অভিজ্ঞান
‘আমার দুই ছেলে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে পড়ে, এ কথা বলতে আমার লজ্জা হয়,’ সোফার ওপরে রবিবারের আজ সকাল, বেঙ্গল নিউজ আর উইকেন্ড ছুঁড়ে বললেন মনোজ। ‘তোরা মানুষ না জানোয়ার? এইসব করিস ডাক্তারি পড়তে ঢুকে? মদ, গাঁজা, ড্রাগস, মেয়েদের ওপরে নোংরামো? ছি! ছি!’
‘আহা! ওদের কেন বলছ?’ আজ সকাল কাগজটা নিপুণভাবে ভাঁজ করতে করতে বলেন অরুণা। ‘ওরা কি কিছু করেছে? বিলু বরং মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে।’
রবিবারের সকাল। আজ জানুয়ারি মাসের ঊনত্রিশ তারিখ। নতুন বছরের গোড়ায় সেই কুৎসিত ঘটনার পরে কেটে গেছে প্রায় একমাস। কিন্তু সংবাদপত্র থেকে ঘটনাটা মিলিয়ে যায়নি। আর বছর তিনেক বাদে বিধানসভা নির্বাচন। বিরোধীপক্ষ প্রতিদিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বাজারে হালকা গুজব ছড়াচ্ছে যে জনমোর্চা পার্টির ক্ষমতায় থাকার এটাই শেষ টার্ম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ, অ্যাডমিনিস্ট্রেশান, শিল্প—সবেতেই সরকারের প্রতিনিধিদের গয়ংগচ্ছ ভাব। এতদিন ক্ষমতায় থেকে তারা ক্লান্ত।
মিডিয়া তার কাজ করছে। প্রতিদিন স্বাস্থ্য দপ্তরের ত্রুটির তালিকা প্রকাশিত হচ্ছে। কোথাও ওয়ার্ডে বেড়াল ঘুরছে, কোথাও হাসপাতাল চত্বরে শুয়োর চরছে, কোথাও ইঁদুর সদ্যজাতর চোখ খুবলে নিয়েছে, কোথাও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দশজন নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। সব খবর সযত্নে প্রথম পাতায় ছবিসহ ছাপা হচ্ছে।
এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় যে কলেজ চত্বরে কালচারাল প্রোগ্রামের সময় ডাক্তারি ছাত্রী মলেস্টেড—তা হলে তো কথাই নেই। ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীরা কলেজে মদ-গাঁজা খেয়ে বেল্লেলাপনা করে। এরা পাস করে বেরিয়ে কীরকম ডাক্তার হবে? এই নিয়ে সাধুভাষায় রোজ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হচ্ছে। বাঙালির অধঃপতন সম্পূর্ণ—এই ভবিষ্যতবাণীও করা হচ্ছে।
দময়ন্তী প্রেসের কাছে মুখ খোলেনি। থানা-পুলিশ করেনি। বাড়িতে বাবা-মাকেও জানায়নি। নতুন বছরের প্রথম রাতটা লেডিজ হোস্টেলে কাটিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। পরদিন অ্যাজ ইউজুয়াল কলেজে এসেছে। রিপুরা সুরজকে সেই রাতে বেধড়ক মারধর করেছিল। চন্দন চেয়েছিল সুরজকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। টিনটিনের আপত্তিতে সেটা করা যায়নি। কলকাতায় সবচেয়ে বড় কলেজের ফেস্টের শেষটা ভালো হয়নি।
থানা-পুলিশে না যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা হঠাৎ কলেজ স্ট্রাইক করে বসে। শুরু হয়েছিল নেতাবিহীন, দলবিহীন, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন হিসেবে। মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে ফার্স্ট ইয়ারের জেমসি, শ্রীপর্ণা, প্রবাল আর সঞ্জয় অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর সামনে ধর্নায় বসে পড়েছিল নতুন বছরের প্রথম দিন। আস্তে আস্তে সেখানে এসে জুটল সাবিনা, দীপ, সব্যসাচী, বিলু, অভি, লাটু। ফার্স্ট ইয়ারের ধর্নায় পরবর্তী তিন ঘণ্টায় অংশ নিল দু’শো ছেলেমেয়ে। রিপু, সুব্রত, আপ্পু, বান্টি আড়াল থেকে অনেক চেষ্টা করল ধর্না তোলার জন্য। ধর্নাকারীরা খেপে গিয়ে পোস্টার লিখে সারা কলেজে সেঁটে দিল। সারারাত মোমবাতি জ্বেলে বসে রইল অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর সামনে।
খবর রটতে সময় লাগে না। বিকেল নাগাদ একাধিক টিভি চ্যানেলের ওবি ভ্যান দাঁড়িয়ে গেল। যে যা পারছে বাইট দিচ্ছে। সব্যসাচী ফটাং করে বলে বসল, ‘দোষীর শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত কলেজে আমরা স্ট্রাইক ডাকলাম।’
‘আমরা মানে কারা?’ জানতে চাইল সাংবাদিক।
‘প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম।’ গর্বের সঙ্গে জানাল সব্যসাচী।
এই খবর টিভিতে দেখানো মাত্র আগুনে ঘৃতাহুতি হল। জনমোর্চার ছাত্র সংগঠনের জেলা কমিটির সেক্রেটারি অধীর হালদার রিপুকে পার্টি অফিসে ডেকে বেদম ঝাড় দিলেন। ‘ছ’শো স্টুডেন্ট স্ট্রেংথওয়ালা কলেজে আমরা ইউনিয়ন চালাচ্ছি। ইউনিয়নের তেরোটা পোস্টের মধ্যে তেরোটাই আমাদের। ক্লিন সুইপ চলছে গত দশ বছর ধরে। তাহলে দুশো ছেলেমেয়ে ধর্নায় বসল কী করে?’
‘আমি দেখছি অধীরদা,’ মিনমিন করে রিপু। ছয়ফুটিয়া ছাত্রনেতা এখন সাড়ে পাঁচফুট, সিড়িঙ্গে চেহারার বড় নেতার সামনে ঘাড় ঝুঁকিয়ে কথা বলছে, ‘আসলে ইস্যুটা এত সেন্সিটিভ…’
‘সেন্সিটিভ ইস্যু নিয়ে ডিল করবে বলেই তুমি নেতা। কিউবার গণ আন্দোলনের মতো গোদা বিষয় নিয়ে দেখার জন্য পলিট ব্যুরো আছে। দুটো ছেলেমেয়ে মাল খেয়ে টেপাটিপি করছিল, এর মধ্যে সেন্সিটিভ কী দেখলে ডাক্তারবাবু?’
রিপু গুম মেরে রইল। ডাক্তারি ফ্রন্টে রাজনীতি করার এই এক মুশকিল। ডাক্তাররা তাকে রাজনীতিবিদ ভাবে। ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে সিরিয়াসলি নেয় না। পলিটিশিয়ানরা তাকে ডাক্তার ভাবে। পলিটিশিয়ান হিসেবে পাত্তা দেয় না। না ঘরকা না ঘাটকা।
‘চুপ করে থাকলে চলবে?’ ধাঁতানি দেন অধীর, ‘পিএমএফ-এর নকশালগুলো একটা স্পনট্যানিয়াস মুভমেন্টকে হাইজ্যাক করে নিল। আর তোমরা ছিঁড়লে?’
‘না ছিঁড়ে কী করতাম?’ রেগে গিয়ে বলে রিপু, ‘স্ট্রাইকে নেতৃত্ব দিতাম? কলেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিরুদ্ধে একটা মুভমেন্ট সাপোর্ট করত আমাদের দল? সেটা ভালো দেখাত? প্রিন্সিপাল আমাদের লোক, সুপারইনটেনডেন্ট আমাদের লোক, ইউনিয়নে আমাদের লোক। নিজেরা মারামারি করে লাভ আছে?’
‘আছে ডাক্তারবাবু আছে,’ রিপুর পিঠ চাপড়ে বলেন অধীর। ‘মাঝে মধ্যে মক ফাইট করতে হয়। কখনও কখনও গট আপ গেম খেলতে হয়। না হলে নেপোয় এসে দই মেরে দিয়ে চলে যায়। যেমন পিএমএফ দিল। অবশ্য ওটাকে দই না বলে তোমার পশ্চাদ্দেশও বলা যেতে পারে। আমাদের তো বাড়ির মালিকদের ইউনিয়ন আছে, আবার ভাড়াটেদের ইউনিয়নও আছে। পরস্পর বিরোধী দুই শক্তিকে ব্যালানস করে চলি না? ট্রাফিক পুলিশের ইউনিয়ন আছে, অটো-ওয়ালার ইউনিয়নও আছে। লাইসেন্সবিহীন অটো সিজ করলে অটোওয়ালারা মিছিল করে। ট্রাফিক কনস্টেবলকে ট্রান্সফার করলে কনস্টেবলরা মিছিল করে। পলিটিক্স নয়, এ হল ‘রিয়্যালপলিটিক’ ডাক্তারবাবু! দেখলে হবে? খরচা আছে!’
জেলা কমিটির সেক্রেটারির কাছ থেকে রাজনীতির পাঠ চুকিয়ে রিপু যতক্ষণে আইএমসিতে ফিরল, ততক্ষণে কলেজে নিশ্ছিদ্র স্ট্রাইক। দলের ছাপমারা পনেরো-ষোলজন ক্লাস অ্যাটেন্ড করছে, বাকিরা ধর্নামঞ্চে বসে।
সেই স্ট্রাইক চলছে গত এক মাস। সুরজ বেপাত্তা। পুলিশ তাকে ধরার চেষ্টা করেনি। কেন না থানায় কোনও অভিযোগ নথিভুক্ত হয়নি। দময়ন্তী নিয়মিত ক্লাস করছে এবং সচেতনভাবে ধর্না মঞ্চে বসছে না বা মিডিয়ার সামনে আসছে না।
সামনেই ফার্স্ট সেমিস্টার। ধর্নামঞ্চে উপস্থিতি কমতে শুরু করেছে। মিডিয়া থাকলে আন্দোলনে রক্ত সরবরাহ বাড়ে। কিন্তু টিভি একই খবর কতদিন দেখাবে? টিভির সাংবাদিকরা আসা বন্ধ করে দিয়েছে। খবরের কাগজের উত্তর সম্পাদকীয়তে চিকিৎসা সঙ্কট নিয়ে মাঝে মধ্যে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। সেইসব পড়েই উত্তেজিত হয়ে খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন মনোজ। আজ তাঁর কল শো আছে। সকাল থেকে প্রস্তুতি চলছে। ঘন ঘন চা, গার্গল, গলায় মাফলার। এসব লক্ষণ বাড়ির সদস্যদের জানা।
‘তোমার অসুবিধে বোধহয় মিডিয়ার অ্যান্টি গভর্নমেন্ট স্ট্যান্ড দেখে…’ কড়াইশুটির কচুরি আর শুকনো আলুর দম খেতে খেতে বলল বিলু।
‘এগুলো মিডিয়া?’ চোখ পাকিয়ে জানতে চান মনোজ, ‘এদের কাজ জনমোর্চাকে খিস্তি করা। এদের এডিটোরিয়াল পলিসি হল যেন তেন প্রকারেণ জনমোর্চাকে দেশ থেকে উৎখাত করা। এ সবই সিআইএ-র চক্রান্ত।’
‘তা বোধ হয় না।’ শান্তভাবে বলে বিলু, ‘শিল্পায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এইবারে জনমোর্চা যখন ক্ষমতায় এল, তখন সন্দীপ সামন্ত যথেষ্ট মিডিয়া সার্পোট পেয়েছিলেন। আজ সকাল, বেঙ্গল নিউজ বা স্কুপ চ্যানেল-এর মালিক মায়াকম। এটা বেসিক্যালি নন-ব্যাঙ্কিং অর্গ্যানাইজেশান। এরা চায় যে ন্যাশনালাইজড ব্যাঙ্কিং সিস্টেম ধ্বসে যাক। এরা চায় লোকের মধ্যে পোস্ট অফিসে টাকা জমানোর প্রবণতা কমুক। এরা খোলাবাজার অর্থনীতিকে সমর্থন করে। মুনাফা করার জন্য এরা আজ কাগজ আর টিভি চ্যানেল তৈরি করেছে। কাল যদি দেখে আলু-পেঁয়াজ বিক্রি করলে মুনাফা বেশি, তাহলে কাল কাগজ আর টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে আলু-পেঁয়াজ বিক্রি করবে। তোমার জনমোর্চা যতদিন বাজার অর্থনীতিকে সমর্থন করেছে, ততদিন আজ সকাল জনমোর্চাকে সমর্থন করেছে। এখন জনমোর্চার যাবার পালা। মৃন্ময় চ্যাটার্জির নবযুগ পার্টি তোমাদের থেকেও বেশি প্রো মার্কেট। আজ সকাল তাই এখন জনমোর্চাকে ফেলছে আর নবযুগকে তুলছে। সহজ বাজারের অঙ্ক। এর মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জুজু দেখা বন্ধ করো।’
মনোজ হালকা হাসলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘প্রগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম। তারা কারা? তারা হল এমন একটা দল, যাদের টিকি ধরে নাড়াচ্ছে জঙ্গলমহলের মাওবাদি নেতারা। তুই ওদের সঙ্গে কী করে ভিড়লি বিলু? সেভেন্টিজে ছেলেমেয়েরা নকশাল মুভমেন্টের দিকে ঝুঁকেছিল। তার একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে। একটা পূর্বাপর আছে। কিন্তু দুহাজার এগারো সালে বাংলা-ঝাড়খণ্ড-উড়িষ্যা-অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা নেতারা তোকে কীভাবে হিপনোটাইজ করল? কীভাবে ব্রেন ওয়াশ করল?’
‘যেভাবে সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন তোমাদের জেনারেশানের ব্রেনওয়াশ করেছেন। আর তোমরা কেরানি কমিনিউজিম চালিয়ে যাচ্ছ!’ খাওয়া শেষ করে বলে রিপু।
অরুণা এতক্ষণ ধরে খবরের কাগজ ভাঁজ করছিলেন। এটা তাঁর নতুন বাতিক। আলাদা আলাদা করে প্রতিটি পাতা নিখুঁত চার ভাঁজ করছেন। তারপর কাগজের তাড়া একটা পলিথিনের প্যাকেটে ঢুকিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখছেন। অভি মায়ের হাত থেকে প্যাকেট ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমার মাথা-ফাথা খারাপ হয়েছে নাকি? এখনও কেউ কাগজ পড়েনি, এর মধ্যে বেঁধেবুঁধে প্লাস্টিকের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললে?’
‘গুছিয়ে রাখি বলে সব খুঁজে পাস।’ ঝংকার দিয়ে ওঠেন অরুণা। ‘আমি না থাকলে দেখবি, এই সংসারের কী হাঁড়ির হাল হয়!’
‘তোমার না থাকার কথা কোথা থেকে আসছে?’ অবাক হয়ে বলে অভি।
‘তোর মায়ের মাথাটা গেছে। একবার সাইকায়াট্রিতে দেখিয়ে নিয়ে আয় তো!’ স্ত্রীকে আওয়াজ দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন মনোজ। স্নান করে বেরিয়ে বললেন, ‘আমার শো আছে কালনায়। ফিরতে রাত হবে। আগে থেকে বলে দিলাম। ফোন কোরো না। আমি ধরব না। তখন আবার তুমি উলটোপালটা চিন্তা করবে।’
মনোজ বেরিয়ে যান। অরুণা এঁটো থালাবাসন ধুতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটাও একটা বাতিক। বারবার বাসন মাজা, বারবার দরজা-জানলা বন্ধ করা, বারবার হাত ধোয়া—এইসব অরুণার আগে ছিল না। সম্প্রতি শুরু হয়েছে। অরুণার আচরণ দেখতে দেখতে বিলু অভিকে বলে, ‘ফার্স্ট সেমিস্টার তো এসে গেল। প্রিপারেশান কদ্দুর?’
‘খুব খারাপ। অ্যানাটমিটা কিছুতে সুবিধে করতে পারছি না।’
‘অস্টিওলজি আর সারফেস মার্কিং প্র্যাকটিস করছিস?’
‘সারফেস মার্কিং? সেটা কী?’
‘এখনও সারফেস মার্কিং জানিস না? তুই অ্যানাটমিতে সিওর ঝাড় খাচ্ছিস। কালুয়া ডোমকে তোর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এনজি বলবেন, ”ডরসালিস পেডিস আর্টারি আঁকো।” তখন তোকে সরু সুতো গুঁড়ো রঙে রাঙিয়ে কালুয়ার পায়ে আর্টারি আঁকতে হবে। আঁকা শেষ হলে এনজি পড়া ধরবেন। ”ডরসালিস পেডিস আর্টারির কোর্স বলো।” পারলে পাস, না পারলে ফেল। তুই এখনও এটার প্র্যাকটিস শুরু করিসনি?’
ভয়ের চোটে অভির পেট গুড়গুড় করতে শুরু করেছে। সে কোনওরকমে খাওয়া শেষ করে তিনতলার ঘরে চলে গেল। সারা সকাল পায়ের হাড় নিয়ে মাথা ঘামানোর পরে নিচে নামল বারোটা নাগাদ। বিলু আপাতত বাড়িতে নেই। পাড়ায় আড্ডা মারতে বেড়িয়েছে। পান্নালাল রাস্তার মোড়ে পাড়ার পাঁচটা বেকার ছেলে রেগুলার ঠেক মারে। মনোজ ওদের পঞ্চপাণ্ডব বলে ডাকেন। বিলু ওদের সঙ্গে আড্ডা মারতে গেছে।
অরুণা বাসন ধোয়া শেষ করে রাধা আর মানদার সঙ্গে গপপো করছেন। রাধা একটা পোস্টকার্ড দেখিয়ে বলছে, ‘মেজর গুরবিন্দর সিং চিঠি লিখেছে। আর কোনও চিন্তা নেই। সাহেবখালির মাঠ থেকে খানসেনাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। অশথতলা গ্রাম এখন ইন্ডিয়ায়। চলে গেলেই হল।’
‘ওলো রাধা!’ আদুরে গলায় আবদার করছে মানদা, ‘আমাকে নিয়ে যাবি, তোর ওই কীসেরতলা গ্রামে? একবার গুরবিন্দরকে দেখে আসতুম। আর্মির সদ্দারগুলো খুব চিসসা হয়।’
‘আঃহ! মানদা। বাজে কথা কেন বলো,’ বিরক্ত হয়ে বলেন অরুণা। ‘টিভির রিমোটটা দাও তো। একটু খবর শুনি। তোমাদের দাদা কালনায় কল শো করতে গেল। যেতে চার ঘণ্টা। আসতে চার ঘণ্টা। ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বাজবে। আমাকে টেনশানে ফেলা ছাড়া লোকটার কোনও কাজ নেই।’
‘টেনশানের কী আছে?’ বিরক্ত হয়ে বলে মানদা। ‘এক বাস লোক যাবে। তোমার বর কি টুন্নি নাকি যে হারিয়ে যাবে?’
‘টুন্নি কী?’ হাসতে হাসতে বলে অভি।
‘ছোট খুকি গো! এটাও জানো না?’ অভিকে নতুন শব্দ শিখিয়ে নিচে চলে যায় মানদা। রাধা অরুণাকে অশথতলা গ্রামের গল্প বলতে থাকে। অরুণাকে বিরক্ত না করে অভি ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়। অরুণার আজকাল রান্নাবান্নায় মন কম। কড়াইশুটির কচুরি আর শুকনো আলুর দম বানিয়েছেন। আলুর দমে নুন বেশি। কোনওরকমে সেটা গিলল অভি। বাটি আর চামচ সিঙ্কে রেখে তিনতলার ঘরে গিয়ে চৌরাসিয়ার বই আর ফিমার নিয়ে বসল। উফ! পরীক্ষাটা চুকলে হয়।
বেলা দুটোর সময় পড়া থেকে প্রথম ব্রেক নিল অভি। নীচে এসে দুপুরের খাওয়া সারল। রাধা আর মানদা এখন একতলায়, নিজের ঘরে। বিলু আড্ডা মেরে এখনও ফেরেনি। অরুণা স্নান করছেন। স্নান চুকতে একঘণ্টা লাগবে।
এটাও নতুন বাতিক। সারা দিনে অজস্রবার হাত-পা ধুয়ে ফাঙ্গাল ইনফেকশান হয়েছে। যাকে বাংলায় ‘হাজা’ বলে। অভি আর বিলু বকে বকেও অভ্যাস বন্ধ করতে পারেনি। ঘেয়ো হাতে যখন অরুণা ভাত বাড়েন, অভির ঘেন্না করে। কিন্তু হাজার হোক, মা তো! কিছু বলতে পারে না। মনোজ আজকাল মাঝে মাঝে রাতে গেস্টরুমে শোন। কারণটা অভি আন্দাজ করতে পারে। কিন্তু এ সব বিষয়ে সে নাক গলাবার কেউ নয়।
রবিবার খেয়েদেয়ে দুপুরে ঘুমনো অভির বদভ্যাস। আজ মেনু হয়েছে ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, বকফুল ভাজা আর পাঁঠার মাংস। নিজেই ভাত বাড়ল অভি। এক থালা ভাত সাফ করে আবার ভাত নিল। এবার একঘণ্টার পাওয়ার ন্যাপ।
সাড়ে তিনটে থেকে আবার অ্যানাটমি নিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু। এবারের সেশন লম্বা। শেষ হল সাড়ে ছ’টার সময়। অভি উঠত না। কিন্তু বিলু মেসেজ করেছে, ‘চা’। তার মানে বাবু আড্ডা মেরে ফিরে, খেয়েদেয়ে, এক ঘুম দিয়ে এতক্ষণে উঠেছে।
দোতলায় নেমে অভি দেখল বিলু মুড়ি মাখছে। কুচি কুচি করে কাটা পেঁয়াজ, লঙ্কা মুড়িতে ঢেলে চানাচুর আর কাঠিভাজা ঢালল। তার ওপর ঢালল আমচুরের তেল। টকটক, ঝালঝাল! ভালো করে মেখে অভিকে বলল, ‘ধর। আমি চা করছি।’
‘তুই এসব পারিস?’ অভি অবাক।
‘আমি কী কী পারি, এই নিয়ে তোর কোনও ধারণাই নেই। সুরজকে যা কেলিয়েছিলাম না! শুয়োরের বাচ্চা আজীবন মনে রাখবে।’
‘ভারি সুপারম্যান এলেন একেবারে!’ বিলুকে আওয়াজ দেয় অভি। চা বানিয়ে ভাইয়ের হাতে কাপ ধরিয়ে বিলু জিজ্ঞাসা করে, ‘দিঠি ঠিক আছে তো?’
মুড়ি চানাচুর খেতে খেতে অভি বলল, ‘গত একমাসে তুই এই প্রশ্নটা একশো সাতাশবার করেছিস। কী ব্যাপার বল তো? ওর সঙ্গে তো রোজ কলেজে তোর দেখা হয়। ওকেই জিজ্ঞাসা করলে পারিস।’
‘আহ! ব্যাপারটা ওরকম নয়।’ একখাবলা মুড়ি মুখে দিয়ে বলে বিলু, ‘সিনিয়র দাদা হিসেবে আমার কাছে মেয়েটা ফ্রিলি কথা বলবে না। তোরা ক্লাসমেট। তোদের কাছে বেশি ফ্রি হবে।’
‘দিঠি ঠিক আছে। তুই মা-কে একবার দ্যাখ।’ চা খেতে খেতে বিলুকে খোঁচায় অভি। অভি আর বিলু খেয়াল করল, অরুণা টিভির সামনে বসে বাংলা নিউজ চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন। চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছায়া।
‘মারও তার কেটেছে। এনিওয়ে, আমি রাধা পাগলি আর মানদা পিসির জন্য চা করেছি। ওরা এলে দিয়ে দিস।’ অভিকে হুকুম করে নিজের ঘরে চলে গেল বিলু। সে যেতে না যেতেই চায়ের গন্ধে ওপরে এসে হাজির রাধা আর মানদা। রাধা চায়ের কাপ নিয়ে অরুণাকে বলল, ‘টিভিতে প্রেসিডেন্টের ভাষণ হয়ে গেছে?’
‘না,’ বিরক্ত হয়ে বলেন অরুণা।
‘মেজর গুরবিন্দরের?’
‘না।’
‘নেতাজির?’
‘ওফ! তুমি থামবে!’ মানদা ধমক দেয় রাধাকে, ‘পাগলির কথা শুনে গা জ্বালা করে।’
‘আমি পাগলি হলে তুই আধ-পাগলি। আর গিন্নিমা পুরো পাগলি। টিভি খুলে অ্যাক্সিডেন্টের খবর খুঁজছে।’ মানদাকে পাল্টা ধমকে অরুণাকে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দেয় রাধা। অরুণা রাগী চোখে রাধাকে দেখে চায়ে চুমুক দেন।
চা-পানের বিরতি শেষ। আবার তিনতলার ঘরে ঢোকে অভি। চৌরাসিয়া খুলে মন দিয়ে পড়ছে, এমন সময় ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, ‘বৃন্দা কলিং!’
‘বলুন ম্যাডাম। গোলাম আপনার জন্য কী করতে পারে?’
‘ধ্যাত!’ কুলকুল করে হাসছে বৃন্দা, ‘তুই আবার গোলাম কবে হলি? শোন না, একটা দরকারি কথা বলতে ফোন করলাম। অ্যানাটমির একটা থিয়োরি কোশ্চেন জানতে পেরেছি।’
‘কোত্থেকে পেলি?’
‘বয়েজ হোস্টেলের প্রবাল নাকি এনজির কাছ থেকে জেনেছে। তারপর সেটা চাউর হয়ে গেছে। ইঙ্গুইনাল ক্যানালের বাউন্ডারি আর তার ক্লিনিকাল সিগনিফিক্যান্স।’
‘হুম!’ আপনমনে ভাবে অভি, ‘আচ্ছা, কোশ্চেন লিক করার কোনও নেক্সাস আছে? এমবিবিএসের কোয়েশ্চেনও কি লিক হয়?’
‘এই শোন’, বিরক্ত হয়ে বলে বৃন্দা, ‘তোকে দেশোদ্ধার করতে হবে না। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট হয়ে স্টিং অপারেশনও করতে হবে না। যা বললাম পড়। ইঙ্গুইনাল ক্যানাল আমাদের প্রথম ডিসেকশান ছিল। মনে আছে?’
‘দিব্যি মনে আছে। এনজি আমায় ঝাড় নামিয়েছিলেন। এনিওয়ে, আমার ওটা পড়া শেষ। থ্যাংকস ফর দ্য টিপ।’
‘উফ! খুব থ্যাংকস শিখেছে! দুদিন আগেও তো ভালো করে কথা বলতে পারতিস না! ফ্যালফ্যাল করে এদিক সেদিক তাকিয়ে থাকতিস।’
‘কী করি বল! মফসসলের ছেলে। কলকাতার জল গায়ে পড়েছে। একটু আধটু ট্যাঁশপনা চলে আসবেই।’
‘কলকাতার জল? হিহি! বাংলায় একটা কথা আছে, ‘বিয়ের জল গায়ে পড়া’। মেয়েদের সম্বন্ধে ব্যবহার করা হয়। বিয়ের জল গায়ে পড়লেই মেয়েরা নাকি বদলে যায়। ‘কলকাতার জল’ কথাটা আজ প্রথম শুনলাম, খুব কিউট!’
ফোনে বৃন্দা কথা বলছে আর তার অদৃশ্য তরঙ্গ গরম ভাপের মতো ছড়িয়ে পড়ছে অভির কানে, গালে, ঘাড়ে। হাতের চেটো গরম হয়ে উঠছে। ভাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে তলপেটে, দুই পায়ের ফাঁকে। শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে অভি বলে, ‘পরীক্ষার আগে ফোনে এত বকবক করছিস, সময় নষ্ট হচ্ছে না?’
‘না,’ সাফ জবাব বৃন্দার। ‘এতক্ষণ বই খুলে বসে আছি। এক লাইনও পড়া হয়নি। ভাবলাম কারও সঙ্গে গপপো করি। তা হলে বোরডম কাটবে। কাকে ফোন করব ভেবে চোখ বুঁজে তোকে দেখতে পেলাম।’ শেষের কথাগুলো বলার সময় বৃন্দা ফিসফিস করে। যেন গোপন কোনও কথা বলছে।
অভি খাটের ওপরে সোজা হয়ে বসেছে। বৃন্দা কি তাকে কিছু বলতে চাইছে? এত ক্যাজুয়ালি কোনও সিরিয়াস কথা বলা যায়? তার মতো মফসসলি, অর্ডিনারি লুকিং ছেলে এইরকম সিরিয়াস কথার যোগ্য? সে ভুল ইন্টারপ্রিটেশান করছে না তো?
‘কী রে? চুপ কেন?’ ওপাশ থেকে আবার ফিসফিসোচ্ছে বৃন্দা।
‘আম…আমি কিছু বুঝতে পারছি না। খুব কনফিউশান হচ্ছে।’ সত্যি কথাটা বলেই ফেলে অভি।
‘কী নিয়ে কনফিউশান?’
‘ম্যা….ম্যা…মানে তুই কি আমাকে কিছু বলতে চাইছিস? না, মানে, তুই আমাকে কি বললি সেটা বো…বো…বোঝার চেষ্টা করছি। মানে…’
‘ইঙ্গুইনাল ক্যানাল এবং তার ক্লিনিকাল সিগনিফিক্যান্স। এইটা আমাদের মন দিয়ে পড়তে হবে। এটাই আমি তোকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। মন দিয়ে পড়াশুনো কর। সেমিস্টারে ঝাড় খেলে ব্যাপক মনখারাপ হবে।’
থতমতো খেয়ে অভি বলে, ‘ঝাড় খেলে মন খারাপ হবে বলছিস?’ তার কনফিউশান এখনও কাটেনি। বৃন্দা তাকে কী বলার চেষ্টা করল?
‘রাখছি।’ ফোন কেটে দিয়েছে বৃন্দা। অভিও ফোন রাখল। ফোনালাপের আফটার এফেক্ট হিসেবে পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশুনো হল না। একবার মনে হল এক্ষুনি বৃন্দার বাড়ি গিয়ে ওর পায়ের কাছে বসে প্রোপোজ করে। একবার মনে হল লুটেরা জলদস্যুর মতো চুমুতে ভিজিয়ে দেয় কমলালেবুর মতো ঠোঁট। একবার মনে হল ‘আই লাভ ইউ’ লিখে এসএমএস করে। পরমুহূর্তে নিজের বোকামোর কথা ভেবে টুকটুক করে ঘাড় নাড়ে।
মোদ্দা কথা, অনেকক্ষণ ধরে হিজিবিজি চিন্তা করার ফলে লেখাপড়া হল না। দিবাস্বপ্ন দেখে, পড়াশুনার নামে ছেলেখেলা করে, কাগজে আঁকিবুঁকি কেটে অভি ঘড়ি দেখল। আরেঃ! রাত এগারোটা বাজে! তাকে এখনও কেউ খেতে ডাকল না কেন?
তরতরিয়ে দোতলায় নামে অভি। ডাইনিং স্পেসে ঢুকতে গিয়ে শুনতে পায় মনোজ আর অরুণার কথোপকথন।
‘ঋষিতা পৌঁছে দিয়ে গেল?’
‘পাগলামো কোরো না। বাস সেকেন্ড ব্রিজ হয়ে বেরিয়ে গেল। আমি হাওড়া থেকে ট্যাক্সি করে ফিরলাম।’
‘ট্যাক্সির ভাড়া মেটালে না তো?’
‘আরও দুজন লোক ছিল। ওরা মিটিয়ে দেবে।’
‘আরও দুজন লোক না আরও একজন?’
‘আচ্ছা বাবা, একজন। এবার খেতে দাও। অভি আর বিলুকে ডাকো। কাল সোমবার। ওরা সকাল সকাল বেরোবে। আমারও অফিস আছে।’
‘তাহলে ঋষিতাই ছিল। মেয়েটার কত বয়স গো? তিরিশের কোঠায়? না আরও ছোট?’
‘ধ্যাত্তেরিকা! খালি বাজে কথা। খেতে দেবে কি না বলো! না হলে আমি শুচ্ছি।’
‘তুমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছ। ঋষিতার সঙ্গে। তোমার মুখ থেকে পেঁয়াজের গন্ধ আসছে। ধাবায় খুব টেস্টি খাবার পাওয়া যায়, না? কালি ডাল। কড়াই মুর্গ। লচ্ছা পরোটা। চিকেন টিক্কা মসালা! আমি ম্যাগাজিন পড়ে পড়ে শিখেছি। আমার রান্না তুমি আর খেতে চাও না। সেই থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়। তোমার এসব ভালো লাগে না, আমি জানি। কাল থেকে খুব টেস্টি রান্না করব। তাহলে তুমি খাবে? খুব ঝাল দেব। খুব তেল। খুব মশলা! সত্যি বলছি। তুমি খাবে গো?’
অরুণার অসহায় অনুরোধ শুনে অভির কান্না পেয়ে গেল। সে এতক্ষণ তিনতলায় বসে বানানো প্রেমের স্বর্গে নিজের জীবনচরিত লিখছিল। একতলা নীচে নেমেই বিবাহ-পরবর্তী বাস্তবতাকে দেখতে পাচ্ছে। মানসিক রোগগ্রস্ত স্ত্রী, চাকরি আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত স্বামী, আর দুজনের মধ্যে এক সমুদ্র দূরত্ব। অথচ মনোজ আর অরুণার লাভ ম্যারেজ।
‘ধুসশালা!’ মনোজের গর্জন শুনতে পায় অভি। ‘আমি রাত্তিরে খাব না। তোমার ফালতু ছেনালি যদ্দিন না বন্ধ হচ্ছে, আমি রাতে গেস্টরুমেই শোব। তুমি আমায় ডিস্টার্ব করবে না।’
গেস্টরুমে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয় মনোজ। আওয়াজে পুরো লক্ষ্মী নিবাস কেঁপে ওঠে। বিলু নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। অভিও ডাইনিং স্পেসে আসে। দুজনকে দেখে, কাঁদতে কাঁদতে, অরুণা শোওয়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন।
ডাইনিং টেবিলে চারজনের খাবারই পড়ে রইল। আজ লক্ষ্মী নিবাসে কেউ খাবে না।
.
বৃন্দা
‘আজ আমি তোদের খাওয়াব।’ একগাল হেসে বলল দময়ন্তী।
‘কেন? প্র্যাকটিকাল ভালো হয়েছে বলে?’ ব্যাজার মুখে বলল অভি।
‘তোর প্র্যাকটিকাল যে ভালো হয়নি সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে,’ অভিকে মুখঝামটা দেয় বৃন্দা, ‘তবে সেটা দিঠির ট্রিট দেওয়ার কারণ নয়।’
‘কী কারণ? দূরে কোথাও হলে আমি যাব না। বাড়ি ফিরতে হবে।’ অভি এখনও ব্যাজার।
অভির কথায় পাত্তা না দিয়ে বৃন্দা চন্দনকে পাকড়েছে। ‘অ্যাই চাঁদু, কোথায় কাটছিস?’
‘তোরা খেতে যা। আমাকে নিয়ে টানাটানি করছিস কেন? আমার কাজ আছে।’ বৃন্দার দিকে না তাকিয়ে বলল চন্দন।
‘তোর কাজ মানে তো একশো পঁচিশে বসে সিগারেট ফোঁকা আর রিপুদার দালালি করা।’ চন্দনকে শুনিয়ে দেয় দময়ন্তী। কলেজ স্ট্রাইকের সময় চন্দনের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সে আদৌ খুশি নয়।
‘তাও তো কিছু একটা করি। কলেজে বাওয়াল বাঁধিয়ে তোর মতো হাওয়া হয়ে যাই না।’
‘দিস ইজ হাইলি সেক্সিস্ট কমেন্ট।’ চশমা ঠিক করে বলে দময়ন্তী। ‘কলেজে বাওয়াল আমি বাঁধাইনি। বাঁধিয়েছিল সুরজ। এবং পরে আমার ব্যাচমেটরা। আমিই একমাত্র পার্সন, যে বাওয়াল প্রিভেন্ট করতে চেয়েছিলাম। আমি এফআইআর বা জিডি করিনি বলেই সুরজ এখনও কলেজে পড়ছে। আজ পরীক্ষাও দিল। তোরাই বরং পিএমএফের পাল্লায় পড়ে আন্দোলন, বনধ আর ধর্না করে কলেজের নাম ডুবিয়েছিস। দিনের পর দিন আইএমসিকে খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে এনেছিস ফর রং রিজনস।’
‘আমি স্ট্রাইক করিনি। স্ট্রাইকের বিরোধিতা করেছিলাম।’ গলা ফুলিয়ে বলে চন্দন।
‘সেটাও পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড ছিল। তুই আমাকে বাঁচাতে ওই অবস্থান নিসনি। নিজের পেছন বাঁচাতে নিয়েছিলি। লাইক আদার মোচা-জ।’
‘তোরা ”মোচা”, ”ছেঁদো” আর ”পিএমএফ” নিয়ে ঝগড়া কর। এদিকে কলেজে ‘ন্যাবা’রা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সেটা খেয়াল করেছিস?’ নিজের মতামত দেয় অভি।
কথাটা সত্যি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চরিত্রে একটা বড় শিফট দেখা যাচ্ছে। সুনামির মতো অমোঘ, আর্মাগেডনের মতো পূর্ব নির্দিষ্ট। নতুন একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান হচ্ছে উল্কার মতো। মৃন্ময় চ্যাটার্জির নেতৃত্বে এই ওয়ান ম্যান পার্টির একমাত্র অ্যাজেন্ডা, জনমোর্চার সরকারকে উল্টে দেওয়া। দীর্ঘ সাতাশ বছর ধরে শাসক দলের দুর্নীতি, দাদাগিরি, প্রশাসনিক ব্যর্থতায় তিতিবিরক্ত রাজ্যের মানুষ ক্ষুদ্র নবযুগ পার্টিকে আপন করে নিচ্ছে। নবযুগ পার্টিকে মিছিলের অনুমতি দেওয়া না হলেও মৃন্ময় মিছিল করেছেন। শাসকদলের ক্যাডাররা প্রকাশ্য রাজপথে তাঁকে লাঠিপেটা করেছে, নবযুগ পার্টিকে ন্যাবা পার্টি নাম দিয়েছে, দলের সমর্থক ও কর্মীবৃন্দকে ক্রমাগত বাড়ি ছাড়া করেছে। কিন্তু নবযুগ পার্টির নৌকার পাল বিরোধীতাকে হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে। রাজনৈতিক আন্দোলন ক্রমশ গতি পাচ্ছে। জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে, গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায়, অলিগলিতে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ন্যাবা পার্টির নতুন সমর্থক তৈরি হচ্ছে। বেশি করে এগিয়ে আসছে মেয়েরা। শাসকদল এখনও এই প্রবল হাওয়াকে পাত্তা দিচ্ছে না। সাতাশ বছর ক্ষমতায় থাকার গর্বে তারা অন্ধ।
নবযুগ পার্টি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজেও ছাত্র উইং খুলে ফেলেছে। সবার আগে সেই দলে যোগ দিয়েছে সুরজ। সক্রিয় সদস্য বলতে সে আর সঞ্জয়। ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রকাশ্যে সমর্থন না করলেও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সঙ্গে আছে। সুরজ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার কারণে কলেজে ছাত্র সংগঠনের ক্রেডিবিলিটি কম। কিন্তু মৃন্ময় চ্যাটার্জি এত বৃহৎ এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যে তাঁর সামনে সমস্ত প্রতিকূলতা জলের স্রোতের সামনে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে।
‘ন্যাবাদের কথা ছাড়,’ পাক্কা মোচাপার্টির নেতার মতো বলল চন্দন, ‘দিঠি কেন খাওয়াচ্ছে, এটা না জানলে আমি যাব না।’
‘খাওয়াচ্ছি, কেন না আমি আমার বাড়ির কাছে একটা দুর্দান্ত রেস্তোরাঁর সন্ধান পেয়েছি।’ গর্বের সঙ্গে বলে দময়ন্তী।
‘তোর বাড়ির কাছে তো আমাদের কী?’ বিরক্ত হয়ে বলে চন্দন।
‘তোর শালা বুদ্ধি হবে না,’ চন্দনের হাত ধরে গেটের দিকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বলে দময়ন্তী, ‘আমার বাড়ি এখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিট। বিনি পয়সায় খেতে পাবি, অত কৈফিয়ত চাইছিস কেন?’
অভি আর বৃন্দা হাসতে হাসতে ওদের পিছন পিছন এগোয়।
.
আজ ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ হল। পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসের কুড়ি তারিখে। শেষ হল পঁচিশে মার্চ। প্রথমে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রির থিয়োরি পরীক্ষা। তারপর এক সপ্তাহ ছুটি। তারপর একদিনের ব্যবধানে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল। থিয়োরি পরীক্ষা সবাই মোটামুটি উতরে দিয়েছে। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা কারোরই ভালো হয়নি। অভি অ্যানাটমিতে ছড়িয়েছে। চন্দন বায়োকেমিস্ট্রিতে। দময়ন্তী আর বৃন্দারও অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল ভালো হয়নি। তবে আজ পরীক্ষা শেষ। একটু আনন্দ ফুর্তি করা যেতেই পারে। কাল রোববার। কলেজে আসার তাড়া নেই।
‘দোকানটার নাম রোম্যানো স্যান্টোস,’ বলল দময়ন্তী, ‘জেম সিনেমা হলের উল্টো দিকে। হোস্টেলে থাকার সময়ে আমরা মাঝে মাঝে ওখান থেকে মোমো আনিয়ে খেতাম। কখনও ঢুকে দেখিনি। যে দিন থিয়োরি পরীক্ষা শেষ হল, বাড়ি ফেরার সময় ওদের টেক-অ্যাওয়ে কাউন্টার থেকে মিক্সড চাউমিন আর হানি চিকেন কিনেছিলাম। খুব ভালো খেতে। অনেকটা কোয়ান্টিটি দেয়। বাবা-মা খেয়ে মুগ্ধ।’
‘চাইনিজ আর টিবেটান ফুড জয়েন্টের নাম হিসেবে রোম্যানো স্যান্টোস কিন্তু বেশ অদ্ভুত,’ বলে বৃন্দা।
হিহি করে হেসে দময়ন্তী বলে, ‘ওদের কাউন্টার থেকে চাইনিজ কেনার দিন নামের ইতিহাস জানলাম। রমেন আর সন্তোষ নামে দুই বন্ধু একটা চায়ের দোকান দিয়েছিল। দোকানটা ইনিশিয়ালি ”রমেন ও সন্তোষের দোকান” বলে চলত। চা বিক্রি করে খানিকটা পয়সা হওয়ার পরে ওরা মোমোর দোকান দেয়। সেটার নাম হয়ে যায় রোম্যানো স্যান্টোস। বাকিটা, অ্যাজ দে সে, ইতিহাস।’
চন্দন মুখ গোমড়া করে হাঁটছিল। হঠাৎ বলল, ‘আজ বাড়ি গেলে ভালো হতো। তোদের পাল্লায় পড়ে যাওয়া হল না।’
‘কদ্দিন বাড়ি যাসনি?’ জিজ্ঞাসা করল অভি।
‘যাইনি অনেকদিন। এখন মাসে একবার, একদিনের জন্য যাই। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে, এই রকমটা নয়। আমাদের গ্রামে একটা গন্ডগোল বাঁধছে।’
‘কীসের গন্ডগোল?’ জানতে চায় দময়ন্তী।
‘জানি না। কাল রাতে বাবার সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। বাবা বলছিল, হেলথ হাব নামের কী একটা উৎপটাং জিনিস হবে বলে সরকার নাকি জমি অধিগ্রহণ করবে। এই নিয়ে আমাদের ওখানে জোর গুজব রটেছে। রোজই মিটিং, মিছিল, পদযাত্রা, ধর্না—এসব লেগেই আছে।’
‘ওসব ছাড়,’ চন্দনের হাত ধরে দময়ন্তী বলে, ‘এই হল রোম্যানো স্যান্টোস। এখানেই আমরা পেটপুজো করব।’
গ্লো-সাইনের নামলিপিতে ট্রাইবাল টাচ। ওয়ান-ওয়ে গ্লাসের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল চারজন। আধো অন্ধকার ঘরে মোট আটটা টেবিল। দুটো টেবিলে আটজন করে বসতে পারবে। বাকিগুলো চারজনের জন্য। কালার স্কিমে কালো আর লালের প্রাধান্য। কাঠের টেবিলগুলোও কালো রঙের। হাইব্যাক লেদার চেয়ারের রং লাল। দেওয়ালের নীচের অর্ধেক কাঠ দিয়ে প্যানেলিং করা। ওপরের অর্ধেকের রং গোলাপি। সিলিং থেকে কাগজের তৈরি চিনা লন্ঠন ঝুলছে। গোলাকৃতি ফানুসের মতো, কাগজের তৈরি লন্ঠনে ড্রাগনের মোটিফ। বিকেল পাঁচটার সময় ছ’জন কাস্টমার রয়েছে। অর্থাৎ রোম্যানো স্যান্টোসের বাজার ভালো।
কাউন্টারে বসা মাঝবয়সি ভদ্রলোক দময়ন্তীকে বললেন ‘আজ টেক অ্যাওয়ে না সিট ডাউন ডিনার?’
‘বিকেলবেলা ডিনার কী করে হবে রমেনদা?’ মুচকি হাসে দময়ন্তী, ‘জলখাবার বলতে পারো।’
চেয়ারে বসে মেনুকার্ড টেনে নেয় বৃন্দা। স্টার্টার থেকে ডেজার্ট—সব কিছু উল্টেপাল্টে দেখে। বেশ ছড়ানো মেনু। দময়ন্তীকে পরামর্শ দেয়, ‘ডেকেছিস যখন, ভালো করে খাওয়া। বাড়ি গিয়ে যেন ডিনার করতে না হয়।’
দময়ন্তী হাতের ইশারায় ওয়েটারকে ডাকল, ‘অর্ডার নিন।’ তারপর চন্দন বা অভিকে জিজ্ঞাসা না করেই অর্ডার করল। চার রকমের স্যুপ, দু’রকমের রাইস, দু’রকমের চাউ, চার রকমের চিকেন। ভ্যারাইটি থাকল। নিজেদের মধ্যে শেয়ার করা যাবে।
চন্দন আমেরিকান চপ স্যুয়ে খেয়ে এত উত্তেজিত যে রাইস ছুঁয়ে দেখল না। অভি মিক্সড ফ্রায়েড রাইস নিয়ে খুশি। বৃন্দা আর দময়ন্তী একটা হাক্কা চাউমিন ভাগাভাগি করে খেল। জিরা রাইসের প্লেটে কেউ হাত দেয়নি। চিলি চিকেন, হানি চিকেন, লেমন চিকেন আর চিকেন সুইট অ্যান্ড সাওয়ার সবাই ভাগাভাগি করে খেল। জিরা রাইসের প্লেট নষ্ট হচ্ছে দেখে বৃন্দা চন্দনকে বলল, ‘এটা শেষ কর। খাবার নষ্ট করতে নেই।’
‘আমি চাষার ছেলে। ভাত নষ্ট করব না।’ লেমন চিকেন সাঁটাতে সাঁটাতে চন্দন বলে, ‘কিন্তু তাহলে আমার স্যুপ অন্য কেউ খা। ওসব জোলো মাল আমার পছন্দ নয়।’
‘তুই এখনও স্যুপ খাসনি?’ অভি অবাক হয়ে বলে।
‘না। খাবও না।’ জিরা রাইসের প্লেট টেনে নিয়ে বলে চন্দন।
চারজনে খেয়ে বিল হল দেড় হাজার টাকা। দময়ন্তী ওয়েটারকে দেড়শো টাকা টিপ দিল। খুশি হয়ে লম্বা স্যালুট ঠুকল সে।
সন্ধে সাতটার সময় রোম্যানো স্যান্টোস থেকে বেরিয়ে বৃন্দা দেখল, এখনও সূর্যের আলো রয়েছে। এসির কারণে মার্চ মাসের লাগামছাড়া গরম এতক্ষণ বোঝা যায়নি। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনো মাত্র কুলকুলিয়ে ঘাম শুরু হয়ে গেল।
‘কাল থেকে কী প্ল্যান?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।
‘কাল হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্ট আছে। ওটা চুকিয়ে পরশু বাড়ি যাব।’ চন্দন নিজের রুটিন জানাল।
‘আমি এক সপ্তাহ পড়ে পড়ে ঘুমোব।’ দময়ন্তী জানাল নিজের প্ল্যান। বৃন্দা অভিকে বলল, ‘তোর কী প্ল্যান?’
‘আমার?’ মিনমিন করে অভি। তার মনে পড়ে যাচ্ছে বৃন্দার সঙ্গে ফোনালাপের কথা। সন্ধ্যার সেই কথোপকথনের পর থেকে অভি এতটাই অস্থির চিত্ত হয়ে গেছে যে পড়াশুনোয় মন দিতে পারেনি। বই খুললে বৃন্দাকে দেখতে পায়। বই বন্ধ করলেও। এভাবে পড়াশুনা হয়? সেমিস্টারে রেজাল্ট খারাপ হলে বৃন্দা দায়ী হবে। আর এখন জিজ্ঞাসা করছে কী প্ল্যান! ন্যাকা!
‘হ্যাঁ। তোর। গোরুর মতো তাকিয়ে আছিস কেন?’ বিরক্ত হয়ে বলে বৃন্দা।
‘জানি না। বাড়িতে থাকব। এই সপ্তাহটা তো ছুটি।’
‘ফোন করিস।’ অভির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে বৃন্দা। অভির হৃদয় একটা ধড়কন বেমালুম মিস করে। বৃন্দা তাকে ফোন করতে বলছে? কেন? যা বলার এখনই বলুক না! অভিকে মিছিমিছি টেনশানে ফেলার কোনও মানে হয়?
‘আমি কাটলাম বস,’ টাটা করে নিজের বাড়ির দিকে এগোয় দময়ন্তী। অভি, বৃন্দা আর চন্দন হাঁটতে হাঁটতে মৌলালি পৌঁছয়। অভি আর চন্দন শিয়ালদার দিকে চলে গেল। চন্দন হোস্টেলে ফিরবে। অভি ট্রেন ধরে বাড়ি। এসপ্ল্যানেডগামী ট্রামে উঠে বসে বৃন্দা।
ট্রাম ব্যাপারটা বৃন্দার খুব পছন্দের। কোনও তাড়াহুড়ো নেই, কোনও ওভারটেক নেই, কোনও রেষারেষি নেই। প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, ভবঘুরে ও ভ্রমণবিলাসী ছাড়া কেউ চাপে না। শিয়ালদা থেকে ধর্মতলার সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে আধঘণ্টা সময় নেয়। কন্ডাক্টর টিকিট কাটতে চায় না। ড্রাইভার অলসভাবে সিগন্যাল সবুজ হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
ধর্মতলায় নেমে একটুখানি হাঁটলেই মেট্রো স্টেশন। বৃন্দার কাছে স্মার্টকার্ড আছে। লেনিন সরনির মুখ থেকে মেট্রো স্টেশান অবধি হেঁটে আসতে গেলে প্রথমে পড়ে ফুটপাথের ম্যাগাজিনের দোকান। গাদাগাদা কাগজ আর পত্রিকা নিয়ে বসে রয়েছে আশি বছরের এক বুড়ো। বই বিক্রি হল কি না তা নিয়ে তার কোনও চিন্তা নেই। রেসের বই আর পর্নো ম্যাগাজিন ছাড়া অন্য কোনও ম্যাগাজিন বিক্রি হতে দেখেনি বৃন্দা। বইয়ের দোকান পেরোনো মাত্র শুরু হয়ে গেল সস্তার জামাকাপড়ের হকারদের চিৎকার, ‘প্যাঁয়ষ্যাট, প্যাঁয়ষ্যাট!’ পঁয়ষট্টি টাকায় টি-শার্ট, হাফ আর ফুল-স্লিভ শার্ট, বারমুডা, কাপরি, সুতির জ্যাকেট—সব পাওয়া যাচ্ছে। হকারের পাশে পশরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে দুটো মাঝবয়সি মেয়ে। গোলাপি শাড়ি আর আর টিয়া রঙের ব্লাউজ এমন ভাবে পরা যে পেট ও বুকের অনেকখানি দেখা যায়। তাদের পাশে বিনি পয়সায় বাইবেল বিলি করছে শ্বেতাঙ্গ যুবক। রোল-চাউমিনের দোকান থেকে খুশবু আসছে, জুতো পালিশওয়ালারা ‘পালিশ-পালিশ’ করে চেঁচাচ্ছে, অশোকা বার থেকে বেরনো মাতাল যুবক তাই শুনে বলল, ‘মালিশ? কে করবে?’
কুড়ি পা হাঁটতে হাঁটতে বিশ্ব দর্শন হয়ে যায় বৃন্দার। জওহরলাল নেহরু রোডের ট্রাফিক জ্যাম টপকে, মেট্রো চ্যানেলে নবযুগ পার্টির ‘জমি অধিগ্রহণ বিরোধী অবস্থান সমাবেশ’ টপকে সে পাতাল-প্রবেশ করে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অঞ্জলি এলা মেননের আঁকা মস্ত বড় ছবিটার দিকে চোখ যায়। অঞ্জলির আঁকা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের পেইন্টিং-টা বৃন্দার খুব পছন্দের। যখনই দেখে, নতুন নতুন ইমেজ খুঁজে পায়। ঠিক করে একদিন এইটার একটা ফোটো তুলতে হবে। এখানে ক্যামেরা অ্যালাওড নয়। তবে লুকিয়ে একটা ছবি তোলাই যায়। পুলিশগুলো বুঝতে পারবে না।
ট্রেন আসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে বৃন্দা। ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে ওঠে। কামরায় বেশ ভিড়। বসার জায়গা নেই। রবীন্দ্র সরোবরে যখন নামল, পৌনে আটটা বাজে। লেকের দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। বৃন্দা অনুভব করল, খুব ক্লান্ত লাগছে। কয়েকদিন টানা রাত জাগা, আজ অবেলায় ভরপেট খাওয়া দাওয়া, সব মিলিয়ে শরীর বশে নেই। বাড়ি ঢুকে বাথটবে এক ঘণ্টা শুয়ে থাকতে হবে।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার মুখে। এখনও শান্তিধামে এক গাদা গাড়ি আর ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দাঁড়িয়ে রয়েছে নার্সিংহোমে ভরতি রোগীদের বাড়ির লোক। সুলতান বৃন্দাকে একগাল হেসে বলল, ‘পরিকছা খতম?’
বৃন্দা বলল, ‘হ্যাঁ, সুলতানচাচু।’
সুলতানকে বৃন্দা ‘চাচু’ বলে ডাকে। বিহারের বাসিন্দা সুলতান যাদবের বাংলায় অল্প হলেও হিন্দির টান আছে। সে শান্তিধামের দারোয়ান কাম গাড়ির ড্রাইভার কাম সিকিয়োরিটি। তার লাইসেন্সড আগ্নেয়াস্ত্র আছে। সুলতান দু’মাসে একবার বালিয়ায় নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বাকি সময়টা শান্তিধামেই থাকে। লম্বা-চওড়া, মোচওয়ালা, মাঝবয়সি মানুষটা বৃন্দাকে খুব ভালোবাসে। মাঝেমধ্যেই রাবড়ি, শোনপাপড়ি, গুলাবি রেউড়ি বা পেঠা খাওয়ায়।
লিফটে উঠতে গিয়ে বৃন্দা খেয়াল করল তাপসী আর কুনাল রুগির বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলছে। স্যামি পাশে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখছেন। তাঁর মুখে হাসিহাসি ভাব।
চারতলায় বসার ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মন্দিরা দৌড়ে এলেন। তাঁর হাতে টেলিফোন। উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বৃন্দাকে বললেন, ‘এক্ষুনি খবরটা পেলাম। বিপিনদা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন।’
‘কে বলল? বাবা?’ ন্যাপস্যাক সোফায় ফেলে রিমোট টিপে ঘরের তাপমাত্রা কমায় বৃন্দা।
‘তোর বাবা বলার লোক নয়। বিপিনদাই ফোন করেছিল।’
‘কোন বইটার জন্য পেল?’
‘সেটা গত বইমেলায় বেরোল। বিধবাপুকুর।’
‘বিপিন দত্ত অ্যাকাডেমি পেয়েছে, তাতে তোমার এত আনন্দের কী আছে?’
‘তোরা বুঝবি না রে,’ নিজের উচ্ছ্বাসে লাগাম পরিয়ে সংযত হয়ে বলে মন্দিরা। ‘আমরা গ্রন্থ-প্রজন্মের লোক। লেখকরা আমাদের কাছে সেলিব্রিটি। তোদের কাছে রণবীর কপুর বা সলমান খান যা, আমাদের কাছে বিপিন দত্ত বা সুদিন চক্রবর্তী তাই। এই সব লোক তোর বাবার বন্ধু—এটা ভেবে গর্ব হয়।’
‘আমি চান করব। তারপর ওই বইটা পড়ব। বার করে রেখো তো।’ মন্দিরাকে হুকুম করে নিজের ঘরে ঢুকে যায় বৃন্দা। বাথরুমে গিয়ে বাথটবের কল খোলে। ঝুনুর মা এর মধ্যে এক গ্লাস লেবু চিনির সরবত নিয়ে এসেছে। বৃন্দা বলল, ‘ওটা বাথরুমেই রাখো। একটু পরে খাব।’
কাপড় জামা খুলে বাথটাবে নামে বৃন্দা। বাথ সল্ট আর শাওয়ার জেল দিয়ে যথেষ্ট ফেনা করা হয়েছে। এখন এই জলের মধ্যে সে অন্তত এক ঘণ্টা বসে থাকবে। শ্যাম্পু আর কন্ডিশনার বাথটবে বসেই লাগাবে।
জলে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বৃন্দা। আহ! কী শান্তি! শরীর আর মন একসঙ্গে শিথিল হয়ে আসে। এতদিন একটানা ঘাড় গুঁজে পড়াশুনো করার জন্য ঘাড়ে, রগে, চোখের পিছনে, কোমরে-ঘ্যানঘেনে এক ব্যথাগাছ বড় হচ্ছিল। বাথটবের ঈষদুষ্ণ জল তাকে শেকড় থেকে উপড়ে দেয়। ড্যাডি-জ গার্ল বৃন্দা নিজের মাথা থেকে কলেজকে সরিয়ে শান্তিধামে ফোকাস করে। লোনলি ওয়াইফ বিপিনের অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পাওয়ার এত উচ্ছ্বসিত কেন? এ কি শুধু সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ? নাকি সাহিত্যিকের প্রতিও? বৃন্দা ঠিক করে স্নান সেরে আজ সে কনট্রোল ফ্রিক-এর চেম্বারে আড়ি পাতবে। থ্রি উইচেস আর কনট্রোল ফ্রিক কী নিয়ে আড্ডা মারে এটা শোনা জরুরি।
উলটোপালটা ভাবতে ভাবতে কত সময় বাথটাবে কাটিয়ে দিয়েছে বৃন্দা, কে জানে! ঝুনুর মায়ের হাঁকডাকে হুঁশ ফিরল। উওম্যান ফ্রাইডের ধমক খেয়ে মনে পড়ল, সুপ্রভাতের কথা। অনেকদিন ঝুনুর সঙ্গে মোলাকাত হয়নি। রাত দুটোয় ঘুমোতে গেলে ভোরবেলা ওঠা সম্ভব নয়।
প্রথমদিন যখন ভোরবেলায় ঝুনুকে দেখেছিল বৃন্দা, তখন এক স্নিগ্ধ অনুভবে ভরে গিয়েছিল মন। সেই অনুভব আজ আর নেই। কদিন ধরে মাথায় ঘুরছে অন্য একটা ছেলের মুখ। মফসসলি, মাঝারি চেহারার একটা ছেলে। পড়াশুনোয় অর্ডিনারি, চেহারায় সাদামাঠা, মধ্যবিত্ত তরুণ। কোনও বৈশিষ্ট নেই। সেই জন্যই ছেলেটাকে মনে ধরেছে বৃন্দার। তার চারপাশে সবাই বিশিষ্ট। সবাই ভিআইপি। সবাই বিখ্যাত। বাবা কলকাতার এক নম্বর সার্জন, মা নামী অভিনেত্রী, বাবার বন্ধুরা বাংলার এক নম্বর কবি, এক নম্বর চলচ্চিত্রকার, এক নম্বর ঔপন্যাসিক। আর সে নিজে? এই মুহূর্তে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের অফিসিয়াল সুন্দরী শ্রেষ্ঠা।
এত স্পটলাইট, এত খ্যাতির বৃত্ত বৃন্দার অসহ্য লাগে। মনের মধ্যে সবসময় পালাই পালাই ভাব হয়। জীবনটা সর্বক্ষণ রেড কার্পেট সেরিমনি। এর মধ্যে কোথাও জীবন যাপনের বিরতি নেই। ওই ক্যাবলা ছেলেটার পাশে থাকলে নিজেকে স্বাভাবিক মনে হয় বৃন্দার। মনে হয় বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে গেল!
ছেলেটাকে অল্পস্বল্প ইঙ্গিত দিচ্ছে বৃন্দা। ছেলেটা কিছু বুঝতে পারছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আনস্মার্ট তো, বেশি ইঙ্গিত দিলে ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে যাবে। তার থেকে এই ভালো। ‘ধীরে চলো’ নীতির পক্ষে মনে মনে সওয়াল করে বাথটাব ছাড়ে বৃন্দা। শরীর এখন ঝরঝরে লাগছে। আনাচে কানাচে যত ব্যথা বেদনা ছিল, সব উধাও। গা-মাথা মুছে, লিনেনের পোশাক গলিয়ে বাথরুম থেকে বেরোয় সে। বাকিরা কোথায় তদন্ত করা যাক।
মন্দিরা টিভির সামনে বসে রয়েছেন। স্কুপ চ্যানেলে একটা ইন্টারভিউ দেখাচ্ছে। উইকেন্ড পত্রিকার সাংবাদিক শক্তিরূপা সেনগুপ্ত ইন্টারভিউ নিচ্ছেন ঔপন্যাসিক বিপিন দত্তর। বিকেলে রেকর্ড করা অনুষ্ঠান, এখন রিপিট টেলিকাস্ট হচ্ছে। তলায় স্ক্রল যাচ্ছে, ‘এখন কেউ ফোন করবেন না। এই অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে।’
উইকেন্ড পত্রিকাটি শান্তিধামে ঢোকে। সিরিয়াস লেখা, লিজার অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট, ফ্যাশন, লাইফ স্টাইল, কমিকস, ওয়ার্ড গেম, নাম্বার গেম মিলে চমৎকার ফ্যামিলি ম্যাগাজিন। আম আদমির জন্য নানান মশলা থাকে। সিরিয়াস রিডারের জন্য একটি প্রবন্ধ, একটি ইন্টারভিউ ও একটি ধারাবাহিক আত্মজীবনী। বিপিনের সাক্ষাৎকারটি আগামী সংখ্যায় যাবে, আন্দাজ করল বৃন্দা।
শক্তিরূপা প্রশ্ন করছে, ‘বিধবাপুকুরের আজকের দিনে কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে? বিধবাবিবাহ আইন প্রচলিত হওয়ার পরে, পুকুরে ডুবে বিধবাদের আত্মহত্যার ঘটনা এখন আর ঘটে না।’
‘দ্য মোর থিংস চেঞ্জ, দ্য মোর দে রিমেন দ্য সেম। বিধবাপুকুরের উপন্যাসে দুটি প্রসঙ্গ আছে। একটি হল নারী শরীরের ওপরে পুরুষের দখলদারি। অন্যটি হল জমির ওপরে পুরুষের দখলদারি। দুটি বিষয় উপন্যাসের শেষে মিলে যাচ্ছে। গোরু ও জোরু, কামিনী ও কাঞ্চন, নারী ও নগরী—পিতৃতন্ত্র এদের আলাদা করে না। লিঙ্গ হোক বা লাঙল—যে কোনও কিছুর মাধ্যমে দখল নিতে চায়। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে দখলদারির ধরন বদলেছে। অতীতে জমিদারের লেঠেলবাহিনী জমির দখল নিত। আজ নেয় বহুজাতিক সংস্থা। দালালি খায় সরকার। অতীতে জমিদার পঞ্চদশী মেয়ের দখল নিত। দালালি খেত মেয়ের গরিব বাবা। আজ অর্গ্যানাইজড ইন্ডাসট্রি নারী শরীরকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে। বাবা-মা উৎসাহভরে মেয়েকে বিকিনি শ্যুটে পাঠায়।’
‘শেষ উদাহরণটা আমার উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে না।’ বিপিনকে থামায় শক্তিরূপা।
‘আমি জানতাম যে আপনার পছন্দ হবে না। কেন না আমার যুক্তিক্রম মানলে আপনার ম্যাগাজিনও এই ধর্ষক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। যারা প্রতি ইস্যুর মলাটে হার্ড নিউজের ছবির পাশাপাশি অর্ধনগ্ন মেয়ের ছবি ছাপে। যারা ফিল গুড ফ্যাক্টর-ওয়ালা স্টোরি ছাড়া কভার স্টোরি করে না। সত্যিকারের খবর আসে পার্শ্ব রচনা হিসেবে।’
‘আমরা বিষয়ান্তরে চলে যাচ্ছি।’ তড়িঘড়ি ইন্টারভিউয়ের রাশ টানে শক্তিরূপা।
‘ছেড়ে দিন,’ হাত নেড়ে মাছি তাড়ায় বিপিন, ‘আসুন আমরা সেফ বিষয় নিয়ে কথা বলি। জীবন বীক্ষা, শিল্পীর অধিকার, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ…’
চাপান উতোর চলছে। মন্দিরা খুব মন দিয়ে শুনছেন। তাঁকে কিছু না বলে, হাউসকোট চাপিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে বৃন্দা। তার গন্তব্য একতলায় স্যামির চেম্বার।
তিনতলায় দেখা হয়ে গেল তাপসী আর কুনালের সঙ্গে। আজ শনিবার। কুনাল বাড়ি যাচ্ছে। তাপসী তার হাতে এক কৌটো গয়না বড়ি তুলে দিয়ে বলল, ‘গিন্নিকে বলবে আমি পাঠিয়েছি। আমাদের গ্রামে বানানো।’
‘গিন্নি গয়নার জন্য দাঁত খিঁচোয়। গয়না বড়ি দেখলে ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে আসবে।’ হাসতে হাসতে বলে কুনাল। বৃন্দাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে বলে, ‘এত রাতে কোথায় পালাচ্ছিস? বয়ফ্রেন্ড এসেছে নাকি?’
‘এলে তো ভালোই হতো!’ মুখভঙ্গি করে বৃন্দা। ‘আগে জোটাই একটা। তারপর ঠিক পালাব।’
কুনাল আর বৃন্দার মশকরার মাঝে তাপসী বলে, ‘তুমি চন্দন সরকারকে চেনো?’
‘হ্যাঁ। আমার ক্লাসমেট। তুমি ওকে কী করে চিনলে?’ অবাক হয়ে বলে বৃন্দা।
‘ও আমার গ্রামের ছেলে। আমার দাদা যে ইশকুলের হেড মাস্টার, ও সেই ইশকুলে পড়াশুনো করেছে। আমি ওর দিদির মতো।’
‘তোমার বাড়ি নতুনগ্রামে?’
‘হ্যাঁ। তুমি আমার গ্রামের নাম কী করে জানলে?’
‘চন্দন উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছিল। ওর গ্রামের নাম, ওর স্যামিলটন স্কুলের নাম আমাদের কলেজের সবাই জানে। আমি আর চন্দন ভালো বন্ধু।’
‘চন্দন বলছিল।’ হাসে তাপসী। হঠাৎ কণ্ঠস্বর বদলে ফেলে কড়া গলায় বলে, ‘তুমি কি বাবার চেম্বারে যাচ্ছ? ওখানে এখন ওঁর বন্ধুবান্ধব এসেছেন।’
‘জানি।’ তাপসীকে পাত্তা না দিয়ে একতলার নামে বৃন্দা। স্যামির চেম্বারের পিছন দিকে একটা অ্যান্টি-চেম্বার আছে। সেই ঘরে ঢুকে দেয়ালে আড়ি পাতে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে মাতাল সুদিনের গলা, ‘আমি অ্যাকাডেমির কমিটি মেম্বারদের পায়ে নিয়মিত তেল মাখাতাম না। তাই আমি পাইনি। তুই মাখাতিস, তাই পেয়েছিস।’
বিপিনের গলা শোনা যায়, ‘আমি অ্যাকাডেমি প্রাইজ পাওয়ায় তুই কি ঈর্ষান্বিত? তা হলে অটোর পিছন দিকে যেটা লেখা থাকে সেটা ফলো কর। ”হিংসা কোরো না। চেষ্টা করো। তোমারও হবে”।’
‘ওরে আমার অটোওয়ালা রে!’ খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসেন সুদিন। ‘এবার বলবি, ‘বন্ধুত্ব বাড়িতে, ব্যবসা গাড়িতে’। কিংবা ‘৮০ বন্ধু। আবার দেখা হবে’।
‘আসি বন্ধুগণ। আবার দেখা হবে।’ মনোতোষের গলা শোনা যায়। ‘আজ এখানকার পরিবেশ দূষিত হয়ে গেছে। না থাকাই মঙ্গল।’
‘দূষিত হলে সেটা বিপিনের জন্য হয়েছে। সারাটা জীবন বিগ হাউসের দালালি করে গেল আর জনগণের কাছে নিজেকে অ্যান্টি-এস্ট্যাবলিশমেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে বিককিরি করল। হিপোক্রিট কাঁহিকা।’
‘হিংসে হিংসে!’ চেঁচিয়ে ওঠেন বিপিন, ‘দ্যাখ স্যামি, ওর কানগুলো সবুজ হয়ে গেছে।’
‘ইস্যুটা ডাইলিউট করিস না। দিস ইজ সিরিয়াস। জলের মতো গদ্য লিখে লিখে ইন্টেলিজেন্সটাকেও জলে ভাসিয়ে দিয়েছিস।’
‘আহ! সুদিন।’ স্যামির জড়ানো কণ্ঠস্বর এতক্ষণে শুনতে পেল বৃন্দা।
‘তুই আগামী শতকের তরুণ-তরুণীদের জন্য কবিতা লিখছিস, তাই লেখ। এখনকার জেনারেশন তোকে বুঝবে না।’ হাসতে হাসতে বলেন বিপিন, ‘তুই পস্টারিটির সাধনা করিস। তোর অমরত্ব চাই। আমার বাবা ওসব হ্যাং-আপ নেই। আমি নাস্তিক মানুষ। পরজন্মে বিশ্বাস করি না। আনন্দ, ফুর্তি, প্রশংসা, পুরষ্কার, রয়্যালটির টাকা—সব এই জন্মেই চাই।’
‘আমি তোর বই থেকে ছবিটা করলে, তোকে দিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখাব। বলা যায় না, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেতে পারিস।’ ফুট কাটে মনোতোষ।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। স্যামির বউকে না লাগালে তোর শান্তি নেই। এ আমি অনেক দিন থেকে জানি।’ চিৎকার করে ওঠেন সুদিন।
ঠাস করে চড় মারার শব্দ হল। শব্দ হয় গ্লাস ভাঙার। হাতাহাতি আর অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনে এক দৌড়ে লিফটে উঠে পড়ে বৃন্দা।
বাংলার বুদ্ধিজীবী! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃন্দা ভাবে, এঁদের ছবি কাগজের ফ্রন্ট পেজে প্রকাশিত হয়। টিভিতে এঁরা ইন্টারভিউ দেন। এঁদের নিয়ে লোকে গর্ববোধ করে। হায় রে! এঁদের থেকে সাধারণ মানুষ অনেক ভালো আছে। তারা বাজার যায়, রান্না করে, আপিস যায়, আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে শান্তিতে ঘুমোয়। মাইল মাইল লম্বা প্যাঁচ মাথার মধ্যে পুরে ঘুরে বেড়ায় না।
মফসসলি, পড়াশুনোয় মাঝারি, সাধারণ চেহারার অভির কথা মনে পড়ে যায় বৃন্দার। ওকে কাল একবার ফোন করতে হবে।
.
চন্দন
সকাল সাড়ে সাতটার মেচেদা লোকাল ফাঁকা থাকে। ওই ট্রেনটা ধরতে হবে। সকালের দিকে মহাত্মা গাঁধী রোড শুনশান। হাওড়া ময়দান—শিয়ালদা রুটের সরকারি বাস কুড়ি মিনিটের মধ্যে শিয়ালদা থেকে হাওড়া পৌঁছে যায়। সেই হিসেব মতো পৌনে সাতটার সময় বয়েজ হোস্টেল থেকে বেরিয়েছে চন্দন। স্টেশানে পৌঁছে টিকিট কাটতে খানিকটা সময় যাবে।
মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল সকাল ছ’টায়। অ্যালার্ম বাজার পরে কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ে চন্দন। পাশের খাটে রিপু ঘুমোচ্ছে। অর্ধেক শরীর খাটের বাইরে। কাল রাত্তিরে অনেকটা রাম খেয়েছিল।
হাওড়ার স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে গতকাল রাতের গ্র্যান্ড ফিস্টের কথা ভেবে মনমরা একটা হাসি ফুটে ওঠে চন্দনের মুখে। হোস্টেলে বোর্ডাস কমিটির অর্গানাইজ করা গ্র্যান্ড ফিস্টে অনেক নতুন নতুন দিক জানা গেল…
অতীতে হোস্টেলে একাধিক মিনি মেস ছিল। মিনি মেসের অর্থ হল, হোস্টেলের প্রতি তলায় একাধিক মেস, সেই ফ্লোরের নির্দিষ্ট কয়েকজন বোর্ডারের জন্য। একতলার জেনারেল মেসের খাওয়ার কোয়ালিটি যাচ্ছেতাই। ডেলা ডেলা আধসেদ্ধ ভাত, ট্যালটেলে জলের মতো ডাল, ঘাসভাজার মতো সবজি, মাছের ঝোলে মাছ নেই। নোংরা স্টিলের থালায় আর নোংরা বাটিতে যখন খাবার আসে, দেখে গা গুলিয়ে ওঠে। প্রতিবেশী রাজ্যের বাসিন্দা, একদল পাচক এই মেস চালায়। কলকাতার অন্যান্য হোস্টেলের মেসের পাচকদের সঙ্গে তাদের জোট বা ঘোঁট অত্যন্ত শক্তিশালী। থেকে থেকেই তারা সরকারি চাকরির দাবিতে আন্দোলন করে। তখন মেস বন্ধ হয়ে যায়।
চাহিদা আছে। জোগান নেই। ছাত্রদের চারবেলা খাবারের বাজার ধরতে প্রতি ফ্লোরে শুরু হল মিনি মেস। বিজনেস মডেল অতিশয় সরল। মেসেরই একজন পাচক হোস্টেলের করিডোরের এক কোণে একটি বা দুটি হিটার বসিয়ে রান্না শুরু করল। জোগাড় করল একটি বড় টেবিল ও দুটি বড় বেঞ্চি। রান্নার বাসনপত্র আর কাঁচা বাজার তার ইনভেস্টমেন্ট। চার বেলার খাওয়ার কোয়ালিটি বেশ ভালো। দাম বেশি। তবে দিতে কেউ আপত্তি করে না। পনেরো থেকে তিরিশজন সদস্য বিশিষ্ট এই মিনি মেসের কারণে একতলার মেস উঠে যাওয়ার জোগাড়। এ দিকে হিটার জ্বালানোর কারণে হোস্টেলের ইলেকট্রিসিটি বিল উঠল লাখ টাকার ওপরে। অনাদায়ী টাকা চেয়ে ইলেকট্রিক সাপ্লাই থেকে বহুবার চিঠি পাঠিয়েছে। লাইন কেটে দেওয়ার গুজবও রটেছে।
অ্যানেক্স ব্লকের মিনি মেসের কোয়ালিটি সব থেকে ভালো। অধিকাংশ অবাঙালি ছেলেরা এই ব্লকের মিনি মেসে খায়। মছলি একদম চলে না। বাঙালি রান্নাও হয় না। অনেক মিনি মেসেই ফ্রিজ আছে। বিয়ার বা অন্যান্য হার্ড ড্রিংক সহজলভ্য। কোনও কোনও মিনি মেস চরস বা কোকেন সাপ্লাই করে।
দময়ন্তী এবং সুরজের ঘটনাটা মিডিয়ার থিতোতে না থিতোতে একদিন স্কুপ টিভি দেখিয়ে দিল, এই সব মিনি মেসের কারণে সরকারের ব্যয় কী পরিমাণ বাড়ছে। ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের এক কর্তা ক্যামেরার দিকে কাগজ নেড়ে জানালেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের বয়েজ হোস্টেল থেকে তাঁদের প্রাপ্য এক কোটি টাকা। অথচ রাজনৈতিক দাদাগিরির জন্য তিনি লাইন কাটতে পারছেন না। তারপরই টিভিতে বাইট দিল পিএমএফের সব্যসাচী। সে প্রথমেই স্বীকার করল, নিজেও মিনি মেসে খায়। তারপর সমস্যাটা সুন্দর ব্যাখ্যা করে বলল, এর একমাত্র সমাধান, একতলার মেসের মানোন্নয়ন করা ও প্রতিটি ফ্লোরের মিনি মেস ভেঙে দেওয়া। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে?
টিভিতে খবরটি সম্প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিপুর ফোন ঝনঝনিয়ে উঠল। ‘অধীরদা কলিং,’ হতাশ গলায় চন্দনকে বলল রিপু। তারপর ফোন ধরল।
‘ডাক্তারবাবু, একবার আমার সঙ্গে দেখা করে যাও।’ হালকা চালে বলেন অধীর।
‘কাল গেলে হবে না?’ জানতে চায় রিপু।
‘এখনই। এই মুহূর্তে।’ ধমক দেন অধীর।
‘আসছি।’ ফোন কেটে বারমুডার ওপরে প্যান্ট গলায় রিপু। তার চোখমুখের অবস্থা ভালো নয়। দেখে মায়া হয় চন্দনের। সে বলে, ‘চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’
‘তুই? পার্টি অফিসে?’ ভুরু কুঁচকে সামান্য ভাবে রিপু। বলে, ‘আচ্ছা, চল।’
রিপুর বাইকে চেপে মৌলালি আর এন্টালি পেরিয়ে আনসারুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে পৌঁছতে সময় লাগল মিনিট কুড়ি। এতদিন চারতলা এই বাড়িটার ছবি কাগজ আর টিভিতে দেখেছে চন্দন। আজ সামনা সামনি দেখে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।
গেট টপকে গাড়ি রাখার প্রশস্ত এলাকা। এক কোণে বাইক পার্ক করে কোলাপসিবল গেট টপকে পার্টি অফিসে ঢোকে রিপু। টপাটপ সিঁড়ি টপকে দোতলায় ওঠে। সিড়ির ল্যান্ডিং-এ কিছুদিন আগে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও পলিটব্যুরোর সদস্যর ছবি। তেলরঙে আঁকা ছবিটা দেখে নমষ্কার করে চন্দন। তার বাবা-মা এই লোকটাকে ভগবানের মতো ভক্তি করে। পারিবারিক নিয়ম মেনে সেও ভক্তি করতে বাধ্য।
দোতলার ঘরে বসে লিকার চা খাচ্ছিলেন অধীর। রিপুকে দেখে বললেন, ‘সঙ্গে এটা কাকে নিয়ে এলে? নতুন চ্যালা? টিনটিন কোথায়?’
‘চ্যালা নয়। এ আমার রুমমেট। নাম চন্দন সরকার। উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছিল। নিজেই আসতে চাইল।’ কাটা কাটা উত্তর দেয় রিপু।
‘উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট?’ রিপুকে ছেড়ে চন্দনকে নিয়ে পড়েন অধীর, ‘বাড়ি কোথায়?’
‘নতুনগ্রাম।’ সংক্ষিপ্ত জবাব চন্দনের।
নতুনগ্রামের নাম শুনে অধীরের মুখে অস্বস্তিকর অভিব্যক্তি তৈরি হয়েছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘এখানে দুটো চা দিয়ো।’
হাওড়া স্টেশানের টিকিট কাউন্টারে পৌঁছে খুপরি দিয়ে কুড়ি টাকার নোট গলিয়ে দেয় চন্দন। খুচরো টাকা আর মেচেদার টিকিট নিয়ে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে। মেচেদা লোকাল পনেরো নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। অনেকটা হাঁটতে হবে। সাতটা কুড়ি বাজে। ভাগ্যিস সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল।
চন্দনকে ছেড়ে রিপুকে নিয়ে পড়েছিলেন অধীর। বলেছিলেন, ‘তোমাদের জ্বালায় কি একদিনও শান্তিতে থাকা যাবে না? ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ রোজ নিউজে আসছে কেন?’
‘দেখুন অধীরদা, মিনি মেস আছে আমার আইএমসিতে ঢোকার আগে থেকে। জেনারেল মেসের বারোটা কীভাবে বাজল, তা আমি জানি না। হাসপাতাল অথরিটির জানা উচিৎ। মিনি মেস একটা রিয়্যালিটি। এখন মিডিয়া যদি চায় যে এই ইস্যুতে সরকারের পিছনে কাঠি করবে, তা হলে তার দায় আমি নেব কেন?’ শান্তভাবে নিজের যুক্তি পেশ করে রিপু।
রিপুর কথার উত্তরে অধীরদা উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগে চন্দন বলল, ‘আমার একটা সাজেশান আছে।’
‘তোর?’ ভুরু কুঁচকে বলে রিপু।
‘বলে ফেলো।’ বলেন অধীর।
‘ইস্যুটা যখন উঠেছে, তখন ছেড়ে দেওয়া উচিৎ না। একে কাজে লাগানো উচিত। এক সপ্তাহের নোটিস দিয়ে সবকটা মিনি মেস বন্ধ করে দেওয়া হোক। হোস্টেলের মেস কোনও প্রাইভেট পার্টিকে কনট্র্যাক্টের ভিত্তিতে দেওয়া হোক। তারা মেস চালাক। ছেলেদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হোক। এতে সমস্যা মিটবে।’
‘মিনি মেস তুলে দিলে একদিকে ছেলেরা খচবে, অন্যদিকে ঠাকুরগুলো খচবে। তারা আন্দোলন শুরু করলে একূল-ওকূল দুকূল যাবে। সে কথা ভেবেছিস?’ দাঁত খিচোয় রিপু।
‘ভেবেছি। বেশিরভাগ ছেলে খাওয়ার কোয়ালিটি নিয়ে বদারড। সে খাবার মিনি মেস থেকে না ম্যাক্সি মেস থেকে আসছে, তা নিয়ে বদারড নয়। আর একটা জিনিস আমরা ভুলে যাচ্ছি। সেটা হল, মিনি মেস তুলে দেওয়ার ফলে কেউ কাজ খোওয়াচ্ছে না। কেন না মিনি মেস যারা চালায় তারা সবাই জেনারেল মেসের স্টাফ। ওরা জানে যে ওরা বেআইনি হুকিং করে। মিনি মেস বন্ধ করলে ওরা আপত্তি করবে না। আপত্তি করবে অ্যানেক্স ব্লকে যারা খায়, তারা। সে আর কী করা যাবে! মেজরিটির সিদ্ধান্ত মাইনরিটিকে মানতে হবে।’
রিপু অবাক হয়ে অধীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কালকের ছোঁড়ার সাহস দেখলেন অধীরদা?’
‘একটু র্যাডিকাল, কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। কাজটা কীভাবে করা সম্ভব বলে মনে হয় চন্দন?’ অধীর জানতে চান।
‘খুব সহজ। হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি একটা রেজলিউশন করুক যে, ”মিনি মেস তুলে দেওয়া হোক।” সেটা হোস্টেলের সুপার এবং কলেজের প্রিন্সিপাল অ্যাপ্রূভ করুক। পাশাপাশি হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির ফ্লোর রিপ্রেজেনটেটিভরা মিটিং ডেকে সমস্ত বোর্ডারকে জানিয়ে দিক যে মার্চ মাসের এক তারিখ থেকে সমস্ত মিনি মেস উঠে যাবে। মিনি মেসের মালিক বা ঠাকুরদেরও এই কথা জানিয়ে দেওয়া হোক। আজ ফেব্রুয়ারি মাসের সাত তারিখ। হাতে অনেক সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে কোনও ক্যাটারিং কোম্পানি খুঁজে বার করতে হবে, যে মেস চালানোর দায়িত্ব নেবে। প্রাথমিকভাবে এক মাসের এগ্রিমেন্ট হোক। খাবারের কোয়ালিটি পছন্দ হলে এক বছরের।’
‘টেন্ডার ডাকতে হবে নাকি? তার তো অনেক হ্যাপা।’ রিপু বলে।
‘কিসসু ডাকতে হবে না। শুরু করাটা জরুরি। আগে শুরু করে দাও। টেন্ডার-ফেন্ডার পরের বছর থেকে হবে।’
‘পরে এই নিয়ে গন্ডগোল হলে?’
‘কেন গন্ডগোল হবে? সত্যি কথাটা প্রথমেই জানিয়ে দাও। যে, সময়ের অভাবের জন্য টেন্ডার ডাকা যায়নি। এবং কেউ কাটমানি খায়নি। প্রসেসটা স্বচ্ছ রাখো। পাবলিক বোকা নয়। তারা আমাদের ইনটেনশান বুঝবে।’
‘পাবলিক বোকা নয়। তারা আমাদের ইনটেনশান বুঝবে…’ চন্দনের বলা কথাগুলো নিজে একবার বলেন অধীর। যেন নিজেকে বোঝান। কিছুটা অন্যমনস্ক লাগে তাঁকে। নিমেষেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রিপুকে বলেন, ‘চন্দন যা বলল, তা করে ফেলো। আর ছোকরাকে এজি দিয়ে দাও। আমাদের পার্টির ‘কর্মসূচী ও কর্মনীতি’ পড়াও। এর মধ্যে মেটিরিয়াল আছে।’
‘জনমোর্চার ”কর্মসূচী ও কর্মনীতি” আমার পড়া। কিন্তু এজি-টা কী বস্তু?’ অধীরের দিকে তাকিয়ে বলেছিল চন্দন। রিপু ফিচেল হেসে চন্দনের হাত ধরে টানতে টানতে আনসারুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিল।
সাড়ে সাতটার মেচেদা লোকাল ফাঁকা। মাঝামাঝি একটা কামরায় উঠে আরাম করে বসল চন্দন। ফাঁকা কামরায় জনা পাঁচেক লোক। ব্যাকপ্যাককে বালিশ করে, বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ল। গতকাল গ্র্যান্ড ফিস্টের খাওয়াটা জম্পেস হয়েছিল।
মিনি মেস উঠে যাওয়া নিয়ে হোস্টেলে কোনও সমস্যা হয়নি। পুরো হোস্টেলে ছাব্বিশটা মিনি মেস চলত। সুপার ও প্রিন্সিপালের নোটিস পাওয়ার একদিনের মধ্যে কুড়িখানা সুড়সুড় করে উঠে গেল। বাকি ছ’টার মধ্যে চারটে অ্যানেক্স ব্লকে। আর দুটো ন্যাবারা চালায়। এগুলো তুলতে বাধা এসেছিল। অবাঙালি ছেলেরা সুরজ আর সঞ্জয়ের নেতৃত্বে লাঠিসোটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চন্দন সঞ্জয়ের হাত থেকে লাঠি কেড়ে তাকে দু’ঘা দিতেই বাকিরা লেজ গুটিয়ে হাওয়া। সুরজের মিনি মেসের ফ্রিজে কয়েক বোতল বিয়ার রাখা ছিল। সেগুলো তিনতলার থেকে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দিয়ে চন্দন বলল, ‘এই ফ্রিজের মালিক কে?’
ছয়ফুটিয়া সুরজ বলল, ‘আমি।’
‘নিজের ঘরে রাখ। করিডোরে যেন না দেখি।’
‘করিডোরে থাকলে কী করবি?’
‘বিয়ারের বোতলের মতো তিনতলা থেকে নীচে ফেলে দেব।’
আর কথা বাড়ায়নি সুরজ। হোস্টেল মেসে কাজ করার জন্য শিয়ালদার নামকরা ক্যাটারিং কোম্পানি পেটপুজো-র মালিক উৎপল বারিককে দেওয়া হল। চন্দন আর রিপুর সঙ্গে উৎপলের আগে থেকেই আলাপ ছিল। ওপিয়াম ফেস্টের সময় যাবতীয় খাবারের বরাত উৎপল পেয়েছিল।
উৎপল কাজ শুরু করল পয়লা মার্চ থেকে। প্রথম সাতদিন খাওয়াদাওয়া করে সবাই খুব খুশি। রান্নাঘরে রঙের পোঁচ পড়েছে, তেলচিটে কড়া-গামলা-ডেগচি উধাও, উনুন ভেঙে দিয়ে অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার এল, থালা-বাটি-গ্লাস স্টিল থেকে ডিসপোজেবল হয়ে গেল। দুর্দান্ত ব্যবস্থা। ডাইনিং হলেও নতুন রঙের পোঁচ, ঢকঢকে কাঠের বেঞ্চি আর নড়বড়ে টেবিলের বদলে সানমাইকা বসানো টেবিল চেয়ার। ‘পেটপুজো’-র মালিক উৎপল পনেরো দিনের মাথায় তিনজন ঠাকুরকে বরখাস্ত করল। তারা চুরি করছিল। তাদের বদলে নিজের লোক ঢোকাল তিনজন। একমাসের মাথায় রুম নাম্বার একশো পঁচিশে এসে উৎপল রিপুকে বলল, ‘ব্যাবসা আমি দাঁড় করিয়ে দেব। কিন্তু ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট তুলতে হলে আমাকে অন্তত তিন বছর সুযোগ দিতে হবে।’
‘দেখুন উৎপলদা, আপনার সঙ্গে যতই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাক না কেন, এখানে আপনি ব্যবসা করতে এসেছেন,’ রিপুকে বলতে না দিয়ে চন্দন বলে, ‘কাগজে লেখাপড়া করা আছে, আপনার মেয়াদ এক বছর। বছর শেষ হলে টেন্ডার ডাকা হবে। এই শর্ত মেনেই আপনি এখানে এসেছেন। এখন অন্য কথা বলা যাবে না।’
‘এক মাসের মাথায় একটা গ্র্যান্ড ফিস্ট দিই?’ চন্দনকে পাত্তা না দিয়ে রিপুকে প্রশ্ন করে উৎপল। ‘নতুন বছরে একপ্রস্থ খ্যাঁটন হয়ে যাক। চিলি চিকেন, মাটন কষা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, আমসত্ব-খেজুরের চাটনি…’
‘আপনাকে মেনুকার্ড মুখস্ত বলতে হবে না।’ উৎপলকে এক ধমকে থামিয়ে দেয় চন্দন, ‘এখন গ্র্যান্ড ফিস্ট করার প্রয়োজন নেই। মেসটা ঠিকঠাক পরের বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত চালান। তারপর ওসব হবে। একদিন ভালো খাইয়ে বাকি দিনগুলো জেলখানার লপসি সাপ্লাই করছেন কি না, আগে দেখে নিই।’
রিপু কিছু বলেনি। বিমর্ষ হয়ে উৎপল ফেরত গিয়েছিল। চন্দন বলেছিল, ‘তোমাকে কদিন হল চুপচাপ দেখছি। কী ব্যাপার বল তো?’
‘কিছু না।’ খাটে আধশোয়া বলে রিপু।
‘অধীরদা এজি না হেঁজিপেঁজি কী একটা বলেছিল। সেটা কী বললে না তো?’ সিগারেট ধরিয়ে বলে চন্দন। রিপু আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে বলল, ‘তুই রাজনীতি করতে আগ্রহী?’
‘রাজনীতি করা মানে কী? আমাদের জীবনটাই তো রাজনীতি।’
‘পাকাপাকা কথা বলিস না। গোদাভাবে কথাটার মানে হল পার্টিকর্মী হিসেবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা। সমর্থক হিসেবে নয়।’
‘দেখো রিপুদা, আমাদের বাড়ি রাজনীতির বাড়ি। বাবা মোচাপার্টির সদস্য না হলেও সক্রিয় কর্মী। মা-ও মিটিং মিছিলে যায়। আমি এই পরিবেশেই বড় হয়েছি।’
‘পার্টির সদস্যপদ সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে?’
‘জনমোর্চা পার্টির স্ট্রাকচারটা পিরামিডের মতো। একদম শীর্ষে পলিট ব্যুরো। তার নীচে রাজ্য কমিটি, তার নীচে জেলা কমিটি, লোকাল কমিটি, ব্রাঞ্চ কমিটি। এটা পার্টি সংগঠনের চেহারা। গণসংগঠনের চেহারাটাও একইরকম। আমাদের ছাত্র সংগঠনেও একই স্ট্রাকচার। শাখা, অঞ্চল, জেলা, রাজ্য, সর্বভারতীয় কমিটি।’
‘এত জানিস আর এজি জানিস না?’
‘জানি না কথাটা ঠিক নয়। আমার বাবাকে এজি অফার করেছিল মোর্চা পার্টির থেকে। বাবা কয়েক দিন মিটিং অ্যাটেন্ড করে আর যায়নি। হাওড়া কোর্টে চাকরি করে, সাংবাদিকতা করে, চাষবাস করে পার্টির জন্য সময় বার করতে পারেনি। পার্টি থেকে অনেক বই পড়তে দিয়েছিল। বাবার সঙ্গে ওইসব বই আমিও পড়ে ফেলেছি।’
‘সবই তো জানিস। তাহলে প্রশ্নটা কী?’
‘এজি পুরো কথাটা কী?’
‘ওহ! এই ব্যাপার। এজি মানে অক্সিলিয়ারি গ্রুপ। কাউকে পার্টি মেম্বারশিপ অফার করার আগে আমরা বাজিয়ে নিই। জনমোর্চার মতাদর্শ সে ব্যক্তিগত জীবনেও পালন করছে কি? না ধান্দাবাজির জন্য পার্টিতে আসছে, তা দেখে নিতে হয়। আমাদের সরকার এসেছে ঊনত্রিশ বছর আগে। তখন যারা পার্টিতে এসেছিল, আর এখন যারা আসছে, তাদের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। সরকারে থেকে থেকে পার্টির গায়ে চর্বি জমেছে। চর্বির ভাগ নিতে অনেকে আসছে। তুই সেইরকম বেনোজল কি না, তা দেখতে হবে। তাছাড়া, মার্কসবাদী পত্রপত্রিকা পড়ার কালচার আমাদের পার্টিতে আছে। নিয়মিত লেভি দিতে হয়।’
‘লেভি কী?’
‘উপার্জনের একটা অংশ পার্টিকে দিতে হবে।’
‘এখন আমার কোনও উপার্জন নেই।’
‘সে আমারও নেই। আমাদের লেভি নামমাত্র। কিন্তু পাস করার পর যখন রোজগার করবি তখন পার্টিকে টাকা দিতে গা কটকট করবে না তো? এই সব ভেবে দেখিস। অধীরদা বলেছেন বলেই স্রোতে গা ভাসানোর জন্য ”হ্যাঁ” বলে দিস না। নেই নেই করেও পার্টিতে সততা, নিয়মানুবর্তিতা, গরিব মানুষের জন্য সিরিয়াসলি ভাবা, তাদের জন্য কিছু করা—এগুলোর মূল্য আছে। জনমোর্চায় এসে কিছু পাবি না। স্যাক্রিফাইস করতে হবে প্রচুর।’
‘আমজনতার কাছে মোচাপার্টির চেহারাটা একরকম নয়। নেতাগুলো মহাখচ্চর। এমনকী তোমার ওই অধীরদাও। ও শিয়ালদার এমএলএ। ওর নামে বদনাম প্রচুর। তোলাবাজি, গুন্ডামি, প্রোমোটারি, হাড়কাটার মেয়েদের কাছ থেকে টাকা তোলা—কী নয়?’
‘জানি। ওই জন্যই তোকে ভাবতে বলছি। আমি পার্টিতে এসেছিলাম আদর্শ নিয়ে। তিন বছরের মধ্যে ফ্রাস্ট্রেটেড। কলেজে তিনটে ‘প’ একসঙ্গে হয় না। পড়াশুনো, পলিটিকস আর প্রেম। আমি তিনটে নিয়েই ঘেঁটে আছি। কোনওটাকে ছাড়তে পারছি না। ওই জন্যই বলছি, অধীরদা বললেন বলে নাচতে নাচতে ”হ্যাঁ” বলিস না। ”ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপোঃ” কথাটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি।’
রিপুর জ্ঞানের মধ্যে আসল কথাটা পিকআপ করে নিয়েছে চন্দন। উত্তেজিত হয়ে সে বলল, ‘তুমি প্রেম করো? কার সঙ্গে? রুমমেট হয়েও বুঝতে পারলাম না। আমার আইকিউ এত কমে গেল কী করে?’
‘আপ্পু! ও আমার ছোটবেলার বন্ধু। ক্লাস টুয়েলভ থেকে প্রেম। ওসব নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে। আর কাউকে বলেছিস জানতে পারলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব।’
‘আমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। যাই হোক, আমার ডিশিসন নেওয়া হয়ে গেছে। আমি এজি হতে রাজি।’ রিপুকে বলেছিল চন্দন।
.
এখন চলন্ত ট্রেনে শুয়ে সেইসব কথা মনে করতে করতে পাতলা হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। হকারের কাছ থেকে এক ভাঁড় চা কেনে।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে জনমোর্চার শাখা ছোট্ট। রিপু শাখা সম্পাদক। শাখার সদস্যরা হল আপ্পু, টিনটিন, বান্টি এবং সুব্রত। ফার্স্ট ইয়ার থেকে এজিতে নেওয়া হয়েছে মোট তিনজনকে। চন্দন ছাড়া প্রবাল এবং দীপ। মেয়েদের কয়েকজনকে আপ্পু অ্যাপ্রোচ করেছিল। কেউ রাজি হয়নি।
প্রথমদিন একশো পঁচিশ নম্বর ঘরেই পার্টির ক্লাস নিয়েছিল রিপু। দরজা বন্ধ করে চন্দন, প্রবাল এবং দীপকে বুঝিয়েছিল জনমোর্চা পার্টির ইতিহাস। হাতে ধরিয়েছিল পার্টি পুস্তিকা, পার্টি চিঠি, কর্মসূচী ও কর্মনীতি। গ্রাহক করেছিল পার্টির সংবাদপত্র জনমতের। পার্টি পুস্তিকাটিতে জনমোর্চার আদর্শগত রূপরেখা সংক্ষেপে ব্যক্ত করা আছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বইটি চন্দনের সঙ্গী।
পার্টি সংগঠনের পাশাপাশি, গণসংগঠনের কাজেও চন্দন যথেষ্ট দড়। তারই প্রমাণ গতকালের গ্র্যান্ডফিস্ট। ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ হওয়ার ঠিক পরদিন হোস্টেলে গ্র্যান্ড ফিস্ট অর্গানাইজ করে হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি হোস্টেলের সমস্ত বোর্ডারদের মন জয় করে নিয়েছে। উৎপল এবং তার পেটপুজো ক্যাটারিং গতরাতে অসাধারণ এক মেনু উপহার দিয়েছে।
উৎপল গোড়ায় যে মেনু বলেছিল, তাতে কাঁটছাঁট করেছে চন্দন। গতরাতে মেনু ছিল লুচি, বেগুন ভাজা, ছোলার ডাল, পাঁঠার মাংস, রাবড়ি। যত খুশি তত খাও। একগাদা আইটেম বাবদ যে খরচা হতো তা বাদ দিয়ে ভালো কোয়ালিটি এবং অফুরন্ত কোয়ান্টিটির দিকে উৎপলকে নজর দিতে বলা হয়েছিল।
ছেলেরা খেয়েছেও সেই রকম। সন্ধে নামতে না নামতে বিভিন্ন ঘরে বোতল খুলে মোচ্ছব শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাত ন’টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত মাতাল এবং পেটুক ছেলের দল সমস্ত খাবার শেষ করে দিল। শেষ পাতে পান এবং মুখশুদ্ধিও ছিল। হোস্টেলের সবাই খুশি। হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি খুশ। উৎপল খুশ। রিপু, বান্টি, সুব্রত—সবাই খুশ। টিনটিনকে গতরাতে দেখা যায়নি।
হঠাৎ চন্দন খেয়াল করল, গমগম ঝমঝম শব্দ করে কোলাঘাট ব্রিজ পেরোচ্ছে মেচেদা লোকাল। সিট থেকে উঠে সে ব্যাগ কাঁধে নেয়। স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই এক লাফে ফ্লাইওভারের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ে। ন’টা নাগাদ কতগুলো দূরপাল্লার বাস আছে। ওগুলোয় উঠলে আধঘণ্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছানো যাবে।
তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাসস্ট্যান্ডে এসে চন্দনের চক্ষু স্থির। বাসস্ট্যান্ডে একটাও বাস নেই। বাসহীন স্ট্যান্ডে একটা জনসভা হচ্ছে। হাজার পাঁচেক লোক ভাষণ শুনছে। প্যান্টশার্ট পরা অফিস বাবু থেকে ধুতি-লুঙ্গি পরা চাষাভুসো মানুষ—সবাই রয়েছে। সবার হাতে নবযুগ পার্টির ফ্ল্যাগ। অনেকের হাতে মৃন্ময় চ্যাটার্জির ফোটোওয়ালা পোস্টার। জমায়েতের কেন্দ্রে মাইক হাতে ভাষণ দিচ্ছে ধবধবে কুর্তা-পাজামা পরা এক ভদ্রলোক।
‘বন্ধুগণ, এতদিন আমরা যা সন্দেহ করেছিলাম, গতকাল সন্ধেবেলা তা সত্যি হল। বর্তমান সরকার চোরের মতো রাতের অন্ধকারে এসে আমার আপনার বাড়ির গায়ে, গাছের গুঁড়িতে, খেতের আলপথের ওপরে নোটিশ মেরে গেছে যে সরকার কর্তৃক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হল। ইংল্যান্ডের কোন কোম্পানি এখানে এসে হেলথ হাব খুলবে। সেই জন্য আমাদের বাড়ি, ঘর, চাষের জমি খোয়াতে হবে। হেলথ হাব কাকে বলে আপনারা জানেন?’
‘না-আ-আ-আ!’ সমবেত চিৎকার করে ক্রুদ্ধ জনতা।
‘আমিও জানি না। এটুকু বুঝেছি যে আপনার আমার জমি লালমুখো সাহেবকে বেচে দিতে হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আবার ফেরত আসছে। আর তার দালালি করছে জনমোর্চার লাল কুত্তাগুলো।’
শক্তিধর মাইতি! বক্তাকে চিনতে এক মিনিটও লাগল না চন্দনের। মাইতি জুয়েলার্সের মালিক। কোটিপতি। এতদিন জাতীয়তাবাদী পার্টি করত। সময় বুঝে নবযুগ পার্টিতে ভিড়েছে। শক্তিধরের বক্তব্য শুনতে মঞ্চের কাছাকাছি যায় চন্দন। তার মনে প্রবল উৎকন্ঠা। সত্যি এই সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে? জমি কেড়ে নিলে লোকগুলো যাবে কোথায়?
‘এই সেই নোটিশ!’ এ-ফোর সাইজের কাগজ নাড়ে শক্তিধর। ‘আমরা জানি সংবিধানগত ভাবে ভারতবর্ষের যাবতীয় জমির মালিক রাষ্ট্র। আমার, আপনার—সবার বাড়ি বা জমির আসল মালিক সরকার। আমাদের তাই প্রপার্টি ট্যাক্স দিতে হয়। দরকারে সরকার জমি নিতে চাইলে নেবে। আমার তা নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই। আমি যতদূর বুঝি, হেলথ হাব মানে হাসপাতাল। দক্ষিণে যেমন ভেলোর, পশ্চিমে যেমন মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল বা পুনের এএফএমসি, এখানেও সেরকম কিছু হওয়া উচিৎ। আমাদের বাড়ির লোক সেখানে চিকিৎসা পাবে। তাছাড়া এখানকার বাজার বাড়বে। রাস্তাঘাট উন্নত হবে, ইলেকট্রিসিটি আসবে, রেললাইন বসবে। সরকার অধিগ্রহণ করেছে বাঁজাপলাশ গ্রামের পুরোটা। এমনকী ওখানকার হেলথ সেন্টারও উঠে যাবে। বাঁজাপলাশ গ্রামে পাকা বাড়ি বলতে স্যামিলটন ইশকুলের প্রধান শিক্ষক গোপাল নস্করের দোতলা বাড়ি। ওই গ্রামে নোনাজমি আর বালির কারণে চাষাবাদ হয় না। ওই গ্রামে জোয়াকিম জনজাতির বাস। তারা বামন। এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করার ফলে দু’হাজার জোয়াকিম বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এ আমরা মেনে নেব?’
পাঁচ হাজার লোক গর্জে উঠল, ‘কখনওই না! নবযুগ পার্টি জিন্দাবাদ। মৃন্ময় চ্যাটার্জি জিন্দাবাদ।’
চন্দন অবাক হয়ে ভাবল, রাজ্য সরকার দু’হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে জমি অধিগ্রহণ করতে চলেছে। যে পার্টি এই সরকার চালায় চন্দন সেই পার্টির খাতায় নাম লিখিয়েছে। এবার কী হবে?
.
দময়ন্তী
এটা কোন জায়গা? ইটের তৈরি একচিলতে সরু রাস্তা খানাখন্দে ভরা। রাস্তার দু’পাশে ফুটপাথের ওপরে একের পর এক দোকান। কোনও দোকানে মশলা চা বিক্রি হচ্ছে, কোনও দোকানে মাংসের ঘুগনি। কোনও দোকানে পরোটা, কোনও দোকানে চাউমিন, কোনও দোকানে দিশি মদ। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা দোকানের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দু’পাশে পুরনো আমলের অজস্র বাড়ি। পলেস্তারা খসে গিয়ে ইট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাড়িগুলো দাঁত বার করে হাসছে। রংচটা সবুজ কাঠের দরজার ওপারে নানা বয়সি অজস্র মেয়ে দাঁড়িয়ে। তারা নিজেদের মধ্যে হাহাহিহি করে হাসছে।
রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে অজস্র লোক। প্যান্টশার্ট, ধুতি-পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি-কুর্তা, লুঙ্গি-ফতুয়া—সব রকমের পোশাক রয়েছে। সকলের মাথায় ছাতা। কেন না মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। দময়ন্তীর পরনের জিনস আর টি-শার্ট ভিজে শপশপ করছে। এই মহল্লায় সে পৌঁছল কী করে? রাস্তার পুরুষরা, ফুটপাথের দোকানদাররা, কোঠার মেয়েরা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।
ভীষণ শীত করছে। ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে দময়ন্তী। উষ্ণতার খোঁজে চায়ের দোকানের ত্রিপলের তলায় দাঁড়িয়ে সে বলে, ‘একটা চা দেখি।’
কঠিন গলায় দোকানদার বলল, ‘মেয়েদের চা খেতে নেই।’
এ আবার কীরকম নিয়ম রে বাবা! বিরক্ত হয়ে সে পাশের দোকানে গিয়ে বলল, ‘এক প্লেট চাউমিন দেখি।’
চাউমিনওয়ালা তার দিকে তাকাতে দময়ন্তী অবাক। এ তো রমেন! রোম্যানো স্যান্টোস ছেড়ে এখানে দোকান দিয়েছে কেন? রমেন মাথা নিচু করে, জিভ দিয়ে ‘ছিক’ আওয়াজ করে, ঘাড় নেড়ে বলল, ‘মেয়েদের চাউমিন খাওয়া বারণ। বাড়ির শিক্ষা-দীক্ষা নেই নাকি? তা ছাড়া মেয়েদের জিনস পরা বারণ, সন্ধেবেলা একা বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ, মোবাইল ব্যবহার করা বারণ। তুমি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছ।’
ধ্যাত্তেরিকা! ফুটপাথ ছেড়ে আবার রাস্তায় নামে দময়ন্তী। কোন জায়গায় এসে পড়েছে সে? এখান থেকে এক্ষুনি কাটতে হবে। সামনে রেনকোট পরা, ঢ্যাঙা একটা লোক হাঁটছে। তাকে দময়ন্তী জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কোন জায়গা?’
রেনকোট পরা লোকটা দময়ন্তীর কনুই চেপে ধরে বলে, ‘এটা ভারতবর্ষ। ইন্ডিয়ার মেয়েছেলে হয়ে ভারতে কেন এসেছ? তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।’
লোকটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে দময়ন্তী। এ তো সুরজ! এ এখানে এল কী করে? কনুই ছাড়িয়ে নিয়ে সরু রাস্তা বরাবর দৌড় লাগায় দময়ন্তী। অবিলম্বে এখান থেকে পালাতে হবে।
পালানোর উপায় নেই। রাস্তায় থিকথিক করছে লোক। পুরুষ মানুষের দল তাকে ঘিরে ফেলছে। সুরজ ধাওয়া করে আসছে নিশ্চিত পদক্ষেপে। দময়ন্তীর শ্বাস আটকে আসছে। নিজেকে বাঁচাতে আবার ফুটপাথে ওঠে সে। চোখের সামনে যে দরজাটা দেখতে পায় সেটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। দরজায় খিল লাগিয়ে দেয়।
‘তেরো নম্বর ঘরেই আসতে হল?’ মেঝেয় বসে খিলখিল করে হাসছে ফুলমতিয়া আর এক মেমসাহেব। মেমের পরনে গোলাপি গাউন। কাট গ্লাসের পাত্র থেকে অনেকটা সোনালি তরল চুমুক দিয়ে মেম বলল, ‘আর কোনও শহর পেলে না? এই শহরে সাইমন আর্চার থাকে।’
হাঁফাতে হাঁফাতে সোফায় বসে দময়ন্তী বলল, ‘ফুলমতিয়া! এ কে?’
‘আমাদের দিদিমণি গো!’ কলকেতে গাঁজা ঠাসতে ঠাসতে বলে ফুলমতিয়া। ‘যার নামে এই হোস্টেল!’
‘মিসেস আর্চার?’ আঁতকে উঠে সোফা ছাড়ে দময়ন্তী। মিসেস আর্চার বলে, ‘এই ঘরে কেন এলে? এখানে সুরজ থাকে।’
এটা সুরজের ঘর? বুকের ভিতর দিয়ে মেল ট্রেন চলে যায় দময়ন্তীর। মুখ শিরিষ কাগজের মতো শুকনো হয়ে যায়। তেরো নম্বর ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে বেরোতে যায় সে। খিল লাগানো দরজা ভেদ করে হঠাৎ তার সামনে চলে আসে সুরজ। মিষ্টি হেসে বলে, ‘আজ আমরা মেল জেনিটালিয়া পড়ব। দ্য কমপোনেন্টস আর পেনিস, টেসটিস, স্ক্রোটাম অ্যান্ড প্রস্টেট। পেনিসের লেংথ বল তো!’
‘জানি না!’ গুঙিয়ে ওঠে দময়ন্তী।
‘জানি না বললে হবে? আর দেড়মাস বাদে ফার্স্ট এমবিবিএস। আয়, তোকে সব শিখিয়ে দিই।’ দময়ন্তীর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নেয় সুরজ।
‘না…’ চিৎকার করে উঠে ঘুম ভাঙে দময়ন্তীর। হাঁফাতে হাঁফাতে খেয়াল করে, সে গোলঘরে শুয়ে রয়েছে। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। এখন সকাল আটটা বাজে।
উঠে বসে হাঁটুতে মুখ দিয়ে স্বপ্নটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে দময়ন্তী। ফেস্টের তৃতীয় দিনের রাতে সেই ঘটনাটা তার ওপরে বড়সড়ো প্রভাব ফেলেছে। শারীরিক এফেক্ট নেই। কিন্তু মেন্টাল ট্রমা হয়েছে মারাত্মক। এইরকম শ্বাসরোধকারী দুঃস্বপ্ন সে এখন প্রায়ই দেখে। তবে আজ সকালের স্বপ্নটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কেন এমন হল?
একটু ভাবতেই পরিষ্কার হল। গতকাল সে, বৃন্দা আর বিলু মিলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। সিনেমাটার নাম ‘বোল’। পাকিস্তানি ডিরেক্টর শোয়েব মনসুরের ছবি। গতকাল ছবিটা একইসঙ্গে ভারত আর পাকিস্তানে মুক্তি পেয়েছে। হুমাইমা মালিক, আতিফ আসলাম, মাহিরা খান, ইমান আলি ছিল। সিনেমাটা জুড়ে সারাক্ষণ মেয়েদের ওপরে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ আর ধর্মের নানারকমের অত্যাচার দেখিয়েছে। ছবিটা খুবই ভালো। দময়ন্তীর অবচেতনে কোনওভাবে ঢুকে গিয়ে বদহজম বাঁধিয়েছে।
পাশাপাশি, আগামী অগাস্ট মাস থেকে তাদের ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আইএমসিতে ঢোকার, দিল্লি ছেড়ে কলকাতা শিফট করার এক বছর পূর্তি হতে চলল। সেটাও স্বপ্নে কোনওভাবে ঢুকে পড়েছে। সে যখন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের মাটিতে পা দিয়েছিল, তখন জনমোর্চা সরকারের বয়স ঊনত্রিশ ছিল। এখন বয়স ত্রিশ।
বিছানার পাশ থেকে চিরুনি নিয়ে আপন মনে চুল আঁচড়াচ্ছে দময়ন্তী, এমন সময় মোবাইলের দিকে চোখ পড়ল। ফোনটা নিঃশব্দে দপদপ করছে। রাতে মোবাইল ফোন সায়লেন্ট মোডে রেখে শোওয়া অভ্যেস দময়ন্তীর। তার কারণ, রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার আর ঘুম আসে না। এটাও ওপিয়ামের শেষদিনের রাতের সেই ঘটনার ফল। প্রথম কদিন তো ঘুমই হয়নি। সারারাত জেগে বসে থাকত। তারপর নিজের থেকেই অ্যাংজাইটি কমানোর ওষুধ অ্যালোপাম খেতে শুরু করে। প্রথম প্রথম চমৎকার ঘুম হতো। মড়ার মতো স্বপ্নহীন রাত কাটত। এখন পয়েন্ট টু ফাইভের বড়ি খেয়ে কাজ হয় না। দময়ন্তী জানে ডবল ডোজ না খেলে এইরকম দুঃস্বপ্ন ভরা ঘুম প্রতি রাতে ফিরে আসবে। এদিকে ওষুধটায় নির্ভরতা হয়ে গেছে। শুতে যাওয়ার আগে না খেলে অস্থির অস্থির লাগে। মনে হয় ঘুম আসবে না। বাবা-মাকে লুকিয়ে এক মাসের ওষুধ আনিয়ে রেখেছে সে। মোবাইল হাতে নেওয়ার আগে দময়ন্তী ভাবল, সে কি ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে গেল? তার কি সাইকায়াট্রিক কাউন্সেলিং করানো উচিৎ?
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!’ বৃন্দার মেসেজে ঝলমল করছে মোবাইলের স্ক্রিন।
‘শুভ জন্মদিন।’ চন্দন।
‘হ্যাপি বার্থডে।’ অভি।
‘এইচবিডি।’ আপ্পু।
গোটা তিরিশেক মেসেজ। গোটা কুড়ি মিসড কল। মেসেজ দেখতে দেখতে দময়ন্তী ভাবল, আজ পঁচিশে জুন। তার জন্মদিন। মনেই ছিল না। ড্যানিয়েল আর শক্তিরূপার মনে আছে কি? মোবাইল ফোনকে নীরব থেকে সরব করে দময়ন্তী বিছানা থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নামে। ড্যানিয়েল কী করছেন দেখা যাক।
ড্যানিয়েলের স্টুডিওর সমস্ত জানলা খোলা। ইজেল ক্যানভাস চড়িয়ে ড্যানিয়েল একটা বিশাল ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে প্যালেট ও মোটা ব্রাশ। দূর থেকেই ছবিটা ভালো লাগল দময়ন্তীর। ড্যানিয়েলের আঁকার মধ্যে একটা বড়সড়ো পরিবর্তন এসেছে। শান্তিনিকেতনের শান্ত ও সমাধিস্থ ঋষিপ্রতিম ড্যানিয়েলের নতুন ছবিগুলো অনেক উজ্জ্বল, অনেক উচ্ছ্বল, অনেক রঙিন, অনেক রংবাজ। কলকাতা শহর নিয়ে একটা সিরিজ আঁকছেন ড্যানিয়েল। নাম দিয়েছেন, ‘আনডাইং সিটি’।
‘আনডাইং সিটি’ সিরিজের ছবিগুলো ড্যানিয়েল আঁকতে শুরু করেছেন কলকাতায় শিফট করার পর থেকে। প্রথমে চিরকুটের সাইজের কাগজে স্কেচ করতেন আর ফেলে দিতেন। তারপর একটু বড় কাগজে কতগুলো থিম্যাটিক স্কেচ করলেন। সেগুলোও ফেলে দিলেন। দময়ন্তী বাবার ফেলে দেওয়া সমস্ত কাগজ একটা বড় স্ক্র্যাপবুকে জমিয়ে রাখে। তাই এই সিরিজটা কীভাবে জন্মগ্রহণ করল তার আগাপাস্তালা জানা। মাসপাঁচেক আগের এক দুপুরবেলায় হঠাৎই ভারমিলিয়ন রেড অয়েল পেন্টের টিউব আর মোটা ব্রাশ নিয়ে ক্যানভাসের দিকে তেড়ে গিয়েছিল ড্যানিয়েল। সাদা ক্যানভাসের সঙ্গে মিনিট পাঁচেকের যুদ্ধ চালিয়ে ক্যানভাসটা ফালাফালা করে ছিঁড়ে দিয়েছিল।
দময়ন্তীর মনে হয়, এই সংঘাতপর্ব থেকে বাবার মাথায় ‘আনডাইং সিটি’ সিরিজের জন্ম হয়। গত পাঁচ মাসে পঁচিশটা ছবি এঁকেছে ড্যানিয়েল। অদ্ভুত এক কার্নিভালের মেজাজ সিরিজ জুড়ে। প্রাইমারি কালচারের প্রাধান্য, চওড়া স্ট্রোক; কালো, ধূসর বা খয়েরি রঙের অনুপস্থিতি, ক্যানভাসের সাদা জমিকে নিপুণভাবে ব্যবহার করা—সব মিলিয়ে ছবিগুলো অনবদ্য।
আজ বাবাকে পঁচিশতম ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দময়ন্তীর মনে পড়ল, কাল রাতেই ড্যানিয়েল বলছিলেন, ‘একঘেয়ে লাগছে। কলকাতা নিয়ে আপাতত আর ছবি আঁকব না।’
‘পঁচিশটা ছবি এক্সিবিশনের পক্ষে যথেষ্ট। করবে নাকি একটা?’ প্রশ্ন করেছিলেন শক্তিরূপা।
‘হ্যাঁ। আগামিকাল হৈমবতী সান্যাল আসছেন। ছবিগুলো দেখতে।’
হৈমবতীর আসার খবর শুনে শক্তিরূপা চুপ করে গিয়েছিলেন। সে বিবস্বান-হৈমবতীর বেতনভুক কর্মচারী। মালিক-কর্মচারীর সম্পর্কের ইকুয়েশন আর আর্টিস্ট-গ্যালারি ওনারের সম্পর্কের ইকুয়েশান আলাদা হয়। এই পাওয়ার পলিটিকসে নিজে কোথায় থামবে বুঝতে না পেরে শক্তিরূপা বলেছিলেন, ‘আমি তাহলে কাল ওই সময়টায় অফিসে থাকব।’
‘তোমার যা ইচ্ছে।’ স্ত্রীর জীবনচর্যায় নাক গলাননি ড্যানিয়েল।
এখন ড্যানিয়েলকে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কথাগুলো মনে পড়ে গেল দময়ন্তীর। মিডিয়া-ব্যারন এবং গ্যালারি-ওনার যুগল কখন আসবেন কে জানে। তার আগে সে-ও বাড়ি থেকে কেটে পড়তে চায়। অত বড় বড় লোকের সামনে পড়ার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। এদের সামনে বসে দেঁতো হাসি হাসার কোনও অর্থ হয় না। বাড়ি থেকে পালাবার জন্য বাথরুমে ঢুকে পড়ে দময়ন্তী। ঝটপট স্নান সেরে ফেলা যাক।
জিনস আর কুর্তি পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাবার টেবিলে এসে দময়ন্তী দেখে শক্তিরূপা একগাদা খবরের কাগজ নিয়ে ব্রেকফাস্ট সারছেন। সবকটা কাগজের হেডলাইনে মৃত্যুর খবর। মায়ের পাশে বসে, প্রাতরাশ করতে করতে বেঙ্গল নিউজ টেনে নেয় সে।
বাঁজাপলাশ গ্রামে ‘হেলথ হাব’ করার জন্য জনমোর্চা সরকার এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করার জন্য নোটিস দিয়েছে। এর জন্য ভিটেহারাদের পুনর্বাসনও দেওয়া হবে। কিন্তু বাঁজাপলাশ গ্রামের মানুষ পুনর্বাসন চায় না। তার জমি ছাড়তে আগ্রহী নয়। সরকার বিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছে বাঁজাপলাশ এবং সংলগ্ন নতুনগ্রামে। তাতে মদত জোগাচ্ছে শহরের বুদ্ধিজীবীরা। ত্রিশ বছর বয়সি জনমোর্চা সরকারকে ফেলার জন্য দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আন্দোলন, যাতে দক্ষিণপন্থী থেকে অতিবামপন্থী সবরকম রঙের সহাবস্থান আছে। এই ‘রেনবো কোয়ালিশন’-এর লক্ষ্য একটাই। ‘বদল চাই।’
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্তর বদলে মৃন্ময় চ্যার্টাজিকে চাই।
জনমোর্চা পার্টির বদলে নবযুগ পার্টিকে চাই।
ত্রিশ বছরের অচলায়তনকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মুক্তধারা চাই।
‘মুক্তধারা’! কবি সুদিন চক্রবর্তী কিছুদিন হল সক্রিয় রাজনীতি করছেন। সুদিনের নেতৃত্বে কলকাতা শহরের চিন্তাশীল মহল তৈরি করেছেন সমন্বয়-মঞ্চ, ‘মুক্তধারা’। গতকাল পার্কসার্কাস সাত মাথার মোড়ে তাঁরা ধর্নায় বসেছিলেন। পুলিশ ধর্না তুলতে গিয়েছিল। তাঁরাও ধর্নামঞ্চ ত্যাগ করবেন না। টানা-হ্যাঁচড়া, গ্রেফতার বরণ, লাঠিচার্জ, স্লোগান—এই সবের মধ্যে পুলিশের সার্ভিস রিভলভার থেকে ছোঁড়া গুলিতে মারা গেছে তরতাজা এক যুবক। হৃষিকেশ নন্দী। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী, বাংলা ফোক ব্যান্ড ‘মাটি’-র ফ্রন্টম্যান।
হৃষিকেশ ওপিয়ামের শেষ দিনে কলেজে পারফর্ম করেছিল। মাটির অনুষ্ঠানের সময়ই সুরজ বদমায়েশি করেছিল দময়ন্তীর সঙ্গে।
হৃষিকেশ ও মাটি সমার্থক। ইয়াং অ্যাডাল্টদের মধ্যে, কলেজ-মহলে খুব জনপ্রিয়। এবং হৃষিকেশ জনমোর্চার সমর্থক ছিল। সরকারের ল্যান্ড গ্র্যাবিং পলিসি মেনে নিতে পারেনি বলে সুদিনের সঙ্গে মুক্তধারার ধর্নামঞ্চে বসেছিল।
আজ সকাল জুড়ে ব্যানার হেডলাইন। ‘পুলিশের গুলিতে যুবকের মৃত্যু’। তলায় পরপর চারটে ছবি। সুদিন চক্রবর্তীর ভাঙাচোরা মুখের ছবি। কোলে হৃষিকেশের লাশ। পাশের ছবিতে ক্রন্দনরত হৃষিকেশের মা। তৃতীয় ছবিতে মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্তর ছবি। কুর্শিতে বসে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আছেন। শেষ ছবিতে মৃন্ময় চ্যাটার্জি। তিনি মহাকরণ অবরোধের ডাক দিয়েছেন।
পাশাপাশি চারটে ছবিতে পশ্চিমবঙ্গের টানাপোড়েনের চেহারা স্পষ্ট। ছবিগুলো দেখতে দেখতে শক্তিরূপা বলল, ‘সাবলাইম খচ্চর!’
‘কাকে বললে?’ আঁতকে উঠে বলে দময়ন্তী। সে মাকে খুব কম গালাগালি দিতে শুনেছে। যখন দেন তখন লোকজনের প্যান্টুল খুলে ছেড়ে দেন।
‘সুদিন চক্রবর্তী। ফ্রাস্ট্রেটেড বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আগে বলা হতো হারামির হাতবাক্স। এখন হাতবাক্সে ধরছে না। হারামির হোল্ড-অল বলতে হয়। একটা ছোকরার লাশ ঘাড়ে নিয়ে এখন চ্যানেল থেকে চ্যানেল বাইট দিয়ে বেড়াবে আর নিজের কবিতা কোট করবে।’
শক্তিরূপার কথার মধ্যে বেল বাজল। দময়ন্তী শক্তিরূপার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওঁরা এলেন। আমি ওঁদের দরজা খুলে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। আলাপ করার ইচ্ছে নেই।’
‘আমারও নেই।’ দ্রুত গতিতে ব্রেকফাস্ট শেষ করছেন শক্তিরূপা। ‘ড্যানিয়েলের কাছে ওঁদের পৌঁছে দিয়ে আমিও কাটব।’
শক্তিরূপাকে টাটা করে ব্যাকপ্যাক নিয়ে তরতর করে একতলায় নামে দময়ন্তী। ডিটিপির দোকানের পাশ দিয়ে উঠে আসছেন সাড়ে পাঁচফুটের বিবস্বান সান্যাল। মোম-মসৃণ ত্বকে গোলাপি আভা। মাথায় একটাও চুল নেই। টাক পড়তে শুরু করার পরে গালের সঙ্গে মাথাও দু’বেলা শেভ করেন। পরনে জিনস ও টি-শার্ট। বাঁ কানে হিরের ইয়ারস্টাড।
হৈমবতী স্বামীর থেকে ইঞ্চি তিনেক লম্বা। পরে আছেন আকাশি রঙের শিফন ও অ্যাকোয়ামেরিন ব্লু রঙের ব্লাউজ। হাতে ফুলের বুকে। বাতাসে হাল্কা সুগন্ধ। যে গন্ধের একটাই বিশেষণ হয়। অভিজাত। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, এজেসি বোস রোডে একটা মার্সিডিজ বেনজ দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘ড্যানিয়েল আর্চার বাড়িতে আছেন?’ বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন বিবস্বান।
‘উনি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আসুন আমার সঙ্গে।’ দময়ন্তী আবার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে।
‘তোমার নাম দময়ন্তী। ডাক্তারি পড়ছ।’ হৈমবতী বলেন।
‘হ্যাঁ।’ দময়ন্তী দু’জনকে নিয়ে দোতলায় আসে। সেখানে শক্তিরূপা ও ড্যানিয়েল দু’জনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এখানে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ড্যানিয়েলকে টাটা করে দময়ন্তী সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফার্স্ট এমবিবিএসের আগে রোজ স্পেশাল ক্লাস হচ্ছে। একটাও মিস করা যাবে না। অ্যাটেন্ডেন্সের ঘাটতিও রাখা যাবে না। এনজি অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে খুব বাওয়াল করছেন।
এসএলটিতে এনজির অ্যানাটমি ক্লাস সকাল ন’টায়। একটু আগেই পৌঁছল দময়ন্তী। ক্লাস একেবারে হাউসফুল। সবাই বলছে, এনজি আগামী কুড়িটা ক্লাসে যা পড়াবেন, সেটাই সাজেশন। থিয়োরি বা প্র্যাকটিকালের কোশ্চেন সেখান থেকেই আসবে। দময়ন্তীকে ঢুকতে দেখে কয়েকজন ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলে চ্যাঁচাল বটে, কিন্তু কারো গলার আওয়াজেই তেজ নেই। ফার্স্ট এমবিবিএসের হাড়িকাঠে গলা দেওয়ার পরে তেজ থাকা সম্ভবও নয়।
সেকেন্ড বেঞ্চের ডানদিকে অভি, চন্দন আর বৃন্দা পাশাপাশি বসে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছে। অভিকে ঠেলে সরিয়ে বসল দময়ন্তী। বলল, ‘কী ব্যাপার, চারিদিকে এইরকম শোকের ছায়া কেন?’
অভি আর চন্দন কোনও কথা বলল না। বৃন্দা বলল, ‘বাজারে জোর গুজব, এনজি ট্রান্সফার হয়ে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ চলে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে এইসব সাজেশান কাজে লাগবে কি না, কে জানে!’
‘শুধু এনজি নয়, এএম-এরও ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে। তবে উনি যাবেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ। আমাদের অবস্থা ঢিলে!’ মিনমিন করে বলল অভি।
‘ওসব ভেবে লাভ নেই। পরীক্ষা তো আর মুখ দেখে হবে না!’ চন্দন ব্যাজার মুখে বলে।
‘আলবাত মুখ দেখে হয়।’ বেঞ্চি থাবড়ায় বৃন্দা, ‘আমাদের থিয়োরি পরীক্ষা হবে অন্য কলেজে। মানে, আমাদের ব্যাচকে পাঠাবে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ, আরজি কর, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু খাতা দেখবে আমাদের কলেজ। আবার প্র্যাকটিক্যাল হবে নিজের কলেজে। কাজেই মুখ দেখাদেখির একটা বড় গুরুত্ব আছে।’
‘আর সুন্দরী মেয়েদের তো ব্যাপারই আলাদা। ওরাল পরীক্ষার সময়ে সামান্য ঝুঁকে বুক দেখিয়ে দিলেই পাস।’ চন্দন ফুট কাটে।
‘ছ্যাবলা কোথাকার,’ চন্দনকে চাঁটায় দময়ন্তী, ‘তাহলে এএম আর পিএমের ভাইভার সময়ে তোরা প্যান্ট খুলে পোল ডান্স করিস। পাস করে যাবি।’
হ্যাহ্যা হিহির মধ্যে নিঃশব্দে ক্লাসে ঢুকেছেন এনজি। টেবিলে অ্যাটেন্ডেন্স খাতা রেখে বললেন, ‘আর্চ অব অ্যাওর্টা অ্যান্ড ইটস ব্রাঞ্চেস। কে কে এক্ষুনি বলতে পারবে?’
গোটা কুড়ি হাত উঠল। বৃন্দা তার মধ্যে একজন।
‘আধঘণ্টা সময় দিলে রিভাইস করে নামাতে পারবে এমন কজন আছে? আগের বার যারা হাত তুলেছে, তারা বাদ দিয়ে বাকিরা হাত তোলো।’
পঞ্চাশ-ষাটটা হাত উঠল। দময়ন্তী তাদের মধ্যে একজন।
‘এখনও একবারও পড়োনি, এমন ক’জন আছ? বাকি সবাই। তাই তো?’
গোটা ক্লাস চুপ। এনজি বললেন, ‘তোমরা যদি ভেবে থাকো যে আমার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে বলে তোমরা পার পেয়ে যাবে, তাহলে খুব ভুল ভেবেছ। আমি ট্রান্সফার হচ্ছি এটা ঠিক। তবে সেটা তোমাদের পরীক্ষা নেওয়ার পরে। এবং আমার কাছে ওনলি মেরিট ম্যাটারস। চন্দন, আর্চ অব অ্যাওর্টার অরিজিন বলো।’
এত ছেলেগুলোর মধ্যে চন্দনকে বেছে নেওয়ায় গোটা ক্লাস অবাক হল না। উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয় কলেজে রাজনীতি করে গত এক বছরে কতটা উচ্ছন্নে গেছে এটা জানতে সবাই আগ্রহী। চন্দন উঠে দাঁড়াল। এনজির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু স্যার হাত না তোলাদের দলে।’
‘আজকে আমি তাদেরই পড়া ধরব।’ এনজি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন।
চন্দন দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে শুরু করল, ‘আর্চ অব অ্যাওর্টা স্টার্টস ফ্রম লেফট ভেন্ট্রিকল অব হার্ট। ইট সাপ্লায়েজ অক্সিজেনেটেড ব্লাড ফ্রম হার্ট টু…’
‘তবে যে বললে পড়োনি।’ এনজি ধমক দিলেন।
‘এসব আমি টুয়েলভ থেকেই জানি। ব্রাঞ্চগুলো যদি জানতে চান তা হলে একটাও বলতে পারব না।’
‘সে চেষ্টা তোমার বন্ধু করুক।’ চন্দনকে থামিয়ে অভিকে দাঁড় করিয়েছেন এনজি। ‘বলো অভিজ্ঞান।’
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এনজির দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অভি।
‘আর্চ অব অ্যাওর্টার ব্রাঞ্চ বলতে না পারলে এমবিবিএস-এ সাপ্লি খাওয়া তোমার কপালে নাচছে।’ কঠিন গলায় বলেন এনজি। ‘নাও স্টার্ট।’
‘জানি না স্যার।’ বেঞ্চির দিকে তাকিয়ে বলে অভি।
বৃন্দা একটা কাগজে ব্রাঞ্চগুলো লিখে কাগজটা অভির দিকে ঠেলে দিল। বেচারি বেঞ্চির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গড়গড় করে আউড়ে দিলেই এই অপমান সহ্য করতে হয় না! তবে অভি কি শোনার বান্দা? সে তর্জনীর টোকায় কাগজ ফেলে দিল।
‘দেখি আর কে কে সাপ্লি খাবে!’ মিষ্টি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে এনজি বললেন, ‘সুরজ, তুমি বলো।’
পরবর্তী একঘণ্টা ধরে বেছে বেছে ত্রিশজন ছেলেমেয়েকে দাঁড় করালেন এনজি। কেউ পড়া পারল না। দময়ন্তী বুঝল, গত এক বছর ধরে দেড়শোজন ছেলেমেয়ের নাড়ি-নক্ষত্র জানা হয়ে গেছে এনজির। প্রত্যেকের নাম ও পদবি জানেন। কার কোথায় বাড়ি জানেন। কোন আইটেমে কে কেমন ফল করেছে জানেন। পার্টে কে কেমন ধেড়িয়েছে, সেটাও জানেন। এক ঘণ্টার মাথায় ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ঘুরে এনজি শুরু করলেন, ‘এই হল আর্চ অব অ্যাওর্টা।’
ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রী অবাক হয়ে দেখল, এনজি দু’হাতে ছবি আঁকছেন। ডান ও বাঁ—দু’হাতেই লাল, নীল, হলুদ, সবুজ রঙের চক। ডান হাতে লাল চক দিয়ে শিরা আঁকছেন। একই সঙ্গে বাঁহাতের নীল চক দিয়ে ধমনি আঁকছেন। লাল চক দিয়ে শিরা আঁকা শেষ করে তার শাখা-প্রশাখা আঁকছেন। তখন বাঁহাতে সবুজ চক দিয়ে স্নায়ু আঁকছেন। চোখ আর হাতের মধ্যে কোন পর্যায়ের সংযোগ থাকলে এই জিনিস সম্ভব! কী সাংঘাতিক স্মৃতিশক্তি, সাবজেক্টের প্রতি কী অসম্ভব ভালোবাসা থাকলে এটা করা যায়! মনে মনে এনজিকে প্রণাম করে দময়ন্তী। ট্রান্সফারের খবরটা শুনে খারাপ লাগছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এনজির লেকচার শুনতে থাকে সে।
.
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটে বাজল। দুপুরের খাবার বাড়ি ফিরে খাবে—এটা বলা ছিল। দময়ন্তীর ধারণা ছিল বাড়ি ফিরে দেখবে, বাবা স্টুডিওতে, মা অফিসে, টেবিলে খাবার ঢাকা রয়েছে। দোতলায় উঠে দেখল ঘটনা অন্যরকম।
শক্তিরূপা অফিস যাননি, অথবা গেলেও বাড়ি চলে এসেছেন। ড্যানিয়েল স্টুডিও ছেড়ে দোতলার ডাইনিং টেবিলে বসে চপিং বোর্ডে ব্রকোলি কাটছেন। শক্তিরূপা কী একটা রান্না করছে। ভীষণ ভালো গন্ধ আসছে। অবাক হয়ে দময়ন্তী বলল, ‘কী সেলিব্রেশান? বাবার ‘আনডাইং সিটি’ সিরিজ বিক্রি হয়ে গেল বুঝি?’
‘বিক্রি হয়নি,’ কাটা ব্রকোলি থালায় রেখে ড্যানিয়েল বলেন, ‘হৈমবতীর ”পথের ধারে” প্রদর্শনীশালার সঙ্গে চুক্তি হল। ওরা আগামী মাসে এই পঁচিশটা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করবে। সামান্য সম্মান দক্ষিণা অগ্রিম দিয়ে গেল। পরে ছবি যে রকম বিক্রি হবে, প্রদর্শনশালার লভ্যাংশ রেখে আমাকে আমার প্রাপ্য দেবে।’
দময়ন্তী জানে, ড্যানিয়েল খুব খারাপ নেগোশিয়েটার। টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পান। আন্তর্জাতিক বাজারে ড্যানিয়েলের আবছা খ্যাতি আছে। কয়েকজন জাপানি ক্রেতা নিয়মিত ড্যানিয়েলের ছবি কেনেন। তবে জাতীয় স্তরে ড্যানিয়েলের বাজার ভীষণ ভালো। ছবি আঁকতে বসার আগেই ক্যানভাস বিক্রি হয়ে যায়। তিন থেকে চার লাখের মধ্যে ছবির দাম ঘোরাঘুরি করে। দময়ন্তীর ধারণা ড্যানিয়েলের ছবির দাম আরও বেশি হওয়া উচিৎ। গ্যালারির ওনাররা ঠকান। চেয়ারে ব্যাগ রেখে সে বলল, ‘এক এক করে বোঝার চেষ্টা করি। ”পথের ধারে” প্রদর্শনশালা মানে ”বাই দ্য ওয়ে” আর্ট গ্যালারি। ”অগ্রিম সম্মান দক্ষিণা” মানে ”টোকেন অ্যাডভান্স”। তাই তো?’
‘এ তো ব্যাঘ্র মানে শার্দুল হয়ে গেল!’ আপত্তি করেন ড্যানিয়েল। উত্তর না দিয়ে দময়ন্তী বলে, ‘কত টাকার টোকেন অ্যাডভান্স পেলে জানতে পারি?’
‘দশ লাখ। টিডিএস করে।’ গ্যাস থেকে কড়া নামিয়ে শক্তিরূপা বলেন।
‘ওয়াও! গ্রেট!’ হাততালি দেয় দময়ন্তী। ‘বাবার অনারে আজকের মেনু কী?’
‘আজকের মেনু হল ভাত, মিক্সড ভেজিটেবিল, সোনামুগের ডাল, বেকড ভেটকি আর পায়েস। তবে এই মেনু তোর বাবার অনারে নয়,’ মেয়ের কাছে এসে মাথায় চুমু খেয়ে শক্তিরূপা বলেন, ‘হ্যাপি বার্থডে দময়ন্তী।’
ড্যানিয়েল চেয়ারের আড়াল থেকে নাহুমের একটা ফ্রুট কেক বার করে বলল, ‘শুভ জন্মদিন, খুকি!’
‘ধ্যাত!’ বাবাকে জড়িয়ে ধরে দময়ন্তী। তার দু’চোখে জল। দেড় মাস বাদের ফার্স্ট এমবিবিএস-এর বিভীষিকার কথা ভুলে গেছে সে।