হৃদয়ের শব্দ – ৮

অভিজ্ঞান

হইহই করে চলে এল হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির ইলেকশান। পুরো হোস্টেল টগবগ করে ফুটছে। খোলায় ভুট্টার দানা ভাজলে তারা যেমন টপাটপ লাফিয়ে উঠে সবাইকে চমকে দেয়, তেমনই নিত্যনতুন কোনও না কোনও ঘটনা চমকে দিচ্ছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজকে। চমকে দিচ্ছে অভিকে।

পুজোর সময়ে বাড়ি ছিল অভি। কোনও ঠাকুর দেখেনি। পাড়ার ঠাকুরটাও নয়। চিলেকোঠার ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে অ্যানাটমির প্রিপারেশান নিয়েছে। সেই থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়। সেই ডক্টর মিত্র,গ্রে, চৌরাসিয়া। কী অসহ্য পরিস্থিতি!

বাড়ির পরিবেশ থমথমে। মনোজ আর অরুণা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। জগদ্দল থেকে ট্রেনে ফেরার গপপোটা যেদিন মনোজ শুনিয়েছিলেন, তার পরদিন আজ সকাল খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ‘রেল অবরোধে বিপর্যস্ত শিয়ালদা’ হেডলাইন দেখিয়ে অরুণা বলেছিলেন, ‘তুমি কাল মিথ্যে কথা বললে কেন?’

মনোজ বলেছিলেন, ‘আমার ফেরা নিয়ে তুমি রোজ টেনশান করো। গতকাল যখন সত্যিই গন্ডগোলে পড়লাম, তখন সত্যি কথা বলে তোমার পাগলামি বাড়াতে চাইনি।’ তারপর জগদ্দল থেকে বাসে, ট্যাক্সিতে, অটোয়, ভ্যান রিক্সায়, হেঁটে হাওড়া ফেরার একটা লম্বা গপপো ফেঁদেছিলেন। অরুণা কতটা কনভিন্সড হলেন, কে জানে! তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে পাগল প্রমাণ করতে চাও? আমাকে পাগলা গারদে ঢুকিয়ে কোন মেয়েছেলেকে বাড়িতে ঢোকাবে? ওই ঋষিতা?’

‘ঋষিতা?’ শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন মনোজ। ‘সে আবার কে? কোনও সিরিয়ালের চরিত্র?’

মনোজের প্রতিক্রিয়াহীনতায় দমে গিয়েছিলেন অরুণা। আর তাঁকে ঘাঁটাননি। দু’জনের মধ্যে সেই থেকে কথাবার্তা বন্ধ। অভি বুঝতে পারে বাড়ির পরিবেশে অস্বাভাবিক শৈত্য। আস্ত একটা পুজো চলে গেল, নতুন কাপড়জামা কেনা হল না, কোথাও বেড়াতে যাওয়া হল না, কোনও ঠাকুর দেখা হল না। গত বছরও অরুণা শ্যামবাজার থেকে মনোজ-বিলু-অভির জন্য জামাপ্যান্ট কিনে এনেছিলেন। রাধা আর মানদার জন্য শাড়ি। বিছানার চাদর, নতুন পর্দা—এসবও কিনেছিলেন।

বিজয়া দশমীর আগে অরুণা নিমকি আর নারকেল নাড়ু বানান। দশমীর দিন লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে পাড়ার মণ্ডপে সিঁদুর খেলতে যান। অষ্টমী আর নবমীর দিন রিকশা নিয়ে মনোজ আর অরুণা ঠাকুর দেখে আসেন। একদিন যান ডানলপ-উত্তরপাড়ার দিকে, একদিন শালকিয়া-ঘুসুড়ির দিকে। অষ্টমীর সকালে বেলুড় মঠের কুমারীপুজো দেখা তো রুটিন। এ বছর দুজনের কেউই ঠাকুর দেখতে যাননি। অরুণা ভূতগ্রস্তের মতো টিভি দেখেছেন। মনোজ পাড়ার নাটকের রিহার্সাল দিয়েছেন। অভি বাড়ি থাকলেও বিলু হোস্টেলে ছিল।

পুজোর পরই হোস্টেলে চলে এসেছে অভি। বাড়িতে থাকলে বেফালতু টেনশান হয়। হোস্টেলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থাকলে নেগেটিভ মেন্টালিটি থাকে না। পড়াশুনোটা মন দিয়ে করা যায়।

হোস্টেলে এখন পড়াশুনোর পরিস্থিতি নয়। চারটে ছাত্র সংগঠন তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য প্রতিটি রুমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাপ্লি পাওয়া স্টুডেন্টদের কোনও দলই বিরক্ত করছে না। কিন্তু ক্রমাগত চিৎকার চেঁচামেচিতে কার লেখাপড়া হয়?

অভি তাই দময়ন্তীর সঙ্গে জোট বেঁধেছে। দময়ন্তীরও অ্যানাটমিতে সাপ্লি। ও অবশ্য হোস্টেলে থাকে না। ভোরবেলা লেডি আর্চার্স হোস্টেলে চলে আসে। সারাদিন হোস্টেলে পড়াশুনা করে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায়। অভি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘রাতে থাকিস না কেন?’

‘বৃন্দা নেই। আমার একা থাকতে বোর লাগে।’ সোজাসাপটা উত্তর দময়ন্তীর।

দময়ন্তীর সঙ্গে পড়ার অ্যাডভান্টেজ হল, গ্রুপ স্টাডিটা হচ্ছে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গেস্টরুমে। বিরক্ত করার কেউ নেই। অভি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে, সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অস্টিওলজি পড়ে। সাড়ে সাতটায় উঠে, ব্যাগে বইপত্তর ঢুকিয়ে, জেনারেল মেসে ব্রেকফাস্ট সেরে লেডি আর্চার্স হোস্টেল চলে যায়। দময়ন্তী সওয়া সাতটার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকে যায়। সে-ও পোশাক বদলে, ব্রেকফাস্ট সেরে, বইখাতা নিয়ে গেস্টরুমের কোনার টেবিল আর চেয়ার দখল করে রেডি থাকে। অভি ঢুকলে পড়াশুনো শুরু হয়।

পৌনে আটটা থেকে সওয়া বারোটা। একটানা সাড়ে চার ঘণ্টা অ্যানাটমি চর্চা। সাড়ে বারোটা নাগাদ অভি যখন বয়েজ হোস্টেলে ফেরে, তখন মাথা বনবন করে ঘুরছে। দুপুরের খাওয়া সেরে একঘণ্টা ঘুম। দুটোর সময় আবার লেডি আর্চার্স হোস্টেল। দুটো থেকে ছটা, আবার চার ঘণ্টার সেশন। ছটার সময় লেডি আর্চার্স হোস্টেল থেকে বয়েজ হোস্টেলে ফিরে টিফিন সারে অভি। এর তার সঙ্গে আড্ডা মেরে, ইলেকশানের খবর নিয়ে সাতটার সময় আবার লেডি আর্চার্স হোস্টেলে। সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত আবার একটা সেশন। তারপর দময়ন্তী বাড়ি পালায়। অভি টুকটুক করে একশো চব্বিশে ফেরে। রাতের খাওয়া সেরে কয়েকটা ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস করে এগারোটার সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

দিনের বেশির ভাগ সময় বয়েজ হোস্টেলের বাইরে কাটালেও ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনারের সময় মেসে গেলে সব খবর জানা হয়ে যায়। মেস হল আড্ডার এক নম্বর ঠেক। হোস্টেলের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় নানা জিনিস চোখে পড়ে।

এতদিন হোস্টেলে ইলেকশানে পোস্টার সাঁটার প্রথা ছিল না। নবযুগ সেটা চালু করেছে। প্রত্যেক ফ্লোরে, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ পোস্টার মেরেছে। তাতে বড়বড় করে লেখা, ‘হোস্টেল বোফর্স কমিটি’। বোফর্স কামান নিয়ে রাজীব গাঁধীর জমানায় একটা কেলেঙ্কারি হয়েছিল। সেই রেফারেন্স টেনে হোস্টেলে বোর্ডার্স কমিটির নানান দুর্নীতি ফাঁস করার চেষ্টা করছে সুরজ অ্যান্ড কোং।

অভির মতে ভুল স্ট্র্যাটেজি। বোফর্স কেলেঙ্কারি যখন হয়েছিল তখন অভিরা জন্মায়নি। সেই রেফারেন্স টানলে টার্গেট অডিয়েন্সের মনে কোনও অনুরণন হবে না। দুর্নীতির তালিকা দিতে গিয়ে, নেতাদের দাদাগিরি, বোর্ডারদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ (মানে নীল ছবি দেখতে না দেওয়া), খাবারের নিম্ন মান (মানে, মিনি মেস উঠে যাওয়া), হোস্টেলে এন্টারটেনমেন্টের অভাব (অর্থাৎ গাঁজা চাষ বন্ধ করে ব্যাডমিন্টন কোর্ট চালু করা)—এই সব বলা হয়েছে। অভি জানে এখনকার হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি সম্পর্কে আবাসিকদের বিশেষ কোনও অভিযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলই আবার ক্ষমতায় আসবে। পড়াশুনো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছেলেরা চায় শান্ত পরিবেশ আর সময়মতো ঠিকঠিক খাবার। নতুন কোনও রাজনৈতিক দলের হাতে কমিটি তুলে দিয়ে তারা এক্সপেরিমেন্ট করবে না।

সেকেন্ড এমবিবিএস-এর ক্লাস শুরু হয়ে গেছে পুজোর পর থেকে। চন্দন নিয়মিত ক্লাস করছে। সন্ধেবেলা ভোটের ক্যাম্পেনও করছে। চন্দনকে যত দেখে, তত অবাক হয়ে অভি। শুধুমাত্র একবগগা জেদ আর গোঁ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে ছেলেটা। ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি—দুটো সাবজেক্টেই গোল্ড মেডেল পেয়েছে। অ্যানাটমিরটা অল্পের জন্য ফসকে গেছে। পড়াশুনা আর পলিটিক্স দুটোই সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের একটা চালু প্রবাদ হল, তিনটে ‘প’ একসঙ্গে হয় না। পড়াশুনা, পলিটিকস আর প্রেম। প্রথম দুটোয় চন্দন এগিয়ে। তিন নম্বরটায় কি অভি? সেই জন্যই তার পড়াশুনা হচ্ছে না?

বৃন্দার কথা মনে এলে ভীষণ অভিমান হয় অভির। সারা পৃথিবীর ওপরে অকারণে রাগ হয়। অভি বোঝে, অকারণ রাগ আসলে নিজের ব্যর্থতার প্রতিফলন। মানুষ তো নিজের ওপরে রাগতে পারে না! নিজেকে শাস্তিও দিতে পারে না। (সে পারে একমাত্র আত্মহত্যাকামীরা!) তাই অন্তর্গত রাগ অন্যের দিকে চ্যানেলাইজ করে সে নিজেকে সামলায়। বৃন্দা রোজ ঠিক তিনবার ফোন করে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে একবার। দুপুরে খাওয়ার পরে একবার। রাতে খাওয়ার পরে আরও একবার। বেশিক্ষণ কথা বলে না। সামান্য দুএকটা শব্দ।

‘ঘুম ভাঙল?’

‘আজকের রুটিন কী?’

‘দুপুরে কী মেনু ছিল?’

‘একদিন তোদের হোস্টেলের গ্র্যান্ড ফিস্টে যাব।’

‘মনমেজাজ ঠিক আছে তো?’

‘আর তো কদিন! কোনও মতে টেনে দে!’

অভিও অল্প কথায় উত্তর দেয়।

‘হ্যাঁ। এই উঠলাম।’

‘আজ সারাদিন একটানা পড়ে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম শেষ করব।’

‘ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, পোনা মাছের ঝাল।’

‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’

‘না, নেই।’

‘হ্যাঁ, সেই তো!’

অল্প কথা! কিন্তু কী তীব্র অভিঘাত! সারা শরীর ঝনঝন করতে থাকে। মনে হয়, বৃন্দা এখন পাশে নেই কেন? একবার দেখতেও তো আসতে পারে! গ্রুপ স্টাডির সময়ে একবার লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গেস্ট রুমে ঘুরে গেলে কী এমন পড়াশুনোর ক্ষতি হবে অভির? বৃন্দার কি তার জন্য মন কেমন করে না? এই কুচ্ছিত সাপ্লিটা কবে যে শেষ হবে! পরীক্ষার প্রসঙ্গ মাথায় আসা মাত্র প্রেম-প্রেম ভাব একলাফে দিগন্তের ওপারে পালিয়ে যায়।

প্রেম ও পড়াশুনার মধ্যেই চলে এল ইলেকশানের আগের জেনারেল বডি মিটিং। যে মিটিংয়ে বিদায়ী কমিটি হিসেব নিকেশ পেশ করবে। মেসে মিটিং হচ্ছিল। অভি তখন খেতে ঢুকেছিল! বড় হলঘরে শ’খানেক ছেলে এক কোণে বেঞ্চিতে বসে বক্তব্য শুনছে। রিপু আয়-ব্যয়ের হিসেব দিচ্ছে, মোচা পার্টির ছেলেরা শুনছে, ন্যাবা পার্টির ছেলেরা হল্লা করে মিটিং ঘাঁটার চেষ্টা করছে। অভি আপন মনে খাচ্ছিল। হঠাৎ শুনতে পেল সুরজের গলা, ‘কওন হ্যায় বে?’

চিৎকার শুনে অভি দেখল, বাইরে বেরোনোর চারটে দরজা বাইরে থেকে কেউ বা কারা বন্ধ করে দিয়েছে। হলঘরে এখন দুটি আলাদা আলাদা পক্ষের শ’খানেক ছেলে। সংখ্যায় প্রায় সমান সমান।

বাংলায় একটা কথা আছে। ‘গণ-ক্যালাকেলি।’ আশি বা নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার শেষে এটা দেখা যেত। ক্লাইম্যাক্সে সবাই সবাইকে ধরে মারছে। কে হিরো, কে ভিলেন, কে হিরোর বন্ধু, কে ভিলেনের সাইড-কিক, কে পুলিশ, কে ভ্যাম্প—বোঝার উপায় নেই। যে যাকে পারছে ঘিপ-ঘাপ কেলিয়ে দিচ্ছে।

সেই দৃশ্য চোখের সামনে ঘটতে দেখে অভির ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। মড়ার ওপরে খাঁড়ার ঘা, পালানোর কোনও উপায় নেই। অগত্যা রান্নাঘরে ঢুকে বামুন ঠাকুরদের পিছনে লুকিয়ে পড়ে অভি। সেখান থেকেই দেখতে পেল রিপু আর চন্দন মিলে সুরজকে ধরে বেদম মারছে। চন্দনের মার চড়থাপ্পড়ের বেশি কিছু না। আনাড়ির স্ট্রিট ফাইটিং। মারপিট করতে হচ্ছে বলে বেজায় লজ্জিত সে।

রিপুর মার কিন্তু পেশাদারি। ছ’ফুটিয়া রিপুর নির্ভুল পাঞ্চগুলো জায়গা বেছে পড়ছে। ডান-গাল, বাঁ-গাল, তলপেট। সুরজ প্রাথমিকভাবে রেজিস্ট করার চেষ্টা করল। তার একটা ঘুষি চন্দনের মুখে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে ঠোঁটে সুপুরি গজিয়ে গেল চন্দনের। তাই দেখে রিপু ঘিপিত করে ঘুষি চালাল সুরজের তলপেটে। ঘুষি খেয়ে আঁক করে সে মেঝেয় লটকে পড়ল। বান্টি, লাটু, সুব্রত, টিনটিন, প্রবালরাও ধুমধাড়াক্কা হাত-পা চালাচ্ছে। তবে সেসব চড়, থাপ্পড়, লাথি ধর্তব্যের মধ্যে নয়। যে মারছে আর যে মার খাচ্ছে, দু’জনেরই সমান লাগছে। বিলু আর সব্যসাচী খাবার টেবিলের ওপরে উঠে মারপিট থামানোর চেষ্টা করছে। অভি হঠাৎ খেয়াল করল সুরজের স্যাঙাত সঞ্জয় সুরজকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টাই করছে না। সে টেবিলের ওপরে উঠে মোবাইলের ক্যামেরায় মারামারির ভিডিও রেকর্ডিং করছে। মারামারিতে ব্যস্ত ছেলেরা কেউ এটা খেয়াল করেনি।

অভির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হল, সঞ্জয়ের মোবাইলটা ভেঙে দিতে হবে। নিদেনপক্ষে কেড়ে নিয়ে ভিডিওটা ডিলিট করতে হবে। ভিডিও ক্লিপের মতো প্রমাণ অনেককে বিপদে ফেলবে। এই ক্লিপ সঞ্জয় নিউজ চ্যানেলকে দিতে পারে, ইউটিউবে আপলোড করতে পারে, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দিতে পারে, পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারে। একঘর ছেলে মারামারি করছে ঠিকই, কিন্তু রিপু আর চন্দন মিলে সুরজকে ব্রুটালি পেটাচ্ছে। কে মারছে আর কে মার খাচ্ছে, ভিডিওয় পরিষ্কার দেখা যাবে।

অভির দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হল, যা হচ্ছে হোক! চন্দন তার বন্ধু, কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ও ফার্স্ট এমবিবিএস পাস করে গেছে। দুটো সাবজেক্টে গোল্ড মেডেল পেয়েছে। আর সে এখনও অ্যানাটমির সাপ্লি নিয়ে ঘষছে। অভি একাই কেন শাস্তি পাবে? চন্দনও পাক। তাছাড়া বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে, প্ল্যানফুলি কাউকে পেটানোটা আর যাই হোক ছাত্র রাজনীতি নয়। এইভাবে হোস্টেলে বোর্ডার্স কমিটির ইলেকশান যারা জিততে চায়, তাদের জেলে যাওয়া উচিত।

মারামারি হঠাৎ শুরু হয়েছিল। হঠাৎই শেষ হল। কে একটা চ্যাঁচাল, ‘পুলিশ এসেছে।’

স্যাটাস্যাট দরজাগুলো খুলে গেল। হুড়মুড় করে ছেলেরা চারটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে নিজের নিজের ঘরের দিকে দৌড়ল। মুহূর্তের মধ্যে মেস ফাঁকা। সবার শেষে মেস থেকে বেরোল সঞ্জয়।

অভি সঞ্জয়কে নজরে রেখেছিল। সে সঞ্জয়ের সঙ্গে বেরোল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় খেয়াল করল, হোস্টেলের কোলাপসিবল গেটের বাইরে পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে। সাদা ড্রেস পরা পুলিশ অফিসার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত সুরজ।

সুরজের ডানহাত সঞ্জয় বিপদের সময় বন্ধুর পাশে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে থাকে। অভি সঞ্জয়কে বলল, ‘তোকে মারামারিতে দেখলাম না তো?’

‘মেরেকো হাতাপাই করনা নেহি আতা। বঙ্গাল মে পড়নে কে লিয়ে আয়া, পলিটিক্স করনে কে লিয়ে নহি।’ জবাব দেয় সঞ্জয়। অভির কৌতুহল যায় না। বলে, ‘আমি রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলাম। ওখান থেকে সব দেখলাম। তুই কোথায় ছিলি?’

‘থা কঁহি পে। কিঁউ?’ কর্কশভাবে প্রশ্ন করে সঞ্জয়।

‘না। এমনিই।’ উত্তর ভারতীয় অ্যাগ্রেসনের সামনে মিইয়ে যায় অভি। সামান্য হেসে বলে, ‘তুই মোবাইলে কী ছবি তুললি? আমায় দেখাবি?’

অভির নিরীহ প্রশ্নের ফল হল চমকপ্রদ। ডাকাবুকো, রংবাজ উত্তর ভারতীয় ছোকরা আতঙ্কিত হয়ে লম্বা লাফে তিনতলায় পৌঁছল। লম্বা পদক্ষেপে নিজের রুমে ঢুকে দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। অভি একবার ভাবল সঞ্জয়ের পিছনে ধাওয়া করে। তারপর সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পাঁচতলায় উঠল।

একশো চব্বিশ ও পঁচিশের সামনে একগাদা ছেলের ভিড়। প্রবাল বলছে, ‘রিপুদা আর চন্দন হাসপাতাল ভরতি হয়েছে। রিপুদার মাথায় আর চন্দনের মুখে চোট লেগেছে।’ অভি জিজ্ঞাসা করল, ‘আর সুরজ?’

‘ও ইমার্জেন্সিতে যাচ্ছে।’ জবাব দেয় প্রবাল, ‘মাইনর ইনজুরি। কিন্তু আমাদের আসল কনসার্ন পুলিশ। ওদের কে ইনফর্ম করল? নির্ঘাৎ ন্যাবারা।’

অভি কিছু না বলে একশো চব্বিশে ঢুকে গেল। হোস্টেলে যত গন্ডগোলই হোক না কেন, ওকে এখন কেউ বিরক্ত করবে না। ঘরের আলো নিবিয়ে অভি প্রথমে ফোন করল বিলুকে।

তুরন্ত ফোন ধরল বিলু, ‘বল।’

‘তুই এখন কোথায়?’

‘পুলিশের সঙ্গে কথা বলছি। তুই কোথায়?’

‘ঘরে। পুলিশ কোথা থেকে এল?’

‘আমিই ফোন করেছিলাম।’

‘তুই মার খাসনি তো?’

‘না। তুই পড়।’ লাইন কেটে দিয়েছে বিলু। অভি পরের ফোনটা করে রিপুকে। তার মোবাইল সুইচ অফ। এবার অভি ফোন করে চন্দনকে। চন্দনের মোবাইলে রিং হচ্ছে। চন্দন ফোন ধরে বলল, ‘বল।’

‘সুরজকে মারলি কেন? মাথাফাথা খারাপ নাকি? ভোটে এমনিই জিততিস। এই সব মারধোরের ফলে কেস ঘেঁটে গেল।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল চন্দন। অবশেষে বলল, ‘এটা শালা রিপুদার প্ল্যান। রিপুদাকে অধীরদা বুঝিয়েছেন যে ন্যাবার ছেলেগুলোকে বেশি বাড়তে দেওয়ার আগেই কেলিয়ে ঠান্ডা করে দিতে হবে। আমি কেন বোকার মতো রাজি হয়ে গেলাম কে জানে! আমি গাধা! আস্ত একটা গাধা!’

‘হাসপাতালে ভরতি হলি কেন? তোর কিসসু হয়নি। আমি সব দেখেছি।’

‘রিপুদা ভরতি হতে বলল। ন্যাবারা যদি এফআইআর করে তাহলে বিপদে পড়ে যাব। সেই জন্য ইমার্জেন্সি থেকে ভরতি হয়ে ইনজুরি রিপোর্ট লিখিয়েছি। সুরজ এফআইআর করতে গেলে, থানা থেকে খবর পেয়ে যাব। তখন আমরা আগে এফআইআর করব।’

‘থানা থেকে কীভাবে খবর পাবি যে সুরজ এফআইআর করতে গেছে? থানার কাউকে হাত করেছিস নাকি?’

‘এসব ট্রেড সিক্রেট। তোর না জানলেও চলবে। তুই অ্যানাটমি নিয়ে রগড়া।’ সাপ্লি পাওয়া নিয়ে অভিকে আওয়াজ দিয়ে চন্দন ফোন কেটে দিল।

অভি চুপচাপ। তার মনে আবার মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে। অভি নম্বর ওয়ান বলছে, ‘বন্ধুর কর্তব্য কর। চন্দনকে বলে দে, সঞ্জয় পুরো মারামারির ভিডিও রেকর্ড করে রেখেছে। সঞ্জয়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে ক্লিপটা ডিলিট কর।’

অভি নম্বর দুই বলছে, ‘চন্দনকে ভিডিওটার কথা জানিয়ে তোর লাভ? চন্দনের প্রতি তোর ব্যক্তিগত ঈর্ষা যদি বাদও দিই, তাহলেও ও যা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সবার সামনে বেধড়ক মারার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই। সেটাও করেছে কলেজের বাইরের এক নেতার পরামর্শে। পুলিশ দলদাস বলে ইচ্ছেমতো মাসল পাওয়ার দেখাবে? এইভাবে বিরুদ্ধ স্বরকে গুঁড়িয়ে দেবে?’

মাথার মধ্যে অভি নম্বর ওয়ান আর দুইয়ের মধ্যে ঝগড়ার মধ্যে অভি মোবাইলে সময় দেখল। রাত বারোটা বাজে। আগামিকাল ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে। ভোট নিয়ে মাথা খারাপ করে আবার অ্যানাটমিতে সাপ্লি পেলে ইয়ার লস হবে। ওসব ভুলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়া যাক। আজ রাতে ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস করা হল না। আলো নিবিয়ে পাশ ফিরে শোয় অভি। ওমনি তার মাথার মধ্যে ঝলমল করে ওঠে কয়েকটা লাইন…

বলা হয়ে গেছে সব কথা।
নানা ভাবে হয়ে গেছে বলা।
দেরিতে পয়দা হলে কেন?
হে নতুন! চোষো তবে কলা!
আরেঃ! পদ্য! তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে অভি। সে আদৌ পদ্য নিয়ে ভাবছিল না। নিতান্তই সাধারণ বিষয় নিয়ে মনের মধ্যে ঘোঁট পাকাচ্ছিল। তার মধ্যে পদ্য? আরে বাঃ! চৌরাসিয়ার সেকেন্ড ভলিউম টেনে নেয় অভি। ডায়াগ্রাম আঁকার লাল স্কেচ পেন দিয়ে থার্ড কভারে লিখতে থাকে,

পূজা, প্রেম, দেশ, ঝিঁঝিপোকা…
যোনির মাড়ির খিলে চাপ।
বাস স্টপে তিনমিনিট ধরে
মেঘবালিকার প্রেমালাপ…
আরিব্বাস! চারলাইনের মধ্যে রবি ঠাকুর, শক্তি, সুনীল, এবং জয়। দ্বিগুণ উৎসাহে অভি লিখতে থাকে,

একার বেদনা, হামতুম,
আমি সে ও সখা…সব শেষ!
শিল্প কিংবা রাষ্ট্র বিরোধীতা
বুড়োগুলো করেছে নিকেশ।
বাংলা বাজারে আমি রুকি,
তবে খুব পরিশ্রমী বটে।
আদাজল খেয়ে পড়াশুনো—
গীতা থেকে পেনসিল খুকি।
পদ্য লিখে এ বান্দারও চাই
ফ্ল্যাট, গাড়ি, ডিপোজিট ফিক্সড।
ফর্ম ও কনটেন্টে মারো পোলি!
লিখছি, লিখব-কবিতা রিমিক্সড!
ঘোরের মধ্যে একটানা কবিতাটা লিখে অভি অবাক হয়ে যায়। অনেকদিন বাদে পদ্য লিখল সে। সাপ্লি পাওয়ার পরে পদ্য বা গপপোর বই পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। হোস্টেলের রিডিং রুমে একগাদা খবরের কাগজ আসে। সেগুলোতে চোখ বুলোনোর ফুরসতও পাওয়া যায় না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পনেরো-ষোল ঘণ্টা পড়াশুনো করে, অন্য কিছু ভাবার সময় পাওয়া যায় না। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পদ্য কোথা থেকে এল?

পদ্যটা আবার পড়ে অভি। খুব ভালো কিছু হয়নি। তবে ইংরিজি ‘রুকি’ শব্দের সংগে খুকি-র মিলটা পছন্দ হয় তার। হাসতে হাসতে বিছানা ছেড়ে উঠে ল্যাপটপ অন করে কবিতাটা টাইপ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সারার সময় অভি হোস্টেলে কোনও অস্বাভাবিকত্ব টের পেল না। কেন না কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। টের পেল সাড়ে বারোটা নাগাদ দুপুরে খাওয়ার সময়। হোস্টেলের বাইরে পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে। চন্দন সাদা ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছে। অভি লোকটাকে চিনতে পারে। গতকাল দুপুরবেলা জেনারেল মেসে মারামারির ঠিক পরে এই লোকটাই হোস্টেলের কোলাপসিবল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন। এর সঙ্গে চন্দনের দোস্তি দেখে আন্দাজ করা যায়, সুরজ থানায় এফআইআর করতে গেলে সে খবর কীভাবে চন্দন আগে পাবে।

দুপুরের খাওয়া চুকিয়ে অভি চুপচাপ ওপরে চলে যাচ্ছিল। চন্দন চেঁচিয়ে বলল, ‘এদিকে আয়।’

অভি গপপো করার মুডে নেই। নেহাত কথা বলতে হয় তাই বলা। বলল, ‘গতকাল রাতে বললি যে হাসপাতালে ভরতি আছিস। আজকের মধ্যে ঠিক হয়ে গেলি?’

‘স্যামি ব্যানার্জি ছুটি করে দিল।’ ফিচেল হাসি হেসে বলে চন্দন। ‘হয় তো এর পিছনে বৃন্দার হাত আছে।’

‘আর রিপুদা?’ চন্দনের ফাঁদে পা না দিয়ে সিনিয়র দাদার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ে অভি।

‘রিপুদা এখনও ভরতি আছে। স্যামি বললেন, মাথায় কনকাসন আছে। সিটি স্ক্যান করে ছাড়বেন। রিপুদার মাথা সুরজ খাবার টেবিলে ঠুকে দিয়েছিল।’

‘টেবিলের সিটি স্ক্যান করতে বলেননি?’ ফিচেল হাসি চন্দনকে ফেরত দেয় অভি। থানার বড়বাবু জানেন যে এগুলো গটআপ কেস। তবে আম-পাবলিকের কাছ থেকে শুনলে খানিকটা টনক নড়বে।

‘অভি, তুই শালা পুলিশের সামনে আমাদের ইনসাল্ট করছিস।’ হাসতে হাসতে বলে চন্দন। বিরক্ত হয়ে অভি বলল, ‘কালকে ইলেকশান। তার আগে ঝামেলাটা না পাকালেই চলছিল না?’

অভির কথা শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এটাই আমি তোমাদের নেতাকে এতক্ষণ বলছিলাম। ফালতু ঝামেলা পাকালে। তোমরা মেডিক্যাল স্টুডেন্টস। ক্রিম অব দ্য সোসাইটি। তোমরা যদি জেনারেল লাইনের ছেলেপুলেদের মতো হাতাহাতি করো, সেটা কি ভালো দেখায়? হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির ইলেকশানের সময় পুলিশ পোস্টিং হলে কলেজের জেনারেল ইলেকশানের সময় কী করবে?’

চন্দন বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই। ইনি তপন চৌধুরী। এন্টালি থানার ওসি। আমার পরিচিত।’

হাত জোড় করে অভি বলল, ‘নমষ্কার। আমার নাম অভিজ্ঞান। চন্দনের ক্লাসমেট।’

‘তোমার বুঝি পলিটিক্সে আগ্রহ নেই?’ সিগারেট বাড়িয়ে বলেন তপন।

‘সিগারেটও নেই।’ হাত নেড়ে অভি বলে, ‘চন্দন, কাল ভোট দিয়ে হোস্টেলে থাকব? না, বাড়ি চলে যাব?’

‘বাড়ি চলে যাও ভাই।’ পরামর্শ দেন তপন। ‘এরা হোস্টেল দখল নিয়ে বিচ্ছিরি মারামারি শুরু করেছে। ইউনিয়নের দখল নিয়ে না জানি কী করবে।’

‘বাড়ি কেন যাবি? পড়াশুনোর ক্ষতি হয়ে যাবে।’ তপনকে থামিয়ে তার হাত থেকে সিগারট নেয় চন্দন। আগের সিগারেট থেকে এটা ধরায়। তপন বলেন, ‘একদম চেন স্মোকার হয়ে গেলে যে!’

দু’জনকে টাটা করে অভি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবে, সঞ্জয়ের কোনও খবর নেই কেন? রিপু ন্যাকামো করে হাসপাতালে ভরতি আছে। চন্দন আর সুরজ হোস্টেলেই রয়েছে। ভোটের আগের দিন সমস্ত ক্যাম্পেন বন্ধ। এই বাজারে ভিডিও ক্লিপটা নিয়ে সঞ্জয় করছেটা কী? ভয়ের চোটে চেপে গেল? নাকি ক্যামেরায় কোনও ছবিই ওঠেনি?

নিজের ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ অন করে কবিতাটা আবার পড়ে অভি। নাম দেয়, ‘কবিতা জকি’। অন্তহীন পত্রিকার সম্পাদক সুদিন চক্রবর্তীকে লেখা ফরওয়ার্ডিং লেটারের ডেট চেঞ্জ করে প্রিন্ট আউট নেয়। চিঠি আর কবিতার কাগজ দুটো স্টেপল করে খামে ভরে আঠা দিয়ে মুখ সাঁটে। আজ দুপুর দুটোর সময় যখন লেডি আর্চার্স হোস্টেলে যাবে, তখন পোস্টবক্সে ড্রপ করে দেবে। দাঁড়ের ঠিক পাশেই একটা গোব্দা লাল রঙের বাক্স আছে।

.

বৃন্দা

শান্ত, নিস্তরঙ্গ গঙ্গা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এখন ভাঁটা। ছাব্বিশে ডিসেম্বরের ভোরবেলায় দুটো বালি তোলার নৌকা মাঝগঙ্গায় নোঙ্গর ফেলছে। প্রতি নৌকায় জনা চল্লিশেক মানুষ। এই শীতেও তারা নাগাড়ে গঙ্গার চর থেকে বালি তুলে নৌকোর খোল বোঝাই করছে। গোটা পাঁচেক স্টিমারও দাঁড়িয়ে। বৃন্দা মোবাইলে কয়েকটা ছবি তোলে। ভোরের আলোয় চমৎকার ছবি এল।

প্রিনসেপ ঘাটে বৃন্দা অতীতে একবারই এসেছে। স্যামি আর মন্দিরার সঙ্গে। ১৮৪১ সালে তৈরি এই স্থাপত্য অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কলার এবং টাঁকশালের অ্যাসেয়ার জেমস প্রিনসেপের নামে উৎসর্গীকৃত। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে এসে জায়গাটা এত ভালো লেগেছিল যে বৃন্দা ঠিক করে রেখেছিল সুযোগ পেলে একবার ঘুরে যাবে।

আজ সেই দিন। অ্যানাটমির সাপ্লি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিন দময়ন্তী এত টেনসড ছিল যে শান্তিধামে ফোন করে মন্দিরার কাছে অনুমতি নিয়েছে যাতে বৃন্দাকে অন্তত এক রাতের জন্য লেডি আর্চার্স হোস্টেলে ছাড়া হয়।

মন্দিরা এখন তুমুল ব্যস্ত। বিধবাপুকুরের ওয়ার্কশপ চলছে শান্তিধামে। একগাদা কমবয়সি থিয়েটার আর্টিস্টদের সঙ্গে। ওয়ার্কশপ কনডাক্ট করছে কলকাতার নামজাদা নাট্যপরিচালক সোহাগিনী দে। জমিদারের ভূমিকায় অভিনয় করছেন মুম্বইয়ের বিশাল কপুর। বিশালের দ্বিতীয় পরিচয়, তিনি অভিনেত্রী চন্দ্রিমার স্বামী। মুম্বইতে বিশালের বউ ও এক ছেলে আছে। ছেলের নাম ভিকি। বিশালের বউ চন্দ্রিমাকে দু’চক্ষে দেখতে না পারলেও ভিকির সঙ্গে চন্দ্রিমার সম্পর্ক ভালো। ভিকি কলকাতায় এলে চন্দ্রিমার লেক গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে ওঠে। ইন্ডাস্ট্রির সবাই জানে যে ফ্ল্যাটটা বিশালের টাকায় কেনা।

বিশাল বাংলার ‘ব’ জানেন না। মদ খেয়ে এত মোটা হয়ে গেছেন যে এখন মুম্বইতে হিরোর বাবার রোলও পান না। তাই টলিউডে ছিপ ফেলেছেন। ফ্লপ বলিউড অভিনেতাদের আপন করে নেওয়ার জন্য চিৎপুরের যাত্রাপাড়া সব সময়ে রেডি।

বিশালের বাংলা বলা নিয়ে ওয়ার্কশপে রোজ খোরাক হচ্ছে। বিশালের মন্দিরাকে বলার কথা, ‘বেদানা, আমি খাব।’ তিনি বলেছেন, ‘বেদানা, হামি খাব!’ তাই নিয়ে প্রবল হাসাহাসি! ওয়ার্কশপের পাশাপাশি চলছে কস্টিউম আর প্রপ নির্বাচন। পুরনো দিনের গাড়ি, গাড়ির নাম্বার প্লেট, সিগারেট, দেশলাই, পাঁজি, বাসন, আসবাবপত্র —এই সব জোগাড় করা। মনোতোষের নেতৃত্বে এই সব রিসার্চ ওয়ার্ক শান্তিধামেই হচ্ছে। শান্তিধাম এখন প্রি-প্রোডাকশানের অফিস। মন্দিরার ছোটাছুটির অন্ত নেই। মায়াকমের তরফে হৈমবতী মাঝে মাঝে আসেন। ওয়ার্কশপে এসে ঘণ্টাচারেক চুপচাপ বসে থাকেন, একটা দুটো কমেন্ট করেন, চলে যান। মনোতোষ এক দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত। তিনি যে রকম ভাবে ছবিটা ভেবেছেন, সেই ভাবেই হবে। আইটেম নাম্বার বা বেড সিন ঢোকানোর চাপ নেই। হৈমবতী বলেছেন ‘ডিরেক্টর্স কাট’ দেখার পরে যা বলার বলবেন।

মন্দিরা বেজায় ব্যস্ত। বৃন্দার হোস্টেলে থাকা নিয়ে দময়ন্তী অনুমতি চাইতেই ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছেন। রাত্তিরে শোবার সময় স্যামি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হঠাৎ হোস্টেলে থাকবে কেন? অন্য কোনও চক্কর নেই তো?’

আয়নার সামনে বসে মুখে ক্লিনিং-টোনিং-ময়েশ্চারিং-এর রুটিন ফলো করতে করতে মন্দিরা বলেছিলেন, ‘ওর রুমমেটের কালকে সাপ্লির রেজাল্ট বেরোবে। সে একা হোস্টেলে থাকতে পারবে না বলে বৃন্দাকে ডেকেছে। এর মধ্যে চক্কর থাকবে কেন?’

স্যামি অলরেডি কোহলঘুমে আচ্ছন্ন। মন্দিরার উত্তর শোনেননি।

সেকেন্ড এমবিবিএস-এর থিয়োরি ক্লাস শেষ করে বৃন্দা বাড়ি চলে গিয়েছিল। রাত ন’টার সময় সুলতান তাকে লেডি আর্চার্স হোস্টেলে ছেড়ে দিয়ে গেল। তেরো নম্বর ঘরে ঢুকে বৃন্দা দেখল দময়ন্তী নিজের খাটে বসে কানে তার গুঁজে গান শুনছে। চোখ বন্ধ। দময়ন্তীর পাশে বসে একটা তার খুলে নিজের কানে গুঁজে বৃন্দা অবাক। গম্ভীর এক পুরুষ কণ্ঠ বলছে, ‘শ্বাস নিন। নাক দিয়ে টেনে নিন নির্মল বাতাস। অনুভব করুন যে আপনার ফুসফুস বিশুদ্ধ অক্সিজেন ভরে যাচ্ছে…’

‘কী সব ভুলভাল শুনছিস?’ হাসতে হাসতে বলে বৃন্দা।

‘ডিপ ব্রিদিং টেকনিক। রিল্যাক্সেশান এক্সারসাইজ। স্ট্রেস কমায়।’ উত্তর দেয় দময়ন্তী। বৃন্দা কান থেকে তার খুলে নিয়ে বলে, ‘ন্যাকামো রাখ। খেতে চল। কাল আমি ভোরবেলা বেরোব।’

‘আমায় একলা ফেলে রেখে কোথায় যাবি?’

‘অভির সঙ্গে কাল ভোরবেলা প্রিনসেপ ঘাটে বেড়াতে যাব। টেনশানের চোটে বেচারার মুখচোখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। আর তোকে একলা ফেলে রাখার কী আছে? তুই তো এক্ষুনি টপাং করে মুখে একটা অ্যালোপাম ফেলে সারারাত ভোঁসভোঁস করে ঘুমোবি।’

‘তা হলে তাই করা যাক।’ খেতে যাওয়ার আগে জিভের তলায় ওষুধ রেখেছিল দময়ন্তী। বৃন্দার সঙ্গে রাতে অভির দেখা হয়নি। ফোনে কথা হয়েছিল, ছ’টার সময় কলেজের সামনে বাসস্ট্যান্ডে দেখা হবে।

দু’জনেই ঠিক সময়ে এসেছিল। অভি পরেছে ফেডেড ব্লু জিনস, সাদা ভি-নেক সোয়েটার, পায়ে নীল-সাদা স্নিকার। গলায় লাল মাফলার জড়ানো। ভোরবেলা বেরোনোর আগে দাড়ি কামিয়েছে, স্নান করেছে, ভালো আফটার শেভ লাগিয়েছে। একটানা পড়াশুনা করে খানিকটা রোগা হয়েছে। যার ফলে ম্যাচিওরড লাগছে। একবছরের আগের মফসসলি তরুণ এখন তরতাজা যুবক।

বৃন্দা পরে আছে সাদা ডেনিম আর গোলাপি পুলওভার। মাথায় লাল টুপি, পায়ে লাল স্নিকার। ভোরবেলা ট্যাক্সি পাওয়া সোজা। প্রিনসেপ ঘাটের নাম শুনে ড্রাইভার বলল, ‘সে তো অনেক দূর মা জননী। দশটা টাকা একট্রা দেবেন।’

‘না।’ গম্ভীর গলায় বলে অভি।

‘ভাইটি, রাগ করে না, সকাল বেলা মন প্রশান্ত রাখতে হয়। পাঁচটা টাকা এক্সট্রা দিও।’

‘আমি ”মা জননী” আর ও ”ভাইটি”? আমার বেলা ”দেবেন” আর ওর বেলায় ”দিও”? যাব না আপনার ট্যাক্সিতে।’ গাঁকগাঁকিয়ে চ্যাঁচায় বৃন্দা।

ড্রাইভার আঁতকে উঠে বলে, ‘সক্কালবেলা সাক্ষাৎ মায়ের দর্শন পেলুম! আমার আজ আর কিচ্ছু লাগবে না। আপনারা বসুন। আমি পৌঁছে দিচ্ছি।’

প্রিনসেপ ঘাটে পৌঁছে ড্রাইভারকে গুনে গুনে টাকা দিয়েছে বৃন্দা। মাঠ পেরিয়ে, সৌধ পেরিয়ে দু’জনে বসেছে গঙ্গার ধারের বেঞ্চিতে। সারা রাস্তা বৃন্দা অভির সঙ্গে কথা বলেনি। এখন গঙ্গার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বলল, ‘আজ থেকে ক্লাস শুরু করবি তো?’

‘আগে রেজাল্ট দেখি।’ নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয় অভি।

‘প্যাথোলজির এইচওডি রিনা দত্ত আমাদের হোস্টেলের সুপার। খুব দিলখোলা মহিলা। রিপুদা আর চন্দনের সঙ্গে অলরেডি খুব র‌্যাপা।’

‘শুনেছি উনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ভালো রিলেশান রাখেন। সুরজ, সঞ্জয়, সব্যসাচী, দাদা—এদের সঙ্গেও খুব দহরম মহরম।’

‘ওই দহরম মহরমের জোরেই চন্দন আর রিপুদা বেঁচে গেল। না হলে সঞ্জয়ের ভিডিওটা নিয়ে বিশাল কেলো হতো।’

সঞ্জয় ভিডিও ক্লিপটা নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি করেনি। ইউটিউব বা সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আপলোড করা, নিউজ চ্যানেলকে মেল করা, বন্ধুদের এমএমএস করা—কিস্যু করেনি। শুধু সন্ধে থেকে সারা রাত ধরে হোস্টেলের ঘরে ঘরে গিয়ে ভিডিওটা দেখিয়েছে। দশ মিনিটের ভিডিও। সব রুমে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রথমদিকে প্রতি রুমে চারজন করে ছেলে দেখেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুমে রুমে ছেলের সংখ্যা বেড়েছে। চন্দন এবং রিপু যখন হাসপাতালে, তখন অর্ধেক হোস্টেল ভিডিও দেখে ফেলেছে। সঞ্জয় বুদ্ধিমানের মতো দুটো কাজ করেছে। ছেলেদের অনুরোধ সত্ত্বেও ভিডিওটা শেয়ার করেনি। বলেছে, ‘এটা বাইরে গেলে দু’জনের কেরিয়ারের ক্ষতি হয়ে যাবে। সেটা আমি চাই না। আমি শুধু সত্যিটা দেখাতে চাই।’ ভোর পাঁচটার সময় জনা পঞ্চাশেক ছেলেকে সাক্ষী রেখে ক্লিপটা ডিলিট করে সঞ্জয় শুতে যায়।

বুদ্ধিমানের মতো দ্বিতীয় কাজটা হল, গোটা অপারেশানের সময় ও সুরজকে সামনে আনেনি। রূঢ় ব্যবহার এবং দাদাগিরির জন্য সুরজকে ছাত্ররা অপছন্দ করে। মোবাইলের মনিটরে রক্তমাখা সুরজের মুখই সিমপ্যাথি ওয়েভের জন্য যথেষ্ট। আসল সুরজ এই ওয়েভে নুইসেন্স ভ্যালু ছাড়া আর কিছু অ্যাড করবে না।

রাতজাগা সেই হুইসপারিং ক্যাম্পেনের ফলাফল পরদিন ভোটের সময় বোঝা গিয়েছিল। যাদের ভোট দেওয়ার কথা নয়, এমন সব ছেলেও ভোট দেবে বলে দূরের জেলা থেকে হাঁচোড় পাঁচোড় করে হোস্টেলে চলে এল। কলকাতার যেসব ছেলে কোনও দিন হোস্টেলে থাকেনি, নাম কা ওয়াস্তে একটা বেড অকুপাই করে রেখেছে, তারাও ভোট দেবে বলে চলে এল। হোস্টেল ইলেকশানে ষাট থেকে পঁয়ষট্টি শতাংশের বেশি ভোট পড়ে না। নব্বই শতাংশ ভোট পড়া অভূতপূর্ব ঘটনা। ভোটের রেজাল্ট বেরোতে দেখে গেল, বোর্ডার্স কমিটির অর্ধেক নবযুগ পার্টির দখলে। চন্দন ভোটে গোহারান হেরেছে। তার দলের যারা জিতেছে, তাদের মার্জিন তিন থেকে চার ভোটের।

হাং পার্লামেন্টের মতো হাং বোর্ডার্স কমিটি। দু’পক্ষই যুযুধান। মিটিং-এ এক পক্ষ কোনও সিদ্ধান্ত নিলে অন্য পক্ষ সেটা বাঞ্চাল করে দিচ্ছে। মেসের খাবারের কোয়ালিটি আবার খারাপ হতে শুরু করেছে। কেন না বোর্ডার্সরা মাসের শেষে টাকা না দিয়ে বলছে, ‘পরের মাসে দেব।’ রিপু আর চন্দন কাউকে চমকাতে গেলে ন্যাবা পার্টি তেড়ে আসে। সুরজ বা সঞ্জয় কাউকে টাকা ঠিক সময়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গেলে মোচাপার্টি তেড়ে যাচ্ছে। নেপু ব্লকের থার্ড ফ্লোরে আবার মিনি মেস শুরু হয়েছে। ব্যাডমিন্টন কোর্টে গাঁজাগাছ ফনফনিয়ে বাড়ছে। সন্ধে নাগাদ নেপু-ব্লক থেকে কড়া গাঁজার গন্ধ ভেসে আসে। দু-একজন প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল। সুরজ বলেছে, ‘ঘরের মধ্যে স্মোক করলে তোর কী? ফোট এখান থেকে।’

সব থেকে দুশ্চিন্তার কথা হল হোস্টেলে অজানা এবং সন্দেহজনক চেহারার লোকের আনাগোনা বাড়ছে। সন্ধে হলেই কমবয়সি কিছু রোগাটে ছোকরা রিপু বা সুরজের ঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে গুজুর গুজুর করে। এখনই এই অবস্থা। জুলাই মাসে ইউনিয়ন নির্বাচন। তখন কী হবে, কে জানে!

‘ওই ভিডিওটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।’ চা-ওয়ালার কাছ থেকে দু’ভাঁড় চা নিয়ে বলে বৃন্দা।

‘সেক্স অ্যান্ড ভায়োলেন্স অলওয়েজ সেলস!’ মুচকি হাসে অভি। অভির হাসি দেখে বৃন্দার বুক আনন্দে ভরে যায়। রোগাপাতলা, ভ্যাবলাটে, আনস্মার্ট ছেলেটার মধ্যে সে কী দেখেছে, নিজেও জানে না। অভিকে পৃথিবী শ্রেষ্ঠতম পুরুষ বলে মনে হয়। ইংরিজিতে একটা কথা আছে, ‘ইউ হ্যাভ টু কিস আ লট অব ফ্রগস বিফোর ইউ গেট ইয়োর প্রিন্স।’ বৃন্দার হয়তো আরও অনেক ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করা উচিত। কলেজে সিনিয়র দাদারা নানারকম ইঙ্গিত ও ইশারা নিয়মিত করে থাকে। কেউ এমডি, এমএস বা ডিএনবি করছে। কেউ ইংল্যান্ড যাচ্ছে, কেউ আমেরিকা। প্রতি বছর গাদাগাদা ছেলেমেয়ে ইংল্যান্ড পাড়ি দিচ্ছে ওখানকার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে জয়েন করার জন্য। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তাদের বৈভবের ছবি দেখতে পায় বৃন্দা। অনেকরকম অসুবিধে আছে। গায়ের রং সংক্রান্ত বৈষম্য, পে স্কেলের বৈষম্য, স্কিন হেডের ঘৃণা। কিন্তু শান্ত, নিরুপদ্রব জীবনযাপন। করাপশান নেই, পলিউশন নেই, রোজকার জীবনে অসহ্য রাজনীতি নেই, চোর-ডাকাতের ভয় নেই, রাস্তায় খানাখন্দ নেই। ওইরকম এনআরআই কোনও ডাক্তারকে পছন্দ করলে বৃন্দার জীবন অন্য খাতে বইবে। স্যামি সেই রকমটাই চান। মন্দিরাও তাই চান হয়তো। বৃন্দা কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিল না তো? সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ালে বৃন্দা কি পারবে, দক্ষিণ কলকাতা ছেড়ে মফসসলে নিজেকে মানিয়ে নিতে? মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঢেউ খেলছে। মাথার মধ্যে ঘোঁট পাকাচ্ছে সংশয়ের কুয়াশা। গঙ্গার ধারের বেঞ্চিতে বসে ভাঁড়ে চুমুক দেয় বৃন্দা। দেখা যাক, কপালে কী আছে।

অভিও চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আড়চোখে ঘড়ি দেখছে। চেহারায়, হাবেভাবে টেনশানের ছাপ। শরীরের ভাষায় অস্থিরচিত্ততা। বেচারা! ফুরিয়ে যাওয়া ভাঁড় বিনে ছুঁড়ে ফেলে বৃন্দা অভির হাত ধরল। বলল, ‘চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বৃন্দা জানে, সে এই কথাগুলো শুধু অভিকে বলল না। নিজেকেও বলল।

অন্যদিনের মতো বৃন্দার স্পর্শ পেয়ে অভির হাত সিঁটিয়ে গেল না। নিজের দু’হাতের দুটি পাতা বৃন্দার হাতের পাতার মধ্যে ঢুকিয়ে অভি বলল, ‘আমার হাত কী ঠান্ডা! আর তোর হাত কী গরম!’

‘আমি দু’হাতে চায়ের ভাঁড় ধরেছিলাম তো! তাই গরম।’ অভির হাতের তালু ঘষতে ঘষতে বলে বৃন্দা। অভির গলা থেকে লাল টুকটুকে মাফলার টেনে নিজের হাতের তালু মুছে বলে, ‘আমারও শীত করছে।’

ঠিক তখনই গঙ্গার থেকে বয়ে এল এক ঝলক ভিজে বাতাস। ঠিক তখনই বটগাছের পাতায় পাতায় দোলা লাগল। ঠিক তখনই মাফলারের মতো এক চিলতে মেঘ সূর্যদেবকে ঢেকে দিল। চা-ওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে বসল। পুলিশের কিয়স্কে বসে থাকা পুলিশকর্মী খবরের কাগজের শব্দজব্দ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মাঝেরহাটগামী ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল, কিন্তু হর্ন দিল না। দু-একজন অফিসযাত্রী প্ল্যাটফর্মে নেমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

এতসব আয়োজন যার জন্য, সেই অভি এখন বৃন্দার দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখ। অবশেষে অভির দৃষ্টি নামে বৃন্দার ওষ্ঠে। বৃন্দার হাত থেকে নিজের হাত বার করে নিয়ে দু’গালে রাখে সে। যেভাবে একটু আগে গরম ভাঁড় বৃন্দা তার হাতের মধ্যে রেখেছিল, সেইভাবে বৃন্দাকে ধরে অভি। এখনও তার মনে দ্বিধা।

আবার গঙ্গার দিক থেকে একঝলক বাতাস বয়ে আসে। আবারও বটগাছের পাতায় দোলা লাগে। টুপটাপ করে অধৈর্য পাতারা ঝরে পড়তে থাকে। ভল্লের মতো একফালি রোদ ছুঁড়ে দিয়ে সূর্যদেব আবার মেঘের আড়ালে চলে যায়। চা-ওয়ালা নিজের জন্য এক ভাঁড় চা নেয়। পুলিশকর্মী নরম সুরে গলা খাঁকরায়। বেচারি আর কতক্ষণ মাথা নিচু করে থাকবে!

শুধু অফিসযাত্রীরা হাঁটা লাগায়। তাদের অত সময় নেই।

অভি ঠোঁট নামিয়ে আনে। বৃন্দা চোখ বন্ধ করে তুলে ধরে নিজের ঠোঁট। একের ওষ্ঠ ও অধর অপরের ওষ্ঠ ও অধর স্পর্শ করে, ছুঁয়ে পরস্পরকে চিনতে থাকে, জেনে নিতে চায়। দু’জনের কাছেই এ এক নতুন অনুভূতি। দু’জনের কাছেই এ এক অজানা মহাদেশে প্রবেশের পাসপোর্ট।

চুম্বনপর্ব চলল সামান্যক্ষণ। চমকে উঠে পরস্পরের থেকে দূরে সরে বসে বৃন্দা আর অভি। বৃন্দা মাথা নিচু করে দু’হাতে নিজের মুখ ঢাকে। অভি বেঞ্চির অন্য প্রান্তে চলে যায়। ট্রেনের ড্রাইভার খুশি হয়ে লম্বা হর্ন বাজায়। শব্দছকের কঠিন সূত্রে বিরক্ত হয়ে পুলিশ কিয়স্ক থেকে বেরিয়ে এসে আড়মোড়া ভাঙে। চা-ওয়ালা তাকে এক ভাঁড় চা দেয়। আকাশে এখন সূর্য গনগন করছে। গঙ্গার থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস আর রোদের মিশেলে চমৎকার পরিবেশ। পুলিশ এক গাল হেসে বললেন, ‘চা খান! খুব ভালো চা!’

বৃন্দার গাল লজ্জায় লাল হয়ে আছে। সে বলল, ‘এই তো একবার খেলাম।’

‘খান তো! আমি পয়সা দেবো। বাবুঘাটের চা হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চা। আসাম, দার্জিলিং, নীলগিরি, কামস্কাটকা, গুয়াতামেলা—সব ফেল!’ হাসতে হাসতে বলে পুলিশ। চা-ওয়ালা দু’ভাঁড় চা বৃন্দা আর অভির হাতে তুলে দেয়। চায়ে চুমুক দিয়ে বৃন্দা বলে, ‘খুব ভালো চা। কিন্তু আপনি পয়সা দেবেন এটা কি ঠিক?’

‘একদম ঠিক নয়। তবে দুনিয়ায় কটা ঠিক কাজ হয় বলো? পুলিশে ঘুষ খায়, ডাক্তার রোগীকে মেরে ফেলে, উকিল টাকা খেয়ে কেস হেরে যায়, এমএলএ জনগণের টাকায় বাড়িগাড়ি করে। এত বেঠিকের মধ্যে আর একটা বেঠিক যোগ করে দিলাম।’ মুচকি হেসে বলে পুলিশ। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বৃন্দা আর অভি স্ট্র্যান্ড রোডে আসে। সাড়ে আটটা বাজে। এবার হোস্টেলে ফেরা যাক।

মেটিয়াবুরুজ-শেয়ালদার মিনিবাসে শেয়ালদা আসতে সময় লাগল আধঘণ্টা। যাত্রাপথে কেউ কোনও কথা বলেনি। ফাঁকা বাসে দু’জনে দু’জনের হাত ধরে বসেছিল। নিজেকে ভীষণ পূর্ণ, ভীষণ শান্ত লাগছে বৃন্দার। অনেকদিন ধরে পথ চলতে চলতে হঠাৎ কোনও মুসাফিরখানার সন্ধান পেলে ক্লান্ত যাত্রী যেমন নিশ্চিন্ত বোধ করে, বৃন্দাও এখন তেমনই চিন্তাহীন। মনের কথা মনে পুষে রাখা, ইশারা, কাগজের হাত বদল, ইঙ্গিত, চোখের ভাষা পড়ে নেওয়া—এই সব অনিশ্চয়তার শেষে সম্পর্কটা কোথাও পৌঁছল। যাকে বলা যায়, ‘সিলড উইদ আ কিস’।’

মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে অভি বয়েজ হোস্টেলের দিকে এগোল। বলল, ‘বারোটার সময় অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর সামনে আসছি।’

‘আচ্ছা।’ টাটা করে লেডি আর্চার্স হোস্টেলে ঢোকে বৃন্দা। তেরো নম্বর ঘরে দময়ন্তী খাটে বসে রয়েছে, আর ফুলমতিয়া মেঝেতে বসে বকবক করছে। বৃন্দা বলল, ‘কী বলছ ফুলমতিয়া?’

‘দিদিমনিকে গোলপো শোনাচ্ছি। হমাদের নদিয়া কি পারের গোলপো।’ হাসতে হাসতে বলে ফুলমতিয়া। ‘শ্যামলাল হেলা নামে এক সুইপার ছিল। পচাস সাল উমর হয়ে গেছে কিন্তু আলুর দোষ যায়নি।’

‘আঃ! ফুলমতিয়া!’ আপত্তি করে দময়ন্তী।

‘আলুর দোষকে বেগুনের দোষ বললে ভালো লাগবে?’ মুখঝামটা দেয় ফুলমতিয়া, ‘তো, শ্যামলালের ছেলে রাজুর বিশ-বাইশ সাল উমর হল। সে রোজ নতুন নতুন মেয়েকে লাইন মারে। রাত্তিরে আড়ালে ডেকে বসে শ্যামলাল রাজুকে বলে, ”পিঙ্কির সঙ্গে পিকচার গেলি? ভালো কথা। লেকিন পেয়ার মতো কর না। উও তেরা বহিন হ্যায়। পিঙ্কি কি মা-কি সাথ মেরি চলতি থি।”’

 ‘পরের দিন রাজু নতুন লেড়কি ঢুঁড়ল। রাতে শ্যামলাল বলল, ”আজ টিনার সংগে আইস কিরিম খাচ্ছিলি। ভালো কথা। কিন্তু প্যায়ার মহব্বত করিস না। ও তোর বোন আছে। টিনার মায়ের সঙ্গে আমার আশনাই ছিল।” এরপরে যাদের পিছনেই রাজু হিড়িক মারে, শ্যামলাল বলে, ”ও তোর বহিন আছে”।’

‘তারপর?’ অবাক হয়ে বলে বৃন্দা।

‘তারপরে আর কী? রাজু কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে পড়ল। রাজুর মা বলল, ”তোর কীসের দুখ বেটা? তুই হমাকে বল।” রাজু মাকে সব খোলসা করে বলল। মা শুনে খুব একচোট হেসে বলল, ”পিঙ্কি, টিনা, নিশা, নেহা—নদিয়া কা পারের যত লেড়কি আছে, তুই সব্বাইকে লাইন মার। ওরা শ্যামলালের মেয়ে হতে পারে, কিন্তু তুই শ্যামলালের ছেলে নোস। আমি তোকে গ্রান্টি দিয়ে বলছি”।’

ফুলমতিয়ার গপপো শুনে হাসতে হাসতে বৃন্দা আর দময়ন্তীর পেট ফেটে যাবার জোগাড়, কোনওরকমে ফুলমতিয়াকে তেরো নম্বর থেকে বার করে বৃন্দা বলল, ‘চান কর। ব্রেকফাস্ট কর। কলেজ চল। ঘরে ভুতনির মতো বসে থাকিস না। রেজাল্ট দেখে প্যাথোলজি প্র্যাকটিকাল ক্লাসে যেতে হবে। তুই পাস করে গেছিস। এটা হামি গ্রান্টি দিয়ে বলছি।’

‘আ-চছা।’ লম্বা হাই তুলে বিছানা থেকে উঠল দময়ন্তী।

রেজাল্ট দেখার সময় খুব অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স হল। সাড়ে এগারোটার সময় বৃন্দা অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এ পৌঁছে শুনল, রেজাল্ট অলরেডি বেরিয়ে গেছে। বায়োকেমিস্ট্রির আরতী ম্যাডাম জানিয়ে দিয়েছেন, যাদের সাপ্লি ছিল, তারা সবাই পাস করে গেছে। সুরজ এক বাক্স লাড্ডু এনে বিলোচ্ছে।

দময়ন্তী আপনমনে বলল, ‘থ্যাংক গড। এবার বাড়ি যাব।’

‘ক্লাস করবি না?’ প্রশ্ন করে বৃন্দা।

‘আজ না। কাল থেকে।’ ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় দময়ন্তী। ‘রাত্তিরে ফোন করে তোর কাছ থেকে বুকলিস্টটা লিখে নেব।’

অভি সুরজের দেওয়া লাড্ডু খেতে খেতে মোবাইলে কথা বলছিল। বৃন্দা পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সাপ্লির পাওয়ার খবর অভি বাড়িতে জানায়নি। কাজেই এটা বাড়ির ফোন নয়। বিলু একটু আগেই ছোটভাইকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেছে। কাজেই এটা বিলুর ফোনও নয়। এক মনে মোবাইলে কথা শুনছিল অভি। বলল, ‘ঠিক আছে। আমি এখনই কিনছি।’ তারপর ফোন কাটল।

‘বই কিনবি?’ জানতে চায় বৃন্দা।

‘হ্যাঁ। চল কলেজ স্ট্রিট চল।’ একগাল হেসে বলে অভি।

‘এক্ষুনি?’ বৃন্দা অবাক। ‘তোর সঙ্গে টাকা আছে? অনেক টাকার ধাক্কা কিন্তু। রবিনস আর হর্ষ মোহনের প্যাথোলজি; ত্রিপাঠি,শানবাগ আর লরেন্সের ফার্মাকোলজি, পানিক্করের মাইক্রোবায়োলজি, পার্ক অ্যান্ড পার্কের কমিউনিটি মেডিসিন, রেড্ডি আর গৌতম বিশ্বাসের ফরেনসিক মেডিসিন…’

‘সেলাই দিদিমনির মতো জ্ঞান দেওয়া বন্ধ কর। আমি দাদার বইগুলো পড়ি। শুধু যে বইগুলোর নতুন এডিশান হয়, সেগুলো কিনি। আজ শুধু পার্ক কিনব।’ বৃন্দাকে ধমক দেয় অভি। তার হাত পাকড়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বলে, ‘কলেজ স্ট্রিট।’

ট্যাক্সিওয়ালা গাঁইগুঁই করল না। দুপুরের জ্যামের মধ্যে শেয়ালদা ফ্লাইওভারে গুটিগুটি উঠল। বাঁদিকে ঘুরে মহাত্মা গাঁধী রোডে পড়ল। এই রাস্তাতে সব সময়ই বেদম জ্যাম। ট্রাম, রিকশা, সরকারি আর বেসরকারি বাস, অটো মিলে নরক গুলজার করে রেখেছে।

কলেজ স্ট্রিটের মোড়ের একটু আগে নেমে ভাড়া মেটাল অভি। বৃন্দার হাত ধরে রাস্তা পেরোল। বৃন্দা হাসতে হাসতে বলল, ‘ওই দিকে বেনারসি শাড়ির দোকান। মেডিক্যাল বুকস এই দিকে। সাগর দত্ত লেনে।’

‘কথা কম বলা প্র্যাকটিস কর।’ ঝাঁকুনি দিয়ে বৃন্দাকে নিজের কাছে টানে অভি। বেনারসি শাড়ির দোকানের ফুটপাথে উঠে পানবিড়ির দোকান টপকে পত্রিকার দোকানের সামনে দাঁড়ায়। পুঁচকে দোকানটায় অদ্ভুত নামের সব ম্যাগাজিন বিক্রি হচ্ছে। বৃন্দা কখনও নাম শোনেনি। অনুষ্টুপ, প্রমা, বিভাব, কবিতীর্থ, ভাষাবন্ধন, ভাষানগর, রক্তমাংস, কোরক, কৌরব…

একজন মোটামতো লোক চশমা পরে ঝিমোচ্ছে। দেওয়ালে ঝুলছে লম্বাটে পোস্টার। তাতে উমাবার্তো একোর বই সংক্রান্ত কোটেশান রয়েছে। এখানে অভি কী খুঁজছে?

গাদাগাদা ম্যাগাজিনের মধ্য থেকে অভি অন্তহীন নামের একটা পত্রিকা তুলে নেয়। মোটাসোটা ম্যাগাজিনের ওপরে লেখা, ‘কবিতা ও কবিতা বিষয়ক পত্রিকা।’ অন্তহীন শব্দটির হরফগুলো বিভিন্ন ধরনের ফন্টে সাজিয়ে চমৎকার প্রচ্ছদ করা হয়েছে। বৃন্দা এতক্ষণে ব্যাপারটা আন্দাজ করল। এই ম্যাগাজিনটাই স্যামির বন্ধু সুদিন চক্রবর্তী সম্পাদনা করেন।

অভি ম্যাগাজিনের দাম মেটাচ্ছে। বৃন্দা সূচীপত্রে চোখ বোলায়। সে ঠিকই আন্দাজ করছিল। এই সংখ্যায় নামি ও অনামি কবিদের সঙ্গে, ‘দুটি কবিতা’ বিভাগে অভিজ্ঞান লাহিড়ীর কবিতা ছাপা হয়েছে। একটা তার পড়া। অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার সময়ে পাওয়া সেই প্রেমপত্র। অন্যটা পড়ছে, এমন সময় অভি তার হাত থেকে ম্যাগাজিন কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আসল জিনিসটাই দেখিসনি। এই দ্যাখ।’ অন্তহীন পত্রিকা উল্টে ফোর্থ কভার দেখায় সে।

পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের বক্তব্য, ‘প্রতি সংখ্যায় আমরা এক নবীন কবিকে তার কাব্য প্রতিভার জন্য পুরস্কৃত করি। এবার সেই পুরস্কার পাচ্ছেন কবি অভিজ্ঞান লাহিড়ী। পুরষ্কার—এক হাজার টাকার কবিতার বই। কবিকে আমাদের দফতরে এসে পুরষ্কার নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।’

‘জীবনের প্রথম কবিতা লিখে পুরষ্কার?’ বৃন্দা অবাক হয়ে বসে।

‘হ্যাঁ, কলেজের ওই ফোনটা সুদিন চক্রবর্তীর ছিল। উনি আগামী রোব্বার সকালবেলা ওঁর বাড়ি যেতে বললেন। ওঁর বাড়িটাই অন্তহীনের অফিস।’

বৃন্দা বলতে যাচ্ছিল, ‘শনিবার সন্ধেবেলা আমার বাড়ি এলেও তুই সুদিনের দেখা পাবি।’ বলল না। কেননা অভি হঠাৎ বৃন্দাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়েছে। ভোরবেলার ফাঁকা প্রিন্সেপ ঘাটের নরম চুমু নয়। এখন দাঁত দিয়ে বৃন্দার নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে, জিভ দিয়ে হামলাবাজি করছে মুখের ভিতরে। নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বৃন্দা ভাবল, পুরুষমানুষ এক আজব প্রাণী। কে যে কী মন্ত্রে বশীভূত হয়, ভগবানও জানেন না।

.

চন্দন

‘আজকে আমরা পড়ব প্যাথলজি অব এনডোমেট্রিয়াম।’ বললেন রিনা দত্ত। তিনি বাড়িতে তিনকোনা লাল ফ্রেমের চশমা পরেন। এখন, ক্লাস নেওয়ার সময় নাকের ওপরে রয়েছে রিমলেস চশমা। পরনে সবুজ পাড়ওয়ালা সাদা কটনের শাড়ি আর লাল রঙের ব্লাউজ। এসএলটির গ্যালারিতে বসে দময়ন্তী বলল, ‘পরের ইলেকশানে কে ক্ষমতায় আসবে এই নিয়ে কনফিউজড। তাই লাল আর সবুজ দুটো রঙই রেখেছেন।’

সবাই ফার্স্ট এমবি পাশ করে গেছে। এক বছর ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে সবাই কাটিয়ে দিল। এবার শুরু হয়েছে সেকেন্ড এমবি। সেটা চলবে সেকেন্ড ও থার্ড ইয়ার জুড়ে। চতুর্থ বছরে চলবে থার্ড এমবি পার্ট ওয়ান। পঞ্চম বা অন্তিম বছরে আসবে থার্ড এমবি পার্ট টু। সেটা পাশ করলে শুরু হবে ইন্টার্নশিপ।

দময়ন্তীর পাশে বসা চন্দন মুখ ভ্যাটকাল, ‘তোদের এই সুপারটা খুব পারভার্ট। হেবি উল্টোপাল্টা বকেন।’

দময়ন্তী নোট নেওয়ার অভিনয় করতে করতে বলল, ‘ওর বর পুশকিন বেড রিডন। মনে হয় রিনা ম্যাডাম ফিজিক্যালি ডিসস্যাটিসফায়েড। তাই নোংরা কথা বলে আনন্দ পান।’

‘শুনেছিলাম নিরোধ স্যারের সঙ্গে শান্টিং আছে! ওঁর বর পুশকিন সেটা জানেন।’ মন্তব্য করে চন্দন।

‘এটা সব্বাই জানে। তুই নতুন কোনও খবর দিলি না।’ চন্দনকে বলে দময়ন্তী। তার গলার আওয়াজ একটু চড়ে গিয়েছিল। দময়ন্তীর দিকে তাক করে চকের টুকরো ছুঁড়ে রিনা ম্যাডাম তীক্ষ্ন স্বরে বললেন, ‘ক্লাসের মধ্যে কথা বললে আমি কী শাস্তি দিই জানো?’

‘হোপফুলি ক্লাস থেকে বার করে দেন।’ ফুট কাটে দময়ন্তী।

‘ডোন্ট বি সো অপটিমিস্টিক। আমি পুরো ক্লাস করাই কিন্তু পার্সেন্টেজ দিই না। সো, নিজের দায়িত্বে বকবক কোরো।’ ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ঘুরে যান রিনা।

দময়ন্তী অন্য পাশে বসা বৃন্দাকে বলে, ‘এ তো মহা অশান্তি হল। তোরা এর ক্লাস করছিস কী করে? হোস্টেলে ফিমেল দেবদাস আর কলেজে হান্টারওয়ালি!’

‘শশ!’ দময়ন্তীকে চুপ করিয়ে, বৃন্দা অন্য পাশে বসে থাকা অভির দিকে তাকায়। অভি গতকাল থেকে খুশিয়াল মুডে রয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের দোকান থেকে এক ডজন অন্তহীন কিনে বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়েছে। আগামী রোব্বার সুদিন চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা হবে, এই স্বপ্নে মশগুল। বন্ধুরা ম্যাগাজিন পেয়ে খুশি। বৃন্দা নিজের কপি ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে। চন্দন ম্যাগাজিন উলটে বলেছে, ‘কবিতা আমার ট্যান যায় বস। এই বই অন্য কাউকে দে।’ চন্দনের কপি টিনটিনকে দিয়েছে অভি।

টিনটিনও কবিতা লেখে। সে বলেছে, ‘অন্তহীন খানদানি লিটল ম্যাগাজিন। গত পঞ্চাশ বছর ধরে রমরমিয়ে চলছে। সত্তর, আশি, নব্বই বা শূন্য দশকের সব কবিই কখনও না কখনও অন্তহীনে লিখেছেন। তুই জাতে উঠে গেলি অভি!’ শুনে অভির গাল লাল।

টিনটিন দেখে বলল, ‘ব্লাশ করছিস? এ তো খাঁটি কবির লক্ষণ! তবে পাশাপাশি পড়াশুনোটাও চালা। কবিতা লিখে তো খেতে পাউরুটি আর ঝোলাগুড়ের খরচও উঠবে না।’

কলেজ স্ট্রিট থেকে কেনা কমিউনিটি মেডিসিনের ঢাউস বই দেখিয়ে অভি বলেছে, ‘এই দ্যাখো। আমি পড়াশুনোও করছি।’

বৃন্দা গতকাল কিনেছে হর্ষ মোহনের টেক্সট বুক অব প্যাথোলজি। ব্যাকপ্যাক থেকে বইটা বার করে জরায়ুর ঝিল্লির ছবি অভিকে দেখায় বৃন্দা।

‘মেনস্ট্রুয়েশান ইজ দ্য উইপিং অফ দ্য উম্ব,’ বললেন রিনা। ‘জরায়ু তার আসন সাজিয়ে, ডিম্বাণুকে কনেচন্দন পরিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। শ্রীমান শুক্রাণু এলে বর-কনের মিলন হবে। নিষিক্ত ডিম্বাণু আসন গ্রহণ করবে জরায়ুর ঝিল্লিতে। কিন্তু লগ্ন পেরিয়ে গেল। সে এল না। মনের দুঃখে ঝিল্লি খসিয়ে ফেলল জরায়ু। কিপ ইন মাইন্ড, শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মধুর মিলন হয়ে গেলে ওই ঝিল্লি ভ্রুণের বাসস্থান হিসেবে আগামী দশমাস পাতা থাকত জরায়ুর গায়ে। তখন মাসিক রক্তস্রাব হতো না। গর্ভবতীদের এই কারণেই পিরিয়ডস হয় না।’

‘রিনা ম্যাডাম প্রচুর ভাট বকে তো!’ বিরক্ত হয়ে বলে প্রবাল। সে চন্দনের সামনে বসে রয়েছে। ‘কঠিন বিষয় নিয়ে ফালতু হ্যাজাচ্ছে।’

সুরজ পাশ থেকে বলল, ‘লড়কি লোগোকে মহিনাকে বারেমে হমলোগ কিঁউ জাসুসি করে? হাম তো জেমসিকা ”সেফ পিরিয়ড” কা খেয়াল রাখতা হ্যায়। ব্যস!’

সঞ্জয় সুরজকে বলল, ‘চুপ হো জা! ইয়ে ম্যাডাম হারামি হ্যায়।’ রিনা ম্যাডাম ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ধমক দিতে যাচ্ছিলেন। সঞ্জয়কে বাঁচানোর জন্যে ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে দীপ জিজ্ঞাসা করল, ‘হরমোনাল চেঞ্জটা একটু বোঝাবেন ম্যাডাম।’

ব্ল্যাকবোর্ডে ছবি এঁকে নানান হর্মোনের নাম আওড়াচ্ছেন রিনা। চন্দন নোট নিতে নিতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল…

.

হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির ইলেকশানের আগে সুরজকে মারধোর করার প্ল্যানটা ব্যাক ফায়ার করায় রিপু এখন চুপচাপ। মন দিয়ে পড়াশুনা করছে। একশো পঁচিশ থেকে খুব একটা বেরোয় না। মেডিক্যাল কলেজে মারপিটের রাজনীতি ঢোকানোর জন্য জেলা কমিটির মিটিং-এ অধীর প্রচণ্ড ঝাড় খেয়েছেন। সঞ্জয়ের তোলা ভিডিও ক্লিপটার কথা সবাই জেনে গেছে। রিপু আর চন্দন ভয়ে ভয়ে আছে যে ওটার কপি সঞ্জয় স্টোর করে রেখেছে। ইউনিয়ন ইলেকশানের আগে বাজারে ছাড়বে।

রেজাল্ট বেরোনোর কয়েকদিন আগে অধীর চন্দনকে আনসারুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অধীরের কড়া নির্দেশ ছিল, রিপু যেন জানতে না পারে। রিপুর সঙ্গে ওখানে আগে গিয়েছে চন্দন। এইবার একা যেতে কেমন যেন লাগছিল।

অধীরের সঙ্গে কথা বলে চন্দন একটা জিনিস বুঝতে পেরেছে। পার্টির অবস্থা এখন বেশ খারাপ। পার্টি চেষ্টা করছে গণসংগঠনে এমন তরুণ নেতা তুলে আনতে, যার স্বচ্ছ এবং সৎ ভাবমূর্তি আছে। নতুন রক্ত যে কোনও সংগঠনের প্রাণ ভোমরা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরে স্বচ্ছ, সৎ, দুর্নীতিমুক্ত নেতা খোঁজা মানে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা। চন্দনের মধ্যে সূচের সন্ধান পেয়েছেন অধীর। চন্দনের গ্রুমিং-এর দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়েছেন।

.

রিনা ম্যাডামের ক্লাস শেষ। হুড়মুড় করে গ্যালারি থেকে নামছে ছেলেমেয়েদের দঙ্গল। এরপরে রয়েছে কমিউনিটি মেডিসিনের ক্লাস। ক্লাস নেবেন হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট নীরদ দে। শান্ত, সৌম্যদর্শন, অবিবাহিত মানুষটি সার্পেন্টাইন লেনে বাড়ি ভাড়া নিয়ে একা থাকেন। সামনের বছর রিটায়ারমেন্ট।

সাবজেক্ট হিসেবে কমিউনিটি মেডিসিন ছাত্রছাত্রীদের কাছে বেশ বোরিং। বিভিন্ন রোগের ইতিহাস, সমাজে তার প্রভাব, পরিশ্রুত পানীয় জল বা নির্মল বাতাসের গুরুত্ব জানতে কেউ আগ্রহী নয়। নীরদ আপ্রাণ চেষ্টা করেন বিষয়টিকে মনোগ্রাহী করতে। দুঃখের বিষয় হল তাঁকে রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিনের ক্লাসও নিতে হয়। তার মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কনডোম, ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল, কপার টি—এই সব জিনিস দেখাতে হয় প্র্যাকটিকাল ক্লাসে। নীরদের নাম হয়ে গেছে নিরোধ স্যার। প্যাথলজির রিনা ম্যাডাম আর বায়োকেমিস্ট্রির আরতী ম্যাডামের সঙ্গে ওঁর শারীরিক সম্পর্কের কথা সবাই জানে বলে নামটা আরও মান্যতা পেয়েছে।

গ্যালারি দিয়ে নামতে নামতে অভি বলল, ‘নিরোধ স্যারের ক্লাস করবি নাকি?’

‘নাঃ!’ জবাব দেয় চন্দন, ‘হেবি বোর! তুই যা! নতুন মুখ দেখলেই চিনে রাখবেন। পরে ধরা দেব। পারলে আমার প্রক্সিটা দিয়ে দিস।’

‘তুই কোথায় যাবি?’ এসএলটি থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করে অভি।

‘আমি হোস্টেলে ফিরে ঘুমোব। অ্যাই দময়ন্তী!’ অভির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে হাঁক পাড়ে চন্দন।

‘কী?’ কান থেকে মোবাইলের ইয়ার প্লাগ খুলে জানতে চায় দময়ন্তী।

‘দিনরাত বিলুদার সঙ্গে দাঁড়ে বসে কী গুজুর গুজুর করিস? অভিকে পছন্দ হল না? এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে। ওর দাদাকে পাকড়ালি!’ আওয়াজ দেয় চন্দন।

‘দ্যাটস নান অব ইয়োর বিজনেস।’ চন্দনকে ধমকে আবার কানে ইয়ার প্লাগ গোঁজে দময়ন্তী।

চন্দনের এই প্রশ্নের পিছনে দুটো উদ্দেশ্য আছে। অভিকে দময়ন্তীর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে পারলে বৃন্দাকে খালি পাওয়া যায়। তা না হলে এটা ‘এক ফুল দো মালি’ কেস হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। দময়ন্তী পিএমএফ-এর নেতার সঙ্গে কেন ওঠাবসা করছে, সেটা জানা জরুরি। ন্যাবা পার্টির রমরমা কলেজে যথেষ্ট বেড়েছে। এই বাজারে পিএমএফ নিয়েও যদি মাথা ঘামাতে হয়, তা হলে বিপদ।

অভি আর বৃন্দা কমিউনিটি মেডিসিনের প্র্যাকটিকাল ক্লাসের দিকে এগোল। দময়ন্তী লাইব্রেরির দিকে। চন্দনের গন্তব্য বয়েজ হোস্টেল। অধীর গতকাল চন্দনকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘হ্যালো ডাক্তার!’

‘বলুন অধীরদা।’

‘আগামিকাল একটা ছেলেকে তোমার কাছে পাঠাব। হোস্টেলের রুমে মিট কোরো। বাইরে নয়।’

চন্দন চুপ। তার সঙ্গে অধীরের যোগাযোগের কথা রিপু যেন জানতে না পারে, এই রকম নির্দেশ দিয়েছেন খোদ অধীর। কিন্তু রিপু চন্দনের রুমমেট। রিপুর সামনে অতিথিকে রুমে ডাকা যাবে কি না সেটা অধীরই বলবেন।

‘ছেলেটার নাম চিকনা। মৌলালিতে থাকে। বিহারের সিওয়ান জেলার ছেলে। কলকাতায় এসেছিল মোটর মেকানিকের কাজ করতে। আমার হাতে তৈরি পার্টি কর্মী। মৌলালির বস্তি ফেডারেশানের তরুণ তুর্কি।’

একটা ছেলের নাম চিকনা? এমন নাম কখনও শোনেনি চন্দন। অধীর বলছেন, ‘ও তোমাকে ফোন করে হোস্টেলে ঢুকবে। তোমার কাছে যখন যাবে তখন যেন রিপু না থাকে।’

সমস্যার সমাধান অধীর করে দিয়েছেন। নিশ্চিন্ত হয়ে চন্দন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘অধীরদা, চিকনাকে আমার কাছে কেন পাঠাচ্ছেন?’

‘অর্গানাইজেশান চালানো ছেলের হাতের মোয়া নয়। কর্পোরেট অফিস যেমন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা, আমাদের পার্টিও তাই। ট্রিক অব দ্য ট্রেড শিখতে হয়। শুধু পোস্টার সেঁটে, মিছিল করে, স্ট্রিট কর্নারিং করে, লোকের বাড়ি গিয়ে ভোটার স্লিপের চোথা ধরিয়ে ইলেকশানে জেতা যায় না। মেডিক্যাল কলেজের এলিটিস্ট পলিটিক্স আর স্ট্রিট পলিটিক্স আলাদা বল গেম। রিপুকে বলে বলেও শেখাতে পারলাম না। দেখি, তোমাকে দিয়ে কদ্দুর হয়!’

একশো পঁচিশে ঢুকে চন্দন দেখল রিপু জানলা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরের এক কোণে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে পড়ছে। নিঃশব্দে জামা প্যান্ট ছেড়ে বারমুডা আর চে গেভারা আঁকা টি-শার্ট পরল চন্দন। দময়ন্তীকে এইরকম একটা টি-শার্ট পরতে দেখে সে-ও কিনেছে। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে একশো চব্বিশে ঢুকল। অভির ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে সব সময় থাকে। ওর ক্লাস করে ফিরতে ফিরতে চারটে বাজবে। ততক্ষণে চিকনার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হয়ে যাবে।

একশো চব্বিশে ঢুকতে না ঢুকতে অজানা নম্বর থেকে ফোন। ‘চন্দনদা? আমি চিকনা।’

‘চলে এসো। আমি একশো চব্বিশে আছি। টপ ফ্লোর। বাঁদিকের উইং-এর শেষ ঘরের আগের ঘর।’

‘আচ্ছা।’ ফোন কাটে চিকনা। ছেলেটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফোন করছিল। ফোনালাপের মিনিট খানেকের মধ্যে দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ হল।

দরজায় খুলে চন্দন দেখল হিন্দি সিনেমার হিরোর মতো সুন্দর দেখতে এক যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। লম্বা, টকটকে ফরসা, ক্লিন শেভড, চোখে সানগ্লাস। এক হাতের আঙুলে ঘুরছে বাইকের চাবি, অন্য হাতে হেলমেট। পরনে জিনস আর কালো টি-শার্ট। পায়ে, অবাক কাণ্ড, হাওয়াই চপ্পল! চন্দন খেয়াল করল ছোকরার পা অসম্ভব নোংরা। এত ধুলো-কাদা মাখা পা কয়লা খনির শ্রমিকদেরও থাকে না।

‘পা ধোবে না?’ ইতস্তত করে বলেই ফেলল চন্দন।

‘তোমাদের নিয়ে এই হল লফড়া!’ হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল চিকনা, ‘শুধু থোবড়া দেখে ইম্প্রেস হও না। পা ভি দেখো।’ তার মুখে একগাল হাসি। হ্যান্ডশেক করে চন্দন বলল, ‘থোবড়া দেখেও ইমপ্রেসড হলাম না। পান মশলা খেয়ে দাঁতের বারোটা বাজিয়েছ।’

‘আরিত্তারা। পুরো হেডমাস্টার ফেস!’ চোখ মেরে চিকনা বলে, ‘বসব?’ তারপর উত্তরের প্রত্যাশা না করে অভির বিছানায় বডি ফেলে দেয়। হতাশ চন্দন সিগারেট ধরিয়ে বলে, ‘শুধুই পান মশলা খাও, না সিগ্রেটও চলে?’

‘আমার সব চলে।’ খ্যাকখ্যাক করে হাসছে চিকনা। চন্দনের বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেট ধরিয়ে হুশহুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘শেয়ালদা স্টেশনটা অধীরদা দেখে। রিসেন্টলি অধীরদা ডান হাত হ্যাপি তিওয়ারি নবযুগ পার্টিতে জয়েন করেছে। বখরার ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। এই লফড়া অনেকদূর গড়াবে।’

‘অধীরদা শেয়ালদা স্টেশন দেখেন? মানে?’ চন্দন অবাক।

‘রেলওয়ের স্ক্র্যাপইয়ার্ড, ছাঁট লোহা, গোডাউন, গুডস ট্রেন, হকার, পাতার ব্যবসা, মেয়েছেলে, ছক্কাপার্টি-রোজ করোড় রুপাইয়ার লেনদেন হয় শেয়ালদায়। হ্যাপি তিওয়ারিকে ডায়না হাত করে অধীরদা খুদ বিজনেস সামহালতো। হ্যাপিকে বেশি ভরোসা করেছিল। সব কনট্যাক্ট হ্যাপির হাতে ছিল। এখন অধীরদাকে লেঙ্গি মেরে হ্যাপি মৃন্ময় চ্যাটার্জির ধুতির তলায় ঘুসেছে।’

চন্দনের এইসব শুনতে খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। রাজনীতি আর আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সম্পর্ক নিয়ে বেশ কয়েকটা সিনেমা সে গত এক বছরে দেখেছে। হলে গিয়ে বা কম্পিউটারে! সত্য, কোম্পানি, ডি কোম্পানি। চিকনা সেই কানেকশানের গল্প বলছে। মেডিক্যাল কলেজের রাজনীতির সঙ্গে চিকনাদের রাজনীতি কোনওদিনও মিলবে না। চন্দনই মেলাতে দেবে না। চন্দন ঠিক করে নিয়েছে যে চিকনার সঙ্গে তার এটাই প্রথম ও শেষ মুলাকাত। তবে যতক্ষণ ছেলেটা আছে, ততক্ষণ মশলাদার গপপো শুনে নেওয়া যাক। বেশ একটা রিং সাইড ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। চিকনাকে উশকে দিতে চন্দন বলল, ‘তোমাদের গ্রুপবাজির মধ্যে আমরা কীভাবে আসছি?’

‘কেন আসছ না? অধীরদা শেয়ালদা এলাকায় সমস্ত ফ্রন্টের ইউনিয়ন লিডার। রিক্সাওয়ালা ইউনিয়ন, ঠেলাওয়ালা ইউনিয়ন, রেন্ডি ইউনিয়ন, লেবার ইউনিয়ন, পোর্টার ইউনিয়ন, ব্যবসায়ী সমিতি, বস্তি ফেডারেশান। রেলওয়ে স্টাফেদের আলাদা ইউনিয়ন তো আছেই। প্লাস শেয়ালদা চত্বরে সব কলেজের ইউনিয়ন। নেক্সট বিধানসভা ইলেকশানের আগে এইসব ইউনিয়ন হাতে না রাখলে শেয়ালদা থেকে অধীরদা আউট। হ্যাপি তিওয়ারি ইন। পার্টি ফান্ডে রোজ লাখো রুপিয়া জমা পড়ে বলেই পার্টিতে অধীরদা জামাইরাজা। রুপিয়ার সোর্স শুকিয়ে গেলে স্টেট কমটি আর কলকাত্তা ডিসট্রিক্ট কমটিতে অধীরদার বারফাট্টাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই, অধীরদার কাছে এ লড়াই বাঁচার লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে।’

‘এইসব ইনফর্মেশান যদি আমাদের ভোটাররা জানতে পারে, তাহলে আমরা একটাও ভোট পাব না।’

‘তারা জানবে না। এইবার চুনাও নিয়ে কোনও রিস্ক নেওয়া যাবে না। সুরজ আর তার চেলালোগ যেন নমিনেশান ফর্ম জমা দিতে না পারে তার বেবোস্থা করতে হবে।’

‘কীভাবে ব্যবস্থা করবে?’ জানতে চায় চন্দন। চিকনাকে তার একদম পছন্দ হচ্ছে না। নেহাত অধীরের গেস্ট। তাই উঠে যেতে বলতে পারছে না। কিন্তু এবার একে কায়দা করে ফোটাতে হবে।

‘সে সব নিয়ে তোমাকে পসিনা বাহাতে হবে না। তোমরা হলে পার্টির লালটু মাল। বংলায় যাকে বলে রাঙা মুলি। পাস করার পরে দেখবে, অধীরদা তোমার কাছে হর মাহিনা মোটা টাকার লেভি চাইছে। কিন্তু মরিজ হয়ে নিজে আসছে না। কাউকে পাঠাচ্ছেও না। কিঁউকি ও তোমাকে ডাক্তার বলেও মনে করে না, পার্টি ক্যাডার বলেও মনে করে না।’

‘আর আমার বন্ধুরা?’

‘তোমার ডাক্তার দোস্তরা তাদের বাড়ির পার্টি-শার্টিতে তোমায় হরগিজ ডাকবে না। লেকিন চুপকে চুপকে সন্ধেবেলা তোমার সঙ্গে ফোনে আনশান ভাটিং করবে। ভালো পোস্টিং পাওয়ার সময় তোমার হেল্প লাগবে তো!’

‘ভালো বললে বস!’ হাই তুলে বলে চন্দন।

‘তোমার টি-শার্টে যে লোকটার ছবি আঁকা আছে ও ডাক্তার ছিল। কিন্তু ওই ডাক্তার আর তোমার মধ্যে যতখানি ফারাক, ততখানিই ফারাক ‘ইনকিলাব’ আর ভোট ব্যাংক পলিটিক্সের মধ্যে। কাজেই সব জিনিস নিয়ে ভেজা গরম কোরো না। মন দিয়ে পড়ালিখা করো। স্টুডেন্টদের টাচে থাকো। বাকিটা আমি দেখছি।’ লম্বা জ্ঞান দিয়ে তড়াক করে খাট থেকে লাফিয়ে উঠেছে চিকনা। হাতে ঝোলানো হেলমেটের মধ্যে থেকে টেনে বার করেছে একটা আগ্নেয়াস্ত্র। সেটা অভির খাটে রেখে বলছে, ‘এটা এখানে থাক। পরে এসে নিয়ে যাব।’

চন্দন অবাক হয়ে অস্ত্রটার দিকে তাকাল। নিয়মিত খবরের কাগজে ছবি দেখে এ জিনিস তার চেনা। দিশি ওয়ান শটার। আগে বিহারের মুঙ্গের থেকে বাংলায় ঢুকত। এখন অস্ত্র তৈরি করা বাংলার ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের মধ্যে পড়ে। নতুনগ্রামেই এই জিনিস তৈরি হয়।

‘এটা এখানে রাখা যাবে না।’ ক্যাজুয়ালি বলে চন্দন।

‘রাখা যাবে না? কিঁউ?’

‘আমি বলছি, তাই।’

‘লেকিন অধীরদা বলছিল…’

‘অধীরদা যাই বলুন না কেন, এ জিনিস এখানে রাখা যাবে না। তুমি নিয়ে যাও।’

চিকনা কিছুক্ষণ স্থির চোখে চন্দনের দিকে তাকিয়ে রইল। ওয়ান শটার খাট থেকে তুলে হেলমেটের মধ্যে রেখে বলল, ‘সুরজদের ঘরে রেগুলার মাল ঢুকছে। সে খবর রাখো?’

‘আমি সুরজের সঙ্গে কথা বলে নেব। দরকার হলে হোস্টেলের সুপার, হসপিটালের সুপার, কলেজের প্রিন্সিপাল, থানার ওসি—সবার সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু আমাদের কলেজ ইলেকশানে এই সব চলবে না। ভোটে হারি বা জিতি, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বেরোব। হোস্টেলে অস্ত্র রেখে কেরিয়ার মায়ের ভোগে পাঠাতে চাই না।’

‘ঠিক হ্যায় বস। লেকচার ঝাড়ার দরকার নেই। আমি পাতলা হলাম। বাই।’ হেলমেট হাতে নিয়ে ঝড়ের গতিতে একশো চব্বিশ থেকে বিদায় নেয় চিকনা। ফাঁকা ঘরে চন্দন থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় তার মাথা কাজ করছে না। নিঃশব্দে গভীর শ্বাস নিতে থাকে সে। মনে মনে গুনতে থাকে, এক…দুই…তিন…

ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করলে টেনশান কমে। মন শান্ত হয়। এখন তার মাথা গরম। মনে হাজার রকমের কনফিউশান…

পারুলের মুখে চন্দন শুনেছে, বড় ছেলে বামন হওয়ার পরে সবাই পারুলকে বলেছিল দ্বিতীয় বাচ্চা না নিতে। কিন্তু চন্দন তখন পেটে এসে গেছে। পবন পারুলকে পরামর্শ দিয়েছিল এবর্শান করার জন্য। পারুল সে কথা শোনেনি। যদি শুনত তাহলে রক্ত মাংসের ডেলা হয়ে চন্দন পড়ে থাকত কোনও ডাস্টবিনে। আজকের এই সময় সে দেখতেই পেত না। তার জীবনের সূত্রপাত সংগ্রাম দিয়ে। সেই সংগ্রাম পরবর্তী কালেও জারি রইল। কৃষক পরিবারের ছেলে, কলকাতা থেকে অনেক দূরের জেলার অখ্যাত ইস্কুলের ছাত্র, প্রাইভেট টিউটরহীন ও গাইডেন্সহীন ভাবে পড়াশুনো করে প্রতি বছর পরীক্ষাতে ফার্স্ট হল। হাড়ভাঙা পরিশ্রম, দাঁতে দাঁত চাপা জেদ, অদম্য ইচ্ছাশক্তি চন্দনকে পৌঁছে দিল নতুনগ্রাম থেকে কলকাতা শহরে। এখানে এসেও সংগ্রাম জারি আছে। ‘চাষা’ সম্বোধন, ইংরিজি উচ্চারণ নিয়ে বাঁকা মন্তব্য, আচার আচরণ নিয়ে মজা করা—সমস্ত ইটের জবাব চন্দন দিয়েছে পাটকেল পাঠিয়ে। পড়াশুনোয় এখন সে ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যে একজন। রাজনীতিতে কলেজের এক নম্বর নেতা। কিন্তু এক জায়গায় সে হেরে বসে আছে। প্রেম।

হেরে যাওয়া চন্দনের স্বভাবে নেই। হারা বলে কিছু হয়—এটাই সে মনে করে না। একটা চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে মানে অসীম সংখ্যক চেষ্টা বাকি আছে।

ডিপ ব্রিদিং কাজ করছে। চিকনার কটু স্বাদ মুখ থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাতলা হাসি ফুটে ওঠে চন্দনের ঠোঁটের কোণে। আজ বৃন্দাকে নিয়ে একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাক। অনেকদিন বিটিং অ্যারাউন্ড দ্য বুশ হল। এবার সরাসরি কথা বলে দেখতে হবে।

একশো চব্বিশে তালা মেরে একশো পঁচিশে ঢোকে চন্দন। রিপু আলো নিবিয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘর অন্ধকার। নিজের টেবিলের ল্যাম্প জ্বালে চন্দন। এখন তার প্ল্যানের প্রস্তুতি পর্ব।

চন্দন স্নান করে। দাড়ি কামায়। ফেডেড ব্লু জিনস, ডার্ক ব্লু টি-শার্ট আর স্নিকার গলায়। পরিপাটি চুল আঁচড়ে, আফটার শেভ আর ডিও লাগিয়ে মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বৃন্দাকে ফোন করে। মেয়েটা কি এখনও নিরোধ স্যারের ক্লাস করছে?

‘বল!’ চন্দনের কানে মধুবর্ষণ করে বৃন্দা। ‘হঠাৎ তলব?’

‘একটা দরকার ছিল।’

‘আমি এখন ট্রামের জন্য দাঁড়িয়ে।’

‘দাঁড়ে বোস। একটা চা খা। আমি আসছি।’ ফোন কেটে হনহন করে হাঁটা লাগায় চন্দন। দাঁড়ে পৌঁছে দেখে, বৃন্দা এক ভাঁড় চা নিয়ে রেলিং-এ বসে পা দোলাচ্ছে। চন্দনকে দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার বল তো, হঠাৎ এত মাঞ্জা?’

চন্দন সিগারেট ধরায়। আবার ডিপ ব্রিদিং শুরু করে। এক ভাঁড় চা নিয়ে বৃন্দার পাশে বসে বলে, ‘আমি তোকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।’

বৃন্দা কী একটা বলতে যাচ্ছিল। চন্দন হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাক্সিমাম নম্বর পেয়ে আমাদের ব্যাচে আমিই ফার্স্ট হব। কেউ আমাকে রুখতে পারবে না। তুই মিলিয়ে নিস।’

‘তো?’ খিলখিল করে হাসছে বৃন্দা।

‘আমি সার্জারিতে হাউসজব করব। কারণ ফিউচারে সার্জারি নিয়ে নিয়ে পড়ার কোনও ইচ্ছে নেই। তাই বেসিকটা শিখে রাখব। হাউসজব শেষ করে মেডিসিনে এমডি করব। এখন পর্যন্ত এতদূর পর্যন্ত ঠিক করা আছে।’

বৃন্দা চন্দনের দিকে তাকিয়ে। চন্দন বৃন্দার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমার গ্রামের ব্যাকগ্রাউন্ড ভুলে যা। আমাকে ইউনিভার্সিটির টপার হিসেবে দ্যাখ। এনআরআই ডাক্তার হিসেবে দ্যাখ। দেখতে পাচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ।’ অবলীলায় ঘাড় নাড়ে বৃন্দা। ‘তোর যোগ্যতা নিয়ে আমার কোনও কনফিউশান নেই।’

‘তাহলে আমাকে তোর অপছন্দ কেন? আমি কালো? আমি বেঁটে? আমার মধ্যে পালিশ নেই?’

‘কে বলল তোকে আমার অপছন্দ?’

‘তাহলে তো মিটেই গেল।’ উত্তেজিত চন্দন হাত থেকে সিগারেট ফেলে বলে। ‘আমার তোকে ভালো লাগে। তোরও আমাকে ভালো লাগে। তাহলে অভির সঙ্গে ঘুরছিস কেন? ওকে ছাড়।’

চন্দনের কথায় বৃন্দার মুখে ছায়া ঘনিয়ে আসে। দৃষ্টিতে ছড়িয়ে পড়ে বিষণ্ণতা। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আসলে… আমি তোর যোগ্য নই রে চন্দন। আমি এত সাধারণ, এত অর্ডিনারি। এত মিডিওকার… আমাকে ভালোবেসে তুই কখনও সুখী হবি না। আমি বাড়ির চাপে ডাক্তারি পড়ছি। পাস করার পরে সব ভুলে গিয়ে ঘর সংসার করব। তোর অনেক অ্যাম্বিশান। তোর সঙ্গী হওয়া উচিৎ কোনও অ্যাম্বিশাস মেয়ের। আমি দময়ন্তীর সঙ্গে কথা বলব?’

বৃন্দার নিপুণ অভিনয় মন দিয়ে দেখছে চন্দন। কীভাবে ঝাড় নামাতে হয়, সেটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেল মেয়েটা। চন্দনের বলা কথাগুলোকে চন্দনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ অস্ত্রহীন করে দিল। এরপর আর কোনও কথা চলে না।

সোজা আঙুলে ঘি উঠল না। এবার আঙুল বাঁকাতে হবে। চন্দন হারতে জানে না। সংগ্রাম তার রক্তে। মনে মনে সে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দেয়—ছক কষতে হবে, ম্যানিপুলেট করতে হবে, অভিনয় করতে হবে। কারণ বৃন্দাকে তার চাই। বাই হুক, অর বাই ক্রুক!

দাঁড় থেকে নেমে চন্দন বৃন্দাকে বলল, ‘তা হলে আর কী? আমারই কপাল খারাপ। এক কাজ করা যাক। লেটস বি ফ্রেন্ডস। নাকি সেটাও অ্যালাউড নয়?’

মুহূর্তে বৃন্দার মুখ-চোখ থেকে বিষণ্ণতার মুখোশ উধাও। ঝলমলে হেসে সে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়।’

একদলা থুতু গিলতে গিলতে, দুঃখ চাপতে চাপতে, বুকের ভিতরে হাউহাউ কান্নার মুখে কাপড় চাপা দিতে দিতে চন্দন অভিনয় শুরু করল। হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘বিএফএফ। বেস্ট ফ্রেন্ডস ফরএভার!’

.

দময়ন্তী

‘ডিফাইন রেপ।’ হুঙ্কার ছাড়লেন ডক্টর রেবতীভূষণ পট্টনায়েক। ফরেনসিক মেডিসিনের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট এবং ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল। এক্স-আর্মি ম্যান। ছ’ফুট লম্বা, তাগড়াই চেহারা, হ্যান্ডল বার গোঁফ। একত্রিশে ডিসেম্বরের শীতেও পরে আছেন হাফহাতা শার্ট।

পঞ্চাশ বছরের রেবতীভূষণ সারা বছরই হাফহাতা জামা পরেন মুগুরভাঁজা হাতের গুলি দেখানোর জন্য। চক দিয়ে যখন ব্ল্যাক বোর্ডে লেখেন, পুটপুট করে জামার হাতার সেলাই ছিঁড়ে যাওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। নিয়মিত পান খেয়ে ক্লাসে আসেন। ঠোঁটদুটি টকটকে লাল হয়ে থাকে। বাংলা ফর্মুলা ছবির ভিলেনদের মতো চেহারা।

এক্স-আর্মি ম্যানের হুঙ্কারে কেউ কোনও উত্তর দিল না। রেবতী বললেন, ‘আমি জানি যে আমার নামের আদ্যক্ষর, মানে রেবতীর ‘রে’ আর পট্টনায়েকের ‘প’ মিলিয়ে, আড়ালে তোমরা আমাকে ‘রেপকাকু’ বলে ডাকো। যতক্ষণ সামনা সামনি না বলছ, দ্যাটস ফাইন উইথ মি। তো, তোমাদের ‘রেপকাকু’ আজ রেপ পড়াবে। ডিফাইন রেপ। এনিবডি?’

‘কোনও মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সঙ্গে ইন্টারকোর্স করা…’ বলল চন্দন।

‘আঠেরো বছরের কম বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে সহবাসে সম্মতি বা ইচ্ছার প্রয়োজন নেই। ইন্টারকোর্স করলেই সেটা রেপ।’ বলল প্রবাল।

‘সহবাসে সম্মতি দেওয়ার সময়ে মেয়েটি ইনটক্সিকেটেড থাকলে সেটাও রেপ।’ বলল জেমসি।

‘প্রাণের ভয়ে সম্মতি দিলে সেটাও রেপ।’ বলল শ্রীপর্ণা।

খুশি হয়ে ঘাড় নাড়লেন রেবতী। ‘বাঃ! তোমরা বেশ কয়েকটা পয়েন্ট কভার করেছ। আমি কমপ্লিট ডেফিনিশনটা লিখছি। এটা আমি প্রত্যেক স্টুডেন্টকে ভাইভায় জিজ্ঞাসা করব। ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড বলতে না পারলে ফরেনসিক মেডিসিনে সাপ্লি নিশ্চিত।’

রেবতী খসখস করে বোর্ডে লিখলেন, ‘আ ম্যান ইজ সেইড টু কমিট রেপ ইফ হি হ্যাজ সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স উইথ এ উয়োম্যান ১) এগেইন্সট হার উইল, ২) উইদাউট হার কনসেন্ট, ৩) উইথ হার কনসেন্ট হোয়েন হার কনসেন্ট হ্যাজ বিন অবটেইনড বাই পুটিং হার অর এনি পারসন ইন হুম শি ইজ ইন্টারেস্টেড ইন ফিয়ার অফ ডেথ…’

রেবতীর দীর্ঘ সংজ্ঞা শেষ হওয়া মাত্র ফিসফিস গুজগুজে এসএলটি ভরে গেল। চন্দন বলল, ‘এটা ডেফিনিশন? এ তো এক মাইল লম্বা!’

দীপ বলল, ‘এক মাইল না ছইঞ্চি?’

জেমসি বলল, ‘শাট আপ!’

প্রবাল বলল, ‘এটা মুখস্থ করার থেকে রেপড হওয়া ভালো।’

শ্রীপর্ণা বলল, ‘শাট আপ!’

সবুজ বলল, ‘এই ডেফিনিশন কোনও ছেলের তৈরি।’

বৃন্দা বলল, ‘কেন তোর এইরকম মনে হচ্ছে?’

সবুজ উত্তর দিল, ‘কেন না কোনও ফাঁক নেই।’

সাবিনা বলল, ‘শাট আপ!’

রেবতী চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। গুঞ্জন থামতে বললেন, ‘আমি জানি তোমাদের অনেক প্রশ্ন থাকবে। এক এক করে শুরু করো।’

‘অ্যাজ পার ডেফিনিশন, ওনলি আ ম্যান ক্যান কমিট রেপ। নট দ্য অপোসিট। এটা কি ঠিক?’ প্রথম প্রশ্ন করল সুরজ। ক্লাস জুড়ে ছেলেদের হাসির হররা। কোনও কোনও মেয়েও হাসছে।

‘এটা আইন। ইন্ডিয়ান পেনাল কোড। আমাদের সংবিধান ঠিক বা ভুলের ঊর্ধ্বে। নেক্সট কোয়েশ্চেন?’

‘উইল আর কনসেন্টের তফাত কী?’ বৃন্দা প্রশ্ন করে।

‘এক্সেলেন্ট কোয়েশ্চেন। ”ইচ্ছা” এবং ”অনুমতি” দুটো আলাদা জিনিস। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যদি কোনও কাজ করা হয়, তা হলে সব সময়ই সেটা তোমার অনুমতি না নিয়ে করা হচ্ছে। কিন্তু উল্টোটা সত্যি না-ও হতে পারে। অজ্ঞান কোনও মহিলাকে ধর্ষণ করা হলে এটা বলা যাবে না যে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। কিন্তু এটা অবশ্যই বলা যাবে, যে অনুমতি না নিয়ে করা হয়েছে। তাই না?’

‘ঠিক।’ ঘাড় নাড়ে বৃন্দা।

‘ম্যারাইটাল রেপ নিয়ে কাগজপত্র নানান লেখালেখি হয়। এটা তো ডেফিনিশনে নেই।’ দীপ প্রশ্ন করেছে।

‘ষোল বছরের কম বয়সি মেয়ের সঙ্গে সহবাস, বিবাহিতা স্ত্রী হলেও, তা ধর্ষণের মধ্যে পড়ে। কিন্তু বাল্যবিবাহের দেশে এই আইন মানা হয় না। থানাপুলিশও হয় না। ষোল বছরের বেশি বয়সি বিবাহিতা মহিলার ক্ষেত্রেই এই শব্দবন্ধ আজকাল বেশি ব্যবহৃত হয়। অজস্র বাংলা সিনেমায় এই দৃশ্য আছে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে। রেপের সংজ্ঞা এবং সহবাসের সম্মতির বয়স—এই দুটোই খুব শিগগির বদলাতে চলেছে। আগামী বছর, মানে ২০১৩ সালেই ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী সহবাসে সম্মতির বয়স হয়ে যাবে আঠেরো। রেপের সংজ্ঞাও দীর্ঘায়িত হবে। এনিওয়ে, আপাতত এইটুকু জেনে রাখো যে, বিবাহের মন্ত্রোচ্চারণের সময় মেয়েরা সহবাসের সম্মতি দিয়ে রাখে, এটা ধরে নেওয়া হয়।’

‘একটা মন্তর বললেই লাইফটাইম মস্তি? জিও কাকা!’ হাসতে হাসতে বলে সুরজ। রেবতী বলেন, ‘সাড়ে তিন মিনিটের মস্তির জন্যে কত টাকা খরচ হয়, তার আইডিয়া আছে? হ্যাভিং সেক্স উইদ ওয়াইফ ইজ দ্য কস্টলিয়েস্ট ইন্টারকোর্স ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। কল গার্লস আর মাচ মাচ চিপার।’

ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা জোরকদমে চলছে। এই আলোচনার মধ্যে মাথা নিচু করে, দাঁতে দাঁত চিপে বসে রয়েছে দময়ন্তী। তার মাথার মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি তৈরি হচ্ছে, স্বপ্নদৃশ্য চলে আসছে জেগে থাকা অবস্থায়। সেই গলি, সেই মহল্লা, সেই বৃষ্টির রাত, সেই খুপরি খুপরি দোকান, ভাঙা বাড়িতে নানান বয়সি সেই সব মেয়েদের মুখ, সেই সুরজের ছুটে আসা…

এই অ্যাকাডেমিক ডিসকাশনটা দময়ন্তী জাস্ট নিতে পারছে না। তার বুক ধড়ফড় করছে, তার খুলির মধ্যে আগুন ফুটছে, তার রগ দপদপ করছে, তার পেটে মোচড় দিচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে ড্যানিয়েল কিংবা শক্তিরূপার কোলে লুকিয়ে পড়তে। এই ক্লাস থেকে একছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।

তা হওয়ার নয়। সংজ্ঞা পেরিয়ে ধর্ষণ এখন আনুষঙ্গিকে গড়িয়েছে। ভিকটিমের বয়স, অ্যাকিউজডের বয়স, পেনিট্রেশন ধর্ষণের জন্য জরুরি কি না, ভিকটিমের মেডিক্যাল একজামিনেশান কীভাবে হবে, কীভাবে হবে অ্যাকিউজডের একজামিনেশান, ইম্পোটেন্ট পুরুষ ধর্ষণ করতে পারে কি না—এইসব নিয়ে আলোচনা চলছে। ছাত্রছাত্রীদের এত গভীর মনোযোগ গত দেড় বছরে এক দিনের জন্যও দেখেনি দময়ন্তী। মাথাব্যথার চোটে চোখে অন্ধকার দেখছে সে। বাধ্য হয়ে ব্যাগ খুলে অ্যালোপাম বার করে মুখে ফেলল। আধঘণ্টার জন্য শান্তি। আশা করা যায়, তার মধ্যে এই ধর্ষণ প্রশিক্ষণ শিবির বন্ধ হবে।

মিনিট কুড়ির মধ্যে ক্লাস শেষ হয়ে গেল। আগামী দিন আনন্যাচরাল সেক্সুয়াল অফেন্স পড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেবতী ক্লাস থেকে বিদায় নিলেন। এসএলটি থেকে সবাই লাফাতে লাফাতে বেরোচ্ছে। আজ শনিবার, তায় একত্রিশে ডিসেম্বর। আর কোনও ক্লাস নেই। বয়েজ হোস্টেলে ইয়ার এন্ড পার্টি আছে। পার্টি আছে গার্লস হোস্টেলেও। কলকাতার বিভিন্ন নাইটক্লাব বা হোস্টেলে বর্ষবরণের পার্টি হয়। সেখানেও অনেকে পালাবে। এখন কলেজে থাকা মানে সময় নষ্ট করা।

চন্দন হোস্টেলের দিকে এগোচ্ছে। বৃন্দা অভির সঙ্গে গপপো করতে করতে দাঁড়ের দিকে যাচ্ছিল। দময়ন্তীকে বলল, ‘বাড়ি যাবি না?’

‘যাব। হোস্টেলে গিয়ে একটু রেস্ট নিই। তারপর।’ পাশ কাটানো উত্তর দিয়ে লেডি আর্চার্স হোস্টেলে ঢোকে দময়ন্তী। বছরের শেষ দুপুরে হোস্টেল ফাঁকা। বারান্দা পেরিয়ে শেষপ্রান্তে তেরো নম্বর ঘরে ঢোকে সে। এক ঘণ্টা রেস্ট নেওয়া যাক। তিনটের সময় বিলু ফোন করবে।

বিলুর ক্রমাগত চাপের কাছে অবশেষে দময়ন্তী নতি স্বীকার করেছে। প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ শনিবার সে নতুনগ্রাম যাচ্ছে। রাতটা গোপাল নস্করের বাড়ি কাটিয়ে সারা দিন পেশেন্ট দেখে রবিবার বিকেলের মধ্যে কলকাতা চলে আসে। ড্যানিয়েল বা শক্তিরূপা ঘটনাটা জানেন। তাঁরা আপত্তি করেননি আবার আগ্রহও দেখাননি। ড্যানিয়েল শুধু বলেছেন, ‘আমি একদিন অনাবিল লাহিড়ী নামের যুবকটির সঙ্গে আলাপ করতে চাই।’

‘কেন?’ জানতে চেয়েছে দময়ন্তী।

‘আমার নাকে যে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, তাকে একবার দেখব না?’ ড্যানিয়েলের কণ্ঠে বিস্ময়।

‘দেখাদেখির কিছু নেই। আমার থেকে সিনিয়র একটা দাদা। পড়াশুনোর পাশাপাশি গরিবদের নিয়ে ভাবে। তাকে জাস্ট হেল্প করছি। এর মধ্যে অন্য কিছু খুঁজো না।’

‘অন্য কিছু মানে কী দিঠি?’ নিষ্পাপ প্রশ্ন ড্যানিয়েলের। ‘একটা দাদা পড়াশুনোর পাশাপাশি গরিবদের নিয়ে ভাবে। তার সঙ্গে আলাপ করতে পারি না?’

‘ধ্যাত! তুমি না!’ জিভ কেটে স্টুডিও থেকে পালিয়েছিল দময়ন্তী।

গতকাল দাঁড়ে বসে চা খেতে খেতে বিলু বলেছে, ‘শনিবার বিকেলের ট্রেনে ভয়ঙ্কর ভিড় হয়। সারা সপ্তাহ যারা কলকাতা বা হাওড়ার মেসে থেকে অফিস করে, তারা শনিবার ওই ট্রেনে বাড়ি যায়। ডেলি প্যাসেঞ্জারের ভিড় তো থাকেই। একটাই সুবিধে, আমরা যাব হাওড়া-আদ্রা শিরোমণি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে। ট্রেনটা গ্যালপিং। হাওড়া থেকে মেচেদা মোট একুশটা স্টেশান। এই ট্রেনটা তার মধ্যে সাঁত্রাগাছি, উলুবেড়িয়া আর বাগনান স্টেশানে দাঁড়ায়। তাই অনেক যাত্রী ওঠে না। একটু ফাঁকা থাকবে। হাওড়া থেকে পাঁচটা পয়তাল্লিশ মিনিটে ট্রেন ছাড়বে।’

‘ঠিক হ্যায়। আমি সাড়ে পাঁচটার মধ্যে হাওড়া স্টেশান পৌঁছে যাব।’ বলেছিল দময়ন্তী।

‘উনিশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছাড়ে। আমি আর সব্যসাচীদা আগে পৌঁছে তোর জন্য সিট রাখব, না তুই লেডিজ কামরায় উঠবি?’

‘জায়গা রাখতে হবে না।’ বলেছিল দময়ন্তী।

ঘুম পাচ্ছে। রুমে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল দময়ন্তী। ক্রমাগত অ্যালোপাম খাওয়ার এফেক্ট। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখল পৌনে পাঁচটায়। এখান থেকে হাওড়া স্টেশনে যেতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। গোলমহলে বলা আছে, সে আজ নতুনগ্রাম যাবে।

.

গ্যালপিং ট্রেনের লেডিজ কামরা ফাঁকা। বিলু আর সব্যসাচী জেনারেল কামরায় সিট রাখলেও সেখানে না বসে মেয়েদের কামরায় আরামে বসে একঘণ্টার মধ্যে মেচেদা পৌঁছে গেল দময়ন্তী। সেখান থেকে বাসে চেপে নতুনগ্রাম আরও আধঘণ্টা। বাঁজাপলাশ গ্রামে গোপাল নস্করের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে পৌনে আটটা। নতুনগ্রাম এবং বাঁজাপলাশ গ্রামে এখন লোডশেডিং। চারিদিকে কুপকুপে অন্ধকার। নেহাত নতুনগ্রামের বাস স্ট্যান্ডে গোপাল টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তা না হলে বাড়ি চিনতে অসুবিধা হতো।

এই বাড়ির দোতলার একটা ঘর আগে থেকেই দময়ন্তীর জন্য নির্দিষ্ট। অ্যাটাচড বাথরুম আছে। বাথরুমে ঢুকে স্নান করে, পোশাক বদলে নীচে নামল দময়ন্তী। বিলু আর সব্যসাচী কোথায় গেল দেখা যাক। পুরো রাস্তা সে লেডিজ কামরায় ঘুমোতে ঘুমোতে এসেছে। বাসেও ঢুলছিল। ওদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়নি। স্নান করার পরে ঘুমঘুম ভাব কেটেছে।

বাগানে কাঠকুটো আর শুকনো পাতা জড়ো করে বন-ফায়ারের আয়োজন করা হচ্ছে। একগাদা চেয়ার পাতা। গায়ে চাদর জড়িয়ে চেয়ারে বসল দময়ন্তী। আজকে ভালো ঠান্ডা আছে। তাপমাত্রা দশের নীচে হবে।

বিলু কোথায় ছিল কে জানে! হঠাৎ তার পাশে এসে বসল। ‘আজ এখানে বর্ষবরণ পালন হবে। কেউ নাচবে, কেউ গাইবে, কেউ পারফর্ম করবে। তুই কী করবি?’

‘আমি কিছু পারি না। হাততালি দেব। এখানে অ্যালকোহলের ব্যবস্থা নেই?’

‘আছে। দিশি হাঁড়িয়া। তোর সহ্য হবে না।’

‘সবার সহ্য হলে আমার হবে না কেন? এখানকার লোকেদের লিভার কি সোনা দিয়ে বাঁধানো?’

‘কাল সকালে হ্যাংওভার হলে কাজ করতে পারবি না।’

‘দিব্যি পারব। তোমার ওই গোপাল নস্করকে বলো, আমাকেও যেন দেয়।’ দময়ন্তীর কথার মধ্যে গোপাল তার পাশে এসে বসলেন। বললেন, ‘হাঁড়িয়া এখানে বাড়ির বউ-ঝিরা খায়। তুমি খেতে পারো। কোনও অসুবিধে হবে না।’

দময়ন্তী খেয়াল করল একগাদা কেলোকুলো বামন লোক, মোটাসোটা বামন বউ-ঝি, আর ক্যাঁওম্যাও করা বামন বাচ্চা এসে শতরঞ্চিতে বসেছে। সবার গায়ে কম্বল জড়ানো। লোকেদের হাতে হাতে গাঁজার কল্কে ঘুরছে। বউগুলো ঘোমটার আড়ালে ফুকফুক করে বিড়ি টানছে। বাচ্চাগুলো ছেঁড়া মাফলার আর ময়লা দোলাই জড়িয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে।

এরা বাঁজাপলাশ গ্রামের বাসিন্দা। এরা জোয়াকিম। দময়ন্তীর পেশেন্ট। এদেরকে বাস্তুচ্যুত করে তৈরি হবে ওয়েলনেস সেন্টার। গোপাল তার হাতে এক গেলাস হাঁড়িয়া তুলে দিয়েছেন। ছোট্ট চুমুক দিয়ে দময়ন্তী ভাবে, ওয়েলনেস কাকে বলে? ভালো থাকা মানে কী? হাজার একর জায়গা জুড়ে, সমুদ্রের ধারে তৈরি হবে অত্যাধুনিক ডি-টক্সিফিকেশান সেন্টার, ইস্থেটিক সার্জারি ক্লিনিক, এইট্টিন হোল গলফ কোর্স, স্পা, মাসাজ পার্লার। সুইডিস মাসাজ, কেরালিয়ান আয়ুর্বেদিক মাসাজ, ডিপ টিসু মাসাজ, থাই মাসাজ, সিয়াৎ সু। এখানে থাকবে ওল্ড-এজ হোম, মেডিক্যাল ট্যুরিজম, হসপাইস কেয়ার। শেষ কথাটির অর্থ, যেসব রোগী মৃত্যু পথযাত্রী, তাদের অন্তিম দিনগুলিকে যতটা সম্ভব বেদনাহীন ও স্বচ্ছন্দ রাখা। নিউ এজ ডাক্তারির আড়ালে এখানে সেক্স ট্যুরিজম শুরু হবে বলে দাবি করছে মিডিয়ার একটা অংশ।

মেডিক্যাল ট্যুরিজম যে ভারতবর্ষের একটা বড় বিজনেস মডেল, বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে দময়ন্তী জানে। ইওরোপ, আমেরিকায় চিকিৎসার খরচ সাংঘাতিক। তার থেকেও বড় কথা, মেডিক্যাল ইনসিয়োরেন্স করা না থাকলে ওখানে ডাক্তাররা পেশেন্ট দেখে না। গত এক দশক ধরে উন্নত দেশগুলির অনেক মানুষ দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে এসে সার্জারি করিয়ে যাচ্ছে। দেশ ভ্রমণ হল, কম পয়সায় সুচিকিৎসাও হল। এতদিন পশ্চিমবঙ্গ এই মার্কেট ট্যাপ করেনি। এখন করছে। ভালো কথা।

মেডিক্যাল ট্যুরিজমের মতো সেক্স ট্যুরিজম নিয়েও দময়ন্তীর শুচিবায়ু নেই। হংকং বা ব্যাংকক-এ আলাদা সেক্স ডিসট্রিক্ট আছে। সেখানে ছেলে, মেয়ে, সমকামী, বিষমকামী, লিঙ্গান্তরকামী, উভলিঙ্গ, টয়বয়, ফ্যাগহ্যাগ, বিডিএসএম চর্চাকারী—সব রকমের প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। নিজে অংশগ্রহণ করতে পারো, চেয়ারে বসে অন্যদের পারফরম্যান্স দেখতে পারো। যার যেটা মর্জি। খোলা বাজারে যৌনতাও পণ্য। ফেলো কড়ি মাখো মুড়ি।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের এই ওয়েলনেস হাব প্রজেক্টকে দময়ন্তী নিরানব্বই শতাংশ সমর্থন করে। এক শতাংশ বিরোধের কারণ এদের স্থান নির্বাচন। নতুনগ্রাম-মেচেদা জাতীয় সড়কের দক্ষিণদিকে আর একটু এগিয়ে জমি অধিগ্রহণ করলে কোনও মানুষকে স্থানচ্যুত হতে হতো না। ওখানে ধুধু করছে বালিয়াড়ি। সমুদ্র, বেলাভূমি, নদী, মোহনা, আকাশ, ফাঁকা জমি—সব রেডি ছিল। ওখানে কেউ থাকে না। সমুদ্রের ধারে ওয়েলনেস সেন্টার চলত রমরমিয়ে। কিন্তু এদের এত লোভ, এরা জেলে পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করবে। যারা সার্ভে করেছিল, তারা ঘুষ খায় না ঘোড়ার ঘাস—এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে দময়ন্তী।

চিন্তায় ছেদ ঘটল গান শুনে। পুরুষমানুষগুলো ধামসা আর মাদল বাজিয়ে একটা গান ধরেছে। ভাষা বুঝতে পারছে না দময়ন্তী। এই এলাকায় বাংলার উপভাষা আর ওড়িয়া ভাষার মিশ্রণ কাজ করে। অল্পবিস্তর উর্দুও থাকে। একই পংক্তি বার বার পাওয়া হচ্ছে বলে দময়ন্তী কিছুক্ষণ বাদে বুঝতে পারল, বলা হচ্ছে,

‘সাবিসাবি, তু তো মোরঅ নালি পানঅ বিবি।
চিড়িয়া, ইস্কা, রুহি লয় গো নালি পানঅ বিবি।
সাবি সাবি…’
‘কুইন অব হার্টস! চিড়েতন, ইস্কাপন বা রুহিতন নয়। আমার সাবি কুইন অব হার্টস।’ কুলকুল করে হাসতে হাসতে দময়ন্তী দেখল, একটি কমবয়সি বউ নাচতে আরম্ভ করেছে। মাজা মাজা রং, পাথরে কোঁদা শরীর, গর্জন তেলে পালিশ করা মুখমণ্ডলী। গাছকোমর করে শাড়ি পরা বউটি একে একে অন্য বউদেরও নাচাতে আরম্ভ করেছে। পাশ থেকে বিলু বলল, ‘যে লোকটা ধামসা বাজাচ্ছে, ওর নাম মাইকেল ধীবর। বাঁজাপলাশ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। আর এই মেয়েটা ওর বউ।’

‘বউয়ের নাম কী?’ হাঁড়িয়ার গ্লাস শেষ করে জানতে চায় দময়ন্তী।

‘জুলি ধীবর। ও আমাদের কমিউনে রান্না করে।’

‘উচ্ছেদ হওয়া নিয়ে ওদের কী বক্তব্য?’

‘সবারই খুব আপত্তি।’

দময়ন্তী গোবিন্দ নস্করের কাছ থেকে আর এক গ্লাস হাড়িয়া চেয়ে নেয়। বিলু বলে, ‘তুই বাড়াবাড়ি করছিস। কাল সকালে উঠতে পারবি না।’

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী দেখে, রাত পৌনে এগারোটা বাজে। গল্পে, গানে, নাচে, আড্ডায় কখন যে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে, খেয়াল করেনি। বিলুকে সে বলে, ‘সব্যসাচী কোথায়?’

‘ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন!’ মুচকি হেসে গম্ভীর হয়ে গেল বিলু।

‘উত্তরদাতারা যে সব প্রশ্নকে ”ইন্টারেস্টিং” বলে থাকে, সেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।’ হাই তোলে দময়ন্তী।

‘বাঃ! ভালো বললি।’

‘উরিব্বাস! আর একটা নন-স্পেসিফিক উত্তর। তাহলে তো জানতেই হচ্ছে সব্যদা কোথায়।’ বিলুর কলার খিমচে ধরেছে দময়ন্তী।

‘তুই আমার কথা শোন…’ কলার ছাড়াতে ছাড়াতে বিলু থামছে, ‘এর আগে একদিন আমি আর তুই একসঙ্গে মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম। ফ্রেশার্স ওয়েলকামের রাতে। সেদিন একটা কেলোর কিত্তি হয়েছিল। সেকেন্ড এমবিতে উঠে নতুন কোনও কেলো বাঁধাস না। প্লিজ।’

বিলুকে ছেড়ে দিয়ে দময়ন্তী চেয়ার থেকে ওঠে। মাইকেল ধীবরের ধামসার বোলে এখন দ্রুতি। জুলি এবং অন্য বউরা হাঁড়িয়া খেয়ে টলমল করে নাচছে। তাদের চোখের ইশারায়, দেহের ভাষায় লাস্য। দময়ন্তীকে দেখে জুলি হাত ধরে টেনে নাচিয়েদের দঙ্গলে ঢুকিয়ে নেয়। দময়ন্তী হাত-পা ছুঁড়ে প্রতিবাদ করে। ‘আমি নাচতে পারি না। প্লিজ ছেড়ে দাও!’

জুলি কোনও কথা শুনছে না। নিজের হাতে দময়ন্তীর হাত জড়িয়ে রেখে নেচে যাচ্ছে। দময়ন্তীর মনে হয়, এই অনুষ্ঠানে নাচতে জানা বা না-জানাটা ইস্যু নয়। বছরকার শেষ দিনে হাত-পা ছুঁড়ে আনন্দ করাটাই প্রধান। মনে মনে সে বলে, ‘এনিবডি ক্যান ডান্স।’ ব্যস! এবার আর নাচতে কোনও অসুবিধে নেই।

মিনিট দশেক নেচে হাঁপিয়ে গেল দময়ন্তী। চেয়ারে বসে বিলুকে বলল, ‘এক গ্লাস জল খাওয়াবি?’

‘বারোটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি। এই সময়ে জল খাবি? আর এক গ্লাস হাঁড়িয়া খা বরং।’ দময়ন্তীর হাতে গেলাস তুলে দেয় বিলু।

‘তিন গ্লাস হাঁড়িয়া? মরে যদি না-ও যাই, তাহলে আগামিকাল হ্যাংওভারের চোটে বিছানা ছাড়তে পারব না।’ চুমুক দিয়ে বলে দময়ন্তী। কিছুক্ষণ নাচ দেখে বিলুকে বলে, ‘আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।’

‘কেন?’

‘জনমোর্চা সরকারের হার্টলেসনেস দেখে। জোয়াকিমরা পৃথিবীর বিলীয়মান সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়ে। ওলন্দাজ নাবিক এবং বাংলার নারীদের ক্রস ব্রিডিং-এর ফলে এই সম্প্রদায়ের জন্ম। এদের নিজস্ব ভাষা আছে। আছে নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব গান, ছবি, কবিতা, বিবাহরীতি। সরকার এদের পুনর্বাসন না করে উৎখাত করছে কেন? এদের তরফে কোনও প্রতিবাদ নেই কেন?’

‘খুব রাগ হচ্ছে?’

‘খুব। হাড়িয়া খেয়ে নেশা করে বলছি না। সত্যিই আমি খচে আছি।’

‘তাহলে,’ হাই তুলে বলে বিলু, ‘কী করা উচিত বলে তোর মনে হয়?’

‘রেজিস্ট করা উচিত। অবশ্যই। গোলমহল থেকে আমাকে যদি কোনও এলিতেলি তাড়াতে আসে, তাহলে আমি তাকে বাঁশপেটা করব।’

‘এ এলিতেলি নয়। এর নাম রাষ্ট্র। এদের বিরুদ্ধে মুখ খোলা মানে দেশদ্রোহিতা। ধরা পড়লে সাত দিনের ফাঁসি আর তিন মাসের জেল।’

‘ইয়ার্কি মেরো না বিলুদা। বোকার মতো ডাক্তারি করে কী লাভ? দু’দিন বাদে এই গ্রামে আর কোনও রুগিই তো থাকবে না। কেন না গ্রামটাই থাকবে না। তোমার পিএমএফ তখন কাদের জন্য মেডিক্যাল ক্যাম্প চালাবে?’

বিলু এতক্ষণ মন দিয়ে দময়ন্তীকে দেখছিল। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আয়।’

 ‘কোথায়?’ টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে দময়ন্তী। বিলু তার হাত ধরে নাচগানের মজলিশ থেকে টেনে বার করে। গোপাল নস্করের বাড়ির কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকে। মাঠের পরে ঝোপঝাড়। সেসব পেরিয়ে পুরোদস্তুর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

‘কোথায় যাচ্ছ?’ ফিশফিশ করে বলে দময়ন্তী। ‘এ তো জঙ্গল!’

‘রাত বলে জঙ্গল মনে হচ্ছে। এগুলো ক্যাশুরিনা গাছ। আমরা সি বিচের দিকে যাচ্ছি।’

ভিজে হাওয়ার ঝাপটায় দময়ন্তী বুঝতে পারল, বিলু ঠিকই বলেছে। শোঁশোঁ করে হাওয়া আসছে সমুদ্র থেকে। পায়ের নীচে শুরু হয়ে গেছে ভিজে বালি। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। শুনতেও অসুবিধে হচ্ছে। সামনে দেখা যাচ্ছে ফসফরাসের মালায় সজ্জিত তরঙ্গমালা। আকাশকে দেখে মনে হচ্ছে সলমা চুমকি জড়ানো ওড়না।

ধপ করে একটা শব্দ হল। কী রে বাবা! আঁতকে উঠে দময়ন্তী বিলুর হাত চেপে ধরে বলে, ‘কী হল?’ উত্তর না দিয়ে বিলু একটা বালিয়াড়ির ওপরে চড়ে।

আবার সেই শব্দ। ধপ! তারপর শব্দের চরিত্র বদলাল? আওয়াজ হল, ফট! হাওয়ার কারণে শব্দ কি তার চরিত্র বদলাল? নাকি অন্য কোনও আওয়াজ? দময়ন্তীর মাথা কাজ করছে না।

বালিয়াড়ি থেকে নামতে গিয়ে দময়ন্তী অবাক। অন্ধকারের মধ্যে হ্যাজাক জ্বেলে অন্তত একশোজন জোয়াকিম বসে। তাদের মধ্যে একমাত্র লম্বা লোক সব্যসাচী। তাই তাকে দূর থেকেও চেনা যাচ্ছে। কিন্তু এরা এখানে কী করছে? একাধিক হ্যাজাক একটা বড় আলোকবৃত্ত তৈরি করেছে। সেই বৃত্তের মধ্যে যা ঘটছে, দেখতে থাকে দময়ন্তী।

খড় দিয়ে তৈরি একজন মানুষ। একে বাংলায় কুশপুতুল বলা হয়। সেটি কাকতাড়ুয়ার কায়দায় লাঠি দিয়ে বালিতে পোঁতা। পুতুলের বুকে, এত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে, ফায়ার আর্মসের টার্গেট প্র্যাকটিসের বুলস আই লাগানো। টার্গেটের পঞ্চাশ মিটার দূরে বালির বস্তা দিয়ে তৈরি হাঁটুর সমান ব্যারিকেড। ব্যারিকেডের পিছনে বসে সব্যসাচী যে আগ্নেয়াস্ত্রটি ফায়ার করল, সেটি দময়ন্তী চেনে। এ কে ফর্টি সেভেন। ‘অ্যাটমোভ্যাট কালাশানিকভা সাতচল্লিশ’। বা ‘কালাশনিকভ অটোমেটিক রাইফেল’। ফায়ারিং-এর শব্দ এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আগের মতো ‘ধপ’ বা ‘ফট’ নয়। নিখুঁত ধাতব শব্দ। বুলস আইয়ের ভিতরে লাগল গুলি।

এবার একজন জোয়াকিম অস্ত্র তুলে নিল। বামন মানুষটি কাঁধে অস্ত্র তুলে, ওজনের ভারে টলমল করে উঠল। তারপর বালির বস্তার ওপরে আগ্নেয়াস্ত্র রেখে টার্গেট ফিক্স করল। এক ঝলক আগুন, বাতাস কাটার হিসস শব্দ, ফায়ারিং-এর আওয়াজ। কুশপুতুল কেঁপে উঠল। আবার বুলস আই।

‘সব্যসাচী কী করছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর পেলি?’ দময়ন্তীর কানে ফিসফিস করে বলে বিলু। দময়ন্তীর মাথার মধ্যে তিনপাত্র কোহল ঢেউ তুলেছে। সে বিলুর হাত ছেড়ে টলোমলো পায়ে বালিয়াড়ি বেয়ে নামে। তাকে দেখে জোয়াকিমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব্যসাচী আধবসা অবস্থায় স্থির।

‘হাই!’ সব্যসাচীর পাশে বসে হাসে দময়ন্তী।

‘একে এখানে নিয়ে এলি?’ ভুরু কুঁচকে সব্যসাচী বিলুর দিকে তাকিয়ে। বিলু কিন্তু-কিন্তু মুখে বলল, ‘খুব জোরাজুরি করল। তাই নিয়ে এলাম।’ দময়ন্তী এর মধ্যে জোয়াকিমের হাত থেকে একে সাতচল্লিশ কেড়ে নিয়েছে।

দময়ন্তীর হাত থেকে অস্ত্র কাড়তে যায় সব্যসাচী। বলে, ‘মদ খেয়ে অস্ত্র নিয়ে ছেলেমানুষি ঠিক না। সব্যসাচীকে ক্যাজুয়ালি ধাক্কা মেরে সরিয়ে নিশানা ঠিক করে ট্রিগার টেপে দময়ন্তী। আবার এক ঝলক আগুন, আবার বাতাস কাটার শিস, আবার বিস্ফোরণ। বিলু আর সব্যসাচী অবাক হয়ে দেখল, নিখুঁত বুলস আই করেছে দময়ন্তী। জোয়াকিমরা হর্ষধ্বনি দিচ্ছে।

‘ফায়ার আর্মস ট্রেনিং আমার স্কুলের কারিকুলামে ছিল।’ শ্রাগ করল দময়ন্তী। আকাশে আতসবাজির রোশনাই দেখে বলল, ”জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক!’ নতুন বছর এসে গেল।’

.

ঋষিতা নামে কোনও মেয়ের সঙ্গে সত্যিই গোপন অ্যাফেয়ার আছে মনোজের? নাকি সবটাই শূচিবায়ুগ্রস্থ অরুণার কল্পনা? অভি আর বৃন্দার প্রেম ভেঙে গেল কেন?

স্যামি ব্যানার্জি মদ্যপ অবস্থায় অপারেশান করতে গিয়ে পেশেন্ট মেরে ফেললেন। মন্দিরা ‘বিধবাপুকুর’ সিনেমায় অভিনয় করে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেলেন। বৃন্দা আর অভির প্রেম ভেঙে গেল কার জন্যে?

বাঁজাপলাশ গ্রামে হেলথ হাবের জন্যে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে পবন আর গোপাল নস্করের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। গোপাল চাইছেন সশস্ত্র বিরোধীতা। পবন চাইছেন মানুষকে বোঝাতে। চন্দন পড়েছে দোটানায়। কলেজ নির্বাচনের নমিনেশান পেপার জমা দেওয়ার দিন কলেজে ঘটে গেল ভয়ানক রাজনৈতিক হত্যা। কে খুন হলেন? জনমোর্চা সরকার এবং কেন্দ্রীয় যৌথ বাহিনী মিলে বাঁজাপলাশ গ্রামে দশজন আন্দোলনকারীকে হত্যা করল। তাদের মধ্যে একজন ডাক্তারি ছাত্র। কে সে?

দময়ন্তীকে খুঁজছে পুলিশ। শক্তিরূপা সম্পাদিত সংবাদ সাপ্তাহিকে ‘উইকেন্ড’-এ অশান্তি শুরু হয়েছে। ড্যানিয়েল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেন? কী হয়েছে তাঁর?

জনমোর্চা সরকার বিদায় নিয়েছে। এখন ক্ষমতায় নবযুগ সরকার। বন্ধুত্ব আর শত্রুতার হিসেব পালটে যাচ্ছে দ্রুত। এই দোলাচলের মধ্যে অভি আর বৃন্দার প্রেম কি জোড়া লাগবে? দময়ন্তীর প্রতি বিলুর মুগ্ধতা কি আদৌ কোনও পরিণতি পাবে? জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সেই চন্দন কি প্রেমে সফল হল?

.

আসছে পরবর্তী সিক্যুয়েল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *