1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ১০

১০

‘সে-ই ধনী, যে অল্পে তুষ্ট হয়,
সুখের চেনা গলির নাম সন্তুষ্টি।’

—সক্রেটিস

***

সক্রেটিস আর সিমন আগোরার পথ ধরে যাচ্ছে। আগোরায় অগুনতি লোক। সক্রেটিসের হাঁটা কিছুটা উদ্ভট। পাগুলো একটু বাঁকা করে থেমে থেমে আগায়। আর সেই সাথে সারা শরীর সামনে ছুড়ে দেয়। তার এই হাঁটা এথেন্সে বিখ্যাত। এরকম করে অন্য কেউ হাঁটে না।

তাকে হাঁটতে দেখে সবাই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। অনেকে কাজ বন্ধ করে হা করে দেখছে। যারা নতুন দেখছে তারা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

সিমন পড়েছে বিপদে। তার মনে হচ্ছে চারদিকের হাজার হাজার চোখ তাদের গিলে খাচ্ছে। সে রাস্তায় নজর দিতে পারছে না। একবার ডানে একবার বামে তাকাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকবার হোঁচট খেয়েছে। সক্রেটিসের কোনো হেলদোল নেই। সে একইভাবে হাঁটছে।

সক্রেটিস বলল, সবাই তাকিয়ে আছে কেন জানো?

সিমন বলল, তোমার হাঁটা দেখছে।

‘আমার হাঁটা কেমন?’

‘হাঁটা ভালো, তবে চলনটা বাঁকা।’

সক্রেটিস হো হো করে হেসে উঠল, এটি ঠিক বলেছ। আমার চলন বাঁকা।

সিমন বলল, মানুষ যেভাবে তোমার বাঁকা চলন দেখছে, মনে হচ্ছে এখানে থিয়েটার হচ্ছে। সবাই হা করে দেখছে। আমার ইচ্ছা করছে টিকেটের ব্যবস্থা করি। টিকেট হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলব ‘এই যে ভাই, আসুন, দেখে যান, নতুন জিনিস, সক্রেটিসের বাঁকা চলন, টিকেট মাত্র দুই ওবল[৩৯]।

সক্রেটিস বলল, টিকেট করতে চাও? তুমি তো বিরাট বেপারী হয়ে গেছো। বেপারীদের মতো সবখানে টাকার গন্ধ পাচ্ছ। চলো, ঐ দোকানে ঢুকি। ঐ দোকানি তোমার থেকে অনেক বড় বেপারী।

আগোরার রাস্তার দুপাশে অনেক দোকান। দামি দামি জিনিসে ঠাসা I সারা পৃথিবীর সব থেকে দামি জিনিসপত্র এখন এথেন্সে চলে আসে। গলির মুখে বিশাল একটি মনোহারি দোকানে ঢুকল সক্রেটিস। দোকানটি ক্রিতোর চাচাত ভাইয়ের। দোকানে আগে থেকেই ক্রিতো ও কয়েকজন বন্ধু বসে ছিল। সক্রেটিস এই দোকানে প্রতি মঙ্গলবার ঠিক সন্ধ্যার পর আসে। কোনোদিন কিছু কেনে না। কিন্তু কোনো মঙ্গলবারই বাদ যায় না।

দোকানে ঢুকেই সক্রেটিস সুন্দর একটি হার হাতে নিল। হারটা ঝুনঝুনির মতো ঝুলিয়ে সক্রেটিস বলল, বাহ, বাহারি শব্দ করছে। এই ঝুনঝুনির দাম কত?

দোকানি বলল, দুইশ ওবল।

দুইশ ওবল অনেক টাকা। দুইশ ওবল দিয়ে একটি জাহাজ কেনা যায়। সিমনের জুতার দোকান করতে সব মিলিয়ে লেগেছে দেড়শ ওবল। এই হারের দাম তার দোকানের চেয়ে বেশি।

সক্রেটিস আরেকটা সোনার পুতুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, আহা, বড়ই চকমারি জিনিস। এই চকমারি পুতুল কত?

দোকানি বলল, সাড়ে তিনশ ওবল।

সক্রেটিস বলল, ঘটনাটা দেখেছ— এথেন্স কত ধনী! এথেন্সের মতো দামি শহর দুনিয়ায় আর একটিও কি আছে?

সবাই বলল, না, না। এথেন্সের মতো দামি শহর একটিও নেই।

তারপর একটি ব্রোঞ্জের ছুরি নিয়ে সক্রেটিস বলল, এটির দাম কত?

‘তিন ওবল।’

‘আর এই বাটি?’

‘এক ওবল।’

সক্রেটিস বলল, ঘটনাটা দেখেছ— এথেন্স কত গরিব! এথেন্সের মতো সস্তা শহর দুনিয়ায় আর একটিও কি আছে?

সবাই হাসতে হাসতে বলল, না, না। এথেন্সের মতো সস্তা শহর আর একটিও নেই।

সিমন কিছুই বুঝতে পারছে না। এ কেমন খেলা!

সিমন বলল, এথেন্স একই সাথে দুনিয়ার সবচেয়ে দামি শহর আবার সস্তা শহর। সেটি কীভাবে?

সক্রেটিস বলল, সন্দেহ হচ্ছে?

সিমন বলল, হ্যাঁ, সন্দেহ হচ্ছে।

সক্রেটিস বলল, বাহ, এর তো সন্দেহ বাতিক আছে।

‘সন্দেহ বাতিক আছে? আমার?’

‘হ্যাঁ, তোমার।’

‘কী বলছ? আমি এখনও বিয়েই করিনি। প্রেমের কোনো ব্যাপার-স্যাপার নেই। সন্দেহ-বাতিক কোত্থেকে আসবে?’

সক্রেটিস বলল, নতুন নতুন বিয়ে করলে যে সন্দেহ-বাতিক হয়, সেটি খুবই জঘন্য একটি জিনিস। আমি বলছি অন্য রকম সন্দেহ-বাতিকের কথা। এই সন্দেহ বাতিক ভালো জিনিস। আমার সাথে যারা ঘোরে তাদের সবার সন্দেহ-বাতিক আছে।

‘কী রকম সেটি?’

‘সেটি হলো, কেউ কিছু বললে, সরাসরি মেনে নেয় না। সন্দেহ করে। সবকিছুতে সন্দেহ করে।

‘খামাখা সন্দেহ করে লাভ কী?

‘সন্দেহ থেকে প্রশ্নের জন্ম হয়। কেউ কিছু বললে, সেটিতে সন্দেহ হলেই মানুষ প্রশ্ন করে। প্রশ্ন থেকেই নঙ্কুন জিনিস বের হয়। এভাবেই পৃথিবীতে নতুন জিনিস আবিষ্কার হয়। মানুষের যা কিছু অর্জন, সবকিছুর শুরু সন্দেহ থেকে। তাই সন্দেহ-বাতিক খুবই ভালো জিনিস।’

সিমন চোখ পিটপিট করে বিড়ালের মতো তাকাচ্ছে। সন্দেহ-বাতিক ভালো জিনিস— এটি মানতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে।

সক্রেটিস আবার বলল, তাহলে যেটি দাঁড়াল সেটি হলো সন্দেহ থেকে জন্ম হয় প্রশ্ন। তুমি প্রশ্ন করেছ। তুমি এখন একজন প্রশ্ন-রোগী।

‘আমি প্রশ্ন-রোগী?’

‘হ্যাঁ, যারা সবকিছুতে প্রশ্ন করে, বিনা প্রশ্নে কিছু মেনে নেয় না, সবকিছু বাজিয়ে দেখতে চায়, নিজে বুঝে নিতে যায়, কারণ জানতে যায়, উত্তর খুঁজতে চায়— তারাই প্রশ্ন-রোগী।’

‘এখন বলবে যে সন্দেহ বাতিকের মতো প্রশ্ন-রোগও ভালো জিনিস?’

‘না, শুধু ভালো জিনিস নয়। প্রশ্ন-রোগের মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।’

সিমন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে মারামারি শুরু করতে পারে।

সক্রেটিস বলল, যে প্রশ্ন করতে পারে, সে নতুন জিনিস বের করতে পারে। একদিন সাগরের দিকে তাকিয়ে পানির ফুলে ওঠা দেখে একজন প্রশ্ন করল, জোয়ার কেন হয়? প্রশ্নটা তাকে ভাবায়। সে কারণ খুঁজতে থাকে। প্রতিদিন জোয়ারের কাছে গিয়ে বসে থাকে। একদিন বের করে ফেলে জোয়ার-ভাটার রহস্য। একটি ছোট্ট ‘কেন’ প্রশ্ন থেকে সে বড় একটি রহস্য বের করল। এভাবেই প্রশ্ন-রোগীরা বড় বড় জিনিস বের করে। মানুষ প্রশ্ন করতে পারে বলেই এগিয়ে চলছে। জ্ঞানের প্রথম শর্তই হলো প্রশ্ন।

সিমন অর্ধেক শান্ত হলো। সক্রেটিসের কথায় যুক্তি আছে। প্রশ্ন করতে শুরু না করলে মানুষ নতুন নতুন জিনিস বের করতে পারত না। আজও সেই গুহায়ই বাস করত।

সিমন বলল, ঠিক আছে, মানলাম প্রশ্ন-রোগ খুব ভালো জিনিস। প্রশ্নই হলো সকল আবিষ্কারের জননী। পৃথিবীতে যত বেশি প্রশ্ন-রোগী হবে, তত বেশি মঙ্গল। কিন্তু ঝামেলা হলো, তুমি জোয়ারের কথা বললে। জোয়ারের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলে, জোয়ার রাগ করে না। কিন্তু মুরুব্বিদের প্রশ্ন করলে তারা রাগ করে। একদিন আমার চাচি বলল, শনিবার দিন নখ কাটিস না। আমি বললাম, কেন চাচি? চাচি বলল, দেবতারা অখুশি হয়। আমি বললাম, কেন তারা অখুশি হয়? চাচি বলল, মুখে মুখে তক্ক করিস? তোর মতো খারাপ ছেলে আমি জন্মেও দেখি নাই।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সক্রেটিসের সব বন্ধুরই এই এক সমস্যা। প্রশ্ন নিয়ে মুরুব্বিদের সাথে ঝামেলা হয়। সকাল-বিকাল ক্যাচাল লাগে। মুরুব্বিরা কথায় কথায় বলেন, এটি কর— দেবতারা ভালোবাসে। ঐটা করিস না— দেবতারা গোস্বা করবে। কিন্তু দেবতারা কেন ভালোবাসে, কেন বেজার হবে, এই প্রশ্ন জানতে চাইলেই বলে, বেআদব, খালি মুখে মুখে তর্ক।

সক্রেটিস বলল, কথা সত্য। প্রকৃতির কাছে প্রশ্ন করলে প্রকৃতি ঝামেলা করে না। কিন্তু মানুষকে তার মনের মতো প্রশ্ন না করলেই, মানুষ রাগ করে। কিন্তু ঘটনা হলো এই সমস্যা চিরকালই ছিল। সমস্যার কারণে প্রশ্ন করা বন্ধ হয়নি। যারা প্রশ্ন করার তারা সারা জীবন করে। তারা অবাধ্য। তারাই নতুন নতুন জিনিস বের করে। যারা ভয় পেয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ করে তারা শান্ত শিষ্ট লেজবিশিষ্ট ভদ্র ছেলেমেয়ে। তারা নতুন কিছু বের করতে পারে না।

সিমন বলল, তাহলে আমাদের কী করা উচিত?

সক্রেটিস বলল, তুমি সবকিছুই সন্দেহ করো। সন্দেহ করলেই প্রশ্ন আসবে। মাথায় প্রশ্ন এলে চুপ থেকো না, জিজ্ঞেস করো। বিনা প্রশ্নে কিছু মেনে নেবে না। যদি তুমি সবাইকে প্রশ্ন করতে পার, তাহলেই তুমি সত্যিটা জানতে পারবে। প্রশ্নের পর প্রশ্নেই সত্য বের হয়ে আসে।

সিমন বলল, তাহলে মানে দাঁড়াল সন্দেহ থেকে আসে প্রশ্ন, আর প্রশ্ন থেকে জন্ম হয় সত্য। সেই হিসেবে প্রশ্ন হচ্ছে সত্যের মা। আর সন্দেহ হচ্ছে সত্যের দাদিমা।

সবাই হেসে উঠল।

সিমন আবার বলল, সত্যের মা আর দাদিমাকে তো পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমার নিজের মা আর দাদিমা যদি শোনে যে আমার সন্দেহ-বাতিক আছে, আর সেই সন্দেহ থেকে আমার প্রশ্ন-রোগ হয়েছে, তাহলে আমার মা-দাদিকে আর খুঁজে পাব না। সত্যের মা-দাদিকে পেয়ে আমার নিজের মা-দাদিকে হারিয়ে ফেলব গো।

সিমন এমন করে বলছে যেন সত্যিই তারা মা আর দাদিমার কিছু হয়ে যাচ্ছে। তার কথায় সবাই হাসছে।

দোকানে এখন অনেক ভিড়। ভিড়ের মানুষ জানে সক্রেটিস প্রতি মঙ্গলবারে সন্ধ্যার ঠিক আগে এই দোকানে আসে। চার থেকে পাঁচ লাইন মজার কথা বলে। সেটি শোনার জন্যই দোকানে ভিড় জমে যায়। এতক্ষণ সিমনের সাথে সক্রেটিসের যে বড় বড় আলাপ হলো— ভিড়ের মানুষের কাছে সেটির কোনো মূল্য নেই। তাদের কাছে এগুলো হাবিজাবি কথা। এমন কথা তো সক্রেটিস ঘাটে-পথে বলে। এসব দিয়ে কী হবে?

দোকানি আঙুরের রস নিয়ে এলো। এটিও প্রতি মঙ্গলবারের রুটিন মজার আলাপ শেষ হলে সে সক্রেটিসকে আঙুরের রস দেয়। দুষ্ট লোকেরা বলে, ওটা আঙুরের রস না, ওটা নাকি সুরা। কিন্তু দোকানির কোনো দোষ নেই। সে আঙুরের রস আর সুরার পার্থক্য বোঝে না। আঙুর দিয়েই সুরা বানায়। সক্রেটিসের সবকিছুতেই খামখেয়ালি। ইচ্ছা করলে ফলের রসে এক চুমুক দেয়, ইচ্ছা না করলে নাই। দোকানির বিশ্বাস সক্রেটিস তুকতাক জানে। কালো জাদু ধরনের কিছু। সে যেদিন রসটা খায়, সেদিন দোকানে বিক্রি কম হয়। যেদিন খায় না, সেদিন বিক্রি বেশি হয়। তাই দোকানি মনে মনে চায় সক্রেটিস যেন আঙুরের রস না খায়।

দোকানির মনের কথা সক্রেটিস জানে, কিন্তু বুঝতে দেয় না। সে চায় এই রহস্যটা থাকুক। দোকানে ধনী লোক দেখলে, সে খায় না। আজ দোকানে কয়েকজন টাকাওয়ালা লোক দেখা যাচ্ছে। আজ সে খাবে না। সে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

কিন্তু দোকানি তার হাত ধরে ফেলল। সিমনকে দেখিয়ে বলল, আজ মেহমান নিয়ে আসছো, মেহমানের খাতিরে হলেও খাও।

সক্রেটিস সিমনকে বলল, মেহমান, তোমাকে খাতির করছে, নাও।

সিমন আঙুরের রস নিয়ে বলল, সক্রেটিস, তুমি সত্যি প্রত্যেক মঙ্গলবার এই দোকানে আসো কিন্তু কিছু কিনো না! তাহলে আসো কেন?

সক্রেটিস বলল, এই দোকানে এথেন্সের সব থেকে ভালো ভালো জিনিস আছে। কিন্তু এসবের কিছুই আমার নেই। এগুলো কেনার ক্ষমতাও আমার নেই। এত এত জিনিস ছাড়াও যে আমি ভালো থাকতে পারি, সেটি পরীক্ষা করতে আসি। কত দামি দামি জিনিস বাদ দিয়েও যে সুন্দর জীবন পাওয়া যায়, সেটি বোঝার জন্য আসি। আমার উদ্দেশ্য— অল্প সম্পদে সুন্দর জীবন।

সক্রেটিস মজা করতে করতে এমন সব কথা বলে যে, সবাই অবাক হয়ে যায়।

সিমন ভালো করে তাকাল সক্রেটিসের দিকে। খালি পা। কোমরে ঝুলছে এক টুকরো কাপড়। কাঁধে চিকন সুতার মতো একটা কিছু। আর কিচ্ছু নেই।

প্রথম যখন সিমনের দোকানে ঢুকেছিল, তার পায়ে জুতা না দেখে সিমন রেগে গিয়েছিল। আজ তার খালি পায়ের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধা হচ্ছে। তার পা খালি, কারণ তার জুতার দরকার নেই। যা কিছু বর্জন করে জীবন যাপন করা যায়, তা সে অবলীলায় বর্জন করেন।

সক্রেটিসের কথায় সিমন মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু দোকানির মাথায় হাত। দোকানি ভাবছে, সক্রেটিস তো মানুষকে অল্প জিনিস দিয়ে জীবন যাপন করতে বলছে। এটি দোকানির জন্য ভালো খবর না। এতে তার ব্যবসা কমে যাবে। সে বলল, বড় অন্যায় কথা। লোকে ভালো ভালো জিনিস না কিনলে আমি বেচবো কী?

সক্রেটিস বলল, তোমার ভয় নেই। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। লোকে কী কিনবে, সেটি লোকের স্বাধীনতা। আর তুমি কী বেচবে, সেটি তোমার স্বাধীনতা।

দোকানি ভাবল, এক্ষুনি বিষয় ঘুরাতে হবে। সক্রেটিস যদি বলতেই থাকে যে দামি দামি জিনিস কেনা খারাপ, তাহলে ব্যবসার তেরোটা বেজে যাবে। বিষয় বদলাতে সক্রেটিসকে একটি যুতসই প্রশ্ন করতে হবে। ঠিক মতো প্ৰশ্ন করতে পারলেই সক্রেটিস সেটি নিয়ে হৈহৈ করে উঠবে। দোকানি চিন্তা করছে। ভালো কোনো প্রশ্ন মাথায় আসছে না। তখন ভাবল এই মাত্র সক্রেটিস বলেছে স্বাধীনতা। এটি দিয়েই প্রশ্ন করি। সে জিজ্ঞেস করল, তুমি বললে, আমি যা বেচব সেটি আমার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা জিনিসটা কী?

তার কথায় সক্রেটিস খুব খুশি। কেউ যদি এসে বলে, আমি এটি জানি না তাহলে সে খুশি হয়। পৃথিবীতে জ্ঞানের কোনো শেষ নেই। এই বিপুল জ্ঞান সাগরের সবই মানুষের অজানা। মানুষ আসলেই খুব বেশি কিছু জানে না। সেজন্য কেউ যদি এসে বলে আমি একটা কিছু জানি না, তার মানে হলো সে সত্য কথা বলছে। সে আরও জানতে চায়। যারা জানতে চায় সক্রেটিস তাদের খুব ভালোবাসে।

দোকানি জানতে চেয়েছে। সক্রেটিস দোকানিকে ভালোবেসেছে। সে দোকানির জন্য এখন বের করবে ‘স্বাধীনতা কী বস্তু’। তার বের করার তরিকা আলাদা। সে নিজে উত্তর করবে না। সে প্রশ্ন করবে। যে জানতে চায়, তার মুখ থেকেই উত্তর বের হবে। এটিই তার প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা।

সক্রেটিস বলল, চলো বের করি স্বাধীনতা মানে কী। আগে তুমিই বলো স্বাধীনতা কী জিনিস? যা মনে আসে, তাই বলো। কোনো ভয় নেই।

দোকানি বলল, স্বাধীনতা মানে নিজের অধীনতা। আমি অন্য কারও অধীনে নই। নিজের যা ইচ্ছা হবে, তাই করতে পারা।

সক্রেটিস বলল, যা ইচ্ছা তাই করা? তাহলে আমার ইচ্ছা হচ্ছে এখন তোমাকে খুন করব, সেটি কি আমার স্বাধীনতা?

‘না, না। কী বলছো? আমাকে খুন করবে? তোমার বিবেক আছে। বিবেচনা আছে।’

‘ভালো বলেছ বিবেক-বিবেচনা। যা খুশি করার আগে ভাবতে হবে। কিন্তু ধরো আমার বিবেচনা নেই। আমার ইচ্ছা আমি তোমাকে খুন করব? এটি কি আমার স্বাধীনতা?’

‘না, না। দেশে আইন-কানুন আছে তো।’

‘খুব ভালো। ঠিক জায়গায় এসে গেছ। তাহলে স্বাধীনতা কী দাঁড়াল, বলো।’

দোকানি বলল, ‘নিজের বিবেক-বিবেচনা দিয়ে বিচার করে এবং দেশের আইন মেনে অন্যের অধীন না হয়ে নিজের ইচ্ছায় চলার নামই স্বাধীনতা।’

সক্রেটিস বলল, চমৎকার। আমি একমত।

এতক্ষণ ক্রিতো কিচ্ছু বলেনি। এবার সে দোকানিকে বলল, তুমি দেখেছো, ‘স্বাধীনতা কী’ সেটি সক্রেটিস বলেনি। সে শুধু প্রশ্ন করেছে। তুমি নিজেই বলেছ, স্বাধীনতা কী।

দোকানি বলল, ঠিক।

ক্রিতো বলল, সক্রেটিসের প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলায় আজ এই দোকানের মধ্যে জ্ঞানের জন্ম হলো। আমরা বুঝতে পারলাম স্বাধীনতা কী। এই যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জ্ঞানের জন্ম দেওয়া, এটির নাম সক্রেটিসের পদ্ধতি বা সক্রেটিক মেথড। এজন্যেই সক্রেটিস জ্ঞানের ধাত্রী।

দোকানি বলল, জ্ঞানের ধাত্রী?

ক্রিতো বলল, হ্যাঁ, জ্ঞানের ধাত্রী

সক্রেটিস বলল, প্রতিটি মানুষের মধ্যে অসীম শক্তি আছে। সেটি বোঝা যায় না। সে নিজেও জানে না, তার ভেতরে কী গভীর ক্ষমতা আছে। কিন্তু ঠিক মতো প্রশ্ন করতে পারলে, তার ভিতরের জিনিস বের হয়ে আসে। তখন সবাই বিস্মিত হয়, সে নিজেও বিস্মিত হয়। আমি মানুষের ভেতরের এই বিস্ময়টা ভালোবাসি। প্রশ্ন করে করে ভেতরের শক্তি বের করে আনি। নতুন নতুন জিনিস জানতে পারি 1 সেজন্যেই আমি জ্ঞানের দাইমা। জ্ঞানের ধাত্রী।

এতক্ষণে দোকানে অনেক ভিড় হয়ে গেছে। হই-হল্লায় চারপাশের মানুষ দোকানে ঢুকে পড়েছে। এখন দোকানির বেচা-কেনা শুরু হবে। সক্রেটিস, ক্রিতো আর সিমন দোকান থেকে বের হয়ে গেল।

***

৩৯. খ্রি. পূ. ৫ম শতকে (সক্রেটিসের জীবনকালে) এথেন্সের রুপার মুদ্রার নাম ছিল আউল বা ওবল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *