রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

হেনরি ডুনান্ট (১৮২৮–১৯১০) – রেডক্রস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা

হেনরি ডুনান্ট (১৮২৮–১৯১০) – রেডক্রস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা

আজও গোটা বিশ্বের বৃহত্তম মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠান এবং আর্তমানবতার কথা বলতেই যে প্রতিষ্ঠানটির কথা সবার আগে মনে উদিত হয়, তার নাম ‘রেডক্রস সোসাইটি’- -সারা বিশ্বের প্রতিটি আর্তমানবের দুয়ারে আজ যার সেবাকার্য সম্প্রসারিত। বিশ্বে সম্ভবত এমন লোকের সংখ্যা একেবারেই বিরল, যিনি জীবনে কখনও-না-কখনও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে রেডক্রসের সেবা-সাহায্য গ্রহণ করেননি।

এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানটির জন্মদাতা হলেন হেনরি ডুনান্ট। তাঁর পুরো নাম ও তার প্রকৃত উচ্চারণ হচ্ছে জঁ অঁরি দ্যুন (Jean Henri Dunant)। সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী। জন্ম ১৮২৮ সালে ৮ মে জেনেভার এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে। পিতার নাম জঁ জ্যাক দ্যুন এবং মায়ের নাম অ্যান অ্যান্টইন্টি কলাভোন।

ডুনান্ট ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অসমম্ভব বুদ্ধিমান এবং ধীরস্থির প্রকৃতির। বড়লোকের ছেলেমেয়েদের বেলায় সচরাচর যা দেখা যায়, অহংকারী এবং অমিতব্যয়ী, ডুনান্ট ছিলেন-এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

এই গুণগুলো তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিকসূত্রেই। তাঁর পরিবারের সব সদস্যই ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের অধিকারী। বিশেষ করে তাঁর মা কলাভোন ছিলেন সত্যিকার অর্থেই এক মহীয়সী মহিলা। মানুষের প্রতি, বিশেষ করে সমাজের নিরন্ন মানুষের প্রতি তাঁর হৃদয়ে ছিল অসীম দরদ।

মা-ই তাঁকে সাথে করে শহরের দরিদ্র পল্লীগুলোতে ঘুরে বেড়াতেন। খবর নিতেন অসহায় ও সহায়সম্বলহীন মানুষজনের। তিনি তাদের দুঃখমোচনের চেষ্টা করতেন।

মায়ের এই মহান চরিত্রই বাল্যকাল থেকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছিল ডুনান্টকে। তাই তখন থেকেই ডুনান্টের মন ছিল কোমল। মানুষের দুঃখকষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

পড়াশোনা শেষ করে ডুনান্ট বাবার ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় ১৮৫৯ সালে ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে সংঘটিত হয় একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এতে প্রায় তিন লাখ সৈন্য অংশ নিয়েছিল। এদের মধ্যে উভয় পক্ষেই নিহত হয় হাজার হাজার সৈন্য। যুদ্ধে এত সৈন্য নিহত হয়েছিল যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিহতদের লাশ সরিয়ে নিতেই সময় লেগেছিল প্রায় তিন সপ্তাহ।

এই সময় ডুনান্ট যাচ্ছিলেন ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে একটি ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পথেই শুনতে পেলেন এই ভয়াবহ যুদ্ধের কথা—যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ও নিহত সৈন্যদের দুর্দশার কথা। তাঁর মন কেঁদে উঠল। ব্যবসার কাজে ফ্রান্সে যাওয়া আর হলো না তাঁর। সোজা চলে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সে কী ভয়াবহ দৃশ্য! মৃতদেহের অন্তহীন স্তূপ। তারই মাঝে আহত সৈন্যদের বাঁচার জন্য আর্তনাদ, হাহাকার। মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না।

তিনি তখন সব কাজ ফেলে নেমে পড়লেন আর্তদের সেবায়। মানবদরদিদের সংগঠিত করে তৈরি করলেন একটি কমিটি। মৃত সৈনিকদের সৎকার এবং আহত সৈনিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা ও সেবায় অনেক সৈনিক ফিরে পেলেন তাদের জীবন। এভাবে তিনি মানবসেবার ক্ষেত্রে স্থাপন করলেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এই ঘটনা থেকেই শুরু হলো তাঁর নতুন জীবন। ১৮৬৩ সালে তিনি জেনেভা শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন। এই সম্মেলনেই প্রথম গঠিত হলো একটি সেবা সংস্থা—নাম রাখা হলো রেডক্রস। সংগঠনটির প্রতীক হিসেবে নির্ধারিত হয় সাদা জমিনের ওপর লাল ক্রস। সাদা হলো পবিত্রতার প্রতীক আর লাল রক্তের। সেবা চিকিৎসার প্রতীক। রেডক্রসের কাজ হলো আর্তমানবতার সেবা। দুর্গত দুঃস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় রেডক্রস।

আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশেই রেডক্রসের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী চলছে তার কল্যাণ তৎপরতা। হেনরি ডুনান্ট যে-প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন আজ তার কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত। বাংলাদেশেও রেডক্রসের শাখা রয়েছে। বাংলাদেশে রেডক্রসের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘রেড ক্রিসেন্ট’।

এই কল্যাণকাজের জন্য হেনরি ডুনান্টকে ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার ভূষিত করা হয়। বিশ্বে তিনিই প্রথম শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল পুরস্কারের বিশাল অঙ্কের টাকা তিনি নিজে গ্রহণ করেননি। সমুদয় অর্থ দান করে গেছেন মানবসেবার কজে।

মহান মানবদরদি মানুষ হেনরি ডুনান্ট ১৯১০ সালে পরলোকগমন করেন। কিন্তু মরে গিয়েও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। আজও বেঁচে আছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রতিষ্ঠান রেডক্রস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *