১৪
‘দুঃখের রাত বন্ধুহীন হয়।’
—পিনডার
***
ঘুটঘুটে অন্ধকার।
খুব কাছের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। পেরিক্লিস আসপাশিয়ার ঘর থেকে বের হলেন মুখ ঢেকে। বের হয়েই চট করে গাড়িতে উঠে পড়লেন। গাধায় টানা গাড়ি। আজ তিনি ঘোড়ার গাড়ি আনেননি। এথেন্সে মাত্র বারোজন লোকের ঘোড়ার গাড়ি আছে। পেরিক্লিস তাদের একজন। তার গাড়ি এথেন্সের সবাই চেনে। তাই ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে কেরামেকাসের মতো নিষিদ্ধ পল্লিতে আসা যায় না।
গোপন চলাচলের জন্য সবচেয়ে ভালো হলো গাধার গাড়ি। গাধার গাড়ি অনেকেরই আছে। হঠাৎ দেখে লোকে সহজে চিনবে না। তাই পেরিক্লিস আজ গাধার গাড়ি নিয়েছেন। গাড়ির চারপাশে পর্দা লাগানো। গাড়ির কোচওয়ানও একদম নতুন। নতুন কোচওয়ানকে এথেন্সের লোক চেনে না। গাড়ির ভেতর জরুরি আলোর ব্যবস্থা আছে। খুব দরকার হলে জলপাই তেলের ছোট্ট কুপি জ্বালিয়ে নিতে হয়। আজকের আসা-যাওয়া গোপন বিষয়। আলো জ্বালানোর কথা নয়। কিন্তু আসপাশিয়া পেপিরাস কাগজে কী লিখেছে সেটি জানার জন্য পেরিক্লিস ছটফট করছেন। তিনি জরুরি কুপি জ্বালালেন।
কী লিখেছে আসপাশিয়া? মনে হয় প্রেমপত্র ধরনের কিছু। চিঠিতে আসপাশিয়া তাকে কী সম্বোধন করেছে? প্রিয়তম, নাকি জনাব? প্রিয়তম শোনার মতো বয়স কি তার আছে? আর জনাব তো তাকে সবাই বলে। আসপাশিয়ার মুখে জনাব মানাবে না! জনাব বড় ভারী শব্দ। সুন্দর মেয়ের নরম মুখে মানায় না।
পেঁচানো পেপিরাস খুললেন পেরিক্লিস। সেখানে প্রিয়তম বা জনাব কোনোটাই নেই। পেপিরাসে প্রথম লাইন বড় করে লেখা—
‘এথেন্স : গণতন্ত্র আবিষ্কারের নগর।’
আসপাশিয়া প্রেমপত্র লিখেনি। পেরিক্লিস আজ সন্ধ্যায় যা বলেছেন, আসপাশিয়া মোটামুটি তার একটি সারাংশ লিখে ফেলেছে। এথেন্সের গণতন্ত্র আবিষ্কারের ইতিহাস দুটো পেপিরাস টুকরায় লিখে ফেলেছে আসপাশিয়া।
পেপিরাস টুকরার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন পেরিক্লিস। এই মেয়ে তো অবিশ্বাস্য রকমের মেধাবী। পেরিক্লিস অনেক বড় বড় যুদ্ধ জিতেছেন। সারা পৃথিবীর জ্ঞানী গুণী মানুষের সাথে তার ওঠাবসা। তার বন্ধুরা পৃথিবীর সেরা শিল্পী, সেরা গায়ক, সেরা রাষ্ট্রনায়ক, সেরা দার্শনিক। কিন্তু আজ আসপাশিয়া যা করেছে, সেটি অসাধারণ। এটুকু সময়ের মধ্যে পেরিক্লিসের মুখে শুনে গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে ফেলার মতো মেধাবী মানুষ তিনি দেখেননি। পেরিক্লিস লেখাটা আগাগোড়া দুইবার করে পড়লেন। অপূর্ব। তেমন কোনো কাটা-ছেঁড়া নেই। ছোট ছোট কথায় কত সহজে লিখে ফেলেছে মেয়েটি।
এরকম নারী এই এথেন্সেই আছে? আর পেরিক্লিস সেই নারীর কাছ থেকে দূরে আছেন? না, আর দূরে থাকবেন না। এখনই ছুটে যাবেন। তিনি গাড়োয়ানকে বললেন, গাড়ি ঘুরাও, আবার কেরামেকাসে চলো।
গাড়োয়ান অবাক। পেরিক্লিসের মাথা কি নষ্ট হয়ে গেছে? ঐরকম নিষিদ্ধ জায়গায় আবার যেতে বলছেন। গাড়োয়ান একটু সাহস দেখাল। বলে ফেলল, হুজুর, আজ জোছনা রাত। মানুষে চিনে ফেলবে।
গাড়োয়ানের দিকে তাকালেন পেরিক্লিস। একটি বাধা খুব দরকার ছিল। ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। গাড়োয়ানের কথা মানলেন তিনি। বললেন, ঠিক আছে। বাড়ি চলো। গাড়োয়ান আবার বলল, কুপিটাও নিভিয়ে দিলে ভালো হয়।
এবারও তার কথা মানলেন পেরিক্লিস। এখন তিনি প্রেমিক মানুষ। প্ৰেমে পড়লে সবার কথা শুনতে হয়।
.
সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুম হলো না পেরিক্লিসের। অনেকবার বিছানায় গেছেন। কিন্তু ঘুমাতে পারেননি। মস্তিষ্ক বলছে, ঘুম চাই। কিন্তু হৃদয় বলছে, আসপাশিয়াকে চাই। ঘুমও আসেনি, আসপাশিয়াকেও পাননি। এক সন্ধ্যায় তার পৃথিবী বদলে গেছে। আসপাশিয়াকে ছাড়া তার চলবে না। তাহলে তার স্ত্রীর কী হবে? তার নয় বছরের সুখী সংসার। দুটো ছেলে। এই মুহূর্তে স্ত্রী বাবার বাড়ি গেছে। সে ফিরে আসার আগেই কিছু একটা উপায় বের করতে হবে। ভালো কারও পরামর্শ দরকার।
পরামর্শের জন্য তার গুরু এনাক্সাগোরাস আছেন। দার্শনিক মানুষ। মাথা ভর্তি বুদ্ধি। যেকোনো সমস্যায়, একটি না একটি কায়দা সে বের করেই। তার বুদ্ধিতেই পেরিক্লিস নেতা হয়েছেন। পেরিক্লিস গোপনে তাকে মুশকিল আসান গুরু বলেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই গুরু মেয়েদের বিষয়ে কিছুই জানেন না। গুরু বিয়ে করেননি। প্রেম তার দুই চোখের বিষ। নারী তার কাছে নরকস্য দ্বার। এই মানুষ আসপাশিয়া বিষয়ে কোনো পরামর্শ দিতে পারবেন?
পেরিক্লিস দোনোমনো করতে করতে গুরুর ঘরে গেলেন। উদ্দেশ্য আসপাশিয়া বিষয়ক সংলাপ। একটু লজ্জা লাগছে। গুরুর কাছে প্রেমের কথা বলা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু গুরুকে কিছুই বলতে হলো না। আসপাশিয়ার খবর তিনি জেনে গেছেন। এথেন্সের সবাই জেনে গেছে। এক সন্ধ্যায়ই এই খবর সবার কাছে চলে গেছে। খবর যত গোপন হয়, তার পাখা তত হালকা হয়, তত তাড়াতাড়ি ওড়ে।
গুরু বললেন, শোন, পেরিক্লিস। মেয়েমানুষ হলো আগুন, পুরুষ হলো ঘি। তো তুমি ঘি হয়ে আগুনের কাছে গিয়েছো, তাই কিঞ্চিৎ গলে গিয়েছো। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তুমি কোনো লজ্জা কোরো না। লজ্জার কিছুই নেই। সৃষ্টির নিয়মই এই রকম।
পেরিক্লিস চুপ করে শুনছেন।
গুরু মহা উৎসাহ নিয়ে বলছেন, এখন ঘি কতক্ষণ আগুনে পুড়বে, সেটি তোমার বিবেচনা। তুমি তো বোকা ঘি নও, তুমি হলে সুচতুর ঘি। চতুর ঘি বেশিক্ষণ আগুনে পোড়ে না। সময় হলেই ফুৎ করে ফুঁ দেয়। ঝামেলা খতম। তো তুমিও ফুঁ দেও, আসপাশিয়ার কাহিনি এখানেই শেষ।
পেরিক্লিস মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
গুরু আবার বললেন, ফিরে এসো পেরিক্লিস। তুমি ফিরে এসো। তুমি গণতন্ত্রের নেতা। লোকে আদর করে তোমাকে বলে গণতন্ত্রের বরপুত্র। গণতন্ত্র অনেক সাধনা করে তোমাকে পেয়েছে। তোমাকে এথেন্সের ভীষণ প্রয়োজন। এক নারী গেলে শত নারী আসবে।
গুরু তাকে নীতিকথা শোনাচ্ছেন! তাকে শিশুশ্রেণির ছাত্র মনে করছেন? ঘি আর আগুনের তত্ত্ব দিচ্ছেন? গুরুর কাছে আসপাশিয়া বিষয়ে কোনো সমাধান নেই। যিনি সংসার করেননি, তার কাছে সংসার বিষয়ে পরামর্শ করতে আসাই ভুল হয়েছে। এমন কারও সাথে কথা বলতে হবে, যে সংসার করেছে আর সেই সাথে প্রেমিক হিসেবেও যার সুনাম আছে। এমন লোক একজনই আছে এথেন্সে। তার নাম ডেমন।
ডেমন[৫১] এথেন্সের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক। তার সুর একবার শুনলেই মেয়েরা তার প্রেমে পড়ে। এথেন্সের অনেক নারীই নাকি ডেমনের প্রেমিকা। কিন্তু এথেন্সের আইনে মেয়েরা ঘরের বাইরে আসতে পারে না, তাই সেসব প্রেমের কথা মানুষ জানে না।
পেরিক্লিসের খুবই অন্তরঙ্গ মানুষ ডেমন। বয়সে তার থেকে একটু বড়। ছোটবেলায় তার কাছে গান শিখেছেন। গুরুর মতোই ডেমনও তার বিপদ- আপদের সঙ্গী। পেরিক্লিস তক্ষুনি ডেমনকে আনতে দাসকে পাঠালেন। দুই বাড়ি পরেই ডেমনের বাড়ি। দশ মিনিটেই ডেমন হাজির হলেন। ডেমনকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন পেরিক্লিস। চিৎকার করে বললেন, বন্ধু, গণতন্ত্রে আমরা কত বড় বড় কাজ করছি। কিন্তু নারীদের নিয়ে তো কিছুই করতে পারলাম না। নারীদের কোনো দামই নেই আমাদের কাছে।
ডেমন হাসতে হাসতে বললেন, নারীটি কি আসপাশিয়া?
ডেমনও ঘটনা জানেন? কারও জানতে বাকি নেই। আর রাখ-ঢাকের দরকার নেই। ডেমনের হাত ধরে পেরিক্লিস বললেন, বন্ধু তুমিই বলো, আমার কী করা উচিত? আসপাশিয়াকে ছাড়া যে আমার চলবে না।
ডেমন গায়ক মানুষ। একটু গুনগুন করছেন। তার হাতের আঙুলগুলো নড়ছে। গভীর কোনো চিন্তায় পড়লে তার গায়কসত্ত্বা জেগে ওঠে, আঙুলে তাল খেলতে থাকে। নতুন বুদ্ধি না আসা পর্যন্ত তাল চলতে থাকে। প্যাঁচ খুলে গেলেই আঙুল থেমে যায়। আসপাশিয়ার বিষয়ে প্যাঁচ মনে হয় খুলে গেছে। ডেমনের আঙুল এখন বন্ধ।
তিনি গায়ক। সব সময় সুর তাল ছন্দ মিশিয়ে কথা বলেন। তিনি বললেন, পেরিক্লিস, ধরো, তোমার কাছে দুটি গানের কলি একটি আসপাশিয়া আর অন্যটি এথেন্স। তুমি কোন গানটা গাইবে?
অস্ফুট স্বরে পেরিক্লিস বললেন, দুটোই।
ডেমন বললেন, তাহলে আসপাশিয়াকে তোমার ঘরে নিয়ে আসার সময় হয়েছে।
‘কিন্তু কীভাবে? সেই পথ তো আমিই বন্ধ করেছি। দু’বছর আগে আমিই আইন করেছি এথেন্সের কোনো নাগরিক এই নগরের বাইরের কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। আসপাশিয়া তো এথেন্সের মেয়ে নয়। তার জন্ম মিলেটাস শহরে।
‘তুমি নিজের পায়েই কুড়াল মেরেছ।’
‘তা তো মেরেছিই। এখন সেই কুড়াল ছুটাব কী করে সেই বুদ্ধি বাংলাও।’
‘আইন বদলাও। বলো, এখন থেকে বিদেশি বিবাহ করা জায়েজ।’
‘সেটি সম্ভব নয়। সবাই আসপাশিয়ার কথা জানে। বুঝে যাবে যে আমি তাকে বিয়ে করতেই আইন পাল্টাতে চাচ্ছি। কেউ ভোট দেবে না।’
‘তাহলে একটিই উপায়।’
‘কী উপায়?’
‘তোমরা যে বিয়ে করেছ, সেটি মানুষকে জানাবে না।’
‘গোপনে বিয়ে করব?’
‘তুমি আসপাশিয়াকে ঘরে নিয়ে এসো। তুমি ভাববে পত্নী। আর লোকে ভাববে উপপত্নী। তুমিও খুশি, লোকেও খুশি।’
‘এটি সম্ভব?’
‘শুধু এটিই সম্ভব। অন্য কিছু সম্ভব নয়। এথেন্সবাসী উপপত্নী মেনে নেবে। কিন্তু পত্নী হিসেবে আসপাশিয়াকে মানবে না।’
মনে মনে খুশি পেরিক্লিস। ডেমন আসলেই একটি জিনিস। প্রেমের প্যাঁচ ছাড়াতে তার মতো আর কেউ নেই। কিন্তু খুশি প্রকাশ করলেন না।
গম্ভীর মুখে বললেন, তোমার বুদ্ধিতে অর্ধেক প্যাঁচ খুলবে। বড় প্যাঁচটা এখনও বাকি।
‘বড় প্যাঁচ কোনটা?’
‘আমার তো স্ত্রী আছে। তার কী হবে?’
ডেমনের আঙুলে আবার তাল খেলছে। গভীর চিন্তা করছেন। তার আঙুল চলতে দেখলে পেরিক্লিস ভরসা পান। সমাধান আসবে।
কিন্তু না, সমাধান এলো না। সমাধান আসার আগেই সেখানে এলো ফিডিয়াস। পেরিক্লিসের আরেকজন কাছের মানুষ শিল্পী ফিডিয়াস। তার হাতে এথেন্সের নতুন নকশা। এথেন্সকে সাজাতে তিনি ডিজাইন করছিলেন। আগোরার কোন ভবনের সামনে কী কী মূর্তি বসবে, কোনটা কী রঙের হবে সেসবের নকশা। পেপিরাস কাগজের উপর নানা রঙের আঁকিবুকি।
নকশা বের করতেই ডেমন বললেন, রাখো তোমার আগোরার নকশা। আগে পেরিক্লিসের জীবনের নকশা ঠিক করো।
ফিডিয়াস কিছুই বুঝতে পারছে না। পেরিক্লিসের সংসার দুপুরবেলার সাগরের মতো স্বচ্ছ। বউ আর দুই ছেলে নিয়ে সুখের ঘরকন্না। তাতে কোনো ঝড় আসতে পারে সেটি কেউই ভাবতেই পারে না। শিল্পী ভাবছে, সামনের নির্বাচনে পেরিক্লিস জিততে পারবে কিনা সেটি নিয়ে তারা ভাবছে।
ফিডিয়াস বললেন, মানুষ চোখ বুজে পেরিক্লিসকে ভোট দেবে, এটি নিয়ে কোনো নকশা লাগবে না।
পেরিক্লিস আর ডেমন দুজনেই হেসে উঠলেন। তখন ডেমন শিল্পীকে আসপাশিয়ার ঘটনা বললেন। ঘটনা শুনে শিল্পী একটি পেপিরাসে আঁকিবুকি শুরু করল। মনে হচ্ছে সে সত্যিই পেরিক্লিসের জীবনের ডিজাইন করছে। ভাবভঙ্গি খুব সিরিয়াস। ঘচাঘচ দাগ টেনে তিনজন মানুষ এঁকে ফেলল। বোঝা যাচ্ছে— এরা পেরিক্লিস, তার স্ত্রী এবং আসপাশিয়া। তাদেরকে লাইন টেনে যোগ-বিয়োগ করছে। হঠাৎ বলল, মিলে গেছে, পেরিক্লিসের জীবনের নকশা মিলে গেছে। আর একজন মানুষ লাগবে।
ডেমন বললেন, আর একজন মানুষ দিয়ে কী হবে।
শিল্পী বলল, সেই মানুষটি পেরিক্লিসের স্ত্রীকে বিয়ে করবে। পেরিক্লিস, তোমার বউকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।
‘মানে?’
‘মানে হলো— আসপাশিয়াকে ঘরে আনার আগেই তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলো। এথেন্সে তো তালাকের নিয়ম নেই। একমাত্র উপায় হলো, অন্য একজনের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দাও।’
শিল্পীর কথা শুধু হাস্যকরই নয়, অসম্ভবও। কিন্তু এই হাস্যকর অসম্ভব কাজটাই সম্ভব করে ফেললেন পেরিক্লিস। প্রেমের মাঠে তিনি নতুন। কিন্তু রাজনীতির মাঠে নতুন নন। ঘরের রাজনীতিতেও সফল হলেন তিনি। এক সপ্তাহের মধেই স্ত্রীর সাথে অন্য এক লোকের বিয়ে হয়ে গেল। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই, শান্তিপূর্ণ মিটমাট। এথেন্সের মানুষ বলল, বাপের জন্মেও শুনিনি কেউ নিজের বউয়ের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটকালি করতে পারে। সেটিও করে দেখাল পেরিক্লিস। গণতন্ত্র যেমন এথেন্সের আবিষ্কার, নিজের বউয়ের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটকালি তেমনই পেরিক্লিসের আবিষ্কার।
***
আজ আসপাশিয়ার বিয়ে।
কিন্তু বিয়ের কোনো অনুষ্ঠান নেই। গীত হচ্ছে না। বাদ্য বাজছে না। দেবতার কাছে কোনো প্রার্থনা হবে না। হলুদ-মেহেদির স্ত্রী আচার নেই। কাউকে নিমন্ত্রণ করাও হবে না। কারণ এটি আইনি বিয়ে নয়। এথেন্সের আইনে আসপাশিয়া বিয়ে করতে পারবে না। সে আজ শুধু পেরিক্লিসের ঘরে গিয়ে উঠবে। বিকেলে পেরিক্লিসের বন্ধু ডেমন আসবেন তাকে নিতে। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে সে কেরামেকাস থেকে পেরিক্লিসের বাড়িতে গিয়ে উঠবে। এটিই তার বিয়ে।
প্রথম যেদিন পেরিক্লিস এই দিনের কথা বললেন, সেদিন আনন্দে নেচে উঠেছিল আসপাশিয়া। সে সারা জীবন এই দিনের জন্যই অপেক্ষা করেছে। তার স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে। কিন্তু দিন যত কাছে এসেছে, তার আনন্দ তত কমে এসেছে। সে পেরিক্লিসের পত্নী নয়। হবে উপপত্নী। শুধু পার্থক্য হবে সে কেরামেকাসে থাকব না। থাকবে পেরিক্লিসের ঘরে।
বিয়ের কোনো রকম আচার করতে পেরিক্লিস কড়া নিষেধ করেছেন। তাতে লোকে বুঝে যাবে যে তারা গোপনে বিয়ে করছেন। সেটি এথেন্সের আইনে অপরাধ হবে। পেরিক্লিসের ক্ষতি হবে। মামলাবাজ শত্রুর অভাব নেই। মামলা করলে সর্বনাশ হবে। তাই কোনো রকম আচার হচ্ছে না।
আসপাশিয়ার আপন দুই বোন থাকে এথেন্সে। কোনো বোনই তার বিয়েতে আসেনি। কোনো ভদ্র ঘরের নারী তার বিয়ের আচার করবে না। আসপাশিয়া নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে হাসিমুখে সব মেনে নেবে। একটুকুও কাঁদবে না। কিন্তু গত সাত দিন ধরে দিন রাত কাঁদছে।
তবে একেবারে কিছুই হবে না, এটি মেনে নিতে পারেনি আসপাশিয়া। সে বড় সাহস করে সক্রেটিসকে তার বিয়ের কথা বলেছিল। সক্রেটিস ছেলেটিকে তার পছন্দ। মনে হয় ছেলেটির সাহস আছে। সে যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারে।
সক্রেটিস চেষ্টা করেছে যদি গোপনে আসপাশিয়ার বিয়ের আচার কিছু হলেও করা যায়। কিন্তু বন্ধুরা রাজি হয়নি। ক্রিতো আগাবে না। তার পিতা মানী লোক, সে বেআইনি কাজে থাকতে পারে না। চেরোফোনও থাকবে না। তার কারণ অন্য। আশপাশিয়া তাদের অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। চেরোফোনের সেই জ্বালা মিটেনি। শুধু সক্রেটিসের নতুন বন্ধু সিমন বলেছে, সক্রেটিস যদি থাকে, তাহলে সেও থাকবে। আসপাশিয়াকে উপহার দিতে সিমন একজোড়া জুতা তৈরি করেছে। আর একজোড়া জুতা বানিয়েছে পেরিক্লিসের জন্য। সেটি এখন দেওয়া যাবে না। পেরিক্লিস জানলে তাদের বিয়েতে থাকাই বন্ধ হয়ে যাবে।
সক্রেটিস গোপনে অনেক সাহস করে তার মা আর খালাকে বলেছে। তার মা শেষ পর্যন্ত সাহস করেছেন। তিনি দয়ালু নারী। মেয়েদের বিপদে তার চোখের কোণে পানি আসে। কোনো মেয়ে বিপদে পড়েছে শুনলে, তিনি কিছু একটি না করে থাকতে পারেন না। তিনি ধাত্রী বলে বাইরে বের হলে সমস্যা নেই। সক্রেটিসের মা আর ডিওটিমা খালা গোপনে আসপাশিয়ার বিয়ের কিছু আচার করবেন।
এখানে মেয়েদের বিয়ে হয় একেবারে পুতুল খেলার বয়সে। বিয়ের আগের দিন সব পুতুল কুমারী দেবী আর্টেমিসের কাছে দিয়ে দিতে হয়। এরপর সুগন্ধি পানিতে বিয়ের গোসল করে দেবী দিমিত্রার মন্দিরে পূজা দেয়।
কথা ছিল বিয়ের আগের দিন সক্রেটিসের মা আর ডিওটিমা যাবেন আসপাশিয়ার বাড়ি। তারা তার পুতুল নিয়ে যাবেন দেবীর কাছে। তাকে সুগন্ধি পানিতে বিয়ের গোসল দেবেন। কিন্তু তারা আসেননি। আসপাশিয়া সারাদিন চোখের জলে তাদের জন্য অপেক্ষা করেছে। সন্ধ্যায় সক্রেটিস এসে বলে গেছে, তার মা কেরামেকাসে আসতে পারলেন না। বিয়ের দিন তারা দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে আসবেন, সেখানে তারা বিয়ের সব আচার করবেন।
.
বিয়ের দিন সন্ধ্যায় গাধার গাড়ি এলো আসপাশিয়াকে নিতে। চালক ডেমন। আসপাশিয়া গাড়িতে উঠে ডেমনকে বলল, আমি একটু দিতি দেবীর মন্দিরে যেতে চাই।
ডেমন বললেন, পেরিক্লিস কিন্তু অপেক্ষা করছেন। লোকজন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তোমাকে বরণ করতে।
‘মন্দিরেও তিনজন অপেক্ষা করছে।’
‘তারা কারা?’
‘সক্রেটিস, তার মা আর খালা।’
ডেমন অবাক। আইন না মেনে আসপাশিয়ার গোপন বিয়ের কাজ করছে, এমন সাহসী পরিবারও এথেন্সে আছে? তিনি চললেন দিতি দেবীর মন্দিরের দিকে।
আসপাশিয়ার দেশ মিলেটাসে এক অসভ্য প্রথা ছিল। বিয়ে ঠিক হলে সব মেয়েকে যেতে হতো দিতি দেবীর মন্দিরে। বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত মেয়েটি সেখানে সেবাদাসী হিসেবে কাজ করত। পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করত। ধনী এবং নেতাদের খুশি করত। তাতে মেয়েটি কিছু টাকা পেত। সেই টাকা আফ্রোদিতির মন্দিরে দান করলে দেবী খুশি হয়ে বিয়ে মঞ্জুর করতো। দেবী অনুমতি দিলে পরদিন বিয়ের আয়োজন হতো। এখন আর এসব প্ৰথা নেই। এখন প্রতীকী হিসেবে বিয়ের আগের দিন আফ্রোদিতির মন্দিরে কুমারীর মাথার চুলের আগা কেটে দেবীকে দান করে। তাতেই দেবী খুশি হয়ে বিবাহের অনুমতি দেয়।
আসপাশিয়া বিয়ের জন্য দিতি দেবীর অনুমতি নেবে। সক্রেটিসের মা সেখানেই বিয়ের আচার করবেন। কিন্তু মন্দিরে গিয়ে দেখল, সেখানে কেউ নেই। সক্রেটিস বা তার মা সেখানে আসেনি।
আসপাশিয়া নিজেই নিজের একটুখানি চুল কেটে দিতি দেবীকে দিল। দেবীকে ভক্তি করে দেবীর কাছে বিয়ের অনুমতি চাইল।
এথেন্সে বিয়ের সময় মেয়েরা দল বেঁধে মন্দিরে এসে বিয়ের গীত গায়। ধনীরা নাচ-গানের আয়োজন করে। আসপাশিয়া রাজরানি হতে চলেছে। কিন্তু তার বিয়েতে গীত গাওয়ার কেউ নেই। কোনো সুর নেই। তার জন্য কেউ নাচবে না। কেউ মঙ্গল প্রদীপ জ্বালবে না।
দিতি দেবীর মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছে আসপাশিয়া। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে কাঁদবে না। সে অন্য মেয়েদের মতো নয়। সে অনেক শক্ত। নতুন নিয়ম তৈরি করার জন্যই তার জন্ম। সে কিছুতেই দুঃখ পাবে না। তার ভেতর ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু চোখের বাইরে যেন এক ফোঁটা পানিও না আসে। সে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে।
হঠাৎ পেছনে একটি গুনগুন সুর শোনা গেল। অপূর্ব সুরে কে যেন বিয়ের গীত গাইছেন। তাকিয়ে দেখে গীত ধরেছেন এথেন্সের শ্রেষ্ঠ গায়ক ডেমন—
মেয়ে, কাঁদিস না রে আর
রূপের দেবী দিল বর
হবে তোর সুখের ঘর
সোনার কাঠি দু’হাতে নিয়ে
ওঠ মেয়ে— আজ তোর বিয়ে[৫২]
গান শুনতে শুনতে আসপাশিয়া দেখল সক্রেটিস আসছে। সাথে তার মা আর ডিওটিমা খালা। তাদের হাতে মঙ্গল প্রদীপ
ডেমন তখনও গাইছেন। তার সাথে সুর ধরেছে সক্রেটিস, তার মা আর খালা। ততক্ষণে আকাশে তারা উঠেছে। মন্দিরের পেছন দিকে উঁকি দিয়েছে চাঁদ। মনে হচ্ছে দিতি দেবী হাসছেন।
এবার আর কান্না থামাতে পারল না আসপাশিয়া। তার চোখ অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে।
***
৫১. ডেমন : পেরিক্লিসের বন্ধু ও সংগীতজ্ঞ।
৫২. এটি কোনো গ্রিক কবিতার অনুবাদ নয়, আসপাশিয়ার বিবাহ উপলক্ষে তাকে আমার উপহার