হেডিস

হেডিস 

নিখিল ডি ফার্নান্দেজের শৈশব ছিল ছিমছাম, গোছানো। বহরমপুর থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরের শহর বিসাইতিলা। সেখানকার একটা খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকায় নিখিলরা থাকত। বাবা স্থানীয় ক্যাথলিক চার্চে পাদ্রী আর স্থানীয় একটা বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থাপক। মা মূলত গৃহিনী ছিলেন। কিন্তু শখের বসে সেলাই করতেন। 

বিসাইতিলা শহরটা খুব ছোট শহর। কোন এক কারণে শহরটা কোনভাবেই বড় হয় না। কারণ এখানে কেউ সেভাবে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলে না। ছোট শহরে থাকার কারণে নিখিলের জগতটাও ছোট ছিল। বেশ মোটা সোটা আর লম্বা চওড়া হওয়ায় বাইরে থেকে নিখিলকে অনেক রাগী মনে হত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিখিল ছিল খুব আমুদে ও মিশুকে বন্ধুদের ভেতরেও তার আলাদা একটা গ্রহনযোগ্যতা ছিল। পড়াশোনায় দুর্দান্ত ছিল নিখিল। 

রোজ স্কুলে যাওয়া। বিকালবেলা আড়াইয়ের হ্রদের ধারে ক্রিকেট খেলা। সন্ধ্যেবেলা বাবার সাথে চার্চে প্রার্থনা সেরে বাড়ি ফেরা। রোজ রবিবারে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাবার সাথে চার্চে যাওয়া। সেখানে আরও দশজনের সাথে একসাথে ঈশ্বরের স্তব পাঠ করা, এই তো। সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি থেকে বড় হচ্ছিলো নিখিল। নিস্তরঙ্গ একটা জীবন ছিল নিখিলের। 

ক্লাসে এইটে পড়ার সময়ে একদিন নিখিল হ্রদের ধারে ঘেঁষে বেড়ে ওঠা ঝোপে বল খুঁজছিল। হঠাৎ একটা দৃশ্য নিখিলের স্বাভাবিক জীবনে একটা ঢেউ আনলো। একটা বিড়াল একটা কাঠবিড়ালীকে খাচ্ছে। কাঠবিড়ালীটা তখনও মরেনি। বাঁচার জন্য তখনও সে হাত পা ছুঁড়ছে। কিন্তু বিড়ালটা সেটার পেটের অনেকখানি খেয়ে ফেলেছে। নিখিলকে দেখেই বিড়ালটা একদৃষ্টিতে নিখিলের দিকে তাকিয়ে ছিল। 

নিখিল সেদিন অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে ফিরেছিল। বাড়িতে ফিরে বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, “বাবা একটা বিড়াল যদি একটা কাঠবিড়ালীকে খেতে যায়, আর কাঠবিড়ালীটা যদি পালাতে চায়, তাহলে ঈশ্বর কার পক্ষে যাবেন?” 

বাবা বললেন, “যে ঈশ্বরের প্রিয় ঈশ্বর তারই পক্ষ নেবেন।”

“আমি কিভাবে বুঝব ঈশ্বর কার প্রিয়?” 

“যে ঈশ্বরের জন্য কাজ করবে সে-ই ঈশ্বরের প্রিয় হবে।” 

“ঈশ্বরের কাজ কোনটা?” 

“মানুষের জন্য ঈশ্বরের কাজ আলাদা। কিন্তু পশু পাখির জন্য বেঁচে থাকাটাই ওদের জন্য ঈশ্বরের নির্ধারিত কাজ।” 

“তাহলে বিড়াল বেঁচে থাকার জন্য কাঠবিড়ালীটাকে খাবে আর কাঠবিড়ালীটা বেঁচে থাকার জন্য পালাবে। দুটোই তো ঈশ্বরের কাজ। তাহলে ঈশ্বর কার পক্ষ নেবেন?” 

নিখিলের বাবা গম্ভীর বললেন, “তাহলে যে বেঁচে থাকার জন্য সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখাবে ঈশ্বর তারই পক্ষ নেবেন। ঈশ্বর তোমাকে কোন পরিশ্রম ছাড়াই সবকিছু দিয়ে দিলে তুমি বেঁচে থাকার মজাটা আর পাবে না। তাই ঈশ্বর এত সহজে সবকিছু দেন না। তুমি যা চাও সেটার জন্য তোমাকে ঈশ্বরের কাছে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।” 

কথাটা নিখিলের ভেতরে যেন একটা আগুন জ্বেলে দিল। এমন আগুন, যা আগে জ্বলেনি। মনের গভীরের একটা দরজা খুলে গেল নিখিলের। নিখিল ফিসফিস করে বলেছিল, যদি আমি সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখাই তাহলে ঈশ্বরের প্রয়োজন কী? ভাগ্য ভালো, নিখিলের বাবা কথাটা শুনতে পাননি। 

ধীরে ধীরে নিখিলের ভেতরে একটা বেপরোয়াভাব দেখা গেল। সব কিছুতে সে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ দাবি করতে শুরু করল। ক্লাসে নিখিল বাদে অন্য কেউ পড়া পারলে নিখিলের মনে হতে শুরু করল, সে দক্ষতা দেখাতে পারছে না। তার মানে ঈশ্বর তার সাথে নেই। তাকে সব ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে হবে যাতে ঈশ্বর শুধুই তাকে সমর্থন করতে বাধ্য হন। বিশাল দেহের নিখিলকে দেখে এবার সবাই সত্যি সত্যিই ভয় পেতে শুরু করল। 

বিসাইতিলাতে একটা কয়লা খননের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, যেটাতে নিখিলের বাবাসহ আরও অনেকেরই মত ছিল না। কারণ বিসাইতিলার মত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা শহরের আশেপাশে কয়লা খনি ছিল একটা অভিশাপের মত। যা হোক, পরে আর কয়লা খনির প্রকল্পটা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকার থেকে ঠিকই টাকা পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের একটা অংশ সেটা নিজেদের ভেতরেই ভাগ বাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলে। যাদের নেতা ছিল আব্দুস সোবহান মোল্লা। লোকটা মিষ্টভাষী। কিন্তু অর্থলোভে আক্রান্ত এক রাক্ষস। 

সরকার থেকে জানতে চাওয়া হয় প্রকল্পটা কেন হয়নি। একটা মনগড়া কারণ দেখিয়ে আব্দুস সোবহান মোল্লা বিশিষ্ট জনদের স্বাক্ষর নেওয়া শুরু করেন। তার ভেতরে নিখিলের বাবাও ছিলেন। নিখিলের বাবা স্বাক্ষর করলেন না। স্বাক্ষর করলেন না স্থানীয় আরও বারোজন। 

পরদিন নিখিলের বাবার লাশ পাওয়া গেল চার্চের সামনে। ঘাড়ে আর কাঁধে এলোপাতাড়ি কোপের চিহ্ন। আব্দুস সোবহান মোল্লা বললেন, “আহারে ভালো মানুষটা। ভালো মানুষ বলেই সারা জীবনে যেইখানে শ্রম দিছে সেইখানেই মরছে।” তিনি অতিসত্বর খুনিদেরকে খুঁজে বের করার ঘোষণা দিলেন। জাতীয় দৈনিক বলল, উগ্রপন্থী জঙ্গীদের হামলায় পাদ্রী নিহত 

বাবার এমন অসময়ে চলে যাওয়া নিখিলের ভেতরের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। ভেতরে ভেতরে সে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলল। তার অদক্ষতার জন্যই ঈশ্বর তার কাছ থেকে তার বাবাকে কেড়ে নিয়েছেন। নিখিলও ঈশ্বরের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেবে। ঈশ্বরের কাছে তার সৃষ্টি মানুষ সব থেকে প্রিয় না? সেই প্রিয় জিনিসই সে কেড়ে নেবে ঈশ্বরের কাছ থেকে। 

শুধু মাত্র একটা সামান্য ক্লাস টেস্টে বেশি দুই মার্কস বেশি পাওয়ার ‘অপরাধে’ নিখিল অক্সফোর্ড ডিকশনারী দিয়ে মেরে একটা মেয়ের মাথা ফাটিয়ে ফেলল। তারপর বাঁকা হয়ে যাওয়া রক্তাক্ত ডিকশনারীটা ছুঁড়ে ক্লাস টিচারকে আহত করল। 

তারপর নিখিলের কি হয়েছিল কেউ জানে না। নিখিলের মা নিখিলকে নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। পুলিশ নিখিলকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেল। বিসাইতিলা শহর ভুলে গেল নিখিল ডি ফারনান্দেজ নামে কেউ ছিল। 

*** 

সতেরো বছর পরে আব্দুস সোবহান মোল্লার লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেল বহরমপুর মাংসের বাজারের শেষ মাথায়; যেখানে পশু জবাই করা হয়। খুব বাজেভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে লোকটাকে। হাত-পা’গুলো বেকায়দায় বাঁকানো। পায়ুপথ দিয়ে মল বেরিয়ে এসেছে। আর কিছু দিয়ে বিশ্রীভাবে খোঁচান হয়েছে পুরো শরীরটাকে। নীলাভ রঙ ধারণ করে ফুলে উঠেছে পুরো শরীর। পাশেই একটা প্ল্যাকার্ড পড়ে আছে। 

“নিজের পাপের কারণ বিনাশ করাই সব থেকে বড় প্রায়শ্চিত্ত।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *