১৫
‘শুধু বেঁচে থাকা কোনো কাজের কথা নয়,
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাই মানুষের উদ্দেশ্য।’
-সক্রেটিস
***
সক্রেটিস, ক্রিতো আর সিমন সন্ধ্যার আড্ডা দিতে যাচ্ছে। আগোরার পেছনের পথ দিয়ে হাঁটছে। রাস্তাটি খুবই সুন্দর। দুপাশে ছোট ছোট জলপাই গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে চমৎকার সব মূর্তি। সাদা মার্বেল পাথরের উপর মিশরীয় নীল রঙের প্রলেপ দেওয়া। দেখে মনে হয় মূর্তিগুলো জীবন্ত। বুঝি কথা বলছে।
মূর্তিগুলোতে একটি করে গল্প আছে। গ্রিক পুরাণ বা হোমারের কাহিনির গল্প। ডানদিকের মূর্তিগুলোতে ট্রয়ের যুদ্ধ—সেখানে লড়াই করছে একিলিস আর হেক্টর। বামে দৈত্যদানব মারছে হারকিউলিস। একটু পেছনে পাথরের দেবতারা ঝগড়া করছে, ঝগড়া থামাতে সালিশ ডেকেছে দেবরাজ জিউস। জিউসের চোখ ফাঁকি দিয়ে জলপাই গাছের আড়ালে একজোড়া দেব-দেবী পাথরের শরীরেই প্রেম করছে।
এথেন্সে এখন সবখানে মূর্তি। মানুষের চেয়ে মূর্তির সংখ্যা বেশি মূর্তিগুলোর বিশেষত্ব হলো পুরুষ মূর্তিগুলো সব ন্যাংটা। পরনে কিছু নেই। আর নারী মূর্তিগুলোর পুরো শরীরে কয়েক প্যাঁচ কাপড়। এথেন্সবাসী মনে করে পুরুষের নগ্নতা বীরত্বের বিষয়। বীরত্ব প্রদর্শন করো। আর নারীর নগ্নতা লজ্জার বিষয়। লজ্জা ঢেকে রাখো। পোশাকের দিক থেকে এথেন্সের পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি সভ্য।
গ্রিকরা ভাস্কর্য বানানো শিখেছে মিশরীয়দের কাছ থেকে। কিন্তু মিশরীয়রা যে ধাঁচে ভাস্কর্য বানাত, গ্রিকরা তা একেবারে পাল্টে ফেলেছে। মিশরীয়দের মূর্তির শরীরে কোনো ভাষা নেই। তারা কিছুই করছে না। মোটা মোটা পাথরের উপর মাছের মতো চোখে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। সব যেন সৈনিক, তাদের সেনাপতি বলেছে সোজা হও, আর সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছুই করছে না।
সেই অচল ভাষাহীন মিশরীয় মূর্তিতে প্রাণ এনেছে গ্রিসের শিল্পীরা। তারা পাথরে কার্ভ দেওয়া শিখেছে। গ্রিসে পাথরগুলো বাঁকা-ত্যাড়া হয়েছে। এতে মনে হয় মূর্তিগুলো কিছু একটা করছে। তারা চলছে। তাদের চোখে-মুখে ভাষা এসেছে। আড়চোখে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে কথা বলছে। এরকম প্রাণবন্ত মূর্তি পৃথিবীতে আগে কেউ বানাতে পারেনি। একেবারে নতুন জিনিস বানাচ্ছে গ্রিসের পাথর শিল্পীরা।
নতুন কিছু করার আনন্দে গ্রিক শিল্পীদের মধ্যে সৃষ্টির জোয়ার এসে গেছে। পাথর দেখলেই তাদের হাত নিশপিশ করে। কেটে ছেঁটে কিছু একটি বানিয়ে ফেলে। সারা শহর ভরে গেছে মূর্তিতে। শিল্পীদের উৎসাহে এখন এথেন্সে যেটি চলছে, সেটিকে একটি মূর্তি বিপ্লব বলা যায়
মূর্তি বিপ্লবে সবচেয়ে বেশি খুশি সক্রেটিস। সে নিজে একজন শিল্পী। মূর্তির কারিগর। তার বাবার পাথরের কারবার। দালান-কোঠা বানায়। সুযোগ পেলে মূর্তিও করে। বাবাই সক্রেটিসকে মূর্তি বানানো শিখিয়েছেন। সেই হিসেবে সক্রেটিস আসলে একজন শিল্পী।
শিল্পী সক্রেটিস তার আড্ডার জন্য মূর্তিভরা জায়গা বেছে নিয়েছে। রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাস ছড়ানো একটি জায়গা। এই জায়গা বাছাই করার পেছনে সক্রেটিসের একটি উদ্দেশ্য আছে। প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা শেষ হলে বন্ধুরা চলে যায়। সক্রেটিস একা একা বসে থাকে। মূর্তিগুলোর সাথে কথা বলে। নিজের একান্ত না বলা কথা। কথা বলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। হঠাৎ কথা থামিয়ে ঝিম মেরে চিন্তা করতে শুরু করে। রাত যত বাড়ে, তার চিন্তার ধারও তত বাড়ে। চিন্তা করতে করতে ধ্যানের মতো হয়ে যায়। তখন সে কেমন যেন নতুন নতুন শব্দ শোনে। কে যেন তাকে ডাকে। ডেকে নতুন নতুন ভাবনা দেয়। তাই এই মূর্তিঘেরা জায়গাটি সক্রেটিসের অনেক প্রিয়। মূর্তিগুলো তার আড্ডার অংশ, জীবনেরও অংশ। সক্রেটিসের চিন্তাকে ধারালো করে মূর্তিগুলো।
সিমন এখানে আগে আসেনি। সে মুগ্ধ হয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে।
সিমন বলল, বাহ, ফাটাফাটি সব মূর্তি। কারা বানাচ্ছে এগুলো?
ক্রিতো বলল, যারা বানাচ্ছে, তাদের একজন তোমার সাথেই আছে।
সিমনের মনে পড়ল, সক্রেটিস তো আসলে একজন ভাস্কর, একজন কারিগর।
এটি কারও মনেই থাকে না। সারাদিন এমন সব কথা বলে সক্রেটিস, তাতে কারও মনেই থাকে না যে— সে একজন ভাস্কর। মনে হয় সে নিজেও ভুলে যায় যে— সে একজন শিল্পী।
সিমন বলল, সক্রেটিস, তাহলে তোমরাই এথেন্সকে মূর্তি দিয়ে ভরে ফেলছো। কী সুন্দর লাগছে শহরটা! মায়াপুরী হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
সক্রেটিস বলল, আমি হলাম কুট্টি জাতের শিল্পী, আমাকে একজন কারিগর বলতে পার। এথেন্সকে যিনি সত্যই মায়াপুরী বানাচ্ছেন, তার নাম ফিডিয়াস।
সিমন বলল, ফিডিয়াস? তিনি কে?
সক্রেটিস বলল, ফিডিয়াস হলেন সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাস্কর এবং স্থপতি। এই চারদিকে নতুন যত মূর্তি আছে, সব তার বানানো। গত পাঁচ বছরে এথেন্সকে বদলে দিয়েছেন তিনি। তিনি যে পাথরে হাত দেন, সেটিই কথা বলতে শুরু করে। এথেন্সের রাস্তাঘাট, দালানকোঠা সব বদলে দিচ্ছেন ঐ লোক। নতুন নতুন নকশা আর কারুকাজে সেজে উঠছে এথেন্স
সিমন বলল, তিনি একা এত কিছু কীভাবে করছেন? পাথর চাঁচতেই তো দিন পার হওয়ার কথা।
সক্রেটিস বলল, এখন আর তিনি নিজে পাথর চাঁচেন না। তার বিরাট কারখানা। কারখানা বলা ঠিক হবে না। বলতে পার মূর্তিখানা। তার মূর্তিখানায় কয়েকশ শিল্পী দিন-রাত কাজ করে। ফিডিয়াস শুধু নকশা করেন, আর দরকার পড়লে শেষের ছোঁয়া দেন।
সিমন বলল, তাহলে ফিডিয়াস তো বিরাট ধনী লোক। তিনি এত পয়সা কোথায় পান?
সক্রেটিস আর ক্রিতো দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
ক্রিতো বলল, আরে ব্যাটা পাদুকা শিল্পী, তুমি তো দেখি শিল্পীদের টাকা- পয়সার ব্যাপারে খুবই কাঁচা। এই বুদ্ধি নিয়া ব্যবসা করলে কপালে দুর্ভোগ আছে।
সিমন বলল, কিছু ভুল বলেছি? মূর্তি বানানোর টাকা ফিডিয়াস দেন না?
ক্রিতো বলল, না, দেন না। টাকা দেন পেরিক্লিস। সরকারি টাকা। এথেন্স সরকারের টাকা। পেরিক্লিস নিজের পকেট থেকেও অনেক টাকা দেন।
সিমন বলল, পেরিক্লিস নিজের পয়সায় এথেন্সকে সাজাচ্ছেন?
ক্রিতো বলল, ঘটনা হলো, পেরিক্লিসের কাছে এথেন্স একটি সুন্দরী নারী। শুধু সুন্দরী নারী নয়, পেরিক্লিসের প্রেমিকা বলতে পার। এক সকালে উঠে তার মাথায় এলো— তার প্রেমিকা এথেন্সকে অপরূপ করে সাজাতে হবে। সাজানোর জন্য ডাক দিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা শিল্পী ফিডিয়াস সাহেবকে। সেই হিসেবে ফিডিয়াস হলো এথেন্সের এক নম্বর সৌন্দর্যবিদ। বিউটিশিয়ান বলতে পার। আর সক্রেটিসের মতো শিল্পীরা হলো তার চ্যালা।
সিমন বলল, ফিডিয়াসকে একদিন দেখতে চাই। গুণী মানুষ দেখলে পুণ্য লাভ হয়। তার হাতের সাথে আমার হাতটা একটু ঘষা দেব।
ক্রিতো বলল, সেই ব্যবস্থা সক্রেটিসই করতে পারে। সক্রেটিস তো ফিডিয়াসের কারখানায় কাজ করেছে।
সিমন বলল, সক্রেটিস তো দেখি ঘাঘু জিনিস। বাপ রে বাপ, তুমি ফিডিয়াসের শিষ্য?
সক্রেটিস বলল, না না, আমি ফিডিয়াসের শিষ্য নই। সেই কপাল আমার হয়নি। ঘটনা হলো, ফিডিয়াস সাহেব আমাদের প্রজন্মের শিল্পীদের গুরু। এথেন্সে এখন যত শিল্পী আছে, ছোটবেলায় ফিডিয়াস নাম শুনতে শুনতে এদের সবার কান ঝালাপালা হয়ে যেত। সবার বাবা-মা বলতেন, ‘শোন বাবা, শিল্পী হতে চাও? তাহলে যাও, ফিডিয়াসকে একটি সালাম করে আসো। দেবতাকে বলো, হে দেবতা, আমাকে ফিডিয়াসের মতো বানিয়ে দাও’। আমার নিজের বাবাও সেই রকম মানুষ। সকাল বিকাল ফিডিয়াসের গুণগান করেন। তিনি বলেন, ফিডিয়াসের হাতে জাদু আছে, ও হাত দিলেই পাথর কথা বলে। ও নাকি যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর শিল্পী। বাবা আমাকে মাঝে মাঝে তার কারখানায় নিয়ে যেতেন। টুকটাক কাজ করেছি সেই মূর্তিখানায়।
সিমন বলল, তাহলে ফিডিয়াস একাই বদলে দিয়েছেন এথেন্সের মূর্তিশিল্প?
সক্রেটিস বলল, ফিডিয়াস এখন এক নম্বর। তবে তার আগে আসল কাজটা করেছেন কয়েকজন। তারা মিশরীয় প্রাণহীন মূর্তিতে প্রাণ দিয়েছেন।
‘তারা কারা?’
সক্রেটিস বলল, তারা কয়েকজন। একজনের নাম ক্রিটিয়াস। তোমরা এক্রোপলিশের উপর একটি বাচ্চা ছেলের মূর্তি দেখেছ। কী সুন্দর বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি করেছেন ক্রিটিয়াস। এজন্য মূর্তিটির নাম ক্রিটিয়াসের বালক (Kritios Boy)। এই ছোট্ট মূর্তিটিই পৃথিবীর প্রথম মূর্তি যেটি বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতেই প্রথম শরীরের মাপ, হাত-পা, চোখ-কান, নাক সবকিছুর অনুপাত সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে। শরীরের মাপ নিয়ে পলিক্লিটাস নামক আরেক শিল্পী একটি বই লিখেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গের মোটামুটি একটি মাপ আছে, একটি অনুপাত আছে। এই অনুপাতকে বলে কন্ট্রাপোস্টো (contrapposto)। সেই অনুপাত ঠিক রেখে মূর্তি বানাতে পারলেই মূর্তি সবচেয়ে সুন্দর হয়। পলিক্লিটাস এই মাপে ব্রোঞ্জ দিয়ে মানুষের সমান উঁচু করে বানালেন একজন বর্শা-বাহকের (Doryphoros) ভাস্কর্য। এটি আগোরাতে ঢোকার রাস্তায় আছে। তোমরা দেখেছ। এটির দিকে তাকালে মনে হয়— যেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা চলছে, চলতে চলতে কারও সাথে কথা বলছে। শরীরের মাপের এই অনুপাতের হিসাব ভাস্কর্য শিল্পকেই বদলে দিয়েছে। এখন সব মূর্তি এই হিসাবেই হয়। সেজন্যেই এথেন্সের মূর্তিগুলো অবিকল মানুষের মতো। তোমরা আর একটি সুন্দর মূর্তি দেখেছ। বাঁকা হয়ে ডিসকাস বা চাকতি নিক্ষেপ করছে একজন খেলোয়াড়। চাকতি-নিক্ষেপের এই মূর্তি করেছেন মিরন নামক আর একজন শিল্পী। তিনিও শরীরের মাপের অনুপাতে এই মূর্তি করেছেন। তাদের পথ ধরে এসব নিয়ম কাজে লাগিয়ে ফিডিয়াস এখন তৈরি করছেন একের পর এক চোখ জুড়ানো মূর্তি।
সিমন বলল, ওরে বাবা! এথেন্সে কত কিছু ঘটছে! মূর্তি নিয়েও হচ্ছে কত চকমারী কাণ্ড। যাক সেসব, সক্রেটিস, এখন তোমার নিজের মূর্তির কথা বলো। তোমার কাজ কেমন চলছে?
সক্রেটিস আকাশের দিকে তাকাল। কিছুই বলছে না।
সিমন আবার বলল, বলবে না? তোমার নিজের মূর্তি নিয়ে তোমার মুখে একটি কথাও শুনিনি। মূর্তি বানাতে তোমার বুঝি ভালো লাগে না?
সক্রেটিস বলল, না না, মূর্তি করতে আমার ভালো লাগে। আমার হাতও মন্দ নয়। তিন অপ্সরার একটি মূর্তি বানানো শুরু করেছি। মনে হচ্ছে জিনিস ভালো হবে। তোমরা চোখ ফেরাতে পারবে না। কিন্তু মূর্তি নিয়ে আমি বড় ঝামেলায় আছি।
‘কী ঝামেলা?’
‘মূর্তি বানিয়ে যখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরি, তখন কেমন একটি শব্দ শুনতে পাই। কে যেন ডাকে। অস্ফুট স্বরে কী সব বলে। কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। কেমন বেহুঁশ বেহুঁশ হয়ে যাই। চারিদিকের জিনিস অর্ধেক টের পাই, অর্ধেক পাই না। তারপর এক সময় হঠাৎ করে চেতনা ফিরে আসে।’
সিমন বলল, এটি তো ধ্যান।
‘না না, ধ্যান কোত্থেকে করব? ধ্যান করতে এক জায়গায় মনোযোগ দিয়ে বসতে হয়। আমি তো দুই দণ্ডও একখানে বসে থাকতে পারি না। সারাদিন টইটই করি। এটাকে ধ্যান বলে না।’
‘তোমার শরীর ছোটাছুটি করে। কিন্তু মন এক বিষয়েই চিন্তা করতে থাকে। এটিও এক রকমের ধ্যান।’
‘তাই নাকি? এমন করে ধ্যান হয়?’
‘হুঁম, ব্যাপারটা অদ্ভুত। মানুষ ধ্যান করে বসে বসে, আর সক্রেটিস ধ্যান করে হেঁটে-হেঁটে। দৌড়ে-দৌড়েও ধ্যান করে।
‘ধ্যান-ট্যান জানি না। আমি শুধু জানি চেতনা ফিরলে আমার একটি কথাই মনে হয়।’
‘কী কথা?’
‘মনে হয় আমি সুন্দর মূর্তি বানাতে চাই না, সুন্দর জীবন বানাতে চাই।’
‘সুন্দর জীবন?’
‘হ্যাঁ, সুন্দর জীবন। আমার মনে হয় সুন্দর মূর্তি করার চেয়ে জীবন সুন্দর করা লক্ষ গুণ বেশি জরুরি।’
সিমন বলল, সুন্দর জীবন মানে তো বীরের জীবন। মহাবীর একিলিসের মতো জীবন।
‘না, সুন্দর জীবন মানে শুধু বীরের জীবন নয়। সুন্দর জীবন মানে ন্যায়ের জীবন, সত্যের জীবন। সুন্দর জীবন মানে কঠিন এবং সহজ সব অবস্থায় সত্য ও ন্যায়ের হাত ধরে থাকা জীবন। কেউ বাধ্য করবে না, তবু নিজে থেকেই সত্যের পথে থাকাই সুন্দর জীবন।’
সিমন ও ক্রিতো তেমন বুঝতে পারছে না। সক্রেটিস নতুন একটি কথা বলছে— সুন্দর জীবন। এমন কথা আগে কেউ বলেনি। গ্রিকদের কাছে বীর হওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। হোমারের একিলিস সবার রোল মডেল। তার জীবনই শ্রেষ্ঠ জীবন। গ্রিসে কোনো ধর্ম গ্রন্থ নেই। ধর্ম গ্রন্থে মানুষের জন্য ভালো-খারাপ কাজের নির্দেশ থাকে। খুব ছোটবেলা থেকেই একটি নীতিজ্ঞান মাথায় ঢুকে যায়। কিন্তু এখানে সেটি নেই। এখানে সবাই একিলিসের মতো বীর হতে চায়। দেবতাদের মতো ক্ষমতাশালী হতে চায়। তাদের কাছে সেটিই সবচেয়ে ভালো জীবন।
কিন্তু সক্রেটিসের সুন্দর জীবন মনে হচ্ছে অন্য জিনিস। সুন্দর জীবন মানে বীর হওয়া নয়, ভালো মানুষ হওয়া। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সিমনের খটকা কাটছে না। সিমনের ইচ্ছা করছে, সুন্দর জীবন কী সেটি বের করতে সক্রেটিসের সাথে প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা শুরু করতে। ‘সক্রেটিক মেথড’ দিয়েই বের করা যায়। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। সে ভাবছে— এখন থাক্। সক্রেটিসের সাথে কয়েক দিন ঘুরলেই সুন্দর জীবন কী, সেটি বুঝে যাবে।
.
সক্রেটিসের হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে। গত কয়েক মাস সে পাগলের মতো দিন-রাত কাজ করছে। ছেনি দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা পাথর চেঁচেছে। তিনটি মেয়ের মূর্তি বানাচ্ছে। মূর্তির নাম তিন অপ্সরা বা থ্রি গ্রেসেস। মূৰ্তি প্ৰায় শেষ। সক্রেটিস মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর হয়েছে দেখতে! অপূর্ব! নিজের কাজের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সমস্যা হলো— এই অপ্সরা যত সুন্দরই হোক না কেন, সে কথা বলে না। সে মানুষের মতো অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে না।
সক্রেটিস মূর্তির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে অপ্সরা, বল তো আমি কে?
অপ্সরা কোনো কথা বলল না।
সক্রেটিস আবার বলল, এই মেয়ে, বল তো, সুন্দর জীবন কী?
এবারও মেয়ে কোনো কথা বলল না।
সক্রেটিস রাগ করে বলল, ধুর, কী সব পাথর-টাথরের পিছে সময় নষ্ট করছি! আর এসব করব না। এ কাজ করার জন্য আমার জন্ম হয়নি। আমি কাজ করব মানুষ নিয়ে। মানুষকে নতুন কিছু শেখাব। আমি কাজ করব জীবন নিয়ে। জীবনকে সুন্দর করব। এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
সে হাঁটছে আর বিড়বিড় করে বলছে, আমি আর মূর্তির কারিগর হব না। আমি জীবনের কারিগর হব। সুন্দর মূর্তি বানাব না। সুন্দর জীবন বানাব
এখন সমস্যা হলো, এ কথা বাবাকে কী করে বলবে? বাবা আগুন হয়ে যাবেন। সে আগুনে সক্রেটিস ভস্ম হয়ে যাবে। সক্রেটিস ভাবছে। একটি বুদ্ধি দরকার। এমন করে বলতে হবে, যাতে মা পক্ষে থাকে। মাকে দিয়ে বলাতে পারলে, অর্ধেক কষ্ট কমে যাবে। অনেক ভেবে সে একটি ফন্দি করল।
ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরে বাবার কাছে গিয়ে বলল, বাবা, একটি ঘটনা আছে। বাবা বললেন, ঘটনা তো প্রতিদিনই হচ্ছে। নালিশ কুমারের জন্য ঘটনা আবার নতুন কী? নতুন নালিশ আসবে, সেই ঘটনা?
‘না, নালিশ-টালিশ নয়। ঘটনা হলো আমি আমার বাবার চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসি।’
সক্রেটিসের বাবা বললেন, এটি আবার কোনো ঘটনা নাকি? সব ছেলেই তার বাবার চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসে। আমিও আমার বাবার চেয়ে মাকে বেশি ভালোবাসতাম।
‘আপনি মাকে বেশি ভালোবাসতেন ঠিকই, কিন্তু আমি আপনার চেয়েও আমি মাকে বেশি ভালোবাসি।’
‘বেশ, তাহলে তুমি শুধু নালিশ কুমার নও, তুমি হলে মাতৃভক্ত নালিশ কুমার। ত ‘বাবা, আপনি মাকে ভালোবাসলেও, আপনি কিন্তু বাবার কাজটাই করেন। আপনার বাবার যে পেশা ছিল, আপনারও একই পেশা।’
‘হ্যাঁ, সবাই তো সেটিই করে।’
‘না, আমি আমার মাকে এত বেশি ভালোবাসি যে আমি আর আমার বাবার পেশায় থাকব না। আমি আমার মায়ের পেশা গ্রহণ করব।’
বাবা বুঝতে পারছেন না ছেলে কী বলছে। তিনি বললেন, মায়ের পেশা মানে কী? তোর মা তো একজন ধাত্রী।
‘হ্যাঁ, আমিও ধাত্রী হব।’
‘তুই ধাত্রী হবি?’
‘হ্যাঁ, আমিও ধাত্রী হব। আমার মা যেমন সন্তান জন্ম দিতে সাহায্য করে, তেমনই আমিও জ্ঞানের জন্ম দিতে সাহায্য করব।’
বাবা কিছুক্ষণ স্তব্ধ বসে রইলেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন বললেন, মাথা তো পুরোই গেছে। তুই অনেক দিন ধরেই জ্ঞান জ্ঞান করছিস। আমি কি বাধা দিয়েছি? এখন নতুন নছল্লা শুরু করছিস। ঠিক আছে যা, আজ থেকেই তুই ধাত্রী। এখন দূরে যা। বিরক্ত করিস না।
‘আমি আর মূর্তি বানাব না।’
‘ও, এটি হলো আসল কথা।’
বাবা এবার মাকে ডাক দিল, শোনো, তোমার ছেলে আর কাজ-কর্ম করবে না। তাই ধানাই পানাই করছে।
সক্রেটিস বলল, না, না। কাজ তো অবশ্যই করব। অন্য কাজ করব। ‘অন্য কী কাজ?’
‘আমি কারিগরই থাকব। কিন্তু মূর্তির কারিগর নয়, জীবনের কারিগর।’
‘জীবনের কারিগর? সেটি আবার কী বস্তু?’
‘সেটি হলো, আমি আর সুন্দর মূর্তি বানাব না, সুন্দর জীবন বানাব।’
‘সুন্দর জীবন বানাবি? তোর জীবন কি অসুন্দর?’
‘আমার জীবন নয়, মানুষের জীবন সুন্দর বানাব।’
‘মানুষের জীবন? কার জীবন? কে তোকে কাজ দিল জীবন সুন্দর করার? বেতন কত দেবে?’
‘কেউ কাজ দেয়নি। আমি নিজেই ঠিক করলাম, আমি মানুষের জীবন সুন্দর করতে কাজ করব।’
এবার বাবা ধমক দিয়ে বললেন, ‘মূর্তি বানাতে না চাইলে না বানাবি। সেজন্য বাবার সাথে ধানাই-পানাই? এসব সুন্দর জীবন, উন্নত জীবনের গল্প বাবাকে বলে না। বাবা তোমার অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছে।’
সক্রেটিস ভাষাহীন। তার মুখের কথা হারিয়ে গেছে। জীবনে এই রকম নাকাল সে কোনোদিন হয়নি। পৃথিবীর ঝানু ঝানু পণ্ডিতকে সে রাস্তায় কাঁদিয়েছে। তার ঠোঁটের আগায় সবসময় যুক্তি তৈরি থাকে। আর বাবার সোজা কথার উত্তর দিতে পারছে না?
এতক্ষণ মা চুপ করে ছিল। এবার মা বললেন, আর মূর্তি বানাবি না? এত কষ্ট করে বাবা তোকে কাজ শিখিয়েছেন। বাবার পেশাকে অসম্মান করছিস?
‘না মা, অসম্মান করিনি। তুমিই বলো— মূর্তির কারিগরের বাবা হওয়া ভালো, নাকি জীবনের কারিগরের বাবা হওয়া ভালো?’
বাবা বললেন, শোন। এসব ভুংভাং আলাপ বাবা-মায়ের সাথে করে না। তোর মূর্তির হাত ভালো। যখন ভালো লাগে তখনই মূর্তি বানাবি। বাকি সময় জ্ঞান নিয়ে থাকিস। সারাদিন সুন্দর জীবন, উন্নত চরিত্র এগুলো সব করিস। মূর্তি বানানো একেবারে ছেড়ে দিস না।
সে ভাবছে, কেমন জ্ঞানী হলাম, নিজের বাবাকে একটি ছোট্ট কথা বোঝাতে পারলাম না।