হৃদয়ের শব্দ – ৬

অভিজ্ঞান

জীবনে এই প্রথম সময়ের অনিবার্যতা সম্পর্কে ধারণা হল অভির। উনিশ কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত আপন মনে ভেসে বেড়িয়েছে। কোনও দায়িত্ব নেয়নি, কারো খিদমত খাটেনি, কখনও টেনশানে ভোগেনি। কুয়োর ব্যাঙের মতো স্বাধীন ও আনন্দময় জীবন ছিল। ডাক্তারি পড়তে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে সব বদলে গেল।

মফসসলের ছেলে কলকাতা শহরে পড়তে এসে দিব্যি গড্ডলিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছিল। একটু পড়া-পড়া খেলা, একটু প্রেম-প্রেম নাটক, একটু রাজনীতি-রাজনীতি ছ্যাবলামি—সব মিলিয়ে তোফা কাটছিল দিনগুলো। ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না!’

কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। কেন না, ওই যে, সময়ের অনিবার্যতা! একটা একটা করে পার্ট আর আইটেম চলে যেতে থাকে, অভি নিয়মিত এনজির কাছে ঝাড় খেতে থাকে। ফার্স্ট সেমিস্টার পার হয়ে যায়। ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রিতে টায়েটুয়ে পাস মার্ক থাকলেও অ্যানাটমিতে ঝাড় নামিয়ে দেন এনজি। সেমিস্টারে ঝাড় খাওয়ার কোনও প্রভাব পড়ে না কলেজ লাইফে। কেউ মনেও রাখে না, কিন্তু অভির মাথায় টিকটিক করতে থাকে দুশ্চিন্তার কাঁটা। সেকেন্ড সেমিস্টারেও এইরকম হবে না তো?

এবং সেকেন্ড সেমিস্টার বা প্রি-টেস্ট চলে আসে। রেজাল্টের পুনরাবৃত্তি হয়। অভি জোর করে অ্যানাটমি বই নিয়ে বসে। চৌরাসিয়া আর ডক্টর মিত্রর বই বারবার পড়তে থাকে।

অধ্যয়নই সার। মাথা থেকে সব বেরিয়ে যায়? কেন? নিজেকে হাজার প্রশ্ন করেও উত্তর পায় না। সে সিনেমা যায় না, রাজনীতি করে না, বৃন্দাকে মন থেকে মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাও কেন এমন হয়?

উত্তরটা একদিন বিলু দিল। ভাইয়ের পাগল-পাগল অবস্থা দেখে বলল, ‘বাড়িতে থেকে অ্যানাটমি পড়া যায় না। হোস্টেলে যা। গ্রুপ-স্টাডি কর। বারবার চেঁচিয়ে না পড়লে ওইসব শক্ত শক্ত নাম স্মৃতিতে থাকে না। ঘুমের মধ্যেও তুই নিজের নাম, আমার নাম বা বাবার নাম ভুলিস না। একে বলে পার্মানেন্ট মেমারি। অ্যানাটমিকে পার্মানেন্ট মেমরির সিন্দুকে ঢোকানোর একমাত্র উপায় ক্রমাগত আওড়ানো। লিখে বা এঁকে এ জিনিস হবে না।’

দাদার কথা মেনে ফার্স্ট এমবিবিএস থিয়োরি পরীক্ষার পনেরো দিন আগে অভি বয়েজ হোস্টেলে শিফট করেছে। বিলু তাকে নিজের রুমে ঢোকায়নি। তার স্থান হয়েছে একশো চব্বিশে, টিনটিনের রুমমেট হিসেবে। হোস্টেলে এসে সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। নতুন জায়গায় অ্যাডজাস্ট করতে সময় লাগে। অভিরও লেগেছে। অ্যাডজাস্টমেন্ট সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরীক্ষার টেনসান। তাছাড়া গ্রুপ স্টাডি করার জন্য গ্রুপ লাগে। হোস্টেলে অলরেডি দুই, তিন বা চারজন ছেলে মিলে গ্রুপ বানিয়ে রেখেছে। এই ক্রুশিয়াল সময়ে তাকে কেউ এন্ট্রি দেয়নি। সবাই পরিষ্কার বলেছে, পরীক্ষার পনেরো দিন আগে একটা চালু সিস্টেমকে তারা ঘাঁটতে পারবে না। ফার্স্ট এমবিবিএস-এর পরে এই নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

হোস্টেলে এসে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় অভি ভেবেছিল বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু দোনামোনা করে যায়নি। হোস্টেলে থাকলে পরীক্ষার দিনগুলোয় বাড়ি থেকে যাতায়াত নিয়ে টেনশান করতে হবে না।

একশো চব্বিশ নম্বরে থাকার সুবিধা হল, এই ঘরে কেউ থাকে না। টিনটিনের বাড়ি ঢাকুরিয়ায়। সে ক্লাস শেষ হলে বিকেলের দিকে আধঘণ্টার জন্য রেস্ট নেয়। তারপর বাড়ি চলে যায়। এটা মোচা-পার্টির মিটিং ঘর। পরীক্ষার চাপে মিটিং এখন বন্ধ। সারাদিন অভি ঘরে একা। পড়াশুনা করার জন্য আদর্শ ব্যবস্থা। কিন্তু পড়াশুনা হচ্ছে কই?

অভির রুটিন খুব সহজ। ভোর পাঁচটার সময় অ্যালার্ম বাজলে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে স্নান করে পড়তে বসে। সকালে অ্যানাটমি পড়ে না। ভোরবেলা অপছন্দের সাবজেক্ট পড়তে বিবমিষা হয়। ফিজিওলজি নিয়ে বসে। চ্যাপ্টার রিভিশন দিতে আর ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস করতে আটটা বেজে যায়। আটটা থেকে ন’টা টিফিন ব্রেক। প্রাতঃরাশ, খবরের কাগজ পড়া, খুচরো আড্ডা চুকিয়ে আবার ঘরে ঢোকে অভি। এইবার অ্যানাটমি নিয়ে বসে। টিনটিনের সংগ্রহ করা একটা স্কেলিটন আলমারিতে ঢোকানো ছিল। অভি সেটাকে হুকে ঝুলিয়েছে। কাপালিকের মতো হাড় আর নরকঙ্কাল নিয়ে চর্চা করে অস্টিওলজি এখন সড়োগড়ো। মাসলের অরিজিন আর ইনসারশন গোলায় না। বিভিন্ন শিরা, ধমনি ও স্নায়ুতন্ত্রর গতিপথও বাগে এনে ফেলেছে। প্রবলেম করছে ভিসেরা বা মানবদেহের ভাইটাল অর্গ্যানস। যেমন হার্ট, লাং, ব্রেন, স্টম্যাক, কিডনি, লিভার। ভাইভার সময় ফর্মালডিহাইডে চোবানো এইসব ভিসেরা হাতে ধরিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করবেন এনজি। না পারলেই ঝাড়। তার ব্যাচের ছেলেরা কালুয়া ডোমের কাছ থেকে ভিসেরা কিনে বালতিতে ভরে রেখেছে। যখন যেটা পড়ে তখন সেটা বালতি থেকে বার করে নেয়। বালতি ভর্তি হৃদয়, ফুসফুস, যকৃৎ, বৃক্কের প্রদর্শনী দেখলে যে কোনও মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। অজ্ঞান বোধহয় অভিও হয়ে যাবে। তবে সেটা অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার দিনের কথা ভেবে।

সকাল নটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত অ্যানাটমি নিয়ে দক্ষযজ্ঞ চলে। তারপর জেনারেল মেসে গিয়ে খাওয়া। মিনি মেস উঠে গিয়ে খুব ভালো হয়েছে। জেনারেল মেসের খাওয়াদাওয়া একদম বাড়ির মতো। পেটপুজো ক্যাটারিং এজেন্সির মালিক উৎপল রোজ লাঞ্চের সময় মেসে উপস্থিত থাকে। খাবারের কোয়ালিটি, মেসের স্টাফদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে।

দুপুর দুটোর সময় শুয়ে পড়ে অভি। ঘুম ভাঙে সাড়ে তিনটের সময়, টিনটিন ঢুকলে। টিনটিন নিজের খাটে রেস্ট নেয়। তার মধ্যে অভি বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে বসে যায়। সাড়ে তিনটে থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ফর্মুলা মুখস্থ করে আর সমীকরণ কষে কেটে যায়। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ডিএনএ আর আরএনএ নিয়ে সাড়ে চারঘণ্টা ধস্তাধস্তি চলে। এবার গন্তব্য ক্যান্টিন।

মুড়ি-ঘুগনি বা লুচি-তরকারি, কিছু একটা খেয়ে এককাপ চা নেয় অভি। তারপর একটা সিগারেট। হ্যাঁ, অভিও সিগারেট ধরেছে। যে অভি আজ থেকে এক বছর আগে বিলুকে সিগারেট খেতে দেখে বলেছিল যে অরুণাকে বলে দেবে, সে এখন ধূমপায়ী। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় অভি, পরীক্ষার টেনশান কাটাতে এই সাময়িক নেশা। পরীক্ষা হয়ে গেলেই ছেড়ে দেবে। আর সে তো চন্দনের মতো দিনরাত ধোঁয়া ছাড়ে না। বিকেলে টিফিনের সময় একটা আর রাতের খাওয়ার পড়ে আর একটা।

আটটায় আবার পড়তে বসে অভি। আবারও অ্যানাটমি। কিছুতেই মন চায় না। তাও। ব্রেনের অ্যানাটমি, হোয়াইট আর গ্রে ম্যাটার, সেন্ট্রাল আর পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম—এই সবের জটিল গোলকধাঁধায় সাড়ে দশটা অবধি কাটিয়ে রাতের খাবার খেতে ওঠে অভি। নাকে-মুখে খাবার গুঁজে এগারোটার সময় আবার পড়তে বসে। বারোটা পর্যন্ত পেপার সলভ করে। গত দশ বছরের ফার্স্ট এমবিবিএস-এর প্রশ্নপত্রের ফটোকপি জোগাড় করেছে সে। প্রতি রাতে একঘণ্টা লেখালেখি করে। তিন দিনে একটা পেপার শেষ হয়। রাত বারোটার সময় দ্বিতীয় এবং শেষ সিগারেট ধরিয়ে অভি হিসেব করে, আজ ক’ঘণ্টা পড়া হল? মাত্র ষোল ঘণ্টা। কাল থেকেই এটাকে বাড়িয়ে আঠেরো ঘণ্টা করতে হবে। তখন তার দু’চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। আধো-জাগা, আধো-ঘুমের মাঝখানে মাথায় ছবি আঁকছে মনোজের দেরি করে বাড়ি ফেরা, অরুণার অকারণ দুশ্চিন্তা ও শুচিবাই, রাধা পাগলি আর মানদা পিসির ঝগড়া, বিলুর অতি-বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। আর এই সবের মধ্যে গালে টোল ফেলে একটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে…

সারা অগাস্ট মাস জুড়ে অনর্গল বৃষ্টিপাত। আকাশের রং ধূসর। রাত বারোটা নাগাদ হাতির পালের মতো মেঘের দল বেলেঘাটা ব্রিজ পেরোচ্ছে। অ্যানাটমির ভারে ক্লান্ত অভির মাথায় নিঃশব্দে বাংলা হরফ এক্কাদোক্কা খেলতে থাকে। ঘুমের মধ্যে অভি বিড়বিড় করে,

‘কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল
কখন জলের মাঝে মেয়ে। মেয়ের দু’গালে টলোমল
স্বেদ, নাকি বৃষ্টি ছিল রাখা। জানি না, হয়নি বলে চাখা।
ধর্মতলাগামী বাসে চাকা, ফেটে গিয়ে এই গন্ডগোল।
স্বাদই অপূর্ণ না শুধু। নামটাও বাকি আছে জানা।
পদবি? তাতেও গরমিল। এছাড়াও জানি না ঠিকানা।
কিছুই জানি না বলে শোক, করার মতন কোনও লোক
নই আমি। তাই আজ থেকে, তার নাম বৃষ্টিদিন হোক।’
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় অভির। কী হল? এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে কী বিড়বিড় করছিল সে? এই কবিতাটা কার লেখা? অন্ধকার ঘরে শুয়ে, সিলিং পাখার দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে থাকতে অভি বুঝতে পারে, কবিতাটা কোনো নামি কবির লেখা নয়। এটা তার নিজের লেখা। এই আট লাইন নিজের থেকে তার মাথায় এসেছে। এখনও লেখা হয়নি।

পদ্য তাকে ছাড়ছে না কেন? সে তো কবেই ও সব পাট চুকিয়ে দিয়েছে। চিলেকোঠার ঘরের লাইব্রেরিতে কবিতার বইতে ধুলো জমে আছে। একটাও কবিতা পড়েনি, সে প্রায় এক বছর হয়ে গেল। তাহলে পদ্য আসে কোথা থেকে? ছন্দ ও অন্ত্যমিল সহযোগে একটা আস্ত পদ্য? সে তো কখনও পদ্য লেখেনি। শুধু পড়েছে।চর্যাপদের যুগ থেকে সাম্প্রতিকতম নবীন কবির প্রথম কবিতার বই নিয়ে সে মাথা ঘামাত। কিন্তু সে সব তো অতীত! আজ হঠাৎ কী এমন ঘটল যে পাঠক অভি হঠাৎ করে পদ্যকার অভি হয়ে গেল? ঘুমিয়ে পড়ার আগে অভির মনে পড়ল, কাল সেই ভয়ানক দিন। কাল অ্যানাটমির থিয়োরি পরীক্ষা। বিকেলবেলা বাড়ি যাবার আগে টিনটিন বলেছে, ডাক্তাররা তাদের জীবনের চারটে রাত কখনও ভোলে না। ফুলশয্যার রাত ছাড়া অ্যানাটমি, প্যাথলজি আর মেডিসিন প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাত।

আজকের রাত সেই চার রাতের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এই রাত অভির আজীবন মনে থাকবে। ইঙ্গুইনাল ক্যানালের বাউন্ডারি পড়তে গিয়ে ভেগাস নার্ভের কোর্স ভুলে যাচ্ছে। আর্চ অব ফুট পড়তে গিয়ে এমব্রায়োলজি ভুলে যাচ্ছে। গা গুলোচ্ছে, ওয়াক উঠছে, টক-ভাব মুখের ভেতরে। পরপর তিনবার তেতো বমি হল। বাথরুমে ওয়াক শব্দ শুনে চন্দন একশো পঁচিশ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বলল, ‘রাত একটা বাজে। এখনও শুসনি?’

‘শোবো। এমব্রায়োলজিটা ঝালিয়ে নিই।’

‘এক বছর ধরে ঝালানো হয়নি। আর ঝালিয়ে কাজ নেই। রাত্তিরে না ঘুমিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে কাল পরীক্ষার সময় কিসসু মনে পড়বে না। যা। ঘুমিয়ে পড়।’

‘এমব্রায়োলজিটা একদম পড়া হল না। কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের ডেভেলপমেন্টটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। এখন ঘুমিয়ে পড়ব?’

‘আমাদের পরীক্ষা এগারোটা থেকে। সিট পড়েছে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে। হাড়কাটা গলির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে আধঘণ্টা লাগবে। আমরা সওয়া দশটা নাগাদ বেরোব। এখন একটা বাজে। তুই সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠলে স্নান-খাওয়া পর্ব বাদ দিয়ে দেড়ঘণ্টা হাতে পাবি এমব্রায়োলজি পড়ার জন্য। এখন চাপ নিস না।’

চন্দনের পরামর্শ শুনে রাত একটার সময় জিভের তলায় একটা অ্যালোপাম নিয়ে শুয়ে পড়েছিল অভি। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েছিল সকাল সাড়ে সাতটায়। অ্যালার্মের শব্দে যখন ঘুম ভাঙল, মাথা ভার। নাক বন্ধ। গা-হাত-পা ম্যাজম্যাজ করছে। জ্বর আসার পূর্ব লক্ষণ। টলতে টলতে বাথরুমে গিয়ে দাঁত মাজল অভি। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে পুরো দমে শাওয়ার চালিয়ে দিল। মিনিট পনেরো ধরে স্নান করার পরে শরীর হালকা হল। গা-হাত-পা মুছে, নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে এক দৌড়ে ক্যান্টিন। আজ ব্রেড পকোড়া হয়েছে। ভারি প্রাতঃরাশ পরীক্ষার জন্য আদর্শ। চারটে ব্রেড পকোড়া আর এক কাপ চা খেয়ে, আর এক কাপ হাতে নিয়ে একশো চব্বিশে ঢোকে অভি। পৌনে ন’টা বাজে। হাতে সওয়া একঘণ্টা সময় আছে। একশো পাতা এমব্রায়োলজি পড়ার জন্য পঁচাত্তর মিনিট! চায়ে চুমুক দেয় সে।

দশটার সময় দরজায় ঠকঠক। চন্দন নতুন প্যান্টশার্ট পড়ে রেডি। কাঁধে ব্যাগপ্যাক। অভির দিকে একপলক দেখে বলল, ‘শরীর খারাপ নাকি?’

‘দেখে মনে হচ্ছে?’

‘চোখটা ছলছল করছে।’ অভির কপালে হাত দিয়ে চন্দন বলে, ‘টেম্পারেচার আছে। একটা প্যারাসিটামল মেরে দে।’ তারপর নিজেই একটা ট্যাবলেট আর জলের জাগ এনে বলে, ‘এক গ্রাম পিসিএম দিলাম। জ্বর বাপবাপ বলে পালাবে।’

ওষুধ খেয়ে দ্রুত ব্যাগ ঘাঁটে অভি। অ্যাডমিট কার্ড, ক্লিপবোর্ড, পেন, পেনসিল, ইরেজার, স্কেল, চোথার মাইক্রোজেরক্স…সব ঠিক আছে। চোথাগুলো টিনটিনের তৈরি। ভালোবেসে জুনিয়রকে দান করেছে। একশো চব্বিশে চাবি মেরে অভি চন্দনকে বলে, ‘চল। এগোই।’

‘এমব্রায়োলজি শেষ হল?’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে চন্দন।

‘পড়তে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।’

‘চল। রিকশায় যেতে যেতে পড়বি।’

‘রিকশা? এখন রিকশা কোথা পাবি?’

‘কাল রাতে উৎপলদাকে বলে রেখেছিলাম। ও একটা রিকশা হোস্টেলের সামনে এনে রাখবে থিয়োরি পরীক্ষার তিনদিন। মেডিক্যাল কলেজ এমন বিকট জায়গায়, হেঁটে যেতেও প্রবলেম, বাসে যেতেও প্রবলেম।’

হোস্টেলের গেটের বাইরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। উৎপল বিহারি রিকশাওয়ালার সঙ্গে দরদাম নিয়ে বচসা চলছে। চন্দন বলে, ‘কত নেবে?’

‘পচাস রুপিয়া বাবু।’ গামছা নেড়ে বলে রিকশাওয়ালা।

‘চল্লিশ দেগা।’ রিকশায় উঠে বসেছে চন্দন। তার দেখাদেখি অভিও। আচার্য জগদীশ্চন্দ্র বসু রোড টপকে, প্রাচী সিনেমা হলের পাশ দিয়ে ডিক্সন লেনে ঢুকল রিকশা। সরু রাস্তা। দু’পাশে পুরনো আমলের বাড়ি। ওপাশ থেকে গাড়ি এলে খুব সমস্যা হবে। গাড়ি এল না, কিন্তু রিকশা এল। তার সঙ্গে একপ্রস্ত ঝগড়া সেরে রিকশাওয়ালা নেবুতলা পার্কে পড়ল। বউবাজার থানার পাশ দিয়ে টুংটুং করতে করতে পৌঁছল বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট। বউবাজারের রাস্তা দিয়ে রিকশা চালানো শক্ত। অজস্র গাড়িঘোড়া। ক্রমাগত ট্রাম যাতায়াত করছে। সামান্য দূরত্ব পেরোনোর পর ডানদিকের গলিতে ঢুকে পড়ে রিকশা।

এতক্ষণ মন দিয়ে এমব্রায়োলজি পড়ছিল অভি। এবার আড়চোখে রাস্তার দিকে তাকাল। স্থানবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটছে পাত্রপাত্রীর। সরু রাস্তায় কোনও যানবাহন নেই। একটা দুটো রিকশা বা স্কুটার দাঁড়িয়ে। অফিসযাত্রীর বদলে এখানে মেয়েদের প্রাধান্য। সকাল দশটার সময় তারা রঙিন, উজ্জ্বল পোশাক পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। পঞ্চাশোর্ধদের পোশাক শাড়ি। তিরিশ থেকে পঞ্চাশরা সালোয়ার কামিজ পড়েছে। তার নিচে সবাই জিনস বা স্কার্ট। গালে চড়া মেক আপ, চোখে মোটা দাগের কাজল, ঠোঁটে উজ্জ্বল লাল রঙের ঠোঁট রাঙানিয়া। জিনস পরা বছর কুড়ির একটা মেয়ে চার ইঞ্চির হাই হিল খটখটিয়ে রিকশার সামনে এসে অভিকে বলল, ‘তুমি বুঝি বুকওয়র্ম?’ রিকশা দাঁড়িয়ে গেল।

‘অ্যাঁ?’ মিনমিন করে বলল অভি। চন্দন বলল, ‘এখন ঝামেলা কোরো না। আমরা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।’

‘তোমার সঙ্গে কথা কইছি না।’ পিচ করে পানের পিক ফেলে লাল ঠোঁট বেঁকিয়ে মেয়েটা বলে, ‘এত বড় বুক-লাভার আমি কখনও দেখিনি। আমার কাছেও দুটো বুক আছে। দেখবে গো?’

এমব্রায়োলজি মাথায় উঠেছে। লজ্জায় অভির কান লাল। সে কোনওরকমে বলল, ‘আম…আমরা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ছেলে। পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।’

‘ডাক্তারবাবু?’ তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ায় মেয়েটি। ‘এক্সট্রিমলি সরি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না স্যার। যান যান, আপনারা যান।’ রিকশাওয়ালার পিঠে থাবড়া কষায় সে। রিকশা আবার চলতে শুরু করে। অভি এমব্রায়োলজিতে মনোযোগ দেয়।

মেডিক্যাল কলেজের যে হলঘরে পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে, সেটা ফুটবল মাঠের মতো বড়। হলঘরের দু’পাশে প্রশস্ত করিডর। করিডরে বড় বড় জানলা। ঘর আলোয় ভেসে যাচ্ছে। হলঘরের দু’পাশে বেঞ্চি পাতা। প্রতি বেঞ্চিতে দু’জনের সিট পড়েছে। অ্যাডমিট কার্ড মিলিয়ে সিট নাম্বার খুঁজতে গিয়ে বৃন্দার সঙ্গে ঠোক্কর লাগল অভির।

‘তুই?’ অভি অবাক।

‘আমার রোল নাম্বার দুই। ফার্স্ট রোয়ে সিট পড়েছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই। ডাহা ফেল করব।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলে বৃন্দা।

‘আমার রোল নাম্বার এক,’ প্রথম বেঞ্চিতে বৃন্দার পাশে বসে সামনের দিকে তাকায় অভি। দু’ফুট দূরে প্ল্যাটফর্মের ওপরে একটা টেবিল ও চারটে চেয়ার। ওখানেই বসবেন ইনভিজিলেটররা। ব্যাগে রাখা মাইক্রোজেরক্সের কথা ভুলে যায় অভি। ওই চোথা এখানে কোনও কাজে আসবে না। তারপর কী ভেবে ব্যাগ খুলে ক্লিপবোর্ড এবং পেনসিল বক্স বার করার ফাঁকে মাইক্রোজেরক্সের বান্ডিল মোজার মধ্যে গুঁজে রাখে। সঙ্গে থাকা ভালো। একঘণ্টা পরে বাথরুমে যেতে দেবে। একদম না পড়া কোনও টপিক এলে দেখে নেওয়া যাবে।

বৃন্দা নিজের জায়গায়, দু’হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে রয়েছে। তার পাশে বসে অভি আবার এমব্রায়োলজি বই খুলল। এই এমব্রায়োলজির জন্যই সে ঝাড় খাবে। কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের ডেভেলপমেন্টটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। গত দশ বছরে এমব্রায়োলজি থেকে লং কোয়েশ্চেন আসেনি। এবারও আশা করা যায় যে আসবে না। পঁচিশ নম্বরের লং কোয়েশ্চেনের উত্তর লিখতে না পারা মানে নিশ্চিত ঝাড়।

ঢং করে ঘণ্টা পড়ল। করিডোরে ঠকঠক, মসমস করে জুতোর আওয়াজ। সারিবদ্ধ ভাবে দু’জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা একজামিনার হলঘরে ঢুকলেন। প্রথম মহিলা একজামিনার প্ল্যাটফর্মে উঠে বললেন, ‘সাইলেন্স।’

হলঘর জুড়ে নৈঃশব্দ নেমে এল।

‘পরীক্ষা শুরু হতে দশ মিনিট বাকি আছে। তার আগে নিয়মগুলো তোমাদের জানিয়ে দিই। আমি যতক্ষণ নিয়ম বলব, ততক্ষণ তিনজন স্যার ও ম্যাডাম তোমাদের টেবিলে কোয়েশ্চেন পেপার ও আনসার শিট পৌঁছে দেবেন। আমরা আশা করব, দশটা বাজার আগে তোমরা লেখা শুরু করবে না। করলে প্রশ্নপত্র কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের আছে।’

উত্তর ও প্রশ্নপত্র বিতরণ শুরু হয়ে গেছে। অভিই প্রথম প্রাপক। কোয়েশ্চেন পেপার বা আনসার শিটের দিকে না তাকিয়ে অভি ম্যাডামের কথা শুনছে। ম্যাডাম বলছেন, ‘বাথরুম যেতে হলে এখন ঘুরে এসো। একঘণ্টার আগে বাথরুমে যাওয়া যাবে না। আর শেষ কথা, কাউকে অসাধু উপায়ে অবলম্বন করতে দেখলে আমরা তার খাতা কেড়ে নেব। ভুলে যেয়ো না, আমরাও একদিন স্টুডেন্ট ছিলাম। সো, ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট।’

দশটা বাজার ঘণ্টা পড়ল। প্রশ্নপত্রের প্রথম প্রশ্নের দিকে তাকাল অভি। ‘ডেসক্রাইব এমব্রায়োলজিকাল ডেভেলপমেন্ট অব কিডনি অ্যান্ড সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যাণ্ড ইন ডিটেইল, উইদ ডায়াগ্রামস।’ পঁচিশ নম্বরের প্রথম প্রশ্ন!

চোখ বুঁজে ফেলে অভি। এখন আর কোনও টেনশান হচ্ছে না। এখন আর কোনও শারীরিক অসুবিধে নেই। এখন বলির পাঁঠার মতো হাড়িকাঠে গলা দিয়ে প্রতিক্ষার পালা। কখন পরীক্ষা শেষ হবে। এক বছরের পরিশ্রম এইভাবে বিফলে যাবে, ভাবতে পারেনি অভি। বৃন্দার দিকে তাকায় সে। বৃন্দা মন দিয়ে প্রশ্নপত্র পড়ছে। অভির দিকে তাকিয়েও দেখল না।

আচ্ছা, এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার কী আছে? অন্য প্রশ্নগুলো দেখা যাক! দ্বিতীয় প্রশ্নে চোখ রাখে অভি। আর্চ অব অ্যাওর্টা অ্যান্ড ইটস ব্রাঞ্চেস। পঁচিশ নম্বর! গুড! কিউবিটাল ফসা—ইটস বাউন্ডারি অ্যান্ড কনটেস্ট। গুড! পঞ্চাশ নম্বর কমন পাওয়া গেল। বাকি পঁচিশ নম্বরে পাঁচটা শর্ট নোট আছে। সেগুলো পড়ে অভি। ইঙ্গুইনাল ক্যানাল সহ বাকি চারটে তার জানা। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় অভি। পঁচাত্তর নম্বর কমন পড়েছে। প্রথম দু’ঘণ্টায় এগুলো শেষ করা যাক। তারপরে বাথরুমে গিয়ে চোথা দেখে এমব্রায়োয়োলজির উত্তরটা কোনওরকমে মুখস্থ করে খাতায় নামিয়ে দিতে হবে। পঁচিশে যদি পাঁচ-সাত নম্বরও পায়, পাস করা কেউ আটকাতে পারবে না। তাদের পাসমার্ক ফিফটি পার্সেন্ট। অর্থাৎ পঁচাত্তর নম্বরের মধ্যে অন্তত পঁয়তাল্লিশ তাকে তুলতেই হবে। আর্চ অব অ্যাওর্টা দিয়ে উত্তর লেখা শুরু করে অভি। লাল নীল স্কেচ পেন দিয়ে ডায়াগ্রাম এঁকে ভরিয়ে দেয় প্রথম তিনপাতা। এবার বিবরণ।

ঠিক দু’ঘন্টার মাথায় উত্তর লেখা শেষ হল অভির। এতক্ষণ হলঘরে কী ঘটে গেছে তার কোনও ধারণা নেই। খাতা আর প্রশ্নপত্র গুছিয়ে রেখে সে ভেবে নেয় চোথাটা কোন পায়ের মোজার মধ্যে রাখা আছে। সিওর হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, একবার বাথরুম যাব।’ ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক ম্যাডাম বলেন, ‘যাও। তাড়াতাড়ি আসবে।’

বেঞ্চি থেকে উঠে বৃন্দার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অভি খেয়াল করল বৃন্দা স্কেচ পেন দিয়ে কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের ছবি আঁকছে। হিংসেয় গা চিড়বিড় করে ওঠে অভির। মেয়েগুলো কি সাংঘাতিক স্টুডিয়াস হয়!

বাথরুমে ঢুকে অভি দেখে ইউরিনালের সামনে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সুরজ, প্রবাল আর দীপ শর্ট নোট নিয়ে আলোচনা করছে। ওদের পাত্তা না দিয়ে টয়লেটে ঢুকে যায় অভি। দরজা বন্ধ করে অবাক হয়ে দেখে সিস্টার্নের ওপরে পাঁজা করে বই রাখা। ক্যানিংহ্যাম, ডক্টর মিত্র, চৌরাসিয়া, স্নেল… কী নেই? এখন কোনও ইনভিজিলেটর দরজা ধাক্কালে সে চরম বেইজ্জত হবে। পরীক্ষায় না-ও বসতে দিতে পারে। হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলে বেরোয় অভি। পাশের টয়লেটের দরজা ঠেলে উঁকি মারে। এই টয়লেটটা নোংরা। তবে কোনও বইপত্র রাখা নেই। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, নিচু হয়ে সে মোজার ভিতর থেকে চোথার তাড়া বের করে আনে। কিডনির এমব্রায়োলজির পাতাটা খুঁজে বার করে বাকি পাতাগুলো কমোডে ফেলে সিস্টার্ন টানে। মুহূর্তের মধ্যে সব কাগজে সাইফনের নলে অদৃশ্য হয়ে যায়। কাগজটা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিডনির এমব্রায়োলজি মুখস্থ করতে থাকে অভি।

.

হলঘরে ঢোকার আগে অভি ঘড়ি দেখল। সে বাথরুমে ঠিক দশ মিনিট সময় কাটিয়েছে। ইনভিজিলেটর কোনও সন্দেহ করেনি তো? চোথার পাতাটা এখনও মোজার মধ্যে রাখা আছে। বলা যায় না, দশ মিনিটের মুখস্থ বিদ্যা খাতায় বমি করতে গিয়ে যদি ভুলে যায়, তাহলে আর একবার টয়লেটে যেতে হবে! এখন ইনভিজিলেটররা তার বডি সার্চ করলেই পরীক্ষা থেকে আউট!

ধুস! এত ভয় পেলে চলে না। ভয় পেলে মুখে তার ছাপ পড়ে। ওতে পরীক্ষকদের সন্দেহ বাড়ে। ক্যাজুয়ালি বৃন্দার পাশ দিয়ে হেঁটে নিজের আসনে বসে অভি। ম্যাডাম ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে বললেন, ‘একটু বেশি সময় লাগল মনে হল!’

এর একটা বোম্বাস্টিং উত্তর দিতে হয়। পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত মুছতে মুছতে অভি বলল, ‘পাইখানা গিয়েছিলাম ম্যাডাম।’

‘পাইখানা’ শব্দটি শুনে ম্যাডাম নাক কুঁচকে ম্যাগাজিনে চোখ রাখলেন। পাশে বসে বৃন্দা কুলকুলিয়ে হাসছে। তাকে পাত্তা না দিয়ে পেনসিল বাক্স থেকে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ স্কেচপেন বার করে অভি। একটা পঁচিশ নম্বরের লং কোয়েশ্চেন বাকি। হাতে সময় পঞ্চাশ মিনিট!

পরীক্ষা শেষ হওয়ার আধঘণ্টা আগে অভির উত্তর লেখা শেষ হয়ে গেল। খুব যে ভালো লিখেছে তা নয়। তবে কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি জোর করে ঢুকিয়ে উত্তরটা সাত পাতা টেনেছে। সঙ্গে গোটা পাঁচেক ডায়াগ্রাম।

লেখালিখির পাট চুকিয়ে রিভিসন করতে বসে অভি। তিনটে লং কোয়েশ্চেন আর পাঁচটা শর্ট নোটের উত্তর পড়তে কুড়ি মিনিট সময় লাগল। এবার খাতা জমা দিতে হবে। হলঘর থেকে দেখা যাচ্ছে আকাশে আবার মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

‘শেষ?’ রিভাইস করতে করতে প্রশ্ন করল বৃন্দা।

‘হ্যাঁ’। উত্তরপত্রগুলো সুতো দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে অভি খেয়াল করল, একটা লুজ শিট সে ব্যবহার করেনি। এটা ম্যাডামকে ফেরত দেওয়া উচিত। আনসার শিট নিয়ে উঠতে যাবে, এমন সময় প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকালো! ‘বাবা গো!’ বলে বৃন্দা বাঁদিকে লাফিয়ে অভির ডান হাত চেপে ধরল।

‘ভ্যাট! ভিতু কোথাকার।’ বৃন্দার হাত ছাড়িয়ে লুজ শিটটার দিকে তাকায় অভি। অনেকদিন বাদে তার মাথায় আবার কবিতা আসছে। বিদ্যুতের মতো আচমকা, বৃষ্টিধারার মতো ঝমঝম করে। পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইনভিজিলেটাররা খাতা জমা নিতে ব্যস্ত। তার মধ্যে লুজ শিটে খসখস করে লিখতে থাকে অভি।

‘কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল।

কখন জলের মাঝে মেয়ে, মেঘের দু’গালে টলোমল…’

ঘোরের মধ্যে কবিতা লেখা শেষ করে অভি। মেঘ ও বৃষ্টির কারণে হলঘরে আলো অপ্রতুল। ছেলেমেয়েরা খাতা জমা দিতে দিতে গজল্লা করছে। চারজন ইনভিজিলেটার খাতা গোনাগুনিতে ব্যস্ত। এর মধ্যে লুজ শিটটা প্যান্টের পকেটে ঢোকায় অভি। আজ তার বুকে দুঃসাহস ভর করেছে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে টকাটক করে নামতে নামতে বৃন্দার পাশে চলে আসে সে। ক্যাজুয়ালি বলে, ‘হোস্টেলে ফিরবি তো?’

‘না। আগামী দু’দিন ছুটি। আজকের দিনটা বাড়ি থাকব।’ জড়োসড়ো হয়ে জবাব দেয় বৃন্দা। তারা দু’জন এখন গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আশেপাশে অন্য ছেলেমেয়েরা। চন্দন ইশারায় অভিকে ডাকছে।

‘এখন কি মেট্রো ধরবি? ছাতা আছে?’ প্রশ্ন করে অভি। বৃন্দার জড়োসড়ো থাকার কারণ সে বুঝতে পারছে না। পরীক্ষা ভালো হয়নি নাকি?

‘না…মানে…দেখি…’ অসংলগ্ন উত্তর দেয় বৃন্দা। অভি আর দেরি করে না। এইটাই আইডিয়াল টাইম। নিখুঁতভাবে ভাঁজ করা লুজ শিট বৃন্দার হাতে ধরিয়ে বলে, ‘এটা তোর জন্যে।’

বৃন্দা কিছু বলার আগে একটা কালো এসইউভি গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়ায়। জানলার কাচ সেন্ট্রাল লকের কেরামতিতে খুলে যায়। চালকের আসন থেকে স্যামি ব্যানার্জি বলেন, ‘বৃন্দা, উঠে আয়।’

লুজ শিট ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বৃন্দা গাড়িতে উঠে পড়ে। টিন্টেড গ্লাসের জানলা মসৃণভাবে উঠে যায়। গাড়িটা অভি ও তার ক্লাসমেটদের মুখের ওপরে ধোঁয়া ছেড়ে হুস করে চলে যায়।

.

বৃন্দা

কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল
কখন জলের মাঝে মেয়ে। মেয়ের দু’গালে টলোমল
স্বেদ, নাকি অশ্রু ছিল রাখা। জানি না, হয়নি বলে চাখা।
ধর্মতলাগামী বাসে চাকা, ফেটে গিয়ে এই গন্ডগোল।
স্বাদই অপূর্ণ না শুধু। নামটাও বাকি আছে জানা।
পদবি? তাতেও গরমিল। এ ছাড়াও জানি না ঠিকানা।
কিছুই জানি না বলে শোক, করার মতন কোনও লোক
নই আমি। তাই আজ থেকে, তার নাম বৃষ্টিদিন হোক।
এবং যে বহুতল জুড়ে, তার বাসা আটতলা জুড়ে,
ঠিকানা জানি না বলে তার, দিলাম ‘আকাশলীনা’ নাম।
এই চিঠি পোস্ট করলাম, মেঘপিওনের হাত দিয়ে।
ডাক-তার ব্যবস্থার কথা, এ বান্দার কিছু আছে জানা।
ফেরতা চিঠির জন্য তাই অপেক্ষা করব বিশদিন।
তার মধ্যে উত্তর না দিলে, মনোমতো উত্তর না পেলে…
তোমার দুয়ারে দিয়ে ঘা, (সমাজ টমাজ মানি না!)
চেঁচিয়ে গাইব, ‘ওলে ওলে!’
বাথরুমের আড়ালে বাথটাবের গায়ে হ্যালান দিয়ে বৃন্দা থম মেরে বসে রয়েছে। বুক ধড়াস ধড়াস করছে, দু’পায়ের ফাঁকে অন্যরকম ভালোলাগার শিরশিরানি হচ্ছে, একটু একটু হাসি পাচ্ছে। প্রথম দুটো লক্ষণ পরিচিত। কিন্তু হাসিটা কেন? নিজেকে নিয়ে কনফিউজড বৃন্দা। একটা ছেলেকে সে দীর্ঘদিন ধরে ছিপের গাঁথার চেষ্টা করেছে। ইশারা ইঙ্গিত করেছে, গোপন ও গূঢ় সিগন্যাল পাঠিয়েছে। ছেলেটা নিরীহ মুখ করে তাকে দেখেছে। বৃন্দার ধারণা ছিল, এইসব সিগনাল ছেলেটার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। একদিন এলএলটি-র পিছনের সিটে বসে চকাম করে চুমু না খেলে কিছুই বুঝবে না।

কিন্তু ছোকরা তো ছুপা রুস্তম! অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার মধ্যে এমন সুন্দর একটা প্রেমপত্তর লিখে ফেলল! জিও বস! নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় বৃন্দা। তার চয়েস আছে! এবং এতক্ষণে হাসির কারণ বুঝতে পারে সে। কবিতাটায় চমৎকার হিউমার আছে। অনেককাল আগে ‘ইয়ে দিল্লাগি’ নামে একটা হিন্দি সিনেমা রিলিজ করেছিল। তাতে কাজল, অক্ষয় কুমার আর সেফ আলি খান ছিল। তাতে একটা গানটা ছিল। ‘যব ভি কই লড়কি দেখে, মেরে দিল দিওয়ানা বোলে, ওলে ওলে ওলে।’

পুরোনো সেই গানের পাঞ্চ লাইন এই কবিতায় চমৎকার ঢুকিয়ে নিয়েছে অভি।

সিনেমার প্রসঙ্গ থেকে বাস্তবে ফেরে বৃন্দা। এতদিন কলেজের কেউ জানত না যে সে সার্জারির এইচওডি স্যামি ব্যানার্জির মেয়ে। অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার দিন এমন ঝড়বৃষ্টি হল যে, স্যামি তাকে গাড়িতে পিক আপ করতে বাধ্য হন। থিয়োরি পরীক্ষার তিনঘণ্টা সকলের মোবাইল ফোন সাইলেন্ট মোডে, ব্যাকপ্যাকে রাখা ছিল। উত্তরপত্র জমা দিয়ে, ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করে বৃন্দা দেখেছিল স্যামির মেসেজ, ‘ওয়েট অ্যাট দ্য ড্রাইভ ওয়ে। আই উইল বি দেয়ার।’

বৃন্দা না বলার সুযোগ পায়নি। অবশ্য না বললে স্যামি শুনতেন না!

গাড়ি বারান্দায় গাড়ি এসে দাঁড়ানোমাত্র এক লাফে গাড়িতে উঠেছিল বৃন্দা। সবাই দেখেছিল, গাড়ি কে চালাচ্ছেন। দুই আর দুইয়ে চার করতে কারও অসুবিধে হবে না।

এনিওয়ে! শ্রাগ করে বৃন্দা। কলেজে এক বছর হয়ে গেল। আজ আর এ সবে কিছু আসে যায় না। মুশকিল হল, অভি যে তাকে একটা কাগজ ধরাচ্ছে, এটা স্যামি দেখেছিলেন। গাড়ির কাচ তোলার পরে পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দেখি!’

ওই সামান্য সময়ের মধ্যে বৃন্দা দেখে নিয়েছিল যে, আনসার সিটে বাংলা হরফে কিছু একটা লেখা রয়েছে। তার ইনস্টিংক্ট বলেছিল, এটা স্যামিকে পড়তে দেওয়া যাবে না। কাগজটা হাতের ফাঁকে লুকিয়ে কোয়েশ্চেন পেপার স্যামির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে স্যামি বলেছিলেন, ‘এত ছোট কাগজ?’

‘ন্যাকামি কোরো না। তিনটে লং কোয়েশ্চেন আর পাঁচটা শর্ট নোটের জন্য কত বড় কাগজ লাগে? কোনও ”অথবা”-ও তো নেই। তুমি কোয়েশ্চেন সেট করো, আর তুমি জানো না?’

‘জানি। আমার মনে হয়েছিল ওই ছেলেটা তোকে বড় কোনও কাগজ দিচ্ছিল।’

‘কোন ছেলেটা?’ নিষ্পাপ বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল বৃন্দা।

‘গাড়িতে ওঠার আগে যে তোকে কাগজটা দিল!’

‘অভি?’ মনে মনে বাবার দৃষ্টিশক্তির তারিফ করতে করতে বৃন্দা বলেছিল, ‘আমার ঠিক পাশে ওর সিট পড়েছে। একদম ফ্রন্ট বেঞ্চ। একটাও কথা বলার স্কোপ পাচ্ছি না। আজ কোনও প্রবলেম হয়নি। ফিজিওলজির দিন আনকমন প্রশ্ন পড়লে কী যে হবে…’

লেখাপড়ার অলোচনা শুরু হয়ে যাওয়ায় স্যামি কাগজ প্রসঙ্গ ভুলে গিয়েছিলেন। শান্তিধামে ফিরে, বাথরুমে ঢুকে জিনসের পকেট থেকে আনসার শিট বার করেছিল বৃন্দা। পড়েছিল কবিতাটা।

তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র! একবার পড়েই মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। থেকে থেকেই আওড়াচ্ছে, ‘কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল…’

অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার রাত বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে হোস্টেলে চলে এসেছে বৃন্দা। আনলাকি তেরো নম্বর ঘরে দময়ন্তীর সঙ্গে একটানা পড়ে ফেলেছে ফিজিয়োলজির সব কটা চ্যাপ্টার। দময়ন্তীর সঙ্গে গ্রুপ স্টাডির ব্যাপারে বৃন্দার চমৎকার তালমিল হয়েছে। দুজনের পড়ার ধরন হুবহু এক। একজন একটা চ্যাপ্টার ধরছে আর সেই চ্যাপ্টারের লং কোয়েশ্চেন আর শর্ট নোটগুলো অন্যজনকে হোয়াইট বোর্ডে এঁকে এঁকে বোঝাচ্ছে। মুখস্থ বিদ্যার দৌড় আর ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস—দুটোই হয়ে যাচ্ছে। চ্যাপ্টার শেষ হলে বক্তা বদল হচ্ছে। দু’জনে মিলে পুরো ফিজিওলজি শেষ করতে দ্বিগুণ সময় লাগছে ঠিকই কিন্তু রিভিশন হচ্ছে সলিড। দু’দিনের ছুটি পুরোপুরি উশুল করছে বৃন্দা। শুধু মাঝেমধ্যে মাথার মধ্যে গুনগুনোচ্ছে, ‘কখন জলের থেকে মেয়ে, মেয়ের দু’গালে টলোমল…’

ফিজিওলজি থিয়োরি পরীক্ষার দিন সকালে ফুরফুরে মেজাজে ঘুম ভাঙল বৃন্দার। মোবাইলে সময় দেখল। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। গতকাল রাতে ফিজিওলজি কোর্স শেষ করে সে আর দময়ন্তী শুতে গিয়েছিল রাত দেড়টায়। আজ সকালে পড়ার জন্য কোনও টপিক রাখা নেই। খুশি মনে দময়ন্তীকে ঠেলা মারল বৃন্দা। মেয়েটা নড়ল না।

দময়ন্তী শুতে যাওয়ার আগে অ্যালোপাম খায়। বৃন্দা ক্যাজুয়ালি বুঝিয়েছে, এটা খেলে অ্যাডিকশান হয়। মেয়ে শোনার পাত্রীই নয়। রাতে শোওয়ার আগে ওষুধ না পেলে সদ্য হাঁটতে শেখা ছাগলছানার মতো তুড়ুক নাচন দেয়। গতকালও জিভের নীচে ওষুধ নিয়ে শুয়েছিল। এখন গাছের গুঁড়ির মতো পড়ে রয়েছে নিশ্চিন্ত, সিন্থেটিক ঘুমে। আবার খোঁচা মারে বৃন্দা, ‘ওরে! এবার ওঠ! পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে নেই নাকি?’

বৃন্দার দ্বিতীয় খোঁচার ফল হল উদ্ভট। দময়ন্তী ধড়মড়িয়ে খাট থেকে উঠে বসল। তার দু’চোখ বন্ধ, গুঙিয়ে উঠে দু’হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে দিল সে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ঘামে ভিজে গেছে রাতপোশাক।

ঘাবড়ে গিয়ে বৃন্দা বলল, ‘এ বাবা! তোর হলটা কী? পাগল হয়ে গেলি নাকি?’

‘কিছু না!’ নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে দময়ন্তী, ‘ওষুধের ঘুম তো! হঠাৎ ভেঙে গেলে ড্রামাটিক এফেক্ট হয়। তাছাড়া আমি একটা নাইট মেয়ার দেখছিলাম…’

‘দুঃস্বপ্ন? পরীক্ষার দিন সকালবেলা? কী দেখলি? সব কোয়েশ্চেন আনকমন?’

‘নাঃহ! এই স্বপ্নটা রেকারিং। খুব বৃষ্টি পড়ছে। আমি একটা বাজারের মধ্যে দিয়ে দৌড়োচ্ছি। আমাকে ধাওয়া করে আসছে সুরজ! আমি পালাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু পালাতে পারছি না…’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলে দময়ন্তী। বৃন্দা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কাঁদিস না। ওসব কথা ভুলে যা। স্নান করে নে।’

‘আমি ভুলতেই চাই। আমার ব্রেনের গভীরে ঘটনাটা এনক্রিপটেড হয়ে আছে। আমার সাবকনশাসে ঘটনাটার কোডিং করা আছে। অ্যালোপাম খেয়েও ডিলিট করতে পারছি না।’ দুঃখের হাসি হাসে দময়ন্তী। চোখের জল মুছে বলে, ‘বাথরুমে যাই। নাইটড্রেসটা কাচতে হবে। স্বপ্নের মধ্যে হিসি হয়ে গেছে।’

দময়ন্তী ঘর থেকে বেরোনো পর্যন্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল বৃন্দা। বন্ধুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। পাঁচ মিনিটের একটা ঘটনা দময়ন্তীর শরীরে এবং মনে কী সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছে! অ্যাংজাইটি কমানোর ওষুধ খেতে হচ্ছে, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে হচ্ছে, বিছানায় ছোট বাইরে করে ফেলতে হচ্ছে। ঘুম ভাঙার সময় যে ফুরফুরে মেজাজ ছিল, সেটা ঘেঁটে গেল। ভুরু কুঁচকে ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে, টাওয়েল কাঁধে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোল।

স্নানঘর ও বাথরুমের অপ্রতুলতা লেডি আর্চার্স হোস্টেলের বনেদি সমস্যা হলেও পরীক্ষার্থী ব্যাচ অগ্রাধিকার পায়। স্নান বা পটি করার ক্ষেত্রে অন্যরা লাইন ছেড়ে দেয়। পটির লাইনে দাঁড়িয়ে বৃন্দা দেখল তার সামনে জেমসি। বৃন্দাকে দেখে চোখ মেরে বলল, ‘সকাল বেলা ডেলিভারি ঠিকঠাক হলে পরীক্ষাও ঠিকঠাক হয়।’ বৃন্দা উত্তর না দিয়ে হাসল। পিছন থেকে শ্রীপর্ণা বলল, ‘বাবার মুখে শুনেছি, আর্মি ব্যারাকেও এই সমস্যা হয়। তবে জওয়ানদের লজ্জা নেই। তারা মাঠে বা জঙ্গলের মধ্যেই বসে পড়ে।’

‘কাঁহা গয়ে জওয়ান লোগ?’ সাবিনা বাথরুমের ভিতর থেকে চ্যাঁচায়। ‘ভেজ দেনা দো চারকো।’

‘অ্যাই! তুই বেরো তো!’ বিরক্ত হয়ে বৃন্দা বলে, ‘সকালবেলায় ব্যাটাছেলে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল।’

‘তাহলে কখন করব ডার্লিং? পরীক্ষা দিতে দিতে?’ ঝ্যাড়াং করে টয়লেটের দরজা খুলে বেরোয় সাবিনা। এক দৌড়ে স্নানঘরে ঢুকে যায়।

প্রাতঃকৃত্য সেরে, রুমে ঢুকে বৃন্দা দেখল, দময়ন্তী রেডি হয়ে গাইটনের মোটকা ফিজিওলজি বই খুলে হর্মোনের চ্যাপ্টার খুলে বসেছে। পোশাক বদলাতে বদলাতে বৃন্দা বলল, ‘কাল তো পড়লি। আবার কেন?’

‘মেনস্ট্রুয়াল সাইকলের সময় হর্মোনাল চেঞ্জটা একটু দেখছি।’

‘আর দেখতে হবে না।’ পোশাক পরে বৃন্দা রেডি। পরীক্ষার্থীদের তুলনায় সামান্য বেশি সাজগোজ হয়ে গেল আজ। চোখের কাজল একটু গাঢ়, ঠোঁটের রং হাফ শেড বেশি গোলাপি, চুলে একটু গর্জাস ক্লিপ, হিলটা এক ইঞ্চি বেশি উঁচু। আড়চোখে সাজগোছ দেখে দময়ন্তী বলল, ‘কী ব্যাপার?’

‘কীসের কী ব্যাপার?’ টেনসান টেনসান মুখ করে বলে বৃন্দা।

‘সাজগোজ কেন?’ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন দময়ন্তীর।

‘সাজগোজ? আর ইউ ম্যাড?’ প্রতিপ্রশ্ন বৃন্দার। দময়ন্তী শ্রাগ করে রুম থেকে বেরোল। পিছন পিছন বৃন্দা। এবার খাওয়াদাওয়া করতে হবে। একতলায় মেস চালায় ‘সঞ্জীবন’ নামের এনজিও। প্রতিবন্ধী মহিলাদের জন্য তৈরি সংস্থাটি সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর একতলার কফিশপটাও চালায়। সুপার রিনা দত্ত সঞ্জীবনকে গত পাঁচবছর ধরে গার্লস হোস্টেলের মেস চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। দশজন মেয়ে মিলে চমৎকার চালায়।

পরীক্ষার সময় সাত্ত্বিক আহারের আয়োজন করা হয়েছে। ভাত, সোনামুগের ডাল, ঝিরিঝিরি করে আলুভাজা, ট্যাংরা মাছের ঝাল। যে সব মেয়ে নিরামিষাশী, তাদের জন্য ছানার ডালনা। দ্রুত খাওয়া শেষ করে হোস্টেলে থেকে বেরোয় বৃন্দা। আজ যদিও আকাশ পরিষ্কার, কিন্তু স্যামি ব্যানার্জির হুকুম যে গাড়ি করে মেডিক্যাল কলেজ যেতে হবে। পরীক্ষার সময় নো রিস্ক।

গাইনি বিল্ডিং-এর সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক দেখে গাড়িতে ওঠে বৃন্দা। সঙ্গে দময়ন্তী। চারপাশ দেখার কারণ, তার ব্যাচের যদি কেউ এখন পাশ দিয়ে যায়, তাহলে বৃন্দা লিফট দেবে। যদিও এ বিষয়ে স্যামির কঠোর আপত্তি আছে। রুমমেট দময়ন্তী ছাড়া আর কাউকে গাড়িতে তোলা যাবে না, সুলতানকে এই অর্ডার দিয়ে পাঠিয়েছেন। সুলতান স্টিয়ারিং ধরে ন’মাসে-ছ’মাসে। মন্দিরার সুইফট ডিজায়ার চালায়। পরীক্ষার সময় সেই গাড়ি বৃন্দার জন্য সুলতান সমেত বরাদ্দ হয়েছে।

গাড়ি শেয়ালদা ফ্লাইওভারে উঠতে জানলার কাচ নামিয়ে দিল দময়ন্তী। বৃন্দাকে বলল, ‘কবিকোকিল বিদ্যাপতি সেতু কলকাতার কোথায় আছে বল তো?’

‘কোকিলের নামে ব্রিজ? যাঃ! ইয়ারকি দিচ্ছিস!’

‘শুধু কোকিল না ইডিয়েট! কবিকোকিল। আচ্ছা বল, বিদ্যাপতি সেতু কোথায় আছে?’

‘জানি না বাবা! বড়বাজার টড়বাজার হবে। ওখানে বহুত নন বেঙ্গলি থাকে।’

‘দূর গাধা! তুই যে ফ্লাইওভারটার ওপর দিয়ে যাচ্ছিস, তার নাম কবিকোকিল বিদ্যাপতি সেতু।’

‘শেয়ালদা ফ্লাইওভারের ভালো নাম কোকিল সেতু? দিঠি, আমি হাসতে হাসতে মরে যাব। কারা এইসব নাম দেয়? মাস্ট বি মিনিস্টার্স।’

‘না। এর জন্য একটা কমিটি আছে।’

‘কমিটি?’ হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে বৃন্দা, ‘নাম দেওয়ার জন্য কমিটি? তুই একবার ভেবে দেখ! মিটিঙে বসে একটা লোক বলছে, ”নিমতলা শ্মশান ঘাটের নাম আজ থেকে ড্রাকুলা সরনি হল। যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁরা হাত তুলুন।” উফ! মাগো!’

দু’জনের হাসাহাসির মধ্যে গাড়ি বাঁদিকে ঘুরেছে। ছবিঘর সিনেমা হল পেরিয়ে মহাত্মা গাঁধী রোড ধরে খানিকটা এগিয়ে সুলতান বলল, ‘কলেজ স্ট্রিট থেকে গাড়ি বাঁদিকে যাবে না কিন্তু।’

‘তুমি পূরবী সিনেমা হল থেকে বাঁদিকে নাও। পরের মোড়ে গিয়ে আবার বাঁদিকে টার্ন নাও। বউবাজারের মোড় থেকে বিবি গাঙ্গুলি স্টিট ধরো।’ বৃন্দা সুলতানকে রাস্তা বলে দেয়। সুলতান কিছুক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালায়। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পড়ে, দুপাশের গয়নার দোকান দেখতে দেঝতে বলে, ‘তুমি এত রাস্তা চিনলে কী করে? কলেজের পরে তোমার সোজা বাড়ি যাওয়ার কথা না?’

‘সুলতান চাচু, প্লিজ!’ বিরক্ত হয়ে বৃন্দা বলে, ‘আমি এখন কলেজে পড়ি।’

‘ভালো। সেটাই তোমার বাবাকে বলব তাহলে।’ ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিক্যাল কলেজের সামনে এসে বলে সুলতান।

‘ধ্যাত্তেরিকা! খুব খারাপ হবে বলে দিলাম!’ গাড়ি থেকে নেমে, দময়ন্তীর হাত ধরে হলের দিকে এগোয় বৃন্দা। পরীক্ষা শুরু হতে আর আধঘণ্টা বাকি।

প্রথম বেঞ্চির বাঁদিকে নিজের আসনে বসে রয়েছে অভি। বৃন্দা এখন মোটেই অভির দিকে তাকাবে না। একটু ‘ভাও’ খাওয়া ইম্পর্ট্যান্ট। পরে মনে হল, পরীক্ষার ঠিক আগে ছেলেটাকে টেনশান খাওয়ানোটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। ফ্রাস্টু খেয়ে বাজে পরীক্ষা দিয়ে ঝাড় খেলে বিপদ! ক্লিপবোর্ড বেঞ্চিতে রেখে অভির দিকে নিউট্রাল দৃষ্টি বিছিয়ে বৃন্দা বলল, ‘প্রিপারেশন কেমন?’

‘খারাপ না। ফিজিওলজি পড়তে আমার ভালো লাগে।’

‘দ্যাটস গুড। অ্যানাটমিতে প্রবলেম হয়েছিল নাকি?’

‘হ্যাঁ। একটা লং কোয়াশ্চেন আনকমন পড়েছিল। বাথরুমে গিয়ে চোথা দেখতে হল।’

‘বাববাঃ! তোর সাহস আছে।’

‘আরে! ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। রিস্ক না নিলে ঝাড় খেয়ে যেতাম,’ পাতলা হাসে অভি। বেঞ্চির দিকে তাকিয়ে একপর্দা গলা নামিয়ে বলে, ‘তোকে একটা কাগজ দিয়েছিলাম…’

ওফ! ছেলেগুলোর সবসময় ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড! কড়া গলায় বৃন্দা বলে, ‘পরে! ম্যাডামরা আসছেন।’

বৃন্দার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঢং করে ঘণ্টা পড়ল। চারজন ম্যাডাম লাইন দিয়ে হলঘরে ঢুকলেন। সবার বয়স চল্লিশের আশেপাশে। এঁরা পরস্পরের বন্ধু। আজ সন্ধেবেলা অ্যাকাডেমিতে কোনও একটা নাটক দেখতে যাবেন। তাই নিয়ে আলোচনা করছেন আর হাসছেন। ক্যাজুয়াল আবহাওয়ার মধ্যে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র বিতরণ শেষ হল। চারজনের মধ্যে দু’জন হলঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দু’জন চেয়ারে বসে গল্প করতে লাগলেন।

প্রশ্নপত্রের দিকে তাকাল বৃন্দা। মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের সময় হরমোনাল চেঞ্জ নিয়ে প্রথম লং কোয়েশ্চেন। দেখেই মাথা খারাপ হয়ে গেল। এটা শেষ করতে কমপক্ষে একঘণ্টা লাগবে। বাকি প্রশ্নগুলোয় দ্রুত চোখ বোলাল সে। হার্ট আর লাং নিয়ে লং কোয়েশ্চেন। শর্ট নোটে এসেছে ব্রেন, কিডনি, লিভার, প্যানক্রিয়াস আর ভিটামিন থেকে।

বাপ রে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃন্দা। আজকের পরীক্ষার মূল সমস্যা সময়। সে যা জানে, তার সবটা লিখতে গেলে ছ’ঘণ্টা সময় লাগবে। মনে মনে ছক কষে বৃন্দা। একশো নম্বরের জন্য বরাদ্দ একশো আশি মিনিট। অর্থাৎ পাঁচ নম্বরের শর্ট নোটের জন্য বরাদ্দ নমিনিট। আর পঁচিশ নম্বরের লং কোয়েশ্চেনের জন্য বরাদ্দ পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তাহলে কাঁটায় কাঁটায় তিনঘণ্টায় পরীক্ষা শেষ হবে। রিভিসনের জন্য কোনও সময় থাকবে না। লং কোয়েশ্চেনগুলো চল্লিশ মিনিটে নামালে হাতে পনেরো মিনিট সময় থাকবে।

এবার দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। লং কোয়েশ্চেন, না শর্ট নোট? কোনটা আগে লিখবে? বৃন্দা ঠিক করে, সব থেকে বড় উত্তর দিয়ে লেখা শুরু করবে। সেটা চল্লিশ মিনিটে শেষ করলে অনেকটা কনফিডেন্স পাওয়া যাবে। অতএব, মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের হর্মোনাল চেঞ্জ দিয়েই ফিজিওলজি পরীক্ষার উত্তর লেখা শুরু হোক।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর লেখা শেষ করে ঘড়ি দেখল বৃন্দা। পঞ্চাশ মিনিট লেগেছে। সে দশ মিনিট লেটে রান করছে। এবার ফুসফুসের বায়োমেকানিক্সে হাত দেওয়া যাক। এটায় লেখা কম। ডায়াগ্রাম বেশি। আশা করা যায় ঠিক সময়ে শেষ হবে।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর লেখা শেষ করে ঘড়ি দেখল বৃন্দা। চল্লিশ মিনিটে শেষ হয়েছে। এখনও সে দশ মিনিট লেটে রান করছে। তৃতীয় ও শেষ লং কোয়েশ্চেনে হাত দেওয়ার আগে সে এক পলক হলঘরটা দেখে নিল। সবাই ঘাড় গুঁজে খসখস করে লিখে যাচ্ছে। চারজন ম্যাডাম লুজ শিট বিতরণ করছেন। অভি মন দিয়ে হার্টের ছবি আঁকছে। ঠিক হ্যায়। বৃন্দাও এবার আঁকবে। ফিজিওলজি অব হার্ট লিখতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে।

তিনটে লং কোয়েশ্চেন লেখা শেষ করে আবার ঘড়ি দেখল বৃন্দা। এটা শেষ করতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। অর্থাৎ সে পনেরো মিনিট পিছিয়ে আছে। এই গতিতে চললে রিভিশান তো হবেই না, একটা শর্ট নোট বাদও পড়তে পারে।

মৃদু টেনশানের মধ্যেই ভিটামিনের শর্ট নোট লিখতে শুরু করে। এটা ন’মিনিটে নামাতেই হবে…

পাঁচটা শর্ট নোট পঁয়তাল্লিশ মিনিটে শেষ হওয়ার কথা। বৃন্দা শেষ করল চল্লিশ মিনিটে। পরীক্ষা শেষ হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। পাঁচ মিনিটে এই মহাভারত রিভিশন দেওয়া সম্ভব নয়। বৃন্দা তাই ডায়াগ্রাম আর চার্টগুলোয় চোখ বুলোল। বড় কোনও ভুল যেন না থাকে।

ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ম্যাডাম এসে অভি আর বৃন্দার হাত থেকে খাতা নিয়ে নিলেন। বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বৃন্দা বলল, ‘বাপরে! একশো মিটারের স্পিডে ম্যারাথন দৌড়োলাম। তোর পরীক্ষা কেমন হল?’

বিষণ্ণ চোখ তুলে অভি বলল, ‘মোটামুটি।’

অভির মুখচোখ দেখে সন্দেহ হল বৃন্দার। প্রশ্ন করল, ‘সব কোশ্চেনের উত্তর লিখেছিস তো?’

লাজুক মুখে অভি বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘এই নিয়ে আর ভাবিস না।’ অভির চুল ঘেঁটে দেয় বৃন্দা, ‘বাই দ্য ওয়ে, তোর কবিতাটা ভালো হয়েছে।’

বৃন্দার হাত সরিয়ে অভি বলল, ‘সমীরণ ব্যানার্জি তোর বাবা? আমি জানতাম না।’

‘জানলে কী হতো?’ বিরক্ত মুখে বলে বৃন্দা, ‘কবিতাটা আমায় দিতিস না?’

সুইফট ডিজায়ার সামনে দাঁড়িয়ে। দময়ন্তী অলরেডি পিছনের আসনে বসে। সুলতান কঠিন চোখে বৃন্দাকে দেখছে। দৃষ্টি উপেক্ষা করে বৃন্দা অভির হাত চেপে ধরে। হাত ছাড়িয়ে অভি বলে, ‘আর একটু বড় কবিতা লিখতাম।’

আগামী পরশু বায়োকেমিস্ট্রি থিয়োরি পরীক্ষার টেনশান মাথা থেকে উড়ে যায়। বৃন্দার পদক্ষেপ এখন হরিণীর ছন্দ। এক ছুট্টে গাড়িতে উঠে সে বলে, ‘চলো সুলতানচাচু।’ তারপর জানলা দিয়ে হাত বার করে চেঁচায়, ‘বাই! পরশু দেখা হচ্ছে।’

‘বাই!’ বিষণ্ণ মুখে হাত নাড়ছে অভি।

.

চন্দন

সকাল থেকে এটা তেইশ নম্বর। সিগারেট ধরিয়ে সময় দেখল চন্দন। রাত দশটা বাজে। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাত উপলক্ষ্যে চন্দন দুটো প্রতিজ্ঞা করেছিল। এক নম্বর, সারা দিনে কুড়িটার বেশি সিগারেট খাবে না। দু’নম্বর, রাত এগারোটার মধ্যে শুয়ে পড়বে। কোনও প্রতিজ্ঞাই রাখা যাচ্ছে না। ভিসেরা রিভিসন করা পুরো বাকি। আজ শুতে রাত দুটো বাজবে।

বায়োকেমিস্ট্রির রিটেন পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। ছাব্বিশে অগাস্ট। শনি-রবি ছুটির পরে, আগামিকাল সোমবার, ঊনত্রিশে অগাস্ট অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল।

থিয়োরি পরীক্ষা চন্দনের ভালো হয়েছে। সব সাবজেক্টেই অনেক নম্বর পাবে। গোল্ড মেডেল পাওয়াও অসম্ভব নয়।

এইসব হাই-ফাই চিন্তা শনিবার সন্ধে পর্যন্ত মাথায় ছিল। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার জন্য পড়তে বসে সোনার মেডেলের ভাবনা মাথা থেকে জাস্ট উড়ে গেছে। পাগল হয়ে যাওয়ার আগের ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে চন্দন সহ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের দেড়শোজন পরীক্ষার্থী।

অ্যানাটমি প্র্যাকটিকালের পাঁচটা ধাপ। প্রথম পর্ব অস্টিওলজি বা অস্থিবিদ্যা। এই পর্বে পরীক্ষক মানব শরীরের দুশো ছ’খানা হাড় টেবিল সাজিয়ে বসে থাকবেন। লম্বা একটা লাঠি টেবিলের ওপরে নাচাতে নাচাতে কোনও একটা অস্থি ছুঁইয়ে বলবেন, ‘এইটা নাও।’

সেই হাড় তুলে নিয়ে পরীক্ষার্থীকে ঠিকঠাক ভাবে ধরতে হবে। ঠিকঠাক ভাবে মানে, মানব শরীরে হাড়টি যেভাবে থাকে। ভুল ভাবে ধরলে একজামিনার বলবেন, ‘রেখে দাও।’ এবং আর কোনও প্রশ্ন না করে অস্টিওলজিতে শূন্য দেবেন। হাড় ঠিক ভাবে ধরলে শুরু হবে প্রশ্নবাণ।

ভিসেরা টেবিলে শরীরের সমস্ত আভ্যন্তরীন অঙ্গ সাজিয়ে বসে রয়েছেন পরের পরীক্ষক। একই কায়দায় ছড়ি ঘুরিয়ে তিনি বলবেন, ‘ওইটা ধরো।’ ব্রেন, হার্ট, লাং, লিভার, কিডনি, পুরুষ বা নারীর যৌনাঙ্গ—যা খুশি হতে পারে। ঠিক ভাবে ধরতে পারলে শুরু হবে প্রশ্নমালা। গোটা পনেরো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে পাস। না পারলে, সাপ্লিতে দেখা হবে!

এর পরে আসবে উইনডো ডিসেকশান, স্ট্রাকচার আইডেন্টিফিকেশান, সারফেস মার্কিং।

দেড়শোজনের পরীক্ষা শুরু হয়ে সকাল ন’টায়। শেষ হতে রাত ন’টা বেজে যায়। মধ্যেখানে টিফিন পর্বের জন্য আধঘণ্টার ছুটি। যদিও, পরীক্ষাপর্ব চোকানোর জন্য পরীক্ষার্থীরা এত উদগ্রীব থাকে যে খাওয়াদাওয়া ভুলে যায়।

তেইশ নম্বর সিগারেট থেকে চব্বিশ নম্বরটা ধরাল চন্দন। প্রবাল ফর্মালডিহাইড ভরতি বালতি থেকে হার্ট বার করে বলল, ‘এইটা দিয়ে শুরু করি?’

‘কর শালা!’ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল চন্দন।

ভিসেরা রিভাইস করা শেষ হল রাত সাড়ে বারোটায়। দরজার বাইরে রিপু সুর করে আওয়াজ ছাড়ছে, ‘টেনশান চাই? টেনশান? তিন টাকা কিলো!’ একটু থেমে থেমে, হোস্টেল কাঁপিয়ে। যেভাবে চৌকিদাররা আগেকার দিনে হাঁফ পাড়ত, ‘হুঁশিয়ার!’ বার তিনেক চেঁচানোর পরে হোস্টেলের সমস্ত রুমের দরজা খুলে গেল। প্রতিটি তলার প্রতিটি ঘর থেকে টেনশান-বিক্রেতার উদ্দেশে বাছাবাছা খিস্তি বর্ষিত হল। বাপ, মা, মাসি, বোন, ঊর্ধ্ব ও অধস্তন চোদ্দগুষ্টিকে লক্ষ্য করে বলা গালাগাল শুনে একলাফে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রিপু বলল, ‘নাঃ! সবাই ঠিকঠাক পড়াশুনা করছে। না হলে এত কুইক রেসপন্ড করত না।’

প্রবাল ভিসেরার বালতি খাটের তলায় ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘সারা হোস্টেলের খিস্তি না শুনলে তোমার চলছিল না?’

রিপু মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ভিসেরা পর্ব শেষ? তাহলে বালতিটা করিডোরে রেখে আয়। আর ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দে। চোখ জ্বালা করছে। এই শালা চন্দন! খেয়েছিস?’

‘না! সারফেস মার্কিং শেষ করে খেতে যাব।’ ডক্টর মিত্রর বই ওল্টাতে ওল্টাতে বলে চন্দন।

‘মারব পিছনে তিন লাথ!’ চন্দনের হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে রিপু বলে, ‘রাত সাড়ে বারোটার সময়েও না খেলে আর কখন খেতে যাবি? মেসের লোকগুলোও তো মানুষ, না কি?’

‘হ্যাঁ। ঠিক। কিন্তু…’ আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে চন্দন বলে।

‘এটা আজকের কত নম্বর?’ উপচানো অ্যাশট্রের দিকে তাকিয়ে রিপু প্রশ্ন করে।

‘একত্রিশ,’ টেবিলে রাখা তিনটে শূন্য ও একটি সদ্য খোলা সিগারেটের প্যাকেট দেখিয়ে বলে চন্দন।

‘ফোট শালা।’ টেবিল থেকে চারটে সিগারেটের প্যাকেট জানলা দিয়ে ফেলে দেয় রিপু। খাট জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অ্যানাটমির সমস্ত বই বন্ধ করে বলে, ‘সোজা খেতে যা। পনেরো মিনিটের মধ্যে খেয়ে এসে একটা অ্যালোপাম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। কাল আটটার সময় ঘুম থেকে উঠে পৌনে নটা পর্যন্ত সারফেস মার্কিং পড়বি। ইটস অ্যান অর্ডার।’

‘শেষ হবে না। ঝাড় খেয়ে যাব।’ থমথমে গলায় বলে চন্দন।

‘অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাতে জাগলে এমনিই ঝাড় খাবি। তার জন্য পরিশ্রম করতে হবে না। যা বলেছি শোন,’ চন্দনকে আবার ধমকায় রিপু। প্রবালকে বলে, ‘তুই আজ এ ঘরে শুয়ে যা। আমি একশো চব্বিশে শুচ্ছি। দেখি, অভি একা ও ঘরে কোন ড্রামা করছে।’

‘শালা! ফার্স্ট ইয়ারের স্নেহময় বাবা এলেন রে!’ রিপুকে আওয়াজ দেয় চন্দন।

‘আমাদের ব্যাচের একটা ছেলে অ্যানাটমি প্র্যাকটিকালের আগের রাতে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেছিল। আজ রাতে বাবা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। শুধু আমি নই। সব সিনিয়ররাই আজ ফার্স্ট ইয়ারের বাবা। তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়।’ নরম গলায় বলে রিপু। চন্দন বিছানা থেকে উঠে প্রবালকে বলে, ‘চল। খেয়ে আসি।’

প্রবাল বলল, ‘গা গুলোচ্ছে,’ তারপর বিকট জোরে ওয়াক তুলল। চন্দন অবাক হয়ে বলল, ‘কী হল রে?’ তারপর নিজে আরও জোরে ওয়াক তুলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোরের পাঁচিলে হড়হড় করে বমি করল। রিপু একশো চব্বিশে ঢুকতে যাচ্ছিল। থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘একত্রিশটা সিগারেটের ধোঁয়া এবার পেছন দিয়ে বেরোবে। যা, তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়।’

‘বমি করে শরীরটা ঠান্ডা হল,’ ভিজে চোখে বলল চন্দন, ‘অ্যালোপাম কোথায় রেখেছ?’

.

ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও ঘুম ভেঙে গেল সকাল সাতটায়। মাথা ভার। পেট ব্যথা। গা গুলোচ্ছে। টেনশানের চোটে জ্বর এসে গেছে। এই অবস্থায় পরীক্ষা দেবে কী করে? বিছানায় শুয়ে ঠিক আধমিনিট ভাবল চন্দন। তারপর তড়াক করে উঠে পড়ল। শরীর খারাপ তাড়ানোর উপায় সে ছকে ফেলেছে।

দাঁত মাজা, দাড়ি কামানো, বড় বাইরে এবং স্নান মিলিটারি দ্রুততায় শেষ করল। ভিজে গামছা পরে রুমে ঢুকে প্রবালকে ঘুম থেকে তুলল। সে ব্যাটা কিছুক্ষণ উঁ-আঁ করতে করতে আড়মোড়া ভালো। তারপর স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে বিছানা থেকে উঠে বলল, ‘সারফেস মার্কিং?’

প্রবালকে পাত্তা দিল না চন্দন। জামা-প্যান্ট-জুতো পরে রেডি হয়ে মেসে গেল। সকালে উৎপলদা লুচি আর আলুর তরকারি করেছে। দুর্ভাবনা মাথা থেকে তাড়িয়ে পনেরোটা লুচি খেল। তার ব্যাচের অন্যরা দুটো লুচিও খাচ্ছে না। সকলেই ওয়াক তুলছে। পেট ভরতি জলখাবার খেয়ে চারটে রসগোল্লা নিল চন্দন। টপাটপ মুখে পুরে এক বোতল জল খেল। আহঃ! শান্তি।

সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠতে উঠতে সে খেয়াল করল, পেট ব্যথা আর গা গুলানো ভাব একদম চলে গেছে। জ্বোরো ভাব আর মাথাব্যথা অল্প হলেও আছে। একশো পঁচিশে ঢুকে নিজের ব্যাগ হাঁটকে একটা অ্যান্টাসিড আর একটা ব্যথার বড়ি বার করে টপাং করে মুখে ভরল। প্রবাল এর মধ্যে স্নান করে রেডি। সে বলল, ‘চল, শুরু করি।’ চন্দন বলল, ‘আগে খেয়ে আয়।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রবাল ব্রেকফাস্ট করে ফিরে এল। পঁচিশটা সারফেস মার্কিং-এর মধ্যে দশটা চন্দন বেছে রেখেছে। এই দশটা প্র্যাকটিস করতে ন’টা বেজে যাবে। বাকি পনেরোটা রিভাইস করা হবে না। কিছু করার নেই। আড়চোখে ঘড়ি দেখল সে। সাতটা পঁয়তাল্লিশ।

দশটা সারফেস মার্কিং রিভিশন করে আবার ঘড়ি দেখল চন্দন। আটটা পঁয়তাল্লিশ। পনেরো মিনিট সময় আছে। আরও পাঁচটা বেছে নিল। ঝড়ের গতিতে শুরু হল রিভিশন। চারটে শেষ হয়েছে, এমন সময় দরজায় ঠকঠক। বাইরে থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় অভি বলছে, ‘পৌনে ন’টা বাজে।’

দড়াম করে চৌরাসিয়ার বই বন্ধ করল চন্দন। প্রবালকে বলল, ‘আমি চললাম।’

‘আর পড়বি না? হোম সেন্টারে পরীক্ষা। পনেরো মিনিট আগে বেরোনোর কী আছে?’ অবাক হয়ে বলে প্রবাল।

‘আর পড়ব না। সাপ্লি না পেলে বাকি জীবনে অ্যানাটমি বইও ছোঁব না।’ বইয়ের বান্ডিল টেবিলে সাজিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় চন্দন।

.

ব্যাগে পরীক্ষা সংক্রান্ত হাবিজাবির পাশাপাশি এক লিটারি বোতলে ওআরএস আর গ্লুকোজ গোলা এনার্জি ড্রিঙ্ক রাখা রয়েছে। সেটায় চুমুক দিতে দিতে চন্দন দেখল, বৃন্দা আর দময়ন্তী আসছে। পরীক্ষা হোক বা সুনামি, মেয়েদের সাজগোজে কখনওই ভাঁটা পড়ে না। আজ দু’জনে বরং একটু বেশিই সেজেছে। চন্দন দময়ন্তীকে প্রশ্ন করল, ‘এত সাজগোজ? ফ্যাশান শো আছে নাকি?’

‘আছে,’ দময়ন্তীর হয়ে বৃন্দা জবাব দেয়। ‘ভাইভায় কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে, মেঝেতে রুমাল ফেলে দিয়ে রুমাল তোলার অজুহাতে বুক দেখাতে হবে না? আমরা দুজনেই পুশআপ ব্রা পরে এসেছি।’

‘ভ্যাট!’ লজ্জা লজ্জা মুখে পরীক্ষা হলে ঢোকে চন্দন।

ডিসেকশানে রুমে শ্রাদ্ধবাড়ির পরিবেশ। একদিকে পরপর পাতা বেঞ্চিতে ছেলেমেয়েরা বসে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্রত্যেকের বাবা-মা মারা গেছেন। ডিসেকশান রুম জুড়ে, দূরে দূরে তিনটে টেবিল পাতা আছে। শ্রাদ্ধবাড়ির কায়দায় টেবিলের ওপরে সাদা কাপড় পাতা। প্রথম টেবিলে একগাদা হাড় রাখা। দ্বিতীয় টেবিলের পাশে বালতিতে রাখা ফর্মালডিহাইডে চোবানো ভিসেরা। তৃতীয় টেবিলে একগাদা কার্ড রাখা। রুমের অন্য প্রান্তে পাঁচটা ডিসেকশান টেবিল। তার ওপরে চারটি সদ্য ব্যবচ্ছেদ করা মৃতদেহ রাখা। দুটি পুরুষ ও দুটি মহিলা। পঞ্চম টেবিলটি খালি। খালি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে এনজি কালুয়াকে নিচু গলায় ধমক দিচ্ছেন। পরীক্ষার টেনশান ভুলে চন্দন কান পাতল।

‘ক্যাডাভার কোথায় গেল?’ গলা না তুলে কালুয়াকে প্রশ্ন করছেন এনজি।

‘জানি না স্যার।’

‘আবার মিথ্যে কথা? গতকাল রাতে কতজন স্টুডেন্ট ক্যাডাভার দেখতে এসেছিল?’

‘কেউ আসেনি স্যার।’

‘মারব গালে তিন থাপ্পড়। উইনডো কার্ড আর বডি দেখানোর জন্য স্টুডেন্ট পিছু কত টাকা নিয়েছিস? এক কথায় উত্তর দে। না হলে আমি এন্টালি থানায় খবর দেব।’

‘থানার ভয় দেখাবেন না স্যার। পুলিশরা ডোমেদেরও ভয় পায়। বেশি ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করলে দু-চারটে পচা লাশ থানার সামনে রেখে আসব। বদবু-র চোটে পুলিশের বাচ্চারা আবার মায়ের পেটে ঢুকে যাবে।’

‘ঠিক আছে। পুলিশের ভয় দেখাচ্ছি না। কাঁটাপুকুর মর্গে কতগুলো নতুন ছেলে ক্যাডাভার নিয়ে কাজ করছে। অ্যানাটমিও ভালো শিখেছে। কম্পিউটার চালাতে জানে। সুপারইনটেনডেন্ট ডক্টর রেবতী পট্টনায়েককে বলে ওদের এই কলেজের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসি?’

যে কালুয়া পুলিশকে ভয় পায় না, সে অন্য ডোমের কথা শুনে হাতজোড় করে এনজিকে বলল, ‘পেটে লাথি মারবেন না স্যার। যা জিজ্ঞেস করবেন বলে দেব।’

‘কাল আর পরশু রাত মিলিয়ে কজনকে বডি দেখিয়েছিস?’

‘একশো তিরিশ জন।’

‘প্রত্যেকের কাছে কত করে নিয়েছিস?’

‘পার হেড একশো স্যার।’

চন্দন শুনে চমকে উঠল। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাতে ক্যাডাভার দেখা খুব পুরনো প্র্যাকটিস। পড়াশুনোয় ভালো ছেলেমেয়েরাও এই চক্কর থেকে বেরোতে পারে না। সাপ্লি পাবে নিশ্চিত, অথবা পাস করার ব্যাপারে সুপার কনফিডেন্ট—দুই দলই একবার মড়া ছুঁয়ে যায়। গত দু’দিনে কালুয়ার নিট ইনকাম তেরো হাজার টাকা। চন্দন অবশ্য আসেনি। রিপু বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘ফালতু লফড়ায় যাসনি। সময় নষ্ট। ঘরে বসে গাঁতিয়ে মুখস্থ কর।’

‘বডি দেখতে দেওয়া এক জিনিস আর আস্ত বডি বাইরে পাঠানো অন্য জিনিস। এই ক্যাডাভারটা কে নিয়ে গেছে?’

‘কেউ নেয়নি স্যার।’

‘আস্ত একটা মড়া হাঁটতে হাঁটতে ডিসেকশান রুম থেকে বেরিয়ে গেল? ইয়ার্কি হচ্ছে?’ এনজির গর্জনের মধ্যে ডিসেকশান হলের বাইরে দময়ন্তীর চিৎকার শোনা গেল, ‘এই তো! আমাদের ক্যাডাভার এসে গেছে!’

এনজি আর কালুয়া দৌড়ে ডিসেকশান হল থেকে বেরোল। দেখল দরজার সামনে একটা তিনচাকার ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ওপরে খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া একটা লাশ। ভ্যানওয়ালা বলছে, ‘কে তুলবে গো? আমাকে আবার যেতে হবে। শেয়ালদা স্টেশানে ট্রেনে কাটা পড়া দুটো বডি আছে।’

কালুয়া একলাফে এসে ক্যাডাভারটা চ্যাংদোলা করে তুলে ডিসেকশান হলে ঢুকে গেল। এনজি এতক্ষণ এইসব কারবার দেখছিলেন। এইবার দময়ন্তীকে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কোথা থেকে এল?’

উত্তর দেওয়ার আগে দময়ন্তীর মোবাইল বেজে উঠল। এনজির পিছনে দাঁড়িয়ে চন্দন খেয়াল করল, ফোনকর্তার নাম দেখে দময়ন্তীর মুখচোখ কুঁচকে গেছে। অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ফোন ধরল সে। ওদিক থেকে কী কথা দময়ন্তীর কানে ঢুকছে, চন্দন শুনতে পেল না। তবে দময়ন্তীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তার কানে গরম সিসে ঢালা হচ্ছে। এনজিকে টপকে দময়ন্তীর কাছে এসে চন্দন বলল, ‘কী হয়েছে রে? কে ফোন করেছে?’

‘তুমি ভেতরে যাও। তোমাকে পাকামো করতে হবে না।’ চন্দনকে ধমক দিলেন এনজি। চন্দন দময়ন্তীর পাশ থেকে নড়ল না। মেয়েটা ভয়ংকর আপসেট হয়ে পড়েছে। চোখমুখ থেকে আতঙ্ক ঠিকরে বেরোচ্ছে।

এনজি দময়ন্তীকে প্রশ্ন করলেন, ‘বডিটা কাগজচাপা দেওয়া ছিল। তা সত্ত্বেও তুমি কী করে জানলে, ওটা বেওয়ারিশ লাশ নয়, পরীক্ষার ক্যাডাভার?’

দময়ন্তী চুপ।

‘তুমিই কি ক্যাডাভারটা গত সন্ধ্যায় ডিসেকশান রুম থেকে হোস্টেলে নিয়ে গিয়েছিলে? কালুয়া এর জন্য কত টাকা নিয়েছে?’

‘না স্যার। আমি এসব করিনি। আমি সন্ধেবেলা ক্যাডাভার দেখতেও আসিনি। কালুয়াকে কোনও টাকাও দিইনি।’ আঁতকে উঠে বলে দময়ন্তী।

‘তাহলে তুমি কী করে জানলে যে এটা ক্যাডাভার? কে তোমাকে ফোন করেছিল?’ এনজি চিৎকার করে উঠলেন।

এনজির জেরার সামনে দময়ন্তী থরথর করে কাঁপছে। এনজি পিছন ফিরে কালুয়াকে বললেন, ‘তুই বলবি না? কাকে বডি সাপ্লাই করেছিলি?’

‘না স্যার।’ সোজা উত্তর কালুয়ার। ‘পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে, এটা বলে দিলাম। কিন্তু স্টুডেন্টের নাম বলতে পারব না। বাওয়াল হয়ে যাবে।’

‘তুমিও বলবে না?’ সামনের দিকে ফিরে দময়ন্তীকে প্রশ্ন করলেন এনজি।

‘না স্যার,’ দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে দময়ন্তী বলে, ‘অসুবিধে আছে।’

‘ওকে! পরীক্ষা শুরু হোক।’ শ্রাগ করে ভিতরে ঢুকে গেলেন এনজি। চন্দনের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হেসে দময়ন্তী বলল, ‘অ্যানাটমির সাপ্লিটা কনফার্মড হল।’

‘চল। ভিতরে চল।’ দময়ন্তীর হাত ধরে ডিসেকশান হলে ঢোকে চন্দন। এতক্ষণের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে সে ভুলে গিয়েছিল যে আগামী দশ-বারো ঘণ্টা প্রবল টেনশানের মধ্যে কাটবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে হানড্রেড পার্সেন্ট পারদর্শীতা দেখাতে হবে। মনে মনে নিজেকে বিচার করে চন্দন। জ্বরজ্বর ভাব, মাথা ভার, পেট ব্যথা, গা গুলানো—কিছুই আর নেই। এক চুমুকে হাফ বোতল এনার্জি ড্রিংক শেষ করে সে বেঞ্চিতে বসল। এনজি এবার নাম ডাকবেন।

পরীক্ষা শুরু হতেই টেনশান কমে গেল। এনজি যখন ডাকলেন, ‘চন্দন সরকার অ্যান্ড বৃন্দা ব্যানার্জি,’ তখন কোনও অনুভূতি হল না। কোনওরকমে পা টানতে টানতে প্রথম টেবিলে পৌঁছল।

সময় সংক্ষিপ্ত করার জন্য একজামিনাররা দু’জনের পরীক্ষা একসঙ্গে নিচ্ছেন। তা বলে প্রশ্ন কমন পড়ার কোনও আশা নেই। বরং বিপদ অনেক বেশি। যেমন শুরুতেই হল। অস্টিওলজির টেবিলে এনজি বললেন, ‘হাড় তোমরা বেছে নাও।’

বৃন্দা চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন বৃন্দার দিকে। কে কোনটা ভালো পড়েছে, কে কোনটায় দুর্বল—ধারণা নেই। বৃন্দা হালকা হেসে পেলভিক গার্ডল তুলে নিল।

পেলভিক গার্ডল অর্থাৎ শ্রোণীচক্র। খুবই কঠিন এবং দুরূহ এলাকা। চন্দন মনে মনে বৃন্দার চয়েসের প্রশংসা করল। এটা কোনওরকমে উতরে দিতে পারলে বাকি পরীক্ষায় এই এলাকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকবে না।

পেলভিক গার্ডল বৃন্দা অ্যানাটমিকাল পোজিশানে ধরে আছে। এনজি চন্দনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঠিক ধরেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আইলিয়াক ক্রেস্ট কোনটা?’

চন্দন দেখাল।

‘গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাসের অরিজিন, ইনসারশান, নার্ভ সাপ্লাই এবং ফাংশান বলো।’

চন্দন বলল। এনজি বললেন, ‘এবার তুমি ধরো।’ চন্দন বৃন্দার হাত থেকে পেলভিক গার্ডল নিজের হাতে নিল। এনজি বৃন্দাকে বললেন, ‘পুডেনডাল নার্ভের ব্রাঞ্চ এবং সাপ্লাই বলো।’ বৃন্দা নিখুঁত উত্তর দিল। প্রশ্নোত্তরের খেলায় আলোচনাটা পেনিসে এসে পৌঁছেছে। এনজি বৃন্দাকে প্রশ্ন করলেন, ‘পেনিসের লেংথ বলো।’

‘ফ্ল্যাসিড অবস্থায় দশ ইঞ্চি আর ইরেকটেড অবস্থায় পনেরো ইঞ্চি।’ হাসি মুখে উত্তর দিল বৃন্দা।

টেবিলের তলা দিয়ে চন্দন বৃন্দার থাইয়ে চিমটি কাটার চেষ্টা করল। মেয়েটা সেন্টিমিটার আর ইঞ্চি গুলিয়ে ফেলে কেলেঙ্কারিয়াস জবাব দিয়েছে!

বৃন্দার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে এনজি বললেন, ‘আমি ঘোড়ার পেনিসের লেংথ জিজ্ঞাসা করিনি। মানুষের পেনিসের লেংথ জিজ্ঞাসা করেছি।’

বৃন্দা অবাক হয়ে চন্দনের দিকে তাকাল। সে এখনও নিজের ভুল বুঝতে পারেনি। চন্দনের পেট ফেটে হাসি আসছে। হাসি চেপে কোনওরকমে বলল, ‘তুই মেজারিং ইউনিট ভুল বলেছিস। ওটা ইঞ্চি নয়। সেন্টিমিটার হবে।’

‘ও মাই গড!’ লজ্জায় দু’হাতের মধ্যে মুখ লুকোয় বৃন্দা। এনজি বলেন, ‘নেক্সট টেবিলে যাও।’ চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে চন্দন বুঝতে পারে, বৃন্দার লালচে গাল দেখে তার লিঙ্গোত্থান হচ্ছে! সেন্টিমিটার বদলে যাচ্ছে ইঞ্চিতে!

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা ঘোরের মধ্যে কাটল। একের পর এক টেবিল, নতুন একজামিনার, নতুন প্রশ্নের সেট, নতুন উত্তরমালা… মেশিনের মতো পরীক্ষা দিল চন্দন।

শেষতম টেবিল সারফেস মার্কিং। আবার চন্দন আর বৃন্দার কম্বিনেশান। বৃন্দা চন্দনকে বলল, ‘ঝাড় খাওয়াবে না তো?’ চন্দন বলল, ‘পেনিসের লেংথ সেন্টিমিটারের বদলে ইঞ্চিতে বলার জন্য যদি এনজি যদি তোকে ঝাড় দেয়, তাহলে ঘোড়ার পেনিস এনজির পিছনে ঢোকাব!’

‘চুপ কর! এনজি আসছে। আমাদের শেষ পরীক্ষাটাও এনজিই নেবেন।’

এনজি ফিরে এসে টেবিলে বিছানো কার্ডের দিকে দেখিয়ে চন্দনকে বললেন, ‘তোলো।’ চন্দন ভয়ে ভয়ে কার্ড তুলল। আজ সকালে রিভিশন না করা কোনও স্ট্রাকচার যদি আঁকতে দেয়? দম আটকে কার্ড ওল্টাল সে। আর্টারিয়া ডরসালিস পিডিস। যাক! কমন পড়েছে। অ্যানাটমি পরীক্ষাটা ভালোয় ভালোয় উতরে গেল তাহলে।

‘কে আঁকবে?’ প্রশ্ন করলেন এনজি।

‘আমি।’ জবাব দিল বৃন্দা।

‘আঁকো। আমি ততক্ষণে চন্দনের ভাইভা নিয়ে নিই।’ পড়া ধরা শুরু করলেন এনজি।

কাঁটায় কাঁটায় সন্ধে সাড়ে সাতটায়, পাঁচ মিনিটের ওরাল পরীক্ষার পরে চন্দন বুঝতে পারল, সে পরীক্ষায় পাস করে গেছে। শুধু তাই নয়, হয়তো ভালো নম্বরও পেয়েছে। ডিসেকশান হল থেকে বৃন্দাকে নিয়ে বেরোতে বেরোতে খেয়াল করল, এখনও পনেরো জনের পরীক্ষা চলছে। তাদের মধ্যে দময়ন্তী আছে। ভিসেরা টেবিলে দময়ন্তীকে ব্রেন ধরিয়ে এনজি শক্ত শক্ত প্রশ্ন করছেন।

আপাতত ওসবে মন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বৃন্দাকে চন্দন বলল, ‘তুই হোস্টেলে থাকবি না বাড়ি যাবি?’

‘হোস্টেলে থাকব। পরশু ফিজিওলজি প্র্যাকটিকাল। এখন কেউ বাড়ি যায়?’

‘তা ঠিক। চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’ প্রস্তাব দেয় চন্দন। শুনে হালকা হেসে বৃন্দা বলে, ‘তার কোনও দরকার নেই। তুই ড্যাম টায়ার্ড। হোস্টেলে গিয়ে রেস্ট নে।’

মাথা চুলকোয় চন্দন। সিগারেট ধরায়। স্যামি ব্যানার্জির মেয়েকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। নতুনগ্রাম থেকে অনেক লড়াই করে কলকাতা শহরে এসেছে। বনগ্রামের শেয়ালরাজা কলকাতা শহরে আপাতত চুনোপুঁটি। চুনোপুঁটি স্ট্যাটাসকে রাঘব বোয়ালে বদলাতে গেলে শুধু পড়াশুনো দিয়ে হবে না। একটু ঠেকনা চাই। একটু ব্যাকিং। স্যামি ব্যানার্জির মেয়ে সোশ্যাল ক্লাইম্বিং-এর জন্য আইডিয়াল। মইয়ের প্রথম ধাপ।

শাহরুখ খানের কায়দায় বাঁহাত দিয়ে চুল ঠিক করে চন্দন বলে, ‘তোর কোনও দরকার না থাকতে পারে। কিন্তু আমার আছে।’

‘রিয়্যালি?’ খিলখিলিয়ে হাসছে বৃন্দা। ‘তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে প্রোপোজ করবি। সেইরকম কোনও ছক নেই তো?’

হুশহুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে চন্দন বলে, ‘যদি থাকে?’

‘থাকলে সেটা কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দে।’

চন্দন আর পারল না। বৃন্দার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ক্যান্টিনে আপ্পুদির র‌্যাগিং-এর হাত থেকে যেদিন তুই আমায় বাঁচিয়েছিলি…’

‘কর্ন জোহরের সিনেমার ডায়ালগ দিস না চন্দন। হোস্টেলে যা। হাত ছাড়।’

‘ছাড়ব না। আজ একটা হেস্তনেস্ত জবাব চাই। না হলে হোস্টেলে গিয়ে পড়ায় মন বসবে না।’ বৃন্দার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে চন্দন।

বৃন্দা ঘুরে দাঁড়ায়। তার চোখে ধকধক করছে রাগ। ঠোঁটের কোণে ঝিকমিক করছে হাসি। ক্যাজুয়ালি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলল, ‘অনেকরকম জবাব হয়। যেমন, ”আমায় ভুলে যা চন্দন। আমি তোর যোগ্য নই। তোর জন্যে অনেক ভালো ভালো মেয়ে অপেক্ষা করে আছে।” অথবা, ”আমি তোকে ঠিক ওইভাবে দেখি না রে চন্দন! উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস।” অথবা, ”আমার একটা শারীরিক সমস্যা আছে। আমাকে ভালোবেসে তুই কোনওদিন সুখী হবি না”। অথবা, ”আমি একজনকে ভালোবাসি রে!” কোন উত্তরটা শুনতে চাস বল।’

‘সত্যিটা।’

‘বেশ। শোন তাহলে।’ গভীর শ্বাস ছেড়ে বৃন্দা বলে, ‘আমি অভিকে ভালোবাসি।’

চন্দন কিছুক্ষণ বৃন্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁটের ফাঁক থেকে পোড়া ফিল্টার নিয়ে রাস্তায় ফেলে বুট দিয়ে মাড়ায়। অবশেষে বলে, ‘বুঝলাম। চল তোকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। এটাতে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবি না?’

‘নাঃ!’ শ্রাগ করে এগোয় বৃন্দা। তার পাশে চন্দন।

.

দময়ন্তী

‘আমার নাম যদি বলিস, তা হলে লাশ ফেলে দেব। কোনও মাই কা লাল কিছু করতে পারবে না। কিপ ইট ইন মাইন্ড।’ ঝড়ের গতিতে কথাগুলো বলে ফোন কেটেছিল সুরজ। দময়ন্তীর মনে হয়েছিল, তার কান দিয়ে গলানো সিসে ঢুকছে। এনজির প্রশ্নের উত্তরে কোনও কথা বলেনি। ক্যাডাভার কে গায়েব করেছে জানা সত্ত্বেও চুপ করে ছিল।

সুরজ পড়াশুনায় ভালো। কিন্তু বড়লোকি চাল ষোল আনার ওপরে আঠেরো আনা। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাতে সবাই একবার বডি দেখে, এই খবর শুনে কালুয়াকে বলেছিল, ‘আমিও দেখব। তবে চোরের মতো চুপিচুপি অ্যানাটমি বিল্ডিং-এ ঢুকতে পারব না। কালুয়া, তুই একটা ক্যাডাভার বয়েজ হোস্টেলে পাঠিয়ে দে।’

‘হোস্টেলে? পাগল নাকি?’ সুরজের কথা উড়িয়ে দিয়েছিল কালুয়া।

‘পাঁচ মিনিটের জন্য তোর রেট কত?’ মুচকি হেসে প্রশ্ন করেছিল সুরজ।

‘একশো টাকা।’

‘হোল নাইটের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেব। রাজি?’

‘রাজি।’ টাকার গন্ধে সঙ্গে সঙ্গে রাজি কালুয়া। রাত্তিরবেলা বডি কোন পথ দিয়ে হোস্টেলে সুরজের রুমে ঢুকবে, সকালে কীভাবে ডিসেকশানে রুমে ফেরত আসবে—এইসব প্ল্যানিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা সুবিধে এই যে, সুরজ এখন অ্যানেক্স ব্লকের গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকে। এদিকে সুইপার ঢোকার একটা ছোট গেট আছে। রাতের বেলা সুরজের রুমে ক্যাডাভার পৌঁছে দিলে কেউ খেয়াল করবে না। এখন সব রুম থেকেই কড়া ফর্মালডিহাইডের গন্ধ আসছে। গন্ধ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।

প্ল্যানমাফিক রাত দশটার সময় কালুয়া তিনচাকার ভ্যানে ক্যাডাভার নিয়ে অ্যানেক্স ব্লকের সুইপার ঢোকার গেটের সামনে এসে সুরজকে ফোন করেছিল। সুরজের রুমমেট সঞ্জয় ত্রিপাঠি। সুইপার ঢোকার দরজা দিয়ে ক্যাডাভার কাঁধে নিয়ে কালুয়া যখন ঢুকল, সঞ্জয় বলল, ‘বিক্রম অওর বেতাল মনে পড়ে যাচ্ছে।’

‘চুপ বে!’ সঞ্জয়কে ধমকে দুটো কাঠের টেবিল জুড়ে ক্যাডাভার রাখার ব্যবস্থা করে সুরজ। নিজের টাকা পকেটে ভরে কালুয়া বলে, ‘এন্ট্রি ভালোয় ভালোয় হল। এক্সিটও তাই হলে ভালো হয়। হেডু হারামি আছে।’

‘শোন বে!’ কালুয়াকে বলে সুরজ, ‘সকাল ছ’টা নাগাদ অন্য একটা ভ্যানওয়ালাকে পাঠিয়ে দিবি। এক ভ্যানওয়ালাকে দিয়ে দুবার কাজ করালে লোকটা গেস করবে যে কিছু ঘাপলা আছে। নতুন ভ্যানওয়ালাকে বলবি সুইপার ঢোকার গেটের বাইরে ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখতে। ওইখান দিয়ে তুই ঢুকে আমার ঘর থেকে বডি নিয়ে যাবি। আমি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করব না। রাতে বডি দেখা হয়ে গেলে কাগজ চাপা দিয়ে রাখব। অ্যানেক্স ব্লকের সবাই রাতজাগা পার্টি। সকাল ছ’টায় কেউ ঘুম থেকে উঠবে না।’

প্ল্যান ফুলপ্রূফ হলেও ঘেঁটে গেল তিনটে কারণে। এক নম্বর কারণ, হাতে কাঁচা টাকা পেয়ে কালুয়া বেশি মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে আটটায়। দু’নম্বর কারণ, হাতের কাছে নতুন বডি পেয়ে সুরজ আর সঞ্জয় মিলে উইনডো ডিসেকশান আর স্ট্রাকচার আইডেন্টিফিকেশান প্র্যাকটিস করল রাত দুটো পর্যন্ত। মোবাইলের অ্যালার্ম দুজনেরই ঘুম ভাঙাতে পারেনি। তাদেরও ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে আটটায়। তিন নম্বর কারণ, কালুয়ার মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল।

সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠে সুরজের পাগল পাগল অবস্থা। চান করবে, খাবে, জামাকাপড় পরবে? না কি ক্যাডাভার পরীক্ষা হলে পাঠাবে? কালুয়াকে ফোন করলে বলছে, ‘মোবাইল ইজ সুইচড অফ।’ নতুন ভ্যানওয়ালা সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে পিছনের গেটে দাঁড়িয়ে। সে রেগেমেগে চলে যাচ্ছিল। একশো টাকা দিয়ে সুরজ ম্যানেজ করল। লোকটা সুরজের অনুরোধে ক্যাডাভার ভ্যানে তুলে নিয়েছে। কিন্তু অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে বডি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গাঁইগুঁই করছে। বলছে, ‘কোথায় যেতে হবে জানি না। ওখানে কেউ না থাকলে আমাকে মড়া নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে। আমার সঙ্গে একজন লোক দিন।’

এই সময়ে সুরজের মাথায় দময়ন্তীর নাম ঝিলিক দেয়। তাদের ব্যাচে এই একটাই মেয়ে আছে, যে তাকে দেখলে কুঁকড়ে যায়। প্যান্ট-শার্ট গলাতে গলাতে দময়ন্তীকে ফোন করে সুরজ।

‘বল।’ ওদিক থেকে বলে দময়ন্তী।

‘তুই এখন কোথায়?’

‘পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। কেন?’

‘অ্যানাটমি বিল্ডিং-এর সামনে?’

‘হ্যাঁ। কেন?’

‘ভ্যানরিক্সায় চড়ে একটা ক্যাডাভার ডিসেকশান হলের দিকে যাচ্ছে। কালুয়াকে ডেকে বডিটা হলে ঢুকিয়ে নে।’ ভ্যানওয়ালার পিঠে চাপড় মেরে অ্যানাটমি বিল্ডিং-এর দিকে ইশারা করে সুরজ। ‘ভ্যানওয়ালাকে পঞ্চাশ টাকা বখশিস দিয়ে ফুটিয়ে দিস। ওকে কেউ যেন জিজ্ঞাসা করতে না পারে যে বডিটা কোথা থেকে নিয়ে এল।’

‘এই তো! আমাদের ক্যাডাভার এসে গেছে!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে ফোন কেটে দেয় দময়ন্তী।

মহা হারামি মেয়েছেলে তো! এইরকম ভাইটাল টাইমে ফোন কাটছে। আবার ফোন করে সুরজ। ওপ্রান্তে এখন নানারকম চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। ক্যাডাভার অলরেডি পৌছে গেছে কি? রিস্ক না নিয়ে সুরজ বলে, ‘আমার নাম যদি বলিস, তা হলে লাশ ফেলে দেব। কোনও মাই কা লাল কিছু করতে পারবে না। কিপ ইট ইন মাইন্ড।’

.

ভাইভা টেবিলে এনজির শক্ত শক্ত প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে হতাশ লাগছিল দময়ন্তীর। সে বুঝতে পারছিল অ্যানাটমিতে সাপ্লি নাচছে। কিন্তু আশায় মরে চাষা। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল, প্রিপারেশান ভালোই আছে। পরের টেবিলের উত্তর ঠিক দিলে ঝাড় নামাতে পারবে না। সো, চিন আপ! স্পাইন স্ট্রেট! গিভ ইট আ শট!

একের পর এক টেবিলে ভাইভা দিতে দিতে দময়ন্তী বুঝতে পারছিল, ভালো প্রিপারেশন বলে কিছু হয় না। পাস বা ফেল নির্ভর করে এক্সামিনারের ইচ্ছের ওপরে।

এনজি খুব রেলিশ করে পরীক্ষা নিলেন। ভিসেরাতে দিলেন ব্রেন। অস্টিওলজিতে ভার্টিব্রা বা কশেরুকা। দু’জায়গার থেকেই ব্রেনের অ্যানাটমিতে ঢুকে গেলেন। উইনডোতে দময়ন্তীর ভাগে পড়ল ‘কিডনি ফ্রম ব্যাক’। মোটামুটি উতরে দিল। স্ট্রাকচার আইডেন্টিফিকেশানে ‘অ্যান্টিরিয়ার ট্র্যাঙ্গেল অব দ্য নেক’ থেকে ক্যারডিট আর্টারি দিলেন এনজি। তারপর ব্রেনের ব্লাড সাপ্লাইতে চলে গেলেন।

সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম, ব্রেন, স্পাইনাল কর্ড—এই সব জায়গা এমন অতল সমুদ্র, যেখানে সাঁতার শিখে লাভ হয় না। সারফেস মার্কিং-এ যখন তার কপালে জুটল ট্রাইজেমিনাল নার্ভ, তখন দময়ন্তী ফেল করার ব্যাপারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর।

হোস্টেল ফিরে পড়তে বসেনি দময়ন্তী। স্নান করে গা থেকে ফর্মালডিহাইডের গন্ধ তুলেছে। যদিও সে জানে, তিনমাস বাদে সাপ্লি পরীক্ষার আগে আবার তাকে ক্যাডাভার আর বোন সেট, গ্রে আর ডক্টর মিত্র, কানিংহ্যাম আর গ্রে-জ অ্যানাটমি নিয়ে রাতের পর রাত জাগতে হবে।

কাপ্রি আর টি-শার্ট পরে, গায়ে গন্ধ ছড়িয়ে বৃন্দাকে দময়ন্তী বলল, ‘কী খাবি?’

বৃন্দা ফিজিওলজির বই নামিয়ে ফেলেছে। অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ‘খিদে নেই।’

একটা অ্যালোপাম জিভের তলায় রেখে দময়ন্তী বলল, ‘আমারও নেই।’

.

ফিজিওলজি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা চমৎকার উতরে দিল দময়ন্তী। ভাইভায় পিএম-এর শক্ত প্রশ্নের হেলায় উত্তর দিল। এবারে বায়োকেমেস্ট্রি প্র্যাকটিকাল। তা হলেই দিন কয়েকের জন্য ছুটি।

বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের দিন সন্ধেবেলা দাঁড়ে বসে একা একা চা খাচ্ছিল দময়ন্তী। রিভিশন মোটামুটি শেষ। কঠিন দুটো চ্যাপ্টারে একবার চোখ বোলাবে। এ ছাড়া কিছু পড়ার নেই। বৃন্দাকে ডেকেছিল চা খেতে। সে আসেনি। মোবাইলে মায়ের সঙ্গে গপপো করছে।

‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম!’ দময়ন্তীর পাশে বসে ঘোষণা করল বিলু। ‘পরের লাইন বল।’

‘দেরে দেরে দেরে।’ জবাব দেয় দময়ন্তী।

চা-ওয়ালা বলে, ‘এত তাড়া দিলে হবে না। দুমিনিট ওয়েট করতে হবে। আরও খদ্দের আছে।’

বিলু হ্যাহ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘সুকুমার রায় আজও কত প্রাসঙ্গিক দেখেছিস?’

‘আগামিকাল বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল। তুমি এখন পাগলা দাশুর মতো বিহ্যাভ কোরো না তো!’

‘বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় পাস করাটা কোনও ব্যাপার না। আরতী ম্যাডামকে খুশি রাখিস। তাহলেই পাস।’

‘এএমকে খুশি রাখা কি চাট্টিখানি কথা? তার তো কথায় কথায় মুড সুইং হয়।’

‘ও সব বাদ দে। অ্যানাটমি পরীক্ষার দিন কী একটা বাওয়াল হয়েছে শুনলাম।’

‘তোমায় কে বলল?’ চমকে উঠে দময়ন্তী।

‘বেফালতু চাপ নিস না তো!’ বিরক্ত হয়ে বিলু বলে, ‘তোদের ব্যাচের সুরজ হারামিটাকে দেখলেই তুই ট্যান খাস। ঠিক কি না?’

‘হ্যাঁ।’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় দময়ন্তী, ‘আমি হয়তো এনজিকে নামটা বলে দিতাম। কিন্তু অন্য একটা কথা ভেবে বললাম না। বিগার পিকচারটা দেখতে পাচ্ছ?’

‘খুব ভালো পাচ্ছি। সুরজ ন্যাবাপার্টির সেক্রেটারি। মোচাপার্টির গাম্বাটগুলো ছাড়া বাকি সবাই বুঝতে পারছে, যে আগামী বিধানসভা ইলেকশানে জনমোর্চার সরকার পড়বে। সন্দীপ সামন্তর বদলে মৃন্ময় চ্যাটার্জি মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কলেজে মোচাপার্টির ছাত্র সংগঠন থাকবে কি না সন্দেহ। ফিউচার লিডারকে তুই চটাতে চাইছিস না।’

‘জলের মতো এক্সপ্লেন করলে। তুমিই বলো, এই পরিস্থিতিতে আমি অন্য কী করতে পারতাম?’

‘জানি না…’ পরপর তিনটে ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলে বিলু, ‘কোন পরিস্থিতিতে কে কী করবে, সেটা ডিপেন্ড করে তার ব্যক্তিত্বের ওপরে। ব্যক্তিত্ব শব্দটা ভেগু-ভেগু। তোর আপ বিংগ্রিং, তোর মরাল ফাইবার, তোর কনসায়েন্স-সব মিলিয়ে ওটা তৈরি হয়। আমি এই পরিস্থিতিতে পড়লে এনজিকে বলে দিতাম যে সুরজ আমাকে থ্রেট করছে।’

‘ভেগু-ভেগু কথা তুমি বললে। সুরজ তোমাকে মলেস্ট করেনি, তাই তুমি কখনও আমার অবস্থান বুঝতে পারবে না। ফিজিকালি এবং মেন্টালি অ্যাসল্টেড হওয়া কাকে বলে তুমি কোনওদিনও জানতে পারবে না। অন্তত এই জন্মে না।’

‘ঠিক।’ পোড়া ফিল্টার টুসকি মেরে ফেলে বিলু বলে, ‘মোচাপার্টি দেখলি, ন্যাবাপার্টিও দেখলি। একবার আমাদের দলের অন্দরটা দেখবি না কি?’

‘প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম? পিএমএফ?’ চায়ের ভাঁড় ফেলে দিয়ে দময়ন্তী বলে, ‘পলিটিক্স ইজ দ্য লাস্ট রেসর্ট অব স্কাউন্ড্রেলস। আমি আর যাই হোই না কেন, স্কাউন্ড্রেল নই। সরি বিলুদা, রাজনীতি আমার জন্য নয়।’

‘আমাকে তোর স্কাউন্ড্রেল মনে হয়?’ চায়ের দাম মিটিয়ে জানতে চায় বিলু।

‘অন্য সময়ে হয় না। যখন রাজনীতির কথা বলো তখন মনে হয়।’

‘ঠিক হ্যায়।’ শ্রাগ করে বিলু, ‘কাল পরীক্ষার পরে কী প্রোগ্রাম?’

‘বাড়ি যাব। এখান থেকে দশ পা দূরে বাড়ি। পরীক্ষার চক্করে এক হপ্তা যাওয়া হয়নি।’

‘আমি তোর জন্য ওয়েট করব। রোম্যানো স্যান্টোসে পেটপুজো করে তোকে ছেড়ে দেব।’

‘তুমি খাওয়াবে না আমি?’

‘লেটস গো ডাচ।’

‘ওলন্দাজগিরি ফলিও না। তুমি নেমন্তন্ন করেছ, তুমি খাওয়াবে। তা না হলে আমি জাস্ট নেই।’

‘আচ্ছা। তাই হবে।’ হতাশ হয়ে আবার শ্রাগ করে বিলু।

‘কী ব্যাপার বলো তো? যা বলছি তাতেই রাজি হয়ে যাচ্ছ? প্রোপোজ করবে নাকি?’ রহস্যময় গলায় জানতে চায় দময়ন্তী। ‘তা হলে কিন্তু লাল গোলাপ, হার্ট শেপেড বেলুন, চকোলেট, টেডি বিয়ার—এইসবও চাই।’

‘ফোট শালা!’ দময়ন্তীকে চাঁটি মারে বিলু। ‘হোস্টেলে গিয়ে পড়াশুনা কর। কাল পাঁচটা নাগাদ ফোন করব।’

.

বায়োকেমেস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল নিয়ে কারো কোনও টেনশান নেই। হোস্টেলে ফিরে দময়ন্তী দেখল জেমসি, সাবিনা আর শ্রীপর্ণা মিলে সিঁড়িতে বসে অন্ত্যাক্ষরী খেলছে। তাদের পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠল দময়ন্তী। তেরো নম্বর রুমে ঢুকে দেখল, বৃন্দা এখনও মোবাইলে গুজগুজ করছে।

‘ওরে, এতক্ষণ মোবাইলে কথা বলার বদলে মাথাটা পরমাণু চুল্লিতে ঢুকিয়ে বসে থাক। আরও সহজে ব্রেন ক্যানসার হবে।’

‘ব্রেন টিউমারের সঙ্গে মোবাইলের বিকিরণের সম্পর্কটা বিজ্ঞানীদের অনুমান। এস্ট্যাব্লিশড কোনও ফ্যাক্ট নয়।’ ফোন কেটে বলে বৃন্দা। ‘কার্বোহাইড্রেট পড়া কমপ্লিট? কাল আরতী ম্যাডাম কিন্তু ক্রেবস সাইকল ধরবেনই।’

‘কথা ঘোরাস না। এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলি?’ বৃন্দাকে চেপে ধরে দময়ন্তী।

‘অভি।’ ফোন রেখে বলে বৃন্দা।

‘অভি? এত ছেলে থাকতে অভিজ্ঞান?’ মুখ ব্যাঁকায় দময়ন্তী। ‘টিপিক্যাল বয় নেক্সট ডোর চেহারা। কোনও হট হাংক পেলি না? টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম…’

‘পেয়েছিলাম। সুরজ। তবে শুনেছি ছোকরা সুবিধের নয়।’ টিপ্পনি কাটে বৃন্দা।

দময়ন্তী এই বিষয়ে আর একটাও কথা না বলে বায়োকেমিস্ট্রি বই খুলে পড়তে বসে যায়। বৃন্দা দময়ন্তীর বই বন্ধ করে বলে, ‘বই পড়ে কোনও লাভ নেই। আয়, আমরা হোয়াইট বোর্ডে ফেল্ট পেন দিয়ে বিভিন্ন সাইকলগুলো আঁকা প্র্যাকটিস করি।’

‘আচ্ছা।’ অনিচ্ছের সঙ্গে খাট থেকে উঠল দময়ন্তী।

.

বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে দিতে দময়ন্তীর মনে হচ্ছে, গতকাল বৃন্দার ডিসিশান ঠিক ছিল। নানান শক্ত কেমিকাল রিঅ্যাকশান, ক্যাটাবলিজম, অ্যানাবলিজম, মেটাবলিজম, এনজাইম, ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাটের স্ট্রাকচার মনে রাখার একমাত্র উপায় প্র্যাকটিস। আঁকো এবং বলো। বলো এবং আঁকো।

প্রথমে প্র্যাকটিকাল, পরে ভাইভা। প্র্যাকটিকালে দময়ন্তীর পড়েছে প্রস্রাবের প্রোটিন নির্ণয়। সেটা করা খুব সোজা। অসুবিধে হবে ভাইভা নিয়ে। প্রোটিন থেকে অ্যামাইনো অ্যাসিডের ঠিকুজি-কুলুজিতে ঢুকে যাবেন পরীক্ষক। এএম-কে আসতে দেখে অ্যাপ্রনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ায় দময়ন্তী।

‘কী ছিল তোমার?’

‘ডিটেকশান অব প্রোটিন ইন ইউরিন। এই যে!’ র‌্যাকে রাখা টেস্ট টিউব দেখায় দময়ন্তী।

‘ডিম সেদ্ধ!’ মুখ ব্যাঁকান এএম। ‘তুমি বরং আমাকে এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিডের নামগুলো টপাটপ বলে ফেলো।’

চোখ বন্ধ করে দময়ন্তী উগরোতে থাকে।

পরবর্তী আধঘণ্টা দময়ন্তীর ওপরে অত্যাচার চালালেন এএম। প্রোটিন থেকে ডিএনএ এবং আরএনএ। তার থেকে জেনেটিকস। তার থেকে জেনেটিক ডিজিজ— সব জিজ্ঞাসা করলেন। ওয়াটসন ক্রিক মডেল পর্যন্ত দময়ন্তী উতরে দিয়েছিল। ডাউনস সিনড্রোম নিয়ে প্রশ্ন শুরু হতে তোতলাতে শুরু করল। তবে বুঝে গেল, পাস করে যাবে।

প্র্যাকটিকাল চুকল সাড়ে তিনটের সময়। লাফাতে লাফাতে হোস্টেলে ঢুকল দময়ন্তী। বাড়ি ফিরতে হবে।

পুরো লেডিজ হোস্টেল জুড়ে সাজো সাজো রব। ফার্স্ট ইয়ারের সমস্ত মেয়ে আজ বাড়ি ফিরবে। জেমসির দিল্লির ফ্লাইট সন্ধে সাড়ে সাতটায়। সে এর মধ্যে একটা ট্যাক্সি ডেকে ফেলেছে। সাবিনার নেপালের ফ্লাইট আটটার সময়। সে জেমসির সঙ্গে যাবে। শ্রীপর্ণার বাবা আর্মির লোক। তিনি ব্যারাকপুর থেকে জিপ নিয়ে চলে এসেছেন। বৃন্দার সুইফট ডিজায়ারও সুলতান সহ রেডি। লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সামনে এখন অটোমোবাইল একজিবিশান চলছে।

দময়ন্তীর তাড়াহুড়ো নেই। তেরো নম্বর রুমে ঢুকে সে প্রথমে বিছানা পরিষ্কার করল। ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি বইগুলো ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে ন্যাপথালিন ছড়িয়ে বন্ধ করল। অ্যানাটমি বইগুলো টেবিলেই রাখল। নিজেকে ধোঁকা দিয়ে কী লাভ? এক মাস পরেই আবার এদের নিয়ে বসতে হবে। ফর্মআলডিহাইডে চোবানো ভিসেরার বালতি আগেই কালুয়াকে ফেরত দেওয়া হয়ে গেছে। ঘরে তাও হালকা ফর্মআলডিহাইডের গন্ধ। ফুলমতিয়াকে ডেকে ফিনাইল দিয়ে ঘর মোছাল দময়ন্তী। ঝুল ঝাড়াল। সারা ঘরে হাড়গোড় ছড়িয়েছিল। সেগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঢুকিয়ে আলমারি বন্দী করল। নিজের আর বৃন্দার বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় বদলে ফ্রেশনার ছড়াল। জানলার পর্দা খুলে ফুলমতিয়াকে কাচতে দিল।

বৃন্দা স্নান করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে ঘরের চেহারা দেখে থ। অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার রে? এ যে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি! হঠাৎ ‘মার ঝাড়ু মার’ মোডে চলে গেলি কেন?’

‘আমরা সিনিয়ার হয়ে গেলাম। গ্র্যাভিটি বলে একটা কথা আছে তো!’ গম্ভীর গলায় বলে দময়ন্তী।

‘ফেল করি আর পাস করি, সিনিয়ার বলে কথা।’ দ্বিগুণ গম্ভীর গলায় দময়ন্তীকে নকল করে বৃন্দা। তার কথায় ধ্বস খেয়ে দময়ন্তী বলে, ‘অ্যানাটমিতে ঝাড়টা সিওর হয়ে গেল। আবার ওইসব পড়তে হবে ভেবেই কান্না পাচ্ছে।’

‘রেজাল্ট না বেরোনো পর্যন্ত তুই ফেল করিসনি।’ নিজের বইপত্র আর হাড়গোড় ট্রাঙ্কে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে বৃন্দা, ‘বাড়ি গেলে কাকু-কাকিমা যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ”পরীক্ষা কেমন হয়েছে?” বলবি, ”ভালো হয়েছে।” কেন বল তো?’

‘কেন?’ জানতে চায় দময়ন্তী।

ন্যাপস্যাক কাঁধে তুলে বৃন্দা বলে, ‘আমির খান কোন একটা সিনেমায় ডায়ালগ দিয়েছিল, ‘এক্সাম আচ্ছা ইয়া বুরা নহি হোতা হ্যায়। রেজাল্ট আচ্ছা ইয়া বুরা হোতা হ্যায়।’ আমি কাটছি। তোকে ড্রপ করে দেব নাকি?’

বৃন্দার রসিকতায় মুচকি হাসল দময়ন্তী। বলল, ‘নাঃ! আমি একটু পরে বেরোব। তুই যা।’

‘ওকে বেবি! বাই!’ হাত নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বৃন্দা। দময়ন্তী মোবাইলে সময় দেখে। পৌনে পাঁচটা বাজে। পাঁচটায় বিলুর ফোন করার কথা। কী বলবে কে জানে!

বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে দময়ন্তী। ফার্স্ট ইয়ারের সবাই হোস্টেলে থেকে চলে গেছে। বিকেলবেলা স্নান করার জন্য কোনও লাইন নেই। দীর্ঘক্ষণ স্নানের বিলাসিতা দেখানো যেতেই পারে। স্নান সেরে রুমে ফিরে আবার মোবাইলে সময় দেখল দময়ন্তী। পাঁচটা দশ। বিলুর দুটো মিসড কল রয়েছে। ওয়েট করুক!

ভেবেচিন্তে পোশাক বাছল দময়ন্তী। কালো জিনস। গোলাপি টি-শার্ট। টি-শার্টে চে গেভারার মুখ আঁকা। চুলে পনিটেল করে, পায়ে গোলাপি-কালো রঙা কনভার্স শু গলিয়ে, গায়ে ডিও ছড়িয়ে ব্যাকপ্যাক তুলে নিল। ব্যাকপ্যাক বেশ ভারী। এতে একগাদা নোংরা কাপড়জামা আছে। বাড়ি গিয়ে কাচতে হবে।

লেডি আর্চার্স হোস্টেল থেকে বেরোতে না বেরোতে আবার বিলুর ফোন। ‘তুই কোথায়? আমরা রোম্যানো স্যান্টোসে অপেক্ষা করছি।’

‘আমরা?’ বিরক্ত হল দময়ন্তী। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রতিপ্রশ্ন করল, ‘আমরা মানে কারা? তোমার প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরামের লোকজন?’

‘হ্যাঁ।’ অম্লানবদনে বলে বিলু, ‘সব্যসাচীদা আছে। আর একজন আছেন। তুই চিনিস না। তাড়াতাড়ি আয়। ওঁকে দূরে ফিরতে হবে।’

‘না এলে?’ বিরক্ত হয়ে বলে দময়ন্তী। পলিটিক্স করা ছেলেগুলো সত্যিই খুব ঘাগু হয়।’

‘না এলে অ্যানাটমিতে ঝাড় খাওয়াটা সিওর।’

‘আর এলে?’

‘ফিফটি—ফিফটি। তোর হয়ে মুভ করার জন্য কাউকে পাশে পাচ্ছিস। ভেবে দেখ।’

‘আমি আসছি।’ ফোন কাটে দময়ন্তী। অ্যানাটমি বই না ছোঁওয়ার জন্য সে নরকে যেতেও প্রস্তুত। আর এ তো সামান্য পলিটিকস।

রোম্যানো স্যান্টোস ঢুকে দময়ন্তী দেখল, কোণের টেবিলে বসে বিলু, সব্যসাচী আর মাঝবয়সি একটা লোক দুটো স্যুপ নিয়ে তিনজনে মিলে ভাগ করে খাচ্ছে। লোকটার পোশাক-আসাক, হাবভাব বলে দিচ্ছে এ কলকাতা শহরের বাসিন্দা নয়। দময়ন্তী ফাঁকা চেয়ারে বসতে বিলু বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই, ইনি গোপাল নস্কর। আমাদের পার্টির স্টেট কমিটির সেক্রেটারি। অনেক দূর থেকে এসেছেন। গোপালদা, এ হল দময়ন্তী সেনগুপ্ত আর্চার। আমাদের কলেজের মেয়ে। সদ্য ফার্স্ট এমবি দিল। ওকে নিয়েই ঘটনাটা ঘটেছিল।’

গোপালকে নমষ্কার করে দময়ন্তী বিলুকে বলল, ‘তোমাদের পার্টি মানে কী? তোমরা তো পিএমএফ-এর সদস্য।’

‘ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি,’ কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছে সব্যসাচী, ‘গণ সংগঠন এবং পার্টি সংগঠন—দুটো আলাদা জিনিস। রাজনৈতিক দলের নাম ”নবযুগ পার্টি”। তাদের ছাত্র সংগঠনের নাম ”নবযুগ ছাত্র সংগঠন”। যাদের তোরা ”ন্যাবা” বলিস। পার্টির নাম ”জনমোর্চা”। ছাত্র সংগঠনের নাম ”ছাত্রমোর্চা”। যাদের তোরা ”মোচা” বলিস। জাতীয়তাবাদী পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ”ছাত্রদল”। যাদের ”ছেঁদো” বলা হয়। ঠিক তেমনই মেডিক্যাল ফ্রন্টে আমাদের গণসংগঠনের নাম ‘প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম’ বা ”পিএমএফ”। কিন্তু মাদার পার্টির নাম ‘ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি’ বা ”আইপিপি”।’

ওয়েটার স্যুপের বোল দিয়ে গেছে। তাতে নুন ঢালতে ঢালতে দময়ন্তী বলল, ‘আমাকে এইসব বলে হেজিও না। আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। অ্যানাটমিতে পাস করা নিয়ে কী বলছিলে বলো।’

দময়ন্তীর হাত থেকে নুনদানি নিয়ে বিলু বলে, ‘ওরেব্বাস! নুনদানিটা হেবি দেখতে! স্ট্যাচু অব লিবার্টির মিনি সংস্করণ! মশাল থেকে নুন পড়ছে।’

সব্যসাচী বলল, ‘ইউএসএ। হোয়্যার লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু।’

‘নিকোনার পাররার কবিতা,’ স্যুপে চুমুক দিয়ে বলে দময়ন্তী। বিলু আর গোপাল মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। সব্যসাচী বলে, ‘তোর কী মনে হয়, ইন্ডিয়া একটা লিবারাল দেশ?’

‘ওয়েল…’ ভুরু কুঁচকে ভাবে দময়ন্তী, ‘লিবারাল’ শব্দটা এসেছে ল্যাটিন ”লিবার” থেকে। যার মানে ”ফ্রি”। আমরা প্রায়ই বলি, ভারতবর্ষ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। অ্যাতো বড় গণতন্ত্রে ফ্রি স্পেসের জায়গা আছে কিনা, এই নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’

”কেন? শুরুটা তো ভালোই হয়েছিল।’ দময়ন্তীকে উশকে দেয় সব্যসাচী, ‘সংবিধানের প্রণেতা বি আর আম্বেদকার লিবারাল ছিলেন, স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল সি রাজা গোপালাচারি লিবারাল ছিলেন, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু লিবারাল ছিলেন। এইসব এলিটিস্ট নেতারা ফ্রি ইন্ডিয়া নিয়ে ভাবেননি?’

‘ওইটাই তো বিপদ। ওই এলিটিজিম। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ, স্বাধীন চিন্তার আসল মানেটা ওপর থেকে নিচুতলায় আসেনি। এলিট থেকে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে যায়নি। তুমি আমাকে ‘বুর্জোয়া লিবারাল’ বললে আমি তোমাকে ‘আর্মচেয়ার মার্কসিস্ট’ বলতে পারি। তুমি আমাকে ‘সিউডো সেকুলার’ বললে আমি তোমাকে ‘রিলিজিয়াস ফ্যানাটিক’ বলতে পারি। শব্দের বিরুদ্ধে শব্দ চলুক। কিন্তু গায়ের জোর নয়। লিগাল রাইটস কেড়ে নেওয়া নয়। জেলে ঢোকানো নয়। রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা নয়। তাহলে আর লিবার্টি থাকে না।’

‘আমাদের ‘ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি’ একটি নিষিদ্ধ দল। বর্তমান সরকার একে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করেছে।’ শান্তভাবে বলেন গোপাল। ‘আমরা কোনও লোককে খুন করিনি, রাষ্ট্রবিরোধী কোনও কথা বলি না। তাও।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে বলে দময়ন্তী।

‘জনমোর্চা সরকার হেলথ হাব তৈরির জন্য এক হাজার একর জমি এক সাহেবকে বিনি পয়সায় দান করছে। ওই জমিতে আটশোটি পরিবারের দু’হাজার বাসিন্দা থাকে। কোনও পুনর্বাসন ছাড়া সব জমি সরকার নিয়ে নিয়েছে। আমি নিজে ওই এলাকায় থাকি। আমিও বাস্তুচ্যুত হতে চলেছি। ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি এর বিরোধিতা করেছে। অর্থাৎ আমরা সরকারের বিরোধিতা করেছি। তাই আমরা রাষ্ট্রদ্রোহী।’

ওয়েটার চিকেন ড্রামস্টিক দিয়ে গেছে। সেদিকে হাত না বাড়িয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আপনারা মিডিয়ার কাছে যাচ্ছেন না কেন?’

‘গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা সাহেবের তৈরি হেলথ হাবের খবরে বেশি ইন্টারেস্টেড। গরিব মানুষরা হেডলাইন হলে কাগজের বিক্রি কমে যাবে।’

গোপাল নস্করকে এতক্ষণ মূর্খ এবং গ্রাম্য বলে মনে হচ্ছিল দময়ন্তীর। ধারণা বদলাল। স্যুপ শেষ করে সে বলল, ‘আমাকে এখানে ডেকে এনে মগজ ধোলাই করার কারণ কী? আমি আদ্যন্ত অ্যাপলিটিক্যাল পার্সন। কলেজে ঢুকেছি ডাক্তারি পড়তে। রাজনীতি আমার কাপ অফ টি নয়।’

‘তোর টি-শার্টে যে লোকটার ছবি আঁকা আছে, সেও ডাক্তার ছিল। স্টেথোস্কোপ না বন্দুক—কোনটা হাতে নেবে, এইরকম একটা ক্রুশিয়াল মোমেন্ট তার জীবনে এসেছিল। লোকটা বন্দুক তুলে নিয়েছিল।’ সব্যসাচী কঠিন মুখে দময়ন্তীকে বলে।

‘কথায় কথায় চে-কে টেনে আনা আমার পছন্দ নয়।’ সব্যসাচীকে দাবড়ে দেয় দময়ন্তী, ‘প্রত্যেকটা মানুষের জীবন আলাদা। বাই দ্য ওয়ে, অ্যানাটমিতে আমাকে কীভাবে পাস করাবে?’

‘তোমাকে চে হতে বলছি না,’ সব্যসাচীকে থামিয়ে গোপাল বলেন, ‘আমাদের গ্রামে প্রতি রোববার একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প হয়। তোমার তো পরীক্ষা শেষ। পরশু আসতে পারবে?’

‘যেতে পারি। তবে বিলুদা আগে বলুক, আমাকে অ্যানাটমিতে পাস করানোর জন্য ও কী করছে।’ দময়ন্তী নাছোড়বান্দা। সে বিলুর দিকে একবারও তাকায়নি।

‘আমি এনজিকে অলরেডি বলে দিয়েছি, তোকে কে ফাঁসিয়েছিল। এবং ক্যাডাভার কে হোস্টেলে নিয়ে গিয়েছিল। এনজি সিমপ্যাথেটিক।’ মিনমিন করে বিলু।

দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এর ফলে তার কলেজের বাকি দিনগুলো ঝামেলাদার হয়ে উঠল। এটা কেন বিলু বুঝল না? সত্যি, স্কাউন্ড্রেলরাই রাজনীতি করে। টেবিল ছেড়ে ওঠার আগে সে গোপালকে বলল, ‘আপনার ফোন নাম্বার দিন। আগামিকাল বলে দেব, রোববার যাব কি না।’

গোপাল ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ‘এলে রাত্তিরে আমার বাড়ি থেকে যেয়ো। গ্রামে কখনও থেকেছ?’

‘না।’ ঘাড় নাড়ে দময়ন্তী, ‘আপনার গ্রামের নাম কী?’

‘বাঁজাপলাশ। এই গ্রামটা নতুনগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের আন্ডারে।’

গ্রামের নামটা দময়ন্তীর মাথায় ছোটছোট বৃত্ত তুলে হারিয়ে গেল। দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগোল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *