হেনস্থা – তপনকুমার দাস
এ মাসের ফর্দে ওভার নাইট ক্রিম আর হেয়ার রিমুভার লেখার কথা ভুলো না কিন্তু। ওভারনাইট ক্রিমের একটা দলা হাতের তালুতে পিষতে পিষতে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয় চন্দ্রা। প্রথম শীত্রে কচি ঠাণ্ডা ঘেরা থমথমে ঘরে শব্দগুলো ভাসতে ভাসতে এসে আছড়ে পড়ে মিহিরের কানে। কথা তো নয় আদেশ। রস কষ হীন নিরেট নির্দেশ।
রাতের এই সময়টা বড় একান্ত সময়। চাকরির ঝনঝনানি নেই-কৌতূহল কোলাহলের হুল্লোড় নেই। বাস মোটরের হর্ণ নেই। ফাইল নেই। উপরওয়ালার হম্বি তম্বি নেই। ইউনিয়নের চলছে চলবে চিৎকার নেই। যা আছে তা হলো দুচারটে ঝি ঝি পোকার কি কি শব্দ। আর দু’জনকে দু’জনের নীরব চোখে দেখে নেওয়া। কিন্তু–
রাতের এই সময়টা বিছানায় আধশোয়া বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছেয়ে ফুসফুস ভরাতে ভরাতে মিহির আজকাল বাসি খবরের কাগজের বুকে চোখ বুলায়। কয়েক বছর আগেও মিহির আধবোজা চোখে তারিয়ে তারিয়ে চার শরীর জোড়া খাজুরাহের শ্রাবন্তী খুঁজতো। এই সময়টা চন্দ্রারও একান্ত নিজস্ব ছিলো। একরাশ পোষাকের জঞ্জালমুক্ত দেহটাকে কোনমতে একটা সুরি পাতলা নাইটিতে জড়িয়ে একের পর এক প্রসাধনের প্রলেপ ঢেলে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সাড়ে তিন ফুট আয়নার সামনে বসে থাকতো অনেকক্ষণ।
সংসারের টুকিটাকি কথাবার্তা বিনিময় করা ছাড়া এখন আর আগের মত কোন কথা বা গল্প খুঁজে পায় না ওরা। সংসার বলতে সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটে মাত্র দু’জনের বসবাস। চন্দ্রা আর মিহির। মৌমিতা এখন আর ওদের কাছে থাকে না। কালিম্পঙের একটা স্কুলে এবছরই কেজি ওয়ানে ভর্তি হতে পেরেছে। গত মাসেই ওরা দেখে এসেছে বাবা-মাকে ছেড়ে এতটুকু মেয়ের হোস্টেলে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।
মৌমিতার জন্য মাঝে মধ্যে মিহিরের মন খুব খারাপ হতো। এখন অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। চন্দ্রা রং তুলনায় অনেক কঠিন। মেয়েকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রথম সারিতে দাঁড় করাতে হবে-তাই অত মায়া দয়ার ধার ধারে না সে। আদর দিয়ে বাঁদর গড়ার চাইতে শাসন করে মানুষ গড়ে তোলাই তার একান্ত ইচ্ছে।
ভাল কথা! কাল আমাদের এসিকিউটিভ কমিটির মিটিং চুলের গোড়ায় ব্রাশ বোলাতে বোলাতে বলে চন্দ্রা, সুজাতাকে কিন্তু অযথা আটকে রেখো না।
ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে কোন স্পেশাল লাভের অর্ডার আসে নি। সিগারেটে শেষ টান দিতে দিতে বলে মিহির।
তোমরা খালি শিখেছ ম্যানেজমেন্ট আর অর্ডার। চুলের ব্রাশটাকে তর্জনীর মত উঁচিয়ে ধরে চন্দ্রা।
চন্দ্রা আর মিহির ফ্ল্যাটের এই ঘরটায় এখন এক ছাদের নীচে—ওরা স্বামী-স্ত্রী। গত এপ্রিল মাসে ওদের বিবাহিত জীবন নয় গড়িয়ে দশে পড়েছে। বস্ত্র দুয়েক আগেও দাম্পত্য জীবনের এই দিনটির কাহিনী নিয়ে হো হো করে রসিকতা করতো মিহির। বলতো, সাত বছ যে প্রেম করলাম সেটা বেমালুম উঠে যাবে? চন্দ্রা যুক্তি দিয়ে বোঝাতো, প্রেমের তো আর কোন লেখা জোখা তারিখ থাকে না। না থাক লেখা জোখা তারিখ, চন্দ্রা যেদিন কানুনগো সাহেবের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলো, সেটাই নাকি প্রেমের শুরু—মনে করে মিহির। একপাল আত্মীয়স্বজনের দঙ্গলে হঠাৎ লাজুক হয়ে ওঠা চন্দ্রার গলায় সাদা রজনীগন্ধার মালাটা টুক করে যেদিন পরিয়ে দিয়েছিলো, সেদিনের তারিখ মনে করতে এখনও সময় লাগে মিহিরের। কিন্তু কানুনগো সাহেবের কাছে বকুনি খাওয়ার তারিখটা তার জিভের আগায় সব সময় ভিড় করে থাকে–২১শে মে, মঙ্গলবার।
উফ! কি সাংঘাতিক। লাজুক লাজুক মেয়েটার বুকের ভেতর যে এমন তেজের আগ্নেয়গিরি ছিলো স্বপ্নেও সেদিন ভাবেনি মিহির। টাইপিস্টের কাজে নতুন যোগ দেওয়া মেয়েটার বসার টেবিল ছিলো ঠিক ওর সামনে। আর পাঁচ জোড়া কৌতূহলী চোখের মত মিহিরও চোখ মেলে দিয়েছিলো নবাগতা চন্দ্রা চৌধুরীর চালচলনের উপর। ব্যাস! তারপরই তুলকালাম। একুশে মে, মঙ্গলবার। মাত্র তিনদিনের কর্মচারী সারা অফিস দাপিয়ে মাথায় করে তুলেছিলো-বারুদ ফাটিয়েছিলো দুম করে কানুনগো সাহবের ঘরে। মিহিরের চোখে মনে বিন্দুমাত্র প্ররোচনা ছিলো না ছিলো না কোন আবেদন কিংবা নিবেদন। আর ভাগ্যি ভালো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ তখনও দানা বাঁধে নি। তাছাড়া ভাল গোবেচারা ছেলে হিসাবে অপিসে একটা সুনাম ছিলো মিহিরের। তবুও হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছিলো পুঁচকে ঐ মেয়েটার কাছে।
আজ রীতাদি বলছিলো তুমি নাকি ওকে জেনারেল সেকসানে ট্রান্সফার করার হুমকি দিয়েছ? ড্রেসিং টেবিল ছেড়ে চন্দ্রা উঠে এসেছে বিছানার কাছে। উবু হয়ে বসে বক্স খাটের ড্রয়ার খুলে একে এক বের করে আনছে বালিশ মশারি।
না ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়, বিছানা ছেড়ে নেমে এ্যাসট্রেতে সিগারেটের টুকরোটা চেপে ধরে মিহির, আসলে জেনারেল সেকসানে সিনিয়ার ক্লার্কের দরকার। তাছাড়া রীতা নন্দী একজন এফিসিয়েন্ট ওয়ার্কার।
এফিসিয়েন্সির নামে তোমাদের জারিজুরি সব আমার জানা আছে, ঝঝন করে বিছানার উপর পাতা বেড় শিটটা তুলতে তুলতে বলে চন্দ্রা।
আচ্ছা চন্দ্রা, তুমি মানে তোমরা কি চাও না অফিসের উন্নতি হোক….
থামো! তোমার গালভরা সব বকুনি। দু দিন আগে তুমিও তো ওদের মত হলঘরের কোনে বসে ফাইল আগলাতে। বদলে ফেলা বেডশিটটা ভাজ করতে করতে ধমকে ওঠে চন্দ্রা।
কথাটা অবশ্য মন্দ বলে নি। এই অফিসে মিহিরের প্রবেশ ইউ ডি ক্লার্কের বেশে। বছর পাঁচেক আগে মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিভাগীয় পরীক্ষায়। আজ অফিসের মালিক হয়ে বসতে পেরেছে। অফিসার হিসাবে কানুনগো সাহেবের চেয়েও নাকি মিহিরের দাপট অনেক অনেক বেশি। তাছাড়া ওর আমলে সারা অফিসের হাল হকিকতু বদলে গেছে। কলকাতায় যে অফিসের সবচেয়ে বেশি বদনাম ছিলো সেই অফিস গতবছর জাতীয় স্তরে প্রথম পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু সবটাই তো সম্ভব হয়েছে অলক্ষ্যে চন্দ্রার ভালোবাসায়, প্রশ্রয়ে আর নীরব উৎসাহে।
তাই চন্দ্রার কাছে এমন চাচাছোলা বুলি আশা করেনি মিহির। যতই ইউনিয়নের পাণ্ডা হোক না কেন সেকশন ম্যানেজারের স্ত্রী তো বটে। চন্দ্রার এই চাচাছোলা চরিত্র সেদিনের সেই একুশে মে মঙ্গলবারই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো মিহির। কানুনগো সাহেবের ধমক খেয়ে পরদিন থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলো অফিসে আসা। লজ্জায় অপমানে কয়েকদিন পরে রেজিষ্ট্রি পোষ্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলো ইস্তফার অগ্রিম নোটিস। অন্য সহকর্মীদের পই পই বারনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেয় নি মনকে। অন্য একটাও চাকরীও পেয়ে গেছিলো কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে-ধানবাদ খনি এলাকায়। কিন্তু বাদ সেধেছিলো চন্দ্রা নিজেই। অফিস ফেরত সন্ধ্যের সময় দুমদাম এসে সোজা ঢুকে গেছিলো ঠাকুর ঘরে-বিধবা মায়ের কোলের কাছে, ছেলেকে একটু শাসন করতে পারেন না। অফিসের বস কিনা কি বলেছে তাই চাকরি ছেড়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে ঘরের কোণে?
তুলসীর মালা আর নামজপ ভুলে ফ্যালফ্যাল করে বাঁশি হাতে বসে থাকা গোপালের দিকে চোখ রেখে থাকা ছাড়া সেদিন কোন ভাষা জোটে নি বাল্যবিধবা মিহিরের মায়ের মুখে। পাশের ঘর থেকে সব শুনছিলো, সব দেখেছিলো মিহির। অনর্গল খই ফোঁটানো চন্দ্রার শাসানি কানের লতি গরম করে দিয়েছিলো সেদিন, জমিদারি থাকলে আমার কিছু বলার নেই। ছেলেকে ঘরে বসিয়ে বোতলে করে দুধ খাওয়ান। আর তা না থাকলে শাসন করুন, অফিসে যেতে বলুন। শেষের শব্দগুলো এখনও মিহিরের কানে ইলশে গুঁড়ির মত ঝিরঝির করে বাজে। কারণ চন্দ্রার গলায় তখন ছিলো দলা পাকানো অম্বলের মতো কান্না মেশানো তেজ। যা একমাত্র চন্দ্রাকেই মানায়।
কিরে খোকা মেয়েটা কি বলছে—তুলসীর মালা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলো মা। ততক্ষণে চন্দ্রা এসে টানটান থমকে পড়েছিলো মিহিরের সামনে লম্বা শরীরটা ঢেকে দিয়ে—অসভ্যের মত মেয়েদের দেখলে উপরওয়ালার বকুনি একশো বার খেতে হবে। কিন্তু কাল অফিসে না গেলে সারা পাড়ায় পোষ্টার লটকে দেব যে তুমি আমায় বিয়ে করতে চেয়েও কথা রাখ নি। বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে নি চন্দ্রা। হু হু করে চৌকাঠ পার হয়ে সোজা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা রিক্সার বুকে নিজেকে সঁপে বিলীন হয়ে গেছিলো অন্ধকারের দেশে হিন্দি সিনেমাকেও হার মানিয়ে।
ফ্যাসাদ, বড় জ্বালা। হাজার চেষ্টা করেও মাকে বোঝাতে পারে নি মিহির। আর শেষ পর্যন্ত পুরানো অফিসে ফিরে আসতে হয়েছিলো কাজে। সবাই সেলিব্রেট করেছিলো ওর ফিরে আসা। এমন কি চন্দ্রাও। সময়ের ঢেউ ঠেলে অনেক কটা দিন পার হয়েছে ওদের জীবনে। মিহির ছুটছে ক্যারিয়ারের পেছন পেছন আর চন্দ্রাকে ছুটিয়েছে ইউনিয়ন। অফিসার হবার পর কর্মক্ষেত্রে যাতে দু’জনের সংঘাত ক্রমাগত দানা বেঁধে না ওঠে তার জন্য রানাঘাটে বদলির চেষ্টা করেছিলো মিহির–কিন্তু ম্যানেজমেন্ট মেনে নেয় নি।
ছিঃ চন্দ্রা তোমার মুখে একথা সাজে না, মৃদু অথচ দৃপ্ত হয়ে ওঠে মিহিরের গলার স্বর।
বিছানায় নতুন চাদর বিছানো ছেড়ে থমকে দাঁড়ায় চন্দ্রা কোন কথা?
অফিসার হবার খোটা, আয়নার সামনে গিয়ে চিরুনি তুলতে তুলতে বলে মিহির, তোমারই তো শখ ছিলো কানুনগো সাহেবের চেয়ারে আমাকে দেখার। বিপিন বাবু ঠিকই বলছিলো আজ…
কি বলছিলো বিপিনবাবু?ধনুকের ছিলার মত ভ্রু বাঁকায় চন্দ্রা, একটা আস্ত দালাল…
ভুলে যেও না বিপিনবাবু তোমার বাবার সহপাঠী ছিলেন।
ব্যাস-অমনি মাথা কিনেছেন কি? অসভ্য বেয়াদপ, দপ করে জ্বলে ওঠে চন্দ্রা, মেয়েদের গায়ে মা মা বলে হাত বোলান কি পিতৃস্নেহে….আমরা কি কিছুই বুঝিনা?
সুন্দরী মেয়েদের গায়ে হাত বোলাতে কোন পুরুষের না ইচ্ছা করে বলো? পরিস্থিতি এবং পরিবেশে হাল্কা প্রলেপ দিতে চায় মিহির।
ওসব ছেলেভুলানো কথা ছেড়ে আসল কথায় এসো, বিছানার উপর পাট-পাট চাদর ছড়াতে ছড়াতে বলে চন্দ্রা, কি বলছিলো বুড়ো ভামটা?
খারাপ কিছু বলে নি বিপিনবাবু। চেম্বারে বসে মিহিরও নিজের কানে শুনেছে আজ চন্দ্রার শ্লেষ ছড়ানো কথাগুলো। টিফিনের অবসরে মহিলা সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে চন্দ্রার বাণী ছিলো, সুপ্রিম কোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি হেনস্থা মানবাধিকার লঙঘন হিসাবে গণ্য হবে, পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা যাতে কর্মক্ষেত্রে কোন বৈষম্যের শিকার হয় সেজন্য সুস্থকাজের পরিবেশ তৈরি করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করাতে হবে কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি বা বাড়তি সুযাগ সুবিধা পাওয়ার জন্য আমরা কোন মতেই যেন পুরুষ কর্তৃপক্ষকে হেনস্থা করার সুযোগ করে না দিই বন্ধুগণ ঠাট্টা ইয়ার্কির মাধ্যমে আমাদের উপরওয়ালারা যেন কোন মতেই কোন বৈষম্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে। আপনারা জানেন মিহির বোস আমার স্বামী তা সত্ত্বেও কর্মচারী বন্ধু এবং বান্ধবীদের সামগ্রিক কল্যাণে ন্যায় এবং স্বার্থরক্ষার লড়াইয়ে তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করতে আমি বিন্দুমাত্র পিছপা হই নি এবং ভবিষ্যতেও হবো না
তারপরেও আরও কি যেন বলতে চেয়েছিলো চন্দ্রা কিন্তু শোনা যায় নি—চটপটাপট হাততালির দৌলতে। হাততালি শেষ হবার পর যেটুকু শুনেছিলো তা হলো— প্রয়োজনে ঘরে এবং সংসারেও আমি প্রতিবাদের বন্যা বইয়ে দেব যদি আপনারা এবং আপনাদের সার্বিক সমর্থন আমার সাথে থাকে….
কি হলো ভিজেবেড়ালের মতো ঘাপটি মেরে গেলে যে? সত্যি কথা বললে অমনই হয়। পাশাপাশি দুটো বালিশ রাখতে রাখতে বলে চন্দ্রা।
বিপিনবাবু খারাপ কিছু বলেনি, উলের পাপোষে পা মুছে বিছানায় উঠে পড়ে মিহির।
ভালটাই বা কি বললো শুনি, মশারিটা খাটের বাইরে ঝেড়ে নেয় চন্দ্রা।
বলছিলো, আজ দুপুরে তোমার বক্তৃতার কথা।
খুব আঁতে লেগেছে বুঝি?
দেখ চন্দ্রা, আমাদের ভেতর একটা বোঝাপড়া করে নেওয়া উচিত। বিছানায় চিৎ হয়ে নিজেকে এলিয়ে দেয় মিহির।
কিসের বোঝাপড়া? খাটের কোণে মশারির দড়ি ঝুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে চন্দ্রা।
যেমন ধরো আমরা প্রফেশনালি দু’জনে দুই মেরুর উপর দাঁড়িয়ে–আমি ম্যানেজমেন্ট সাইডে, তুমি কর্মচারীর পক্ষে। আবার এ্যাকসিডেন্টালী ব্যক্তিজীবনে আমরা স্বামী স্ত্রী। সুতরাং আমাদের মধ্যে একটা ক্লিয়ার আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা একান্ত প্রয়োজন। নিজের বক্তব্য বেশ জোরালো ভাবে বলতে পারায় তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিহির।
কি আন্ডারস্ট্যান্ডিং চাইছো? মশারি গোঁজা ফেলে থমকে বসে চন্দ্রা।
দেখ নারী পুরুষ আকৃতিগত পার্থক্যে গড়া দুটো জীবন হলেও মূলত তারা মানুষ। সমাজে, সংসারে কিংবা অফিসে উভয়েরই সমান সমান অবদান আছে। আছে আলাদা এবং স্বতন্ত্র ভূমিকা, বলতে বলতে উঠে বসে মিহির, স্বাধীন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেই যে যার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারবে।
তাই বলে তোমরা পুরুষেরা, দিনের পর দিন মেয়েদের হেনস্থা করবে, মুখ বুজে সহ্য করে যাব?
সেকথা আমি বলি নি। বোঝাতে চেষ্টা করে মিহির, বিপিনবাবু আমাদের পিতৃস্থানীয়। অপত্য স্নেহে সে যদি কারও মাথায় হাত রাখে—
আগাছা প্রথম দিনেই বিনাশ করতে হয় বুঝলে, ফোঁস করে ওঠে চন্দ্রা, নইলে জঙ্গল হয়ে যায়। আজ মাথায় হাত রাখছে কাল বুকে হাত দেবেন পরশু…..
আহ! চন্দ্রা! অহংকার তোমাকে সীমানার অনেক বাইরে নিয়ে চলেছে। নিজের ওজন বুঝে চলার চেষ্টা করো— শাস্তি পাবে। বোঝায় মিহির।
উচিত কথা তো অহংকারের মতই শোনাবে। বেড সুইচ অফ করে দেয় চন্দ্রা। গাঢ় অন্ধকারে হঠাৎ ডুবে যায় সারা ঘরটা। মিহির বুঝতে পারে চন্দ্রা বালিশে মাথা রেখে বিছানায় গড়িয়ে দিয়েছে নিজেকে। কথা না বাড়িয়ে নিজেও টুক করে শুয়ে পড়ে চার পাশে রাখা বালিশে। এতক্ষণে ঘরে অন্ধকার একটু ফিকে করতে ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে চুইয়ে এসেছে রাস্তার একচিলতে আলো।
তুমি কি চাও আমি ইউনিয়ন করা ছেড়ে দিই? ভীষণ গম্ভীর শোনায় চন্দ্রার গলা।
মোটেও না। সংক্ষিপ্ত জবাব মিহিরের।
তুমি চাইলেও আমি ছাড়তে পারবো না, কারণ প্রতিবাদ আমার রক্তে মিশে গেছে আপাতত যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চলবে আন্দোলন চলবে। বিপিবাবুদের মত বুড়ো শয়তানদের বিরুদ্ধে। শক্ত টানটান গলায় ঘোষণা করে চন্দ্রা। কোন জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শোয় মিহির—অন্ধকারে নিজেকে ঢেকে।
কি হলো? সাড়া শব্দ দিচ্ছে না যে? মিহিরের পিঠে ঠেলা দেয় চন্দ্রা।
প্রকৃত কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু কোন ইলুউশনের পেছনে দৌড়ে কেউ যদি অফিসের ওয়ার্ক কালচার আর ডিসিপ্লিন নষ্ট করে।
ইউনিয়ন এ্যাকটিভিটি তোমার মতে ডিসিপ্লিন নষ্ট করা? আবার ফোঁস করে ওঠে চন্দ্রা।
আমি সে কথা বলিনি। ব্রফ গম্ভীর স্বরে জবাব দেয় মিহির। অফিসের ইস্যু অফিসেই সেটেল করা ভালো সংসারে এক বিছানায় শুয়ে নয়।
বেশ তাই হবে।
আমি বরং এখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিই, অনেকটা স্বগতোক্তির মত বলে মিহির, তাতে অন্তত তোমার আমার মধ্যে সাংসারিক শান্তি কবে।
এ্যাই। বাজে কথা বলবে না, আমি কোন অশান্তি করি নি।
বিপিনবাবুও সেই কথাই বলছিলেন—অগ্নিকন্যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায় সংসার করা যায় না।
কি? বিপিনবাবু আমাকে অগ্নিকন্যা বলেছে? মুখে ফুঁসে উঠলেও মনে মনে খুশি হয় চন্দ্রা। আর কোন কথা না বাড়িয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে। ঘুম আসতে চায় না। হঠাৎ মনে পড়ে মৌমিতার কথা। মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। মানসিক দুর্বলতাই যে কোন মনখারাপের কারণ। হঠাৎ চন্দ্রা বুঝতে পারে তার ভেতর একটা মা আছে—যে মা সন্তানের জন্য কাঁদে। বুঝতে পারে তার ভেতর একটা মেয়ে আছে, যে মেয়ে স্বামীর কোলে ভালবাসার তাপ পেয়ে পেয়ে পুড়ে যেতে চায়। ঘুম না আসা চোখ কড় কড় করে ওঠে চন্দ্রার—আর মিহির পরম শান্তিতে পাশে শুয়ে নাক ডাকিয়ে চলে ঘোতর ঘোতর
এ্যাই! ঘুমিয়ে পড়লে? মিহিরের গায়ে টোকা দিয়ে নিবিড় হতে চায় চন্দ্রা, কি গো? ঘুমুলে?
ইউনিয়ন আর ম্যানেজমেন্টের কচকচানি আমার একটুও ভালো লাগছে —আমার ঘুম পাচ্ছে…জড়ানো গলায় জবাব দেয় মিহির।
বাড়িতে এসব আলোচনা না করাই ভালো। কি বলো? চন্দ্রা তার ডান হাতটা দেয় মিহিরের শরীরে। রাগ হয়েছে? আমার দিকে ফিরবে না?
এই মুহূর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারে না মিহির। চন্দ্রা যে দিন দিন অনেক অনেক দুরে সরে গেছে। এই পরিস্থিতিতে চার দিকে ফিরে চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলে যদি কোন অন্যায় হয়, হেনস্থা করা হয় অধস্তন কোন কর্মীকে। কারণ চন্দ্রা তো কেবলমাত্র তার স্ত্রী নয়, অফিসের একজন মহিলা টাইপিষ্টও বটে। পাশ ফিরে কাত হয়ে শুয়ে থাকা চন্দ্রাকে এক ঝলক দেখতে চেষ্টা করে মিহির— কিন্তু পারে না। ঘুলঘুলি দিয়ে চুইয়ে পড়া আলোয় সে জোর নেই যা অন্ধকারকে ঠেলে আপাত বিবাদমান দুটো মনকে একাকার করে দিতে পারে।