১
আমি আরিফুর রহমান। বয়স চুয়াত্তর।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে জীবন কাটিয়েছি। রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার সাধনার জায়গা। জীবনভর মনে করেছি যে আমি একটি কাঁচের ঘরে বাস করেছি। যেদিকে তাকিয়েছি সেদিকেই দেখেছি নিজের চেহারা। কখনো সে চেহারা খুব অন্তরঙ্গ মনে হয়েছে। কখনো একদমই অচেনা। যেন অন্য কেউ আমারই সবটুকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো মনে হয়েছে যে ঘরকে আমি কাঁচের ঘর মনে করেছি, সেটা আসলে কোনো ঘরই নয়। সে এক বিশাল প্রান্তর। ঘরবাড়ি, হাটবাজার, পথঘাট, নদী, হাজার হাজার মানুষ নিয়ে আমার জীবনের চারদিকে ছড়িয়ে আছে। আর আমি নিজেকে সর্বত্র হেঁটে যাওয়ার জন্য তৈরি করেছি।
শিক্ষকতা পেশায় আমি পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়েছি। এখন অবসর জীবনে আছি। আমি জানি পেশা থেকে অবসর নিলেই অবসর জীবনে ঢোকা হয় না। অবসর কখনো ঘাড়ের ওপর বোঝার মতো চেপে বসে। এই মুহূর্তে আমি আমার ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় বসে আছি। যে ইজিচেয়ার এখন আমার দখলে এটি আমার প্রিয়। বেশ প্রিয়। যথেষ্ট পুরনো হয়েছে। প্রায় একত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। কিন্তু বসতে আরামদায়ক লাগে দেখেই ফেলে দেইনি। কখনো সখনো কোনো ঘটনা বা বস্তু এভাবে আঁকড়ে থাকে মানুষকে। এভাবে আমি দর্শনের ধারণায় নিজের ভেতরে বোধের বলয় তৈরি করি। ভাবি, যে জীবন কাটিয়েছি তার সবটুকু নিয়ে হেঁটে যাব সামনে। পিছুটানের স্বর্ণলতা ভরে নেব আমার সঞ্চয়ের ঝুলিতে।
দক্ষিণের বারান্দায় এলেই আমার ভেতরে দার্শনিক চিন্তা কাজ করে। আমি অনবরত খুঁজতে থাকি জীবনের জন্য অর্থবহ পরিসর। পরিসর আমার জন্য ব্যাপ্ত চিন্তা। এখন খোঁজাই আমার নিয়তি। আমি হারিয়েছি অনেক। হারিয়েছি ডালিয়াকে। গত পাঁচ বছর ধরে ডালিয়া আমার সামনে থেকেও নেই। আমি তো অনবরত সেই ডালিয়াকে খুঁজেছি যাকে একদিন ভালোবাসার কথা বলেছিলাম। ও মৃদু হেসে বলেছিল, জানতাম তুমি একদিন আমাকে তোমার জীবনের প্রিয় কথাটিই বলবে।
কি করে জানলে?
তোমার চোখের ভাষা আমাকে বলে দিয়েছিল। মানুষ কীভাবে চোখের ভাষা তৈরি করে তা আমাকে অনেক দিন ভাবিয়েছে। সেদিন থেকে আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম তোমার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য।
আমি অবাক হয়ে ডালিয়ার দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখেছিলাম ডালিয়ার নিজের চোখের দৃষ্টি আশ্চর্য উজ্জ্বল। আমার মুগ্ধতার শেষ ছিল না সেই দৃষ্টির জন্য। এখন ওর চোখ আছে, কিন্তু দৃষ্টি নেই। আমি তো এক পথিক। অনবরত পথ চলি। আমি কোথাও দাঁড়াই না। ডালিয়ার বোজা চোখেও আমার দেখার কিছু আছে। ফেলে-আসা জীবনের ছবিগুলো আমি বুজে থাকা চোখের পাতায় দেখতে পাই। তখনই বুঝতে পারি আমার স্বপ্ন ফুরিয়ে যাবার নয়।
গত পাঁচ বছর ধরে আমি ওর বোঁজা চোখ দেখি। যেদিন থেকে ও চোখ বুঁজেছে সেদিন থেকে আমি ওর দৃষ্টি খুঁজে বেড়াই। খুঁজি এই বাড়ির সবটুকু জায়গাজুড়ে। এই বাড়ির বয়স এখন ছাব্বিশ বছর। এক বিঘা জমির ওপর বাড়ি। শোবার ঘরটি অনেক বড়। আলো-বাতাসের অভাব নেই। রোদ এসে ভরে যায় ঘরে। ডালিয়া সুস্থ থাকতে পর্দা সরিয়ে ঘরের সব জানালা খুলে রেখে বলতো, দেখো রোদ-বাতাসের লুকোচুরি। আলোর ছায়ায় জীবনচুরি।
আমি হেসে বলতাম, জীবনচুরি কি?
সবকিছু কি অর্থ মিলিয়ে বলি নাকি? যা মনে আসে তাই বলি। হাসিতে গড়িয়ে পড়ত ডালিয়া। ওর হাসিতে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ত ঘরে। আমি বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলতাম, প্রেমের হাসি এমনই সুন্দর। যেন আমি একটা বিশাল তিমি। হাসির সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি।
বাব্বা, কবি হতে বাকি নেই তোমার।
আমি চোখ বড় করে বলতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অর্থনীতি পড়াই। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি।
এটাও কবিতার মতো করে বললে। ডালিয়া আবার বাঁধভাঙ্গা হাসিতে ভেঙে পড়তো। হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলতো, আমাদের জীবন কবিতা লেখার খাতা। এখানে দুঃখের কবিতাও লেখা হবে। শুধু আনন্দের না।
কথা বলে ওর সঙ্গে জেতা আমার জন্য কঠিন ছিল। আমি ভেতরে ভেতরে চেষ্টা করেছি। ওকে বুঝতে দেইনি। তারপরও দেখতাম ও যা বলে সেটা সুন্দর। আমার কথা আড়াল হয়ে যায়। সেদিন ও বলেছিল, দুঃখেরও কবিতা লেখা হবে। আমি এখন সেই দুঃখের কবিতায় আছি।
এই বড় আকারের শোবার ঘরে ডালিয়া এখন একা শুয়ে আছে। বাড়িতে আরও তিনটে বেড়রুম আছে। দু’টোয় থাকতো আমার দুই ছেলেমেয়ে। আর একটি অতিথিদের জন্য। ছেলের ঘরটিতে আমি থাকি। মেয়ের ঘরটি ফাঁকা। ছেলে ভ্যাঙ্কুবারে থাকে। মেয়ে সুইডেনে। দুজনেই চাকরি করে। দু’জনেই বিয়ে করেছে। মেয়ের স্বামী বিদেশি। ওদের ঘরে চারজন নাতি-নাতনি আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার ভালো থাকার কথা ছিল। আমার ভালো থাকা হয়নি। ডালিয়াকে খুঁজে ফিরে আমি সময় কাটাই। এক আশ্চর্য সময়! আমি জানি সময়ের পথঘাটে আমার ক্লান্তহীন পথযাত্রায় আমার অজস্র সঙ্গী আছে। জোনাকির আলো যেমন আছে, তেমন আছে পূর্ণিমা। আমি সবটুকু আমার সঞ্চয়ের ঝোলায় রাখি।
আমার জীবনে এমন আশ্চর্য সময় অনেকবার এসেছে। সময়ের চিন্তায় আমি ড্রইংরুমে আসি। আমিতো আমার সময়কে বাজিয়েছি – খুঁজেছি হারিয়ে যাওয়া মানুষকে। আমি সঙ্গীত শিল্পী আলতাফ মাহমুদের ছবির সামনে এসে দাঁড়াই। না, ছবিটা ওর একার নয়। সঙ্গে আমিও আছি। ও আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। আমাদের যৌবনের শুরুর সকালটি ছিল জীবনের এক আশ্চর্য সময়। যৌবনে আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। সেই সময় আমার সামনে স্থির হয়ে আছে। সহস্র মুক্তোর মালায় জড়িয়ে আছে সময়। শুধু খুঁজে পাই না আলতাফকে। খুঁজতে থাকি অনবরত।
ড্রইংরুমে চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি আমার সময় এখন কাঁচের দেয়াল। দেয়ালজুড়ে ফুটে আছে আমারই চেহারা। চোখে চোখ পড়লে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছ?
ভালো নেই। আমি মাথা নাড়ি।
ভালো থাকার উপায় খোঁজ।
কত আর খুঁজব। খুঁজতে খুঁজতে জীবনের শেষ সীমায় এসেছি।
উপায় খোঁজাই বেঁচে থাকা।
উপদেশ দিচ্ছ?
যদি মনে করো উপদেশ, তাহলে তাই। এই শর্ত তুমি মানতে পার, নাও পারো।
আমি চেঁচিয়ে বলি, মানি না। মানি না।
আমার চিৎকারে মুখের ভঙ্গি বদলে যায়। চোয়ালের হাঁড় উঁচু হয়ে ওঠে। দাঁত বেরিয়ে পড়ে। জিহ্বা দেখা যায়। ঘরের চারদিকে কুৎসিত একটা কিছু যেন ভেসে উঠেছে। আমি নিজেকে করুণা করি এবং ঘৃণাও। চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে আমার মাথা ঝিম মেরে যায়। আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ি। নিজের দিকে তাকাতে আমার ভয় করে। আমি এক ভয়ঙ্কর প্রাণী বুঝি। আমার খোঁজার প্রহর কাটে না। আমি ডাইনোসরের সময়ের মানুষ হয়ে যাই। আমি নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি।
বুঝতে পারি ডালিয়া এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। বলছে, ওঠো। আমার হাত ধরো। চলো আমরা পটুয়াখালির তালতলির বৌদ্ধ মূর্তিটি দেখে আসি। অসাধারণ সুন্দর বুদ্ধকে দেখে তোমার বেঁচে থাকার স্বপ্ন ফুল হয়ে ফুটবে। ভাববে জীবনের সঞ্চয়ে ধুলো জমে না। সেদিন রাখাইনরা একটি অপূর্ব অনুষ্ঠান করেছিল। জল ছিটিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করেছিল। অনুষ্ঠান শেষে তুমি আর আমি চারদিকে ঘুরছিলাম। দেখেছিলাম রাখাইনদের ঘরবসতি। কি সুন্দর যে লেগেছিল। চলো আমরা আবার সেখানে যাই।
আমি ডালিয়াকে বলি, ডালিয়া আমাদের সময় কি ফুরোয়নি?
না, আমাদের সময় কোনোদিন ফুরোবে না। আমরা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের গর্তগুলো বুঁজিয়ে দেবো।
আমরা চাইলেও তা পারবো না। ফাঁকি দেয়ার চিন্তাকে আমি ঘৃণা করি ডালিয়া।
আমার কান্না ফুরোয়। শুনতে পাই মৃদুকন্ঠের ডাক, নানাভাই।
আমি দু’হাতে চোখ মুছে ওর দিকে তাকাই। ওর হাতে ঝাড়– এবং ন্যাকড়া। ও রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। যখন সময় পায় তখন এসে আমার ঘরগুলো পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।
আজও আমার দিকে তাকিয়ে বলে, নানাভাই ঘর ঝাড়– দিমু? কোন ঘর আগে?
ও প্রতিদিন এমন একটি প্রশ্ন আমাকে করে। আমার মনে হয় এটাও ওর খোঁজা। ডালিয়ার অসুস্থতার পরে আমি ওকে কাজের জন্য ডেকে এনেছি। বলেছি, যখন খুশি আসবি। যেভাবে কাজ করতে ভালোলাগবে সেভাবে করবি। শুধু ঘরগুলো পরিষ্কার থাকা চাই। কাজ করার এই স্বাধীনতা পেয়ে ও খুশি। বলেছিল, কি মজা যহন খুশি তহন কাম করমু। এইডা মোর আরামের চাকরি। ওকে স্বস্তি দিতে পেরে আমার মনে হয়েছিল ও আমার খোলা প্রান্তরের এক বালিকা যে একদৌড়ে পার হতে পারে সে প্রান্তরের পুরোটা। ছুঁতে পারে দিগন্ত। কেন ওকে নিয়ে এমন ভাবনা আমার মনে হয়েছিল তার কোনো সূত্র খুঁজে পাইনি আমি।
আবার শুনতে পাই ওর কন্ঠস্বর। মনে হয় ও যেন প্রান্তরের কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদূর থেকে আমার সঙ্গে কথা বলছে।
নানাভাই কোন ঘর আগে? আপনে মোর কথা কি হুনতে পান না?
তোর কথা তো শুনতে পাচ্ছি রে মেয়ে। তুই রায়নার ঘরে যা। আমার মেয়ের ঘর আগে ঝাড়– না দিলে আমার শান্তি লাগে না।
ওই ঘরে অনেক মাকড়সা। ওই ঘর ঝাড়– দিতে মোর ডর করে।
মাকড়সা কোথায়? আমিতো মাকড়সা দেখতে পাইনা।
সারা ঘরে মাকড়সা আছে। কোনহানে যে মাকড়সা নাই তা কইবার পারুম না।
চল তো দেখি। তুইতো আমাকে নতুন কথা শোনালি।
আমি ওর সঙ্গে রায়নার ঘরে আসি। কতদিন যে আমি রায়নার ঘরে ঢুকিনি তা আমার মনে নেই। আসলে তা নয় এই ঘরে তো আমি রোজই ঢুকি। তবে কেন এমন হয়, ওর ঘরে ঢুকলে আমি ওকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু কোথাও ওকে পাই না। উল্টো আমার বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ হয়। আমি জানি ও আমার কাছে নেই। দূর দেশে আছে। চাকরি করছে। বিদেশি ছেলেকে বিয়ে করে ঘর-সংসার করছে। দু’টি সন্তানের মা হয়েছে। তারপরও আমার কেবলই মনে হয় আমি ওকে হারিয়েছি। আমার সামনে ওর শৈশব আর কৈশোর আছে। আর কিছু নেই। এই ফুল বিক্রি করা মেয়েটির নাম বেলি। আমি ওকে বেলফুল ডাকি। কারণ ওকে দেখে আমার রায়নার কৈশোর দেখা হয়। রায়নাকে ফুল বিক্রি করতে হয়নি। ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। বিদেশে গিয়ে পিএইডি করেছে। এখন সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। বেলির মধ্যে ওর কৈশোর খোঁজার বিষয় জানতে পারলে আমার মেয়ে চিৎকার করে বলবে, তুমি আমাকে অপমান করছ বাবা। একটা পথের মেয়ের মধ্যে আমার কৈশোর খুঁজছ? তোমার মাথায় কি গোলমাল হয়েছে বাবা?
হ্যাঁ, তাইতো। আমার মাথায় গোলমাল হয়েছে কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়। আমি জানি আমি সুস্থই আছি। আমি যে কোনো মেয়ের মাঝে আমার মেয়ের কৈশোর খুঁজতে পারি। আমার সামনে শ্রেণি-বৈষম্যের ভেদরেখা ঘুচে যায়। আমি মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য দেখতে চাই না। আমি এই আদর্শ নিয়ে বড় হওয়া চিন্তাকে খুঁজে ফিরি। বুঝতে পারি চারদিকের সবখানে মাকড়সার বাসায় ভরে আছে। ওদের বাসাগুলো এক একটি গোলকধাঁধাঁ।
আমি বেলফুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, মাকড়সাকে তোর ভয় লাগে কেন রে নাতনি?
আমি কইতে পারুম না। আমার মা যেদিন গাড়ির তলে পইড়া মইরা গেল তখন মা রে দেইখা মনে হইছিল, মা একডা মাকড়সা হইয়া গেছে। ছোডবেলা থাইকা আমি মাকড়সা দেইখলে চিল্লাইতাম।
আমিও মাকড়সা দেখলে ভয় পাই রে বেলফুল।
আপনে ভয় পাইবেন ক্যান? আপনে তো আমার মতো ছোডু না। আপনে অহন খালার ঘরে চলেন।
আয় দেখি। ভাবি, মাকড়সা আমার সঞ্চয়ের ঝুলিতে আছে। বাসা বানিয়ে বাচ্চা ফোটাচ্ছে। আমার পায়েও মাকড়সা বাসা বানিয়েছে। সোনালি আলোয় ঝকঝক করছে মাকড়সার নকশি-ঘর।
আমি ওর সঙ্গে রায়নার ঘরে সামনে গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে তাকিয়ে দেখি ঘরটা গোছানোই আছে। শুধু দেয়ালের এককোণায় একটি ছোট্ট মাকড়সার জাল ঝুলছে। কোথাও আর কিছু নেই। আমি ফুলবিক্রি মেয়ের দিকে তাকাই। বলি, বেলফুল আয়।
ও ঝাড়– বুকে চেপে ধরে নিজেকে সামলায়। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢোকে। দ্রুত ঘর ঝাড়– দেয়।
আমি বলি, ওই কোণায় মাকড়সার জাল আছে। ভেঙে আয় বেলফুল।
মুই পারুম না। মায়ের গালে ঝাড়– লাগাইতে পারুম না। ওইডাতে মোর মরা মা।
তাহলে ঝাড়–টা আমাকে দে। আমি ওর হাত থেকে ঝাড়ু নিয়ে দেয়াল থেকে মাকড়সার জাল পরিষ্কার করি। আতঙ্কিত মেয়েটি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ওর হাতে ঝাড়– ফেরত দিতে গেলে ও বলে, ঘর তো সাফ হয় নাই নানাভাই। মাকড়সার বাসাতো সারা ঘরে আছে।
কই, আমিতো আর দেখছি না। কি বলিস তুই?
আমিতো দেহি। সবখানে আছে। খাডে, টেবিলে, আলমারিতে, আলনায়। কোনহানে নাই?
আমি ওর মাথায় হাত রেখে বলি, তোর খিদে পেয়েছে বেলফুল?
হ,পাইছে। সকাল থাইকা কিছু খাই নাই। কেউ তো মোর খাঅনের খোঁজ লয় না।
আয় আমার সঙ্গে। দেখি ফ্রিজে কি আছে।
ফ্রিজ খুলে ভাত আর গরুর মাংস পাই। একটি থালায় ভাত-মাংস নিয়ে ওকে বলি, ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে আয়। রান্নাঘরের ওই পিঁড়িতে বসে মনের আনন্দে খাবি। মনে কোনো দুঃখ যেন না থাকে।
চোখে পানি থাকব না?
চোখের পানি? হ্যাঁ, চোখে পানি রাখতে পারিস, যদি তা খুশির পানি হয়।
আচ্ছা। ও খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে দৌড়ে বাথরুমে যায়। আমার বুক চেপে আসে। আমি রান্নাঘরে ঢুকি। পানি খাই। ডালিয়াকে স্যুপ খাওয়াতে হবে। স্যুপ তৈরির উদ্যোগ নেই। পাঁচ বছর ধরে ঢাকা শহরের আত্মীয়-স্বজন ডালিয়ার জন্য স্যুপ বানিয়ে পাঠায়। হঠাৎ করে কেউ না পাঠাতে পারলে সেদিন আমি করি। তারপর নলে ঢেলে ওকে খাওয়াতে হয়। হায় ডালিয়া, তুমি এমন করে আমার সামনে থেকে নিখোঁজ হয়ে যাবে? এ কেমন ভালোবাসা বুকে নিয়ে তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলে? আমার চোখে পানি আসে। আমি মুছি না। চোখের পানি গড়াতে দেই। হাত ধুয়ে রান্নাঘরে ফিরে আসে বেলফুল। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, নানাভাই আপনের চোখে পানি ক্যান?
আমি ওর দিকে তাকাই না। ও আবার ডাকে, নানাভাই। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বলি, কি বলবি বল।
আপনের চোখের পানি খুশির না দুঃখের নানাভাই?
দুঃখের। আমি এবারও ওর দিকে তাকাইনা।
আপনে মোর চোখে খুশির পানি রাখতে কইছেন। তাইলে আপনের চোখে দুখের পানি ক্যান?
আমার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে ও বলে, নানির লাইগা? নানি যে মইরাও বাঁইচা আছে হের লাইগা?
তুই ভাত খেয়ে নে বেলফুল। আর কথা বলবি না।
আইচ্ছা। ও থালা নিয়ে মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে। ওর আনন্দ আমাকে তোলপাড় করে। মাত্রতো এক থালা ভাত! যেন এটুকুই ওর এই জীবনের সঞ্চয়। ও জমিয়ে রাখবে সারাজীবন।
ভাত খেয়ে ও আমাকে বলে, আইজ আমি নানির নলের মদ্যে সুপ দিমু। দিমু তো নানাভাই?
না। তোর কাজ ঘর পরিষ্কার করা। তুই যে কাজের জন্য এই বাড়িতে আসিস সেটাই করবি।
হ, তাইতো। অহন কোন ঘর ঝাড়– দিমু?
তোর মামার ঘর। ভাত খেয়ে পেট ভরেছে?
হ, ভরছে। ও বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়। থালা ধুয়ে এক কোণায় রাখে। এই একটি থালা আলাদা করে রাখা আছে ওদের তিনজনের জন্য। যে ছেলেটি রাস্তার ধারে বসে জুতো সেলাইয়ের কাজ করে ও আমার বাজার করে। যে ছেলেটি রাস্তায় ঝাড়– দেয় ও আমার গাড়ি পরিষ্কার করে। আর পাশের বাড়িতে কাজ করে যে মহিলা সে সন্ধ্যায় এসে আমার রান্না করে দেয়। এভাবে আমার রাতদিনের কাজের হিসাব চলে। আমিতো বেশ আছি। অকস্মাৎ হা-হা হাসিতে আমি চারদিক ফাটিয়ে দেই। বেশ মজা পাই। বেলফুলের হাত থেকে মেলামাইনের থালা পড়ে যায় বেসিনের উপর। ও দ্রুত উঠিয়ে রেখে বাইরে চলে যায়। বুঝতে পারি আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস ওর নেই। আমি চুলো থেকে প্যান নামিয়ে রাখি। আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে ভাবি সব কষ্ট পুড়িয়ে দাও আমার। যদি পোড়ানোর সাধ্য না থাকে তবে দাউদাউ জ¦লো কেন আগুনের পরশমনি! আমি আমার মন তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। পুড়িয়ে দগ্ধ করো। আমি মন নামের এক টুকরো কয়লা নিয়েই বাঁচতে চাই। বেঁচে থাকার অর্থতো আমার ফুরিয়েছে। আমি চুলো বন্ধ করি। এখন আমার ডালিয়ার কাছে যেতে হবে। ওকে পরিষ্কার করতে হবে, কাপড় বদলে দিতে হবে।
শুনতে পাই বেলফুল চিৎকার করছে, নানাভাই নানাভাই।
আমি ইশতিকের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, কি হয়েছে বেলফুল?
খাডের নিচে একডা বড় ইঁন্দুর। কেমুন কইরা যেন চাইয়া রইছিল।
তুই ওটাকে মামা ডাকবি।
মামা? বেলির কান্নাভেজা চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়।
হ্যাঁ, মামা। ও তোর ইশতিক মামার ঘরে থাকে। তোর মামাকে ভালোবেসে।
ইন্দুর মামা হয় ক্যামনে? ও আল্লাহরে -। আমি আর এই বাসায় কাম করুম না। আগে তো এই বাসায় মাকড়সা আর ইন্দুর আছিল না। আইজ ক্যান এমুন লাগতাছে।
ও ঘরের ভেতর লাফালাফি করে। আমার মনে হয় ইশতিক ওর কৈশোর নিয়ে এই ঘরে এসেছে। বড় অল্প সময়ের জন্য। আমি বেলফুলকে দেখি। ও ছেলে না মেয়ে তা আমি চিন্তায় রাখি না। শুধু এক আশ্চর্য সময় আমার সামনে।
এক কিশোরীর মাঝে আমি খুঁজে বেড়াই আমার জীবনের এক ক্ষুদ্র অংশ – যেখানে গোলাভরা শস্য ছিল। শস্যের দানা খাওয়ার জন্য ইদুঁরের ঘোরাফেরা ছিল। আর ইদুঁরের খেয়ে-যাওয়া শস্যদানার খোসার ভেতর জড়ো হয়ে গেছে হারানো সময়। আমি হল অফ মিরর এফেক্টে একজন ধ্যানমগ্ন সত্তা। অন্তহীন জিজ্ঞাসায় নিমজ্জিত জীবন। আমি বেলফুলের হাত ধরে বলি, আজ তোর ছুটি। বাড়িতে যা।
ও ঘরের মধ্যে ঝাড়– ফেলে একছুটে বেরিয়ে যায়। আমি ওকে ডেকে বলতে পারি না যে ঝাড়–টা জায়গা মতো রেখে যা। ও যেভাবে ঝাড়–টা ছুঁড়ে ফেলে দৌড় দিল সেটা আমর সামনে এক অন্যরকম দৃশ্য। ওর চলে যাওয়া উপভোগ করি। ঝাড়ি– উঠিয়ে বারান্দায় রেখে আসি। তারপর আমি এসে দাঁড়াই ডালিয়ার বিছানার কাছে। ওকে একজন সন্ত নারীর মতো লাগছে। গায়ে সাদা রঙের চাদর। দু’চোখ বোঁজা। শ্বাস পড়ছে। আমি চাদরের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা ডান হাত ধরি। বলি, ডালিয়া চোখ খোল। ভোর হয়েছে।
যৌবনে আমরা এভাবে একজন আর একজনকে ডাকতাম। যেদিন ওর আগে ঘুম ভাঙতো সেদিন ও জানালার পর্দা সরিয়ে বলতো, দেখ আলো ফুটেছে। ওঠো সোনাপাখি। ময়ূর আমার।
আমাকে নতুন নতুন নামে ডাকার জন্য ও অনেক পাখির নাম মুখস্ত করেছিল। এক একদিন এক এক নামে ডাকতো। আমি ওকে ডাকতাম নদীর নামে।
আজও ওর হাতে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললাম, ওঠো আমাজন নদী। দেখো রেইন ফরেস্টের মাথায় আলো ছড়িয়েছে।
ওর হাত ধরে বসে রইলাম। কোথাও কোনো শব্দ নেই।
এমনতো কথা ছিল না ডালিয়া যে তুমি আমার সঙ্গে পাঁচ বছর তিন মাস কথা বলবে না। চোখ খুলে তাকাবে না। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলবে না, শোন গুণগুণ ধ্বনি। তুমি বলো আমার এই ধ্বনি কখনো গানের চেয়েও বেশি মধুময় লাগে। হায় ডালিয়া নিজের সবটুকু নিয়ে তুমি এখন আড়াল হয়ে আছ। তোমার নিশ্বাসটুকুই আমার শেষ অবলম্বন। নিশ্বাস-প্রশ্বাস আমার কাছে এখন এক অলৌকিক আনন্দ। এই আনন্দ নিয়ে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। বুঝতে পারি বেঁচে থাকার সৌন্দর্য কোথাও কোথাও প্রতিটি মানুষের জন্য খানিকটুকু থেকে যায়।
তুমি কতদিন আমাকে বলেছো, আমরা আজ রাতে ঘুমুবো না। তুমি গান করবে আমি শুনব। আমরা কেউই ঘড়ির দিকে তাকাব না। ঘুমে ঢলে পড়ব না। বিষখালি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রক্তাভ আকাশের সূর্য ওঠা দেখব। হায় ডালিয়া, তুমি এখন এসব স্মৃতির বাইরে। বেঁচে থাকার নিষ্ঠুর বিপর্যয়ে আমার দিন এমন কুঁকড়ে যাবে, কি করে মেনে নেই তা -।
শুনতে পাই দরজায় কেউ টুকটুক শব্দ করছে। হয়তো কাজের লোকের কেউ এসেছে। জুয়েল আসতে পারে। এখন ওর বাজার করে দেয়ার সময়। জুয়েল রাস্তার ধারে বসে জুতো সেলাইয়ের কাজ করে। আমার বাজার করার কাজ পেয়ে ও বেজায় খুশি। খুশিতে আটখানা বলা যায়। মাস গেলে বেতন পায়, আবার বাজারের দরদামের হাত সাফাইতো আছেই। আমার এই একা দিনযাপনে খুঁটিনাটি এইসব কিছু আমাকে মেনে নিতে হয়। আমি বেঁচে থাকার শর্ত হিসেবে মেনে নিয়েছি। বড় বেশি সাহসী জীবনযাপন। সাহস এই অর্থে যে আমি বাঁচা-মরার আর কোনোকিছু পরোয় করছি না।
বেলটা জোরে জোরে আরও কয়েকবার বাজে। ডালিয়ার হাতটা চাদরের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি দরজা খুলতে আসি। জুয়েলই এসেছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে স্যার?
কিছু হয়নি তো। তোর কেন মনে হলো যে কিছু হয়েছে?
আপনার শরীর ভালো আছে?
ভালোইতো আছি। তুইতো আমাকে কালও দেখে গেলি। আমাকে দেখতে খারাপ দেখাচ্ছে?
হ্যাঁ, কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে যে মানুষকে রোজ দেখি আজ আপনি সেই মানুষ না।
আমি হা-হা করে হাসি। প্রাণখুলে হাসি। হাসতে হাসতে ওকে ঈশারায় ভেতরে ডেকে দরজা বন্ধ করে দেই। হাসি থামিয়ে বলি, আমার হাসিও কি অন্যরকম লাগছে?
ও ঘাড় কাত করে বলে, হ্যাঁ। একদমই অন্যরকম লাগছে।
তাহলে তুই ভুল করে অন্য বাড়িতে ঢুকে পড়েছিস জুয়েল। ভেবে দেখ ঠিক বাড়িতে এসেছিস তো?
আমি ঠিক বাড়িতেই এসেছি। আমার কোনো ভুল হয়নি।
তাহলে বাড়ির মানুষটাকে বেঠিক লাগছে কেন?
লাগছে সেটা জানি। কেন লাগছে জানি না। আজকে কি বাজার করব স্যার? কি মাছ আনব? নাকি মুরগি?
ম্যাডাম কি খাবে জিজ্ঞেস করি। তুই বোস। ম্যাডামের খাবার মেনুটা জানতে হবে না।
ম্যাডাম? জুয়েল বিস্ফারিত চোখে তাকায়। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে যাই। তাইতো, আমি কি বললাম ওকে? কত বছর আগে এমন করে কথা বলতাম! এখন কি তেমন করে কথা বলা যায়। হায়, আমার কি হবে! এমন ভুল বারবার করলে লোকে আমাকে পাগল বলবে।
ম্যাডামের স্যুপ আনতে হবে স্যার?
অনেক কিছুই লাগবে। তুই বোস আমি রান্নাঘর দেখে তোকে স্লিপ দেব।
ততক্ষণে আমি মামা আর খালার ঘরদু’টো ঝাড়– দেই? বেলি আমাকে ঝাড়– দিতে বলে গেছে।
ওর আজ কাজ করতে ভয় করছিল।
ওর কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না। আজ ওর কি হয়েছে কে জানে? অন্যদিন তো এমন করে না। তাই ও ভয়ের কথা বলেছে। আপনাকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছে। জুয়েল ফিক করে হাসে।
বেশ দুষ্টু হয়েছে তো? আর আমি বুঝতেই পারিনি। আমি ভাবলাম মেয়েটার হলো কি? এক মুহূর্ত থেমে আমি বলি, তবে ওর বুদ্ধি আছে। ঘটনাটা ভালোই সাজিয়েছে। মেয়েটা লেখাপড়া শিখলে ভালো করবে। আহা রে, ওকে যদি আমি স্কুলে ভর্তি করাতে পারতাম!
স্যার আমি ঘর ঝাড়– দিতে যাচ্ছি। মুছেও দেব। বেলি করেনি বলে ভাববেন না যে আপনার আর কেউ নেই।
আচ্ছা। আমি ঘাড় নেড়ে সায় দেই। বাজারের তালিকা করতে করতে বারবারই বেলির কথা মনে হয়। মেয়েটির কল্পনাশক্তি আমাকে অভিভূত করে। আমার মতো বয়সী মানুষকে একদম ঘায়েল করে ফেলেছে। আমি ধরতেই পারিনি। আবার কাজটা যাতে হয় সেজন্য জুয়েলকে করতে বলে গেছে। ফাঁকিবাজির জায়গাটাকে অ্যাড্রেস করেছে ও। আমি খুব খুশি হই। ভেবে দেখি কৈশোরে রায়নার এমন দুষ্টু বুদ্ধি ছিল না। ও মেধাবী শান্ত মেয়ে ছিল। তাহলে বেলফুল সময়ের সুযোগ নিতে শিখেছে। চারপাশ থেকে শিখতে পারছে। বাহ, এটাও দারুণ। আমি স্লিপ হাতে ড্রইংরুমে আসি। বুঝতে পারি বেলফুলের সুগন্ধ আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে। ওর বুদ্ধিমত্তা এবং নিখুঁত পারফরম্যান্স আমাকে মোহিত করে রেখেছে। বেঁচে থাকার তাড়না কি ওকে এমন কৌশলী হতে শিখিয়েছে? তাই হবে। রায়নার সামনে বেঁচে থাকার তাড়না ছিল না। নিজের বোঝা ওকে টানতে হয়নি। বরং বাড়তি পাওয়ায় পূর্ণ ছিল ওর কৈশোর। আমি বাজারের স্লিপ হাতে বসেই থাকি। আলমারি থেকে টাকা বের করতে যাই না। আমার বসে থাকতে ভালোলাগছে। আমার সামনে উড়তে থাকে সময়ের মেঘরাজি। আমি সেই মেঘরাজিতে খুঁজতে থাকি আমার কৈশোর। কোথাও খুঁজে পাই না। আমি একজন বয়সী মানুষ আমার কৈশোর হারিয়ে ফেলেছি। আমার বুকের ভেতরে ধুপধুপ শব্দ হয়। আমি নিজের বুকের শব্দ নিজেই কান পেতে শুনি। একসময় মনে হয় ভালোলাগছে শুনতে। যেন আমার সামনে কোনো এক ঢাকী ঢোল বাজাচ্ছে। কৈশোরে ঢোলের শব্দ শুনে বুঝতে পারতাম আজ উৎসব। পুজোর উৎসব। প্রতিমা গড়া শেষ হয়েছে। আশ্চর্য, আমার কৈশোর ফিরে এসেছে। হুররে, আমি হাতে ধরা কাগজটি ঘরের ভেতরে উড়িয়ে দেই। বলি, যাও মেঘরাজি ছুঁয়ে এসো।
কাজ শেষে সামনে এসে দাঁড়ায় জুয়েল।
ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে ঢাকা শহরের রাস্তায়। একদিন ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। স্যান্ডেল খুলে ওকে দিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কতক্ষণ লাগবে? ও গালভরা হাসিতে আমাকে মাতিয়ে দিয়ে বলেছিল, তিন সেকেন্ড।
তিন সেকেন্ড? কি রে মিছে কথা শিখেছিস কেন?
মিছে কথা না। আমি এভাবেই কথা বলি।
কে শিখিয়েছে?
ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছে।
বাবার নাম কি?
সুরেন দাস। পেশায় মুচি। নিখুঁতভাবে জুতো সেলাই করে।
সুরেনের ছেলে জুয়েল। আমি দ্বিধা নিয়ে ওর দিকে তাকাই।
বাবা আমাকে রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ন্যাকড়ায় পেঁচিয়ে কেউ আমাকে ফেলে দিয়েছিল। বড় হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি আমার নামের শেষে দাস লিখতে দাও না কেন? বাবা বলেছিলেন, কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের ধর্ম আমি জানব কি করে সেজন্য তুই শুধু জুয়েল। আমার মানিক। তোর মায়ের বুকের ধন। আর তোর দুই দিদির ছোট্ট সোনা।
সেদিন ওর একটানা কথা আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ও আমার সামনে একটি স্কুল। ও নিজে একটি প্রতিষ্ঠান। এবং এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার কোনো সীমা টানা নেই।
শুনতে পাই ও মৃদুস্বরে ডাকছে আমাকে।
স্যার। স্যার। স্যার। স্যার। স্যার –
বেশ লাগছে শুনতে ওর কন্ঠস্বর। আমি কান পেতে শুনি। যেন এই মুহূর্তে ও আমার ছাত্র। ক্লাশভরা ছাত্রছাত্রী নেই। বড় ঘরটায় ও একাই ছাত্র। একসময় ওর দিকে তাকিয়ে বলি, তোর বাবা তোকে লেখাপড়া না শিখিয়ে জুতো সেলাইয়ের কাজ শিখিয়েছে কেন রে?
লেখাপড়াতো শিখেছি। ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত। এর বেশি আমি পড়তে চাইনি। বাবাকে বলেছি জুতা সেলাইয়ের কাজ শিখব।
কেন? জুতো সেলাইয়ের কাজ কেন?
বারে আমি তো বাবার ছেলেই হতে চেয়েছি। যার কেউ নেই তার একটা ঠাঁই হলেই হয়। বেশি কিছুর দরকার নেই। যার ঘরে বড় হয়েছি তার সবকিছুই আমার। বুড়ো হলে যখন মরব তখন সবাইকে বলে যাব আমাকে যেন চিতায় পোড়ানো হয়। বাবার ধর্মই আমার ধর্ম।
তুই একটা দারুণ ছেলে জুয়েল। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, নইলে এতকিছু আমার জানা হতো না। এখন থেকে তোকে আমি স্যার ডাকবো।
ছি, ছি কি যে বলেন স্যার। এখন আবার আপনাকে আমার অন্যমানুষ লাগছে। এমন মানুষ আমি কখনো দেখিনি। পথেই তো থাকি। কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ আপনার মতো না।
ওদের সঙ্গে তো তোর অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়। তাদের চিনবি কি করে? আমার সঙ্গে তোর রোজ দেখা হয়। কাজের বাইরে অন্য সময়ে ডাকলেও তুই আসিস। ঘরের ছেলের মতো হয়ে গেছিস।
হ্যাঁ, এই বাড়িটা আমার দ্বিতীয় ঘর। বেঁচে থাকার শুরুতে ঘর পেয়েছিলাম। মায়ের আদর, দিদিদের যত্ন সব পেয়েছি। এখন আপনার কাছ থেকে শেখার জায়গা পেয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি। আমি পৃথিবীর ভাগ্যবান ছেলে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় একটি ঘোড়া পেলে পৃথিবী ঘুরে আসব। এটুকুই আমার সাধ।
কোথা থেকে এসেছিস তা জানার ইচ্ছা হয় না?
একটুও না। ওদের কথা ভাবলে আমার ঘেন্না হয়। আমার তো মনে হয় আমি একটা শেয়ালের পেটে জন্ম নিয়েছিলাম।
শেয়ালের ওপর তোর রাগ হলো কেন রে?
জানি না। এমনি মনে হলো। কথার কথায় শেয়ালের নাম এসেছে।
মানুষের কথা মনে হলো না কেন?
মনে হয়। ওদেরকে আমি হারামি ভাবি।
সব মানুষ খারাপ হলে তোর বাবা পেতি কোথায়?
আমার বাবা দেবতার মতো মানুষ। একটু থেমে আবার বলে, আপনাকেও আমার দেবতার মতো মানুষ লাগে।
কেন রে? আমার ভেতরে কি পেলি?
আপনি মানুষকে ভালোবাসেন। আপনি তো আমাকে রাস্তা থেকে ডেকে এনেছেন। কাজে লাগিয়েছেন। বিশ্বাস করেন। আমার উপর নির্ভর করেন।
তোকে আমার দরকারে এনেছি। তুই আমাকে সাহায্য করবি সেজন্য ডেকেছি।
তা ঠিক, কিন্তু খারাপ ব্যবহার করেন না। আদর করেন। আর আপনি মাঝে মাঝে এত অনেকরকম মানুষ হয়ে যান যে সেটা আমার খুব ভালো লাগে। আপনার ভেতরে অনেক রকম মানুষের ছায়া আছে।
ভয় করে না আমাকে? মনে হয় না এখানে থেকে পালিয়ে যাই?
না, একদম মনে হয় না। আমার যখন বিয়ে হবে তখন আমার বউকে বলব, আপনার সব কাজ করে দিতে। খালাআম্মার দেখাশোনা করতে।
তুই কবে বিয়ে করবি জুয়েল?
জুয়েল লাজুক হেসে বলে, জানি না। আমার বিয়ের কথা এখনো ভাবিনি।
তোর বউ কি তোর বাবা ঠিক করবে?
জানি না। বাবা যদি কাউকে বিয়ে করতে বলে আমি রাজি থাকব। বাবার কথার উপর আমার কথা নাই। আপনি যদি একটি মেয়ে দেখেন তাও আমি রাজি হব।
মেয়ের খোঁজার ইচ্ছে তোর হবে না?
ও লাজুক হেসে মুখ নিচু করে বলে, হবে হয়তো। কাউকো তো পছন্দ হতেই পারে।
কথা শেষ করে ও মেঝে থেকে বাজারের স্লিপটা তুলে নেয়। লম্বা স্লিপ হয়েছে। অনেক কিছু কিনতে হবে। ও স্লিপের দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো পড়ছে। অনেক সময় হাতের লেখা বুঝতে কষ্ট হয়।
আমি আবার মৃদুস্বরে ওকে ডাকি, জুয়েল।
ও আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, স্যার।
তোর কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়নি?
এখনো হয়নি। তবে হয়তো অল্পদিনে হবে। বাবাকে সে মেয়ের কথা বলব। বাবা কি বলে তা শুনব। আমি জানি বাবা-মা দুজনেই আমার পছন্দ মেয়ে নেবে।
তোর বিয়ের আয়োজন আমার বাড়িতে করব।
ও জোরের সঙ্গে বলে, না। কখনোই না। এ বাড়িতে বিয়ে হবে না।
কেন? কেন না করছিস? এ বাড়ির খারাপ কি হয়েছে?
এ বাড়িতে একজন মরা মানুষ আছে। জুয়েল এবারও চেঁচিয়েই বলে।
কি বললি মরা মানুষ? কি বললি তুই? ডালিয়া মরা মানুষ –
আমি উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াই। থরথর করে আমার শরীর কাঁপে। আমি পা বাড়াতে পারছি না। ওকে কষে দু’টো থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে। ও দু’পা পিছে সরে গেছে। খোলা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো ভাবছে, আমি তাড়া করলে দৌড়ে পালাবে। ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে, শুধু নিশ্বাস পড়লেই মানুষ বেঁচে থাকে? এমন বেঁচে থাকা আমি চাই না। এইটা কোনো জীবিত মানুষ হলো?
হারামজাদা। ফের যদি এই কথা বলবি –
আমার যে মাকে আমি দেখিনি সেও আমার কাছে মরা মানুষ।
তুইতো তাকে নিশ্বাস ফেলতে দেখিস না শয়তান। সে তোর সামনে নাই।
ওই একই কথা। থাকা না থাকা দিয়ে কিছু আসে যায় না।
কখনোই একই কথা না।
আমার যা মনে হয়েছে তা আমি বলেছি।
তোকে একটা কথা বলি শোন, তোর খালাআম্মা যতদিন নিশ্বাস ফেলবে ততদিন আমি তার পাশে থাকব। যত্ন করব। স্যুপ খাওয়াব। মনে করব বেঁচে আছে।
জুয়েল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার দিকে তাকায় না। আমি ঘরে গিয়ে বাজারের টাকা আনি। টাকাটা ওর হাতে দিয়ে বলি, সবসময় মন ভালো রাখিস। মানুষকে দেখতে হয় বুকের চোখ দিয়ে। যেমন তোর বাবা তোকে দেখেছিল। তার বুকে চোখ ছিল বলেই তুই তার আদর পেয়েছিলি।
ও ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, আমার বুকের ভেতর চোখ নাই।
চোখ জন্মের সময় থাকে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বানাতে হয়। আমি তোকে চোখ বানাতে শেখাব। শিখবি তো? মানুষের চোখ মানুষই বানায়। শুধু শিখতে হয়।
ও চুপ করে থাকে। মুহূর্ত সময় মাত্র। তারপর ঘাড় নেড়ে বলে, যাই। ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, শিখব। আমি চোখ বানানো শিখব।
কতক্ষণ লাগবে বাজার করতে?
তাড়াতাড়ি আসব। ও ফিক করে হেসে বলে, স্যার আপনার জন্য কাজ করতে আমার ভালোলাগে। মাস শেষে টাকা নেই অভাবের জন্য। এই টাকা দিয়ে বাবার জন্য ওষুধ কেনা হয়। এটাই কি বুকের চোখ স্যার?
আমি মাথা নাড়ি। ওর কাঁধে হাত রাখি। পিঠ চাপড়ে দেই।
আমার চোখটা আরও বড় বড় করতে হবে। অনেক বড়। আমার মা ও দিদিদের দেখতে হবে। বেলিকে দেখতে হবে। আরও অনেককে দেখতে হবে।
হ্যাঁ, এভাবে সবাইকে দেখতে শেখা খুব দরকার।
আমি আপনার কাছ থেকে দেখতে শিখতে পারব। আমার বুকে দুইটা চোখ থাকবে না। হাজার হাজার চোখ থাকবে।
আমি হা-হা করে হাসি। ও লজ্জা পায়। ওর অনুভবে আমি খুব আনন্দ পাই। পথের ধারের একটি ছেলে আমার কাছ থেকে শিখতে পারছে। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষার্থী না। ও জীবিকার অর্থনীতি শিখছে। কার্ল মার্কস আমার গুরু। আমি মার্কসীয় দর্শন ওকে কীভাবে শেখাব। সেটা হবে না। ওর চারপাশ থেকে অর্জিত জ্ঞান ওর অভিজ্ঞতার ঘরে অনবরত জমা হবে।
স্যার টাকা! ও হাত বাড়ায়।
ও, হ্যাঁ। এই নে। স্লিপ দেখে কেনাকাটা করবি। ভুল হয় না যেন। আজকে বাজার একটু বেশিই হবে।
সবই ঠিকঠাক মতো আসবে স্যার। আপনি ভাববেন না। এখনতো নেইলা বুয়া আসবে খালাআম্মার কাপড় ধোয়ার জন্য।
ওহ্, তাইতো। ঠিক আছে তুই যা।
আমি দরজা বন্ধ করে দ্রুত ডালিয়ার বিছানার পাশে আসি। নিষ্পাপ শিশুর মতো দু’চোখ বন্ধ করা ডালিয়া আমার সামনে এখন অরেঞ্জ নদী। আমি বলি, আমার অরেঞ্জ নদী চোখ খোল।
আগে যখন ওকে অরেঞ্জ নদী ডেকেছি, ও বলতো অরেঞ্জ নদী নাম আমার পছন্দ না। ও আরও বলতো, দক্ষিণ অফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া অরেঞ্জ নদী আমি হতে চাই না গো। তুমি আমাকে আগুনমুখা ডাক। আগুনমুখা আমাদের নদী। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিশেছে।
আমি বলতাম, আমি যে তোমাকে বিশ্ব জুড়ে দেখতে চাই। ডালিয়া আমাদের ভালোবাসার সীমানা নেই। আমাদের ভালোবাসা পৃথিবীর সবটুকু।
ডালিয়া উজ্জ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলতো, তুমি এমন করে কথা বলো যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তোমার কথা শুনলে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না।
সম্পর্কতো এমনই হওয়া দরকার ডালিয়া। দু’জনে যেন দু’জনের ভেতরে আটকে থাকি। বোধে-চেতনায়-বোঝায়-চিন্তায় –
ডালিয়া দু’হাত উপরে তুলে জোরে জোরে বলতো, হয়েছে হয়েছে থাম। থাম। একজীবনে এতবড় জায়গা ধরে রাখা কঠিন। মনের ভেতরে ক্ষয় আছে, ভূমিকম্প আছে, বন্যা-খরা আছে। সবকিছুই সম্পর্কের দেয়ালে আঘাত করবে। ভুলে যেও না যে আমারও মানুষ।
ঠিক বলেছ। আমার উচ্ছ্বাস ঝিমিয়ে যায়। আমি মিনমিন স্বরে বলি, হ্যাঁ আমরা মানুষ। আমাদের রাগ আছে, হিংসা আছে, নীচতা আছে, ভালো কিছু মেনে না নেয়ার দ্বন্দ্ব আছে -। হ্যাঁ, আমরাতো মানুষই আগুনমুখা-ডালিয়া।
আমি ওর কাপড় বদলে দেই। আলমারি থেকে একটি নতুন শাড়ি বের করি। ওর জন্য নতুন শাড়ি কেনা হয়। ওর জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকীতে কিংবা ঈদে ওকে শাড়ি-ব্লাউজ উপহার দেই। ওর দিকের এবং আমার দিকের আত্মীয়স্বজন ওর জন্য আমার কাছে কাপড় রেখে যায়। ছোট ছেলেমেয়েরা ফুল নিয়ে আসে। ওর বালিশের কাছে ফুল রেখে দেয়। বিশেষ করে সুগন্ধী ফুল ওরা বেশি আনে। পুরো ঘরে তখন ফুলের গন্ধ ম-ম করে। আমার বেশ লাগে। ভাবি এভাবেই জীবনের নানাকিছু ঘুরে ঘুরে আসে। এভাবে বেঁচে থাকা মোড় নেয়। ওর অসুস্থতার পরে আমি বিছানা আলাদা করেছি। একটি সিঙ্গল খাট কিনে আমি বিছানা পাতি। আমি জানি ওর কোনো অসুবিধে হলে ও শব্দ করবে না। আমাকে ডাকবে না। বলবে না, হেমিংবার্ড ওঠো আমাকে পানি দাও। হায় আমার ডালিয়া, আমাকে এত অভিজ্ঞতা দিয়ে ভরিয়ে রাখলে।
আমি ওর পিঠে-বুকে পাউডার ছড়াই। গরমের সময় শরীরে পাউডার না দিয়ে ঘুমুতে যেত না। একে-অপরকে পাউডার দিতাম। বিছানায় পাউডার ছড়াতাম। আজ কাজটি আমি একা একা করছি। একসময় আমার হাত থেমে যায়। ভাবি, আমিতো আনন্দেই আছি। ও কথা বলতে পারে না, তাকায় না, আমাকে ডাকে না। তাতে কি আসে যায়? স্মৃতির সবটুকু নিয়ে ও এখন আমার রাজত্ব। এই রাজত্বে আমি একাই রাজা। হা-হা শব্দে হাসতে থাকি। হাসতে হাসতে বলি, নীলনদ ঘুমোও। পিরামিড বানিয়ে আমি তোমাকে রাখব। তোমার কোনোকিছুই হারাবে না।
শুনতে পাই কলিং বেল বাজছে।
দরজা খুলতে হবে। হয়তো কাপড় ধোয়ার বুয়া এসেছে। আমি ডালিয়ার কাপড়গুলো গুছিয়ে ঘরের কোনায় রাখি। নিজের কাপড়ও ধোওয়ার জন্য আলাদা করি। বেলটা বাজতেই থাকে। বাহ বেশ লাগছে তো বেলের শব্দ শুনতে! আমি নিজের ভেতরে মগ্ন হয়ে যাই। আমার মগ্ন চৈতন্যে ভালোবাসার শিস বাজে।
দরজা খুলে দেখি নেইলা বুয়া এসেছে। ও ঢুকবে বলে আমি একপাশে সরে দাঁড়াই। দু’পাল্লা খোলা থাকার জন্য এক ঝলক বাতাস ঢোকে। টের পাই বাতাসে ধুলো ভাসছে। আমার চোখে ধুলো ভরে যায়। আমি দু’হাতে চোখ মুছি।
খালু আপনের কি শরীল খারাপ?
আমি ঠিকমতো তাকাতে পারছি না। চোখে হাত রেখেই বলি, না তো ভালোই আছি।
আহা রে, এমুন কইরা মানুষ কি ভালা থাকতে পারে? আহা রে, কত কষ্ট আপনের!
বুয়া তুমি ঘরে ঢোক। আমি দরজা বন্ধ করব।
আপনে সরেন খালু আমি দরজা লাগাইয়া দেই। কতক্ষণ ধইরা বেল বাজাইতাছি আপনে দরজা খোলেন নাই। তাই ভাবলাম আপনের শরীর ঠিক নাই।
তুমি কি আমার কৈফিয়ৎ চাইছ?
কৈফিয়ৎ! নেইলা বুয়া নাক-চোখ কোঁচকায়।
হ্যাঁ, দেরি করে দরজা খোলার কৈফিয়ৎ।
ছিঃ ছিঃ কি যে কন খালু। আমি কামের বেডি। আমার কি এত সাহস হইতে পারে? বুঝছি আপনের মন ভালা নাই।
ও নিজের কাপড়ের পোটলাটা জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢুকে যায়। আমি দরজা বন্ধ করি। এখন আমি কি করব? ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। বুয়া বেডরুমে গিয়ে কাপড় তুলে বাথরুমে যায়। কল ছাড়ার শব্দ পাই। ঝপঝপিয়ে পানি পড়ছে। অনেক সময় ও আকারণে কল ছেড়ে রাখে। জুয়েলের কাছে বলেছে, পানি পড়তে দেখলে ওর ভালোলাগে। ছোটবেলায় দেখা ছোট নদীর কথা মনে হয়। বিয়ের পরে শহরে আসা এবং বস্তীতে থাকার কারনে ওর জীবনে আর নদী নেই। কলের পানি জোরে ছেড়ে দিয়ে ও নদী খোঁজে।