1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ১১

১১

‘Life is short, art long, opportunity fleeting, experinence treacherous, judgement difficult.’

—হিপোক্রাটিস

***

এথেন্সে অদ্ভুত এক শাসন শুরু হয়েছে।

এই শহরে কোনো রাজা নেই। রানিও নেই। কোনো একজন মানুষের কথায় দেশ চলে না। মন্দিরের পুরোহিত বা যাজকদের নির্দেশেও দেশ চলে না। কিছু ধনী মানুষও দেশ চালায় না। নগরের সব মানুষ মিলে নিজেরাই নিজেদের শাসন করে। যেকোনো বিষয়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিস্টেমের নাম তারা দিয়েছে গণতন্ত্র বা মানুষতন্ত্র।

এরকম জিনিস আগে পৃথিবীর কোথাও ছিল না। এথেন্সবাসী গণতন্ত্র আবিষ্কার করেছে। কেউ তাদের উপহার দেয়নি। তারা পথের ধারে কুড়িয়েও পায়নি। কোনো বইতে কেউ লিখেও দেয়নি— নাও, এটি হলো গণতন্ত্র। এথেন্সের মানুষ নিজেরাই নিজেদেরকে শাসন করার জন্য একটি ব্যবস্থা চালু করেছে। সবাই মিলে ভোট দিয়ে সবকিছু ঠিক করছে। এটির নামই গণতন্ত্ৰ।

সারা দুনিয়ায় নিয়ম ছিল— যুদ্ধ ভালো করতে পারে, এমন কেউ একজন ঘোড়া ছুটিয়ে এসে বলে, আমি রাজা। সে আসলে একজন দস্যু। শক্তির জোরে দস্যু থেকে হয়ে যায় রাজা। রাজার বুদ্ধি থাকলে এসে বলে, আমি দেবতার বংশধর। আমাকে দেবতা পাঠিয়েছেন তোমাদের রাজা করে। মানুষ তাকে মেনে নেয়। তারপর আরও বড় কোনো দস্যু যদি তাকে তাড়িয়ে দেয়, সেই হয় নতুন রাজা। দস্যুদের মারামারি না হলে, রাজার ছেলে রাজা হয়। এভাবে সারা পৃথিবীতে শাসন চলে। একেবারে জোর যার মুলুক তার।

সেই সময়ে এথেন্সের মানুষ ভাবল— মারামারি না করে, সবাই মিলে ভোট দিয়েও শাসক বানানো যায়। তারা সেটিই করল। অস্ত্রের শক্তি বাদ দিয়ে তারা মানুষের শক্তিকে ধরল। নাম দিল ডিমোস (Demos) ক্রাতিয়া (Cratia) মানে মানুষের শাসন। পণ্ডিতেরা পুঁথির ভাষায় নাম দিল গণতন্ত্র (Democracy)।

পৃথিবীর যেখানে রাজা আছে, সেখানে রাজার কথাই আইন। রাজা যা মনে করে সেটিই বিচার। রাজার যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেয়, যাকে ইচ্ছা মুক্তি দেয়। সেখানে একজন রাজা, বাকি সব প্রজা। সারা দেশের মালিক রাজা একা। প্রজারা তার দয়ায় বাস করে, বিনিময়ে রাজাকে খাজনা দেয়।

কিন্তু এথেন্সের গণতন্ত্রে কোনো প্রজা নেই। তারা নগরে থাকে, তাই নাগরিক। কারও একজনের ইচ্ছায় এখানে কিছুই হয় না। এখানে সবাই সমান। সবার সমান অধিকার। সবাই একসাথে বসে ভোট দিয়ে আইন তৈরি করেছে। আইনগুলো একটি বইতে লিখে রেখেছে। সেই বইয়ের নাম সংবিধান। সংবিধানে যা লেখা আছে, সেভাবেই দেশ চলে। সেভাবেই বিচার হয়। আদালত আছে। এখানে দেশের মালিক সকল নাগরিক।

গণতন্ত্র যে কী জিনিস, এথেন্সের বাইরের মানুষ সেটি বোঝে না। বোঝাতে চাইলেও তারা তা বিশ্বাস করে না। উল্টা হাসাহাসি করে। সক্রেটিসের বন্ধুদের মধ্যে চেরোফোন গণতন্ত্রকে খুবই ভালোবাসে। সুযোগ পেলেই সে গণতন্ত্রের গুণগান শুরু করে। বন্ধুরা ঠাট্টা করে তাকে বলে গণতন্ত্রের প্রেমিক। গণতন্ত্র প্রেমের জন্য সে মাঝে মাঝেই ঝামেলায় জড়ায়।

গত বছর ডেলফিতে গিয়ে চেরোফোন আলাপ করছিল মিশরের এক লোকের সাথে। এক ঘণ্টা আলাপ করেও ঐ লোককে বোঝাতে পারেনি, কীভাবে এথেন্স চলছে।

লোকটি বলছিল, ধুর, কী সব অদ্ভুত কথা বলো তোমরা! গণতন্ত্র আবার কী জিনিস! যতসব আজগুবি কাহিনি! পৃথিবীর নিয়ম হলো দেবতার নির্দেশে একজন রাজা হবে, তার কথা সবাই মানবে। আর তুমি বলছো, এথেন্সে কোনো রাজা নেই? সাধারণ মানুষ দেশ চালায়? সব মানুষ মিলে সিদ্ধান্ত নেয়। এটি কিছু হলো? সেখানে কে কাকে মানে? গরু মানে গাধাকে, নাকি গাধা মানে গরুকে? নদীর জল আর ঘটির জল কি এক হলো? চাষি আর বিচারক কি এক রকম সিদ্ধান্ত দিতে পারে? অদ্ভুত, বড়ই অদ্ভুত!

চেরোফোন রেগে বলেছিল, চলো, এক্ষুনি এথেন্সে চলো। নিজের চোখে দেখে যাও গণতন্ত্রী এথেন্স কত সুন্দর! কত সমৃদ্ধ!

লোকটি বিশ্বাস করেনি। সে এথেন্সে আসেও নি। শুধু এথেন্সের বাইরের লোকই নয়, এথেন্সের ভেতরের অনেক লোকও গণতন্ত্র পছন্দ করে না। তাদের মধ্যে চেরোফোনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষ সক্রেটিস একজন। প্রিয় বন্ধু সক্রেটিস গণতন্ত্র পছন্দ করেন না। এটি ভাবলেই চেরোফোনের কষ্ট হয়। সে দুটি জিনিসের ভক্ত। এক. সক্রেটিস আর দুই. গণতন্ত্র। কিন্তু সক্রেটিস আর গণতন্ত্রের মধ্যে ঝামেলা আছে। সক্রেটিস গণতন্ত্র নিয়ে সন্দিহান। তার সন্দেহ দূর করতে চেরোফোন মাঝে মাঝেই তাকে নিয়ে আসতে চায় পিনিক্স পাহাড়ে।

পিনিক্স পাহাড় এথেন্সের সংসদ। গণতন্ত্রের কেন্দ্র। এক্রোপলিসের পশ্চিমে অল্প দূরে এই পাহাড় সব সময় লোকে লোকারণ্য। সেজন্যেই এর নাম পিনিক্স পিনিক্স কথাটার মানে ভিড়ের জায়গা। ছোট্ট পাহাড়ের উপর ছয় হাজার মানুষ জমা হয়। লোকে গিজগিজ করে। চ্যাঁচামেচি, চিৎকার, কোলাহল এমন যে সারা এথেন্স থেকে শোনা যায়। সবাই বোঝে সংসদে অধিবেশন চলছে।

এথেন্সের ধনী এবং মধ্যবিত্ত মানুষের কোনো কাজ নেই। তাদের সব কাজ করে দাসেরা। ধনীদের হাতে অফুরন্ত সময়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তারা চলে আসে পিনিক্স পাহাড়ে। এই পাহাড়ের ঢালে পাথর কেটে কেটে গ্যালারির মতো বসার জায়গা আছে। সেখানে বসে সামনে তাকালেই দেবী এথিনার মন্দির। যেন সেখানে যা কথা হয়, দেবী শুনতে পান। সেখানে খোলা আকাশের নিচে মন্দিরের দিকে মুখ করে সবাই বসে। দেবীকে সাক্ষী রেখে নগরীর বিষয়ে আলাপ শুরু হয়। আলাপ এক সময় বক্তৃতা হয়ে যায়। ঝড়ের মতো যুক্তি দিয়ে বক্তৃতা। আবেগে বুক ভাসিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চলে বক্তৃতা। বক্তৃতা করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়, তখন সবাই ভোট দেয়। এভাবে সকল নাগরিক সরাসরি ভোট দিয়ে প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। এটিই এথেন্সের গণতন্ত্র।

এই মুহূর্তে এথেন্সের গণতন্ত্রের সুদিন চলছে। শহরে শান্তি আছে। মানুষ ধনী হচ্ছে। শিক্ষিত মানুষেরা গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করে। তারা বলে এই গণতন্ত্রে সবাই সমান। এখানে মুচির পাশে বসেছে সৈনিক, দাস বেপারীর পাশে ডাক্তার, নাবিকের পাশে চামড়ার কারবারি— সব এক সারিতে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়। সবার এক ভোট। সবাই হাত তুলে ভোট দেয়।

সক্রেটিস গণতন্ত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি সহ্য করতে পারে না। যত সব আদিখ্যেতা। পিনিক্স পাহাড়ে আসতে তার ইচ্ছে করে না। এর আগে দুবার এসেছিল। কোনোবারই ভালো লাগেনি I

পিনিক্স পাহাড়ে শুধু পুরুষ নাগরিকরা আসতে পারে। নারীদের স্থান এই গণতন্ত্রে নেই। এথেন্সের নারীরা থাকবে ঘরের মধ্যে। বাইরের জীবন তাদের জন্য নয়। দাসদেরও কোনো স্থান নেই গণতন্ত্রে। শুধু আঠারো বছরের বেশি পুরুষরাই এখানে আসতে পারে।

সক্রেটিস এসেছে পিনিক্স পাহাড়ে। নিজের ইচ্ছায় আসেনি। চেরোফোন জোর করে নিয়ে এসেছে। গণতন্ত্র নিয়ে সক্রেটিসের সন্দেহ দূর করতে তাকে নিয়ে এসেছে চেরোফোন। লোকজন আসতে শুরু করেছে। সক্রেটিসের বয়স আঠারোর বেশি। সে চাইলেই ভোটও দিতে পারবে। কিন্তু সে কোনোদিন ভোট দেননি। এই ছেলেখেলা তার ভালো লাগে না। আজও ভোট দেবে না। সে শুধু দেখনেওয়ালা। দেখতে এসেছে এখানে কীভাবে কী হয়।

তারা দূরে এক কোনায় গিয়ে বসল।

চেরোফোন বলল, ওই তো পেরিক্লিস। একেবারে সামনেই তার আসন।

সক্রেটিস বলল, কিন্তু তিনি মাথায় হেলমেট পরে আছেন কেন! এটি পরে তো লোকে যুদ্ধে যায়। উনি কি শিরস্ত্রাণ পরে বক্তৃতা দেন?

চেরোফোন বলল, পেরিক্লিসের মাথাটা শরীরের চেয়ে বেশ বড়। তাই মাথা ঢেকে রাখেন।

সক্রেটিস বলল, অদ্ভুত, এত বড় নেতা, অথচ মাথা ঢেকে রাখতে হয়!

এবার হেসে উঠল চেরোফোন। বলল, মজা করেছি। তুমি তো এদিকে আসো না, তাই জানো না। পেরিক্লিস সেনানায়ক। তাই এখানেও সৈনিকের পোশাক পরে এসেছেন।’

‘সৈনিকের পোশাক মেনে নিলাম। তাই বলে হেলমেট পরে সংসদে? বিদেশি কেউ দেখলে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে। বলবে ঐ দেখ, হেলমেট পরে বসে আছেন এথেন্সের গণতন্ত্র।’

.

একটি পাথরের উপর বড় পেপিরাস কাগজের টুকরা লাগানো। তাতে লেখা আছে আজ সংসদে কী কী বিষয়ে আলোচনা হবে। পাঁচশ জনের একটি পরিষদ ঠিক করে আলোচনার বিষয়। সংসদের আজকের বিষয় দুটি। এক. জলপাই তেল আরও বেশি করে বিদেশে বিক্রি করা হবে কিনা। দুই. স্পার্টার রাজার চিঠি নিয়ে আলোচনা।

প্রথমে জলপাই তেল নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। একজন প্রস্তাব দিলেন। কয়েকজন পক্ষে বললেন। আবার কয়েকজন বিপক্ষে বললেন।

এবার ভোট। ভোট দিতে সবাই লাইন ধরে আগাচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে দুটো করে পাথরের ছোট চাকতি। চাকতির মাঝখানে ছিদ্র থাকলে সেটি ‘না’ ভোট। আর ছিদ্র না থাকলে সেটি ‘হ্যাঁ’ ভোট। ভোটাররা হ্যাঁ বা না ভোটের একটি চাকতি মাটির পাত্রে ফেলবে। মাটির পাত্রটি হলো ব্যালট বাক্স। পাশের অন্য একটি পাত্রে বাকি পাথরটি রেখে দেবে।

ভোটাররা সবাই পাথরের মাঝখানে দুটো আঙুল দিয়ে ছিদ্র ঢেকে রেখেছে। এতে কোন ভোট দিচ্ছে, সেটি অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। সবাই পাত্রের মধ্যে পাথরের চাকতি ফেলল। সেগুলো গণনা করে ফলাফল জানাবে। হ্যাঁ ভোট জিতলে আরও বেশি করে জলপাই বিদেশে বিক্রি করতে পারবে। না ভোট জিতলে জলপাই বিক্রি বাড়ানো যাবে না।

সক্রেটিস বেশ মজা নিয়ে দেখছে। সে ভাবছে এই যে এত ভোটার। কতজন জলপাই তেল বিক্রির বিষয়টি বুঝতে পারছে? তারা কি বুঝে ভোট দিচ্ছে?

হঠাৎ চেরোফোন বলল, আমার কিন্তু একটি ভোট দিতে ইচ্ছে করছে।

সক্রেটিস জিজ্ঞেস করল, কী ভোট দিবে, হ্যাঁ নাকি না?

‘তা তো জানি না। একটি দিলেই হলো।’

সক্রেটিস চমকে উঠল, বলো কী? এটি একটি ফয়সালা। কতটুকু জলপাই তুমি ঘরে রাখবে আর কতটুকু বিদেশে বিক্রি করতে পারবে, সেই সিদ্ধান্ত। অনেকের জীবন-মরণ ব্যাপার। যারা জলপাই তেল বানায়, তাদের জন্য খুবই জরুরি। আর তুমি আন্দাজে হ্যাঁ-না কিছু একটা দিয়ে দেবে?

চেরোফোন রাগ করে বলল, তোমার কি মনে হয় যারা ভোট দিচ্ছে, তারা সবাই হিসাব করতে পারছে, কোনটাতে তাদের লাভ?

চেরোফোনের কথা মিথ্যে নয়। মানুষ আনন্দে ভোট দিচ্ছে। যেন উৎসব। দেখে মনে হচ্ছে না, সবাই বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস। সক্রেটিসের মনে হলো এটি ঠিক হচ্ছে না, দেশ শাসনকে ছেলেখেলা বানিয়ে দিচ্ছে। যার যা ইচ্ছে ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত হচ্ছে।

এতক্ষণে দ্বিতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। স্পার্টার সাথে এথেন্সের বিদেশনীতি। এটি নিয়ে বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়িয়েছেন পেরিক্লিস। ধীরে অথচ গম্ভীর একটি স্বরে তিনি শুরু করলেন,

‘এথেন্সের ভাইয়েরা।’

তিনি কথা বলামাত্র পিনিক্স পাহাড় নিশ্চুপ। একটু আগে সবাই চিৎকার করছিল। বক্তৃতার মাঝেই না না বলে রব তুলছিল। কিন্তু পেরিক্লিসের ভরাট গলা শুনে সবাই চুপ। একেবারে পিনপতন নীরবতা।

সক্রেটিস ফিসফিস করে বলল, লোকটার মাথা বড়। বড় মাথায় বেশি বুদ্ধি। সবাই কেমন চুপ করে গেছে।

পেরিক্লিস বলছেন, ভাইয়েরা, স্পার্টার চিঠি আপনারা পড়েছেন। সারা গ্রিসের মধ্যে একদিন স্পার্টা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। এখন এথেন্সই ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী নগর। আমরা এখন সব নগরের নেতা। অর্থ বলুন আর অস্ত্র বলুন, সব দিক দিয়েই আমরা স্পার্টাকে হারিয়ে দিয়েছি। স্পার্টার রাজার দূত বলছে তারা এখন আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। তা তো চাইবেই। বড়লোকের বন্ধুত্ব কে না চায়! আমরা স্পার্টাকে বলব, না, এখন আর মৈত্রীর দরকার কী! এখন এথেন্স সারা পৃথিবীর নেতা হতে চলেছে। আমরা সবাইকে পথ দেখাই। স্পার্টাকেও পথ দেখাব। স্পার্টা এথেন্সের অধীনে আসুক। আপনারা কী বলেন?

সবাই এক বাক্যে বলল, হ্যাঁ।

‘এর বিপক্ষে কেউ আছেন?’

কেউ হাত তুলল না।

এটি নিয়ে আর ভোট দরকার নেই। পেরিক্লিসের প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। সক্রেটিস বললেন, এই রাজনৈতিক আলাপ আর সহ্য হচ্ছে না। মাথা ধরে যাচ্ছে। তার চেয়ে চলো তোমাকে আজ এক জায়গায় নিয়ে যাব। সেখানে এমন কাঠখোট্টা বক্তৃতা নয়, সেখানে আনন্দও আছে।

চেরোফোন বলল, ‘কোথায়?’

‘চলোই না।’

‘আগে বলো কোথায়।’

‘এথেন্সে নতুন একজন মেয়ে এসেছে। তুমি তাকে দেখোনি। ইউরিপিডিস দেখেছে। একদিন থিয়েটারে তার সাথে ঝগড়া করেছে। মেয়েটির নাম আসপাশিয়া।’

‘কোথায় থাকে?’

‘কেরামেকাস।’

‘কেরামেকাস? সেখানে তো কোনো ভদ্র পরিবার থাকে না।

‘কেরামেকাস অভদ্র পল্লি। কিন্তু আসপাশিয়া অভদ্র নয়। সে খুবই ভদ্র মেয়ে।’

‘ভদ্র মেয়ে হলে কি কেরামেকাসে থাকে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ, সক্রেটিস। কী বলছো তুমি? আমরা জ্ঞানপ্রেমী। আমরা কেরামেকাসে যাব? জানাজানি হলে মান-সম্মান থাকবে না।’

চেরোফোন ভয় পাচ্ছে। তার পিতাও তাকে সক্রেটিসের কাছ থেকে দূরে সরাতে চাপ দিচ্ছে। এখন যদি শোনে যে সক্রেটিস তাকে কেরামেকাসে নিয়ে গেছে, তাহলে আর রক্ষা নেই।

সক্রেটিস বলল, আসপাশিয়া অসাধারণ জ্ঞানী। এমন জ্ঞানী নারী এথেন্সে আর একজনও নেই। তার মুখে দর্শনের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি।

‘দর্শনের কথা? একজন নারীর মুখে?’

‘জ্ঞানের জগতে ছেলে-মেয়ে ভেদ নেই। তুমি চলো। ওখানে সব আছে, নাচ আছে, গান আছে, সুরা আছে। তুমি যা চাও সবই পাবে।’

‘বয়স কত ঐ নারীর?

‘আমার বয়সী।’

‘সক্রেটিস, সাবধান। মান-সম্মান হলো কচু পাতার পানি। একটু নাড়া লাগলেই শেষ।’

‘আরে বন্ধু, আমি সেখানে যাই তার কথা শুনতে। আমি তার গুণমুগ্ধ। এথেন্সে অমন নারী আর একজনও নেই। দেখে নিও, এই মেয়েটি একদিন অনেক বিখ্যাত হবে।’

চেরোফোন বলল, ‘সক্রেটিস, এথেন্স হলো জ্ঞানের শহর। এখানে পথে পথে সফিস্টরা ঘোরে। সারা পৃথিবীর জ্ঞানপ্রেমীরা এখানে আসে। সফিস্টদের সাথে জ্ঞানের আলাপ না করে, তুমি যাচ্ছ আসপাশিয়া নামের এক মেয়ের কাছে?

‘ওই সফিস্টরা পয়সাখোর। টাকা নিয়ে জ্ঞান দেয়। তারা জ্ঞানপ্রেমী নয়, টাকাপ্রেমী। আমি ওদের একদম সহ্য করতে পারি না। জ্ঞান টাকার জন্য নয়।’

‘তা, এই আসপাশিয়া বুঝি পয়সা নেবে না।’

‘আমার কাছ থেকে নেবে না। আমি তো জ্ঞানের আলাপ করতে যাই। তাই সে আমাকে পছন্দ করে। আমি তো তার প্রণয়ী নই। আমি তার কাছে রূপ চাই না। সে আমার কাছে নারী নয়। যুবতি নয়। সে আমার কাছে একজন মানুষ। সে একজন জ্ঞানী মানুষ। এখানে টাকা-পয়সার কারবার নেই।’

‘আর একবার ভেবে দেখো। পরে পস্তাবে।’

‘তুমি চলো। আমাকে বিশ্বাস করে কেউ ঠকেনি।’

‘এখুনি যেতে হবে?’

‘হুঁম, এখানে রাজনীতির আলাপে আমার হাত-পা জ্বালা করছে। ওঠো।’ সক্রেটিস জোর করে চেরোফোনকে নিয়ে চলল কেরামেকাসের দিকে।

কেরামেকাস।[৪০]

আগোরার দক্ষিণে এথেন্সের দেয়ালের ঠিক বাইরে খুবই ঘিঞ্জি এলাকা। এটি এথেন্সের কুমোরপাড়া। মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানানো হয়। পাহাড়ের ঢালে ছাদখোলা ঘরগুলোতে দিনরাত আগুন জ্বলছে। চরকা ঘুরছে। কুমোররা কাঁচা মাটি ছানছে। পোড়াচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল মাটির পিপে, তৈজসপত্র, গৃহস্থালী আর মনোহারি জিনিস।

এথেন্স থেকে শুধু দুটো জিনিস বিদেশে বিক্রি হয়— জলপাই তেল আর সুরা। এই দুটো জিনিস রাখতেই দরকার হয় বড় বড় মাটির পাত্র। এই পাত্র তৈরি হয় কেরামেকাসে। কেরামেকাসের মাটির পাত্র পৃথিবী বিখ্যাত। জাহাজে করে সারা পৃথিবীতে যায়। কেরামেকাস এথেন্সের শিল্পাঞ্চল।

তবে শুধু মাটির পাত্র নয়, এখানে অন্য কিছুও আছে। কেরামেকাস এথেন্সের প্রধান গণিকাপল্লি। সবাই এক নামে কেরামেকাসকে চেনে। এখানের নারীদের কেউই এথেন্সের নয়। সবাই বিদেশি, আশপাশের নগর থেকে এসেছে।

মারাত্মক রকমের অভদ্র পল্লি কেরামেকাস। এখানে আর যাই থাক, জ্ঞানের কোনো কথা নেই। জ্ঞানের জন্য কেউ কেরামেকাসে আসে না। কিন্তু সক্রেটিস যাচ্ছে। জ্ঞানের সন্ধানেই চেরোফোনকে নিয়ে কেরামেকাসে যাচ্ছে সক্রেটিস।

মাঝপথে ক্রিতোর সাথে দেখা। তাকে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এমনিতেই ক্রিতোর বাবা ক্রিতোকে মারধর করেন। তার ওপর যদি শোনে ছেলে কেরামেকাসে যায়, তাহলে আর উপায় থাকবে না। কিন্তু না বুঝেই ক্রিতোও তাদের সাথে হাঁটা ধরেছে কেরামেকাসের পথে।

একটি দোতলা বাড়ির সামনে থামলেন সক্রেটিস। উপরে তাকিয়ে বলল, ঐ ঘরে থাকে আসপাশিয়া।

আসপাশিয়া জন্মেছিল এজিয়ান সাগরের ওপাড়ে মিলেটাস নামক এক শহরে। খুবই অল্প বয়সে তার বাবা-মা মারা যায়। তারা তিন বোন, কোনো ভাই নেই। আসপাশিয়া সবার ছোট। ভীষণ বিপদের দিনে এথেন্সের এক ধনীর পছন্দ হয় তার বড় বোনকে। বড় বোনকে বিয়ের পর সে তিন বোনকেই এথেন্সে নিয়ে আসে। তখন আসপাশিয়া অনেক ছোট।

আসপাশিয়া এমন কিছু গুণ নিয়ে জন্মেছে, যা সাধারণ মেয়েদের থাকে না। সে সবকিছু পালটে দিতে চায়। দিন বদলের ইচ্ছা তার প্রবল। তার মধ্যে ফিনিক্স পাখির গুণ আছে। সে ধ্বংসের ভেতর থেকে নতুন সৃষ্টি করতে চায়। সে লেখাপড়া শিখেছে। পৃথিবীকে জেনেছে। গান শিখেছে। সে বুঝতে পেরেছে রূপের বাইরেও তার একটা কিছু আছে, যেটি অন্য মেয়েদের নেই। সে চাইলে সুন্দর একটি বক্তৃতা লিখে ফেলতে পারে। সে কথা বললে সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে।

সে স্বাধীন মেয়ে। বড় হয়ে আর বোনের সংসারে থাকেনি। কিন্তু এথেন্সে একা মেয়ে কোথায় থাকবে? তার ওপর বিদেশি। সে বাসা ভাড়া নেয় কেরামেকাসে। এখানে ছাড়া অন্য কোনো পল্লিতে বিদেশিদের বাসা ভাড়া দেওয়া হয় না। সেখানে সে জ্ঞানের চর্চা করে, সংগীত, কবিতা নিয়ে থাকে। তার মতো মেয়েকে বুঝতে এথেন্সের দেরি হয়নি। কয়েক মাসের মধ্যেই সে এই শহরের সবচেয়ে আলোচিত নারী সক্রেটিস, ক্রিতো আর চেরোফোন তিন বন্ধু সামনের ঘরে বসে আছে। আসপাশিয়া ভেতরের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ফাঁকা আসন আছে। কিন্তু আসপাশিয়া বসছে না।

আসপাশিয়াকে দেখে চেরোফোনের মাথা ঘুরে গেছে। এত সুন্দর মানুষ হয়! সে সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির কথা শুনেছে। কিন্তু দেখেনি কখনই। আফ্রোদিতিকে সংক্ষেপে দিতি দেবী বলে। চেরোফোনের মনে হচ্ছে দিতি দেবীকে আর দেখার দরকার নেই। তিনি কিছুতেই এই মেয়ের চেয়ে রূপবতী হবেন না। তখন দেবীর প্রতি ভক্তি উঠে যাবে।

এথেন্সে মেয়েরা বাইরে আসতে পারে না। তাই এখানের যুবকেরা সারা দিনে কোনো মেয়ে দেখতে পায় না। সেজন্য মেয়ে দেখলে ছেলেদের মাথা ঘুরে যায়। চেরোফোন কী করবে বুঝতে পারছে না। তার চোখ পিটপিট করছে। বাঁকা চোখে দেখছে আসপাশিয়াকে।

সক্রেটিস আসপাশিয়াকে বলল, আজ বন্ধুদের নিয়ে এসেছি। এই দুষ্ট চেরোফোন বিশ্বাসই করে না যে, একজন নারীও জ্ঞানী হতে পারে।

আসপাশিয়া বলল, ওর আর দোষ কী! জন্মের পর থেকেই যা দেখেছে, তাই তো ঠিক মনে করবে। ঠিক না চেরোফোন?

চেরোফোন যে আড়চোখে আসপাশিয়াকে দেখছে, সেটি ধরা পড়ে গেছে। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে অ্যা অ্যা করে বলল, কী, কী নিয়ে যেন কথা হচ্ছে!

আসপাশিয়া বলল, তেমন কিছুই নয়, মেয়েদের মাথায়ও ঘিলু-টিলু কিছু আছে কিনা ঐ বিষয়ে।

চেরোফোন বলল, ছিঃ ছিঃ, আমি সেভাবে বলিনি। সক্রেটিস মিথ্যা বলেছে। আশপাসিয়া বলল, তোমাদের দোষ নেই। তোমরা তো এসব দেখেই বড় হয়েছ। এথেন্সে একটি মেয়ে সাত বছর হলেই ঘরে বন্দি। বাইরে যেতে পারে না। বছরে দু-একটি অনুষ্ঠানে শুধু মন্দিরে যেতে পারে। আর থিয়েটারে যেতে পারে। এছাড়া এথেন্সের নারীদের জন্য ঘরের বাইরে কোনো জায়গা নেই। চার দেয়ালেই তার জীবন। তোমরা ভাববে কী করে যে নারীরাও জ্ঞানী হতে পারে!’

চেরোফেন বলল, না না, আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে।

‘কী করে ভুল ভাঙল?’

‘আপনাকে দেখে। এমন রূপ যার, সে জ্ঞানী না হয়ে পারে? রূপের টানেই জ্ঞান চলে আসবে। আপনি অবশ্যই জ্ঞানী। মহাজ্ঞানী।’

‘রূপের টানে জ্ঞান চলে আসবে?’

‘হুঁম। আমি এখন কান দিয়ে আপনার জ্ঞানের কথা শুনব আর চোখ দিয়ে আপনাকে দেখব।’

‘ওহ, তোমার কান আর চোখ হলেই হবে? মনের কোনো দরকারই নেই? ইশ, বিধাতা তোমাকে ভুল করে মন দিয়ে ফেলেছে।’

চেরোফোন এমন মুগ্ধ হয়ে গেছে যে আসপাশিয়ার খোঁচাও বুঝতে পারছে না। সে গদগদ গলায় বলল, ‘আমি ভাবতে পারছি না। আমার সামনে এক দেবী বসে আছে। না না। ভুল বলেছি। আমার সামনে এক শরীরে দুই দেবী সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতি আর জ্ঞানের দেবী এথিনা।’

সক্রেটিস দেখল সর্বনাশ। চেরোফোন যা শুরু করেছে, তাতে আসপাশিয়ার কাছে মান-ইজ্জত কিছুই থাকবে না। সে চেরোফোনের দিকে একেবারে বজ্র দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু হাঁদা চেরোফোন কিছু বুঝতে পারলো না। সে বলেই যাচ্ছে। হাঁদাটা সব মাটি করে দিচ্ছে। এক্ষুনি বিষয় পাল্টাতে হবে।

সক্রেটিস বলল, চেরোফোন আমরা আসপাশিয়ার কাছে এসেছি জ্ঞানের কথা শুনতে।

চেরোফোন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুরু হোক। সুন্দর মুখে সুন্দর কথা। রূপ দেখব আর জ্ঞান শুনবো।

আসপাশিয়া চেরোফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু জনাব, রূপ বা জ্ঞান কোনটাই আজ হবে না। তোমাকে আরেক দিন আসতে হবে।

এরপর সক্রেটিসের দিকে তাকিয়ে বলল, সক্রেটিস, আজ এখানে একজন অতিথি আসবেন। বিশিষ্ট অতিথি। তোমরা তাকে চেনো। আজ তোমাদের সময় দিতে পারছি না। আমি সুরা পাঠিয়ে দিচ্ছি, না খেয়ে যেও না কিন্তু আসপাশিয়া ভেতরের ঘরে চলে গেল।

হতভম্ব হয়ে গেছে সক্রেটিস। আসপাশিয়া তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে! অন্য কারও জন্য অপেক্ষা করছে? তাদেরকে চলে যেতে বলছে? সে কত বড় বড় কথা বলে বন্ধুদের নিয়ে এসেছে। আর আজই আসপাশিয়া এমন অপমান করল! সক্রেটিসের উচিত এক্ষুনি বের হয়ে যাওয়া। কিন্তু অপমানে পা সরছে না

সুরা নিয়ে ঘরে ঢুকল এক দাসী। তার মুখে মিষ্টি হাসি। হাতে সুরাপাত্র। পোড়ামাটির পাত্রটির উপর সুন্দর কারুকাজে লেখা— ‘আমাকে নাও’। সক্রেটিসের ইচ্ছা করছে, এক্ষুনি পাত্রটি নিয়ে ভেঙে টুকরা টুকরা করে ফেলতে।

চেরোফোনের মুখে কিন্তু হাসি লেগেই আছে। তার অপমান লাগেনি। আসপাশিয়ার রূপে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। সে এক ভাঁড় সুরা তুলে নিল 1

চেরোফোনকে সুরা নিতে দেখে সক্রেটিসের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল সুরা খেতেই হবে? জীবনে সুরা দেখেনি? সে চেরোফোনের হাত থেকে সুরার ভাঁড় কেড়ে নিয়ে টেবিলে রাখল।

দাসীটি দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ফিক করে একটি হাসি দিল।

ক্রিতো এতক্ষণ কিছুই বলেনি। এবার সে উঠে দাঁড়াল। সক্রেটিসের কথায় এখানে এসে কী অপমানটাই হলো না! দাসীও ব্যঙ্গ করছে। ক্রিতো এক হাতে সক্রেটিসের অন্য হাতে চেরোফোনের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। দুই শয়তানকে ঘর থেকে টেনে বের করতে হবে।

ঠিক সেই সময় ঘরে ঢুকলেন পেরিক্লিস।

পেরিক্লিসকে দেখে তারা তিনজনেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল আসপাশিয়ার বিশিষ্ট অতিথি তাহলে পেরিক্লিস! তাদের মুখ হা হয়ে গেছে। এক্ষুনি এখান থেকে পালাতে হবে। পেরিক্লিস তাদেরকে দেখেছেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই তারা হুড়মুড় করে বের হয়ে গেল।

বের হয়েই চেরোফোন বলল, ঘটনা বুঝেছ? আসপাশিয়ার বিশিষ্ট অতিথি হলেন পেরিক্লিস। সে আমাদের মতো পুঁচকে ছেলেদের পাত্তা দেবে কেন? তার ঘরে এখন এথেন্সের সবচেয়ে বিশিষ্ট অতিথি পেরিক্লিস।

পেরিক্লিসকে দেখে সক্রেটিসের রাগ কমে গেছে। সে কাহিনিটা ধরতে পেরেছে। দুয়ে দুয়ে চার মিলেছে। পেরিক্লিস যেদিন আসপাশিয়ার ঘরে আসবে, সেদিন যে আসপাশিয়া তাদেরকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে সেটিই তো বেশি।

ক্রিতো বলল, কিন্তু পেরিক্লিস এখানে কেন? ওনারও কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? লোকে দেখলে কী বলবে? ওনার স্বভাব-চরিত্র তো ভালো বলেই জানতাম। ছিঃ ছিঃ। শেষ পর্যন্ত উনিও!

সক্রেটিস বলল, একটু আগে আমরা তো ওখানেই ছিলাম। আমরা কি খারাপ হয়ে গিয়েছি?

‘আমরা তো জ্ঞানের জন্য গিয়েছি।’

‘আর পেরিক্লিস কিসের জন্য গিয়েছেন?’

‘তা তো জানি না। ‘

‘না জেনে বলা কি ঠিক হচ্ছে?’

সক্রেটিসের দিকে তাকাল ক্রিতো। একটু আগেই কী অপমানটাই না করল আসপ্নাশিয়া! সেটি ভুলে গেল সক্রেটিস? এখন তার হয়ে ওকালতি করছে।

ক্রিতো বলল, পেরিক্লিসকে দেখে তুমি মনে হয় খুশি হয়েছ?

সক্রেটিস বলল, হুঁম, খুশি হয়েছি। পেরিক্লিস আসলেই ধুরন্ধর। অতি চতুর লোক। তিনি ঠিকই আসপাশিয়াকে খুঁজে বের করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী নারীটিকে খুঁজে পেয়েছেন পেরিক্লিস। এই দুজনের মতো ভালো জুটি আর সম্ভব নয়। তোমরা দেখো, পেরিক্লিস অনেক বড় নেতা হবেন। তোমাদের গণতন্ত্রের সুদিন আসছে।

‘কিন্তু সক্রেটিস, তুমি ভুলে গেছো যে পেরিক্লিস বিবাহিত। তার দু দুটো সন্তানও আছে।’

‘অ্যাঁ, তাই তো!’

‘আরও আছে। আসপাশিয়া তো এথেন্সের কেউ নয়। সে বিদেশি। আমরা বলি মেটিক। এথেন্সের নিয়মে পেরিক্লিস তাকে বিয়ে করতে পারবেন না। তাকে নিয়ে কী করবেন পেরিক্লিস?’

‘তাহলে তো বিরাট ঝামেলা হবে।’

চেরোফোন বলল, ঝামেলা একটু হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত পেরিক্লিস জীবনে বড় কোনো ভুল করেননি। এবারও করবেন না। দেখো, তিনি ঠিকই কোনো না কোনো পথ বের করবেন।

ক্রিতো বলল, পেরিক্লিসের পথ উনিই বের করবেন। কিন্তু সক্রেটিস আজ আমাদের কুপথে নিয়ে যাচ্ছিল। কানের পাশ দিয়ে তীর গেল। তামি কান ধরলাম। জীবনে কোনোদিন কেরামেকাসে আসব না।

***

৪০. প্রাচীন এথেন্সের শিল্প নগরী, এখানে মৃৎশিল্প তৈরি হতো। গ্রিকদের মৃৎশিল্পী বা কুমারদের দেবতার নাম Kerameus, তার নাম থেকেই নগরের নাম Kerameikos (কেরামেকোস)। এই কেরামেকোস থেকেই সিরামিকস শব্দটি এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *