হেমলকের নিমন্ত্রণ – ১

‘আমি পৃথিবীতে এসেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য, কখনই ঘৃণা করার জন্য নয়।’ — সফোক্লিস

***

এই বয়সের ছেলেরা খুব সহজেই যুবতিঘটিত সমস্যায় পড়ে।

কিন্তু এই ছেলেটি কোনো যুবতিঘটিত সমস্যায় পড়েনি। তার সমস্যা যুবকঘটিত। সে এক দুষ্ট যুবকের খপ্পরে পড়েছে। শুধু খপ্পরে পড়েনি, একেবারে দুষ্ট যুবকটির চ্যালা হয়ে গেছে। তার সাথে দিনরাত টো টো করে। তার কথাতেই ওঠে, তার কথাতেই বসে। মা-বাবাকে মানে না। দুষ্ট যুবকের সাথে মিশে সে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাকে সুপথে আনতে বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছেন। ঝাড়ফুঁক করেছেন, তুকতাক করেছেন। কিছুতেই কিছু হয়নি।

ছেলেটির নাম ক্রিতো[১]। আর যে দুষ্ট যুবক তাকে নষ্ট করছে, তার নাম সক্রেটিস[২]। সক্রেটিসের বয়স বাইশ। আর ক্রিতো এবার বিশ বছরে পড়েছে।

তারা এথেন্স শহরের বাসিন্দা। ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এজিয়ান সাগরের তীরে তাদের শহর এথেন্স। পাহাড় ঘেরা এই শহরটি খুবই মনোরম। একেবারে চোখ-জুড়ানো। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, নীল সাগরে পা ভিজিয়ে পাহাড়কে ফাঁকি দিয়ে আকাশের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে শহরটি। সেই কথায় কান রাখলে বোঝা যায়— এটি আনন্দের শহর, জ্ঞানের শহর, শান্তির শহর।

এই শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ইমিতোস নামক একটি পাহাড়ের কোলে সক্রেটিস ও ক্রিতোর বাড়ি। পাড়াটির নাম এলোপেকি। এই পাড়ায় ঘন সবুজ জলপাই গাছের ফাঁকে ফাঁকে অনেকগুলো লাল-সাদা বাড়ি। সেগুলোর মধ্যে যে বাড়িটি সবচেয়ে ছোট, সেটি সক্রেটিসের বাবার; আর যে বাড়িটি সবচেয়ে বড়, সেটি ক্রিতোর বাবার।[৩]

ক্রিতোর বাবা বিরাট ধনী মানুষ। এমন ধনী যে, হাত ঝাড়া দিলেই ঝরঝর করে টাকা-পয়সা পড়ে। মারাত্মক রকমের ধনীরা বড় বড় সমস্যা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু ছোটখাটো আলতু-ফালতু সমস্যায় খুবই কাহিল হয়ে যায়। ক্রিতোর পিতাও সেরকম একটি ফালতু সমস্যায় কাহিল হয়ে গেছেন। তার সমস্যার নাম ‘সক্রেটিস’।

সক্রেটিস তার পাশের বাড়ির ছেলে। ছেলেটি কোনো কাজের নয়। দিনরাত খালি পায়ে ঘোরে। কাজ-কর্ম কিছুই করে না। সে নাকি জ্যোৎস্নাভুক— চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচে। সংসারের কোনোকিছুতেই তার বিন্দুমাত্র নজর নেই। বাবা- মা অনেক বোঝায়। কিন্তু বুঝ মানার মতো ছেলে সক্রেটিস নয়।

ইদানীং সক্রেটিসের একটি রোগ হয়েছে— প্রশ্নরোগ। সে সবকিছুতে প্রশ্ন করে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। বিনা প্রশ্নে সে কিচ্ছু মেনে নেয় না। মুরুব্বিরা কিছু বললে অন্য সব ছেলে একবাক্যে মেনে নেয়, কিন্তু সক্রেটিস মানে না। পাল্টা প্রশ্ন করতে থাকে। তার প্রশ্নের যন্ত্রণায় মুরুব্বিরা অস্থির হয়ে যায়।

সক্রেটিসের এই প্রশ্নরোগ ভীষণ ছোঁয়াচে। কোনো এক রহস্যময় কারণে তার সাথে যে মিশে, সেও প্রশ্নরোগে আক্রান্ত হয়। সেও সবকিছুতে প্রশ্ন করতে শুরু করে। সক্রেটিসের কাছে একবার এলে তরুণরা অন্ধের মতো তাকে অনুকরণ করতে থাকে। ইলেকট্রিসিটির ছোঁয়ায় ধাতু যেমন ইলেকট্রিফাইড হয়, তেমনই সক্রেটিসের কাছে এলেই তরুণরা হয়ে যায় সক্রেট্রিফাইড।

ক্রিতোও সম্প্রতি সক্রেট্রিফাইড হয়ে পড়েছে। সেও এখন সবকিছুতে প্রশ্ন করে। মুরুব্বিদের মানে না। কিন্তু ক্রিতোর পিতা কিছুতেই ছেলেকে নষ্ট হতে দেবেন না। যে করেই হোক, তিনি সক্রেটিসের হাত থেকে পুত্রকে বাঁচাবেনই। সেজন্য তিনি মাঝে মাঝেই ছেলেকে মারধর করেন। যখন তখন উদ্ভট উদ্ভট উপায়ে শুরু করেন কঠিন পুত্ৰশাসন।

এই মুহূর্তে পুত্ৰশাসন চলছে।

সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। পাহাড় চুঁইয়ে আঁধার নামছে। আলো-আঁধারির রহস্যময় পরিবেশে এই মুহূর্তে ক্রিতোর পিতা পুত্রশাসন করছেন। কঠিন শাসন। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছেলেকে লাঠি দিয়ে মারছেন।

পুত্রশাসন দেখতে উঠানে অনেক মানুষের ভিড়। কিন্তু ভিড়ের মানুষ হাসছে। কারণ পিতার কাণ্ড-কারখানা দেখে কারওই মনে হচ্ছে না যে, এখানে পুত্রশাসন হচ্ছে। মনে হচ্ছে থিয়েটার চলছে। পিতার হাবভাব থিয়েটারের নায়কের মতো। হাতে একটি নকশি লাঠি। লাঠিতে লাল-সাদা ডোরাকাটা নকশা। লাঠিটি মাথার উপর ঘুরাচ্ছেন আর উচ্চ স্বরে আবৃত্তি করছেন মহাকবি হোমারের[৪] কবিতা। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তিনি ছেলেকে শাসন করছেন কবিতার ছন্দে। কিন্তু কবিতা ভালো মুখস্ত নেই। একটু পর পর ভুলে যাচ্ছেন। কবিতা ভুলে গেলেই আঘাত করছেন ছেলেকে। যেন সব দোষ কবিতার। সব দোষ কবি হোমারের।

ছেলেকে শাসন করতে তিনি অনেক কষ্টে হোমারের একটি কবিতার চার লাইন মুখস্ত করেছেন। পুত্রশাসনের কড়া কবিতা। কিন্তু দরকারের সময় ভুলে গেছেন। শুধু দুই লাইন মনে আছে—

কুপিতার সুপুত্র নাহি হয় ভবে
পিতা যদি ভালো হয়, পুত্র ভালো হবে।

পরের দুই লাইন ভুলে গেছেন। কিন্তু পরের দুই লাইনই আসল। সেখানেই আছে পুত্রের প্রতি উপদেশ। সেটি কিছুতেই মনে আসছে না। তিনি কবিতা বলছেন, আর ভিড়ের লোক হো হো করে হাসছে। ভীষণ রাগে ছেলেকে শপাং শপাং বাড়ি মেরে আবার প্রথম থেকে শুরু করছেন। কিন্তু দুলাইন শেষে তিন নম্বর লাইনে এসেই আবার ভুলে যাচ্ছেন। কিছুতেই মনে আসছে না। তবু চেষ্টা করেই চলছেন, আর প্রতিবার একই জায়গায় ভুলে যাচ্ছেন।

ভিড়ের মানুষ ভীষণ মজা পাচ্ছে। এত বড় ছেলেকে ভুলভাল কবিতা বলে মারছে, তাও নকশি লাঠি দিয়ে— এমন মজা বিনা পয়সায় মিলে না। সবাই হো হো করে হাসছে। সময় যত যাচ্ছে, মানুষের হাসি তত বাড়ছে। সারা উঠান হাসিতে গমগম করছে।

এখন ক্রিতোও হাসছে। চোখ ডলতে ডলতে হাসছে। শুধু ক্রিতোর মা ভেতরের ঘরে বসে কাঁদছেন। তিনি ঘরের বাইরে আসতে পারছেন না। এথেন্সে মেয়েদের পরপুরুষের সামনে আসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই তিনি ঘরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।

বাবা অনেক চেষ্টা করেও কবিতার পরের লাইন মনে করতে পারলেন না। তেত্রিশ বার চেষ্টা করে তিনি কবিতায় ক্ষান্ত দিলেন। ঠিক করলেন এই জীবনে আর কোনোদিন কবিতা পড়বেন না। আজ থেকে কবিতা হলো তার সবচেয়ে বড় দুশমন। ছেলেকে সুপথে আনতে কবিতা ব্যর্থ। এখন দরকার ঝাড়ি। কঠিন ঝাড়ি।

তিনি বিশাল এক ঝাড়ি মেরে ক্রিতোকে বললেন, তোমাকে সক্রেটিসের ভূতে ধরেছে? প্রশ্নের ভূত! আজকেই ভূত ছাড়াব। নকশি লাঠি দিয়ে ছাড়াব। লাঠিতে কাজ না হলে ঝাড়ু নেব। আমার যেমন নকশি লাঠি আছে, তেমনই নকশি ঝাড়ুও আছে।

ভিড়ের থেকে একজন বলল, জীবনে অনেক কিছু দেখেছি, কিন্তু নকশি ঝাড়ু কোনোদিন দেখি নাই। জিনিসটা দেখার বড়ই শখ। আলো থাকতে যদি ঝাড়ুখান বের করতেন, জীবনের একটি সাধ পূর্ণ হতো।

ক্রিতোর পিতা উত্তর দিলেন না। তিনি মজা করছেন না। ছেলে শাসনের মতো সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন।

তিনি আবার শক্ত গলায় ক্রিতোকে বললেন, আজ তোকে ধোলাই দেব। আগে লাঠি ধোলাই, তারপরে ঝাড়ু ধোলাই। জন্মের মতো সক্রেটিসকে ভুলে যাবি। বাপ-দাদার নাম ভুলে যাবি। নিজেকেও ভুলে যাবি।

ক্রিতো আস্তে আস্তে বলল, নিজেকে ভুলে যাব কী করে? আমি তো নিজেকে জানিই না।

পিতা বললেন, নিজেকে জানিস না? নিজের নাম জানিস না? বাপের নাম জানিস না?

ক্রিতো বলল, বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের নাম আমার ঠোঁটস্থ। গড়গড় করে বলতে পারি। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় সক্রেটিস হঠাৎ বলল, ‘নিজেকে জানো’। তারপর থেকে আমি কেবল ঐ কথাটাই শুনতে পাচ্ছি। মাথার ভেতর কে যেন বারবার ফিসফিস করছে, ‘নিজেকে জানো’, ‘নিজেকে জানো’।

বাবা কিছুই বুঝতে পারছেন না। ‘নিজেকে জানো’– এমন একটি সাধারণ কথা নিয়ে তার ছেলে কেন এমন করছে! ছেলের মুখের দিকে ফ্যাল- ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। তাকে হতভম্বের মতো লাগছে।

ক্রিতো আবার বলল, বাবা, আপনি কি নিজেকে জানেন?

পিতা বলতে গেলেন, জানি না মানে? অবশ্যই জানি।

কিন্তু বলতে পারলেন না। ভাবছেন, আমি কি সত্যি নিজেকে জানি? নাকি জানি না! এ কেমন প্রশ্ন! এর উত্তর তার জানা নেই। উত্তর দিতে না পেরে তার রাগ আরও বেড়ে গেল। বাড়িভরা লোকের সামনে তিনি অপমানিত হচ্ছেন। এজন্য দায়ী সক্রেটিস।

পিতা চেঁচিয়ে উঠলেন, নিজেকে জানো! এমন প্যাঁচমারা কথা সক্রেটিস ছাড়া আর কে বলবে? তোর মুখে যদি আর একবারও সক্রেটিসের নাম শুনি!

বলেই আবার লাঠি উপরে তুললেন। কিন্তু এবার আর লাঠি নিচে নামাতে পারলেন না। পেছন থেকে এক ভদ্রলোক লাঠিটি ধরে ফেলেছেন। লোকটি সুর করে বললেন,

দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় আগুন দিলাম নিজের ঘরে
অঙ্গার হলো সোনার অঙ্গ, সেই দুঃখ বলিব কারে?

এই ভদ্রলোক একজন কবি। ক্রিতোর বাবার ছেলেবেলার বন্ধু। কবি অনেক দিন বিদেশ ঘুরে এথেন্সে ফিরেছেন। তিনি সক্রেটিসকে চেনেন না।

কবি ক্রিতোর বাবাকে বললেন, কোথাকার কোন সক্রেটিসের জন্য নিজের ছেলেকে এমন করে মারছো?

ক্রিতোর বাবা বললেন, শুনলে তো— ছেলে কেমন বেআদব হয়েছে। মুরুব্বি মানে না। একটি কথা বললে বত্রিশটা কথা শুনায়। সব ঐ সক্রেটিসের কুবুদ্ধি। সে পোলাপানের মাথায় পোকা ঢুকাচ্ছে। গুঁড়া গুঁড়া পোকা। প্রশ্নের পোকা। সব বাচ্চা-কাচ্চাকে নষ্ট করে ফেলছে ঐ মহাদুষ্ট সক্রেটিস।

কবি বললেন, এথেন্সের সব বাচ্চাকে নষ্ট করে ফেলছে একটি মাত্র ছেলে? তার নাম সক্রেটিস? তাহলে তো সক্রেটিস একটি মারাত্মক জিনিস। এমন জিনিস একবার নিজের চোখে দেখতে চাই। কোথায় আছে তোমার সক্রেটিস?

উত্তর দিল ক্রিতো। বলল, চাচা চলেন, আমি আপনাকে সক্রেটিসের কাছে নিয়ে যাই। বাবাকে অনেকদিন বলেছি। বাবা সক্রেটিসের কাছে যাবেন না। বাবা সক্রেটিসকে ভয় পান।

‘ভয় পান?’

ক্রিতো বলল, হ্যাঁ, এথেন্সের সব বুড়ো সক্রেটিসকে ভয় পান। যমের মতো ভয়। ওনারা সক্রেটিস-ফোবিয়ায় আক্রান্ত। সক্রেটিসকে দেখলেই দৌড়ে পালান।

কবি ক্রিতোর পিতাকে বললেন, সক্রেটিস-ফোবিয়া! মানে সক্রেটিসভীতি? ধুর্, যতসব আজগুবি কথা! চলো, আমার সাথে চলো। তোমার সক্রেটিসভীতি আজই দূর করে দেব।

ক্রিতোর বাবা কিছুই বলছেন না।

কবি আবার বললেন, একটু সাহস করো। সাহস খুবই কাজের জিনিস। সাহস বিষয়ে কবি হোমার তার ‘অডিসি’[৫] বইয়ের শুরুতেই একটি চমৎকার কথা বলেছেন। ‘অডিসি’র শুরুতেই অডিসিয়াসের ছেলেকে সাহস দিতে দেবী এথিনা বললেন,

যুবক, বাঁধ ভেঙে এসো, পথে নামো- সাহসী হও,
সময়ের গহ্বর থেকে নিজের নামটা জিতে লও,
যে নাম বেঁচে রবে একাল থেকে সেকাল
সব কাল পার হয়ে ঐ সুদূরের মহাকাল।

কবিতা শুনে ক্রিতোর বাবা ক্ষেপে গেলেন। তিনি একটু আগে অনেক চেষ্টা করেও কবিতার দুইটি লাইন মনে করতে পারেননি। আর তার কাছে এসে ফটর ফটর করে কবিতা বলছে। হোমারের কবিতা! রাগে তিনি হাতের নকশি লাঠি আবার মাথার উপর ঘোরালেন। বললেন, তুমি যেটি বললে, সেটি হলো বাচ্চা ছেলেকে সাহস দেওয়ার কবিতা। তুমি এই কবিতা আমাকে বলছো! আমাকে কি তোমার বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে?

কবি বললেন, ভুল হয়েছে। ক্ষমা দাও। কাজের কথায় আসো। সাহস করে চলো সক্রেটিসকে একটি শিক্ষা দিয়ে আসি।

ভিড়ের মানুষ হইহই করে বলল, চলেন, চলেন, আমরাও যাই। সক্রেটিসকে শিক্ষা দিয়ে আসি।

.

ভিড়ের মানুষ বুঝেছে, ক্রিতোর বাবার হম্বি-তম্বি শেষ। তাই এখানের মজাও শেষ। নতুন মজা পেতে এখন সক্রেটিসকে দরকার। তাকে সামনে পেলেই নতুন কিছু ঘটবে।

একজন বলল, তাড়াতাড়ি চলেন। গোধূলি লগ্নের বেশি বাকি নাই। শিক্ষা দেওয়ার জন্য গোধূলি লগ্নই সবচেয়ে উত্তম।

ক্রিতোর পিতা বললেন, আমি যাব না। আমি সত্যিই সক্রেটিসকে ভয় পাই। সত্যিই আমার সক্রেটিস-ফোবিয়া আছে।

ভিড়ের থেকে একজন বলল, ভয় তো পাবেনই। সক্রেটিস নাকি ইদানীং আসপাশিয়ার[৬] বাড়ি যায়।

কবি বললেন, কার বাড়ি যায়?

‘আসপাশিয়ার বাড়ি।’

‘কে এই আসপাশিয়া?’

ক্রিতোর বাবা ইশারা করে কবিকে থামালেন। ফিসফিস করে বললেন, চুপ যাও। কুট্টি পোলাপানের সামনে মান-সম্মান যাবে। আসপাশিয়া অসাধারণ রূপসী একটি মেয়ে। কিন্তু অভদ্র পল্লিতে থাকে। তাকে নিয়ে কথা বলো না। এগুলো গুজব। সক্রেটিসের নানান দোষ আছে, কিন্তু মেয়েঘটিত দোষ নাই। আসপাশিয়ার ব্যাপারে পরে আলাপ হবে। এত মানুষের সামনে বলা যাবে না।

কবি ইশারা বুঝলেন। ক্রিতোও ইশারাটা খেয়াল করল। ভিড়ের মানুষ ফিসফিস করছে, আসপাশিয়াকে চেনো? সক্রেটিস নাকি আসপাশিয়ার বাড়ি যায়!

কবি কথা ঘুরিয়ে বললেন, চলো, চলো। সক্রেটিসকে শিক্ষা দিতে চলো।

ক্রিতোর বাবা বললেন, অন্ধকার নামছে। মশালচি সাথে নিয়ে যাও।

মশাল হাতে দুইজন লোক বেরিয়ে এলো। এরা ক্রিতোদের দাস। এখানে সন্ধ্যার পরে সবাই মশাল নিয়ে চলাফেরা করে। ধনীরা নিজ হাতে মশাল নেয় না। তাদের সব কাজের জন্য আলাদা আলাদা দাস আছে। মশাল বহনের জন্যও আছে মশালচি। ক্রিতোদের অনেকগুলো দাস। তাদের শুধু মশালচিই আছে আট জন।

দেবী এথিনার[৭] নাম নিয়ে কবি যাত্রা শুরু করলেন। এথেন্স শহরের প্রধান দেবীর নাম এথিনা। গ্রিক ভাষায় শহরের নামও এথিনা। এখানে যেকোনো শুভকাজ এথিনার নামেই শুরু হয়।

ক্রিতো পথ দেখিয়ে সবার আগে হাঁটছে। তার সাথে চলছেন কবি। পেছনে এক ঝাঁক মানুষ। তাদের হাতে জলপাই তেলের মশাল। এখানে সবার জলপাই গাছ আছে। জলপাই থেকে তেল হয়। সব কাজে সেই তেল ব্যবহার করা হয়। মশাল মিছিল এগিয়ে চলছে সক্রেটিসকে খুঁজতে। তারা আনন্দে হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে। আজ সক্রেটিসের খবর আছে।

মশাল মিছিল এথেন্সের আগোরার পাশ দিয়ে চলছে। আগোরা মানে বাজার। নাম বাজার হলেও এথেন্সের সব অফিস, আদালত, জেলখানা সব এই আগোরার ভেতরেই। আগোরাই এথেন্সের মূলকেন্দ্র। আগোরার শেষ মাথায় গিয়ে ক্ৰিতো আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ যে পাহাড় থেকে নেমে আসছে একটি ছেলে। ওরই নাম সক্রেটিস।

সকলে পাহাড়ের ঢালে তাকাল।

সক্রেটিস আধো অন্ধকারে হাঁটছে। ঠিক হাঁটছে না, মনে হচ্ছে নাচছে। নাচতে নাচতে পাহাড় থেকে নামছে। তার নাচ দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। বাইশ বছরের একটি ছেলে রাস্তার মধ্যখানে একা একা তিড়িং-বিড়িং নাচছে। মজার ওপর মজা। ক্রিতো বলল, সক্রেটিস এরকমই, যখন-তখন নাচে। সুযোগ পেলেই নাচে। ও বলে, নৃত্যকলা শরীরকে সুন্দর রাখে।

কবি বললেন, তার মানে সক্রেটিস একজন নর্তক। ঘাটে-পথে নৃত্য করে। এজন্যই বুঝি সক্রেটিস দেখতে এত সুন্দর! একেবারে দেবতার মতো। তার রূপের রহস্য হলো পথে-ঘাটে নৃত্য করা!

সবাই আবার হো হো করে হেসে উঠল। কবি পিন দিয়েছেন। সক্রেটিসের চেহারা মোটেই সুন্দর নয়। সক্রেটিসের চেহারা অদ্ভুত। বিশাল বড় বড় চোখ। থ্যাবড়ানো বোঁচা নাক, চ্যাপ্টা ঠোঁট। এই অঞ্চলের মানুষের চেহারা খুবই সুন্দর। একেবারে দেবতার মতো। চোখ, নাক, মাথা সবকিছু জ্যামিতির স্কেল মেপে বানানো। সেই তুলনায় সক্রেটিসের চেহারা একেবারে বদখত। নাক, চোখ, মাথা কোনোকিছুরই জ্যামিতির হিসাব মিলে না। তাকে বানানোর সময় বিধাতা মনে হয় জ্যামিতি ভুলে গিয়েছিলেন। চেহারার দিক থেকে সক্রেটিস এক কথায় কদাকার। এথেন্সের সবাই ময়ূর হলে, সক্রেটিস ময়ূর সভায় কাক পক্ষী।

সক্রেটিস খালি পায়ে পাহাড় থেকে নামছে। এই ঠাণ্ডার মধ্যেও তার পা খালি। জুতা, খড়ম কিছুই নেই। গায়েও তেমন কিছু নেই। শরীরের দুই দিকে কোনোরকমে ঝুলছে ছোট্ট দু’টুকরো কাপড়। তবু মুখটা সুখী সুখী। আধা- ন্যাংটা, খালি পা, সুখী-সুখী মুখ। এত অল্প কিছু নিয়ে যে কোন মানুষ সুখী হতে পারে, সেটি কেউ বিশ্বাস করে না। লোকে বোঝে না, সক্রেটিস কি সত্যিই সুখী, নাকি সবটাই সুখের অভিনয়? যদি সুখের অভিনয় হয়, তাহলে সক্রেটিসের চেয়ে বড় অভিনেতা আর নেই

সুখী হোক আর না হোক— সক্রেটিস সবার থেকে আলাদা। সে রহস্যময়। তাকে বোঝা যায় না। তাই তার প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ। তার মতো আর কেউ নেই। তাকে একবার দেখলে আর ভোলা যায় না। ভিড়ের মধ্যেও তাকে আলাদাভাবে চোখে পড়ে। তার হাঁটার ভঙ্গিও উদ্ভট। এমন হাঁটার ভঙ্গি অন্য কারও নেই। সে সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটে। কীভাবে যেন দুই পা দুদিকে বাঁকিয়ে দেয়। তাকে হাঁটতে দেখলে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। কিন্তু তার হাঁটা আর চেহারা মিলে একটি ছবি তৈরি হয়। ছবিটি মনে গেঁথে যায় চিরদিনের জন্য। দূর থেকে এক নজরেই বলে দেওয়া যায় সক্রেটিস আসছে।

তরুণরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে। তার মধ্যে কী যেন একটি আছে। সে তরুণদের চমক দেয়। নিত্য নতুন চমক। সে কখনো একঘেয়ে নয়। তরুণরা চমক ভালোবাসে। তারা সক্রেটিসকেও ভালোবাসে। তারা সক্রেটিসের মতো হতে চায়। অনেক তরুণের কাছেই সে এক পরশ-পাথর। তাকে ছুঁলেই নাকি সোনা হওয়া যায়। কিন্তু বুড়োরা তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। তারা বলেন, ওর কোনো যোগ্যতা নেই। সব ভড়ং-ভাড়ং। ও ছোটদের উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করতে শেখায়। ওর সাথে মিশলে ছেলেপেলেরা আর মুরুব্বি মানে না। বুড়োরা বড় গলায় বলেন, সক্রেটিস বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর।

আলো একেবারেই কমে গেছে। প্রায় অন্ধকার। সক্রেটিস পিটপিট করে মশাল মিছিলের দিকে তাকাল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, এতজন বয়স্ক লোক তার কাছে এসেছে! নিশ্চয়ই ঘাপলা হয়েছে। বড় কোনো ঘাপলা।

সক্রেটিস বলল, কালিসপেরা।

এর মানে শুভসন্ধ্যা। জবাবে কেউ শুভসন্ধ্যা বলল না। তারা সক্রেটিসের সন্ধ্যাটি শুভ করতে আসেনি। অশুভ করতে এসেছে। অশুভ করার কাজটি শুরু করলেন কবি।

কবি সক্রেটিসের কানের কাছে মুখ নিয়ে গলার স্বর অস্বাভাবিক রকম মোটা করে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম?

সক্রেটিস কবিকে চেনে না। কিন্তু গলার স্বরে বুঝল ঘটনা খারাপ। এরা ঝগড়া করতে এসেছে। সে বুঝল ওরা চায় আমি ঝগড়া করি। গলা ফাটিয়ে জবাব দিই। কিন্তু সেটি করা যাবে না। ওরা যা চায়, সেটির উল্টোটা করতে হবে। মখমলের মতো ব্যবহার করতে হবে। মুখ থাকবে হাসি হাসি। গলার স্বরে থাকবে মধু। ওদের ফন্দিফিকির নষ্ট করে দিতে হবে।

সক্রেটিস মিষ্টি করে বলল, হ্যাঁ, আমার নাম সক্রেটিস সক্রোনিকাস। বাবার নাম সফ্রোনিকাস। দক্ষিণ পাড়ার এলোপেকি মহল্লায় বাড়ি। আপনারা এত মানুষ একসাথে কোথায় যাচ্ছেন? আমি কি কিছু ভুল করেছি? আমার কিন্তু ভয় লাগছে।

এমন মধুর ব্যবহার কবি আশা করেননি। তিনি ভেবেছিলেন— সক্রেটিস ভীষণ রকম ত্যাড়া। মুরুব্বিদের সাথে তর্ক করে। কিন্তু ছেলেটি তো অত্যন্ত ভদ্র। ব্যবহার অমায়িক! যুক্তি মিলিয়ে কথার পিঠে কথা বলছে। কোনো সন্দেহ নেই যে ছেলেটি জ্ঞানী। অথচ বিনয়ের একেবারে পরাকাষ্ঠা। গলার স্বরে মধু ঝরে ঝরে পড়ছে! কবির হিসাবে গণ্ডগোল লাগছে। কিন্তু তিনি সক্রেটিসকে শিক্ষা দিতে এসেছেন। নরম হওয়া যাবে না।

কবি বললেন, তুমি নাকি সবাইকে আলতু-ফালতু বুদ্ধি দিয়ে বেড়াচ্ছ?

সক্রেটিস আরও মিষ্টি করে বলল, ছি ছি, কী যে বলছেন! বুদ্ধি দিচ্ছি আমি? বুদ্ধি দিতে জ্ঞান লাগে। অনেক কিছু জানতে হয়। আমার কোনো জ্ঞান নেই। আমি শুধু একটি জিনিসই জানি, সেটি হলো— আমি আসলে কিছুই জানি না। আমি বুদ্ধি দেব কী করে?

কবি বললেন, তুমি নাকি এথেন্সের ছেলেদের নষ্ট করে ফেলছো?

সক্রেটিস বলল, জনাব, কাউকে নষ্ট করতে ক্ষমতা লাগে। আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আমি এখনও শিখছি। সবার কাছে শিখছি। এই মুহূর্তে আপনার কাছেও শিখছি।

কবি ভালো ঝামেলায় পড়েছেন। এই ছেলে ঝগড়া করছে না। কেউ ঝগড়া না করলে, পায়ে পা দিয়ে কতক্ষণ চালানো যায়। কবি চারপাশের মানুষের চোখে তাকালেন। জনতার চোখ বলছে— সক্রেটিস মিষ্টি ভাষায় সম্মান দিয়ে কথা বলছে। সক্রেটিস বড় মনের মানুষ। আর কবি অযথা ত্যাদড়ামি করছেন। কবি ছোট মনের মানুষ। কবি বুঝলেন— সক্রেটিসের সম্বন্ধে কিছুই না জেনে দলবল নিয়ে এসে তিনি ভুল করেছেন। তার সাথের লোকজনও এই ছেলেটির সম্বন্ধে কিছুই জানে না। মানুষের মুখে উল্টা-পাল্টা শুনেই সবাই ছেলেটিকে গালাগালি করে।

কিন্তু এখন কী করবেন কবি? তিনি এত লোকের নেতা হয়ে এসেছেন। সক্রেটিসকে শিক্ষা দিতেই হবে। কিন্তু কী বলবেন! মাথায় কিছুই আসছে না। সক্রেটিস তার মাথা আউলা করে দিয়েছে। তিনি কথা খুঁজছেন— ক্রিতো যেন কী একটি কথা বলে তার বাবার সাথে তর্ক করছিল! মনে পড়ছে না। তিনি ক্রিতোর দিকে তাকালেন। ক্রিতো হাসি দিল। এই হাসির নাম মিচকা হাসি। এই হাসির মানে হলো— এখন বোঝো কেমন লাগে! সেই হাসি দেখে কবির ভীষণ রাগ হলো। রাগ হলেও ক্রিতোর মিচকা হাসিতে কাজ হলো। কবির মনে পড়ে গেল— সক্রেটিস সবাইকে বলে বেড়ায়— ‘নিজেকে জানো’। তিনি ঠিক করলেন, এই ছেলেকে আর সুযোগ দেওয়া যাবে না। এখন ধমক দেওয়া শুরু করবেন। ধমকের উপর ধমক দিতে হবে।

তিনি বললেন, শোনো, এখন তো খুব ভালোমানুষির ভান ধরছো! ঐদিকে সবাইকে তো বাণী দিয়ে বেড়াচ্ছ— ‘নিজেকে জানো’। পিচ্চি পিচ্চি পোলাপানকে সামনে পেলেই বলো— নিজেকে জানো। ঠিক কিনা?

‘হ্যাঁ, ঠিক। আমি বলি, নিজেকে জানো।’

‘কেন বলো? জ্ঞান বেশি হয়ে গেছে? ঘাটে পথে জ্ঞান বিলাতে হচ্ছে? জ্ঞান রাখার ভাণ্ড পাচ্ছ না? লাগলে বলো— এথেন্সের সবচেয়ে বড় মটকি ‘এমফোরা’ কিনে দিই। এমফোরার উপরে বড় করে লিখে রাখবে সক্রেটিসের জ্ঞান-মটকি।’

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কবি ছাই দিয়ে ধরেছেন। আজ সক্রেটিসের খবর আছে।

সক্রেটিস মিষ্টি হেসে বলল, ‘জ্ঞান রাখার ভাণ্ড লাগবে না। আমার কোনো জ্ঞান নেই।’

‘জ্ঞান নাই, তো ষাঁড়ের মতো ‘নিজেকে জানো’, ‘নিজেকে জানো’ বলে চেঁচাও কেন? সোজা কথার সোজা উত্তর দাও। ধানাই-পানাই করবে না। ‘নিজেকে জানো’ কেন বলো?’

‘নিজেকে জানো— কথাটা আমি বলি। কিন্তু এই কথা আমার নয়। এই কথা আমরা সবাই জানি। আপনারা সবাই কথাটা দেখেছেন।

‘দেখেছি?’

‘হ্যাঁ, দেখেছেন।’

‘কথা দেখেছি?’

‘হ্যাঁ, এই কথাটা দেখেছেন।’

‘বেকুবে কয় কী! কথা নাকি দেখেছি? আরে, কথা কি দেখার জিনিস? নাকি খাওয়ার জিনিস?’

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কবিও হাসছেন। সক্রেটিসকে শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়েছে। ভিড়ের জনতা তুমুল মজা পাচ্ছে।

সক্রেটিস বলল, কথা দেখার জিনিস নয়। কিন্তু এই কথাটা আপনারা দেখেছেন। দেখেছেন ডেলফি[৮] নগরে দেবতা এপোলোর মন্দিরে। সেই মন্দিরের সামনের দেয়ালে খুব বড় করে লেখা আছে— নিজেকে জানো।

সবাই চমকে উঠল— ‘তাই তো, এটি তো সবাই দেখেছি। ডেলফিতেই তো আছে।’

ডেলফি এখানের প্রধান তীর্থস্থান। এথেন্সের সবাই অবশ্যই বছরে একবার হলেও ডেলফি শহরে যায়। সেখানে এপোলোর মন্দিরের পুরোহিত একজন ওরাকল। সে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। তার নাম পিথিয়া। পিথিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী শুনেই এখানকার বড় বড় সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এথেন্সে একজনও পূর্ণ বয়স্ক মানুষ নেই যে ডেলফিতে যায়নি। ডেলফির বিখ্যাত মন্দিরের একেবারে সামনে বিশাল বড় করে লেখা আছে— নিজেকে জানো’[৯]

কবি ধরা খেয়ে গেছেন। তার চোখ-মুখ কালো হয়ে যাচ্ছে। তিনিও এপোলো মন্দিরে কথাটা অনেকবার দেখেছেন। তার মনেই ছিল না। কিন্তু এখন আর স্বীকার করার উপায় নেই। ভিড়ের লোকজন ফিসফিস করছে। তারা সবাই কথাটা দেখেছে। সক্রেটিস এই সুযোগের আশায়ই ছিল। সে জনতার উদ্দেশ্যে বলল, ভাইয়েরা, কে কে কথাটা দেখেছেন, একটু হাত তোলেন।

ভিড়ের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল, কে কার আগে হাত তুলবে। তারা হৈ হৈ করে বলছে— ‘আমি দেখেছি’। ‘আমিও দেখেছি’। ‘আমি দশবার দেখেছি’। ‘আমি দেখেছি পঞ্চাশবার’।

ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, বোঝা গেল— আপনারা সবাই কথাটা দেখেছেন। কিন্তু কথাটা দেখেনি, এমন মূর্খ কি এখানে কেউ আছে?

কেউ হাত তুলছে না। পেছন থেকে আর একজন বলল, কবি সাহেব মনে হয় কথাটা দেখেন নি!

কবি চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। এখন সবাই সক্রেটিসের পক্ষে। কবি ফেঁসে গেছেন। এখন আর বলতে পারছেন না যে তিনিও কথাটি দেখেছেন। জনতার চোখে কবিই এখানে একমাত্র মূর্খ। ‘নিজেকে জানো’ – কথাটি একমাত্র কবিই দেখেননি।

কবি অবাক হয়ে দেখছেন, সক্রেটিসকে শিক্ষা দিতে যে জনতা তার সাথে এসেছে, তারা এখন কবিকে শিক্ষা দিচ্ছে। জনতার পক্ষ পাল্টাতে এক মুহূর্তও লাগে না। জনতা হৈ হৈ করছে। তুমুল হাসাহাসি। অপমান কাকে বলে কবি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

ক্রিতোও হাসছে। তার আশা পূরণ হয়েছে।

কবি ভাবছেন, একটু আগে সক্রেটিসকে যত ভোলা-ভালা মনে হয়েছিল, সে আসলে তা নয়। সে অনেক কিছু জানে। বুদ্ধির খেলায় ভীষণ পাকা।

সক্রেটিস জনতার উদ্দেশ্যে হাত তুলল। সে এখন কবিকে অগ্রাহ্য করছে। কবি এখন তুচ্ছ মানুষ। কবি এখন আর নেতা নন। সক্রেটিস বলল, ‘নিজেকে জানো’ কথাটি আপনারা সবাই দেখেছেন। এই কথাটি মন্দিরের গায়ে লিখে সেখানের ওরাকল পিথিয়া সবাইকে ডাক দিয়ে বলছেন, ‘শোন, আমি ভবিষ্যৎ বলতে পারি। এসো, আমার কাছে এসে তোমার ভবিষ্যৎ জানো।’ আর আমি ওই কথাটিকেই একটু ঘুরিয়ে বলি, তুমি নিজেই নিজেকে জানো। নিজের ভেতরের মানুষটাকে জানো। আত্মজ্ঞানী হও।

সবাই একদৃষ্টে সক্রেটিসের দিকে তাকিয়ে আছে। এই কদাকার ছেলেটা কেমন নতুন কথা বলছে! এখানের সবাই জানে, ওরাকল সবকিছু জানেন। এখন মনে হচ্ছে ওরাকলের চেয়েও সক্রেটিস বেশি জানে। সক্রেটিস এমনভাবে কথা বলছে, মনে হচ্ছে, এর চেয়ে সত্য কথা আর নেই। ওর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। এই ছেলেটি সত্যিই আলাদা। ওর সামনে অন্য সবাই তুচ্ছ।

ভিড়ের মানুষ নিজেদের অজান্তেই ফিসফিস করতে শুরু করেছে- ‘নিজেকে জানো। নিজের ভেতরের মানুষকে জানো।’

কবির হাঁসফাঁস লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ক্রিতোর বাবাই সঠিক সক্রেটিস আসলেই ভয়ংকর। কবিকেও সক্রেটিস-আতঙ্ক পেয়ে গেল।

কবি বললেন, আমাকে একটি সভায় জরুরি কবিতা পড়তে হবে। এখন যাই।

জরুরি কবিতা পড়তে কবি প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। সবাই হই হই করে উঠল। এই কবি আর সক্রেটিসের সামনে আসবেন না। তাকেও ঘিরে ধরল সক্রেটিস-ফোবিয়া। এখন থেকে তিনিও সবাইকে বলবেন, ‘সক্রেটিস খুব খারাপ ছেলে, ও মুরুব্বি মানে না, ওর কাছে ভুলেও ছেলেদের যেতে দিও না।’

ক্রিতো আনন্দে সক্রেটিসকে জড়িয়ে ধরল। এই মুহূর্তে ক্রিতোর চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। সন্ধ্যায় সে বাবার হাতে মার খেয়েছে। আর সেই ঘটনা থেকেই কবির সাথে জ্ঞানযুদ্ধে সক্রেটিস কবিকে পরাজিত করল। ক্রিতোর খুব ভালো লাগছে। অনেক কষ্টের পর অনেক আনন্দের মতো মধুর জিনিস পৃথিবীতে আর নেই। ক্রিতোর আকাশ ছুঁতে ইচ্ছে করছে। সে বিশাল বিশাল লাফ দিচ্ছে। লাফ দিয়েই সে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। সক্রেটিসকে সে অনেক ভালোবাসে। তার জন্য সে সবকিছু করতে পারে। ক্রিতোর এমন গভীর ভালোবাসার কথা সক্রেটিস জানে। সেও ক্রিতোকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। সে নৈঃশব্দ্যে বন্ধুর আকাশ ছোঁয়া লাফালাফি দেখছে।

সক্রেটিসের বন্ধুভাগ্য খুবই ভালো। এথেন্সের সবচেয়ে ভালো তরুণরাই তার বন্ধু। তরুণদের নানা রকম নেশা থাকে। সক্রেটিস আর তার বন্ধুদের নেশা হলো জ্ঞানের নেশা। তারা এক-একজন জ্ঞানখোর। এই বন্ধুরা কিছুদিন ধরে একটি খেলা শুরু করেছে। তারা মনে করে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হচ্ছে সক্রেটিস। কিন্তু শুধু মনে করলে তো হবে না। প্রমাণ চাই। প্রমাণ করার জন্য তারা যেকোনো ছুতায় একজন মুরুব্বিকে পাকড়াও করে নিয়ে আসে সক্রেটিসের সামনে। আলাপ শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সক্রেটিস প্ৰমাণ করে দেয় যে, ঐ মুরুব্বি তেমন কিছুই জানেন না। মুরুব্বি পালাতে পালাতে বলেন, ‘সক্রেটিস একটি শয়তান, সে মুরুব্বি মানে না।’ আর বন্ধুরা হৈ হৈ করে ওঠে, আরও একবার প্রমাণিত হলো যে সক্রেটিসই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ। বাকি সবাই ফাটাবাশ।

সক্রেটিস নিজে বিশ্বাস করে না যে, সে খুব জ্ঞানী মানুষ। সে মনে করে এটি একটি খেলা। জ্ঞান নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। বন্ধুরা খেলছে। সময় ভালো কাটছে। মন্দ কী! এই খেলা সক্রেটিসের জন্য মন্দ কিছু নয়, কিন্তু মুরুব্বিদের জন্য খুবই ভয়ংকর। তাদের মান-ইজ্জতের বারোটা বাজাচ্ছে ইঁচড়ে পাকা সক্রেটিস। তাই সক্রেটিস তাদের শত্রু হয়ে যাচ্ছে। এই জ্ঞান-জ্ঞান খেলার ফলাফল হলো— এথেন্সের এক দল মানুষ এখন সক্রেটিসের চরম শত্রু, আরেক দল পরম বন্ধু।

ক্রিতোর লাফালাফি শেষ হয়েছে। সক্রেটিস আর ক্রিতো পাহাড়ের উপর পা ছড়িয়ে বসেছে।

সামনে এজিয়ান সাগর। এই সাগর ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। দুপুরের পর হয়ে যায় টলটলে নীল। তখন মনে হয় চেনা সাগরের অচেনা পানিতে ভাসছে একগুচ্ছ নীলকণ্ঠ ফুল। কাকে যেন ভালোবেসে সাগরটি নীল হয়ে গেছে। কাকে ভালোবেসেছে ও? কার ভালোবাসার রং অমন ভয়ংকর নীল! আবার শেষ বিকেলে এই নীল সাগর রাঙা হতে থাকে। সন্ধ্যার মিষ্টি আলোয় কেমন লাজুক হয়ে ওঠে I

লাজুক সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে সক্রেটিস। তার মনে হচ্ছে— সাগরের লজ্জারাঙা পানিতে সে ভাসছে। স্বপ্ন ধুয়ে ভাসছে। আবার মনে হচ্ছে— সে উড়ছে। জীবন ভিজিয়ে উড়ছে। সাথে উড়ছে সাগরের সাদা পাখি সিগাল। এজিয়ান সাগরের শঙ্খবুক-কমলাচঞ্চু সিগাল। পাখিগুলো দেখলেই ধরতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ধরা দেয় না। সুখের মতো বদমাশ। সাগর তীরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট পাহাড়ি দ্বীপ। দুঃখের মতো বেহায়া। সরাতে চাইলেও নড়ে না।

সক্রেটিস তন্ময় হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্রিতো ভাবছে, আজ সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে যা হলো সেটি সক্রেটিসকে বলবে কিনা! এই মুহূর্তে সক্রেটিস আনন্দে আছে। তার সাথে বন্ধুত্বের অপরাধে ক্রিতোর বাবা ক্রিতোকে মেরেছে, এটি শুনলে সে দুঃখ পাবে। মানুষকে দুঃখ দিয়ে কারও কোনো লাভ হয় না। কিন্তু বন্ধুকে পিন মেরে ব্যাপক আনন্দ লাভ হয়। ক্রিতো সক্রেটিসকে পিন মারবে। নারীঘটিত পিন। আসপাশিয়াকে নিয়ে পিন। মেয়েদের নিয়ে পিন মারতে হয় ফিসফিস করে। ক্রিতো ফিসফিস করে বলল, ঘটনা তো মানুষ জেনে গেছে।

সক্রেটিস বলল, কোন ঘটনা?

‘তার ঘটনা।’

‘তার ঘটনা মানে কার ঘটনা?

ক্রিতো আরও ফিসফিস করে বলল, আসপাশিয়ার ঘটনা। মানুষ জেনে গেছে, তুমি আসপাশিয়ার কাছে যাও।

সক্রেটিস বলল, হু, আমি যাই। সবার সামনেই তো যাই। গোপনে যাই না তো!

ক্রিতো এবার সক্রেটিসের একেবারে কানের কাছে মুখ এনে গভীর রহস্য নিয়ে বলল, মানুষ কিন্তু নানান কথা শুরু করেছে। আজেবাজে কথা। কুকথা। সুড়সুড়ি লাগা কথা।

সক্রেটিস বলল, তুমি ফিসফাস বন্ধ করো। মানুষ বাজে কথা বললেই আমি বাজে লোক হয়ে যাব না, আসপাশিয়াও বাজে মেয়ে হয়ে যাবে না। সে ভীষণ বুদ্ধিমতী, অসাধারণ জ্ঞানী, অনেক উঁচু স্তরের একজন মানুষ।

‘তাহলে তার নামে এত বাজে কথা কেন?’

সক্রেটিস বলল, ‘বাজে কথার অনেকগুলো কারণ। এক নম্বর কারণ হলো আসপাশিয়া এথেন্সের নিয়ম-কানুন মানে না। সে নিয়ম-ভাঙা মেয়ে। এথেন্সের নিয়ম হলো মেয়েদের থাকতে হবে অন্তঃপুরে; মেয়েরা এমনভাবে চলবে যেন সূর্যের আলোও শরীর স্পর্শ করতে না পারে। কিন্তু আসপাশিয়া ঘরে থাকে না, যেখানে খুশি যায়, যার তার সাথে মেশে। এথেন্সের লোকেরা এমন নিয়ম- ভাঙা মেয়ে সহ্য করতে পারে না। তারা তাকে বলে খারাপ মেয়ে।

দ্বিতীয় কারণ হলো এই মেয়ে অনেক জ্ঞানী। সে অনেক কিছু জানে। পুরুষরা কোনোদিন চায় না যে একটি মেয়ে তার চেয়ে বেশি জানুক। পুরুষের কাছে মেয়েরা হলো দুর্বল, অবলা। সেখানে এই মেয়ে অনেক বেশি সুবলা। সে চমৎকার কথা বলে। বক্তৃতা করতেও জানে। গান জানে। কিথারা যন্ত্রও বাজাতে পারে। যেকোনো বিষয়ে সুন্দর করে দু’চার কথা লিখে ফেলতেও পারে। এত গুণ থাকলে সেই মেয়েকে এমনিতেই পুরুষরা ভয় পায়। ভয় পেয়ে পথ আটকাতে চায়। আটকাতে না পারলে, তাকে নিয়ে নোংরামি শুরু করে। চরিত্রে কলঙ্ক দেয়।

এবার শোন তৃতীয় কারণ। আসপাশিয়া অসম্ভব রূপবতী। তার মতো সুন্দরী মেয়ে সারা গ্রিসে কোথাও নেই। কিন্তু তার রূপ ঠাণ্ডা আলোর মতো নয়, একেবারে আগুনের মতো জ্বলজ্বলে। এমন মেয়ে যেখানেই থাকুক, তাকে নিয়ে গুজব হবেই। তাকে নিয়ে আলাপ করতে মানুষের ভালো লাগে। তাকে জানুক আর নাই জানুক, সবাই তার কথা বলে বাহাদুরি নিতে চায়। এভাবে তৈরি হয় গুজব। মেয়েদের নিয়ে গুজব মানেই আজেবাজে কথা। মশল্লামাখা কথা।’

ক্রিতো বলল, শেষের কারণটাই আমার পছন্দ হয়েছে। সেই মেয়ে অত্যধিক সুন্দরী, তাই তাকে নিয়ে কানাঘুষা হয়। লোকে বলে, আসপাশিয়া হলো এই যুগের হেলেন। চারশো বছর আগে স্পার্টায় ছিল হেলেন, আর এখন এথেন্সে এসেছে আসপাশিয়া। হেলেনের রূপে তখন যেমন পুড়ে গিয়েছিল ট্রয় নগরী, তেমনই আসপাশিয়ার রূপে এখন পুড়বে এথেন্স নগরী।

সক্রেটিস বলল, মজা তো! আসপাশিয়া এথেন্সের হেলেন?

ক্রিতো বলল, হ্যাঁ, মানুষ ফিসফাস করে বলে, হেলেনকে চুরি করেছিল ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস। এখন আসপাশিয়াকে কে চুরি করবে? আজ বিকেলে লোকজন যা বলছিল, তাতে মনে হয় আসপাশিয়াকে তুমিই চুরি করবে?

অট্টহাসি দিয়ে সক্রেটিস বলল, ক্রিতো, তুমি এতদিনে আমাকে এই চিনেছ? আমি জ্ঞানচোর, কখনই মেয়েচোর নয়।

ক্রিতো বলল, বিশ্বাস নেই। আসপাশিয়াকে নিয়ে যেমন সুন্দর ব্যাখ্যা দিলে, তাতে বোঝা যায় তুমি তাকে নিয়ে সারাদিন ভাবো। তাই জ্ঞানচোর যে কবে মনচোর হয়ে যাবে, কিচ্ছু বলা যায় না।

সক্রেটিস বলল, একথা ঠিক। আমি আসপাশিয়াকে যেভাবে বুঝেছি, এথেন্সে অন্য কেউ সেভাবে বোঝেনি। সবাই তাকে শুধুই মেয়েমানুষ ভাবে, একমাত্র আমিই তাকে মানুষ ভেবেছি। যারা তার নামে বাজে কথা ছড়ায়, তারা কেউ তাকে চিনেই না। ক্রিতো, তুমি একদিন চলো, নিজেই দেখবে, এমন মিষ্টি মনের মেয়ে এথেন্সে আর নেই। ও কথা বললেই মনে হয় চারদিকে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে, একটি নরম ভেজা ভেজা হাসি।

ক্রিতো বলল, থাক, আমার আর ভেজা ভেজা হাসির দরকার নেই। আমি তোমার সাথে ঘুরি শুনেই আমার বাবা মার-ধর শুরু করেছে। যদি শোনেন আমি আসপাশিয়ার কাছে গিয়েছি, আমার বাবা আত্মহত্যা করবে। আসপাশিয়ার ভেজা হাসি তোমারই থাকুক। আমার একটি শুকনা হাসির মেয়ে হলেই চলবে।

রাত বাড়ছে। আঁধারের সাথে পাল্লা দিয়ে ঠাণ্ডা নামছে। তারা বাড়ির দিকে রওয়ানা করল। পথে ক্রিতো বলল, কালকে নাকি থিয়েটারে যাচ্ছ?

সক্রেটিস বলল, ধুর, আমি নাটক-ফাটক দেখি না।

‘আমাদের সাথে দেখো না। কিন্তু ইউরিপিডিসের[১০] সাথে ঠিকই দেখো।’

‘হুঁম, আমি শুধু ইউরিপিডিসের সাথেই থিয়েটারে যাই। সে নাটক পাগল মানুষ। আমাকে বাড়ি থেকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। মানা করলে শোনে না। তবে তার সাথে থিয়েটারে গেলে লাভ আছে।’

‘লাভ?’

‘হ্যাঁ, সে সাথে থাকলে এক টিকেটে দুটি নাটক দেখা যায়।’

‘এক টিকেটে দুই নাটক? ঘটনা কী?’

‘ঘটনা হলো ইউরিপিডিস নাটক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। আর আমি বিশেষভাবে অজ্ঞ। সে জানে যে, আমি নাটকের ‘ন’ও জানি না। সেজন্য তার সাথে থিয়েটারে গেলে নাটক শুরু হওয়ামাত্র সে ধারাভাষ্য শুরু করে। অভিনেতারা অভিনয় করে মঞ্চে, আর ইউরিপিডিস অভিনয় করতে থাকে আমার কানের কাছে। আমি একবার মঞ্চে তাকাই, একবার তার দিকে তাকাই। এভাবে একটির পয়সায় দুটি নাটক দেখি।’

ক্রিতো হো হো করে হেসে বলল, তাহলে কাল যাচ্ছ থিয়েটারে?

‘হ্যাঁ, কালকে নাকি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি নাটক হবে।’

‘কী নাটক? নাট্যকার কে?’

‘নাটকের নাম ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’[১১] মানে প্রমিথিউস বন্দি। লিখেছেন আমাদের বুড়ো নাট্যকার এস্কিলাস[১২]।’

***

১. ক্রিতো : Crito, এথেন্সের দার্শনিক। সক্রেটিসের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সক্রেটিসের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার সাথে ছিলেন। তার নামে প্লেটো একটি ডায়ালগ লিখেছেন।

২. সক্রেটিস : Socrates, (খ্রি. পূ. ৪৬৯-৩৯৯), দর্শনের জনক।

৩. এথেন্সের কেন্দ্র (এক্রোপলিস) থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এলোপেকি (Alopece) নামক মহল্লায় সক্রেটিস জন্মগ্রহণ করেন। জায়গাটি ইমিতোস (Hymettus) নামক একটি পাহাড়ের পাদদেশে ছিল। এখন এই নামে কোনো পাড়া বা মহল্লা নেই, সেখানে কোনো বসতিও নেই।

৪. গ্রিক মহাকবি হোমার (Homer) সক্রেটিসের দুই/তিন শতাব্দী আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব সাত বা আট শতকের মানুষ ছিলেন। ট্রয়ের যুদ্ধের বীরদের নিয়ে তার রচিত ‘ইলিয়াদ’ ও ‘অডিসি’ মহাকাব্য দুটি সমগ্র ইউরোপীয় সাহিত্যের ভিত্তি।

৫. ট্রয় যুদ্ধে জয়ের পর গ্রিক যোদ্ধা অডিসিয়াসের গ্রিসে ফেরার কাহিনি নিয়ে হোমারের মহাকাব্য অডিসি (The Odyssey)। এই কবিতাটিসহ এই বইয়ে যেখানেই অডিসি মহাকাব্যের অনুবাদ দরকার হয়েছে, আমি Emily Wilson এর ইংরেজি (The Odyssey) অনুবাদ থেকে বাংলা করেছি।

৬. আসপাশিয়া (Aspasia): এথেন্সের সবচেয়ে বিখ্যাত নারী দার্শনিক। গণতন্ত্রের প্রধান নেতা পেরিক্লিসের সহচরী। গণতন্ত্রের ইতিহাসের সুবিখ্যাত Pericles Funeral Oration তিনি লিখেছিলেন বলে প্লেটো উল্লেখ করেন।

৭. এথিনা (Athena) : গ্রিকরা বিশ্বাস করত যে অলিম্পাস পাহাড়ে বারো জন দেবতা থাকেন, এথিনা তাদের একজন। তিনি জ্ঞানের দেবী।

৮. ডেলফি : Delphi, এথেন্স থেকে ১৮০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বিখ্যাত পবিত্র নগরী।

৯. মন্দিরে গ্রিক ভাষায় লেখা ছিল ‘Gnothi Seauton’, মানে ‘Know Yourself’.

১০. ইউরিপিডিস (Euripides): খ্রি.পূ. ৪৮০-৪০৬, তিন সেরা গ্রিক ট্র্যাজেডিয়ানের একজন।

১১. প্রমিথিউস বাউন্ড (Prometheus Bound) : ট্রাজেডির জনক এস্কিলাস রচিত ট্র্যাজেডি।

১২. এস্কিলাস : Aeschylus, (খ্রি.পূ. ৫২৪-৪৫৫), গ্রিক নাট্যকার, ট্রাজেডির জনক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *