অভিজ্ঞান
গ্রের অ্যানাটমি কোল থেকে নামাল অভি। বাপরে! কী ওজন বইটার! কয়েকদিন বইটা তাক থেকে পাড়লে আর ওঠালে বাইসেপস, ট্রাইসেপস, ডেল্টয়ড, ল্যাটিসিমাস ডরসাই—সব আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগারের মতো হয়ে যাবে।
এ বই পড়া যাবে না। আপন মনে বিড়বিড় করে অভি। যেমন মোটা বই, তেমন বোরিং সাবজেক্ট। দু’কলম জুড়ে থাক থাক লেখা। বই খুলতে ভয় করে। একটা চ্যাপ্টার পড়তে শুরু করলে শেষ হতে চায় না। উফ! কী কষ্ট!
গ্রে সরিয়ে ডক্টর মিত্রর অ্যানাটমি বইয়ের রোগাপাতলা দ্বিতীয় খণ্ড হাতে নেয় অভি। এই বইটা চার খণ্ডে ভাগ করা বলে বই হাতে নিলে টেনশান কম হয়। তবে বইটার ইলাসট্রেশান ভালো নয়। জ্যাবড়া জ্যাবড়া কালির দাগওয়ালা ছবি।। পড়তে গেলে বিরক্ত লাগে।
আগামিকাল অভির প্রথম আইটেম। অনেক কিছু এই কদিনে পড়ানো হয়ে গেছে। প্রথম আইটেম হবে ‘ডরসাম অব ফুট’ বা পায়ের পাতার সামনের দিক। হাড়, মাংসপেশি, শিরা, ধমনি, স্নায়ুর নাম মুখস্থ করতে গিয়ে নাকানি চোবানি খাচ্ছে অভি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টর মিত্রর বই রাখল সে। বই হাতে নিয়ে আজ পর্যন্ত কখনও টেনশান হয়নি। আঠারো বছরের জীবনে যাবতীয় টেনশান কেটে গেছে যে কোনও বই হাতে নিলে। সেই বিশল্যকরণীই এখন গরল হয়ে দেখা দিচ্ছে।
রাত আটটা বাজে। কলেজ থেকে ফিরে একঘণ্টা ঘুমিয়েছে অভি। রাত তিনটে অবধি পড়ে ‘ডরসাম অব ফুট শেষ’ করে দেবে, এইরকম মনোবাসনা। এখনও পর্যন্ত পড়া শুরুই করে উঠতে পারেনি। পড়া শুরু তো দূরস্থান, কী বই পড়বে এটাই বুঝতে পারেনি। বিরক্ত হয়ে চন্দনকে এসএমএস করল। ‘ডরসাম অফ ফুট কোন বই থেকে পড়ব? গ্রে না ডক্টর মিত্র?’
উত্তর এল তৎক্ষণাৎ। ‘কোনওটাই না। ট্রাই চৌরাসিয়া।’
চন্দন কি হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনতে বলছে? উত্তেজিত স্নায়ু ঠান্ডা করার দাওয়াই দিচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয়? না। মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ে অভি। চন্দন যত বড় পড়ুয়াই হোক না কেন, চৌরাসিয়ার বাঁশি শোনার মতো অ্যান্টেনা নেই। ও চৌরাসিয়ার লেখা অ্যানাটমি বই পড়তে বলছে। গ্রে আর ডক্টর মিত্রর সঙ্গে চার খণ্ড বি ডি চৌরাসিয়ার অ্যানাটমি বই বিলুর রুম থেকে গত সপ্তাহেই অভি বাড়ি নিয়ে এসেছে। এনেছে ফিজিয়োলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রির বই। আগামী বছরগুলোতেও তাকে কোনও বই কিনতে হবে না। দুই ভাই এক স্ট্রিমে পড়ার এই এক সুবিধে। এডিশান চেঞ্জ হলে অন্য ব্যাপার।
বুক শেলফ থেকে চৌরাশিয়ার ভলিউম টু পাড়তে গিয়ে অভির মনে হল, গ্রে বা ডক্টর মিত্রর অ্যানাটমি বইতে কোনও আন্ডারলাইন বা হাইলাইটিং দেখেনি। অভি জানে, বিলুর স্বভাব হল বইতে দাগ দেওয়া, মার্জিনে নোট নেওয়া, লুজ কাগজে অতিরিক্ত তথ্য লিখে বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখা। সেগুলো নেই মানে, গ্রে বা মিত্রর বই বিলু পড়েনি।
চৌরাশিয়ার বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড খুলে অভি নিশ্চিন্ত হল। হ্যাঁ, এই বইটাকেই বিলু টেক্সট হিসেবে পড়েছিল। পাতায় পাতায় লাল-নীল-হলুদ-সবুজের হাইলাইট, গুঁজে রাখা কাগজের তাড়া তাই বলছে।
নিজের ওপরে বিরক্ত হল অভি। কলেজে ঢোকার পর থেকে বিলুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। দু’সপ্তাহ আগেও রোজ কথা হতো। এখন তিনদিনে একবার হয় কিনা সন্দেহ। বিলুকে জিজ্ঞাসা করলেই আইটেম সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। চৌরাসিয়ার বইয়ের ডরসাম অফ দ্য ফুট চ্যাপ্টারটা খুলল অভি। চমৎকার ডায়াগ্রাম, ছোট্ট ছোট্ট প্যারাগ্রাফ, পয়েন্ট করে লেখা রয়েছে পা—বৃত্তান্ত। ছবি ও লেখা মিলে দশপাতা। ঘড়ির দিকে তাকাল অভি। সাড়ে আটটা বাজে। দেখা যাক, কতক্ষণে এই নরক যন্ত্রণা শেষ হয়।
অভির ধারণা ছিল, কোনও কিছু মুখস্থ করার জন্য প্রথমবার পড়াটা সব থেকে শক্ত কাজ। প্রথমবার পড়া শেষ করে, রাতের খাওয়া খেয়ে রাত সাড়ে দশটার সময় দ্বিতীয় বারের জন্য পড়তে বসে অভির মনে হল, ধারণাটা ভুল। দ্বিতীয় পাঠ সবচেয়ে শক্ত। কেননা, প্রথম পাঠে সবটাই অজানা। ভুলে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দ্বিতীয় পাঠে স্মৃতিকে পরীক্ষা দিতে হয়। অবাক হয়ে অভি দেখল, প্রথমবার পড়ার সময় সে যা যা পড়েছিল তার সবকিছু সম্পূর্ণ ভুলে মেরেছে! কী হতাশাজনক ঘটনা! আর একটু হলেই অভি কেঁদে ফেলছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে অ্যানাটমির নিমোনিক্স আওড়ায় অভি। ‘টল হিমালয়াস আর নেভার ড্রাই প্লেসেস।’
কোনও জিনিস মুখস্থ করার জন্য নিমোনিক্স খুব ভালো অস্ত্র। রামধনুর সাত রঙ মুখস্থ করার জন্য বলা হয় ‘বেনীআসহকলা’। অর্থাৎ, বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল—এই সাত রঙের আদ্যক্ষর সাজিয়ে তৈরি হয়েছে শব্দটি। অ্যানাটমিতেও নানান তালিকা মুখস্থ করতে হয়। ক্রম বজায় রেখে একগাদা নাম মুখস্থ করার জন্য আদ্যক্ষর পরপর সাজিয়ে, অদ্ভুতুড়ে এবং মজাদার বাক্য তৈরি করা হয়। হাস্যকর এবং ‘ক্যাচি’ বলে বাক্যগুলো মনে থেকে যায়। অ্যানাটমিতে এত বেশি নিমোনিক্স আছে যে শুধু নিমোনিক্স-এর জন্য একটা পকেট বই কিনতে পাওয়া যায়।
নিমোনিক্স নিয়ে ভয়ের কারণ হল, অনেক সময় শুধু মজার বাক্যটা মনে থাকে। মূল লিস্টটা মনে পড়ে না। এখন যেমন অভির হচ্ছে। গোড়ালির এক্সটেনসর রেটিনাকুলামের ভিতর দিয়ে কোন কোন শিরা-ধমনি, স্নায়ু-পেশি গেছে, তার নিমোনিক্স হল, ‘টল হিমালয়াস আর নেভার ড্রাই প্লেসেস।’
অভি নিজের মনে আওড়াচ্ছে। ‘ ”টল” মানে ”টিবিয়ালিস অ্যান্টিরিয়র” মাসল। ”হিমালয়াস” মানে ”এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাস” মাসল। ”আর” মানে ”অ্যান্টিরিয়ার টিবিয়াল আর্টারি”। ”নেভার”…মনে পড়ছে না। ”ড্রাই”…মনে পড়ছে না। ”প্লেসেস” মানে ”পেরোনিয়াল টার্শিয়াস মাসল”।’ স্বগতোক্তি শেষ করে যে দুটো জিনিস ভুলে গেছে, সেগুলো আবার দেখে নেয় অভি।
দ্বিতীয় পাঠ শেষ। দশখানা ছবি আঁকা প্র্যাকটিস করে ঘড়ির দিকে তাকাল অভি। একটা বাজে। এখন এক কাপ কফি বা চা পেলে ভালো হতো। মা-বাবা দুজনেই ঘুমোচ্ছে। রাধা আর মানদাও ঘুমোচ্ছে। দোতলায় নেমে রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাস জ্বালালে মনোজ-অরুণার ঘুম ভেঙে যাবে। তা ছাড়া, অভি চা বানাতে পারে না। ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম খাবে নাকি? আইসক্রিম খেলে কি ঘুম পালায়? কে জানে! অভি ঠিক করে, কাল কলেজে যাওয়ার আগে মাকে বলবে, থার্মোফ্লাস্ক বার করে রাখতে। ফ্লাস্কে দু’কাপ চা বানিয়ে রেখে দিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কিন্তু এখন ঘুম-সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? পড়ার টেবিল থেকে উঠে ছাদে পায়চারি করতে যায় অভি। চারদিক শুনশান। আকাশে অনেক তারা। ঘাড় উঁচু করে আকাশ দেখার অভ্যাস নেই অভির। সন্ধে নাগাদ যদি বা কখনও তাকায় ধোঁয়া আর কুয়াশার কারণে নোংরা ন্যাতার মতো লাগে আকাশকে। এখন, এই গভীর রাতে, সলমা-চুমকি বসানো ওড়নার মতো লাগছে আকাশকে।
ওড়নার আড়ালে কারও মুখ দেখা যাচ্ছে কী? টানা টানা চোখ, ফোলা ফোলা গাল, টোল ফেলা গালওয়ালা কোনও মেয়ে?
নিজের মাথায় চাঁটি কষায় অভি। আগামিকাল প্রথম আইটেম। এখন চন্দ্রাহত হওয়ার সময় নয়। এখন ডরসাম অব দ্য ফুট নিয়ে তৃতীয়বার রগড়াবার সময়। এটাই ফাইনাল রিহার্সাল। আগামিকাল সময় পাওয়া যাবে না। ঘরে ফিরে আবার পড়ার টেবিলে বসে অভি। ডরসালিস পেডিস আর্টারির ব্রাঞ্চগুলো কী কী যেন…চৌরাসিয়ার দ্বিতীয় খণ্ড বন্ধ করে সাদা খাতায় লাল স্কেচ পেন দিয়ে ছবি আঁকতে থাকে।
.
সকাল সাতটায় মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল অভি। অরুণার ডাকাডাকিতে ঘুম ভালো সাড়ে আটটায়। কখন অ্যালার্ম বেজেছে, বুঝতে পারেনি। তৃতীয়বার রগড়ানো শেষ হল রাত তিনটের সময়। তখনও অভি কনফিডেন্ট নয়। চতুর্থ পাঠে মনে হল, এতক্ষণে পায়ের অ্যানাটমির একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। পঞ্চমবার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন ভোর হচ্ছে।
এক লাফে বাথরুম। নিত্যকর্মপদ্ধতি সেরে, জামাপ্যান্ট গলিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দৌড়। মনোজ দাড়ি কামাতে কামাতে বললেন, ‘চান করলি না?’
অভি উত্তর দিল না।
অরুণা চিৎকার করলেন, ‘রুটি-তরকারি করেছি। খেয়ে যা।’
রাস্তায় নেমে দৌড়তে দৌড়তে অভি বলল, ‘ন’টা আঠাশের ট্রেন। এখন ওসব করা যাবে না।’
ডানকুনি লোকালে বাদুড়ঝোলা হয়ে শিয়ালদা পৌঁছল সাড়ে দশটায়। দৌড়তে দৌড়তে যখন কলেজে ঢুকল, পৌনে এগারোটা। দশটা থেকে প্রথম থিয়োরি ক্লাস শুরু হয়েছে এসএলটিতে। সে ক্লাস শেষ হতে চলল। বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাসে কাউকে প্রক্সি দিতে বলা ছিল না। তার মানে অ্যাটেনড্যান্স রেজিস্টারে লাল দাগ। ব্যাজার মুখ করে ক্যান্টিনে ঢুকে অভি বলল, ‘জীবনদা, ডিম-টোস্ট আর এক কাপ চা। ফটাফট।’
জীবনদা বলল, ‘ডিমটা তুমি পাড়বে না আমি?’
উত্তর না দিয়ে ক্যান্টিনের টেবিলে মাথা রেখে ঝিমোতে লাগল অভি। বারো ঘণ্টা পেটে কিছু পড়েনি। শরীর দুর্বল লাগছে। মাথাটাও কেমন করছে! খেয়ে-দেয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে আর একপ্রস্ত ঝালাতে হবে। কাল যা পড়েছে, তার কিছু মনে আছে কি? কে জানে!
‘অ্যাই শালা!’ কলার ধরে অভিকে শূন্যে তুলে ধরেছে রিপু। ‘ক্লাস না করে ক্যান্টিনে ঠেক মারতে এসেছিস? চল! আমাদের কলেজ ফেস্ট ”ওপিয়াম”-এর মিটিং আছে। তোকে অ্যাড তোলার কাজে লাগাব।’
‘আজ না রিপুদা,’ কাঁইমাই করে ওঠে অভি, ‘আজ আমার আইটেম আছে।’
‘তো?’ অভিকে বেঞ্চিতে বসিয়ে ভুরু নাচায় রিপু। ‘সবার আইটেম থাকে। নাথিং নিউ।’
‘আজ আমার ফার্স্ট আইটেম। ডরসাম অব দ্য ফুট। হেবি ভয় করছে।’
‘ব্যস! হয়ে গেল,’ কপাল চাপড়ায় রিপু। ‘এই জঘন্য আইটেম দিয়ে তোর ভাইভা শুরু হল? প্রথমবারের জন্য সহজ কিছু বাছতে পারলি না?’
‘বাছাবাছি কি আমার হাতে?’ জীবনদার দেওয়া ডিম-টোস্টে কামড় বসিয়ে অভি বলে, ‘আমাদের কলেজ ফেস্টের নাম ”ওপিয়াম” কেন? অন্যান্য কলেজ ফেস্টের নাম কত সুন্দর হয়। জাভোৎসব, মিতালি, ফেস্টাম…’
‘ওপিয়াম থেকে পেনকিলার মেডিসিন তৈরি হয়। ডাক্তারি-শাস্ত্রের সঙ্গে যোগসূত্র আছে। প্লাস আফিম মানে নেশাভাং, আনন্দ-ফুর্তি… এনিওয়ে তোকে এখন ঘাঁটাব না। আইটেম দিয়ে ক্যান্টিনে আসিস। মিটিং-এ থাকতে হবে।’ অভির প্লেট থেকে সিকি খাওয়া ডিম-টোস্ট মুখে পুরে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল রিপু।
দূর বাবা! খেতেও দিল না। বিরক্ত হয়ে অভি ভাবল, আর একটা ডিম-টোস্ট অর্ডার দেবে। না থাক। বারোটার সময় এনজির সামনে বসতে হবে। তার আগে একবার অ্যানাটমির জাবর কাটা প্রয়োজন। এক চুমুকে ঠান্ডা চা শেষ করে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ায় সে।
.
‘নাম?’
‘অভিজ্ঞান লাহিড়ী।’
‘গ্রুপ?’
‘এ।’
‘কার্ডে লেখোনি কেন?’ অভির দিকে দু’ভাঁজ করা গোলাপি কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলেন এনজি। গ্রিটিং কার্ডের মতো দেখতে চার পৃষ্ঠার কার্ডের প্রথম পাতার ওপর দিকে নামধাম লেখার জায়গা। তার নীচে পর পর পার্ট আর আইটেমের নাম। প্রথম পৃষ্ঠায় নাম, রোল নম্বর, গ্রুপ লিখে এনজিকে কার্ড ফেরত দিল অভি।
‘নেম দ্য বোনস দ্যাট ফর্ম অ্যাঙ্কল জয়েন্ট।’ অভির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন এনজি। এই রে! হাড়গোড়ের লিস্ট তো অস্টিওলজি সেকশানে আছে। সেটা পড়েনি অভি। চৌরাসিয়ার বইতে ‘ডরসাম অফ দ্য ফুট’ চ্যাপ্টারে হাড়ের নাম ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় আছে। পুরো অধ্যায় থেকে হাড়ের নামগুলো মনে করতে থাকে অভি। ‘ট্যালাস, লোয়ার এন্ড অব টিবিয়া অ্যান্ড ফিবুলা…’
‘থেমে থেমে বলছ কেন? পড়ে আসোনি? আমি তো ক্লাসে বলে দিয়েছি, আইটেম দেওয়ার কোনও বাঁধাধরা ডেট নেই। কনফিডেন্ট ফিল করলে তবেই আসবে। খারাপ পারফর্ম করলে ফেরত পাঠিয়ে দেব।’
‘না স্যার! আমি পড়েছি।’ এনজিকে থামায় অভি। একবার যদি ফেরত পাঠিয়ে দেয়, তাহলে কাল রাতের নরক যন্ত্রণা আবার সহ্য করতে হবে। বাবা গো!
‘ইংরিজি বলায় সমস্যা থাকলে বাংলায় উত্তর দিতে পারো।’ টুকটুক করে ঘাড় নেড়ে বলেন এনজি। ‘ডরসালিস পেডিস আর্টারির কোর্স বলো। ফাম্বল না করে, স্টেডিলি।’
কোশ্চেন কমন পড়ে গেছে! উল্লসিত অভি গড়গড় করে পায়ের পাতার প্রধান শিরার গতিপথ বর্ণনা করতে থাকে। তাকে থামিয়ে দিয়ে এনজি বলেন, ‘ডিপ পেরোনিয়াল নার্ভের কোর্স বলো।’
যাববাবা! প্রশ্নের উত্তর কনফিডেন্টলি দিলেই থামিয়ে দিচ্ছে! তার মানে, জানা থাকলেও একটু কুঁতোনোর অভিনয় করতে হবে। এই প্রশ্নের উত্তর যেমন অভির জানা। স্নায়ুর শুরু থেকে শেষ সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। তাও থেমে থেমে উত্তর দেয়। হিসেব মতো এনজি পুরো উত্তর শুনলেন। মাঝপথে থামিয়ে পরের প্রশ্নে চলে গেলেন না।
‘মার্চ ফ্র্যাকচার কাকে বলে?’ পরের প্রশ্ন। এবং বাউন্সার। এটা চৌরাসিয়ার বইতে নেই। বিলু দুটো ছোট কাগজ ‘ডরসাম অব দ্য ফুট’ চ্যাপ্টারে গুঁজে রেখেছিল। একটা কাগজে লেখা ছিল ‘মার্চ ফ্র্যাকচার’। অভি পড়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সেইটাই এনজি জিজ্ঞাসা করলেন? উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে অভি।
‘কী বই পড়েছ?’ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করছেন এনজি। রাগে তাঁর মুখ থমথম করছে।
কী উত্তর দেবে অভি? গ্রে বা মিত্র-র নাম না বলে চৌরাসিয়ার নাম বললে এনজি যদি খচে ফায়ার হয়ে যান? অন্যদিকে মিথ্যে কথা বলার বিপদ অনেক। দুয়েকটা প্রশ্ন করে এনজি বুঝে যাবেন, অভি কোন বই পড়েছে।
অভি সত্যি কথা বলে, ‘চৌরাসিয়া পড়েছি স্যার।’
‘চৌরাসিয়া ভালো বই। কিন্তু ওতে এসব নেই। তুমি ”স্নেল”-এর ক্লিনিকাল অ্যানাটমি কেনোনি?’
অভি যে কোনও বইই কেনেনি এটা এনজিকে বলার প্রয়োজন নেই। সে বলল, ‘না স্যার।’
এনজি কিছু বলার আগে অভি একটা অচেনা গন্ধ পেল। ফুলেল পারফিউমের গন্ধ। এমন মেয়েলি গন্ধ কে মেখেছে? গেস করার আগে শুনতে পেল, তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃন্দা বলছে, ‘স্যার। আইটেম।’
‘বসে পড়ো।’ অভির পাশের টুলের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন এনজি
অভির বুকের ওপর দিয়ে এখন রেলগাড়ি যাচ্ছে। তার সমস্ত অনুভূতিকে অবশ করে দিয়েছে অচেনা বুনো ফুলের গন্ধ। সে পড়া ভুলে যাচ্ছে। এনজি প্রশ্ন করলেন ‘বৃন্দা, তোমার কী টপিক?’
‘আমার আর ওর এক আইটেম। আমরা এক গ্রুপে।’ অভির দিকে আঙুল দেখায় বৃন্দা, ‘ডরসাম অব দ্য ফুট বড্ডো টাফ স্যার। কিছু মনে থাকছে না।’
গলা খাঁকরে বলেন এনজি, ‘এই আইটেমটায় এত বেশি নাম মনে রাখতে হয় যে আমারই মাঝে মধ্যে গুলিয়ে যায়। ওই জন্যেই এই আইটেমটা ফার্স্টে রেখেছি।’
যে এনজি এতক্ষণ ভুরু কুঁচকে দাঁত খিঁচোচ্ছিলেন, তিনি এখন অপূর্ব মখমলি কণ্ঠে কথা বলছেন! বোঝো কারবার! অভি অবাক। মেয়ে হওয়ার কী সুবিধে রে বাবা! এই রকমটা আগে জানলে সে সেক্স চেঞ্জ অপারেশন করিয়ে ডাক্তারি পড়তে ঢুকত।
‘অভিজ্ঞান তুমি এক কাজ করো। তুমি বৃন্দাকে প্রশ্ন করো।’ অভিকে আদেশ করেন এনজি। তথাস্তু! দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভি জানতে চায়, ‘নেম দ্য বোনস দ্যাট কনস্টিটিউট অ্যাঙ্কল জয়েন্ট।’
‘অ্যাঙ্কল জয়েন্ট কন্সটিটিউটস অব…’ গড়গড় করে বলতে শুরু করেছে বৃন্দা। অভি মনে মনে জিভ কাটল। সে এই প্রশ্নের উত্তর বলতে পারেনি।
বৃন্দার জবাব শেষ হতে এনজি বৃন্দাকে বললেন, ‘এবার তুমি ওকে একটা প্রশ্ন করো।’
‘নেম দ্য স্ট্রাকচারস দ্যাট গো আন্ডার এক্সটেনসর রেটিনাকুলাম অফ অ্যাঙ্কল জয়েন্ট।’ মৃদু হেসে প্রশ্ন করে বৃন্দা। এই চ্যাপ্টারের সবচেয়ে কমন প্রশ্নটা করতে পেরে সে খুশি। এই প্রশ্নের উত্তরও গড়গড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাহলেই এনজি থামিয়ে দিয়ে পরের প্রশ্নে চলে যাবে। সন্তর্পণে এগোয় অভি। টল হিমালয়াস আর নেভার ড্রাই প্লেসেস।
‘নেক্সট কোয়েশ্চেন?’ অভির উত্তরদান পর্ব শেষ হলে তাকে আদেশ করলেন এনজি। অভি সহজ প্রশ্ন করল। ‘ডেসক্রাইব দ্য কোর্স অব ডরসালিস পেডিস আর্টারি।’
বৃন্দা প্রশ্নের উত্তর দিল গড়গড় করে। তারপর প্রশ্ন করল, ‘এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাস মাসলের অরিজিন আর ইনসারশন কোথায়?’
জানা প্রশ্ন। চেনা উত্তর। গড়গড় করে বলতে গিয়ে হঠাৎ আটকাল অভি। তার মাথাটা হঠাৎ খালি হয়ে গেল। চেতনার ওপরে ঝপাং করে নেমে এল সাদা পর্দা। পায়ের পেশির উৎস ও মোহনা তো দূরস্থান, সে কোথায়, কার সামনে বসে রয়েছে, পাশে কে বসে, এটা কোন কলেজ—কিছু মনে পড়ছে না। তার নিজের নাম মনে পড়ছে না। সে যেন কোনও ট্রান্সে রয়েছে। রাধা পাগলির মতো মুহূর্তের মধ্যে তার-জোড়া থেকে তার-কাটা মেন্টাল স্টেটে চলে গেছে।
‘কী হল? বল!’ এনজিকে লুকিয়ে অভির হাঁটুতে খোঁচা দিল বৃন্দা। অভি ভেবলুর মতো এনজির দিকে তাকিয়ে রইল।
‘রাতে ঘুমোওনি?’ সহৃদয় প্রশ্ন এনজির।
‘না স্যার।’ মিনমিন করে জবাব দেয় অভি।
‘সকালে কিছু খেয়েছ?’
‘এক কাপ চা আর ডিম টোস্ট।’ মাথা নিচু করে বলল অভি। বলতে বলতেই হঠাৎ তার মাথার থেকে কালো পর্দাটা সরে গেল। মাথা আবার কাজ করছে। সাগরের ঢেউ-এর মতো স্মৃতি ফেরত আসছে। দিব্যি মনে পড়ে যাচ্ছে এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাসের অরিজিন ও ইনসারশান। তার-কাটা অবস্থা থেকে তার-জোড়া অবস্থায় ফিরে এসে অভি তড়বড় করে বলতে থাকে, ‘এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাস ইজ অরিজিনেটেড ফ্রম…’
‘থাক!’ হাত তুলেছেন এনজি। ‘তোমার হাইপোগ্লাইসিমিয়া হয়েছে। ব্রেনে গ্লুকোজ কমে গেলে এরকম হয়। বৃন্দা, ওকে এক্ষুনি চিনির জল খাওয়াও। না হলে অজ্ঞান হয়ে যাবে।’ অভির আইটেম কার্ড টেনে তিনি নম্বর দিলেন, ‘চার।’ দশের মধ্যে চার পাওয়া মানে ফেল। তারপর বৃন্দার কার্ড টেনে লিখলেন, ‘আট।’
‘আমাকে আবার এই আইটেমটা দিতে হবে স্যার?’ ঘামতে ঘামতে বলল অভি।
‘হ্যাঁ। সেদিন ভালো করে খেয়ে-দেয়ে এসো।’ এনজি চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
আবার এই বিভীষিকা চ্যাপ্টার পড়তে হবে? আবার সেই রাত জাগা? আবার মোটামোটা বই ওলটানো? আবার ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস? আবার নিমোনিক্স মুখস্থ করা? এর থেকে মরে যাওয়াও ভালো। টেবিলে মাথা রেখে হুহু করে কাঁদতে থাকে অভি। বুঝতে পারে বৃন্দা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে, ‘এত তাড়াতাড়ি ধ্বস খেলে হবে? এই তো সবে শুরু। এমবিবিএস প্র্যাকটিকালের সময় এইরকম একশোটা আইটেমের যে কোনও জায়গা থেকে প্রশ্ন করবে। সেটা কে সামলাবে?’
বিড়বিড় করে অভি নিজেকে বলল, ‘কেন এলাম এখানে? কেন? এসব আমার জন্য নয়।’ সে ঠিক করল এখনই এই কলেজ থেকে বেরোবে। আর কোনওদিন ফেরত আসবে না। টাটা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ। গুডবাই বৃন্দা। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে গটগট করে ডিসেকশান রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে।
‘অ্যাই অভি! হনহন করে কোথায় যাচ্ছিস?’ পিছন থেকে চিৎকার করেছে বৃন্দা। অভি উত্তর না দিয়ে হাঁটা দেয়। বৃন্দা দৌড়ে এসে অভির হাত চেপে ধরে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছিস? জবাব দে।’
শার্টের হাতায় চোখ মুছে অভি বলে, ‘ছাড়!’
‘ছাড়ব না। আগে বল কোথায় যাচ্ছিস?’
‘বাড়ি। আমি ডাক্তারি পড়ব না। এসব আমার জন্য নয়। আমার ইনক্লিনেশান অন্য দিকে। এই লাইনে এসে আমি ভুল করেছি।’ কঠিন গলায় বলে অভি।
‘ঠিক আছে। পড়বি না। এই নিয়ে নাটক করছিস কেন? চল, জীবনদার ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা খাবি। তোর ফেয়ারওয়েল ড্রিঙ্ক।’ অভির হাত ধরে ক্যান্টিনের দিকে এগোয় বৃন্দা। মাথা নিচু করে অভি ভাবে, বৃন্দার কথা শুনে ভুল হয়ে গেল। এক্ষুনি রিপুর পাল্লায় পড়তে হবে। ওকে এইসব কথা বলা যাবে না। বৃন্দা না বলে দেয়। তাহলে আর এক প্রস্ত বেইজ্জত।
ক্যান্টিনের টেবিল চাপড়ে আপ্পু গান গাইছে, ‘মার কাটারি কচি ডাবে। শাঁস পাবে, জলও পাবে।’ রিপু ধুয়ো দিচ্ছে, ‘পাবে পাবে, পাবে পাবে।’ অভি হেসে ফেলে বলল, ‘কোথায় পাও এইসব ফালতু গান? ডাবল মিনিং-এ ভর্তি?’
‘হুঁহুঁ বাওয়া! এসব হল সাবঅল্টার্ন গান। কলকাতার লোকে নাক সিঁটকোবে। গ্রাম বাংলায় সুপারহিট।’
‘গ্রামবাংলার গানের খবর তুমি পেলে কোথা থেকে?’
‘ওরে, আমরা মানুষের সঙ্গে মিশি। মানুষের পালস বুঝি। আমরা এই গান জানব না তো কি তুই জানবি?’ হাসতে হাসতে হুমকি দেয় আপ্পু। অভি বলে, ‘এটা কার গাওয়া?’
‘জানি না। এই মিউজিক ভিডিয়োটা আমাদের সাপ্লাই করেছে উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয়, কুমার চন্দন।’ মোবাইল খুলে ভিডিয়োটা অভির সামনে মেলে ধরে। অ্যামেচার ভিডিয়োতে হিরোর পোশাক আর ডান্স স্টেপ দেখে অভি পেট চেপে ধরে হাসতে লাগল।
বৃন্দা বলল, ‘আমায় দেখা।’ তারপর অভির হাত থেকে মোবাইল কেড়ে ক্লিপিং দেখতে লাগল।
আপ্পু বলল, ‘হিরোইনের মুভমেন্ট খেয়াল করিস।’
পরবর্তী পনেরো মিনিট ক্যান্টিনে আর কিছু হল না। সবাই ব্লু-টুথ ডিভাইস দিয়ে ক্লিপিংটা নিজের নিজের মোবাইলে নিয়ে নিল। রিপু বলল, ‘ ”দয়াল বাবা কলা খাবা” বলে একটা গান আছে। বাড়ি ফিরে ইউটিউবে দেখে নিস। অভি তোর আইটেম কেমন হল?’
অভি কিছু বলার আগে বৃন্দা বলল, ‘অভিকে তোমরা এখন বিরক্ত কোরো না। ও ফাউল মুডে আছে।’
অভি ঘাবড়াল। বৃন্দা মেয়েটা এইরকম বেয়াক্কেলে? সবার সামনে বলে দেবে তার আইটেমে ঝাড়ের কথা? ধুর! ভাল্লাগে না। ক্যান্টিনে এসে মনটা ভালো হয়েছিল। আবার হেজে গেল।
‘কেন?’ প্রশ্ন করে আপ্পু, ‘আইটেমে ঝাড় খেয়েছে নিশ্চয়?’
‘ঝাড় তো খেয়েছে। সেটা কোনও ব্যাপার নয়। বেচারি ঝাড় খেল আমার জন্য। এই ভেবে আমার খারাপ লাগছে।’ করুণ মুখে বলে বৃন্দা। রিপু খচে ফায়ার হয়ে বলে, ‘তুই নির্ঘাৎ ওর আইটেমের সময়ে এনজির কাছে আইটেম দিতে গিয়েছিলি?’
‘হ্যাঁ।’ অবিকল অভির কায়দায় মুখ নিচু করে বলে বৃন্দা। রিপু অভিকে বলে, ‘লেসন নাম্বার ওয়ান। সুন্দরী মেয়ের পাশে বসে কখনো পরীক্ষা দিবি না। ঝাড় অবধারিত। এক্সামিনার ফিমেল হলে এই লেসন খাটবে না। স্পেশালি বায়োকেমিস্ট্রির আরতী ম্যাডাম বা প্যাথলজির রিনা ম্যাডাম হলে ওরা ফেল আমরা পাস। বৃন্দা নিশ্চয় পাস করেছে?’
অভি উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘ওকে আট দিল। আর আমায় চার। আবার ওই ছাইপাঁশ পড়তে হবে।’
‘একদম পড়বি না।’ পরামর্শ দেয় আপ্পু। ‘আগামিকাল এই প্রিপারেশান নিয়েই এনজির সামনে বসবি। দেখবি, ছয় কি সাত দিয়েছে।’
‘আচ্ছা,’ ঘাড় নাড়ে অভি। এবার তাকে উঠতে হবে। জীবনদার ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে মেন গেটের দিকে হাঁটছে অভি, পিছন থেকে বৃন্দা বলল, ‘কাল পপলিটিয়াল ফসার ডিসেকশান আছে। পিএম রেসপিরেটরি সিস্টেম পড়াবেন। ঠিক সময়ে আসিস।’
‘আচ্ছা।’ ঘাড় নাড়ে অভি। শেয়ালদা স্টেশানের দিকে যেতে যেতে মনে হয়, বৃন্দা চা খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে ডেকেছিল। সেটাই খাওয়া হল না।
.
বৃন্দা
‘অ্যাই! রোজ ডে-স্কলারদের মতো ক্লাস শেষ হলেই বাড়ি কাটিস কেন?’ বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল শেষ করে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং থেকে বেরোনো মাত্র বৃন্দাকে প্রশ্ন করল আপ্পু।
‘আমি ডে-স্কলার। তাই!’ হাসতে হাসতে উত্তর দিল বৃন্দা।
‘হোস্টেলে রুমের দরকার নেই তা হলে?’ সরু চোখে প্রশ্ন করে আপ্পু। উত্তর দিতে গিয়ে থমকায় বৃন্দা। এটা সত্যি যে সে হোস্টেলে থাকবে না। কিন্তু কখনও কোনও ইমার্জেন্সিতে কলেজে রাত কাটানোর প্রয়োজন হতে পারে। সেটা কলেজ ফেস্ট হোক, বা এমবিবিএস পরীক্ষার আগের কয়েক সপ্তাহ। সুতরাং হোস্টেলের একটা রুমে নিজেকে অ্যালট করা জরুরি। আপ্পু তার সংগঠনের স্বার্থ দেখছে। পাশাপাশি জুনিয়রের প্রতি কনসার্নও আছে। আপ্পুর প্রশ্নের উত্তর সাবধানে দেয় বৃন্দা, ‘দরকার তো আছে। কিন্তু আমার থেকেও বেশি দরকার, যাদের দূরে বাড়ি, তাদের।’
বৃন্দা জানে, গার্লস হোস্টেলে স্থান সংকুলানের সমস্যা পুরনো। এবং এই সমস্যার একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। মানবীবিদ্যা নিয়ে যারা চর্চা করেন তারা ভালো বলতে পারবেন, কেন মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলগুলোয় ছেলেদের জায়গা পাওয়া কোনও সমস্যা নয়, কিন্তু মেয়েদের হোস্টেলে বেড পাওয়া নিয়ে নিয়মিত চুলোচুলি হয়।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের আদি নাম রবিনসন মেডিক্যাল কলেজ। এখানকার মেয়েদের হোস্টেলের নাম লেডি আর্চার্স হোস্টেল। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা শহরে সাইমন আর্চার নামে এক আমলা এসেছিলেন। তাঁর বাসস্থান ছিল লাল ইটের তৈরি এই দোতলা বাড়ি। সাইমন প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যেতেন ব্রিটিশ সরকারের কাজে। সারাদিন লেডি আর্চার বাড়িতে একা। একগাদা নেটিভ চাকর পরিবেষ্টিত হয়ে তাঁর দিন কাটত। সন্ধে পার করে সাইমন বাড়ি ফিরতেন। রাত হলেই বাড়িতে পার্টি, রোজ নিত্যনতুন শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারীর আনাগোনা, মদের ফোয়ারা, নাচাগান, হইহুল্লোড়। দিনের বেলার বিমর্ষ লেডি আর্চার রাতের বেলায় হয়ে উঠতেন পুরোদস্তুর সোসাইটি লেডি। সাইমন স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। কিন্তু জানতে পারেননি যে লেডি আর্চার কোনও শ্বেতাঙ্গর সঙ্গে নয়, এক নেটিভ ভিস্তিওয়ালার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক নিয়মিত লিপ্ত হন। ইন্ডিয়ান সামারে অসুস্থ হয়ে একদিন দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে সাইমন দেখেন, শোওয়ার ঘরে লীলাখেলা চলছে। রাগের চোটে বেডরুমেই বন্দুক চালিয়ে ভিস্তিওয়ালা এবং লেডি আর্চারকে হত্যা করেন সাইমন। তারপর নিজের রগে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালান। এই ত্রিকোণ প্রেমের গালগল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লেডি আর্চার্স হোস্টেল।
চৌকোনা দোতলা প্রাসাদ। মাঝখানে বিশাল বাগান। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ব্রিটিশ আমলের যে কটি স্থাপত্য আছে, তার মধ্যে অন্যতম।
বসতবাড়িকে হোস্টেলে বদলে ফেললে যা যা সমস্যা হয় তার সবক’টি লেডি আর্চার্স হোস্টেলে আছে। ঢাউস ঢাউস ঘর, কিন্তু সংখ্যায় কম। প্রতি ফ্লোরে বাথরুমের সংখ্যা নামমাত্র। ঘরে এত বড় বড় জানলা, যে ঢাকতে গিয়ে পর্দায় টান পড়ে। বিশাল বাগান, কিন্তু দেখাশুনো করার মালি নেই। আলাদা ডাইনিং রুম নেই। গার্লস হোস্টেলের সুপার রিনা দত্ত একতলার দুটো ঘর নিয়ে থাকেন। ঘর-সংকট থাকা সত্ত্বেও কেউ রিনা দত্তকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। কেননা তিনি প্যাথলজির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট এবং জনমোর্চা চিকিৎসক সংগঠনের সদস্য। সব মিলিয়ে লেডি আর্চার্স হোস্টেলে মেয়েদের সমস্যা তিনটে। স্থানাভাব, বাথরুমের অভাব, আব্রুর অভাব।
মেয়েদের হোস্টেলে রুমের ক্রাইসিস এত মারাত্মক যে এই নিয়ে সরকারপন্থী এবং সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন দু’দলই আন্দোলন করেছে। ডেপুটেশান থেকে বনধ, অনশন থেকে সুপারের অফিস ঘেরাও—সব হয়েছে। আন্দোলনের শেষে প্রাপ্তি, পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের একটি চিঠি। যার সারমর্ম, ‘লেডি আর্চার্স হোস্টেল নিডস ভার্টিকাল ইরেকশান। দ্য গার্ডেন শুড নট বি ট্যাম্পার্ড উইদ।’ সারমর্ম, ফাঁকা জায়গায় নতুন কনস্ট্রাকশন করা যাবে না। দোতলা হোস্টেলকে তিন বা চারতলা করা যেতে পারে।
চিঠি নিয়ে কলেজে প্রবল হাসাহাসি। রাতারাতি লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গায়ে পোস্টার পড়ে গেল, ‘গার্লস আর ওয়েটিং ফর ভার্টিকাল ইরেকশান।’
আবাসিক মেয়েরা কিছু মনে করেনি। পোস্টার ছিঁড়েও দেয়নি।
ঠাট্টা-ইয়ার্কি সত্ত্বেও গোদা কথা হল, গার্লস হোস্টেলে তীব্র স্থানাভাব। একেকটা ঘরে পাঁচ থেকে ছজন থাকে। সিনিয়র দিদিরা হাউসস্টাফশিপ কমপ্লিট করার পরেও বেড ছাড়ে না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের জন্য পড়াশুনো ছাত্রীদের হোস্টেলে থেকেই করে। সত্যি কথা বলতে কি, হোস্টেলে আনঅথরাইজড এবং অথরাইজড বোর্ডারের সংখ্যা সমান সমান। রোজ সকালে বাথরুমের সামনে সুলভ শৌচালয়ের মতো লম্বা লাইন পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে আপ্পু বৃন্দাকে হোস্টেলে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বৃন্দা না বলে কী করে?
‘তোকে অত কথা ভাবতে হবে না। তুই আমার সঙ্গে রিনা ম্যাডামের কাছে চলে চল। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ বৃন্দার ব্যাকপ্যাক ধরে টানতে টানতে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সবুজ লোহার গেট পেরিয়ে কম্পাউন্ডের ভিতরে ঢুকল আপ্পু।
লাল রঙের বাড়ি। জানলা-দরজা সবুজ রঙের। প্যারাপেট এবং থামের রং হালকা বাদামি। ছাপমারা ব্রিটিশ আর্কিটেকচার। বিশাল আর্চওয়ালা প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ডানদিকে গেস্টরুম। পুরুষ প্রজাতি গেস্টরুম পর্যন্ত অ্যালাওড। গেস্টরুমে গোটাপাঁচেক সোফা রাখা রয়েছে। গোটাপাঁচ টেবিল। মেঝেয় জুটের কার্পেট। কতদিন ধুলো ঝাড়া হয়নি কে জানে! দেওয়ালে কয়েকটা পেন্টিং অথবা ফোটোগ্রাফ ঝুলছে। বছরের পর বছর ধরে তাদের ওপরে ধুলোর আস্তরণ জমেছে, জাল বুনেছে মাকড়সা। কাঠের ফ্রেমের চৌখুপ্পির মধ্যে কালো আর ধূসর রঙের টানাপোড়েন ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না।
ছাদ থেকে ঝুলছে পাখা এবং টিউবলাইট। পুরনো দিনের বাড়ির উচ্চতা এখনকার বাড়ির দেড়গুণ। বড় ঘরে কম সংখ্যক ফ্যান এবং টিউবলাইট থেকে হাওয়া এবং আলো ছড়ানোর জন্য তাদের লম্বা রড দিয়ে ঝোলানো হয়েছে। দেওয়ালে লাগানো পে-ফোনের বাক্সে ঝুল জমেছে। বৃন্দা আন্দাজ করল, মোবাইল পূর্ববর্তী জমানায় বাক্সটা বসানো হয়েছিল। মোবাইল আসার পরে প্রয়োজন ফুরোলেও কেউ খুলে নেওয়ার কথা ভাবেনি। বাক্সটা অ্যান্টিক পিসের মতো দেওয়াল থেকে লটকে আছে।
শুধু বাক্স কেন, গোটা গেস্টরুম থেকেই অ্যান্টিক-অ্যান্টিক গন্ধ বেরোচ্ছে। আপ্পু বলল, ‘গেস্টরুম দেখার জন্য তোকে হোস্টেলে আনিনি। রিনা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করবি চল।’
প্রধান ফটকের বাঁদিকে হোস্টেল সুপার রিনা দত্তর কোয়ার্টার। সেগুন কাঠের বিশাল দরজার এককোণে মান্ধাতার বাবার আমলের গোল, সাদাকালো কলিং বেল। আপ্পু বেল টিপতেই ক্যাঁক-ক্যাঁক করে বিকট শব্দ হল। মুহূর্তের মধ্যে শোনা গেল কুকুরের ঘেউঘেউ চিৎকার, পাখির কলরব এবং বিকট বাজখাঁই গলায় ধমক, ‘ক্যা?’
হয়তো রিনা ‘কে’ বলতে চেয়েছেন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে, বৃন্দা শুনল ‘ক্যা?’ দরজার ওপারে এত রকমের আওয়াজ আর চেঁচামেচি হচ্ছে যে বৃন্দার মনে হল নোয়ার নৌকায় ওঠার জন্য স্ট্যাম্পিড শুরু হয়েছে।
দরজা খুলে উঁকি মারলেন যিনি, তাকে টিনটিনের কমিক স্ট্রিপের জেনারেল আলকাজারের বউয়ের মতো দেখতে। আপ্পুর মতো লম্বা না হলেও, অনেকটা লম্বা। চওড়াতেও আপ্পুর সমকক্ষ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। পরে আছেন লাল কাফতান। চোখে লাল তিনকোনা ফ্রেমের চশমা। ওই তিনকোনা ফ্রেমের কারণেই রিনাকে জেনারেল আলকাজারের বউ ভেবেছিল বৃন্দা! রিনার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। মুখ থেকে হালকা অ্যালকোহলের গন্ধ আসছে। ঘড়িতে সময় দেখল বৃন্দা। বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। এখন থেকেই মদ্যপান করছেন? এ দেখি স্যামির থেকেও এক কাঠি সরেস।
‘আরে আপ্পু! প্লিজ ডু কাম!’ দরজা খুলে আপ্পুকে ভিতরে আহ্বান করলেন রিনা। বৃন্দা পিছন পিছন বসার ঘরে ঢুকল। দু’কামরাওয়ালা কোয়ার্টারের প্রথম ঘরকে বসার ঘর বলতে হয় তাই বলা। না হলে, এটিকে লাইব্রেরি অথবা ল্যাবরেটরি অথবা শুঁড়িখানা—যা খুশি বলা যেতে পারত।
ঘরের চারটি দেওয়াল জোড়া বুক র্যাক। তাতে প্যাথোলজি বিষয়ক নোটবুক, রেফারেন্স বুক, টেক্সট বুক, জার্নাল, ম্যাগাজিন থইথই করছে। টেবিলের ওপরে রাখা একটি হাই এন্ড ডেস্কটপ কম্পিউটার ও একটি বাইনোকিউলার মাইক্রোস্কোপ। ডেস্কটপটি তার দিয়ে মাইক্রোস্কোপের সঙ্গে যুক্ত। মাইক্রোস্কোপের আই-পিসে ডিজিটাল ক্যামেরা ফিট করা। এই হাই-টেক সেটআপের পাশে গেলাসে সাদা পানীয়। বুক র্যাকের পাশে লালরঙা বার কাউন্টার ভরতি গোটা পঞ্চাশেক ছোট-বড় বোতল।
স্যামির কল্যাণে বৃন্দা সারা পৃথিবীর অ্যালকোহলের ব্র্যান্ড চেনে। তার জ্ঞানের বাইরে অবস্থান করছে এইরকম কিছু বোতলও দেখা যাচ্ছে। ঘরময় সিগারেটের গন্ধ।
‘সো… ধান্দাটা কী?’ নিখুঁত তিনটে রিং ছেড়ে প্রশ্ন করলেন রিনা। কোনও সামাজিক সম্ভাষণ নয়, হাই হ্যালো নয়, একদম কাজের কথা। রিনার দুনিয়াদারি দেখা আছে। তিনি ফালতু ‘পেপ টক’ পছন্দ করেন না।
‘এর নাম বৃন্দা। একে হোস্টেলে একটা বেড দিতে হবে।’
‘বেড দেওয়ার দায়িত্ব তোদের। আমার কাছে যখন এনেছিস, তখন কোনও একটা প্যাঁচ আছে। সেটা কী?’ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন রিনা।
‘ও কলকাতার মেয়ে। হস্টেলের তেমন দরকার নেই।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি। তা না হলে আমার কাছে আনবি কেন? আমি বলতে চাইছি ওকে হোস্টেলে বেড দেওয়ার জন্য তুই এত ইগার কেন? ভোটে দাঁড় করাবি?’
এতক্ষণে বৃন্দার বোধোদয় হল। রিনা অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করেছেন। আপ্পু তো-তো করতে করতে জবাব দিল, ‘অতটা ভাবিনি। ও এবার মিস আইএমসি হয়েছে। সেই জন্য বলছিলাম…’
‘লেম এক্সকিউজ!’ সিগারেট অ্যাশট্রেতে পিষে বৃন্দার দিকে তাকিয়ে রিনা বললেন, ‘বাড়ি কোথায়?’
‘সাউথে!’ দায়সারা উত্তর দেয় বৃন্দা।
‘সাউথ-পোল না সাউথ-আমেরিকা না সাউথ-ইন্ডিয়া না সাউথ-টোয়েন্টি ফোর পরগনাস?’ শ্লেষের তির মাখানো মালটিপল চয়েস প্রশ্ন ধেয়ে এল রিনার কাছে থেকে।
‘সাউথ ক্যালকাটা।’ লজ্জা পেয়ে বলে বৃন্দা। ক্যাজুয়ালি উত্তর দেওয়া অনুচিত হয়েছে।
‘বোড়াল না গড়িয়া না পশ্চিম পুঁটিয়ারি?’ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন করেন রিনা। লাল ত্রিকোণ ফ্রেমের ওপাশে তাঁর চোখ ঝকঝক করছে। বৃন্দার মধ্যে নধর মুরগি খুঁজে পেয়েছিল তিনি।
‘মুদিয়ালি।’ অসহায়ভাবে বলে বৃন্দা।
‘মুদিয়ালির কোথায়? চারু মার্কেট?’ রিনা ইচ্ছে করে মুদিয়ালির এমন জায়গার নাম করলেন, যেখানে কয়েকটা বস্তি আছে। বৃন্দা মাথা নেড়ে বলল ‘এসআর দাস রোড আর এসপি মুখার্জি রোডের ক্রসিং-এ।’
‘ওই কর্নারে তো একটাই বাড়ি। শান্তিধাম।’ জ্বলজ্বলে চোখে বৃন্দার দিকে তাকিয়ে বলেন রিনা। বৃন্দার মনে পড়ে যায় স্যামির পরামর্শ। কলেজের কেউ যেন জানতে না পারে যে সে সার্জারির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের মেয়ে। বৃন্দা কথা ঘোরানোর জন্য বলে, ‘আপনারও মুদিয়ালিতে বাড়ি?’
রিনা কিছু বলার আগে ভিতরের ঘর থেকে পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, ‘হ্যাঁগো, একবার শুনবে? এটা নিয়ে যাও না!’ রিনার কৌতূহলের অবসান ঘটল কি না বোঝা গেল না, তবে পুরুষ কণ্ঠের অনুরোধ শুনে তিনি প্রশ্ন করা বন্ধ রেখে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। ফাঁকা ঘরে বৃন্দা আপ্পুর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল। ফিশফিশ করে বলল, ‘এটা কী কেস গুরু?’
আপ্পু ঠোঁটে তর্জনী রেখে ইশারা করল, ‘চুপ।’
রিনা ফেরত এসেছেন। কম্পিউটার খুলে একটা ফোল্ডার হাঁটকে বললেন, ‘দোতলার রুম নম্বর থার্টিন।’
‘ম্যাডাম, ওই ঘরটা বাথরুমের পাশে।’ আপ্পু আপত্তি করে, ‘বাথরুমের দখল নিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া হয়। ও ঘরে কেউ থাকতে পারে?’
‘ওই ঘরে কেউ থাকে না বলেই বৃন্দাকে অ্যালট করছি। চারটে বেড আছে। তার মধ্যে দুটো বেড অকুপাই করে দুই হাউসস্টাফ ছিল। ওরা এমডিতে চান্স পেয়ে সদ্য হোস্টেল ছেড়েছে। রুম এখন খালি।’
‘আমার কোনও প্রবলেম নেই।’ তড়িঘড়ি বলে বৃন্দা। সে কোনওদিনও হোস্টেলে থাকবে না। তার রুম বাথরুমের পাশে হলে অসুবিধে নেই।
‘ঠিক হ্যায়!’ কি-বোর্ড টিপে ডেটা এন্ট্রি করতে করতে রিনা বলেন, ‘নাম-ঠিকানা বলো…’
‘বৃন্দা ব্যানার্জি, ওয়ান বাই ওয়ান এ এসআর দাস রোড, কলকাতা…’ নাম ঠিকানা বলার পরে পিন নম্বর বলতে বলতে বৃন্দা খেয়াল করল, রিনা কি বোর্ড টিপছেন না। মনিটরের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন।
ঘটনাটা শুধু বৃন্দার নয়, আপ্পুরও চোখে পড়েছে। সে বলল, ‘ম্যাডাম, ঠিকানা লিখবেন না?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ…’ লাল ত্রিকোণ ফ্রেমের চশমা ঠিক করে টকাটক কি-বোর্ড টেপেন রিনা। আর একটা সিগারেট মুখে গুঁজে ফশ করে দেশলাই ধরান। তাঁর চোখে চিকচিক করছে জল এবং কৌতূহল। ড্রয়ার খুলে চাবি বার করে বৃন্দার হাতে দিতে গিয়ে প্রশ্ন করলেন ‘শান্তিধাম?’
আবছা ঘাড় নাড়ে বৃন্দা। আপ্পু যেন কিছু বুঝতে না পারে।
‘স্যামি? বাবা?’ ক্যাজুয়ালি বলেন রিনা।
আবার আবছা নড করে বৃন্দা। মনে মনে প্রার্থনা করে রিনা যেন আর কিছু জিজ্ঞাসা না করেন।
রিনা কি বৃন্দার প্রার্থনা বুঝতে পেরেছেন? বোধহয় হ্যাঁ। তিনি আবার পুরনো চেহারায়। এক চুমুক ভদকা পান করে আপ্পুকে বললেন, ‘তোরা এবার আয়। একটা আর্টিকলের জন্য ছবি তুলতে গিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি।’
ভিতর থেকে আবার পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, ‘রিনা, কারা এসেছে?’
রিনা উত্তর দেওয়ার আগে বৃন্দা আর আপ্পু সুপারের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এল। চওড়া দালান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপ্পু বলল, ‘ভেতর থেকে যে লোকটি কথা বলছিলেন, উনি রিনা ম্যাডামের হাজব্যান্ড। ভালো নাম জানা নেই। সবাই পুশকিনদা বলে। উনিও ডাক্তার। শুনেছি অনেক বছর আগে অ্যাক্সিডেন্টের ফলে ওনার স্পাইনে চোট লাগে। তারপর থেকে দুই পা অবশ।’
‘ও।’ মার্বেল বসানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে বলে বৃন্দা।
‘কমিউনিটি মেডিসিনের নিরোধ দে-র সঙ্গে রিনা ম্যাডামের শান্টিং-এর রিলেশান আছে। তবে আমি শিয়োর নই।’
‘শান্টিং আবার কী?’
‘নেকুপষুমুনুগিরি হচ্ছে?’ দুই হাত দিয়ে সঙ্গমের ইঙ্গিত করে আপ্পু বলে, ‘শান্টিং জানিস না?’
‘ও! তাই বলো!’ নিজেকে সামলে নেয় বৃন্দা, ‘আমি শুনেছি যে বায়োকেমিস্ট্রির এইচওডি-র সঙ্গেও ওঁর ওই ব্যাপারটা আছে।’
‘কমিউনিটি মেডিসিনের হেডুর নাম নিরোধ স্যার। বিয়েথা করেনি। আমাদের কলেজের উলটো ফুটে, প্রাচী সিনেমা হলের পাশের রাস্তাটার নাম ডিক্সন লেন। ওই রাস্তায় নিরোধ স্যার একা একটা পুরোনো বাড়িতে থাকেন। একদিন রিনা ম্যাডাম যান, একদিন আরতী ম্যাডাম যান। রিনা ম্যাডামের বাচ্চা-কাচ্চা নেই। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ থেকে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে গেলে পঙ্গু পুশকিনদাকে নিয়ে বিপদে পড়বেন। নিরোধ স্যারকেও আর পাবেন না। ওই জন্য মন দিয়ে জনমোর্চার ডাক্তারি অ্যাসোসিয়েশান করেন আর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পান্ডাদের হাতে রাখেন। নেতাদের সব কথা শোনেন। যেমন আমার কথা শুনলেন।’ দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে বলল আপ্পু।
লেডি আর্চার্স হোস্টেলের স্থাপত্য দেখে বৃন্দা মুগ্ধ। সাদা-কালো চৌখুপ্পি মেঝে, লোহার রেলিং, উঁচু কাঠের দরজার ওপরে রঙিন কাচের জাফরি—একদম উনিশ শতকের কলকাতার বাড়ি। লাহাবাড়ি বা দাঁ ফ্যামিলিদের প্যালেসে শুটিং না করে এখানে করা যেতে পারে। টানা বারান্দায় ঝোলানো খাঁচায় বন্দি টিয়াপাখির বদলে এখানে তার থেকে ঝুলছে মেয়েদের নানান মাপের অর্ন্তবাস, জিনস, টি-শার্ট, পেটিকোট, তোয়ালে।
বারান্দার একদম শেষ ঘরটার সামনে এসে আপ্পু বলল, ‘এই হল তোর রুম। আমি জানতাম রিনা ম্যাডাম তোকে এই ঘরটা অ্যালট করবেন। দরজা খোল।’
ইয়াব্বড়ো তালায় চাবি ঢোকাতে ঢোকাতে বৃন্দা বলল, ‘রুম নম্বর তেরো হয় কী করে? আগের রুমের মাথায় নম্বর হল সাতাশ। সেই হিসেবে এটা আঠাশ হওয়া উচিত।’
কাঠের খড়খড়ি দেওয়া দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আপ্পু বলল, ‘এই হোস্টেলের বারো নম্বর ঘরের পরের ঘরটার নম্বর হল চোদ্দ। আনলাকি থার্টিনে কেউ থাকবে না বলে ওই নম্বরটা ওমিট করা হয়েছে। পরে হিসেব মেনটেইন করার জন্য আঠাশ নম্বর ঘরকে তেরো নম্বরের শিরোপা দেওয়া হয়েছে। আনলাকি নাম্বার ফর অ্যান ওমিনাস রুম।’
‘ওমিনাস কেন?’ ঘরে ঢুকে বলল বৃন্দা।
‘এটা সাইমন আর লেডি আর্চারের মাস্টার বেডরুম ছিল। এই ঘরেই সাইমন তার বউ আর ভিস্তিওয়ালাকে রেড হ্যান্ডেড ধরেছিলেন। এই ঘরেই দুটো মার্ডার আর একটা সুইসাইড হয়েছিল। এই ঘরে ওঁরা নাকি ফিরে আসেন।’
‘ভ্যাট!’ হেসে ফেলে বৃন্দা। বারান্দার উল্টোদিকের দুটো বড় বড় জানলা খুলে দেয়। শেষ বিকেলের রোদে ঘর ভরে যায়।
ঘরটা বিশাল বড়। আরও বড় লাগছে, কেন না এই ঘরে আসবাব কম। দুটি সিঙ্গল বেড, দুটি টেবিল আর দুটি চেয়ার ছাড়া কিছু নেই। তিরিশ ফুট বাই তিরিশ ফুট ঘরে এই কটা ফারনিচার নস্যি। অনেক ওপরে দুটো চার ব্লেডওয়ালা ফ্যান চুপচাপ বৃন্দাকে মাপছে। দেওয়াল আর সিলিংয়ে ঝুল, মেঝেতে এক আঙুল পুরু নোংরা। খাট, টেবিল, চেয়ার—সব ধুলোর আস্তরণে ঢাকা। ‘হ্যাঁচ্চো’ ‘হ্যাঁচ্চো’ করে বারতিনেক হাঁচে বৃন্দা।
আপ্পু বলে, ‘জানলাগুলো বন্ধ করে দে। ওদিকটায় গ্রুপ ডি স্টাফের কোয়ার্টার। সবসময় হাঁ করে হোস্টেলের জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।’
বৃন্দা বলে, ‘আমার ডাস্ট অ্যালার্জি হচ্ছে। কী ধুলো।’
আপ্পু জানলা বন্ধ করে বলে, ‘ডাস্ট অ্যালার্জি সেরে যাবে। তোর ভূতে ভয় নেই তো? থাকলে আগে থেকে বল। পরে নাকি কান্না চলবে না।’
‘আজ পর্যন্ত ভূত কেউ দেখেছে?’ রুমাল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলে বৃন্দা।
‘কেউই দেখেনি। তবে দু-একজন মেয়ে এ ঘরে থাকার চেষ্টা করে ফেল করেছে। রাতে নাকি খাটের পায়া নড়ে, জানলা নিজের থেকে খোলা-বন্ধ হয়, সুইচ না টিপলেও বনবন করে পাখা ঘুরতে শুরু করে, গাউন-পরা মেমসাহেব হাই হিল জুতো পরে খটখট করে ঘুরে বেড়ায়। আমি চাইছি রুমটা ইউজ হোক। যেখানে থাকার এত সমস্যা, সেখানে ভূতের ভয়ে এত বড় একটা রুম খালি যাবে, এটা ঠিক না।’
‘ভূতের গন্ধ যে ঘরের গায়ে লেগে গেছে, সে ঘরে থাকা শক্ত। বিচ্ছিরি মানসিক চাপ পড়ে।’ হাসতে হাসতে বলে বৃন্দা। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমিও যথেষ্ট ভিতু। কোনওদিন রাতে এ ঘরে থাকব কি না সন্দেহ। তবে দিনের বেলা রেস্ট নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এত বড় ঘরে আমি একা থাকব? কোনও রুমমেট পাব না?’
‘যারা পারমানেন্টলি হোস্টেলে থাকছে বা থাকবে, তারা কেউ আসতে রাজি নয়। তোদের ব্যাচের সাবিনা, জেমসি, শ্রীপর্ণাকে বলেছি। ওরা কেউ আসেনি। অন্য রুমে পাঁচ-সাতজন গাদাগাদি করে থাকবে, কিন্তু এই রুমে আসবে না। আমি দময়ন্তীকে বলেছি। ও নিমরাজি। বলেছে, কেউ একজন এলে, তবেই আসবে। সেই জন্যেই তোকে পাকড়ালাম। তোরা দুজনে বছরখানেক এই রুমে কাটিয়ে দিতে পারলে সামনের বছর এই ঘরে পাঁচজন ঢুকে যাবে। অন্য রুমের ওপরে চাপ কিছুটা হলেও কমবে।’
বৃন্দার হাঁচি বন্ধ হয়নি। সে বলল, ‘চলো, এবার বেরোই। বাড়ি ফিরতে হবে।’
রুম নম্বর থার্টিন থেকে বেরিয়ে আসে বৃন্দা আর আপ্পু। আপ্পু রুমের দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি বৃন্দার হাতে দিয়ে বলে, ‘কাল বাড়ি থেকে চাদর নিয়ে এসে পেতে ফেলিস। নীচে ফুলমতিয়া বসে আছে, ওকে পঞ্চাশ টাকা দিস। রুম সাফ করে দেবে। বন্ধ থেকে থেকে ড্যাম্প হয়ে গেছে।’
‘ফুলমতিয়া কে?’ চাবি ব্যাগে ঢুকিয়ে বলে বৃন্দা।
‘ক্যান্টিনের জীবনদার বউ। গাইনিকলজি ডিপার্টমেন্ট আর লেবার রুমের আয়া। যখন ডিউটি থাকে না, তখন লেডিজ হোস্টেলের ঝাড়ুদারনি-কাম-উওম্যান ফ্রাইডে। চোথা করার জন্য মাইক্রো জেরক্স, রাত একটার সময় ভদকার বোতল, পাজামা পার্টির জন্য হ্যাশ—সব ওর কাছে পাবি। আমাদের হোস্টেলের মাঝখানের বাগানে গাঁজা গাছের চাষ হয়, এটা জানতিস?’
‘এখানে গাঁজা?’ বৃন্দা অবাক।
‘এখানেই তো সুবিধে। পুলিশের বাবাও জানতে পারবে না। ফুলমতিয়া গাঁজা সাপ্লাই করে ওর বরকে। জীবনদার ক্যান্টিনে উৎকৃষ্ট ”মণিপুরি গাঁজা” নামে যা পাওয়া যায়, তা আসলে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের ফসল।’
বৃন্দা বলতে যাচ্ছিল, ‘আমার কোনওটারই দরকার নেই।’ বলল না। আপ্পু মেয়েটা ভালো। অযথা চটিয়ে লাভ নেই।
আপ্পু বৃন্দাকে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আলমারি খুলে অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ট্যাবলেট দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নে। হাঁচি বন্ধ হয়ে যাবে।’
এই ঘরে খাটের সংখ্যা দেখে বৃন্দা আন্দাজ করল পাঁচজন থাকে। সিনিয়র দিদিদের বৃন্দা চেনে না। তাদের ব্যাচের জেমসি এই রুমে থাকছে। সে পাজামা আর টি-শার্ট পরে কানে ইয়ার ফোন গুঁজে ল্যাপটপে স্কাইপ করছে। মুখের কাছে মাউথপিস ধরে বিড়বিড় করে কথা বলছে আর কুলকুলিয়ে হাসছে। ল্যাপটপের পর্দায় মাঝবয়সি এক মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। বোধহয় জেমসির মা। ওয়েব-ক্যামের থেকে দূরে রইল বৃন্দা। জেমসিকে বলল, ‘চললাম।’ জেমসি অন্যমনস্ক ভাবে হাত নাড়ল।
লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সবুজ গেট পেরিয়ে বাইরে এসে বৃন্দা আপ্পুকে রুমের চাবি ফেরত দিয়ে বলল, ‘আমি কাল বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, মশারি —এই সব নিয়ে আসব। তুমি ফুলমতিয়াকে বোলো, রুমটা সাফ করে রাখতে। আমি কাল দিঠির সঙ্গে কথা বলে নেব।’
‘দিঠি?’
‘দময়ন্তীর ডাকনাম। ওর ভালোনামটা বড্ডো বড়। ওই নামে আমাদের ক্লাসে ওকে কেউ ডাকে না। আমরা দিঠি বলি।’
‘গুড। আমিও দিঠিই বলব।’
‘আপ্পুদি, আমি তাহলে এগোলাম। কাল দেখা হবে।’
আপ্পু হাসি মুখে কথা বলছিল। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ওপিয়াম নিয়ে ইউনিয়ন রুমে মিটিং আছে। যাবি না?’
‘ওপিয়াম? মানে ফুলমতিয়ার গাঁজা? তাই নিয়ে মিটিং?’
‘আমাদের কলেজ ফেস্টের নাম ওপিয়াম।’ চোখ পাকিয়েছে আপ্পু।
‘আজ ছেড়ে দাও প্লিজ!’ মিনতি করে বৃন্দা।
‘ঠিক আছে। আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। তবে এটা মনে রাখিস, কলকাতার প্রথম পাঁচটা ইন্টার-কলেজ ফেস্টের মধ্যে ওপিয়াম বিলং করে। স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করার জন্য বহুত হ্যাপা পোয়াতে হয়। ফার্স্ট ইয়ার বলে গায়ে হাওয়া দিয়ে বেড়ালে চলবে না। অ্যাডভার্টাইজমেন্ট জোগাড়ের কাজগুলো তোকে দিয়ে করাব।’
‘আমি অ্যাড তুলতে বেরোব?’ কাঁদোকাঁদো গলায় বলে বৃন্দা। ‘আমাকে কেউ চেনে? না, আমি কাউকে চিনি?’
‘কাউকে চিনতে হবে না। রিপু তোকে ওষুধ কোম্পানির অ্যাড্রেস বলে দেবে। তুই গিয়ে মার্কেটিং ম্যানেজারের হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে আসবি। মিস আইএমএসকে দেখলে ওরা মাল্লু ছাড়তে বাধ্য।’
‘ভ্যাট!’ হেসে ফেলে বৃন্দা।
.
চন্দন
‘ওপিয়াম’! কলকাতার কলেজ ফেস্টিভাল সার্কিটের অন্যতম জনপ্রিয় নাম। গোটা শীতকাল জুড়ে বিভিন্ন কলেজে চলতে থাকে ‘ফেস্ট’। ইন্টার-কলেজ কম্পিটিশান আর গেস্ট পারফরম্যান্সের মোহে বিভিন্ন কলেজের ছেলেমেয়েরা হাজির হয় ফেস্টে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ফেস্ট ভীষণ জনপ্রিয়। ডিসেম্বরের শেষ তিনদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। রোজই বেশি রাতে অতিথি শিল্পীর অনুষ্ঠান থাকে। শেষ দিনে থাকে ‘বিশেষ’ গেস্ট পারফরম্যান্স। যাকে বলা হয়, ‘কালচারাল এক্সট্রাভ্যাগানজা’। ফেস্ট সার্কিটের ছেলেপুলেরা আদর করে বলে, ‘এক্সট্রা ভ্যাজাইনা’।
সিনিয়রদের মুখে চন্দন শুনেছে, অতীতে কলেজ ফেস্ট ছিল আয়তনে ছোট, কিন্তু ট্যালেন্টের বীজতলা। আজকের যত নামকরা সাংবাদিক, সম্পাদক, ফিল্ম মেকার, লেখক, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, মঞ্চ ও চিত্র জগতের অভিনেতা, বিজ্ঞাপন জগতের নামিদামি লোক—তারা সবাই বড় হয়েছেন ফেস্ট করে। বাংলা ব্যান্ডের প্রধান নামগুলির প্রতিটি সদস্য ফেস্ট সার্কিটে গান গাইতেন। তখন অনুষ্ঠানের রকম ছিল অন্য। একদিকে হতো গানের কম্পিটিশান। রবীন্দ্রসঙ্গীত আলাদা গুরুত্ব পেত। এ ছাড়া ইস্টার্ন সোলো, ওয়েস্টার্ন সোলো, ইস্টার্ন সেমি-ক্লাসিকাল, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল—এইরকম ভাগ থাকত। থাকত কোলাজ, এক্সটেমপোর স্পিচ, ‘জাস্ট আ মোমেন্ট’ বা ‘জ্যাম’, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, পেন্টিং, ক্যাপশান রাইটিং, ওয়ান অ্যাক্ট প্লে, একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতা। সবাইকে যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য থাকত ‘পারপেন্ডিকুলার রাউন্ড’ বা ‘পার্পস’। যেখানে বেলুন ফোলানো, পাঞ্জা-লড়া, অন্ত্যাক্ষরী এইসব হতো। ক্যুইজ, ডাম শ্যারাড, ক্যাও ক্যুইজ এবং ট্রেজার হান্ট ছিল স্টার অ্যাট্রাকশান। তখন স্পনসর ছিল কম। প্রাইজ মানি নগন্য। কলেজ স্টুডেন্টদের আগ্রহে ফেস্ট ফেটে পড়ত।
এখন পরিস্থিতি অন্য। কোল্ড ড্রিংক কোম্পানি, বাইক কোম্পানি, ইয়াং অ্যাডাল্ট ম্যাগাজিন, ইংরিজি কাগজের মেট্রো সেকশান—সবাই ফেস্ট স্পনসর করতে আগ্রহী। এখন টাকা জোগাড় করা সুলভ। ছাত্রছাত্রীদের ইনভলভমেন্ট কম। সবাই গিটার কাঁধে নিয়ে ঘোরে আর রক সঙ্গীত গায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কম্পিটিশান বাতিল হয়ে গেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাতিল, বাংলা সেমি-ক্লাসিকাল বাতিল, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল বাতিল। পেন্টিং, ক্রিয়েটিভ রাইটিং বাতিল। একাঙ্ক নাটক বাতিল। ওসব করার লোক পাওয়া যায় না। যা কিছু ভারনাকুলার, যা কিছু বাংলা—তা বাতিল। যা কিছু করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন, সময়ের প্রয়োজন—তা বাতিল। এখন খুব পপুলার প্রোগ্রাম হল ফোটোগ্রাফি কন্টেস্ট। টিনটিন একটা ভালো কথা বলেছে। ‘এক সময় শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ”এত কবি কেন?” তিনি বেঁচে থাকলে নতুন শতকে বলতেন, ”এত বাংলা ব্যান্ড কেন?” আর এই শতকের দ্বিতীয় দশকে বলতেন, ”এত ফোটোগ্রাফার কেন?” মোবাইল ফোনে ক্যামেরা আসার পরে, ডিজিট্যাল ক্যামেরা সস্তা হওয়ার পরে, ফোটো এডিটিং করা সহজ হওয়ার পরে—সব্বাই প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার।’
ফেস্ট অ্যাটেন্ড করা একদল ছেলেপুলে সব কলেজেই থাকে। এরা দিনরাত ক্যান্টিনে বসে ডাম শ্যারাড, অন্ত্যাক্ষরী আর জ্যাম প্র্যাকটিস করে। ক্যুইজ-পাগলারা দিনরাত বই, খবরের কাগজ আর কম্পিউটারে মাথা গুঁজে বসে থাকে। এদের বাদ দিলে ডেডিকেটেড ফেস্ট পাবলিকের সংখ্যা আগের থেকে কম। রাতের গেস্ট পারফরম্যান্স হাউসফুল হয়। সেগুলো মূলত বাংলা ব্যান্ড বা হিন্দি সিনেমার গানের অনুষ্ঠান।
বাৎসরিক তিনদিনের মোচ্ছব সফলভাবে উতরে দেওয়ার জন্য কলেজের একদল ছেলেমেয়ে বছরের ছ’মাস প্রাণপাত করে। কারণ এর সঙ্গে কলেজের সুনাম যুক্ত। ইউনিয়নের সম্মান যুক্ত। কালচারাল সেক্রেটারি ও জেনেরাল সেক্রেটারির সুনাম যুক্ত। টিনটিন আর রিপুর ‘ইজ্জত কা সওয়াল’ বলে কথা।
ওপিয়ামের মিটিং অ্যাটেন্ড করে চন্দন বুঝেছে, এই দক্ষযজ্ঞ কন্ডাক্ট করার জন্য দু’শ্রেণির ছেলে লাগে। একদল প্ল্যান করে। আর একদল ইমপ্লিমেন্ট করে। প্ল্যানিং-এর দায়িত্ব থাকে সিনিয়ররা। সেটা স্বাভাবিক, কেন না দু’তিনটে ফেস্ট হাতে কলমে উতরে না দিলে প্ল্যানার হওয়া যায় না। ইমপ্লিমেন্টেশান মানে গাধার খাটুনি। বিভিন্ন সাব-কমিটির সদস্য হয়ে, বুকে ব্যাজ লাগিয়ে দৌড়ে বেড়ান। এই কাজটা করে ফার্স্ট ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ার। তবে এখানে একটা সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা আছে। কলকাতার ছেলেমেয়েদের দেওয়া হয় রিসেপশানে সামলানোর কাজ, কম্পিটিশানের ‘এমসি’ বা ‘মাস্টার অব সেরিমনি’ হওয়ার কাজ, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব। কেন না তারা চৌখশ, স্ট্রিট-স্মার্ট, বাংলা ছাড়াও হিন্দি ও ইংরিজিতে পারদর্শী। মফস্বল ও গ্রামের ছেলেমেয়েরা হেঁসেল সামলায়, হিসেব রাখে, বাজার করে। তারা ব্যাকস্টেজ ওয়ার্কার।
ব্যাকস্টেজ ওয়ার্কার যদি হতে হয়, তাহলে এক নম্বর ব্যাকস্টেজ ওয়ার্কার হওয়াই ভালো। রিপুকে পটিয়ে পাটিয়ে একশো পঁচিশে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার ইনস্টল করিয়েছে চন্দন। সঙ্গে ইন্টারনেট কানেকশান আর প্রিন্টার-কপিয়ার-স্ক্যানার। ইউনিয়নের টাকায় কেনা ইউনিয়নের সম্পত্তি। স্যামিলটন ইস্কুলে একটা কম্পিউটার নিয়ে কুড়িজনের সঙ্গে মারামারি করতে হতো। সেই মেছো বাজারে প্রয়োজনীয় অপারেশানগুলো রপ্ত করে হাত পাকিয়েয়েছিল চন্দন। এই ডেস্কটপে নিয়মিত কাজ করে হাত সেট করে ফেলল। একদিন মিটিং-এর মধ্যে রিপুর হাতে তুলে দিল বিভিন্ন কমিটি ও সাবকমিটির ছেলেমেয়ের নাম ও মোবাইল নম্বর। কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া আছে, সেই দায়িত্ব কত তারিখের মধ্যে পালন করতে হবে, কাকে রিপোর্টিং করতে হবে, কাজে ফেইল করলে ‘প্ল্যান বি’ কী হবে।
দশ পাতার প্রিন্ট আউট দেখে রিপু হাঁ। সবার সামনে চন্দনের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘যা ফ্লো চার্ট বানিয়েছ গুরু, গাধারাও ফেস্ট উতরে দেবে।’
কালচারাল সেক্রেটারি টিনটিন কাজের ঢিলেঢালা গতি নিয়ে রোজ মিটিংয়ে সবাইকে খিস্তি করে। চন্দনের তৈরি করা ‘হাউ টু অর্গানাইজ আ ফেস্ট’ কর্মসূচী দেখে বলল, ‘এটা তুই নিজে বানালি? না নেট থেকে নামালি?’
‘নিজে বানালাম।’
‘এত ডিটেলে সবকিছু জানলি কী করে? এর আগে তো একটা ফেস্টও অ্যাটেন্ড করিসনি।’
‘ইউনিয়ন রুমে গত দশ বছরের ওপিয়ামের ফাইল জমিয়ে রাখা আছে। ধুলো ঝেড়ে ফাইলগুলো পড়ছিলাম। মিটিং-এর মিনিট পড়লে বোঝা যায় প্রতি বছর প্রবলেমের প্যার্টানগুলো এক। আমি সেই প্রবলেমগুলোকে অ্যাড্রেস করেছি।’
‘আমাকে এক কপি দে তো!’ চন্দনের দিকে হাত বাড়ায় টিনটিন। চন্দন বলে, ইউনিয়নের সব সদস্যদের আর ওপিয়ামের বিভিন্ন কমিটিতে যতজন সদস্য আছে, সবাইকে আমি এই অ্যাটাচমেন্টটা মেল করে দিয়েছি। নিজেরা ডাউনলোড করে প্রিন্ট নিও। এই প্রিন্টারের কার্ট্রিজে কালি কম আছে।’
‘আমাকে প্রিন্ট আউট দিবি না?’ ফুঁসে ওঠে টিনটিন। ‘ফার্স্ট ইয়ারের ছোকরা, আমার সঙ্গে রোয়াবি হচ্ছে?’
‘আহ! টিনটিন!’ রিপু থামায় কালচারাল সেক্রেটারিকে, ‘এখন বাওয়াল দেওয়ার সময় নয়। প্রিন্টারে সত্যিই কালি নেই। মিটিং-এর পরে আমরা এই প্রিন্ট আউট থেকে ফোটোকপি করে নেব। তুই এখন বল, প্রথম দিন গেস্ট পারফম্যান্স কাকে দিয়ে করাবি?’
‘প্রথম দিন কোনও বাংলা নাটক-ফাটক রাখো। কম পয়সায় উতরে যাবে।’ ক্যাজুয়ালি বলে টিনটিন।
‘না না। নাটকের লোকগুলো খুব ঢ্যাঁঠা হয়। স্টেজে উঠে ইমপ্রমচু অ্যান্টি-গভর্নমেন্ট কিছু বলে দিলে বাওয়াল হয়ে যাবে। অন্য কিছু ভাব।’ আপত্তি করে রিপু, ‘গ্রুপ থিয়েটারের লোকগুলো এখন ব্যাপক ঢ্যামনা হয়ে গেছে। কম টাকায় কাজ তো করবেই না, উলটে স্টারসুলভ ‘অ্যাটি’ দেখিয়ে ফেস্টে এসে সন্দীপ সামন্ত আর জনমোর্চাকে হাম্পু দিয়ে চলে যাবে। তখন অধীর হালদার জেলা কমিটিতে ডেকে প্যান্টুল খুলে নেবে।’
‘অধীর হালদার কে?’ জানতে চায় চন্দন।
‘তোর অত জানার কী দরকার?’ টিনটিন দাবড়ানি দেয় চন্দনকে। চন্দন বিরক্ত হয়ে বলে, ‘মিটিং-এর মধ্যে কোনও কথা বললে, সেটা এক্সপ্লেনও করতে হয়। যাক গে যাক। বাদ দাও। আমার একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না। কোনও নাটকের দল অ্যান্টি-গভর্নমেন্ট কথাবার্তা বললে আমাদের কী? আমরা কি গভর্নমেন্টের ঠিকাদারি নিয়ে রেখেছি নাকি?’
‘অ্যাই! তুই চুপ!’ চন্দনকে আবার শাসায় টিনটিন। রিপুকে বলে, ‘তাহলে আমি একটা ডিজে ধরে আনি। সস্তায় পুষ্টিকর। হাজার দশেক টাকায় নাচাগানা হয়ে যাবে।’
‘গুড! এই তো! আমাদের কালচারাল সেক্রেটারির মাথা খেলছে।’ টিনটিনের পিঠ চাপড়ে দেয় সুব্রত। বান্টি বলে, ‘সেকেন্ড ডে তে কী রাখবি? বাংলা ব্যান্ড?’
‘বাংলা ব্যান্ড শেষ দিনে। এখন ব্যান্ডগুলোর হেবি ভাও হয়েছে। লাখের নিচে কথা বলছে না কেউ।’ বিরিক্ত মুখে বলে টিনটিন, ‘ ”চন্দ্রভানু” এক লাখ পনেরো চাইছে। প্লাস এসি গাড়িতে যাতায়াত এবং যন্ত্রপাতির জন্য পিকআপ ভ্যান। ”জীবাশ্ম” বলছে দেড়লাখ। সব ইনক্লুসিভ। ‘ফণীমনসা’-র ফ্রন্টম্যান ডাক্তার। মেডিক্যাল কলেজের ফেস্টে ডাকলেই আসে। ছেলেটার প্রাণে মায়াদয়াও আছে। এক লাখে রাজি হয়েছে। তবে ওদের গ্রুপের মেম্বারদের মধ্যে এত ঝগড়া যে ডাকতে ভরসা হয় না। ”পিপুফিশু” আর ”আততায়ী”ও অনেক টাকা চাইছে।’
‘সঞ্চারী সেনকে ডাকলে হয় না?’ পরামর্শ দেয় চন্দন, ‘উনি খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। শুনেছি রেমুনারেশানও বেশি নয়।’
‘কলেজ ফেস্টে রবীন্দ্রসঙ্গীত? চাষাটাকে তাড়াও রিপুদা।’ শ্রাগ করে টিনটিন। ‘এর কথা শুনলে ভোটে হার গ্যারান্টিড।’
‘ওর কথা ছাড়। তুই বল।’ রিপু টিনটিনকে বলে।
‘আমার মনে হয় সেকেন্ড ডে-তে ফ্যাশন শো করা যেতে পারে। আমাদের বন্ডেল রোডে ”ওম” নামের একটা বুটিক খুলেছে। ওরা শুধু কলেজ স্টুডেন্টদের ক্যাটার করে। বোথ বয়েজ অ্যান্ড গার্লস। জামা-কাপড়, অ্যাক্সেসারি, এনার্জি ড্রিংক, বই, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ঠেক। ওদের বললে কম খরচে একটা শো নামিয়ে দেবে।’ মতামত জানায় টিনটিন। সুব্রত আর আর বান্টি টিনটিনের পিঠ চাপড়ে বলে, ‘ব্রাভো গুরু! হেব্বি আইডিয়া।’ রিপু চন্দনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী রে? আইডিয়াটা কেমন?’
‘আমি চাষার ছেলে। ফ্যাশান এখনো বুঝি না। তবে এইটা বুঝি যে একটা কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপন করার জন্য ওপিয়ামের স্টেজ ব্যবহার করবে। সেক্ষেত্রে আমরা কোনও টাকা দেব না। কম বা বেশি কোনো খরচই আমরা করব না। খরচ করবে ওম।’ চন্দন ঠান্ডা মাথায় বক্তব্য রাখে।
তার কথার প্রতিক্রিয়ায় বান্টি বলে, ”ফ্যাশান এখনও বুঝি না’ কথাটার মানে কী? ”এখনও” বলতে কী বোঝাচ্ছিস?’
‘সব জিনিস শিখতে সময় লাগে। আমি গ্রামের ছেলে। মাজরা পোকা বুঝি। ইউরিয়া বুঝি। ”ওস্তাদ” বিষ বুঝি। শ্যালো বুঝি। ওটা তোমরা বোঝো না। আমাদের বাড়িতে বছর খানেক থাকলেই বুঝবে। তেমনই, আমি বছর খানেক কলকাতায় থাকলেই ফ্যাশন বুঝব। সোজা কথা।’ ফতুয়ার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে টিনটিনকে অফার করে চন্দন, ‘খাও। রাগ কোরো না।’
টিনটিনের মুখ লাল। রাগে সে এবার ফেটে পড়বে। সিগারেট না নিয়ে বলল, ‘তোর কী মনে হয়? আমি কাট মানি খাব?’
‘আমার তা মনে হয় না,’ সিগারেট ধরিয়ে বলে চন্দন, ‘আমার মনে হয় সাপ্লাই-ডিম্যান্ডের তত্ত্বটা তুমি বুঝতে পারোনি। ওমের মালিককে বলো যে, ”এক ঘণ্টার জন্য ওপিয়ামের স্টেজ দেব। আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। তুই এলে আয়। আমাদের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশানসে রাজি না হলে, ওমের বদলে বোম, লোম বা যম আসবে।” দেখো, ঠিক রাজি হয়ে যাবে।’
‘তা হলে সেকেন্ড ডে-তে ফ্যাশন শো ফাইনাল।’ চন্দনকে থামায় রিপু, ‘টিনটিন, তুই ওমের মালিকের সঙ্গে কথা বল। পঞ্চাশ হাজার না হলেও চলবে। তিরিশের নীচে নামিস না। থার্ড ডেতে কাকে ডাকছিস বল।’
‘কলকাতার প্রধান পাঁচটা রকব্যান্ড গত পাঁচ বছরে পারফর্ম করেছে। চন্দ্রভানু, জীবাশ্ম, ফণীমনসা, পিপুফিশু, আততায়ী—সব্বাই। এবার নতুন কাউকে ডাকব? না ওদেরই?’ বান্টি আর সুব্রতর মতামত চায় টিনটিন।
তারা কিছু বলার আগে চন্দন বলে, ‘মাটি নামে যে ফোক ব্যান্ড আছে, ওদের ডাকো না।’
‘ফোক সঙের তুই কী বুঝিস?’ টিনটিন দাবড়ানি দেয় চন্দনকে।
‘তোমার থেকে বেশি বুঝি। বাউল, দরবেশ, সুফি, ভাটিয়ালি, আগমনী গান এখনও গ্রামে শোনা যায়। তোমরা যা সিডিতে শোনো, আমরা, চাষারা সেটা লাইভ শুনি। দোতারা বা গুপিযন্ত্র বা খঞ্জনি বাজিয়ে যে গান গাওয়া হয়, সেই গানকে ধুমধাড়াক্কা বাজনার সঙ্গে মিশিয়ে চচ্চড়ি বানিয়ে ”মাটি” তোমাদের শোনাচ্ছে। পাবলিক ভালোই খাচ্ছে। ‘মাটিকে ডাকো।’ রিপুর দিকে তাকিয়ে বলে চন্দন।
‘আইডিয়াটা খারাপ নয়।’ রিপু টিনটিনকে বলে, ‘মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ আমাদের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকে। আমার সঙ্গে আলাপ নেই। এই সুযোগে আলাপটা করলে হয়।’
টিনটিন মাথা নিচু করে ভাবছিল। টুকটুক করে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘তুমি তাহলে ওদের সঙ্গে কথা বলো। আমিও ”আরবান স্কাউন্ড্রেল”দের সঙ্গে কথা বলছি। ওরা পাঁচ বছর আগে লাস্ট এসেছিল। নতুনরা ওদের পারফরম্যান্স দেখেনি। যে কম টাকায় রাজি হবে তাকে ডাকা হবে।’
‘ঠিক হ্যায়! তাহলে এখন মিটিং শেষ। কাল আবার আমরা রাত দশটার সময়ে এখানে মিট করছি।’ খাট থেকে উঠে বলে রিপু।
চন্দন বলে, ‘কালকের মিটিং-টা অন্য ঘরে করো। ফেস্টের পরেই আমাদের ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষা। এখন থেকে পড়তে না বসলে ফেল করব।’
‘ওকে ওকে!’ সহৃদয় গলায় বলে রিপু, ‘কালকের মিটিংটা টিনটিনের ঘরে হবে। একশো চব্বিশ।’
টিনটিন রাগত চোখে চন্দনকে মাপল। অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, ‘আচ্ছা।’ তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। টিনটিনের সঙ্গে বেরিয়ে গেল বান্টি, সুব্রত এবং বাকিরা। ঘরে এখন রিপু আর চন্দন। ফিকফিক করে হেসে রিপু বলল, ‘তুই শালা খুব হারামি আছিস।’
‘ঠিক বলেছ।’ হাই তুলে বলল চন্দন।
‘অ্যাঁ? তুই জানিস যে তুই হারামি?’ রিপু অবাক।
‘জানি।’ বারমুডার ওপরে প্যান্ট গলাচ্ছে চন্দন। ‘কতটা হারামি এটা এখনও জানি না।’
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘লেডি আর্চার্স হোস্টেলে।’
‘এত রাতে?’
‘বৃন্দার কাছ থেকে কতগুলো নোটস নেব। গতকাল আর আজ ফিজিওলজির থিয়োরি ক্লাস করিনি। পার্বতী ম্যাডাম দু’দিনে অ্যানিমিয়ার ক্লাসিফিকেশান পড়িয়ে দিয়েছেন। সবাই বলছে, ওটা ম্যাডামের ফেভারিট চ্যাপ্টার। ভাইভায় ধরবেই।’
‘অ্যানিমিয়া বুঝতে সারা জীবন লাগে। দু’দিনের নোটস পড়ে ঘোড়ার ডিম বুঝবি। আমার বক্তব্য সেটা নয়। নোটসটাই আসল উদ্দেশ্য, না বৃন্দার সঙ্গে ঝাড়ি মারার প্ল্যান করছিস?’
‘বামনের চন্দ্রভিলাষ কি খারাপ?’
‘উরিততারা! কী টাফ বাংলা বলছিস মাইরি!’ হাসতে হাসতে কানে আইপডের ইয়ারপড গোঁজে রিপু। শার্ট গলিয়ে চন্দন একশো পঁচিশ থেকে বেরোয়। বয়েজ হোস্টেলের চারতলা থেকে তরতরিয়ে নেমে, অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং আর এলএলটির মাঝখানের গলতা দিয়ে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গেটে পৌঁছয়। সবুজ গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ফুলমতিয়াকে বলে, ‘রুম নাম্বার থার্টিনের বৃন্দাকে বলো, চন্দন এসেছে।’
ফুলমতিয়ার বেশ ডাঁটো চেহারা। উত্তর ভারতীয়দের কায়দায় ডানদিকে শাড়ির আঁচল। শাড়ির ঝুল হাঁটু আর গোড়ালির মাঝামাঝি। পায়ে রূপোর মল পরা। কপালে আর চিবুকে উল্কি করা। দু’হাত ভরতি সিটি গোল্ডের চুড়ি। চোখের পাতায় মোটা করে কাজল ল্যাপা। মাথার চুল দু’বিনুনি করে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। কুটকুট করে পানমশলা চিবোতে চিবোতে বছর চল্লিশের ফুলমতিয়া বলল, ‘দিনের বেলা দরকার মিটাতে পারো না? সব দরকার রাতে?’
‘সব দরকার না। একটাই দরকার। তুমি ডেকে দাও।’ সিগারেট ধরিয়ে বলে চন্দন।
ঠোঁট উল্টে ফুলমতিয়া বলে, ‘সে তেরো নম্বরে পার্টি করছে। ওই চুড়েইল ঘরের দিকে আমি যাব না। তুমি মোবাইলে ডেকে নাও।’
বিরক্ত হয়ে চন্দন বলে, ‘ওফ! ভূত ভূত করেই তোমরা গেলে।’ তারপর বৃন্দাকে ফোন করল। দু-তিনবার রিং হওয়ার পরে বৃন্দা ধরে বলল, ‘বল।’
‘আমি গেস্টরুমে। তুই আজকের ফিজিয়োলজির ক্লাস নোটস নিয়ে একবার নীচে আয়।’
‘উফফ! আমি এখন নামতে পারব না। আমাদের রুমে এক্ষুনি পাজামা পার্টি শুরু হবে।’
‘কী পার্টি?’
‘পাজামা পার্টি। এটা একটা অল গার্লস পার্টি। ছেলেরা নট অ্যালাওড। আমরা সাজুগুজু না করে ক্যাজ থাকি।’
‘শালা, নতুনগ্রাম থেকে কলকাতায় না এলে জানতেই পারতাম না যে পাজামা পার্টি নামে এক ধরনের পার্টি হয়।’
‘ধুস! ওটা একটা নাম। দিতে হয় তাই দেওয়া। রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার আগে আমি, দিঠি, সাবিনা, জেমসি, শ্রীপর্ণা আর আপ্পুদি মিলে ভদকা খাব।’
‘তোরা মদ খাবি? মদ তো বাজে মেয়েরা খায়!’
‘বাজে মেয়ে মদ খায়। আমি থাকি ভদকায়,’ ছড়া কেটে খিকখিক করে হাসে বৃন্দা। বলে, ‘তুই মোবাইলে আর বকাস না। আমি আসছি।’
লাইন কেটে দিল বৃন্দা। দু’মিনিটের মধ্যে নেমে এসে বলল, ‘গেস্টরুমে আয়। ভালোই ঠান্ডা পড়েছে।’
ডিসেম্বর মাসের আজ ছ’তারিখ। সোমবার। এখনও শীত পড়েনি। বৃন্দা জিনস আর টপের ওপরে একটা সুতির চাদর জড়িয়ে আছে। চাদর থেকে লেবুলেবু গন্ধ আসছে। এই গন্ধটা পেলে চন্দন নিজেকে আর সামলাতে পারে না। দু’দিকে দু’হাত ছড়িয়ে শাহরুখ খানের কায়দায় ছুটতে ইচ্ছে করে। ম্যানহ্যাটানের রাস্তা দিয়ে স্লো-মো দৌড়ের শেষে প্রীতি জিন্টা দাঁড়িয়ে রয়েছে। গালে টোল ফেলা হাসি।
বৃন্দা গালে টোল ফেলে হাসল। বলল, ‘পিএমের ক্লাসে এলি না কেন? প্রবাল তোর প্রক্সি দিয়েছে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’
‘ফিজিওলজি আমি ম্যানেজ করে ফেলব। বায়োকেমিস্ট্রিও। কিন্তু অ্যানাটমিটা কিছুতেই সামলাতে পারছি না। নাম মুখস্থ করতে করতে জান কয়লা হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস বাঙ্ক করে অ্যানাটমি পড়ছিলাম।’ সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলে চন্দন।
‘ওই করতে গিয়ে শেষে ফিজিওলজিতেই সাপ্লি খাবি। এই নে, তোর নোটস।’
একতাড়া কাগজ নিয়ে চন্দন বলে, ‘তুই হোস্টেলে থাকা কবে থেকে শুরু করলি?’
‘গত সপ্তাহ থেকে। আপ্পুদি একদিন ধরে বেঁধে এনে আমাকে আর দিঠিকে একটা করে বেড অ্যালট করে দিল। রুম নাম্বার থার্টিন। আনলাকি রুম। ওই ঘরেই নাকি লেডি আর্চার মার্ডার হয়েছিলেন। মেমপেত্নীর ভয়ে ওই ঘরে কেউ থাকে না।’ নিকোটিনের গন্ধওয়ালা ধোঁয়া নাক থেকে তাড়িয়ে বলে বৃন্দা।
‘তোর ভয় করল না?’ লেবুগন্ধের অক্সিজেন নাকে টেনে প্রশ্ন করে চন্দন।
‘আমি শুধু সোমবার রাতগুলোয় থাকছি। টোকেন প্রেজেন্স। মঙ্গলবার সকালের বায়োকেমিস্ট্রি থিয়োরি ক্লাসটা ন’টা থেকে। ওটা মিস করলে আরতি ম্যাডাম বিশাল ঝামেলা করে। তাছাড়া আপ্পুদি ওপিয়ামের জন্য অ্যাড তোলার দায়িত্ব দিয়েছে। মিডিয়া পার্টনারও জোগাড় করতে হচ্ছে। এইগুলো সোমবার সেকেন্ড হাফে করছি। হোস্টেলে থাকার জন্য অজুহাত লাগে তো! এগুলো আসলে অজুহাত।’ চন্দনের হাত ধরে টেনে গেস্টরুমে ঢোকায় বৃন্দা, ‘ভেতরে আয়, বাইরে হিম পড়ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে।’
‘ভ্যাট! ঠান্ডার নামগন্ধ নেই। তুই খুব শীতকাতুরে আছিস মাইরি।’ সোফায় বসে বলে চন্দন। এদিক ওদিক দেখে পোড়া ফিল্টার ছুঁড়ে মারে গেস্টরুমের কোণে।
‘তা আছি।’ সামনের সোফায় গুটিশুটি মেরে বসে বলে বৃন্দা।
‘অ্যাড তুলতে কোথায় কোথায় গেলি?’
‘মিডিয়া পার্টনার জোগাড় করতে খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলের অফিসে যাওয়াটা খুব ইন্টারেস্টিং। অনেক সেলিব্রিটি দেখা যায়। অ্যাড তুলতে ওষুধ কোম্পানিতে যাওয়াটা বোরিং। মার্কেটিং ম্যানেজারগুলো খুব ঢ্যাঁটা হয়। আমাদের অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখে।’
ছদ্ম বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকে চন্দন বলল, ”আমরা” মানে? তোর সঙ্গে আর কে থাকছে?’
‘অনেকগুলো টিম আছে তো! একেক সপ্তাহে একেক জন থাকছে। কোনওদিন প্রবাল, কোনওদিন দীপ, কোনওদিন সঞ্জয়, কোনওদিন সবুজ, কোনওদিন অভি। টিমগুলো এমন করে বানানো হয়েছে যাতে প্রতি টিমে একটা একটা ছেলে আর মেয়ে থাকে।’
‘আমাকে তো কেউ বলেনি!’ এখনও ভুরু কুঁচকে আছে চন্দনের।
বৃন্দা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘তোকে বলেনি, কেন না তোকে অন্য টিমে রেখেছে। তুই যেতে চাস? সেটা আগে বলিসনি কেন?’
‘কাকে বলব?’ মিচকে হেসে বলে চন্দন।
‘কেন? আমাকে!’
‘তুই কাকে বলবি?’
‘কেন রিপুদাকে?’
‘রিপুদা কাকে বলবে?’
‘শুনেছি টিনটিন আর চন্দন মিলে সাব কমিটিগুলো বানিয়েছে…’ বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়ে বৃন্দা, ‘আয়্যাম সরি রে। কী বোকার মতো কথা বলছি।’
দু’জনেই চুপচাপ। গেস্টরুমের দেওয়ালের পে-ফোনের বাক্সে নীরবে তাকিয়ে রয়েছে দু’জনের দিকে। হোস্টেলের ভিতর থেকে মেয়েদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে না। ফুলমতিয়া একবার উঁকি মেরে বলে গেল, ‘আমি এন্টালি থেকে মোমো আনতে যাচ্ছি। তোমাকে ওরা ডাকছে।’
বৃন্দা ফুলমতিয়াকে পাত্তা দিল না। ফাঁকা ঘরে এখন চন্দন আর বৃন্দা। আর দেওয়াল ঘড়ির ঘড়ির টকটক শব্দ।
মেঝের দিকে তাকিয়ে চন্দন বলল, ‘বৃন্দা…’
বৃন্দা বলল, ‘না।’
‘কী ”না”? আমি কিছু বলব না? না, আমি যা বলব, তার উত্তর ”না”?’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলে চন্দন। সে সাহস করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। গোড়াতেই তাকে থামিয়ে দিয়েছে বৃন্দা।
‘আপাতত প্রথমটা। তুই এখন হোস্টেলে যা। অনেক রাত হল।’ শালমুড়ি দিয়ে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে যায় বৃন্দা। তেরো নম্বর ঘরে ঢুকে দেখে, জেমসি ভদকার সঙ্গে লাইম কর্ডিয়াল মেশাচ্ছে। দময়ন্তীর খাটে বসে আপ্পু, সাবিনা, আর দময়ন্তী। তার খাটে বসে শ্রীপর্ণা আর জেমসি। নিজের খাটে না বসে, মেঝেতে পাতা মাদুরে বসে কোলের কাছে একটা বেঁটে টেবিল রেখে বৃন্দা বলে, ‘মোমো কই?’
জেমসি বলল, ‘ফুলমতিয়া আনছে।’
তেরো নম্বর ঘরটা ফুলমতিয়া ঝকঝকে করে দিয়েছে। ধুলো, ঝুল, নোংরা —সব উধাও। বৃন্দা গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে চারটে সিএফএল বাতি লাগিয়েছে। এত বড় ঘরে দুটো টিউবলাইট যথেষ্ট নয়। একগাদা ফুলগাছের টব নিয়ে এসেছে। দময়ন্তী বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে বাহারি ল্যাম্পশেড, বেডশিট, বেডকভার, বালিশ আর পাশবালিশের ওয়াড়, একগাদা ওয়াল হ্যাঙ্গিং, মুখোশ, ছবির প্রিন্ট, মাদুর আর দড়ি। জানলার পর্দা দোকান থেকে বানিয়ে নিয়েছে। ঘর সাজাতে সাজাতে বৃন্দা আর দময়ন্তীর মধ্যে চমৎকার সখ্য গড়ে উঠেছে।
তেরো নম্বর ঘরটা দেখতে হয়েছে চমৎকার। দেওয়ালের রং অফ হোয়াইট। বিছানার চাদরে আর বালিশের ওয়াড়ে কচি কলাপাতা সবুজ আর সর্ষে খেতের হলুদ রঙের মেলামেশা। পর্দাতে জলপাই সবুজ আর গেরুয়ার কম্বিনেশান। ল্যাম্পশেডের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহারে জোনাল লাইটিং ফুটে উঠেছে চমৎকার। তেরো নম্বরে ভূত থাকলেও সে খুব নরম সরম, মিষ্টি ভূত হবে।
জেমসি সবার হাতে গ্লাস ধরালো। বৃন্দা গ্লাস মুখে ঠেকিয়ে বলল, ‘মিষ্টি মিষ্টি খেতে।’
জেমসি হাত থেকে গ্লাস কেড়ে নিয়ে বলল, ‘দারু পিনার এটিকেট জানিস না? সবাই হাতে গ্লাস নেবে। ফের চিয়ার্স হবে। ফের দারু খাওয়া হবে।’
‘দারু খাবে না পিবে?’ খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে সাবিনা।
জেমসি বলে, ‘সরি সরি! বঙ্গালি লোগ সবকুছ খাতা হ্যায়। সিগারেট ভি খাতা হ্যায়, পানি ভি খাতা হ্যায়। চিয়ার্স বেবিলোগ! হ্যাপি হাউস ওয়ার্মিং পার্টি!’
‘চল চল, ফার্স্ট পেগ তাড়াতাড়ি শেষ কর। পরেরগুলো আস্তে আস্তে খাস।’ তাড়া দেয় আপ্পু, ‘ফুলমতিয়া মোমো নিয়ে আসছে।’
‘জীবনদার ক্যান্টিনের মোমো নয় তো? ওগুলো টেরিবলি ব্যাড।’ শ্রীপর্ণা ঢক করে চুমুক দিয়ে বলে।
‘না। আমাদের বাড়ি যাওয়ার পথে, জেম সিনেমার উলটো দিকে একটা রেস্তোরাঁ আছে। নাম ”রোম্যানো স্যান্টোস”। চিনে আর তিব্বতি খাবারের কোয়ালিটি বেশ ভালো। আমি অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। ফুলমতিয়া আনতে গেছে।’ জানায় দময়ন্তী।
‘আই লাভ স্টিমড মোমো।’ গেলাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বলে জেমসি। তার কথার মধ্যে ফুলমতিয়া ঢোকে। অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া মোমো আর প্লাস্টিকের পাউচে ভরা স্যুপ টেবিলে রেখে আপ্পুকে বলে, ‘আমার কোটা?’
‘জেমসি, ফুলমতিয়াকে এক গেলাস দে।’ হুকুম করে আপ্পু। বৃন্দা সবার আগে গ্লাস মুখে দিয়ে পান করার অভিনয় করেছিল। সবার সঙ্গে চিয়ার্স করার পরেও একবিন্দু মুখে ঢালেনি। বাড়িতে মদ্যপ স্যামিকে দেখে দেখে তার অ্যালকোহলের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে। সেটা এখানে এক্সপ্রেস করা যাবে না। তার থেকে অভিনয় বেটার। মোমো নিতে নিতে গ্লাসের ভদকা সে বেঁটে টেবিলের নীচে রাখা গাছের টবে ঢেলে দিল। খাটে না বসে এই কারণেই সে মাদুরে বসেছে। নাইন ও’ক্লকের টবটা আগে থেকেই টেবিলের তলায় রেখে দিয়েছিল। এক পেগের অভিনয় করতে পারলেই যথেষ্ট। একটু বাদেই এরা সবাই মাতাল হয়ে যাবে।
জেমসি গোয়ার গল্প বলছে। শোনার অভিনয় করতে করতে বৃন্দা ভাবল, চন্দন প্রোপোজ করতে চায়না কি? কী জানি বাবা! স্কুল জীবন থেকেই ছেলেদের অ্যাডমিরেশান পেয়ে অভ্যস্ত বৃন্দা। ক্লাসমেটের বাবাদের দৃষ্টিতে অপত্য স্নেহের বাইরে অন্যরকম অনুভূতি ছায়া ফেলত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তাকে প্রোপোজ করেনি। নিজেকে নিয়ে বেশ গর্ব হল বৃন্দার। পাশাপাশি চন্দনকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে সে খুশি। প্রেম-ফ্রেম প্রচুর চাপের জিনিস। এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে না।
.
ফাঁকা গেস্টরুমে চন্দন অনেকক্ষণ একা একা বসে থাকে। তার উল্টোদিকে ব্যাথাহত মুখে এসে বসেন শাহরুখ খান। হিরোর কাঁধ এখন ঝোঁকানো। হিরোর চোখের কোণে অশ্রু। শাহরুখকে গেস্টরুমে বসিয়ে রেখে চন্দন বেরোয়। হনহন করে বয়েজ হোস্টেলের দিকে হাঁটতে থাকে। ‘না’ শব্দটি তার মাথায় দমাস দমাস করে হাতুড়ি মারছে। পরাজয় তার পছন্দ নয়। রাগের চোটে মাথা কাজ করছে না। আক্রোশবশত আবার সিগারেট ধরায় সে।
.
দময়ন্তী
ড্যানিয়েল সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে যাবেন। শক্তিরূপা স্কুপ চ্যানেলের ডিজাইনার আড্ডায় যাবেন। একত্রিশে ডিসেম্বরের রাতে দময়ন্তী গোলমহলের গোলঘরে একা বসে ভ্যারেন্ডা ভাজবে? অসম্ভব! বিকেলবেলা এই নিয়ে ড্যানিয়েল-শক্তিরূপার সঙ্গে দময়ন্তীর ঝগড়া হয়ে গেল।
ড্যানিয়েল বললেন, ‘আমি তো সাড়ে বারোটার মধ্যে চলে আসব।’
শক্তিরূপা বললেন, ‘আমিও তাই।’
দময়ন্তী কী করে দুজনকে বোঝায় যে, ওঁরা রাত আটটার মধ্যে বেরিয়ে যাবেন। রাত আটটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একা বাড়িতে কাটানো যায়? তাও বর্ষশেষের রাতে? এবং ওপিয়ামের তৃতীয় এবং অন্তিম রাতে। যখন সেন্ট্রাল হলে কালচারাল এক্সট্রাভ্যাগানজাতে ‘মাটি’ পারফর্ম করছে?
ড্যানিয়েল সাজেশন দিয়েছিলেন, ‘সিনেমা দেখে আয়!’
খারাপ সাজেশান নয়। বছরের শেষদিন শুক্রবার পড়েছে। কিন্তু আজকে কুচ্ছিত দুটো সিনেমা রিলিজ করেছে। একটার নাম ‘আদা…এ ওয়ে অব লাইফ।’ অন্যটার নাম ‘ভূত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস।’
প্রথমটায় আছে নওহিদ সাইরুশি, আয়েষা ঝুলকা আর রাহুল রায়। দ্বিতীয়টা জ্যাকি শ্রফ আর অশ্বিন মুশরান। এসব ছবি দেখা যায়? রাহুল রায় দময়ন্তীর জন্মের কাছাকাছি সময়ে ‘আশিকি’ নামে একটা সিনেমা করেছিলেন। অনু আগরওয়াল হিরোইন ছিলেন। গানের জন্য সিনেমাটা হিট করে। ইউটিউবে গানগুলো দেখেছে দময়ন্তী। সিনেমাটা জাস্ট নিতে পারেনি। সেই রাহুল রায়ের আর একটা সিনেমা? ইইইকস!
আয়েষা ঝুলকাও অতীতের ফ্লপ হিরোইন। নওহিদ মেয়েটা টিভির ভিডিয়ো জকি। জ্যাকি শ্রফের চোখের নীচে অ্যালকোহলের পাউচ ব্যাঙের মতো ফোলা। এত বড় একটা বিয়ার বেলি। ছ্যা ছ্যা! এদের ছবি দেখার কথা ভাবা মানেও পাপ।
‘টুনপুর কা সুপারহিরো’ চলছে, ‘তিস মার খান’ চলছে, ‘নো প্রবলেম’ চলছে, ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ চলছে।
‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ নিয়ে দময়ন্তীর আগ্রহ আছে। রণবীর সিংহ নামে একটা নতুন হিরো আর অনুষ্কা শর্মা নামে একটা নতুন হিরোইন আছে। প্লাস যশরাজ প্রোডাকশানের ছবি। খুব ঝোলাবে না। কিন্তু তার মন টানছে ওপিয়াম। মন টানছে ‘মাটি’। বৃন্দাও আজ লেডি আর্চার্স হোস্টেলে থাকবে। ওয়াইন খেয়ে মাটির পারফরম্যান্সের সময় নাচানাচি করে হোস্টেলে থেকে যাওয়ার প্ল্যান আছে। এত কথা বাবা-মাকে বলা যায়?
এবারের ওপিয়ামের সাফল্য চমকপ্রদ। শুধু আইএমসির ছেলেমেয়েরা নয়, অন্য কলেজের ছেলেমেয়েরাও এই কথা বলছে। এবং তার একমাত্র কারণ অজস্র কলেজের ছেলেমেয়েদের পার্টিসিপেশান। কলকাতার প্রধান সবকটা কলেজ তো এসেইছে, মফস্বল এবং জেলার কলেজও যোগ দিয়েছে। শিলচর, জামশেদপুর, বোকারো, পটনা, ভুবনেশ্বরের কয়েকটা কলেজও এসেছে। ছেলেমেয়েরা টিনটিনের পিঠ চাপড়াচ্ছে। কিন্তু গোটা ফার্স্ট ইয়ার জানে, এর পুরো ক্রেডিট চন্দনের। নেট থেকে সমস্ত কলেজের মেল আইডি জোগাড় করে চন্দন আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিল। বয়েজ আর গার্লস হোস্টেলের একটা উইং খালি করে, সেখানে দূর থেকে আসা ছেলেমেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। খাওয়ানোর দায়িত্ব হোস্টেলের ক্যান্টিনকে না দিয়ে, তুলে দিয়েছে শিয়ালদার নামকরা কেটারিং কোম্পানির মালিক উৎপল বারিকের হাতে। অন্য রাজ্য থেকে আসা ছেলেমেয়েরা ভীষণ খুশি। প্রত্যেকে বলেছে সামনের বছর আবার আসবে। অন্য কলেজকেও নিয়ে আসবে।
জমাট কম্পিটিশান হয়েছে। অন্যান্যবার কলকাতার কলেজগুলোই ফার্স্ট সেকেন্ডের প্রাইজ নিয়ে যায়। এবার অসম আর ঝাড়খণ্ডের কলেজ অনেক প্রাইজ পেয়েছে। সেই তুলনায় পশ্চিমবাংলার জেলার কলেজের পারফরম্যান্স বেশ খারাপ।
প্রথমদিন গেস্ট পারফরমার হিসেবে সন্ধেবেলা এসেছিল কলকাতার এক নম্বর ডিজে ‘পয়জন’। লো-রাইজ জিনস আর হাতকাটা লেদার জ্যাকেট, মাথার বেগনি রঙের চুলে মো—হক করা, হাতের দশ আঙুলে কুড়িটা আঙটি, দু’কানে ছ’টা দুল, ভুরুতে দুল, গা ভরতি ট্যাটু—আক্ষরিক অর্থেই ‘বিষ’ জিনিস! তবে নিজের কাজটি ভালো বোঝে। রাত আটটার সময় সেন্ট্রাল হলে কিশোর কুমারের গান দিয়ে শুরু করল। সেন্ট্রাল হলে তখন কেউ নেই। পুরনো দিনের গান শুনতে টুকটুক করে জড়ো হল ছেলেমেয়ের পাল। পয়জন তখন কুমার শানু-অলকা যাগ্নিক জুটির হিট গান চালাচ্ছে। রাত ন’টা থেকে সে আইটেম নাম্বারে শিফট করল। ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে ফ্লেভার্ড ভদকার বোতল। শুরু হল উদ্দাম নাচ। সাইকেডেলিক আলোর খেলার সঙ্গে সঙ্গে গান বদলাল। এল ব্রিটনি, শাকিরা, রিহানা, ম্যাডোনা। রাত বারোটায় পয়জন যখন অনুষ্ঠান শেষ করল তখন সেন্ট্রাল হল জুড়ে নাচতে থাকা ছেলেমেয়েদের শরীরে আর কোনও এনার্জি নেই। রিপু, টিনটিন আর চন্দন পিছনে বসে পুরো অনুষ্ঠানটা দেখেছে। পয়জনের হাতে চল্লিশ হাজার টাকার চেক তুলে দিয়ে টিনটিন বলল, ‘থ্যাংকস।’
দ্বিতীয় রাতে ছিল জমজমাট ‘ফ্যাশান শো ফর কলেজ-গোইং গাইজ অ্যান্ড গার্লস’। আয়োজনে ‘ওম’। রাত আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত রোগা এবং স্বল্পবসনা মেয়ে আর মাসল ফোলানো ছেলেরা একটানা হাঁটাহাঁটি করে দেখিয়েছে ফান টি-শার্ট, জিনস, লেগিংস, সারং, গয়না, ব্যাগ, ন্যাপস্যাক, ব্যাকপ্যাক, সানগ্লাস, চপ্পল, ফ্লোটার্স, ফ্লিপফ্লপ, শু। ফ্যাশন শোয়ের পরে রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে ওমের মেক শিফট স্টল থেকে দেড় লাখ টাকার মাল বিক্রি হয়েছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক টিনটিনের হাতে ধরিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে ওমের মালিক।
আজ মাটির পারফরম্যান্স। একলাখ টাকা চেয়েছিল মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ। এক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকার সুবাদে রিপু কুড়ি হাজার টাকা কমিয়েছে। সব মিলিয়ে এই বছরে ওপিয়ামের জন্য ইউনিয়নের খরচ বেড়েছে। কিন্তু ইংরিজি খবরের কাগজের পেজ থ্রি থেকে টিন ম্যাগাজিনের ওয়েব পোর্টাল, টিভির চুটকি খবর থেকে ফেসবুক—সব জায়গায় ওপিয়ামকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেকে বলছে, ওপিয়াম এই মুহূর্তে কলকাতার সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস কলেজ ফেস্ট।
এমন অনুষ্ঠানের কার্টেন কল জবরদস্ত হওয়ার কথা। মাটি পারফর্ম করার ফলে হাইপ আরও বেড়ে গেল। এমন অনুষ্ঠানে দময়ন্তী থাকবে না, এ কখনও হতে পারে? দিল্লির স্কুলে সে অনেক ফেস্ট অ্যাটেন্ড করেছে। সেখানে মূলত ইন্ডিপপ বা হিন্দি-রক চলে। বাংলা ফোক-ফিউশন সে কখনও শোনেনি। আজ একটু গাঁজা টানলে মন্দ হয় না।
কলেজ থেকে তিনটের সময় বাড়ি ফিরে এসে গোলঘরে একপ্রস্ত ঘুমিয়ে নিল দময়ন্তী। উঠল সাড়ে পাঁচটার সময়। দোতলার স্টুডিওয় বসে ড্যানিয়েল ‘মায়ার খেলা’ শুনছেন। শক্তিরূপা এখনও অফিস থেকে ফেরেননি। ওঁদের কথা মাথা থেকে উড়িয়ে দময়ন্তী আলমারি খুলে ভাবতে বসল। এটা-ওটা-সেটা নাড়াচাড়া করে কিছুই পছন্দ হল না। ধন্দের সময় গোল্ডেন রুল হল, ‘হোয়েন ইন কনফিউশান, ওয়্যার ব্ল্যাক’। কালো পোশাক গ্রেসফুল, শরীরের হাজারটা খুঁত ঢাকে, শীতকালের পক্ষে আইডিয়াল। ব্ল্যাক টাইটসের সঙ্গে কালো গোলগলা ফুলস্লিভ সোয়েটার পরল। সঙ্গে লাল-টুকটুকে চওড়া বেল্ট আর লাল-কালো কনভার্স শু। ঠোঁট না চোখ—কোনটা হাইলাইট করবে, এটা ভাবতে সময় লাগল। আবশেষে ঠোঁট ন্যুড লিপস্টিক বুলিয়ে, চোখে গাঢ় করে কাজল বোলাল। চুলে পনিটেল করে লাল হেয়ারব্যান্ড বাঁধল। ব্যস! আর কিছুর দরকার নেই। একটা ন্যাপস্যাক নিয়ে, ড্যানিয়েলকে টাটা করে, লাল টুকটুকে হুডি গলিয়ে গোলমহল থেকে বেরোল। আজ জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে।
কলেজে এখন ছন্নছাড়া অবস্থা। সবে সন্ধে সাতটা বাজে। ফেস্ট শেষ হয়েছে ছ’টার সময়। মাটির প্রোগ্রাম শুরু হবে রাত ন’টায়। এই সময় উদ্যোক্তারা বিশ্রাম নিচ্ছে। অন্য প্রদেশ অথবা দূরের জেলা থেকে আসা ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে ঘুমোচ্ছে। কলকাতার অন্যান্য কলেজের ছেলেমেয়েরা বাড়ি চলে গেছে। কলেজ চত্বর ফাঁকা। সেন্ট্রাল হলের ভিতরে সাউন্ড-চেক চলছে। দময়ন্তী আপনমনে বলল, ‘লাল বিফোর দ্য স্টর্ম।’ তারপর গার্লস হোস্টেলের দিকে এগোল।
উলটোদিক থেকে বিলু আসছে। দময়ন্তীকে দেখে বলল, ‘আগে চলে এসেছিস।’
ফিক করে হেসে দময়ন্তী বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে। হোস্টেলে পালাই।’
‘সব সময় এত পালাই পালাই ভাব কেন?’ চোখ পাকায় বিলু। ‘চল দাঁড়ে বসে এককাপ চা খাই। বছরের শেষ দিনে স্বাস্থ্যপান করা উচিত।’
‘বিলুদা, একটা রিকোয়েস্ট করব?’ ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলে দময়ন্তী।
‘কী রিকোয়েস্ট? খুব কোনও খারাপ কথা বলবি বলে মনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ। আমায় গাঁজা খাওয়াবে?’
দময়ন্তীর প্রস্তাব শুনে বিলুর চোখমুখের চেহারা দেখার মতো হল। প্রথমে টেনসান খেল, তারপর সিনিয়ার দাদার গেরামভারি ভাব দেখাতে গিয়ে হেসে ফেলল, তারপর অসহায়ের মতো বলল, ‘আমি কখনও খাইনি।’
‘যাঃ! সত্যি?’
‘মাইরি বলছি। নেশাভাং করার অভ্যেস নেই। মাঝেমধ্যে সিগারেট খাই শুধু।’ মিনমিন করে বলে বিলু।
‘চলো। আমি তাহলে তোমাকে খাওয়াই। আমার হাতেই তোমার গাঁজাখড়ি হোক।’ খ্যাকখ্যাক করে হাসছে দময়ন্তী।
‘গাঁজাখুরি কথা বলিস না তো।’ পান করার দুর্বল চেষ্টা করে বিলু। ‘আমাদের ক্যাম্পাসে কোথায় গাঁজা পাওয়া যায় তুই জানিস?’
‘জীবনদার ক্যান্টিনেই পাওয়া যায়। এসো তুমি আমার সঙ্গে।’ বিলুর হাত ধরে টান মারে দময়ন্তী। দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিলু বলে, ‘আমার পক্ষে ওসব কেনা সম্ভব নয়। আর তুইও ওসব কিনিস না।’
‘পলিটিকাল ইমেজ?’ ভুরু নাচাচ্ছে দময়ন্তী, ‘প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরামের নেতা গাঁজা খেলে পাবলিক ইমেজ খারাপ হবে? আমার ধারণা ছিল, র্যাডিক্যাল লেফটদের মধ্যে ক্যানাবিসের হ্যালু ইন থিং।’
‘ওসব তোদের দিল্লিতে। এখানে নয়।’ পার্স থেকে একশো টাকা বার করে বিলু বলে, ‘জীবনদাকে বলছি ভালো হ্যাশ দিতে।’
‘তুমি এমন লজ্জা পাচ্ছ যে ”গাঁজা” শব্দটা উচ্চারণ না করে ”হ্যাশ” বলছ।’ আবার খ্যাকখ্যাক করে হাসে দময়ন্তী। বিলুর হাত থেকে একশো টাকার নোট নিয়ে জীবনদার ক্যান্টিনে ঢুকে যায়। একটু বাদে ফিরে আসে এক প্যাকেট স্মুদ কাট সিগারেট, একটা দেশলাই আর ছোট দুটো পুরিয়া নিয়ে। সিগারেটের প্যাকেট দেখে বিলু বলল, ‘এই ব্র্যান্ডের এক প্যাকেটের দাম ষাট টাকা। গাঁজার জন্য তোর পকেট থেকে কত গেল?’
‘দ্যাটস নান অব ইয়োর বিজনেস,’ ক্যাজুয়ালি শ্রাগ করে দময়ন্তী। ন্যাপস্যাকের সাইড পকেটে সিগারেটের প্যাকেট আর পুরিয়া ঢুকিয়ে বলে, ‘কোথায় খাওয়া যায় বলো তো? আমি যে কোনও জায়গাতেই বসতে পারি। তবে তোমার ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে।’
‘আমি কখনও খাইনি।’ লাজুক মুখে বলে বিলু, ‘নিয়মকানুন জানি না। উলটোপালটা কিছু হয়ে গেলে বিপদে পড়ব।’
‘আমি জানি।’ লেডি আর্চার্স হোস্টেলের দিকে যেতে যেতে বলে দময়ন্তী। ‘আমাদের হোস্টেলের কয়েকজন মেয়ে খায়। চলো আমরা গেস্টরুমে বসি। ওখানে গন্ধ শোঁকার জন্য কেউ থাকবে না। প্লাস আমাদের কোনও অসুবিধে হলে সেফ জোনে থাকব।’
‘কী বলতে চাইছিস?’
‘গাঁজার নেশা আনপ্রেডিক্টেবল। ধুনকির মাথায় তুমি আমাকে মলেস্ট করতে এলে আমি এক ছুটে হোস্টেলের ভেতরে পালিয়ে যাব। আমি তোমাকে মলেস্ট করতে গেলে তুমি এক ছুটে হোস্টেলের বাইরে পালিয়ে যেতে পারবে। দু’জনেই দু’জনকে মলেস্ট করতে গেলে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ফুলমতিয়া ঝাঁটা হাতে তেড়ে আসবে। আর দু’জন কনসেন্টিং অ্যাডাল্ট হিসেবে সেক্স করতে চাইলে কেউ বিরক্ত করবে না।’
‘আমি যাব না। তুই হেবি ভয় দেখাচ্ছিস।’
বকর বকর করতে করতে দু’জনে এসে দাঁড়ায় লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সামনে। বছরের শেষ সন্ধেয় জব্বর শীত পড়েছে। কোনও জনপ্রাণীকে বাইরে দেখা যাচ্ছে না। রিনা দত্তর কোয়ার্টার ভিতর থেকে বন্ধ। হোস্টেলের সব ঘরের সব দরজা জানলা ভিতর থেকে বন্ধ। ফুলমতিয়ারও পাত্তা নেই। দময়ন্তী আর বিলু সুট করে গেস্টরুমে ঢুকে পড়ে।
সোফায় জমিয়ে বসে ন্যাপস্যাকের সাইড পকেট থেকে স্মুদ কাট সিগারেটের প্যাকেট বার করে দময়ন্তী। প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বার করে বিলুকে দিয়ে বলে, ‘দুটো সিগারেট থেকেই হাফ টোব্যাকো ফেলে দাও।’
একটা সিগারেট নিয়ে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ফাঁকে ঘোরাতে ঘোরাতে বিলু বলে, ‘ওই সিগারেটটা রেখে দে। একটাই এনাফ।’
‘সিগারেটের ফিল্টারে লিপস্টিক লেগে গেলে আমাকে কিছু বলতে পারবে না কিন্তু।’ প্যাকেটে সিগারেট ঢুকিয়ে একটা পুরিয়া বিলুর হাতে তুলে দেয় দময়ন্তী। হাতের তালুতে অনেকটা তামাক জমেছে। সেটা ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলে পুরিয়া খোলে বিলু। শুকনো, খয়েরি, শেকড় বাকড়ের মতো গাঁজা হাতের তালুতে নিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে গুঁড়ো করে। সন্তর্পণে গাঁজার গুঁড়ো সিগারেটের ফাঁপা নলে ঢোকায়। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে রোল করে ন্যাতপেতে ভাব তাড়ায়। গাঁজা ভরতি সিগারেট দময়ন্তীকে দিয়ে বলে, ‘লেডিজ ফার্স্ট!’
কাঁপাকাঁপা হাতে সিগারেট নিয়ে দময়ন্তী বলে, ‘ধরাই?’
বিলু ঘাড় নাড়ে। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট রেখে অনভ্যস্ত হাতে দেশলাই জ্বালায় দময়ন্তী। তিনটে কাঠি নষ্ট করে অবশেষে সিগারেট ধরাতে সক্ষম হয়। হালকা টান মেরে খকখক করে কাশতে কাশতে বলে ‘কী কুচ্ছিত টেস্ট! ব্যাব্যা গো!’
‘দে! এসব তোর জন্য নয়।’ ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে সিগারেট চেয়ে নিয়ে লম্বা টান দেয় বিলু। ধোঁয়া কিছুক্ষণ মুখে আর বুকে ধরে রাখে। তারপর নাক দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে।
‘ওয়াও! প্রিটি কুল!’ বিস্ময় প্রকাশ করে দময়ন্তী। বিলুর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিজে এক টান দেয়। গাঁজার গন্ধে গেস্টরুম ভরে ওঠে।
মিনিট পাঁচেক বাদে যখন সিগারেট শেষ হল, তখন দু’জনে ঢুলুঢুলু চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর বোকাবোকা হাসছে।
‘মা-টি! মা-টি!’ বিড়বিড় করে বিলু।
‘নো-শশা হয়ে গেল? নো-শশা?’ জিজ্ঞাসা করে দময়ন্তী।
‘আমার হয়নি। তোর হয়েছে। কথাটা নোশা নয়। নেশা।’
‘হোয়াই ড্রিংক অ্যান্ড ড্রাইভ, হোয়েন ইউ ক্যান স্মোক অ্যান্ড ফ্লাই…’ বিড়বিড় করছে দময়ন্তী। ‘টি-শার্টে এই কথাটা লেখা থাকে। আজ মানে বুঝলাম। আমার মনে হচ্ছে, উড়তে পারব। দেখো তো, ডানা গজাচ্ছে কি না!’ বিলুর দিকে কাঁধ বাড়িয়ে দিয়েছে সে। বিলু প্রথমে কাঁধে চোখ ফোকাস করে। তারপর মাথায় আর পায়ে। বলে, ‘ডানা এখনও গজায়নি। তবে সিং আর খুর গজাচ্ছে।’
‘ল্যাজ?’ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, বিলুর দিকে পিছন করে, সোফার হাতল ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে নিজের পশ্চাদদ্দেশ দেখায় দময়ন্তী। সেখানে থাবড়া মেরে বিলু গান ধরে ‘আহা থাকত যদি তোমার ওগো ল্যাজের ওপর ডানা, উড়ে গেলেই আপদ যেত করত না কেউ মানা। আহা…করত না কেউ মানা। আহা… করত না কেউ মানা।’
‘অ্যাডিং ইনসাল্ট টু ইনজুরি?’ সোফায় বসে চোখ পাকায় দময়ন্তী, ‘হামারি মাং পুরি করো। পুরি করো।’
‘তোর আবার কী মাং?’ ভেবলে গিয়ে বলে বিলু, ‘খুন ভরি মাং?’
‘নহি রে বুড়বক! রেখাওয়ালি মাং নহি! মাটি-ওয়ালি মাং! মেরেকো মাটি কা গানা সুনাও! মিট্টি কা খুশবুওয়ালি গানা!’
‘অ! তাই বল!’ দময়ন্তীর ন্যাপস্যাক ঘেঁটে সিগারেটের প্যাকেট বার করেছে বিলু। বার করেছে গাঁজার পুরিয়া। নতুন সিগারেট বানাতে বানাতে বলে, ”মাটিতেই জন্ম নিলাম। মাটি তাই রক্তে মিশেছে।” এই গানটা কার লেখা জানিস?’
‘হাট্টিমাটিম টিম? যারা মাঠে পাড়ে ডিম? যাদের খাড়া দুটো সিং?’ মাথার দু’পাশে হাতের মুঠো রেখে তর্জনী সোজা করে সিং দেখায় দময়ন্তী।
‘না রে পাগলি। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। নামকরা গায়ক। আমাদের ওদিকে বাড়ি। ”চল কোদাল চালাই, ভুলে নামের বালাই, ঝেড়ে অলস মেজাজ, হবে শরীর ঝালাই। যত ব্যাধির বালাই বলবে পালাই পালাই…” এটা কী জানিস?’
‘মাটি কাটার গান?’
‘না রে পাগলি। এটা ব্রতচারীর গান।’ সিগারেট ধরিয়ে টান দিয়েছে বিলু। গান ধরেছে, ‘ও মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে উগলে হিরে মোতি, ও মেরে দেশ কি ধরতি!’
‘চলো। এখানে বসে বসে গান না গেয়ে, সেন্ট্রাল হলে গিয়ে গান শুনি।’ ঘড়ি দেখে বলে দময়ন্তী, ‘ন’টা বাজে। মাটি-র পারফরম্যান্স শুরু হল বলে।’
‘যাব? এত তাড়াতাড়ি?’ দময়ন্তীর হাতে সিগারেট ধরিয়ে বলে বিলু। ‘আচ্ছা। চল। বাই দ্য ওয়ে, আমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না তো যে গাঁজা টেনেছি?’
‘না।’ মোবাইলে বৃন্দাকে ফোন করতে করতে দময়ন্তী বলে, ‘আমি অন্তত বুঝতে পারছি না। তবে আমার কথা ছাড়ো। আমি নো-শশা করে আছি।’
‘থ্যাংক ইউ!’ গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে বিলু হাসে, ‘তাহলে কোনও চিন্তা নেই। আজ সবাই নো-শশা করে আছে।’
সেন্ট্রাল হলে মাটির প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। হৃষিকেশের উদাত্ত কণ্ঠস্বরে শোনা যাচ্ছে মাটির হিট গান, ‘আমরা হাঁটি, যেথায় মাটি। সঙ্গে আছে শেতলপাটি।’ একতারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে গিটার রিফ, ডুগডুগির সঙ্গে অক্টাপ্যাড। খঞ্জনির সঙ্গে সিমব্যাল। ছাত্রছাত্রীর তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।
বৃন্দা সেন্ট্রাল হলের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। বিলু আর দময়ন্তীকে দেখে চিৎকার করে বলল, ‘এ কী, দুজনের চোখ ছলছল করছে কেন? গাঁজা খেয়েছিস নাকি?’
‘কী করে বুঝলি?’ সিগারেটে টান দিয়ে বলে দময়ন্তী।
‘দশ মাইল দূর থেকে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’ দময়ন্তীর হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে লম্বা টান দেয় বৃন্দা। সিগারেট শেষ করে দুজনের হাত ধরে টানতে টানতে সেন্ট্রাল হলের ভেতরে ঢোকায়। ‘স্টেজের ডানদিকে বার কাউন্টার। রিপুদা, টিনটিনদা, সুব্রতদা আর বান্টিদা ছেলেদের সার্ভ করছে। আপ্পুদি মেয়েদের। তাড়াতাড়ি চল।’
‘গাঁজার পরে বুজ?’ মাটির গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেঁচায় দময়ন্তী। ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?’
‘তোমরা যাও মালে মালে, আমরা যাই পাতায় পাতায়,’ চিৎকার করে বিলু। দময়ন্তীকে ছেড়ে দিয়ে পিছনের বেঞ্চে বসে। সেখানে সব্যসাচী গম্ভীর মুখে গান শুনছে।
সেন্ট্রাল হলের মাঝখানে এখন কোনও চেয়ার নেই। সাইকেডেলিক আলোর ঝলকানিতে দেখা যাচ্ছে সেখানে শ’তিনেক ছেলেমেয়ে নাচছে। অন্য কলেজের ছেলেমেয়ে নেই। সবাই আইএমসির। শ্রীপর্ণা, জেমসি, সাবিনা, দীপ, প্রবাল আর সঞ্জয়কে চিনতে পারল। তালঢ্যাঙা সুরজকে অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। মাটি নতুন গান ধরেছে। ‘বঁধুয়া আমায় ফেলে চলে গেলে নতুন শহরে। কেয়ার করি না, নতুন বন্ধু পেয়ে গেছি, তোমার মতো আড়ে বহরে।’
‘কী নিবি?’ দময়ন্তীকে জিজ্ঞাসা করল আপ্পু।
‘ওয়াইন নেই?’ ঘোর লাগা গলায় বলে দময়ন্তী।
‘নেকু। ওসব এখানে থাকে না। হুইস্কি, রাম না ভদকা? ফটাফট বল।’
‘ভদকা দাও। ফ্লেভারওয়ালা।’ দাবি করে বৃন্দা।
‘এই নে।’ দুটো বোতল দু’জনের হাতে ধরিয়ে আপ্পু বলে, ‘এটা মিক্স করা আছে। আস্তে আস্তে খা। আর দেব না। খেয়েদেয়ে সোজা হোস্টেলে যাবি।’
‘আচ্ছা।’ বোতলের টক-মিষ্টি পানীয় গলায় ঢালতে ঢালতে ডান্স ফ্লোরের দিকে দৌড়ায় দু’জনে। প্রোগ্রাম জমে উঠেছে। দুহাজার এগারো সাল আসতে আরও দেড়ঘণ্টা বাকি। এই সময়টা নেচে ফাটিয়ে দিতে হবে।
দময়ন্তী কতক্ষণ ধরে নেচেছে খেয়াল নেই। একবার চন্দন আর অভিকে দেখল, একবার দেখল লাটুকে। সুরজ, প্রবাল, দীপ, সঞ্জয়—সবাই একবার এসে তার সঙ্গে নেচে গেল। এমনকী রিপুদাও। রাত বারোটা বাজতে ঠিক এক মিনিট বাকি থাকতে অনুষ্ঠান শেষ করল মাটি। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে হৃষিকেশ বলল, ‘কাউন্টডাউন ফর নিউ ইয়ার বিগিনস নাও। প্লিজ পুট দ্য লাইটস অফ।’
সেন্ট্রাল হল অন্ধকার হয়ে গেল। সমবেত চিৎকার শোনা যাচ্ছে, ‘সিক্সটি, ফিফটি নাইন, ফিফটি এইট…’
দময়ন্তীর মাথা ঘুরছে। বৃন্দা কোথায়? আজ বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।
‘ফিফটি, ফর্টি নাইট, ফর্টি এইট…’
অভি আর একবার এসে তার হাত ধরে বলল, ‘কী কিলার স্টেপস দিচ্ছিস মাইরি!’ বৃন্দা কোথা থেকে এসে অভিকে ধরে নিয়ে চলে গেল। গা গুলোচ্ছে… এবার এখান থেকে বেরোনো যাক।
‘ফর্টি, থার্টি নাইন, থার্টি এইট…’
সুরজ এখন তার সামনে। ‘ফিলিং ড্রাউজি, বেবি?’ সহৃদয় কণ্ঠে জানতে চাইছে।
‘হ্যাঁ।’ ঘাড় নেড়ে উত্তর দেয় দময়ন্তী। সুরজ তাকে জড়িয়ে ধরে।
‘থার্টি, টুয়েন্টি নাইন, টুয়েন্টি এইট…’
সুরজ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরেছে। পাজাঁকোলা করার কায়দাটি অদ্ভুত। এক হাত পিঠের তলা দিয়ে এসে বুকের ওপরে। অন্য হাতটি হাঁটুর তলা দিয়ে এসে পেটের ওপরে। দময়ন্তী চেষ্টা করে সুরজের হাত সরানোর জন্য। পারে না। অন্ধকার সেন্ট্রাল হলের মধ্যে সুরজ সেন্ট্রাল হলের পিছনের দিকে সরে যেতে থাকে। যে দিকে ছোট কিউবিকলগুলো আছে।
‘টুয়েন্টি, নাইন্টিন, এইট্টিন…’
একটা কিউবিকলে দময়ন্তীকে ঢুকিয়ে দিয়েছে সুরজ। এই ঘরটায় সেন্ট্রাল হল সাফ করার মালপত্রে ভরতি। মপ, ঝাঁটা, ঝুলঝাড়া, ফ্লোর-ক্লিনারের বোতলে ঠাসা। এক হাতে দময়ন্তীকে ধরে রেখে অন্য হাতে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করে সুরজ। পারে না। নিজেই দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দময়ন্তীর হুডি খোলার চেষ্টা করে।
দময়ন্তী ভাবে, তার বাধা দেওয়া উচিত। চিৎকার করা উচিৎ। সুরজের পেটে লাথি কষানো উচিত। কিন্তু সে কিছুই করতে পারে না। হাত-পা বশে নেই। কথা বলতে গেলে মুখ দিয়ে ফিশফিশ করে আওয়াজ বেরোচ্ছে। কী ঘটতে চলেছে সেটার আবছা আন্দাজ পেলেও আতঙ্ক বা দুশ্চিন্তা বা ক্রোধ—কিছুই হচ্ছে না। প্রতিরোধের চেষ্টাটুকু আপনা আপনি আসছে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো।
‘সেভেনটিন, সিক্সটিন, ফিফটিন…’
লাল টুকটুকে হুডি মেঝেয় লুটোচ্ছে। কালো, গোলগলা সোয়েটারের ফাঁকে ঢুকে গেছে সুরজের বাঁ-হাত। ডান হাত দিয়ে বেল্ট খোলার চেষ্টা করছে সে। দময়ন্তীর চোখে জল। কাজল ধেবড়ে গেছে। ন্যুড লিপস্টিকের রঙ ছড়িয়ে গেছে গালে। দু’হাত দিয়ে সে সুরজকে দূরে সরাবার চেষ্টা করছে। বিড়বিড় করে কী সব বলতে চাইছে।
‘থার্টিন, টুয়েলভ, ইলেভেন…’ লাল বেল্ট খুলে ফেলেছে সুরজ। কালো সোয়েটার দময়ন্তীর মাথার ওপরে তুলে দিয়েছে। দময়ন্তী এখন কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার হাতও অকেজো। তার শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুরজের হাত। টাইটস হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে দময়ন্তীর পা-দুটোও অকেজো করে দিয়েছে সে।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে, বিবস্ত্র ও প্রতিরোধহীন অবস্থায় দময়ন্তীর নেশা কাটতে শুরু করে। শরীরে শক্তি ফিরে আসে, গলায় আওয়াজ ফিরে আসে, মাথায় ঢুকে পড়ে আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, ক্রোধ। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে তার প্রথম অস্ত্র প্রয়োগ করে। দুই ফুসফুসের সমস্ত ক্ষমতা উজাড় করে চ্যাঁচায়, ‘বাঁচাও, বাঁচাও! সুরজ আমাকে মলেস্ট করছে।’
‘টেন, নাইন, এইট…’
দময়ন্তীর চিৎকারে কাজ হয়। আওয়াজের তীব্রতায় হতচকিত সুরজ একপা পিছিয়ে যায়। পরমুহূর্তে এগিয়ে এসে দময়ন্তীর পেটে চিমটি কেটে বলে, ‘চিল্লানা মত! মজা লে!’
দময়ন্তী সোয়েটার নামিয়ে নিয়েছে। সে আবার সব কিছু দেখতে পাচ্ছে। হাঁটু পর্যন্ত নামানো টাইটস তুলতে গিয়ে সে একটা টেকনিক্যাল ভুল করল। তার দৃষ্টি অন্য দিকে চলে গেল। এই সুযোগে সুরজ লাল বেল্ট দময়ন্তীর কোমর বরাবর জড়িয়ে নিয়ে পিছন দিকে গিঁট পাকিয়ে দিল।
দময়ন্তীর দুই হাত এখন বেল্টের নীচে। আবার সে অসহায়। সুরজ জিনসের জিপার খুলল। বাঁ হাতে দময়ন্তীর চুলের মুঠি ধরে ডান হাত সোয়েটারের তলায় পাঠিয়ে দিল। ‘উহ! মাগো!’ যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে দময়ন্তী।
‘সেভেন, সিক্স, ফাইভ, ফোর…’
‘ওকে ছেড়ে দে।’ করিডোরে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বলছে বিলু।
‘আজা তু ভি আজা… দোনো মিলকে মজা লেতে হ্যায়…’ বিলুকে হাতের ইশারায় ডাকছে সুরজ।
‘ওকে ছেড়ে দে।’ এক পা এগিয়ে বলে বিলু।
‘আবে নকশালিয়া! রংদারি মতো দিখা। তেরে জ্যায়সে চুহাকো হামলোগ রোজ তিনবার ঠোকতে হ্যায়!’ আঙুল নাড়িয়ে বিলুকে সরে যেতে বলছে সুরজ।
বিলু আর একপা এগোতেই দময়ন্তীকে ছেড়ে বিলুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুরজ। এক ধাক্কায় তাকে কিউবিকল থেকে বার করে আবার দরজার গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়ায়। ওইটুকু সময়ের মধ্যে বেল্টের গিঁট খুলে ফেলেছে দময়ন্তী। সুরজ তার দিকে ঘুরে বলে, ‘তু ভি নকশালিয়া হ্যায় কা? দিখা তেরা রেড করিডোর দিখা।’
‘হাঁ হ্যায়!’ চিৎকার করে দময়ন্তী। তারপর সুরজের চোখে আঙুল গুঁজে দেয়। লাল নেলপালিশ লাগানো নখের আঘাতে আর্তনাদ করে ওঠে সুরজ।
‘থ্রি, টু, ওয়ান! হ্যাপি নিউ ইয়ার! বাই বাই টু থাউজ্যান্ড টেন। ওয়েলকাম টু থাউজ্যান্ড ইলেভেন!’ চিৎকার করছে মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ। সেন্ট্রাল হল জুড়ে আলো জ্বলে উঠেছে। মাটি আবার গান ধরেছে, ‘আমরা হাঁটি যেথায় মাটি। সঙ্গে আছে হাতপাখাটি।’
বিলু সুরজের কলার ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দময়ন্তী কুড়িয়ে নিচ্ছে হুডি। দৌড়ে আসছে রিপু, আপ্পু, টিনটিন, লাটু, বৃন্দা, সাবিনা, জেমসি…
দময়ন্তী বিলুর দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। অথবা অন্য কিছু।