স ভরে উঠেছে।
এথেন্সের পথ-ঘাট এখন জ্ঞানী লোকে গিজগিজ করে। তাদের বলা হয় সফিস্ট (Sophist)। গ্রিক শব্দ সোফিয়া (Sophia) মানে জ্ঞান। সফিস্টরা সারাদিন জ্ঞান কপচান, জ্ঞান নিয়ে ওঠা বসা করেন। সুযোগ পেলেই নতুন নতুন থিওরি বলেন। হাতে কাঠের কলম আর পেপিরাস কাগজ নিয়ে আগোরার আশেপাশে কাউকে ঘুরতে দেখলেই সবাই বলে উনি একজন সফিস্ট।
সিমন ভাবছে, সক্রেটিস কি সফিস্ট?
এথেন্সে সফিস্টগণ ঘণ্টা-মেপে জ্ঞান বিক্রি করেন। তারা জ্ঞানের ব্যাপারী। টাকার বিনিময়ে তরুণদের শিক্ষা দেন। তারা অনেক ধনী। জ্ঞান বিক্রি করে মোটা আয় করেন। কিন্তু সক্রেটিস কোনোদিন জ্ঞান দিবে কারও কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেয়নি। সে জ্ঞানের জন্য সারা দিন পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তার সাথে অর্থের ব্যাপার নেই। সে কারও কাছে বেতন নিয়ে জ্ঞান দান করে না। তার জ্ঞান বিক্রির জিনিস নয়। জ্ঞান অমূল্য, জ্ঞানের কোনো আর্থিক মূল্য হতে পারে না।
আবার সফিস্টরা সব মধ্য বয়স পার হওয়া ভদ্রলোক। তাদের মাথায় চুল থাকে না। যদি থাকে, সেই চুল অবশ্যই ধবধবে সাদা। এথেন্সে কঁচা চুলের কোনো সফিস্ট নেই। চুল কাঁচা হলে, যতই জ্ঞান থাকুক না কেন, তাকে সফিস্ট বলে কেউ মানবে না। সক্রেটিস আর তার বন্ধুরা সব কাঁচা চুলের ছোকরা, বয়স ত্রিশের কম। তাই এখনও কেউ তাদের সফিস্ট বলে মানে না। বয়স্কদের কাছে তারা ইঁচড়ে পাকা বিচ্ছু।
সেজন্য সক্রেটিস সফিস্ট নয়। উল্টো তারা বন্ধুরা সফিস্টদের নিয়ে হাসি- ঠাট্টা করে। তাদেরকে বলে ঘণ্টা-মাপা জ্ঞানের ফরিয়া।
এই ঘণ্টা-মাপা সফিস্টদের বাইরেও আরেক ধরনের জ্ঞানী মানুষ আছে। তারা ঘণ্টা-মেপে পয়সা নেন না। তারা পণ্ডিত মানুষ। তারা বই-পত্র লেখেন, অনেকের স্কুল আছে, শিষ্য আছে। সক্রেটিস তাদের সম্মান করে। এরকম একজন মানুষ ছিলেন পিথাগোরাস। তিনি ছাড়া গ্রিসে সাতজন জ্ঞানী মানুষ আছেন, তাদেরকে একত্রে বলে সেভেন সেইজেস (Seven Sages)। তাদের মধ্যে মহাজ্ঞানী সলোন আছেন, বিজ্ঞানের জনক থেলিস আছেন। তারা সাধু টাইপের পণ্ডিত।
কিন্তু সক্রেটিস পণ্ডিত নয়। সে বই লেখে না। সে স্কুল দেয়নি। সে সভায় বক্তৃতা দেয় না। নতুন নতুন থিওরি দেয় না। পণ্ডিত বললে যে রকম একটি ছবি মনে আসে, সক্রেটিস একেবারেই সেরকম নয়।
তাহলে সক্রেটিস আসলে কী?
গ্রিক ভাষায় জ্ঞান আর প্রেম মিলিয়ে একটি সুন্দর শব্দ আছে। সোফিয়া (Sophia) মানে জ্ঞান আর ফিলিন (philein) মানে ভালোবাসা; এই দুটি একত্রে হয় ফিলোসফি (Philosophy) মানে জ্ঞানের জন্য ভালোবাসা। যিনি জ্ঞানকে ভালোবাসেন, তিনি হলেন ফিলোসফার (Philosopher)। সক্রেটিসের জন্য এর চেয়ে ভালো শব্দ আর হতে পারে না। অনেকে বলে, ফিলোসফার শব্দটি পিথাগোরাস তৈরি করেছেন। যেই তৈরি করুন না কেন, জ্ঞান-প্রেমিক শব্দটি বললে এথেন্সের সবার চোখে এখন একটি নামই ভাসবে। সে হলো সক্রেটিস।
সক্রেটিসই একজন সত্যিকারের জ্ঞানপ্রেমিক। জ্ঞানই তার জীবনের একমাত্র নেশা। কিছু জানার ইচ্ছা হলে না জানা পর্যন্ত সে ছটফট করে। নতুন কিছু শেখার জন্য গভীর রাতে নিশির ডাকের নাম করে গুরুর কাছে ছুটে যায়। তার প্রেমের গুরু ডিওটিমা তাকে শিখিয়েছেন যে, প্রেমের সবচেয়ে চূড়ান্ত রূপ হলো জ্ঞানের জন্য প্রেম। সক্রেটিস সেটি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছে, জ্ঞানপ্রেমী হওয়ার জন্য আত্মনিয়োগ করেছে।
জ্ঞান ছাড়া তার জীবন অর্থহীন। সে জ্ঞান-ভিখারি। পথে পথে ঘুরে জ্ঞান ভিক্ষা করে। সে জ্ঞানের ধাত্রী। প্রশ্ন করে করে মানুষের ভেতরের জ্ঞান বের করে আনে। সে জ্ঞান দিয়ে পয়সা কামায় না। পণ্ডিত হিসেবে নাম করতে চায় না। তবু দিন-রাত জ্ঞান নিয়েই থাকে। জ্ঞানই তার প্রেমিকা, জ্ঞানই তার জীবনসঙ্গী।
সে এখন ঘরে ঘরে জ্ঞানপ্রেমিক বানাচ্ছে। জ্ঞানকে প্র্যাকটিক্যাল জীবনে ব্যবহার করে করে মানুষের জন্য সুন্দর জীবন আনবে। গণিত, আর্কিটেকচার- এর মতো জ্ঞানেরও প্র্যাকটিক্যাল ব্যবহার থাকবে। এরকম কথা আগে কেউ বলেনি। তার এই ভাবনা থেকে জন্ম হলো একটি নতুন শাস্ত্র ‘জ্ঞানের জন্য প্রেম’ মানে ফিলোসোফি। যেটি দিয়ে জীবন বদলে দেওয়া যায়। সুন্দর জীবন পাওয়া যায়। ফিলোসফির জনক হলো সক্রেটিস।
তার আগে কি কোনো ফিলোসফার নেই? পিথাগোরাস, থেলিস এঁদেরকে কি ফিলোসফার বলা যাবে না?
যাবে। তবে সত্যি হলো— সক্রেটিসের আগে জ্ঞানকে ভালোবাসার কথা কেউ এমন করে বলেনি। কেউ জ্ঞান দিয়ে মানুষের জন্য সুন্দর জীবন আনতে চায়নি। সক্রেটিসই ফিলোসফিকে আকাশের বিষয় থেকে মানুষের অন্তরের বিষয় করে তুলেছে। তাই সক্রেটিসই ফিলোসফির জনক। তার আগে যারা ছিল, তাদেরকে প্রি-সক্রেটিক ফিলোসফার বলা যাবে।
সিমন সক্রেটিসের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, একটু আগে সক্রেটিস বলল যে, সে আজ সত্যকে দেখতে পেয়েছে। যে সত্যকে দর্শন করেছে, সেই তো দার্শনিক।