হেগ

হেগ

ভিনসেন্ট যে সত্যি-সত্যিই হেগ-এ আসবে এ-বিশ্বাস মভের ছিল না, তাঁর স্ত্রী জেট-এরও না। তাঁদের ধারণা ছিল জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে হঠাৎ আর্টিস্ট হবার খেয়াল সব মানুষেরই একবার হয়।

মভ বললেন—বাঃ ভিনসেন্ট, সত্যিই তুমি হেগ-এ এসে গেলে দেখছি! তাহলে ছবি-আঁকিয়ে না হয়ে তুমি আর ছাড়বে না। বেশ, বেশ! থাকবার জায়গা ঠিক হয়েছে?

ভিনসেন্ট বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশ বড়ো ঘর একটা পেয়েছি, একেবারে শহরের ধারে, মাঠের কাছে। রিন স্টেশনের ঠিক পেছনে।

বাঃ, তাহলে তো এখান থেকে খুব কাছাকাছিই হল। তারপর, টাকাকড়ির অবস্থা কেমন?

খুব বেশি হাতে নেই। তবে, একটা টেবিল আর খান দুই চেয়ার কিনতে পেরেছি।

জেট জিজ্ঞাসা করলেন—আর চৌকি বিছানা?

ভিনসেন্ট হেসে বললে—না, ওসব এখনও জোটাতে পারিনি। মেঝেতেই শুচ্ছি, মুড়ি দেবার একটা কম্বল আছে।

মভ স্ত্রীকে ইশারা করলেন। জেট পাশের ঘর থেকে নিয়ে এলেন টাকা-পয়সার একটা ব্যাগ। মভ একটা একশো গিল্ডারের নোট বার করে বললেন—নাও, এ-টাকাটা তোমাকে ধার দিলাম। সময়ে শোধ দিয়ো। বিছানাপত্র এখুনি কিনে নাও। রাত্রে ভালো করে না, ঘুমোলে দিনে কাজ করবে কী করে? ঘরভাড়া দিয়েছ? দাওনি তো? ওটাও মিটিয়ে ফেল এই টাকা থেকে। ঘরটায় আলো কেমন?

আলো প্রচুর, তবে একটিমাত্র জানলা দক্ষিণদিকে।

এই নাও! তাহলে সারাদিন আকাশে সূর্য ঘুরবে আর দশ মিনিট অন্তর তোমার মডেলের গায়ের আলো পালটাবে। ও হবে না। জানলায় বেশ ভালো। কয়েকটা পর্দা না ঝোলালে চলবে না।

কিন্তু দাদা, আপনার কাছ থেকে অর্থসাহায্য আমি ‘চাইনে। আপনি যে আমাকে শেখাবেন বলেছেন এই যথেষ্ট।

বাজে কথা রাখো। সাহায্য আবার করছে কে তোমাকে? ধার দিচ্ছি, আবার আদায় করে নেব। দরকার তো সকলেরই আসে, তাতে আবার অত কিন্তু করবার কী আছে?

বেশ নিচ্ছি তাহলে, আশাভরা কণ্ঠে ভিনসেন্ট বললে—যেই আমার দু-একখানা ছবি বিক্রি হবে অমনি শোধ দিয়ে দেব।

নিশ্চয়, বিক্রি হবে বই কী! টারস্টিগ এ-বিষয়ে নিশ্চয় তোমাকে সাহায্য করবে। তবে রং নিয়ে শুরু করো—জলরং, তেলরং। বাজারে পেনসিলস্কেচের কোনো দাম নেই।

মস্ত বড়ো চেহারার হলে কী হয়, মভ আসলে নার্ভাস প্রকৃতির লোক, মানসিক চঞ্চলতা তাঁকে কাজ করায়। কোনোকিছু একবার মাথায় এলে সবুর সয় না আর। ভিনসেন্টকে স্টুডিয়োর মাঝখানে টেনে নিয়ে এসে তিনি বললেন—এই নাও, এই রয়েছে রঙের বাক্স, আর এই তুলি, প্যালেট, প্যালেটছুরি আর তার্পিন। দেখি, কেমন প্যালেট হাতে নিয়ে ইজেলের সামনে দাঁড়াতে পার!

চিত্রাঙ্কনের প্রাথমিক ক-টি কৌশল তিনি ভিনসেন্টকে শেখাতে লাগলেন। ভিনসেন্টও সঙ্গে সঙ্গে শিখে নিতে লাগল।

বাঃ, মভ বললেন—তোমাকে আমি যা ভেবেছিলাম তা তো দেখছি তুমি নও! বেশ বুদ্ধি আছে তোমার। রোজ সকালে এখানে তুমি আসবে, রঙের কাজ শিখবে। এ ছাড়া শিল্পীদের একটা গোষ্ঠীর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। আলাপ পরিচয় হবে, মাঝে মাঝে সন্ধে বেলা মডেল নিয়ে কাজ করতে পারবে। মানুষের চেহারা আঁকায় হাত যদি একবার পাকা হয়, তাহলে তো অর্ধেক রাজ্যই জয় হয়ে গেল।

ভিনসেন্ট বিছানা কিনল, জানলার পর্দা কিনল, মিটিয়ে দিল ঘরের ভাড়া। ব্রাবান্টের ছবিগুলো সে দেয়ালে দেয়ালে টাঙাল। সে জানে ওগুলো ভুলে ভরতি, বাজারে ওগুলো একটিও কখনও বিকোবে না। তবুও সে ফেলে দিতে পারবে না। কাঁচা হাতের স্কেচগুলোর মধ্যে কোথায় যেন প্রাণের স্পন্দন আছে; আছে প্রকৃতির সঙ্গে সহজ সহযোগ। ডি বকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে ওই ছবিগুলোর সম্বন্ধে তার সচেতনতা আরও বেড়ে উঠেছে।

খাসা লোক ডি বক। চমৎকার আচার-ব্যবহার, পকেটে পয়সার অভাব কখনও নেই। বিদ্যাশিক্ষা তার ইংল্যান্ডে। তার সঙ্গে ভিনসেন্টের আলাপ গুপিলের গ্যালারিতে। সর্ববিষয়ে ডি বক একেবারে ভিনসেন্টের উলটো। জীবনকে সে নিতান্ত খোশমেজাজে নিয়েছে, কোনো চাঞ্চল্য নেই, কোনো উত্তেজনা নেই, বেঁচে থাকা যেন মাপের গেলাসে করে দৈনন্দিন উপভোগের পানীয়কে পান করা।

ভিনসেন্টকে সে নিমন্ত্রণ করল—আসুন না আমার ওখানে! চা খাওয়া যাবে একসঙ্গে। আমার নতুন কয়েকখানা ছবিও দেখার। টারস্টিগ আমার কয়েকখানা ছবি বিক্রি করেছেন সম্প্রতি, সেই থেকে আমার তুলিতে যেন নতুন উত্তেজনার ছোঁয়াচ লেগেছে।

বেশ তো, চলুন এখুনি।

হেগ শহরের সবচেয়ে অভিজাত অঞ্চল উইলেমস্পার্ক পল্লিতে ডি বকের স্টুডিয়ো। ছায়া ছায়া রঙের ভেলভেট-মোড়া সারাদেয়াল, ঘরের কোণে কোণে উঁচু গদিওয়ালা সোফা আর কুশন। ধূমপানের সরঞ্জাম সাজানো ছোটো ছোটো টেবিল, সুদৃশ্য বুককেস, মাটিতে পূর্বদেশীয় কার্পেট। নিজের স্টুডিয়োর কথা মনে হতেই ভিনসেন্ট ক্ষণিকের জন্যে যেন লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।

রাশিয়ান সামোভারের নীচে গ্যাসের স্টোভ জ্বেলে চায়ের জল গরম শুরু করল ডি বক, পরিচারিকাকে দোকানে পাঠাল কেক কিনে আনতে। তারপর আলমারির মধ্যে থেকে একটা ছবি বার করে ইজেলে রেখে বললে—এইটে আমার সবচেয়ে নতুন ছবি। ও, দাঁড়ান দাঁড়ান, দেখবার আগে একটা চুরুট ধরিয়ে নিন। বলা যায় না, সিগারের সুখটানের সঙ্গে আপনার চোখে ছবিটা উতরোবে ভালো।

ডি বকের গলায় সর্বদা একটা হালকা খুশির সুর। টারস্টিগ তার কয়েকখানা ছবি কেনার পর থেকে তার আত্মবিশ্বাস একেবারে আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, ভিনসেন্ট ছবিটার তারিফ করবেন। লম্বা একটা রাশিয়ান সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে ভিনসেন্টের মুখভাব সে লক্ষ করতে লাগল ঠিক যেন পরীক্ষকের দৃষ্টি নিয়ে

ডি বকের দামি চুরুটের নীলাভ ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে ভিনসেন্ট তীক্ষ্ণ চোখে ছবিটা দেখতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ দেখেও সে মনে মনে ভেবে ঠিক করতে পারল না কী সমালোচনা সে করবে। ছবিটা একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য; ভালোও বটে, আবার ভালোও নয়। ডি বকের নিজের প্রকৃতিটা যেন পুরোপুরি তার শিল্পের মধ্যে প্রকাশিত—দিব্যি ফিটফাট ছিমছাম সৌন্দর্য, ব্যাস এই পর্যন্ত। এক মিনিটে ছবিটা দেখা শেষ হলেও ভদ্রতা করে বেশ কিছুক্ষণ সে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে—প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার হাতে চমৎকার আসে, ঠিক মিষ্টি সৌন্দর্যটি কী করে ফুটিয়ে তুলতে হয় তা আপনি বেশ বোঝেন।

খুশিতে গলে গিয়ে ডি বক বললে—ধন্যবাদ। আরে, এই নিন, চা খান।

চায়ের বাটিটা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরল ভিনসেন্ট, ভয়ে ভয়ে, পাছে দামি কার্পেটের ওপর চলকিয়ে পড়ে। সামোভার থেকে এক পেয়ালা চা ডি বক ঢেলে নিল নিজের জন্যে। ভিনসেন্ট ভাবতে লাগল, বেশ আঁকে, সুন্দর আঁকে ডি বক, বেশ চমৎকার ভদ্রলোক, তার ওপর নতুন বন্ধু তার। তবু সমালোচনার ভাষা একেবারে সংযত করা দুঃসাধ্য।

ছবিটা সম্বন্ধে একটা ব্যাপারে আমার কিছুটা অবশ্য ধাঁধা লাগছে—

ডি রক ট্রে-টা বাড়িয়ে দিল সামনে ধরুন, কেক খান।

ভিনসেন্ট বললে—থাক। এক হাতে চায়ের পেয়ালা আর এক হাতে কেক একসঙ্গে সামলানো তার পক্ষে অসম্ভব।

ডি বক বললে—তাহলে বলুন, ছবিটা কোথায় আপনার খারাপ লাগছে?

আপনার ওই মূর্তিগুলো। ওগুলো যেন সত্যি বলে মনে হচ্ছে না।

নরম সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে গলায় খুব একটা আন্তরিকতার আভাস এনে ডি বক উত্তর দিল—আসলে ব্যাপারটা কী জানেন? অনেকদিন আমি ভেবেছি মানুষের চেহারাটা ভালো করে রপ্ত করব। কিন্তু কিছুতেই তা আমার হয় না। ক-দিন হয়তো মডেল নিয়ে খুব করে খাটি, তার পরেই আবার প্রাকৃতিক দৃশ্য মন টেনে নেয়। আর দেখুন, প্রাকৃতিক দৃশ্যই হচ্ছে আমার শিল্পের মূল উপজীব্য, মানুষের চেহারা ঠিক হল বা না-হল বড়ো বয়েই গেল। ঠিক না?

তবু ধরুন, দৃশ্যের মূলে তো মানুষ, দৃশ্য তো মানুষেরই পটভূমি! সে যাই হোক, আপনি নামকরা শিল্পী, আর আমি তো কালকের শিক্ষানবিশ। তবু একটু যদি সমালোচনা করি রাগ করবেন না?

বাঃ, রাগ করব কেন? করুন না সমালোচনা।

আপনার কাজ খুব সুন্দর, কিন্তু যেন বড়ো বেশি সুন্দর। তাতে যেন আন্তরিক উন্মাদনার কিছুটা অভাব মনে হয়

মুচকি হেসে কুঞ্চিত চোখে ডি বক শুধোলে—উন্মাদনা? প্যাশন? ফ্যাশন তো অনেকরকম, কোনটার কথা আপনি বলছেন?

সে যা বলতে চায়, তা ডি বককে বুঝিয়ে বলা অসম্ভব হল তার পক্ষে।

.

নাই-বা থাক ডি বকের মতো আসবাবের আড়ম্বর, তবু স্টুডিয়ো তো আছে ভিনসেন্টের। রিক্ততাই তার ভূষণ। বিছানাটাকে সে ঠেলে দিল এক কোণে। লুকিয়ে ফেলল রান্নার সরঞ্জামগুলো। উন্মুক্ত মেঝে, খাঁটি স্টুডিয়ো, আয়েশ করে বসবার ঘর নয়। থিয়োর কাছ থেকে টাকা এখনও আসেনি, তবে মভের ঋণের কয়েকটা ফ্র্যাঙ্ক অবশিষ্ট আছে। এই অর্থ দিয়ে ক-দিন সে মডেল ভাড়া করল। ক-দিন পরে মভ এলেন দেখা করতে তার স্টুডিয়োতে।

দেখেশুনে খুশিই হলেন মভ। উৎসাহ দিলেন খুব। বললেন–বাঃ! মডেল নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছ দেখছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ, ক-দিনই তা-ই করছি। তবে বড়ো খরচ।

তা হোক। প্রথমটা খরচ, কিন্তু পরে লাভ। কেন, হাতে কিছু আর নেই?

ধন্যবাদ, মভ ভাই। ও কিছু না, চালিয়ে নিতে পারব ঠিক।

মভের কাছে আর হাত পাততে সে চায় না, তিনি যে শেখাচ্ছেন এই অনেক। ক-টা ফ্র্যাঙ্ক এখনও পকেটে আছে। দু-দিনের খাবার কেনার পক্ষে যথেষ্ট।

ঘণ্টা খানেক মভ রইলেন। কী করে রঙের ওপর রং লাগাতে হয়, কী করে ওয়াশ দিতে হয়—শেখালেন হাতে কলমে। ভিনসেন্টের অপটু হাতে সব নোংরা হয়ে যেতে লাগল। মভ আশ্বাস দিলেন—নতুন নতুন অমনি হয়, লজ্জা কী তাতে? ঠিকমতো তুলি ধরতে পারা কি একদিনের কাজ?

তার ব্রাবান্টের স্কেচগুলো আবার ভালো করে. মভ দেখলেন। বললেন—সত্যি তোমার স্কেচের হাত ভালো। একবছর ধরে পেনসিলস্কেচ করা যে অভ্যেস করেছ, এটা বৃথা হয়নি। এইবার মন দিয়ে রঙের কাজ শেখো আর-একটি বছর। তার পরেই টারস্টিগকে ছবি বিক্রি করতে পারবে, এ আমি বলে দিচ্ছি।

মস্ত বড়ো আশ্বাস। বুক ভরে গেল ভিনসেন্টের। কিন্তু দু-দিন পরেই কান্না শুরু করল জঠর। পকেটে একটি ফুটো পয়সা নেই। প্রতি মাসের প্রথমে একশো ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠাবে কথা দিয়েছে থিয়ো। কিন্তু মাসপয়লার পরে ক-দিন পার হয়ে গেল, এখনও সে টাকার দেখা নেই। থিয়ো কি প্রতিশ্রুতি ভুলে গেল? সাফল্যের মুখে এসে দাঁড়িয়ে এবার চিরদিনের মতো সর্বনাশ হবে যে তার তাহলে! পকেটে একটা ডাকটিকিট ছিল, থিয়োকে করুণ করে ভিক্ষার চিঠি সে লিখল।

তিন দিন একবিন্দু খাদ্য পেটে পড়েনি। সকাল বেলা মভের কাছে গিয়ে রং–ছবির তালিম নেয়, বাকি দিনটা কাটে পথের ভিড়ে বা স্টেশনের থার্ড ক্লাস ওয়েটিং রুমে বসে দাঁড়িয়ে পেনসিলস্কেচ করে। মুখ খুলতে পারে না’ মভের কাছে। বউদি জেট যদি বলেন একসঙ্গে বসে মধ্যাহ্নভোজনটা সেরে নিতে, তাতেও সে রাজি হতে পারে না।

পেটের মধ্যে অবিরাম একটা জ্বালা কিনকিন করছে। এ-জ্বালা তার অচেনা নয়। মনে পড়ে বরিনেজের কথা। মাথার মধ্যেটা কেমন ফাঁকা লাগে। ভাবে, এমনি খিদে নিয়েই কি তার সারাজীবন কাটবে? দু-বেলা দু-মুঠো আহার আর নিজের কাজ নিয়ে এককোণে পড়ে থাকার শান্তি, এইটুকু সামান্য চাহিদা থেকেও কি সে বঞ্চিত থাকবে চিরদিন?

চতুর্থ দিন মানসম্ভ্রম জলাঞ্জলি দিয়ে সে গেল টারস্টিগের কাছে। হেগ-এর তামাম শিল্পীগোষ্ঠীর তিনি পৃষ্ঠপোষক। তাঁর কাছে সাহায্য মিলবে নিশ্চয়ই।

শুনল—টারস্টিগ নেই, আগামীকাল হয়তো ফিরবেন প্যারিস থেকে।

খিদের জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে সারাগায়ে নেমে এল জ্বরের জ্বালা। হাত থেকে পেনসিল খসে পড়ল, ঘরে ফিরে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়। পরদিন কোনো রকমে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আবার টলতে টলতে চলল গুপিল গ্যালারির অভিমুখে। টারস্টিগ ফিরেছেন, ধার দিলেন পঁচিশটি ফ্র্যাঙ্ক। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রতা করে বললেন–একটু সময় পেলেই যাব একদিন তোমার স্টুডিয়ো দেখতে ভিনসেন্ট।

কম্পিত পদক্ষেপ, দুর্বল দেহ। বুভুক্ষু শুধু উদর নয়, সারা অন্তর। যাবার সময় একটিমাত্র কামনা ছিল, টাকা চাই। ক-টা টাকা যদি হাতের মুঠোয় আসে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার আবার ফিরে চলেছে শ্লথ গতিতে, সত্যিই ক-টা টাকা হাতের মুঠোয়। ভাবনা কী, খাবে সে পেট পুরে। তবু এত খারাপ লাগছে, এত বিষণ্ণ লাগছে, মনে হচ্ছে এমনি একাকিত্বের বোঝা টেনে বুঝি আর চলতে পারে না।

আকণ্ঠ খেল ভিনসেন্ট। টান টান হয়ে উঠেছে পেটের চামড়াগুলো। তবু টনটন করছে বুকের ভেতরটা। সস্তা তামাক কিছুটা কিনে ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে পাইপটা ধরাল। একলা ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল স্মরণপ্রান্তবর্তিনী কে-র তীক্ষ্ণ তীব্র শেষ ক-টি কথা—না, না, কখনও না। বেদনার চাপে যেন নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল।

বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দক্ষিণের জানলাটা খুলে বাইরে মাথাটা বাড়িয়ে দিল ভিনসেন্ট। জানুয়ারি মাসের তুষারকিরীটিনী হিমরাত্রি। জানলাটা আবার বন্ধ করে কোট আর টুপিটা হাতে টেনে নিয়ে দরজা খুলে সে দৌড়োল রাস্তায়, রিন স্টেশনের সামনাসামনি সস্তা মদের একটা ভাঁটিখানা আছে সে জানে, সেই পথে।

ভাঁটিখানার দোরগোড়ায় একটা ঝোলানো তেলের আলো। আর-একটা আলো একেবারে পেছনদিকে ঠিক মদ পরিবেশনের বার-টেবিলটার ওপরে। ঘরটার সারা মধ্যভাগ জুড়ে আবছা অন্ধকার। দেয়ালের ধারে ধারে বেঞ্চি, তাদের সামনে নানা রকমের দাগ-ধরা পাথর বসানো টেবিল। দেয়ালগুলো রংচটা, নোনা-ধরা, ফাটা সিমেন্টের মেঝে। এখানে লোকে ফুর্তি করতে আসে না, আসে, আশ্রয় খুঁজতে।

একটা টেবিলের ধারে বসে ভিনসেন্ট ক্লান্তভাবে দেয়ালে পিঠ এলিয়ে দিল। সত্যিই তো, পকেটে যখন টাকা আছে খাবার কেনবার, মডেল ভাড়া করবার, ছবি আঁকার, নিয়মিত কাজ করবার যখন রয়েছে সংস্থান তখন সে নিশ্চিন্ত। তবু এমনি করে ওঠে কেন মন? বেদনা একাকিত্বের। কেউ নেই যার কাছে গিয়ে দু-মিনিট বন্ধু বলে বসতে পারে, সোজাসুজি প্রাণখোলা দুটি কথা বলতে পারে। মভ তার শিক্ষক, টারস্টিগ মস্ত ব্যবসায়ী, ডি বক মস্ত পয়সাওয়ালা। এরা তার বন্ধু নয়। এক গ্লাস মদ পেটে পড়লে হয়তো মনের ফাঁকাটা ভরবে। ঘরে ফিরে গিয়ে কাজ নিয়ে বসতে পারবে শান্ত মনে।

সামনে গ্লাসভরতি রক্তিম সুরা। আস্তে আস্তে সে পান করতে লাগল। ভিড় নেই। সামনাসামনি অপরদিকের দেয়ালের কাছে একটি শ্রমিক। বারের কাছে একজোড়া মধ্যবয়সী নোংরা পোশাক পরা স্বামী-স্ত্রী। তার পাশের টেবিলে একলা একটি স্ত্রীলোক। স্ত্রীলোকটি এতক্ষণ তার নজরেই পড়েনি।

স্ত্রীলোকটির সামনে এসে দাঁড়াল ওয়েটার, কর্কশ তার গলা—মদ চাই আর?

স্ত্রীলোকটি উত্তর দিলে—একটি পয়সাও আর নেই।

ভিনসেন্ট মুখ বাড়াল মেয়েটির দিকে, বললে—কিছু মনে কোরো না, খাবে আমার সঙ্গে এক গ্লাস?

আপত্তি কীসের?

কাছাকাছি বসল এসে। ওয়েটার সামনে মদের গ্লাস রেখে ভিনসেন্টের কাছ থেকে দাম নিয়ে চলে গেল।

মেয়েটি বললে—ধন্যবাদ।

ভিনসেন্টের চোখ এবার ভালো করে পড়ল ওর ওপর। অল্পবয়সী নয়, সুন্দর নয়, জীবনে অনেক ঘা-খাওয়া বিবর্ণ মেয়ে। ঋজু দেহটিতে সৃষ্টিকর্তার নৈপুণ্যের আভাস এখনও আছে। আঙুলের ডগাগুলি মোটা মোটা, অনেক কাজ-করা হাতের আঙুল। আবছা আলোয় ভিনসেন্টের মনে হল ও যেন সার্দিন বা জ্যান স্টিনের আঁকা কোনো নারী। মোটা খাড়া নাক, ঠোঁটের ওপরে অস্পষ্ট রোমরেখা। চোখ দুটির উদাস তবু করুণ দৃষ্টির পেছনে কীসের যেন দৃপ্ত ইশারা।

ভিনসেন্ট বললে—ধন্যবাদ তোমাকে। সঙ্গ দিলে, এইজন্যে।

আমার নাম ক্রিস্টিন, মেয়েটি বললে সোজাসুজি—তোমার? ভিনসেন্ট।

এই শহরেই থাক?

হ্যাঁ।

কী কর?

ছবি আঁকা কাজ আমার।

হায় হায়! তাহলে তো বড়ো দুঃখের জীবন তোমার!

একটু অপ্রতিভ হয়ে ভিনসেন্ট উত্তর দিল—হ্যাঁ তা সময়ে সময়ে দুঃখকষ্টে পড়তে হয় বই কী!

আমার কাজ কাপড় কাচা। তা অবশ্য গতরে যখন পোষায়। বড়ো খাটুনি, সবসময় আর পেরে উঠিনে।

তখন কী কর?

রাস্তায় বার হই। নইলে চলবে কী করে?

কেন? কাপড় কাচা কি খুব শক্ত কাজ?

দিনের মধ্যে বারো ঘণ্টা খাটতে হয়। আর মজুরি যা মেলে তা আর বলার নয়। এমনি সারাদিন খাটার পরও বাচ্চাদের খাওয়াবার মতো পয়সা কতদিন জোটে না, তখন আবার রাস্তায় ছুটতে হয় পুরুষ খুঁজতে।

তোমার ছেলেপুলে কটি ক্রিস্টিন?

পাঁচটা, আবার একটা পেটে এসেছে।

স্বামী! নেই? মারা গেছে?

স্বামী! আমার বাচ্চাদের বাপেদের খবর আমিই জানি নাকি? ভিনসেন্ট সমবেদনার স্বরে বললে—ভারি ‘বিপদের কথা তো ক্রিস্টিন! মৃদু কাঁধ-ঝাঁকুনি দিল ক্রিস্টিন—হায় রে ভগবান, পাপ নিয়ে কারবার করি, পেটে কোনদিন পোড়া পাপ বাসা বাঁধবে, সে-ভয় করলে চলবে কেন?

ওদের একজনেরও বাপকে তুমি চেন না?

প্রথম যেটা পেটে এসেছিল তার বাপটা কে তা বুঝতে পেরেছিলাম। তার পরের কুকুরবাচ্চাগুলোর একটারও না।

আর এখন তোমার পেটে যেটা?

কী করে বলব? খুব শরীরটা খারাপ হয়েছিল তখন। খাটুনি সইত না একদম। মানুষও তখন নিতে হয়েছিল অগুনতি। আর, বাচ্চার বাপ কে তা আমাদের চিনলেই-বা কী, আর না চিনলেই-বা কী?

আর-এক গ্লাস মদ খাবে নাকি ক্রিস্টিন?

খাব। এবার জিন খাই, কী বলো? তা তোমাকে দেখেও তো খুব একটা শাঁসালো বলে মনে হচ্ছে না! ছবি তোমার বিক্রি হয় তো?

হয় না ক্রিস্টিন। এই তো সবে শিখতে শুরু করেছি।

অ্যাঁ! শিখছ সবে? এই বয়সে?

বয়েস খুব বেশি নয় আমার, তিরিশ।

ও, দেখে মনে হয়েছিল যেন চল্লিশ। তা, তোমার চলে কী করে?

আমার ছোটোভাই আমাকে কিছু টাকা পাঠায়, তাতেই চলে।

মরণ! এর চাইতে ধোপানিগিরিও ভালো!

তা, তুমি থাক কোথায় ক্রিস্টিন?

আমার মারু কাছে সবাই আমরা একসঙ্গে থাকি।

তুমি যে রাস্তায় বার হও তা তোমার মা জানে?

হাসল ক্রিস্টিন। কঠোর নিস্পন্দ হাসি। বললে—জানে না? সে-ই তো আমায় এই পথে পাঠায়। তারও তো সারাজীবনের পেশা ছিল এই-ই। এই করেই তো আমি জন্মেছি, আমার ভাই জন্মেছে।

তোমার ভাই কী করে?

সে একটা মেয়েমানুষ পুষেছে বাড়িতে। তার জন্যে বাবু জোগাড় করে।

আর ওই বাড়িতেই তোমার ছেলেমেয়েরা থাকে! এ তো ভালো নয়—

ভালো না হলেই-বা কী করা যায় বলো? ওরাও বড়ো হয়ে এই কাজ করবে।

নাঃ, বেঁচে থাকাটাই যাচ্ছেতাই, তাই না ক্রিস্টিন?

এ নিয়ে আর ডুকরে কেঁদে ফল কী বলো? ও কী? সারাহাতটা জুড়ে এত বড়ো একটা ঘা হল কী করে তোমার?

হাতটা পুড়েছিল।

ইস! খুব লেগেছিল? এখনও খুব যন্ত্রণা, না?

ঘায়ের চারপাশে ক্রিস্টিন একটু হাত বোলাতেই ভিনসেন্ট হাতটা টেনে নিলে। বললে—এখন আর বেশি ব্যথা নেই। তা ছাড়া ইচ্ছে করেই আমি পুড়িয়েছিলাম।

একটু চুপ করে ক্রিস্টিন বললে আবার—তা একলা এসে বসেছ এখানে, তোমার বন্ধুটন্ধু কেউ নেই?

না। এক ভাই আছে, সেও থাকে প্যারিসে।

মাঝে মাঝে একলা খুব মন কেমন করে, না?

ঠিক বলেছ ক্রিস্টিন, ভারি খারাপ লাগে।

আমি জানি। এই দেখো না, বাড়িভরতি আমার লোক। মা, ভাই, পাঁচ-পাঁচটা ছেলেমেয়ে। তা ছাড়া উটকো হাজার মানুষ নিয়ে আমার কারবার। কিন্তু একলা হওয়া তাতে ঘোচে না। ভিড় মানে তো আর লোক নয়। লোক হচ্ছে যে-লোককে পছন্দ নয়, সেই লোকটি।

পছন্দসই একটি লোকও তোমার জোটেনি ক্রিস্টিন?

জুটেছিল। সেই প্রথম লোকটি। বয়েস তখন আমার ষোলো। বড়ো ঘরের ছেলে, ইচ্ছে থাকলেও বিয়ে করতে পারল না আমাকে। তা সত্যি কথা বলব, বাচ্চার সব খরচপত্র দিত। বরাত আমার, ক-বছর না যেতেই মরে গেল। তারপর থেকে গতর না খাটালে একটা ফুটো পয়সা দেবার মানুষও আর রইল না।

বয়স তোমার কত হল ক্রিস্টিন?

বত্রিশ। পোয়াতি হবার আর বয়েস নেই। হাসপাতালের ডাক্তার বলেছে এটা বিয়োতেই আমি মরব।

তা কেন হবে? এত ভয় কীসের? প্রসবের সময় ডাক্তারি ব্যবস্থা যদি ভালো থাকে তাহলে কোনো গণ্ডগোল হবে না।

সে আমার ভাগ্যে জুটবে কোত্থেকে বলো! আমি তো যাব বিনিপয়সার হাসপাতালে, খালাস করাবে বিনেপয়সায়।

আচ্ছা, এজন্যে কিছুটা টাকাকড়িও কি তুমি জোগাড় করতে পার না?

তা হয়তো পারি। বরো, এখন থেকে বাকি তিন মাস রোজ বাইরে বার হয়ে যদি মুঠো মুঠো মানুষ ধরে আনতে পারি, তাহলে হয়তো দুটো পয়সা জমে। কিন্তু তা করতে গেলে আগেভাগেই আমি মরব।

দুজনে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ভিনসেন্ট প্রশ্ন করল—এখান থেকে বেরিয়ে তুমি কোথায় যাবে এখন?

ক্রিস্টিন বাললে—সারাদিন বারো ঘণ্টা কাপড় কেচে কেচে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম, তাই এখানে ঢুকেছিলাম এক গেলাস ঢেলে নিতে। দেড় ফ্র্যাঙ্ক মজুরি, তাও শনিবার পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছিল। এ-দিকে দুটো ফ্র্যাঙ্ক অন্তত জোগাড় না হলে কাল খাবার জুটবে না। ভেবেছিলাম একটু জিরিয়ে নিয়ে বাবু পাকড়াতে বার হব।

আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে দেবে ক্রিস্টিন? আমিও বড়ো একলা, কোথাও যাবার নেই আমার।

বাঃ, কী বলো গো! আমার তো ঝামেলা মিটেই গেল তাহলে! তা ছাড়া লোকও তুমি খুব ভালো—

তোমাকেও আমার খুব ভালো লেগেছে ক্রিস্টিন। ওই যে তুমি আমার পোড়া হাতটা ধরে দুটো সমবেদনার কথা বললে, এমনি কথা কোনো মেয়ে জীবনে আমাকে বলেনি।

সে কী কথা? লোক তুমি তো খারাপ নও, ব্যবহারও এত ভালো, তবু?

বরাত, ক্রিস্টিন! ভালোবাসা আমার বরাতে নেই।

তা যদি বলো হয়তো তা-ই। উঠবে এখন? আমায় আর-এক গ্লাস খাওয়াবে না?

উঠে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। বললে—দেখো ক্রিস্টিন এখান থেকে দুজনে যাবার আগে মাতাল হয়ে নেবার কোনো দরকার নেই, তোমারও না, আমারও না। তার চাইতে বরং এই যা আমার আছে পকেটে, রাখো। এর বেশি তোমাকে দেবার মতো নেই, এই দুঃখ।

না, ক্রিস্টিন প্রতিবাদ করল—আমি টাকা চাইনে তোমার কাছে। দেখে তো মনে হচ্ছে আমার চেয়ে তোমার দরকার কম নয়। টাকা লাগবে না, এমনি তুমি চলো। তুমি যাবার পর আর-একটা লোক আমি ঠিক জোগাড় করে নেব।

তার দরকার নেই। টাকা তুমি নাও ক্রিস্টিন। আজও আমি একজনের কাছ থেকে পঁচিশ ফ্র্যাঙ্ক ধার পেয়েছি। আমার অসুবিধে হবে না।

বেশ, চলো তাহলে এখান থেকে।

অন্ধকার গলির রাস্তায় দুজনে চলল পুরোনো দুই বন্ধুর মতো গল্প করতে করতে। নিজের জীবনের কাহিনি শোনাতে লাগল ক্রিস্টিন, তার কথায় কোনো অনুযোগ নেই, সহানুভূতি আকর্ষণের কোনো বিকৃত প্রচেষ্টা নেই।

ভিনসেন্ট জিজ্ঞাসা করল—তুমি কখনও মডেলের কাজ করেছ?

করেছি কয়েক বার, যখন বয়েস কম ছিল।

বেশ তো, তোমাকে তাহলে আমার কাজেই লাগবে। বেশি আমি তোমাকে দিতে পারব না। বড়োজোর দৈনিক এক ফ্র্যাঙ্ক এখন। ছবি বিক্রি শুরু করার পর দু-ফ্র্যাঙ্ক করে দেব। কাপড় কাচার চাইতে সে তোমার অনেক ভালো হবে।

পৌঁছোল ক্রিস্টিনের বাড়িতে। ক্রিস্টিন বললে—ভাবনা নেই, কেউ তোমাকে দেখবে না। রাস্তার ওপরের ঘরটাই আমার।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙতে ভিনসেন্ট দেখল, সে একলা নেই। অপরিচিত সব, অচেনা শয্যা, কিন্তু প্রত্যুষের ঝাপসা আলোয় শয্যাপাশে আর একজনের ঘুমন্ত দেহ, আর-একটি জীবন্ত মানুষের। মন্দ নয়, একাকিত্বের গুরুভার বেদনাটা ঘুচেছে, জীবনটাকে মনে হচ্ছে অনেকটা বন্ধুর মতো।

প্রশান্তির মতো ভোর বেলাটা।

সকাল বেলাকার ডাকে এল থিয়োর চিঠি, সঙ্গে একশোটি ফ্র্যাঙ্ক। টাকা পাঠাতে দেরি হল বলে থিয়ো দুঃখ প্রকাশ করেছে। দৌড়ে রাস্তায় বার হয়ে সে একটি বুড়িকে ধরল—মডেল হবে? বুড়ি রাজি হল তখনি।

ঘরে এনে বুড়িকে বসাল এক কোণে, চিমনি আর উনুনের পাশে, একধারে রাখল জলের কেটলিটা। বুড়ির চেহারাটার মধ্যে প্রাণ আছে, আছে জীবনের প্রত্যক্ষ পরিচয়। এই সে চায়। রং-তুলি সাজিয়ে নিয়ে সে কাজ শুরু করল। এতদিন স্কেচ হতো শক্ত শক্ত, হঠাৎ মনে হল আঙুলে যেন সাবলীলতা খেলা শুরু করেছে, রেখাগুলি যেন তরঙ্গের মতো বাধাহীন। রং চড়াতেও কেমন মধুর লাগছে, বিশেষ করে বুড়ির পেছনদিককার আবছা অন্ধকার চোয়ালের কোণটা। মনে মনে ধন্যবাদ দিল ক্রিস্টিনকে। যা সে দিয়েছে কাল রাত্রে, তার দাম হয় না। জীবনজোড়া প্রেমের বঞ্চনা মনে জড়ো করে রেখেছে পুঞ্জীভূত বেদনা, কিন্তু যৌনতৃপ্তির অভাবও তার দেহের প্রত্যেক গ্রন্থিকে যেন শুকিয়ে এনেছিল, শুকিয়ে এনেছিল তার শিল্পের আবেগকে, অজ্ঞাতসারে ধীরে ধীরে হত্যা করে চলেছিল তাকে।

দরজায় করাঘাত। ঢুকলেন মিনহার টারস্টিগ। ট্রাউজার্সের ইস্ত্রিতে বেদনাকর ঋজুতা, পালিশ-করা জুতো আরশির মতো। চমৎকার দাড়ির ছাঁট, চমৎকার চুলের কেয়ারি। বকের পালকের মতো সাদা শার্ট কলার।

ভিনসেন্টের স্টুডিয়ো হয়েছে আর সে সত্যি খুব পরিশ্রম করছে, এ দেখে টারস্টিগ আন্তরিক খুশি হলেন। নতুন নতুন শিল্পীরা নাম করুক—এ তাঁর খেয়াল, আবার এই তাঁর পেশা। কিন্তু নাম তো অমনি হয় না, খাটতে হয়, কষ্ট করতে হয়। সাধনা করতে হয় সুনির্দিষ্ট পথে। সাফল্য সোজা কথা নয়। প্রতিভা তো হচ্ছে ফাঁকির রাস্তা, আসল রাস্তা সাধনার। গুপিলের উঠতি শিল্পীরা টারস্টিগকে ভালো করেই চেনে। তা ছাড়া টারস্টিপ বনেদি লোক, সামাজিক জীবনে ভব্যতার একচুল নড়চড় তাঁর সয় না। যে-শিল্পীর এই বনেদি ভব্যতাবোধ নেই, সে-শিল্পী মাস্টারপিস আঁকলেও গুপিলে তার স্থান নেই।

বললেন—দেখো ভিনসেন্ট, তোমার কাজের মধ্যে এসে তোমাকে অবাক করে দিলাম তো? আমার শিল্পীদের সঙ্গে এমনিভাবে দেখা করতেই আমি চাই। ভিনসেন্ট বললে—আমি যে কত কৃতার্থ তা আমি মুখে প্রকাশ করতে পারছিনে মিনহার টারস্টিগ!

কিছু না, কিছু না। আমি ক-দিন থেকেই ভাবছিলাম তোমার স্টুডিয়ো দেখতে আসব।

মলিন শয্যা, সস্তা দুটো চেয়ার টেবিল, এককোণে উনুন। দেখবার মধ্যে শুধু ইজেলটা।

লজ্জিত গলায় ভিনসেন্ট বললে—কী যে বলেন! কী আর দেখবার আছে বলুন?

ঘাবড়িয়ো না। খাটো প্রাণপণ। মভ আমাকে বলেছে সে তোমাকে জলরঙের কাজ শেখাচ্ছে। এই তো, বেশ তো এগিয়েছ। জলরঙের কাজের দাম আছে। কাজ ভালো হোক, এখানে আমি তোমার ছবি বেচব, প্যারিসে তোমার ভাই বেচবে।

কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে গেল ভিনসেন্ট। টারস্টিগ আবার বললেন—ভালো কথা, থিয়ো তোমাকে মাসে একশো ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠায়। প্যারিসে গিয়ে আমি দেখে এসেছি। থিয়োর এতে বেশ টানাটানিই হয়। অতএব ভেবে দেখো, এ তো বেশি দিন চলবে না! নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে তোমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

আমি তো একটুও ফাঁকি দিইনে মিনহার!

বেশ তো! এই তো চাই। মভের সঙ্গে লেগে থাকো। তোমার ছবি বিক্রি হতে শুরু করলেই ভালো ঘর নেবে, ভালো জামাকাপড় করাবে, সমাজে মেলামেশা আরম্ভ করবে। ওটাও দরকার। পরে যখন অয়েল পেন্টিং করবে, পোর্ট্রেট আঁকবে তখন কত কাজে লাগবে দেখো। আচ্ছা আজ চলি। সালোঁর ছবিটা মভের কতদূর এগোল একবার দেখে আসতে হবে।

বিকেল বেলা গোলাপি খামের মধ্যে গোলাপি কাগজে এল ডি বকের চিঠি:

প্রিয় ভ্যান গক,

কাল সকালে একজন মডেল নিয়ে তোমার স্টুডিয়োতে যাব। একসঙ্গে স্কেচ করা যাবে।

ডি বি

মডেলটি যুবতী, অপূর্ব সুন্দরী। দক্ষিণাও অল্প নয়। নিজের পয়সায় তাকে ভাড়া করার ক্ষমতা ভিনসেন্টের পক্ষে কবে হতো কে জানে! ভারি খুশি হল এ-সুযোগে। উনুনে গনগনে আগুন। তার উত্তপ্ত আওতায় দাঁড়িয়ে মডেলটি পোশাক খুলতে লাগল। একেবারে পেশাদার ছাড়া এমন মডেল পাওয়া যায় না, যারা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। আর পেশাদার মানেই যুবতী। এটা ভিনসেন্টের ভারি অপছন্দের ব্যাপার। সে আঁকতে চায় বুড়ো-বুড়ির দেহ, যে-দেহে জীবনের স্থূল সূক্ষ্ম নানাপ্রকার স্পর্শচিহ্ন আছে, আছে চরিত্রের প্রকাশ।

মডেলটি বললে—–আমি তৈরি, ভঙ্গিটা ঠিক করে দিন।

ভিনসেন্ট শুধোলে—বসে না দাঁড়িয়ে, ডি বক?

প্রথমটা দাঁড়িয়েই হোক। আমি যে নতুন ল্যান্ডস্কেপটা আঁকছি তাতে কয়েকটা দাঁড়ানো মূৰ্তি আছে।

ঘণ্টা খানেক দুজনে স্কেচ করার পর মডেলটি ক্লান্ত হয়ে পড়ল।

ভিনসেন্ট বললে—ওর বসা অবস্থাটা স্কেচ করি এখন, কী বল? রেখাগুলো অনেকটা নরমও হবে তাহলে।

যে যার ড্রয়িং বোর্ডের ওপর ঝুঁকে পড়ে দুপুর অবধি আঁকল, প্রায় নিঃশব্দেই তারপর ডি বক তার ঝোলা থেকে লাঞ্চ বার করল। উনুনের ধারে বসে তিনজনে

খাওয়াদাওয়া সারল। খেতে খেতে দেখতে লাগল সকাল বেলাকার কাজ।

মেয়েটির মুখের আদল ডি বক তার স্কেচে চমৎকার তুলেছে, কিন্তু বাকি চেহারাটার মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যেকোনো সুগঠিত সুন্দর নারীদেহ।

ভিনসেন্টের স্কেচ দেখে ডি বক বলে উঠল—ও কী? মুখটা গেল কোথায়? তার বদলে এটা কী এঁকেছ! এই বুঝি তোমার ছবিতে প্যাশন ইনজেকশন করার নমুনা?

ভিনসেন্ট বললে—কী মুশকিল! আমরা কি পোর্ট্রেট আঁকছিলাম নাকি? দেহটা স্কেচ করাই তো ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।

বাঃ, জীবনে এই প্রথম শুনলাম যে দেহ আছে, তার মুখ নেই।

বটে? আচ্ছা দেখো তো পেটটা কেমন এঁকেছ তুমি?

কেন, পেটের আবার হল কী?

দেখে মনে হচ্ছে পেটটা যেন হাওয়া-ভরা বেলুন। ওর মধ্যে যে নাড়িভুঁড়ি আছে তার আভাস কই?

অ্যাঁ! বেচারি মেয়েটি যখন দাঁড়িয়েছিল তখন ওর পেট ফুটো হয়ে নাড়িভুঁড়ি বাইরে ঝুলছিল নাকি? চোখে পড়েনি তো?

এসব কথা শুনেও মডেলটির মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। তার ধারণা, সব শিল্পীরই মাথায় অল্পবিস্তর ছিট থাকে। নিঃশব্দে সে খেয়ে চলেছে।

আমার আঁকা পেটটা দেখো, ভিনসেন্ট বুঝিয়ে বললে—ভেতরে নাড়িভুঁড়ি আছে, তার গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে সারাজীবনে কত মণ খাবার পথ খুঁজে খুঁজে চলেছে, দেখো, তার আভাস ঠিক ফুটেছে কি না?

আরে, ছবি আঁকার সঙ্গে তোমার ওই অদেখা গোলকধাঁধার সম্পর্ক কী? বিচলিত গলায় ডি বক বললে—মড়া কাটা কি আমার পেশা? আমার আঁকা ছবি যখন লোকে দেখে, তারা দেখে কুয়াশায় ঢাকা আবছায়া সবুজ গাছের মেলা, দেখে মেঘের ও-পারে সূর্যাস্তের রং। পেট-চেরা মানুষের নাড়িভুঁড়ি তাদের দেখাবার আমার দরকার নেই।

প্রত্যেক দিন ভোর বেলা এক-একটা মডেলের খোঁজে ভিনসেন্ট বার হয়। একদিন সে ধরে আনে এক কামারের ছেলেকে, একদিন আনে পাগলাগারদ–ফেরত এক বুড়িকে, আর একদিন আনে শ্রমিক ব্যারাকের এক থুথুড়ি ঠাকুমাকে, সঙ্গে তার নাতি। এসব মডেলদের দক্ষিণা দিতে হয়, যে-খরচ হয় তাতে মাসের শেষে খাবার কেনার পয়সা থাকে না। কিন্তু খাওয়ার জন্যে তো সারাজীবনই পড়ে রয়েছে। হেগ-এই যদি এলাম, গুরু পেলাম মভের মতো, তখন কি আর খাওয়ার কথা ভেবে কাজে ফাঁকি দেওয়া চলে?

প্রতি সন্ধ্যায় সে মভের স্টুডিয়োতে যায়। ঘর জুড়ে মধুর উত্তাপ, কাজ করতে কী আরাম! মভ যত্নের সঙ্গে শেখান। ছবিতে পরিচ্ছন্ন করে রং চড়াতে সে পারে না, নোংরা কাদার মতো মোটা ‘মোটা করে সে রঙের তুলি বোলায়, নিজের কাজ দেখে নিজেই হতাশ হয়ে পড়ে। মভ তাকে প্রবোধ দেন, উৎসাহ দেন।

ভিনসেন্ট বলে—বলুন মভ ভাই, কতদিনে আমার হবে? ছবি এঁকে রোজগার যে আমাকে করতেই হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!

মভ বলেন—হোক না দেরি। সেজন্যে দুঃখ করো কেন? সত্যকে কি সহজে পাওয়া যায়? ছবিতে লোক-ভোলানো সুলভ সৌন্দর্য আয়ত্ত করতে চাও তো সে রাস্তা আছে, কিন্তু তাতে ঠকবে নিজে, ঠকাবে নিজেকে।

না মভ ভাই, সৌন্দর্যের ফাঁকিতে আমার কাজ নেই। সত্যকে আমি প্রকাশ করতে চাই, স্পষ্টভাবে, রুক্ষভাবে; মিথ্যা মাধুর্যের প্রলেপ আমি তার ওপর লাগাতে চাই না। কিন্তু তবু দেখুন না, লোকের পছন্দসই করে কয়েকটা রঙিন ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছি, এমনি যদি আঁকি চটপট বিক্রি তো হবার আশা আছে?

দেখি কী এঁকেছ?

ছবিগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়লেন মভ। বললেন—তোমার রুক্ষ সত্যকেই আঁকড়ে থাকো। ঝুটো মালের পসরা সাজিয়ে বাজারে বার হতে চেয়ো না। আমি বলছি, শেষ পর্যন্ত তুমি ঠকবে না।

সে-দিন মভের বাড়িতে ছোটোখাটো একটা পার্টি ছিল। নিমন্ত্রিত ছিলেন কয়েকজন শিল্পী। উইসেনব্রাক তাদের অন্যতম। ইনি যেমন ভালো শিল্পী, তেমনি কঠোর শিল্পসমালোচক। বেঁটেখাটো ছোটো মানুষটি, তীক্ষ্ণ মুখ চোখ। যেমনি ক্ষুরধার জিভ, তেমনি ক্ষুরধার প্রতিভা। নির্ভীক সত্যবাদিতা, সোজাকথায় যাকে বলে দুর্মুখতা, এই জন্যে টারস্টিগের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। গুপিল কোম্পানি তাঁর ছবি বেচে না, কিন্তু যা-ই তিনি আঁকুন না কেন, ক্রেতার অভাব কখনও হয় না। তাঁর তীক্ষ্ণ সত্যভাষণের জন্যে প্রসিদ্ধি তাঁর শিল্পীপ্রসিদ্ধির চাইতে কম নয়, ঘৃণ্যকে ঘৃণা করার ক্ষমতা তাঁর মতো খুব কম লোকেরই আছে। সরাসরি ভিনসেন্টকে নিয়ে তিনি পড়লেন। বললেন—কিহে ভ্যান গক বংশোদ্ভব, তোমার খুড়োরা ছবি বেচতে যেরকম ওস্তাদ, ছবি আঁকতে তুমি তেমনি ওস্তাদ হচ্ছ তো?

ভিনসেন্ট সবিনয়ে বললে—আজ্ঞে না, ছবি আঁকায় সবে আমার হাতেখড়ি।

বটে? তাহলে তো চমৎকার! আমার মতের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে দেখছি। সত্যিকারের শিল্পী যে হতে চায়, জীবনের প্রথম ষাটটা বছর পর্যন্ত তার উপোস করা দরকার, তাতে হয়তো শেষজীবনে সত্যিকারের ভালো ছবি দু-একটা সে এঁকে যেতে পারে।

ভিনসেন্ট বললে—ধ্যাত, বাজে কথা! এই ধরুন না, আপনার তো চল্লিশ পার হয়নি, আপনি কি ভালো আঁকেন না?

নগণ্যের মুখের ‘ধ্যাত’ কথাটি চমক লাগাল উইসেনব্রাকের মনে। সোজাসুজি এমনিভাবে তাঁকে প্রতিবাদ করার সাহসের পরিচয় অনেকদিন তিনি পাননি। বললেন—বটে! আমার ছবি ভালো এই যদি তোমার ধারণা হয় তাহলে ছবি আঁকা ছেড়ে দোকানদারি করো। ছবিগুলো আমি বিক্রি করি কেন? কারণ এগুলো আবর্জনা ছাড়া আর-কিছু নয়। বোকা ক্রেতারা ওতেই ভোলে। সত্যিকারের ভালো ছবি যদি আঁকতে পারতাম, তাহলে বেচতাম না, নিজের কাছে রেখে দিতাম। না ভায়া, জেনে রাখো, প্রতিদিন আমি শুধু প্র্যাকটিস করেই চলেছি। ষাট বছর যখন বয়েস হবে তখন আমি সত্যিকারের ছবি আঁকা শুরু করব। তারপর থেকে যা-কিছু কাজ আমি করব, তা রেখে দেব নিজের কাছে। ব্যবস্থা করে যাব, আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার কবরে সেসব কাজ যেন চাপা পড়ে। নিজের হাতের প্রকৃত ভালো কাজ, ভ্যান গক, শিল্পী কখনও হাতছাড়া করে না। রদ্দি মালই কেবল সে বাজারে বেঁচে।

দূর থেকে ডি বক চোখ টিপল ভিনসেন্টকে। তাই ভিনসেন্ট এবার বললে–আপনি গোড়াতেই ভুল করেছেন শিল্পী হয়ে। শিল্পসমালোচক হওয়া উচিত ছিল আপনার।

হো-হো করে হেসে উঠলেন উইসেনব্রাক, চেঁচিয়ে বললেন মভকে—তোমার এই ছাত্রটিকে দেখে যত বোকা বলে মনে হচ্ছিল আসলে কিন্তু এ তা নয়। জিভে তো বেশ ধার আছে!

ভিনসেন্টের দিকে ফিরে এবার নিষ্ঠুর গলায় তিনি বললেন—তা তুমি এইরকম ছেঁড়া ধোকড় পরে সমাজে ঘুরে বেড়াও কোন লজ্জায়? ভদ্রলোকের মতো জামাকাপড় কিনতে পার না?

থিয়োর একটা পুরোনো সুট ভিনসেন্টের পরনে। দরজি ভিনসেন্টের গায়ের মাপে সেটাকে অদলবদল করেছে একেবারে যাচ্ছেতাই করে। এই তার দৈনন্দিনের সর্বদা পরবার পোশাক। এ পরে সে ছবিও আঁকে, তার চিহ্নও বর্তমান।

হল্যান্ডের প্রত্যেক লোককে নতুন জামাকাপড় পরাতে পারে, এত টাকা তোমার কাকাদের। তোমাকে বুঝি একপয়সাও তারা ঠেকায় না?

কেন ঠেকাবেন বলুন? আপনার মতো তাদেরও যে একই ধারণা, আর্টিস্টদের উপোস করাই উচিত।

বুঝেছি, মোটকথা তোমার ওপর তোমার কাকাদের কোনো আস্থা নেই। লোকে বলে, ভ্যান গকরা একশো মাইল দূর থেকে আসল আর্টিস্টের গন্ধ পায়। তোমাকে যে তারা পৌঁছে না, তার কারণ তুমি হচ্ছ পচা আর্টিস্ট।

দপ করে জ্বলে উঠল ভিনসেন্ট। রাগকে ভদ্রভাবে সংযত করতে সে পারে না। বলে উঠল—যান যান, জাহান্নামে যান আপনি!

ভিনসেন্ট দূরে সরে যাচ্ছিল, উইসেনব্রাক হাত বাড়িয়ে তার বাহুমূল চেপে ধরলেন, হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ।—সাবাস! দেখছিলাম কটু কথা কতটা তুমি সহ্য করতে পার। পরীক্ষায় পাশ করেছ তুমি। শক্তি আছে তোমার, ঠিক তুমি পারবে।

কয়েক দিন পরে রাত্রি বেলা ভিনসেন্টের দ্বারে করাঘাত।

ক্রিস্টিন। কালো টুপি, কালো ঘাঘরা, ঘন সবুজ কাঁচুলি। সারাদিন সে কাপড় কেচেছে। এখন সারাশরীরে সীমাহীন ক্লান্তি। অবসাদে অধরোষ্ঠটা যেন ঝুলে পড়া, গালের ব্রণচিহ্নগুলি স্পষ্টতর।

হ্যালো ভিনসেন্ট, নিষ্প্রভ কণ্ঠে উত্তাপের আভাস এনে সে বললে–দেখছিলাম, তুমি কোথায় থাক খুঁজে পাই কি না।

এসো এসো। বাড়ি খুঁজে খুঁজে কাছে এসেছে, আমার জীবনে তুমি সেই প্রথম মেয়ে ক্রিস্টিন। এসো, বোসো চেয়ারে।

আগুনের ধারে ক্রিস্টিন বসে দু-হাত তাতিয়ে নিল। তারপর বললে—মন্দ নয় তোমার ঘরটা, কিন্তু বড়ো ফাঁকা।

জানি আমি। কিন্তু একগাদা আসবাবপত্র কিনব, পয়সা কোথায় বলো!

হ্যাঁ, তা ছাড়া এর বেশি তোমার আর দরকারই-বা কী?

ভিনসেন্ট নিমন্ত্রণ করলে—রাত্রের রান্নাটা শুরু করেছিলাম। তুমি আমার সঙ্গে খাবে ক্রিস্টিন?

তুমি আমাকে সিয়েন বলে ডাক না কেন? সিয়েন আমার ডাকনাম।

সিয়েন? বাঃ, বেশ নাম। কিন্তু বললে না তো?

কী রান্না করছ?

এই, আলুর তরকারি আর চা।

তা কেন, আজ দু-ফ্র্যাঙ্ক পেয়েছি। একটু মাংস কিনে আনি।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি পয়সা দিচ্ছি।

কয়েক মিনিট পরে মাংস কিনে ফিরল ক্রিস্টিন। বললে—সরো, আর রান্না দেখাতে হবে না। মেয়েমানুষের কাজ মেয়েমানুষকেই করতে দাও।

ভিনসেন্ট অদূরে চেয়ারে গিয়ে বসল চুপটি করে। উনুনের ধারে কাজ করছে ক্রিস্টিন, আগুনের আভা ছড়িয়ে পড়েছে মুখে। সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। নিজের বাড়ি, নিজের ঘর। সেখানে তার খাবার বানাচ্ছে মিষ্টি হাতে একটি মেয়ে। জীবনসঙ্গিনী কে-কে নিয়ে এমনি একটি কবোষ্ণ কোমল পরিবেশের স্বপ্ন সে দেখেছে কতদিন। শুধু ব্যর্থ স্বপ্নই।

পেছন ফিরে তাকাল ক্রিস্টিন। দেখল চেয়ারটাকে এমন বিপজ্জনকভাবে পেছনদিকে হেলিয়েছে ভিনসেন্ট যে কখন উলটে পড়ে তার ঠিক নেই। চেঁচিয়ে উঠল—আরে বোকা, সোজা হয়ে বোসো না! পড়ে গিয়ে ঘাড় ভাঙবে শেষকালে না কি!

হাসিতে দাঁত বার হয়ে এল ভিনসেন্টের।—আচ্ছা আচ্ছা সিয়েন, ঠিক হয়ে আমি বসছি।

ক্রিস্টিন মুখ ফেরাতেই সে আবার আগের মতো করে চেয়ার হেলিয়ে বসে নিশ্চিন্ত আয়েশে পাইপ টানতে লাগল।

টেবিলে ডিনার সাজাল সিয়েন। মাংস, আলু, রুটি, চা।

খাবে এসো। বলো দিকিন, আমার মতো রাঁধতে পার তুমি?

না সিয়েন। আর মাছই রাঁধি মাংসই রাঁধি আর যাই রাঁধি, রান্নার পর মুখে দেবার সময় সব সমান।

চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগল দুজনে। এমনি গল্প ভিনসেন্ট ডি বক বা মভের সঙ্গে করতে পারে না। সহজ সরল কথাবার্তা, সাবধান হতে হয় না, দরকার হয় না আত্মগোপনের। ভিনসেন্ট যখন কথা বলে তখন ক্রিস্টিন চুপ করে শোনে, অপরকে চুপ-করিয়ে-দেয়া আত্মঘোষণার কোনো তাড়া নেই। নিজের দুঃখ-বেদনার কাহিনি যখন ক্রিস্টিন বলে যায়, তখন ভিনসেন্ট নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে সে-কাহিনিকে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখে, সম-অনুভূতির দু-একটি বাক্যে স্পষ্ট করে তোলে সেই বঞ্চিত জীবনচিহ্নকে। কথার মধ্যে কোনো শ্লাঘা নেই, কোনো ভান নেই নীরবতাকে ঘিরে। কোনো বাধা নেই ব্যবধান নেই, নেই বড়োর অভিমান আর ছোটোর দীনতা। দুটি নির্বাধ নগ্ন মানবাত্মার আত্মবিনিময়।

উঠে দাঁড়াল ভিনসেন্ট।

উঠলে কেন, কোথায় চললে?

বাসনগুলো–

বোসো তুমি। ও-কাজ তোমার নয়, মেয়েমানুষের

বেসিনের মধ্যে বাসনপত্রে সাবান মাখাতে লাগল ক্রিস্টিন। সাবানের ফেনার সঙ্গে বহুপরিচিত অভ্যস্ত দুটি কর্মঠ হাত; নীল শিরাগুলি পরিস্ফুট, আঙুলগুলি চঞ্চল। কাগজ পেনসিল নিয়ে ভিনসেন্ট হাত দুটি স্কেচ করতে লাগল কিছুক্ষণ। কাজ শেষ করে হাত মুছে ক্রিস্টিন বললে—আঃ! বেশ লাগছে এখন। তবে, একটু মদ যদি থাকত!

এবার আমার বার হবার পালা। বোসো তুমি, আমি নিয়ে আসছি। গ্লাস–ভরতি জিন। গরম উনুনের পাশে চেয়ারের ওপর বসে আছে ক্রিস্টিন, হাত দুটি কোলের ওপর চুপ। এমনি পরিচ্ছন্ন আশ্রয়, এমনি নিরুদ্‌বেগ তৃপ্তি, আসল নেশা তো এরই। ভিনসেন্ট স্কেচ করছে ভঙ্গিটির।

জিজ্ঞাসা করলে—তোমার এবারের কাপড় কাচার কাজ আর ক-দিন, সিয়েন?

কাল শেষ হবে। ভালোই হবে। শরীর আর একটুও বইছে না।

শরীরটা কি খারাপ লাগছে নাকি আজকাল তোমার?

না, সেরকম খারাপ নয়। তবে কিনা পেটের বাচ্চাটা বড়ো হচ্ছে তো! নড়েচড়ে, বুঝতে পারি।

তাহলে আসছে সপ্তাহ থেকে তুমি আমার এখানে পোজ দিতে আসবে তো?

কাজটা কী হবে আমার? এমনি করে বসে থাকা?

ব্যাস, আর কী! অবিশ্যি দাঁড়াতেও হবে মাঝে মাঝে। আর জামাকাপড় খুলে ফেলতে হবে সব।

বাঃ, ব্যবস্থা তো মন্দ নয়! কাজ করবে তুমি, আর বসে দাঁড়িয়ে মজুরি পাব আমি?

রাত বেশ ঘনিয়ে এসেছে। জানলার দিকে তাকাল ক্রিস্টিন। বাইরে তুষার পড়ছে। বললে—বেশ তো এতক্ষণ কাটল। এখন কিন্তু মনে হচ্ছে বাড়িতে থাকলেই ভালো ছিল। কতটা পথ হাঁটতে হবে, সম্বল তো ওই শালখানা!

কাল সকালে কি আবার তোমাকে এই পাড়াতেই আসতে হবে নাকি?

হ্যাঁ। শেষরাত্তিরে বলতে গেলে। ছ-টার সময়।

তোমার যদি অসুবিধে না হয়, তুমি এখানে থেকে যাও, সিয়েন।

কীসের অসুবিধে? ভালোই লাগবে আমার। কিন্তু শোবো কোথায়?

কেন, আমার বিছানাটা কি ছোটো? দুজনের জায়গা হবে না? খুব হবে সিয়েন, খুব হবে।

এই রাত্রে তুমি যে আমাকে থাকতে বললে সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ ভিনসেন্ট।

না সিয়েন, এই রাত্রে তুমি যে আমার কাছে রইলে, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

ভোর বেলা উঠে মেয়েটি ভিনসেন্টের জন্যে কফি বানাল, বিছানা তুলল, ঘর ঝাঁট দিল। তারপর চলে গেল নিজের কাজে। ও যাবার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা স্টুডিয়োটা হঠাৎ যেন আরও কত ফাঁকা হয়ে গেল।

সে-দিন বিকেল বেলা আবার টারস্টিগের আবির্ভাব। বললেন—নতুন কী আঁকলে, দেখাও।

জলরঙের কাজগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে বললেন টারস্টিগ—বাঃ, এই তো এগোচ্ছ মন্দ না। কিন্তু সাধনা চাই, সেটা ভুলো না। খাটো ভালো করে, পরিশ্রম না করলে কতদিন আর পরের ওপর নির্ভর করে থাকবে?

আজ্ঞে হ্যাঁ মিনহার। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানো যে কত দরকার তা আমি খুবই বুঝি।

তাহলে খাটো। এক মিনিট ফাঁকি দিয়ো না। মনে রেখো তোমার ছবি কেনবার জন্যে সবচাইতে ব্যাকুল হয়ে আছি আমি।

ভিনসেন্টের এক কাকা কর্নেলিয়াস ভ্যান গক আমস্টার্ডামের সবচেয়ে বড়ো ছবির দোকানের মালিক। সে তাঁকে লিখেছিল, শিল্পশিক্ষার জন্যে সে হেগ-এ এসেছে আর স্টুডিয়ো নিয়েছে। কর্নেলিয়াস মাঝে মাঝে ছবি কিনতে হেগ-এ আসতেন। এক রবিবার বিকেলে তিনি উপস্থিত হলেন ভিনসেন্টের স্টুডিয়োতে। জীবনে শিল্পীর স্টুডিয়ো তিনি যত দেখেছেন, অত বোধ হয় হল্যান্ডের আর কোনো লোক দেখেনি। মুহূর্তে তিনি চোখ বুলিয়ে নিলেন সবকিছুর ওপর

নোংরা চেয়ারটা ছেড়ে ভিনসেন্ট তাঁকে সমাদর করে বসাল। বিনীত আগ্রহে শুধোল—এক কাপ চা করে দেব কর কাকা? বাইরে তো বেশ ঠান্ডা!

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কর কাকা বললেন—তাহলে তুমি এবারে ছবি-আঁকিয়ে হবেই, ঠিক তো? ভালোই হল, গত ত্রিশ বছর ধরে হাইন, ভিনসেন্ট আর আমি পরের ছবিই কিনে এসেছি, এবার তোমার ছবি কিনে ঘরের টাকা ঘরেই রাখব। কী বলো!

ভিনসেন্ট বললে—সত্যি কাকা, আমার তিন কাকা আর এক ভাই ছবির ব্যবসায় এক-একজন রথী-মহারথী। আমার ভাবনা কী?

কর্নেলিয়াস বললেন—টারস্টিগের কাছে শুনলাম থিয়ো তোমাকে মাসে একশো ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠায়, সত্যি নাকি?

ভিনসেন্ট বললে—হ্যাঁ, তবে সেটা ধার, কাকা। দাঁড়াতে যখন পারব, সব শোধ দিয়ে দেব আমি।

ও-প্রসঙ্গ কর্নেলিয়াস আর বাড়ালেন না, ছবি দেখতে লাগলেন। ছোটো ছোটো কয়েকটি দৃশ্যপট বোধ হয় চোখে লাগল। বললেন—এমনি স্কেচ আর করেছ নাকি? আজ্ঞে হ্যাঁ, এ আমার অবসর সময়ের কাজ। আরও আছে, দেখবেন? হেগ শহরের টুকরো টুকরো দৃশ্য। কর্নেলিয়াস বললেন—এমনি বারোটা দৃশ্য আমাকে এঁকে দিতে পারবে?

নিশ্চয়ই পারব। তবে, আপনি যখন ছবির ব্যাবসাদার, দামটা আগে ঠিক হোক?

বেশ তো, তোমার দাম তুমি বলো।

এমনি ছোটো ছোটো সাইজের স্কেচের জন্যে আড়াই ফ্র্যাঙ্ক করে আমি নেব। বেশি চাইছি কি?

মুচকি হাসলেন কর্নেলিয়াস। এ তো নগণ্য। তাতেও এত দ্বিধা! বললেন—না, দাম বেশি বলনি। আর এ-বারোখানা যদি ভালো হয়, তাহলে এমনি আরও বারোখানা আমস্টার্ডামের স্কেচ তোমায় করতে দেব।

লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট। ছলো-ছলো চোখে বললে—কর কাকা, এই আমার প্রথম অর্ডার। আমি যে কত কৃতার্থ হলাম, তা মুখে আপনাকে জানাব কেমন করে!

উঠে দাঁড়ালেন কর্নেলিয়াস। বললেন—কিছু তোমায় বলতে হবে না ভিনসেন্ট। মনে রেখো আমরা সবাই তোমাকে সাহায্য করতে চাই, সকলে তোমার পেছনে আছি। ভালো ছবি যখন থেকে তুমি আঁকতে পারবে, তোমার সব ছবি আমরা নেব। কোনো ভাবনা থাকবে না তোমার।

খুশিতে উচ্ছল হয়ে নতুন জলরঙের কাজটা হাতে নিয়ে ভিনসেন্ট দৌড়োল মভের বাড়ি। দরজা খুললেন জেট। চিন্তান্বিত মুখ। বললেন—দাঁড়াও ভিনসেন্ট, আমার মনে হয় আজ তোমার ওঁর স্টুডিয়োতে না যাওয়াই ভালো।

ব্যাপার কী বউদি? মভ ভাইয়ের শরীর খারাপ?

না, শরীর ঠিকই আছে, তা নয়, মেজাজ ভয়ংকর গরম। হাতের ছবিটা শেষ হয়ে আসছে কিনা?

তাহলে তো আমার মুখ দেখলেই এখন চটে যাবেন, তা-ই না?

হ্যাঁ। আজ তুমি যাও ভিনসেন্ট। তোমার কথা আমি মনে করিয়ে দেব। মাথাটা একটু ঠান্ডা হলে নিজেই একদিন তোমার ওখানে যাবেন।

তা-ই ভালো। কিন্তু আপনি ভুলে যাবেন না তো বউদি?

না, ভুলব না।

বেশ ক-দিন অপেক্ষা করল ভিনসেন্ট। মভের দেখা নেই। এর মধ্যে টারস্টিগ এলেন, একবার নয়, দু-বার। প্রত্যেকবারই একইরকম কথাবার্তা—

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ তো এগোচ্ছ ভিনসেন্ট। তবে এখনও দেরি আছে। খাটো, আরও খাটো, তবে না?

খুব তো খাটছি, মিনহার। ভোর পাঁচটায় উঠি, তখন থেকে কাজ করি রাত এগারোটা পর্যন্ত। মাঝে খাওয়ার জন্যে যেটুকু সময় নষ্ট হয়।

মাথা নাড়লেন টারস্টিগ। ব্যাপারটা যেন তাঁর উপলব্ধির বাইরে। বললেন—তোমার ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে ভিনসেন্ট। তোমার কাজে প্রথমে যে-রুক্ষতা যে-অপরিচ্ছন্নতা আমি লক্ষ করেছিলাম সেসব দোষ ঠিক এখনও তেমনি রয়েছে। এতদিন এসব তোমার শুধরে ওঠা উচিত ছিল। ভেতরে ভেতরে যদি শক্তি থাকে তাহলে পরিশ্রমেই তো এসব দোষ কাটে।

ব্যর্থতার আঘাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ভিনসেন্ট।

টারস্টিগ আবার বললেন—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার ছবি বিক্রি করতে আমি চাই। নইলে নিজের পায়ে তুমি নিজে দাঁড়াবে কী করে? কিন্তু যা করছ তা ছবি হয়ে ওঠা তো চাই, নইলে আমি কিনব কী করে? পরের অনুগ্রহ সম্বল করে কতদিন তুমি চালাতে চাও বলো?

এত প্রশ্নে কান মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল ভিনসেন্টের। উত্তর দেবার মতো কোনো কথা তার নেই।

পথে একদিন মভের সঙ্গে দেখা। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে দ্রুতগতিতে হেঁটে চলেছেন মভ, কোথায় যাচ্ছেন যেন তার কোনো দিশা নেই। ভিনসেন্টকে তিনি যেন চিনতেই পারলেন না। ভিনসেন্ট দৌড়ে সামনে গিয়ে তাঁর পথ আটক করল।

অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি মভ ভাই।

অপরিচিত গলায় মভ বললেন—বটে? হ্যাঁ, আমি খুব ব্যস্ত আছি ক-দিন—

ভিনসেন্ট বললে—জানি, আপনার নতুন ছবি। কেমন হচ্ছে ছবিটি?

মভ শুধু বললেন—ওঃ! এলোমেলো ভঙ্গি করলেন একটুখানি।

আপনার স্টুডিয়োতে একদিন একটুখানির জন্যে আসব? আমার শেখা একেবারেই এগোচ্ছে না।

না না, এখন না। বললাম না, খুব ব্যস্ত! নষ্ট করার মতো সময় নেই হাতে।

তাহলে আপনি বেড়াতে বেড়াতে আমার স্টুডিয়োতে একদিন আসবেন, কেমন? আমার কাজের ওপর দু-একটা কথা যদি আপনি বলেন তবেই আমার অনেক উপকার হবে।

হবে হবে, দেখি যদি সময় করতে পারি। আচ্ছা, আমি এগোই—

হনহন করে চলে গেলেন মভ। ভিনসেন্ট হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

হল কী? মভ চটলেন কেন? অন্যায় সে কিছু করেছে?

কয়েক দিন পরে ভিনসেন্টের বিস্ময়ের অবধি রইল না যখন দেখে, উইসেনরাক তার স্টুডিয়োতে উপস্থিত। নতুন নতুন যারা এ-লাইনে আসে, উইসেনব্রাকের একফোঁটা নজরও তাদের ওপর পড়ে না, আর যদি দুর্ভাগ্যক্রমে কখনও-বা পড়েই যায়, তাহলে গালাগালি দিয়ে তিনি ভূত ভাগান। কটুভাষণে তাঁর জুড়ি নেই।

চারদিক তাকিয়ে বিদ্রুপতীক্ষ্ণ কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন—বাঃ, এ তো একেবারে রাজপ্রাসাদ দেখছি! হ্যাঁ, শিগগিরই তো এখানে বসে তুমি রাজারানির ছবি আঁকবে হে!

অপমানে মুখ কালো হয়ে উঠল ভিনসেন্টের। মুখের ওপর সে বললে—এসেছেন কেন আমার এখানে? পছন্দ না হয়, সোজা বার হয়ে যেতে পারেন! মুচকি হাসি হেসে উইসেনব্রাক আবার বাঁকা প্রশ্ন করলেন—এ-ছবি আঁকার খেয়াল তুমি ছেড়ে দাও না কেন ভিনসেন্ট? এ তো কুকুরের জীবন!

এ-জীবন আপনার পক্ষে তো দিব্যি শাঁসালো হয়েছে!

হ্যাঁ, তা হয়েছে। তার কারণ আমি কৃতকার্য হয়েছি, সফল হয়েছি। কিন্তু তুমি তা সারাজীবনেও হতে পারবে না।

না পারি, কিন্তু জীবনে আপনার চেয়ে ঢের ভালো ছবি আঁকতে পারব, এটাও শুনে রাখুন।

এবার প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন উইসেনব্রাক। বললেন—অতটা না পারলেও হেগ-এ যত শিল্পী আছে তাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে কাছাকাছি যে তুমি পৌঁছোতে পারবে তাও আমি বলে দিলাম, অবশ্য তোমার মেজাজ যেমন, ক্ষমতাও যদি তেমন জবরদস্ত হয়।

জল হয়ে গেল ভিনসেন্ট। দাঁত বার করে বললে—তাহলে এতক্ষণ গালাগালি দিচ্ছিলেন কেন? আসুন, বসবেন না?

না, বসলে আমি দেখতে পাইনে। এগুলো কী? জলরং! এ তোমার চলবে না। তুমি যা বলতে চাও, মিনমিনে জলরঙের তা প্রকাশ করার সাধ্য কই।

জলরঙের দৃশ্যপটগুলো একধারে সরিয়ে একধারে সরিয়ে উইসেনব্রাক ভিনসেন্টের পেনসিলস্কেচগুলো দেখতে লাগলেন—বরিনেজ, ব্রাবান্ট আর সম্প্রতি হেগ-এ আঁকা বিচিত্র নরনারীর মেলা যেগুলোতে। চোখ দুটো তাঁর জ্বলজ্বল করতে লাগল। বললেন—তুমি তো দারুণ ড্রয়িং কর হে! এমনি ড্রয়িং থেকে আমারই যে আঁকতে ইচ্ছে করছে!

ভিনসেন্ট শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়িয়েছিল দুর্জয় একটা আঘাতের জন্যে প্রস্তুত হয়ে। তার বদলে এমনি অকপট ভালো লাগার এমনি মৃদু পিঠ-চাপড়ানি! কেঁপে উঠল তার পা দুটো। ধপ করে সে বসে পড়ল। অস্ফুট স্বরে বললে—কিন্তু সবাই যে বলে আপনার জিভ নিষ্ঠুর তরোয়াল, উইসেনব্রাক!

ঠিকই বলে। স্কেচগুলো যদি সত্যি ভালো না হতো আমি বলতাম না।

কিন্তু, কিন্তু টারস্টিগ তো এইগুলোর জন্যেই আমাকে ধমকেছেন। বলেছেন, এগুলোর মধ্যে কোনো লালিত্য নেই, কর্কশ বুনো ড্রয়িং

বাজে কথা। যেটা বলেছে দোষ সেইটেই তো গুণ! বন্যতার মধ্যেই তোমার শক্তি লুকিয়ে আছে ভিনসেন্ট।

আমি এই কাজই এখন বেশ কিছুদিন করে যেতে চাই, কিন্তু টারস্টিগ জোর দেন ওয়াটার কালারের ওপর।

হুঁ, যাতে চটপট বাজারে কাটে, তা-ই না? দেখো ভায়া, তোমার চোখে বিশ্বজগৎ যদি কালি কি পেনসিলের রেখাতেই ধরা দেয়, ঠিক তেমনি করেই তাকে ধরবে। আর যা সবচেয়ে বড়ো কথা, কারও উপদেশে কান দেবে না, আমারও না। যে-পথ নিজে ভালো বোঝ, সেই পথেই এগোবে।

বেশ, তা-ই করব।

মভ একদিন বলছিল তুমি হচ্ছ জন্ম-আঁকিয়ে। তাই নিয়ে টারস্টিগের সঙ্গে তার তর্ক। আমি সে-দিন ছিলাম, তবে চুপচাপ ছিলাম। তোমার কাজ যখন দেখলাম, এবার থেকে মভের দিকে আমি।

অ্যাঁ, সত্যি বলছেন, মভ বলেছেন আমি জন্ম-আঁকিয়ে?

– থাক থাক, ও-কথায় অতটা না ফুললেও চলবে। মরবার কাল পর্যন্ত যদি আঁকিয়ে থাকতে পার, তবেই বুঝবে কিছুটা করলে।

তাহলে মভ আজকাল আমার ওপর এতটা বিরূপ কেন? কথাই বলেন না, চিনতেই পারেন না যেন!

সকলের প্রতিই মভের ব্যবহার আজকাল অমনি। ‘শেভেনিনজেন’ ছবিটা শেষ করছে কিনা! বড়ো ছবির শেষের দিকে এলে ওর মেজাজ অমনি হয়। আবার দেখো ঠিক হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে কোনো দরকার হলে, আমার কাছে আসতে পারো। একটু ভেবে ভিনসেন্ট বললে—একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করব, উইসেনব্রাক?

বলো।

মভই কি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন?

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।

কিন্তু কেন?

তোমার কাজ সম্বন্ধে আমার কী মত তা সে জানতে চায়।

কিন্তু কী দরকার তাঁর? তাঁর নিজেরই যদি ধারণা যে আমি—

তা আমি জানিনে। তবে আমার মনে হয় টারস্টিগের কথায় তার মনে এ নিয়ে কিছুটা ধাঁধা লেগেছিল।

টারস্টিগ আশা হারিয়েছেন তার ওপর, মভের ব্যবহারে সুদূর নির্লিপ্তি। হতাশ মনের দৈন্য পূরণের জন্যে তবু আছে ক্রিস্টিন, মেটায় সহজ সাথিত্বের বেদনা। রোজ ভোরে সে আসে, সঙ্গে আনে সেলাইয়ের ঝুড়ি। ভিনসেন্টের হাত কাজ করে, সঙ্গে সঙ্গে কাজ করে তার হাত দুটিও। কণ্ঠ তার কোমল নয়, ভাষা, লালিত্যবিহীন, তবু সে মৃদুস্বরে কথা বলে, যখন বোঝে ভিনসেন্টের ছবি আঁকার একাগ্রতা, চুপ করতে ভোলে না। জানলার ধারে গরম উনুনের পাশে চুপ করে বসে থাকতেই আসলে খুব ভালো লাগে মেয়েটার, নীরবে আসন্ন সন্তানের জন্যে কাঁথা পোশাক সেলাই করে। মডেল হিসেবে তার কোনো শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা নেই, তবু আড়ষ্টতা পরিহার করতে ভিনসেন্টকে খুশি করতে সে মন থেকেই চায়। নতুন একটা কাজ নিজের থেকেই নিয়েছে। বাড়ি যাবার আগে ভিনসেন্টের জন্যে দুপুরের রান্নাটাও করে যায়।

কেন কষ্ট করে আবার এসব করছ সিয়েন—ভিনসেন্ট বলে।

কষ্ট কীসের? রান্নাটা তোমার চাইতে ভালোই পারি, তাই করছি।

তাহলে শেষ করেই চলে যেয়ো না। খাবেও আমার সঙ্গেই, কেমন?

বেশ তো। মা ঘরে বাচ্চাদের দেখবেন। এখানে থাকতে তো আমার ভালোই লাগে।

ভিনসেন্ট এক ফ্র্যাঙ্ক করে দেয় রোজ। নিয়মিত. এতটা খরচ তার ক্ষমতার বাইরে, তবু ক্রিস্টিনের এই সঙ্গটুকু পেয়েই তো সে আছে। তা ছাড়া মেয়েটাকে যে এই অবস্থায় দৈনন্দিন কাপড় কাচার হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছে, তার ভালো লাগাটা তো কম কথা নয়। দুপুর গড়িয়ে যায় বিকেলে। বিকেলে যদি তাকে বাইরে যেতে হয়, ক্রিস্টিন অপেক্ষা করে। ফিরে এসে অনেকক্ষণ ধরে তাকে বসিয়ে স্কেচ করে ভিনসেন্ট, গভীর রাতে ফিরে যাবার পরিশ্রমটা ক্রিস্টিন আর তখন সইতে চায় না। ভালো লাগে ভোরে যখন কফির গন্ধে ঘুম ভাঙে, তন্দ্রালু চোখ আটকে যায় অদূরে উনুনের ধারে চেনাশুনো একটি নারীর অস্পষ্ট দেহরেখায়।

কোনো কোনো রাত্রে ক্রিস্টিন অকারণেই তার ঘরে থেকে যায়। বলে—ইচ্ছে করছে আজ রাত্রে এখানেই শুয়ে থাকি ভিনসেন্ট, শোব?

নিশ্চয়ই, সিয়েন। এ আর জিজ্ঞেস করছ কেন? জান তো, যত তুমি আমার কাছে থাক ততই আমার ভালো লাগে।

নিজের থেকে কোনো কাজ করতে কোনোদিন ভিনসেন্ট ক্রিস্টিনকে বলেনি, তবু সে ক্রমে ক্রমে অনেক কাজ হাতে নেয়। ভিনসেন্টের জামাকাপড় কাচে, সেলাইফোড়াই করে, দোকানবাজার আনে। সাংসারিকতায় পটু সে নয় মোটেও। তার পরিবেশ আর জীবনযাত্রা, নিয়মানুবর্তিতা ও পরিচ্ছন্নতার স্বাভাবিক বৃত্তি তার মন থেকে ঝাঁটিয়ে দিয়েছে অনেকদিন। কুড়েমি তার মজ্জাগত, হঠাৎ-খেয়ালের দমকে আর প্রয়োজনের তাগিদে কাজ করাই তার স্বভাব; যাকে পছন্দ করে এমনি একটি মানুষের হয়ে ঘরকন্না করছে সে জীবনে প্রথম, এতে জেগেছে ভালো লাগার নতুন অনুভূতি। ভিনসেন্ট বাধা দেয় না। নোংরা আর নিত্য ক্লান্তিভরা জীবনযাত্রা যে ঘুচেছে, এই ভালো। গলার স্বরের রুক্ষতা যে কমছে, কর্কশ ইতর কথাগুলো যে একে একে ভুলছে, এই অনেক। তবু মেজাজ এখনও শুধরোয়নি, হঠাৎ হঠাৎ কারণে অকারণে যদি রেগে ওঠে, নিজেকে সংযত করতে পারে না, গলার নীল নীল শিরা ফুলিয়ে চেঁচায়, মুখে এমনি ঘৃণ; অশ্লীল কথার খই ফোটে যা ভিনসেন্ট জীবনে কখনও শোনেনি।

এমনি তুমুল কাণ্ডের সময়ে ভিনসেন্ট চুপ করে থাকে, ঝড়ের প্রকোপটা কমবার জন্যে অপেক্ষা করে। এমনি চুপ করে থাকার পালা ক্রিস্টিনেরও আসে। ড্রয়িং-এ যখন সব ভুল হয় বা যখন ভিনসেন্টের নির্দেশ সব মাথার মধ্যে গুলিয়ে যাবার ফলে ক্রিস্টিন ভুল ‘পোজ’ করে, তখন এক-একসময় তেতে আগুন হয়ে ওঠে ভিনসেন্ট, দেয়াল ফেটে পড়ে তার বকুনির চিৎকারে। নীরবে তখন সব বকুনি হজম করে ক্রিস্টিন। রক্ষা এই যে, দুজনে একসঙ্গে কখনও ফাটে না।

স্কেচের পর স্কেচ করে ক্রিস্টিনের দেহের প্রতিটি রেখার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হবার পর ভিনসেন্ট স্থির করল, এবার সত্যিকারের একটা স্টাডি সে আঁকবে। উনুনের পাশে একটা চৌকো কাঠের ওপর নগ্ন ক্রিস্টিনকে সে বসাল। কাঠের ব্লকটার জায়গায় সে আঁকল গাছের গুড়ি, আশেপাশে একটু সবুজের আভাস, ছবির পটভূমি রইল প্রকৃতি। তারপর সে আঁকল ক্রিস্টিনের মূর্তি, জীর্ণা বিশীর্ণা নারী, দু-হাঁটুর দুটি গোল হাড় আঁকড়ানো শিরাসর্বস্ব প্রেত আঙুলগুলি, দীর্ঘ দুটি ক্ষীণ বাহুর আড়ালে রেখাবিড়ম্বিত মুখ ঢাকা, বিরল কেশের ক-টি গুচ্ছ লুটিয়ে আছে পিঠের নিঃসঙ্গ শিরদাঁড়ায়, লম্বমান দুটি স্তনের বিনষ্ট বৃত্ত ঝুলে আছে পঞ্জরাস্থি ছাড়িয়ে, নিষ্প্রাণ দুটি পায়ের পাতা অশক্ত আচ্ছন্নতায় কোনো রকমে মাটি ছুঁয়ে আছে। এই নারী—জীবনের শেষ রসবিন্দুটুকু পর্যন্ত যার নিংড়ানো। এই তার ছবি—যে-ছবির নাম ভিনসেন্ট দিল—বঞ্চনা।

এক সপ্তাহ লাগল ছবিটা শেষ হতে। ইতিমধ্যে সব টাকা ফুরিয়ে গেল। মার্চের পয়লা তারিখ আসতে এখনও দশদিন বাকি। ঘরে আর দু-তিন দিনের মতো কালো রুটি অবশ্য আছে। কিন্তু বাকি খরচের পয়সা নেই একটিও।

ভিনসেন্ট বললে—সিয়েন, ভয় হচ্ছে মাস কাবারের আগে বুঝি আর তোমার

আসা চলবে না।

কেন, কী হল?

আর আমার টাকা নেই।

মানে, আমাকে দেবার জন্যে?

হ্যাঁ।

তা না থাক, এমনিতেই আমি আসব। আমার আর তো কাজ নেই!

কিন্তু টাকা তো তোমার চাই সিয়েন। সারাদিন এখানে থাকলে কাপড় কাচতেও পারবে না, চলবে কী করে তোমার?

থাক, সে আমি দেখব… তোমাকে তা ভাবতে হবে না।

তিন দিন পরে রুটি ফুরোল। ভিনসেন্ট ক্রিস্টিনকে এই বলে বিদায় দিল যে সে আমস্টার্ডামে কাকার কাছে যাচ্ছে, ফিরে এসে দেখা করবে। তিন দিন স্টুডিয়ো থেকে সে বার হল না। শুধু জল খেয়ে আর পুরোনো ড্রয়িং কপি করে কাটাল। তৃতীয় দিন বিকেলে সে ডি বকের স্টুডিয়োতে চলল, এই আশায় যে সেখানে চা কেক মিলতে পারে।

ডি বক মুখের কথায় আপ্যায়িত করল, কিন্তু চায়ের প্রসঙ্গ উঠল না।

মভ এখন তার সঙ্গে দেখা করবেন না সুনিশ্চিত, জেট বউদির কাছে হাত পাতা অসম্ভব। আর মভের কাছে তার সম্বন্ধে টারস্টিগ যে-মন্তব্য করেছেন বলে সে শুনেছে, এরপর মরে গেলেও টারস্টিগের কাছে সাহায্যের জন্যে সে যাবে না। ঘরে ফিরে এল। সঙ্গে সঙ্গে এল অনাহারের পুরোনো বন্ধু—জ্বর। শুয়ে পড়ে রইল সে, ঘুরেফিরে একটি চিন্তা, বরাতক্রমে থিয়োর টাকাটা যদি দু-দিন আগে এসে যায়!

পাঁচ দিনের দিন বিকেলে নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকল ক্রিস্টিন। ভিনসেন্ট তখন ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত লোকটির মুখ ক্রিস্টিন ভালো করে দেখল, কপালে গভীর বলিরেখা, নোংরা লালচে দাড়ির নীচে নীরক্ত পাংশু গাল, ফাটা শুকনো ঠোঁট দুটো। .. আস্তে কপালে হাত রেখে দেখল, গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। খুঁজে দেখল সেলফের ওপর এক কণা রুটি কি এতটুকু কফি কোথাও নেই। আবার নিঃশব্দে সে বার হয়ে গেল।

ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ভিনসেন্ট দেখছে ইটেনে মা-র রান্নাঘরটা থেকে আসছে রান্নার উষ্ণ মধুর সুরভি। হঠাৎ ঘুম ভাঙল, দেখল উনুনে কী যেন চড়িয়েছে ক্রিস্টিন।

ক্ষীণ, শুষ্ক কণ্ঠে সে ডাকল—সিয়েন!

বিছানার কাছে এল ক্রিস্টিন, শীতল একটি হাত রাখল তার উত্তপ্ত গালের ওপর। কাছাকাছি মুখ এনে বললে—এমনি দেমাক আর কখনও কোরো না, আর কখনও এমনি করে আমার কাছে চেপে রেখো না নিজেকে। আমরা গরিব, কিন্তু দোষ কী তাতে? তোমার যখন টানাটানি, আমার কাছ থেকেও তা লুকিয়ে রাখবে? কেন? আমার দরকারে কে দেখে? তুমি না?

সিয়েন! অস্ফুট স্বরে আবার বললে ভিনসেন্ট।

নাও, আর কথা বলতে হবে না। চুপ করে শুয়ে থাকো। তোমার দশা দেখে আমি বাড়ি গিয়েছিলাম। কটা আলু আর সিম জোগাড় করে এনেছি। সেদ্ধও হয়ে এসেছে।

ডিসের ওপর চটকানো সেদ্ধ আলু আর সেদ্ধ সিম নিয়ে বিছানার ধারে বসে ভিনসেন্টকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে লাগল ক্রিস্টিন। বললে—শেষের দিকে তোমার এমনি টান পড়বে যদি জানতে তো রোজ রোজ আমাকে টাকা দিতে কেন? ক-দিন একটি দানা দাঁতে কাটনি বলো তো? এমনি ধারা কি ভালো?

এমনি সহানুভূতির আঘাতে শক্তি হারাল ভিনসেন্টের মন। পরদিন কাঙাল হয়ে সে চলল টারস্টিগের উদ্দেশ্যে। কাদা-মাখা জুতোর একপাটির শুকতলা খসে পড়েছে, তালি-দেওয়া নোংরা প্যান্ট। থিয়োর কোটটা গায়ে কয়েক সাইজ ছোটো। ময়লা কলারের একধার দিয়ে ঝুলছে বিবর্ণ টাই, মাথায় কিম্ভুত একটা টুপি পথের ধারে একটা আরশিতে চেহারাটার ছায়া পড়ল, স্পষ্ট স্বচ্ছ চোখে দেখল, আরশির ওই লোকটাকে। কে ওটা? নোংরা ছেঁড়া ধোকড়-পরা রাস্তার একটা বাউন্ডুলে, কেউ যার নেই, কেউ যাকে পৌঁছে না, আশাহীন, আশ্রয়হীন বরবাদ একটা ঝুটোমানুষ।

টারস্টিগ বললেন—বাঃ বাঃ, আজ তো দোকানে তুমি আমার প্রথম খদ্দের, ভিনসেন্ট। বলো, কী করতে পারি তোমার জন্যে।

ভিনসেন্ট জানাল তার দুরবস্থার কথা।

টারস্টিগ প্রশ্ন করলেন—কেন, তোমার মাসোহারার টাকা গেল কোথায়?

খরচ হয়ে গেছে।

বুঝে যদি খরচ না কর তাতে আমি উৎসাহ দেব আশা কোরো না। তিরিশ দিনে মাস, সেই হিসেবে দিনের খরচটাকে বেঁধে ফেলা এমন কিছু শক্ত হিসেব নয়।

বাজে খরচ আমি করিনি মিনহার। প্রায় সব টাকাই দিতে হয়েছে মডেলের জন্যে।

বটে? তাহলে মডেলের দরকার কী? মডেল বাদ দিলে অনেক সস্তায় কাজ করতে পারবে।

মডেল যদি না পাই তো মানুষের চেহারা আঁকব কী করে? দরকার নেই মানুষ আঁকার। গোরু ভেড়া আঁকো। ওদের পেছনে পয়সা লাগে না।

গোরু ভেড়া আমি আঁকতে পারিনে মিনহার। ও আমার মেজাজে আসে না।

মানুষের চেহারা কাঠ-পেনসিল দিয়ে স্কেচ করাটাই যদি খালি তোমার মেজাজে আসে, অমন মেজাজকে বাতিল করো। তোমার ওইসব স্কেচ কখনও বিক্রি হবে না। আমি তোমাকে বলেছিলাম খালি জলরঙের দৃশ্য আঁকবে, আর কিছু নয়, মনে আছে? আমি বুঝি কেন তুমি ড্রয়িং করো। আসলে তুমি ফাঁকি দিতে চাও। জলরঙের কাজ শিখতে গেলে যে-সাধনা যে-পরিশ্রমটা দরকার, সেটাকে এড়াতে চাও তুমি। এই তো?

চুপ করে রইল ভিনসেন্ট। কী উত্তর সে দেবে এ-কথার?

টারস্টিগ বলে চললেন—ডি বকের মডেল দরকার হয় না। কিন্তু ছবি সে আঁকে। প্রত্যেকটা ছবি তার চমৎকার, বিক্রিও হয় তেমনি। কী করে সে এমনি পারে? আর এতদিনেও শিক্ষানবিশি তোমার ঘুচল না, শুরুতে যেমন কুৎসিত ছিল, এখনও তেমনি কুৎসিতই রয়ে গেল তোমার হাত। সহজ সত্যি কথাটা যদি শুনতে চাও—তুমি আর্টিস্ট নও, এ-রাস্তা তোমার জন্যে নয়।

পাঁচ দিনের উপবাসক্লিষ্ট দেহ ভেঙে পড়ে বুঝি। ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল ভিনসেন্ট। তার গলার স্বর বুঝি ক্ষুধার্ত জঠরের মধ্যে পথ হারিয়েছে। একটু পরে করুণ আর্ত স্বর বার হল—এ-কথা কেন বলছেন, মিনহার?

তার কারণ আমি মনে করি, তোমার প্রতি, তোমাদের ভ্যান গক পরিবারের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। শিল্পী চিনতে আমার ভুল হয় না, সে-শিল্পী তুমি নও। অল্প বয়সে যদি শুরু করতে, তবু হতো কিছু হয়তো। কিন্তু এ-বয়সে আর হয় না। এখনও যদি বাঁচতে চাও অন্য পথে যাও। পরান্নভোজী হয়ে আর সময় কাটিয়ো না।

কিন্তু মভ যে বলেছেন আমার হবে।

হ্যাঁ, তার কারণ মভ তোমার আত্মীয়। সে তোমাকে আঘাত দিতে চায়নি। কিন্তু আমি তোমার বন্ধু। আমার কথায় আজ আঘাত পাচ্ছ, কিন্তু অন্য পথে অন্য কাজে জীবনে যদি প্রতিষ্ঠিত হতে পার, এ-আঘাতের জন্যে সেদিন তুমি আমাকে ধন্যবাদ দেবে।

মিনহার টারস্টিগ, ভাঙা গলায় ভিনসেন্ট বললে—আপনার কথা সত্যি, আমি আর্টিস্ট নই। এ-পথ আমি ছেড়ে দেব। কিন্তু এখন আমাকে বাঁচান। গত পাঁচ দিন ধরে একটুকরো রুটি কেনবার একটা পয়সা আমার পকেটে নেই। নিজের উপোসের জন্যে ভাবিনে, আমার মডেল একজন অসুস্থ স্ত্রীলোক, তার কাছে আমার ধার পড়ে আছে। দশটা গিল্ডার অন্তত আমাকে ধার দিন। থিয়োর কাছ থেকে টাকা এলেই আপনাকে শোধ দিয়ে যাব।

টারস্টিগ গম্ভীরভাবে দামি কোটের পাশ থেকে ব্যাগ বার করে দশ গিল্ডারের একটা নোট বাড়িয়ে দিলেন।

ভিনসেন্ট চেয়ার থেকে উঠে কম্পিত হাত বাড়িয়ে বললে—ধন্যবাদ মিনহার,

ধন্যবাদ। অশেষ আপনার দয়া।

ময়লা একটা ন্যাতা দিয়ে ঘর মুছছিল ক্রিস্টিন। চুলগুলো মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা, ব্রণকলঙ্কিত মুখভরতি ঘাম। মুখ তুলে বললে–টাকা পেয়েছ?

হ্যাঁ, দশ ফ্র্যাঙ্ক—বললে ভিনসেন্ট।

দেখো, বড়োলোক বন্ধু থাকার কত সুবিধে।

মনে স্বস্তি, তাই ক্রিস্টিনের গলায় ঠাট্টার সুর।

এই নাও, ছ-ফ্র্যাঙ্ক তোমার পাওনা ছিল, হাতে রেখে দাও আগে।

ক্রিস্টিন উঠে দাঁড়াল। ময়লা অ্যাপ্রনে মুখটা মুছে নিল একবার। বললে—কটি পয়সাও এখন আমাকে দেবে না। আগে ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা আসুক, ারপর। বাকি চার ফ্র্যাঙ্কে তোমার চলবে কী করে?

আমি ঠিক চালিয়ে নেব সিয়েন। তোমার তো দরকার।

—দরকার তোমারও। শোনো বলি। ভাইয়ের কাছ থেকে যতদিন না খবর ও ততদিন আমি এখানেই থাকব। এ-টাকায় তুমিও খাবে, আমিও খাব। হলো?  

কিন্তু সিয়েন, তোমার মডেল হওয়ার দাম আমি তো দিতে পারব না!

শোনো! অনেক তুমি দিয়েছ, দেবেও অনেক। খেতে দেবে, শুতে দেবে, জগারের জন্যে পথে বার হতে হবে না, তার দাম কি কম?

দু-বাহু বাড়িয়ে ভিনসেন্ট কাছে টেনে নিল ক্রিস্টিনকে। পাতলা খড়খড়ে চুলের গুচ্ছগুলো ঘামে ভেজা কপাল থেকে সরিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তার। রুদ্ধকণ্ঠে বললে, বেঁচে থাকো তুমি সিয়েন, বেঁচে থাকো। তোমাকে দেখে আবার যেন বিশ্বাস হচ্ছে যে ভগবান আছেন।

সপ্তাহ খানেক পরে ভিনসেন্ট মভের সঙ্গে দেখা করতে গেল। দরজা খুলতেই সামনে মভ। বিরস কণ্ঠে বললেন—কী দরকার তোমার? এখন আমার সময় নেই। ভিনসেন্ট বললে—কয়েকটা ওয়াটার কালার করেছি। আপনি যদি একটু দেখে দেন সেইজন্যে। থাক এখন, আমি পরে আসব।

—সময় অসময়ের জ্ঞান তো তোমার নেই! যাক, এসেই যখন পড়েছ চলো।

স্টুডিয়োতে ঢুকে দেখল উইসেনব্রাককে। মভের হাতের কাজ শেষ হয়েছে, এখন সময় বিশ্রামের, মানসিক স্বস্তির। বন্ধুর সামনে ভিনসেন্টকে ঠাট্টা করলে মনটা চাঙা হবে মন্দ না।

ভিনসেন্টের দিকে আঙুল দেখিয়ে মভ উইসেনব্রাককে বললেন—দেখো দেখো, লোকটার চেহারা দেখো!

চোখ-মুখ পাকিয়ে চেহারার একটা বিকৃত কুৎসিত ভঙ্গি করে উইসেনব্রাকের কাছে কয়েক পা এগিয়ে আধবোজা চোখে তাকিয়ে তোতলার মতো কয়েকটি কথা বললেন মভ। তারপর বললেন—দেখো, ঠিক একে নকল করতে পেরেছি কি না?

হো-হো করে হেসে উঠলেন উইসেনব্রাক। মভ বললেন—ওহে, এবার তোমার নোংরা দাড়িটা একটু চুলকোও তো দেখি?

স্তম্ভিত হয়ে গেল ভিনসেন্ট। এমনি দুরন্ত অপমান সে মভের কাছে আশা করেনি। এক কোণে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে উইসেনব্রাক বিদায় নিলেন। এতক্ষণে তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মভ বললেন—কী, ঠায় দাঁড়িয়ে আছ? এখনও বিদেয় হওনি?

মভ যেমন মুখভঙ্গি করেছিলেন ঠিক তেমনি ছাপ সত্যিই ভিনসেন্টের মুখে ব্যাকুল কণ্ঠে সে বললে কী হয়েছে মভ ভাই? কী করেছি আমি? আপনি এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করছেন কেন আমার সঙ্গে?

ক্লান্ত দেহে মভ নরম একটা সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।

দিন দিন তুমি যা হচ্ছ, মভ বললেন—তা আমি মোটেই সমর্থন করতে পারছিনে ভিনসেন্ট। এতদিনে এক পয়সা রোজগার করবার তোমার ক্ষমতা হল না, আর তার বদলে এর-তার কাছে তুমি ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছ আর সারা ভ্যান গক বংশের নাম ডোবাচ্ছ!

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভিনসেন্ট বললে—টারস্টিগের কাছে শুনেছেন, তাই না? বুঝলাম, আর আপনি আমাকে শেখাবেন না।

না।

বেশ। এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে তাহলে লাভ নেই। অনেক দয়া আপনি আমায় করেছেন। কৃতজ্ঞতা মুখে প্রকাশ করার নয়। আমার কোনো দুঃখ নেই। আচ্ছা চলি তাহলে মভ ভাই।

না যেয়ো না, দাঁড়াও।

অন্যমনস্কভাবে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন মভ। তারপর বললেন—রাগ কোরো না ভিনসেন্ট। বড়ো ক্লান্ত আমি, শরীরটাও ভালো নেই। দাও, দেখি কী ছবি তুমি এঁকেছ।

কিন্তু, এখন থাক না! পরে না হয়—

না না, নিয়ে যখন এসেছ, দাও দেখি।

ক্লান্ত রক্তচক্ষু মেলে ছবিগুলো দেখতে লাগলেন মভ। তারপর বললেন–ভুল, তোমার ড্রয়িং আগাগোড়া সব ভুল। এতদিন যে কেন আমার চোখে পড়েনি তা-ই আশ্চর্য!

কিন্তু আপনিই যে একদিন বলেছিলেন–

ভুল করেছিলাম আমিও। যা অপটুত্ব তাকে ভেবেছিলাম শক্তির আভাস। আসলে কিছুই তোমার এতদিনে হয়নি। শিখতেই যদি চাও, গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। ওই ফার্নেসের পাশে গোটা কতক প্লাস্টারের ছাঁচ আছে। যাও, ওইগুলো দেখে দেখে ড্রয়িং করতে শেখো গে।

স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ছাঁচগুলোর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল ভিনসেন্ট। হাতের সামনে একটা পায়ের ছাঁচ। পকেট থেকে. পেনসিল আর ড্রয়িং-কাগজ বার করে হাতে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ছাঁচটার দিকে। কাগজে একটি লাইনও সরল না। শুধু অপমান নয়, শানিত অস্ত্রের মতো বুকে বিঁধে গেছে হতাশার তীব্র যন্ত্রণা। পিছন ফিরে দেখল মভ সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছেন। ঘুমিয়ে পড়লেন বুঝি।

কয়েক ঘণ্টা কাটল। একমনে পর পর সাতখানা ড্রয়িং করল ভিনসেন্ট ওই প্লাস্টারের পা-টার। নাসিকাধ্বনি বন্ধ হল। ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মভ, ভিনসেন্টের কাছে এসে বললেন—দেখি দেখি, কতদূর কী করলে?

পর পর ড্রয়িংগুলোর ওপর তাড়াতাড়ি চোখ বুলিয়ে চিৎকার করে উঠলেন মভ― না, না, না!

টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন হাতের কাগজগুলো সেই ছেলেমি, সেই জড়তা, সেই কর্কশতা! ঠিক সেই প্রথম দিনের মতো। চোখের সামনে ছাঁচটা রয়েছে, ঠিক ওটা যেমন তেমনি আঁকতে পার না? একটা জিনিস আসলে যেমন দেখতে, ঠিক সেই জিনিসটা ড্রয়িং করা কি কখনও তোমার ধাতে আসবে না? কাগজের ওপর পেনসিলের একটা লাইন, তার একটা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ ভাষা আছে, তেমনি একটা লাইন টানারও ক্ষমতা তোমার নেই?

পেছনের দরজা দিয়ে নীরবে বার হয়ে বাগান ছাড়িয়ে রান্নাঘরে গেল ভিনসেন্ট। সেখানে কিছুটা খেয়ে আবার ফিরে এল স্টুডিয়োতে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আলো জ্বলছে। এক কোণে বসে আবার সে ওই প্লাস্টারের পা-টা আঁকতে লাগল।

রাত শেষ হয়ে গেল। মভ এসে স্কেচগুলো দেখলেন। বললেন—বৃথা, বৃথা। কিছু হয়নি। ড্রয়িং-এর নিতান্ত মৌলিক ভুল যেগুলো, সেগুলো প্রত্যেকটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে রয়েছে তোমার কাজে। খুব হয়েছে! এবার ছাঁচটাকে হাতে নিয়ে বাড়ি যাও। যেদিন একটা পা অন্তত ঠিক করে আঁকতে পারবে, সেদিন আবার আমার এখানে এসো। তার আগে নয়।

ছাঁচটাকে সজোরে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল ভিনসেন্ট, ভেঙে গেল টুকরো টুকরো হয়ে। রুদ্ধ গর্জন করে উঠল—ছাঁচ? মরা ছাঁচ দেখে আবার আঁকব আমি? যেদিন পৃথিবীতে জীবন্ত হাত আর পা একটাও থাকবে না, সেদিন, তার আগে নয়।

ছুটে বার হয়ে গেল সে মভের স্টুডিয়ো থেকে।

.

দুপুর বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখে, ক্রিস্টিন এসেছে তার বড়ো ছেলে হার্মানকে সঙ্গে নিয়ে। রোগা রক্তহীন চেহারা ছেলেটার, ত্রস্ত ভয়ার্ত চোখ। লেখাপড়া শেখেনি, অচেনা লোকের কাছে এগোতে সাহস করে না। ভিনসেন্ট একটুকরো কাগজে একটা গোরু এঁকে তাকে দিল, আর তার হাতে দিল একটা পেনসিল। ভাব হয়ে গেল ছেলেটার সঙ্গে। ক্রিস্টিন বার করল কিছুটা রুটি আর পনির। খেল সবাই মিলে।

হঠাৎ কে আর তার ছেলে জ্যানকে মনে পড়ল ভিনসেন্টের। কী যেন আটকে এল গলার মধ্যে।

ক্রিস্টিনের শরীর ভালো নেই। পেটের মধ্যে কেমন একটা অসহ্য যন্ত্রণা, এমন আগে কোনবার তার হয়নি। বললে—আমি আজ উঠতে পারছিনে ভিনসেন্ট, তুমি হার্মানকে আঁকো।

সারাদিন সে শুয়ে রইল বিছানায়।

পরদিন ভিনসেন্ট জোর করে ক্রিস্টিনকে টেনে তুলল। নিয়ে চলল লিডেনের সরকারি হাসপাতালে।

ডাক্তার পুঙ্খানুপুঙ্খ করে পরীক্ষা করলেন, প্রশ্ন করলেন অসংখ্য। পরে বললেন—বাচ্চা পেটের মধ্যে ঠিক অবস্থায় নেই।

কী করা যাবে ডাক্তার? ভিনসেন্ট প্রশ্ন করল।

অপারেশন করাতে পারেন। খুব শক্ত কিছু নয়, কেবল ফরসেপস দিয়ে শিশুকে ঘুরিয়ে ঠিক অবস্থায় এনে দেওয়া। অপারেশনের জন্যে কোনো ফি দিতে হবে না, তবে হাসপাতাল-খরচ কিছু লাগবে।

ক্রিস্টিনের দিকে ফিরে ডাক্তার বললেন—হাতে জমিয়েছ কিছু?

ঘাড় নেড়ে ক্রিস্টিন বললে—একটি পয়সাও না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন ডাক্তার—ঠিক যা ভেবেছিলাম। ভিনসেন্ট শুধোল—কত খরচ লাগবে ডাক্তার?

পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্কের বেশি নয়।

আর যদি অপারেশনটা না হয়?

তাহলে প্রসবের সময় যে-বিপদ ঘটবে তা সামলানো অসম্ভব।

এক মুহূর্ত ভাবল ভিনসেন্ট। তারপর বললে—টাকার ব্যবস্থা আমি করব ডাক্তার।

বেশ, তাহলে শনিবার সকালে নিয়ে আসবেন, আমি নিজে অপারেশন করব। হ্যাঁ, আর-একটা কথা। এ-মেয়েটির সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক জানিনে, ডাক্তার হিসেবে আমার জানবার দরকারও নেই। তবে কিনা আপনার হয়তো দরকার একটা কথা জানবার। প্রসবের পর ও যদি আবার রাস্তায় বার হবার ব্যাবসা

শুরু করে তাহলে কবরে যেতে ছ-মাস লাগবে না।

আপনাকে কথা দিচ্ছি ডাক্তার, ও আর সে জীবনে ফিরে যাবে না।

বেশ, চমৎকার কথা। তাহলে শনিবার দিন আবার দেখা হবে।

.

ক-দিন পরে টারস্টিগ এলেন। বললেন—হুঁ, এখনও তুমি এসব নিয়েই আছ দেখছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ, এই আমার কাজ। আমি কাজ করছি।

তুমি আমাকে ডাকে যে দশ ফ্র্যাঙ্ক ফেরত পাঠিয়েছিলে, তা আমি পেয়েছি। নিজে গিয়ে ধন্যবাদের সঙ্গে ঋণটা শোধ করে আসবে, এটুকু আশা আমি করেছিলাম।

অতদূর রাস্তা, আর আবহাওয়াটাও এত খারাপ ছিল ক-দিন, তাই ভাবলাম ডাকেই–

বাঃ, বাঃ! টাকাটা ধার করতে যখন গিয়েছিলে, তখন কিন্তু রাস্তাটা খুব বেশি মনে হয়নি।

ভিনসেন্ট চুপ করে রইল। টারস্টিগ আবার বললেন—তোমার ওপর আমি যে রাগ করি ভিনসেন্ট, তার কারণ তোমার কোনো সম্ভ্রম নেই, কোনো ভদ্রতাবোধ নেই। এইজন্যেই তোমার ছবি নিতে আমার বিতৃষ্ণা আসে।

এবারে উত্তর দিল ভিনসেন্ট। বললে—আমার তো ধারণা ছিল, মিনহার, আপনার ছবি কেনার সঙ্গে কোনো ব্যক্তিবিশেষকে ভালো লাগা বা না-লাগার কোনো সম্পর্ক নেই।

নিশ্চয়ই নেই। আমার কথার ওরকম ঘুরিয়ে মানে করার চেষ্টা তুমি না করলেও পারো। তোমার কাজের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্রও সৌন্দর্য থাকত, তাহলে একটা ছবিও অন্তত আমি নিতাম।

ভিনসেন্ট বললে—এ-প্রসঙ্গ থাক মিনহার, আমি যে-পথে চলেছি সেই পথই আমার ভালো। বিক্রির জন্যে তৃতীয় মানুষের পছন্দসই মাল তৈরি করা আমার না হোক।

টারস্টিগ কোটের একটা বোতাম খুলে চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন—আমার মধ্যে-মধ্যে সন্দেহ হয়, তোমার ছবি লোকে কিনুক তা তুমি আসলে মনে মনে চাও না। সত্যিকারের তুমি চাও পরনির্ভরশীল হয়ে থাকতে।

তা নয় মিনহার। আমার একটা ছবি যদি বিক্রি হয় তাতে আমার চাইতে স্বস্তি কে পাবে? তবে কিনা, তার চাইতে আমি অনেক বেশি খুশি হই যখন উইসেনব্রাকের মতো কোনো শিল্পী আমার ড্রয়িং দেখে প্রশংসা করেন।

টারস্টিগ হাতের ছড়িটা দু-হাঁটুর ওপর রেখে–চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসলেন।

শোনো ভিনসেন্ট, তোমার বাবা মা আমাকে চিঠি লিখেছেন, অনুরোধ করেছেন তোমাকে যেন আমি সাহায্য করি। তাই আমি এসেছি। তোমার ছবি কিনে তোমাকে কখনওই সাহায্য করতে পারব না, সে আমার বিবেকে বাধবে। তার বদলে কয়েকটা নিতান্ত বাস্তব উপদেশ তোমাকে দিচ্ছি। এও তোমার উপকারে আসবে কম নয়। এই যে তুমি ছেঁড়া নোংরা ধোকড় পরে ঘুরে বেড়াও, এভাবে তুমি নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছ। নতুন জামাকাপড় কিছু কেনো। ভদ্রলোকের পোশাক না পরলে তুমি যে ভ্যান গক সে-পরিচয়ই-বা দেবে কেমন করে? তারপর মেলামেশা। শহরের উঁচুঘরের লোকজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের কোনো ঝোঁক তোমার নেই। যত কুলি মজুর, নীচু জাতের লোকের সঙ্গে তোমার মিল। নিতান্ত সব যাচ্ছেতাই জায়গায় যাচ্ছেতাই লোকজনের আড্ডায় তোমাকে দেখা গেছে। এমনি যদি কর তাহলে জীবনে বড়ো হবে কী করে?

টেবিলের কোণ থেকে নেমে ভিনসেন্ট টারস্টিগের সামনাসামনি এসে দাঁড়াল এই সুযোগ, সহানুভূতি আর বন্ধুত্ব নতুন করে ফিরে পাবার এই উপযুক্ত ক্ষণ। স্বাভাবিক কর্কশ গলার স্বরকে যতটা সম্ভব নরম করে বললে–মিনহার, আপনি আমার ভালোই চান, আমাকে সাহায্য করতে, আমার উপকার করতেই চান। আমিও আপনাকে অকপটেই আমার কথা খুলে বলছি। আপনি বলছেন, আমি ভালো কাপড়চোপড় পরিনে কেন? এর নিতান্ত সোজা আর সত্য জবাব হচ্ছে—পয়সা নেই বলে। এ তো -আপনার অজানা নয়। জায়গায় জায়গায় আমি ঘুরে বেড়াই, এ-কথা মিথ্যে নয়। কখনও জাহাজঘাটে, কখনও রেলস্টেশনে, পথে, বাজারে, গলিঘুঁজিতে, শ্রমিকদের সন্ধে বেলাকার আড্ডায়। এমনি ঘুরতে কারুর ভালো লাগে না, কেবল এক শিল্পীর ছাড়া। অভিজাত চায়ের পার্টি, সুবেশা সুন্দরী মেয়েদের ভিড়, তার চাইতে বস্তির জটলাও ভালো, যদি শিল্পীর মনের খোরাক সেখানেই মেলে। শিল্পীর কাজ নোংরা কাজ, নোংরা তার পরিবেশ। শিল্পবিক্রেতার চকমকে পোশাক আর ঝকমকে আচার-ব্যবহারে তার কাজ কী? মজুর আর মজুরনি, যারা মাটি কাটে, রাস্তা বানায়, তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন আমার কাটে। আমার কুৎসিত মুখ আর কদর্য পোশাক ঠিক মিলে যায় তাদের সঙ্গে। ওরা শ্রমিক, আমিও শ্রমিক ওদেরই মতো। এক হয়ে মিশে যেতে পারি ওদের সঙ্গে। দামি পোশাকের কোনো ব্যবধান ওদের আর আমার মধ্যে থাকে না। তাই তো ওরা আমাকে বিশ্বাস করে, সহজ হয়ে আমার সঙ্গে মেশে। ওদের মধ্যে থেকে অজানা আশ্চর্য সৌন্দর্যকে আমি খুঁজে খুঁজে বার করি। সমাজে যারা বরবাদ, তাদের বস্তির দরজা আমার কাছে খোলা, আমার স্টুডিয়োতে তাদের চির–নিমন্ত্রণ। এতে আমি নষ্ট করছি কী করে নিজেকে, মিনহার? আমার যা কাজ তাই তো আমি করছি। তার জন্যে গরিবদের সঙ্গে গরিব হয়ে মিশলে নিজেকে ছোটো করা হয়? না শিখলাম আমি অভিজাত ঘরের আদবকায়দা, ক্ষতি কী তাতে মিনহার?

গম্ভীর গলায় টারস্টিগ বললেন—তাহলে তোমার থেকে যারা বড়ো আর তোমার যারা মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, তাদের কোনো উপদেশ তুমি শুনবে না? জীবনে বারে বারে তুমি ব্যর্থ হয়েছ, আবার তুমি ব্যর্থ হবে?

ভুল কথা মিনহার, দেখুন আমার হাতখানা। ড্রয়িংওয়ালার মোটা মোটা আঙুল আমার, এ-আঙুলে শক্তি আছে।

কোটের বোতাম এঁটে উঠে দাঁড়ালেন টারস্টিগ চরম কথাটা বলবার জন্যে। সিঙ্কের টুপিটা মাথায় চড়িয়ে বললেন—বেশ, মভ আর আমি এবার দেখব যাতে থিয়োর কাছ থেকে আর-একটি পয়সাও তুমি না পাও। এ নইলে তোমার চৈতন্য হবে না।

কী যেন একটা চুরমার হয়ে ভেঙে গেল ভিনসেন্টের বুকের মধ্যে। থিয়োর দিক থেকে যদি আক্রমণটা আসে, তাহলে সে হবে চরম আক্রমণ। তাহলে আর কোনো আশা নেই!

দু-হাত জোড় করে সে আকুল চিৎকার করে উঠল—কেন, কেন? আমার এমনি সর্বনাশ আপনারা কেন করবেন? শুধু আপনাদের সঙ্গে আমার মতে মেলে না বলে? এটা কি উচিত? আমি শপথ করছি, আপনাদের সামনে আর কখনও আমি আসব না। আপনারা ভুলে যান আমাকে, এককোণে আমাকে নিজের মনে পড়ে থাকতে দিন। থিয়ো! থিয়ো ছাড়া আমার কেউ নেই, ওর দয়াতেই আমি বেঁচে আছি! ওকে আপনারা কেড়ে নেবেন না আমার কাছ থেকে।

আমরা যা করব, তা তোমার ভালোর জন্যেই করব।

টারস্টিগ চলে গেলেন।

পয়সার ব্যাগটাকে মুঠো করে ধরে ভিনসেন্ট রাস্তায় দৌড়োল। দৌড়োতে দৌড়োতে একটা দোকানে পৌঁছে সেখান থেকে প্লাস্টারের একটা পা কিনে আবার ছুটল মভের বাড়ি। জেট দরজা খুলে ভিনসেন্টকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।

তুমি এখানে?

মভ ভাই কোথায়?

অ্যান্টন বাড়ি নেই। তোমার ওপর সে ভয়ানক চটেছে। বলেছে জীবনে তোমার মুখ দেখবে না। এমনি কাণ্ড কেমন করে ঘটল ভিনসেন্ট?

পায়ের ছাঁচটা সে জেট-এর হাতে তুলে দিল। বললে—এটা মভকে দেবেন, বলবেন আমি দিয়ে গিয়েছি। আর বলবেন, যা হয়েছে সব আমার দোষ। বড়ো দুঃখিত আমি সেজন্যে।

ফিরে গেল ভিনসেন্ট। আলো-জ্বলা রাস্তা ছাড়িয়ে মাঠে প্রান্তরে তখন ধূসর অন্ধকারের জটলা।

ক্রিস্টিনের অপারেশন ভালোই হল, কিন্তু পেছনে রেখে গেল মস্ত সমস্যা। সমস্যাটা টাকার। ভিনসেন্ট কর্নেলিয়াস কাকাকে বারোটা ছবি পাঠিয়ে দিল, কিন্তু দাম তো হাতে-হাতে মিলবার নয়! খুশিমতো তিনি পাঠাবেন। লিডেন হাসপাতালের ডাক্তারই ক্রিস্টিনকে প্রসব করাবেন, অতএব হাসপাতালের টাকা আটকে রেখে তাঁকে অখুশি করা অসম্ভব। থিয়োর পাঠানো মাসোহারা থেকে সে-টাকা সে মিটিয়ে দিল। অসুস্থ ক্রিস্টিনের পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া দরকার, সে–খরচও ওই একই পুঁজি থেকে গেল। অতএব ভিনসেন্টের জীবনে আবার পুরোনো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। প্রথমে কফি আর কালো রুটি, তারপর শুধু কালো রুটি, তারপর খালি পেটে শুধু জল। সঙ্গে সঙ্গে জ্বর আর ভুল বকা। মাথাটা যখন একটু পরিষ্কার হয়, ভাবে, ‘ভাগ্যিস সে আগে থাকতেই ক্রিস্টিনের হাতে যতটা পারে টাকা তুলে দিয়েছিল, নইলে তার সংসারে তারও বুঝি এমনি অবস্থাই হতো।

এমনি অবস্থায় কোনো রকমে টলতে টলতে সে একদিন উইসেনব্রাকের স্টুডিয়োতে গেল। উইসেনব্রাকের প্রচুর টাকা, কিন্তু জীবনযাত্রায় নিষ্করুণ মিতব্যয়িতা। একটা বাড়ির চারতলার ওপরে তাঁর স্টুডিয়ো। ফাঁকা মস্ত একটা ঘর, কোনো আসবাব নেই, ছবি নেই, বই নেই, দ্বিতীয় লোকের বসবার জন্যে একটা টুল পর্যন্ত নেই। শুধু আছে ছবি আঁকার জিনিসপত্র, কারিগরির হাতিয়ার। অপরের স্টুডিয়োতে আড্ডা দিতে যেতে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু তাঁর ঘরে কেউ এলেই তাঁর মেজাজ হয়ে ওঠে খাঁচায় পোরা বাঘের মতো।

ভিনসেন্টকে দেখেই একেবারে খ্যাকখ্যাক করে উঠলেন—আচ্ছা? তুমি, তুমি এখানে এসেছ! কী মনে করে?

ভিনসেন্ট তার দুরবস্থার কথা জানাল।

ভুল, ভুল করেছ তুমি ভায়া, কঠোর হাসি হেসে উইসেনব্রাক বললেন—এক্কেবারে ভুল লোকের কাছে তুমি এসেছ। একটি পয়সাও তুমি আমার কাছে পাবে না।

না?

কিন্তু, এই ক-টা টাকা আপনি ক-দিনের জন্যে আমাকে ধার দিতে পারেন

আলবাত পারি, একশো বার পারি। তুমি কি ভেবেছ আমি তোমার মতো হাতুড়ে আর্টিস্ট যার একখানা ছবি জন্মে বিক্রি হয় না? এখনই আমার ব্যাঙ্কে এত টাকা আছে যা আমি তিন জন্মেও খরচ করে উঠতে পারব না।

তাহলে পঁচিশটা ফ্র্যাঙ্ক মাত্র আমাকে ধার দেবেন না কেন! একটুকরো বাসি রুটি কেনবার পয়সা আমার পকেটে নেই।

চমৎকার! চমৎকার! এই তো আসল দাওয়াই পড়েছে। না হলে তুমি আর্টিস্ট হবে কেমন করে?

খুশিতে দু-হাঁটুতে হাত বোলাতে লাগলেন উইসেনব্রাক।

ভিনসেন্ট দেয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড়াল। একটিমাত্র টুল, তাতে গৃহকর্তা নিজে বসে। কিছু না-ধরে দাঁড়াবার শক্তি নেই তার। কাতর গলায় বললে—অনাহারে আমি মরছি, এর মধ্যে আপনি চমৎকারটা কী দেখলেন?

এ তোমার মস্ত সৌভাগ্য ভিনসেন্ট। তুমি মরবে না, কিন্তু কষ্ট পাবে।

আমি কষ্ট পাব, তাতে আপনার এত আনন্দ কেন?

পায়ের ওপর পা তুলে টুলের ওপর জমিয়ে বসলেন উইসেনব্রাক। লাল রং মাখা একটা তুলি ভিনসেন্টের মুখের দিকে উঁচিয়ে বললেম—তার কারণ, কষ্ট না পেলে শিল্পী হওয়া যায় না। বেদনার বেদিতেই শিল্পীর প্রতিষ্ঠা। যত দুঃখ তুমি পাবে তত কৃতার্থ তুমি বোধ করবে। ভরা পেটের চাইতে খালি পেট ভালো। ভরা বুকের চাইতে ভালো ভাঙা বুক। যে কখনও দুঃখ পায়নি জীবনে, শিশুর অভিজ্ঞতাটুকুও তার হয়নি, সে আবার আঁকবে কী? সুখ তো গোরুর জন্যে আর দোকানদারের জন্যে। শিল্পীর হৃদয় দুঃখের পারাবার। যত কষ্ট পাবে, যত যন্ত্রণায় ছটফট করবে তত মনে ভাববে এ ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

কিন্তু দারিদ্র্য, সে তো ধ্বংস করে।

যে দুর্বল তাকে ধ্বংস করে, যে সবল তাকে নয়। শিল্পী হবার পথে পা বাড়িয়ে অনাহারে আর যন্ত্রণায় যে মরে, মরাই তার পক্ষে ভালো। অর্থসাহায্য করে তাকে বাঁচানোর কোনো সার্থকতা নেই। প্রকৃত যে শিল্পী, তার সর্বশেষ অবদান হৃদয় নিংড়ে দিয়ে যাবার আগে পর্যন্ত তার ধ্বংস নেই। তার আগে, কি ঈশ্বর কি শয়তান কেউ তাকে মারতে পারে না।

এসব কথা আমাকে বলা বৃথা, উইসেনব্রাক। বছরের পর বছর দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে আমার জীবন কেটেছে। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, আশ্রয় নেই, ক্ষুৎপীড়িত জ্বরাক্রান্ত দেহ, বেদনাব্যাকুল বিকল মন, এ-অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়।

অভিজ্ঞতার এই তো শুরু ভায়া! বেদনা অসীম, এ-সমুদ্রের পারাপার নেই। বাড়ি যাও, কাগজ পেনসিল নিয়ে বোসো গে। যত খিদে পাবে, তত ভালো কাজ বার হবে।

ঠিক বলেছেন, আর টারস্টিগের হাতে তত তাড়াতাড়ি আমার ছবির পর ছবি বাতিল হবে।

প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন উইসেনব্রাক। বললেন—আলবত, বাতিল হবে বই কী! না হলে চলবে কেন? তোমার ভালোর জন্যেই তো! তাতে যন্ত্রণা আরও বাড়বে, পরের ছবিটা আরও ভালো হবে। এমনিভাবে বেশ ক-বছর কাটাবার পর শেষ পর্যন্ত একটি ছবি হয়তো আঁকতে পারবে যার স্থান হবে জ্যান স্টিনের ছবির পাশে

কিংবা উইসেনব্রাকের–ভিনসেন্ট বললে।

ঠিক বলেছ। কিংবা উইসেনব্রাকের। আর আমি কিনা তোমাকে এখন টাকা ধার দিয়ে তোমার অমরত্বের পথে বাধ সাধব! খেপেছ?

অমরত্ব চুলোয় যাক। এই মুহূর্তে আমি ছবি আঁকতে চাই। কিন্তু খালি পেটে তা অসম্ভব।

বাজে কথা, ভায়া। দুনিয়ার আজ পর্যন্ত প্রকৃত ভালো যা-কিছু আঁকা হয়েছে, তা ওই খালি পেটেই হয়েছে। ভরতি পেটের যা কাজ, সেসব তুচ্ছ।

কথাবার্তা কিছু তরল পর্যায়ে নামিয়ে আনা চাই। ভিনসেন্ট বললে—কিন্তু, আপনি কিছু খালি পেটে এঁকেছেন বলে তো শুনিনি!

এটা আমার প্রতিভা ভায়া, আর অসাধারণ কল্পনাশক্তি। আগুনের মধ্যে হাত না দিয়েও দাহনের যন্ত্রণাকে অনুভব করতে আমি পারি।

বাজে কথা। ঠকানোর আর লোক পাননি?

বাজে নয়, বিলকুল সত্যি। আমি যদি জানতাম যে ডি বকের মতো নিষ্প্রাণ দোকানদারি ছবি আমি কেবল আঁকতে পারি, তবে কবে এসব ছেড়ে দূরে অন্য রাস্তায় হাঁটা দিতাম। বেদনার স্মৃতিকে বাদ দিয়ে বেদনার সম্পূর্ণ অনুভূতিকে আমি মুঠোর মধ্যে ধরতে পারি। এইজন্যেই তো আমি এত বড়ো আর্টিস্ট!

হ্যাঁ, আর এত বড়ো ঠগ। যাক, অনেক তো বক্তৃতা দিলেন উইসেনৱাক, এবার পঁচিশটি ফ্র্যাঙ্ক আমাকে ধার দিন।

পঁচিশটা সেন্টিমও নয়। শোনো ভিনসেন্ট, এর মধ্যে কোনো ঠকামি নেই। অকপটেই আমি বলছি, তোমার সম্বন্ধে অনেক উঁচু ধারণা আমার। টাকা ধার দিয়ে তাকে আমি খাটো করতে চাইনে। নিজের ভাগ্যের সঙ্গে নিজে যদি লড়াই করে যেতে পার, আমি বলছি একদিন তোমার শিল্পকাজ অটুট হয়ে উঠবে। মভের ডাস্টবিনে প্লাস্টারের সেই ভাঙা পাখানা দেখে এ-বিশ্বাস আমার আরও দৃঢ় হয়েছে। যাও, কাজ করোগে। পথে নঙরখানা পাবে, সেখান থেকে বিনে পয়সায় একবাটি ঝোল চুমুক দিয়ে খেয়ে নিয়ো।

কয়েক মুহূর্ত উইসেনব্রাকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ভিনসেন্ট যাবার জন্যে পিছু ফিরল। দরজায় হাত দিতেই সে ডাক শুনল—যেয়ো না, এক মিনিট দাঁড়াও।

কী হল? মুখ ফিরিয়ে কঠোর গলায় ভিনসেন্ট বললে—মনটা ভিজল নাকি? প্রতিজ্ঞার পাথরে কি ফাটল ধরল?

ভিনসেন্টের কাঁধে হাত রাখলেন উইসেনব্রাক—শোনো ভ্যান গক। আমি পাথর নই, কিন্তু আমার একটা প্রিন্সিপ্ল আছে। তোমাকে যদি আমি অযোগ্য লোক ভাবতাম, তাহলে হাতে-হাতে পঁচিশটা ফ্র্যাঙ্ক ঠেকিয়ে প্রথমেই তোমাকে বিদায় করতাম। কিন্তু তুমি তা নও, সহকর্মী বলেই আমি দিলাম না। কিন্তু তার বদলে এমনি জিনিস দিচ্ছি যা সারা পৃথিবীর সব টাকা দিয়েও কোথাও তুমি পাবে না। কেমন, নিতে রাজি? এ-জিনিস আমি মভ ছাড়া কাউকে কখনও দিতাম না। বেশ। এ-দিকে এসো। স্কাইলাইটের পর্দাটা সরিয়ে দাও। ব্যাস, এইবার ঠিক হয়েছে। এই স্টাডিটা ভালো করে দেখো তো? এইবার দেখো, কী করে এর থেকে ছবি ফুটিয়ে তুলতে হয়। দেখে যাও ভালো করে, চোখে নয় শুধু, মনের মধ্যে গেঁথে রাখো। আঃ, সরো না! আলোটাকে আড়াল করে দাঁড়ালে কাজ হবে কী করে? ঘণ্টা খানেক পরে ভিনসেন্ট পথে বার হল। মনে তার উচ্ছ্বল পরিপূর্তি। এই এক ঘণ্টায় সে যা শিখেছে, কোনো আর্ট স্কুলে এক বছরের তালিমেও তা শিখতে পারত না। লক্ষ্যহীন সে চলল। অনেকটা দূর যাবার পর হঠাৎ মনে হল—জঠর–জোড়া তার বুভুক্ষা, সারা শরীরে জ্বরের তাপ। আর সারা দুনিয়ার কোথাও একটি পয়সাও তার জন্যে জমা নেই।

কয়েক দিন পরে সমুদ্রতীরে মভের সঙ্গে দেখা

মভ ভাই, ভিনসেন্ট বললে—সে-দিন আপনার স্টুডিয়োতে আমি যে ব্যবহার করেছি, সেজন্যে আমি মর্মাহত হয়ে আছি। খুবই অন্যায় হয়েছিল আমার। –তবু আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন না? আসবেন না একবার আমার ওখানে?

সরাসরি মভ অস্বীকার করলেন—না কখনও না! তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই আর।

কেন মভ ভাই, আমার ওপর আপনার কোনো আস্থাই আর নেই?

না, বিন্দুমাত্রও নেই। তুমি অত্যন্ত ঘৃণ্য চরিত্রের লোক।

চমকে উঠল ভিনসেন্ট। বললে—কী অন্যায়! কী ঘৃণ্য কাজ আমি করেছি আমাকে বলুন। আমি নিজেকে শুধরোতে চেষ্টা করব।

তাতে আমার কোনো উৎসাহ নেই। তোমাকে আমি চিনিনে।

মভ মুখ ফেরালেন। পায়ে পায়ে ভিনসেন্ট সরে গেল তাঁর কাছ থেকে। খবরটা চাপা থাকবার নয়। ক্রিস্টিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাটা ছড়াল। ডি বকই তার প্রধান ঘোষক। একদিন মিষ্টিমুখে চতুর হাসি শানিয়ে নিয়ে সে ভিনসেন্টের স্টুডিয়োতে এল। ক্রিস্টিন তখন পোজ দিচ্ছে, ড্রয়িং করছে ভিনসেন্ট।

দামি কালো ওভারকোটটা চেয়ারে ফেলে লম্বা একটা সিগারেট ধরিয়ে সে খোশমেজাজি গলায় প্রশ্ন করল—হ্যাঁ, হে ভিনসেন্ট, তুমি নাকি একজন রক্ষিতা রেখেছ? টারস্টিগ, মভ, উইসেনব্রাক সবাই এ-কথা বলছে, বেদম খেপে আছে। ক্রিস্টিনের উপস্থিতির জন্যে সে বললে ইংরেজিতে। ভিনসেন্টও উত্তর দিল ইংরেজিতেই—

ও, তাই নাকি?

ব্যাপারটা একটু চেপেচুপে রাখতে হয় ভায়া! তোমার কোনো বুদ্ধি নেই। যাই হোক, জিনিসটি জোটালে কোথা থেকে? কোনো মডেল নাকি? আমি তো সবাইকে চিনি। কোনটি বলো তো?

ভিনসেন্টের চোখ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই ঘুরে গেল ক্রিস্টিনের দিকে। ডি বকের মুখ থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল, লাফিয়ে উঠল সে–

অ্যাঁ! ওই নাকি তোমার রক্ষিতা, ওই মাগিটা?

শান্ত গলায় ভিনসেন্ট বললে—কোনো রক্ষিতা আমি রাখিনি ডি বক। তবে কথা যদি উঠে থাকে, তা হয়তো এই মেয়েটিকে নিয়েই।

কপালে একবার জামার হাতাটা বুলিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ ডি বক ক্রিস্টিনকে দেখল। তারপর বিস্মিত কণ্ঠে বললে—ওটার সঙ্গে তুমি শোও কী করে বলো তো?

কেন? কেন এ-কথা বললে?

আরে ভায়া ও যে বাজারের মেয়েমানুষ, একেবারে সদর রাস্তার ঝুনো মাল। বুঝেছি; টারস্টিগ কী খেপেছে সাধে? আরে মেয়েমানুষ রাখবে তো অল্পবয়সী, দেখতেশুনতে ভালো এমনি শহরের কোনো মডেলকে রাখলেই তো পারতে। তার কি কোনো অভাব আছে নাকি?

আমি তোমাকে আগেই বলেছি ডি বক, মেয়েটি আমার রক্ষিতা নয়।

তাহলে, কে ও তোমার?

ও আমার স্ত্রী।

স্ত্রী! তোমার স্ত্রী?

হ্যাঁ, আমার বাগদত্তা। ওকে আমি বিয়ে করব।

কী সর্বনাশ! সচকিতে হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল ডি বকের। ক্রিস্টিনের দিকে একবার ভয় আর বিতৃষ্ণামিশ্রিত দৃষ্টি হেনে সে ছুটে বার হয়ে গেল ঘর থেকে। যাবার সময় কোটটা হাতে তুলে নিতেও ভুলে গেল।

ক্রিস্টিন বললে—তোমরা আমার সম্বন্ধে কী কথা বলছিলে?

ভিনসেন্ট পরিপূর্ণ চোখে ক্রিস্টিনকে দেখল কয়েক মুহূর্ত, তারপর বললে—ডি বককে আমি বলছিলাম সিয়েন, তোমাকে আমি বিয়ে করব।

বিয়ে করবে? আমাকে? সে কি গো?

হ্যাঁ সিয়েন। বিয়েই যদি না করব, তাহলে এত কাছে ডাকলাম কেন! গার্হস্থ্যজীবনের দুঃখ-সুখের অভিজ্ঞতা কেন এড়াব বলো? জানো ক্রিস্টিন, আর–একটি মেয়েকে আমি ভালোবেসেছিলাম। যখন আমি তার বাড়ি গেলাম, তার বাড়ির সবাই আমাকে দুরদুর করে হাঁকিয়ে দিল, শোনাল—সে নাকি আমাকে শুধু ঘৃণাই করে। জ্বলন্ত, জীবন্ত আমার প্রেম, তাকে ফিরিয়ে দিল, মেরে ফেলল ওরা সবাই। কিন্তু মৃত্যুর পরেও পুনর্জন্ম আছে। তুমিই আমার সেই পুনর্জন্ম, সিয়েন।

কিন্তু আমাকে বিয়ে কী করে করবে তুমি? আমার এতগুলো ছেলেপিলে! আর, তোমার ভাই যদি রাগ করে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়?

– তুমি মা হতে চলেছ ক্রিস্টিন! সে কি যে-সে কথা? তোমার কি যে-সে সম্মান! সেই সম্মানের দাম আমি দেব। হার্মান আর তোমার নবজাত শিশুকে আমার সঙ্গে রাখব। তোমার অন্য ছেলেমেয়েরা তোমার মা-র কাছে থাকবে। আর থিয়ো? হ্যাঁ, সে তো আমার মাথাটাই কাটতে পারে। তবে সব কথা বুঝিয়ে বললে হয়তো সে আমাকে ত্যাগ করবে না।

ক্রিস্টিনের পায়ের কাছে মাটিতে বসল ভিনসেন্ট। প্রথম যে-দিন দেখেছিল তারপর থেকে ওর চেহারা অনেক ভালো হয়েছে। করুণ ওর বাদামি চোখ দুটিতে সামান্য একটু আনন্দস্পর্শ। সারা দেহে-মনে নতুন কেমন এক দীপ্তির ইশারা। প্রথম যখন ওকে দেখে, ও ছিল কর্কশ, অভব্য, পথের মেয়ে। এখন কত ও বদলেছে, কত মধুর, কত নরম হয়ে গিয়েছে। এখনও ওর মুখভরতি গুটি গুটি কলঙ্কের দাগ; তবু কে বলবে মাধুর্যের স্পর্শ ও-মুখে লাগেনি?

সিয়েন! বলো, সংসার তুমি করবে না আমার সঙ্গে? নেবে না আমার দুঃখকে ভাগাভাগি করে? যতদিন না তুমি হাসপাতালে যাও ততদিন তোমাকে আমি দেখবই। ফিরে এসে তুমি আমাকে কেমন দেখবে জানিনে। হয়তো তখনও রুটি থাকবে, হয়তো থাকবে না। যাই থাকুক, তুমি, তোমার শিশু আর আমি তা-ই ভাগ করে নেব। রাজি আছ তো?

ক্রিস্টিন চেয়ার থেকে নেমে কাছে এসে বসল, গলা জড়িয়ে ধরল ভিনসেন্টের। বললে—তোমার কাছে আমাকে শুধু থাকতে দিয়ো, ভিনসেন্ট। তার বেশি কিছু চাইনে। পোড়া রুটি, কলের জল, তা-ই খাব। তাতেই আমার সুখ। তোমার আগে কোনো লোক আমাকে দেখেনি, হাত রাখেনি আমার পিঠে। বিয়ে আমাকে কোরো না। দরকার নেই বিয়েতে। যতক্ষণ পোজ করতে বলবে, যত শক্ত কাজ করতে বলবে সব আমি করব। শুধু তোমার কাছে আমাকে থাকতে দিয়ো। এইটুকুতেই হবে। এইটুকু আমার জীবনের মস্ত বড়ো শান্তি। এত সুখ, এত শান্তি কখনও পাইনি, কখনও পাব না কোথাও।

তুমি আমাকে ভালোবাস, না ক্রিস্টিন?

হ্যাঁ ভিনসেন্ট, ভালোবাসি।

ভালো লাগে, ভালোবাসা পেতে ভালো লাগে, দুনিয়ার যে যতই না খারাপ বলুক একে।

ভিনসেন্টের বুকে মাথা রেখে সহজ ভাষায় ক্রিস্টিন বললে—ঝাঁটা মারি তোমার দুনিয়ার মুখে!

মাটিতে বসে রইল দুজনে খুব কাছাকাছি। অন্ধকার নেমে এল, আশ্রয়ের মতো অন্ধকার। উনুনটা জ্বলছে। উত্তাপ আর লালচে আভা আদরের মতো যেন।

স্বপ্ন ভাঙল। ডাকপিয়ন দিয়ে গেল আমস্টার্ডামের একখানা চিঠি।

ভিনসেন্ট,

তোমার জঘন্য জীবনযাত্রার সংবাদ আমার কানে পৌঁছেছে। বাকি ছ-খানা ছবির অর্ডার আমি বাতিল করলাম। তোমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমার কোনো কৌতূহল এখন থেকে আর থাকবে না।

কর্নেলিয়াস ভ্যান গক

থিয়ো। থিয়োই একমাত্র ভরসা। ছবি শেখাতে ছিলেন মভ, তিনি গেছেন। ছবি বিক্রি করতে ছিলেন টারস্টিগ, তিনি মুখ ফিরিয়েছেন। পরিত্যাগ করুক আত্মীয়–স্বজন, ঘৃণা ভরে অবহেলা করুক বন্ধুর দল। সাধনা আছে, আর আছে পথ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া প্রণয়িনী ওই ক্রিস্টিন। কিন্তু থিয়ো না থাকলে তো চলবে না!

ভাইকে সে চিঠি লিখল সব কথা জানিয়ে, সব দুঃখ বুঝিয়ে, আকুল ভিক্ষা নিবেদন করে। তৃষ্ণার্ত বুক নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কবে উত্তর আসে।

উত্তর এল বই কী ভাইয়ের কাছ থেকে; পছন্দ করিনে, কিন্তু বাধা দেব না। তোমাকে বিশ্বাস করি, তাই তোমার পেছনে আছি, ভয় নেই, দেখা করব শীঘ্র।

.

ছ-মাস পরে লিডেন হাসপাতালে ক্রিস্টিনের প্রসব হল। বাচ্চাটি সুস্থদেহ, কিন্তু ফরসেপস দিয়ে তাকে পৃথিবীর আলোয় টেনে আনতে হল। প্রসবের অসহ্য যন্ত্রণা ক্রিস্টিন ভুলে গেল ভিনসেন্টকে দেখে। নীরক্ত বিবর্ণ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললে–শিগগিরই ভালো হয়ে যাব তোমার কাছে। আবার তুমি আমাকে আঁকবে, তাই না?

প্রসুতি আর নবজাতকের শয্যার সামনে দাঁড়িয়ে দু-চোখ বাষ্পাকুল হয়ে এল ভিনসেন্টের। হোক না ওই শিশু পিতৃপরিচয়হারা, ও তো তারই সন্তান, আর ওই নারী, ও তো তারই স্ত্রী। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল বেদনায় আর আনন্দে। চোখে জল, মুখে হাসি।

লিডেন থেকে ফিরে এসেই বাসাটা সে বদলাল। নতুন বাসাটা একই বাড়িওয়ালার, চার ফ্র্যাঙ্ক মাত্র বেশি ভাড়া। তবে এটার স্টুডিয়োর পাশেই ছোট্ট একটা বসবার ঘর, তা ছাড়া আরও একটা থাকবার ঘর; রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর আলাদা। দেয়ালে নতুন কাগজ লাগানো। অধীর আগ্রহে ঘর সাজাতে লাগল ভিনসেন্ট। ক-দিন পরেই ক্রিস্টিন আসবে। আর লুকোচুরি নয়, সংসার পাতবে দুজনে।

১০

নতুন বাড়িটা চমৎকার। স্টুডিয়োর দেয়ালটায় বাদামি রঙের কাগজ আঁটা, খটখটে কাঠের মেঝে। দেয়ালে কয়েকটা স্টাডি, দু-কোণে দুটো ইজেল, মাঝখানে কাজ করবার জন্যে বেশ বড়ো একটা টেবিল। দেয়ালের গায়ে আলমারি, তাতে ড্রয়িং বোর্ড, কাগজ বই তুলি রং আর-সব শিল্পীর দরকারি জিনিসের টুকিটাকি। বসার ঘরে একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার, একটা স্টোভ। জানলার ধারে ক্রিস্টিনের বসবার জন্যে বড়ো একটা বেতের চেয়ার আর ছোট্ট একটা দোলনা। দেয়ালের একদিকে রেমব্রাঁর আঁকা ছবি: শিশু ও দুই নারী। অন্যদিকে বড়ো একটা আয়না।

রান্নাঘরের জিনিসপত্র প্রয়োজনের বেশি একটিও নয়, যাতে করে ক্রিস্টিন রান্নার কাজটা দশ মিনিটে সেরে ফেলতে পারে। শোবার ঘরে দুটি বিছানা, একটি নিজেদের জন্যে আর একটি হার্মানের।

হাসপাতাল থেকে আসার দিন ডাক্তার, প্রধান নার্স, পরিচালিকারা সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে ক্রিস্টিনকে বিদায় দিল। এমনি ব্যবহার—মানুষ মানুষের সঙ্গে যেমনি সহানুভূতি আর সহযোগিতায় স্বাভাবিক ব্যবহার করে, তা ক্রিস্টিন আগে কখনও পায়নি। অভিভূত হয়ে পড়ল সে। ভিনসেন্ট মনে মনে বললে—দেখো, এতদিন পর্যন্ত কেউ ওকে ভালো চোখে দেখেনি। ও নিজে যে ভালো হবে, তার সুযোগ পেয়েছিল কোথায়?

ভিনসেন্ট আগে কিছু ভাঙেনি, নতুন বাড়ি দেখে হাঁ হয়ে গেল ক্রিস্টিন। চেয়ার, দোলনা, ছবি, আয়না, ফুলের টব—একবার এটা ধরে দেখে, একবার ওটার গায়ে হাত বুলোয়। নাচবে কি ছুটবে ভেবে পায় না। ভিনসেন্টের তাকে সংযত করা দায়।

ক্রিস্টিনের স্বাস্থ্য আস্তে আস্তে ফেরে। ভিনসেন্ট তাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। ঘর গোছানো, কাপড় কাচা, বিছানা পাতা, উনুন ধরানো, ভারী জিনিস তোলা পাড়া—এসব কাজ ভিনসেন্ট নিজের হাতে করে। মনে হয়, কতদিনকার তার এই সংসার, ক্রিস্টিন আর বাচ্চারা তার কতদিনকার আপনার!

শিল্পকর্মে নতুন উৎসাহ, বুকজোড়া নতুন শান্তি। নিজের ঘর, নিজের সংসার, স্ত্রীর স্পর্শ, ছেলেমেয়ের হাসিকান্না—এ না থাকলে জীবন? মানুষের নয়, জন্তুর জীবন। এরাই তাকে সাহস দিয়েছে, বল এনেছে প্রাণে। আর থিয়োর মতো ভাই যেন পেছনে আছে, তখন ভয়টা কীসের? সত্যিকারের শিল্পী হবার পথে বাধা কোথায়? থিয়ো লিখেছে চাকরিতে তার উন্নতি হয়েছে, একশোর বদলে দেড়শো করে ফ্র্যাঙ্ক এবার থেকে সে মাসে মাসে পাঠাবে।

বরিনেজে সে প্রাণ দিতে বসেছিল ঈশ্বরের জন্যে। সে-ঈশ্বর রূপহীন, রসহীন সে-ধর্ম। এবার থেকে নতুন ঈশ্বর, নতুন ধর্মের সন্ধান সে পাচ্ছে, যে-ধর্ম ধরা–ছোঁয়ার বাইরে নয়, রূপের মধ্যে যার প্রকাশ। পথের একটি শ্রমিক চাষি, মাঠের রেখাঙ্কিত বুকে উঁচু-নীচু সোনালি বালিয়াড়ির ছন্দ আর আকাশের উদার নীলিমা–ওরা এত সহজ কিন্তু এত শক্ত! রূপে-রেখায় ওরা ধরা দেয়, কিন্তু অধরা ওদের মর্মবাণী। এই মর্মচেতনাকে রং আর রেখার কাব্যে ছন্দায়িত করা, মানুষ আর প্রকৃতির প্রাণস্পন্দনকে একই হাতের মুঠোয় চেপে ধরা, এ কি সোজা? এ কি যে–সে সাধনা?

কিন্তু বাধা আসে, আঘাত আসে। একদিন স্টুডিয়োর সামনে টারস্টিগের সঙ্গে দেখা। বন্ধুর মতো সহজভাবে তিনি কথা বলতে লাগলেন। আশঙ্কায় ভিনসেন্টের মুখ শুকিয়ে উঠল, কিন্তু বাড়িতে না ডেকে উপায় নেই।

বসবার ঘরে ক্রিস্টিন শিশুটিকে বুকে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছে। হার্মান খেলা করছে মেঝেতে স্টোভের কাছে। টারস্টিগ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন তাদের দিকে। নির্বাক বিস্ময় বুঝি আর ভাঙেই না।

অনেকক্ষণ পরে বললেন—ইংরেজি ভাষায়—এই স্ত্রীলোক আর শিশু, এরা কারা? এসবের মানে কী?

ও ক্রিস্টিন, আমার স্ত্রী। বাচ্চাটি আমাদের।

মানে, তাহলে তুমি বিয়ে করেছ?

বিয়ে বলতে যে-অনুষ্ঠানটির কথা আপনি চিন্তা করছেন, সেটি অবশ্য এখনও করে উঠতে পারিনি।

কিন্তু তাহলে তুমি এভাবে একজন অনাত্মীয়া মেয়েছেলে আর তার ছেলেপিলেদের নিয়ে বসবাস কর কী করে?

সাধারণত পুরুষমানুষে বিয়েই করে আর শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা স্বাভাবিকই হয়ে যায়, তা-ই না মিনহার?

কিন্তু বিয়ে তুমি করবে কী করে? তোমার পয়সা কোথায়? তোমার ভাই তো তোমাকে রেখেছে!

আপনার ভুল ধারণা। থিয়োর হয়ে আমি কাজ করি। তার জন্যে মাইনে আমি পাই তার কাছ থেকে। আর যা-কিছু কাজ আমি করি সব তার। এ থেকে তার সব টাকা একদিন উশুল হয়ে আসবে।

পাগল তুমি, বদ্ধ পাগল! মাথা খারাপ না হলে এমনি কথা কেউ বলে না। মানুষের ব্যবহার, মিনহার—গম্ভীর চালে ভিনসেন্ট বললে—অনেকটা ঠিক ড্রয়িংয়েরই মতো। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে তার নতুন নতুন রূপ খোলে। জিনিসটা একই, তবে কিনা তফাত হচ্ছে একজনের দেখায় আর অন্য একজনের দেখায়।

অসহ্য হয়ে গায়ে বিধছে ভিনসেন্টের ব্যবহার, তার এই ধরনের কথা। টারস্টিগ আর সামলাতে পারলেন না, বলে উঠলেন—তোমার বাবাকে আমি লিখব ভিনসেন্ট, সব কথা আমি তাঁকে লিখে জানাব।

তা যা ভালো বোঝেন তা তো আপনি করবেনই। তবে কিনা, ধরুন আপনি খুব গরম গরম ভাষায় আমার বিরূদ্ধে অনেক কথা তাদের লিখলেন, আর তার পরেই আমি আবার তাঁদের আমাদের বাড়িতে আসতে নেমন্তন্ন করে চিঠি লিখলাম। দুটো ঘটনা একসঙ্গে জড়িয়ে বেশ একটা মজার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কী বলেন?

তুমি নিজে তাঁদের আসতে লিখবে?

বাঃ, সে আবার বলতে? তবে কিনা, বাবা এখন ইটেন থেকে নিউনেনে বদলি হওয়ার ব্যাপারে খুব ব্যস্ত, আর এ-দিকে আমার স্ত্রীরও শরীর খুব খারাপ, তাই যা ক-দিনের অপেক্ষা।

তাহলে আমি আর কিছু লিখব না। আমার মনে হয় তুমি নিজের হাতে গলায় পাথর বেঁধে জলে ডুবতে যাচ্ছ। তোমাকে সাবধান করে দেওয়া আমি মনে করেছিলাম আমার কর্তব্য।

আপনার উদ্দেশ্য যে সাধু তাতে আমার সন্দেহ নেই, মিনহার টারস্টিগ। সেইজন্যে আপনার কথাবার্তায় আমি চটছিনে। কিন্তু এ-প্রসঙ্গ আমার আর প্রীতিকর বলে মনে হচ্ছে না।

কেমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা মন নিয়ে টারস্টিগ বিদায় নিলেন।

.

অসার দম্ভের চাতুরী দিয়ে প্রথম আঘাতটাকে ঠেকানো গেল। কিন্তু দ্বিতীয় আঘাতকে নয়। সে-আঘাত অপ্রত্যাশিতভাবে এল উইসেনব্রাকের কাছ থেকে। খেয়ালমতো ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি ভিনসেন্টের বাড়িতে এসে পৌঁছোলেন। হাঁক ছেড়ে বললেন—কী হে, এখনও বেঁচে আছ? বাঃ বাঃ, দিব্যি তোফায় আছ দেখছি, অ্যাঁ? তাহলে সে-দিন টাকাটা আমার কাছ থেকে আদায় করতে না পারলেও মরনি দেখছি!

না, দেখতেই তো পাচ্ছেন, মরিনি।

ভালোই করেছিলাম তাহলে না দিয়ে?

বেশ করেছিলেন। এবার একটা কথা বলব? দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে ভিনসেন্ট বললে—উচ্ছন্নে যান, নরকে যান, বার হয়ে যান এখান থেকে।

বাঃ বাঃ, চমৎকার! এই তো চাই! এমনি মেজাজটা যদি শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে পার, তাহলে কালে আর-একটা উইসেনব্রাক তুমি হবে। এবার আমার একটা কথা শোনো। তোমার বাড়িতে এলাম, আর তোমার ওই ফার্স্ট ক্লাস রক্ষিতাটির সঙ্গে আমার একটু আলাপও করিয়ে দিলে না! এ কেমন ভদ্রতা হে?

আমাকে যা বলবার তা বলুন উইসেনব্রাক, কিন্তু ওর সম্বন্ধে একটি কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবেন না। ভালো হবে না তাহলে!

মাথা নীচু করে শিশুকে দোল দিচ্ছিল ক্রিস্টিন। বুঝল, তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করছে আগন্তুক। মুখ তুলে ব্যথিত চোখ মেলে তাকাল। ভিনসেন্ট দু-পা পিছিয়ে দাঁড়াল ওই নারী আর শিশুর সামনে, সারা দুনিয়ার অপমানের মার থেকে সে ওদের রক্ষা করতে চায়।

উইসেনব্রাক চেয়ে রইলেন তাদের দিকে, তারপর চোখ গেল দোলনার ঠিক ওপরে দেয়ালে রেমব্রাঁর ছবিটার ওপর।

দি আইডিয়া! চিৎকার করে উঠলেন তিনি—কী চমৎকার দৃশ্য, ছবির কী অপূর্ব উপকরণ, আহা, পবিত্র পরিবার!

সগর্জনে একটা গালাগাল উচ্চারণ করে তেড়ে গেল ভিনসেন্ট। উইসেনব্রাক চট করে নেমে গেলেন ‘রাস্তায় হাতের মুঠো এড়িয়ে।

ফিরে এল ভিনসেন্ট মা আর সন্তানের কাছে। চোখ তুলতেই সামনের আরশিতে দেখল নিজেদের। এক লহমার নিষ্করুণ ভয়ংকর স্পষ্টতায় উইসেনব্রাকের চোখ দিয়ে নিজেদের সে দেখল। এক শিশু, এক নারী আর এক পুরুষ—জারজ, বেশ্যা আর পরান্নভোজী ভিক্ষুক।

কানে এল ক্রিস্টিনের গলা—ও-লোকটা কী আমাদের বলে গেল?

পবিত্র পরিবার।

তার মানে?

ছবি একটা—মেরি, যিশু আর জোসেফের ছবি!

হু-হু করে জল ছুটে নামল ক্রিস্টিনের দু-চোখ বেয়ে। শিশুর কাপড়চোপড়ের মধ্যে সে মুখ লুকোল। ভিনসেন্ট দোলনার ধারে হাঁটু গেড়ে মাথা নীচু করে বসল। উত্তরের জানলা দিয়ে প্রদোষান্ধকার যেন পাখা মেলে ঘরে এসে ঢুকছে। কোণে কোণে ছায়া কালো কালো। মাথা তুলে আর-একবার ভিনসেন্ট তাকাল আরশিটার দিকে। আবার সে তাকিয়ে দেখল দর্পণের ওই তিনটি মূর্তিকে। এবার সে দেখল নিজের গভীর মর্মচক্ষু মেলে।

ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল ক্রিস্টিনের মাথায়। জটা জটা রুক্ষ চুলে জড়িয়ে গেল আঙুলগুলো।

কেঁদো না, আর কেঁদো না সিয়েন। মুখ তোলো, চোখের জল মোছো, মাথা উঁচু করে দাঁড়াও। উইসেনব্রাক মিথ্যে তো বলেননি!

.

মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়েস, কিন্তু এরই মধ্যে শিল্পব্যবসায়ী হিসেবে বেশ নাম করেছে থিয়ো। গুপিলসের তরুণ কর্মচারীদের মধ্যে তার জুড়ি খুব কম। প্যারিস থেকে প্রায়ই এখানে ওখানে তাকে যেতে হয়। কিন্তু গুপিল কোম্পানি তাদের প্যারিসের ব্যাবসাটা ভ্যালাডনকে বিক্রি করে দিয়েছে। নতুন মালিকের ব্যাবসার নাম লে মেসিয়ুর্স। থিয়ো তার পুরোনো চাকরিতেই বহাল আছে, কিন্তু কাকাদের যুগে ব্যাবসার যে-নীতি ছিল, তার বদল হয়েছে অনেক। ছবির এখন কদর নেই, আছে ছবির দামের কদর। যেসব শিল্পী নামজাদা শুধু তাদেরই এখন খাতির। নতুন শিল্পীকে আবিষ্কার করা, তাকে উৎসাহ দেওয়া—এ-নীতি বরবাদ। মানে, মনে, পিসারো, সিসলি, রেনোয়াঁ, ডেগাস, সিজান প্রভৃতি নতুন শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গি বৈপ্লবিক। তাদের তুলিতে নতুন বাণী, নতুন বলিষ্ঠতা। কিন্তু লে মেসিয়ুর্সের সিংহদ্বার তাদের জন্যে খোলা নয়। থিয়ো দিনের পর দিন অনেক অনুরোধ উপরোধ করেছে কর্তাদের। তাঁরা বধির। তাঁদের ধারণা এসব শিল্পী অশিক্ষিত, উন্মাদ, আর থিয়োর মতে এরাই আসন্ন যুগের পথপ্রদর্শক। কিন্তু থিয়ো তো কর্মচারী মাত্র, তার স্বাধীনতা কোথায়?

হেগ শহরে থিয়ো এল, সোজা গেল ভিনসেন্টের বাড়ি। ক্রিস্টিন ওপরতলায় শোবার ঘরে, নীচে স্টুডিয়োতে বসল দুই ভাই। প্রাথমিক সম্ভাষণের পালা শেষ হবার পর থিয়ো সোজাসুজি বললে—একটা কাজের সুযোগ নিয়ে এখানে আমি এসেছি। জরুরি দরকার কিন্তু আমার তোমার সঙ্গেই। এই যে-মেয়েটির কথা লিখেছ তার সঙ্গে কোনোরকম পাকাপাকি সম্পর্ক করা এখন তোমার চলবে না। তার আগে মেয়েটি কেমন জানতে চাই।

ভিনসেন্টও তেমনি সোজাসুজি উত্তর দিল—জুড়েয়ার্টের আমাদের বুড়ি নার্স লিন ভারমানকে মনে আছে?

আছে।

আমার ক্রিস্টিনও ঠিক সেইরকম, থিয়ো। নিতান্ত সাধারণ নারী, কিন্তু সেই সাধারণই আমার চোখে মহীয়সী। এমনি সাধারণ মেয়েকে যে ভালোবেসে ভালোবাসার প্রতিদান পায়, জীবনের শত দুঃখের কালোতেও তার মনের খুশির আলো নেভে না। এ ভালোবাসার জন্যে আমি খুঁজে মরিনি, এ নিজেই আমার কাছে ধরা দিয়েছে। ক্রিস্টিন এমনি মেয়ে যে আমার সমস্ত দৈন্য বেদনাকে আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে। তা ছাড়া ও-ই আমার মডেল। কে-র ভালোবাসা পাইনি বলে এখন আর কষ্ট নেই। মনে হয় কে-কে বিয়ে করিনি ভালোই হয়েছে। ক্রিস্টিন থাকলে শিল্পী হবার পথে বাধা আসবে না, সুবিধে হবে অনেক।

ঘরের মধ্যে কয়েক বার পায়চারি করার পর একটা জলরঙের ছবি অনেকক্ষণ ধরে থিয়ো দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ বললে—একটা কথা আমি বুঝিনে, যে-লোক ক-দিন আগে কে-র জন্যে পাগল ছিল, সে আজ এমনি একটা মেয়েকে কী করে ভালোবাসতে পারে!

এ-ভালোবাসায় আমি ঝাঁপিয়ে পড়িনি থিয়ো, এ এসেছে আস্তে আস্তে নিঃশব্দ পায়ে। কে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তা-ই বলে কি প্রাণের সব আলো নিভিয়ে অন্ধকারে আমি বসে থাকব? এই যে স্টুডিয়োতে তুমি পা দিয়েছ প্রথম থিয়ো, এটা মৃতের কবর নয়, জীবন্তের সংসার। আমি আঁকি। কী আঁকব, কেমন করে আঁকব যদি জীবনের স্পন্দনকে এড়িয়ে থাকতে চাই চিরজীবন? বলতে পার, খুব নীচু ঘরের মেয়েকে সঙ্গিনী করেছি। কিন্তু তাতে আমি নিজে যে নীচু হয়ে গেছি, ছোটো হয়ে গেছি, তা আমি বিশ্বাসই করিনে। সাধারণ মানুষ, মাটির সঙ্গে নিকট-সম্পর্ক যাদের তারাই আমার শিল্পের উপজীব্য, সত্যিকারের ছবি আছে তাদেরই জীবনে। কেননা তাদের আনন্দ-বেদনায় ছলনা নেই। যে নীচুতলার লোক নিয়ে আমার শিল্পের কারবার, সেই নীচুতলার মেয়েকেই তো আমার জীবনের কারবারে চাই!

এ নিয়ে ‘আমার কোনো তর্ক নেই, ভিনসেন্টের কথা থামিয়ে বলে উঠল থিয়ো—কিন্তু তা-ই বলে একেবারে বিয়ে করতে হবে কেন?

তার কারণ, ওর আর আমার মধ্যে বিয়ের একটা অঙ্গীকার রয়েছে। ও আমার রক্ষিতা নয়, ও আমার দু-দিনের ভোগে লাগার মেয়েমানুষও নয়। তার চেয়ে অনেক বেশি, তার চেয়ে অনেক কাছাকাছি।

কিন্তু আমি তোমাকে চট করে বিয়ে করতে বারণই করব।

নিশ্চয়ই থিয়ো, তোমার কথা মানব বই কী। যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়াই, ততদিন বিয়ে করব কী করে? যেদিন শ দেড়েক ফ্র্যাঙ্ক নিজের ছবি বেচে উপায় করতে পারব, আস্তে আস্তে আমার পেছনে তোমার খরচ করাটা বন্ধ হবে, তখন উঠবে বিয়ের কথা। তার আগে নয়।

এই হচ্ছে খাঁটি বুদ্ধিমানের কথা।

পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। ভিনসেন্ট বললে—ওই ক্রিস্টিন আসছে! লক্ষ্মীটি থিয়ো, সমালোচকের কঠোর চোখ মেলে ওকে দেখো না। ও স্ত্রী, ও মা—দেখো সত্যি ও তা-ই কি না।

স্টুডিয়োর দরজায় এল ক্রিস্টিন। পরনে কালো রঙের পরিচ্ছন্ন একটি পোশাক, চুলগুলি পরিপাটি করে আঁচড়ানো, গালে সামান্য একটু রঙের আভাস, তাতে ব্রণচিহ্নগুলো অনেকটা ঢাকা পড়েছে। কেমন সহজ সাদামাটা ঘরোয়া সৌন্দর্য তাকে ঘিরে। ভিনসেন্টের ভালোবাসায় তার চেহারায় এসেছে নতুন কমনীয়তা, মনে আত্মবিশ্বাসের নব উন্মেষ। এগিয়ে এসে সে সহজভাবে থিয়োর করমর্দন করল, শান্ত গলায় প্রশ্ন করল চা খাবে কি না, জানাল রাত্রে খাবার নিমন্ত্রণ। তারপর জানলার ধারে বেতের চেয়ারে সে সেলাই নিয়ে বসল, মাঝে মাঝে দোলা দিতে লাগল শিশুর দোলনায়। ভিনসেন্ট দেরাজ থেকে টেনে বার করে থিয়োকে দেখাতে লাগল তার আঁকা ছবির পর ছবি, স্কেচের পর স্কেচ। থিয়োর দৃঢ় বিশ্বাস যে একদিন ভিনসেন্টের শিল্পসাধনা সার্থক হবেই। ছবির সমালোচক হিসেবে দৃষ্টিও তার খুব কাঁচা নয়। কিন্তু ভিনসেন্টের সমস্ত কাজ দেখেও সে কোনো একটা সুনির্দিষ্ট ধারণায় পৌঁছোতে পারল না। এ-দিকে ভিনসেন্টের বাসনা—জলরং তো অনেক হল, এবার তেলরং নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে।

সব ছবি দেখার পর থিয়ো বললে—তেলরঙের কাজই যদি করতে চাও তো দেরি করছ কেন? শুরু করে দাও।

বুঝতেই যে পারছিনে ড্রয়িং আমার কেমন হচ্ছে। টারস্টিগ আর মভ বলছেন আমি কিছুই জানিনে।

—আর উইসেনব্রাক বলছেন তুমি খুব জান, এই নিয়ে ধাঁধায় পড়েছ তো? নিজের কাজের বিচার তোমায় নিজেকেই করতে হবে। আত্মবিশ্বাস যদি থাকে তাহলে ঝুলে পড়ো।

কিন্তু থিয়ো, খরচটার কথা ভেবেছ? এক-একটা তেলরঙের টিউবের তো সোনার দাম!

থিয়ো বললে—কাল সকাল দশটায় আমার হোটেলে এসো। তারপর দেখা যাবে। আসল কথা, যত শিগগির তেলরঙের ক্যানভাস আমাকে পাঠাবে, তত শিগগিরই তোমার পেছনে ব্যয়ের টাকা আমি উশুল করতে পারব। সেটা খেয়াল আছে?

রাত্রে খাবার সময় প্রাণ খুলে আলাপ করল থিয়ো আর ক্রিস্টিন। যাবার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভিনসেন্টের দিকে ফিরে থিয়ো বললে—বেশ ভালো, বেশ চমৎকার মেয়ে! আমার ধারণাই ছিল না।

পরদিন সকাল বেলা ভাগেনস্ট্রাটের রাস্তায় দুই ভাইয়ের চেহারার বিচিত্র বৈসাদৃশ্য। ছোটোভাইয়ের কড়া ইস্ত্রি-করা পোশাক, চকচকে পালিশ-করা কালো জুতো, মাথায় স্টাইল করে বসানো কালো সিল্কের টুপি। নধর গালের ওপর চমৎকার করে ছাঁটা দাড়ি, প্রতিটি পদক্ষেপে গভীর আত্মচেতনার ভঙ্গিমা। মূর্তিমান আভিজাত্য। আর বড়োভাইয়ের পায়ে ছেঁড়া বুট, তালি-মারা ট্রাউজার্স আর রংচটা কোট, মাথায় একটা চাষির টুপি। মুখভরতি জটা-জটা লালচে দাড়ির রাশ, আর কদম কদম পা ফেলে চলায় উত্তেজিত আতিশয্য।

থিয়ো ভিনসেন্টকে নিয়ে গুপিলের দোকানে গেল তেলরং তুলি বুরুশ আর ক্যানভাস কেনবার জন্যে। টারস্টিগ খাতির করতেন থিয়োকে, বুঝতে চাইতেন ভিনসেন্টকে। তিনি নিজের হাতে ভিনসেন্টের জন্যে জিনিসপত্র দেখেশুনে পছন্দ করে দিলেন।

সমুদ্রতীর ধরে বেড়াতে বেড়াতে থিয়ো আর ভিনসেন্ট পৌঁছোল শেভেনিনজেনে। মনুমেন্টের পাশেই ছোট্ট একটা কাঠের গুমটি, সেখানে একটা লোক বসে আছে। মাছের একটা নৌকো তীরে এসে লাগছে। নৌকোটা কাছাকাছি আসতেই গুমটির লোকটা একটা পতাকা হাতে এসে দাঁড়াল। হাত উঁচু করে কয়েক বার পতাকাটা নাড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মেয়ে-পুরুষ আর বাচ্চার পাল ভিড় করে এল বালির ওপর। এদের মধ্যে একজন লোক আবার ঘোড়ার পিঠে। নৌকো এসে তীরে লেগেছে। নোঙর বাঁধা হচ্ছে, শিশুরা নাচছে, রুমাল উড়িয়ে চিৎকার করছে মেয়েরা, পুরুষরা মাঝিদের কাঁধে করে তীরে নামাচ্ছে, রশি বেঁধে নৌকোকে তুলছে বালির ওপর, উজাড় করছে মালপত্র।

দু-দিক থেকে দীর্ঘ দুই বালিয়াড়ি উত্তর সমুদ্রের মধ্যে যেন হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই প্রশস্ত বাহুর মাঝখানে আশ্রয় নিয়েছে শেভেনিনজেন। মাঝিদের গ্রাম। সোনালি বালুকাতীর। বালির ওপর ওলটানো নৌকোর পর নৌকো, খুঁটিতে লটকানো জালের পর জাল। নীল রঙের ঘোড়ার গাড়ির বাক্স, লাল তাদের চাকা, তীর থেকে গ্রামের মধ্যে মাছ চালান করবার জন্যে। তীরের কাছাকাছি সমুদ্রের রং ধূসর, ঢেউয়ের মাথায় মাথায় সাদা ফেনা, তার ও-পারে গাঢ় সবুজ রং কখন গিয়ে দিগন্তব্যাপী নীলিমায় আশ্রয় নিয়েছে। সূর্য যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন স্লেট রঙের আকাশে নীলের স্পর্শ লাগে, তার গায়ে উড়ন্ত সাদা মেঘের বিচিত্র লীলা।

নৌকো থেকে সবাই যখন তীরে নামল, তখন যেন শোভাযাত্রা শুরু হল। গ্রামের দিকে। দল বেঁধে মার্চ করতে করতে সবাই বালিয়াড়ির একটা উঁচু খাড়াই পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ও-পারে। সকলের সামনে সেই ঘোড়ায়-চড়া লোকটা, আকাশে উঁচিয়ে ধরা পতাকাটা নিয়ে।

ভিনসেন্ট বললে—রং দিয়ে এমনি ছবিকে যদি ক্যানভাসে ধরতে পারতাম! : থিয়ো বললে—নিজের কাজে নিজের বিশ্বাস যখনই আসবে, তারপর আর একমুহূর্তও দেরি কোরো না। বড়ো ক্যানভাস ধরো, তেলরং লাগাও। আর ছবি পাঠিয়ে দাও প্যারিসে আমার কাছে। বিক্রি করার ভার আমার।

ভিনসেন্ট বললে—পাঠাবো থিয়ো, নিশ্চয়ই, কিন্তু সত্যি, বিক্রি তোমাকে করতেই হবে আমার কাজ।

১১

থিয়ো চলে যাবার পর ভিনসেন্ট তেলরং নিয়ে পরীক্ষা শুরু করল। তেলরঙের তিনটি ছবি সে আঁকল। প্রথমটি গিস্ট ব্রিজের পেছনে উইলো গাছের সারি, দ্বিতীয়টি একটি মেঠোপথ, তৃতীয়টিতে নীল পোশাক পরা একটা লোকের খেতে আলু কুড়োবার দৃশ্য। নিজের কাজ দেখে নিজেরই বুক ফুলে উঠল। নির্ভুল ড্রয়িং, চমৎকার রং চড়ানো, কাঁচা হাতের প্রথম কাজ বলে কেউ ধরতেই পারবে না। আশ্চর্য লাগল নিজেরই, এতটা সাফল্য সে নিজেই কখনও কল্পনা করতে পারেনি আগে।

একদিন সন্ধে বেলা উইসেনব্রাক এলেন—অনেক কাজ করেছ, চলো আমার সঙ্গে। একটু নাচগান দেখে আসি, মাথাটা ঠান্ডা হবে তোমার।

আড়ষ্ট গলায় ভিনসেন্ট বললে—ধন্যবাদ। তবে মাফ করবেন, সন্ধে বেলা স্ত্রীকে ছেড়ে যেতে আমার ইচ্ছে নেই।

আগের দিন উইসেনব্রাক এদের কী কথা বলে গেছেন তা তাঁর স্মরণেই নেই। তিনি এগিয়ে এসে ক্রিস্টিনের হস্তচুম্বন করলেন, তার স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞাসা করলেন, খুশি মনে বাচ্চাটিকে আদর করলেন কয়েক বার।

তারপর বললেন—কই, তোমার নতুন স্কেচ কয়েকটা দেখাও।

ভিনসেন্টের মনটাও খুশি হল। আগ্রহভরে সে স্কেচের তাড়া বার করল। চারটি স্কেচ পছন্দ করলেন উইসেনব্রাক। বাজারের ছবি একটি, আর একটিতে সুপ কিচেনের সামনের জনতার ভিড়। তৃতীয়টি পাগলাগারদের তিনটি লোকের স্টাডি। চতুর্থটি শেভেনিনজেনের সমুদ্রবেলায় মাছ ধরবার নৌকোর দৃশ্য।

এগুলো কি বিক্রির জন্যে নাকি? তাহলে এ-কটা আমি কিনতাম।

ভিনসেন্ট বললে—এও কি আপনার আর-একটা পুরোনো ঠাট্টা নাকি?

ছবি নিয়ে আমি কখনও ঠাট্টা করিনে। অপূর্ব হয়েছে স্টাডিগুলো! বলো, কত দাম?

ভিনসেন্ট ভাবল, আসল ঠাট্টাটা বোধ হয় এইবার এল বলে। ভয়ে ভয়ে সে বললে—আপনিই বলুন কত দেবেন?

ধরো এক-একটা পাঁচ ফ্র্যাঙ্ক করে? সবসুদ্ধ কুড়ি?

দু-চোখ বড়ো হয়ে গেল ভিনসেন্টের—পাঁচ ফ্র্যাঙ্ক করে? এ যে অনেক দাম! আমার কাকা কর্নেলিয়াসের কাছ থেকেই পেয়েছি আড়াই ফ্র্যাঙ্ক করে এমনি এক-একটার জন্যে।

ঠকিয়েছে তোমাকে। সব ব্যাবসাদারই ঠকায়। এ এমন নতুন নয়। সেই ছবিই হয়তো একদিন পাঁচ হাজার ফ্র্যাঙ্কে বিক্রি হবে। যাই হোক, রাজি তো?

উইসেনব্রাক, আপনাকে চেনা দায়। কখনও আপনি নরপিশাচ, কখনও দেবদূত!

ওই তো মজা! একইরকম হলে যে বন্ধুবান্ধবের কাছে পুরোনো হয়ে যেতাম। মানিব্যাগ থেকে কুড়ি ফ্র্যাঙ্ক বার করে ভিনসেন্টের হাতে দিয়ে ছবি-কটা বগলদাবা করলেন উইসেনব্রাক, তারপর বললেন—নাও, এসো এবার, লক্ষ্মীছেলের মতো পথে বার হও তো আমার সঙ্গে।

ক্রিস্টিনের সম্বন্ধে যতটা সম্ভব সব কথা জানিয়ে ভিনসেন্ট চিঠি লিখল, বাবাকে, সঙ্গে উইসেনব্রাকের দেওয়া কুড়ি ফ্র্যাঙ্ক পাঠিয়ে তাঁকে নিমন্ত্রণ করল হেগ-এ আসতে। এক সপ্তাহ পরে থিয়োডোরাস এলেন।

তাঁর মাথার চুল পেকেছে, চোখের নীল রঙে ধূসরতার ছাপ, চলাফেরায় সে দৃঢ়তা নেই। শেষবার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেই ভিনসেন্ট বাড়ি ছেড়েছিল, তবে এক বছরে চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে দুজনের মধ্যেকার তিক্ততা ঘুচেছে, কর্নেলিয়াও মাঝে মাঝে ছেলের জন্যে দু-একটা জামাকাপড়, টুকিটাকি জিনিসপত্র, ঘরে তৈরি খাবার প্রভৃতি পাঠিয়েছেন। ক্রিস্টিনকে বাবা কী চোখে দেখবেন এ ভয় ভিনসেন্টের ছিল। আশা ছিল শুধু ক্রিস্টিনের ওই শিশুটির জন্যে। শিশুটির মুখের দিকে চেয়ে তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবা নিশ্চয় ক্রিস্টিনের অতীত জীবনকে ক্ষমা করে নিতে পারবেন।

থিয়োডোরাসের হাতে মস্ত একটা বান্ডিল। বাবার হাত থেকে বান্ডিলটা নিয়ে, ভিনসেন্ট খুলে দেখল তার মধ্যে একটি মেয়েদের গরম কোট, ক্রিস্টিনের জন্যে। দেখে আশঙ্কা তার কমল।

ক্রিস্টিন ওপরে যাবার পর স্টুডিয়োতে বসে থিয়োডোরাস ভিনসেন্টকে বললেন—একটা কথা তুমি আমাকে চিঠিতে জানাওনি। ছেলেটি কি তোমার? ভিনসেন্ট বললে—না, ক্রিস্টিনের সঙ্গে যখন আমার আলাপ হয়, তখনই ও গর্ভবতী ছিল।

যার সন্তান সে কোথায় তবে?

ক্রিস্টিনের সন্তানধারণের কারণটা সে স্পষ্ট করে বাবার কাছে বলতে চাইল না। শুধু উত্তর দিল—সে ওকে পরিত্যাগ করে গেছে।

কিন্তু তুমি ওকে বিয়ে করবে, তা-ই তো? এভাবে বসবাস করাটা উচিত নয়।

নিশ্চয়ই বাবা। যত শীঘ্র পারি বিয়েটা করে ফেলব। এ নিয়ে থিয়োর সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। ছবি বেচে মাসে দেড়শো ফ্র্যাঙ্কের মতো উপার্জন যেই হবে, তখুনি বিয়ে করে ফেলব।

হ্যাঁ, তাই ভালো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা ঘুরিয়ে নিলেন থিয়োডোরাস—তোমার মা আর আমি দুজনেই খুব খুশি হতাম ভিনসেন্ট, যদি ক-দিনের জন্যে তুমি আমাদের ওখানে আসতে। নিউনেন তোমার খুব ভালো লাগবে। সারা ব্রাবান্টে এমনি সুন্দর গ্রাম দুটি নেই। ছোটো একটি গির্জে, ঠিক যেন এস্কিমোদের ইগলুর মতো দেখতে, শ খানেক লোকের মতো। আমার বাড়িটাও চমৎকার, চারিদিকে হর্থনের বেড়া ঘেরা। গির্জের ঠিক পেছনে ফুলে ফুলে ছাওয়া গোরস্থান, পুরোনো সমাধির মাথায় মাথায় কাঠের মতো ক্রস।

ক্রস? সাদা রঙের?

হ্যাঁ, আর তার লেখাগুলো কালো, তাও বৃষ্টিতে ধুয়ে সাদা হয়ে আসছে।

কিন্তু বাবা, গির্জেটার বেশ উঁচু চুড়ো আছে তো?

নিশ্চয়ই! প্রাচীন গির্জের প্রাচীন চুড়ো, তবে একেবারে আকাশে গিয়ে ছুঁয়েছে।

জ্বলজ্বল করছে ভিনসেন্টের চোখ। বললে—, গির্জার ওই চুড়োটার ছায়া তাহলে নিশ্চয়ই লম্বা হয়ে পড়ে সমাধিক্ষেত্রের ওপর? তাই না? বাঃ, ঠিক অমনি একটি দৃশ্য আমার আঁকতে বড়ো ইচ্ছে!

বেশ তো। তা ছাড়া গ্রামের ধারেই পাইন বন আর শস্যের খেত। চলো না তুমি শীঘ্র একবার।

ঠিক বাবা, আমি যাবই। সমাধিক্ষেত্রের ছোটো ছোটো ক্রস, গির্জের চুড়ো, মাঠের চাষি—সত্যি, যেখানেই থাকি না কেন, ব্রাবান্ট আমাকে সবসময় টানে।

.

থিয়োডোরাস ফিরে গিয়ে স্ত্রীকে প্রবোধ দিলেন, ছেলের ব্যাপারে যতটা কেলেঙ্কারি তিনি ভেবেছিলেন তার কিছুই আসলে নয়। ভিনসেন্টও নতুন উদ্দীপনায় ছবির কার্জে লেগে গেল। থিয়ো তাকে বিশ্বাস করেছে, বাবা মা চটেননি, আর এখানে হেগ-এ আর কেউ তাকে বিরক্ত করতে আসছে না। নিশ্চিন্ত মনে ডুবে গেল সে কাজে।

বাড়ির নীচে একটা কাঠগুদাম। সেখানে অনেক শ্রমিক কাজের খোঁজে আসে। যারা কাজ পায় না, গুদামের মালিক তাদের ভিনসেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেন। তারা হয় ভিনসেন্টের মডেল। পকেট থেকে পয়সা যায়, কিন্তু স্কেচের পোর্টফোলিয়ো ভরে ওঠে। দোলনার বাচ্চাটিকেও আঁকে বারে বারে। বাইরে বাইরে ঘুরে দৃশ্য আঁকারও বিরাম নেই। তেলরং অভ্যাস হয়ে আসছে, আপন প্রেরণায় রঙের ওপর রং চড়ানোর আন্তররহস্য সে আবিষ্কার করছে দিনে দিনে।

দুঃখ তাকে টানে। মানুষই আঁকুক আর প্রকৃতিই আঁকুক, তার মধ্যেকার অন্তগূঢ় দুঃখটিকে সে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে, যে-দুঃখবোধ ভাবালুতায় ভরা সামান্য দুঃখবোধের অনেক ঊর্ধ্বে। মনে মনে বলে—আমি যা আঁকব, তা যেন দর্শকের মর্মমূলে গিয়ে পৌঁছোয়, অনুভূতির কেন্দ্রে গিয়ে যেন নাড়া দেয়। তেমনি করেই যদি না নাড়া দিতে পারি, তাহলে আর আঁকলাম কী?

ভিনসেন্ট বোঝে যে দুনিয়ার সকলের চোখে সে একটা পাগল,’ একটা বাউন্ডুলে। জীবন তার কিছু না, কিছু না। দুনিয়ায় তারই মতো এমনি যারা সমাজ–ছাড়া একঘরে, এমনি যারা কিছু না, তাদের মর্মবাণী সে তার শিল্পের মধ্যে দিয়ে উদ্‌ঘাটন করবে, এই তার সাধনা। তাই সে তার শিল্পের উপজীব্য খুঁজে পায় শ্রমিকের নোংরা বস্তিতে, জেলেবউয়ের ভাঙা কুটিরের উঠোনে, পাকা সড়ক ছেড়ে গলিঘুঁজিতে, অপাঙ্ক্তেয় অবজ্ঞাত লোকযাত্রায়। ছবি আঁকাই তার একমাত্র, নেশা, অবসর নেই; অবসরবিনোদনের অন্য কোনো নেশা নেই। যা নেশা তা-ই প্রতিমুহূর্তের পেশা, যা স্বপ্ন তারই মধ্যে সর্বসম্ভাবনা। তা ছাড়া সময় কই? শিল্পী হওয়া সোজা কথা নয়, শিল্পসাধনা সর্ববিরতিহরা।

একমাত্র অসুবিধে, তেলরঙের দাম নিদারুণ। অল্প অল্প করে রং লাগাতে সে পারে না, টিউব থেকে টিপে রং বার করে মোটা করে ক্যানভাসের ওপর লেপে দেওয়া আর জুইডার জির জলে ফ্র্যাঙ্ক ঢেলে দেওয়া একই কথা যেন। তা ছাড়া আস্তে-আস্তেও সে আঁকতে পারে না। দু-মাসে মভ যত আঁকেন, একদিনে ততটা তার আঁকা হয়ে যায়।

তাই ক্যানভাস খরচেরও শেষ নেই। উড়ে যায় টাকা, ঘর ভরে ওঠে ছবিতে। থিয়ো একবারে টাকা পাঠায় না, প্রতি মাসে দশ দিন অন্তর অন্তর তিনবার পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠায়। যখনই একবার পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক আসে, দৌড়ে যায় দোকানে, রঙের পর রং আর ক্যানভাস কেনে। পাগলের খুশিতে প্রাণটা ভরে ওঠে। পাঁচ-ছ দিন যেতে-না-যেতেই সব টাকা ফুরিয়ে যায়, বাকি দিন ক-টা কায়ক্লেশে টানাটানিতে চলে।

কিন্তু শুধু ছবি এঁকেই তো সব কটা টাকা খরচ করা চলে না! কত খরচ বাচ্চাটির পেছনে, তা ছাড়া ক্রিস্টিনের জন্যে নিয়মিত ওষুধ, ভালো খাবার, নতুন পোশাক। হার্মানকে স্কুলে ভরতি করেছে, তার দায়ও কম নয়। সংসারের জন্যে দৈনন্দিন ব্যয়ের তো সীমা নেই। তিনটি লোক তার পোষ্য, পঞ্চাশটি ফ্র্যাঙ্কের কত সে সংসারে দেবে, আর কতটা রাখবে শিল্প’লক্ষ্মীর উপচারের জন্যে, তা সে কিছুতেই হিসেব করে উঠতে পারে না।

ক্রিস্টিন বলে—থিয়োর টাকাটা পেয়েই তুমি রঙের দোকানে ছোট, মজুরি মিললেই মজুর যেমন ভাঁটিখানায় ছোটে ঠিক তেমনি।

শেভেনিনজেনের সমুদ্রতীরটা সত্যিই নেশার মতো। প্রত্যেক দিন সে ভারী ইজেলটা কাঁধে নিয়ে বালুচর ভাঙতে ভাঙতে সেখানে যায়। প্রহরে প্রহরে আকাশের আর সমুদ্রের রং বদলায়, রংমাতাল ভিনসেন্ট রঙের পর রং চড়ায় ছবির পর ছবিতে। শরৎ-শেষে শিল্পীরা সাধারণত স্টুডিয়োতে কাজ করে, বাইরে তখন শীতের আক্রমণ। ভিনসেন্টের তাতে মন ওঠে না, সমুদ্রতীরে সে ইজেল পাতে জেলেনৌকোর ধারে। আঁকে সে কুয়াশা আর ঝড়-বৃষ্টিকে তুচ্ছ করে। নোনা জলের ঝাপটা কখনও এসে লাগে তার ছবির কাঁচা রঙে; বৃষ্টিতে ভিজে, ঠান্ডা বাতাসে অসাড় হয়ে আসে আঙুল, উড়ন্ত বালুকণা চোখে ঢুকে করকর করে। বয়ে গেছে তার! প্রকৃতিকে যে বাঁধতে চায় রেখা আর রঙের বাঁধনে, প্রকৃতির ভ্রুকুটিলীলাকে সে করবে ভয়?

কে তাকে রুখবে এক মৃত্যু ছাড়া?

.

একদিন রাত্রি বেলা একটা নতুন ক্যানভাস সে ক্রিস্টিনকে দেখাল। ক্রিস্টিন আশ্চর্য চোখে বলে উঠল—কী করে তুমি আঁক ভিনসেন্ট! এ তো ছবি নয়, এ যেন সত্যি দেখছি!

ভিনসেন্টের খেয়াল রইল না যে সে একজন নিতান্ত অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের সঙ্গে কথা কইছে, মভ বা উইসেনব্রাকের মতো কারও সঙ্গে নয়। বললে—আমিও বুঝিনে। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গা ভালো লেগে যায়। সেইখানে ইজেলটা খাটাই। চড়াই সাদা একটা ক্যানভাস। মনে মনে বলি—সাদা থাকলে চলবে না, একটা কিছু হতেই হবে। অনেকক্ষণ ধরে কাজ করি, তারপর বাড়ি ফিরে আসি অতৃপ্ত মন নিয়ে। লুকিয়ে রেখে দিই ছবিটা। কিছুটা বিশ্রাম করার পর ভয়ে ভয়ে দেখি—মনে ভাবি, আসল যা দৃশ্য দু-চোখ ভরে দেখেছি, তার কতটুকু বা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি? কিন্তু ছবিটা দেখতে দেখতে যা সত্য তার প্রতিবিম্ব চোখে ফোটে, তার প্রতিধ্বনি এসে কানে বাজে। মনে হয় প্রকৃতি যেন আমার কানে কানে তার গোপন অন্তরবাণী শুনিয়েছে। সেই বাণী হারায়নি, তাকে আমি টুকে রাখতে পেরেছি রঙের তুলি বুলিয়ে। সব কথা হয়তো টুকতে পারিনি, কিছুটা বাদ পড়েছে, কোথাও রয়ে গেছে ফাঁক, কিন্তু যেটুকু ধরেছি তার মধ্যে মিথ্যে নেই কোথাও।—কী হল, বুঝতে পারছ কী বলছি?

ক্রিস্টিন হেসে বললে—না, একবর্ণও না।

১২

সত্যিই, ভিনসেন্টের যা কাজ তার কিছুই ক্রিস্টিন বুঝত না। তার ধারণা, ভিনসেন্টের শিল্পক্ষুধা নিতান্ত একটা বনেদি বদখেয়াল ছাড়া আর-কিছু নয়। এই ক্লান্তিহীন পরিশ্রম, আত্মপ্রকাশের এই প্রতিমুহূর্তের যন্ত্রণা তার ক্ষুদ্র উপলব্ধির সম্পূর্ণ বাইরে। সাধারণ মানুষের সংসারসঙ্গিনী হবার উপযুক্ততা তার ছিল, কিন্তু রক্তে যার সংসারবৈরাগ্য, তার বিবাগী ভাবনাকে সে আশ্রয় দেবে কোন ক্ষমতায়? কথা দিয়ে নিজেকে যখন ভিনসেন্ট প্রকাশ করতে পারে না তখন সে লেখার আশ্রয় নেয়। কী দেখেছে, কী ভেবেছে, কী এঁকেছে—প্রায় প্রতি রাত্রেই দীর্ঘ চিঠিতে সে থিয়োকে লেখে। অপরের চিত্তপ্রকাশকে সে যখন উপভোগ করতে চায়, তখন সে উপন্যাস পড়ে, ফরাসি ইংরেজি ডাচ জার্মান, যেকোনো ভাষায়। তার জীবনের নিতান্ত সামান্য অংশের সঙ্গেই ক্রিস্টিনের সহযোগ। তার ধ্যানধারণা তার শিক্ষা-সংস্কৃতি এসবের বোঝা চাপিয়ে ক্রিস্টিনের অশিক্ষিত মনকে সে পীড়িত করতে চায় না। ক্রিস্টিনকে জীবনসঙ্গিনী করবে বলে যে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এ নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা নেই।

ভরা শীতকাল এল। ততদিন কোনো অসুবিধে হয়নি, যতদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে বাইরেই থাকত রং-তুলি নিয়ে। সঙ্গিনী ছিল বিশ্বপ্রকৃতি। কিন্তু শীতকালে বাইরে শুধু তুষারঝড়, সারাদিনে একবারও বাড়ির বাইরে বার হওয়া অসম্ভব। এইবার শুরু হল মুশকিল।

রঙের খরচটা বাঁচল। সারাদিন ঘরে বসে কাজ, ফিরে গেল ড্রয়িংয়ে। কিন্তু মডেলের দর্শনী জোগানো প্রাণান্তকর। যারা রাস্তায় মুষ্টিভিক্ষার বিনিময়ে যেকোনো শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে লালায়িত, তেমনি লোকও যখন শোনে স্টুডিয়োতে চুপটি করে বসে থাকতে হবে, তখন চড়া দর হাঁকে। শেষ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে পাগলাগারদে গিয়ে ড্রয়িং করার অনুমতি চাইল। কর্তৃপক্ষ তাতে নারাজ, বড়োজোর যে-দিন যে-দিন দর্শকরা আসতে পারে, সেই-সেই দিনে আসবার অনুমতি মিলল।

একমাত্র ভরসা ক্রিস্টিন। ভিনসেন্ট আশা করেছিল শরীরটা একটু সারলে ক্রিস্টিন আবার আগের মতো পোজ করে তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু ক্রিস্টিনের তাতে মনে মনে আপত্তি। প্রথম প্রথম সে দুর্বলতার অজুহাতে ভিনসেন্টের অনুরোধকে এড়িয়ে যেত। আর বেশ ভালোমতো সুস্থ যখন সে হয়ে উঠল, তখনই-বা তার সময় কোথায়?

বলে—আগে যেমন ছিলাম এখন কি আর তেমনটি আছি ভাব নাকি? এখন যে সংসারের গিন্নি হয়েছি। চারটে লোকের রান্না করা, বাড়ি পরিষ্কার রাখা, ধোয়া-মোছা, কম হল? তার ওপর আবার বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চা। নিশ্বাস ফেলবার সময়টুকু রেখেছ?

ভোর পাঁচটায় উঠল ভিনসেন্ট। অন্ধকার থাকতেই যা-কিছু সংসারের কাজ নিজে হাতে করে নিল যাতে করে দিনের বেলা ক্রিস্টিন তার জন্যে সময়টা দিতে পারে। পরিবর্তে ক্রিস্টিন কথা শুনিয়ে দিল—বয়ে গেছে! আমি এখন আর তোমার মডেল নাকি? আমি এখন বউ!

ওরকম কোরো না সিয়েন, অবুঝ হোয়ো না। আমার জন্যে তোমাকে পোজ করতেই হবে। তোমাকে যে আমার কাছে এনেছি, এর একটা উদ্দেশ্য তো তা-ই।

রাগে আগুন হয়ে ঝংকার দিয়ে উঠল ক্রিস্টিন। গোড়ায় গোড়ায় যেমন তার বাগ-না-মানা অভদ্র মেজাজ ছিল, হঠাৎ তেমনি মেজাজ প্রকাশিত হয়ে পড়ল। ফেটে পড়ল কর্কশ চিৎকারে—কী? কী বললে? এই জন্যে আমাকে এনেছ? এই করে তুমি পয়সা বাঁচাবে? সারাদিন গতর ভেঙে তোমার বাড়িতে দাসী-বাঁদির কাজ করব, তাতেও আকাঙ্ক্ষা তোমার মেটে না? এর ওপর আবার তোমার ড্যাবডেবে চোখের সামনে তিন ঘণ্টা ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? আর তা নইলে দূর করে দেবে বাড়ি থেকে?

ভিনসেন্ট চুপ করে ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর বললে—এমনিধারা কথা তো তুমি ভুলে গিয়েছিলে সিয়েন, নিশ্চয়ই আবার শিখছ তোমার মার কাছ থেকে।

শিখছি তো শিখছি। মিথ্যে তো নয় কিছু!

সিয়েন, আমার কথা শোনো। তোমার মার ওখানে যাওয়া তোমার বন্ধ করতে হবে।

ইঃ, বললেই হল! পেটের মেয়ে আমি, মার ওপর আমার দরদ নেই?

কিন্তু সিয়েন, তোমার আমার সম্বন্ধের মাঝখানে ওরা যে ফাটল ধরাচ্ছে! ওরা যা ভাবে, ওরা যা চায় তাতে আবার যদি তুমি সায় দাও, তাহলে কোথায় থাকবে আমাদের বিয়ে?

বটে? কিন্তু ঘরে যখন খাবার থাকে না তখন তুমিই তো সাধো আমাকে মার ওখানে যেতে। নিজে যদি পয়সা কিছু রোজকার করতে পার, আমাকেও তাহলে আর যেতে হয় না।

শেষ পর্যন্ত ভিনসেন্ট ক্রিস্টিনকে পোজ করতে রাজি করাল বটে, কিন্তু নিষ্ফল সে-স্বীকৃতি। ইচ্ছাতেই হোক অনিচ্ছাতেই হোক, ক্রিস্টিন এমন সব অশুদ্ধ ও বীভৎস ভঙ্গি নিতে লাগল যে শেষ পর্যন্ত ভিনসেন্ট হাল ছাড়তে বাধ্য হল। ফলে বাইরের মডেলের খরচ বাড়ল, আর বাড়ল ঘরের নিরন্ন দিনের সংখ্যা। ঘরে যখন যথেষ্ট খাবার থাকে না, ক্রিস্টিনকে তার শিশুকে নিয়ে যেতে হয় তার মায়ের ওখানে। প্রত্যেক বার মার কাছ থেকে ক্রিস্টিন ফিরে আসে, আর ভিনসেন্ট লক্ষ করে, একটু একটু সে বদলাচ্ছে। সে বোঝে কী সাংঘাতিক অলাতচক্রে সে বাঁধা পড়েছে। যে-কটা টাকা সে থিয়োর কাছ থেকে পায়, সবই যদি সে সংসারে ব্যয় করে তাহলে ক্রিস্টিনকে তার মার প্রভাবে পড়তে হয় না, তার সঙ্গে তার সম্পর্কটা সুস্থ থাকে। কিন্তু তা-ই যদি সে করে, তাহলে নিজের কাজে ইস্তফা দিতে হয়। আর শিল্পকর্মেই যদি জলাঞ্জলি দিল, তাহলে থিয়োর কাছ থেকে মাসোহারা নেবে কোন লজ্জায়?

ক্রিস্টিনকে সে বাঁচিয়েছে, সে কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে হত্যা করার জন্যে? রুগ্‌ণা গর্ভবর্তী ক্রিস্টিন, হাসপাতালে প্রসূতি ক্রিস্টিন, প্রসবের পর রক্তশূন্য দুর্বল ক্রিস্টিন, সে-ক্রিস্টিন ছিল একরকম, সমাজপরিত্যক্তা, আশ্রয়হারা, আশাহারা, মৃত্যুপথযাত্রিণী। মৃদুতম মিষ্টিকথায় সামান্যতম সাহায্যে তার কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। যন্ত্রণা তখন তার কানায় কানায়, তা থেকে মুহূর্তের মুক্তির জন্যে যা চাও তা-ই সে করতে পারত, আত্মশুদ্ধির কঠোরতম প্রতিজ্ঞা করতে তার আটকায়নি। কিন্তু এখন নতুন রক্ত জেগেছে শিরায়, মাংস লেগেছে দেহে, ঔষধে পথ্যে চিকিৎসায় বিশ্রামে স্বাস্থ্য ফিরেছে, স্মৃতি মুছে যাচ্ছে, ঘুচে যাচ্ছে গৃহিণী আর জননী হবার অঙ্গীকার। পুরোনো জীবনের বাসনা আর অভ্যাস ধীরে ধীরে ফিরে আসছে। চোদ্দো বছর যে পথচারিণী বারবনিতার জীবনযাপন করেছে, এক বছরের পরিবর্তনের মূল্য তার কাছে কতটুকু? ভিনসেন্ট প্রথমটা বুঝতে পারেনি. কিন্তু ক্রমেই তার চোখ ফুটছে।

থিয়োর কাছ থেকে এক অদ্ভুত চিঠি এল এমনি সময়ে। প্যারিসের রাস্তা থেকে থিয়ো একটি মেয়েকে কুড়িয়ে এনেছে। মেয়েটি সহায়-সংগতিহীনা, রোগজীর্ণা। আত্মহত্যা করতে সে চলেছিল, এমনি অবস্থায় থিয়ো তাকে ফিরিয়ে এনেছে। এক বন্ধুপরিবারের আশ্রয়ে রেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা সে করেছে। তারপর?

ভিনসেন্টকে সে লিখেছে—কী করি এখন? রোগীটিকে মৃত্যুর দ্বার থেকে তো ফিরিয়ে আনলাম, এখন জীবনের মধ্যে নিয়ে আসা ছাড়া কী উপায়? বিয়ে করব? এ ছাড়া অন্য পথ কিছু আছে?

ভিনসেন্ট সহানুভূতি জানিয়ে থিয়োকে সুদীর্ঘ চিঠি লিখল, কিন্তু কোনো উপদেশ দেওয়া তো সহজ নয়!

এ-দিকে দিনের পর দিন ক্রিস্টিন অসহ্য হয়ে উঠছে। শুধু রুটি আর কফিতে তার পোষায় না, ভালো খাবারদাবারের জন্যে তার অভিযোগ লেগেই আছে। সঙ্গে জুটছে নতুন পোশাকের বায়না, সেজন্যে গায়ের পুরোনো পোশাককে নষ্ট করতে ছিঁড়ে ফেলতে তার দ্বিধা নেই। এ-দিকে ভিনসেন্টের জামার একটা বোতাম সেলাই করতেও তার হাত ওঠে না। ভিনসেন্ট কেন মডেলের পেছনে পয়সা ওড়ায়, কেন সব টাকাটা সংসারে ঢালে না, এই তার নিত্য নাকিকান্না। তার মা তাকে সর্বদা ভয় দেখাচ্ছে, দু-দিন পরেই হয় ভিনসেন্ট তোকে তাড়াবে, নাহয় তোকে ফেলে নিজেই অন্য কোথাও পালাবে। পরামর্শ দেয়—বিয়ে করা বউই যখন নয়, তখন এমনি ঠুনকো সম্পর্কটা থাকলেই-বা কী গেলেই-বা কী?

ভিনসেন্ট ভাবল—সে-ই তো পূর্বসূরি। তারই পথে তো থিয়ো পা বাড়িয়েছে। বিয়ে করলেই কি সমস্যার সমাধান? লিখল—তাড়াতাড়ি কিছু একটা করে বোসো না। সাহায্য করো, দেহে মনে সুস্থ করে তোলো মেয়েটিকে। কিন্তু ঝপ করে বিয়ে করে বোসো না। তোমাদের মধ্যে যদি ভালোবাসা হয়, তখন বিয়ে কোরো। নইলে শুধু বিয়ে করেই তোমার সমস্যার সমাধান নয়।

গৃহস্থালিতে ক্রিস্টিনের মন নেই, তাই খরচের হাতও অসংযত। সংসারের ব্যয় বেড়ে চলে, ক্ষতি হয় তার কাজের। ঋণ জমতে থাকে, বাড়িওয়ালা, মুদি, রুটিওয়ালা, রংওয়ালা কার কাছে নয়? থিয়োও নতুন খরচের দায়িত্ব নিয়েছে, সময়ে সে টাকা পাঠায় না। প্রত্যেক মাসে তিনবার করে সে থিয়োকে টাকার জন্যে ব্যস্তসমস্ত চিঠি লেখে। প্রত্যেক বার টাকা আসা মাত্র কোথায় যে উড়ে যায়। ঋণ

আর শোধ হবার অবসর পায় না!

থিয়োর আশ্রিতাটির অপারেশন হবে হাসপাতালে। মস্ত একটা ধাক্কা। যেমন ভিনসেন্টকে তেমনি নিউনেনে বাবাকেও টাকা পাঠাতে হয় থিয়োর। তারপর নিজের খরচ তো আছেই। তারও অরস্থা সঙিন।

মার্চ মাসে একদিন ভিনসেন্টের হাতে একটি পয়সা নেই একটা ছেঁড়া নোট ছাড়া। ঘরে নেই একদানা খাবার, বাজারে নেই ধার নেবার একবিন্দু সংগতি থিয়োর কাছ থেকে টাকা আসতে অন্তত আরও আট-ন দিন দেরি। কোনো উপায় নেই আর।

ভিনসেন্ট বললে—সিয়েন, বাচ্চাগুলো না খেতে পেয়ে মরবে। তুমি ক-দিন ওদের নিয়ে তোমার মায়ের কাছে গিয়েই থাকো। থিয়োর চিঠি এলেই আমি তোমাদের নিয়ে আসব।

উভয়ে উভয়ের মুখের দিকে তাকাল একমুহূর্ত। দুজনেরই মনে একটি কথা, যা মুখে প্রকাশ করা অসম্ভব। চোখ নামিয়ে ক্রিস্টিন বললে—হ্যাঁ, এই ভালো, এ ছাড়া আর রাস্তা নেই।

ছেঁড়া নোটটার বদলে মুদি দিল কালো একটা পাঁউরুটি আর খানিকটা কফি।

ন-দিন পরে এল থিয়োর চিঠি, সঙ্গে পঞ্চাশটি ফ্র্যাঙ্ক।

থিয়ো লিখেছে—তার আশ্রিতাটির অপারেশন ভালোই হয়েছে, এখন তাকে রেখেছে একটা নার্সিং হোমে। আর্থিক অবস্থা তারও সঙিন, ভবিষ্যতে ভিনসেন্টকে টাকা পাঠিয়ে যেতে যে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ভিনসেন্ট প্রায় পাগল হয়ে গেল চিঠি পড়ে। এর মানে কি থিয়ো আর তাকে টাকা পাঠাবে না? তাতে তার দুঃখ নেই, কিন্তু এর মানে আর-কিছুও হতে পারে। দিনের পর দিন স্কেচের পর স্কেচ সে থিয়োকে পাঠিয়েছে, জানিয়েছে তার অগ্রগতির পরিচয়। কিন্তু এসব ছবি দেখে থিয়োর মনে কি শেষ পর্যন্ত এই ধারণাই দাঁড়িয়েছে যে সে অক্ষম, অকৃতার্থ শিল্পী, ব্যর্থ তার প্রয়াস, তাই টাকা খরচ করে তাকে পোষণ করবার কোনো মানে হয় না?

রাতের পর রাত জেগে ভিনসেন্ট থিয়োকে চিঠির পর চিঠি লিখল। কেন? কেন? আসল কারণটা কী খুলে বলো! উত্তর নেই। দিনের বেলা পথে পথে ঘুরে বেড়াল রুজিরোজগারের কোনো একটা উপায়ের সন্ধানে। পন্থা নেই।

১৩

ফিরে গেল ক্রিস্টিনের কাছে। দিব্যি সভা বসেছে ক্রিস্টিনের মার ঘরে—মা, ভাই, ভাইয়ের রক্ষিতা আর অপরিচিত একটা লোক। তাদের মাঝখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে আর কালো চুরুট ফুঁকছে ক্রিস্টিন, হাতে মদের গ্লাস।

মার সঙ্গে ন-দিন মাত্র বসবাসের ফলেই পুরোনো বদভ্যাসগুলি ফিরে এসেছে। ভিনসেন্ট প্রতিবাদের সুরটুকু তুলতেই দপ করে জ্বলে উঠল সে।

বেশ করব, খুব করব! চুরুট যদি নিজের পয়সায় আমি কিনে খাই তোমার বলবার কী? আর মদ? মাঝে মাঝে জিন খেতে হাসপাতালের ডাক্তারই তো আমায় বলেছে।

বলেছে, কিন্তু যাতে খিদে বাড়ে শুধু সেই জন্যে, ওষুধের মতো করে।

ভিনসেন্টের মুখের ওপর খলখল করে হেসে উঠল ক্রিস্টিন—ওষুধ! মাল টানব ওষুধের মতো করে? কোথাকার….তুমি!

অত্যন্ত নোংরা সম্বোধন সে করল। এমনি কথা সে ভুলেই গিয়েছিল ভিনসেন্টের সংস্পর্শে আসার পর থেকে।

ভিনসেন্টেরও তখন একেবারে ভাঙাচোরা মন, আত্মসংযমের শক্তিটুকু নেই। এমনি জঘন্য উত্তর ক্রিস্টিনের মুখ থেকে শুনতে হবে? দুর্দমনীয় রাগে সে ফেটে পড়ল। ক্রিস্টিনও থামবার পাত্র নয়, ভয় না পেয়ে সেও চেঁচাতে লাগল সমানে।

খেতে দাও? পরতে দাও? ইঃ, সোহাগ তো কতখানি, চোখ রাঙাবার বাবু! একপয়সা রোজগারের মুরোদ নেই, আমার মরদ এসেছেন!

জোর করে সে নিয়ে গেল ক্রিস্টিনকে বাড়িতে।

শীতের শেষে বসন্ত এল যেন নিরুপায় অনিচ্ছায়। ভিনসেন্টের অবস্থা আরও নামতে লাগল। উঁচু হতে লাগল ঋণের পাহাড়। উপযুক্ত খাবার পেটে পড়ে না, পেট শুরু করল বিদ্রোহ। গলা দিয়ে কিছুই নামতে চায় না। পেটের অসুখ দাঁতকে আক্রমণ করল, দাঁত থেকে ডান কান। দাঁত গলা কান আর মাথা সর্বদা যন্ত্রণায় দপদপ করে জ্বলে।

ক্রিস্টিনের মা রোজই আসা-যাওয়া করে। মেয়ের সঙ্গে বসে চুরুট ফোঁকে, মদ খায়। একদিন ভাইও এল, ভিনসেন্টকে দেখেই অবশ্য চটপট সরে পড়ল লোকটা। ভিনসেন্ট জিজ্ঞাসা করল—তোমার ভাই এখানে এসেছিল কেন? তোমার সঙ্গে এখানে আবার ওর কী দরকার?

ক্রিস্টিন বললে—ওরা সবাই বলছে, এবার তুমি আমাকে তাড়িয়ে দেবে।

তুমি জান সিয়েন, ওদের কথা মিথ্যে। যতদিন তুমি নিজে না ছেড়ে যেতে চাও ততদিন তুমি আমার কাছে থাকবে।

মা আমাকে বলছে চলে যেতে। বলছে, যেখানে দু-মুঠো খেতেই না পাওয়া যায়, সেখানে পড়ে থেকে লাভ কী?

গেলে কোথায় যাবে?

কেন? বাড়িতে, মার ওখানে।

ছেলেদেরও নিয়ে যাবে

এখানে থাকলে তো না খেয়ে মরব। আমি কাজকর্ম করে রোজগারও করতে পারব।

কী কাজ?

এই….এই কাজ আর কী।

– আবার কাপড় কাচবে ধোপাবাড়িতে?

হ্যাঁ, তাও করতে পারি—আমতা আমতা উত্তর।

মুহূর্তে ভিনসেন্ট ধরতে পারে ও মিথ্যে কথা বলছে। কঠোর হয়ে বলে–বুঝেছি কী কাজের জন্যে ওরা তোমাকে কুমতলব দিচ্ছে।

তা-ই যদি করি এমন আর মন্দটা কী? পয়সা তো আসে!

শোনো সিয়েন, আবার যদি তোমার মায়ের বাড়িতে যাও, আর প্রাণে বাঁচবে না। মা তোমাকে আবার রাস্তায় বার করাবে। লিডেনের ডাক্তার কী বলেছিল মনে আছে তো? আবার যদি বিপথে ফিরে যাও তাহলে নির্ঘাত তুমি মরবে।

মোটেই না। শরীর আমার এখন অনেক ভালো।

হ্যাঁ, সাবধানে আছ তাই বলেই ভালো। কিন্তু আবার যদি–

কে আবার যাচ্ছে, যদি না তুমি আমাকে তাড়িয়ে দাও?

ক্রিস্টিনের চেয়ারের হাতলের ওপর বসল ভিনসেন্ট, ডান হাত রইল ওর কাঁধের ওপর। বললে—তাহলে বিশ্বাস করো সিয়েন, আমি কখনও তোমাকে পরিত্যাগ করব না। আমার যা আছে তার অংশ নিয়ে যতদিন তুমি আমার কাছে থাকতে চাও ততদিনই তুমি থাকবে। তবে তোমার ভাই আর মা, ওদের তোমাকে ছাড়তেই হবে। ওদের খপ্পরে আবার পড়লে তুমি বাঁচবে না। কথা দাও তুমি ওদের সঙ্গে আর দেখা করবে না!

কথা দিচ্ছি—ক্রিস্টিন বললে।

দু-দিন না যেতেই কোথায় রইল এ-প্রতিশ্রুতি। সারাদিন বাইরে কাজ করার পর সন্ধ্যা বেলায় ভিনসেন্ট ফিরে এসে দেখে, ক্রিস্টিন উধাও। খুঁজে পেল ঠিক তাকে তার মায়ের বাড়িতে, মদ খাচ্ছে বসে বসে।

ধরে তাকে বাড়ি নিয়ে এল ভিনসেন্ট। চেঁচাতে লাগল ক্রিস্টিন—বেশ করব, খুব করব। যা ইচ্ছে তা-ই করব। কেন যাব না মার কাছে? আমি কার কেনা বাঁদি যে হুকুম করলেই হল? ইঃ!

ফিরে চলল সে পুরোনো কুশ্রীতায়, আগেকার সমস্ত রকমের নোংরা অভ্যাসে। ভিনসেন্ট তাকে কত বোঝায় কত সাবধান করে, ভয় দেখায়—এমনি করলে দুজনে একসঙ্গে থাকবে কী করে? উত্তরে শোনে—হ্যাঁ, এখন তো এসব কথা বলবেই, ঝামেলা মনে মনে তাড়াতে চাও কিনা?

বাড়িঘর নোংরা, তছনছ সংসার। ক্রিস্টিনের অলস উদাসীনতা সীমা ছাড়িয়ে চলেছে, কিছু বললেই ঝংকার দিয়ে ওঠে—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি যা আমি তা-ই। আমি কুঁড়ে, আমি কোনো কর্মের নই, আমি রাস্তার ময়লা….বেশ বেশ, রাস্তাতেই আমি যাব….নদীর জলে ডুবে মরুর আমি। হল?

ক্রিস্টিনের মা আজকাল রোজ আসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেয়ের সঙ্গে আসর জমায়। বিশৃঙ্খলার শেষ নেই, সামান্য রান্নাটুকু পর্যন্ত একবেলায় হয় তো আর বেলায় বাদ পড়ে। হার্মানের ইস্কুল ঘুচেছে, সে নোংরা গায়ে ছেঁড়া জামা পরে পথে পথে ঘোরে। ক্রিস্টিনের কুঁড়েমি যত বাড়ে, তত বাড়ে তার চুরুট ফোঁকা আর মদ খাওয়া। এত নেশার পয়সা তার কোথা থেকে জোটে, তা সে ভিনসেন্টের কাছে ভাঙতে চায় না।

গ্রীষ্মকাল এল। আর ঘরে বসে ড্রয়িং নয়, বাইরে বার হয়ে রঙিন ছবি আঁকার সময় এটা। তেলরং, তুলি, ক্যানভাস প্রভৃতি নতুন করে কেনার খরচ। থিয়ো লিখল—তার আশ্রিতাটির শরীর ফিরছে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে মানসিক জটিলতা বাড়ছে। এবার সে কী করবে মেয়েটিকে নিয়ে?

ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি চোখ বুজে রইল ভিনসেন্ট—ডুবে থাকতে চাইল ছবির মধ্যে। ক্রিস্টিন নামছে দিনে দিনে, সঙ্গে সঙ্গে তাকেও টানছে রসাতলের দিকে। কীটদষ্ট জীর্ণ সংসার কোনদিন ভেঙে পড়বে একেবারে মাথার ওপর। কিছু করার নেই। ভোর বেলা সে বাড়ি থেকে বার হয়ে যায় ছবি আঁকার সরঞ্জাম পিঠে ঝুলিয়ে, সারাদিন মগ্ন হয়ে থাকে কাজের মধ্যে। রোজ মনে মনে ভাবে, আজকের এই ছবিটি এত সুন্দর হবে যে ক্রেতা এসে লুফে নেবেই, এই একটি ছবিতেই রুদ্ধ হৰে সর্বনাশের পথ, মিলবে আত্মপ্রতিষ্ঠা। নিজের সারাদিনের কাজ রাত্রে যখন নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি মেলে দেখে, হতাশায় মন ভরে যায়। কই? কোথায়? আর কতদিন?

একমাত্র তৃপ্তি ওই বাচ্চাটাকে নিয়ে, যার নাম আন্টুন। আশ্চর্য শক্তি ওইটুকু শিশুর। সারাদিন একলা একলা মেঝের ধুলোয় লুটোচ্ছে, যা হাতের কাছে পায় তা-ই মুখে পুরে খিদে মেটাচ্ছে, আর সারাদিন তার ভাষাহারা রকবকানি আর খিলখিল হাসি। সুন্দর বেড়ে উঠছে আপন আনন্দে। প্রায়ই সে স্টুডিয়োর কোণে বসে থাকে, কখনও ভিনসেন্টের দিকে তাকিয়ে অর্থহীন হাসি হাসে, কখনও নিঃশব্দে দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ক্রিস্টিন যত তাকে অবহেলা করে, ভিনসেন্টের স্নেহ তার দিকে তত ধায়। এই পিতৃপরিচয়হীন মানবসন্তান, এর দাম কি কম? ক্রিস্টিনের জন্যে আক্ষেপ করে কী হবে? এই শিশু, একে তো ভিনসেন্টই পৃথিবীর আলো চোখে দেখিয়েছে, এর মধ্যে তো ভিনসেন্টেরও কিছুটা সার্থকতা।

উইসেনব্রাক এলেন আর-এক দিন। গত বছরে আঁকা কয়েকটি স্কেচ ভিনসেন্ট তাঁকে দেখাল। ভিনসেন্টের চোখে এগুলো এখন বড়ো কাঁচা, বড়ো বাজে, বড়ো অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়।

উইসেনব্রাক বললেন—ভুল ভায়া এমনি ধারণা। অনেক বছর পরে নিজের হাতের পুরোনো কাজগুলির দিকে যখন তাকাবে তখন কী মনে হবে জান? মনে হবে এগুলোর মধ্যে অনেক নিষ্ঠা ছিল, অনেক সহজ আন্তরিকতা ছিল। যা হোক, এখন তা ভাববার নয়। এখন শুধু খাটো, এগিয়ে চলো, থেমে পড়লে চলবে না।

কিন্তু থামতেই হল দৃঢ় মুষ্টির আঘাতে। কয়েক মাস আগে পাড়ার এক বাসনওয়ালার কাছে একটা আলো সারাতে নিয়ে যায়। সে-সময় দোকানদার তাকে কয়েকটা বাসন গছিয়ে দেয়। ভিনসেন্ট বলেছিল—টাকা নেই এখন, দাম দেব কোত্থেকে?

দোকানি বলেছিল—তাতে কী হয়েছে? নিয়ে যান, দামের জন্যে কী? যখন সুবিধে হয় দেবেন।

দু-মাস পরে বাসনওয়ালা এসে দরজায় ধাক্কা দিল। লোকটার গাট্টাগোট্টা জাঁদরেল চেহারা।

ভিনসেন্ট অসামর্থ্য জানাতে হেঁকে উঠল সে—নেই টাকা? মিথ্যে কথা বললেই হল? দু-মাস হল টাকাটা ফেলে রেখেছেন, ইচ্ছে করলেই দিতে পারেন তা আমি জানিনে?

ভিনসেন্ট বুঝিয়ে বললে—সত্যি এখন একটিও পয়সা নেই হাতে, এবার টাকা পেলেই দামটা চুকিয়ে দেব, কথা দিচ্ছি।

তাহলে ওই জুতোওয়ালাকে টাকা দিলেন কী করে? আমার চোখ কান নেই? আমি বুঝি জানিনে? মিথ্যে কথা চালাবেন খালি আমার বেলায়!

শক্ত হয়ে গেল ভিনসেন্ট। বললে বিরক্ত কোরো না, আমার এখন কাজের সময়। বলে দিয়েছি টাকা নেই, টাকা পেলে তবে দেব। এখন তুমি যেতে পার।

বারুদ হয়ে উঠল লোকটা।

যাব? যেতেই হবে? বললেই হল? কর্জের করকরে টাকাটা ফেলুন তবে যাব, তার আগে নয়।

একটা অবিবেচনার কাজ করল ভিনসেন্ট। লোকটাকে মৃদু একটা ধাক্কা দিল দরজার দিকে। ধমক দিয়ে বললে—যাও, যাও এখন!

বারুদে আগুন লাগল। লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ডান হাত দিয়ে বিরাট একটা ঘুসি চালাল ভিনসেন্টের মুখে, ভিনসেন্ট ছিটকে গিয়ে ধাক্কা খেল দেয়ালে। আবার তেমনি সজোরে আর-একটা ঘুসি, ভিনসেন্ট লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আর একটা কথা না বলে অপসৃত হল লোকটা।

ক্রিস্টিন যথারীতি মায়ের আড্ডায়। হামাগুড়ি দিয়ে ভিনসেন্টের কাছে গিয়ে বাচ্চা আন্টুন তার ঘা-খাওয়া মুখে হাত বোলাতে লাগল আর কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। একটু পরে ভিনসেন্টের জ্ঞান ফিরে এল। সে কোনো রকমে খাড়া হয়ে টলতে টলতে উঠে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল।

মুখে খুব আঘাত লাগেনি, শারীরিক যন্ত্রণার কোনো অনুভূতি নেই। কিন্তু বেদনাটা অন্যত্র। ওই দুটিমাত্র আঘাতে কী যেন একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বুকের মধ্যে, একেবারে হার হয়েছে তার।

ক্রিস্টিন এল। ওপরে গিয়ে দেখে ভিনসেন্ট নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, মাথা আর একটা হাত বিছানার বাইরে ঝুলে রয়েছে একধারে, অন্য ধারে পা দুটো। কী হল? চেঁচিয়ে উঠল সে।

অনেকক্ষণের অনেক চেষ্টায় যেন ভিনসেন্ট কোনো রকমে শরীরটাকে নাড়তে পারল, মাথাটা পাতলা বালিশের ওপর। নিশ্বাস টেনে টেনে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে—সিয়েন, এখানে আর নয়। হেগ ছেড়ে আমাকে যেতেই হবে।

একটু সুস্থ বোধ করার পর সে আবার বললে—চলো সিয়েন, এই শহর থেকে পালাই। গ্রামে গিয়ে থাকব, সেখানে অনেক কম খরচ, অনেক বেশি শান্তি।

কোথায়?

ড্রেনথে যাব।

আমিও যাব তোমার সঙ্গে? সে অসম্ভব। শহরবাজার নইলে আমার চলবে না, টাকা ফুরিয়ে গেলে খাব কী?

জানিনে সিয়েন। ধরো, উপোস করব তখন।

একটা প্রতিজ্ঞা তুমি করবে? যে দেড়শো ফ্র্যাঙ্ক পাও, সেটা সংসারে দেবে পুরোপুরি? মডেল আর রঙের পেছনে কিছুই খরচ না করে?

অসম্ভব সিয়েন। খাই আর না-খাই, ছবি আঁকা আগে।

ঠিক, তোমার কাছে তা-ই ঠিক। কিন্তু বাঁচতে তো হবে। না খেয়ে বাঁচতে পারিনে ভিনসেন্ট।

আমিও ছবি না এঁকে বাঁচতে পারিনে সিয়েন।

ক্রিস্টিন হাসল। আসন্ন প্রদোষের ধূসরতা সে হাসিতে। বললে—বেশ তো! তোমার টাকা, তোমার দাবি আগে বই কী। এখন কি পকেটে খুচরো কয়েকটা সেন্টিম আছে? তাহলে ওঠো, রিন স্টেশনের ধারের সেই ভাঁটিখানাটায় একবার যেতে ইচ্ছে করছে।

পৌঁছোল দুজনে। ঘরটায় দেশি মদের টক টক গন্ধ। ঘুলিঘুলি অন্ধকার, এখনও আলো জ্বালা হয়নি। প্রথম যে-দিন তাদের এখানে দেখা হয়, তখন যে-টেবিলে তারা বসেছিল, সেটা খালি। ক্রিস্টিন এগিয়ে গেল। ভিনসেন্টকে নিয়ে সেই পুরোনো জায়গায় বসল। অর্ডার দিল দু-বোতল দেশি মদ। গ্লাসটা চেপে ধরে আঙুলগুলি খেলা করতে লাগল ক্রিস্টিনের। ভিনসেন্টের মনে পড়ল প্রায় দু-বছর আগে ঠিক এমনি দিনে এমনি অবস্থায় ক্রিস্টিনের মোটা মোটা খাটিয়ে মেয়ের চঞ্চল আঙুলগুলি প্রথম সে দেখেছিল, আকৃষ্ট হয়েছিল মন।

টেবিলের দিকে মুখ নীচু করে ক্রিস্টিন বললে—ওরা বলত তুমি শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে যাবে। আমিও যে তা জানতাম না তা নয়।

সত্যি আমি তোমারে পরিত্যাগ করে যেতে চাইনে সিয়েন

না গো এ পরিত্যাগ নয়, এ ভালো। ভালো ছাড়া তুমি আমার কখনও কিছু করনি।

আমার জীবনের ভাগ এখনও যদি তুমি নিতে চাও সিয়েন, চলো আমার সঙ্গে।

আবেগহীন স্পষ্টতায় মাথা নাড়ল ক্রিস্টিন—না, যা আছে দুজনের তাতে চলবে না।

সিয়েন, ভুল বোঝনি তো আমাকে? ভুল বুঝো না। যদি আমার বেশি থাকত, সব তোমাকে দিতাম। কিন্তু তোমাকে খাওয়াব কি আমার কাজকে খাওয়াব, এই দোটানার সামনে যখন দাঁড়াই—

ভিনসেন্টের হাতে ডান হাতটি রাখল ক্রিস্টিন, শক্ত খসখসে তালুর চামড়া। বললে—বুঝেছি, বুঝেছি—মন খারাপ কোরো না এ নিয়ে। আমার জন্যে সবকিছু তুমি করেছ, সব আমার মনে আছে। তবু শেষ পর্যন্ত যখন ছাড়াছাড়ির সময় আসে, আসতে দাও—

যদি না ছাড়ি সিয়েন? মুখ ফুটে তুমি একবার বলো সিয়েন যে তুমি খুশি হবে, আমি তোমাকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যাব।

অস্ফুট গলায় ক্রিস্টিন বললে—না। আমার মায়ের কাছেই আমার জায়গা, সেখানেই আমি ফিরে যাব। যার যা জীবন। তুমি ভেবো না, ভালোই হবে, আমার ভাই বলেছে নতুন একটা ঘর সে নেবে তার রক্ষিতার আর আমার জন্যে।

গ্লাসটা তুলে মুখে উপুড় করে দিল ভিনসেন্ট। শেষ তলানিটুকুর তিক্ত কষায় স্বাদ।

বললে—সিয়েন, এটা তুমি জান, আমি যখন যতটা পেরেছি তোমাকে সাহায্য করতেই চেষ্টা করেছি। তোমাকে ভালোবেসেছি, স্নেহ মমতা যা ছিল সব তোমাকে দিয়েছি। সে-কথা স্মরণ করে আমার একটি কথা তুমি রাখবে বলো?

কী কথা?

ও-পথে আর যেয়ো না। আন্টুনটার কথা অন্তত মনে করে ও-পথ থেকে সরে থেকো।

চুপ করে রইল ক্রিস্টিন। তারপর বললে—আর-এক গ্লাসের মতো পয়সা হবে?

হ্যাঁ হবে।

গ্লাসের প্রায় অর্ধেকটা মদ একচুমুকে শুষে নিয়ে ক্রিস্টিন বললে—আঃ, ধন্যবাদ। পোড়া পেটের ছেলেগুলোকে খাওয়াবার জন্যেই ও-পথে আমি যাই, আর কোনো কারণে নয়।

কিন্তু সিয়েন, অন্য কাজ যদি পাও তাহলে?

তাহলে যাব না, কথা দিচ্ছি।

আমি তোমাকে প্রত্যেক মাসে টাকা পাঠাব সিয়েন, ওই বাচ্চাটার জন্যে। ওটাকে তুমি দেখো, ওটাকে বড়ো হবার সুযোগ দিয়ো।

পাগল? টাকা পাঠাবে তুমি? কিছু ভেবো না। ঠিক বড়ো হবে ও। অন্যগুলোর মতোই।

.

ভিনসেন্ট থিয়োকে চিঠি লিখে জানাল সে ক্রিস্টিনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে গ্রামে গিয়ে থাকতে চায়। পত্রপাঠ থিয়ো উত্তরে পূর্ণ সমর্থন জানাল, আর সেইসঙ্গে পাঠাল পুরোনো সব দেনা মিটিয়ে ফেলবার জন্যে অতিরিক্ত একশোটি ফ্র্যাঙ্ক। চিঠিতে লিখল—

ক-দিন হল আমার আশ্রিতাটি অন্তর্ধান করেছে। যাবার সময় যা ছিল সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে গেছে, রেখে যায়নি কিছু, ঠিকানাটুকুও না। তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার পর দেখছিলাম, জীবনের মধ্যে তাকে আনবার মতো উপযুক্ত সম্পর্কটা খুঁজে পাচ্ছিনে। অতএব এ ভালোই হয়েছে। এবার তোমার আমার দুজনেরই শৃঙ্খল ঘুচেছে, দুজনেই মুক্ত।

উপরের ঘরটায় ভিনসেন্ট তার জিনিসপত্র বন্ধ করে রাখল। ভাবল আবার কিছুদিন পরে হেগ-এ ফিরে আসবে। ড্রেনথে যে-দিন যাবে, তার আগের দিন নিউনেন থেকে পেল বাবার এক চিঠি, আর মার কাছ থেকে একটি পার্সেল। পার্সেলে মার হাতে তৈরি কিছু খাবার আর খানিকটা তামাক।

বাবা লিখেছেন—কবে তুমি এখানে আসবে? গোরস্থানের ক্রসগুলি আঁকবে না?

না, ড্রেনথে নয়, বাড়ি যাবে। পেটে ক্ষুধা, হাতে নেই অর্থ, শক্তিহীন বিষণ্ণ বুক। বাড়ি গিয়ে ক-দিন মার কাছে থাকলে শরীর সারবে। রাবান্টের গ্রামাঞ্চল, তার খেতখামার আর বন, গাছের ছায়া আর কর্মরত কৃষাণের মূর্তি—ওরা সবাই ডাকছে, টানছে।

ক্রিস্টিন আর তার দুটি ছেলে সঙ্গে গেল স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সবাই, কথা নেই কারও মুখে। ট্রেন এসে দাঁড়াল, উঠে পড়ল ভিনসেন্ট। ক্রিস্টিন দাঁড়িয়ে রইল নির্বাক নিশ্চল হয়ে। বুকে তার শিশুটি, ডান হাতে হার্মানের হাত ধরা। ভিনসেন্ট জানলা দিয়ে দেখতে লাগল তাদের যতক্ষণ না আধো-অন্ধকার প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন গিয়ে পড়ল জ্বলজ্বলে রৌদ্রভরা প্রান্তরে। পড়ে রইল ক্রিস্টিন স্টেশনের কালো অন্ধকারে, মিলিয়ে গেল, দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে গেল জীবন থেকে চিরকালের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *