৮
রাত নেমেছে। নিয়ন বাতি জ্বলে উঠেছে। তবুও ওর মনে হয়, ওর সামনে সবটাই অন্ধকার। শুধু এই শহর নয়, পুরো দেশের আনাচে-কানাচে গভীর অন্ধকার। অন্ধকারই জীবন। ওর চারপাশে কাচের দেয়াল। পুরো শহরটাই যেন একটা ঘর। ও নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সেই ঘরের দিকে। কত মানুষ গাড়িতে ও রিকশায় চলে যাচ্ছে। ফুটপাতেও মানুষের স্রোত। কাউকে ও চেনে না। কিন্তু কাঁচের আয়নায় তারা নিজেদের অস্তিত্বসহ ফুটে আছে। বলছে, চেহারা দেখে চিনে রাখো। আয়নায় ভেসে আছে ছাব্বিশের হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষের মুখ। যার চেহারাটি মশিরুল কোনোদিন ভুলবে না। অবলীলায় তার চেহারার নিখুঁত বর্ণনা করতে পারবে।
দেখা যাচ্ছে নিজের বাবা-মায়ের মুখ। ওর বুঝে ওঠার বয়স থেকে যাদের চেহারা প্রতিনিয়ত দেখেছে। সেই দেখায় নিজের মুগ্ধতা ছিল বেশি। তারা বকাবকি করলে নিজের ভেতরের ক্রোধ নিয়ে দেখেছে। সে চেহারা ক্রোধের রোষে বিকৃত হয়ে যেত। মনে হতো রাক্ষসের মতো। কিন্তু এখন এ মুহূর্তে দু’জন প্রিয় মানুষকে স্মরণ করে ওর চোখে জল আসে। ও জল মোছার জন্য হাত ওঠায় না। গাল বেয়ে তা গড়ায়। ও দেখতে পায় কাঁচের দেয়ালের সবটুকু এখন নদী।
এ নদীতে ওর বাবা হারিয়েছে। খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। ও নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা ওকে কলেজে পড়ার সময় নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালীর ইতিহাস’ বইটি উপহার দিয়েছিল। সে সময়ে পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল, এই বই পড়ার মতো বিদ্যাবুদ্ধি ওর হয়নি। সুন্দর কাগজের মলাট লাগিয়ে রেখে দিয়েছিল র্যাকে। মাস্টার্স পাস করার পরে পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে ঝোঁক বাড়ে ওর। ‘বাঙালীর ইতিহাস’ বইয়ের পাতা উল্টানোর সময় পেয়েছিল ‘দেশ পরিচয়’ নামে একটি অধ্যায়। সেখানে ও পড়েছিল ‘বাংলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাংলার ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী। এই নদ-নদীগুলোই বাংলার প্রাণ; ইহারাই যুগে যুগে বাংলাকে গড়িয়াছে, বাংলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে, এখনও করিতেছে। এই নদীগুলিই বাংলার আশীর্বাদ, কখনও কখনও অভিশাপও।’ এটুকু স্মরণ করেই থমকে যায় মশিরুল। এই বই পড়ে নদী কীভাবে বঙ্গভূমি তৈরি করেছিল, বিশেষ করে ওদের বাংলাদেশ, ইতিহাসের পূর্ববঙ্গ, তা-ও জানতে পারে। বিষয়টি শুধু ওর কৌতূহল মেটায় না, জানার পরিধিও বাড়ায়। ও মনে করে, দুরন্ত আবেগ ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যে দুরন্ত আবেগ নিয়ে ওর বাবা মফিজুল নিজের দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে। ছেলেকে বলতেন, নিজ দেশের সবকিছু জানো। বিশেষ করে ইতিহাস জানো। হ্যাঁ, ইতিহাস নিয়েই তো আছে ও।
এক সময় দু’হাতে চোখের জল মুছলে কাঁচের দেয়ালে ভেসে ওঠে মাইশার মুখ। বলে, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো কেন কাকু?
মশিরুল ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, তুমি আমার মা যে?
মাইশা নিজেকে ছাড়িয়ে খানিকদূরে দাঁড়িয়ে বলে, আমি তো তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াইনি কখনো। তাহলে মা হলাম কী করে?
তুমি আমাকে ঘুম পাড়িয়েছ মাগো। তখন তো আমি অনেক ছোট ছিলাম, তাই তোমার মনে নেই।
নিজে নিজেই আবার কোলে এসে বসে বলে, তুমি এত বড় হলে, আমি বুড়ি হইনি কেন?
সেদিন হো-হো করে হেসেছিল মশিরুল। প্রাণভরা হাসি। আর মাইশা ওর কোল থেকে নেমে ছুটে গিয়েছিল শোবার ঘরে। মা, মা করে ডাকছিল নিশাতকে। নিশাত ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, আমি তোমার জন্য পুডিং বানাচ্ছি।
আমার জন্য না। বানাচ্ছ কাকুর জন্য। তবে আমিও খাব। যত খুশি তত খাব।
সেদিন মশিরুলের মনে হয়েছিল সম্পর্ক আর গড়াতে দেওয়া উচিত না। মেয়েটি খুব শার্প। বয়সের চেয়ে এগিয়ে আছে। এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে বলবে, তুমি কি নদীর কথা ভাবছ? নদী তোমার এত প্রিয় কেন কাকু?
নদী আমার বাবাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সে জন্য আমি নদীর কাছে গিয়ে আমার বাবাকে খুঁজি।
মাছেরা কি তোমার বাবার বন্ধু হয়েছে?
আমি তো জানি না।
নদীতে কি মাছেদের বাড়িঘর আছে?
আছে মামণি। নইলে ওরা কোথায় থাকবে?
তুমি দেখেছ ওদের ঘরবাড়ি?
দেখিনি, তবে খুঁজে দেখব।
আমিও তোমার সঙ্গে খুঁজতে যাব। আমাকে নেবে?
তখন নিশাত বলে, মাইশা, তোমার ছবি আঁকার খাতা নিয়ে এসো। মাছেরা কেমন ঘরবাড়ি বানাতে পারে সে ছবি আঁকবে।
আমি তো মাছেদেরকে ঘরবাড়ি বানাতে দেখিনি। কেমন করে আঁকব?
মশিরুল ওকে কাছে টেনে বলেছিল, তোমার ভাবনায় যা আসে তাই আঁক।
অ্যাকুয়ারিয়াম আঁকব?
হ্যাঁ, তাও আঁকতে পার।
মশিরুল ওকে আদর করে দিলে ও ছুটে ওর ঘরে যায়। তারপর আবার ফিরে এসে বলে, এরপর তুমি যখন নদীর ধারে তোমার বাবাকে খুঁজতে যাবে তখন আমি তোমার সঙ্গে যাব কাকু। নেবে?
নেব। একশোবার নেব।
আমি গেলে ঠিকই তোমার বাবাকে খুঁজে পাবে।
ও আবার ছুটে চলে যায়। নিজের ঘরে ঢুকে কাগজ-রঙ নিয়ে বসে। কী আঁকবে ও? মশিরুল সেদিন খুব মন খারাপ করেছিল। কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না। কেন মন খারাপ করেছিল তার কোনো ব্যাখ্যাও ছিল না। মাঝে মাঝে ওর এমনই হয়। ওর জীবনে দু’জন মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আছে। এই সময় নিশাতের সঙ্গে জটিল সম্পর্কের একটি টানাপোড়েন সময় আছে। ওর নিঃসঙ্গ থাকার সুযোগ কই? একদম নেই। ঘরে ফিরলে বই আছে। বইয়ের ভেতরে ইতিহাস আছে। পড়তে শুরু করলে নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার চমক আছে। বাড়ি ভাড়া দিয়ে মাস চলে। প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা জমেও যায়। সেসব নিয়ে উধাও হয় দেশের কোনো এলাকায়। ওর কাছে নিঃসঙ্গতা কোনো শব্দমাত্র নয়। নিঃসঙ্গতা একটি বড় ক্যানভাস। তাতে ফুটে থাকে রঙ। রঙের সঙ্গে রেখা। রেখার সঙ্গে বিমূর্ত চিত্রকলা। হাঃ, এভাবেই নিঃসঙ্গতার সঙ্গে ওর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। মাঝে মাঝে মঈন বলে, স্যার এই বাড়িতে আর কেউ আসবে না?
আসবে না কি রে? এই বাড়িতে কত লোকই তো আসে। আমার আত্মীয়-স্বজনরা আসে না? বন্ধুবান্ধব
আমি তো এনাদের কথা বলিনি।
বুঝেছি বুঝেছি। তুই চাইলে তোকে বিয়ে দেব। তারপর তোর বাচ্চাকে ঘাড়ে করে ঘুরতে যাব মহেশখালী। নইলে লালদিয়ার চরে। নাহলে থানচিতে কিংবা সাজেক ভ্যালিতে।
জানি আপনি অনেক জায়গায় ঘুরতে যেতে পারেন। আমার বাচ্চা তো আপনার বাচ্চা হবে না।
আহ্, চুপ কর মঈন। বেশি কথা শিখেছিস।
মঈন চুপ করে। নিঃশব্দ হয়ে যায় বাড়ি। মশিরুল বইয়ের র্যাকের সামনে দাঁড়ালে ভাবতে পারে এখানে কোনো নিঃশব্দতা নেই। প্রতিটি অক্ষরের শব্দ আছে। পঙ্ক্তিমালা মিছিলের মতো চলে যায়। স্লোগানের মতো তুমুল শব্দরাজি অনবরত নিজেদের জানান দেয়। এও এক ধরনের কণ্ঠস্বর। এই ধারণা বুকের ভেতরে রেখে ও ঘরে আসে। দরজাটা খোলাই ছিল। ঠেলে ভেতরে ঢোকে। ও বাইরে থাকলে মঈন দরজা বন্ধ করে না। বলে, দরজা বন্ধ করলে ভয় করে।
কিসের ভয় রে? এত বড় হয়েছিস, তোর আবার ভয় কী? এ কথার উত্তর মঈন কখনও দেয় না। ওর ভেতরে তখন নিঃশব্দ রাত আসে। আজও ঘরে ঢুকে টের পায় রান্নাঘর থেকে ওর মৃদু কণ্ঠের গান ভেসে আসছে। ও এমনই। সব সময় নিজেকে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ওর দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার সুখ অনুভব করে মশিরুল। এও তো নিজের উপভোগে বেঁচে থাকার এক রকম শর্ত। মশিরুল ডাইনিং টেবিলে বসে ওকে ডাকে।
এক গ্লাস পানি খাওয়া রে মঈন।
ও পানি নিয়ে এসে বলে, কফি বানাবো? নাকি একবারে রাতের ভাত খাবেন?
তুই কী করবি?
আপনাকে টেবিলে ভাত দিয়ে আমি সিনেমা দেখতে যাব। ফিরতে রাত হবে। আমার কাছে তো চাবি আছে। আমি আপনাকে ডাকবো না। টেরই পাবেন না যে আমি কখন ঘুরে ঢুকলাম।
তুই যদি না ফিরিস? যদি অন্য কোথাও চলে যাস তখন কে আমাকে দরজা খুলে দেবে?
মঈন চোখে ঝিলিক তুলে বলে, কেন দোতলার খালাম্মা, পুব দিকের বারান্দা থেকে ডাকলেই শুনতে পাবেন। তিনি দৌড় দিয়ে চলে আসবেন।
দৌড় দিয়ে আসবে কেন? সিঁড়িতে কি দৌড়ানো যায়?
তাহলে তিন-চার সিঁড়ি লাফ দিয়ে আসবেন। আপনি ডাকলে তিনি এভাবেই আসবেন।
মশিরুল কথা না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। এত সাবধানতার পরও ও বুঝেছে। দোতলার বাড়িতে আর কেউ নেই যে বুঝবে। ওর স্বামী কি বুঝেছে? মঈন তখন একটা ঢোক গিলে বলে, ভাত দেব স্যার?
না। খিদে লাগলে আমি নিজে নিয়ে খাব। তুই খেয়ে নে। তারপর সিনেমা দেখতে যা। কী সিনেমা রে?
নাম জানি না। হলে যেটা আছে সেটাই দেখব। আজ আমার মাথায় সিনেমার ভূত ঢুকেছে।
ঠিক আছে যা। তোকে তো আমি কোনো কিছুতেই মানা করি না রে।
এজন্যই তো আপনি আমার বাবার মতো, মায়ের মতো, ভাইয়ের মতো, বোনের মতো আমার চৌদ্দগুষ্টির মতো।
বলতে বলতে একমুখ সরল হাসি নিয়ে মঈন সামনে থেকে সরে যায়। মশিরুল টেবিলের ওপরে রাখা খবরের কাগজটা খুলে বসে। নিয়মিত ভোরবেলা কাগজ পড়ার অভ্যাস ওর নেই। যখন ইচ্ছে হয় তখন পড়ে, নইলে পড়ে থাকে। পরদিন মঈন সরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের পেছনে জমা করে। মশিরুল কাগজটা উল্টাতে উল্টাতে ভাবলো, সংবাদ ওর কাছে সারভাইভাল অব ফ্যাক্ট নয়। অজস্র ঘটনা ইতিহাসের পাতায় টিকে থাকে না। অজস্র ঘটনা ব্যক্তির জীবনকে পীড়িত করে। সেসব ঘটনা টিকে থাকে ব্যক্তির স্মৃতির পাতায়। ঘটনার বৈশ্বিক ব্যাখ্যায় বেরিয়ে আসে বিশ্বজোড়া মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণের নানা দিক। প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে পাতা ওল্টায়। তৃতীয় পৃষ্ঠায় গিয়ে একটি খবরের উপরে চোখ আটকে যায়।
মেঘনা নদী! বাবার নদী! মশিরুল কাগজটা উল্টে রাখে। গালে হাত দিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। মাথায় ঘূর্ণি। খবরের শিরোনামের দিকে তাকায়। লেখা আছে ‘মেঘনাপাড়ের আকাশে স্বজনহারাদের মাতম।’এই হেডিংয়ের নিচে ছোট হরফে লেখা হয়েছে ‘মনপুরায় ট্রলারডুবির দ্বিতীয় দিনে আরও দুই লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ পনেরো।’ পনেরো সংখ্যাটি দেখে ও। ও তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মফিজুল হককে নিয়ে যে ট্রলার ডুবেছিল সে ট্রলারের লাশ পাওয়া গিয়েছিল সাতজনের। নিখোঁজ ছিল তিনজন। ও আবার সামনে তাকায়। এভাবে একটি ঘটনা অপর একটি ঘটনাকে সংযুক্ত করে। সংযুক্তির হিসেব ধরে স্মৃতির দরজায় করাঘাত করে দুঃখের সহস্র পিঁপড়ে। ও যখন খবরটি পুরো পড়বে বলে আবার পত্রিকার পাতায় ফিরে আসে তখন মঈন সামনে এসে দাঁড়ায়।
স্যার? একবার ডেকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ও।
মশিরুল ওর দিকে না তাকিয়ে বলে, কী বলবি বল।
আমরা কবে ভোলা যাব?
সাত-আট দিন পরে।
ভোলার কোথায় যাব?
মনপুরায়।
মনপুরা! মনপুরায় আপনার বাবা যেখানে ট্রলার ডুবিতে – না, না মনপুরায় না, মেঘনা নদীতে – অনেক দূরে, সমুদ্রের কাছাকাছি
মাথা না তুলে মশিরুল আবার বলে, আমরা মেঘনা নদীতে ঘুরতে যাব মঈন। একটি ট্রলার ভাড়া করব। তুই আর আমি ট্রলার নিয়ে ঘুরব। নিজেদের ইচ্ছেমতো জায়গায় থামব। বসে থাকব, যতক্ষণ সূর্য ডুববে না ততক্ষণ নদীকে বলব, মেঘনা নদী বলে দাও কোন অতলে বাবাকে ঘুম পাড়িয়েছ।
মশিরুল সরাসরি ওর দিকে তাকায়।
আমিও আপনার বাবাকে খুঁজব। আমার মনে হয় আমি ঠিকই খুঁজে পাব। আপনি একটুও ভাববেন না স্যার। আমি এখন যাই?
মশিরুল মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয়। বলে, যা। পথে দেরি করিস না। তুই ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি জেগেই থাকব রে।
আচ্ছা, আমি সিনেমা শেষ হলেই চলে আসব। আপনি আমার জন্য একটুও ভাববেন না। মশিরুলের কানে লেগে থাকে দুইবার উচ্চারণ করা একই কথা। মায়া হয় ওর জন্য। ভাবে, সিনেমা দেখে ফিরে এলে ওকে টাকা দিয়ে বলবে, কাল তোর ছুটি। সারাদিন ঘুরে আয় কোথাও থেকে।
মশিরুল ওর দিকে তাকায় না। কথাও বলে না। ওকে শুধু মাথায় রাখে। ও ততোক্ষণে খবরের ভেতর ঢুকে গেছে। দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যায় মঈন। দরজা বন্ধের শব্দ এক ধরনের ঝমঝম ঘূর্ণির যন্ত্রণা দেয়। মশিরুলের মাথাটা বুঝি ছিঁড়েই পড়ে যাবে। আসলে শব্দ দরজা থেকে আসেনি। স্মৃতির দরজা ঘূর্ণির সৃষ্টি করেছে। ওটা মগজের ভেতরে প্রবল বেগে বইছে। তারপরও ও পত্রিকার খবরের দিকে নজর দেয় এবং প্রতিটি শব্দ ভেতরে ঢোকাতে থাকে ‘ভোলা প্রতিনিধি : ভোলার মনপুরায় মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনার দ্বিতীয় দিনে আরও দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন পনেরো জন। এদিকে মেঘনাপাড়ের আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে স্বজনহারাদের শোকের মাতম। নিখোঁজদের সন্ধানে চলছে নদীতে ট্রলার নিয়ে স্বজনের উদ্ধার অভিযান। অন্যদিকে ট্রলার ডুবে মারা যাওয়া প্রত্যেকজনের পরিবারকে বিশ হাজার এবং আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি এগারো জনের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করেছে প্রশাসন। এ ঘটনায় ট্রলার চালকের সহকারী মো. সুমনকে আটক করেছে পুলিশ।’
এটুকু পড়ার পরে খবর অন্য পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। ওকে পাতা উল্টে এগারো পৃষ্ঠার পাঁচ নম্বর কলামে যেতে হবে। ওর মনে হয় দরজার কোনো শব্দ হয়নি। সেই কত বছর আগের ট্রলারের শব্দ এখন এই ঘরে। ও নিজেও ট্রলারে করে বাবাকে খুঁজেছে। আর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর মা বিলাপ করে কাঁদছিল। তার কান্নায় মেঘনা নদীপাড়ের আকাশে মাতম ছিল। এই ঘরেও সেই মাতমের ধ্বনি। আসলে সব ধ্বনি ওর বুকের ভেতর। ও দেখতে পায় ঘরের চারদিকে কাচের দেয়াল। চারদিকের দেয়ালে মেঘনা নদী। পাড়ে ওর মা। নদীতে যে ট্রলারটি স্বজনদের খুঁজছে তার সঙ্গে ও নিজেও আছে। বাবা নদীর কথা বলতেন। পূর্ববঙ্গের নদী কীভাবে এই ভূখন্ডে পলিমাটি নিয়ে আসছে সেসব কথা বলতেন। কাঁচের দেয়ালের ভেতর থেকে বাবা ওকে নীহারঞ্জন রায়ের বই থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন, ‘এইসব নদনদী উচ্চতর ভূমি হইতে প্রচুর পলি বহন করিয়া আনিয়া বঙ্গের বদ্বীপের নিন্মভূমি গড়িয়াছে। সেই হেতু বদ্বীপ-বঙ্গের ভূমি কোমল, নরম ও কমনীয়। পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ববঙ্গের কিয়দংশ ছাড়া বঙ্গের প্রায় সবটাই ভূতত্ত্বের দিক হইতে নবসৃষ্ট ভূমি। বাংলার নদনদীগুলি ঐতিহাসিক কালে উদ্দাম প্রাণলীলায় কতবার যে পুরাতন খাত ছাড়িয়া নূতন খাতে, নূতন খাত ছাড়িয়া আবার নূতনতর খাতে বর্ষা ও বন্যার জলকে ছুটাইয়া লইয়া গিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই।’
দু’হাতে চোখের পানি মোছে মশিরুল। বলে, কোমল নরম মাটির কোন অতলে তুমি ঘুমাতে গেলে বাবা যে শেষ দেখা আর দিলে না। মেঘনা নদীর কাছে যাব। নদীতে ভাসব। তোমার শরীরের ঘ্রাণটুকু নিয়ে ফিরে আসব। আবার এই বাড়ির ঘরগুলো তোমার আর মায়ের কথা বলবে। কখনও ফিসফিসিয়ে, কখনও জোরে জোরে। যেভাবে মা কাঁদতে কাঁদতে বলতেন তোমার কথা ঠিক সেভাবেই।
মশিরুল পৃষ্ঠা উল্টে খবরের শেষ অংশ পড়তে থাকে :‘মনপুরা উপজেলার রামনেওয়াজ ঘাট থেকে শুক্রবার সন্ধ্যায় শিশুসহ দু’জনের লাশ উদ্ধার করেছেন স্থানীয় জেলেরা। সারাদিন স্বজনহারাদের দেখা গেছে ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীতে নিখোঁজদের সন্ধান করতে। নূরুন্নাহার নামের এক মহিলার আর্তনাদে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। তার দুই সন্তান রনি, জনি আর স্বামী বেল্লালসহ তিনিও ডুবে গিয়েছিলেন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করেছে। বাঁচানো যায়নি ছেলে রনিকে। রনির লাশ উদ্ধার করেছে জেলেরা। তবে এখন পর্যন্ত তার স্বামী এবং জনি নিখোঁজ রয়েছে। তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে ভোলার মনপুরার কলাতলীর চরে বোনের বিয়ে উপলক্ষে যাচ্ছিলেন। একই অবস্থা উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের বিবি হালিমা ও সাবিহা খাতুনের। অসুস্থতার খবর পেয়ে দাদিকে দেখতে আসার সময় ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে আট বছরের শিশু জান্নাত। গতকাল সন্ধ্যায় জান্নাতের লাশ উদ্ধার করেন জেলেরা। এদিকে যে ট্রলারডুবিতে এসব মানুষ মারা গেছেন, সেই ট্রলার মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলেও মামলা নিতে পুলিশ গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও গণমাধ্যমকর্মী ও স্থানীয়দের চাপের মুখে ট্রলারের হেলপার মো. সুমনকে আটক করেছে পুলিশ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ ঘটনায় মামলা হয়নি। তবে মনপুরা থানার ওসি জানান, এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
খুব মনোযোগ দিয়েই খবরটি পড়ে মশিরুল কাগজটা ভাঁজ করে নিজের পড়ার টেবিলে রাখে। ভাবে, মনপুরায় গেলে এসব পরিবারের খোঁজ করবে। কিংবা করতে নাও পারে। বরং খোঁজ করবে সেইসব পরিবারকে যারা তার বাবার সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাদের নাম-ঠিকানা লেখা আছে ওর ডায়েরিতে। কোথাও ওর বাবার কবর নেই এই সত্য মেনে নিতে পারেনি ওর মা। কবরের কাছে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়া হলো না। এমন মৃত্যু কেন হবে মানুষের? তবে ওর মা যতদিন ঠিকমতো চলাফেরা করেছে ততদিন বছরের সেই তারিখটিতে মা-ছেলে মনপুরা গিয়েছে। মেঘনা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়েছে মা। বলেছে, নদী তুই মানুষটাকে গিলে ফেললি কেন? কী অপরাধ করেছিলাম আমরা তোর কাছে? নদীরে।
মায়ের বাঁধভাঙা চোখের পানির সাক্ষী মশিরুল মা মারা যাওয়ার পরে আর তেমন করে মেঘনা নদীর ধারে যায়নি। নদী কাঁদায়-হাসায়। নদী মাছ ধরার সুযোগ দিয়ে ভাতের জোগান দেয়। চিকিৎসার পয়সা দেয়। পড়ালেখারও সুযোগ করে দেয়। নদী চলাচলের ব্যবস্থা করে। যার কাছ থেকে এতকিছু নেওয়ার আছে তার তলানিও কিছু চায় এটা মশিরুলের ধারণা। দেয়া-নেয়া সাঙ্গ করে প্রকৃতিও। আজকের খবরটিও তো তেমনই। হয় মৃত্যু, না হয় নিখোঁজ। অথবা জীবিত উদ্ধার।
কাগজটা রেখে শোবার ঘর থেকে বের হতেই শুনতে পায় দোতলার ধুপধাপ আওয়াজ। ও বুঝে যায় যে শরীফ আর নিশাত মারামারি করছে। প্রায়শ এমন ঘটনা ঘটে। সঙ্গে আছে চিৎকার এবং গালাগালি। পরে নিশাতের কান্না। সম্পর্কের টানাপোড়েনের নির্মম শব্দ ওর কানে এসে পৌঁছায়। ও দরজায় হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে পায় এক স্থবির রাত ওর চারপাশে ঘন অন্ধকার চিত্রিত করেছে। ও জানালার কাছে এসে দাঁড়ালে দু’জনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পায়। ওইসব কুৎসিত শব্দ না শোনার জন্য ও জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দেয়। ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
একদিন নিশাত ওকে বলেছিল, যতদিন তোমার জীবনে কেউ না আসবে ততদিন তুমি আমাকে আশ্রয় দাও। তোমার জীবনে কেউ এলে আমি নিঃশব্দে সরে যাব। কেউ কিছু জানবে না।
শুরুটা এমনই ছিল।
নিশাতের সঙ্গে আড়ালে-আবডালে সম্পর্ক ভালোই দাঁড়িয়েছে। শরীফ ব্যবসার সূত্রে বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে থাকে। ঢাকায় থাকলেও অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। সকাল দশটার মধ্যে বেরিয়ে যায়। বাড়িতে নিশাত মেয়েকে নিয়ে সময় কাটায়। ওকে স্কুলে দিয়ে এলে ঘরে কেউ থাকে না। আত্মীয়স্বজন মাঝে মাঝে আসে। তাতে তেমন কোনো বাধা হয়নি। দু’জনের সমঝোতার জায়গা সুযোগের ব্যবহারে গিট্টু বেঁধেছে। এবং ভালোই চলছে।
শুরুর পরিণতি অন্যরকম করে তুলতে চাইছে নিশাত। দু’দিন আগে বলেছে, শরীফের উপর প্রতিশোধ নিতে চাই। ওর সঙ্গে ঘর করে আমি তোমার কাছ থেকে একটি সন্তান চাই। মশরু, তুমি আমাকে নিরাশ করো না।
মশিরুল এমন একটি প্রস্তাবে খুশি-অখুশির দ্বন্দ্বে ছিল। খুশির কারণ ছিল, একক জীবনযাপন করার ব্রত নিয়ে একটি সন্তানের বাবা হওয়া তো আনন্দের। কোনোদিন নিশাত যদি বাচ্চাটির দায়িত্ব নিতে বলে তাহলে নেবে। খুশি হয়েই নেবে। আর অখুশি ওর কাছে দ্বিধার শব্দ হয়েছিল। কাজটি সঙ্গত কি-না সেই প্রশ্নে দ্বিধা।
নিশাত দু’দিন পরে আবার জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি তো কিছু বললে না মশরু?
আমাকে ভাবতে দাও নিশু।
আমার সঙ্গ কি তোমার কাছে আনন্দের না?
গভীর আনন্দের। যতদিন এই আনন্দ থাকবে ততদিন আমি অন্য নারীর কথা ভাবব না।
শরীফ যদি এই বাড়িতে না থাকে, তখন?
তখনেরটা তখন বুঝব। এখন ভাবব না।
সেদিন নিশাত আর কিছু বলেনি। মশিরুলের বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে বলেছিল, জীবনটা কষ্টের। অ্যাডজাস্ট না হলে তো ভালোবাসা থাকে না। ভালোবাসাহীন যৌন সম্পর্ক অবৈধ। বিয়ের স্বীকৃতি থাকলেই কি সন্তান বৈধ হয়? আমার ভেতরে অনেক প্রশ্ন মশরু।
প্রশ্ন নিয়ে জীবন কাটানোতে থ্রিল আছে। প্রশ্নহীন সম্পর্ক তো তাপহীন নিশু। আমি তো তাই মনে করছি। কিন্তু সমাজ বলে একটি ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থা মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। তাকে মেনে চলতে হয়। মানুষ তো যার যার খুশিমতো জীবন কাটাতে পারে না। তাহলে প্রবল অনাচারের সৃষ্টি হবে।
তোমার বক্তৃতা থামাও মশরু। তুমি যা বলছ এসব তো আমিও জানি। আমি কি এসব বুঝি না মনে করছ?
মশিরুল হা-হা করে হেসেছিল সেদিন।
নিশাত তর্জনী তুলে শাসিয়ে বলেছিল, হাসি থামাও। হাসছ কেন?
হাসব না তো কী করব? আমরা সবই বুঝি, আবার এসবের বাইরেও যেতে যাই। আনন্দ খুঁজি। তাই না নিলু?
খুঁজবই তো। খুঁজব না কেন? আমি কি রোবট?
মোটেই না। তুমি গতির মানুষ। গতি তোমাকে শক্তি দেয়। শক্তি তোমার ইমাজিনেশন বাড়িয়ে দেয়। তখন তুমি তীব্রগতিতে ছুটতে পারো।
আজ তোমার হয়েছে কী মশরু?
কথা কি বেশি বলছি?
তাইতো দেখছি। মনে হচ্ছে বাতাসের বেগে ছুটছে তোমার কথা।
ঠিক আছে চুপ করলাম।
আমি তোমার ঠোঁটজোড়া বন্ধ করে দেই?
দাও।
নিশাত যখন চুমুতে ভাসিয়ে দিয়েছিল আমাকে, আমার তখন বাবার বলা নদীর কথা মনে হচ্ছিল। বাবা পড়ছিলেন নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালীর ইতিহাস’। আর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আমি ‘বাংলার এই নদীগুলি সমগ্র পূর্ব ভারতের দায় ও দায়িত্ব বহন করে। উত্তর ভারতের প্রধানতম দুইটি নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বিপুল জলধারা, পলিপ্রবাহ এবং পূর্ব-যুক্তপ্রদেশ, বিহার ও আসামের বৃষ্টিপাতপ্রবাহ বহন করিয়া সমুদ্রে লইয়া যাইবার দায়িত্ব বহন করিতে হয় বাংলার কমনীয় মাটিকে। সেই মাটি সর্বত্র এই সুবিপুল জলপ্রবাহ বহন করিবার উপযুক্ত নয়। এই জলপ্রবাহ নূতন ভূমি যেমন গড়ে, মাঠে যেমন শস্য ফলায়, তেমনই ভূমি ভাঙেও, শস্য বিনাশও করে। বাঙালি ক্রোধভরে পদ্মাকে বলিয়াছে কীর্তিনাশা, পদ্মা বাঙালির অনেক কীর্তিই নাশ করিয়াছে সত্য; অথচ এই মেঘনা-পদ্মাই তো আবার স্বর্ণশস্যের আকর; এই পদ্মার দুই তীরে তো বাংলার ঘনতম মনুষ্যবসতি, সমৃদ্ধ ঐশ্বর্যের লীলা।’
মশিরুল সেদিন নিশাতকে বলেছিল, তুমি আমার নদী গাঙ্গেয় বদ্বীপ।
তাহলে আজ থেকে আমাকে বদ্বীপ ডেকো। আমি একটি ভূখন্ড হতে চাই। হাজার বছরের ইতিহাসে যে ভূখন্ড একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে।
বাহ্। বেশ সুন্দর করে বললে বদ্বীপ। থ্যাঙ্কু। এই স্বাধীন দেশের জন্য নিখোঁজ হয়েছেন একজন মানুষ। তার রক্তাক্ত শরীরটি জিপের পেছনে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল নিষ্ঠুর সৈনিকরা।
কার কথা বলছ?
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন।
ওহ, কত জীবনদান। তোমার বাবা তোমাকে যেভাবে ইতিহাস শুনিয়েছেন আমার বেলায় তা হয়নি। আমার বাড়িতে লেখাপড়া কম ছিল। টাকা ওড়ানোর নেশা বেশি ছিল। সেজন্য আমি অনেক জানাশোনা থেকে দূরে রয়ে গিয়েছি। তবে মাইশাকে আমি তোমার মতো করে বড় করে তুলব।
ভেরি গুড। তাহলে ও আমার মেয়ে হবে।
নিশাতের দৃষ্টি খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। গুনগুন করে গাইতে গাইতে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল। মশিরুলের মনে হচ্ছিল সিঁড়ির এক একটি ধাপ নিশাতের জীবনের এক একটি পর্যায়। আজ এই মধ্যরাতে ও তেমন একটি পর্যায়ে আছে। এই সিঁড়ি কীভাবে ছাড়িয়ে আর একটিতে কীভাবে পা রাখবে সেই চিন্তা এখন ওর মাথায় ঢুকেছে। মশিরুল জানে, নিশাত জেদী নারী। যা ভাবে সেটা করেই ছাড়ে। না করে ও ছাড় দেবে না।
উপরতলা নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আর কোনো শব্দ নেই। মশিরুল ফ্রিজ থেকে বিরিয়ানি বের করে মাইক্রো ওভেনে দেয়। গরম করে নিয়ে টেবিলে আসে। কোকের ক্যান ফ্রিজ থেকে বের করে আনে। সঙ্গে পুডিংও। সবকিছুই নিশাত নিজের হাতে করে। তারপর ওর জন্য নিয়ে আসে। খেতে বসে মনে হয় মঈন ফিরছে না কেন? ঘড়ি দেখে। না, সিনেমা হয়তো এখন শেষ হয়েছে। রাস্তায় কিছুক্ষণ সময় তো লাগবেই। ও ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে। প্লেট- গ্লাস ধুয়ে রাখে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে আর কিছু করার আছে কি-না। না, মঈন রান্নাঘর সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। কোথাও এলোমেলোভাবে কিছু রাখা নেই। ও সুইচ অফ করে। ডাইনিং স্পেসের বাতিটা জ্বালিয়ে রেখে বেডরুমে আসে। বেডশিট উঠিয়ে রেখে বিছানা ঠিক করে। মশারি টাঙায়। নিশাত একদিন বলেছিল, তুমি যখন বিয়ে করবে তখন নতুন একটি খাট কিনবে। এই খাটটি অন্য ঘরে নিয়ে রাখবে। আমার স্মৃতিস্বরূপ।
মশিরুল সেদিন ওকে কিছু বলেনি। এ ধরনের আবেগের সঞ্চয় ওর বাবা-মায়ের জন্য আছে। বাবার জন্য মেঘনা নদীর পাড়ে ঘুরে আসা। মায়ের কবরে যাওয়া। কবরের ধারে বসে থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কথা শোনা, যারা দু’টো টাকার জন্য ওর পেছনে পেছনে আসে। মোনাজাতের সময় ওর সঙ্গে হাত তুলে দোয়া পড়ে। যেটুকু ওদের জানা আছে সেটুকুই হয়তো পড়ে। মশিরুল জানতে চায় না যে, ওরা কতটুকু জানে। মা-বাবার কাছ থেকে যতটুকু শিখেছে সেটুকুই জানে ওরা। শুধু জানতে চায়, কী দিয়ে ভাত খেয়েছে, স্কুলে যায় না কেন। বাবা কী করে, মা কী করে। ওরা অবলীলায় নিজেদের কথা বলে। বলতে বলতে হা-হা হি-হি হাসিতে ভরিয়ে তোলে নিজেদের। কতটুকু কাক্সিক্ষত হয়ে বড় হচ্ছে, সে কথা ওদের কেউ বলে না। মশিরুল মায়ের না থাকার দুঃখ বুকে নিয়ে ওদের জন্যও দুঃখ নিয়ে বাসায় ফেরে। এ এক অন্যরকম দুঃখবোধ। ও জানে, ওর কাছে এর কোনো সমাধান নেই। সেজন্য দুঃখের মাত্রা গভীর।
বাবা যে সঞ্চয় দিয়ে গেছে তা দিয়ে ও নিজের ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করে। তাহলে ওর কৃতিত্ব কোথায়? ও নিজেকে উত্তর দেয়, ভবঘুরে জীবনে। আবারও প্রশ্ন, ভবঘুরে জীবনে তুমি নিজেকে ধরে রাখতে পারোনি। তুমি অত্যন্ত ঘরমুখী ছেলে। নিশাতের সঙ্গে সম্পর্ক তোমার যাযাবর জীবনের কথা বলে না। নিজেকে এড়াতে চেও না মশিরুল। তোমার বাবা সংসারী হয়েও তিনি যাযাবর জীবনের আচরণ করেছেন। ঘুরেছেন নদীতে, ঘুরেছেন দেশের আনাচে-কানাচে। সুযোগ পেলেই বাইরে যাওয়ার ডাক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। হাঃ, মশিরুল জীবনের পরিসর এত ছোট নয়। তোমার বোঝায় কমতি আছে মনে রেখো। ও শুয়ে পড়ে। নিজেকে এভাবে খতিয়ে দেখা ওর অভ্যেস। এটাকে ও বাবার শাসন মনে করে। এই বয়সেও বাবার শাসন ওর চাই। মাঝে মাঝে ওর এমনই হয়। জহিরুল বলে, বেশি একা একা থাকলে এমনই তো হবে। তখনও মনে মনে কাউকে না কাউকে আঁকড়ে ধরতে হয়।
মশিরুল তেড়ে উঠে বলে, তুই কি করে জানিস? তুই তো একা থাকিস না?
এসব জানতে হয় না। এসব বোঝা যায়। এ ধরনের বোঝার ইচ্ছা সব মানুষেরই থাকা উচিত।
বেশি কথা বলবি না। বানিয়ে বানিয়ে বোঝা যায়? তাহলে বলতে হবে তুই বানিয়ে বোঝার পন্ডিত। বোঝার জন্য নিজের অভিজ্ঞতা লাগে।
মারব ঘুঁষি, শালা। মানুষের মস্তিষ্ক বলে যা আছে তাকে কাজে লাগাবে না কেউ?
হয়েছে থাক। এখন তোকে কফি দেব। খেয়ে চলে যা।
ফ্রিজে কী আছে দেখব না?
না, আজ সে সুযোগ নেই। বসে থাক এখানে। কফি শেষ করে এক মিনিট থাকতে পারবি না।
রেগে আছিস কেন?
রাগ না। এটা একা থাকার হিসাব। তুই থাকা মানেই আমার একা থাকার সময় নষ্ট।
ফুস। ও কার্পেটের ওপর চিৎপটাং হয়। তারপর একটি প্রেমের গান করে। মশিরুলের মনে হয় শুনতে ভালোই লাগছে। আরও কিছুক্ষণ গান শোনা যায়। ওর গলায় সুর আছে। মশিরুল ফ্রিজ থেকে টিকিয়া বের করে মাইক্রো ওভেনে দেয়। কান পেতে জহিরুলের গান শোনে তোমাকে ভালোবেসে জীবন পাড়ি দিতে চাই। কাছে আসো বা না আসো কিছু এসে যায় না। শুনতে শুনতে মৃদু হাসে মশিরুল। এমন ভাবনা কি কোনো নারীকে নিয়ে ভাবা যায়? নাকি ভাবতে হয় আরও বড় পরিসরে যেখানে পূর্ববঙ্গের হয়ে ওঠার ইতিহাস আছে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের আত্মার ধ্বনি আছে। নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষকে খোঁজার আকাক্সক্ষা ফুরোয় না। জহিরুল এভাবে ভাবে না। ওর ভাবনায় গতি নেই, স্থবিরতা আছে। সেদিন ওকে চা আর টিকিয়া খাওয়ালে ও বলেছিল, তোর মতো বন্ধু হয় না। আসলেই কি তাই? মাঝে মাঝে নিশাত বলে, তোমার মতো প্রেমিক হয় না। আসলেই কি তাই? মঈন কখনও বলে, আপনার মতো মনিব হয় না। আসলেই কি তাই? প্রতিবেশীদের কেউ কেউ বলে, তুমি থরো জেন্টলম্যান। সবকিছু নিয়ে জীবন ভাবনায় ও কোথায় আছে তা ও ভাবতে পারে না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটে বাজে। মঈন এখনও ফিরল না। কোথায় গেল ছেলেটি? সিনেমা দেখা ওর নেশা। রাতের শো দেখতে পছন্দ করে। সময়মতো ফিরেও আসে। আজকে কী হলো ওর? মোবাইলে সময় দেখে বালিশের পাশে রাখে মোবাইল। যদি কোনো জরুরি ফোন আসে? এত রাতে অহেতুক ফোন করার কেউ নেই। নিশাতও করে না। বলে, রাতে তোমাকে ডিস্টার্ব করতে চাই না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। যেন ক্ষুদে পোকার শব্দও তোমার চেতনায় ঘা দিতে না পারে। কিন্তু ঘুম আসছে না মশিরুলের।
হলো কী? নিজেকেই প্রশ্ন করে। মাঝেমধ্যে এমন তো হয়ই। তখন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। সব ঘরের বাতি জ্বালায়। ডেক ছেড়ে দিয়ে গান শোনে। মনে হয় গান ওর কাছে মায়াবী আলো। গানের এক একটি বাণী এক একরকম রঙ নিয়ে ওর কানের গহ্বরে জ্বলে ওঠে। কোন শব্দ গোলাপি আলো হয়। কোন শব্দ সবুজ রঙ হয়। কাননের শব্দ নীল রঙ হয়। ফুল শব্দ বেগুনি রঙ হয় তখনও ‘তুমি কোন কাননের ফুল’শুনে সুরের আবেশ নিয়ে রঙের ভুবনে ঢুকে যাওয়ার মজা আছে ওর নিঃসঙ্গ জীবনের ধারাপাতে। এভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে গান শুনতে শুনতে ও সোফার ওপর ঘুমিয়ে পড়ে। তখন চারদিকে দিনের আলো ফুটি ফুটি করছে।
ঘুম ভাঙে অনেক বেলায়। দুপুর ছুঁইছুঁই সময় তখন। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। ঘরের বাতিগুলো বন্ধ করে। বাথরুমে যায়। শুনতে পায় মোবাইল বাজছে। মোবাইল অন করতেই ভেসে আসে বদরুলের কণ্ঠস্বর। বদরুল ধমক দিয়ে বলে, বারো-তেরোবার ফোন করেছি। মোবাইল ধরিস না কেন? কী হয়েছে তোর?
শেষ রাতের দিকে ঘুম এসেছে। টের পাইনি রে।
নাস্তা খেতে হবে না। এখনই মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে চলে আয়।
মর্গে? কী বলছিস তুই?
আসতে বলেছি আসবি। বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।
ফোন কেটে দেয় বদরুল। কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে ও। চারদিকে তাকায়। মঈন বোধহয় রাতে ফেরেনি। ঘরের মধ্যে ওর ফেরার চিহ্ন নেই। ও দরজা খোলার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে, তালাটা বাইরে থেকে লাগানোই আছে। তখন বদরুলের কণ্ঠস্বর ওর দু’কানে উচ্চকিত হয়ে ওঠে। ও দ্রুতপায়ে বাথরুমে ঢোকে। হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে শরীফকে ফোন দেয়। শরীফের ফোন বেজে বেজে থেমে যায়। দু’বার-তিনবার ফোন দেওয়ার পরেও যখন ধরে না, তখন নিশাতের মোবাইলে ফোন দেয়। রাতে দু’জনে মারামারি করেছে। এখন কী করছে? ঘুমাচ্ছে কী? পরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবল, নিশাত হয়তো মাইশাকে নিয়ে স্কুলে গেছে। নাকি অন্য কিছু? এইসব ভাবনার মাঝে নিশাত দ্বিতীয়বার ফোন ধরে।
মশরু আমি রাস্তায়। বাড়ি ফিরছি।
কতদূরে আছো?
বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
তোমার গলা খুব নার্ভাস শোনাচ্ছে মশরু।
গতরাতে মঈন দরজায় তালা দিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। রাতে ফিরে আসেনি। আমি ভেতরে আটকা পড়েছি।
নিশাত হাসতে হাসতে বলে, ও এই খবর। তুমি তো বন্দিজীবন ভালোবাসো। থাকো বন্ধ ঘরে। তোমার নিঃসঙ্গতা ফুল হয়ে ফুটুক।
আহ, নিশাত রসিকতা করার সময় এখন নয়। আমার বন্ধু বদরুল আমাকে মেডিকেলের মর্গে যাওয়ার হুকুম দিয়েছে। আমাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে সেখানে। তুমি এসে আমার দরজা খোল। আমি পুবদিকের বারান্দায় দাঁড়াচ্ছি। ওখান থেকে চাবি দেব তোমাকে।
আমি বাড়িতে পৌঁছে তোমাকে ফোন দেব। অপেক্ষা করো।
অপেক্ষার সময় যে এমন অনন্ত হয় তা ওর জানা ছিল না। মশিরুল পায়চারি করে। এক কাপ চা বানিয়ে চুমুক দেবে সে ইচ্ছাও হয় না। এমনকি ফ্রিজে যে খাবার আছে সেসব বের করেও খাবার ইচ্ছা হয় না। এত শৈথিল্য জীবনের বোঝাপড়ায় এমন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তা ওর জানা ছিল না। ওর প্রবল অস্থিরতায় ঘর-বারান্দা করে। ফোন আসে বদরুলের।
কী রে, বের হয়েছিস?
রাতে মঈন আমাকে আটকে রেখে গিয়েছিল সিনেমা দেখতে। তুই তো জানিস, ও প্রায়ই এমন করে। আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। ও ফেরেনি। দোতলার মিসেস শরীফ মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেছে। তাকে ফোন করেছিলাম। পথে আছে। তিনি এলেই বের হতে পারব। কী হয়েছে বলবি দোস্ত?
আয়, কথা হবে। আমি মর্গের সামনে আছি।
তুই ওখানে কী করছিস?
ফোন কেটে দেয় বদরুল। ওর আরও অস্থির লাগে। অবশ্য অস্থিরতার অভিজ্ঞতা আছে ওর। বাবা যেদিন মেঘনা নদীতে ডুবে গেল সেদিন বাবাকে খোঁজার সময় এর চেয়ে বেশি অস্থিরতা ওকে পেয়ে বসেছিল। সেই অস্থিরতার জের এখনও ওর ভেতরে তোলপাড় করে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন ওর সামনে এক একটি বিশাল অমাবস্যা।
অল্পক্ষণে নিশাত এসে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখেই চাবির গোছা দেয় মশিরুল। এতক্ষণে ওর ভেতরের কাঁপুনি থামে। নিশাত দরজা খুলে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
জানি না। ও কিছু বলছে না। যেতে বলছে। মঈনের কিছু হতে পারে কি-না ভাবছি। গেল সিনেমা দেখতে। এখন ওকে কি আমি মর্গে খুঁজতে যাব নিশু?
আমি তোমার গাঙ্গেয় বদ্বীপ। বদ্বীপের পোড়খাওয়া জীবনের সঙ্গে আর একটি ঘটনা যোগ করো না। আমি ওপরে যাচ্ছি। মর্গ শুনে আমার ভীষণ ভয় করছে।
নিশাত দ্রুতপায়ে সিঁড়ি ভাঙে। মশিরুল ঘরে তালা লাগিয়ে রাস্তায় এসে রিকশায় ওঠে। এলিফ্যান্ট রোড থেকে হাসপাতাল বেশি দূরে নয়। কিন্তু ট্র্যাফিক জ্যাম ভয়াবহ। ও ঘামতে থাকে। মঈনের বাড়ির খবর ওর জানা আছে। মা অসুস্থ। ওর বোনের কাছে থাকে। বছর দুয়েক আগে বাবা মারা গেছে। বাড়িতে তিন চাচা আছে। ওরা ওর খবর রাখে না। ঢাকা শহরে ওর কেউ নেই। মশিরুল নিজেই ওর নির্ভরতার মানুষ। মর্গ মানে মৃত্যু। যদি ওর তেমন কিছু হয় তাহলে কী করবে? মা তো ঢাকা শহরে আসতে পারবে না। বোনও না। বোনের স্বামী তাজুল যদি আসতে চায় তাহলে? মশিরুল আর ভাবে না। বিষণœ বোধ করে। ওর নিজের জন্যও দুঃখ হয়। ও নিজেই বা কাকে অবলম্বন করবে। একজন মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। তাকে আপন করে নেওয়াও সহজ নয়। সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগে। নানাকিছু ভাবনার মাঝে ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটে রিকশা থেকে নামে। দ্রুতপায়ে মর্গের দিকে এগোলে দূর থেকে দেখতে পায় বদরুলকে। আমগাছের নিচে বসে আছে বদরুল। ও কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কেন এখানে ডেকেছিস?
মঈন কি বাড়িতে আছে?
কাল রাতে সিনেমা দেখতে বেরিয়েছিল। আর ফিরেনি। ওর জন্য রাত জেগে ছিলাম বলে ঘুম ভাঙতে বেলা হয়েছে। তুই ওর কোনো খবর জানিস? তুই এখানে এসেছিস কেন?
আমার এক আত্মীয় অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে এসেছি। যিনি মারা গেছেন, উনি ওর চাচাশ্বশুর।
পোস্টমর্টেম হয়েছে তার?
হচ্ছে। সে জন্য বসে আছি। আর বসে আছি তোর জন্যও।
মঈন কি মর্গে?
হ্যাঁ। একজনকে দেখতে এসে দু’জন মানুষকে দেখা হলো মর্গে। যা দেখে আয়।
ও এখানে কেন?
কেন, তা পরে জানবি। আগে দেখে আয় ওকে।
তুইও আমার সঙ্গে চল।
না, না, আমি আর যেতে পারব না। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। তুই ঘুরে আয়।
মশিরুল মর্গের ভেতরে ঢোকে।
মশিরুল নঈমের লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
মশিরুল ওর রক্তাক্ত শরীর দেখে আঁতকে ওঠে।
মশিরুল দু’হাতে মুখ ঢাকলে শরীরে কাঁপুনি ওঠে।
মশিরুলর সামনে রক্তাক্ত মৃত নঈম একটি মৃত নগরী হয়ে যায়। ওর বুকের ভেতর অজস্র শব্দরাজি ধিক্কারে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ওর একজন বড় মানুষের কথা মনে পড়ে যে মুহূর্তে তুমি তোমার নীতি ও মূল্যবোধ বিসর্জন দাও, তখনই তুমি একজন মৃত মানুষে পরিণত হও। তখন তোমার সংস্কৃতি মৃত হয়ে যায় এবং তোমার সভ্যতাও।
একটি সরল, সাধারণ তরুণকে যারা মেরে ফেলে, সে শহরে মৃতের সংখ্যা বাড়ে। সে শহরে জীবিতরা মৃত শহরের মানুষ হয় এবং শহরের কোনো প্রাণ থাকে না।
মশিরুল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
পেছন থেকে বদরুল এসে ওর ঘাড়ে হাত রাখে। বলে, আয়। আমাদের জীবনে এ দেখার শেষ থাকবে না।
আমার তো জানতে হবে, ওর কী হয়েছিল।
চল ডিউটি ডাক্তারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, কে ওকে এখানে এনেছে। পুলিশ না সাধারণ মানুষ।
দু’জনে ইমার্জেন্সির ডিউটিরত ডাক্তারের কাছে আসে।
বদরুল বলে, আমার এক আত্মীয় দুর্ঘটনায় মারা যায়। পোস্টমর্টেমের জন্য তার লাশ মর্গে আছে। মর্গে গিয়ে আমি আর একটি লাশ দেখি।
একটি ছেলের লাশ? নাম পরিচয়হীন?
হ্যাঁ, ছেলেটি ওর ঘরের ছেলে।
মশিরুল গলার স্বর কঠিন করে বলে, আমি জানতে চাই ও কীভাবে এখানে এলো।
কাল রাতে আমি তো ডিউটিতে ছিলাম না। তাই আমি ঠিক জানি না। আমি রেজিস্টার দেখে বলছি।
ডাক্তার রেজিস্টার খুলে দেখেন। বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশ হিসেবে ও রেজিস্টারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পুলিশ ওকে এখানে এনেছে। কোথায় ছিল কাল রাতে, আপনারা সেখানে গিয়ে খোঁজখবর করুন। তারপর থানায় গিয়ে ডায়েরি করবেন।
মশিরুল নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। ভেজা কণ্ঠে বলে, আমি ওর লাশ দাফন করতে চাই।
ময়নাতদন্তের পরে আপনি লাশ পাবেন। ওর ছবি এবং বাবা-মায়ের নাম-ঠিকানাসহ কাগজ আনুন, আমি লাশ রিলিজের ব্যবস্থা করে দেব।
মশিরুল হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বলে, তুই ওকে এখানে না দেখলে আমি জানতেও পারতাম না যে কোথায় গেল। ও আমার কাছে নিখোঁজ মঈন হয়ে থাকত। জীবনভর আমি ভাবতাম কোনোদিন না কোনোদিন ও আমার কাছে আসবে। বলবে, আমি মেঘনা নদীতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। একজন জেলে আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি পথ খুঁজে পেয়ে আপনার কাছে এসেছি স্যার।
বদরুল ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলে,তুই এতটা ভেঙে পড়বি তা আমি ভাবিনি রে।
ঠিক আছে। আমি যাই। সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দেখি কী হয়েছে তা জানতে পারি কি-না। আমি যখন ওকে আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাব, তখন কিন্তু তুই আমার সঙ্গে থাকবি বদরুল।
না রে, তা পারব না। আমাকে তো আমার আত্মীয়ের লাশের সঙ্গে তেঁতুলিয়া যেতে হবে। পোস্টমর্টেমের অপেক্ষায় আছি।
ওকে। আমি যাচ্ছি।
মশিরুল রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। সিনেমা হল তো এখন বন্ধ। অন্যদের পাওয়া যাবে না। দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। কী এমন ঘটনা ঘটল যে, নঈমকে এভাবে মরে যেতে হলো? মশিরুলের ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। কখনও মনে হয় শহরটা মেঘনা নদী। কখনও মনে হয় শহরটা একটা কবরস্থান। এখানে কোনো জীবিত মানুষ নেই। হলের সামনে এসে রিকশা থেকে নামলে বুঝতে পারে, গত রাতে এখানে একটা কিছু হয়েছে। চারদিকে ভাংচুরের ফলে বেহাল অবস্থা। ও সামনে এগিয়ে কোনায় বসে থাকা পানের দোকানদারের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, এই হলে কাল রাতে একটি ছেলে সিনেমা দেখতে এসেছিল। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি।
পান দোকানদার খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলে, কত বড় ছেলে? বয়স কত?
সতেরো-আঠারো বছর বয়স হবে।
সর্বনাশ! তাহলে তো সেই ছেলেটাই হবে।
কোন ছেলে! আপনি দেখেছেন ওকে?
সন্ত্রাসীরা ওকে পিটিয়ে মেরেছে।
তখন হলের আরেক পাশ থেকে এগিয়ে আসে একজন। জিজ্ঞেস করে, আপনি কে?
আমি একটি ছেলেকে খুঁজতে এসেছি। পান ভাইয়ের কাছ থেকে খবর শুনেছি। কী হয়েছিল ওর?
দু’জন সন্ত্রাসী ভিড়ের মধ্যে একজন মহিলার গলার চেন ছিঁড়ে নিয়েছিল। আরেক জনের কানের দুল। তারা চিৎকার করে উঠলে আপনার ছেলেটি একজনকে জাপটে ধরে। ও কাছেই ছিল। তখন অন্য সন্ত্রাসী ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বুকের ওপর লাত্থি মারে। মাথায়ও। সিনেমা হলের অন্য দর্শকরা সন্ত্রাসীদের ধর ধর করে চিৎকার করে উঠলে ওরা পালিয়ে যায়। অন্যদিকে দর্শকদের মধ্যে শুরু হয় হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি। ছেলেটি আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। আমি দেখেছি, ওর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। ততক্ষণে পুলিশের গাড়ি আসে। কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। সবাই সরে যায়। আমি নিজেও সিনেমা হলের ভেতরে ঢুকে গেটে তালা আটকে রাখি। পুলিশের ভয়ে করি।
এটুকু বলে দারোয়ান থেমে যায়। পান দোকানদারও কথা বলে না। মশিরুল বুঝতে পারে, ওদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তারপর পান দোকানদারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনিও কি ছেলেটির মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে দেখেছেন?
হ্যাঁ দেখেছি। ওহ, আল্লাহরে
মৃদু আর্তনাদ দু’জনের কণ্ঠ থেকেই বেরিয়ে আসে। মশিরুল মৃদুস্বরে বলে, মানুষের শুভবুদ্ধি লোপ পেলে শহর তো মৃত হয়ে যাবেই।
ছেলেটি আপনার কেউ হয়, ভাইসাহেব?
আপনজন।
আপনার বাসায় থাকত বুঝি?
হ্যাঁ। আমার ঘরের একজন ছিল।
আহা রে, সোনার ছেলে ছিল!
খুব সাহসী। ওর সাহস দেখে অবাক হয়েছি।
শক্ত করে জাপটে ধরেছিল।
এখন ও কোথায় আছে?
মর্গে।
মরে গেলে তো মর্গেই থাকবে। ওর মুখে কি রক্ত লেগে আছে?
আছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দু’জন সাধারণ মানুষ নিজেদের উৎকন্ঠা অন্যভাবে প্রকাশ করে। বলে, ভাইসাহেব ওর ডান হাতটা মুচড়ে দিয়েছিল। হাতটা কি বাঁকা হয়ে আছে? হাতটা কি ভেঙে গেছে?
মশিরুল হঠাৎ করে রেগে উঠে বলে, জানি না। তোমরা মর্গে গিয়ে ওকে দেখে আস।
ভাই সাহেব, ওর কবর কোথায় হবে?
আজিমপুর কবরস্থানে। গণকবর। গরিব মানুষের কবর যেখানে হয়।
দারোয়ান বলে, আমি ওর কবর দেওয়ার সময় থাকব। আপনার ফোন নম্বরটা আমাকে দেবেন?
হ্যাঁ, নিন। বিকেলের দিকে আমাকে ফোন দেবেন।
ফোন নম্বর দিয়ে আবার রিকশায় ওঠে মশিরুল। বাড়িতে গিয়ে ওর ছবি আর অন্য কাগজপত্র গুছিয়ে নেয়। ফ্রিজ খুলে ভাত আর মাছের তরকারি বের করে ওভেনে দেয়। এখন কিছু না খেলে সারাদিন খালি পেটে থাকতে পারবে না। শারীরিক সমস্যা হবে। সব গুছিয়ে বের হওয়ার সময় দেখা হয় নিশাতের সঙ্গে। ও মাইশাকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরেছে। জিজ্ঞেস করে, আবার কোথায় যাচ্ছ? তুমি না একটু আগে ফিরলে?
আগে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। এখন যাচ্ছি মর্গে।
আবার মর্গে? ব্যাপার কী? তুমি না মর্গ থেকে এলে?
মঈনকে ওখানে পাওয়া গেছে। আমি ওকে দেখে এসেছি।
কি দেখেছ? মঈনের লাশ?
হ্যাঁ, তাই। মর্গে তো জীবিত মানুষ থাকে না।
ডোমরা থাকে। তারা জীবিত মানুষ। জীবিত মানুষের কথাও মনে রাখা দরকার।
মনে রেখো ডোমরা টেবিলে শুয়ে চিৎ হয়ে থাকে না। এভাবে কথা বলে আমার সময় নষ্ট করো না। ও মাইশার মাথায় হাত রেখে বলে, যাই মামণি।
টা টা কাকু। কাল আমার স্কুলে স্পোর্টস হবে। দৌড়ে আমি ঠিকই ফার্স্ট হবো।
খুব ভালো। তোমাকে কংগ্রাচুলেশনস মামণি। তোমার ইচ্ছা সফল হোক।
নিশাতের সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে দ্রুত পায়ে রাস্তায় এসে রিকশা ধরে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে গিয়ে জানতে পারে, পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে। প্রহারে মৃত্যু হয়েছে বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে ডাক্তার। প্রহার? পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে যে মারা যায় তাকে একটি শব্দ দিয়ে কি ব্যাখ্যা করা যাবে? মশিরুল রেগে উঠতে চায়, পারে না। মশিরুল থানায় যেতে চায়, পারে না। এখন ওকে গাছপালায় ভরা সেই কবরস্থানে যেতে হবে, যেখানে প্রিয়জনের কবর বলে চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। আবার সেখানে অন্য কাউকে কবর দেওয়া হবে।
ও একটি ভ্যানগাড়ি জোগাড় করে মঈনকে কবরস্থানে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এখন পর্যন্ত ছেলেটি ওর কাছে মঈনই। এখন পর্যন্ত ও ওকে লাশ বলে উল্লেখ করতে পারেনি। ডেডবডি বলবে কি? যে প্রাণ হারায় তার বডিকে তো ডেডই বলা হয় আর একটি ভাষায়। তফাত তো কিছু নেই তাতে। ওর নিজের ওপর করুণা হয়। ঘটনাটি মানতে না পারায় নিজে এখন দিকহীন নাবিক। বুঝতে পারছে না কী করবে! চাটাইয়ে মুড়িয়ে মঈনের লাশ ভ্যানগাড়িতে তোলা হয়। ও একটি রিকশা নেয়। ফোনে দারোয়ান হামিদকে কবরস্থানে আসতে বলে। তারপর ফোনটা বন্ধ করে পকেটে রাখে। বাকি সময় ও মঈনের জন্য রাখে। ভাবে, কারও সঙ্গে কথা না বললে ওর আত্মা খুশি হবে। বলবে, দেখ, স্যার আমাকে কত ভালোবাসে। পরক্ষণে মনে হয় ওর বোনের হাজব্যান্ডকে খবরটা দেওয়া দরকার। ফোনের সুইচ অন করে ফোন করে তাজুলকে।
আমি ওকে নিয়ে কবরস্থানে এসেছি তাজুল।
ভাইসাহেব, আপনি যা করার করেন। আমরা তো কিছু করতে পারব না। আমার শাশুড়িকে আমি খবরটা বলিনি। বউকেও না। ও জানুক যে, ওর ভাইটা নিখোঁজ। ওদের খোঁজ-খবর নেয় না।
কেন এমন চিন্তা মাথায় এলো আপনার?
মরে গেছে বললে তো সব আশা ফুরিয়ে যাবে। নিখোঁজ বললে পথ চেয়ে বসে থাকবে। ভাববে, একদিন না একদিন ফিরে আসবে ভাইটি।
আমার মনে হয়, কাজটি ঠিক হবে না। ওর জন্য দোয়া পড়তে হবে। মা আর বোন বাড়ির ছেলেটির জন্য দোয়া করবে না।
আমিতো সবই বুঝি ভাই সাহেব। কিন্তু আমার শাশুড়ির অবস্থা বেশি ভালো না। ছেলে মরে গেছে শুনলে তিনিও বাঁচবেন না।
ঠিক আছে, আপনি যা বোঝেন করেন। আমি আপনার শাশুড়ির জন্য মাসে মাসে টাকা পাঠাবো। তার চিকিৎসা করাবেন। আপনার স্ত্রীকে বলবেন তার যত্ন নিতে।
আচ্ছাভাই সাহেব। মেয়ে ছাড়াতো এখন আর তার কেউ থাকল না। আপনি ভালো থাকবেন। আপনার পাঠানো টাকা পেলে তিনি মনে করবেন তার ছেলে বেঁচে আছে।
আপনি একটু সময় নিয়ে তাকে মৃত্যুর খবর দেবেন। আমি আপনার কথা মানতে পারছি না।
ঠিক আছে ভাইসাহেব। আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। খোদা হাফেজ।
মশিরুল ফোনের সুইচ অফ করে। বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত এখন ওর পুরো সময় মঈনের জন্য। ও আর কাউকে মনে করবে না। ওর সামনে কেউ থাকবে না। কবরস্থানের গেটে এসে রিকশা থামে। ভ্যানগাড়ি আগেই এসে পৌঁছেছে। কবরস্থানের লোকরা ওকে ধোয়ানোর জায়গায় নিয়ে গেছে। ভ্যানচালকের ভাড়া দিয়ে ওকে বিদায় করে। কাফনের কাপড়সহ অন্যান্য সামগ্রী কেনার জন্য লোকদের টাকা দেয়। কবর খোঁড়ার জন্য লোকেরা তৈরি। কবরের স্থান ঠিক করা হয়েছে। একটি শিউলি গাছের নিচে ওর কবর হবে। কবে, কোনো সময়ে কেউ প্রিয়জনের স্মরণে গাছটি লাগিয়েছিল। এখন ওই গাছটির ফুল ফোটার বয়স হয়েছে। শরৎ এলে ওই কবরে সাদা ফুল বিছিয়ে থাকবে। কমলা রঙের বোঁটায় কবরের ঔজ্জ্বল্য বাড়বে। সেদিন এসে ও জিজ্ঞেস করবে, মঈন ভালো আছিস তো? ভেসে আসবে ফুলের গন্ধ। সেটিই হবে ওর উত্তর। মশিরুল চোখ মোছে।
তখন সিনেমা হলের দারোয়ান হামিদ আসে।
মশিরুল ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, আসুন।
আপনি চলে আসার পরে আমি ওর জন্য কোরআন তেলাওয়াত করেছি। ও একটি ভাগ্যবান ছেলে। আপনি ওর লাশের দাফন না করলে ও বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যেত।
থাক, এসব কথা।
আপনাকে না দেখলে আমি তো ওর জন্য দোয়া পড়তাম না। মোনাজাত করতাম না। এই কবরস্থানে আসতাম না।
আপনি তো ওকে সামনাসামনি আহত হতে দেখেছেন।
আপনার সৌভাগ্য যে, এমন একটি দৃশ্য আপনাকে দেখতে হয়নি।
হ্যাঁ, এটা আমার সৌভাগ্য হামিদ সাহেব।
মশিরুলের মনে হয় ও অকারণে নিজেকে সান্তনা দিচ্ছে। সান্তনার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। তারপরও একটি মৃত্যু, কবরস্থান, ওর জন্য একজন অপরিচিত লোকের মায়া, শিউলি গাছের নিচে কবর পাওয়া সব মিলিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন ছবি ওর সামনে ভেসে ওঠে। ও কবর খোঁড়া দেখার জন্য এগিয়ে যায়। সামনে তাকালে ওর সামনে এখন সবকিছু মেঘনা নদী। ও নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
মঈন নামের ছেলেটি এখন ভেসে যাবে মেঘনা নদীতে। ও ফিরে আসে গেটে। হামিদকে বলে, আপনি আমার এই ছেলেটির মৃত্যু দেখেছেন। ওর জন্য কোরান তেলাওয়াত করেছেন। ওর জন্য জানাজা পড়বেন। আমি এখন যাই।
আর কিছুক্ষণ থাকেন। আপনি না থাকলে ওর আর কেউতো থাকলনা।
আমি আর পারছি না। সারা দিন এতকিছু দেখে আমার অনেক ক্ষয় হয়েছে। ওর শান্তির জায়গাটা আপনার কাছে থাকুক। মঈনের আপনজন হিসেবে আপনি ওর কবরে দোয়া পড়বেন।
আমি কালকে আসব। অনেকক্ষণ বসে দোয়া পড়ব।
ঠিক আছে যান। বাকি সব কাজ আমি করব।
মশিরুল গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায়।
বুঝতে পারে ওর ভেতরে কাঁপুনি।
মশিরুল আকাশের দিকে তাকায়।
বুঝতে পারে ও বাড়ির পথ ভুলে যাচ্ছে।
ওর কষ্টের তোলপাড়ে ভেঙে যাচ্ছে বুকের দু’পাড়।
ও একটি রিকশায় ওঠে। বিড়বিড়িয়ে বলে, তোকে আমার মেঘনা নদীর পাড়ে নেওয়া হলো না। আমি তো মনপুরা যাব। বাবার ডাক শুনতে পাচ্ছি। বাবা বলছে, ‘মেঘনা সম্বন্ধে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত। খাসিয়া-জৈন্তিয়া শৈলমালা হইতে মেঘনার উদ্ভব, কিন্তু উত্তর-প্রবাহে মেঘনা সুরমা নামেই খ্যাত এবং এই নামটি প্রাচীন। সুরমা শ্রীহট্ট জেলার ভিতর দিয়া মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ মহকুমার পূর্বসীমা স্পর্শ করিয়া ভৈরব-বাজার এক সময় ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হইত। সুরমা যেখান হইতে পশ্চিমাগতি ছাড়িয়া দক্ষিণাগতি লইয়াছে, সেখান হইতে মেঘনা নামও লইয়াছে। এই নদীপথের উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয় নাই। মেঘনার প্রবাহের দুই তীরে সমৃদ্ধ জনপদের পরিচয় চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতার বিবরণেই পাওয়া যায়।’
বাসায় পৌঁছানোর জন্য রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বলতে হয়। এলিফ্যান্ট রোডে ওর বাড়ির ঠিকানা চেনা সহজ, কিন্তু ভুল হয় নিজেরই, অন্যমনস্ক থাকার কারণে ভুল।