হৃদয়ের শব্দ – ৭

অভিজ্ঞান

অরুণা হাঁ করে স্কুপ টিভি দেখছেন। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। ঘাড় বাঁকা, টিভির রিমোট মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরা। শ্বাস পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। অভির মনে হল, শ্বাস নেওয়ার কাজটা কর্মাশিয়াল ব্রেকের সময় করবে। সারা শরীর টেলিভিশনের পর্দার দিকে এগিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, একটু বাদেই বোকাবাক্সের মধ্যে ঢুকে যাবেন।

অরুণা এত মনোযোগ দিয়ে দেখছেন একটি বাংলা মেগা সিরিয়াল। নাম ‘যদিদং হৃদয়ং মম’। আজ মেগা সিরিয়ালটির হাজারতম পর্ব টেলিকাস্ট হচ্ছে। বাংলার সেলিব্রিটি গেস্টদের নিয়ে এক ঘণ্টার স্পেশাল এপিসোড। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট শঙ্করনাথ রায়চৌধুরীর আজ পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী। সেই উপলক্ষ্যে রায়চৌধুরী ম্যানসনের বাগানে বিশাল পার্টি অর্গানাইজ করা হয়েছে। আয়োজক দুই ছেলে অমরনাথ ও কমলনাথ এবং এক মেয়ে শালিনী। পুত্রবধূ অন্তরা, বিজয়া ও জামাতা অলোকেন্দু মজুত। শঙ্করনাথের স্ত্রী অবলাবালা নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যস্ত। রায়চৌধুরী ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির বোর্ড মেম্বার এবং কর্মচারীরা পানভোজন করছেন, এমন সময় নাটকীয়ভাবে প্রবেশ এক কিশোরীর। পরনে গাছকোমর করে বাঁধা গোলাপি রঙের শাড়ি ও রানি রঙের ব্লাউজ। মাথায় দুই বিনুনি। পায়ে রুপোর মল ঝমঝম করছে। হাত ভরতি চুড়ি, বালা, রিস্টলেট, আর্মলেট। কপালে অদ্ভুত দেখতে টিপ। চোখে কাজল, ঘাড়ে ট্যাটু। তার দাবি, সে শঙ্করনাথের নাতনি। শঙ্করনাথের আগের পক্ষের স্ত্রী এখনও জীবিত। উত্তরবঙ্গের এক গির্জায় একান্তে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর পুত্র ড্রাগ অ্যাডিক্ট। পুত্রবধূ গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে গত দশ বছর ধরে কোমায় রয়েছে। বাবা-মায়ের চিকিৎসার জন্য মেয়েটি ঠাকুরদার কাছে টাকা চাইতে এসেছে।

বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে গান গাইছে বাংলা ব্যান্ড ‘মাটি’। মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার পরে ব্যান্ডের বাজারদর তুঙ্গে। এখন লিড সিঙ্গার টিটো নামের একটা ছেলে। সে গাইছিল, ‘আমরা হাঁটি যেথায় মাটি, সঙ্গে থাকুক হাতপাখাটি।’ টিটো নাটকীয়ভাবে গান থামিয়ে দিল। অভিনেত্রী চন্দ্রিমা সেন কবি সুদিন চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। দু’জনে অবাক হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালেন। চিত্রপরিচালক মনোতোষ ঘোষ ঔপন্যাসিক বিপিন দত্তর সঙ্গে গল্প করছিলেন। তাঁরাও অবাক হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালেন। ছোট ছোট কাটে সব্বার রিঅ্যাকশান দেখাতে দেখাতে আস্ত একটা সেগমেন্ট শেষ হল। এখন বিজ্ঞাপনের বিরতি। অরুণা হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘শেষে ওই বুড়োটাও! আমি এতদিন ওকে ভালো ভাবতাম। নাঃ! জগতে একজনও সৎ পুরুষ মানুষ নেই।’

হাসতে হাসতে অভি বলল, ‘টিভি দেখে মাথা খারাপ কোরো না। এক কাপ চা খাওয়াও।’

‘এখন পারব না।’ হাত নাড়েন অরুণা, ‘তোর বাবা আসুক।’

মনোজের অফিস থেকে ফেরাটা অজুহাত। মেগা-সিরিয়ালের মেগা-ধামাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অরুণা টেলিভিশনের সামনে থেকে উঠবেন না। মনোজ জীবন সংগ্রামের নাটক করতে গিয়ে পরিবারের পিছনে সময় দিতে পারছেন না। আর অরুণা টিভি দেখতে গিয়ে। তাহলে অরুণা কোন সাহসে মনোজকে দোষারোপ করেন?

হঠাৎ অভির মাথায় কতগুলো শব্দ খেলা করতে শুরু করল। শব্দগুলো নিজের মর্জি মতো একে অপরের সামনে-পিছনে বসে লাইন হয়ে উঠছে। আচমকা। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া।

‘মাছের কাঁটার মতো ঊর্ধ্বে মেলা কেশ
কুটিল বিভঙ্গে দাও যৌনতা-সন্দেশ।’
যাব্বাবা! এর মানে কী? ঘাবড়ে যায় অভি। অসহায়ভাবে খেয়াল করে, আরও নতুন লাইন ঢুকছে মাথায় মধ্যে। যেভাবে খোলা জানলা দিয়ে ঢোকে হাওয়া। মাথার মধ্যে লাইনগুলো সাজাতে সাজাতে তিনতলার চিলেকোঠার ঘরে ঢোকে অভি। কাগজ পেন টেনে নিয়ে খসখস করে লিখতে থাকে…

‘চোখেতে পড়েছে ছানি। হয়ে গেছে স্ট্রোক
কচি মাথা দেখলেই টেনে মারো চোখ।
স্তনেতে আঁশের গন্ধ, স্বাদ কিছু বাসি
মজেছে মন্ত্রীর পিসে, ক্ষুদ্র ভাগচাষি।’
এটা একটা পদ্য। এইটুকু বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কী নিয়ে? অভি কনফিউজড। বৃদ্ধা বেশ্যার বর্ণনা চলে আসছে পদ্যে। যে রকম মেয়েদের অভি দেখেছে হাড়কাটা গলিতে। কিন্তু তারা পদ্যে কেন আসছে?

এই নিয়ে ভাবা বন্ধ করে অভি। কেন না, পরের লাইনগুলো ফড়ফড় করে মাথার চারিদিকে উড়ছে। খাতায় বন্দী না করলে হারিয়ে যাবে। অভি লেখে,

‘নিতম্বে দাদের বৃত্ত, উকুনের ডিম
স্পর্শে চিত্তে শিহরণ, আনন্দ অসীম।
দামড়া মোচার মতো কোঁচকানো থাই
সর্বস্ব বিলিয়ে দেব, যদি ওটি পাই।
গহনার নৌকাসম সর্বগ্রাসী যোনি
ওতেই মজেছে দিল্লি থেকে বাঁশদ্রোণি।
ভাঁড়ে মা ভবানি হোক। উল্টোক পৃথিবী
রাস্কেল-তন্ত্রের জয়। গেরস্থের টিভি।’
একটানা আট লাইন লিখে থামল অভি। সব মিলিয়ে চোদ্দ লাইনের কবিতা, প্রতি লাইনে চোদ্দটি অক্ষর—তার লেখা প্রথম সনেট। যদিও ক্লাসিকাল সনেটের অন্তমিল এই সনেটে নেই, তবুও। কী করে লিখল সে? যখন শুরু করেছিল তখন জানত না যে এটা চতুর্দশপদী কবিতা হবে। তাহলে কীভাবে তার মন অক্ষর গুনল? এই অবাক কাণ্ডটা কীভাবে ঘটল? অভি কি তবে কবি হয়ে গেল?

একা একা কিছুক্ষণ খ্যাকখ্যাক করে হাসল অভি। ‘অভি কি তবে কবি?’ নিজের মনে বার কয়েক বলল। সবচেয়ে বড় কথা, পদ্যটার উৎস অরুণার টিভি সিরিয়াল গেলা। পদ্যটা লেখার সময় সেটা অভি বুঝতেই পারেনি।

হতভম্ব ভাব কাটিয়ে অভি পদ্য কারেকশান করতে বসল। অবশ্য কারেকশান না করলেও কোনও ক্ষতি নেই। এই পদ্য কেউ পড়তে যাচ্ছে না!

আচ্ছা, এই পদ্যের নাম কী হতে পারে? অভি একবার লিখল, ‘কহানি ঘর ঘর কি’। সেটা কেটে দিল। ওই নামের হিন্দি মেগা-সিরিয়াল খুব জনপ্রিয়, কিন্তু বাংলা কবিতার হিন্দি নাম? নতুন নাম দিল, ‘চতুর্দশপদী খিস্তি।’ এইবার নামটা পছন্দসই হয়েছে।

কবিতায় ছোট একটা ত্রুটি চোখে পড়ল। অতীতে টিভির অ্যান্টেনা লাগানো থাকত বাড়ির ছাদে। অ্যান্টেনাকে মাছের কাঁটার সঙ্গে তুলনা অতীতে ব্যবহৃত হয়েছে। অভি আবার ইউজ না করলেই পারত। এখন ওটা অচল। তা ছাড়া বুড়ি বেশ্যার যৌন আবেদনের সঙ্গে টিভির জনসম্মোহনী ক্ষমতাকে মেলানো ছাড়া এই কবিতায় বিশেষ কিছু নেই।

তাও একটা নতুন কবিতা। খাতাটা বুক র‌্যাকের পিছনে রেখে দিল অভি। বিলু মাঝেমধ্যে বইয়ের খোঁজে এই ঘরে হানা দেয়। কোনওদিন চোখে পড়লে অভি আওয়াজ খেয়ে মরে যাবে।

পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। আজ সোমবার, সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ তারিখ। এখন একটানা পনেরো দিন ছুটি। বাড়িতে বসে কী করবে বুঝতে পারছে না অভি। দীর্ঘদিন হোস্টেলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থেকে, বাঁধনছাড়া জীবনযাপন করে, বাড়িতে এসে প্রচণ্ড একঘেয়ে লাগছে। সান্ত্বনা বলতে বৃন্দার সঙ্গে ফোনালাপ।

বৃন্দার প্রসঙ্গ মাথায় আসতে নিজেকে সামলাল অভি। এক্ষুনি আবেগের সুনামিতে ভেসে যাওয়ার কিস্যু হয়নি। পরীক্ষার মধ্যে হঠাৎ করে হাতে পদ্য গুঁজে দিলাম, আর মেয়েটা ঢক করে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিল, জীবনে এতটা সরল নয়। কলকাতা শহরের এক নম্বর সার্জেনের মেয়ে। দ্বিতীয় প্রজন্মের চিকিৎসক। স্যামি ব্যানার্জির মতো বৃন্দাও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করতে বিলেত যাবে। ফিল্ম ম্যাগাজিনের গসিপ কলামের সূত্রে অভি জানে, বৃন্দার মা প্রাক্তন অভিনেত্রী মন্দিরা ব্যানার্জি। এইরকম ঘ্যামা ব্যাকগ্রাউন্ডওয়ালা মেয়ের পাশে তার মতো একটা ছেলে? মফসসলে বাড়ি, মফসসলে স্কুলিং, বাবা সরকারি করণিক, মা গৃহবধূ। যোগ্যতা বলতে দুই ভাই ডাক্তারি পড়ছে। বড় ভাই আবার অতিবাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নাঃ! অভি কিছুতেই বৃন্দার পাশে নিজেকে বসাতে পারছে না। চূড়ান্ত মিসম্যাচ মনে হচ্ছে। তার ওপর ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি। ঝাড় খেয়ে যেতে পারে অভি। এই বাজারে প্রেম-ফ্রেমের মতো ন্যাকামি পোষায় না। এই প্রেমের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। বৃন্দা ফোন করলে ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাছাড়া প্রেম ব্যাপারটা অভির কাছে খুব জটিল এবং রহস্যময় ব্যাপার। ও সব তার মতো ছেলেদের জন্য নয়। ও সবের জন্য ম্যাচিয়োরিটি লাগে। নিজেকে অতটা বড় বলে মনে হয় না অভির।

তাহলে কোন সাহসে অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার সময় সে পদ্য লিখে বৃন্দার হাতে তুলে দিয়েছিল? তখন তো মনে হয়নি, সে যথেষ্ট ম্যাচিয়োর নয়। কী ব্যাপার কে জানে বাবা!

বৃন্দার প্রসঙ্গ ভুলে কান খাড়া করে অভি। দোতলা থেকে গোলযোগ শোনা যাচ্ছে। মানদা, রাধা আর অরুণা মিলে কথা কাটাকাটি করছে। ব্যাপারটা কী জানতে অভি নীচে নামে। তাকে দেখে মানদা বলে, ‘কী ঘণ্টার ডাক্তারি পড়ছ? রাধাকে পাগলা গারদে ঢোকাও, এ আমি বলে দিলুম। ও যে কোনওদিন এখান থেকে ভাগলবা হবে। তখন পুলিশ তোমাদের গারদে ঢোকাবে।’

‘আহ! আহ! লুক হুজ টকিং অ্যাবাউট পোলিস। আ হোর হু রেগুলারলি গেটস ফাকড বাই দেম…’ ঘৃণাভরে বলে রাধা।

রাধা পাগলির ইংরিজি শুনে অনেকবার চমকেছে অভি, আজ শিউরে উঠল। ‘হোর’? ‘ফাক’? এই সব শব্দ রাধা জানল কী করে? আর, রাধার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মানদা তো সাংঘাতিক চিজ!

সৌভাগ্যবশত, মানদা রাধার ইংরিজি বকবকানির মানে বুঝতে পারেনি। সে অভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইংরিজিতে আমাকে গালাগালি দিল। তাই না?’

‘হ্যাঁ। আমি তোকে গালিগালাজ করেছি।’ ফ্যাঁশফ্যাঁশে গলায় বলে রাধা, ‘কেউ তো তোকে গালি দিল! কেউ তো তোকে নিয়ে মাথা ঘামাল! কেউ তো বুঝিয়ে দিল যে বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ! আমার মতো নির্বান্ধব তো তুই নোস।’

‘নির্বান্ধব?’ অরুণা অবাক, ‘তোমার যে একা লাগে সেটা কখনও বলোনি তো!’

‘কী বলব? গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে ঘুরব? কপাল চাপড়ে চ্যাঁচাব, ‘ওগো! আমার কেউ নেই গো! আমায় দেখো!’ আয়্যাম নট আ ক্রাই-বেবি। আয়্যাম নট দ্যাট কাইন্ড অব লেডি হু হোয়াইনস অ্যাট দ্য ড্রপ অব আ হ্যাট। আমি তোমাদের মতো নই।’

‘তুই পাগল না সেয়ানা পাগল না পুলিশের লোক? তুই এত ইংরেজি জানলি কী করে?’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে মানদা, ‘পঞ্চপাণ্ডব বলে, তোর সঙ্গে আমেরিকার ষড় আছে।’

‘পঞ্চপাণ্ডব? মানে ওই বখাটে ছোঁড়াগুলো? তোর তো ওদের সঙ্গেও আশনাই আছে। সন্ধেবেলা স্নো-পমেটম মেখে গঙ্গার ধারে যা রঙ্গ-তামাশা করিস তা আমি দেখিনি ভেবেছিস? ঢলানি মাগির রং-রলিয়া দেখে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে বৌদি।’

‘অ্যাই পাগলি, চুপ! আমাকে নিয়ে কোনও চুদুরবুদুর নয়! পঞ্চপাণ্ডব ঠিকই বলে, তুই আমেরিকার এজেন্ট!’

‘কোন শালা বলে বে? সিআইএ? কেজিবি? র? আইএসআই? মোসাদ? পেন্টাগন? এফবিআই? কোন মাই কা লাল আছে? ডেকে আন!’ গর্জে ওঠে রাধা পাগলি, ‘একমাত্র তিনিই জানেন আমি কে! আমি অন্য কারও পরোয়া করি না।’

এতক্ষণে অরুণা নড়ে চড়ে বসেছেন। সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে বলছেন, ‘কার কথা বলছ? তোমার এইসব কথা শুনে আমার কেমন ভয় ভয় করে।’

‘ভয় তো পবিত্র জিনিস। শ্রেণি ঘৃণার মতো পবিত্র। যে ভয় পায় সে ওঁর দিকে আর এক কদম এগিয়ে যায়। যেমন আমি যাচ্ছি। নেভার ফরগেট, ফিয়ার ইজ দ্য কি।’ কাঠ কাঠ গলায় বলে রাধা পাগলি।

‘ধুর বাবা! আজ এর তার কেটেছে।’ তড়বড়িয়ে নীচে চলে যায় মানদা পিসি। অভি আবার অরুণাকে বলে, ‘এক কাপ চা হবে?’

‘দিচ্ছি।’ সোফা থেকে উঠে অরুণা বলেন, ‘কটা বাজল রে?’

‘সাড়ে সাতটা। তোমার বরের ফিরতে আজও সাড়ে এগারোটা বাজবে।’ সবজান্তা, প্রফেটিক টোনে বলে রাধা।

‘তুমি কী করে জানলে?’ বিরক্ত হয়ে বলেন অরুণা, ‘চালপড়া, কলাপড়া শিখেছ নাকি?’

‘নাঃ! ওসব শিখিনি। তবে মানব চরিত্র সম্পর্কে এত নিখুঁত ও নির্দিষ্ট ধারণা আছে, যে এসব বলতে কোনও অসুবিধে হয় না।’

‘আমার বরকে নিয়ে কী ধারণা হল শুনি? সারাদিন আপিসে গাধার খাটনি খাটে। তারপর ইউনিয়নের কাজ, নাটকের রিহার্সাল, কল শো। বাড়িতে যখন ফেরে তখন শরীরে একবিন্দু এনার্জি থাকে না। লোকটাকে তুমি কিছু বোলো না তো!’

‘এনার্জি কোথা থেকে থাকবে?’ ফুট কাটে রাধা। অরুণা চা করতে করতে ছাঁকনি নিয়ে তেড়ে যান, ‘পাগলির মরণ, তুই আমার বরকে নিয়ে আর একটা ভুলভাল কথা বললে দেব গায়ে গরম জল ঢেলে…’

‘তুমি আমাকে এমন কথা বলতে পারলে?’ অবাক হয়ে অরুণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাধা। ‘ছুঁড়ে দেওয়া তির আর বলে ফেলা কথা কখনও ফেরানো যায় না। কিন্তু না-বলা কথা বুকের মধ্যে জমে গাছ হয়। সেই গাছের শেকড় নীচে নামে। পা থেকে ছড়িয়ে যায় মাটির গভীরে। আর ডালপালা মেলতে থাকে ওপর দিকে। সবুজ পাতায় শরীর ঝলমল করে। তোমারও করবে। আজ না হোক কাল। তুমি সবুজে ঝলমলিয়ে উঠবেই। তবে কিনা ঈর্ষার রংও সবুজ হয়। তুমি যেন হিংসে-গাছ হয়ে যেও না! আগে থেকে সাবধান করে দিলাম!’

সাদা থান শরীরে জড়িয়ে ধীর পদক্ষেপে নীচে চলে যায় রাধা। অভিকে এককাপ চা ধরিয়ে অরুণা বললেন, ‘কী বলল কিছু বুঝলি? জ্ঞানের ভড়ং আওড়াল না আমাকে অভিশাপ দিল?’

‘বুঝলাম না।’ সুড়ুত করে চায়ে চুমুক দিয়ে অভি বলে, ‘বাবার কোনও শো আছে?’

‘জগদ্দলে একটা পথনাটক আছে। ‘নতুন দিনের গল্প’ না কী যেন একটা নাম। তোর বাবার এইসব পাগলামো কবে বন্ধ হবে বল তো?’

‘বন্ধ হবে না। এটাই বাবার জীবন। লোকে কিছু না কিছু নিয়ে বাঁচে। বাবা নাটক নিয়ে বাঁচছে।’

অরুণা আবার ফিরে গেছেন টিভির সামনে। ‘যদিদং হৃদয়ং মম’ শেষ হতে চলেছে। মাটি এখনও পারফর্ম করছে। টিটো গান গাইছে, ‘মাটিতেই জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে।’ শঙ্করনাথ বলছেন যে তাঁর দ্বিতীয় কোনও স্ত্রী নেই। ছেলে, ছেলের বউ, নাতনি তো অনেক দূরের কথা। দুই ছেলে অমরনাথ ও কমলনাথ বাবাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। দুই মেয়ে অন্তরা আর বিজয়া বাচ্চা মেয়েটাকে জেরা করছে। সবার আড়ালে মেয়ে শালিনী আর জামাই অলোকেন্দুর চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল। এই মেয়েটাকে তারাই ভাড়া করে এনেছে। ঝ্যাং ঝ্যাং শব্দ করতে করতে সিরিয়ালের মেগা এপিসোড শেষ হচ্ছে। পর্দায় সবার মুখের ক্লোজ শট।

অরুণার সিরিয়ালে আর মন নেই। তিনি বাংলা খবরের চ্যানেলে ঢুকে পড়েছেন। এই চ্যানেল ওই চ্যানেল করতে করতে আটকে গেলেন স্কুপ চ্যানেলে। নবযুগ পার্টির একটা বিশাল মিছিল যাচ্ছে আলপথ দিয়ে। চাষের জমির ফনফনে সবুজ ফসল আর হলুদ পতাকার রং মিশে গেছে। মৃন্ময় চ্যাটার্জি স্লোগান দিচ্ছেন, ‘দালাল দিয়ে, পুলিশ দিয়ে, লাঠি দিয়ে, বারুদ দিয়ে, আন্দোলন দমন করা যায়নি…’

হাজার হাজার লোক চেঁচাচ্ছে, ‘যাবে না!’

ক্যামেরায় স্কুপ চ্যানেলের সাংবাদিক বলছে, ‘হেলথ হাব তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ করার লক্ষ্যে একদিকে যখন সরকার নোটিস দিয়েছে, অন্যদিকে তখন বিরোধী নেতা মৃন্ময় চ্যাটার্জির নেতৃত্বে নতুনগ্রাম এবং বাঁজাপলাশ গ্রামে গড়ে উঠেছে অভূতপূর্ব গণ আন্দোলন। শিবির তৈরি করে রাত পাহারার কাজ শুরু হয়েছে নতুনগ্রাম এবং পার্শবর্তী বাঁজাপলাশ গ্রামে। রাতের অন্ধকারে পুলিশবাহিনী এসে যাতে জমি দখল করতে না পারে তার জন্য পালা করে রাত জাগছে বাচ্চা থেকে বুড়ো, ছেলে থেকে মেয়ে—সবাই। মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্ত জানিয়েছেন, তাঁর কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে যে এইসব শিবির গুলিতে অস্ত্র আসছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে, রেড করিডোর ধরে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকেও বিপুল অস্ত্রের সম্ভার ঢুকছে জলপথে। এই শিবিরগুলিতে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি বা আইপিপির মদতে বসছে স্বাস্থ্যশিবির। কলকাতার অতিবাম মনোভাবাপন্ন চিকিৎসকরা শিবির পরিচালনা করছেন। এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টরা স্থানীয় মানুষদের শেখাচ্ছেন, কীভাবে রোজকার গেরস্থালির জিনিসপত্র দিয়ে বোমা বানানো যায়। শেখাচ্ছেন অস্ত্র চালাতে। সব মিলিয়ে নতুনগ্রামের পরিস্থিতি এখন অগ্নিগর্ভ। ক্যামেরায় রাজ্যের সঙ্গে স্কুপ চ্যানেলের পক্ষে আমি, পরিমল।’

নতুনগ্রামের খবর শেষ হতে না হতেই চ্যানেল বদলে গেল। অন্য খবরের চ্যানেল দেখাচ্ছে শেয়ালদহ শাখায় রেল দুর্ভোগের কাহিনি। জগদ্দল স্টেশনে টিকিট না কেটে ট্রেনে ওঠা এক যুবকের কাছে টিকিট দেখতে চাওয়ায় যুবক চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ মেরেছে। স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় পরে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর নিত্যযাত্রী ও সাধারণ মানুষ মিলে রেল লাইনে অবরোধ করেছেন। ওভারহেড তারে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে কলাপাতা। শেয়ালদহের মেন লাইনে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ।

অরুণার ভুরু কুঁচকে গেছে। আঙুল মটকাচ্ছেন ঘন ঘন। একবার বাথরুম থেকে ঘুরে এলেন। মনোজের মোবাইলে ফোন করলেন বারচারেক। আপন মনে বিড়বিড় করলেন, ‘মোবাইল সুইচড অফ!’

অরুণার এই খ্যাপামো অভির চেনা। ওসবে পাত্তা না দিয়ে সে ভাবল, কবিতাটা নিয়ে কী করবে? কলেজ ম্যাগাজিনে দিয়ে দেবে? নাঃ! ওখানে এই কবিতার মর্ম কেউ বুঝবে না। অন্য কোথাও? কোনও লিটল ম্যাগাজিনে?

তাদের পাড়া থেকে একটা লিটল ম্যাগাজিন বেরোয়। নাম ‘চয়ন’। তলায় লেখা থাকে, ‘অতি অনিয়মিত ত্রৈমাসিক’। এ সব নিজেকে ‘লিটল’ প্রমাণ করার ছক। ম্যাগাজিনটির সম্পাদক এই এলাকার জনমোর্চার এমএলএ। সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে ম্যাগাজিনটি শাঁসেজলে আছে। ভুলভাল লেখা ছাপা হয়।

মনে মনে চয়নের পাশে ঢ্যাঁড়া দেয় অভি। মনোজের দফতর থেকে একটা ম্যাগাজিন বেরোয়। সেটার নাম জীবন সংগ্রাম। চয়নের সঙ্গে চরিত্রগতভাবে কোনও তফাত নেই। সরকারি বিজ্ঞাপনে ঠাসা, সরকারের স্তাবকতায় ভরা। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চরিত্র বজায় রাখতে নিয়ম করে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ ও পত্রিকাকে গালাগালি দেয়। জীবন সংগ্রামের পাশেও ঢ্যাঁড়া দেয় অভি।

হঠাৎই মনে পড়ে অন্তহীন পত্রিকার কথা। কবি সুদিন চক্রবর্তীর সম্পাদনায় এই দ্বি-মাসিক কাব্যপত্রটি অনেকদিন ধরে চলছে। সুদিন আজ সকাল সংবাদপত্রের রবিবারের পাতার সম্পাদক। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুরোদস্তুর যুক্ত। তা সত্ত্বেও নতুন কবিদের জন্য তৈরি করেছে প্ল্যাটফর্ম, অন্তহীন। বাংলাভাষার নবীন ও প্রবীন এমন কোনও কবি নেই যিনি অন্তহীনে লেখেননি। অভিও ট্রাই করবে নাকি?

মাথায় ভূত যখন চেপেছে, তখন একটাই উপায়। কাজটা করে ফেলা। চায়ের কাপ সিঙ্কে রেখে তিনতলায় ওঠে অভি। কবিতার খাতা বার করে, সাদা কাগজে কবিতাটা কপি করে। আর একটা সাদা কাগজ নিয়ে বসে। একটা ফরওয়ার্ডিং লেটার থাকা উচিত, যাতে তার নাম, ঠিকানা, ফোন-নম্বর বা মেল আইডি থাকবে। সামান্য ভেবে সে লেখে,

‘শ্রী সুদিন চক্রবর্তী,

সম্পাদক,

অন্তহীন,

মান্যবরেষু,’

আচ্ছা মান্যবরেষু বানানে মূর্ধণ্য ষ, না দন্ত স? কবিতার খাতা টেনে নিয়ে দু’রকম বানানই লেখে অভি। চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ‘মান্যবরেসু’ ভুল বানান। তা হলে ‘মাননীয়াষু’ বানান কী? এখানে দন্ত স না মূর্ধণ্য ষ? কনফিউজড হয়ে অভিধান পেড়ে বানান দেখে নেয় অভি। ও হরি, মেয়েদের ক্ষেত্রে দন্ত স আর ছেলেদের ক্ষেত্রে মূর্ধণ্য ষ। তাহলে সে ঠিকই লিখেছে। খসখস করে আবার কলম চালায়।

‘অন্তহীন’ পত্রিকার জন্য একটি কবিতা পাঠালাম।

আশা করি মনোনীত হবে।

নমস্কারান্তে,

অভিজ্ঞান লাহিড়ী।

৫/৯/২০১১

ওপরে চিঠি ও তলায় কবিতার কাগজ রেখে স্টেপল করে অভি। খয়েরি খাম পাড়ে বইয়ের তাক থেকে। তিনভাঁজ করে চিঠি খামে ঢোকায়। আঠা দিয়ে খামের মুখ আটকে খামের ওপরে বড়বড় করে অন্তহীন পত্রিকার ঠিকানা লেখে। প্রেরক হিসেবে নিজের নাম-ঠিকানা লেখে। তারপর দোতলায় নেমে আসে। এখনই কুরিয়ার করে দেওয়া যাক।

মনোজ অফিস থেকে চলে এসেছেন। মনোজকে দেখে অবাক হল অভি। সাড়ে নটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে গেছেন? তা হলে নিশ্চয় গাড়িতে ফিরেছেন। অরুণা রান্নাঘরে আবার চা করছেন। অভি বলল, ‘মা, আর এক কাপ চা হবে নাকি?’

অরুণা উত্তর দিলেন না। অভি সোফায় বসে রিমোটের দিকে হাত বাড়াল। অরুণা টিভি বন্ধ করে দিয়েছেন।

টিভি চালানো মাত্র রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলেন অরুণা। অভির হাত থেকে রিমোট কেড়ে, মাথায় চাঁটি মেরে বললেন, ‘দিনরাত টিভি আর টিভি। তোর পড়াশুনা নেই?’

‘যাব্বাবা! আমি আবার কখন টিভি দেখি। তুমিই তো দিনরাত মেগাগুলো গেল। আজ দেখছিলে ”যদিদং ডিংডং”, কাল দেখবে ”হৃদয়ং পিংপং”!’ প্রতিবাদ করে অভি।

‘তুই চুপ কর।’ অভিকে থামিয়ে অরুণা বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো, তারপর কী হল?’

এদের ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। বিরক্ত হয়ে অভি ভাবে, নিচ থেকে ঘুরে আসা যাক। রাধা আর মানদার এতক্ষণে নিশ্চয় গলায়-গলায় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সিঁড়ির দিকে এগোয় সে।

‘আর বোলো না!’ খুশিয়াল গলায় বলছেন মনোজ, ‘যত বোঝাই যে আমরা স্টার নই, আমরা পলিটিকাল অ্যাকটিভিস্ট, কিছুতেই কথা শোনে না। অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। দু-একটা টিভি চ্যানেলের লোকাল করেসপন্ডেন্ট তো ইন্টারভিউও নিল। এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েও জনমোর্চার কথা বলার মতো চ্যালেঞ্জিং জব কী করে সামলাচ্ছি, আগেকার সেই ডেডিকেশান কী করে মেনটেন করছি… যত্তো সব বোরিং ব্যাপার। লাকিলি ঠিক সময় ট্রেনটা পেয়ে গেলাম তাই। তা না হলে সেই সাড়ে এগারোটা বাজত। আর তোমার মুখটা তেলো হাঁড়ির মতো হয়ে থাকত।’

একতলায় নামতে গিয়ে অভি থমকে গেল। স্লো মোশানে পিছন ফিরে দেখল অরুণা রান্নাঘর থেকে আবার বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর চোখেমুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। ঠান্ডা গলায় তিনি বললেন, ‘তুমি স্নান করে নাও। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব।’

‘আচ্ছা।’ আধখাওয়া চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বাথরুমে ঢোকে মনোজ। অরুণা ধীরপায়ে হেঁটে এসে টিভি চালান। সাউন্ড একদম কমিয়ে দেন। অভি শুনতে পায়, স্কুপ চ্যানেল এখন রেল বিভ্রাটের কাহিনি দেখাচ্ছে। সঞ্চালক পরিমল বলছে, ‘শেয়ালদা লাইনের ট্রেন চলাচল এখনও পর্যন্ত বন্ধ। সকাল সাড়ে নটায় রেল অবরোধ শুরু হয়েছে। এখন রাত সাড়ে নটা বাজে। বারো ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। রেল দফতর এখনও এই অবরোধ তুলতে পারছেন না। এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আমরা চলে যাচ্ছি…’

অভি অরুণার হাত থেকে টিভির রিমোট কেড়ে নিয়ে টিভি অফ করে দেয়। সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নামতে নামতে শুনতে পায় অরুণা বিড়বিড় করছেন, ‘পাগলের অভিশাপ! ঠিক ফলে গেল।’

.

বৃন্দা

ভোরবেলা একটা বদখত স্বপ্ন থেকে ঘুম ভেঙেছে বৃন্দার। স্বপ্নে ছিল থ্রি উইচেস, লোনলি ওয়াইফ, কনট্রোল ফ্রিক, উওম্যান ফ্রাইডে আর সুপ্রভাত। সুপ্রভাত আর কনট্রোল ফ্রিক অসিযুদ্ধ করছিল। থ্রি উইচেস ঝাঁটায় চড়ে উড়তে উড়তে ছড়া কাটছিল। লোনলি ওয়াইফ আর উওম্যান ফ্রাইডে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস! গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস!’

এইরকম বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে মনখারাপ হওয়ার কী আছে? ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষা দেওয়ার পরে সে আত্মহত্যা করেনি বা পাগল হয়ে যায়নি। শুধু দুঃস্বপ্ন দেখেছে। এ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। বিছানায় পাশ ফিরে মোবাইলে সময় দেখল বৃন্দা। সকাল ছটা বাজে। এত সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে না! তা হলে ঘুম কেন ভেঙে গেল! মোবাইলের স্ক্রিনে আজকের তারিখ দেখে বুক ধড়ধড় করে উঠল। তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসল বৃন্দা। আজ ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর। আজ ফার্স্ট এমবিবিএসের রেজাল্ট বেরোবে! ওরে বাবা রে! আর শুয়ে থাকা সম্ভব নয়।

গত একমাস দিব্যি ছিল সে। এক লাইনও পড়াশুনো করেনি। খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, সিনেমা দেখেছে, মোবাইলে বন্ধুদের সঙ্গে গপপো করেছে, ল্যাপটপে সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট ঘাঁটাঘাঁটি করেছে।

অভির সঙ্গে একদিন দেখা করেছিল। কলেজে নয়। তাহলে স্যামি জেনে যেত। দেখা হয়েছিল মাল্টিপ্লেক্সে। অভি আগের থেকে দুটো টিকিট কেটে হলের ভিতরে ঢুকে বসেছিল। সুলতান গাড়ি করে বৃন্দাকে শপিং মলে পৌঁছে দিয়ে একটা টিকিট কেটে তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। দুশো টাকার টিকিট। নষ্ট করতে খুব গায়ে লাগে। কিন্তু কী আর করা যাবে? বৃন্দা হলে ঢুকতেই অভি হাত নেড়ে ডেকে নিয়েছিল। অভির পাশে বসে বৃন্দা বলেছিল, ‘মুখটা প্যাঁচার মতো করে বসে আছিস কেন? মুড অফ?’

‘কে বলেছে?’ পর্দার দিকে তাকিয়ে বলেছিল অভি। বেছে বেছে একটা আর্ট-হাউস বাংলা ছবির টিকিট কাটা হয়েছে। বিদেশে পুরষ্কার পাওয়া, স্বদেশে সাংঘাতিক ফ্লপ ছবি। শুক্রবার ছবি রিলিজ করেছে, সোমবারের মধ্যেই শো-টাইম চেঞ্জ করে সারা দিনে একটা শো রাখা হয়েছে। আজ হলে সাকুল্যে তিরিশজন দর্শক। আর্ট ফিল্মে কথাবার্তা আর মিউজিক কম থাকে। বেশির ভাগ শুটিং ইনডোরে হয়। ছবি চলার সময়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে অসুবিধে হয় না।

‘কে আবার বলবে? মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে।’ জবাব দিয়েছিল বৃন্দা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভি বলেছিল, ‘মনে হচ্ছে অ্যানাটমিতে ঝাড় খাব।’

‘সেটাই কারণ? না অন্য কোনও কারণ আছে?’ অভির নরম আঙুল নিজের হাতে নিয়েছিল বৃন্দা। রোগা রোগা, সরু আঙুল। নির্লোম হাত। অন্ধকারে মেয়েদের হাত বলে মনে হয়। বৃন্দা হাত ধরায় টেনশানের চোটে কুলকুল করে ঘামছে। বৃন্দা সন্তর্পণে হাত ছেড়ে দিয়েছিল। একটু রিল্যাক্সড হোক বেচারি!

‘অন্য একটা কারণও আছে। সেটা পারিবারিক।’

‘নির্ঘাৎ তোর দাদা! বিলুদা পলিটিকস নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করছে।’

‘দাদা না! বাবা।’

‘তোর বাবাও পলিটিকস করে?’

‘দাদার থেকে বেশিই করে। কিন্তু সেটা ইস্যু নয়। বাবা বোধ হয় কোনও চক্করে ফেঁসেছে।’

‘কী চক্কর বল তো?’

‘রোজ দেরি করে অফিস থেকে বাড়ি আসে, আর বলে কল শো ছিল।’

‘কল শোটা কী জিনিস?’

‘উফ! নাটক নাটক! আমার বাবা অফিসের ইউনিয়নের কালচারাল সেক্রেটারি।

‘টিনটিনদার মতো?’

‘হ্যাঁ। তুই চুপ কর। আমাকে বলতে দে।’ বৃন্দার হাতে চিমটি কেটে থামায় অভি। বৃন্দা এই রকমটা আশা করেই সমানে ভুলভাল প্রশ্ন করছিল। অভি বৃন্দার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়নি। বৃন্দা কিছু না বলে চুপ করে বসে রইল।

অভি আপন মনে বকবক করছে, ‘বাবাদের নাটকের দল জীবন সংগ্রাম নিয়মিত বিভিন্ন জায়গায় কল শো করে। কয়েকদিন আগে জগদ্দলে শো করতে গিয়েছিল। আমাদের বলল, ট্রেনে করে ফিরেছে। অথচ আমি আর মা টিভিতে দেখলাম, সে দিন ট্রেন অবরোধ ছিল। পরে আমি খবর নিয়ে জেনেছি, ওই দিন জগদ্দলে বাবাদের ইউনিয়নের থেকে কোনও নাটকের শো ছিল না।’

‘তা হলে?’

‘আমি জানি না। মায়ের সন্দেহ বাবা কোনও মেয়েছেলের চক্করে পড়েছে।’

‘ও আবার কী ল্যাঙ্গোয়েজ? মেয়েছেলে?’ অভির হাতে থাপ্পড় কষায় বৃন্দা। ভেবেচিন্তে, মৃদু থাপ্পড়। যদি হাত সরিয়ে নেয়!

না। সরায়নি। শুধু বলল, ‘সরি! আমি কথাটাকে রি-ফ্রেজ করছি। মায়ের সন্দেহ, বাবা কোনও মহিলার চক্করে পড়েছে। ইনফ্যাক্ট, এন্টালিতে কল শোয়ের সময় ঋষিতা নামে একটা মেয়ে বাবার মোবাইল ধরে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল।’

‘কী বলেছিল?’

‘বলেছিল যে বাবা এখন স্টেজে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কে বলছেন। উত্তরে মেয়েটা বলেছিল, ওর নাম ঋষিতা। মৌলালিতে থাকে। ওরাই স্ট্রিট থিয়েটার অর্গানাইজ করেছিল।’

‘তোর কথা শুনে মেয়েটাকে ঠিকঠাক বলেই মনে হচ্ছে। ওকে সন্দেহ করছিস কেন?’

‘আমি সন্দেহ করিনি। মা করেছে। মা একটু প্যারানয়েড আছে।’

‘সব মানুষই অল্পবিস্তর প্যারানয়েড।’

‘মায়ের সন্দেহ, ঋষিতাই সেই মহিলা, যার চক্করে বাবা ফেঁসেছে।’

‘সন্দেহটা মিটিয়ে ফেল। ঋষিতার খোঁজপাত্তা লাগা।’

‘কী করে? কাগজে বিজ্ঞাপন দেব? না এন্টালি থানায় যাব?’

‘বোকার মতো কথা বলিস না। দময়ন্তীকে ফোন কর। ওর বাড়ি এন্টালিতে।’

‘এন্টালি বড় জায়গা। লাখলাখ লোকের মধ্যে ঋষিতাকে খুঁজে বার করা সোজা নাকি?’

‘তুইই তো বললি মেয়েটা স্ট্রিট থিয়েটার অর্গানাইজ করেছিল তার মানে নাটকের মেয়ে। প্লাস জনমোর্চা করে। একে ট্রেস করা শক্ত নয়।’

‘বাঃ। এটা ভালো বলেছিস।’ দু’হাতে বৃন্দার কনুই চেপে ধরে ধন্যবাদ জানায় অভি।

ওই একদিনই অভির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ফোনে রেগুলার কথা হলেও মনোজ বা ঋষিতার প্রসঙ্গ ওঠেনি। দময়ন্তীর সঙ্গে এই নিয়ে অভি কথা বলেনি। সবাইকে বাড়ির কেচ্ছা বলা যায় না। যদিও, মনোজ রেগুলার দেরি করে ফিরছেন। অরুণা ডিপ্রেসনে ভুগছেন। বিলুর ধারণা অরুণার অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার হয়েছে। দিনরাত হাত-পা ধোয়, দরজা-জানলা বন্ধ আছে কি না চেক করে।

অভির জন্য কষ্ট হয় বৃন্দার। তার ওপরে আজ ফার্স্ট এমবিবিএস-এর রেজাল্ট বেরোবে। পরীক্ষা কেমন দিয়েছে কে জানে! ঝাড় না খেয়ে যায়!

বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গেল বৃন্দা। এই সময় লেকের এই দিকটা একদম নির্জন থাকে। আর কয়েকদিন বাদে পুজো। এই এলাকায় বড়বড় দুটো পুজো হয়। মুদিয়ালি আর শিবমন্দির। মুদিয়ালির পুজোটা তাদের বাড়ির গায়েই হয়। স্যামি অন্যান্য বারের মতো এবারও পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট। উদ্যোক্তারা প্রত্যেক বছর স্যামিকে সেক্রেটারি করতে চায়। স্যামি সময়ের দোহাই দিয়ে কেটে বেরিয়ে গেলেও অনেকগুলো কর্পোরেট স্পনসর জোগাড় করে দেন।

রাস্তায় বাঁশ পড়তে শুরু করেছে। ওপর থেকে বৃন্দা দেখল, সুপ্রভাত সুলতানের হাতে একগাদা কাগজ আর ম্যাগাজিন দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। এই ঝুনুই স্বপ্নে স্যামির সঙ্গে লড়াই করছিল। স্বপ্নটা মাথায় আসতে ফিক করে হেসে ফেলে বৃন্দা। যত্তো সব পাগলামি।

মন্দিরা ঘুম থেকে উঠে চা বানাচ্ছেন। বৃন্দাকে বলল, ‘চা খাবি?’

‘দাও।’ হাই তুলে চেয়ারে বসে বৃন্দা বলে, ‘মা, তুমি কিন্তু বেশ মুটিয়েছ।’

‘বলছিস?’ একগাল হেসে বলেন মন্দিরা।

‘এতে আনন্দের কী আছে?’ বিরক্ত হয়ে বলে বৃন্দা, ‘গত এক মাসে খাবার পাতে বেশি মাখন খেয়ে আর দুপুরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তুমি না হোক দশ কেজি ওয়েট গেইন করেছ।’

‘তুই একদম ঠিক গেস করেছিস। পাক্কা দশ কেজি। এখন আমার ওজন বাহাত্তর। এটাকে পঁচাত্তর অবধি তুলে মেনটেন করব।’ বৃন্দাকে চা দিয়ে বলেন মন্দিরা।

‘পাগল নাকি? তোমার পেটে টায়ার দেখা যাচ্ছে। খাওয়া কমাও। এক্সারসাইজ করো।’ মন্দিরাকে ধমক দেয় বৃন্দা।

মন্দিরা নিজেও এককাপ চা নিয়েছেন। চেয়ারে বসে বললেন, ‘বিধবাপুকুর উপন্যাসে বেদানা দাসীর বর্ণনায় বিপিনদা লিখেছিলেন, ‘অল্প বয়সে বিধবা হইবার বড় জ্বালা। তাহা বেদানাকে দেখিয়া বুঝা যায়। বাড়ন্ত শরীরে সর্বদা খাইখাই ভাব। পাঠক, ভুল বুঝিবেন না। এ ক্ষুধা পেটের ক্ষুধা। জঠরাগ্নি নির্বাপণ করিতে বেদানা যাহা পাইত মুখে পুরিত। ফলতঃ, মধ্য চল্লিশে সে বিলক্ষণ পৃথুলা। তাহার ঊরুতে স্নেহ জাতীয় পদার্থ, কটিদেশে চর্বি, নিতম্বে চর্বি, মায় দুই বাহু চর্বির ওজনে দুলদুল করিতে থাকে। দেখিয়া কুৎসিত কদাকার ময়দার তাল বলিয়া ভ্রম হয়।’

চা খেতে খেতে বিষম খায় বৃন্দা। ‘মনোতোষ ঘোষ বিধবাপুকুর গপপোটা ফিলিম করছে নাকি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ আনন্দে ডগোমগো মন্দিরার মুখ।

‘তুমি হিরোইন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘প্রোডিউসার পেয়েছে?’

‘পেয়েছে। আজ একটু বাদেই মনোতোষদা আর প্রোডিউসার আমাদের বাড়ি আসছেন। স্ক্রিপ্ট ন্যারেশান করতে।’

‘ওরেব্বাবা! স্ক্রিপ্টও রেডি?’

‘মনোতোষদা গত একবছর ধরে চিত্রনাট্যর খসড়া করেছে। এটা নাকি টুয়েন্টি ফিফথ ড্রাফট।’

‘প্রোডিউসারটি কে? নির্ঘাত অগাবগা কেউ! কয়লার ব্যবসা থেকে কালচারের লাইনে আসছে।’

‘তুই আমাকে এত আন্ডার এস্টিমেট কেন করছিস বৃন্দা? আমি একসময় টলিউডের এক নম্বর হিরোইন ছিলাম। তোর জন্যই স্পটলাইট ছেড়েছি। তুই যদি এরকম বলিস…’

মন্দিরার মুখে আষাঢ়ের মেঘ। দেখে মনে হচ্ছে আর কিছু বললেই কেঁদে ফেলবে! বৃন্দা চেয়ার থেকে উঠে মন্দিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সরি মা। আসলে তোমার অ্যাক্টিং নিয়ে আমরা হাল্কা চালেই কথা বলি। এটা অন্যায়। আর কোনও দিনও এই ভুল হবে না। এবার বলো প্রডিউসার কে?’

‘মায়াকম। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পরে এবার ওরা অডিও-ভিজুয়াল মিডিয়ায় ঢুকছে। বাংলা সিনেমায় কর্পোরেট হাউসের এনট্রিও এই প্রথম। ওঁদের পলিসি হল, সাহিত্যভিত্তিক ছবি করবেন। পাশাপাশি রুচিসম্মত ফর্মুলা ফিল্মও বানাবেন। ওঁদের সিইও হৈমবতী সান্যাল এই ছবির প্রডিউসার।’

চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বৃন্দা বলল, ‘বাবা জানে?’

ঝুনুর মা এসে গেছে। তাকে জলখাবারের নির্দেশ দেওয়ার সময়ে মন্দিরা মুচকি হাসলেন। ‘তোর বাবাকে এখনও বলিনি। খেতে বসার সময়ে বলব।’

বৃন্দা নিজের ঘরে দৌড়য়। স্নান করে ফেলা যাক। আজ তাড়াতাড়ি কলেজে যেতে হবে। ভয়ের চোটে পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছে। যদি সাপ্লি হয়, তাহলে পাহাড়প্রমাণ বই আবার পড়তে হবে। বাবা গো! ওয়াক তুলতে গিয়ে নিজেকে সামলায় বৃন্দা। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে মাস্টার বেডরুমে উঁকি মারে। স্যামি ঘুম থেকে উঠে খাটে বসে আছেন। মুখ দেখে বোঝা যায়, হ্যাংওভার কাটেনি।

স্নান করে পোশাক পরে রেডি হয়ে খাবার টেবিলে এল বৃন্দা। সাড়ে আটটা বাজে। স্যামি এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেননি। আজ স্যামির গাড়িতে যাওয়া হবে না। ঝুনুর মা চিজ স্যান্ডুইচ বানিয়েছে। এটা বৃন্দার প্রিয় খাবার। কিন্ত আজ মুখে রুচি নেই। একটা স্যান্ডুইচ মুখে পুরে গরুর মতো জাবর কাটতে কাটতে বলল, ‘ওঁরা কখন আসবেন?’

‘বিকেল সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে। তুই ততক্ষণে চলে আসবি তো?’

‘হুম।’ মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে ঘাড় নাড়ে বৃন্দা। এক চুমুক কফি দিয়ে স্যান্ডুইচ নরম করে গিলতে গিলতে বলে, ‘কী রেজাল্ট হবে কে জানে! পাস করে গেলে ওঁদের সামনে আসব। ঝাড় খেলে মুড অফ থাকবে। তখন আমার কাছ থেকে সোশাল ভিজিট এক্সপেক্ট কোরো না।’

মন্দিরা সামান্যক্ষণ বৃন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘টেনশান করিস না। তোর রেজাল্ট ভালো হয়েছে। আর একটা স্যান্ডুইচ খা।’

মন্দিরার দিকে তাকিয়ে বৃন্দা বলল, ‘বাবা বলেছে?’

‘হ্যাঁ। তোকে বলতে বারণ করেছিল। তোর মুখ-চোখের অবস্থা দেখে মায়া হল। তাই বলে দিলাম। বাবাকে বলিস না। খুব রেগে যাবে।’

‘বলব না।’ আর একটা স্যান্ডুইচ নিয়ে বৃন্দা বলে, ‘বাই এনি চান্স, বাবা আমার হয়ে ক্যাচ মারেনি তো?’

‘তোদের এই ”ক্যাচ” শব্দটা আমার জঘন্য লাগে। ডাক্তারদের মধ্যে চেনাশুনো থাকে বলে কেউ যদি তার কোলিগকে বলে, ‘আমার ছেলে বা মেয়েটাকে একটু দেখিস’, তা হলে সেটাকে অন্য অনেক নামে ডাকা যায়। ”ক্যাচ” কেন?’

‘কখনও ভাবিনি। এটাই চালু ডায়ালগ। তুমি শব্দ ও তার নিগূঢ়ার্থ নিয়ে মাথা ঘামাও। আমি বেরোলাম। সুলতানচাচুর যাওয়ার দরকার নেই। আমি মেট্রোয় চলে যাব।’ ব্যাকপ্যাক কাঁধে লটকে শোওয়ার ঘরে উঁকি মারে বৃন্দা। স্যামি এখন বাথরুমে। মা আর ঝুনুর মাকে টাটা করে সিঁড়ি দিয়ে টপাটপ নামতে থাকে সে।

.

 কলেজে ঢোকার মুখে দেখা হয়ে গেল প্রবাল আর শ্রীপর্ণার সঙ্গে। দু’জনে টেনশান-টেনশান মুখ করে দাঁড়ে বসে চা খাচ্ছে। বৃন্দাকে দেখে শ্রীপর্ণা বলল, ‘বারোটায় রেজাল্ট আউট হবে। আপাতত আড়াই ঘণ্টা মুখ শুকিয়ে ঘুরে বেড়া!’

শ্রীপর্ণার পাশে বসে বৃন্দা বলল, ‘তুই হোস্টেলে ফিরলি কবে?’

‘গতকাল রাতে। সবাই ফিরে এসেছে। ফার্স্ট ইয়ার জয়েন করেছে। তাদের র‌্যাগিং করবে বলে সবাই, যাকে বলে, ‘ওয়েটিং উইদ বেটেড ব্রেদ!”

‘কোনও ভালো দেখতে ছেলে দেখলি?’

‘না না! সব শালা চিকনা টাইপ! চুলে জেল, লো ওয়েস্ট জিনস, ক্লিন শেভড, ফাঙ্কি টি-শার্ট পরা মেনিমুখো মেট্রোসেক্সুয়ালের পাল। না হলে গ্রামের ভেজিটেবিল। এবিসিডি বলতে গিয়ে পটি করে ফেলবে। কিন্তু কানে ঠিক ইয়ারফোন গোঁজা। একটাও আইএসআই ছাপযুক্ত মরদ দেখতে পেলাম না।’

শ্রীপর্ণার ডেসক্রিপশান শুনে বৃন্দা হিহি করে হাসে। প্রবাল বলে, ‘তোদের ছামের কালেকশান কী রকম?’

‘মেয়েরা ভালোই হয়। আজকাল গ্রাম বা মফসসলের মেয়েরাও নিজেদের ঠিকঠাক ক্যারি করে। মুখ খুললেই অবশ্য বিপদ। বলবে, ”আমি শ্যারদের খুব রেশপেক্ট করি।”’

আবারও একপ্রস্ত হাসে সবাই। একভাঁড় চা নিয়ে বৃন্দা বলে, ‘স্টানিংলি বিউটিফুল কেউ আসেনি?’

‘মানে তোর মিস আইএমসির ক্রাউনের উত্তরাধিকারী? দিল্লির একটা মেয়ে এসেছে। কাইরা সিনহা। প্রায় ছ’ফুট হাইট। রেগুলার মডেলিং করে। ওই এবারের ক্রাউন পাবে।’ জানায় শ্রীপর্ণা।

তিনজনের আড্ডার মধ্যে প্রবাল বলল, ‘ওই যে! মোচার লিডার আসছেন।’

বৃন্দাও দেখেছিল। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হনহন করে ঢুকছে চন্দন। শ্রীপর্ণার দিকে হাত নেড়ে হাঁটা লাগাল। বৃন্দা বলল, ‘হ্যাঁ রে! আমি কি এতই কুচ্ছিত যে মুখ দেখলে দিন খারাপ যাবে?’

চন্দন দাঁড়াল। একটা সিগারেট ধরাল। এগিয়ে এসে দাঁড়ে বসে বলল, ‘আমি তোকে খেয়াল করিনি। আর, কারও মুখ দেখলে দিন খারাপ যায়, এই কথা বিশ্বাস করি না।’

‘ওসব ছাড়!’ প্রবাল চন্দনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘রেজাল্টের কোনও খবর পেলি?’

‘আমি কী করে খবর পাব?’ চন্দন অবাক।

‘তুই শালা নেতা। প্রিন্সি তোকে ঠিক বলে দিয়েছে।’

‘ফালতু কথা বন্ধ কর।’ প্রবালকে ধমকায় চন্দন, ‘চা শেষ করে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং চল। ওখানেই রেজাল্ট ঝোলাবে।’

‘এখন নয় বস। দুপুর বারোটায়। হাতে অনেক সময় আছে।’ শ্রীপর্ণা বলে। তার হাত থেকে ভাঁড় কেড়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে চন্দন বলে, ‘তা হলেও চল। ওখানেই সবাই বসে আছে। চল বৃন্দা। অ্যাই প্রবাল, পয়সা মিটিয়ে দে।’

‘আমি কেন মেটাব?’ কাঁইমাই করে ওঠে প্রবাল, ‘শ্রীপর্ণা আমাকে চা খাওয়াতে নিয়ে এসেছিল।’

‘শ্রীপর্ণাকে আমি হাইজ্যাক করে নিয়ে চললাম। এবার সামলা।’ শ্রীপর্ণার কবজি ধরে হাঁটছে চন্দন। পাশে পাশে বৃন্দা।

অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর সামনে মেলা বসেছে। দেড়শো ছেলেমেয়ে হাজির। আর একটু বাদেই পাস ফেলের হিসেব হয়ে যাবে। এই বাজারে কে মোচা, কে ন্যাবা, কে ছেঁদো, কে পিএমএফ-এইসব বাছবিচার উধাও। চন্দন সুরজের থেকে সিগারেট নিচ্ছে, সঞ্জয় আর অভি গল্প করছে, প্রবাল, দীপ, সাবিনা আর জেমসি সময় কাটানোর জন্য ডাম শ্যারাড খেলছে। সাবিনা আর শ্রীপর্ণা মোবাইলের ভিডিও গেমে মত্ত।

দেড়শো ছেলেমেয়ে এক জায়গায় হলে একটা ভোঁভোঁ আওয়াজ হয়। ভালো বাংলায় যাকে বলে গুঞ্জন। সেই গুঞ্জন হঠাৎ থেমে গেল। বৃন্দা দেখল, এনজি, এএম আর পিএম মিলে লাইন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে নোটিশ বোর্ডে চারটে এ-ফোর সাইজের কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটাচ্ছেন। দেড়শো ছেলেমেয়ের একজনও নিজের আসন থেকে নড়ল না। কাগজ সাঁটা শেষ করে এনজি ঘুরে দাঁড়ালেন। ‘বয়েজ অ্যান্ড গার্লস, তোমাদের জানিয়ে রাখি, আমার ট্রান্সফার অর্ডার চলে এসেছে। অ্যায়াম গোইং টু নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ। অ্যানাটমিতে এ বছর সাপ্লি পেয়েছে দশজন। এই দশজনের পরীক্ষা নিতে তিন মাস পরে আমি আবার আসব। টিল দেন, গুডবাই।’

দেড়শো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সুরজ এক পা এগিয়ে বলল, ‘একটা ফেয়ারওয়েল দেওয়ার চান্স দিলেন না স্যার।’

এনজি সুরজকে পাঁচ সেকেন্ড মাপলেন। বললেন, ‘না। দিলাম না। বাই।’ তারপর অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলেন।

সুরজ টুকটুক করে নোটিশ বোর্ডের দিকে এগোচ্ছিল। এমন সময় পিএম বললেন, ‘আমিও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি। তবে তোমাদের একটা খুশির খবর জানাই। ফিজিওলজিতে এই বছরে কেউ সাপ্লি পাওনি। সুতরাং অ্যাজ আ টিচার, এটাই তোমাদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ভালো থেকো।’

বিপুল করতালির মধ্যে পিএম অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর দিকে এগোলেন। এএম বললেন, ‘পার্বতী ম্যাডামের মতো সুখবর আমি তোমাদের দিতে পারছি না। বায়োকেমিস্ট্রিতে পাঁচজনের সাপ্লি আছে। আর আমি এই কলেজেই থাকছি। কাজেই তোমরা না চাইলেও দেখা হবে।’

এএম অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর দিকে এগোলেন। গোটা চত্বর জুড়ে নীরবতা। কেউ সাহস করে নোটিস দেখতে এগোচ্ছে না।

সবার আগে উঠল চন্দন। টুকটুক করে নোটিস বোর্ডের সামনে পৌঁছল। তিনপাতা নোটিসে চোখ বুলিয়ে আকাশের দিকে লাফিয়ে, ফিস্ট পাম্পিং করতে করতে চ্যাঁচাল, ‘পাস!’

এবার উঠল সুরজ। নোটিশ বোর্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের রেজাল্ট দেখে কপাল চাপড়ে বলল, ‘শিট!’

মেয়েরা কেউই উঠছে না। ছেলেরা নোটিস বোর্ডের চারদিকে গুঁতোগুঁতি করছে। দশ মিনিটের মধ্যে এলাকা ফাঁকা হয়ে গেছে। এবার উঠল মেয়েরা। গোটা দশেক মেয়ে নোটিশ বোর্ডের কাছে যাওয়ার পরে জেমসি বলল, ‘ফাইটিং করে কোনও ফয়দা নেই। আমি সবারটা চেঁচিয়ে পড়লে কোনও আপত্তি আছে?’

‘না।’ ন’জন ঘাড় নেড়ে পিছিয়ে আসে।

‘ওকে দেন…’ জেমসি শুরু করল, ‘রোল নাম্বার ওয়ান, অভিজ্ঞান লাহিড়ী, সাপ্লি ইন অ্যানাটমি! শিট! হোয়াট আ ব্যাড স্টার্ট!’

বৃন্দা আড়চোখে অভির দিকে তাকাল। নোটিশ বোর্ডে গুঁতোগুঁতি করে অভি যখন রেজাল্ট দেখছিল, তখন ওর মুখ দেখেই বৃন্দা বুঝেছে, সাপ্লি আছে। বেচারি মাথা নিচু করে বসে আছে। পিঠে চন্দনের হাত রাখা। বৃন্দার উচিত এখনই ওর পাশে যাওয়া।

‘রোল নাম্বার টু, বৃন্দা ব্যানার্জি। পাস। রোল নাম্বার থ্রি…’ জেমসি মেশিনের মতো পড়ে যাচ্ছে। বৃন্দা প্রয়োজনীয় কয়েকটা তথ্য পিক আপ করল। দময়ন্তী এবং সুরজ, দু’জনেই অ্যানাটমিতে সাপ্লি পেয়েছে। শ্রীপর্ণা, সাবিনা, জেমসি—সবাই পাস। দীপ, প্রবাল আর সঞ্জয়ও পাস। দুটো সাবজেক্টই ঝাড় খেয়েছে এমন ছাত্রের সংখ্যা মাত্র দুই। তাদের মধ্যে একজন হল সুরজ।

অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর সামনেটা খালি হয়ে যাচ্ছে। অভি চন্দনের সঙ্গে হোস্টেলে যাচ্ছিল। পথ আটকাল বৃন্দা। ‘শোন। তোর সঙ্গে দরকার আছে।’

‘কী?’ নিজের পা দেখতে দেখতে বলল অভি।

‘এখন হোস্টেলে গিয়ে ডিপ্রেশান কাটাতে মাল না খেলেই নয়?’

‘আমি মদ খুব একটা খাই না।’

‘আজ খাবি। আমি সিওর। সুরজ অলরেডি গ্রুপ বানিয়ে ফেলেছে। একটু পরে তোর কাছেও আসবে। এটা আইএমসির ট্র্যাডিশান। ফেলুরা রেজাল্ট বেরোনোর দিন মদ খায়। এই অনুষ্ঠানের নাম, ‘মাল্যদান’। যারা পাস করেছে তাদের কাছে টাকা চেয়ে খায়। এ সবের মধ্যে তোকে থাকতে হবে না। বেটার অপশন হল, তুই আমাদের বাড়ি চল। পরিবেশ বদলালে মন ভালো হবে।’

বৃন্দার কথা শুনে চন্দন বলল, ‘সুপার সাকসেসফুল ডাক্তারের বাড়িতে গেলে, আর কিছু না হোক ইনফিরিয়টি কমপ্লেক্সটা জোরদার হবে। ভেবে দ্যাখ অভি।’

অভি একবার বৃন্দার দিকে তাকাল। একবার চন্দনের দিকে। চন্দন তার বন্ধু। বৃন্দা কি তার প্রেমিকা? এখনও সে নিশ্চিত নয়। তবে ওয়েল উইশার তো বটে! যাওয়া যাক না একবার ওদের বাড়ি। বৈভব দেখে মাথা ঘুরে যাবে, এমন ইমম্যাচিওর অভি নয়। তবে, এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। বাড়ি গেলেই মায়ের বিষণ্ণ মুখ, রাধা আর মানদার কুচ্ছিত ঝগড়া আর বাবার দেরি করে বাড়ি ফেরা! ধুস!

চন্দনের হাত ছেড়ে, বৃন্দাকে অভি বলে, ‘চল।’

‘ঠিক হ্যায় বস! আমি চললাম।’ চন্দন হোস্টেলের দিকে এগোয়।

হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নেয় বৃন্দা। আজ বাসে-ট্রামে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাবার কোনও মানে হয় না। বিকেলবেলা রাস্তাঘাট ফাঁকা। সাড়ে চারটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেল বৃন্দা। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মেটানোর সময় অভি বলল, ‘তোর বাড়িতে কিছু বলবে না তো?’

‘কেন বলবে? কলেজের বন্ধু বাড়িতে এলে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়?’ অভিকে নিয়ে শান্তিধামের গেট পার হয় বৃন্দা। সুলতান তার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেও অভির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়।

ড্রয়িংরুমে মন্দিরা আর মনোতোষ ছাড়া এক মহিলা বসে রয়েছেন। শাড়ি পরা মহিলাকে দেখে বৃন্দা আন্দাজ করল, ইনি হৈমবতী সান্যাল। তিনজনের কেউ তাদের পাত্তা দিল না।

মনোতোষ ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘সিন টুয়েলভ। ডে। এক্সটিরিয়ার। জমিদার অনন্তনারায়ণের এলাকায় মা কালীর মন্দির সংলগ্ন পুকুরপাড়। বেদানাদাসী ও যশোমতী। বেদানা বলছেন, ”বড়বাবু নতুন এক লেঠেল রেকেচেন। তাকে দেকেচিস?” যশোমতী বলছেন, ”কাল রাতে সব্বো অঙ্গ দিয়ে তার লাঠিখেলা দেকেচি। আজ তোমরা মনিমেন্টের নীচে চড়ুইভাতি করতে যাচ্চ, যাও। আমাকে যেতে বোলো না। মনিমেন্ট দেখার সাধ আমার মিটে গেচে।”’

মনোতোষকে থামিয়ে হৈমবতী বললেন, ‘মন্দির সংলগ্ন পুকুর কোথায় পাবেন? রেকি করেছেন?’

‘করেছি। পুকুরপাড়ে মন্দির আছে অনেক জায়গাতেই। তবে আমি ভারজিন লোক্যালিটি চাইছি। একটা নতুন জায়গার সন্ধানও পেয়েছি। বর্গভীমার মন্দির।’

‘এই মন্দিরটা কোথায়?’

‘নতুনগ্রাম বলে একটা জায়গায়। কলকাতা থেকে একশো কিলোমিটারের মধ্যে। শুটিং ইউনিট থাকার মতো ভালো কোয়ালিটির হোটেল আছে। বেলাবেলি শুটিং শেষ হলে কলকাতায় ফেরাও করা যায়।’

‘জায়গাটার খবর কীভাবে পেলেন?’

‘এই নার্সিং হোমের যিনি মেট্রন, তাঁর বাড়ি নতুনগ্রামে। উনিই আমাকে বলেছেন। আমি স্ক্রিপ্ট লেখার মধ্যে একদিন রেকি করে এসেছি। বর্গভীমার মন্দিরে শুটিং-এর পারমিশান জোগাড় করতে অসুবিধে হবে না।’

‘ওখানে কী একটা পলিটিকাল আনরেস্ট চলছে না?’

‘সেটা প্রোডাকশান ম্যানেজার বুঝবে। এনিওয়ে, বেদানা বললেন…’

বৃন্দা অভিকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। ঝুনুর মা এখন নেই। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে বৃন্দা বলে, ‘মন খারাপ?’

‘খুব।’ অভির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।

‘কাঁদিস না।’ অভির চোখের জল মুছিয়ে দেয় বৃন্দা। অভি কাঁদতে কাঁদতে বৃন্দার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘আরও তিনমাস অ্যানাটমি পড়তে হবে। এই চাপ আমি নিতে পারব না। আমি পাগল হয়ে যাব।’

অভির মাথা নিজের বুকে নিয়ে, বৃন্দা অভির পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ‘চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

.

চন্দন

‘বন্ধুরা, একটা সহজ কথা সহজ করে বলে ফেলি। সেটা হল, আগামী পনেরোই অক্টোবর হোস্টেল বোর্ডাস কমিটির ইলেকশান। আজ সাতাশে সেপ্টেম্বর। হাতে দিন পনেরো আছে। তার মধ্যে অনেকটা সময় দুর্গাপুজো খেয়ে নেবে। কাজেই আজ রাত থেকে ইলেকশানের কাজ আরম্ভ করে দিতে হবে।’ গম্ভীর গলায় বলল রিপু।

‘সবে তো কাল রেজাল্ট বেরোল। একটু মস্তি করতে দাও।’ মিনতি করে সবুজ।

‘মস্তি করায় কেউ বাধা দিচ্ছে না। তোরা পার্টির হোল টাইমার নোস যে চব্বিশ ঘণ্টাই পলিটিকাল কাজ করবি। প্রতিদিন সন্ধেবেলা একঘণ্টা সময় দে। তাহলেই কাফি। যারা সাপ্লির প্রিপারেশান নেবে, তাদের একদম ডিস্টার্ব করা যাবে না।’

‘আমাদের কী করতে হবে সেটা বলবে তো!’ অধৈর্য হয়ে বলে সবুজ।

‘আমি বলছি।’ সিগারেট ধরিয়ে চন্দন বলে, ‘আমাদের বয়েজ হোস্টেল পাঁচতলা। প্রত্যেক তলায় চারটে উইং। প্রত্যেক উইং থেকে একজন ফ্লোর রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচিত হবে। অর্থাৎ আমাদের দল থেকে কুড়িজন ভোটে দাঁড়াবে। আমাদের ক্যান্ডিডেট যেমন নমিনেশান ফাইল করবে, তেমনি পিএমএফ, ন্যাবা এবং ছেঁদোরাও নমিনেশান ফাইল করবে। পিএমএফ-এর সব্যসাচী আর বিলুর সঙ্গে রিপুদা কথা বলেছে। যে যে ফ্লোরে পিএমএফ ক্যান্ডিডেট দেবে, সেখানে আমরা ক্যান্ডিডেট দেব না। এটা এক ধরনের নির্বাচনী সমঝোতা। ন্যাবা বা ছেঁদোপার্টির পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা এখনও নেই। কিন্তু আমরা কোনও রিস্ক নেব না।’

‘পাশাপাশি,’ চন্দনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রিপু বলে, ‘ন্যাবা এবং ছেঁদোরা নিজেদের মধ্যে অ্যালি করেছে। যে ফ্লোরে ন্যাবারা প্রার্থী দেবে, সেই ফ্লোরে ছেঁদোরা ক্যান্ডিডেট দেবে না। তার মানে এই ইলেকশানে দ্বি-মুখী প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে। একদিকে মোচা আর পিএমএফ। অন্যদিকে ন্যাবা আর ছেঁদো। আমাদের কাজ খুব সিম্পল। প্রতি ফ্লোরের প্রতিটি বোর্ডারকে আমাদের ভোটার বানানো।’

‘তাই আবার হয় নাকি?’ আপত্তি করে সবুজ।

‘হয় বৎস! কীভাবে হয় সেটা চন্দন বোঝাবে। আমাদের কলেজ ফেস্ট ওপিয়ামের সময় ও যেমন ফ্লো-চার্ট বানিয়েছিল, ইলেকশান নিয়েও সেইরকম একটা চার্ট বানিয়েছে। বল চন্দন।’

রুম নম্বর একশো পঁচিশ। সময় রাত নটা। গতকাল রেজাল্ট জেনে হোস্টেলে ফেরার পরেই রিপু চন্দনকে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, ‘পাস করে গেছিস। কনগ্র্যাচুলেশনস। এবার ভোটের কাজে নামতে হবে।’

‘জানি।’ সংক্ষিপ্ত জবাব চন্দনের। ‘কী করতে হবে বলো।’

গত রাতে চন্দন, রিপু, টিনটিন, বান্টি আর সুব্রত মিলে ছোট একটা মিটিং সেরে ফেলেছিল। আজ সকালে এসএমএস করে হোস্টেলের মোচার সমস্ত সাপোর্টারদের রাত সাড়ে আটটায় একশো পঁচিশে আসতে বলা হয়েছিল। প্রতিটি রুমে গিয়েও বলে আসা হয়েছে। রেজাল্ট বেরোনোর পরে ফার্স্ট ইয়ারের বেশির ভাগ ছেলে বাড়ি চলে গেছে। তা সত্ত্বেও জমায়েত খারাপ নয়। ঘরে পঁচিশজন ছেলে বসে আছে। তাদের দিকে চোখ বুলিয়ে চন্দন বলে, ‘প্রথম কাজ প্রার্থী নির্বাচন। দ্বিতীয় কাজ ক্যাম্পেন। তৃতীয় কাজ নমিনেশান পেপার জমা দেওয়া। চার নম্বর কাজ ভোট করানো। পাঁচ নম্বর কাজ কাউন্টিং করানো।

‘এক এক করে এগোনো যাক। প্রার্থী নির্বাচন দিয়ে শুরু করি। আমাদের হোস্টেলে চারটে উইং আর পাঁচটা ফ্লোর। আমি এক্সেল স্প্রেড শিটে পুরোটা বানিয়ে রেখেছি। ফ্লোর ধরে ধরে প্রার্থীদের নাম বলব। তোদের পছন্দ হলে হাত তুলবি। অপছন্দ হলে তুলবি না। ক্লিয়ার?’

কারও কোনও বক্তব্য নেই। সব্বাই জানে, পার্টির চার-পাঁচজন মিলে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে কে কোন ফ্লোর থেকে দাঁড়াবে। এখন গণসংগঠনের মঞ্চে নামগুলো ঘোষণা করে তাতে গণতন্ত্রের ছাপ দেওয়া চলছে। এই পদ্ধতিতে কারও কোনও আপত্তি নেই। কেন না রাজনীতিতে এদের আগ্রহ নেই। গন্ডগোল এড়াতে দলে ভেড়া। যাদের আগ্রহ আছে, যেমন চন্দন, ঠিক নেতা হয়ে গেছে।

‘নর্থ গ্রাউন্ড ফ্লোরের জন্য ভেবেছি লাটুদার নাম। লাটুদা ওই উইং-এর গতবারের ফ্লোর রিপ্রেজেন্টেটিভ। কারও কোনও বক্তব্য আছে?’

সবাই নীরবে হাত তুলল।

‘তাহলে নর্থ জি থেকে দাঁড়াচ্ছে লাটুদা,’ স্প্রেড শিটে টিক মারে চন্দন। ‘কুড়িটা আসনের মধ্যে পিএমএফ পাঁচটা আসনে প্রার্থী দেবে। অর্থাৎ আমাদের মোট পনেরোজন প্রার্থীর নাম নির্বাচন করতে হবে। একজন হয়ে গেল। বাকি রইল চোদ্দ। সাউথ জি থেকে আমার প্রস্তাব…’

চোদ্দজন প্রার্থী নির্বাচন করতে চল্লিশ মিনিট লাগল। সুরজের বিরুদ্ধে স্ট্রং প্রার্থীর দাবি তুলেছে সবাই। কিন্তু ওই ফ্লোরে দীপ ছাড়া অন্য কোনও ক্যান্ডিডেট পাওয়া গেল না। সেই নিয়ে কিছুক্ষণ হইহল্লা হল। চন্দনের না দাঁড়ানো নিয়ে কথা উঠল। রিপু ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিল। সবাই বুঝতে পারল, আগামী কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচনে রিপু সরে দাঁড়াবে। ইউনিয়নের লড়াইতে ঢুকবে চন্দন। ছোট লড়াই থেকে তাই ও বাদ।

‘দ্বিতীয় কাজ, ক্যাম্পেন।’ একগাদা প্রিন্ট আউট সবার হাতে ধরিয়ে বলল চন্দন, ‘আমি প্রত্যেক ফ্লোরের প্রত্যেক উইং থেকে তিনজন ছেলের নাম বেছে নিয়েছি। হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির নির্বাচনে পোস্টারিং, মিছিল, স্ট্রিট কর্নারিং—এসব কিস্যু হয় না। জাস্ট ওয়ান-টু-ওয়ান কথাবার্তা। এই তিনজন ছেলে রুম ধরে ধরে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলবে। আমাদের ভোট অ্যাসিওর করবে। সপ্তাহে দুটো দিন, বুধ ও শনিবার একশো পঁচিশে এসে আমার কাছে রিপোর্টিং করবে। কোনও ঢপবাজি চলবে না। আমি ক্রস চেক করব। যে মিথ্যে কথা বলবে, তার কোনও শাস্তি হবে না। কিন্তু আমি, ব্যক্তিগতভাবে বাকি জীবনে তাকে আর বিশ্বাস করব না। যে রাজি নয়, সে এখনই বলে দাও। কোনও চাপ নেই।’

কেউই আপত্তি করল না। এমন কোনও হাতিঘোড়া কাজ নয়। সন্ধেবেলা আড্ডা মারতে মারতে একবার বললেই হল, মোচাকে ভোটটা দিস। আর সেটা না বলার কোনও কারণ নেই। মিনি-মেস তুলে দিয়ে চারবেলা খাবারের কোয়ালিটি এরাই ইমপ্রূভ করেছে। শোনা যাচ্ছে, এইবার জিতলে মাঝখানের বড় জমিটায় বাগান করবে। কমন রুমে ছেচল্লিশ ইঞ্চি এলসিডি টিভি বসাবে।

‘তোদের যে প্রিন্ট আউট ধরানো হল, তাতে প্রার্থীদের নাম, প্রতি ফ্লোরে ভোটদাতার নাম, ক্যাম্পেনের বিষয় বুলেট পয়েন্ট করে দেওয়া আছে। ব্যাকআপ হিসেবে সবার মেল আইডিতেও একটা করে মেল পাঠানো আছে। আশা করি তোদের ঘটে এইটুকু বুদ্ধি আছে যে কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে।’

আজকের মিটিং-এ একজনে সাপ্লি পাওয়া ফার্স্ট ইয়ার আছে। অভি। যারা সাপ্লি পেয়েছে, তাদের মিটিং-এ ডাকা হয়নি। অভি নিজের থেকেই এসেছে। সে এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। হঠাৎ বলল, ‘সব থেকে ভালো হয়, আমরা যদি সরাসরি কথা বলি। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে সরাসরি বলা, যে মোচার হয়ে এই ফ্লোরে লাটুদা দাঁড়িয়েছে। ওকে ভোটটা দিস। হোস্টেলের ছেলেরা কেউ গান্ডু নয়। বিটিং অ্যারাউন্ড বুশ করতে গেলে খেপে যাবে।’

‘সবাই এভাবে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ না-ও হতে পারে। কোনও বোর্ডার সরাসরি রাজনীতির কথা অপছন্দ করতে পারে। সেই জন্যই ফিক্সড রুল রাখা হয়নি। যে যেমন ভাবে পারে, ক্যাম্পেন করবে। যাই হোক,’ মোবাইলের ক্যালেন্ডার দেখে নিয়ে চন্দন বলে, ‘পয়লা অক্টোবর থেকে পুজো। আমাদের ইয়ারের ছেলেরা অলরেডি বাড়ি কেটে পড়েছে। যারা পড়ে আছে, যেমন অভি বা আর কেউ, তারা আগামিকাল কাটবে। নতুন ফার্স্ট ইয়ার অলরেডি কলেজ থেকে হাওয়া। সিনিয়ররাও পাত্তাড়ি গুটোবে। আমি এক্সপেক্ট করছি না, কেউ সাতই অক্টোবরের আগে হোস্টেলে ব্যাক করবে। কিন্তু তারপরে জান লড়িয়ে দিতে হবে। যারা ভোটে দাঁড়ালি তারা নমিনেশন পেপারে সই করে রুম থেকে বেরোবি। তোরা যখন বাড়ি থাকবি তখন নমিনেশান জমা দেওয়ার কাজটা আমরা এগিয়ে রাখব।’

সইসাবুদ করে ছেলেরা টুকটুক করে যে যার নিজের ঘরে চলে গেল। মিটিং শেষ। রুমে এখন রিপু, চন্দন আর অভি। চন্দন অভিকে বলল, ‘সবার সামনে বলিনি। এখন বলছি। তোর কিন্তু মিটিং-এ থাকার কথা নয়। পড়াশুনো করার কথা।’

‘ভালো লাগছে না।’ নিষ্পৃহ জবাব অভির।

‘পড়তে ভালো লাগছে না। না, একা থাকতে ভালো লাগছে না?’

‘দুটোই।’

‘বৃন্দার সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি কর।’ চন্দনের কণ্ঠস্বরে বিদ্রুপ।

‘বৃন্দা সাপ্লি পায়নি।’

‘না পাক। তোকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারল। আর একবার অ্যানাটমি পড়তে পারবে না?’

অভি কোনও উত্তর না দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে। রিপু এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে সংলাপ শুনছিল। এবার বলল, ‘অভি বৃন্দার সঙ্গে প্রেম করছে নাকি?’

‘একদম, একদম। হাত ধরে ঘোরাঘুরি, বাড়ি যাওয়া, মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুজুরগুজুর, মিনিটে মিনিটে এসএমএস…’ প্রেমের যাবতীয় সাইনস অ্যান্ড সিম্পটমস দেখা যাচ্ছে।’ জবাব দেয় চন্দন। অভি বিরক্ত মুখে একশো পঁচিশের দরজা খোলে।

রিপু বলে, ‘কীরে অভি? চন্দন যা বলছে তা কি সত্যি?’

রুম থেকে বেরোনোর আগে অভি মৃদু স্বরে বলে, ‘অ্যানাটমিতে ঝাড় না খেলে ”হ্যাঁ” বলতাম। আপাতত সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের কায়দায় বলি, ”ইটস কমপ্লিকেটেড”।’ তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

রিপু বলে, ‘আমার ফাইনাল এমবি এসে গেল। আমি আর আপ্পু ইলেকশানের চক্করে খুব বেশি জড়াব না। তোদেরকেই সামলাতে হবে।’

চন্দন বলে, ‘আমি কাল সকালে বাড়ি যাচ্ছি। বেষ্পতিবারে ফিরে নমিনেশান ফর্ম জমা দেওয়ার কাজটা করে দেব। তারপরে আবার বাড়ি গিয়ে দুর্গাপুজো চুকিয়ে আসব। পুজোয় তো হোস্টেল ফাঁকা থাকবে।’

‘একদম ফাঁকা নয়। অন্য স্টেটের অনেক ছেলে থাকে। সাপ্লি পাওয়া মালগুলো থাকে। ডিসট্রিক্টের ছেলেরা কলকাতার পুজো দেখবে বলে থেকে যায়। তুইও থেকে গেলে পারতিস। কলকাতার পুজো কখনও দেখেছিস?’

‘দেখিনি। এবার দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাড়ির লোক বহুত হুজ্জুত করছে।’

‘বাড়ির কথা ছাড়! বাবা-মারা ওরকম বলে!’

‘বাবা-মাকে পুজোর ব্যাপারে ম্যানেজ করা যাবে। ওটা ইস্যু নয়। আমাদের ওখানে একটা পলিটিকাল গন্ডগোল হচ্ছে। সেটায় বাবা যাতে বেশি জড়িয়ে না পড়ে সেটা দেখতে বাড়ি যাওয়া। নতুনগ্রাম এখন ফুটছে।’

‘কী রকম?’ জানতে চায় রিপু।

‘ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়ানোর ব্যাপারে নতুনগ্রামের অনেক ভূমিকা আছে। আমাদের ওখানকার ছেলেমেয়েরা ব্রিটিশদের গুলি করে, ফাঁসির দড়িতে ঝুলে,ইতিহাসের পাতায় ছবি হয়ে বসে আছে। যখন তখন ঘেরাও করা, রাস্তা কাটা, ব্রিজ ওড়ানো, বোমা বানানো, বাচ্চাদের জামাপ্যান্টের মধ্যে ওয়েপন পাচার করা আমাদের ওখানকার কালচারের মধ্যে পড়ে। নতুনগ্রাম ছেলেরা আর বাঁজাপলাশের জোয়াকিমরা জরির কাজ, হীরে পালিশের কাজ, রান্নাবান্নার কাজ নিয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে। বিদেশেও আছে। তারা টাকা পাঠাচ্ছে। খিদিরপুর থেকে যে সব বেসরকারি বাস নতুনগ্রাম হয়ে আরও দূরে যায়, তাতে বস্তাবন্দী হয়ে অস্ত্র ঢুকছে প্রত্যেক রাতে। জনমোর্চা জমি নোটিশ লটকে দিয়েই খালাস। অধিগ্রহণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। লোকাল লোক রেজিসট্যান্স দেবে। মোচার কয়েকজন পাঁড় সাপোর্টার ছাড়া বাকি সবাই এই ব্যাপারে এককাট্টা। নবযুগ, জাতীয়তাবাদী পার্টি, ইনডিয়ান পিপলস পার্টি, জনমোর্চা থেকে সরে যাওয়া লোকেরা—সবাই এক হয়েছে। পড়ে আছে আমার বাবার মতো কয়েকজন। আমার বাবা ক্যালানি না খেয়ে যায়।’

‘তুই জন্মানোর আগে থেকেই মোচার খাতায় তোর নাম লেখা ছিল।’ হাসতে হাসতে বলে রিপু।

‘বলতে পারো। আমি যাকে বলে, নীল রক্তের লাল মোচা।’

পরীক্ষার আগে আগে চন্দন পার্টির মেম্বারশিপ পেয়েছে। অক্সিলিয়ারি গ্রুপ বা এজির ক্লাস নিয়মিত হতো না। কেন না, যাদের এজি দেওয়া হয়েছিল, তারা একটা মিটিং করেই বলে দিয়েছে, ছাত্র সংগঠনে গা ঘষাঘষি করতে আপত্তি নেই। কিন্তু পার্টির খাতায় নাম লেখাবে না। রয়ে গেছে চন্দন। জনমোর্চার অতীত ইতিহাস, পার্টির নিয়মকানুন নিয়ে চন্দনের পড়াশুনো অন্যদের থেকে অনেক বেশি। ওকে নিয়ে আলাদা মিটিং হতো না। অধীর মাঝে মাঝে আনসারুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে চন্দনকে ডেকে পাঠাত। সেখানে অল্পবিস্তর পার্টি ক্লাস হতো। মাসদুয়েক এইরকম চলার পরে রিপু একদিন চন্দনকে ডেকে বলল, ‘তোকে সিএম-শিপ দেওয়া হল।’

সিএম মানে ক্যান্ডিডেট মেম্বার। অর্থাৎ, পার্টি মেম্বারশিপের অ্যাপ্রেনটিস পর্ব। এই অবস্থায় কিছুদিন চন্দনকে চোখে চোখে রাখা হবে। কোনও বেচাল না দেখলে দেওয়া হবে পিএমশিপ বা পারমানেন্ট মেম্বারশিপ।

চন্দন পিএম হয়ে গেছে একমাসের মধ্যে। পার্টি সংগঠনের শাখা সম্পাদক রিপু, কিন্ত সে এখন ফাইনাল এমবিবিএস-এর পড়া নিয়ে ব্যস্ত। সব কাজ চন্দনকেই দেখতে হয়।

রিপু আর চন্দনের গপপোর মধ্যে রুমে দু’জন মানুষ ঢুকে পড়েছেন। তাদের দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে রিপু বলল, ‘আরে অধীরদা, তপনদা! আপনারা? এত রাতে?’

জনমোর্চার ছাত্র সংগঠনের কলকাতা জেলা কমিটির সেক্রেটারি অধীরের কথা এক্ষুনি চন্দন ভাবছিল। ভদ্রলোক অনেককাল বাঁচবেন। সঙ্গের লোকটি চন্দনের অচেনা। না-গোঁজা, বুক-খোলা টি-শার্ট; ফর্মাল ট্রাউজারের সঙ্গে স্নিকার, কলপ করা গোঁফ, পেশিবহুল চেহারা ও ভুঁড়ির কম্বিনেশান বলে দিচ্ছে, লোকটা পুলিশ!

‘তোমাদের হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির খোঁজখবর নিতে এলাম।’ খাটে বসে বললেন অধীর। তপন একপাশে দাঁড়িয়েছিলেন। চন্দন তাঁকে একটা সিগারেট দিয়ে বলল, ‘বসুন।’

সিগারেট নিয়ে তপন বললেন, ‘আমি সিগারেট খাই বুঝলেন কী করে?’

‘গা থেকে নিকোটিনের গন্ধ আসছে। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমায় নিকোটিনের হলদে ছাপ, টি-শার্টের পকেটে লাইটারের আদল…’ নিজে সিগারেট ধরিয়ে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি বাড়িয়ে দেয় চন্দন।

‘আমার নাম তপন চৌধুরী। আমি এন্টালি থানার এসআই,’ সিগারেট ধরিয়ে নমষ্কার করেন তপন। ‘আপনাদের এই কলেজটা আমার এলাকায় পড়ে। হোস্টেলের বা কলেজের ইলেকশান মানে আমার হেডেক। মেডিক্যাল কলেজে সে রকম বাওয়াল হয় না। তবে খবর নেওয়াটা ডিউটির মধ্যে পড়ে।’

চন্দন খেয়াল করল, তপনের মধ্যে নেতার ন্যাওটা সুলভ আচরণ নেই। অধীরের সঙ্গে এসেছেন বটে, তবে তাঁকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। চন্দন বলল, ‘আপনারা বোধহয় ছোটবেলার বন্ধু। অথবা কলেজ মেট।’

‘হঠাৎ কেন মনে হল তোমার?’ স্বপনের হাত থেকে সিগারেটের কাউন্টার নিয়ে টান দিয়ে বলেন অধীর। তাঁর ঠোঁটের কোণে পাতলা হাসি।

‘আপনাদের ক্যাজুয়াল রিলেশান দেখে।’

তপন প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে চন্দনের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আমার বয়স পঞ্চান্ন। রিটায়ারমেন্টের পাঁচ বছর বাকি। আমার ছেলে তোমারই বয়সি। তোমাকে তুমিই বললাম। কিছু মনে করলে না তো?’

‘আরে, না না! মনে করার কী আছে?’

‘আমার ছেলে আর তুমি বয়সে এক হলে কী হবে? আমার ছেলেটা এক্কেবারে গাধা। পরপর দুবার জয়েন্ট দিল। একবারও মেডিক্যাল চান্স পেল না। এখন ডেন্টাল কলেজে ভরতি হয়েছে।’

রিপু এতক্ষণ শুনছিল। বলল, ‘তপনদা, চন্দন ওদের ব্যাচে উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছিল। মেডিক্যালে র‌্যাঙ্ক পঁচানব্বই।’

‘পাবলিকের একটা ধারণা আছে যে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা আজকার আর অ্যাকটিভলি পলিটিকস করে না।’ মুচকি হেসে বলেন তপন।

‘আপনিও রাজনীতি করতেন নাকি?’ জানতে চায় চন্দন।

‘সন্ন্যাসী যেমন পূর্বাশ্রমের কথা বলে না, রাজ কর্মচারীরাও তেমন রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা বলে না। অধীরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা একদমই অরাজনৈতিক। বরং আমি থাকলে ওর ছড়ি ঘোরাতে অসুবিধে হয়।’ বলেন তপন।

‘হোস্টেলের মধ্যে পুলিশ ঢোকা কিন্তু বেআইনি।’ তপনকে বলেন অধীর।

‘ছাত্র সংগঠনের নেতা হতে পারিস। কিন্তু তুইও বহিরাগত। তোরও হোস্টেলে ঢোকাটা বেআইনি।’ হাসতে হাসতে বলেন তপন। তাঁর কথা শুনে চন্দন আর রিপুও হাসল।

চন্দনের দিকে তাকিয়ে তপন বললেন ‘তোমার সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল। আমার ছেলেকে অনেকটা তোমার মতো দেখতে। বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোঁট্টা, শ্যামলা। পারলে একদিন আলাপ করিয়ে দেব। ওদের কলেজ রাস্তার উলটো ফুটে।’

‘আচ্ছা।’ ঘাড় নাড়ে চন্দন। রিপু আর অধীরকে তপন বললেন, ‘চললাম। পরে কথা হবে।’

তপন বেরিয়ে যাওয়ার পরে অধীর রিপুকে বললেন, ‘পার্টির মিটিং হচ্ছে?’

‘ওদের পরীক্ষা ছিল।’ চন্দনের দিকে ইঙ্গিত করে রিপু।

‘পরীক্ষা একমাস আগে শেষ হয়ে গেছে। গতকাল রেজাল্ট বেরিয়েছে। এত দিনে একটাও মিটিং করা গেল না? বেশিক্ষণ তো লাগে না। পার্টি চিঠিগুলো পড়বে, গণ সংগঠন ও পার্টি সংগঠন নিয়ে আলোচনা করবে—এই তো ব্যাপার! এত নিষ্ক্রিয়তা ভালো নয়। আমাদের পার্টির অর্ধেকের বেশি সদস্য পলিটিক্যালি ইন্যাকটিভ হয়ে পড়েছে। তিরিশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফল। সামনেই রিনিউয়াল। শুদ্ধিকরণের জন্য নিষ্ক্রিয় সদস্যদের পদ পুনর্নবীকরণ করা হবে না। সদ্য পার্টিতে এসেই যারা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে, তারা বেরিয়ে যাওয়াই ভালো।’

‘দেখুন অধীরদা, অতীতে কার্ড-হোল্ডার হতে গেলে পাঁচ-সাত বছর ঘষতে হতো। মিটিং করা, মিছিল করা, পোস্টার লেখা, পোস্টার সাঁটা, সব কাজে দড় হতে হতো। আজকের দিনে আপনি সেই ডেডিকেশান ডিমান্ড করতে পারেন কি? বিশেষত মেডিক্যাল কলেজের এক ছাত্রের কাছে? জনমোর্চার সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আমি আপনার পিছনে ঘুরঘুর করিনি। রিপুদাই আমার পিছনে ঘুরঘুর করেছিল। এজি তো অনেকেই হয়েছিল। আজ তারা কোথায়? যে আছে, তাকে ঘাঁটাবেন না।’ অধীরকে একটানা অনেক কথা শুনিয়ে দেয় চন্দন।

‘বাবাঃ! এ ছেলে তো নকশালদের মতো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছে। পার্টিতে থাকলে হয়।’ নাক সিঁটকোয় অধীর।

‘মতের মিল না হলেই নকশাল বলে দেগে দেওয়ার অভ্যেস অনেক পুরনো। ওটা বন্ধ করুন। আর আপনার ভয় নেই। আমি অন্য কোথাও যাব না। তবে মৃন্ময় চ্যাটার্জির তাড়া খেয়ে জনমোর্চা কোথায় যায়, এটাই দেখার।’

‘ওফ! তুমি ওই ছোটলোকের বাচ্চাটার নাম কোরো না তো। আনকালচার্ড, সাইকোপ্যাথ, কাগুজে বাঘ একটা! মিডিয়া ওকে তুলেছে। মিডিয়াই ওকে ফেলবে। যত্ত অ্যান্টি-জনমোর্চা প্রোপোগান্ডা।’

‘তাও ভালো, ওকে সিআইএর এজেন্ট, তোজোর কুকুর অথবা বুর্জোয়া কবি বলেননি। ভুল করা আর ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে আমাদের পার্টির কোনও জুড়ি নেই।’

চন্দনের কথা শুনে অধীর রাগ করলেন না। কৌতূহল ভরে বললেন, ‘এইসব গালাগালি না করে মিটিংটা রেগুলার করতে পারো তো। তাহলে আমাকে আর আজেবাজে বকতে হয় না।’

‘পার্টি মিটিং হোক বা না হোক, জনমত না পড়ে আমার দিন শুরু হয় না। তবে আপনার সঙ্গে আমি একমত যে মিটিং রেগুলার হওয়া উচিত। ডিসিপ্লিন খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

অধীর সিগারেট শেষ করে বললেন, ‘সামনে পুজো। তারপরে হোস্টেলে ইলেকশান। এই দুটো পেরিয়ে যাক। তারপর কথা হবে।’ তারপর রিপুকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চন্দনও একশো পঁচিশ থেকে বেরোল। রাতের খাওয়া সেরে ফেলা যাক। কাল ভোর ভোর বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।

.

পারুল বললেন, ‘জলখাবার দেব? না একেবারে ভাত খাবি? আসতে আসতে তো বেলা এগারোটা বাজিয়ে দিলি।’

চন্দন বলল, ‘কী করব বলো? পরপর দু’জায়গায় অবরোধ। মেচেদায় একবার, ডিমারিতে একবার। ওগুলো না হলে কখন চলে আসতাম!’

পারুল বললেন, ‘চান করে নে। একেবারে খেতে দিয়ে দিই। সজনে ফুলের বড়া আর পটল মাছের ঝাল করেছি।’

‘বাবা কোথায়? তুমি বললে আজ কোর্টে যায়নি। তা হলে বাড়িতে নেই কেন?’

‘তিনি বেরিয়েছেন। বাঁজাপলাশের জোয়াকিমদের বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন, সরকারকে জমি দান করলে আখেরে আমাদের কত লাভ হবে। কেউ শুনছে না। নেহাত লোকটাকে সবাই মানিগন্যি করে তাই। না হলে এতদিনে মার খেয়ে যেত!’ রাগের ঝাঁঝ পারুলের গলায়।

‘জোয়াকিমদের উচ্ছেদ করে সেখানে হাসপাতাল হবে? এটা কোন দেশি নিয়ম?’

‘তোর বাবাকে জিগ্যেস কর। বলছে, হাসপাতালে নাকি প্রতি পরিবারের একজনকে চাকরি দেবে। ওই চাকরির ক্যাঁতায় আগুন। হাসপাতাল হল ডাক্তার আর নার্সদের জায়গা। সেখানে অশিক্ষিত, বামন জোয়াকিমরা কী কাজ করবে? গেটের দারোয়ান? জমাদার? ঝাড়ুদার? ক্যান্টিনের ঠাকুর? রুগিরা হাসবে তো! জমির সঙ্গে মানুষের বাঁধনটা বড় শক্ত। সেই বাঁধন কাটার চেষ্টা করছে জনমোর্চা সরকার। সন্দীপ সামন্ত সামনের ভোটে এমন হারান হারবে, যে পালাবার পথ পাবে না।’

পারুলের কথা শুনে অবাক হল চন্দন। পারুল বরাবর দৃঢ়চেতা। কিন্তু বাইরে শান্ত। সংসারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বাইরের লোককে বুঝতে দেন না। স্বামী অনুগত স্ত্রীর ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেন। এইরকম হিসেবি এবং বুদ্ধিমতী মহিলার এ হেন বিস্ফোরণ দেখে চন্দন বুঝল সিচুয়েশান সত্যিই গন্ডগোলের। খাওয়াদাওয়া শেষ করে সে নিজের ঘরে ঢুকল।

নন্দন এখনও বাড়ি ফেরেনি। সার্কাসের দলের সঙ্গে শিলিগুড়িতে আছে। নিজের ঘরে ঢুকে চন্দন দেখল এখনও সাজিয়ে রাখা রয়েছে ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত যাবতীয় বইপত্র আর খাতা। কিছুদিন আগেও এগুলো দেখলে ভালো লাগত চন্দনের। আবাসবাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করত।

আজ আত্মার সেই বন্ধনটা খুঁজে পেল না। বইগুলোকে মনে হল আবর্জনা। জায়গা নষ্ট করছে। সমস্ত বইখাতা ঘর থেকে বার করে উঠোনে রাখল চন্দন। কাল কাগজওয়ালাকে বেচে দিতে হবে। ফার্স্ট এমবিবিএস-এর কিছু বই সে ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। সব বই এক সঙ্গে আনা সম্ভব নয়। সেই বইগুলো ফাঁকা বুক র‌্যাক সাজাল। তারপর দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে সিগারেট ধরাল। চোখের সামনে ভেসে উঠল অভির মুখ।

অভি ঝাড় খাওয়ায় চন্দনের আনন্দ হয়েছে। বৃন্দার ব্যাপারে অভি তার কম্পিটিটার। কাজেই অভি ঝাড় খাওয়ায় চন্দন খুশি।

চন্দনের সঙ্গে অভির কীসের তফাত? দু’জনের কেউই শহরের নয়, কেউই দেখতে সুন্দর নয়, দু’জনেই আনস্মার্ট, দু’জনেই ইংরিজি বলতে পারে না। চন্দন উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট বয়। আর অভি ফার্স্ট এমবিবিএসে ঝাড় খেয়েছে। চন্দনই তো এগিয়ে। তাই না? তা হলে বৃন্দা তার। সোজা কথা! ঘুমিয়ে পড়ার আগে চন্দন ভাবল, নমিনেশান পেপার জমা দেওয়ার জন্য একবার কলেজ যেতে হবে। ছুটির বাকি সময়টা সে নতুনগ্রামের বাড়ি বাড়ি যাবে। গন্ডগোলের উৎস কতটা গভীর, এটা জানা জরুরি।

খানিকটা বৃন্দা, খানিকটা অভি, খানিকটা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ, খানিকটা নতুনগ্রামের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে চন্দন।

.

দময়ন্তী

মহাকরণের প্রতি দপ্তরের প্রতি টেবিলে এখন কম্পিউটার। নিয়মিত ট্রেনিং এবং ওরিয়েন্টেশান প্রোগ্রাম হয়, কিন্তু মেশিনটিকে মনোজ সন্দেহের চোখে দেখেন। কয়েক দশক আগে, যুবা বয়সে অটোমেশানের বিরুদ্ধে মিছিলে স্লোগান দিয়েছেন। আজ সেই মেশিন তাঁর টেবিল আলো করে বসে থাকবে, এটা ভাবতে অসুবিধে হয়। মনোজ একদমই টেক-স্যাভি নন।

কিন্তু কী আর করা যাবে? যে পুজোর যে মন্ত্র। ই-গর্ভন্যান্স নিয়ে একের পর এক সরকারি নির্দেশ আসছে। না শিখলেই নয়। সহকর্মীরা তো সব শিখে নিয়ে দেদার তাস খেলছে। বাধ্য হয়ে মনোজ হাত পাকাতে গেলেন।

গুগলে প্রথম কয়েকদিন স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখট, সফদার হাশমি, শম্ভু মিত্র— এইসব সার্চ দিয়ে বোর হয়ে গেলেন মনোজ। একদিন লিখলেন, ‘সেক্স’। মনোজ জানতেন না, এই শব্দটা গুগলে সার্চ করা ‘মোস্ট কমন কি ওয়ার্ড’। এর পরেই দিগন্ত খুলে গেল। সরকারি ওরিয়েন্টেশান প্রোগ্রাম, ট্রেনিং আর টিউটোরিয়াল যা শেখাতে পারেনি—ভারচুয়াল যৌনতা এক সপ্তাহে সে সব শিখিয়ে দিল। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই। বিলুর কম্পিউটারে হাতমকশো করতেন। ওয়েব-হিসট্রি কীভাবে মুছতে হয় শিখে গেছেন।

দ্বিতীয় সপ্তাহে সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের খপ্পরে পড়লেন মনোজ। সবাই যেমন খোলে, ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে, একে তাকে ফ্রেন্ডস রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে আর ট্যাগ করে, ভুলভাল স্ট্যাটাস মেসেজ লিখে, অন্যদের আপলোড করা ছবিতে ‘লাইক’ দিয়ে বোর হতে হতে একদিন এক ‘ফ্রেন্ড’-এর প্রোফাইল থেকে সন্ধান পেলেন ‘ইন্ডিয়ান ডেটস’ নামের এক নিরীহ ওয়েবসাইটের।

ফেসবুকের সূত্রে প্রোফাইল খোলার অ-আ-ক-খ জানা ছিল। এখানে মাথা খাটিয়ে সবটা আবার বানাতে হল। দু’নম্বরি মেল আইডি বানানো দিয়ে কাজ শুরু। ইউজার নেম দিলেন ‘ম্যাচিওরড হটি’। বয়স লুকোনোর কোনও মানে হয় না। তাই ‘ম্যাচিওরড’। আর শারীরিক সক্ষমতা বোঝাতে ‘হটি’।

এবার ফোটো। মনোজ একবার ভাবলেন ছবি দেবেন না। চেনাশুনো কেউ এই সাইটের মেম্বার হলে কেলেঙ্কারির একশেষ! কিন্তু ক্যালকাটা ডেটস পরামর্শ দিল, ফোটো দিলে বন্ধু পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সবদিক ভেবে নাটকের মেক আপ করা একটা ফোটো আপলোড করলেন মনোজ। এডিট করে ছবিটাকে ঝাপসা করে দিলেন। লম্বা-চওড়া, সাজোয়ান চেহারা দাড়ি-গোঁফের আড়ালে ঢাকা। চোখে সুর্মা, পরনে পাঠান-পোশাক। নিজেকে দেখে নিজেই ইমপ্রেসড মনোজ!

ক্যালকাটা ডেটস পেশা জানতে চাইছে। কায়দা করে মনোজ লিখলেন, সিভিল সার্ভেন্ট।

পরের প্রশ্ন, রিলিজিয়ন? সঙ্গে একগাদা অপশন। এইরকম একগাদা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরে ক্যালকাটা ডেটস জানতে চাইল, ‘প্যাশন?’

এইখানে থমকালেন মনোজ। অপশনের মধ্যে থেকে বেছে নিলেন, ‘থিয়েটার।’

‘পার্টনারের সঙ্গে কী করতে চাও?’

অপশনে আছে ‘চ্যাটিং, ফ্রেন্ডশিপ, ইটিং আউট, রোম্যান্টিক রঁদেভ্যু, নো-স্ট্রিংস-অ্যাটাচড ফান।’

শেষটা পছন্দ হল মনোজের। এটাই থাক। ডেটিং-এর ভাষায় ‘এনএসএ ফান’। এইভাবেই পঞ্চাশোর্ধ ‘ম্যাচিওর্ড হটি’-র ‘এনএসএ ফান’-এর আবেদন ছড়িয়ে পড়ল ‘ক্যালকাটা ডেটস’ জুড়ে। এবং প্রথম চব্বিশ ঘণ্টাতেই বাজিমাত! ছাব্বিশ বছরের ‘লেডিলাভ’ মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘থিয়েটার ইজ ইওর প্যাশন? রিয়্যালি?’

এক সপ্তাহের ভারচুয়াল বন্ধুত্ব। মাইলের পর মাইল লম্বা চ্যাট। অবশেষে ডালহৌসিতে মনোজ ও ঋষিতা দেখা করল। আকাশি-নীল ফেডেড জিনস, ময়ুর-নীল ক্রাশড কটনের কুর্তি আর গোলাপি স্নিকার পরে লালদিঘির ধারে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট ধরে ধর্মতলার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, সে শেয়ালদা চত্বরে থাকে, জেরক্স-ল্যামিনেশান-স্পাইরাল বাইন্ডিং-ডিটিপির ব্যবসা চালায়, বাড়িতে দাদা-বউদি আছে। বাবা-মা নেই। বিয়ে হয়েছিল। স্বামী অ্যালকোহলিক, ইমপোটেন্ট এবং ঠ্যাঙাড়ে। যেমন অধিকাংশ মেয়ে করে, সংসার ধরে রাখার জন্য সেই মক্কেলকে এক বছর সহ্য করেছিল ঋষিতা। তারপর বেরিয়ে আসে। এখন প্রেম বা বিবাহে রুচি নেই। শারীরিক চাহিদা মেটানোটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে যাচ্ছে। মাসের বিশেষ কয়েকটা দিন, ঋষিতার ভাষায়, ‘আমাকে দিনে একাধিকবার ডিলডো ব্যবহার করতে হয়। ফ্যান্সি মার্কেটের কালেকশান ভালো। এখন অবশ্য শপিং মলগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে।’

মনোজের কাছে একটা অজানা জগৎ খুলে গিয়েছিল। বিবাহিত জীবনে অরুণা ছাড়া অন্য কোনও নারীতে উপগত হননি। থিয়েটারের সূত্রে অল্পবিস্তর ছোঁয়াছুঁয়ি—ওটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। মধ্য-চল্লিশ থেকেই আর ইচ্ছা জাগত না। ঋষিতার সঙ্গে কার্জন পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যৌবনবেলার মতো পুরুষাঙ্গের ধকধকানি টের পেয়েছিলেন মনোজ। বুঝেছিলেন, কিছুই চলে যায়নি। ক্লান্ত মগজ অন্য কিছু চাইছে। অন্তর্জাল সেই সুযোগ এনে দিয়েছে।

‘আমি আপনার কাছে এনএসএ ফান ছাড়া আর কিছু চাইছি না।’ ধর্মতলার মোড়ে, লেনিনের স্ট্যাচুর উলটোদিকের ফুটপাথের দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ঋষিতা বলেছিল, ‘সেক্স এর সাইড এফেক্ট হল, এর থেকে প্রেম হয়। লাভ ইজ আ সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ। সেটা থেকে প্রোটেকশান নিতে হবে। না হলে বিপদ আপনার। ফ্যামিলি ভেসে যাবে।’

‘আমাদের সম্পর্কের কী নাম হবে?’ মৃদু স্বরে জানতে চান মনোজ।

‘ওফ! টিপিক্যাল বাঙালি মধ্যবিত্তদের মতো কথা বলবেন না তো! আমার ইরিটেটিং লাগে। আমি আপনার বউ নই, বোন নই, মা নই। পরস্ত্রী বা রক্ষিতাও নই। ফাক-বাডি বলতে পারেন। নামে কী আসে যায়?’

ফাক-বাডি! নতুন একটা শব্দ শেখা হল। মুচকি হেসে মনোজ বললেন, ‘কোনও বাংলা প্রতিশব্দ পাচ্ছি না। কাছাকাছি একটা শব্দবন্ধ পেলাম। ‘লাগ-সই’। চলবে?’

হাহা করে হেসে ঋষিতা বলেছিল, ‘চলবে কি মশাই? দৌড়বে। তবে আপনি কেমন দৌড়ন, এটা জানা খুব দরকার।’

‘আর আমার যেটা জানার দরকার, সেটা হল, তুমি তোমার বয়সি কোনও ফাক-বাডি খুঁজছ না কেন? তোমার পছন্দের মানুষের যে প্যারামিটার দিয়েছ, তাতে লেখা আছে ম্যাচিওরড, মুসট্যাশড মেল, প্রেফারেবলি ইন দেয়ার গোল্ডেন ফিফটিজ! কেন?’

বয়কাট চুল ঝাঁকিয়ে ঋষিতা বলেছিল, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষ প্রতিবার তার যৌনক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবনের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার কাছে ফিরে যেতে চায়। আমিও হয় তো তাই চাইছি।’

‘তুমি জীবনে প্রথমবার একজন ফিফটি প্লাসের সঙ্গে সেক্স করেছিলে? তখন তোমার বয়স কত?’

‘তখন আমার বয়স তেরো। উনি আমার জ্যাঠা ছিলেন। মারা গেছেন।’

মনোজ স্তব্ধ হয়ে ডাস্টবিনের দিকে তাকিয়েছিলেন। এসব জিনিস তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে। তাঁর এখান থেকে পালাতে ইচ্ছে করছে। চুলোয় যাক ভারচুয়াল ডেটিং। চুলোয় যাক ঋষিতা। যৌনতাবিহীন জীবন কাটাতে তাঁর কোনও অসুবিধে হবে না।

মেয়েরা সব বোঝে। ঋষিতাও বুঝেছিল। সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছিল সে। থিয়েটার নিয়ে তর্ক লাগিয়েছিল। শ্যামবাজারের থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার, বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার, নাটককে সময়ের কাছে কতটা দায়বব্ধ থাকতে হয়, সরকারের ধামা ধরে থিয়েটার চলে কি না—এইসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে দু’জনে হেঁটে মৌলালি পৌঁছেছিল। মোহিত চট্টোপাধ্যায় নাটকের লিরিসিজম নিয়ে কথা বলতে বলতে বিশাল তিনতলা বাড়ির সামনে পৌঁছেছিল দু’জনে। একতলায় কাঁসা-পেতলের বাসনের দোকান, মোবাইল সারাইয়ের দোকান, জেরক্স-ল্যামিনেশান-স্পাইরাল বাইন্ডিং -ডিটিপির অফিস। কুড়ি-একুশ বছরের এক ছোকরা অফিস সামলাচ্ছিল। ঋষিতা তাকে বলল, ‘পাপ্পু, যা। তোর আজ ছুটি। আমরা এখন কাজ করব।’

‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।’ পাপ্পু দৌড় দিল। রোলিং শাটার নামিয়ে, কাচের স্লাইডিং ডোরে তালা মেরে ঋষিতা বলল, ‘মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘সুন্দর’ দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ। অনেকবার। আবারও দেখব।’ ঋষিতার চুলের মুঠি ধরে সপাটে, অথবা সাপটে চুমু খেলেন মনোজ। এত তীব্র যৌন উত্তেজনা অনেক দিন, অনেক মাস, অনেক বছর অনুভব করেননি তিনি।

‘আমি কিন্তু ট্যাবলেট খাই না।’ জিনস খুলতে খুলতে বলল ঋষিতা।

‘ও!’ ঋষিতার জিনসের জিপার খুলতে খুলতে বলেছিলেন মনোজ, ‘তুমি কি তাহলে আরও অনেকের…’

‘শশশ! আমার নাম ‘লেডিলাভ’! আপনার নাম ‘ম্যাচিওরড হটি’। এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন নেই।’ ঠোঁট দিয়ে মনোজকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল ঋষিতা। পরবর্তী আধঘন্টা ধরে এমন সব ঘটনা ঘটিয়েছিল, যা মনোজ একমাত্র নীল ছবিতে দেখেছে। কখনও অরুণার জন্য অপরাধবোধে ভুগতে,কখনও ‘অরুণা কেন এসব পারে না তাহলে আমাকে ঋষিতার কাছে আসতে হতো না’ রাগে ফুটতে ফুটতে, পঞ্চাশোর্ধ্ব মনোজ নিজের হারিয়ে যাওয়া যৌবন পুনরাবিষ্কার করছিলেন। যৌন প্রহার করার সময় একটা মেয়েকে যন্ত্রণা আর আনন্দে একটানা ছটফটাতে দেখলে কী আনন্দ যে হয়! বিশেষত সে যদি হয় পঁচিশ বছরের ছোট!

যৌনস্নানের শেষে অনেক্ষণ শুয়ে রইলেন মনোজ। অনেক কাল এইরকম ঝোড়ো যৌনতার অভ্যেস নেই। বেদম হয়ে পড়েছেন।

ঋষিতাই আগে বিছানা ছাড়ল। বাথরুমে ঘুরে এল। টপাটপ জিনস আর কুর্তি গলিয়ে, ব্যবহৃত কন্ডোম প্যাকেটে পুরে মনোজের ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, ‘কফি করছি। আপনি রেডি হয়ে নিন।’

মনোজের ওঠার ইচ্ছে ছিল না। জোর করে উঠলেন। আয়নায় দেখে নিলেন কোনও দাগটাগ আছে কি না। ঋষিতা বড্ডো কামড়ায়। স্নান সেরে জামা প্যান্ট গলিয়ে, কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তুমি কি অফিসেই থাকো?’

‘আমার বাড়ি আনসারুদ্দিন স্ট্রিটে। সারা দিন অফিসে কাটাতে হয় বলে শোওয়ার ব্যবস্থা রেখেছি। দুপুরে একঘণ্টা গড়িয়ে নিই।’

‘তোমার দাদা কী করেন?’

‘আপনার বড্ড কৌতূহল। নেহাত আসল কাজটা ভালো পারেন, তাই উত্তর দিচ্ছি। না হলে স্ট্রেট ফুটিয়ে দিতাম। এখান থেকে বেরিয়ে মৌলালির দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্তোরাঁ পাবেন। নাম রোম্যানো স্যান্টোস। আমার দাদা ওটার মালিক।’

‘রোম্যানো স্যান্টোস? ভারি অদ্ভুত নাম তো!’

‘বোকাবোকা নাম। ভালো চলে অবশ্য। চাইনিজের কোয়ালিটি খুব ভালো। আপনি দয়া করে যেন কিছু কিনতে ঢুকবেন না।’

‘আচ্ছা।’ চুল আঁচড়ে অফিস থেকে বেরোয় মনোজ। পিছন থেকে ঋষিতা বলে, ‘আমি ফোন না করলে আপনি আমাকে ফোন করবেন না। ঠিক আছে?’

‘এ আবার কী রকম একপেশে নিয়ম?’ হাসতে হাসতে বলেছিলেন মনোজ। ‘যদি করি তা হলে কী হবে?’

‘আপনার বাড়ি গিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে আসব।’ হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিল ঋষিতা। ‘যখন স্নান করছিলেন, তখন মোবাইল থেকে আপনার বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বরটা লিখে রেখেছি। টু সিক্স ফাইভ ফোর হাওড়ার এক্সচেঞ্জ, তাই না?’

মনোজ নিঃশব্দে তিনতলা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ঋষিতাকে আর ফোন করেননি। ক্যালকাটা ডেটস ওয়েবসাইট থেকে নিজের প্রোফাইল ডিলিট করে দিয়েছিলেন। মোবাইল থেকে মুছে দিয়েছিলেন ঋষিতার নম্বর। এই বয়সে অ্যাডভেঞ্চার ভালো নয়। সংসার নষ্ট হয়ে যাবে। নাটকের রিহার্সাল আর জীবন সংগ্রামের কল শোতে বেশি বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন।

ফোন এল এক সপ্তাহ বাদে, দুপুরবেলায়। মনোজ তখন মুড়ি আর শসা দিয়ে টিফিন করছিলেন। ঋষিতার মোবাইল নম্বর ডিলিট করে দিলেও শেষের তিনটে সংখ্যা মনে ছিল। ওরই ফোন এসেছে সেটা বুঝেও মনোজ বললেন, ‘হ্যালো?’ সম্বোধনের শেষে জিজ্ঞাসা চিহ্ন।

‘ঋষিতা বলছি। আগামিকাল সন্ধে সাতটা।’ ফোন কেটে গিয়েছিল।

মুহূর্তের মধ্যে যাবতীয় সংকল্প এক ফুঁয়ে উড়ে গেল। ঋষিতার গলার আওয়াজ শুনে প্যান্টের ভিতরে পুরুষাঙ্গ নড়াচড়া শুরু করেছে।

পরের দিন দেরি করে বাড়ি ফিরে অরুণাকে নাটক নিয়ে প্রথম মিথ্যেটা বলেছিলেন মনোজ। যে, কল শো ছিল। সেটা না বললে দেরি করে ফেরার ব্যাখ্যা দেওয়া যেত না। তারপরে অনেক বার মিথ্যে বলতে হয়েছে। কেন না দুপুরবেলা মনোজের পক্ষে অফিস কাটা সম্ভব হলেও ঋষিতার পক্ষে পাপ্পুকে দুপুরবেলা দোকান থেকে বার করে দেওয়া অসম্ভব। অগত্যা সন্ধেবেলা। পাঁচটায় অফিস শেষ হলে ইউনিয়ন রুমে নাটকের রিহার্সাল দিতে হয়। ঋষিতার কাছে যাওয়ার দিন আধঘন্টা আগে বেরোন মনোজ। সন্ধেবেলার অফিসপাড়ার যানজট পেরিয়ে এন্টালি পৌঁছতে সওয়া সাতটা। ঋষিতার ওখান থেকে বেরোতে কখনও আটটা, কখনও সওয়া আটটা। বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়।

কয়েকবার মেলামেশার পরে ঋষিতা অনেক সহজ হল। কথাবার্তার সূত্রে মনোজ জানতে পারলেন, সে-ও একটা নাটকের গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। মূলত ঋষিতার উদ্যোগেই জীবন সংগ্রাম এন্টালিতে সফদার হাসমির ‘হল্লা বোল’ পারফর্ম করে গেছে। সেই নাটকের দিনই বিপদটা হয়েছিল।

মনোজ তখন অভিনয় করছেন। মোবাইল রাখা ছিল ঋষিতার কাছে। বারবার ফোন আসায় ঋষিতা ফোন ধরেছিল। ঋষিতার যুক্তি খুবই স্বাভাবিক। মনোজ যখন অভিনয় করছেন, তখন যে কেউ তাঁর ফোন ধরতে পারে।

মনোজ ঋষিতাকে অরুণার সন্দেহবাতিক আর শুচিবায়ুর কথা বলেননি। থেকে থেকেই অরুণা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঋষিতার কথা জিজ্ঞাসা করেন। মনোজ শান্তভাবে বারকয়েক উত্তর দিয়েছেন। তারপর একবার রেগে গেছেন। মনোজ ভেবে দেখেছেন, যে কোনও হাজব্যান্ড এইরকম আচরণ করবে।

কেসটা গুবলেট হয়ে গেল জগদ্দলের নাম করায়। সন্ধে সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত ঋষিতার কাছে কাটিয়ে মনোজ কী করে জানবেন যে শেয়ালদা মেইন লাইনে ট্রেন বন্ধ? আর এমন কপাল, সেদিন তিনি ফিরেছেন শেয়ারের ট্যাক্সিতে। রাস্তাঘাটে এ নিয়ে কোনও আলোচনা শুনতে পাননি।

আগের থেকে অনেক সাবধান হয়েছেন মনোজ। ঋষিতাকে বারবার বলে সময়টা সাতটার বদলে পাঁচটায় নামিয়েছেন। তা হলে সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি ঢোকা যায়। অরুণাকেও সময় দিতে হচ্ছে। বিরক্তিকর হলেও, এতে অরুণা অনেকটা ভালো আছে। সন্দেহবাতিক খানিকটা কমেছে। এই বয়সে এসে প্রতি সপ্তাহে পুরনো বউ ঘাঁটাঘাঁটির মতো বোরিং কাজ আর কিছু হয় না।

গতরাতে অরুণাকে যান্ত্রিক আদর করতে করতে মিজারেবলি ফেল করেছেন মনোজ। আজ অফিসে তাই ডিপ্রেসড ছিলেন। কাজে মন নেই, আড্ডায় অংশ নিচ্ছেন না, টিফিনে রুচি নেই। থেকে থেকেই মনে হচ্ছে, এই তা হলে বার্ধক্যের শুরু? তা হলে কি মাংকি ক্যাপ পরে, হাতে লাঠি নিয়ে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটার দিন সমাগত? ছানি, ব্লাড সুগারের ওষুধ, কোষ্ঠ সাফ করার দাওয়াই, বাঁধানো দাঁত—চোখের সামনে একের পর এক ছবি ভাসছে। এমন সময় ঋষিতার ফোন এল। ‘পাঁচটা নাগাদ আসবে নাকি? পাপ্পুকে আজ আগে ছেড়ে দিলাম!’

দু’পায়ের ফাঁকে রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে। খসখসে গলায় মনোজ বললেন, ‘যাব। আজ দু’বার হবে।’

‘ও মা কেন?’ হাসতে হাসতে বলে ঋষিতা। ‘বউ আজকাল দিচ্ছে না?’

ফোন কেটে দেন মনোজ। দ্রুত বাকি কাজ শেষ করেন। শরীর গরম, কান গরম, গাল গরম। মাথায় চিড়িক চিড়িক করে ফুলকি ছড়াচ্ছে আদিম রিপুর আগুন। শরীর আজ অসহায়ভাবে শরীর চাইছে।

সাড়ে চারটেয় অফিস থেকে বেরিয়ে, পাঁচটার সময় মৌলালি পৌঁছলেন মনোজ। এন্টালির তিনতলা বাড়িটায় যখন ঢুকছেন, তখন ন্যাপস্যাক কাঁধে, চশমা পরা একটা মেয়ে তার পাশ দিয়ে হেঁটে দোতলায় সিঁড়ির দিকে গেল। কানে মোবাইল। মনোজ শুনতে পেলেন, মেয়েটা বলছে, ‘দ্যাখো বিলুদা, প্রচুর চাপের মধ্যে আছি। এখন আমাকে আর পরোপকার করতে বোলো না।’

.

‘রোববার একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প করবি, তার মধ্যে চাপ নেওয়ার কী আছে? ঠিক হ্যায়। সাপ্লির পরেই কথা হবে।’ ফোন কেটে দিয়েছে বিলু। মোবাইল বন্ধ করে টকাটক সিঁড়ি টপকে দোতলায় ওঠে দময়ন্তী। বিলুর ওপরে অত্যন্ত বিরক্ত সে। রেস্তোরাঁয় ডেকে পলিটিকাল জ্ঞান দেওয়ার জন্য তো বটেই, গোপাল নস্করের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যও। বিলুকে তার ভালোই লাগে। তবে রাজনীতির কথা বললেই ভালো লাগা উড়ে যায়। একটাই কথা মনে হয়। স্কাউন্ড্রেল। রাজনীতি যাদের শেষ আশ্রয়।

অবশ্য, দময়ন্তীর বিলুকে ভালো লাগে তার ওই রাজনৈতিক চালচিত্রের জন্যই। আজকের জমানায় একটা ছোকরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে, সততার সঙ্গে গরিবদের কথা ভাবছে। এর মধ্যে কোনও ভণিতা বা ওপর চালাকি নেই। জুনিয়রদের বিপদে সব সময় এগিয়ে আসে। পড়াশুনোর পাশাপাশি দেশ-দুনিয়ার জন্য ভাবে। এই জন্যই বিলু ভালো। দময়ন্তীর অ্যানাটমিতে সাপ্লি আটকানোর জন্য বেচারা অনেক চেষ্টা করেছিল। এনজি একবগগা। রাজি হননি। সুরজকেও ফেল করিয়ে পাপস্খালন করেছেন। সুরজের হয়ে ন্যাবারা এনজিকে নানা ভাবে চমকেছিল। ফোনে, সরাসরি দেখা করে, অ্যাডমিনিস্ট্রিশানের মাধ্যমে। এনজি সিদ্ধান্ত বদলাননি। কুৎসিত গালিগালাজ শুনতে শুনতে কলেজ ছেড়েছেন। সুরজ চমকেছে, সাপ্লিতে পাস না করালে এনজির ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেবে। এরা এখনও ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেনি। এখনই এই অবস্থা। যদি সত্যিই নবযুগ ক্ষমতায় আসে, তখন না জানি কী হবে!

গোপাল নস্কর আর এক ঘরের-খেয়ে-বনের-মোষ-তাড়ানো পাবলিক। এক রবিবারে দময়ন্তীকে টানতে টানতে নতুনগ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন। দময়ন্তীর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। সাপ্লির টেনশান, মোটামোটা অ্যানাটমি বইগুলো আবার পড়া, আবার ডিসেকশানের জন্য ক্যাডাভার দেখা, আবার সারফেস মার্কিং প্র্যাকটিস—এইসব অশান্তির মধ্যে পরোপকার করতে ভালো লাগে?

তবে নতুনগ্রাম পৌঁছে দিব্যি লাগল। শান্তিনিকেতনের বাইরে বাংলার কোনও গ্রাম দেখেনি দময়ন্তী। শান্তিনিকেতনও আর গ্রাম নেই। গাদাগাদা বাড়ি, হোটেল আর রিসর্ট মিলিয়ে শ্যামবাজারের মতো চেহারা হয়েছে। সে তুলনায় নতুনগ্রাম অনেক ভালো। মেচেদা-নতুনগ্রাম সড়কের দু’পাশে সারসার পাকা বাড়ি। শহর-শহর ভাব। পাকা বাড়ির ফাঁক দিয়ে চারপা এগোলেই দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেত। আকাশ কতটা নীল, ঘাস কতটা সবুজ আর বাতাস কতটা বিশুদ্ধ হতে পারে—দময়ন্তীর ধারণা ছিল না।

দময়ন্তী যতটা সুন্দর আর পবিত্র ভেবেছে, নতুনগ্রাম নিশ্চই অতটা ‘ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়’ নয়। এখানেও ঘরোয়া কোঁদল আছে, পঞ্চায়েতের দাদাগিরি আছে, রাজনীতির আর্ম-টুইস্টিং আছে, শ্যালোর জলে আর্সেনিক আর ফসলে কীটনাশকের বিষ আছে। তবে প্রথম দর্শনে সেসব চোখে পড়েনি। গোপাল নস্করের বাড়ি বাঁজাপলাশ গ্রামে। হেলথ সেন্টার ছাড়া এটা এই গ্রামের একমাত্র পাকা বাড়ি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, দোতলা। ভদ্রলোক বিয়ে-থা করেননি। একগাদা কমবয়সি ছোকরা বাড়িতে থাকে। তারা কী করে বুঝতে পারেনি দময়ন্তী। ছেলেগুলো পড়াশুনা করছে, রান্নাবান্না করছে, নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টা করছে। সন্ধে নাগাদ আগুন জ্বেলে তার চারদিক ঘিরে গোল হয়ে বসে গানবাজনাও করছে। গোপাল বলেছিল, বাড়িটা কমিউন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরা ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টির ছেলে। অন্য রাজ্যের ছেলেও আছে। নিজের বৃত্তের বাইরে এরা একদমই কথা বলে না।

বাঁজাপলাশ গ্রামের সব্বাই বামন—এটা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল দময়ন্তী। গোপাল বলেছিল, এরা সবাই একই জেনেটিক রোগে আক্রান্ত। ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে করে এমন হয়ে গেছে। যে কয়েক ঘর লম্বা মানুষ ছিল, তারা বাঁজাপলাশ ছেড়ে চলে গেছে। এরা পেশাগত ভাবে জেলে। পাশাপাশি এই গ্রামের লোকের হাতে যাদু আছে। তারা ভালো রান্না করে, ভালো জরির কাজ জানে, হিরে পালিশের কাজ জানে। তারা সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে। লেখাপড়া শেখে না বলে দেদার এক্সপ্লয়েটেড হয়। বারো-তেরো বছরে বাড়ি ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। কুড়ি বছরের আশেপাশে গ্রামে ফিরে একটা মেয়েকে বিয়ে করে, গর্ভবতী বানিয়ে কাজের জায়গায় ফেরত যায়। বছরে বা দুবছরে একবার বাড়ি ফিরে সন্তানের মুখ দেখে, বউকে আবার গর্ভবতী করে আবার কাজের জায়গায় ফেরত যায়। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত এই রুটিন চলে। তার পরে শরীর নেয় না। জরি আর হিরে শিল্পে যারা আছে, তাদের চোখ খারাপ হয়ে যায়। অন্যরা শারীরিক সক্ষমতায় পেরে ওঠে না। অগত্যা বাধ্যতামূলক অবসর। টাকা জমানোর জন্যে ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে যাওয়ার ধারণা এদের মধ্যে নেই। নন ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান ‘মায়াকম’-এর এজেন্ট এই গ্রামে রোজ আসে। বাঁজাপলাশের প্রতিটি বাড়ির টাকা জমা রাখা আছে মায়াকমে।

দময়ন্তী ডাক্তারির কী-ই বা বোঝে? ফার্স্ট এমবিবিএস-ও পাস করেনি। বিলু আর সব্যসাচী রোগী দেখেছিল, দময়ন্তী খাতায় লেখালেখি করছিল। বাঁজাপলাশ গ্রামের বাচ্চাদের মাথায় উকুন, গায়ে স্কেবিস, পেটে কৃমি, ভিটামিনের অভাবে বাচ্চাগুলো রাতকানা। অথচ এখানে হেলথ সেন্টার আছে। সেখানে কোনও ডাক্তারের পোস্টিং না থাকলেও সিস্টারের পোস্টিং আছে। হেলথ সেন্টার কখনও খোলে কখনও খোলে না। এখানকার গর্ভবতী মায়েরা রক্তাল্পতায় ভুগছে। জ্বরজারি, সর্দিকাশি, পেটখারাপ তো আছেই। গোটা পনেরো পেশেন্ট দেখার পর দময়ন্তী প্যাটার্ন বুঝে রোগী দেখা শুরু করল। দেখতে দেখতেই তাদের সঙ্গে গপপোগাছা। জেলে পরিবারগুলোয় এক সমস্যা। পলিউশানের কারণে সমুদ্রে মাছ কমছে। জেলের কাজ ছেড়ে পুরুষমানুষরা জনমজুরি ধরছে। সরকারের একশো দিনের কাজ খাতায় কলমে। বেশিরভাগ জোয়াকিম কাজ পায় না। পেলেও টাকা কম পায়। বউরা বাড়ির কাজ করে। পঞ্চায়েতকে বলেও বিপিএলের কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে সেটা এরা জানে না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে জনমোর্চা সরকারের জমি অধিগ্রহণের নোটিশ। এরা এতদিন ভাবত, কী খাব? এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কোথায় যাব?

নতুন দিল্লি ভারতবর্ষের রাজধানী। কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের কর্মস্থল। লন্ডন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরগুলির মধ্যে পড়ে। এই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো দময়ন্তীর কাছে বাঁজাপলাশ গ্রাম এক রিভিলেশন! আলোকোজ্জ্বল ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র তলায় মুখ লুকিয়ে থাকা, হতদরিদ্র ভারতবর্ষ। শপিং মল, পার্কোম্যাট, মাল্টিপ্লেক্স, থ্রি বিএইচকে কন্ডোভিলের ঝাঁ-চকচকে বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাচ্ছে অনাহারে অর্ধাহারে, অন্ধকারে, অশিক্ষায় ডুবে থাকা বাঁজাপলাশ গ্রাম। যে গ্রাম ভারতবর্ষের ভিত্তি।

দময়ন্তীর মাথা গুলিয়ে যায়। পাগল পাগল লাগে। সে আদ্যন্ত শহুরে মেয়ে। কলকাতা শহরের একটা ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম আছে, যার প্রেমে সে পড়ে গেছে। বাকি জীবন এই শহরেই কাটাবে। কিন্ত ওই গ্রাম তার জন্য নয়। আর ওখানে যাবে না। ওই বাস্তবতায় প্রবেশ না করে তার দিব্যি চলে যাবে। বিলুর কথায় নেচে, গোপালের উত্তেজক ভাষণে হিপনোটাইজড হয়ে পার্টি ক্যাডারে পরিণত হওয়ার জন্য সে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ঢোকেনি।

রবিবার অনেক রাতে বাঁজাপলাশ গ্রাম থেকে কলকাতায় ফেরার পরে অদ্ভুত এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। বাঁজাপলাশ গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে গোলঘরে নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিল দময়ন্তী। অ্যালোপাম না খেয়ে। অনেকদিন পর ওষুধহীন ঘুম। হয় তো সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর কাহিল ছিল। হয় তো নতুন পরিবেশে গিয়ে মন শান্ত ছিল। যে কারণই হোক না কেন, দময়ন্তী ঘুমল। রবিবার রাত দশটা থেকে সোমবার সকাল ন’টা পর্যন্ত ওষুধ ও দুঃস্বপ্নহীন রেস্ট। ঘুমের শেষে নিজেকে কী ঝরঝরে যে লাগছিল! মনে হচ্ছিল, শান্তির সমুদ্রে অবগাহন হল।

আবার ওষুধ খাচ্ছে দময়ন্তী। সামনে সাপ্লি। চাপ প্রচুর। তার মস্তিষ্ক বলছে, ‘বাঁজাপলাশ গ্রামে আর যাবে না। ওই দুঃখ, দারিদ্র, অনাহার, কুসংস্কার দেখে তুমি যখন কিছু করতে পারবে না, তখন চোখ বন্ধ রাখো। ওরা ছিল, আছে, থাকবে। তুমি কেন মিথ্যে মিথ্যে কষ্ট পাবে?’

আর হৃদয় বলছে, ‘তোমার নিজের চিকিৎসা লুকিয়ে আছে বাঁজাপলাশে। তোমার সুশ্রুষা ওই অসুস্থ বাচ্চা আর তাদের মায়েরা। সাপ্লি চুকলেই চলে যাও গোপালের কমিউনে। বাচ্চা আর মায়েদের চিকিৎসা করো। তারপর ফিরে এসো। দেখবে, ওষুধহীন এক রাত ঘুম তোমার অপেক্ষায় রয়েছে।’

মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত দময়ন্তী সাপ্লির প্রিপারেশান নিতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *