অভিজ্ঞান
মঞ্চের কেন্দ্রে এখন বৃন্দা। টিনটিন বলল, ‘তেরা নাম কেয়া হ্যায় বৃন্দা?’
বৃন্দা পরে আছে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। ময়ূরকণ্ঠি রঙের ব্লাউজ। চুলে টপনট করা। স্পটলাইটের চড়া আলোয় ভুরু কুঁচকে অডিয়েন্সের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাই নেম ইজ বন্ড-ওপাধ্যায়। বৃন্দা বন্ডোপাধ্যায়।’
বৃন্দার মুখ গোল। টপনট করার ফলে লম্বাটে ভাব এসেছে। ঠোঁট সত্যি সত্যিই গোলাপি, না শাড়ির ছায়া পড়েছে, কে জানে! অভি কনফিউজড হয়ে যায়। এত সুন্দর কোনও মেয়ে হতে পারে? এত নিখুঁত? এত সরল? এত নিষ্পাপ?
টিনটিন বলল, ‘দ্যাটস মোর লাইক আ বন্ড গার্ল!’
‘দ্যাটস, মোর লাইক বন্ড, আই প্রিজিউম!’ নিষ্পাপ চোখ অডিটরিয়ামে বিছিয়ে বলল বৃন্দা। দর্শকাসনে বসে থাকা অভির হৃদয় একটি স্পন্দন মিস করল। পুলিশ যেভাবে চোর ধরে, ডান হাত দিয়ে সেইভাবে বাঁ হাতের তালু খিমচে ধরে সে। তার জিভ গরমকালের পিচের রাস্তার মতো শুকনো। শীততাপনিয়ন্ত্রিত সেন্ট্রাল হলে বসে গরম লাগছে। ঘাড়ে, কানে, রগে ঘাম হচ্ছে বিনবিন করে।
‘লেটস কাট দ্য ক্র্যাপ। কী পারফর্ম করবি বল।’ টিনটিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে বৃন্দার দিকে।
‘পারফর্ম করব?’ ফ্যাকাশে হাসে বৃন্দা, ‘আমি তো কিছু পারি না। সাবিনা বা শ্রীপর্ণার মতো গান জানি না, জেমসির মতো নাচ জানি না…’
‘জেমসি নাচবে একথা বলার জন্য তোকে মঞ্চে ডাকা হয়নি। ডোন্ট বি আ স্পয়েল স্পোর্ট,’ আলতো ধমক দেয় টিনটিন। ‘কী করবি বল।’
‘আমি বরং একটা কবিতা বলি? কেমন?’ মিনতি করে বৃন্দা।
‘ঠিক হ্যায়। স্টার্ট।’ শ্রাগ করে মঞ্চের এক পাশ সরে যায় টিনটিন। মঞ্চের মাঝখানে এখন বৃন্দা। তার ওপরে পড়েছে স্পটলাইট। আলোকবৃত্তের মাঝে দাঁড়িয়ে সে কাঁপা গলায় বলে—
‘হাত তোলো যদি নৃত্যনাট্য
কথা যদি বলো ছন্দ
ভ্রুকুটিশাসনে অবশ করেছ
শরীরের চতুরঙ্গ…’
শঙ্খ ঘোষ! অসহায় উত্তেজনায় শিউরে ওঠে অভি। তার ধারণা হয়েছিল, যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য না পড়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরিজিতে অনার্স না পড়ে, কবিতা-গপপো-উপন্যাসের থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছে সে। এখন তো দেখছে অন্য ব্যাপার। ‘স্বয়ং খোদা’ তাকে ধাওয়া করে ফিরছেন কবিতা থেকে কবিতায়।
বৃন্দা বলছে—
‘শরীরে হঠাৎ ফেরে কৈশোর
মাটিতে ছোঁয়ালে পা
আর কোনওদিন তোমার ঘরের
ত্রিসীমায় যাব না।’
অভির শরীরে সত্যিই ফিরে আসছে কৈশোর। যে সাহিত্যের প্রেমে তার কিশোরবেলা কেটেছে, বাবা-মায়ের তাড়নায় তাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আজ সাহিত্য সেই অপমানের শোধ তুলছে। শোধ তুলছেন কবি। শোধ তুলছে পুতুল-পুতুল মেয়েটা। গোলাপি সারল্যে সামনের দিকে তাকিয়ে ও কাকে খুঁজছে? অভিজ্ঞানকে? না অন্য কাউকে? অভির মনে পড়ে যায় বিলুর পড়ানো ‘প্রতিহিংসা’ কবিতার লাইনগুলো—
‘যুবতী কিছু জানেনা, শুধু প্রেমের কথা বলে
দেহ আমার সাজিয়েছিল প্রাচীন বল্কলে…’
অভির মনে হয় সে এক প্রত্নগাছ, যে সৃষ্টির আদি থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্জলা, বন্ধ্যা, প্রান্তরে। তার চারিদিকে প্রাগৈতিহাসিক লাভা টগবগ করে ফুটছে। পৃথিবী নিজের অক্ষে নিজের নিয়মে ঘুরে চলেছে। মাথার ওপরে জ্বলছে সূর্য। দিন যাচ্ছে, রাত যাচ্ছে, সপ্তাহ-মাস-বছর যাচ্ছে, দশক ও শতক যাচ্ছে। রেন ফরেস্ট তৈরি হচ্ছে, অ্যামাজন নদী গতিপথ বদলাচ্ছে, মাথা তুলছে হিমালয়, হ্যালির ধূমকেতু উড়ে যাচ্ছে বারবার। আকাশ ভরা সূর্য তারা মাথায় নিয়ে অভি একা ক্লান্তিহীন দাঁড়িয়ে। আর তাকে সন্তর্পণে ঢেকে রাখছে প্রাচীন বল্কল, বৃন্দা ব্যানার্জি।
অভি কিছু শুনতে পাচ্ছে না। চারিদিক আউট অব ফোকাস হয়ে যাচ্ছে। শুধু গোলাপি এক দীপশিখা তার চোখের সামনে তিরতির করে কাঁপছে। অভি বুঝতে পারল, সে ওই গোলাপি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে। সহায়হীন, অবলম্বনহীন ভাবে প্রেমে পড়ে গেছে।
চোরের মতো সেন্ট্রাল হল থেকে বেরিয়ে এল অভি। কে মিস আইএমসি হল, কে মিস্টার আইএমসির খেতাব জিতল, টিনটিনের লেখা নাটক ‘ফিফটি ফিফটি’ কেমন হল—এইসব জানার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। জানার ইচ্ছে নেই রয়্যালের বিরিয়ানি কেমন খেতে, মদ্যপান করে নাচানাচি করতে কেমন লাগে।
নিজের মধ্যে আকস্মিক জেগে ওঠা এই অনুভূতি তার কাছে নতুন। শরৎকালের শিউলি ফুলের মতো নতুন। গ্রীষ্মের কালবৈশাখীর মতো নতুন। বর্ষার প্রথম কদম ফুলের গন্ধের মতো নতুন। এই বুক ছাপানো নতুন অনুভূতিমালা নিয়ে অভি কী করবে?
ন্যাপস্যাক কাঁধে ভূতগ্রস্থের মতো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে অভি। বিলুকে বলা উচিত ছিল, যে সে বাড়ি চলে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল হলে বারদুয়েক বিলুকে দেখেছে। কোনও কথা বলেনি।
অভি ফোন করার প্রয়োজন বোধ করল না। সাড়ে আটটার ডানকুনি লোকাল ধরলে রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাবে। লক্ষ্মী নিবাসে ঢুকে ফোনে জানিয়ে দিলেই হবে যে সে বাড়িতে।
শেয়ালদা স্টেশানের দিকে দৌড়তে দৌড়তে অভি বিড়বিড় করে—
‘আমিও পরিবর্তে তার রেখেছি সব কথা
শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছে আগুন, প্রবণতা।’
.
অরুণা স্কুপ টিভিতে খবর দেখছিলেন। অভিকে ঢুকতে দেখে বললেন, ‘কী হয়েছে রে? মুখ শুকনো লাগছে কেন?’
‘কই! না তো!’ অরুণাকে এড়িয়ে চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগোল অভি।
‘ওপরে পরে যাস। আগে আমার কাছে এসে বোস। কলেজে র্যাগিং করেছে নাকি? বিলু ছিল না?’ অরুণা নাছোড়বান্দা।
এখন এখান থেকে পালালে পরে নীচে নেমে কৈফিয়ত দিতে দিতে অভির কালঘাম ছুটবে। তার বদলে দু-চারটে মিথ্যে কথা বলে জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ করা যাক।
‘দাদা ছিল। আমার ওইসব ঝাঁই-ঝপাঝপ মিউজিক সহ্য হয় না। তাছাড়া ওরা খেতে দেবে অনুষ্ঠান শেষ হলে। অতক্ষণ থাকা পোষাল না। তাই পালিয়ে এলাম।’
‘দুপুর থেকে কিছু খাসনি?’ ছেলের খিদের কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যে অরুণার প্রশ্নমালা গায়েব। ‘এখন খেয়ে নিবি? না বাবা এলে খাবি?’
‘বাবা এখনও ফেরেনি?’ দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় অভি। দশটা পনেরো বাজে। ‘বাবা তো এত রাত কখনও করে না! নাটক-ফাটক আছে নাকি?’
‘জানি না!’ পিড়িং পিড়িং করে রিমোট টিপে চ্যানেল চেঞ্জ করছে অরুণা, ‘ফোন করলে ফোন ধরছে না। মোবাইল বেজে যাচ্ছে।’
‘তুমি একটা অমলেট ভেজে দাও।’ ল্যান্ডফোনের পাশে বসে অভি বলে, ‘বাবার ব্যাপারটা আমি দেখছি।’
অরুণা অনিচ্ছার সঙ্গে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। অভি প্রথমে ফোন করল বিলুকে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরে বিলু ফোন ধরে বলল, ‘তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেলি কেন? রিপু তোর খোঁজ করছিল।’
‘আমার বোর লাগছিল।’ ক্যাজুয়ালি বলে অভি। তার বুকের বাঁদিকে আবার গাবগুবাগুব শুরু হয়েছে, ‘প্রোগ্রাম শেষ? কে ক্রাউন পেল?’
‘এদিকে বলছিস বোর লাগছিল। আবার জিজ্ঞাসা করছিস ‘কে ক্রাউন পেল?’ কী ব্যাপার রে? স্টেজে তো তোকে বেশি মুরগি করেনি!’
‘আহ! তুই বল না।’
‘মিস্টার আইএমসি হয়েছে সুরজ। মিস আইএমসি বৃন্দা।’
‘বৃন্দা’ নামটা শোনামাত্র অভির গাবগুবাগুব বেড়ে গেল। কান আর গাল জ্বালা করছে। গলা শুকনো। কোনও রকমে সে বলে, ‘আমি ভেবেছিলাম জেমসি হবে।’
‘মেয়েটার অ্যাটিটিউড প্রবলেম আছে। এত অ্যাগ্রেসিভ উত্তর দিল যে পাবলিক ব্যাপক প্যাঁক দিয়েছে। ‘বাঙালিদের গায়ে দুর্গন্ধ’—এইরকম কমেন্ট করল। তারপর অডিয়েন্স এমন খিস্তি করেছে যে মেয়েটা স্টেজেই কেঁদে ফেলল। উদুম বাওয়াল।’
‘প্রোগ্রাম কি শেষ? কোনও আওয়াজ পাচ্ছি না তো?’
‘টিনটিনের নাটকের পরে শুরু হয়েছে ধিঙ্গিনাচন। আমি হোস্টেলে চলে এসেছিলাম। পরে আবার গেলাম। তুই বাড়ি গিয়ে ঠিকই করেছিস। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পুরো কলেজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকাল ছেলেছোকরাগুলো এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। গত বছর একটা মেয়েকে সেন্ট্রাল হলের পিছনে মলেস্ট করেছিল। তাই নিয়ে চূড়ান্ত অশান্তি হয়।’
‘বৃন্দা কোথায়?’ অভির মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল। ভুল সময়ে, ভুল মানুষের কাছে ভুল প্রশ্ন। প্রশ্নটা করেই জিভ কাটল অভি। কেলো করেছে! বিলু নিশ্চয়ই সব বুঝে গেল।
বিলু কোনও রিঅ্যাকশান দেখাল না। বলল, ‘ডে-স্কলার মেয়েদের আমরা বাসে বা গাড়িতে তুলে দিয়েছি। শ্রীপর্ণা, দময়ন্তী আর বৃন্দা বাড়ি চলে গেছে। জেমসি, সাবিনাদের মতো হোস্টেলাইটদের নিয়েই চিন্তা। আকণ্ঠ ভদকা খেয়ে এখনও নাচানাচি করছে।’
বিলুর চিন্তা শুনে অভির মনে পড়ে গেল মনোজের না ফেরা নিয়ে অরুণার দুশ্চিন্তার কথা। বিলু বলল, ‘বাবা এখনও বাড়ি ফেরেনি।’
‘তো? এই নিয়ে টেনশান খাওয়ার কী আছে? দেখ গিয়ে, হয় তো জীবন সংগ্রামের নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে। আমি ছাড়লাম।’ বিলু ফোন কেটে দিল।
অভি ঝটপট তিনতলায় উঠে কাপড় জামা ছেড়ে বারমুডা আর টি-শার্ট গলিয়ে নীচে নেমে এল। বাথরুমে থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল, টেবিলে অমলেট রাখা। অরুণা আবার রিমোট হাতে টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছেন। অভিকে দেখে বললেন, ‘বিলু কী বলল?’
‘বলল বাবা হয়তো নাটকের রিহার্সাল নিয়ে ব্যস্ত। চিন্তা করতে বারণ করল।’ এক টুকরো অমলেট মুখে পুরে অভি আবার ল্যান্ডফোনের রিসিভার তোলে। ‘বাবাকে একবার ফোন করে দেখি।’
ফটাফট মোবাইলের দশটা নম্বর ডায়াল করে সে। মনোজের মোবাইলে গান বাজছে, ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে…’ সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে গণসঙ্গীতটি বেজে একসময় থেমে গেল। রিসিভার ক্রেডল রেখে অভি আর একটুকরো অমলেট মুখে পুরল।
‘ধরল না?’ নিউজ চ্যানেল দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক গলায় বলেন অরুণা।
‘না,’ অমলেট শেষ করে সোফা থেকে ওঠে অভি। ‘নীচে গিয়ে একবার মানদা পিসি আর রাধাদির সঙ্গে দেখা করে আসছি।’
‘এক মিনিট শোন,’ বিড়বিড় করে বলে অরুণা, ‘টিভিতে দেখাচ্ছে যে ধর্মতলায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। দুটো সরকারি বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোর বাবা ওখানে ছিল না তো?’
অরুণার কথা শুনে চমকে ওঠে অভি। মনোজ মাঝে মাঝে ধর্মতলায় যান। মেট্রো চ্যানেলে পথনাটক করেন। এই সম্ভাবনার কথা তার মনে হয়নি। এই জন্যই অরুণাকে এত চিন্তান্বিত লাগছে?
‘ভ্যাট! তোমার যত ফালতু চিন্তা!’ এক পর্দা গলা তুলে প্রতিবাদ করে অভি। ধমকটা যত না অরুণাকে, তার চেয়ে বেশি নিজেকে। দুশ্চিন্তা খুব ছোঁয়াচে রোগ। এক্ষুনি অরুণার কাছ থেকে তার কাছে চলে আসবে। অরুণাকে টিভির সামনে বসিয়ে একতলায় নেমে আসে সে।
একতলায়, সিঁড়ির বাঁদিকের ঘরে থাকে মানদা। তার ঘরে একটা সিএফএল আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে মানদা মুখে স্নো মাখছে। দরজার বাইরে থেকে অভি বলল, ‘পিসি, আসব?’ স্নো মাখা বন্ধ রেখে একগাল হেসে মানদা বলে, ‘এসো গো! আজ মড়া কাটলে?’
সরু খাটে বসে অভি বলে, ‘ধুস! ওসব পরের সপ্তাহ থেকে। তোমার কী খবর?’
‘খবর আর কী? খাটতে খাটতে জান কয়লা হয়ে গেল, তবু তোমার মায়ের মন ভরে না। বাড়িতে থাকতে দিয়েছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে। আড়িয়াল একটা মরদ পাই, পালাব তার সঙ্গে। তোমরা খুঁজেও পাবে না।’
মানদা পিসি মাঝে মধ্যে এমন শব্দ ব্যবহার করে যেগুলোর মানে অভি জানে না। এই যেমন সে এখন ‘আড়িয়াল’ শব্দটা শুনল। বাংলাদেশে আড়িয়াল খাঁ নামে একটা নদ আছে। নদ আর নদীর তফাত আছে। অজয় বা ব্রহ্মপুত্র হল নদ। গঙ্গা বা যমুনা, নদী।
আড়িয়াল খাঁ হল নদ। বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে ‘আড়িয়াল’ শব্দটা মরদকে একটা বৈশিষ্ট দিচ্ছে। ডাকাবুকো বা ডানপিটে বা ওয়েল বিল্ট—এইরকম কোনও মানে হবে। বিলু একবার অভিকে বলেছিল, মানদার নাকি দু’বার বিয়ে হয়েছিল। প্রথমবার বর তাড়িয়ে দেয়, কেন না মানদা বন্ধ্যা। দ্বিতীয় বিয়ের পরেও সন্তানহীনতার সমস্যা। তবে এই বরটা বেশি শয়তান ছিল। সে মানদাকে তাড়ানোর বদলে মুম্বইতে বেচে দিয়েছিল। বন্ধ্যা যৌনকর্মীর চাহিদা বেশি, কেন না তাকে নিরোধ ব্যবহার করতে হবে না। কামাতিপুরার ঠেক থেকে মানদাকে উদ্ধার করেছিল কলকাতার এক এনজিও। মানদার পুনর্বাসনের জন্য এনজিও থেকে মহাকরণের পাশে ঘুগনির দোকান করে দিয়েছিল।
কামাতিপুরা থেকে দালালরা এসে মানদাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মনোজ সেদিন বাঁচিয়েছিলেন মানদাকে। থানায় গিয়ে সব খবর দিয়ে লক্ষ্মী নিবাসে নিয়ে এসেছিলেন।
‘আড়িয়াল’ বা এই জাতীয় সাংকেতিক ভাষা মানদা আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে শিখেছে। ওর মুখ খুব খারাপ। যাবতীয় অশালীন বিষয়ে তীব্র আগ্রহ। নিয়মিত সাজগোজ করে, ঝকমকে শাড়ি পরে সন্ধে নাগাদ পাড়ায় বেড়াতে বেরোয় আর ফিরে এসে অরুণাকে শোনায়, ‘আজ গঙ্গার ধারে একটা চিসসা মরদ দেখলাম।’
অরুণা রাগ করে বলেন, ‘মুখ-পাতলা মেয়েছেলে!’
‘তুমি মুখে ওটা কী মাখছ?’ প্লাস্টিকের ডিব্বা হাতে নিয়ে বলে অভি। হাত থেকে কৌটা কেড়ে নিয়ে মানদা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘এই সব দিকে নজর কেন?’
যা দেখার অভি দেখে নিয়েছে। স্নোয়ের ঢাকনার ওপরে লেখা, ‘রাজারানি স্নো। নিমেষে অবাঞ্ছিত রোম তোলার সেরা উপায়।’
হেয়ার রিমুভিং ক্রিম নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মানদার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ডান দিকের ঘরে ঢোকে অভি। এই ঘরে রাধা থাকে।
রাধার ঘরে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বলছে। ময়লা আলোর তলায় চৌকি পাতা। চৌকির ওপরে পাতলা এবং নোংরা গদি, তেলচিটে চাদর, ল্যাতপ্যাতে বালিশ। রাধার যখন মুড ঠিক থাকে তখন সে সোডা আর সাবান দিয়ে বিছানার চাদর আর বালিশের ওয়াড় কাচে, বালিশ আর গদি রোদে শুকোতে দেয়। মুড অফ থাকলে ওসবের দিকে তাকায় না। বিলু বলে ‘তার-কাটা ফেজ’ আর ‘তার-জোড়া ফেজ’। এখন রাধার তার-জোড়া ফেজ চলছে।
চৌকিতে বসে রাধাদি গুনগুন করে কী একটা বলছে। অভি বলল, ‘কী বলছ রাধাদি?’
‘শায়েরি গো শায়েরি। শুনবে নাকি?’ দরাজ গলায় বলে রাধা।
‘শোনাও,’ নোংরা বিছানায় বসে বলে অভি।
গলা খাঁকরে রাধা বলে,
‘বাঁধলে দো-চার বোতল কফন মে
কবর মে বৈঠকে পিয়া করেঙ্গে।’
‘ওয়াহ ওয়াহ!’ রাধাকে সাবাশি দেয় অভি। রাধা বলে—
‘বাঁধলে দো-চার বোতল কফন মে
কবর মে বৈঠকে পিয়া করেঙ্গে।’
‘আগে!’ হাঁক পাড়ে অভি। মুচকি হেসে রাধা বলে—
‘যব মাঙ্গেগে খুদা হিসাব গুনাহ কা
এক দো পেগ উসে ভি দিয়া করেঙ্গে।’
‘কেয়া খুব! কেয়া খুব!’ ওস্তাদের মতো ঘাড় নাড়ে অভি। শায়েরি শেষ করে গান ধরেছে রাধা। গানটা অভির চেনা। কেন না রাধা একটাই গান জানে। গানটা হল—
‘গারো পাহাড়, গারো পাহাড়।
গারো পাহাড়ের কী যে বাহার।
নেই কো তৃষ্ণা নেই আহার।
গারো পাহাড়। গারো পাহাড়।’
এই অদ্ভুত গানটা মাঝে মধ্যেই রাধা গায়। মনোজ বলেন, ‘এই গানের প্রথম লাইনটা রাধা পাগলি ঠিকঠাক গায়। বাকিটা ওর বানানো।’
গান শেষ করে রাধা একটা বড়, রঙিন কাগজ খুব মন দিয়ে কী সব দেখতে লাগল। অভি জিজ্ঞাসা করল, ‘এত মন দিয়ে কী দেখছ রাধাদি?’
‘ম্যাপ!’ হাসল রাধা। সাদা থান পরিহিতা, সাদা কদমছাঁটওয়ালা বৃদ্ধাকে হলদে আলোয় রহস্যময় লাগছে।
‘কীসের ম্যাপ?’
‘আমার শ্বশুরবাড়ির।’ ঝটপট কাগজ ভাঁজ করে রাধা। অভি দেখে ওর হাতে আর্কিওলজিকাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার ছাপা ভারতবর্ষের ম্যাপ।
‘তোমার শ্বশুরবাড়ি গারো পাহাড়ে?’ নিরীহ প্রশ্ন করে অভি।
‘কাছাকাছি বলেছ। মেঘালয়ে। আমার জন্ম বরিশালের অশথতলা গ্রামে। বিয়ে হয়েছিল বার্মায়। আমরা তো বার্মাতে থাকতাম। গন্ডগোলের সময় যখন তোমাদের এখানে চলে আসছি, তখন টুরাতে ওর সঙ্গে দেখা।’ লজ্জালজ্জা মুখে বলে রাধা।
‘টুরা?’
‘ভূগোলেতে গোল নাকি? গারো পাহাড় মেঘালয়ের তিনটে জেলা জুড়ে। তার মধ্যে একটা টুরা। ভাবছি একবার ঘুরে আসব।’
এই রে! রাধা পাগলি তার-কাটা ফেজে চলে গেছে। এবার ভুলভাল বকবে। কেটে পড়া বেটার। পালানোর জন্য অভি বিছানা থেকে ওঠে। রাধা তার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে, ‘আমি কিন্তু সব জানি।’
‘কী জানো?’ মিনমিন করে বলে অভি। পাগল নাকি এক্সট্রা-সেনসারি পারসেপশান থাকে। ইএসপি বা এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশান দিয়ে রাধা তার মনের অবস্থা জেনে গেল নাকি?
‘ইএসপি’ থেকে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল। বেলুড় থেকে বাসে করে ধর্মতলা বা এসপ্ল্যানেড যেতে ভরসা চুয়ান্ন নম্বর বাস। চুয়ান্ন নম্বর বাসের সামনের কাচে চুন দিয়ে, কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হাতের লেখায় লেখা থাকে ‘ইএসপি’, যেটা আদতে এসপ্ল্যানেড বোঝাতে লেখা আছে। বিলু অনেকদিন পর্যন্ত অভিকে বুঝিয়েছিল, চুয়ান্ন নম্বর রুটের ড্রাইভাররা ‘এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশান’ দিয়ে বাস চালায়।
‘ইএসপি’ থেকে এত কথা মনে পড়ে গেল। শব্দ নিয়ে এই মোহ কবে যে যাবে অভির! নিজের ওপরে বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে সে রাধার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কী জানে রাধা? কেন ও বলল, ‘আমি কিন্ত সব জানি?’
‘উনি আছেন।’ ওপর দিকে তর্জনী নির্দেশ করে রাধা। ‘উনি সব জানেন, সব দেখছেন, সব কিছুর হিসেব রাখছেন। ভুলেও ভেবো না কেউ পার পাবে। এত অনাচার চলছে, এত পাপ চারিদিকে, এত লোভ—এ জিনিস আর বেশি দিন চলবে না। আমার কাছে শুনে নাও, এন্ড ইজ নিয়ার।’
‘ভগবানের কথা বলছ?’ নিরীহ মুখে প্রশ্ন করে অভি।
‘মূর্খ মানবক! ভগবান ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না? অমন মাথা রাখার কী দরকার? হাড়িকাঠে দিয়ে এসো। ভগবান তো মানুষের তৈরি করা কনসেপ্ট। শূন্য থাকলে আঁক কষতে সুবিধে হয় বলে মানুষ শূন্য বানিয়েছে। ভগবান থাকলে পাপপুণ্যের দাঁড়িপাল্লায় ফেলে মানুষকে কুচিকুচি করতে সুবিধে হয়, তাই ভগবানকে বানানো হয়েছে। মোহর, কার্তুজ আর শৃংখলের মতো ভগবানও একটা যন্ত্র। কিন্তু সে কি তোমরা বুঝবে?’
বাপরে! কী কঠিন ভাষণ! অভি বলল, ‘তাহলে তোমার উনিটা কে?’
‘তোমার বোঝার সময় আসেনি। সময় এলে আপনি বুঝবে। সেদিন কেঁদে কূলকিনারা পাবে না।’ বিরক্ত হয়ে বলে রাধা, ‘এখন ওপরে যাও। না হলে তোমার মা চেল্লাবে।’
টুকটুক করে ওপরে আসে অভি। অরুণা এখনও টিভির সামনে বসে স্কুপ চ্যানেলে অ্যাকসিডেন্টের খবর দেখছেন।
‘খেতে দেবে না?’ জানতে চায় অভি। ‘এগারোটা বাজতে যায়।’
‘এদিকে আয়!’ হাত নেড়ে ছেলেকে ডাকেন অরুণা। তাঁর আহ্বানে অভি সোফায় বসে টিভির দিকে তাকায়। সঞ্চালকের বক্তব্য অনুযায়ী দুটি বাসের আগুন নিবিয়ে ফেলা হয়েছে। বাসযাত্রীরা বিপন্মুক্ত। যে দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে গন্ডগোলের সূত্রপাত, সেই পথচারী মারা গেছেন। তাঁর শরীর এতটাই থেতলে গেছে যে সনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে না।
খবর শুনে বিরক্ত হয়ে অরুণার দিকে তাকায় অভি। ‘বাসযাত্রীদের কারও কোনও ক্ষতি হয়নি। তাহলে তুমি চিন্তা করছ কেন?’
‘আহ! অ্যাঙ্কর কী বলল শুনলি না? মৃত পথচারীকে সনাক্ত করা যায়নি…’ ফিসফিস করে বলেন অরুণা।
‘মা! তুমি পাগলি হয়ে যাচ্ছ নাকি? বেছে বেছে বাবাকেই বাসে চাপা দিয়েছে—এই তোমার ধারণা?’
‘তাই যদি হয়? তাহলে কী হবে অভি?’ রিমোট বদলে অন্য খবরের চ্যানেলে চলে গেছেন অরুণা। এক পেট খিদে নিয়ে বিরক্ত মুখে অভি চেয়ারে বসতে যাচ্ছে, এমন সময় ঝনঝন করে ল্যান্ডফোন বেজে উঠল।
ফোনের আওয়াজ শুনে হাত থেকে রিমোট ছুঁড়ে ফেলে এক লাফে উঠে ফোনের কাছে গেলেন অরুণা। ফোন তুলে বললেন, ‘হ্যালো, হ্যালো, কে বলছেন? পুলিশ?’
ধুত্তেরিকা! বিরক্ত হয়ে মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় অভি। বলে, ‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘আসলে, আমি আপনাদের চিনি না।’ ওপাশ থেকে মেয়ের গলা শোনা যায়। মনোজদা আপনাদের ফোন করতে বললেন।’
‘বাবা কোথায়?’
‘উনি এখন স্টেজে। জীবন সংগ্রামের একটা স্ট্রিট থিয়েটার হচ্ছে আমাদের এখানে। আই মিন, মৌলালিতে। নাটকটা হঠাৎই নামল। উনি আপনাদের খবর দিতে পারেননি। আধঘণ্টা বাদে শেষ হয়ে যাবে। ওঁর বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা বাজবে।’
‘থ্যাংক ইউ,’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে অভি। ফোন রাখার মুহূর্তে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কে বলছেন জানতে পারি?’
‘আমার নাম ঋষিতা। আমি মৌলালিতেই থাকি। আমরাই স্ট্রিট থিয়েটারটা অর্গানাইজ করেছি। ফোনটা গ্রিন রুমে রাখা আছে। অনেকবার বাজল। আমি মনোজদাকে বলায় উনি আপনাদের ফোন করে দিতে বললেন।’
‘আচ্ছা। অনেক ধন্যবাদ।’ ফোন কাটে অভি। অরুণাকে বলে, ‘মা, খেতে দাও। বাবার ফিরতে বারোটা বাজবে। অতক্ষণ জেগে থাকতে পারব না।’
অরুণা গজগজ করতে করতে খেতে দিলেন। কী খেল, বুঝতেও পারল না অভি। তিনতলায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল, বৃন্দা ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছেছে তো? ও কি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে, না বাবা-মায়ের কাছে মিস আইএমসি ক্রাউন জেতার গল্প করছে? না করো সঙ্গে মোবাইলে ফিশফিশ করে কথা বলছে? কে সেই ছেলেটা? হাতের কাছে পেলে অভি তার দাঁত উপড়ে নেবে।
ফিক করে হেসে চিলেকোঠার ঘরে ঢোকে অভি। এত ফালতু চিন্তা না করে সোমবারই বৃন্দার সঙ্গে আলাপ জমাতে হবে। শুভস্য শীঘ্রম!
.
বৃন্দা
‘বয়েজ অ্যান্ড গার্লস। লেটস গো টু দ্য ডিসেকশান রুম।’ হাত থেকে চকের গুঁড়ো ঝেড়ে এনজি এসএলটি থেকে বেরিয়ে গেলেন। গ্যালারিতে বসে থাকা ছেলেমেয়েরা একে অন্যের দিকে তাকাল। জেমসি বৃন্দাকে বলল, ‘ক্যাডাভার! সড়া হুয়া ডেডবডি! ইইকস! আই হেট অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল।’
বৃন্দা বলল, ‘ন্যাকামি করিস না। ডাক্তারি পড়তে এসে মড়া না ঘাঁটলে চলবে?’
জেমসি গত পরশু ফ্রেসার্শ ওয়েলকামের দিন অডিয়েন্সের ঝাড় খেয়ে সামান্য শুধরেছে। হোস্টেলের মেয়েদের কাছে অল্পবিস্তর বাংলা শিখতেও শুরু করেছে।
‘মোড়া মিনস ক্যাডাভার না? পোচা!’ মুখ ভেটকে বলে জেমসি। এসএলটির দরজা থেকে সবাইকে আহ্বান জানায় মিস্টার আইএমসি সুরজ, ‘চলো, চলো দোস্তোঁ, ডরনা মানা হ্যায়। রামনাম সত্য হ্যায়।’
দেড়শো ছেলেমেয়ে সুরজের আহ্বানে গুটিগুটি এসএলটি থেকে বেরোয়। বৃন্দা জেমসিকে বলে, ‘পোচা নয়, পচা। মোড়া নয়, মড়া। ক্যাডাভারের ঠিকঠাক বাংলা হল মৃতদেহ।’
‘টু টাফ। আই প্রেফার মড়া।’ জানায় জেমসি।
ডিসেকশন রুম অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের একতলায়। পাশেই মর্গ। এই সহাবস্থান চাহিদা এবং যোগানের তত্ত্ব মেনে। মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য নবীন চিকিৎসকদের বোঝানোর জন্য অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন বেওয়ারিশ লাশের প্রয়োজন। এত বেওয়ারিশ লাশ প্রতিদিন এক জায়গাতেই জড়ো হয়। মর্গ।
তবে ছাত্রদের পড়াশুনোর জন্য যে কোনও লাশ চলবে না। রোড ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট বা মেট্রোয় আত্মহত্যা বা ট্রেনে কাটা পড়া ছিন্নভিন্ন মানবশরীর অ্যানাটমির পাঠে কাজে আসে না। যে সব বেওয়ারিশ লাশে মানব শরীর ত্রুটিহীন থাকে সেইসব লাশই অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে সাপ্লাই হবে। কিছু কিছু মানুষ এনজিও-র মাধ্যমে স্বেচ্ছায় দেহদানের অঙ্গীকার করে থাকেন। তাঁদের শরীর ডাক্তারি স্টুডেন্টদের পড়াশুনোর কাজে লাগে। তবে তার সংখ্যা কম। কেউ দেহদানের ফর্ম ফিলআপ করে থাকলেও তার মৃত্যুর পরে বাড়ির লোক চায় শাস্ত্রমতে সৎকার করতে। তারা এনজিও বা হাসপাতালে ফোন করে মৃত্যুর খবর জানায় না। এইসব কারণে ত্রুটিহীন মৃতদেহ পাওয়ার জন্য বেওয়ারিশ লাশই ভরসা।
দোতলা অ্যানাটমি বিল্ডিং-এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিচ্ছিরি একটা গন্ধে বেরোয়। বৃন্দার বমি পায়। সমীরণ গতকাল রাতে বৃন্দাকে বলেছেন, ‘ওটা ফর্মালডিহাইডের গন্ধ। এই রাসায়নিক মৃতদেহের পচন রোধ করে। দুর্গন্ধ ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।’
অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে ঢোকার পথ বিল্ডিং-এর পিছনদিকে। রাস্তার দিকের দেওয়ালে বড় বড় জানলা তারজালি দিয়ে আটকানো। সোঁদা, স্যাঁতসেঁতে বাতাসে হলঘরের পরিবেশ ভারী। মনখারাপের ঝুলকালি কুয়াশার মতো মিশে রয়েছে আবহাওয়ায়।
অ্যাপ্রন পরে, হাতে ডিসেকশান বক্স নিয়ে দেড়শো ছেলে মেয়ে হলঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। এখানে কোনও বসার জায়গা নেই। হলঘরে আটটা টেবিল পাতা। চারপায়া টেবিলের ওপরে পাথরের স্ল্যাব। স্ল্যাবগুলো আপাতত শূন্য। দু’সারি টেবিলের মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা সেইখানে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। বৃন্দা খেয়াল করল, সুরজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘অ্যানাটমি বলতে তোমরা কী বোঝ?’ ইংরাজিতে প্রশ্ন করলেন এনজি। বৃন্দা চুপ করে রইল। আশেপাশে কয়েকটা হাত উঠল পণ্ডিতি ফলানোর জন্য।
‘সুরজ। তুমি বলো।’
‘ইটস আ ডেড সাবজেক্ট।’ ক্যাজুয়ালি শ্রাগ করল সুরজ। নিজের ডাবল মিনিং রসিকতায় নিজেই একপ্রস্ত হেসে নিল।
‘অ্যানাটমিস্টরা মৃতদেহ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। শরীরে কটা হাড়, কটা পেশি, কটা শিরা-ধমনী, কটা স্নায়ু, তার চর্চা চলে। মাসল এর শুরু ও শেষ, শিরা ও ধমনীর শাখা-প্রশাখা, স্নায়ুর গতিপথ, মস্তিষ্কের গঠন—সবই লেখা আছে। মোটা মোটা বই আছে, গাদা গাদা সিডি আর অ্যাপ আছে, কম্পিউটারে তথ্য স্টোরড আছে। মানুষের শরীর গত কয়েক হাজার বছরে বিশেষ বদলায়নি। তাই সাবজেক্টও বদলায়নি। সে অর্থে এটা ডেড সাবজেক্ট। তুমি ঠিকই বলেছ সুরজ। তবে কিনা, এ-বি-সি-ডি না শিখলে বই পড়া যায় না। বর্ণপরিচয় না হলে গপপো উপন্যাস পড়া যায় না। কাজেই ডাক্তার হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হিসেবে তোমাদের মানব শরীর জানতে হবে। শরীরের প্রতিটি হাড়, মাংসপেশি, নার্ভ, আর্টারি, ভেইনের নাম জানতে হবে। পাগলের মতো মুখস্থ করতে হবে। অ্যান্ড ইউ পিপল উইল হেট মি লাইক এনিথিং।’ চুপ করেন এনজি।
‘আই হ্যাভ আ কোয়েশ্চেন স্যার।’ হাত তুলেছে সুরজ। আশকারা পেয়ে সে একটু স্মার্টনেস দেখাতে চায়।
‘বলো।’
‘আমাদের ক্লাসগুলো কীভাবে হবে? আমাদের কী গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হবে?’
‘থিয়োরি ক্লাস সবাইকে নিয়ে হবে। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের জন্য তোমাদের দেড়শোজনকে রোল নাম্বার ওয়াইজ আমি ছটা গ্রুপে ভাগ করেছি। প্রতি গ্রুপে পঁচিশজন। তোমাদের ছ’ভাগে ভাগ করেছি কারণ ক্যাডাভারকেও অ্যানাটমিকালি আমরা ছটা পার্টে ভাগ করি। তোমরা এই ছটা কার্ড নাও। এতে অ্যালফাবেটিকালি তোমাদের নাম টাইপ করা আছে।’
সুরজ এগিয়ে গিয়ে কার্ড নিল। এনজি বললেন, ‘পড়ো সুরজ। গ্রুপে এ-তে কে কে আছে?’
সুরজ পড়ছে। বৃন্দা খেয়াল করল, তার চেনা নাম বলতে গ্রুপ এ-তে অভি ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিদের সঙ্গে আস্তে আস্তে আলাপ হয়ে যাবে।
সুরজের পড়া শেষ। কার্ড ফেরত নিয়ে এনজি বললেন, ‘কোন গ্রুপ কোন পার্ট স্টাডি করবে, সেটা আমি বলে দেব। প্রতিটি পার্ট একাধিক আইটেমে বিভক্ত।’
‘আইটেম?’ মুচকি হাসে সুরজ, ‘অ্যাজ ইন আইটেম নাম্বার?’
এনজি ঠান্ডা চোখে সুরজের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রায় একইরকম। এ গ্রুপের জন্য পার্ট হল, ‘ইনফিরিয়র এক্সট্রিমিটি’ মানে পা। এই পার্টকে একাধিক আইটেমে ভাগ করা আছে। ডিসেকশান ক্লাসে তোমরা এক-একদিন এক-একটা আইটেমের ডিসেকশান করবে। বাড়িতে গিয়ে গ্রে-র অ্যানাটমি খুলে সেটা স্টাডি করবে। তারপর আমাদের কাছে আইটেমের ভাইভা দেবে। সেটা শেষ হলে পার্টের ভাইভা হবে। অর্থাৎ পুরো ইনফিরিয়র এক্সট্রিমিটির ভাইভা।’
এনজির কথার মধ্যে পাঁচজন শিক্ষক-শিক্ষিকা এসে দাঁড়ালেন। এনজি বললেন, ‘আলাপ করিয়ে দিই, এঁরা তোমাদের শিক্ষক। ডানদিক থেকে প্রথমে রয়েছেন…’
এনজি-র কথা কেউ শুনছে না। প্রত্যেকে নাক চাপা দিয়েছে। বিকট, বিবমিষা উদ্রেককারী, তীব্র দুর্গন্ধে ভরে যাচ্ছে ডিসেকশান রুম। কালুয়ার নেতৃত্বে পাঁচজন ডোম ছ’টা ডেডবডি ছটা টেবিলে শুইয়ে রাখছে।
‘আমি এ গ্রুপকে ডিসেকশান শেখাব। তোমরা টেবিল ওয়ানে চলে এসো।’ এনজি আলাপ পর্ব সেরে প্রথম টেবিলে চলে গেছেন।
দেড়শো জনের দলটা ভেঙে গেল। পঁচিশ জনের ছোট দল টেবিলগুলোকে ঘিরে দাঁড়াল। বৃন্দা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মৃতদেহের দিকে তাকাল।
বছর চল্লিশের এক নারী। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। ফর্ম্যyলডিহাইডে চুবনো থাকার ফলে শরীরে পচন ধরেনি। তবে শরীর শুকিয়ে গেছে। চোখ ঢুকে গেছে, গাল চুপসানো, কোমর সরু, হাত-পা কাঠিকাঠি, বুকের খাঁচা নৌকার দাঁড়ের মতো উঠে রয়েছে।
মহিলার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে এনজি বললেন, ‘আমরা শুরু করছি ইনফিরিয়র এক্সট্রিমিটির পার্ট। প্রথম আইটেম হল ইঙ্গুইনাল ক্যানাল।’ তারপর গ্লাভস পরা হাতে ডিসেকশান বক্স খুলে স্ক্যালপেল বার করলেন।
বৃন্দার অস্বস্তি হচ্ছে। কেন সেটা বুঝতে সামনের দিকে তাকাল। টেবিলের ওপ্রান্ত থেকে অভি তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে। বৃন্দার চোখে চোখ পড়ামাত্র দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। বৃন্দা দেখল, অভি ব্লাশ করছে। তার গাল আর কান ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে। কয়েকবার ঢোঁকও গিলল। বৃন্দা ভুরু কুঁচকে ভাবল, ব্যাপারটা কী? কৌতূহল নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে রইল।
বাঁদিকে সিঁথি করা একমাথা চুল। মায়াবী চোখ। না কামানো গালে এক-দুদিনের দাড়ি। সঙ্গে ব্রনর খানাখন্দ। নীল জিনস ও সাদা টি-শার্টে মাঝারি চেহারার ছেলেটিকে দেখলে মনে হয় সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। যুবকোচিত পৌরুষের বদলে লাবণ্যময় তারুণ্য খেলা করছে শরীরে। অভি বুঝতে পেরেছে যে বৃন্দা তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। ইঙ্গুইনাল ক্যানালের ডিসেকশান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সন্তর্পণে সে বৃন্দার চোখে চোখ রাখে। তারপর অপরাধীর মতো হাসে।
দুজনের মাঝখানে পড়ে রয়েছে বেওয়ারিশ রমণীর লাশ। বিশ্রী গন্ধ ভাসছে বাতাসে। কলকল কথা বলছে ছাত্রছাত্রীর দঙ্গল। জটিল, দাঁতভাঙা মেডিক্যাল টার্ম বলছেন এনজি। তারই মধ্যে বৃন্দা অভির দিকে তাকিয়ে হাসি ফেরত দেয়। অভির চোখমুখে অস্বাভাবিক ঔজ্বল্য ফুটে ওঠে। বৃন্দার মনে হয়, কেউ যেন সুইচ টিপে বালব জ্বেলে দিয়েছে অভির ভিতরে।
বৃন্দা ডিসেকশানে মন দেয়। এনজির সুচারু হাতের ছোয়ায় রমণীর ঊরুর উপর দিকে দেখা যাচ্ছে একটি খাত। যার নাম ইঙ্গুইনাল ক্যানাল। কোন কোন পেশি ও তন্তু দিয়ে ক্যানালের দেওয়াল তৈরি, বোঝার চেষ্টা করে সে। হঠাৎ বিকট শব্দে ডিসেকশন হল কেঁপে ওঠে।
শব্দটা এসেছে গ্রুপ এফ থেকে। হলের সবাই সেই টেবিলের দিকে তাকায়।
ক্যাডাভার দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে সুরজ। ছয়ফুটিয়া যুবক কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেছে মেঝেতে।
সাবিনা ব্যাগ খুলে জলের বোতল বার করে সুরজের মুখে ছেটাল। চারজন ডোম সুরজকে চ্যাংদোলা করে ডিসেকশন হলের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এনজি কড়া গলায় বললেন, ‘গাইজ অ্যান্ড গার্লস। তোমরা ডিসেকশানে মন দাও।’
গ্রুপ এ-র ছেলেমেয়েরা আবার টেবিল ঘিরে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চিপে এনজি বললেন, ‘আইটেম নাম্বার আর আইটেম যে এক জিনিস নয়, এটা এইবারে বুঝে গেল!’
.
রবীন্দ্র সরোবর স্টেশনে মেট্রো দাঁড়াল বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে ওপরে উঠে এস পি মুখার্জি রোডের ফুটপাথে পৌঁছে বড় শ্বাস নিল বৃন্দা। ডিসেকশান হলের দুর্গন্ধ এখনও তার শরীরে লেপ্টে রয়েছে। বাড়ি ঢুকে স্নান না করলে যাবে না।
শান্তিধামে এখন ভিজিটিং আওয়ার। বাড়ির সামনে গাদাগাদি করে ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে রয়েছে। গুচ্ছের লোকের ভিড় টপকে রিসেপশানের পিছন দিকের লিফটের বোতাম টিপল বৃন্দা। এটা প্রাইভেট লিফট। শান্তিধামের বাসিন্দা ও কর্মচারীদের জন্য।
চারতলায় পৌঁছে সোজা নিজের বাথরুমে ঢুকল বৃন্দা। আজ সে বাথটাবে স্নান করবে। কল চালিয়ে শোওয়ার ঘরে ফেরত আসে। ঝুনুর মা চা নিয়ে এসেছে। বৃন্দাকে দেখে বলল, ‘কোন নর্দমায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলে? গা দিয়ে বোকা পাঁঠার মতো বোঁটকা গন্ধ আসছে।’
‘নর্দমার থেকেও খারাপ জায়গায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম।’ ঝুনুর মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দেয় বৃন্দা। ‘আমি একঘন্টা ধরে চান করব। মাকে বলে দিও, আমাকে যেন বিরক্ত না করে।’
‘তোমার মা পাস্তা বানাচ্ছে। খাবে তো?’
‘খাবো।’ চা শেষ করে বাথরুমে ঢোকে বৃন্দা। কল বন্ধ করে বাথ-সন্ট, অ্যারোমেটিক অয়েল আর লিকুইড সোপ বাথটাবে ঢালে। ফটাফট জিনস, টি-শার্ট আর অন্তর্বাস খুলে জলে নামে। বাথটাবে পড়ার জন্য প্লাস্টিকের তৈরি কমিক্স রাখা আছে একদিকের র্যাকে। একটা কমিক্স নিয়ে পড়তে শুরু করে। আধঘণ্টা জলে বসে থাকার পরে আরও আধঘণ্টা ধরে সারা গায়ে ছোবড়া ঘষে স্নান করার পরে মনে হল গন্ধটা গেছে। বাথটাব থেকে উঠে শাওয়ারের তলায় আর এক প্রস্ত স্নান করে বৃন্দা। বাথটাবের ঝাঁঝারির ঢাকনা খুলে নোংরা জল বার করে দেয়। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে কেপরি আর টি-শার্ট পরে। ভিজে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রান্নাঘরে এসে বলে, ‘মা, খাব।’
মন্দিরার পাস্তা বানানো হয়ে গেছে। টেবিলে খাবার রেখে তিনি ঝুনুর মায়ের সঙ্গে ধোপার বাড়িতে কী কী কাপড় পাঠানো হবে, তার লিস্ট তৈরি করছেন। বৃন্দাকে দেখে বললেন, ‘এতক্ষণ ধরে স্নান করলি? ঠান্ডা লাগলে?’
‘আজকে ডিসেকশান শুরু হল। এখন থেকে আমি রোজ দুবেলা চান করব।’ পাস্তার থালা হাতে বলে বৃন্দা।
‘তার মানে ধোপার খরচ বাড়বে’।
‘তুমি এত কিপটে কেন বলো তো?’ মন্দিরাকে ধাঁতানি দেয় ঝুনুর মা। ‘রাজরানির মুখে এসব কথা মানায় না। তোমাদের পয়সা খাবে কে?’
‘আর যেই খাক না কেন, ধোপাকে বা তোমাকে খেতে দেব না।’ মৃদুস্বরে ঝুনুর মাকে ভর্ৎসনা করেন মন্দিরা। পাস্তা চিবোতে চিবোতে বৃন্দা দেখে মন্দিরার কোলে একটা ফোটো অ্যালবাম রাখা রয়েছে। এগুলো পুরনো জমানার অ্যালবাম। প্রি-ডিজিটাল যুগে লোকে ছবি প্রিন্ট করে অ্যালবামে সাজিয়ে রাখত।
টক করে অ্যালবামটা তুলে নেয় বৃন্দা। এটা কয়েক বছর আগে তার দেখা।
‘ওটা তোর দেখা।’ বিব্রত হয়ে বলেন মন্দিরা।
‘আর একবার দেখব।’ অ্যালবাম আর পাস্তার থালা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দ্য লোনলি ওয়াইফের অতীতে ডুব দেয়।
কালো, খসখসে, হ্যান্ডমেড পেপারের ওপরে আটকানো অজস্র ছবি। অধিকাংশই রঙিন। অল্প কিছু সাদাকালো ছবি আছে। আছে মন্দিরা অভিনীত সব সিনেমার রিভিউ, ইনভিটেশান কার্ড, লবি-কার্ড, পোস্টারের ফোটো, ফিল্মি জগতের মানুষদের চিঠিচাপাটি। এক কালের বাংলা ফিল্ম ইনডাস্ট্রির ডাকসাইটে হিরোইনের ‘অভিনয়-সমগ্র’ বলা যেতে পারে এই অ্যালবামকে। বৃন্দা জানে, মন্দিরার কাছে সব ছবির ডিভিডি আছে। মোট ন’টি ছবিতে অভিনয় করে অবসর নিয়েছিলেন তিনি।
মন্দিরার প্রথম ছবি ‘বেপাড়ার মেয়ে।’ মহানায়ক প্রদীপকুমারের সঙ্গে নবাগতা মন্দিরাকে চমৎকার মানিয়েছিল। গোল্ডেন জুবিলি পার্টিতে ওয়াইন গ্লাস হাতে, কাঞ্জিভরম পরা মন্দিরাকে দেখে মুগ্ধ বৃন্দা।
দ্বিতীয় ছবির নাম ‘প্রত্যাঘাত’। মুম্বইয়ের বাঙালি বিনোদ চক্রবর্তীর পরিচালনা। তিনজন হিরোর ছবি। তিন হিরোইনের রোল গানের দৃশ্যে তাদের কাঁচুলির থেকেও ছোট। রোলের দৈর্ঘ যেমনই হোক না কেন, ছবিটা ভালোই ব্যবসা দিয়েছিল। বিনোদ চক্রবর্তীর লেখা একটি চিঠি মন্দিরা ল্যামিনেট করে অ্যালবামে আটকে রেখেছেন। যশ চোপড়া মন্দিরার অভিনয় দেখে ইমপ্রেসড—এমন কথা চিঠিতে লেখা আছে।
তৃতীয় ছবির নাম, ‘সানাই’। অতীতের নামি পরিচালক অজিত রায়ের শেষ ছবি। হিরো আবারও প্রদীপকুমার। তবে এই ছবিটা চলেনি। গ্রাম বাংলার পটভূমিকায়, এক বিয়েবাড়িতে আসা বরের বন্ধু আর কনের বোনের প্রেম কাহিনি পাবলিক খায়নি। ‘সানাই’ বৃন্দার দেখা। খুব খারাপ সিনেমা। ছবিটার স্ক্রিপ্ট খারাপ, মিউজিক জঘন্য, লাইটিং অ্যামেচারিশ, মেকআপ যাত্রার মতো। প্রদীপকুমার যাত্রার হিরোদের মতো চড়া দাগের অভিনয় করেছে। যার পাশে মন্দিরার আন্ডার অ্যাক্টিং একদম মানায়নি। এই ছবি ফ্লপ করায় হার্ট অ্যাটাক করে অজিত রায় মারা যান। তাঁর শ্রাদ্ধের আমন্ত্রণপত্র সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন মন্দিরা।
মন্দিরার পরের তিনটি ছবি বাম্পার হিট। বিনোদ চক্রবর্তীর ‘প্রত্যাশা’, আর্ট ফিল্ম করিয়ে জিনিয়া দাশগুপ্তর ‘স্বপ্নের বারান্দা’, নবীন পরিচালিক জুটি শামিম-অজন্তার ‘রাতপরি’। ‘প্রত্যাশা’ গোল্ডেন জুবিলি করেছিল। আজও টিভিতে দেখালে চ্যানেলের টিআরপি বেড়ে যায়। মফসসলের মেয়ের শহরে এসে স্ট্রাগল করার গল্প। ছবিটা দেখতে দেখতে বহুবার কেঁদেছে বৃন্দা।
‘স্বপ্নের বারান্দা’-ও বৃন্দার প্রিয় ছবি। জিনিয়া নারীকেন্দ্রিক ছবি করেন। আদ্যন্ত ফেমিনিস্ট ছবি বানিয়ে বলেন, ‘আমি ফেমিনিস্ট নই, আমি হিউম্যানিস্ট।’ কলকাতার এক অধ্যাপিকা স্বপ্নে একটি বারান্দা দেখতে পান। ঘর বা বাহির নয়, শুধু একটি বারান্দা। সেই বারান্দার সন্ধানে বেরোন তিনি। এই জার্নি নিয়েই ছবি। দেশে ব্যবসা করতে না পারলেও বিদেশের একাধিক ফেস্টিভালে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। আন্তর্জাতিক ফিল্ম মার্কেটে ছবিটি ভালো দাম পায়। প্রোডাকশান কস্ট বহুকাল উঠে গেছে। নতুন নতুন দেশে ছবিটা আজও বিক্রি হয়। প্রযোজক আজও টাকা পান।
‘রাতপরি’ টিপিক্যাল মশলা-মুভি। হাই সোসাইটি কল-গার্লের রোল। ‘হোর উইদ আ গোল্ডেন হার্ট’ ফরমুলা যুগে যুগে হিট। দেবদাসের চন্দ্রমুখী সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ‘রাতপরি’তে মন্দিরার লিপে মিশা ধাবোলকারের গলায় ছটা গান ছিল। ক্যাবারে সং, লুলাবাই, রোম্যান্টিক ডুয়েট, মীরার ভজন, স্যাড সং—কী নয়! পুজোর মণ্ডপে গানগুলো আজও বাজে। বাঙালি নস্ট্যালজিয়া আর গানগুলো সমার্থক।
মন্দিরার সাত ও আট নম্বর ছবি হিন্দিতে। ‘আখরি জানবাজ’ বিনোদ চক্রবর্তীর ছবি। মালটিস্টারার এবং ফ্লপ। ‘তেরে খোয়াইশ’ সুপারহিট ডিরেক্টার মদনমোহন ভাটের ছবি এবং সুপার-ডুপার হিট। মন্দিরা মুম্বইতে শিফট করবেন, এরকমটা প্রায় ঠিক। যশ চোপড়ার সঙ্গে পরের ছবির কনট্র্যাক্ট সাইন হবে, এমন সময় মনোতোষের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্যামি ব্যানার্জির সঙ্গে আলাপ হল মন্দিরার। প্রেম করতে করতে ন’নম্বর ছবিটা করেছিলেন মন্দিরা। মনোতোষের পরিচালনায় মন্দিরার অন্তিম ছবি, ‘অচেনার ডাক’। এ ছবিও বক্স অফিসে যথেষ্ট সফল। পারিবারিক মেলোড্রামায় একাধিক নামকরা, জাঁদরেল অভিনেতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর কমিক টাইমিং-এর প্রশংসা করে সমালোচকরা বলেছিল, ‘ভারতীয় সিনেমা শুধু স্টার নয়, একজন চরিত্রাভিনেতাও পেয়েছে। ব্যবহারের দায়িত্ব পরিচালক ও প্রযোজকদের।’
পরিচালক ও প্রযোজকরা মন্দিরাকে আর পায়নি। অচেনার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তখন ঘরের বউ।
অ্যালবাম দেখতে দেখতে কত সময় কেটে গেছে খেয়াল করেনি বৃন্দা। হঠাৎ খেয়াল করল, ঘরের মধ্যে পরিচিত একটা গন্ধ। তামাক, অ্যালকোহল, আফটার শেভ, ডিওডোর্যান্ট আর নতুন ইস্ত্রি করা জামাকাপড়ের গন্ধ। বাবার গন্ধ।
ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ। অন্ধকার নেমে আসায় মাথার কাছের টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নিয়েছিল বৃন্দা। ল্যাম্পের আলো বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। আলোকবৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করেছে স্যামির পা।
‘বাবা!’ নিচু গলায় বলে বৃন্দা। ‘কটা বাজে গো?’
‘দশটা!’ জড়ানো গলায় জবাব দেন স্যামি, ‘খেতে চল।’
‘এত রাত হয়ে গেল?’ অ্যালবাম বালিশের পাশে রাখে বৃন্দা। সাতটা নাগাদ অ্যালবাম নিয়ে বসেছিল। ছবি দেখতে দেখতে তিনঘণ্টা পার করে দিল?
‘কলেজ থেকে ফিরতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?’ প্রশ্ন করেন স্যামি। আজ বাবা আর মেয়ে মৌলালি পর্যন্ত একসঙ্গে গেছে। মৌলালিতে গাড়ি থেকে নেমে বাকি রাস্তা হেঁটে গেছে বৃন্দা। কলেজ থেকে ফেরার সময় বৃন্দা ব্রেকজার্নি করেছে। ট্রামে উঠে ধর্মতলায় এসে মেট্রো ধরেছে। ভিড় বাসে ওঠার অভ্যাস এখনও হয়নি।
‘অসুবিধে হচ্ছে না। তুমি কাপড় জামা ছাড়বে না?’ স্যামির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে প্রতিপ্রশ্ন করে বৃন্দা। ঘরের আলো জ্বেলে দেয়।
‘ছাড়ব।’ অ্যালবাম হাতে নিয়ে স্যামি বলেন, ‘মায়ের পাস্ট সাকসেসের ছবি দেখছিস? আমার আজকের সাকসেস স্টোরি শুনলে অবাক হয়ে যাবি।’
বৃন্দা ভুরু কুঁচকে স্যামির দিকে তাকায়। স্যামির গোটা জীবনটাই সাফল্যে ভরপুর। স্কুলে, কলেজে, স্বদেশে, বিদেশে, সরকারি হাসপাতালে, বেসরকারি নার্সিং হোমে—সর্বত্র। সেই লোক বউয়ের অতীতের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত বোধ করছেন? যাচ্চলে! স্যামির হাত ধরে বৃন্দা ডাইনিং স্পেসে নিয়ে আসে। মন্দিরা খাবার টেবিলে বসে রয়েছেন। হাতে ফিল্ম ম্যাগাজিন। বৃন্দা বলল, ‘বাবা, আমরা আগে খেয়ে নিই। তারপর তুমি জামাপ্যান্ট ছেড়ো।’
‘না। আমি আসছি।’ অ্যালবাম নিয়ে মাস্টার বেডরুমে ঢুকে যান স্যামি। মিনিট দশেক বাদে স্নান সেরে, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে, গায়ে পারফিউম ছড়িয়ে বেরোন। চেয়ারে বসে বৃন্দাকে বলেন, ‘ফিল্ম অ্যাকটর বা অ্যাকট্রেস দেখলে অত এক্সাইটেড হোস কেন? দে আর অ্যাভারেজ পার্সন। রোগবালাই হলে ডাক্তারদের কাছেই আসতে হয়। আমার কাছে যেমন চন্দ্রিমা এসেছে। আজই ওর অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করলাম।’
ঝুনুর মা খাবার দিয়েছে। ডালে রুটি ডোবাতে গিয়ে স্যামির দিকে তাকাল বৃন্দা। চন্দ্রিমার অপারেশন স্যামি করেছেন সপ্তাহখানেক আগে। যেদিন বৃন্দা কলেজে জয়েন করল, তার আগের সন্ধ্যায় চন্দ্রিমাকে শান্তিধাম থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। স্যামি সেটা ভুলে গিয়েছেন? অত্যধিক মদ্যপান করলে স্মৃতিভ্রম হয়। অ্যালকোহলিকরা বানানো গপপো বলে স্মৃতির শূন্যস্থান পূর্ণ করে। স্যামির কি তাই হল?
নাকি এ এক ধরনের জেলাসি? কলকাতা শহরের সফলতম শল্য চিকিৎসক তার স্ত্রীকে ঈর্ষা করছেন? যে স্ত্রী অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন আজ থেকে কুড়ি বছর আগে? হাস্যকর ব্যাপার!
বৃন্দা দেখল স্যামি স্যালাডের বোল থেকে চামচ দিয়ে শসা তুলছেন। চামচ ধরা স্যামির হাত থরথর করে কাঁপছে।
হাত কাঁপা বা ট্রেমরও অ্যালকোহলিজমের লক্ষণ। সার্জনের হাত কাঁপা মানে কেরিয়ারের পতনের শুরু।
বৃন্দা আড়চোখে মন্দিরার দিকে তাকায়। মন্দিরাও স্যামির কম্পমান হাত দেখছেন। তাঁর দুচোখে বিষণ্ণতা কাজলের মতো লেপটে রয়েছে। মাথা নিচু করে রুটি চিবোতে চিবোতে বৃন্দা ভাবে, বাবার শিল্পী বন্ধুদের এই বাড়িতে ঢোকা বন্ধ করতে হবে। ‘থ্রি উইচেস’ সুদিন, বিপিন আর মনোতোষের জন্যই স্যামির এই হাল!
‘তোমার কাল ওটি আছে। এইরকম ট্রেমর নিয়ে কাজ করবে কী করে?’ স্যামির হাত থেকে চামচ নিয়ে তার পাতে স্যালাড তুলে দেন মন্দিরা। স্যামি এক কুচি শসা মুখে পুরে বলে, ‘আগামী এক সপ্তাহ প্ল্যানড ওটি বন্ধ। তাপসী দেশে যাচ্ছে।’
‘তাপসী না থাকলেও অন্য ওটি সিস্টার তো আছে।’
‘তা আছে। তবে কুনালও বাড়ি যাচ্ছে। নার্সিংহোমের মেট্রন এবং আরএমও থাকবে না বলে নেক্সট উইকে ওটি রাখা হয়নি।’
বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনতে শুনতে বৃন্দা ভাবছিল, মন্দিরা এইবার মদ্যপান প্রসঙ্গে স্যামির তিন বন্ধুর কথা বলবে? মন্দিরা সে প্রসঙ্গে গেলেন না। তার বদলে বললেন, ‘মনোতোষদা আজ ফোন করেছিল।’
‘কেন?’ খাওয়া বন্ধ রেখে জ্বলজ্বলে চোখে মন্দিরার দিকে তাকান স্যামি।
‘জানি না। ঝুনুর মা ফোন ধরেছিল। আমি তখন বাথরুমে ছিলাম।’ খাওয়া শেষ করে চেয়ার থেকে উঠেছে মন্দিরা।
বৃন্দা দেখল, স্যামি রুটি ছিঁড়ছেন। তাঁর হাতের আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপছে।
.
চন্দন
অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল শুরু হয়েছিল গত সোমবার। ফিজিওলজি প্র্যাকটিকাল শুরু হবে আজ। শনিবার। হোস্টেলাইটরা যখন বাড়ি ফেরার জন্য লাফাচ্ছে। বিশেষত চন্দন।
একশো পঁচিশ নম্বর ঘরে চন্দন অ্যাডজাস্ট হয়ে গেছে। প্রথম দিনের র্যাগিং কতটা মেন্টাল ট্রমা ঘটিয়েছে তা বোঝার উপায় নেই। রিপু আর লাটুর মতো দুই জাঁদরেল সিনিয়রের সঙ্গে দিব্যি আছে। নিজেই ঝাড়ু দিয়ে মেঝে ঝাঁট দিয়েছে, ন্যাতা দিয়ে মুছেছে, ঝুলঝাড়া দিয়ে ঝুল ঝেড়েছে। খাটের ওপরে পাঁজা পাঁজা ‘জনমত’ জমা হয়ে ছিল। কাগজ বেচে তিনশো টাকা পেয়েছে। সেই টাকার সঙ্গে আরও পাঁচশো টাকা যোগ করে শিয়ালদার ফুটপাথ থেকে সস্তার কাপড় কিনে জানলা দরজার পর্দা বানিয়েছে। রিপুর আর লাটুর বই কাবার্ডে সাজিয়ে রেখেছে। প্ল্যাকার্ডগুলো ঢুকিয়ে রেখেছে খাটের তলায়। মিটিং করার জন্য আনা চেয়ারগুলো একশো চব্বিশে শিফট করে দিয়েছে। টিনটিন আপত্তি করেছিল। চন্দন মোল্ডেড প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো একটার ওপরে আর একটা রেখে দড়ি দিয়ে বেঁধে ওর খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। টিনটিনকে প্রমিস করেছে, যতবার মিটিং হবে, ততবার চেয়ার পাতা ও তুলে রাখার দায়িত্ব তার।
গত এক সপ্তাহে কোনও মিটিং হয়নি। চন্দন আসার আগে একশো পঁচিশ ছিল অফিস ঘর। যে কেউ যখন খুশি ঢুকে পড়ত, যতক্ষণ খুশি থাকত, মেঝেয় সিগারেটের ছাই ফেলত, আলো পাখার সুইচ অফ না করে চলে যেত। সব সময় দরজা হাট করে খোলা। নোংরা অফিস ঘরে এইরকম আচরণ করতে বাধত না।
চন্দন যতক্ষণ ঘরে থাকে, করিডোরের দিকের জানলা ও দরজা বন্ধ রাখে। অন্তত তিনবার না ধাক্কালে দরজা খোলে না। কেউ সিগারেট খেলে অ্যাশট্রে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘বস, এইটাতে মাল ফেলো। বাইরে ফেলো না।’ কেউ রিপু বা লাটুর খাটে ঠ্যাং তুলে বসলে বলে, ‘বস, ওরা তো এখন নেই। আমি একটু পড়ছিলাম। তুমি হেল্প করবে? হার্টের ব্লাড সাপ্লাই মাথায় ঢুকছে না। সুপিরিয়র করোনারি আর্টারির কোর্সটা একটু বোঝাও না!’
প্রতিক্রিয়া হয় নানাবিধ। দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনও উত্তর না পেয়ে অনেক ছেলে চলে যায়। অনেকে দমাদম লাথি মারে। বান্টি এবং সুব্রতর ফেভারিট কাজ দরজায় লাথি মারা। দরজা বন্ধ রাখার জন্য মঙ্গল এবং বুধবার সুব্রতর কাছে থাপ্পড় খেয়েছে চন্দন। বৃহষ্পতিবার রিপু দুপুরবেলায় ঘুমোচ্ছিল। তখন দুজনে মিলে লাথি মারার বদলে দরজার তলা দিয়ে বালতি বালতি জল ঢেলেছে। সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ। ঘুম থেকে উঠে, সদ্য সাফসুতরো হওয়া ঘরের অবস্থা দেখে রিপু খচে বোম! বান্টি আর সুব্রতকে বেদম ঝাড় দিয়েছে। তারপর থেকে দরজায় লাথালাথি বন্ধ।
সিগারেটখোরদের জন্য অ্যাশট্রের ট্রিকও সফল। মেঝেয় ছাই ফেলা বন্ধ হয়েছে। চন্দন নিজে সিগারেট খাচ্ছে বলে, মেঝে পরিষ্কার রাখার নৈতিক দায়িত্ব তার।
সিগারেট খাওয়া নিয়ে ধন্দে আছে সে। কেন স্মোক করছে নিজেই জানে না। থেকে থেকে কনফিডেন্সের অভাব বোধ করে। তখন হাত সুড়সুড় করে, ঠোঁট সুলসুল করে, মনে হয় আঙুলের ফাঁকে সাদাকাঠি থাকলে শিরদাঁড়া শক্ত হবে। একা থাকতে বোর লাগলেও সিগারেট খুব হেল্পফুল। পাঁচ-সাত মিনিট আরামসে কেটে যায়। তবে নেশার জন্য খরচ আছে। এক প্যাকেট সিগারেটের দাম পঁয়ত্রিশ টাকা। দুদিনে উড়ে যাচ্ছে। কেউ চাইলে ‘না’ বলা যায় না। চন্দন ঠিক করেছে বিড়ি ট্রাই করবে। জীবনদার ক্যান্টিনে’র ‘স্টুডেন্ট বিড়ি’ দারুণ পপুলার। বিড়ির নাম ‘স্টুডেন্ট’ কেন, এই নিয়ে জীবনদার একটা তত্ত্ব আছে। বিড়িটা ছোট। আড়াই টানে শেষ হয়ে যায়। দু’টান দেওয়ার পরে স্টুডেন্ট যখন দেখে যে টিচার আসছে, তখন হাফ সুখটান দিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ে।
একশো পঁচিশে যারা আড্ডা মারতে আসে তাদের পড়াশুনোর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। সেমিস্টারের আগের পনেরো দিন গাঁতিয়ে পড়ে পাস করে যায়। চন্দনের অভ্যাস হল দিনে অন্তত ছ’ঘন্টা পড়া। যতক্ষণ সে হোস্টেলে থাকে, লেখাপড়া নিয়ে থাকে। অ্যানাটমির দাঁতভাঙা নাম মুখস্থ করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। সিনিয়র দাদাদের কাছে পড়াশুনো সংক্রান্ত হেল্প চাইলেই তারা খিস্তি করতে করতে পালায়।
আজ সকালে একটাই থিয়োরি ক্লাস। বায়োকেমিস্ট্রি। আরতি মুখার্জির ভাট শুনতে চন্দনের আগ্রহ নেই। সে প্রবালকে বলে দিয়েছে প্রক্সি দেওয়ার জন্য। দেড়শো জনের ক্লাসে অ্যাটেন্ডান্সের সময় যে কেউ ‘ইয়েস ম্যাম’ বলে দিলে এএমের পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। ফিজিওলজি প্র্যাকটিকালে নার্ভ কনডাকশন সংক্রান্ত কিছু একটা হবে। সেটা পড়া যাক। স্নান খাওয়া করে ব্যাগ গুছিয়ে এগারোটার সময় বেরোবে। ক্লাস শেষ করেই হাওড়া স্টেশনের দিকে দৌড়।
ফিজিওলজি প্র্যাক্টিকাল ক্লাস অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর চারতলায়। ছ’তলা এই বিশাল বিল্ডিংটি তৈরি শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। স্বাস্থ্য দফতরের অর্কমণ্যতা, ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের কিপটেমি, পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের আলসেমি —যে কোনও একটি, দুটি, তিনটি বা সবকটি কারণেই বিল্ডিংটি শেষ হয়েছে দশ বছর বাদে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নানা ডিপার্টমেন্টের প্র্যাকটিকাল ক্লাস এই বিল্ডিং-এ চলে এসেছে। কলেজের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিও অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এ। অবশ্য অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্ট আসেনি। এলে ক্যাডাভারের দুর্গন্ধে বাকি ডিপার্টমেন্টগুলো পালাবে।
অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরের ক্যান্টিনে একবার উঁকি মেরে লিফটে চড়ে চন্দন। এগারোটা বাজে। দেরি করলে পিএম দাঁত খিঁচোবে।
প্র্যাকটিকাল ক্লাসরুমে ঢুকে চন্দন দেখল, জনাতিরিশেক ছেলেমেয়ে রয়েছে। শনিবার বলেই বোধহয়, বেশির ভাগ স্টুডেন্ট পালিয়েছে। পার্বতী মুখার্জি ওরফে পিএম চন্দনকে বললেন, ‘এসো। আজ আমরা হিমাটোলজি প্র্যাকটিকাল করছি।’
যা! জিভ কাটে চন্দন। বোকার মতো স্নায়ুতন্ত্র পড়ে এসেছে সে।
‘কী হল? জিভ কাটছিস কেন?’ পাশ থেকে বলে বৃন্দা।
‘আমি হিমাটোলজি পড়ে আসিনি।’
‘তো?’
‘না…মানে…আগে থেকে পড়ে না এলে আমার একটা প্রবলেম হয়!’
‘তুই আর ক্লাস টুয়েলভের ফার্স্ট বয় নেই। প্রতি ইভেন্টে ফার্স্ট হওয়ার প্রবণতা বন্ধ কর।’
‘চেষ্টা করব।’ বিড়বিড় করে চন্দন।
‘নো সাইড টক!’ পিএম ধমক দেয় চন্দন আর বৃন্দাকে। ‘আজ আমরা স্লাইডে ব্লাড স্মেয়ার টেনে সেটাকে স্টেইন করা শিখব। ব্লাড স্লাইড কেন দেখা হয়? কে বলতে পারবে?’
‘আমি,’ হাত তোলে চন্দন। ‘ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট দেখার জন্য।’
‘আর কিছু?’
চন্দন চুপ করে থাকে। এদিক ওদিক থেকে টুকরো টাকরা উত্তর আসছে। কেউ বলছে, ব্লাড ক্যানসার, কেউ বলছে থ্যালাসেমিয়া, কেউ বলছে অ্যানিমিয়া। গুঞ্জন শেষ হলে পিএম বললেন, ‘কী দেখব সেটা পরে ভাবব। কী ভাবে দেখব সেটা আলোচনা করা যাক। তোমাদের আমি দুটো গ্রুপে ভাগ করছি। একদল হবে ভলান্টিয়ার, যারা ব্লাড দেবে। অন্যরা সেই ব্লাড থেকে স্লাইড টানবে। এরপরে রোল রিভার্সাল হবে। যারা ফার্স্ট রাউন্ডে ভলন্টিয়ার হতে চাও তারা হাত তোলো!’
কেউ হাত তুলল না।
‘কেউ যখন হাত তুলছ না, আমি তাহলে ভলান্টিয়ার বেছে নিচ্ছি,’ ভ্যাম্পায়ারের মতো বাঁকা হেসে, চন্দনের দিকে তাকিয়ে পিএম বললেন, ‘ভালো ছেলে, তুমি এসো।’
‘আমার নাম চন্দন সরকার।’ এক পা এগিয়ে বলে চন্দন।
‘আমি ওর সঙ্গে থাকছি।’ বৃন্দাও এক পা এগিয়ে আসে।
‘ওকে! এই ভাবে বাকিরা দুটো গ্রুপে ভাগ হয়ে যাও।’ পিএম নির্দেশ দিলেন। ‘পরিষ্কার গ্লাস স্লাইড আর স্টেরাইল নিডল প্রতি ডেস্কে রাখা রয়েছে। কীভাবে করবে দেখে নাও।’ নিজের বাঁ হাতের তর্জনীর ডগায় ডান হাত দিয়ে তড়িৎ গতিতে সূচ ফোটালেন পিএম। তর্জনীর ডগায় ফুটে উঠল প্রবাল রঙের রক্ত বিন্দু। স্লাইডে আঙুল স্পর্শ করিয়ে আঙুল তুলে নিলেন। স্লাইডের এক প্রান্তে এখন এক বিন্দু রক্ত আঁকা রয়েছে। লিউকোপ্লাস্ট আঙুলে সেঁটে পিএম বললেন, ‘ব্যাপারটা এতটাই সহজ। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
চন্দন অবাক হয়ে দেখছিল। মহিলার যন্ত্রণাবোধ বলে কিছু নেই নাকি? নিজের আঙুলে সূচ ফোটালেন। মুখের একটা পেশিও কাঁপল না। চন্দনের তো এখনই মুখ শুকিয়ে আসছে। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। একটা সিগারেট…
‘এই দ্যাখো! এই ভাবে ব্লাড স্মেয়ার টানতে হয়।’ স্লাইডে রক্তের পাতলা লেয়ার তৈরি করেছেন পিএম। ‘এরপর এই ব্লাড ফিল্মকে বাতাসে শুকিয়ে নিয়ে স্টেইন করব। কিন্তু সেটা পরে হবে। আগে তোমরা স্মেয়ার টানো। চন্দন, এগিয়ে এসো।’
চন্দন ইতস্তত করছিল। পিএম ধমক দেওয়ার আগেই বৃন্দা চন্দনের হাত ধরে ডেস্কের কাছে নিয়ে গেল। র্যাগিং-এর সময় যেভাবে হাত ধরে টেনেছিল, অবিকল সেইভাবে। চন্দনের হাতে নিডল তুলে দিয়ে বলল, ‘প্রিক কর!’
‘কী করব?’ নিডল নিয়ে বোকার মতো বলে চন্দন।
‘প্রিক কর! আই মিন, সূচটা আমার আঙুলে ফোটা। পিএম যেমন করলেন।’ ফিশফিশ করে চন্দনকে ধমকায় বৃন্দা, ‘এত গাম্বাট হলে কী করে হবে? তাড়াতাড়ি কর! না হলে পিএম আমাকে বলবেন তোর আঙুলে সূচ ফোটাতে।’
চন্দনের দু আঙুলের ফাঁকে সূচ থরথর করে কাঁপছে। বৃন্দার ডান হাতের তর্জনী নিজের হাতে নিয়ে সে বলল, ‘আমাকে কেন বারবার সেভ করছিস?’
‘বেশ করছি। তোর কী?’ চন্দনের হাত থেকে সূচ নিয়ে নিজের তর্জনীর ডগায় গেঁথে দেয় বৃন্দা। ব্যথায় শিউরে উঠে দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। চন্দন দেখে বৃন্দার দু’চোখের কোলে জল টলটল করছে।
‘কেন করলি এরকম?’ বৃন্দার হাত চেপে ধরেছে চন্দন।
‘ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফেরার তাড়া আছে বলে।’ চন্দনের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলে বৃন্দা, ‘তাড়াতাড়ি চারটে স্লাইড টান। আমায় লিউকোপ্লাস্ট দে। নিজের আঙুলের লিউকোপ্লাস্ট লাগা। কুইক।’
বৃন্দার প্ল্যান বুঝতে পেরেছে চন্দন। সেটা কার্যকর করতে হলে, সব কিছু দ্রুত করতে হবে। কেন না প্র্যাকটিকাল রুমে পিএম পায়চারি করছেন পেয়াদার মতো। আপাতত তিনি একদম পিছনের ডেস্কে। সেখান থেকে এখানে আসতে বিশেষ সময় লাগবে না। তার মধ্যে চন্দন কি পারবে চারটে স্লাইডে নিখুঁত স্মেয়ার টানতে?
বৃন্দার তর্জনী টেনে নিয়ে ছটা স্লাইডে ঠেকায় চন্দন। সবকটা স্লাইডেই কম বেশি রক্তবিন্দু এসেছে। দুটো লিউকোপ্লাস্ট ছিঁড়ে একটা বৃন্দার তর্জনীতে লাগায়। একটা নিজের তর্জনীতে। নতুন একটা স্লাইড বৃন্দার হাতে ধরিয়ে বলে, ‘তুই তিনটে স্মেয়ার টান। আমি তিনটে টানছি।’
স্মেয়ার টানার কাজটা যত সোজা ভেবেছিল চন্দন, তত সোজা নয়। প্রথম স্লাইডের ওপরে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। সেটা নষ্ট হল। দ্বিতীয় স্লাইডের স্মেয়ার টানতে গিয়ে চন্দন স্লাইড মেঝেয় ফেলে দিল। সেটা ভেঙে গেল। সবেধন নীলমণি তিন নম্বর স্লাইডে কোনওরকমে স্মেয়ার টানল সে। দেখে মনে হচ্ছে রক্তের ওপরে ন্যাতা বুলোনো হয়েছে। এই স্মেয়ার দেখে পিএম তাকে বেদম ধাঁতানি দেবেন!
পিএম এখন তাদের পিছনে। বৃন্দাকে প্রশ্ন করছেন, ‘কেমন স্মেয়ার টানলে দেখি?’
‘এই যে ম্যাডাম,’ টেবিল রাখা দুটো স্লাইড দেখায় বৃন্দা। পিএম বৃন্দার স্মেয়ার পর্যবেক্ষণ করে বলেন, ‘নট ব্যাড! তোমার পার্টনার কেমন স্মেয়ার বানাল? শ্রীমান চন্দন?’
‘এই যে ম্যাডাম!’ রক্তের ন্যাতা বোলানো স্লাইডের দিকে আঙুল দেখায় চন্দন, ‘খুব একটা ভালো হয়নি।’
‘কে বলল ভালো হয়নি? বিউটিফুল স্মেয়ার হয়েছে। তোমার তো চমৎকার হাত হে!’ চন্দনের স্লাইড চোখের সামনে এনে পর্যবেক্ষণ করছেন পিএম।
অবাক হয়ে তাকাল চন্দন। ম্যাডামের হাতে ন্যাতা বোলানো স্লাইড নেই। অন্য একটা স্লাইড রয়েছে। ডেস্কের দিকে আড়চোখে তাকায় চন্দন। তার টানা স্মেয়ার ট্রে-র আড়ালে পড়ে রয়েছে। এবার বৃন্দার দিকে তাকায় চন্দন। বৃন্দা চোখের ইশারায় তাকে চুপ করে থাকতে বলছে।
এতক্ষণে বুঝতে পারে চন্দন। বৃন্দা তিনটে স্লাইড টেনেছিল। ম্যাডামকে দুটো দেখিয়েছে। যেটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে, সেটা চন্দনকে দিয়েছে। লেখাপড়ার ব্যাপারে অন্যর কৃতিত্বকে নিজের বলে চালাতে কোনওদিনও শেখেনি চন্দন। কিন্তু আজ এই ঘটনা তার মন্দ লাগছে না।
‘বয়েজ অ্যান্ড গার্লস! এবার আমরা স্লাইড স্টেইন করা শিখব। মাইক্রোস্কোপের তলায় লিশম্যান স্টেইন করা স্লাইড দেখে চিনব লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা এবং অনুচক্রিকা। লিশম্যান স্টেইন নামটা এসেছে উইলিয়াম বুগি লিশম্যান থেকে। লিশম্যান একজন স্কটিশ প্যাথলজিস্ট যাঁর জন্ম গ্লাসগোতে। ব্রিটিশ আর্মিতে চাকরি করতেন এবং ইন্ডিয়াতেও এসেছিলেন। ওঁর তৈরি লিশম্যান স্টেনে রাঙানো স্লাইড দেখেই কলকাতা শহরে বসে স্যার রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়ার মশার জীবনচক্র আবিষ্কার করেছিলেন।’
প্রবাল কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘ম্যাডাম, আজকে ছেড়ে দিন না! এক সপ্তাহ বাড়ি যাইনি। আজ শনিবার।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম! আজ ছেড়ে দিন। প্লিজ!’ সমবেত গুঞ্জন ওঠে ফিজিওলজি প্র্যাকটিকাল রুম থেকে।
‘ঠিক আছে। আজ স্মেয়ার টানা শিখলে। আগামী বুধবার স্টেইন করা শিখবে। যাও। আজ ছুটি।’ পিএম প্র্যাকটিকাল রুম থেকে বেরিয়ে যান। বৃন্দা চন্দনকে বলে, ‘আঙুল থেকে লিউকোপ্লাস্ট খুলে ফেল। অনেক অ্যাক্টিং করেছিস।’
চন্দন বৃন্দার দিকে তাকিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে, ‘আমি অ্যাক্টিং করতে পারি না। অ্যাক্টিং করছিস তুই।’
‘আমি?’ চড়াত করে নিজের তর্জনী থেকে লিউকোপ্লাস্ট খুলে বৃন্দা বলে, ‘সূচেরদাগটা অ্যাক্টিং বুঝি?’
‘জানি না।’ ফিজিওলজি প্র্যাকটিকাল রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলে চন্দন।
.
মেচেদা স্টেশনে চন্দন নামল দুপুর আড়াইটার সময়। কলেজ থেকে বেরিয়ে শিয়ালদা কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্টেটবাসে উঠে হাওড়া স্টেশানে আসতে সময় লেগেছে আধঘণ্টা। দুপুরে মহাত্মা গাঁধী রোড মোটামুটি ফাঁকা থাকে। বড়বাজার এলাকায় সরু রাস্তা, একাধিক সিগন্যাল, ট্রামলাইন আর বেআইনি পার্কিং-এর কারণে বাঘমার্কা স্টেটবাসও কচ্ছপের গতিতে চলে। হাওড়া ব্রিজে উঠে লেট রান মেকাপ করে নেয় বাস।
দুপুরের মেচেদা লোকাল একদম ফাঁকা। গোটা কামরায় দুটো লোক। সিটে শুয়ে, মাথার নীচে ব্যাকপ্যাক রেখে চন্দন একপ্রস্ত ঘুমিয়ে নিল। বাগনান স্টেশনে একগাদা স্কুলছাত্রী উঠল। তাদের বসার জায়গা দিতে গিয়ে চন্দনের ঘুম ভেঙে গেল। বেজায় খিদে পেয়েছে। তিন টাকা দিয়ে এক প্যাকেট বাদাম কেনে চন্দন। এই রুটে মেচেদার সিঙাড়া আর ভেজিটেবিল চপ খুব বিখ্যাত। তবে চন্দন ওগুলো খায় না। চপ বা সিঙাড়া পাঁশকুড়ার একটা দোকানে তৈরি হয়। সেখান থেকে পাইকারি হারে কিনে সব হকার বিক্রি করে। তারা যেমন খুশি দাম নেয়। তিনটে চপের দাম অফিস টাইমে দশ টাকা। অন্য সময়ে ছ’টাকা। দিঘার ট্রেনে, যেখানে সবাই ট্যুরিস্ট, তিনটে চপের দাম হয়ে যায় পনেরো টাকা।
ঘুম ভাঙার পরে চন্দনের মনে পড়ল, সে এতক্ষণ একটা স্বপ্ন দেখছিল। ওড়নার মতো হালকা, কুয়াশার মতো ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নটি স্কুলপড়ুয়াদের কলকলানিতে ভেঙে গেছে। মিষ্টি ব্যথার মতো সেটা বুকের বাঁদিকে তপতপ করছে।
এক ফোঁটা রক্ত! চাঁপার কলির মতো একটি তর্জনী। নরম একটা হাত। চোখের হালকা ইশারা। একটা মেয়ে। তার দু’গালে টোল।
বৃন্দা ব্যানার্জি।
মেচেদা স্টেশনের ফ্লাইওভার দিয়ে দৌড়ানোর সময় চন্দন দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে রাখল। ‘কাল হো না হো’ সিনেমায় ‘হর ঘড়ি বদল রহি হ্যায় রূপ জিন্দেগি’ গানটা গাইবার সময় শাহরুখ খান এই কায়দায় দৌড়েছিল। তবে শাহরুখের জন্য ম্যানহাটানের রাস্তা আছে, মনীশ মলহোত্রর বানানো ডিজাইনার পোশাক আছে, সোনু নিগমের মখমলি গলা আছে। চন্দনের কিসসু নেই। বৃন্দার গালে প্রীতি জিন্টার মতো টোলের স্মৃতি ছাড়া।
সবজিউলির ধমকানিতে হুঁশে এল চন্দন। দৌড়তে দৌড়তে সে ফ্লাইওভারের সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাসস্ট্যান্ডে চলে এসেছে। আর একটু হলেই রাস্তায় সাজানো পাতিলেবুর ডালা উলটে দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি সবজিউলির কাছে ক্ষমা চেয়ে তড়াক করে নতুনগ্রামের বাসে উঠে জানলার ধারে বসে। পৌঁছতে আধঘন্টা লাগবে। পকেট থেকে মোবাইল বার করে নন্দনকে ফোন করে। দাদাকে বলে দেওয়া যাক যে দুপুরে বাড়ি ফিরে ভাত খাবে।
‘বল।’ ভারী গলায় ওপার থেকে বলে নন্দন।
‘আমি দুপুরে খাব। মাকে বলে দে।’
‘আগে বলিসনি কেন? আড়াইটের সময় ভাত থাকে?’
‘ঠিক আছে। আমি হোটেলে খেয়ে বাড়ি ঢুকছি।’
‘পাকামি না করে বাড়ি আয়।’ নন্দন ফোন কেটে দিয়েছে। চন্দন জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। হুহু করে পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক জনপদ। বুড়ারি, কাঁকটিয়া, ডিমারি, রত্নালি, মানিকতলা। ধানখেত, কাঁচাবাড়ি, পাকাবাড়ি, দোকানপাট, গরু-ছাগল চলে যাচ্ছে পিছন পানে। কলকাতা শহর মুছে যাচ্ছে। চন্দন সরকার ফিরে আসছে পুরনো ঠিকানায়। নতুনগ্রামে। সঙ্গে নিয়ে আসছে একজনের চোখের ইশারা, গালের টোল, চুলের উড়ে যাওয়া।
‘নতুনগাঁ, নতুনগাঁ…’ হাঁক পাড়ছে কন্ডাক্টর। বৃন্দার কথা ভাবতে ভাবতে ভাড়া দিতে ভুলে গিয়েছিল চন্দন। বাস থেকে নামার সময় কন্ডাক্টারের হাতে পাঁচ টাকা গুঁজে দিয়ে নেমে যায়।
পাঁশকুড়ার সিঙাড়ার মতো এই রুটের বাসভাড়াও চন্দনের আগ্রহের বিষয়। মেচেদা থেকে নতুনগাঁ, এই পনেরো কিলোমিটার দূরত্বের জন্য অন্তত তিন রকমের ভাড়া আছে। কন্ডাক্টর প্যাসেঞ্জারের কাছে ভাড়া চাওয়ার পরে, প্যাসেঞ্জার যদি বলে ‘ছ’টাকা’, তাহলে কন্ডাক্টার বুঝে যায় যে এ ডেলি প্যাসেঞ্জার। তার কাছ থেকে ছ’টাকাই নেয়। যদি প্যাসেঞ্জার বলে ‘নতুনগাঁ’, তাহলে কন্ডাক্টার বুঝতে পারে, এ নতুন যাত্রী। তার কাছ থেকে আট টাকা নেয়। যদি কোনও প্যাসেঞ্জার বলে ‘স্টুডেন্ট’, তাহলে কনসেশন করে তার কাছ থেকে পাঁচ টাকা নেয়। চন্দনের মতো স্কুলড্রেসহীন কলেজ ছাত্ররা পুরনো অভ্যাসবশত পাঁচ টাকা ধরালে কন্ডাক্টর আইকার্ড দেখতে চায়। তখন একপ্রস্ত ঝগড়া হয়।
চন্দন ঝগড়ার সুযোগ দিল না। কন্ডাক্টরের হাতে টাকা গুঁজে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে সে। এক সপ্তাহ বাদে বাড়ি ফিরতে পেরে মনটা খুশি খুশি লাগছে। বিজয় মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে ‘দ্য গ্রেট অলিম্পিক সার্কাস’ এসেছে। সার্কাসের তিনজন বামন রাস্তার ধারে গাছের গুঁড়ির ওপরে বসে রোদ পোয়াচ্ছিল। তাদের মধ্যে থেকে একজন তড়াক করে লাফিয়ে চন্দনের কাছে এসে বলল, ‘বেশি পাকা হয়েছিস, না? হোটেলে ভাত খেয়ে বাড়ি ঢুকবি? মা তোর কথা শুনে খুব খচে আছে!’
নন্দনের কথা শুনে ফিক করে হেসে চন্দন বলে, ‘ঝামেলাটা তো তুই শুরু করলি দাদা!’
বিজয় মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডের উল্টোদিকের সরু রাস্তা ধরে দুই ভাই। অল্প একটু রাস্তা হেঁটে দুজনে আবাসবাড়ি ঢুকল।
শনিবারে হাওড়া কোর্টে ছুটি। পবন বেরোননি। বাড়িতে বসে বেলাকূল পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যা নিয়ে মিটিং করছেন সম্পাদক গোপাল নস্করের সঙ্গে।
পবন বলছেন, ‘দেখো গোপাল, সামনেই পুজো। এই সময় রাজনৈতিক কচকচি কম করা উচিৎ। মানুষ এই সময় ফিল গুড ফ্যাক্টর চায়। একটু নস্ট্যালজিয়া, একটু খাওয়া দাওয়া, একটু বেড়ানো-এইসব। আগামী সংখ্যায় ”পুজোর বেড়ানো”, ”পুজোর সিনেমা”, ”স্বর্ণযুগের বাংলা গান”-এই রকম কতগুলো আর্টিকল থাক। সঙ্গে ছবি। কাশফুল, শিউলি গাছ, দুর্গার কাঠামো। ইস্যু হিট হতে বাধ্য।’
গোপাল বললেন, ‘ভাই পবন, তুমিও সাম্রাজ্যবাদী ফরমুলার শিকার হলে?’
‘এর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ কোথায় দাদা? পুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। বেলাকূল সেটা সেলিব্রেট করবে না?’
‘বাঙালি নয়, বলো হিন্দু বাঙালি। দুর্গাপুজো মুসলমানদের উৎসব নয়।’ আপত্তি করেন গোপাল।
‘আচ্ছা তাই সই। হিন্দু বাঙালির উৎসব। কিন্তু সেটা উদযাপন করতে অসুবিধে কোথায়? আমরা তো ইদ সংখ্যাও বার করি।’
‘দুটোই ট্র্যাপ। দেশের একটা বড় অংশের মানুষ খেতে পাচ্ছে না। তাদের বাসস্থান নেই। পানীয় জল নেই। ইস্কুল নেই। অসুখ হলে ডাক্তার নেই। তা নিয়ে স্টেটের কোনও মাথাব্যথা নেই। তারা জমিবাড়ির দালালি করছে। বহুজাতিক কোম্পানিকে জমি সরবরাহ করা কি সরকারের কাজ? একচেটিয়া পুঁজিপতির পোষা কুত্তা হয়ে সন্দীপ সামন্ত ঘেউঘেউ করে কৃষকদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করে বলছে, এর নাম শিল্পায়ন। এই বিষয়টা নিয়ে আমি একটা বড় লেখা লিখব। খুকুগদ্যে মা-মাসিদের জন্য এলোমেলো ড্রামা তুমি লেখো।’
দুই বন্ধুর ঝগড়ায় কান না দিয়ে চন্দন নিজের ঘরে ঢোকে। সেখানে ভাতের থালা নিয়ে অপেক্ষা করছেন পারুল। পাশে এক মাঝবয়সি মহিলা। একে চন্দন আগে কখনও দেখেনি।
‘বাবাঃ! কলকাতার জল খেয়ে কী ঝোড়োকাকের মতো চেহারা হয়েছে তোর?’ মৃদু বকুনি দিলেন পারুল।
‘ভ্যাট!’ লজ্জা লজ্জা মুখ করে ব্যাকপ্যাক খাটের ওপরে ফেলে চন্দন বলে, ‘আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। খেয়েদেয়ে ঘুমোব।’
‘আগে দিদিকে প্রণাম কর। তারপর হাত-পা ধুবি।’ মহিলার পায়ের দিকে ইশারা করেন পারুল। চন্দন ঢক করে একটা পেন্নাম ঠুকে দেয়।
‘এমা বৌদি! একি করলে?’ মহিলা আঁতকে উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘আমি সিস্টার। চন্দন দুদিন বাদে ডাক্তার হবে। ওর স্থান আমার অনেক ওপরে!’
‘যখন হবে, তখন হবে। তুই চুপ কর তো তাপসী!’ মহিলাকে ধমক দিলেন পারুল। চন্দন কলতলায় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে চলে এসেছে। জামাকাপড় পরে ছাড়া যাবে। আপাতত ভাত খাওয়া যাক। পেটে ছুঁচোয় ডন বৈঠক দিচ্ছে।
মুসুর ডাল আর পোস্তবাটা দিয়ে ভাত মাখছে চন্দন। পারুল বললেন, ‘কাকে প্রণাম করলি জানিস?’
‘না!’ মুখে এক গ্রাস ভাত চালান করে চন্দন।
‘তাপসীদি গোপালদার ছোটবোন। ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল। বর মারা যায়। এখন কলকাতায় থাকে। কোন একটা নার্সিংহোমের হেড নার্স। মাসে একবার বাড়ি আসে। আমাদের বাড়ি আগে কখনও আসেনি। তাই চিনিস না।’ গড়গড় করে বলেন পারুল।
‘হেড নার্স নয়। মেট্রন।’ পারুলকে সংশোধন করে তাপসী। ‘আজকে তোমার বাড়ি আসার একটা কারণ আছে। আমার দাদা যখন তোমাদের বাড়ি আসবে বলে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে, তখন পবনদার ফোন এসেছিল। পবনদার মুখে শুনলাম যে চন্দন বাড়ি আসছে। আমার বসের মেয়েও ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হয়েছে। ভাবলাম, যাই তার সহপাঠীর সঙ্গে আলাপ করে আসি। ফিরে গিয়ে বলব, ‘তুমি যার সঙ্গে পড়ো, সেই চন্দন আমার গাঁয়ের ছেলে। উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয়।”
‘কী নাম?’ ভাত খাওয়া শেষ করে পারুলের হাতে থালা ধরিয়ে জানতে চায় চন্দন। এখন একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু খাওয়া যাবে না।
‘বসের নাম সমীরণ ব্যানার্জি। উনি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের সার্জারির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। আর আমি যে নার্সিংহোমের মেট্রন, তার নাম শান্তিধাম।’
‘না না, আমি মেয়েটার কথা বলছি।’ হাতমুখ ধুতে ঘর থেকে বেরোচ্ছে চন্দন।
‘ওর নাম বৃন্দা ব্যানার্জি। ডল পুতুলের মতো দেখতে। হাসলে গালে প্রীতি জিন্টার মতো টোল পড়ে। চেনো? ওকে?’ জানতে চাইছে তাপসী।
মাথার মধ্যে সোনু নিগম গান ধরলেন, ‘হর ঘড়ি বদল রহি হ্যায় রূপ জিন্দেগি…’ ম্যানহাটানের ল্যান্ডস্কেপ পিছনে রেখে লাল গাউন পরা প্রীতি জিন্টা এক পাক নেচে নিল। তার গালে টোল। তার চোখে অজানা ইশারা। তার তর্জনীতে এক ফোঁটা রক্ত।
‘চিনিস রে?’ জানতে চাইছেন পারুল।
‘চিনি।’ ঘড়ঘড়ে গলায় জবাব দেয় চন্দন।
.
দময়ন্তী
‘ইউরিনের প্রোটিন দেখা হবে!’ উত্তেজিত হয়ে বলল অভি।
‘তো?’ নাক সিঁটকে বলল দময়ন্তী।
‘আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে।’
‘আমার একটুও লাগছে না। বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকালে এইসব নোংরামো হয় জানলে ক্লাসে আসতাম না।’
‘এসে যখন পড়েছিস, তখন পালাতে পারবি না। আরতি ম্যাডামের চোখ সিটিটিভির মতো। পলক পড়ে না।’ ফিশফিশ করে বলে অভি।
এএম ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে প্রস্রাবের বর্ণ, গন্ধ, পিএইচ, প্রোটিন ভ্যালু বোঝাচ্ছেন। আস্ত একটা চক শেষ করে ছাত্রছাত্রীদের দিকে ঘুরে বললেন, ‘তাহলে, টেস্ট করার জন্য কোন ইউরিন ব্যবহার করা হয়?’
‘আর্লি মর্নিং মিড-স্ট্রিম ইউরিন।’ হাত তুলে জবাব দিল চন্দন। অভি ফুট কাটল, ‘হাত তোলা অভ্যেসটা এখনও গেল না?’
‘এই, তোরা হ্যাহ্যাহিহি করিস না। তা হলে আমার পড়াতে অসুবিধে হবে।’ হাস্কি গলায় বললেন এএম। আজ তিনি পরে আছেন হালকা নীল রঙের তসরের শাড়ি। সারা শাড়ি জুড়ে গোলাপি আর সবুজ রঙের জিয়োমেট্রিক্যাল প্যাটার্নের আঁকিবুকি। সঙ্গে লাল সিল্কের পুরোহাতা ব্লাউজ। বাঁহাতে মোটা, নীল রঙের বালা। ছেলেরা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে না তাকিয়ে এএমের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাঁর করুণ আকুতিতে গোটা ক্লাস নিমেষে চুপ করে গেল।
‘শোন না, তোদের একটা কথা বলি।’ ফ্লোরাল প্রিন্টের রুমাল দিয়ে মুখ মুছে এএম বললেন, ‘আমার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ। পিরিয়ড ইররেগুলার হতে শুরু করেছে। সামনেই মেনোপজ। এই সময় ভীষণ মুড সুইং হয়। আমি হঠাৎ চ্যাঁচামিচি করলে তোরা কিছু মনে করিস না। পাশাপাশি এটাও ঠিক, তোরা আমাকে ইরিটেট করলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। তার দায় তোদের ওপরে বর্তাবে।’
দময়ন্তী আর একটু হলে হাততালি দিচ্ছিল। বখাটে স্টুডেন্টদের ম্যানেজ করার অনেকরকম কৌশল সে জানে। কিন্তু এইরকম অভিনব কৌশল কখনও শোনেনি। আশেপাশের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখল সে। মেয়েরা সিমপ্যাথেটিক মুখ করে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে। ছেলেদের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ বিস্ময়! দময়ন্তী বুঝে গেল, বোরিং প্র্যাকটিকাল ক্লাস করুক বা না করুক, এএমকে কেউ কখনও ডিস্টার্ব করবে না।
‘তোদের পিছনে একটা জেরিক্যানে ইউরিন রাখা আছে। মাইন্ড ইট, ওটা ইউরিন নয়। ডিসটিলড ওয়াটারে ডিমের সাদা অংশ মেশানো আছে। ইউ হ্যাভ টু ট্রিট ইট অ্যাজ ইউরিন। তোদের সামনে যে টেস্ট টিউব হোল্ডার আছে, তাই দিয়ে একটা টেস্ট টিউব ধরবি। পিপেট দিয়ে টেস্ট টিউবে দশ মিলিলিটার ইউরিন নিবি। বুনসেন বার্নারের ওপরে টেস্ট টিউব ধরে সামান্য গরম করবি। কী রেজাল্ট হল আমাকে জানাবি। ক্লিয়ার?’
কারও কিছু ক্লিয়ার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এএম দেখিয়ে দিলেন কীভাবে টেস্ট টিউব হোল্ডারে টিউব ধরতে হয়। সেটা প্র্যাকটিস করতে গিয়ে প্রথম ধাপেই বিপত্তি। দময়ন্তীর হাতের হোল্ডার ফসকে টিউব মেঝেতে পড়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল।
‘ইডিয়েট কোথাকার!’ নেকু নেকু গলায় বললেন এএম, ‘ভালো করে ধরতেও শিখিসনি।’
‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’ ভাঙা কাচ কুড়োনোর চেষ্টা না করে এএমের চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল দময়ন্তী। তার গলার স্বর কঠিন।
এএম দরদর করে ঘামছেন। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললেন, ‘আয়্যাম সরি। প্রিসিশনের অভাব দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।’
‘আপনি যদি মনে করেন, প্রথম চেষ্টাতেই আমি খুব ভালো ল্যাব টেকনিশিয়ান হয়ে যাব, তাহলে সেটা আপনার সমস্যা, আমার নয়। প্লাস, ‘ইডিয়েট’ কথাটা ক্লাসরুমে ব্যবহারের জন্য ঠিক নয়।’ দময়ন্তীর কণ্ঠস্বরের কাঠিন্য একটুও কমেনি। অভি পিছন থেকে তার কুর্তা ধরে টানছে। বলছে, ‘ওরে চেপে যা!’
‘আয়্যাম সরি!’ আবার বললেন এএম। দময়ন্তী কাজে ফিরল। পরীক্ষার বাকি ধাপগুলো তরতর করে উতরোল। টেস্ট টিউব গরম করার পরে দেখা গেল ইউরিনের একটা অংশ সাদা হয়ে জমে গেছে।
‘অ্যাজ ইন এগ অ্যালবুমিন।’ ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখছেন এএম। ‘ডিমের প্রোটিন অংশকে সেদ্ধ করলে জমে সাদা হয়ে যায়। ইটস আ ভেরি বেসিক টেস্ট টু ডিটেক্ট প্রোটিন ইন ইউরিন। বাই দ্য ওয়ে, নর্মালি ইউরিনে কোনও প্রোটিন থাকে না। কিডনির ছাঁকনি খারাপ হয়ে গেলে তবেই আসে।’
প্র্যাকটিকাল ক্লাসের বাকি অংশটা শক্ত টারমিনোলজি শুনে কেটে গেল। তিনটের সময় ক্লাস শেষ করে এএম প্র্যাকটিকাল ক্লাস থেকে বিদায় নিলেন।
অভি দময়ন্তীকে বলল, ‘তোর সাহস তো কম না! এইচওডি-র সঙ্গে ঝগড়া করলি? জানিস, উনি তোকে ফেল করিয়ে দিতে পারেন?’
‘দিতে পারেন আবার কী? অলরেডি দিয়েছেন।’ পাশ থেকে ফুট কাটে চন্দন।
চন্দনের কথায় পাত্তা না দিয়ে দময়ন্তী অভিকে বলল, ‘আমি কারও সঙ্গে ঝগড়া করিনি। উনি আমাকে ইডিয়েট বলেছেন। আমি তার প্রতিবাদ করেছি।’
বৃন্দাকে এতক্ষণ দেখা যায়নি। সে পিছনের সিটে বসেছিল। এএম ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে সামনে এসেছে। বলল, ‘এএম মেয়েদের একদম পছন্দ করেন না। লেফট অ্যান্ড রাইট ফেল করান। কিন্ত ছেলেদের সাতখুন মাফ। স্পেশালি সে যদি সুরজের মতো টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম মিস্টার আইএমসি হয়।’
প্রবাল পাশ থেকে বলল, ‘যারা কম্পিটিশানে নাম দিয়েছিল, তাদের জন্য কোনও স্টুডেন্ট কনসেশন নেই?’
‘যারা মিস্টার আইএমসিতে পার্টিসিপেট করেছিলি কিন্তু খেতাব পাসনি, তারা একসঙ্গে ওঁর ঘরে ডেপুটেশান দিতে পারিস। তুই, সবুজ, সঞ্জয় আর দীপ একসঙ্গে যা! উনি গ্রুপি পছন্দ করেন।’
‘ভ্যাট! খালি বাজে কথা!’ দময়ন্তী আপত্তি করে, ‘তুই ম্যাডামের সম্পর্কে এত কথা জানলি কোত্থেকে?’
এই প্রশ্নে বৃন্দা মিইয়ে যায়। বলে, ‘আমার চেনা একজন এখানে ডাক্তারি পড়ত। সে বলছিল যে কমিউনিটি মেডিসিনের বসের সঙ্গে আরতী ম্যাডামের কী সব চক্কর আছে।’
‘ম্যাডাম কিন্তু হেবি সেক্সি আছে।’ সুরজও আলোচনায় যোগদান করেছে, ‘পুরো ”ম্যায় হুঁ না” সিনেমার সুস্মিতা সেন। ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে গেলে এভরি হার্ট গো-জ ধকধক!’
‘সুস্মিতা সেনও কেমিস্ট্রির টিচার ছিলেন না? কী যেন নাম ছিল ক্যারেক্টারের?’ মনে করার চেষ্টা করছে প্রবাল।
‘চাঁদনি চোপড়া,’ পাশ থেকে লাইফলাইন দেয় সুরজ। বৃন্দাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ম্যাডাম কমিউনিটি মেডিসিনের স্যারের সঙ্গে ”মেক আউট” করেন—এটা সিয়োর?’
‘মেক আউট? সেটা আবার কী বস্তু?’ প্রবাল অবাক।
‘আররে ইয়ার! ”মেক আউট” মিনস ”ডু দে হ্যাভ সেক্স”? তোরা, বাঙালিরা তো ”সেক্স” ওয়ার্ডটা শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাস। তাই ”মেক আউট” বললাম।’ বিরক্তির সঙ্গে বলে সুরজ।
‘বাঙালিরা ”সেক্স” শব্দটা শুনলে অজ্ঞান হয়ে যায়? আর তোর মতো মুম্বাইয়ের ছেলেরা ”সেক্স” শব্দটা শুনলে কী করে? প্যান্ট নামিয়ে দেওয়াল ধরে দাঁড়ায়?’ চাবুকের মতো কথাগুলো বলল দময়ন্তী।
বৃন্দা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘অ্যাই সুরজ, ম্যাডাম কার সঙ্গে কী করেন তাই নিয়ে তোর কী? শুনলি তো, মেনোপজ হচ্ছে।’
সুরজের চোখ লাল। সে রাগী মুখে দময়ন্তীকে বলল, ‘আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে ভালো করলি না কিন্তু।’ তারপর বৃন্দাকে বলল, ‘আই লাভ সেক্স উইদ এজেড উইমেন। কোনও প্রবলেম আছে?’
সুরজের কথায় সবাই বিরক্ত। প্রবাল বলল, ‘বস, তুই ভুলভাল না বকে হোস্টেলে চল। আরেকবার দাবাংটা মেরে আসি। এলিটে চলছে।’
অভি বলল, ‘তুই মুম্বইয়ের ছেলে হয়ে এত ভালো বাংলা জানলি কী করে?’
সুরজের মেজাজ খানিকটা ঠান্ডা হয়েছে। সে অভিকে বলল, ‘আমার জন্ম কলকাতায়। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সেন্ট জেমসে পড়েছিলাম। বাবা মুম্বইতে ট্রান্সফার হয়ে গেল, তাই চলে গেলাম। চল প্রবাল, দাবাং মারকে আতা হ্যায়।’
অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং থেকে বেরোতে বেরোতে অভি দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোকে দেখে বারুদ বালিকা বলে মনে হয়।’
দময়ন্তী অভির কলার ধরে বলে, ‘এটা একটা কবিতার বইয়ের নাম না?’
অভি অবাক হয়ে দময়ন্তীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অবশেষে বলে, ‘দিল্লিওয়ালি বাংলা কবিতার খবর রাখে? ব্যাপারটা ঘেঁটে গেল বস!’
‘খবর রাখি না,’ শ্রাগ করে দময়ন্তী। ‘আমার মা-র বই পড়া বাতিক। এই বইটা বাড়িতে আছে। কার লেখা জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারব না। সিক্সটিজ বা সেভেনটিজের কোনও পোয়েট হবে। আয়্যাম নট সিওর।’
‘অমিতাভ দাশগুপ্ত।’ কবির নাম বলে দেয় অভি।
বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল ক্লাসের পরে আজ আর কিছু নেই। চন্দন, প্রবাল আর সুরজ হোস্টেলের দিকে চলে গেল। মেয়েরা গার্লস হোস্টেলের দিকে এগোচ্ছে। অভি-দময়ন্তীর-বৃন্দার মতো ডে-স্কলাররা বাড়ি যাবে। তিনজনে এজেসি বোস রোডের দিকে এগোয়। অভি যাবে শিয়ালদা স্টেশন। দময়ন্তী এন্টালি। বৃন্দা ধর্মতলা।
সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর সামনে বিলু তিনজনের রাস্তা আটকাল। অভিকে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘বাড়ি,’ আড়চোখে বৃন্দা আর দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় অভি। এই কলেজে এখনও কেউ জানে না যে বিলু তার দাদা। বিলুর সেইরকম অর্ডার ছিল।
‘তাড়াতাড়ি ফোট। ডানকুনি লোকাল আর দশ মিনিট পরে ছাড়বে।’ অভির মাথায় চাঁটি কষায় বিলু। বিলুর আচরণের মধ্যে সিনিয়র দাদাসুলভ আচরণের বাইরে অন্য কিছু একটা ছিল। দময়ন্তী বিলুকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কী করে জানলে ও কোথায় যাবে? তোমরা কি একই দিকে থাকো?’
বিলু ফচকে হেসে উত্তর দিল, ‘একই দিকে। ইনফ্যাক্ট একই বাড়িতে। ও আমার ভাই।’
‘ওমমা! তাই? হাউ সুইট!’ অভির চুল ঘেঁটে দেয় দময়ন্তী। অভি আর বৃন্দা কলেজ গেটের দিকে দৌড় লাগায়। বৃন্দা ধর্মতলাগামী ট্রামে উঠে পড়ে। তাকে টাটা করে অভি দৌড়োয় স্টেশানের দিকে। সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর সামনে এখন বিলু আর দময়ন্তী। দময়ন্তীর দিকে ফিরে বিলু বলে, ‘কফি খাবি?’
‘জীবনদার ক্যান্টিনে? নো ওয়ে!’
‘ওখানে না। সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর একতলায় একটা দোকান আছে। প্রতিবন্ধীরা চালায়। কফিটা খারাপ বানায় না।’
‘চলো।’ ক্যাজুয়ালি বলে দময়ন্তী। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
দোকানটার নাম ‘সঞ্জীবন’। চা, কফি, পেস্ট্রি, পাউরুটি, বিস্কুট, পোট্যাটো চিপস, মিনারেল ওয়াটার এইসব পাওয়া যায়। একটি মেয়ে হুইলচেয়ারে বসে সবকিছু সামলাচ্ছে। দশটাকা দিয়ে দু’কাপ কফি নিয়ে বিলু বলল, ‘চল। বাইরে গিয়ে দাঁড়ে বসি। একটু বাদে ভিজিটিং আওয়ার শুরু হবে। তখন পেশেন্ট পার্টির ভিড়ে এখানে টেকা যাবে না।’
‘দাঁড়? সেটা আবার কী?’ বিলুর হাত থেকে কাগজের কাপ নিয়ে সেন্টিনারি বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করল দময়ন্তী।
সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর সামনে যে রাস্তা, তার গা বরাবর ইটের তৈরি নিচু প্রাচীর। পাঁচিলের ওপাশে অতীতে বাগান করার চেষ্টা হয়েছিল। আপাতত সেখানে জঞ্জালের স্তূপ। পাঁচিলের ওপরে বসে বিলু বলল, ‘এইটা হল দাঁড়। আমাদের আড্ডার ঠেক। সন্ধে নাগাদ এখানে ভাটাতে আসি।’
‘ইন্টারেস্টিং!’ বিলুর পাশে বসে বলল দময়ন্তী।
‘কলকাতায় এসে কেমন লাগছে?’ কফিতে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে বিলু।
‘খুব ভালো। আমি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গা দেখেছি। লন্ডন, শান্তিনিকেতন, দিল্লি। আবুধাবি, মিশর, ইথিয়োপিয়া, ফ্রান্স। খুব বড়লোক, খুব গরিব, খুব অভিজাত, খুব ছোটলোক, ভীষণ মিডিওকার—সব রকম জায়গা দেখা। কিন্তু কলকাতা আলাদা। ভীষণ ওয়ার্ম একটা শহর। আর আমি হাফ বং! বাঙালিয়ানা বা কলকাতা বা পশ্চিমবাংলা নিয়ে সেন্টিমেন্ট থাকবেই। যদিও পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় সেটল করতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না।’
‘বিশ্বনাগরিক বলতে চাস নিজেকে?’
‘খুব ট্যাঁশ শোনালেও উত্তরটা হল, হ্যাঁ।’ দময়ন্তীর সোজাসাপটা উত্তর শুনে বিলু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। অবশেষে বলে, ‘এত জায়গা কীভাবে ঘুরলি? বাবা-মা কী করেন? নিজেকে হাফ-বং কেন বলছিস?’
‘পরের উত্তরটা আগে দিই?’ আর এক চুমুক কফি খেয়ে বলে দময়ন্তী, ‘আমার বাবা ব্রিটিশ। মা বাঙালি। এই কারণে আমি হাফ বং। আমার জন্ম লন্ডনে। আর, তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি, আমার বাবা পেইন্টার। মা জার্নালিস্ট। দু’জনেই পেশার কারণে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমি ল্যাংবোটের মতো পিছন পিছন যেতে বাধ্য হয়েছি।’
বিলু মাথা নিচু করে শুনছিল। বলল, ‘এখন তোর বাবা-মা কোথায়?’
‘কলকাতায়। র্যাদার এন্টালিতে।’ দক্ষিণ দিকে তর্জনী দেখায় দময়ন্তী। ‘দু’জনেই পাস্ট দেয়ার প্রাইম। মনে হচ্ছে কলকাতায় সেটল করল। ফাইনালি।’
‘আর তুই?’
‘আমিও এখানেই থিতু হতে চাই। দ্যাটস ফর শিওর। আসলে, এতদিন পর্যন্ত আমার কোনও কিছুর প্রতি মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হয়নি। ছোটবেলা থেকে বারবার বিভিন্ন জনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। বাবা-মায়ের ঠাঁই বদলের ফলে সেসব বন্ধুত্ব ভেঙে গেছে। তখন খুব কষ্ট হতো। রোজ কাঁদতাম। ইথিওপিয়ার হারুন নামে একটা ছেলের সঙ্গে অনেককাল পেনফ্রেন্ডশিপ রেখেছিলাম। হঠাৎ চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। আর কখনও কোনও খবর পাইনি। তখন বুঝেছিলাম যে, কোনও সম্পর্কই টেঁকে না। তাই পরে আর ওই রিস্ক নিতাম না। এখন নানা টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট হয়েছে। ইমেল, সোশাল নেটওয়র্ক, মোবাইল ফোন। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ মেনটেইন করা সহজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার ফিজিক্যালিটি লাগে। যাকে চাই, তাকে হাতের কাছে চাই। স্কাইপে বা জি-টকে নয়। বন্ধুত্ব ব্যাপারটা আমার কাছে জরুরি।’
‘আর কমিটমেন্ট?’
‘কমিটমেন্ট ইজ টু বিগ আ ওয়ার্ড। আমি এখন ওসব নিয়ে ভাবতে চাই না। কলেজে ভরতি হয়েছি। পড়াশুনা করব, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারব, মজা করব, ডিগ্রি নেব! আপাতত এইটুকুই প্ল্যান। নট আ পেনি মোর, নট আ পেনি লেস।’
‘রাজনীতিতে আগ্রহ নেই?’
‘আঃহা! কামিং টু দ্য পয়েন্ট।’ হাহা করে হাসছে দময়ন্তী। ‘ফিশিং ফর নিউ রিক্রুট ফর ইয়োর পার্টি? কী যেন নাম তোমার দলের? প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম। তাই না? ইউ আর অ্যাপ্রোচিং রং পার্সন বিলুদা!’
‘আমি বলেছি যে তোকে রিক্রুট করতে চাই? আমি জাস্ট জিজ্ঞাসা করেছি যে তোর রাজনীতিতে আগ্রহ আছে কি না?’ বিরক্ত হয়ে বলে বিলু।
‘আছে। মোস্ট প্রোব্যাবলি তোমার থেকে বেশি আছে। কারণ আমার মা একজন জার্নো। অ্যান্ড হার ফিল্ড অব স্পেশালাইজেশন ইজ ন্যাশনাল পলিটিকস উইদ আ ফোকাস অন বেঙ্গল। বাড়িতে দিনরাত রাজনীতির চর্চা হয়।’
‘রিয়্যালি?’ ফিকফিক করে হাসছে বিলু। ‘রাজনীতিতে আগ্রহ আছে কিন্তু মানুষে আগ্রহ নেই। এটা হিপোক্রিসি হয়ে গেল না?’
‘হল না। তুমি জানতে চেয়েছ আমার রাজনীতিতে আগ্রহ আছে কি না। আমি সেই প্রশ্নের উত্তরে ”হ্যাঁ” বলেছি। তুমি যদি জানতে চাইতে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে আমার আগ্রহ আছে কি না, তাহলে বলতাম, ”না”। আমি নিজেকে অ্যাকডেমিশিয়ান অন পলিটিক্স বলেছি। পলিটিশিয়ান বলিনি।’
‘যাকে চালু কথায় ”আর্মচেয়ার পলিটিশিয়ান” বলা হয়।’ দাঁড় থেকে নেমে বলে বিলু।
‘অ্যাবসলিউডটলি রাইট।’ দাঁড় থেকে দময়ন্তী নেমেছে। জিনসের পিছন ঝেড়ে সে বলে, ‘থ্যাংকস ফর দ্য কফি। বাই।’
‘উঠল বাই তো কটক যাই। দাঁড়া, অত বাই বলতে হবে না। তোর কোনও ডাক নাম নেই? দময়ন্তী নামটা খুব বড়। উচ্চারণ করতে দাঁত ভেঙে যায়।’
‘উচ্চারণ কোরো না। প্রোনাঙ্কচুয়েশান করো। তা হলেই ঝামেলা মিটে যায়,’ শ্রাগ করে দময়ন্তী, ‘বাঙালিদের উচ্চারণের ব্যাপারে খুব একটা সুনাম নেই। হিন্দি তো বলতে পারেই না, বাংলাটাও ভুল বলে।’
‘যেমন?’ জানতে চায় বিলু। দময়ন্তী বলে, ‘কেয়া হুয়া, হুক্কা হুয়া টাইপের হিন্দি বাদ দিচ্ছি। বাঙালি ”সম্মান”কে বলে ”সনমান”। ”প্রতিবাদ”কে বলে ”পতিবাদ”। ”লজ্জাজনক”কে বলে ”লজ্জাস্কর”। জঘন্য উচ্চারণ!’
‘তোর বাংলায় কিন্ত কোনও টান নেই।’
‘কেনই বা থাকবে? আমি ইংরিজিটাও শুদ্ধ বলি। বাংলাটাও। বাড়ির শিক্ষা। বাই দ্য ওয়ে, আমার ডাকনাম দিঠি।’
‘বাহ! শর্ট অ্যান্ড সুইট। দিঠি, তোর বাবা পেইন্টার বললি না? কী নাম ওঁর?’
‘ড্যানিয়েল আর্চার। এবার আমি কাটছি।’ এজেসি বোস রোডের দিকে এগোয় দময়ন্তী। তার হাত চেপে ধরে বিলু বলে, ‘ড্যানিয়েল আর্চার মানে দিল্লি ডিকনস্ট্রাকটেড আরগোয়া নাগেটস সিরিজ যাঁর আঁকা? যাঁর স্ত্রী শক্তিরূপা সেনগুপ্ত উইকেন্ড-এর এডিটর?’
‘হ্যাঁ বাবা, হ্যাঁ। তুমি দেখছি আমার বাবা-মায়ের ব্যাপারে আমার থেকে বেশি জানো।’ হাসতে হাসতে বলে দময়ন্তী।
‘এতক্ষণে বোঝা গেল কেন তুই বিশ্বনাগরিক, কেন তুই কমিটমেন্ট ফোবিক, কেন তুই আর্মচেয়ার পলিটিশিয়ান!’ বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়ে বিলু, ‘ঠিক আছে দিঠি। কাল দেখা হবে। বাই।’
‘উঠল বাই তো কটক যাই!’ বিলুকে জিভ ভেঙিয়ে এজেসি বোস রোডের ভিড়ে মিলিয়ে গেছে দময়ন্তী।
বিলু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, ‘দিঠি! চমৎকার নাম!’ তারপর হোস্টেলের দিকে এগোয়। এই মেয়েটাকে সে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। মেডিক্যাল কলেজে ট্যাঁশ মেয়ে কম দেখেনি সে। কিন্তু এ যেন সবার থেকে আলাদা। নিজের শিকড়ে ভীষণ গ্রাউন্ডেড। একই সঙ্গে ভীষণ আন্তর্জাতিক। হয় তো এরকম মেয়ে অনেক আছে। বিলুর দেখার জগৎ ছোট বলে এরকম মনে হচ্ছে। যাই হোক না কেন, মেয়েটার প্রতি বিলু একটা টান অনুভব করছে। প্রেমফ্রেম নয়, জাস্ট টান। মেয়েটাকে সংগঠনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এই কলেজের পিএমএফের তিন-চারটে মেয়ে আছে। মহিলা সদস্যের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।
সংগঠনের কথা ভাবতে ভাবতে বিলুর মাথা থেকে দয়মন্তীর চিন্তা উধাও। মনে পড়ে গেল, স্টেট লেভেলের লিডারদের সঙ্গে আজ মেডিক্যাল স্কোয়াডের একটা মিটিং আছে কালিঘাট থানার পাশে এক কমরেডের বাড়িতে। সব্যসাচী খবরটা দিয়েছে। স্টেট লিডারদের সঙ্গে কখনও মিটিং করেনি বিলু। রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ দিকে গড়াচ্ছে। গত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করার পরে সন্দীপ সামন্তর ঔদ্ধত্য বেড়ে গেছে। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে সদম্ভে বলেছেন, ‘আমরা দুশোটা আসন পেয়েছি। ওরা তিরিশটা আসন পেয়েছে। এখন ওরা চুপ করে পনেরো বছর বসে থাক। আমাদের কাজ করতে দিক।’ হিটলারের সঙ্গে কোনও তফাৎ নেই লোকটার।
নতুনগ্রামে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্টেট কমিটির মিটিঙে প্রচণ্ড মতবিরোধ হয়েছিল। এটাও সব্যসাচীর মুখে শুনেছে বিলু। দলের একাংশ এই সরকারকে আরও একটা টার্ম সময় দিতে চাইছে। হাজার হোক, এরাই একদিন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিল। জমিহীন কৃষকদের মধ্যে পাট্টা বিলি করেছিল। দলের অন্য অংশের বক্তব্য, অতীত ধুয়ে জল খেয়ে লাভ নেই। সন্দীপ সামন্ত এখন দেশি এবং বিদেশি পুঁজিপতির দালাল। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এইসব করছেন। অবিলম্বে জনমোর্চাকে গদিচ্যুত করতে হবে। তার জন্য যদি দক্ষিণপন্থী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, তাই সই। পকেট থেকে সিগারেট বার করে দাঁড়ে ঝোলানো জ্বলন্ত দড়ি থেকে ধরিয়ে, গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে হোস্টেলের দিকে এগোলো বিলু। সন্ধের মিটিংয়ে জানা যাবে, স্কোয়াডের বক্তব্য কী।
.
জোড়াগির্জা, মিশনারিজ অব চ্যারিটি, প্র্যাট মেমোরিয়াল, সেন্ট জেমস স্কুল— সব মিলিয়ে এন্টালির এই চত্বরটায় বেশ সাহেব সাহেব গন্ধ আছে। মায় আয়কর দফতরের নামও ‘ব্যাম্বু ভিলা’। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান—সব রকম মানুষজনের বসবাস। লেদার এক্সপোর্টকারী কোটিপতি থেকে চামড়ার কারখানার দিনমজুর, ড্রাগ পাচারকারী থেকে ড্রাগখোর, মাসাজ পার্লারের মেয়েলি ছেলে থেকে এসকর্ট এজেন্সির ডবকা ছুঁড়ি, মাংসের দোকানের শিশু কসাই থেকে সুপারি কিলার, চার্চের ফাদার থেকে হজ ফেরত মৌলবি—সবাই গায়ে গা লাগিয়ে ঘুরঘুর করে। কোটি টাকার এসইউভি আর রিকশা, তারকাটা ট্রাম আর ব্রেককাটা অটো, ঠেলা আর তিনশো সিসির বাইক পরস্পরের পাশে আরামসে দাঁড়িয়ে থাকে। এলাকাটা বেশ পছন্দ দময়ন্তীর।
আরও পছন্দ গোলমহল। একতলাটা, ড্যানিয়েলের ভাষায়, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। কাঁসা-পেতলের বাসনের দোকান, দেওয়ালের ফুটোয় গজিয়ে ওঠা মোবাইল রিপেয়ারিং শপ, ফোটোকপি-ল্যামিনেশন-স্পাইরাল বাইন্ডিং-ডিটিপির ঝাঁ চকচকে অফিস, শ্যাম্পু-কন্ডিশনার-জেল-মুসের খালি কৌটো দিয়ে উইন্ডো সাজানো বিউটি পার্লার—এইসব পেরিয়ে ঘুপচি, ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেই সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ। পাথরের দেওয়াল, মার্বেলের মেঝে, ঝরোখার ফুটো দিয়ে আসা রোদ্দুরের বল্লম, পায়রার বকম বকম। বাইরের শব্দ ও দৃশ্যদূষণ ভিতরে পৌঁছয় না।
দোতলার দখল নিয়েছেন শক্তিরূপা আর ড্যানিয়েল। তিনতলাটা দময়ন্তীর। সংবাদ সাপ্তাহিকের সম্পাদকের বসার ঘর যেমন হওয়া উচিৎ, দময়ন্তীর স্টাডি রুম অবিকল সেরকম। বিশাল বড় ঘরের দেওয়াল জোড়া লম্বা বুকশেলফ বইয়ে ঠাসা। মেহগনি কাঠের মস্ত টেবিল কাগজপত্র আর ফাইলের স্তূপ। ডেস্কটপ কম্পিউটার সব সময় কুঁককুঁক শব্দ করছে। টেবিলের অন্যপ্রান্তে গোটাদশেক চেয়ার। বোঝা যায় এই বাড়িতে একসঙ্গে অনেক অতিথি আসেন।
স্টাডি আপাতত খালি। কিন্তু মেশিন চালু রয়েছে। অর্থাৎ শক্তিরূপা বাড়িতে। অবাক হল দময়ন্তী। সদ্য সম্পাদকের দায়িত্ব যিনি গ্রহণ করেছেন, তাঁর পক্ষে কাজের দিনে বিকেল চারটের সময় বাড়ি থাকা সম্ভব নয়!
শক্তিরূপা ও ড্যানিয়েলের শোবার ঘরটিও বিশাল বড়। ঘরের মাঝখানে গোটাকয়েক থাম আছে। এগুলো আগে ছিল না। ড্যানিয়েলের পরামর্শ মতো স্থপতি বানিয়ে দিয়েছেন। তাতে ঘরের রূপ খুলেছে। দেওয়ালে ঝুলছে ড্যানিয়েল এবং শক্তিরূপার সংগ্রহ করা সারা পৃথিবীর শিল্পকর্ম। ট্রাইবাল মুখোশ, পোড়ামাটি বা ধাতুর গয়না, চামড়ার বটুয়া এবং চাবুক, কাপড়ের স্ক্রল ও থাংকা, বিভিন্ন কেতার টুপি ও হাতপাখা, নানা আকৃতির ওয়াল হ্যাঙ্গিং আর উইন্ড চাইমে ঘরটি ঠাসা। শুধু ড্যানিয়েলের কোনও পেন্টিং নেই।
দোতলাতে আরও দুটো ঘর ছিল। আর্কিটেক্ট ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলে, মাঝের দেওয়াল ভেঙে সেটাকে একটা ঘরে বদলে দেওয়া হয়েছে। রাজস্থানি স্থাপত্যের জানলা ভেঙে বসানো হয়েছে শক্তপোক্ত কাচের উইনডো। আলোয় ভাসাভাসি এই ঘরটি ড্যানিয়েলের স্টুডিও। সারাদিন এই ঘরে কাটান তিনি। খেতে আর ঘুমোতে বাইরে বেরোন। রান্নাঘর আর খাবার ঘরও দোতলায়।
তিনতলায় একটিই ঘর। গোল, গম্বুজের মতো। ওঠার ব্যবস্থা বলতে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। আকারের কারণেই ঘরটির নাম হয়ে গেছে গোলঘর। দময়ন্তীর আস্তানা এই গোলঘর। শক্তিরূপা প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। ড্যানিয়েল মেয়ের পছন্দ সমর্থন করেছেন এবং ঘরটি সাজিয়ে দিয়েছেন। গোলঘরের মাঝখানে একটা গোল বিছানা। ছাদের হুক থেকে ঝুলছে মশারি। রাতে শোয়ার সময় দড়ি ধরে টানলে গোল মশারি নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গোলঘরের একদিকের পরিধি বরাবর বসার জায়গা। বেঁটে, চৌকো, গদিগুলো রাজস্থান থেকে আনা। পরিধির অন্যদিকে পড়ার টেবিল ও বই রাখার জায়গা। দামি, বিদেশি ব্র্যান্ডের ফারনিচার। হালকা, মজবুত, চূড়ান্ত ফাংশনাল, দুর্দান্ত স্টাইলিশ। গোলঘরে এ ছাড়া আছে একটা ইন্টারকম। এখানে এত হাওয়া বয় যে নিচ থেকে কেউ ডাকলে শোনা যায় না।
স্টাডি রুম থেকে স্টুডিওয় এসে ড্যানিয়েল এবং শক্তিরূপাকে দেখতে পেল দময়ন্তী। ড্যানিয়েল স্টুডিওর আর্মচেয়ারে বসে রয়েছেন। পরনে ঢোলা পাজামা আর বেনিয়ান। শক্তিরূপা মেঝেয় বসে রয়েছেন। পরনে এখনও অফিসের পোশাক, জিনস ও কুর্তি। গলা থেকে আইকার্ড পর্যন্ত খোলেননি। সাউন্ড সিস্টেম থেকে রবি ঠাকুরের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে—
‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি—
তবু মনে রেখো।’
স্টুডিওর দরজায় দাঁড়িয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আসব?’
‘আয়!’ রিমোট টিপে গান বন্ধ করে হাত নেড়ে মেয়েকে ডাকেন ড্যানিয়েল। ঘাড় ঘুরিয়ে শক্তিরূপাও বলেন, ‘আয়।’
‘তুমি আজ তাড়াতাড়ি চলে এলে?’ স্টুডিওর ঠান্ডা মেঝেতে পা দিয়ে প্রশ্ন করে দময়ন্তী।
‘কেন এলাম বল তো?’ মেয়ের দিকে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করেন শক্তিরূপা। অনেক ভেবেও দময়ন্তী কোনও কারণ খুঁজে পায় না। তাদের তিনজনের কারোর আজ জন্মদিন নয়। তা হলে তৃতীয় অনুমানটাই ঠিক। ড্যানিয়েল-শক্তিরূপা যে ভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসছেন, তাতে পরিষ্কার, দুজনের কাছেই আজকের দিনটা স্পেশাল।
‘আজ তোমাদের বিবাহবার্ষিকী?’ জিজ্ঞাসা করে দময়ন্তী।
‘হ্যাঁ,’ একগাল হেসে জবাব দিলেন ড্যানিয়েল। ‘আজ আমরা শ্যামদেশের সুখাদ্য চাখতে বাইরে যাব।’
‘উফ! তোমার এই বাংলা!’ ড্যানিয়েলের হাঁটুতে চিমটি কাটেন শক্তিরূপা। দময়ন্তী বলে, ‘থাই ফুড? তার তো খুব অদ্ভুত নাম হয়। ভাত মতো খাও। খাও ঘি ভাত। খাও শুয়ে। খাও ফটাফট।’
‘ভ্যাট!’ আপত্তি করেন শক্তিরূপা, ‘কলেজে ঢুকে এইসব উলটোপালটা কথা শিখেছিস।’
সুখী দম্পতিকে বিরক্ত না করে দময়ন্তী গোলঘরে চলে যায়। রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার আগে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।
.