হেঁচকি

হেঁচকি

মৌটুসি খুব সুন্দর গান গাইতে পারে, নাচতে পারে, কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। শুধু তাই না, সে লেখাপড়ায় খুব ভালো, এমনকি সে দেখতেও পরীর মতন সুন্দরী। কিন্তু ক্লাসে তার কোনো বন্ধু নেই, তাকে কেউ দুই চোখে দেখতে পারে না, কারণ সে অসম্ভব অহংকারী একটা মেয়ে। তার সমস্যা হচ্ছে যে সে এক সেকেন্ডের জন্য ভুলতে পারে না যে সে সুন্দরী, লেখাপড়ায় ভালো এবং নাচ গান আবৃত্তিতে তার মতো কেউ নেই।

তাই স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যখন টুনিদের ক্লাস থেকে মৌটুসিকে একক নজরুলগীতির জন্যে ঠিক করা হলো তখন কেউ অবাক হলো না, কিন্তু কেউ খুশিও হলো না। বরং সবাই মুখ বাঁকা করে একটু যন্ত্রণার শব্দ করল। কারণ সবাই জানে এই ব্যাপারটা নিয়েও সে নাক উঁচু করে ঘুরে বেড়াবে।

টুনিদের ক্লাসের রাজুও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করবে সেটা নিয়ে সবাই খুশি, কবিতাটি মুখস্থ হয়েছে কিনা প্রত্যেকদিনই সবাই তার খোঁজখবর নিচ্ছে। তাদের ক্লাসের রেশমা আর সানজিদা স্কুলের দলীয় নাচে সুযোগ পেয়েছে, সেটা নিয়েও সবার উৎসাহ তাদের লাল পাড় সাদা শাড়ি লাগবে, অনেক মেয়েই তাদের বাসা থেকে সেই শাড়ি আনার জন্য উৎসাহ দেখিয়েছে। কিন্তু মৌটুসিকে নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই, এমনকি সে কোন গানটা গাইবে কেউ সেটা একবারও তাকে জিজ্ঞেস করেনি। শুধু তাই না অনেকেই মনে মনে দোয়া করছে যেন অনুষ্ঠানের দিন মৌটুসির গলা বসে যায়।

তবে অনুষ্ঠানের দিন মৌটুসির গলা বসে গেল না, সে তার গানের খাতা নিয়ে গান গাওয়ার জন্য সময়মতো চলে এসেছে। স্টেজের পেছনে শিল্পীদের জায়গায় সে গম্ভীর হয়ে তার ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রচনা প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা বা কোনো ধরনের খেলাধুলাতেই টুনি কখনো অংশ নেয় না, কিন্তু সব অনুষ্ঠানেই সে উপস্থিত থাকে। স্টেজের পেছনে কিংবা অনুষ্ঠানের পেছনে যে নানা ধরনের কাজ থাকে সেই কাজগুলোতে সব সময়েই তার ডাক পড়ে।

তাই আজকেও টুনি স্টেজের পেছনে ছিল এবং সে একসময় এসে মোটুসিকে বলে গেল, “মৌটুসি, এই কোরাসের পরে একটা দলীয় নৃত্য তারপর তোমার একক সংগীত। রেডি থেকো।”

মৌটুসি মুখ উঁচু করে বলল, “আমি সব সময় রেডি থাকি।”

টুনিদের ক্লাসে সবাই সবাইকে তুই করে বলে শুধু মৌটুসি তার মাঝে আলাদা। তার সাথে কোনো ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব নেই, সে কাউকে তুই বলে না, অন্যরাও কেউ তাকে তুই করে বলে না।

যখন কোরাস গানটা মাঝামাঝি এসেছে তখন হঠাৎ টনিদের ক্লাসের আরেকটা মেয়ে দৌড়ে টুনির কাছে এসেছে। সেও টুনির মতো ভলান্টিয়ার। মেয়েটির মুখে এগাল থেকে অন্য গালজোড়া হাসি। সে টুনির কাছে এসে হাতে কিল দিয়ে বলল, “কী মজা হয়েছে?”

টুনি জানতে চাইল, “কী মজা?”

“মৌটুসির হেঁচকি।”

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “একটু পরেই না সে গান গাইবে?”

“হ্যা! চিন্তা করতে পারিস?”

বলে সে গানের সুরে বলল, “লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া–তারপর হিঁক–”

মৌটুসির ওপর তার এতই বিতৃষ্ণা যে সে হেঁচকির জন্য গান গাইতে পারবে না চিন্তা করেই আনন্দে হাসি থামাতে পারছে না!

টুনি তাড়াতাড়ি মৌটুসির কাছে গেল, দেখল সে এক গ্লাস পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একটু পর পর হিক করে একটা হেঁচকি তুলছে।

পাশে আরেকজন দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল, “পানিটা এক টোকে খেয়ে ফেলো হেঁচকি বন্ধ হয়ে যাবে।”

মৌটুসি বলল, “খেয়েছি তো তবু তো বন্ধ হচ্ছে না–হিঁক–”

“গ্লাসের সোজা দিকে খেলে হবে না। উল্টোদিকে খেতে হবে।”

“উল্টো দিক আবার কী? হিক।”

“পেছনের দিকে মুখ দিয়ে খেতে হবে।”

মৌটুসি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “পেছনের দিকে মুখ দিয়ে কীভাবে পানি খায়? হিক। হিক।”

আরেকজন বলল, “নাক চেপে ধরে রাখো।”

মৌটুসি নাক চেপে ধরে রেখে হেঁচকি তুলল, “হিঁক।”

টুনি কিছুক্ষণ মৌটুসির দিকে তাকিয়ে রইল। ক্লাসে এই মেয়েটির কোনো বন্ধু নেই-তাই মনে হয় জীবনে কোনো রকম সত্যিকারের আনন্দও নেই। যা কিছু আনন্দ সেগুলো আসে নানা ধরনের প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়ে, অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে। সেটাও যদি করতে না পারে তাহলে তার জীবনে আর থাকল কী? তাকে কি একটু সাহায্য করবে?

টুনি কিছুক্ষণ মৌটুসির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “একদিক দিয়ে হয়তো ভালোই হয়েছে।”

মৌটুসি বলল, “কী ভালো হয়েছে? হিঁক।”

টুনি বলল, “ভাবছিলাম তোমাকে বলব না। কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি যখন আর গান গাইতে পারবে না–তোমাকে বলেই ফেলি।”

মৌটুসি শুকনো মুখে বলল, “কী বলেই ফেলবে?”

টুনি মৌটুসির হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল, “নিরিবিলি বলতে হবে।”

তাকে আলাদা সরিয়ে নিয়ে বলল, “একটু আগে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এসেছিলেন। তোমাকে খোঁজ করছিলেন।”

“আমাকে? কেন?”

“ঠিক বুঝতে পারলাম না। তোমার ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন।”

মৌটুসি চোখ কপালে তুলে বলল, “আমার ওপর? কেন?”

“কী জানি একটা ঘটেছে। তুমি কি গত কয়েকদিনে কিছু একটা করেছ, যেটা করার কথা না?”

মৌটুসি মনে করার চেষ্টা করে শুকনো মুখে বলল, “ঠিক মনে পড়ছে না–”

“কোনো ধরনের বেয়াদবি কিংবা অন্যায়-”

“অ্যাঁ অ্যাঁ–”

মৌটুসি মাথা চুলকালো।

টুনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, “বলেছেন তোমাকে স্কুল থেকে বের করে দিবেন। তোমার গান বন্ধ করে দিতে চাইছিলেন।”

“বে-বের করে দিবেন?”

“তাই তো বললেন। আমি অনেক রিকোয়েস্ট করলাম বললাম, নিশ্চয়ই মৌটুসির আব্বু-আম্মু এসেছেন, এখন গান বন্ধ করে দিলে ঠিক হবে না–সবাই মনে কষ্ট পাবে–”

মৌটুসি কোনো কথা বলতে পারল না। রক্তশূন্য মুখে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি বলল, ‘প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলেছেন তোমার আব্বু আম্মুকে নাকি ডেকে পাঠিয়েছেন—”

মৌটুসি ঢোঁক গিলে বলল, “আ-আ-আব্বু-আম্মুকে?”

টুনি কিছুক্ষণ চুপ করে মৌটুসির দিকে তাকিয়ে রইল। মৌটুসির মুখ ছাইয়ের মতো সাদা। টুনি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “মৌটুসি, তোমার হেঁচকি কোথায়? বন্ধ হয়েছে?”

“হেঁচকি?”

“হ্যাঁ, ভয় পেলে হেঁচকি বন্ধ হয়ে যায়। সেইজন্য তোমাকে মিছেমিছি একটু ভয় দেখালাম। দেখেছ, হেঁচকি বন্ধ হয়েছে।”

মৌটুসি বলল, “আসলে কিছু হয় নাই?”

টুনি হি হি করে হাসল, বলল, “ধুর! কী হবে? কিছু হয় নাই। সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছি।”

“বা-বা-বানিয়ে বলেছ?”

“হ্যাঁ! তুমি এত সুন্দর গান গাও–আজকে যদি গান গাইতে না পার কেমন করে হবে? তাই তোমার হেঁচকি ভালো করে দিলাম! এখন গাইতে পারবে না?”

মৌটুসি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। খুব ধীরে ধীরে তার মুখে হাসি ফিরে এল।

টুনি বলল, “ভয়ে তোমার নিশ্চয় গলা শুকিয়ে গেছে। নাও, এক ঢোঁক পানি খেয়ে নাও! খুব সুন্দর করে গান গাইতে হবে কিন্তু। আমাদের ক্লাসের প্রেস্টিজ!”

মৌটুসি এক টোক পানি খেয়ে বলল, “উহ! কী ভয় পেয়েছিলাম? এখনো আমার বুকটা ধুক ধুক করছে।”

টুনি মৌটুসির হাত ধরে বলল, “আমি সরি মৌটুসি, আমি তোমাকে এত ভয় দেখিয়েছি। যাও, রেডি হও। এক্ষুনি তোমাকে ডাকবে।”

সত্যি সত্যি তখন দলীয় নৃত্যের মেয়েরা নাচ শেষ করে ভেতরে ঢুকল। উপস্থাপক গান গাওয়ার জন্য মৌটুসিকে ডাকল। মৌটুসি গ্লাসটা নিচে রেখে স্টেজের দিকে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে টুনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্যাংকু টুনি।”

তারপর স্টেজের দিকে ছুটে গেল।

মৌটুসি অসাধারণ একটা গান গাইল। গান গাওয়ার পর হাততালিতে হল ভরে গেল।

সবচেয়ে জোরে হাততালি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *