1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ১২

১২

‘আগে ঠিক করো তুমি কী পেতে চাও, তারপর যা কর, ওটা পাওয়ার জন্যই করো।’

— ইপিকটেটাস

***

আসপাশিয়া খুব বেশি সাজুগুজু করেনি।

হালকা সাদা পোশাক। গলা থেকে ঝুলছে একটি লাল উত্তরীয়। চুলে হাল্কা সুগন্ধি। খোঁপায় ছোট্ট একটি মালা। তাকে মন্দিরের সাধিকার মতো লাগছে। যেন পবিত্র কোনো কাজে যাচ্ছে।

সকাল থেকে সে খুশি। মহাখুশি। খুশিতে বাকবাকুম বাকবাকুম করছে। খুব ভোরে এক দাস এসে খবর দিয়ে গেছে, আজ বিকেলে পেরিক্লিস আসবেন। সেই থেকে আসপাশিয়া উড়ছে। কিছুতেই তার মন বসছে না। সে এই দিনটার আশায়ই ছিল। তার এথেন্সে আসা সার্থক হতে চলেছে।

পেরিক্লিস চোখ বন্ধ করে আছেন। আসপাশিয়া কিথারা বাজাচ্ছে। বাজাতে বাজাতে গুনগুন করে গান ধরল। মহাকবি হোমারের লেখা গান—

‘ও গো মা বসুন্ধরা, আমায় তুমি দিলে ঠাঁই
চিরকাল তোমার বুকে সুখে-দুঃখে হেসে-খেলে দিন কাটাই।
গাছে গাছে সুমিষ্ট ফল, মাঠে মাঠে ভরা ফসল
হাসিমুখ শিশু কলকল, তুমি দু’হাত ভরে দিয়েছো সদাই
চিরকাল তোমার বুকে সুখে-দুঃখে হেসে-খেলে দিন কাটাই
আজ সবাই মিলে দুহাত তুলে তোমাকেই সালাম জানাই
চিরকাল তোমার বুকে সুখে-দুঃখে হেসে-খেলে দিন কাটাই।’[৪১]

পেরিক্লিস বললেন, এই গান আগে কতবার শুনেছি! হোমারের পালা শুরু হওয়ার আগে কয়েকজন মিলে গায়। গানের সাথে অনেকে মিলে নাচে, হৈহৈ করে। আমোদ-ফূর্তি চলে। আজ তুমি একা গুনগুন করে গাইলে। মনে হলো গানটা কত গভীর। মনে হলো আমরা সত্যি সত্যি মা বসুন্ধরাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

আসপাশিয়া বলল, আজ গান ভালো লেগেছে, কারণ আজকে আপনার কান ভালো আছে। গান শুনতে কান লাগে।

‘আজকে আমার কান ভালো আছে। তো অন্যদিন কান খারাপ থাকে? আমার কান যে ঠসা, সেটি তো জানতাম না।’

পেরিক্লিস রাগ করেছেন। আসপাশিয়ার ভালো লাগল। প্রণয়ের আগে রাগ ভালো লক্ষণ।

সে বলল, ‘ঘটনা হলো, অন্যদিন গান শোনেন সভার মধ্যে। সেখানে আপনি নেতা। আর আমার কাছে আপনি শ্রোতা। গান নেতার কানে এক রকম আর শ্রোতার কানে অন্য রকম। ‘

মেয়েটির আস্পর্ধা দেখে পেরিক্লিস অবাক হচ্ছেন। গলার স্বরে একটি শাসন শাসন ভাব আছে। মেয়েটি তাকে শাসন করছে। কিন্তু সমস্যা হলো পেরিক্লিস কঠোর হতে পারছেন না। কোনো এক অজানা কারণে মেয়েটার শাসন তার ভালো লাগছে। তিনি নতুন কিছু শুনছেন। তিনি সারাদিন চাটুকারদের মধ্যে থাকেন। তিনি যা বলেন সবাই হ্যাঁ-হ্যাঁ করে। চারপাশে সব জি হুজুরের দল। কেউ নতুন কিছু শোনায় না। কেউ প্রতিবাদ করে না। এই মেয়েটি তাকে নতুন কিছু শোনাচ্ছে। মেয়েটির সাহসও আছে। কত সহজে তাকে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে।

আসপাশিয়া বলল, এবার আপনার পালা। এখন আপনি গাইবেন, আমি শুনব ‘আমি গাইব? গান?’

পেরিক্লিস কঠিন চোখে তাকালেন। এবার মেয়েটির সাহস সীমা ছাড়িয়ে গেছে। লাই পেয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে।

আসপাশিয়া আবার বলল, ‘আমি আপনার মুখে গানই শুনতে চাই। তবে সেটি অন্য রকম গান।’

‘অন্য রকম গান?’

‘হ্যাঁ, এ গান আপনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।’

‘তাহলে সেটি মনে হয় পেরিক্লিস সংগীত?’

‘কাছাকাছি। পেরিক্লিস সংগীত না, সেটি হলো গণতন্ত্র সংগীত।’

পেরিক্লিস কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি তাকিয়ে রইলেন।

‘আমি আপনার কাছে এথেন্সের গণতন্ত্রের কথা শুনতে চাই।’

পেরিক্লিসের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গণতন্ত্রের নাম শুনলেই তার রক্তে আলো জ্বলে ওঠে। তিনি ভাবছেন, এই মেয়ে সত্যি গণতন্ত্রের কথা শুনতে চায়? মেয়েরা বলবে ঘরের কথা, প্রেমের কথা। ফিস-ফিস ভিস-ভিস করবে। গান-টান, আঁকা-আঁকি, শিল্প এসব নিয়ে দু’চার লাইন চেষ্টা করতে পারে। তাই বলে গণতন্ত্র! জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ে তার সাথে গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলতে চাইছে। তাহলে তিনি ভুল শোনেননি। এই মেয়েটি অন্য রকম।

তিনি আসপাশিয়ার চোখে ভালো করে তাকালেন। সেই চোখে কৌতুক আছে, প্রেম আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি আছে জ্ঞানের জ্যোতি। তাকালেই মনে হয় এই মেয়ে আমার ভেতর-বাহির সব পড়ে ফেলছে, এই মেয়ে সাংঘাতিক ওর চোখে চুম্বক বসানো আছে।

পেরিক্লিস সাবধান হলেন। এত তাড়াতাড়ি বেশি আহ্লাদ দেখানো যাবে না। পেরিক্লিস গম্ভীর হয়ে বললেন, গণতন্ত্রের কথা বলতে হবে? কী শুনতে চাও বলো।

‘এথেন্সে কীভাবে শুরু হলো গণতন্ত্র— সেই কাহিনি বলুন।’

পেরিক্লিস উঠে দাঁড়ালেন। বক্তৃতা করার মতো দুদিকে তাকালেন। তিনি ভুলে গেছেন, তিনি একটি মেয়ের সাথে একা একলা ঘরে খুব কাছে বসে কথা বলছেন। একা মেয়ের সাথে কথা হবে নরম-তরম। একেবারে একান্ত কথা। ফিসফিস হলে আরও ভালো হয়। পেরিক্লিস ফিসফিসের ধারে কাছেও গেলেন না।

তিনি গদগদ কণ্ঠে শুরু করলেন, ‘শোন, এথেন্স হলো সারা দুনিয়ার আলো। যেদিকে তাকাও— আলো আর আলো। সেই আলোর সবচেয়ে উজ্জ্বল বাতিটির নাম গণতন্ত্ৰ।

এথেন্স গণতন্ত্র আবিষ্কার করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষ এই এক্রোপলিসের উপর বসে আবিষ্কার করেছে গণতন্ত্র। আমরা গণতন্ত্র কুড়িয়ে পাইনি। কেউ এসে আমাদের বলেনি, এই নাও গণতন্ত্র। সময়ের প্রয়োজনে আমরা নিজেরাই বের করেছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো শাসন— গণতন্ত্র। আমাদের কোনো রাজা নেই। কোনো সম্রাট নেই। আমরা নিজেরাই নিজেদের রাজা। আমরা নিজেরাই আমাদের শাসন করি। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা পৃথিবীতে আর নেই। পৃথিবীর জন্য এথেন্সের এক মহা মূল্যবান দান গণতন্ত্ৰ।’

পেরিক্লিসের কণ্ঠে জোয়ার এসে গেছে। গণতন্ত্রের নাম শুনলেই তার রক্ত নেচে ওঠে। মুখে লাভার মতো কথা আসতে থাকে। অজান্তেই বক্তৃতার মতো হয়ে যায়।

আসপাশিয়ার চোখে চোখ হতেই পেরিক্লিস লজ্জা পেলেন। বললেন, বক্তৃতা হয়ে যাচ্ছে, না?

আসপাশিয়া বলল, বক্তৃতাই ভালো। আপনার গণতন্ত্রে তো মেয়েরা নেই। আমরা ঘরের বাইরে যেতে পারি না। আমরা বক্তৃতা শুনতে পাই না। আমি কোনোদিন আপনার বক্তৃতা শুনিনি। আপনি এভাবেই বলুন। আমার ভালো লাগছে। সংসদে যেমন করে বলেন, সেভাবেই বলুন।

পেরিক্লিস বললেন, জানো আসপাশিয়া, আমি গণতন্ত্রকে অনেক ভালোবাসি। যতটুকু এথেন্সকে ভালোবাসি, ততটুকুই গণতন্ত্রকে ভালোবাসি।

‘আপনাকেও গণতন্ত্র অনেক ভালোবাসে।’

‘ওহ, আমাকে শুধু গণতন্ত্রই ভালোবাসে! অন্য কেউ ভালোবাসে না?’

আসপাশিয়া ভাবছে, কী শুনতে চায় পেরিক্লিস? আসপাশিয়া তাকে ভালোবাসে কিনা, সেটি বলার সময় এখনও হয়নি। সে কিছুই বলল না।

দাসী পেরিক্লিসের সুরার পাত্র ভরিয়ে দিল।

আসপাশিয়া বলল, জনাব, একটি কথা আগে বলে নেই। আপনি যেভাবে গণতন্ত্রের গুণকীর্তন শুরু করেছেন, তাতে মনে হয় এখন বলবেন গণতন্ত্র মানে মানুষের তন্ত্র, গণতন্ত্র মানে আইনের শাসন, সেই আইনে সবাই সমান, গণতন্ত্র মানে কথা বলার অধিকার— এরকম হিজিবিজি বহুত কিছু। আমি আগেই বলেছি, এগুলো আমি জানি। আর খুব ভালো করে মানি। আমিও গণতন্ত্রের ভক্ত। আপনি যেমন গণতন্ত্রের প্রেমিক, আমিও তেমনই গণতন্ত্রের প্রেমিকা। তাই আমাকে এসব ধানাই-পানাই বলার দরকার নাই। আমি শুনতে চাই গল্প। কে গণতন্ত্র চালু করল? কবে, এথেন্সের ঠিক কোন জায়গায়, কেমন করে গণতন্ত্র এলো। আপনি সেই গল্প বলুন।

পেরিক্লিস বললেন, তুমি তো বহুত ঝামেলাবাজ। এমন করে দিনক্ষণ ধরে কেউ বলতে পারে? বড় ফ্যাসাদে ফেলে দিলে।

আসপাশিয়া বলল, আপনি ছাড়া মার কেউ বলতে পারবে না। যেটুকু পারার আপনিই পারবেন। শুরু করুন।

পেরিক্লিস বললেন, এই গল্প অনেক লম্বা। বলা শুরু করলে রাত ফুরিয়ে যেতে পারে। তখন রাতটা নির্ঘুম কাটাতে হবে।

আসপাশিয়া বলল, তাহলে এই রাতের একটি নাম দেই। নাম হোক— ‘গণতন্ত্রের চাদরের উপর একটি নির্ঘুম রাত। ‘

পেরিক্লিস শুরু করলেন গণতন্ত্রের জন্মের গল্প :

তিনি বললেন, আমরা সবাই তো হোমারের ইলিয়াড বইটির কথা জানি। হোমার ইলিয়াড শুরু করেছেন কীভাবে?

আসপাশিয়া বলল, ইলিয়াডের শুরুটা হলো এভাবে : ট্রয়ের যুদ্ধ চলছে। একিলিস মারাত্মক রাগ করেছে রাজা আগামেমননের ওপর। রাজার ওপর রাগ করে একিলিস চলে যাচ্ছে। সে যুদ্ধ করবে না।

এথেন্সের সবার হোমারের ইলিয়াড আর অডিসি মুখস্থ। শুধু মুখস্ত নয়, একেবারে ঠোঁটস্থ। ছোটবেলা থেকে এরা তোতাপাখির মতো হোমার পড়ে।

পেরিক্লিস বললেন, ‘ঠিক বলেছ। বীর একিলিস রাজার আদেশ মানেনি। সে রাজার অধীনে যুদ্ধ করেনি। সে নিজেকে স্বাধীন মনে করত। এথেন্সের প্রত্যেকটি ছেলে মনে করে, সে একজন একিলিস। ছেলে সন্তান জন্ম নিলে আমরা আশীর্বাদ করি— একিলিসের মতো হও। তো বীর একিলিস যেমন তার রাজাকে মানেনি, আমরাও কোনো রাজা-রানি মানি না। আমরা অনেক দিন আগেই রাজা-রানি বাতিল করে দিয়েছি।

রাজা-রানি বাতিল হওয়ার পরে কিছু ধনী মানুষের একটি কমিটি শাসন করত এথেন্স। অল্প কয়েকজন ধনীর শাসনকে পণ্ডিতেরা বলে অভিজাততন্ত্র। ধনীদের শাসনে ধনীরাই আরও বেশি ধনী হয়, গরিবরা হয় আরও গরিব। তো ধনী-গরিব ঝগড়া শুরু হলো। মারামারি কাটাকাটি অবস্থা। তখন ঠিক হলো আইন লিখতে হবে। পাথরে লিখে শহরের কোনায় কোনায় বসিয়ে দিতে হবে আইন। তাহলে মানুষ সহজে আইন জানবে। জানলে নিজে থেকেই আইন মানবে। শহরে শান্তি আসবে। আইন লেখার দায়িত্ব দেওয়া হলো একজনকে। তার নাম ড্রেকো[৪২]‍।

ড্রেকো হচ্ছে ইউরোপের প্রথম আইন প্রণেতা। সে আইন লিখল। কিন্তু লোকটার কিছু বাতিক ছিল। সে ভুল সহ্য করতে পারত না। সে ভাবতো— মানুষের কোনো ভুল থাকতে পারবে না। মানুষ হবে পাথরের দেবতার মতো নির্ভুল। ড্রেকো ছোটখাটো সব দোষের জন্য শাস্তি লিখল ‘মৃত্যুদণ্ড’। একটি বাঁধাকপি চুরির শাস্তি— ফাঁসি। কাজে ফাঁকি দিলে পরদিনই ফাঁসি। ছোট বড় সব দোষের জন্য ফাঁসি।

আসপাশিয়া বলল, কাজে ফাঁকি দিলে ফাঁসি? ওই আইন থাকলে, প্রতিদিন আমার তিনবার করে ফাঁসি হতো। মাঝে মাঝে আমি সারাদিন শুয়ে থাকি। আমার জন্য ফাঁসির দড়ি নিয়ে জল্লাদ আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত।

পেরিক্লিস হাসলেন।

আসপাশিয়া আবার বলল, মানুষ ড্রেকোকে জিজ্ঞেস করেনি যে, সব অপরাধের শাস্তি প্রাণদণ্ড কি কারণে হবে?

‘হুঁম, জিজ্ঞেস করেছিল। ড্রেকো জবাব দিয়েছিল, আমি ভাবলাম এমন আইন করব যাতে সবাই ভয় পায়। কেউ আর অপরাধ করতে সাহস না পায়। প্রথমে ছোট অপরাধের শাস্তি পাথরের উপরে লিখে ফেললাম ‘মৃত্যুদণ্ড’। যখন বড় অপরাধের শাস্তি লিখতে চাইলাম, তখন দেখি মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে বড় আর কোনো শাস্তি নেই। অতগুলো পাথরে লেখা হয়ে গেছে, পাথরগুলো নষ্ট করব? তাই ছোট-বড় অপরাধের জন্যও মৃত্যুদণ্ডই থাকল। আফসোস, মৃত্যুদণ্ড খুবই ছোট শাস্তি। এর চেয়ে বড় কোনো শাস্তি থাকলে, বড় অপরাধের জন্য সেটিই দিতাম।’

আসপাশিয়া বলল, এই লোক তো উন্মাদ। মহা উন্মাদ। এজন্যই লোকে বলে, ড্রেকোর আইন কালি দিয়ে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল রক্ত দিয়ে।

পেরিক্লিস বললেন, তুমি তো দেখি সবই জানো!

‘না, আমি সব জানি না। টুকরা-টুকরা জানি। সব জানেন আপনি। বলতে থাকেন। আর কোনো থামাথামি নেই। সামনে পুরো রাত। রাতের নাম— গণতন্ত্রের চাদরের উপর একটি নির্ঘুম রাত।’

আসপাশিয়ার উচ্ছ্বাস পেরিক্লিসের ভালো লাগছে।

সুরা পাত্রে চুমুক দিয়ে পেরিক্লিস আবার শুরু করলেন—

‘ড্রেকোর আইন পাথরে খোদাই করে সারা এথেন্সে বসিয়ে দেওয়া হলো। চালু হলো ভয়াবহ সেই আইন। শুরু হলো মৃত্যুদণ্ড। কারণে অকারণে মৃত্যুদণ্ড। ছোটখাট দোষ বেশি করে গরিবরা। ফাঁসিও হতে থাকল তাদের। অল্প-স্বল্প ঋণের জন্য সন্তানদের বিক্রি করে দিতে হলো দাস বাজারে।

কিন্তু এভাবে আর কত দিন! এক সময় গরিবরা ক্ষেপে উঠল। ধনীরা দেখল সর্বনাশ। এই আইন না পাল্টালে ধন-প্রাণ সবই যাবে। ভালো আইন করতে হবে। সেজন্য একজন ভালো ও যোগ্য মানুষ দরকার। এমন কাউকে দরকার যাকে ধনীরাও পছন্দ করে, আবার গরিবরাও কাছের ভাবে। তারা এক বৃদ্ধকে খুঁজে পেল। তার নাম সলোন[৪৩]।

সলোন উচ্চ বংশের সন্তান। কিন্তু তার পিতা শেষ বয়সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যান। সলোন খুবই কষ্টে পড়েন। তিনি একেবারে শূন্য থেকে আবার শুরু করলেন। তিনি গরিবদের সাথে মিশে ব্যবসা শুরু করলেন। তার ব্যবহার ছিল খুবই মিঠা। অল্পদিনেই গরিবদের দোস্ত হয়ে গেলেন। জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন ভূমধ্যসাগরে। দেশ বিদেশ ঘুরতে লাগলেন। লাফিয়ে লাফিয়ে ব্যবসাও হতে লাগল। আবার ধনী হয়ে গেলেন সলোন। মানুষ হাতে পয়সা পেলে গরিব বন্ধুদের ত্যাগ করে। ইজ্জতের গায়ের গরিবীয়ানার ছোঁয়া মুছে ফেলে। ভোল- চাল পাল্টে ফেলে। কিন্তু সলোন সেটি করেননি। তিনি গরিব বন্ধুদের ভোলেননি। তাই তিনি ধনী-গরিব সবারই ভালোবাসার মানুষ।’

আসপাশিয়া বললেন, সলোন তো অনেক বড় কবিও ছিলেন। তার অনেক কবিতা পড়েছি।

পেরিক্লিস অবাক হয়ে বললেন,তুমি সলোনের কবিতাও পড়েছ?

আসপাশিয়া বলল, তার লেখা একটি কবিতা আমার অনেক প্রিয়-

‘প্রতিদিন বয়স বাড়ে
প্রতিদিন নতুন কিছু দেখি
পুরনো সূর্য ওঠে নতুন করে
প্রতিদিন আমি নতুন কিছু শিখি’[৪৪]

পেরিক্লিস বললেন, তো ভালোমানুষ সলোনকে এথেন্সবাসী ধরল। নগরে শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ধনী-গরিব দুই পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে হবে। প্রস্তাব শুনে সলোন বললেন, না না, আমি কবি মানুষ। বুড়ো হয়ে গেছি। মাফ করো ভাই।

কিন্তু না, মাফ করা যাবে না। এথেন্সে তখন সলোন ছাড়া গীত নেই। সবার মুখে সলোন। যেন তার হাতেই জাদুর পিদিম। ঘষা দিলেই শান্তি আসবে। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হলেন। তিনি একটি ব্যবস্থা করবেন। তবে দুটি শর্তে। প্রথম শর্ত— সবাইকে কথা দিতে হবে,তিনি যে ব্যবস্থা দেবেন, সবাই মেনে নেবে। কোনোরকম গাঁইগুঁই চলবে না। দ্বিতীয় শর্ত— তিনি যা করবেন, সামনের দশ বছর সেটির কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।

সবাই বলল, জো হুকুম। শুধু দুইটা কেন, হাজারটা শর্ত দিলেও আমরা রাজি। আপনি এথেন্সকে বাঁচান।

তো সলোন হলেন নগর কমিটির প্রধান। সভার পর সভা হতে লাগল। এথেন্সের নতুন আইন চাই। এমন আইন যাতে ধনীও খুশি, গরিবরাও অখুশি নয়। সলোন নিজে অঢেল সম্পদ আর ভয়াবহ দারিদ্র্য দুটোই খুব কাছে থেকে দেখেছেন। ধনী-গরিব দুই দলের চাওয়া-পাওয়াই তিনি বুঝতেন। তিনি গরিবদের সাথে বসলেন। ড্রেকোর আইনের কারণে অনেক গরিব অতি তুচ্ছ কারণে মৃত্যুদণ্ড পাচ্ছিল। সলোন ড্রেকোর আইন বাতিল করলেন।

আসপাশিয়া বলল, রক্ষা করেছেন আমাকে। না হলে, ঘরে শুয়ে থাকার জন্য আজই আমাকে ফাঁসি দিয়ে দিত। আচ্ছা, সলোন নাকি দাস প্রথাও বাতিল করেছিলেন?

‘না, বাতিল করেননি। দাস না থাকলে এথেন্স চলবে কী করে? তিনি দেনার দায়ে সন্তান বিক্রি বাতিল করেছেন।’

‘কী রকম?’

‘তখন এথেন্সে সন্তান ছিল পিতার সম্পত্তি। টাকার দরকার হলে ছেলে- মেয়ে বিক্রি করা যেত। তো কিছু গর্দভ কোনো কাজ করত না, সারা দিন বসে বসে মদ খেত। মদের টাকা জোগাতে ধার করত। একদিন আর ধার শোধ করতে পারত না। তখন বলত, যাও, আমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যাও। আজ থেকে ওরা তোমার দাস। ওদের নিয়ে আমাকে দেনার থেকে রেহাই দাও। এই গর্দভদের পথে আনতে সলোন ঘোষণা করলেন, আজ থেকে সন্তান আর পিতার সম্পত্তি নয়। আর কেউ ছেলেমেয়েকে বিক্রি করতে পারবে না। দেনার জন্য যারা দাস হয়েছে, তারা এখন থেকে মুক্ত। ভবিষ্যতেও দেনার দায়ে আর কাউকে দাস করা যাবে না।’

আসপাশিয়া বলল, তাহলে এজন্যই এখন এথেন্সের নাগরিকরা কেউ দাস হয় না। এথেন্সের সকল দাস বিদেশি।

আসপাশিয়ার বুদ্ধি দেখে পেরিক্লিস অবাক হচ্ছেন। তার কিছুটা ভয়ও লাগছে। প্রেমিকা হবে বোকা বোকা, নাকি নাকি সুরে কথা বলবে। গাল ফুলিয়ে এটি ওটা চাইবে। পুরুষের মনে হবে আমি এই মেয়ের প্রভূ। আমি ছাড়া এর কোনো গতি নেই। তাহলেই পুরুষ সুখী হবে। প্রেমেও শান্তি আসবে। আর এই মেয়ের বুদ্ধি এত বেশি? এর সাথে প্রেম জমবে না।

পেরিক্লিস আবার শুরু করলেন, সলোন গরিবদের জন্য অনেক কিছু করলেন। তিনি সকল ঋণ মাফ করে দিলেন। ঘোষণা করলেন এই মুহূর্তে যার কাছে যত ঋণ আছে, সব মওকুফ। কারও কাছে আর কেউ দেনা নেই। সবাই নতুন করে জীবন শুরু করো। গরিবরা জানাল, ধনীরা বেশি দামে সব ফসল বিদেশে বেচে দেয়। এতে খাবারের দাম বেড়ে যায়। দুর্ভিক্ষ হয়। গরিব মানুষ না খেয়ে মরে। সলোন আইন করলেন, শুধু জলপাই ছাড়া আর কিছুই বিদেশে বিক্রি করা যাবে না।

আসপাশিয়া বলল, বুদ্ধি ছিল লোকটার। তিনি নাকি উচ্চ বংশের সুযোগ- সুবিধা বাতিল করে দিয়েছিলেন?

পেরিক্লিস বললেন, ‘হ্যাঁ, তখন সরকারি চাকরিতে শুধু উচ্চবংশের লোকজন থাকত। তারা হলো অভিজাত। তাদের রক্ত নীল। শুধু তারাই শাসন করবে। বাকি সব শাসিত হবে। সলোন বললেন, ‘এই ব্যবস্থা বাতিল। সবাই সব রকম চাকরি পাবে।’ অভিজাতরা বেজার হলো। তারা বলল, ‘এত বড় আস্পর্ধা! নীল রক্তের মান রাখতে আমরাও যুদ্ধ করতে পারি।’

সলোন দেখলেন বিপদ। উচ্চ বংশের মানুষের রাগও উচ্চে উঠে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। এমন ব্যবস্থা করছি যাতে সাপ মরবে, কিন্তু লাঠি ভাঙবে না। ঘোষণা করলেন, এখন থেকে সরকারি চাকরিতে উচ্চ বংশের জন্য কোটা থাকবে না। কিন্তু ধনী-গরিব থাকবে। চাকরি ভাগ হবে মানুষের টাকা- পয়সা অনুসারে। তিনি সম্পদ অনুসারে এথেন্সবাসীকে চারটি দলে ভাগ করলেন। সবচেয়ে ধনী দুই দল উচ্চপদে বসতে পারবে। আর নিচের পদগুলো সবার জন্য।’

আসপাশিয়া বলল, কিন্তু যার বেশি টাকা সে উচ্চ পদে— এমন আইন গরিবরা মানলো?

পেরিক্লিস বললেন, না, ধনী বা গরিব কেউই মানলো না। তখন সলোন এথেন্সের আসল ব্যবস্থাই পাল্টে ফেললেন। এগুলো একটু জটিল, সহজে বলা যায় না।

আসপাশিয়া বলল, হোক জটিল। আমি জানি আপনার চেয়ে সহজ করে অন্য কেউ বলতে পারবে না।

পেরিক্লিস মুচকি হেসে বললেন, সলোন এবার নগর শাসনের প্রধান কমিটিই পাল্টে ফেললেন। তখন এথেন্সে একটিই নগর কমিটি ছিল। এর নাম আরিওপেগাস (Areopagus)। রাজাদের মন্ত্রিসভার মতো এটি। এই কমিটিই সব সিদ্ধান্ত নিত। এই কমিটিতে শুধু উচ্চ বংশের লোক থাকত। অভিজাতদের খুশি রাখতে সলোন এই কমিটি শুধু উচ্চ বংশের জন্যই রাখলেন। কিন্তু এর ক্ষমতা কমিয়ে দিলেন। এরা শুধু বিচার করবে আর নামে মাত্র প্রধান হবে। আসল ক্ষমতা এদের থাকবে না। আসল ক্ষমতার জন্য নতুন আর একটি কমিটি বানালেন। সেটির নাম দিলেন বোলি (Boule)। এই কমিটির সদস্য হবে অন্যভাবে। এথেন্সের মানুষদের চারটি জাতি ছিল। চার জাতি থেকে একশ করে মোট চারশো জন হবে এই কমিটির সদস্য। এরাই শাসন করবে এথেন্স। তবু একটি সমস্যা রয়ে গেল। নগর কমিটির প্রধান ছিলেন নয়জন। এদের বলে আরকন। তখন পর্যন্ত এরা সবাই উচ্চ বংশের হতো। সলোন নতুন উপায় করলেন। বললেন, এথেন্সের চার জাতি প্রত্যেকে দশ জন করে চল্লিশ জনের নাম দেবে। এই চল্লিশ জন থেকে লটারি করে নয়জন প্রধান বাছাই করা হবে।

এই ‘লটারি’ বিষয়টা একেবারে নতুন আবিষ্কার। সলোন বললেন, লটারি হলো ঈশ্বরের ইচ্ছা। দেবী এথিনা যার কপালে লিখেছেন, তার নামই লটারিতে উঠবে। এতে কে প্রধান হবে কেউ আগে জানবে না। তাতে ঘুষ, দুর্নীতি কমবে। সলোনের নতুন আইনে ধনী-গরিব কেউই খুশি হয়নি। কিন্তু দুই পক্ষই অনিচ্ছায় মেনে নিয়েছে। সলোন কবিতা দিয়ে সকলকে বোঝালেন। শোন—

‘দরিদ্ররে দিয়েছি অধিকার,      নিদেনপক্ষে যতটুকু দরকার
হ্রাস-বৃদ্ধি করিনি সম্মান
ধনীরাও সুখে থাক        অতি লোভ দূরে যাক
এথেন্সে কারও হবে না অপমান।’[৪৫]

সলোনের আইন চালু হলো।

পরদিন সংসদে একটি টকটকে লাল পোশাক পরে এলেন সলোন। এমন পোশাক তিনি কখনো পরেন না। বেশ-ভূষায় তিনি সাদাসিধা মানুষ। কিন্তু আজ একেবারে ঝাকানাকা পোশাকে এসেছেন। তিনি সংসদে বক্তার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

লোকজন ফিসফিস করছে লোকটা আবার কী চায়! কয়েক বছর ধরে তো পরিবর্তনের নামে অনেক ঘ্যান ঘ্যান করছে। অনেক পরিবর্তন হইছে। নতুন কী চায়! নতুন আবার কী মতলব?

সলোন ধীরে ধীরে বললেন-

প্রিয় এথেন্সবাসী, আপনারা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন একটি জাহাজ চালানোর। সেই জাহাজের নাম এথেন্স। আমি জাহাজকে পথে এনেছি। পাল ও তুলে দিয়েছি। এখন জাহাজ চলবে। আপনারা চালাবেন। আমার আর প্রয়োজন নেই। আমি এক্ষুনি নগর পরিষদের প্রধান থেকে ইস্তফা দিলাম। আমি আজই এথেন্স ছেড়ে চলে যাব। দেবী এথিনা আপনাদের মঙ্গল করুন।

সবার মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেছে। লোকটা বলে কী! এত ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবে? এমন বোকা মানুষ হয় নাকি?

সলোন পিরাউস বন্দরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। তার কাজ শেষ হয়েছে। তিনি চিরতরে এথেন্স থেকে চলে যাবেন। জাহাজ নিয়ে বের হবেন সাগরে। ভেসে ভেসে দুনিয়া দেখবেন। তাকে বিদায় দিতে এথেন্সের পিরাউস বন্দরে চলে এসেছে সারা এথেন্সের মানুষ। সবার চোখে পানি। সলোনের চোখেও পানি। জাহাজ ছেড়ে দেবে। তিনি হাত নেড়ে বিদায় নিচ্ছেন। এমন সময় পেছনে চিৎকার শোনা গেল। ঘোড়ায় চড়ে একজন চিৎকার করতে করতে আসছে। লোকটি বলছে, থামো, থামো। সলোন জোচ্চুরি করেছে। ওকে যেতে দিও না। আটকাও। ও একটি চোর। মহাচোর।

সলোন জাহাজ থামাতে বললেন।

ঘোড়ার সওয়ার বলল, সলোন আইন করে সকল ঋণ বাতিল করেছেন। আসলে উনি মতলব করে টাকা চুরি করেছেন।

ভিড়ের লোক জিজ্ঞেস করল, কীভাবে টাকা চুরি করেছেন?

অভিযোগকারী বলল, গত সোমবার ওনার কয়েকজন বন্ধু অনেকের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নেয়। পরদিনই সলোন ঘোষণা করেন, আজ থেকে এথেন্সের সবার ঋণ মওকুফ। কেউ কারও কাছে আর কোনো টাকা পাবে না। তারপর ওনার বন্ধুরা আর কাউকে টাকা ফেরত দেয়নি। সেই টাকা নিয়ে উনি চুপিচুপি পালিয়ে যাচ্ছেন।

সবাই লোকটিকে বলল, তোর কথা বিশ্বাস করি না। সলোন দেবতুল্য মানুষ। তার নামে নিন্দা করিস। এক্ষুনি তোর বিচার হবে।

সলোন ঘোড়ার মর্দকে ডাকলেন। বললেন, এসো, তুমি নিজে জাহাজ ভালো করে খুঁজে দেখো। আমি টাকা নিলে সেটি জাহাজেই থাকার কথা!

ঘোড়ার মর্দ জাহাজে উঠল। সারা জাহাজ তন্ন তন্ন করে দেখল। জাহাজে অনেক মালামাল। কিন্তু নগদ অর্থ নেই।

সলোনের হিসাব রক্ষক বলল, সলোনের হাতে এখন নগদ আছে মাত্র বিশ মিনা। তার আর কোনো টাকা নেই। তার সব টাকা অন্যরা ধার নিয়েছে। এখন আর কেউ ফেরত দেবে না। নতুন আইনে সব দেনা মওকুফ হয়ে গেছে।

সলোন আবার হাত তুলে বললেন, তোমরা এই ঘোড়-সওয়ারকে কিছু বোলো না। ও যা বলেছে সেটি সত্য। দোষ আমার।

‘আপনার দোষ?’

‘হ্যাঁ, যখন ঋণ মাফ করার চিন্তা মাথায় আসে, খুব আনন্দ হয়েছিল। আনন্দে কয়েকজনকে আমার সিদ্ধান্তের কথা বলেছিলাম। তার মধ্যেই দু’একজন এই দুষ্ট বুদ্ধি করেছে। তারা অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার করেছে। আমার কাছ থেকেও টাকা নিয়েছে। আমাকে নিঃস্ব করেছে। তারা আমার বুদ্ধিতে আমাকেই ঘায়েল করেছে। তারা সাংঘাতিক কুটিল। একেবারে চতুর শিরোমণি। আমি তাদের ক্ষমা করলাম। কিন্তু অন্য যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে, সেগুলো ক্ষমা করা হবে না। আমাকে বলো, আমি সব শোধ করে দিচ্ছি।’

‘আপনার কাছে তো টাকাই নেই।’

‘টাকা নেই কিন্তু আমার জাহাজে অনেক জলপাই তেল আছে। তেল বিদেশে নিয়ে যাচ্ছি বিক্রি করতে। সেখান থেকে সবার দেনা শোধ করা যাবে। বলো কে কত টাকা পাবে?’

ঘোড়ার সওয়ার খুব লজ্জা পেল। সলোনের টাকা সে নিতে পারে না। সে বলল, আমি আপনাকে জোচ্চোর বলেছি। ভুল করেছি। মহাভুল। আমাকে মাফ করুন।

সলোন বললেন, উত্তেজনায় মানুষ অনেক কিছু বলে। আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম। তবে কটু কথা সব সময়ই বিপদ আনে। দেবী এথিনা কটু কথা পছন্দ করেন না। শোন, একটি কবিতা শোন। এটি এথেন্সে আমার শেষ কবিতা—

‘ভালো মানুষের ভাঙা ঘর, দুষ্টের গোলা ভরা
তবু ভাঙা ছাদেই নিশিরাতে উঁকি মারে তারা
টাকা-পয়সা দুই দিনের, হাতে-হাতে ঘোরে
গুণ থাকে অন্তরেতে, বুকের ভেতর নড়ে।’[৪৬]

সলোনের জাহাজ ভেসে চলল দূর দেশের দিকে। এথেন্স ছেড়ে চলে গেলেন তিনি।

একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বলে থামলেন পেরিক্লিস। আসপাশিয়া সলোনের উদ্দেশ্যে সালাম জানাল।

আসপাশিয়া বলল, তাহলে সলোনই এথেন্সে গণতন্ত্র এনেছেন?

পেরিক্লিস বললেন, না, সলোন গণতন্ত্র আনেননি। গণতন্ত্র এসেছে আরও পরে। কিন্তু সলোন যে ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটি আজও আছে। তার বানানো আদালত এখনও আছে। নগর কমিটি মোটামুটি এক রকমই আছে। কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের পিতা নন।

‘এত কিছু করেও তিনি পিতা নন?’

‘না। কারণ তিনি মানুষকে ভাগ করেছেন টাকা-পয়সার বিচারে। তার নিয়মের মূল ছিল সম্পদ। মানুষ নয়। সম্পদের বিচারে চাকরি বণ্টন হতো। এজন্য সলোন গণতন্ত্রের পিতা নন। ‘

‘তাহলে গণতন্ত্রের পিতা কে?’

‘তার নাম ক্লিসথেনিস[৪৭]।’

‘ও মহান ক্লিসথেনিস? আপনার দাদু।’

‘হুঁম, তিনি আমার মায়ের চাচা। তিনিই সবকিছুর কেন্দ্রে নিয়ে আসেন মানুষকে। শুরু করেন মানুষের শাসন। আমরা বলি গণতন্ত্র।’

‘সেটি কীভাবে?’

‘সেটি বলতে আবার বক্তৃতা শুরু করতে হবে। সেটিও লম্বা কাহিনি।’

‘আপনার কপাল খারাপ। আমার মতো সুন্দর মেয়ের সামনে একটু প্রেম- ট্রেমের আলাপ করবেন। সেটি আপনার কপালে নেই। আপনাকে শুধু বক্তৃতা দিতে হচ্ছে।’

পেরিক্লিস বললেন, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও গম ভানে। আমি হলাম ঢেঁকি। আমড়া কাঠের ঢেঁকি

‘না, না। আমড়া কাঠের ঢেঁকি নন, জলপাই কাঠের ঢেঁকি। এথেন্সে আমড়া কাঠ নেই। জলপাই কাঠ আছে।’

পেরিক্লিস মজা করে বললেন, তুমি কি জানো, তুমি কার সাথে মশকরা করছো?

‘জি জনাব, আপনি হলেন পেরিক্লিস। গণতন্ত্রের জনক মহান ক্লিসথেনিসের নাতি। তো, নাতি সাহেব, শুরু করুন। বলুন, আপনার দাদু কীভাবে গণতন্ত্র আবিষ্কার করলেন।’

***

৪১. হোমারের Hymn to the Earth: Mother of All, কবি শেলীর ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমি কিছু অংশ বাংলা করেছি।

৪২. ড্রেকো (Draco) এথেন্সের প্রথম আইন প্রণেতা, তার নাম থেকেই draconian শব্দটি এসেছে, যার অর্থ খুব নির্মম। খ্রি. পূ. ৬২২/৬২১ অব্দে তিনি এথেন্সের আইন লিপিবদ্ধ করেন।

৪৩. সলোন : Solon, এথেন্সের আইনপ্রণেতা, দার্শনিক ও কবি। সাত জন গ্রিক জ্ঞানীর একজন। এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার আইন অবদান রেখেছে। তিনি খ্রি.পূ. ৫৯৪ অব্দে এথেন্সের জন্য আইন প্রণয়ন করেন।

৪৪. সলোনের এই কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ছিল ‘Each day grew older, and learnt something new’. বিখ্যাত গ্রিক জীবনীকার Plutarch তার ‘Parallel Lives’ গ্রন্থে সলোনের জীবনী লিখছেন। সেটির ইংরেজি অনুবাদ (Arthur Hugh Clough সম্পাদিত) থেকে আমি এই কবিতাটি বাংলা ভাবানুবাদ করেছি।

৪৫. Arthur Hugh Clough সম্পাদিত Plutarch এর ‘Parallel Lives’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ থেকে সলোনের এই কবিতাটি বাংলা ভাবানুবাদ করেছি।

৪৬. Arthur Hugh Clough সম্পাদিত Plutarch এর Parallel Lives’ গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ থেকে সলোনের এই কবিতাটি বাংলা ভাবানুবাদ করেছি।

৪৭. ক্লিসথেনিস : Cleisthenes, এথেন্সের গণতন্ত্রের জনক, তিনি খ্রি.পূ. ৫০৮ অব্দে এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *